দ্বিতীয় অধ্যায়
ইখওয়ানের সাথে আমার সম্পর্ক এবং হাসানুল বান্না শহীদের সাথে আমার সাক্ষাতের ঘটনা বড় হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষনীয়। এ সাক্ষাতকারের সূচনাপর্ব শুনেই আপনি সমাপ্তি পর্বের বিবরণ উপলব্ধি কতে পারবেন। আমি যখন ওকালতির ব্যবসায় গ্রহণ করি তখন শাব্বিনুল কানাতের এলাকায় দপ্তর খুলে বসি। আমার বাসস্থান ছিল পেম্বার থেকে এগার কিলোমিটার দূর তিলমেসানী ফার্মে। আমি ঘর থেকে অফিসে যাতায়াতের সময় বাস এবং রেলগাড়িতে ভ্রমণ করতাম। গৃহে আমার কাজ ছিল মুরগী পালন। এই খামারে আমি আমার মানসিক প্রশান্তির জন্য যে মুরগীর খামার খুলেছিলাম তাতে মোরগ-মুরগী ছাড়াও নানা জাতের কবুতর এবং খরগোশও পালতাম। এই ফার্মেই ছিল আমার থাকার ঘর। এবং সেখানেই ছিল মনোলোভা এক পুষ্পোদ্যান।
১৯৩৩ সালের প্রথম দিকের কথা। সেদিন ছিল শুক্রবার। আমি তখন ফুল বাগানে বসে ছিলাম। ফার্মের চৌকিদার এসে আমাকে খবর দিলো দু’জন আপ টু ডেট লোক আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। আমি আমার পরিবার পরিজনকে অন্দর মহলে চলে যাওয়ার জন্য ইংগিত করলাম এবং চৌকিদারকে মেহমানদরে ভেতরে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলাম। দু’জন যুবকই ভিতরে প্রবেশ করলো এবং তাদের পরিচয় প্রদান করলো। তাদের কেজন ছিলেন ইজ্জত মুহাম্মাদ হাসান আর অপর জনের নাম ছিল মুহাম্মাদ আবদুল আল। প্রথমোক্ত ব্যক্তি ছিলো শাব্বিনুলি কানাতের কসাইখানার কর্মচারী এবং শেষোক্ত ব্যক্তি ছিলেন ডেল্টা রেলওয়ে ষ্টেশনের ষ্টেশন মাষ্টার। মেহমানদের স্বাগত জানানো ও আথিথেয়তার কিছু সময় কেটে গেল। চা পান শেষে ইজ্জত মুহাম্মাদ হাসান নীরবতা ভংগ করে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এখানে কি করেন?” এ ধরনের প্রশ্ন আমার কাছে অদ্ভূত মনে হলো। আমি তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পেলাম এবং কৌতুকের ভংগীতে জবাব দিলাম, “আমি এখানে মুরগীর বাচ্চা পুষি।”
আমার কৌতুককর জবাবে মেহমানদের স্নায়ুর ওপর অস্বাভাবিক প্রভাব পড়লো না। বরং জবাব শুনে ইজ্জত মুহাম্মদ হাসান বললেন, “আপনার ন্যায় নওজোয়ানদের জন্য মুরগীর বাচ্চা পালনের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ অপেক্ষা করছে।” আমি এখনো পর্যন্ত গাম্ভীর্যের পরিবর্তে রসিকতা পূর্ণ মেজাজেই কথাবার্তা শুনছিলণাম। সুতরাং আমি সেই ভংগিতেই পুনরায় প্রশ্ন করলাম, “সেটা কি জিনিস যা মুরগীর বাচ্চা অপেক্ষা অধিক আমার মনোযোগ ও প্রশিক্ষণের উপযুক্ত?” মেহমান গাম্ভীর্য সহকারে প্রত্যুত্তরে আজর করলেন, “মুসলিমগণ আপনার মনোযোগ লাভের অধিক উপযুক্ত। তারা তাদের দ্বীন থেকে দূরে সরে পড়েছে এবং এই উদাসীনতা তাদেরকে এতবেশী প্রভাবহীন করে দিয়েছে যে, তাদের নিজের দেশেও তাদের কোন গুরুত্ব এবং বিন্দুমাত্র ইজ্জত ও সম্মান নেই। বিশ্বের জাতিসমূহের মধ্যে তাদের অস্তিত্ব ও অবস্থান তো না থাকার সমান।”
“আমি এই জটিল ব্যাপারে কি করতে পারি বলুন। আমর শক্তি সামর্থই বা এমন কি আছে?”
মেহমানগণ বললেন যে, এ ময়দানে আপনি একা নন। বরং আপনার মত যুবকদের একটা সংগঠন গঠিত হয়েছে। এক মহান ব্যক্তি সাইয়েদ হাসানুল বান্না এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতহা এবং মুর্শিদে আ’ম। কিছুদিন পর সেই যুবক দু’জন পুনরায় আমার দপ্তরে আগমন করেন এবং আমাকে বলেন যে, সাইয়েদ সাহানুল বান্নাহর সাথে আমার সাক্ষাতের কর্মসূচী তৈরী হয়ে গেছে। মুর্শিদে আ’ম কায়রোস্থ ইলিকিনিয়া রোডের ছিরামিয়া এলাকায় আবদুল্লাহ বেগ মহল্লাহয় থাকতেন।
পূর্ব নির্ধারিত সময়ে আমি মুর্শিদে আ’ম-এর বাসায় দরজায় গিয়ে পৌঁছি। দরজার কড়া নাড়তেই বড় দরজা খুলে গেলো। আমি দ্বারদেশে করাঘাত করলাম এবং জবাবে একটা আওয়াজ শুনতে পেলাম “কে?” আমি বললাম: “শাব্বিনুল কানাতির থেকে আগাত এডভোকেট ওমর তিলমেসানী”। সংগে সংগে তিনি ওপরের কক্ষ থেকে নীচে নেমে আসেনে এবং আমাকে স্বাগত জানান। অনন্তর বাইরের দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সময় ডান পার্শ্বে যে কামরা ছিল তার দরজা খোকলেন। আমি মেজবানের পেছনে পেছনে সেই রুমে গিয়ে প্রবেশ করি। কক্ষটি ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাই কামরার মধ্যে কি আছে তা আমি মোটেও অনুমান কতে পারলাম না। মেজবান কক্ষের একমাত্র জানালাটি খুলে দিলে ভেতরে আলো প্রবেশ করলো। তখন আমি লক্ষ করলাম যে কক্ষটি অত্যন্ত সাদাসিদে এবং সাদা গোছের ছোট একটা অফিস। দপ্তরের মধ্যে রাখা কয়েকখানা চেয়ার যেগুলো গতানুগতিকভাবে কাঠ মিস্ত্রীদের হাতে তৈরী। চেয়ারগুলোর ওপর কিচু ধূলাবালি জমে ছিল। মেজবান একটি চেয়ারে বসলেন এবং আমার বসার জন্যে অপর একটি চেয়অর এগিয়ে দিলেন। মূল্যবান সুট পরে সেই চেয়ারে বসা আমার কাছে কিছু অপসন্দনীয় মনে হলো। কিন্তু আমি পকেট থেকে রুমাল বের করে চেয়ারের ওপর বিছিয়ে বসে পড়লাম। মেজাবান কৌতুহলী দৃষ্টিাতে আমাকে নিরীক্ষণ করছিলেন। তাঁর ঠোটে স্নেহ দরদভরা হাঁসি যেন নৃত্যু করছিল।
আমি লক্ষ্য করলাম এবং মনে মনে ভাবলাম যে, মুর্শিদে আম’ম হয়তো আমার এই কীর্তিকলাপ দেখে বিস্মিত হয়েছেন। এখানে দু’টি ভিন্ন পথ ছিল। যে ব্যক্তি ফ্যাশন পূজারী এবং উন্নত ও মূল্যবান পোশাকের প্রতি যত্নবান সে দাওয়াতে হকের কঠিন রাস্তায় কিভাবে চলতে পারবে? কোথায় বাহ্যিক কেতাদুরস্ত ঢঙে চলা আর কোথায় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর দাবী? দাওয়াতে হকের দায়িত্ব তো জীবনে কঠোর পরীক্ষা বিপদাপদ নিয়ে আসে। এর সাথে একত্মতা প্রকাশ করলে আরাম এয়শ ও ভোগ বিলাস সবকিচুই ত্যাগ করতে হয়। দুঃখ-কষ্ট ও মসিবত বরদাশ করতে হয়। একাকীত্ব ও নিঃস্বঙ্গতার জ্বালা সইতে হয়।
আমার বাহ্যিক জাঁকালো অবয়ব সত্ত্বেও মুর্শিদে আ’ম এর চেহারায় কোন প্রকার অস্বস্তি বা অস্থিরতা ছিল না। সাধারণ মানুষ হলে আমাকে দেখা মাত্র দাওয়াতে হকের দায়িত্ব পালনে অনুপযুক্ত মনে করে বসতো। কিন্তু মুর্শিদে আ’ম অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আমার কাছে তার পয়গাম ও কর্মসূচী পেশ করতে শুরু করলেন। কি ছিল তার পয়গাম? তার পয়গামের মূল কথা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই ছিল যে, “শরীয়াতের বিধি-বিধানের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জন এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জনসাধারণের মধ্রে মানসিক প্রস্তুতি ও অনুভূতির তীব্রতা সৃষ্টি করতে হবে। সর্বসাধারণের সম্মুখে এই সত্যটি উদঘাটিত ও সুস্পষ্ট রূপে তুলে ধরতে হবে যে, কোন প্রকার কল্যাণ ও মঙ্গল একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারো থেকে লাভ করা সম্ভব নয়। তাঁর দেয়া জীবন বিধান ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত করতে হবে…..”
“হাসানুল বান্না শহীদ অত্যন্ত সফল ও কার্য়কর ভংগিতে দাওয়াত পেশ করলেন। আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত গভীর মনোনিবেশ সহকারে তাঁর সমস্ত কথা শুনলাম। তাঁর কথা বলার মাঝে আমি একবারও কোন কথা বলিনি। বক্তব্য শেষ করে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি আমার সাথে ঐকমত্য পোষন করতে পারছেন?” আমার মুখ খোলার পূর্বেই তিনি পুনরায় বলতে লাগলেন, “দেখুন! এখনই জবাব দেয়ার প্রয়োজন নেই। আপনাকে পুরো এক সপ্তাহ সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে কুব গুরুত্বের সাথে চিন্তা-ভাবনা করে দেখুন। হৃদয় দিয়ে অনুভব করুন। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে মূল্যায়ণ করুন। স্বীয় বিবেকের রায় গ্রহ?ণ করুন। আমি আপনাকে পিকনিক কিংবা আনন্দ ভ্রমণের দাওয়াত দিচ্ছি না?। আমি আপনাকে যে কথার দিকে উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি তা অত্যন্ত দুঃসাহসী লোকদের কাজ। আপনার মন যদি এতে সাড়া দেয় এবং আল্লাহ তায়ালা এ কাজের জন্য আপনার হৃদয় মনকে উদার ও উন্মুক্ত করে দেন তা হলে খুবই ভাল কথা। আগামী সপ্তাহে বাইয়াতের জন্য আসুন। আর যদি এ কাজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে না পারেন তা হলেও কোন দুশ্চিন্তার কারণ নেই। আমার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, আপনি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের একজন হিতাকাংখী বন্ধু।”
যে ঈমান সঞ্জীবনী মজলিশে বসার এবং অতুলনীয় কথাবার্তা দ্বারা উপকৃত হওয়ার সৌভাগ্য আমি লাভ করেছি তারপরও কি কেউ বাইয়াত (আনুগত্য শপথ) গ্রহণ করতে মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব করতে পারে? (কিন্তু যেহেতু মুর্শিদের নির্দেশছিল তাই সে দিনের মত) আমি চলে আসলাম এবং আদেশ মোতাবেক এক সপ্তাহ পর পুনরায় যথা সময়ে গিয়ে হাজির হলাম। আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করে হাসানুল বান্নার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলাম। এই বাইয়াত ছিল আমার জীবনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্র ও সৌভাগ্যজনক ঘটনা। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সাথে বিগত প্রায় অর্ধ শতাব্দিরও অধিক সময় যাবৎ কাজ করার সম্মান আমি লাভ করেছি। এই বাইয়অতের পর যখন থেকে আমি হকের রাস্তায় চলতে শুরু করলাম তখন থেকেই পরীক্ষা নিরীক্ষা ও বিপদ-মুসিবতের যাতাকলে পিষ্ট হয়ি আমাকে চলতে হয়েছে। এসব ঘটনা ইতিহাসের অংশ। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মুখোমুখি হওয়ার পশ্চাতে আমার রবের সমীপে তার যথাযথ পুরস্কার লাভের প্রত্যাশা ছাড়া আমার আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না। (আমার বিনম্র প্রার্থনা) এসব ত্যাগ ও কুরবানী শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য গণ্য হোক এবং এর পুরস্কার ও পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকটই নির্ধারিত থাকুক।
আমার মনের ঐকান্তিক আকাংখা হলো, আজকের যুবক মুসলিমগণ এই বৃদ্ধ (তিলমেসানী) থেকে যিনি তাঁর জীবনের আশিটি বসন্ত পেরিয়ে এসেছেন এই শিক্ষা গ্রহণ করুক যে, আল্লাহ তায়ালা (পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য থেকে) যা কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন তা অত্যন্ত ধৈর্য ও স্থৈর্যের সাথে সহ্য করতে হবে এবং আল্লাহ তায়ালার মর্জির ওপর সর্বদা সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
আল্লাহ তায়ালার কোন ফায়সালা এবং ভাগ্যের ব্যাপারে তিল পরিমাণ আপত্তি ও অসন্তোষ প্রকাশ করবে না। আমার আরো কামনা হলো সর্বদা আল্লাহর রহমাত ও সাহায্য আমার ওপর বর্ষিত হতে থাকুক আর যখন আমি এই নশ্বর পৃথিবী থেকে চিরদিনের তরে সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করবো তখনো যেন আল্লাহর পথের একজন সৈনিক হিসেবে তার নিকট যেতে পারি। আমার আন্তরিক বাসনা হলো আমার সমস্ত আশা ভরসা ও চাওয়া পাওয়া যেন আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্কিত থাকে। তার সত্য প্রতিশ্রুতির ওপর থাকে আমার এমন পরিপূর্ণ বিশ্বাস যা অনুরণিত হয় আমার প্রতিটি শিরা উপশিরায়। যে পর্যন্ত আমার এমন সৌভাগ্য ও মর্যাদা লাভ না হয়ে যায় যে, আমি আমার নিজ চোখে আমার মওলা ও মনীব এবং প্রভু ও প্রতিপালককে দেখতে পাই অথবা আপন হাত দ্বারা স্পর্শ করতে পারি। আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই ও নিরাপত্তা ও সফলতার যোগ্র তাকওয়ার অধিকারীগণকেই বানিয়েছেন। আমি আল্লাহ তায়ালার নিকট এই দোয়া করছি তিনি যেন আমাকে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সকল সদস্যকে সত্যিকার অর্থে তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত করেন এবং আমাদেরকে তার সাহায্য ও সহযোগিতা লাভের উপযুক্ত বানিয়ে দেন…..।”
ইমাম হাসানুল বান্নার সাথে আমি আমার প্রথম সাক্ষাতের কাহিনী বর্ণনা করলাম। আমাদের মধ্যে যে কেউ-ই ইমামের সাথে সাক্ষাত করেছেন সে-ই এ ব্যাপারে অবগত যে শহীদ আমাদের সাথে প্রথম সাক্ষাতেই সমস্ত কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করছেন। তিনি আমাদেরকে কোন মিথ্যা আশ্বাস দেননি। আমাদেরকে তিনি এমন কথা কখনো বলেননি যে, এই পথে পা রাখার সংগে সংগেই সমগ্র পৃথিবী আমাদের স্বাগত জানানো ও বরণ করে নেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়বে। কিংবা আমাদের গলায় ফুলের মালা পরাতে এগিয়ে আসবে অথবা জীবনের ভোগ বিলাস ও আরাম-আয়াসের উপায় উপকরণ অপেক্ষা করতে থাকবে। না কখ্খনো নয়। বরং তিনি আমাদেরকে সর্বদা সাবধান ও সতর্ক করে দিয়েছেন যে, দাওয়াতে হকের রাস্তা কন্টকাকীরণ কঠিন উপত্যকা পরিক্রমা মাত্র। বড়ই বন্ধুর ও দুরতিক্রম্য এই পথ, যে কেউ-ই এই দাওয়াত কবুল করতে এগিয়ে আসুক না কেন তাকে ভালভাবে বুঝে শুনে অত্যন্ত সাবধানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তারপর যখন নির্যাতনের যাতাকলে ঘুরতে আমম্ভ করবে তখন কাউকে দোষারোপ করা উচিত নয়। বরং বলিষ্ঠ হাতে ধৈর্যের লাগাম ধরে স্থরিভাবে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। মুর্শিদে আ’ম কখনো কাউকে প্রতারিত করেননি। বরং প্রথম থেকেই এই পথের দাবী সম্পর্কে অবহিত করে এসেছেন।
অতপর তারা যখন সাহসের সাথে কোমর বেঁধে এই কাফেলার সংগে চলতে থাকে তখন আল্লাহ তাদের অন্তরে পারস্পরিক ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। তাদের আন্তরিক সম্পর্ক এত গভীল যে, মানুষ তা দেখে হতবাক হয়ে যায়। এমনকি কেউ বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, “যদি কোন ইখওয়ানী আলেকজান্দ্রীয়ায় চীৎকার করে উঠে তা হলে আসওয়ানের ইখওয়ানী তা শুনতে পায়।” আর আমি বলে থাকি যে, আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এত মজবুত ও নিবিড় যে, ইউরোপে অবস্থানকারী কোন ইখওয়ানী যদি কোন জিনিসের আকাংখা করে আর কানাডায় বসবাসরত কোন ইখওয়ানী তা জানতে পারে এবং বুঝেন যে, তিনি তা পূরণ করতে পারেন তা হলে তার চাওয়ার পূর্বেই তিনি তা পূরণ করে দেবেন। এ জন্য শর্ত শুধু একটিই, তা হচ্ছে এরূপ কামনা বাসনা আল্লাহর আনুগত্যের সীমার মধ্যে হতে হবে, এর বাইরে যাওয়া চলবে না।
সত্য পথে চলতে গিয়ে আমি কঠিন মসিবত সহ্য করেছি। কিন্তু কখনো কোন অভিযোগ উত্থাপন করিনি। ইবরাহীম আবদুল হাদী মরহুম এবং জামাল আবদুল নাসের মরহুমের হাতে নির্যাতনের যাতাকলে আমার অন্যান্য ইখওয়ানী সাথীদের মত আমিও বছরের পর বছর ধরে পিষ্ট হয়েছি। কিন্নতু আমি এই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে কখনো কোন অশালীন উক্তি করিনি। কিংবা মনে কোন প্রকার বিদ্বেষও পোষণ করিনি, কেননা আমার বিষয়টি আল্লাহ তায়ালার নিকট সোপর্দ করে দিয়েছি।
ইবরাহীম আবদুল হাদীর নির্যাতন
১৯৪৮ সালে ইবরাহীম আবদুল হাদী আমাকে সর্বপ্রথম গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য কারাগারে বন্দী করে এবং তুর পাহারে নির্বাচিত করে। কিন্তু মানুষ তার সমস্ত চক্রান্ত সত্ত্বেও খুবই দুর্বল ও অসহায়। ক্ষমতার যে মসনদে বসে গর্বে ও অহংকারে মানুষের বুক ফুলে ওঠে অথচ সেই মসনদ তার শেষ রক্ষা করতে পারে না। অবশেষে ইবরাহীম আবদুল হাদীও মসিবতে পড়ে যায় এবং তার মসনদও বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অতএব আমাকে ও আমার অপর দুই কয়েদী বন্ধু জনাব মুহাম্মাদ আল আল বাহী মরহুম ও উস্তাদ মুহাম্মাদ আল খাদরামীকে (আল্লাহ তার হায়াত দীর্ঘায়িত করুন) তুর থেকে তার কাছে ডেকে পাঠায়। পুলিশের কড়া নিরাপত্তায় প্রধানমন্ত্রী দপ্তরে আমাদেরকে নিয়ে হাজির করা হয়। আমাদেরকে একটা প্রশস্ত কামরায় নিয়ে বসানো হয়। উজীরে আযম ইবরাহীম আবদুল হাদী তার দফতরে উপস্থিত ছিলেন। আমাদেরকে এক এক করে তার চেম্বারে ডেকে পাঠানো হয়। সর্বপ্রথম মরহুম মুহাম্মাদ আলবাহীর ডাক পড়ে, তারপর উস্তাদ আল্ খাদরামীর এবং সর্বশেষে ডাকা হয় আমাকে। আমাদেরকে একে একে প্রধান মন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করানো হয়।
উস্তাদ আল্ খাদরামকী যখন প্রধানমন্ত্রীর কক্ষে উপস্থিত ছিলেন তখন করিম সাবিত পাশা মরহুম (অন্যতম মন্ত্রী) দ্রুত গতিতে বাহির থেকে আসেন। দেখে মনে হচ্ছিল যে, কেউ পেছন দিক থেকে তাকে জোরপূর্বক ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুত গতিতে সে প্রধান মন্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করে এবং কয়েক মিনিট পর তড়িৎ গতিতে আবার বাইরে বেরিয়ে আসে। সে অত্যন্ত অস্থির ছিল। বস্তুত উজীরে আযমের রূঢ়তা ও কঠোরতার কারণে ছোট বড় নির্বিশেষে সবাই তটস্থ ছিল।
বর্বরতা ও পাশবিকতার প্রতীক নাসের
অত্যঅচার উৎপীড়ন ও জুলূম নিপীড়নে জামাল আবদুন নাসের ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ইবরাহীম আবদুল হাদী ছিল কঠোর ও নিষ্ঠুর। কিন্তু নাসেরের ব্যাপারই তো ছিল আলাদা। ইবরাহীমের অত্রাচার-নির্যাতনের যেখানে সমাপ্তি ঘটতো নাসেরের জুলুম নির্যাতন সেখান থেকে শুরু হতো। অত্যাচার ও নির্যাতনের এমন সব অমানবিক পন্থা নাসের উদ্ভাবন করেছিল তা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় কামনা করি। সে তার পরে আগমনসকারী অত্যাচারীদের সর্বজন স্বীকৃতম উস্তাদ হিসেবে পরিগণিত।
শিক্ষা লাভের জন্য দর্শন
ইবরাহীম আবদুল হাদীর শাসনকালের সমাপ্তি ছিল নির্মম ও শিক্ষণীয়। যার বিবেক একেবারে মরে যায়নি সে অবশ্যই এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা লাভ ক রতে পারে। ঈদের পূর্ব রাতে বাদশাহ উজীরে আযমকে পদত্যাগ করার নির্দেশ দেন। এই জালিম ব্যক্তির পদত্যাগের খবর ঈদের দিন পত্র-পত্রিকায় লাল ব্যানার হেডে মুদ্রিত হয়। প্রত্যেক পত্রিকা তাদের উল্লাস প্রকাশ করতে গিয়ে জাতিকে সুসংবাদ পরিবেশন করে যে, শাহ্ ফারুক উজীরে আযমকে বরখাস্ত করে দেশবাসীকে ঈদের শ্রেষ্ঠ উপহার প্রদান করেছেন। আহ! তারপর আগমনকারীগণ এই লাঞ্ছনাকর ও শিক্ষনীয় পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতো। কিন্তু ক্ষমতার নেশাতে মানুষকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে থাকে। তাই দেয়ালের লিখন কে পাঠ করবে এবং সুবিবেচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে?
পিস্তলের নল
যাই হোক এখন উজীরে আযমের সাথে সাক্ষাতের কাহিনী শুনুন। যখন আমার পালা আসল আমি প্রধান মন্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করলাম। আমার আবা ছিল আমার কাঁধের ওপর। আমি সালাম দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লাম। কিন্তু উজীরে আযমের অবজ্ঞানজনক আচরণ ছিল দেখার মত। সে আমার সালঅমের জবাব পর্যন্ত দিল না। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, সেই সময় তিনি বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতিতে আটকে গিয়েছিল। আমি নিজেই আলোচনার সূচনা করে উজীরে আযমের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জটিলতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলাম। এই সময় একজন বড় অফিসার ওমর হোসাইন আমার পিঠের ওপর পিস্তলের নল তাক করে দাঁড়িয়েছিল সম্ভব সে তখন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইনচার্জ ছিল। মনে করুন তার পিস্তলের নল আমার কানপট্টি স্পর্শ করছিলো। একবার মনে করলাম পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে তা জ্বালাই। কিন্তু বিবেক বাধা দিলো। কারণ পকেটে এই মুহূর্তে হাত দেয়া নিশ্চিত মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানানো ছাড়া কিছু নয়। যদিও কক্ষে প্রবেশের অব্যবহিত পূর্বেই সিকিউরিটির লোকজন খুব ভাল করে আমার বডি তল্লাসী করেছিলো কিন্তু যে ব্যক্তি পিস্তল উঁচিয়ে দন্ডায়মান ছিল তার ওপর কি ভরসা করা যেতে পারে যে, আমার হাত নাড়ানোকেই সে প্রধানমন্ত্রীর ওপর আক্রমণের উদ্যোগ মনে করে গুলী করে বসবে না? এমতাবস্থায় যদি আমি জীবন দিয়ে দিতাম তাহলে আল্লাহ তায়ালার কাছে তো অবশ্যই শাহাদাতের মৃত্যু বলে গণ্য হতো। কিন্তু কোন প্রকার মোকাবিলা ছাড়া জীবনটা দিয়ে দেয়াও তেমন ভাল কোন কাজ নয়।
উজিরে আযমের প্রতিক্রিয়া
কিছুক্ষণ পর প্রধান মন্ত্রী আমার সাথে কথা বলতে শুরু করেন এবং কোন প্রকার ভূমিকা ছাড়াই আসল মতলব ব্যক্ত করলেন। তথাপি বিদগ্ধ পাঠকদের মনোরঞ্জনের জন্য একটা কথা বলে রাখা জরুরী মনে করি। আর তা হচ্ছে, তার কথার ভংগী আনোয়ার সাদাতের ভংগী থেকে ছিন্ন ছিল। আনোয়অর সাদাতের সাথে সাক্ষাতের সময় “ওমর, ওমর!” বলে সম্বোধন করতো। কিন্তু ইবরাহীম আবদুল হাদী “ওস্তাদ ওমর” বলে কথার সূচনা করেন। তিনি বলেন, “ওস্তাদ ওমর” আমি আপনাকে শুধু তিনটা প্রশ্ন করতে চাই। যদি আপনি সঠিক জবাব দেন তাহলে আপনাকে এবং অন্য সমস্ত ইখওয়ানী কয়েদীদেরকে সংগে সংগে মুক্ত করে দেয়া হবে। এর অন্যথা হলে জেনে রাখুন সব কয়েদীর কয়েদ ও নজর বন্দীর সমস্ত দায়িত্ব আপনার ওপর বর্তাবে। কেননা আপনারা ইখওয়ানের হাই কমান্ডের সদস্য।
১। আপনাদের অস্ত্রশস্ত্রের গুদাম কোথায়?
২। সেই স্টেশনটি কোথায় যেখান থেকে আপনারা অস্ত্রশস্ত্র বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করে থাকেন?
৩। ইখওয়ানের গুপ্ত সংগঠনের নেতা কে কে?
আমি তাকে যথার্থ উত্তর দিলাম যে, “আপনার এসব প্রশ্নের কোন একটির জবাবও আমার কাছে নেই।” অতএব আমাদেকে তুরের পরিবর্তে পুনরায় আল হাইকসিতার জিন্দানখানায় পাঠিয়ে দেয়া হলো।
ইমাম হাসানুল বান্নার শাহাদাত
ইবরাহীম আবদুল হাদীর আমলে ইখওয়ানের যে ভূমিকা ছিল, সুধী পাঠক একটু চিন্তা করলেই স্বাভাবিকভাবেই তা উপলব্ধি করতে পারবেন। আমরা ইবরাহীমের ক্রোধ ও রোষাণলের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলাম। কারণ আমরা জনসাধারণকে বিরাজমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিয়ে আসছিলাম। আমরা জাতির মন-মগজে একথা বদ্ধমূল করে দিচ্ছিলাম যে, দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করা হচ্ছে। এবং সরকার জনগণের যাবতীয় অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। এটা ছিল সেই সময়ের কথা যখন “আযাদ অফিসার কিংবা মুক্ত কর্মকর্তাগণের” নামও কেউ শুনেনি। জাতির মধ্যে উপলব্ধি ও সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টার প্রতি লক্ষ্য করুন। অতপর আমাদের সম্পর্কে বিপ্লবী “আযাদ অফিসারগণের” তৎপরতাও নিরীক্ষণ করুন। আবদুন নাসের ও তার সহযোগীরা আমাদেরকে বিপ্লবের শত্রু উপাধিতে ভূষিত করে। সে তো নির্লজ্জতার এমন নিম্নস্তরে পৌঁছে গিযেছিল যে, আমাদের ইমাম শহীদ হাসানুল বান্নার শাহাদাতের অভিযোগও আমাদের ওপরই আরোপ করে। আমাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ ছিল এই যে, ইমামের শাহাদের পর আমরা আনন্দোৎস করেছিলাম এবং মিষ্টান্ন বিতরণ করেছিলাম। কবির ভাষা:
বিবেক ও কান্ডজ্ঞান লোপ পেলে বিস্ময়ের আর কি থাকে যে তার পর এরূপ কথাবার্তা বলে বেড়ানো স্বাভাবিক।
বায়ুমান যন্ত্র মেরাগ
আমাদের বিরুদ্ধে অপবাদ আরোপ করে কারা? বিপ্লবের অধিনায়ক এবং তাদের তপ্লীবাহক সাহিত্যিক ও সাংবাদিকগণ। আজ পর্যন্তও এই গীত গাওয়া অব্যাহত গতিতে চলছে। যে কেউ-ই শাসক গোষ্ঠীর প্রিয়পাত্র হতে চায়- সে-ই এ সস্তা হাতিয়ার ব্যবহার করে ইখওয়ানের ওপর ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপ করতে শুরু করে। শাহ্ ফারুকের আমলে আমরা তার ভুল ও অন্যায় কার্যক্রম এবং স্বেচ্ছাচারী হস্তক্ষেপের পুরোপুরি সমালোচনা করতাম। কিন্তু এই সব সুশীল ও সাহসী সাহিত্যিক ও সাংবাদিকগণ তাদের মর্যাদাবোধের প্রকাশ ঘটাতো এভাবে যে, তারা শাহের স্তব স্তুতি ও প্রশংসা গীতিতে ভরা লম্বা চওড়া প্রবন্ধ লিখতো এবং তাকে আসমানে পৌঁছিয়ে দিতো। শাহ সম্পর্কে তাদের লিখনীও ভাষায় লেখা হতো:
“প্রথম শিক্ষক”
“মিশরের প্রথম প্রকৌশলী”
“জন্মভূমির প্রথম নিষ্ঠাবান কর্মী”
এভাবে তার জন্য সর্বক্ষেত্রে “সর্ব প্রথম” শব্দ প্রয়োগ করতো। এমনকি তারা এমন সব কথা বলতো ও লিখতো যাতে লজ্জা শরমের আর কোন বালাই থাকতো না। তারপর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলে এই কলমধারীগণই তাদের কলম ও মুখ দ্বারা এতদিন যে ফারুকের প্রশংসায় অগ্রগণ্য ছিল এখন তাকেই “ঘৃণার পাত্র” ও “হত্যার উপযুক্ত” প্রভৃতি বিশেষণ লাগাতে শুরু করে।
এই মহত্ব ও নীচতা
বিপ্লবের প্রারম্ভে এই শরীফ ও খান্দানী সাহিত্যিকগণের লক্ষ্য বস্তু ছিল ফারুক। কিন্তু যখন জামাল আবদুল নাসের ও ইখওয়ানের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয় তখন কামানের নল একেবারে ঘুর যায়। এখন ইখওয়ানের ইজ্জত ও সম্ভ্রম নিয়ে খেলা এই সাহিত্যিকগণেল পেশায় পরিণত হয়। নাসেরের এই ধামাধরা গোষ্ঠী বাতাসের গতি এমনভাবে ফিরিয়ে দেয় যে, তাকে আকাশের উচ্চতারও উপরে নিয়ে যায়। আবার নাসের যখনই চক্ষু মুদিত করেন তখন এই সম্ভ্রান্তরাও তাদের নৃত্যের তাল পরিবর্তন করেন। এখন তাদের কাছে মিসরের ইতিহাসের অন্ধকারময় ও কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়। নাসেরের শাসনকাল। এই লোকদের এতটুকুও লজ্জা শরম নেই যে গতকাল পর্যন্ত যার গুণ-কীর্তন করেছে আজই তার কবরের ওপর জুতোর আঘাত করছে সবটুকু শক্তি দিয়ে।
সাদাতের ক্ষমতার দন্ড হাতে নেয়ার পর এই চাটুকদাররা তাদের চিরাচারিত অভ্যাস অনুযায়ী তার প্রশংসা বর্ণনায় তাদের কলমের পূর্ণ শক্তি ব্যয় করে। তারা তাকে একেবারে হিরো বানিয়ে দেয় এবং ইতিহাসের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তিত্ব ও উজ্জল নক্ষত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। এই পুরো সময়কালে ইখওয়ান প্রত্যেক শাসকের হাতেই জুলুমের চাকায় পিষ্ট হতে থাকে।
ফেরেশতা থেকে শয়তান
সাদাতের বিবেক ও কান্ডজ্ঞানেরই বা কি হয়েছিলো যে, সে তার পূর্ববর্তীদের আচরণ ও পরিণাম স্বচক্ষে দেখার পরও সেই ধোঁকা ও প্রতারণার জালে জড়িয়ে পড়ে। অথচ তার ভালভাবেই জানা ছিল এই চিত্র শিল্পীগণ যারা প্রতিটি উদীয়মান সূর্যের পূজারী, আবার যখনই কোন তারকার ওপর কোন প্রকার বিপদের পাহাড় ভেংগে পড়ে তখন তাকে কঠোর ভাষায় গালি দিতেও তাদের কোন প্রকার দ্বিধা হয় না। আফসোস ও দুঃখ হয় এ জন্য যে, যদি তারা সতর্কতার সাথে কাজ করতো এবং শিক্ষা গ্রহণ করতো কিন্তু ক্ষমতার লোভ ও গদীর নেশায় বিবেক ও অনুভূতিই লোপ পেয়ে থাকে। অতএব সাদাতও তার পূর্ববর্তী শাসকগণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এবং তাদের পরিণতিই বরণ করতে বাধ্য হয়। এসব সাহিত্যিকদের লিখনী ও মুখ “হাতিয়া”র কলমও মুখের রূপ পরিগ্রহ করেছে। ফলে সাদাত “ফেরেশতা” থেকে হঠাৎ শয়তানে পরিণত হয়। (‘হাতিয়া’ আরবী ভাষার এমন এক কুখ্যাত কবি যার চেহারাও ছিল কদাকার ও বিশ্রী। অন্যের সমালোচনা ও দোষ বর্ণনায় সে ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আর অন্যায় সমালোচনার কারণে হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা) তাকে কিছুদিনের জন্য নজর বন্দীও করেছিলেন। সে যে কোন ব্যক্তির দোষ বর্ণনায় সদা প্রস্তুত থাকতো। এমন কি হতভাগা তার নিজেরও সমালোচনা করতে অভ্যস্ত কঠোরভাবে। নিজের দোষত্রুটি বর্ণনায় সে এমন সব কথাবার্তা বর্ণনা করতো যা আদৌ বর্ণনাযোগ্য নয়।)
বিপ্লবের প্রাথমিক গতি
২৫শে জুলাই-এর বিপ্লব দিবসের আগমনে জাতি পরিবর্তনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। আযাদ ফৌজি অফিসারগণকে জনসাধারণ আনন্দের সাথে স্বাগত জানায়। এই ব্যাপারটি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী ছিল। কারণ এটা শুধু একজন মন্ত্রীর পদচ্যুতি ও অন্য একজনের ক্ষমতা গ্রহণ করার একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র ছিল না। বরং একটা পরিবর্তনের প্রত্যাশা প্রতিটি নাগরিকের হৃদয় মনে তরঙ্গায়িত হচ্ছিলো। আবদুন নাসের তার ক্ষমতা গ্রহণের প্রারম্ভেই ইখওয়ান ও মিসরের যুবক কয়েদীদের সকলকেই মুক্তি দিলেন। জনগণ তার এই পদক্ষেপে খুই উল্লাস প্রকাশ করল। সর্বসাধারণ একে একটা শুভ লক্ষণ বলে মনে করলো এবং সবার মাঝে এই ধারণা সৃষ্টি হলো যে, এই পরিবর্তন সম্পর্কে আযাদ অফিসারগণ ও ইখওয়ানের মধ্যে পরিপূর্ণ সহযোগিতা ও বুঝাপড়া রয়েছে। সাধারণ মানুষের উল্লাসের মৌলিক কারণ এই ছিল যে, ইখওয়ানের ওপর ছিল তাদের অবিচল আস্থা, যাদের কথা ও কাজের মধ্যে ছিল পুরোপুরি সামঞ্জস্য। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, মিসর এবার তার হৃত গৌরব ফিরে পাবে। ইখওয়ান সম্পর্কে প্রত্যেক ব্যক্তিই জানতো যে, তারা শুধু মুখে দাবী করার লোক নয় বরং কাজের লোক।
রাজনৈতিক উপলব্ধি
আমার জীবনে ইতিপূর্বেও কয়েকটি রাজনৈতিক ঘটনার উদ্ভব ঘটেছিল। আমি প্রত্যহ নিয়মিতভাবে সংবাদপত্র পাঠ করতাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনীর হাতে মিত্রবাহিনীর সৈন্যদের পিটুনির খবর আমার জন্য বিশেষ আগ্রহের কারণ ছিল। প্রখ্যাত জার্মান জেনারেল হিন্ডনবার্গ এবং তার সামরিক দক্ষতার প্রশংসায় আমি ছিলাম পঞ্চমুখ। রাশিয়ান ফ্রন্টে তার হাতে প্রায় দশ লক্ষ রুশ সৈন্যের পরাজয় ও বন্ধীত্ব বরণ তার রণদক্ষতা ও যোগ্রতার উজ্জল প্রমাণ। স্বভাবগতভাবে আমার সহানুভূতি ছিল জার্মানদের সাথে। কারণ তাদের দুশমন ইংরেজদের আমি দুই চোখে দেখতে পারতাম না। আমাদের দেশের ওপর তাদের উপনিবেশবাদী আগ্রাসন এবং অত্যাচার ও নির্যাতনের নীতি আমি কিভাবে সহ্য করতে পারি। সেই সময় খুবই মজার মজার সংবাদ পর্যালোচনা ও খবরাদি ছাপা হতো। যেমন যেসব দেশ কার্যত বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি তাদের সম্পর্কে এই পর্যালোচনা যে, “নিরপেক্ষ নীতির অনুসারী কিন্তু মিত্রবাহিনীর প্রতি সহানুভূতিশীল।” আমরা একে অন্যেল সাথে রসিকতা করতাম এবং এ ধরনের উক্তি ব্যবহার করে যথেষ্ট আনন্দ উপভোগ করতাম।
সংবাদপত্র পাঠ
আমি মিসর থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্র সংবাদপত্র আল আহরাম, আস্ সিয়াসাহ, আল জিহাদ এবং সাপ্তাহিক পত্রিকা যেমন আল মুসাওয়ির, আত্ তায়েফ, আস্ সিয়াহ, আল জিহাদ এবং আহ তিজারাহ সবগুলোর নিয়মিত পাঠক ছিলাম। আমি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবগুলো পৃষ্ঠা পড়তাম। স্কুল বন্ধ থাকলে তো বেশ অবকাশ পাওয়া যেতো এবং মন-মস্তিষ্কও চাংগা হয়ে উঠতো। পড়াশুনা ছাড়াও ফুটবল খেলার প্রতি ছিল আমার বিশেষ অনুরাগ। প্রতিযোগিতা দেখার জন্য নিয়মিত ও গুরুত্বের সাথে যেতাম যদিও আমি নিজে খেলোয়ার হতে পারিনি।
আলো ছায়া
আমার আরো একটা স্থায়ী অভ্রাস হচ্ছে আমি কথা বলি কম এবং শুনি বেশী। যদি আমার সাধ্যে কুলাতো তাহলে শুধু শুনেই যেতাম বলা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতাম। আমার মাধ্যমিক ও ইউনিভার্সিটি শিক্ষা জীবনে দেশে বড় বড় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই সময় পুরো মন্ত্রী সভার রদবদল এবং উজীর আযমের উত্থান পতন আমি আমার নিজ চোখে দেখেছি। তখনকার সময়ে প্রধান মন্ত্রীকে “নাজেরুন নাজ্জার” (চীপ ট্রাস্টি) বলা হতো। আমি সা’দ জগলুল, ইসমাঈল সিদ্কী, মুহাম্মদ মাহমুদ, (ইস্পাত কঠিন হস্তধারী) তাওফিক নাসীম, ইউসুফ দাহবা, মুহাম্মাদ সায়ীদ ও আহমদ যিওর প্রমুখকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। পার্লামেন্টে আবদুল হামীদ, আবদুল হক ও সুলাইমান গান্নামের ভূমিকা ও ভাষণ বিশেষ আকর্ষণ ও মনোযোগ সহকারে শুনতাম ও পড়তাম। সেই সময় পুরো এসেম্বলিতে অফ্দ পার্টির দুইজন মাত্র সদস্য ছিলেন। অনুরূপ সিনেটে অফদের একজন মাত্র সদস্য ছিলেন উস্তাদ আল জুনদী। সিনেটের অধিবেশনে উস্তাদ আল জুনদীর বক্তৃতা বিবৃতি অত্যন্ত জোরালো ও সাবলীল।
জনসাধারণে রেফারেন্ডাম
আমার এই চক্ষুদ্বয় এমন স্মরণীয় দৃশ্যও দেখেছে যখন শাহ্ ফুয়াদ বেলজিয়ামের একজন উপদেষ্টার নিকট তার মতামত চেয়েছিলেন। উদ্ভূত সমস্যা ছিল এই যে, উচ্চ পরিষদের সদস্য নিয়েঅগের ব্যাপারে শাহ্ এবং সা’দ জগলুল পাশা (জাতির জনক)-এর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছিলো। বাদশাহর কাছে নতি স্বীকার করার পরবির্তে সা’দ জগলুল মোকাবিলা করার নীতি গ্রহণ করেন। গোটা জাতি ছিল সা’দ-এর পক্ষে। সুতরাং একটা বিশাল ও জনাকীর্ণ মিছিল শাহী মহল “আবেদীন প্রাসাদ”-এর সম্মুখে সা’দ-এর পক্ষে জোরালো বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। আমিও এই মিছিলে বিক্ষোভ প্রদর্শনকারীদের সাথে শামিল ছিলাম। গগণ বিদারী শ্লোগান ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। শ্লোগানের প্রতিধ্বনি শুনে বেলজিয়ান উপদেষ্টা মহলের একটা জানালঅ খুলে ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে বাদশাহকে বলতে থাকেন “আলমপনা! আমার নিকট থেকে আর কি মতামত নেবেন। গোটা জাতি তার রায় প্রকাশ করে দিয়েছে।” প্রত্যেক ব্যক্তির মুখে একই শ্লোগান “সা’দ জগলুল অথবা বিপ্লব”।
আইন কলেজের শিক্ষা সমাপনী
এসব ঘটনা আমার আবেগ ও আদর্শিক মন-মানসিকতার সাথে সম্পর্কিত ছিল। কিন্তু আমি ঐসব তৎপরতার সাথে কার্যত অংশ গ্রহণ করা সত্ত্বেও কোন সময় পড়া লেখায় কোন প্রকার ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে দিইনি। আমি নিয়মিত পড়াশোনা করে যেতে থাকি, এমনকি আইন কলেজে অধ্যয়ন সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তা চালিয়ে যাই। এটা ১৯৩১ সালের কথা। এ বছর আইনের গ্রাজুয়েশন ডিগ্রী লাভকারীদের মোট সংক্যা ছিল প্রায় সাত শত। আমার খুব ভালভাবে মনে আছে যে, ইসলামী আইন বিষয়ক পত্রে আমি সর্বাধিক নাম্বার পেয়েছিলাম। লিখিত পরীক্ষা ছাড়াও মৌখিক পরীক্ষাও অনুষ্টিত হতো। আমার আজও মনে আছে যে, আমার মৌখিক পরীক্ষা নিয়েছিল আহমদ জায়িদ বেগ ও আহমদ ইবরাহীম বেগ নামের দুইজন শিক্ষক। তারা আমাকে উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কিত দু’টা প্রশ্ন করেন। আমি দু’টি প্রশ্নেরই অত্যন্ত সন্তোষজনক জবাব দেই। তারা সন্তুষ্ট হয়ে যান। আমি বলে, “আরো জিজ্ঞেস করুন।”
আমি দু’টো কারণে একথা বলেছিলাম। প্রথমত, আমার মহান ওস্তাদ আহমদ বেগ ইবরাহীম এরূপ কথায় খুবই সন্তুষ্ট হতেন। দ্বিতীয়ত, উলূমে শরীয়াতের বিষয়ে আল্লাহর রহমতে আমার জ্ঞানের ব্যপ্তি ছিল ঈর্ষা করার মত। অন্যান্য বিষয়ে খুব কষ্ট করেই পার পেতাম।
যৌবনকাল ও দুরন্তপনা
আমার ছাত্র জীবনের কতিপয় কৌতুকপ্রদ ঘটনা আজও আমার মনে পড়ে। হাসান পাশা সিদকী শিশিনী আইন কলেজে আমাদেরকে রাজনৈতিক অর্থনতি বিষয় পড়াতেন। রাজনৈতিক অর্থনীতি বিভাগের ক্লাস রুম ছিল এমন স্থানে যেখানে সিকো রেল হাউস অবস্থিত ছিল। এই বৃহদায়তন ইমারতের কোন কোন কামরা এই বিভাগের সম্মুখেই ছিল। একদিন এক পিরিয়ড চলা কালে জনাব উস্তাদ হাসান পাশা দেখেন যে, ক্লাসে সকল ছাত্র জানালা দিয়ে সিকো রেল হাউসের দিকে উঁকিঝুঁকি মারছে। অগত্যা তিনিও সে দিকে দৃষ্টিপাত করেন এবং অদূরে একটি জানালায় দুইজন যুবতী মেয়েকে দন্ডায়মান দেখতে পান। উস্তাদ ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছেন জেনে সমস্ত্র ছাত্র অত্যন্ত লজ্জিত হয়। কিন্তু হাসান পাশা সাহেব শুধু এতটুকু বলেন যে, “হয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে, এবার এসো আমরা পাঠের প্রতি মনোযোগী হই।” কলেজে আমাদের শিক্ষকগণের সবাই ছিলেন সুপন্ডিত ও পি এইচ ডি ডিগ্রীধারী। কোন কোন শিক্ষকের নামতো এখন স্মৃতিপট থেকে মুছে গেছে। কিন্তু জনাব আবদুল হামিদ আবু হাইফ, জনাব আহমদ আমীন, জনাব আল আশমাভী, জনাব শিশিনী, জনাব আল খাইয়াল, জনাব আবদুল মুতাওয়াল, জনাব ওয়াহীদ রাফাত, জনাব আমদ ইবরাহীম, জনাব কামিল মুরসী, জনাব উস্তাদুন নাহুরী এবং জনাব মুহাম্মদ সাদেক ফাহমী প্রমুখরন নাম আজও আমার স্মৃতিপটে সংরক্ষিত আছে।
আইন কলেজের মর্যাদা
আমাদের সময়ে আইন কলেজ ইউনিভার্সিটির অধীনস্থ সমস্ত কলেজ ও বিভাগসমূহের নেতৃত্ব প্রদান করতো। ছাত্রদের সমাবেশ, মিছিল ও প্রদর্শনীতে এই কলেজের ছাত্রগণই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতো। জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের মেরুদন্ডের হাড়ছিল ছাত্র সমাজ। সেকালে কতিপয় ব্যতিক্রম ব্যতীত সমস্ত মন্ত্রী উকীলদের মধ্য থেকেই নিয়োগ পেতেন। এই কারণে আইন কলেজে শুধুমাত্র প্রবেশাধিকার লাভই ছাত্রদের জন্য গৌরবের কারণ হতো। একথা শুনে আপনি হয়ত বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন যে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্কিত মন্ত্রীগণের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধপ্রতীম সম্পর্ক থাকতো বিরাজমান। অনুরূপভাবে সেইসব সাংবাদিক যারা মন্ত্রীবর্গের কোন কোন পলিসির কঠোর সমালোচনা করতেন। ব্যক্তিগতভাবে সেই মন্ত্রীগণের সাথে তাদের খুবই সৌহার্দ ও বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক ছিল। মন্ত্রী আবদুল হামীদ আবদুল হক তার মন্ত্রীত্বের আমলে সংবাদপত্র সেবীদের সাথে অধিকাংশ সময় সাক্ষাত ও প্রেস কনফারেন্স করতেন। এসব অনুষ্ঠানে তার নিজরে পার্টি অফ্দ-এর পৃষ্ঠপোষক এবং হিযবের বিরোধী শিবিরের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য সাংবাদিকগণও উপস্থিত থাকতেন। তিনি নির্বিশেষে সকল সাংবাদিকদের সাথে একান্ত ঘনিষ্ট হয়ে সম্প্রীতি সৌহার্দের ভংগীতে মত বিনিময় করতেন।
সাহিত্য রসিকতা
আবদুল হামীদ আবদুল হকের মিসরের উচ্চ এলাকার গ্রামীন বাচনভংগী এবং স্বভাব জাত প্রতিভা ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব বড় বড় বিস্ময়কর কৌতুকপ্রদ কাহিনী সৃষ্টি করতো। সাংবাদিকগণের সাথে কোন শব্দের অর্থ নিয়ে মতানৈক্যের সৃষ্টি হলে বলতেন, “লাদাইকুম আজুল” (তোমাদের কাছে কি গাভীর বাছুর আছে?) মূলত আজুল শব্দ দ্বারা তিনি উকুল বুঝাতেন অর্থাৎ তোমাদের কি বিবেক ও বুদ্ধিশুদ্ধি আছে? কিন্তু আঞ্চলিক বাচনভংগীর পার্থক্যের কারণে মাহফিলে যেন আনন্দ ও সুগন্ধির যোয়ার বয়ে যেত, তথাপি শব্দ নিয়ে বিতর্ক হতো। তিনি শব্দটির অর্থের ওপর অটল থাকতেন। সাংবাদিক জিজ্ঞেসা করতেন, আপনি যে অর্থ প্রকাশ করছেন উহার কোন প্রমাণ? প্রতুত্বরে তিনি তৎক্ষণাৎ বলতেন, “আল-জামুছ” (মহিষ) এখানে “আল-কামুস” (লেগাত বা ডিক্সনারী) কে তিনি তার আঞ্চলিক ভাষায় “আল-জামুস” বলে রসিকতা সৃষ্টি করতেন। সেই যুগে আমি কোন দিন মতামতের বিভিন্নতাকে দুশমনি ও শত্রুতার রূপ পরিগ্রহ করতে দেখিনি। বিশেষত সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং পত্রিকার সাংবাদিকগণের মধ্যে তো নয়ই।
অবসর গ্রহণ ও অধ্যয়ন
আমার যৌবনকাল বেশ শান্তি ও নিরাপদের মধ্যে কেটেছে। যৌবনের প্ররম্ভেই আমার বিয়ে হয়েছিলো এটাই হয়তো এর মূল কারণ। ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা যা নির্ধারিত করে রেখেছিলেন তাতে কল্যাণ আর মংগলই নিহিত ছিল। ছোট শহরগুলোতে আইনজীবিদের দপ্তর রাতের বেলায় খোলা রাখা হতো না। বরং সকাল আটটা থেকে দুপুর দু’টো পর্যন্তই কাজ হতো এবং তার পরই অবরসর। তাই অফিসের সময়ের পর অধ্যয়ন অনুশীলনের জন্য আমি পর্যাপ্ত সময় হাতে পেয়ে যেতাম। আমি খুব পড়াশুনা করতাম। দাবা খেলার প্রতিও এক সময় আমার কিছুটা আগ্রহ ছিল। কিন্তু আল্লাহর তায়ালার শোকর যে, তিনি এই বাজে ও অনর্থক খেলা থেকে রক্ষা করেছেন। কেননা শাবিনুল কানাতির থেকে আমি কায়রোতে চলে আসি এবং এমনভাবে কাজের মধ্যে ডুবে যাই যে, এই খেলা প্রায় পুরোপুরি ভুলে গেছি।
দ্বীনি বই–পুস্তকের প্রতি অনুরাগ
ইত্যবসরে আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে এই সময় আমি মৌলিক বই-পুস্তকগুলো পুড়ে ফেলি। যেসব লোক আমার মত পরিবেশে জীবন যাপন করে তাদের অধিকাংশেরই এসব বই-পুস্তক পাঠের সময় ও সুযোগ কমই হয়ে থাকে। কিন্তু আমার প্রতি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ রয়েছে। এসব বই-পুস্তক প্রকৃতই দ্বীন ইসলামের উৎস। এসব গ্রন্থ আমার মধ্যে এমন ব্যক্তিত্ব নির্মাণ করেছে যা আজ আমার মধ্যে আছে। যে ব্যক্তিই তার দ্বীন ও দুনিয়া সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি লাভ করতে চায় তার জন্য এসব গ্রন্থ মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করা আবশ্যক।
পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা ও সুরুচি
আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিফলন তার বান্দাদের মধ্যে দেখতে চান। অতএব আমিও আমার চলাফেরা, চাল-চলন, আচার-আচরণ ও বেশ-ভূষায় আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতের বহিঃপ্রকাশ করতাম। আমার গৃহীত পেশার মাধ্যমে এতটুকু হালাল রিযিক আমার হস্তগত হচ্ছিলো যা দিয়েই সহজেই আমর সকল প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব হতো। তাই পরিচ্ছন্নতা ও উন্নত রুচির পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহারে আমি ছিলাম প্রবাদ বাক্যের মত।
আমি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে একই রংয়ের স্যুট, সার্ট, টাই, রুমাল, মোজা ও বুট জুতা ব্যবহার করতাম। যেন প্রত্যেক স্যুটের সাথে অন্যান্য আনুসংগিক সামগ্রী, সাইজ ও রংয়ের পুরোপুর ম্যাচিং করে। সবার কাছে একথা সুস্পষ্ট থাকা দরকার যে, মুসলমান কঠোরভাবে হালাল হারামের সীমার মধ্যে অবস্থান করেও তার জাঁকজমক ও পরিচ্ছন্নতার পূর্ণ প্রকাশ ঘটাতে পারে। ইখওয়ানী নওজোয়ানগণ কখনো কোন সংকীর্ণ দৃষ্টিভংগীর শিকার হয়ে থাকেনি। তারা রাতের বেলায় থাকে তাহাজ্জুদে সিজদাবনত। আর দিনের বেলায় ঘোড়ার পিঠে। আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত ও তাঁর নৈকট্যলাভের জন্য তারা নরম ও আরামদায়ক বিছানা ছেড়ে রাতে আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল থাকেন। এবং দিনের বেলায় আল্লাহর দ্বীনের পতাকা তুংগে তুলে ধরার ও ইসলামের সামগ্রিক বিজয় প্রতিষ্ঠার জন্য নিরবচ্ছিন্ন জিহাদে লিপ্ত থাকেন।
আমি কোন জুমআর সমাবেশে বক্তব্য রাখার সুযোগ পেলে মুসলিমদের লক্ষ্য করে বলতাম এই সুন্দর দুনিয়া অমুসলিমদের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। পোশাক-পরিচ্ছদ, পানাহার, আরাম-আয়েশ ও জীবন যাত্রার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত নেয়ামতের মধ্যে যা কিছু হালাল ও পবিত্র আমি তা পুরোপুরি ভোগ ও ব্যবহারের প্রবক্তা। হযরত মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান প্রত্যেক ক্ষেত্রেই পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা পসন্দ করতেন। সাইয়েদেনা ওমর (রা) বিন খাত্তাব এ ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, “আমীরুল মু’মিনীন! আমি (সিরিয়াতে) এমন লোকদের পাশে থাকি যাদের ওপর আমার বাহ্যিক জাঁকজমকের সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়ে। এতসব সত্ত্বেও যদি আপনি নির্দেশ দেন তাহলে আমি এই জীবন পদ্ধতি বাদও দিতে পারি।” মুত্তাকী ও সাধক আমীরুল মু’মিনীন বলেন, “আমি এই ব্যাপারে তোমাকে আযাদী দিচ্ছি।”
চুপ থাকাই কল্যাণকর
আমার যৌবন বড় সৌভাগ্যের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। আমার স্বভাব বড়ই খোলামেলা এবং হৃদয়-মন বড় উদার। আমি হাসি মুখে থাকা ও রসিকতা পসন্দ করি। কিন্তু কখনো নির্থক তর্ক, বিতর্কে সময় নষ্ট করি না। কেউ আমার ওপর অত্রাচার করলেও প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে আমি তার ব্যাপারটা আল্লাহর ওপর সোপর্দ করে দেই। কোন বিষয়ে কখনো আলোচনার সময় মতপর্থক্য হয়ে গেলে আমি একগুঁয়েমি ও হঠকারিতার পরিবর্তে নিশ্চুপ হয়ে যাই। যদিও আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয় যে, আমি-ই সত্যের পক্ষে রয়েছি। যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা আমি আমার প্রতিপক্ষকে পরাভূতও করতে পারি। কিন্তু তার অনমনীয়তা ও পক্ষপাত দেখে আমি আলোচনা থেকে সরে দাঁড়ানোকেই শ্রেয় মনে করি। তাছাড়া স্বভাবগতভাবেই আমি বলার চেয়ে অধিক শুনার পক্ষপাতি।
হালাল রিযিক
অধিকাংশ লোক যৌবনের প্রারম্ভেই কিছু একটা লক্ষ্য ও আদর্শ স্থির করে নেয় এবং তা লাভ করার চেষ্টা-সাধনায় মেতে ওঠে। উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য বৈধ-অবৈধ প্রতিটি উপায় অবলম্বন তাদের কাছে বৈধ হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানীতে যৌবনেও আমার ক্ষেত্রে এ নিয়মের সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ঘটেছে। আমি দ্বীনি বই-পুস্তক অধ্যয়ন করেছিলাম যাতে আমি ইবাদাত সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে পারি এবং তদনুযায়ী আমলী জীবনও গঠন করতে পারি। আমি আমার পেশাগত জীবনেও পুরোপুরি সততা ও বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছি। যাতে আমার আয়-উপার্জন হালাল হয়। আমি মানুষের সীমালংঘনের বিনিময়ে প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তা বিবেচনা করে থাকি যাতে আমার ও অন্যান্য লোকদের মাঝে দুরত্ব ও বিচ্ছেদ সৃষ্টি না হয়।
সরকারী গুরুত্বপূর্ণ পদের প্রলোভন
সম্ভবত আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছিযে, সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে সরকারী উকিল হওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়েছে এবং বিচার বিভাগেও পদ গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমি দু’টি প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করেছি। এটা ১৯৩৬ সালের কথা, আমার এ দু’টি পদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার অর্থ এই ছিল না যে, আমি এই দু’টি পদকে ঘৃণা বা গুরুত্বহীন মনে করতাম। বরং এজন্য যে, কোন সরকারী পদ গ্রহণ করতে আমার স্বাধীনতা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছিলাম না। আমি দু’ দু’বার পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম এবং দু’বারই অকৃতকার্য হয়েছিলাম। এসব নির্বাচনে অংশ গ্রহণের পশ্চাতে আমার উদ্দেশ্য শুধু এই ছিল যে, সত্যের পতাকা সুমন্নত করার জন্য আমি এই অতি গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফরম ব্যবহার করতে পারবো। অন্যথায় মন্ত্রীত্ব ও পদের কোন খেয়াল কখনো আমার অন্তরে স্থান পায়নি।
ওকালতির পেশা প্রশস্ত ময়দান
আমি লোকদের সম্মান করি কিন্তু কাউকে ভয় পাই না। আমি প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে সমতা ও মানবিক সাম্যের ভিত্তিতে কাজ কারবার করার পক্ষপাতি। আমার প্রকৃতির সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল বলেই আমি ওকালতির পেশা গ্রহণ করেছি। কেননা এই পেশার সাহায্যে মানুষের কাছে এমন সব বিষয় উন্মোচিত হয়ে থাকে যা অন্য কোন পেশার দ্বারা সম্ভব নয়। ডাক্তার, প্রকৌশলী এবং অন্যান্য পেশাজীবী শ্রেণীর একটা নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ ক্ষেত্র থাকে। অথচ ওকীলদের সামনে থাকে বিশাল জগত। আইনজীবী তার পেশার প্রয়োজনে জীবনের অন্যান্য দিক ও বিভাগ সম্পর্কেও অনেক কিছু জানার সুযোগ পায়। কারণ, আদালতে বিভিন্ন মোকদ্দমা চলাকালে হরেক রকমের শৈল্পিক ও পেশাভিত্তিক রিপোর্ট তাকে দেখতে হয়।
দ্বীনের দাবী
আমি আমার কর্ম জীবনে যথার্থভাবে দায়িত্ব পালন করতে শুরু করি তখন থেকে যখনই ইখওয়ানের হকের পথের কাফেলার সহযাত্রী হই। এটা ছিল এমন একটি সময় যখন আমার মধ্যে এই অনুভূতি জাগ্রত হয় যে, আমার দ্বীন আমার নিকট দাবী করে যে, তার সাহায্য ও প্রচার প্রসারের জন্য আমার সমস্ত শক্তি সামর্থ ও যোগ্যতার ব্যয় করা দরকার এজন্য যদি অলিগলি ও রাজপথের সর্বত্র হামাগুড়ি দিয়েও চলতে হয়। সেদিন আমার নিকট এই রহস্য উন্মোচিত হয় যে, কুরআন মজীদ কেবল মাত্র তাবীজ তুমার ও সওয়াব এবং বরকত হাসিলের গ্রন্থ নয়। এ গ্রন্থ নাযিল করার উদ্দেশ্য কখনো এ নয় যে, একে বরকতের জন্য পকেটে রেখে দেয়া হবে অথবা সুগন্ধি মেখে ভ্রান্তির তাকের ওপর সাজিয়ে রাখা হবে। কিংবা হিফাজতের জন্য এর কপি মোটর গাড়ীতে রেখে দেয়া হবে। এসব উদ্দেশ্য তো নিসন্দেহে হাসিল হয়েই থাকে। কারণ, তা যাবতীয় কল্যাণের উৎস, এবং নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী। কিন্তু তা থেকেও বড় মর্যাদা বা সম্মান যা এ গ্রন্থের অবতীর্ণকারী একে প্রদান করেছেন তা হচ্ছে, একে জীবনদর্শন ও জীবন ব্যবস্থা বানাতে হবে। আকীদা ও রাজনীত, অর্থনীতি ও সমাজ, আখলাক ও আদাব, যুদ্ধ ও সন্ধি, ক্রয়-বিকয়, কৃষি ও বাণিজ্য, চিকিৎসা ও চিকিৎসা বিজ্ঞান মোটকথা মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগ কুরআনের নির্দেশ মোতাবেক ঢেলে সাজাতে হবে। তাহলেই এই বিজ্ঞানময় মহাগ্রন্থ মানুষের ইহকালীন কল্যঅণ ও পরকালীন মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করবে। মুসিলম উম্মাহ যতদিন এর হিদায়াত ও নির্দেশনার ওপর আমল করেছেন ততদিনেই তারা দুনিয়ার সর্বাধিক শক্তিধর ও সম্মানিত জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। আমীরুল মু’মিনীনের মুখ নিঃসৃত এক একটি অক্ষরের গুরুত্ব পৃথিবীর প্রতিটি কোণে উপলব্ধি করা হতো। এই জাতিই কুরআনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বসে এবং তার নির্দেশনার ওপর আমল করার পরিবর্তে তা দ্বারা শুধুমাত্র বরকত হাসিল করার নীতি অবলম্বন করে তখনই তাদের উন্নতি অবনতিতে রূপান্তরিত হলো এবং মর্যাদার স্থলে অপমান ও লাঞ্ছনা তাদের ললাটের লিখন হয়ে গেলে খিলাফতের অবসান ঘটলো এবং তার কল্যাণও তিরোহিত হলো। অতপর আমরা অধপতনের এমন অতল গহ্বরে পৌঁছে গেলাম যে সম্পর্কে সবাই অবহিত। এখন আমাদের থাকা আর না থাকা সমান। উম্মতের এই অধপতন সম্পর্কে আমি অনবহিত ছিলাম না। কিন্তু ভাবছিরাম এর প্রতিকার করা যাবে কিভাবে? ইখওয়ানের দাওয়াত কবুল করার পর এই সমস্যার সমাধান আমি খুঁজে পেয়েছি। তখন আমি জানতে পারলাম যে, আমাদের গৌরবোজ্জল অতীত আবারও প্রত্যাবর্তন করতে পারে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ সোনালী রংগে রংগীন হয়ে উঠতে পারে যদি আমরা কুরআন, সুন্নাহ এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের শিক্ষার ওপর আমল করতে পারি। এবং সালফে সালেহীন ও ফুকাহায়ে ইসলামের ইজমার অনুসরণ করি। এটাই ইখওয়ানের দাওয়াতের মূল কথা। আর এর মধ্যেই রয়েছে উম্মাতে মুসলিমার দোজাহানের কল্যাণ নিহিত।