ষষ্ঠ অধ্যায়
প্রসংগক্রমে ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের জীবনী সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা জরুরী মনে করছি। যাতে যেসব কার্যকরণ তাঁর মনে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল আর তিনি তাঁর মহান উদ্দেশ্য অর্জনের কাজ শুরু করেছিলেন তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি। এ ক্ষেত্রে আমরা এও দেখতে পাবো যে, এ কাজের সূচনা কিভাবে হয়েছিল।
হাসানুল বান্না ১৯০৭ সালে মাহ্মুদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। এটা ছিল আল্ বুহাইরা প্রদেশের অন্তর্গত একটা শহর। এ শহরটি ছিল কায়রোর তুলনায় আলেকজান্দ্রিয়ার নিকটবর্তী। ইমাম যেই গৃহে ভূমিষ্ট হন তা ছিল দ্বীনি পরিবেশে ধন্য। তা৭র পিতা মুহ্তারাম শাইখ আহমদ আবদুর রহমান আল বান্না ছিলেন একজন আলেম ও সুফী লোক। তিনি হাদীস শাস্ত্রের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছি লেন। এবং হাদীসের ওপর তার বেশ কিছু সংকলন গ্রন্থও রয়েছে। তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ ছিল ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র)-এর মাসনাদ-এর শরাহ যা “আল ফাতহুর রাব্বানী” নামে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। নিসন্দেহে এটা একটা মূল্যবান ও বৃহদায়তন গ্রন্থ। কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সম্পর্কিত উলামা ও শিক্ষার্থীদের জন্য এই গ্রন্থখানা খুবই উপকারী ও সহায়ক।
এমন রূহানী ও পবিত্র পরিবেশে আমাদের ইমাম জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষিত পরিবারের আদরের দুলাল হওয়া সত্ত্বেও তিনি গ্রন্থ রচনার দিকে বেশী মনোযোগ দেননি। বরং তিনি গ্রন্থের পরিবর্তে মানুষ রচনায় আত্মনিয়োগ করেন এবং অগণিত মর্দে মুজাহিদ তৈরীর কঠিন দায়িত্ব পালনের প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়েন। ছোট বেলা থেকেই তার দৃষ্টি বাস্তব কাজের দিকে ছিল বেশী। প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়েই তিনি তার সহপাঠিদের সাথে নিয়ে একটা সংগঠনের ভিত্তি রচনা করেন এবং তার নাম রাখেন “জমিয়তুল আখলাকিল আদাবিয়া।” এই সংগঠনের নামকরণ ও তার প্রতিষ্ঠা থেকেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও সূক্ষ্মদর্শী।
কচিকাঁচাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা
তিনি ছিলেন খুবই মার্জিত চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী। খুব সহজেই সবার সাথে মিশতে এবং তাদের মন জয় করে নিতে পারতেন। আমি তার চেহারায় কখনো বিষণ্ণতার ছাপ দেখিনি। কোন সময় কারো কথার মধ্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করতেন না এবং জোরপূর্বকক নিজের কথা কারো ওপর চাপিয়ে দিতেন না। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই শিষ্টাচার, শালীনতা ও সৌজন্যবোধের পরিচয় দিতেন। মসমস্যা যত বড় কিংবা ছোটই হোক না কেন কিছুতেই তিনি ভেংগে পড়তেন না। আব্বাসীয়া এলাকায় ছিল মুহাম্মাদীয়া প্রাইমারী স্কুল। একবার আমি ইমামের সাথে সেই স্কুলে গিয়েছিলাম। সেখানে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ইমামের বক্তব্য পেশ করার কথা ছিল। সেখানে পৌঁছে আমাকে বলতে লাগলেন “ছাত্রদের কিছু বলো।” আমি বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাতে লাগলাম েএবং বললাম, “এই কচি কিশোরদের সম্মুখে বক্তৃতা দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই। আমি জজ ও উকীলদের সামনে ভাষণ দিয়ে অভ্যস্ত। (বাচ্চাদের উপযোগী বক্তৃতা দানে আমি কি করে সফলতা লাভ করতে পারবো।)”
আমার কথা শুনে অত্যন্ত মিষ্টি হাসি হাসলেন এবং বললেন, “আচ্ছা বাদ দাও।” তারপর ক্লাস রুমের জানালার পার্শ্বে যেখানে উস্তাদের চেয়ার ও টেবিল রাখা ছিল এবং দেয়ালের সাথে ব্লাক বোর্ড লাগানো ছিল সেখান দিয়ে নীচে নামলেন এবং ছাত্রদরে মাঝে গিয়ে দাঁড়ালেন। যখন তাদের সাথে কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন তখন মনে হলো যেন তিনি তাদেরই সমবয়স্ক ও সহপাঠি। বাচ্চাদেরই ভাষায় যা তারা সহজেই বুঝতে পারে এবং একানত্ভাবে তাদেরই ভাব-ভংগীতেই- যাতে তারা অভ্যস্ত ছিল তিনি বক্তৃতা দিতে লাগলেন। মাশাআল্লাহ কি হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য। যখন তিনি তার ভাষণ সমাপ্ত করলেন আমি তখন বিস্ময়ের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে গেলাম। শিশুরা তার চার পার্শ্বে এসে সমবেত হলো। তার প্রতি কচিকাঁচাদের অনুরাগ ও আসক্তি দেখে মনে হচ্ছিলো যে, তারা তাঁর সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। এই সময় ইমামের কণ্ঠস্বর ছিল স্নেহ ভরা। বাচ্চাদের শিশুসুলভ আচরণকে উপেক্ষা করে নিজের উন্নত চরিত্র মাধুর্য এবং শিষ্ঠাচার শালীনতার পুরোপুরি প্রদর্শনী করেছিলেন। (এরূপ আচরণই বাচ্চাদের পোষ মানিয়ে নিতে সাহায্র করেছিল।)
(হাঁ আসি ইমামের জীবন সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম) তিনি জমিয়াতুল আখলঅক-এর পর “জমিয়াতুল মনয়িল মুহাররামাত” (হারাম কাজ প্রতিরোধ সংস্থা) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের নামই এর মহৎ উদ্দেশ্যের দিকে অংগুলি নির্দেশ করে। নেশাকর সামগ্রীর ব্যাপক প্রসার হয়ে গিয়েছিল। গ্রীক এবং ইটালীয়ানরা ব্যাপক হারে মিসরে এসে বসবাস করছিল। তারা মিসরের বস্তিতে বস্তিতে পর্যন্ত শরাবখানা খুলে বসেছিল। তারা অত্যন্ত মামুলিভাবে উম্মুল খাবায়েছ বা মাদক দ্রব্যের কারবার শুরু করতো এবং রাতারাতি ধন কুবেরে পরিণত হতো। এমন কি নেশাতে অভ্যস্ত কৃষকরেদ অধিকাংশ ভূ-সম্পত্তির ওপর তারা দখল জমিয়ে বসতো। যদি এমনিতেই তাদের কারবার জমে না উঠতো তাহলে তারা তাদের দেগশীয় পেশাদার সুন্দরী গায়িকা ও নর্তকীদের ব্যবহার করতো আর এভাবে মিসরের সরলপ্রাণ কৃষককূল তাদের জালে জড়িয়ে পড়তো।
মুর্শিদ মুহতারাম (তার যৌবনকালেই) এটা উপলব্ধি করেছিলেন য, কৃষকগণকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য (যে ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ অনবহিত কিন্তু যা অত্যন্ত চতুরতার সাথে তাদের প্রতারক শত্রুগণ তৈরী করে রেখেছে) সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হবে ইনসদিাদে মুহাররমাত বা নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতিরোধ। এই অপকর্মর মোকাবিলা করার জন্য তিনি তাঁর যৌবনের উন্মেষের সময়ই “তরীকায়ে হিসাফিয়ার” মাশায়েখগণের সাথেও সম্পর্ক গড়ে তোলেন। নিসন্দেহে এই আধ্যাত্মিক অনুরাগ তার আত্মার পবিত্রতার প্রতি ইংগিত দান করে এবং এই সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যে আল্লাহ এই আত্মা সৃষ্টি করেছেন এবং তাকওয়ার তাওফিক দিয়েছেন সেই মহান সৃষ্টিকর্তার সাথে তার সম্পর্ক কতইনা গভীর।
আমার মতে প্রকৃত সুফী-সাধকগণ ঈমানের শীর্ষে উন্নীত হয়ে থাকেন। তারা দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন না। কিন্তু তার অপবিত্রতা ও কদর্যতা থেকে আত্মরক্ষা করে চলেন। আখিরাতের আকাংখায় সদা কর্মমুখর ও প্রাণচঞ্চল থাকেন আবার দুনিয়া আবাদ করার ব্যাপারেও উদাসীন থাকেন না। কারণ এই দুনিয়াই পরকালের শস্যক্ষেত্র। সেখানে আমরা সেই ফসলই কর্তন করবো যা এখানে বপন করবো।
তাসাউফ আল্লাহর ভীতির নাম। আর সুফী-সাধকগণ আল্লাহকে ভয় করেন। সৃষ্টির প্রতি ভয় ভীতির কোন আকীদা বিশ্বাস তারা পোষণ করেন না। তারা মনে করেন আমাদের ওপর যেসব বিপদ-মুসিবত আপতিত হওয়ার কোন অবস্থায়ই তার পরিবর্তন হতে পারে না। আবার যে মুসিবত থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করবেন তা কেউ আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারবেন না। সবকিচু আল্লাহ তায়ালার ওপর সোপর্দ করে দেয়ার নাম তাসাউফ। কোন মানুষকে ভয় করে চ লতে হবে কেন সে তো নিজর লাভ-লোকসানের অধিকারীও নয়। যতদিন পর্যন্ত একজন সালেক আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে নিজেকে পাক-পবিত্র রাখে ও আত্মার পবিত্রতার প্রতি সদা সতর্ক থাকে। মানুষের কাছে যা কিছু আছে তার প্রতি মুখাপেক্ষী না হয়ে আল্লাহ তায়ালার কাছে যা আছে তার ওপর সন্তুষ্ট থাকে (সে-ই প্রকৃত সুফী)। তাসাউফ একাধারে তাকওয়া, নির্ভিকতা, নেকীর কাজে অগ্রণী হওয়া এবং ইখলামেসর বিভিন্ন স্তরে ঈমানের শ্রেষা্ঠত্বের পরিচয়ের নাম। ঢাক ঢোল বাজানো, পতাকা উড়নো ও নজর নিয়াজ মানার সাথে তাসাউফের কোন সম্পর্ক নেই। আমাদের মুর্শিদ এমনিভাবে সত্যিকার সুফীদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করিয়েছেন। যখন েইংরেজ সরকার তাঁকে অর্থ সম্পদের লোভ দেখিয়ে বলে যে, আপনি “গণতন্ত্রের” ওপর ভাষণ দিন। তিনি তৎক্ষণাৎ তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবংবলেন, যেটা আমি বুঝ সেটাই গণতন্ত্র, না তোমাদের কাছে যা আছে সেটাই গণতন্ত্র?
ইংরেজরা বললো: আপনি জানেন যে, আমরা এখন (নাৎসীর বিরুদ্ধে) যুদ্ধে লিপ্ত। এ সময় প্রচারের ক্ষেত্রে আমাদের আপনার মত ব্যক্তিত্বের দরকার। একথা শুনে তিনি মুখ ফিরিয়ে নেন এবং নিজের দাওয়াতী কাজে মনোনিবেশ করেন। এতে মিসরের তৎকালীন শাসক তাকে হুমকি দেন কিন্তু তিনি এই ভয়-ভীতির কোন তোয়াক্কাই করেননি। অধিকন্তু তাদের গাল-মন্দের জবাবে নসীহত ও হিতোপদেশ দান করতে থাকেন। আর যখন তাঁর ওপর বর্বরোচিত হামলা চলতে থাকে তখন তিনি তাঁর অবস্থানে অটল থাকেন। আল্লাহ তাঁর ওপর বর্বরোচিত হামলা চলতে থাকে তখন তিনি তাঁর অবস্থানে অটল থাকেন। আল্লাহ তাঁর জন্য সফলতা নির্ধারিত করে দেন। হাসানুল বান্না তার তাসাউফের সাহায্যে ১৯৫২ সালে বিপ্লবের পথ সুগম করেছিলেন। যদিও আজ পর্যন্ত আমাদের প্রতি ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপ করা হয়ে থাকে যে, আমরা বিপ্লণবের দুশমন।
পরিবর্তনের সূচনা
সরকার আযাদ সামরিক অফিসারদের (দিবাতে আহরার) কাউকে হত্যা করেননি। কারো বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেননি বা কাউকে কারাগারেও নিক্ষেপ করেননি। কিন্তু ইখওয়ানের বিরুদ্ধে ধরপাকড়ের অভিযান পরিচালিত হয়েছে। তাদেরকে জেলে পুরা হয়েছে এবং তাদের মুর্শিদে আ’মকে প্রতারণার সাহায্যে গুলী করে শহীদ করা হয়েছে। এটা হয়েছিল এ জন্য যে, ইখওয়ান খোলাখুলিভাবে তার কাজ করতো। কিন্তু আযাদ অফিসারগণ গোপনে তাদের তৎপরতা প্রদর্শনে নিয়োজিত ছিল। ইমাম শহীদ তাঁর নিজের নেতৃত্বে সর্বসাধারণের মন-মানসিকতা প্রস্তুত করেছিলেন। দেশবাসীর অন্তরে বিপ্লবের বীজ এমনভাবে বপন করেছিলেন য, তার ফলে জনগণ একটা আমুল পরিবর্তন ও সর্বাত্মক বিপ্লবের জন্য সদা প্রস্তুত ও প্রতীক্ষমান ছিল। ইত্যবসরে আবার যখন আযাদ সিপাহীগণ ইখওয়ানের সহোযোগিতায় তৎপর হন তখনও তারা জাতিকে তৈরী পেয়ে যান। জনসাধারণ তাদের আন্তরিক অভিবাদন ও নেক প্রত্যাশার সাথে সিপাহীদেরকে স্বাগত জানায়। ইখওান শহরের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অফিস আদালত ও দালান কোঠার হেফাজতের জন্য পাহারাড় দেন: যাতে বিপ্লবের দুশমনরা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের কোন সুযোগ না পায়। এতদসত্ত্বেও (অত্যন্ত দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে যে,) ইখওয়ান বিদ্বেষীরা এই অপবাদ আরোপ থেকে বিরত থাকছেন না যে, ইখওয়ান এই বিপ্লবের বিরোধী ছিলেন। কবির ভাষায়:
(আরবী**********)
বাহ্যত মিসরে কতই হাস্যসম্পদ কথাবার্তা বলা হয়ে থাকে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঐ হাসির অন্তরালে কান্না ও আর্তনাদ লুকায়িত রয়েছে।
ইমামের জীবনাল্লেখের দিকে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করে বলতে চাই যে, ইমাম ১৯২০ সালে মানহুরস্থিত টিচার্চ ট্রেনিং স্কুলে স্থানান্তরিত হয়ে যান যাতে রুটিন মোতাবেক সেখান থেকে একজন (প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত) সুদক্ষ শিক্ষক রূপে শিক্ষা লাভ করতে পারেন। কিন্তু তাঁর অদম্য সাহস মহৎ অনুভূতি এবং অকৃত্রিম উচ্চাকাংখার তুলনায় এই পেশা সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল না। তাই এই স্কুল থেকে ১৯২৩ সালে শিক্ষা সমপনের সংগে সংগেই তিনি কায়রোর দারুল উলুমে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯২৭ সালে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন। এতে তিনি কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং প্রথম স্থান অধিকার করেন। এটা একটা মজার কাহিনী যে, এই প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল ছিলেন মরহুম আবদুল আজিজ আতিয়া যিনি অত্যন্ত সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ উস্তাদ। স্কুল জীবনে তিনি চিলেন হাসানুল বান্নার উস্তাদ। কিন্তু পরবর্তী সময় তিনি তার এই ছাত্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এবং ইখওয়ানুল মুসলিমুনের ন্যায ও সত্যের আন্দোলনে শরীক হয়ে একজন কর্মতৎপর কর্মীতে পরিণত হন।
ইখওয়ানুল মুসলিমুন অন্যান্য ইসলামী আন্দোলনের তুলনায় কিছুটা ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। যেমন িএ সংগঠন খুঁটিনাটি মতবিরোধ ও ছোট খাট কলহ-বিবাদের পরিমন্ডল থেকে দূরে থাকে। প্রতিপক্ষের সাথে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়ার পরিবর্তে তাদেরকে তাদের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেয় যাতে তারা ইখওয়ান সম্পর্কে যা কিছু বলার বলতে পারে ১৩৪৭ হিজরীর জিলকদ মোতাবেক মার্চ ১৯২৮ সালে নীল নদের উপকণ্ঠে ইসমাঈলিয়া থেকে সূচীত হয়েছিল এই আন্দোলন। সেদিন মাত্র ছয় জন লোক ছিলেন এর উদ্যোক্তা অর্থা ইমাম হাসানুল বান্না শহীদ, আল আখআস সুলী ও আল আখ হাসবুল্লাহ প্রমুখ। অবশিষ্ট তিনজনের নাম এই মুহূর্তে আমার স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। হয়তো বা পরে আমার মনে হয়েও যেতে পারে। তখন তাদেরকে এই স্মৃতিকথায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।
কুরআন ও তলোয়ার
মুর্শিদের সকল প্রয়াস প্রচেষ্টা এই বিষয়কে কেন্দ্র করে পরিচালিত হতো যেন এমন একটা প্রজন্ম তৈরী করা যায় দ্বীনের ব্যাপারে যাদের থাকবে সুস্পষ্ট ও বস্তুনিষ্ঠ ধারণা। অর্থাৎ এই বিশ্বাস যে, ইসলাম দ্বীন ও দুনিয়া উভয়টিই রাষ্ট্র ও সরকার সর্বত্র পরিব্যপ্ত এটা কুরআন ও তলোয়ার। ইবাদাত ও মুআমালাত, শিক্ষা ও নৈতিকতা এতে যেমন রয়েছে রাজনীতি তেমনি রয়েছে অর্থনীতি। এটা সমাজের নীতিমালা উপস্থাপন করে আবার আদালতের জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দান করে। এটা একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা যা জীবনের শ্রেষ্ঠতম পর্যায় থেকে শুরু করে অতি সাধারণ বিষয় পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা পেশ করে। এমনকি পায়খানা-পেসাবখানায় যাওয়া সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়। এই দাওয়াত যুবক, বৃদ্ধ, কৃষক, মজুর ও উম্মাতের সকল শ্রেণীর মানুষের অন্তরে রেখাপাত করতে থাকে। শুধু সাধারণ মানুষই নয় বরং আমীর ওমরাহ এবং ধনিক-বনিক ঘরের নওজোয়ানগণ এই আন্দোলনে প্রভাবিত হতে থাকে। যেমন আবদুর রাজ্জাক, আবদুন নবী এবং আদদাল্লাহ গোত্রের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই দাওয়াতের মধ্যে মুসলিমগণ একটা নতুন জিনিস লক্ষ্য করেন যা কোন ঐতিহ্যগত চিন্তাগোষ্ঠীর কাছে বা প্রচলিত জ্ঞানচর্চাকারীদের কাখে তারা কখনো পায়নি। ইমাম শহীদের উক্তির সত্যতা প্রমাণ করে দাওয়াত যখন ব্যাপকতা লাভ করে এবং তাতে বিভিন্ন চিন্তাগোষ্ঠী ও সমাজের সাধারণ লোক যোগ দেয় তখন ১৯৩২ সালে হাসানুল বান্না কায়রোতে চলে আসেন। তিনি কায়রোর বাইরে প্রদেশ ও জিলাসমূহের ব্যাপারে কখনো উদাসীন ছিলেন না। বরং নিজেই সর্বদা বিভিন্ন ব স্তি ও জনপদে একাদিক্রম পরিদর্শনে যেতেন। এসব সফরে তিনি লোকদের সামনে সুস্পষ্টভাবে বিশ্লেষণ করতেন যে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত শুধু মিসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং গোটা বিশ্বমানবতার জন্যই দাওয়াত। তিনি মিসরের বাইরে অপরাপর ইসলামী রাষ্ট্রের সাথেও যোগ সূত্র স্থাপন করতে শুরু করে ছিলেন। তিনি যদি আরো কিছুদিন অবকাশ পেতেন (এবং জালিম রক্ত পিপাসুদের গুলী যৌবনেই তাঁর জীবন প্রদীপ নির্বাপিত না করতো) তবে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সংগঠন সমগ্র পৃথিবীতে কায়েম হয়ে যেতো। কেননা ইসলাম বিশ্বজনীন দ্বীন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্বন্ধে কুরআন মজিদের ঘোষণা হলো:
(আরবী**********)
“হে (গোটা দুনিয়ার) মানুষ, আমি তোমাদের সকলের নিকট আল্লাহর মনোনীত রাসূলরূপে প্রেরিত হয়েছি।”
অতিএব ইসলাম বিশ্বজনীন দাওয়াতের মর্যাদা রাখে। এটা কোন জাতি, ভাষা, কিংবা বর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অতএব যার মধ্যেই অদম্য সাহস আছে তার জন্য এটা কোন বিস্ময়ের ব্যাপর নয় যে, সে তার মনজিলে মকসুদে পৌঁছে যাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া থেকে বিদায় নিলে আবুয বকর সিদ্দীক (রা) পতাকা তুলে ধরেন। অতপর যথাক্রমে উমর (রা) উসমান (রা) ও আলী (রা) তাদের সমকালে এই গুরু দায়িত্ব আনজাম দিয়ে ইসরামকে দুনিয়ার আনাচে কানাচে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌছিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পৃথিবী থেকে তিরোধানের পরই দুর্বল ঈমানের অধিকারীগণ মুরতাদ হয়ে যায়। এমন কি কতিপয় পথভ্রষ্ট ব্যক্তি নবুওয়াতের দাবী করে বসে। তারা ইসলাম সম্পর্কে বিচিত্র ও অদ্ভূত ধারণা পেশ করতে থাকে। (তথাপি বাতিল নিশ্চিহ্ন ও নির্মূল হয়ে গেছে এবং ইসরাম বিজয়ী শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।)
পুনাত্মা অগ্রজদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আন্দোলনও অব্যাহত গতিতে চলেছে। ইতিমধ্যে হাসানুল বান্নাকে শহীদ করা হয় এবঙ হাসান আল হুদাইবি হকের পতাকা ধারণ করেন। তখন তিনিও তার রবের সান্নিধ্যে চলে যান তখন ইখওয়ান এই পতাকা উত্তোলনে সহযোগিতা করেন। (যদিও এখন এই পতাকা সাইয়েদ ওমর তিলমেসানীর পবিত্র হস্তে সমর্পিত কিন্তু তার বিনয় নম্রতার প্রতি লক্ষ্য করুন। -অনুবাদক)
এটা নিরন্তর প্রচেষ্টার কাজ। তাই হাসানুল বান্নার মৃত্যুর সাথ সাথে এর পরিসমাপ্তি ঘটেনি। কেননা আমরা হাসানুল বান্নার পবিত্রতার প্রতি ঈমান পোষণ করতাম না। কিংবা তা আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও ছিল না। আমাদের মূল লক্ষ্য মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। হাসানুল বান্না ছিলেন একজন মানুষ। প্রতিটি মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য। অনুরূপ হাসানুল বান্নাও মৃত্যুর এই পেয়ালা পান করেছেন। যে দাওয়াত স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুহাম্মাদ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাযিল করেছেন তার হিফাজত ও সংরক্ষণের দায়িত্বও তিনি নিজেই গ্রহণ করেছেন। প্রকৃত গুরুত্ব হাসানুল বান্না কিংবা কোন মুর্শিদে আ’ম-এর নয় বরং মূল গুরুত্ব হচ্ছে দ্বীনে হকের। যে দ্বীনের ওপর তার শত্রুরা উম্মাদের ন্যায় আক্রমণ করছে। ইখওয়ানের চিন্তা এই বিষয়েই কেন্দ্রীভূত। তারা তাদের জীবন পণ করে এই সহায়তায় নিবেদিত। িএ জিহাদ চলতেই থাকবে। কোন মুর্শিদে আ’ম থাকুক না বা না থাকুক যে সমস্ত লোক ইখওয়ানের প্রতি দোষারোপ করে যে, আমরা হাসানুল বান্নার অনুসারী। তাদের অন্তরে রয়েছে বক্রতা ও বিদ্বেষ; তাদের বোধ শক্তি উল্টো এবং তাদের বিবেক ও কান্ডজ্ঞানের হয়েছে অপমৃত্যু।
ইখওয়অনুল মুসলিমুনের বিশ্বব্যাপী ভূীমকা দ্বারা একথাই দিবালোকের মত প্রমাণিত হয় যে, তাদের মুর্শিদে আ’ম তাদের সকলকেই জিহাদের দাওয়াত দিয়েছিলেন যাতে মুসলিম মিল্লাতের জঘন্যতম শত্রুদের কবল থেকে িএকটা মুসলিম রাষ্ট্রকে উদ্ধার করা যায়। এই দাওয়াতের ওপরই ইখওয়ান তাদের সম্মতি জ্ঞাপন করেছে এবং ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডে সর্বপ্রথম প্রবাহিত গর্বিত খুনের অধিকারী তারাই- তাদের রক্তেই রঞ্জিত হয়েছিল সেখানকার মাটি। (এবং আমি নিসংশয়ে বলতে পারি যে,) যদি এই অঞ্চলের শাসকগোষ্ঠী দায়িত্ব এড়িয়ে পলায়নি মনোবৃত্তির পরিচয় না দিতো এবং আলস্য ও নৈরাশ্যের শিকার হয়ে না পড়তো তা হলে ইতিহাস ভিন্ন আঙ্গিকে লিখিত হতো। কিন্তু এই সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারীদের নিয়ে কি কর যাবে? তারা বাস্তব জিহাদ থেকে দূরে সরে থাকে; অথচ অনলবর্ষী বক্তৃতা-বিবৃতি ও ঘোষণা দ্বারা জাতিকে সর্বদা বিভ্রান্ত করে রাখে। এরা শুধু ফিলিস্তিনের অধিবাসীদেরকে কার্যত সহায়তা পদ্রানে বিরত থাকেনি বরং তারা সর্বত্র ইখওয়ানকেই তাদের যুদ্ধের ও প্রতিশোধ গ্রহণের নিশানা বানিয়ে নিয়েছে। যেন ইহুদীদের বিরোধিতা করা তাদের দৃষ্টিতে ইখওয়ানের মহাঅপরাধ। ইহুদীদের মোকাবিলায় ইখওয়ানেসর সাহসিকতাপূর্ণ পদক্ষেপ এমন মোক্ষম আঘাত ছিল (যদি নিজেদের ঘরের শাসকরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতো তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই ইহুদীদেরকে ঝেঁটিয়ে সম্পূর্ণরূপে বহিষ্কার করা যেতো। প্রশংগত এখানে একজন কবির ক্ষেদোক্তির উল্লেখ করছি:
(আরবী***********)
“যার কণ্ঠনালীতে গ্রাস আটকা পড়েছে সে পানি পান করে তার প্রতিকার করতে পারে। কিন্তু যার গলদেশে পানিই আটকে যায় সে কি করবে?”
সব বিষয় পূর্বেও আল্লাহ তায়ালার হাতে ছিল পরেও তাঁরেই হাতে থাকবে। অচিরেই আল্লাহ তায়ালা এসব লোকের নিকট থেকে এমন কঠোরভাবে হিসেব গ্রহণ করবেন যার কল্পনাও তারা করতে পারেনি কখনো।
আমার ইচ্ছা ছিল, আমি দাওয়াতের সূচনা ও তার পূর্ণতার ব্যাপারে কিছু আরজ করবো। আমি তা শহীদের ভাষায়ই পেশ করছি। কেননা আমার অন্তরে তাঁর শিক্ষার বড় মর্যাদা বিদ্যমান। লোকদের সম্মুখে দাওয়াত পেশ করতে গিয়ে তিনি যা বলেছিলেন তা আজও আমার স্মৃতিপটে অঙ্গিত হয়ে আছে। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন:
“এ দাওয়াত সূর্যের চেয়েও অধিক উজ্জল, ঊষাকাল থেকেও বেশী আলোকময় এবং দিবালোকের চেয়ে অনেক দীপ্তিময়। এ দাওয়াত পবিত্র পরিচ্ছন্ন এবং অকপট ও অকৃত্রিম। এতে কোন সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ নেই। এ আন্দোলন সকল প্রকার আকাংখা ও স্বার্থন্ধতা থেকে মুক্ত। ইখওয়ান মানুষের নিকট থেকে কোন প্রকার বিনিময় প্রশংসা এবং কোন প্রকার বাহবা পাওয়ার প্রত্যাশা করে না। তাদের মনের আর্ত হলো তারা তাকওয়ার গুণে নিজেদেরকে গুণান্বিত করবে কিন্তু মানুষের দৃষ্টি থেকে তা থাকবে একান্ত সংগোপনে-আড়ালে। তারা এমন বিনয় নম্রতার প্রত্যাশী ও পথিকৃত যে, যখন তারা এসে হাজির হবে তখন কেউ যেন তাঁদের জন্য জায়গা খালি করে না দেয়। আবার যখন অনুপস্থিত থাকবে তখন তাদের সম্পর্কে যেন খোঁজ-খবর নেয়া না হয়। তাদের জন্য শুধু এতটুকুই যথেষ্ট যে, তাদের আল্লাহ তাদের অবস্থা জানেন। আল্লাহ তাদেরকে যেন এমন জায়গায় ও এমন কাজে দেখতে পান যাতে তিনি তাদের প্রতি খুশী হতে পারেন……।”
হাসানুল বান্না চাইতেন তিনি যেন মানুষের সাথে অত্যন্ত অন্তরংগ পরিবেশে এবং সহজ, সরল ও ভালবাসাসিক্ত হৃদয় নিয়ে কথাবার্তা বলতে পারেন। তিনি সহজবোধ্য কথা পসন্দ করতেন। দার্শনিক স্টাইল থেকে সর্বদা দূরে থাকতেন।
ইমাম আমাদের শিখিয়েছিলেন যেন আমরা এই দাওয়াতে বিলীন ও একাকার হয়ে যাই- আমাদের আপাদমস্তকে দাওয়াতের জীবন্ত নমুনা পরিদৃষ্ট হয় এবং দাওয়াতের মধ্যে আমাদের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ ছবি দেখতে পাওয়া যায়। দাওয়াতের ব্যাপারে যেন আমাদের নিকট তার প্রত্যাশা ছিল:
(ফারসী**********)
“আমিতোমার হয়ে গেলাম আর তুমি হয়ে গেলে আমার
আমি আত্মা হয়ে গেলাম আর তুমি হয়ে গেলে দেহ।
এমনভাবে আমরা পরস্পরের মধ্যে বিলীন হয়ে যাই যেন
তারপর আর কেউ যেন বলতে না পারে আমি আর তুমি ভিন্ন!
এর অর্থ এটা কখনো নয় যে আমরা দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলবো। ইখওয়ান বিস্তৃত জমিনের ওপর চলাফেরা করে কাজ কারবার করে এবং আল্লাহ তায়ালার দেয়া উৎকৃষ্ট রিজিক খেয়ে থাকে। কিন্তু যখন দুনিয়াবী কোন জিনিস আমাদের দাওয়াতের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় তখন আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি। এবঙ এমন জীবন ধারা অবলম্বন করি যা আল্লাহ আমাদের নিকট চান। আমি মনে করি না যে, কিতাবুল্লাহ এবং সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিঘোষিত জীবন পদ্ধতির ব্যাপারে আরো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কোন প্রয়োজন রয়েছে। কোন কোন লোক জেনে বুঝে কিংবা স্থুল বিবেক-বুদ্ধির ফলে বাড়াবাড়ির পরিচয় দিয়ে ইখওয়ানের বিরুদ্ধে অপবাদ আরো করে থাকেন যে, তারা অইখওয়ানীদেরকে মুসলমানই মনে করে না।
ইখওয়ানের প্রতি অপবাদ
এটা খুবই নিকৃষ্ট অভিযোগ যা এই জামায়াতের প্রতি আরোপ করা হয়ে থাকে। এরূপ বিকারগ্রস্ত মানসিকতার সাথে আমাদের দূরতম সম্পর্কও নেই। আমরা সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে মুসলিম ও তাওহীদের অনুসারী বলে মনে করি। আল্লাহ তায়ালার ওপর তাদের সকলেরই অত্যন্ত মজবুত ঈমান রয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। যখন ইখওয়ানের প্রতিষ্বঠাতা মজলিশের কোন কোন সদস্যের বহিষ্কা কার্যকরী করা হয় তখন মুর্শিদে আ’ম জনাব হাসান আল হুদাইবি মরহুম বলেছিলেন: আমরা এই সদস্যদেরকে এ কারণে বহিষ্কার করছি না যে, তাদের দ্বীন ও নৈতিক চরিত্রের ব্যাপারে আমরা কোন সন্দেহ পোষণ করি। তাদের শুধু এজন্য বহিষ্কার করা হয়েছে যে, তারা সংগঠনের নিয়ম-শৃংখলা ও বুনিয়াদী নীতিমালার আনুগত্য করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে। নিয়ম-শৃংখলার অনুসরণ এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে এর অবর্তমানে কোন সংগঠন অথবা পার্টি টিকে থাকতে পারে না।
আমরা সব মুসলিমের সাথেই লেন-দেন করে থাকি। অনেক সময় একজন অইখওয়ানী মুসলিম একজন ইখওয়ানী মুসলিম অপেক্ষা অধিক বলিষ্ঠ ঈমানের অধিকারী হতে পারে। আমাদরে বক্তব্য শুধু এই যে, উম্মাতে মুসলিমা সামষ্টিকভাবে তাদের দ্বীনি শিক্বষাকে বাদ দিয়ে এবং এর প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করে চলার নীতি গ্রহণ করেছে। তারা নিজেদের দৈনন্দিন কার্যক্রমে ইসলাম থেকে পথনির্দেশনা গ্রহণ করেন। তাই ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত হচ্ছে, মুসলিম থেকে পথনির্দেশনা গ্রহণ করেন। তাই ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত হচ্ছে, মুসলিমদের দ্বীনে হানিফের দিকে প্রত্যাবর্তন করা আবশ্যক। অলসতার মেহা নিদ্রা ভংগ করে তাদেরকে সক্রিয় ও আন্দোলন মুখর হতে হবে। জীবনের সকল কর্মকান্ডে ইসলামের উপস্থাপিত রীতিপদ্ধতির যথাযথ অনুসরণ করতে হবে। এই দাওয়াতের ভিত্তিতেই মানুষের সাথে আমাদের সকল প্রকার লেন-দেন হয়ে থাকে। আমরা নিদ্রিতকে জাগ্রত এবং অলসকে সচেতন করতে চেষ্টা করি যেমন মুয়াজ্জিন মানুষের এই অনুভূতি জাগ্রত করতে চায় যে সালাতের সময় এসে গেছে।
আমরা কস্মিনকালেও এমন দাবী করি নাই যে, আমরা অন্যদের তুলনায় ভাল। আমরা কখনো অন্য কোন দাওয়াতী সংগঠনের প্রতিও দোষারোপ করি না যে, তারা এরূপ বা সেরূপ ইত্যাদি। একান্তই যদি আমরা এসব সংগঠনের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হই তবেতা হয় সাময়িক এবং তা কেবল বুনিয়াদী বিষয়ের মধ্যে সীমিত থাকে।
আমার এই স্মৃতিকথা বিশেষত এর যে অংশ ইখওয়ানের দাওয়াতের সাথে সম্পর্কিত তা সম্পূর্ণরূপে ইমাম শহীদের সেসব শিক্ষার উল্লেখ করেছি- যা আমি তার নিকট থেকে শিখেছি। কিচু কথা আছে এমন যা আমার স্মৃতিতে সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলো ইমামের বক্তৃতা কিংবা চিঠি-পত্রের সাথে সম্পর্কিত। আমি এই স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে কোন উৎসের সাহায্য গ্রহণ করিনি। আমি চেয়েছিলাম, এই স্মৃতিকথাগুলো পুনরাবৃত্তি করতে গিয়ে আমার স্মরণ শক্তিরও একটা পরীক্ষা হয়ে যাক যে, এই আন্দোলনের নেতা থেকে আমি যা কিছু শিক্ষা লাভ করেছি তা আজও সংরক্ষিত আছে কিনা? কালের আবর্তন আমার স্মৃতির কিছু অংশ ছিনিয়ে নেয়নি তো? এই স্মৃতিকথাগুলো রেকর্ড করে নেয়া জরুরী মনে করছি। আমি এগুলোর রেকর্ড করার সময় ক্রমবিন্যাসের দিকে লক্ষ্য রাখিনি। (যা লিপিবদ্ধ করার সময় লিখত সাধারণত করে থাকেন)। উদাহরণ স্বরূপ আমি কোন কথা হয়তো শুরু করেছি ইত্যবসরে অন্য প্রসংগ এসে পড়েছে। তারপর আমার এমন সূত্র এসে পড়েছে যাতে বক্তব্য পূর্ব প্রসংগের দিকে মোড় নিয়েছে। মানুষ কোন কথা ভুলে যায় না কিংবা কথা বলতে শুরু করলে কোন প্রসংগ বাদ পড়ে না এমন খুবই কমই হয়ে থাকে। খুঁটিনাটি বিষয়ে কোথাও না কোথাও কম বেশী হয়ে যাওয়অ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। আদম সন্তানের বৈশিষ্ট্যিই হচ্ছে সে ভুল করে বসে। ভুলে যাওয়া লোকদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের ভুল জানতে পারলে অনুতপ্ত হয়। আমি আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে ঐ ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবো যে আমাকে এমন কোন বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করবে যা আমার থকে বাদ পড়েছে কিংবা আমার কোন ভ্রম সংশোধন করে দেবে যা আমার পক্ষ থেকে প্রকাশ পেয়েছে। আমিতো ইচ্ছাকৃতভাবে কোন ভুল করিনি এবং অনিচ্ছাকৃত ভ্রান্তির ওপর অনমনীয়তা প্রদর্শনও করবো না বরং ধন্যবাদের সাথে তা সংশোধন করে নেবো।
দাওয়াতের প্রচার ও প্রসার
ইমাম দাওয়াতের সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেছিলেন এভাবে যে, তিনি চায়ের দোকান ও অন্যান্য যেসব স্থানে মানুষ একত্রিত হয়ে গল্প গুজবে মেতে উঠতো সেখানে গমন করতেন। তিনি একটা ছোট ব্লাক বোর্ড বগল দাবা করে ফিরতেন। কথাবার্তার মাঝে যদি কোন সূক্ষ্ম তত্ব বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন দেখা দিতো তাহলে ব্লাকবোর্ডের সাহায্যে তা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁক এমন হৃদয়গ্রাহী বাকপটুতা প্রদান করেছিলেন যে, তার কথা শোবনার জন্য লোকজন এসে জড়ো হতো। ফলে সমস্ত চা দোকানের মালিক ও কফিখানার ম্যানেজারগণ সমবেতভাবে তার সমীপ আবেদন করতে লাগলেন যেন তাদের দোকানেও তিনি গমন করেন। এমনিতেই ইসমাঈলিয়ার প্রত্যেক রেস্তোরার মালিকগণ সর্বদা চাইতেন যেন হাসানুল বান্না তাদের দোকানেও যান এবং মানুষের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন।
প্রতিদিন এই ধারা অব্যাহত থাকতো। শিক্ষকতার দায়িত্ব থেকে অবসর হয়েই মুর্শিদ এই কাজে লেগে যেতেন। প্রথম প্রথম মানুষ মনে করেছিলো যে যদিও তাঁর কর্মপদ্ধতি খুবই আকর্ষণীয় কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি সাধারণ ওয়ায়েজীনদের মত একজন দ্বীনি মুবাল্লিগ বৈ নন। অতএব সুয়েজ খাল কোম্পানী- যেখানে বেশ কিছু চিহ্নিত ইসলামী দাওয়াত বিদ্বেষী লোক ছিল- আত্মপ্রতারিত হয়। তারা মনে করে যে তিনি হয়তো বা কোন তাবলীগ পন্থি মৌলভী হতে পারেন। তাই এই কোম্পানী ইসমাঈলিয়ায় উম্মুহাতুল মু’মিনীন মাদ্রাসা এবং তৎসংলগ্ন মসজিদ নির্মাণে সংগঠনকে (ইখওয়ানের) সহযোগিতা করে। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য সামাজিক সংগঠনও প্রাথমিক অবস্থায় তাদের সহায়তার হাত সম্প্রসারিত করে।
আমার একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেছে। জনৈক ইখওয়ানী ভাই কোন একটা কোম্পানীতে ড্রাইভার পদে নিযুক্ত ছিলেন। তার নিকট একখানা বাইসাইকেল ছিল। এর সাহায্যে সে তার ডিউটির জন্য প্রত্যহ নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই তার কর্মস্থলে গিয়ে পৌঁছতো। কোম্পানীর দায়িত্বশীল কর্তারা তার এই সময়নুবর্তিতার কারণে তাকে মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতো। তারপর হঠাৎ দেখা গেলো তিনি তার কাজে কিছুটা দেরীতে উপস্থিত হতে লাগলেন। কোম্পানীর চেয়ারম্যান বিস্মিত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, সে তার দীর্ঘ সতর্ক অভ্যাস এবং যথা সময়ে উপস্থিতির ব্যাপারে পরিবর্তন আনলো কেন? তিনি তার প্রত্যুত্তরে বললেন:
আমার একটা বাইসাইকেল ছিল। আমি সেটির সাহায্যে নির্দিষ্ট সময়ে ডিউটিতে এসে পৌঁছে যেতাম। আমাকে বলা হয়েছিল যে, ইখওয়ানের কোন কাজে এয়ানতের প্রয়োজন তাই আমি আমার সাইকেল বিক্রি করে দিয়েছি এবং বিক্রিলব্ধ অর্থ মুর্শিদে আ’ম-এর হাতে তুলে দিয়েছি। এখন আমি পায়ে হেঁটে এসে থাকি তাই পৌঁছতে দেরী হয়ে যায়।
কোম্পানীর চেয়ারম্যান মনোযোগ সহকারে এই ঘটনা শুনেন এবং ইখওয়ানী ভ্রাতার বাদ্যান্যতা দানশীরতায় অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে যান। অবশেষে কোম্পানীর তরফ থেকে তিনি তাকে একটা নতুন সাইকেল কিনে দেন। এখন পুনরায় সে ভাই তার সাবেক অভ্যেস অনুযায়ী খুবই সময়ানুগভাবে তার ডিউটিতে সময়ের পূর্বেই গিয়ে পৌঁছতে থাকেন। এই ঘটনা (যদিও নেহায়েত মামুলী) তথাপি এ দ্বারা আমাদের সামনে এই সত্য উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে যে, ইখওয়ান তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের পথে কত আত্মনিবেদিত এবং মুর্শিদের উপর তাদের কি অপরিসীম আস্থা ও বিশ্বাস। তদুপরী তাদেরকে যখন ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহ তথা আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হতো তখন তারা সাথে সাথে তা কার্যকরী করতো।
অতপর নবনির্মিত মসজিদে ইখওয়ানের সমাবেশ আরম্ভ হয়। প্রতি রাতেই জনসমাগমে মসজিদ মুখরিত হয়ে উঠতো। তারা মুরিআশদে আ’ম-এর বক্তব্য শোনার জন্য অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে সমবেত হতো। তিনি যখন কায়রো এসে বসবাস শুরু করেন তখন সপ্তাহে প্রতি মংগলবার কেন্দ্রীয় দপ্তরে সমাবেশ হতে থাকে। আমার মনে আছে কেন্দ্রীয় অফিস ও বিভিন্ন সময় কয়েকটিচ জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। প্রথমে এটি ছিল মুর্শিদের নিজের বাস গৃহে। অতপর সাইয়েদা জয়নাব মহল্লার নীচ তলায় নিয়ে আসা হয়। তারপর আবার আতাবাতুল পার্লামেন্ট হোটেলে স্থানান্তরিত করা হয় এবং শেষে হিলমিয়ায় শাদীদায় কেন্দ্রীয় অফিসের স্থান নির্ধারিত হয়।
ইউনিভার্সিটিতে দাওয়াতের কাজ
ইত্যবসতরে ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা বিশেষভাবে এই নবগঠিত সংগঠনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কলেজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত তাদের বন্ধুদের কাছে এই দাওয়াত প্রচার করতে থাকে। সময়যতই গড়িয়ে যেতে লাগলো ইখওয়ানী ছাত্রের সংখ্যাও ততই বেড়ে চললো। এমনকি শীঘ্রই এমন সময় উপস্থিত হলো যখন ছাত্র সংসদের নির্বাচন কোথাও ইউনিয়নের ওপর ইখওয়ানী ছাত্রদের পূর্ণমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলো। আবার কোথাও বা নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জিত হলো।
এ বিষয়টি সরকার এবং দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলকেও অস্থির করে তোলে। তাদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তারা আকস্মিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে যে, জাতির মধ্যে এমন একটা নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটেছে যা তাদের চিন্তাধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। ব্যস! আর যায় কোথায়! ইখওয়ান ও ইখওয়ানের সুষ্ঠু চিন্তার বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায। সাথে সাথে দাওয়াতের কাজও জোরদার হয়ে ওঠে। শহর বন্দর ও গ্রামে গঞ্জের যেসব লোক দাওয়াত হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিল; তারাও তাদের আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজন ও বন্ধু বান্ধবকে এই আলোর সাথে পরিচিত করাতে শুরু করে। জনগণের মধ্যে এমন সাড়া পড়ে যায় যে, বস্তির পর বস্তি এবং জনপদের পর জনপদ এই দাওয়াতের কেন্দ্রে পরিণত হতে থাকে। অতপর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত জিহাদের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এই পর্যায়ে ইসলামের শত্রুরা দাওয়াতকে তাদের জন্য সমূহ বিপদের কারণ বলে ভাবতে থাকে এবং এই পূত-পবিত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে শয়তানী চক্রান্ত শুরু করে দেয়। সকল শয়তানী শক্তি ও বাতিল শক্তি এই উদীয়মান শক্তিকে সমূলে উৎখাত করার জন্য আদা পানি খেয়ে লেগে যায়। কিন্তু তাদের এই অশুভ উদ্দেশ্য অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শহর-বন্দর ও গ্রাম-গঞ্জের কর্মী ও সদস্যদের কর্মপদ্ধতি ছিল, তারা মানুষের মাঝে তাদের কাজ অব্যাহত রাখতো। যখন তারা উপলব্ধি করতো যে, তাদের টার্গেটভুক্ত কোন লোক নিষ্ঠার সাথে দাওয়াত হৃদয়ঙ্গ করতে সমর্থ হয়েছে, তখন তারা তাঁকে মুর্শিদে আ’ম-এর খেদমতে হাজির হওয়ার জন্য আহ্বান জানাতো এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার জন্য বাইয়াত গ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করতো। এই বাইয়াত হতো শুধু আল্লাহর পথে- তারই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। হাসানুল বান্নার পথে বা তাঁকে খুশী করার জন্য নয়। এর প্রমাণ হলো, বাইয়াতের শপথনামার সর্বশেষ কথাটি ছিল এরূপ:
“মুর্শিদের নির্দেশের আনুগত্য এমতাবস্থায় কখনো করা যাবে না। যখন তা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অমান্য করার কারণ হবে।”
আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, একথা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে যায় যে, আমরা কোন ব্যক্তির বাইয়াত তার নিজের স্বার্থে করি না। বরং আমরা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালারই বাইয়াত করে থাকি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাইয়াতকেও আল্লাহ তায়ালা তাঁর বাইয়াত বলে আখ্যায়িত করেননি। বরং তাঁর নিজের (আল্লাহর বাইয়াত বলে ঘোষণা করেছেন….. (আরবী*********) (নিশ্চয়ই যেসব লোক আপনার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন…..।)
সাংবাদিকতার জগতে ইসরামী আন্দোলন
অতপর ইখওয়ানের ইতিহাসে একটা মহত সাংবাদিকতা অধ্যায়ের সূচনা হয়। দু’টি সাময়িকী- “আল-ইখওয়ান” ও “আন-নাজীর” এবং একটা দৈনিক পত্রিকা “আল-ইখওয়ানুল মুসলিমুন” প্রকাশিত হতে থাকে। এসব পত্রিকা ইখওয়ানুল মুসলিমুনের পয়গামের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। ফলে শাসক শ্রেণী, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং অন্যান্য গ্রুপ, খৃস্টান, কমিউনিস্ট ও ইহুদী শক্তি তথা দল মত নির্বিশেষে সকলেই ইখওয়ানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইখওয়ানের ওপর তাদের আক্রমণ ছিল খুবই কঠোর ও নিষ্ঠুর। এতে কোন প্রকার নৈতিক সীমা এবং মানবতার বিবেচনা করা হয়নি। এই শত্রুতামূলক বর্বরোচিত হামলার ফলে অধিকাংশ লোক আমাদের দাওয়াতে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। আমাদের নিজেদের চেষ্টা-সাধানার তুলনায় আমাদের শত্রুদের প্রচেষ্টায়ই আমাদের নাম ও খ্যাতি অনেক বেশী ছড়ায। হকের বিরোধিরা তাদের নিজেদের বিরোধিতার দ্বারাই সত্যকে (মানুষের অন্তরে অনুসন্ধানী কৌতুহল ও মনোভাব সৃষ্টি করতঃ) আরো প্রসারিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। অনুরূপভাবে হকের ব্যাপকতা সৃষ্টি ও বিস্তৃতি ঘটানোর ব্যাপারে ইমামের অব্যাহত সফর এবং দায়ীদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার প্রভাবও কম গুরুত্ব বহন করে না।
সংগঠনের শামিল হওয়ার বিভিন্ন পর্যায়
জনসাধারণের সংগঠনে যোগদানের বেশ কয়েকটা পর্যায় ছিল। যেমন একটা স্তর ছিল “সুধী ও হিতাকাংখীদের” যারা সংগঠনকে ভালবাসতো কিন্তু সংগঠনের কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণের মত মনোবল তাদের মধ্যে ছিল না। সংগঠনের দ্বিতীয় পর্যায়ে ছিলেন “সহযোগী ও সক্রিয় সমর্থকগণ”। এই শ্রেণীর লোকেরা সংগঠনের পুরো নিয়ম শৃংখলার অনুসারী ছিলেন না। কিন্তু সংগঠনকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করতেন। তৃতীয় পর্যায় ছিল বাইয়াত গ্রহণকারীদের। এই পর্যায়ের ইখওয়ানরা ইমামের হাতে বাইয়াতের মাধ্যমে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করতো এবং সংগঠনের কাজে পুরোপুরি অংশ নিতো। সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল সম্পূর্ণ নিবেদিত প্রাণ কর্মীবাহিনী। তারা বাইয়াত গ্রহণের পর তাদের জান-মাল ও সন্তানদেরকেও দাওয়াতে হকে সোপর্দ করে দিতো।
দাওয়াত তাদের কাছে জান-মাল, পরিবার পরিজনের কুরবানী দাবী করলে তারা কোন প্রকার অজুহাত ও যুক্তি উপস্থাপন না করে আল্লাহর পথে তাদের এই প্রাণ প্রিয় সম্পদগুলোও পেশ করে দিতো। ইনশাআল্লাহ শীগ্রই আপনাদের সামনে বিষদ বিবরণ তুলে ধরা হবে যে, “নিষ্ঠাবান ও নিবেদিত প্রাণ কর্মীবাহিনীর” জ ন্য তাদের মধ্যে কি গুণাবলী সৃষ্টি করা আবশ্যক। এই প্রসংগে আপনার জন্য একটা উদাহরণই যথেষ্ট হবে বলে মনে করি। পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের এক ইখওয়ানী ভাই তার যুবক সন্তানকে ফিলিস্তিন জিহাদে অংশ গ্রহণের জন্য মুজাহিদ বাহিনীর সাথে প্রেরণ করেন। এই নওজোয়ান জিহাদে শহীদ হয়ে যান। ইমাম যখন সমবেদনা প্রকাশের জন্য সেই ভাইয়ের কাছে যান তখন তিনি জিজ্ঞেস করেন: আপনি কি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য এসেছেন? যদি আমার অনুমান সত্য হয় তবে আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমার সান্ত্বনার প্রয়োজন নেই। আর যদি আপনি আমাকে ধন্যবাদ জানাতে এসে থাকেন তাহলে আমি প্রাণভরে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আসুন! আপনি যখন আমার সামনে আল্লাহর নিকট শহীদগণের মর্যাদার বর্ণনা দিয়েছেন তখন থেকেই আমি শাহাদাতের উচ্চ সম্মান সম্পর্কে অবহিত হয়ে গিয়েছি। আল্লাহর রহমতে ওপর ভরসা রেখে আমি আশা করি যে, আমার সন্তান শহীদি কাফেলায় শীর্ষস্থানীয় মর্যাদা লাভ করবে। আমার একান্ত প্রত্যাশা যে আমিও ঈমানের সাথে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করি এবং আল্লাহ আমাকে আমার ছেলের সাথে সেখানে মিলিত হওয়ার সৌভাগ্য দান করেন।
ইখওয়ানের সংগঠনবুক্ত ও দলবদ্ধ হওয়ার উদ্দেশ্য
ইখওয়ানের সংগঠন প্রতিষ্ঠিত এই উদ্দেশ্যে যে, যেসব বিপদ-মুসিবত মুসলিমদের ঈমান আকীদা ধ্বংস করে দিচ্ছে সেগুলোর যেন প্রতিবিধান করা যায়। এসব বিপদ সম্পর্কে মুসলিমদের অনুভূতি পর্যন্ত লোপ পেয়ে বসেছে। অথচ তাদের পায়ের নীচে ভয়ংকর গভীর গর্ত খনন করা হয়েছে। যে কোন মুহূর্তে তারা তার অতল তরে পতিত হয়ে হারিয়ে যেতে পারে। শুধু এখানেই শেষ নয়, বরং সিনেমা, থিয়েটার, টেলিভিশন ও রেডিও প্রভৃতি গণমাধ্যমের উদ্দেশ্য এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে উন্নতি-অগ্রগতি, তাহযীব-তামাদ্দুন ও সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রভতির নামে মুসলিমদেরকে পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণের মোহে মোহগ্রস্ত করা। ইসলামের কোন ত্রুটি বা দুর্বলতা নেই। কিন্তু কোন মুসলিমই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইখওয়ানের দাওয়াত ইসরাম বৈরিদের ইসলাম বিদ্বেষী তৎপরতার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ বাস্তব রূপ লাভ করেছে বলে আমি মনে করি না। বরং এটা একট ইতিবাচক আন্দোলন যা মুসলিমদেরকে তাদের দ্বীন, দ্বীনের শিক্ষা ও মূলনীতির দিকে ফিরিয়ে আনতে চায়। ইসলামের শিক্ষা ও তার মূলনীতি ন্যায় ও সত্য। কিন্তু মুসলিমদের উদাসীনতার কারণে তাদের গৌরবের দীপ্তি মাঝে মধ্যে নিষ্প্রভ হয়ে যেতে থাকে।
ইখওয়ানের কর্মনীতি ও কর্মপরিকল্পনা কোন কাজের প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি কখনো নয়। ইমাম শহীদ বায়োঃপ্রাপ্ত হওয়অর পর থেকেই মুসলিম উম্মাহর শোচনীয় অবস্থা সম্পর্কে গভীরভাবে নিরীক্ষণ এবং এর প্রতিকার সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করেন। অতপর তিনি একটি মৌলিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন যা কোন কোন বাহ্যিক কার্যকারণের ফসল নয় বরং জীবনের প্রতিটি দিক আলোকিত করার জন্য একটি উর্বর মাস্তিষ্কের সতর্কতা ও সাবধানতার ফসল।
(সাধারণত দল ও সংগঠন কোন নির্দিষ্ট দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হতো।) কিন্তু কোন সাম্রাজ্রবাদের হাত থেকে কোন বিশেষ এলাকা মুক্ত করার উদ্দেশ্যে ইখওয়ান প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং ইখওয়ানের সামনে তার চেয়েও বড় লক্ষ্য ছিল এবং তাহচ্ছে মুসলিম উম্মাহকে ইসলামের পবিত্র জীবন এবং তার জীবনদায়িনী ঝর্ণার দিকে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করানো; তাদের পূর্ণাংগ স্বাধীনতা ও শান্তিপ্রিয়তার বিশ্বাসে অভ্যস্ত করে তোলা। এই উদ্দেশ্য হাসিল হলে এবং এই জীবন্ত সত্য মুসিলম মিল্লাতের মন-মগজের গভীরে স্থায়ীভাবে বদ্ধমুল হলে সকল সমস্যা আপনা থেকেই সমাধান হয়ে যাবে। তারা নিজেরাই বুঝতে পারবে যে, সাম্রাজ্রবাদ এবং স্বাধনিতা দু’টো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস যা কখনো এক জায়গায় একই সময় অবস্থান করতে পারে না। অনুরূপ আযাদী ও জুলুম, ন্যায় ও সত্যে বিশ্বাস, অর্থনৈতিক সাম্রাজ্রবাদ। মুসলমানদের আত্মমর্যাদা ও আদর্শিক সাম্রাজ্রবাদও পরস্পরের বিপরীত। এ দু’টিরও পাশাপাশি অবস্থঅন অসম্ভব। দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করে মানুষ কখনো আরাম ও শান্তির জীবন যাপন করতে পারে না।
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত এই বুনিয়াদী নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। যাতে মুসরমানদেরকে জীবনের ছোট বড় সকল ব্যাপারে সত্য দ্বীনের অকপট অনুসারী বানিয়ে দেয়া যায়। আর এটা একটা পৃথক ও মৌলিক বিশ্বাস। যার ইতিবাচক সত্তা রয়েছে। তাই তা কোন কার্যকারণ বা ঘটনার প্রতিক্রিয়া নয়। অতএব এই আন্দোলন যখন কোন ছড়িয়ে পড়া বিপর্যয়ের সংশোধনী অথবা কোন ব্যাপক গোমরাহীর গতি রোধ করার আহবান জানায় তখন তা ইসলামের সুমহান শিক্ষারই প্রকৃত দাবী।
নামকরণ
পূর্বে যে ছয় ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে যখন তারা শপথ গ্রহণ করে এবং ইমামও উপলব্ধি করেন যে এখন তারা একটা জামায়াত বা সংগঠনের রূপ পরিগ্রহ করতে যাচ্ছে তখন এই নবগঠিত সংগঠনের নাম কি হবে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। ইমাম বললেন: “আমরা কি ইখওয়ান (ভাই ভাই) নই? সকলেই বলে উঠলো “অবশ্যই” তিনি পুনরায় বললেন: তাহলে আমরা “আল-ইখওয়ানুল মুসলিমুন”। প্রসংগত আমি এখানে একটা কথা আরো যোগ করে দিতে চাই যে, এর নাম কুরআন মজীদেও বর্ণিত হয়েছে। অতএব এটা কোন মনগড়া “বেদায়াত” নয়। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন (আরবী******) (মু’মিনরা পরস্পরের ভাই।) তিনি আরো বলেছেন: (আরবী************) (তিনি তোমাদের মুসলিম নামে অভিহিত করেছেন) সুতরাং এটা কোন নতুন জিনিস নয়। সাথে সাথে এই ভুল বুঝাবুঝিরও অপসারণ হয়ে যাওয়া প্রয়োজন যে আমরা আমাদের এই জামায়াতকে “আল-জামায়াতুল মুসলিমা” বলে দাবী করিনি। কেননা জামায়তে মুসলিমার মধ্যে সব মুসলিম শামিল রয়েছে। আমরা আমাদেরকে “জামায়াতে মুসলিমীন” কিংবা “জামায়াতুন মিনাল মুসলিমীন” বলে বিশ্বাস করি। অর্থাৎ উম্মাতে মুসলিমার মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক মুসলিম দাওয়াতে ইসলামের কাজ সংগঠিত উপায়ে ও সংঘবদ্ধভাবে করার জন্য একটা সংগঠন কায়েম করেছে। ইসলাম শুধু আমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এমন লোকদের পরিণাম ও পরিণতি কি হবে যারা আমাদেরকে হত্যার উপযুক্ত বলে মনে করে এবং আমাদের ওপর বিদায়অতের অভিযোগ আরোপ করে। এটা বল্ম এমন একটা অপরাধের শাস্তি হিসেবে যা করা তো দূরে থাক আমাদের কল্পনাতেও কোনদিন আসেনি।
সাবধান! অপরের ছিদ্র অন্বেষণ এবং দোষ খুঁজে বেড়ানো লোকদের উচিত আল্লাহকে ভয় করা। আমি আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের নসীহত করছি এবং একটা হাদীস তাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।
“যারা বা যে ব্যক্তি মানুষের গোপনীয় বিষয় জানার জন্য তৎপর থাকে আল্লাহ হয়তো তার ত্রুটি-বিচ্যুতি ফাঁস করে দেয়ার জন্য কাজ শুরু করে দেবেন। আর আল্লাহ এরূপ করলে তাঁকে তাঁর গৃহের মধ্যেই অপমাণিত ও লাঞ্ছিত করে ছাড়বেন।”
আমাদের সকল কর্মতৎপরতায় আল্লাহর সাহায্যই যথেষ্ট। তিনিই সর্বোত্তম কর্মসম্পাদানকারী। আমাদের নাম ছড়িয়ে পড়ুক কিংবা আমাদের কথা সর্বত্র শোনা হোক তা আমাদের উদ্দেশ্য মোটেই নয়। আমরা চাই প্রকাশ্র ও অপ্রকাশ্র শুধু আল্লাহর জন্য চেষ্টা-সাধনা করে যাই।