চতুর্থ অধ্যায়
মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্বের সাথে স্মরণীয় সফর
এই ব্যক্তিত্ব (শহীদ হাসানুল বান্না) তার অনুসারীদের অতি ক্ষুদ্র বিষয়ের খেয়াল রাখতেন যাতে তাদের আরাম-আয়েশের পূর্ণ ব্যবস্থা করা যায়। ইমামের এই মহতী ব্যক্তিত্বের কারণে তাঁর সাথে তাঁর অনুসারীদের সম্পর্ক ছিল খুবই মজবুত ও নিবিড়। আপনি কোথাও এমন একজন ব্যক্তির সন্ধান পাবেন না। যিনি মুর্শিদের সাথে কিছু সময় অতিবাহিত করেছেন অথচ মুর্শিদের উত্তম আচরণ ও কোমল হৃদয়বৃত্তির অনুরাগী হয়ে যাননি।
একবার আমি মুর্শিদের সাথে তানতা গিয়েছিলাম। সেখানে একটি মসজিদের উদ্বোধন করার জন্য জনৈক স্থানীয় নেতা দাওয়াতনামা পাঠিয়েছিলেন। মসজিদের উদ্বোধন ও বক্তৃতার পর ইখওয়ান মসজিদে-ই রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করতে লাগল। মুর্শিদ মেজবানের কানে কানে কি যেন বললেন। অতপর মেজবান আমাদের কাছে আসলেন এবং আমাকেও অন্যান্য সংগীগণকে সাথে করে পার্শ্ববর্তী একটা জাঁকালো প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। আমরা শয়ন কক্ষে প্রবেশ করে দেখলাম অত্যনত মূল্যবান আসবাবপত্র দ্বারা কক্ষটি সুসজ্জিত। অকস্মাৎ আমি দেখতে পেলাম আমার দুই সাথীর একজন এই সুসজ্জিত কক্ষ দেখে “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা” পড়ছেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম “ভাই কি হয়েছে?” তিনি জবাব দিলেন: যে অর্থ এই বাহ্যাঙম্বর বিলাসিতা ও কক্ষের সাজ-সজ্জায় ব্যয় করা হয়েছে তার উত্তম ব্যয়ের খাত ছিল আল্লাহর পথ। আমি বললাম, আল্লাহ আমার ও আপনার ওপর রহম করুন। আমাদেরকেক কোন্ জিনিসে এখানে টেনে এনেছে? তিনি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন: আল্লাহর পথে দাওয়অত- তোমরা কি এটাকে নিজের জন্য আল্লাহর রহমত মনে করো না। তিনিই তো এই সফরে আমাদের জন্য এই আরামদায়ক শয়ন কক্ষের ব্যবস্থা করেছেন। হয়তো আমাদের কেউই কখনো এরূপ আরামদায়ক রাত্রি যাপনের আনন্দ পায়নি। তাহলে কি অসন্তোষ প্রকাশের পরিবর্তে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় আমাদের কর্তব্য নয়?
আমি আরজ করলাম: “তুমি কি এটাকে নিজের জন্য আল্লাহ তায়ালার ইহসান এবং রহমত মনে কর না? তিনিই তো এই সফরে আমাদের জন্য এই আরামদায়ক কক্ষের ব্যবস্থা করেছেন। হয়তো আমাদের কেউই কখনো এমন আরামদায়ক শয্যায় রাত্রি যাপনের আরাম উপভোগ করার সুযোগ পায়নি। তারপরও কি আপনি মনে করেন না যে, আমাদেরকে অসন্তোষ প্রকাশ করার পরিবর্ত আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
বায়ুর গতি নির্ণায়কযন্ত্র
রাতটি সেখান অতিবাহিত করার পর পরদিন সকালে আমরা তানতা রেলষ্টেশনে গিয়ে পৌঁছি যাতে কায়রো অভিমুখী গাড়ী ধরতে পারি। আমরা স্টেশনের প্লাটফর্মেই ফজরের নামায আদায় করলাম। মৃদুমন্দ প্রাতঃসমীরণ আমাদের চেহারা ও পোষাক নিয়ে যেন খেলা করছিল। আমরা নিরাপদদেই কায়রো রেল স্টেশনে গিয়ে পৌঁছি এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ গৃহ অভিমুখে রওয়ানা দেই যাতে তৃপ্তি সহকারে আরো একটু ঘুমিয়ে নিতে পারে। কিন্তু মুর্শিদে আ’ম (রহমাতুল্লাহ আলাইহি) একাই সাবতিয়াস্থ মাদ্রাসাতু উম্মে আব্বাসের পথ ধরেন যাতে স্কুলে তার নির্ধারিত প্রথম পিরিয়ড পড়াতে পারেন। এই ঘটনার দ্বারা আপনি কি লক্ষ করেছেন যে, পরিপূর্ণ ইখলাস ও আন্তরিকতা নিয়ে আলআহর পথের একজন সৈনিক কাজের চাপ এবং সময়ের স্বল্পতার প্রতিকার সাধন কিভাবে করতে পারেন। প্রকৃতই যে ব্যক্তি সকল কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে দেন। জেনে রাখুন যে, আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ এবং ইহসান অনেক বড়।
সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। কিছুদিন পর আমাদের সেই ভাই যিনি তানতায় আমার সাথে রাত্রিযাপন করেছিলেণ- একটা দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। হঠাৎ এক সময় তিনি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমি তার কুশলাদি কামনা করতে যাই। যেহেতু তিনি ছিলেন শয্যাশায়ী তাই তার অবস্থা জানার জন্য আমি সোজা গিয়ে তার বিশ্রামের কক্ষে প্রবেশ করি। আমি কক্ষে প্রবেশ করেই দেখতে পাই রুমের মধ্যে অত্যন্ত মূল্যবান ও দামী সাজ-সরঞ্জাম এবং কম্বল পড়ে রয়েছে। আমি এদিক ওদিক দৃষ্টিপাত করার পর তার দিকে দৃষ্টিপাত করি এবং চাপা স্বরে বলতে থাকি “আল্লাহ তায়ালা আপনাকে পরিপূর্ণ রূপে সুস্থ্য করে দিন।”
তিনি ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান। আমার কথার স্বরেই অতীতের সমস্ত ঘটনাবলী বুঝে ফেলেন এবং মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করেই বলে উঠলেন “উস্তাদ ওমর সেই কথা বাদ দিন।” বস্তুত তিনি আমার ইংগিতের যথার্থতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তানতায় মসজিদের উদ্বোধন সেখানকার মূল্যবান আসবাবপত্র এবং বিশ্রাম কক্ষের সাজ-সজ্জা ও সেই দিনগুলোর অন্যান্য ঘটনাবলী তার স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠেছিল। আপনি দেখুন আল্লাহ তায়ালা মানুষকে কত পর্যায়ে অতিক্রম করান। এক সময় কোন লোক একটা বিষয়কে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখে কিন্তু অন্য সময় সেই একই বিষয় আবার তার কাছে চোখের তৃপ্তি ও মনের প্রশান্তি হয়ে দাঁড়ায়।
আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছ ফলবতী বানিয়ে দেন। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধা বানিয়ে ছাড়েন। সেই প্রকৃত মালিক যাকে মনে করেন কালেমায়ে হকের ওপর দৃঢ় থাকার সৌভাগ্য দান করেন, তাকে স্বাধীনচেতা বানিয়ে দেন ও বলিষ্ঠতা দান করেন। যাতে দুনিয়াতেও তিনি হক কথার ওপর স্থির থাকতে পারেন এবং আখেরাতেও তার পদস্খলন না ঘটে। এসব লোক সর্বদা নিজের নীতির ওপর সর্বত্র অটল থাকে। পক্ষান্তরে কিছু কিছু লোককে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত বায়ু নির্ণায়ক যন্ত্রের মতো বানিয়ে থাকেন। যারা সবসময় বায়ুর গতি বুঝে নিজেদের লক্ষ পরিবর্তন করে থাকে। বাতাসের সাথে ভেসে বেড়ানো এই সুবিধাবাদীদের সাধ্য থাকলে তারা হাওয়অকেও মাত করে দিতো এবং হাওয়া প্রবাহিত হওয়ার পূর্বেই তার গতিবেগ অনুমান করে নিজের কিবলা করে নিতো।
হে আল্লাহ! তুমি তোমার অনুগ্রহ দ্বারা আমাদেরকে সর্বদা হকের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার মত দৃঢ়তা দান করো। তোমার রাস্তায় তোমারই সন্তুষ্টিলাভের জন্য যে বিপদই আসুক না কেন তা হাঁসি সহ্য করার মত মনোবল প্রদান করো। হে প্রভু! আমরা যখন তোমার শাহী দরবারে উপস্থিত হবো তখন যেন তুমি আমাদের ওপর পুরোপুরি সন্তুষ্ট থাকো এ ছাড়া আমাদের আর কোন চাওয়ার নেই।
এখানে হতাশার কোন স্থান নেই
এই মহান ব্যক্তি (মুর্শিদে আ’ম) হতাশাকেও ককনো তাঁর ধারে কাছেও ঘেঁষতে দিতেন না বরং তাঁর আশা দুনিয়া ও দুনিয়ার সবকিচু থেকে বিশাল ছিল বাহ্যত হতাশাব্যঞ্চক পরিস্থিতিতেও তিনি আশার আলো দেখতে পেতেন। দুর্দিনে ও সুদিনের দীপ্তি তার দৃষ্টিতে সম্মুখে উদ্ভাবিস হয়ে উঠতো। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে তিনি বিশেষ নেয়ামত লাভে ধন্য হয়েছিলেন। তাঁর অন্তর ছিল বিশ্বজাহানের মালিকের সাথে একান্ত সম্পর্কিত। তাঁর সহ্য ক্ষমতা ছিল খাঁটি ইস্পাতের চেয়েও শক্ত ও মজবুত। সর্বশক্তিমান আল্লাহর সত্তাই ছিল তাঁর সাহায্যের উৎস। প্রত্যেক ব্যাপারেই কিছু না কিছু ব্যতিক্রম থাকে কিন্তু আল্লাহ তায়ালার কুদরত ও ক্ষমতা অসীম তাতে ব্যতিক্রমের লেশমাত্র নেই।
নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ
একবার আমি মুর্শিদে আ’ম-এর সাথে কালয়ুবিয়া প্রদেশের তুখ শহর সফরে গিয়েছিলাম। শহরে খুবই জাঁক-জমক ও আজিমুশ্বান জালসা অনুষ্ঠিত হয়। উচ্চ প্রতিধ্বনি এবং শ্লোগানের আওয়াজ শুনতে পেলাম যেন প্রতিটি জিনিসই শান-শওকতের প্রদর্শনী করছিলো। জালসা শেষে আমরা সেই রাতেই কায়রো ফিরে আসি। পথিমধ্যে মুর্শিদে মুহতারাম আমাকে জিজ্ঞেস করেন “এই জলসা সম্পর্কে তোমার মতামত কি?”
আমি আরজ করলাম, “শোরগোল ও গগণ বিদারী শ্লোগানের আওয়াজ আমার জন্য সান্ত্বনাদায়ক নয়। আমার নিকট এগুলো ঢোলের মতই মনে হয়। আপনি যখন ঢোলে হাত মারবেন তখন প্রচন্ড আওয়াজ হবে। কিন্তু যদি তার ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখেন তাহলে দেখবেন সেখানে কিছুই নেই। শুধু মাত্র খালি ঢোলই রয়েছে।”
আমার কথা শুনে তিনি বললেন: “দেকুন আমরাতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের পদাঙ্ক অনুসরণ করে থাকি। তাঁর অবস্থা ছিল এই যে, বাজার এবং মেলায় পর্যন্ত গিয়ে তিনি লোকদের নিকট আল্লাহ তায়ালার পয়গাম পেশ করতেন। প্রত্যুত্তরে জনগণ ঠাট্টা-বিদ্রুপ ও অত্যাচার-উৎপীড়ন এবং জুলুম-নিপীড়ন দ্বাড়া তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতো। তাহলে কি মানুষের উদাসীনতা ও অনাগ্রহের ভাব প্রদর্শনে আমাদের সবর করা উচিত নয়? প্রকৃত সত্য হচ্ছে, যদি হাজারো জনতার মধ্যে থেকে একজন বিবেক-বুদ্ধিসম্পনন ব্যক্তিও আমাদের প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠে তা হলে এই সফলতা আমাদের জন্য গোটা পৃথিবী ও তার মধ্যস্থিত সমস্ত ধন-সম্পদ অপেক্ষা অধিক মূল্যবান।” এভাবে মুর্শিদে আ’ম আমাদের অন্তরে আশার আলো জ্বালিয়ে দিতেন এবং আল্লাহর পথে আতিত বিপদে ধৈর্য ধারণের শিক্ষা প্রদান করতেন।
হাসানুল বান্না রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আমাদেরকে এসব শিক্ষা তার অফিসে কিংবা ক্লাস রুমে অথবা লেকচার হলে বসিয়ে পড়াতেন না, কিংবা শুধু তাত্বিক ও দার্শনিক বুলিই শিক্ষা দিতেন না বরং তিনি আমাদেরকে বাস্তব ক্ষেত্রেও সবকিছু শিখিয়েছেন। আমাদের নিজেদেরকে অটলভাবে টিকে থাকতে এবং অন্যদেরকে লৌহদন্ডের ন্যায় মজবুত ও বলিষ্ঠভাবে স্থির থাকতে শিক্ষা দিতে ও উদ্ভূত প্রত্যেক সমস্যা দৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করার প্রশিক্ষণ তিনি তার বাস্তব অনুশীলন দ্বারা আমাদের শিখিয়েছেন। আমি তাঁর সাথে দূর দূরান্তে অবস্থিত শহরের, পশ্চাতপদ গ্রামের এবং দূরতিক্রম্য কঙ্করময় পথে দীর্ঘ সফর করেছি। আমাদের পদযুগল ধুলাবালিতে একাকার হয়ে যেতো এবং কখনো পিচ্ছিল পথ ধরে একাধারে চলতে থাকতো। কোন কোন সময় কর্দমাক্ত রাস্তায় চলতে হতো, দীর্ঘ সফরে চলতে চলতে আমার শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে যেতো এবং বার বার ঘাম মোছার ফলে আমার রুমাল নিংড়ানোর উপযুক্ত হয়ে যেতো। সফরকালীন সময়ে আমি আমার দ্বীনি ভাইদের সাথে মসজিদের বিছানার ওপর শুয়ে পড়তাম কিংবা কখনো কোন সাধারণ হোটেলে রাত্রিযাপন করতাম- যদি মসজিদে অথবা কোন মেজবানের নিকট শোবার জায়গা না হতো। আমাদের খাদ্য হতো পরিমাণে অল্প এবং শুল্ক নিরস। বাইয়াতের দায়িত্বানুভূতি আমাদেরকে নিজেদের পছন্দনীয় জিনিস ত্যাগ করার জন্য অনুপ্রানিত করতো। আমি মুর্শিদের নিকট বাইয়াত করে এই শপথ নিয়েছিলাম যে, শরীয়াত অনুমোদিত প্রতিটি কাজে আমি তাঁর শর্তহীন আনুগত্য করে যাবো।
আপনাকে আমি মুর্শিদে আ’ম-এর প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও সহৃদয়তার দৃষ্টান্ত তো অনেকই দিতে পার তথাপি কয়েকটি উদাহরণই যথেষ্ট মনে করবো। আপনি দেখতে পাবেন এই দৃষ্টান্তগুলো বাস্তব নমুনা পেশ করে থাকে। একদিন আমি মুর্শিদের সাথে একটা সমাবেশে গিয়েছিলাম। সমাবেশ শেষে আমরা দু’জনই ঘরের অপর অংশে চলে যাই যেখানকার এক কামরায় আমাদের জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। আমরা এসব দাওয়াতি অভিযানে বস্তুগত আরাম-আয়েশ থেকে বঞ্চিত থাকতাম। কিন্তু মানসিক প্রশান্তিতে হৃদয় ভরে যেতো। আমরা কক্ষের ভেতর প্রবেশ করলাম যাতে কিছু সময়ের জন্য শারীরিক আরাম লাভ করা যায়। কক্ষের মধ্যে দু’টো চৌকি ছিল এবং প্রত্যেক চৌকির ওপর একটা করে মশার ছিল। কেননা এই অঞ্চলে মশার উপদ্রব ছিল। মশাগুলোও ছিল বড় বেয়াড়া, উদর ভর্তি করে যতক্ষণ পর্যন্ত মনুষ্য রক্তপান করতে না পারতো ততক্ষণ অবধি তারা শান্ত হতো না। আমি পরবর্তী সময় কোথায় যেন পড়েছিলাম যে মশা যতক্ষণ ক্ষুধার্ত থাকে ততক্ষণই জীবিত থাকে। কিন্তু পেট ভরে রক্ত পান করলেই মারা যায়।
যাই হোক মুর্শিদ এক চৌকির ওপর শুয়ে পড়লেন, এবং মশারিও খাঁটিয়ে নিলেন। আমিও তাঁর অনুকরণ করে অন্য চৌকিতে মশারি নীচে শয্যা গ্রহণ করলাম। এই সফর কালে ক্লান্তি ও অবসাদ এতবেশী পেয়ে বসেছিলো যে, তা বর্ণনা করে শেষ করতে পারবো না। আমি সম্পূর্ণ পরিশ্রান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েছিলাম। পাঁচ মিনিট পর মুর্শিদের আওয়াজ কানে ভেসে আসলো, “ওমর ঘুমিয়ে গেছো?” আমি জবাব দিলাম, “এখনোও ঘুমুতে পারিনি!” এভাবে কিছুক্ষণ পর পর প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি চলতে থাকলো। এমনকি শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটি আমার নিকট অশ্বস্তিকর বোধ হতে লাগলো। আমি মনে মনে ভাবলাম যতটা ক্লান্তি আমাকে ইতিপূর্বেই অবসন্ন করে ফেলেছে তা কি যথেষ্ট নয় যে, এর ওপর তিনি আরো কিছু যোগ করেছেন। তিনি কি আমাকে ঘুমুতে দিবেন না? মনের ভেতরে একটি খেয়াল উদয় হচ্ছিলো এবং নিজে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, মুর্শিদ যদি আবারো প্রশ্ন করেন তাহলে নীরব থাকবো। যাতে তিনি মনে করেন যে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। যেই কথা সেই কাজ। আমার চুপ থাকায় তিনি সত্যিই ভাবলেন যে, আমি নিদ্রার কোলে আশ্রয় গ্রহণ করেছি। অতপর তিনি চুপিসারে সন্তর্পণে চৌকি থেকে উঠে পড়লেন এবং দরজার কাছে গিয়ে কাঠের স্লিপার হতে নিয়ে নগ্ন পায়ে হাম্মাখানায় গিয়ে অজু করলেন এবং বিশ্রাম কক্ষ থেকে একটু দূরে অন্য কামরায় একটা ছোট জানামায বিছিয়ে তাহাজ্জুদের নামাযে মনোনিবেশ করলেন। তিনি সেখানে ততক্ষণ পর্যন্ত তার রবের হুজুরে নফল পড়তে থাকেন যতক্ষণ আল্লাহ তায়ালা তাকে তৌফিক দিয়েছেন। এদিকে তো মাশাআল্লাহ চৌকির ওপ আমার অবসন্ন দেহ এলিয়ে দিয়ে অঘোরে নিদ্রা সুখ ভোগ করছিলাম। সকালে আমি যখন জেগে উঠি তখন এই নীরব বাস্তব শিক্ষা স্মৃতিপটে পুরোপুরি জাগ্রত ছিল যা গত রাতে আমার নিজ চোখে দেখতে পেয়েছিলাম।
আল্লাহ তায়ালা মুর্শিদকে এমন শক্তিশালী ও সুগঠিত শরীর দান করেছিলেন যে, তিনি দিনভর মানুষের সাথে কথাবার্তা বলতেন, বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা করতেন এবং রাত্রিবেলা যখন লোকজন বিশ্রাম গ্রহণের জন্য নিজ নিজ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়তেন তখন নামমাত্র বিশ্রামের পর মুর্শিদ তার মাওলার সমীপে রুকূ’ ও সিজদায় অবনত হতেন। তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকেই এই বিশেষ তাওফীক দান করা হয়েছি লো। তাই তিনি দিবা-রাত্রি ইবাদাত ও তাওয়াদের কাজে নিবিষ্ট থাকতে পারতেন।
অনুসারীদের মাঝে তখনো এতটুকু শক্তি সৃষ্টি হয়নি যে, তারা তাদের মুর্শিদের মত কষ্ট সহ্য করতে পারে। আবার মুর্শিদ নিজেও তাদের এই দুর্বলতা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত ছিলেন। অতএব পূর্ণাংগ স্নেহের সাথে তিনি অনুসারীদের আরামের প্রতি যত্নবান থাকতেন যেন তাতে কোন বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়। মুর্শিদ কখনো চাইতেন না যে, তার অনুসারীগণ তারই কারণে কোন প্রকার কষ্টের সম্মুখীন হোক। খুবই স্বাভাবিক যে, যদি তিনি আমাকে জানিয়ে তাহাজ্জুদের জন্য উঠতেন তা হলে আমাকেও আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে সান্নিধ্য দিতে হতো। আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য সবকিছু সহজ ও সুগম করতে চান, তাদেরকে কোন প্রকার কষ্টে ফেলতে চান না। (আরবী*************) তাই এই কুরআনী নির্দেশ ও প্রশিক্ষণ পদ্ধতির আলোকে মুর্শিদ সর্বদা ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেন। প্রথমে তিনি তাঁর অনুসারীদের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করতেন তারপর তাঁর রবের ইবাদাত ও নৈকট্য লাভের চেষ্টায় রত হতেন।
এটাই প্রকৃত প্রশিক্ষণ ও বাস্তব শিক্ষা। যাকেই কোন দল কিংবা কোন দেশ ও জাতির নেতা নির্বাচিত করা হোক না কেন তাঁর কর্তব্য হচ্ছে অনুরূপ কর্মনীতি গ্রহণ করা। তাকে জাতি ও দলের জনগণের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করতে হবে সর্ব প্রথম এবং নিজের আরামের চিন্তা করতে হবে সর্ব শেষে।
মুর্শিদে আ’ম (র)-এর অভ্যাস ছিল তাঁর ভাষণ শেষ হলে তিনি অগ্রসর সাথীদের নিয়ে পৃথক বৈঠকে মিলিত হতেন। (যেন তাদের নিকট থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন।) এরা হতেন এমন নিষ্ঠাবান লোক যাদেরকে মুর্শিদ ভালভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তাঁর একান্ত সান্নিধ্যের জন্য মনোনিত করতেন এবং যাদের মধ্যে তিনি কল্যাণ ও মংগলের লক্ষণ দেখতে পেতেন। মুর্শিদ নিজেই ছিলেন একটা স্বতন্ত্র আন্দোলন। তিনি না কখনো ক্লান্ত হতেন আর না কখনো অধৈর্যও হতেন। আত্মার জন্য শুধু এটাই জরুরী নয় যে, শুধু মাত্র নিজের দেহকেই জীবিত রাখবে বরং তার জন্য অধিকতর জরুরী হচ্ছে যার সাথেই সে মিলিত হবে তাকেই জীবনের নেয়ামতরাজি দ্বারা ধন্য করে দেবে।
আদর্শ সমালোচনা
তোয়াহা হোসাইন প্রণীত গ্রন্থ “মুছতাকবিলুসসাকাফাতে ফি মিছর” (মিসরের সাংস্কৃতিক ভবিষ্যত) মুদ্রিত ও প্রকাশিত হলে ইসরাম বিরোধী গোষ্ঠীসমূহ তার প্রশংসায় আকাশ পাতাল মুখরিত করে তোলে। বইটির প্রচার প্রপাগান্ডা এতবেশী করা হয় যে, এই বিষাক্ত প্রপাগান্ডার ফলে অধিকাংশ যুবকের মন-মস্তিষ্ক বিষিয়ে ওঠে এবং তরা এই গ্রন্থে পরিবেশিত সমস্ত বাতিল ও ভিত্তিহীন তত্ব ও তথ্যকে খাঁটি সত্য বলে মনে করতে থাকে। ইমাম হাসানুল বান্না এই বিপদ উপলব্ধি করতে পারেন এবং তিনি যাতে এই গ্রন্থের ওপর তাঁর সমালোচনা পেশ করতে পারেন সেজন্য ইউনিভার্সিটির কর্মকর্তাদের নিকট দাবী করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এই দাবী মেনে নিতে টালবাহানা ও গড়িমসি করতে থাকেন। কিন্তু দাওয়াতে ইসলামীর নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের চরম ও অনমনীয়তার ফলে প্রশাসনকে অবশেষে নতি স্বীকার করতে হয়। অনন্তর শাইখ ব্রবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখে লিখিত অনুমতি প্রদানের দাবী করেন। পত্রে তিনি তার সুপরিচিত নাম হাসানুল বান্না লিখিত স্বাক্ষর করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত ধৃষ্ঠতার সাথে এই পত্র প্রত্যাক্রান করেন এবং বলেন কেবলমাত্র এই শর্তে অনুমতি দেয়া যেতে পারে যে, বক্তা তার পুরো নাম হাসান আহমদ আবদুর রহমান লিখবেন। শাইখ কোন পরিচিতির মুখাপেক্ষী ছিলেন না। তাই তিনি এসব ছোট ছোট বিষয় কখনো তার অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রতিবন্ধকত রূপে দাঁড় করাননি। তিনি এসব খুটিনাটি ব্যাপার থেকে ছিলেন অনেক উর্ধ্বে। মুর্শিত তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয় পত্র পাঠিয়ে ব্যবস্থাপনার দাবী পূরণ করেন। তিনি কখনো চাইতেন না যে, কোন মহৎ ও উন্নত উদ্দেশ্রের সম্মুখে এ ধরনের মামুলী বিষয় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াক।
থিয়েটা হল (যেখানে লেকচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল) কানায় কানায় ভরে গেলো। অথচ সমবেত শ্রোতার সংখ্যা এত বেশী ছিল যে, বিশাল থিয়েটার হলও তা ধারণের জন্য যথেষ্ট হলো না। এই ভরা মজলিশে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হাসানুল বান্না দাঁড়িয়ে তার বক্তব্য পেশ করতে লাগলেন। তিনি আলোচ্য বইয়ের যথোপযুক্ত সমালোচনা করে এক একটি বিষয় বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করলেন। ফলে তোয়াহা হোসাইনের বিপজ্জনক সংকল্প সুস্পষ্টরূপে ধরা পড়লো। তোয়াহা হোসাইনের বিশ্বাব ছিল এই যে, পাশ্চাত্য সভ্যতা সংস্কৃতি রপ্ত করার ব্যাপারে কোন প্রকার দ্বিধা-সংকোচ থাকা উচিত নয়।
পশ্চিমা সভ্রতা যা কিচুই হোক আর যেমনই হোক না কেন তার সমুদয় সৌন্দর্য ও ত্রুটিসহই পুরোপুরি গ্রহণ করা আবশ্রক। তার মতে পশ্চিমা উন্নতি অগ্রগতি এবং উন্নত জীবন যাত্রার মান অর্জন সেই সভ্যতার প্রতি পুরো আনুগত্য প্রকাশ ছাড়া আদৌ সম্ভব নয়।
মুর্শিদে আ’ম-এর ভাষণ কয়েক ঘন্টা পর্যন্ত চলতে থাকে। এই পর্যায়ে তিনি বইয়েল ওপর জ্ঞানগর্ভ পর্যালোচনা করতঃ ঐ সকল গোপন চক্রান্ত ও বিপজ্জনক পরিণতিসমূহ বিস্তারিতভাবে উপস্থিত জনতার সম্মুখে আলোচনা করে গ্রন্থকারের মূল উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। শ্রোতামন্ডলী ও সর্বস্তরের জনগণের ওপর এই বক্তৃতার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। যুবকদের মন-মগজে পাশ্চাত্য সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের যে ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছিলো তা সম্পূর্ণরূপে বিদূরীত হয় এবং গ্রন্থের খ্যাতিও উবে যায়। মার্কেটে ও বুকস্টলে বইটর চাহিদার দারুণ ভাটা পড়ে। এমনিভাবে প্রাইমারী স্কুলের একজন শিক্ষক আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন একজন ডক্টরেট ডিগ্রীধারী ব্যক্তির ওপর সুস্পষ্ট বিজয় লাভ করেন। তিনি এমন এক ডক্টর যাকে (তার স্তবকরা) আবরী সাহিত্য এবং প্রাচ্য জগতের নেতা মনে করতো। প্রকৃতপক্ষে তিনি (তোয়াহা হোসাইন) না ছিলেন নেতা না ছিলেন সত্যিকার মর্যাদা লাভের যোগ্য। (সব রকম প্রচার-প্রপাগান্ডা সত্ত্বেও) মানুষ তোয়াহা হোসাইনের স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত হয়ে যায়। তিনি আরবী সাহিত্যের স্তম্ভ কিভাবে হতে পারেন যখন তার রুচিবোধ আরবী এবং ইসলামী নামও কষ্টদায়ক মনে হয়। অতএব (কে না জান যে) তার সন্তানদের নাম আরবী কিংবা ইসলামী নাম নয় বরং ফরাসী ভাষায় রাখা হয়েছে।
সাহিত্য সমালোচনা
(আরবী************)
“যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য অর্থাৎ তার দ্বীনের সহায়তা কর তাহলে আল্লাহ তায়ালাও তোমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবেন এবং তোমাদের পা মজবুত করে দেবেন।”
এই দীর্ঘ বক্তৃতার সময় ইমাম উক্ত গ্রন্থের বিভ্রান্তিকর বিষয়গুলো কঠোর সমালোচনা করেন কিন্তু ব্যক্তি তোয়াহা হোসাইন সম্পর্কে তাঁর মুখ থেকে সমালোচনা মূলক একটি কথাও উচ্চারিত হলো না। অতপর আমি জানতে পেরেছি যে, এরূপ সমালোচনা নীতির কারণে তোয়াহা হোসাইন নিজেও ইমামের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন এবং তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন।