সাতাশতম অধ্যায়
মাঝে মধ্যে সেই প্রাচীন কিস্সা কাহিনীর সান্নিধ্য লাভ
আমি ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বার বার সফর করেছি। উদ্দেশ্য নিজের দুর্বল শরীরের বিভিন্ন চিকিৎসা করা। যখনই আমি চিকিৎসা ব্যাপদেশে কোন দেশে যাই তখন ইউরোপ ও আমেরিকার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ইখওয়ানরা আমার চারপাশে এসে সমবেত হয়। দলে দলে তাদের আগমন আমার নিরাপদে সেখানে গিয়ে পৌঁছার আনন্দে কিংবা শীঘ্রই আমার আরোগ্য লাভের প্রত্যাশার কারণে হতো না। বরং তারা তাদের সেই দ্বীনি ভাইকে এক নজর দেখার জন্য আগমন করতো যিনি মুর্শিদে আ’ম হাসানুল বান্না শহীদের সাথে তাঁর জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ অতিবাহিত করেছেন। তারা তাদের সেই দ্বীনি ভাইকে দেখ, তার কথাবার্তা শুনে এবং তাঁর মজলিশে বসে নিজেরা নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করে। কারণ তাদের এই দ্বীনি ভাই শহীদ ইমামের সাথে দাওয়াতী কাজে অংশগ্রহণ করেছে। তাঁর প্রশিক্ষণ লাভে ধন্য হয়েছে এবং তার কাজকর্ম ও আচার আচরণকে নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করার মর্যদা লাভ করেছে। যে সংস্কারকের দাওয়াতী কর্যক্রম এই যুবক শ্রেণীর জীবন বিপ্লব সাধন করেছে। তাদের আকংখা ও ঐকান্তিক কামনা হলো, হায়! যদি এই মাহপ্রাণ ব্যক্তিকে তার জীবদ্দশায় স্বচক্ষে তারা একবার দেখতে পেতো। এখন যেহেতু ইমাম শহীদকে দেখাতে আর সম্ভব নয়, অতএব তাঁর সংগীদেরকে দেখেই এসব যুবক সন্তুষ্ট হয়ে যায়। বর্তমান যুগে ইসলামী রেনেসাঁর যে তরঙ্গ পরিদৃষ্ট হচ্ছে তাতে ইমামের খুব বড় পরিচিত করেছেন। আমার এই যুবক ভাইয়েরা ইমাম শহীদের দাওয়াতকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। তারপরও তারা সেই ব্যক্তির মুখ থেকে কিছু শুনতে চান যিনি তাদের সম্মুখে নিকট অতীত ও সুদূর অতীতের ঘটনাবলীর চিত্র অংকন করতে পারেন। এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে এর শত্রুরা মিথ্যা ও বাতিলের যত ষড়যন্ত্র রচনা করেছে তার সবকিছুই এই সাক্ষাতের সময় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়।
হিজাযের পথের ধুলাবালির আকাংখা
এ দ্বীনের দুশমনদের সংখ্যা অনেক এবং সর্বত্রই তারা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু যেভাবে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের বিরুদ্ধে দ্বীনের দুশমনরা সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়ে থাকে এরূপ অন্য কোন ইসলামী সংগঠনের বিরোধীতা করতে সাধারণত তাদের দেখা যায় না। এখন প্রশ্ন হলো ইখওয়ানের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালানোর ব্যাপারে ইসলামের শত্রুরা এত বেশী তৎপর কেন? ইখওয়ান কি কোন নতুন দ্বীন নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল? ইখওয়ান কি কিতাব ও সুন্নাহ ব্যতীত অন্য কোন জিনিসের আনুগত্য ও অনুসরণ করছিলো? তারা কি জুলুম ও সন্ত্রাসের পথ অবলম্বন করেছিলো? কখনো নয়। ইখওয়ান এসব জিনিস থেকে বহু দূরে এবং এখনও রয়েছে। আমাদের দেশপ্রেম এবং দ্বীনের সাথে সম্পর্কের স্বরূপ আমদের রবই ভাল জানেন। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় সুদৃশ্য এলাকা এবং চিত্তাকর্ষক দৃশ্য রয়েছে কিন্তু আমার দৃষ্টিতে তা প্রিয় জন্মভূমির ধূলিকণার সমতুল্যও নয়। অনুরূপভাবে দুনিয়ার কোন জিনিসই মকবুল হজ্জের রাস্তার তুলনায় আমার নিকট প্রিয় নয়।
যাবের রুটি ও আলী হয়দারের বাহু
হাসানুল বান্না শহীদ মজলুমদের আর্তচিৎকারে সাড়া দেয়ার ব্যাপারে ছিলেন সর্বাপেক্ষা নির্ভীক ব্যক্তিত্ব। তিনি কোন বড় বিপদকেও তোয়াক্কা করতেন না। বরিপুরুষ মাত্রই সকল মুসিবতক্লিষ্ট লোকের সাহায্যার্থে জালিমের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। মজলুম তার পরিচিত হোক বা না হোক তাতে কিছু এসে যায় না। পক্ষান্তরে ভীরু ও কাপুরুষ ব্যক্তি তার জাতির প্রতিরক্ষা এবং আপনজনদের সহযোগিতায় এগিয়ে যাওয়া থেকেও পালিয়ে বেড়ায়।
মিসরে এমন একটা সময়ও এসেছিলো যে, রাতের বেলা রাস্তা ঘাটে ডাকাতি হতে লাগলো। পেশাগত অপরাধীরা সড়কের ওপর বিপদগ্রস্ত হওয়ার ভান করে দাঁড়িয়ে যেতো এবং গাড়ী থামানোর জন্য ইশারা করতো। যেই মাত্র কোন গাড়ী থামতো সংগে সংগে তারা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো এবং আরোহীদের মালপত্র ও কাপড় চোপড় লুট করে নিয়ে যেতো। সে আমলেরই কথা, ইমাম হাসানুল বান্না কোন সফর থেকে মধ্যরাতে কায়রো ফিরে আসছিলেন। রাস্তার মধ্যে একস্থানে তিনি সড়কের পার্শ্বে একটা প্রাইভেট কার দাঁড়ানো দেখতে পেলেন। যার পাশে এক ব্যক্তি সড়কের ঠিক কিনারে দাঁড়িয়ে তাঁর গাড়ি থামানোর ইংগিত দিচ্ছে। ডাকাতির খবরাখবর ইতিমধ্যে প্রত্যহ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিলো। তথাপি ইমাম গাড়ীর চালক ভাইকে গাড়ী থামানোর নির্দেশ দিলেন। তিনি একাকী গাড়ী থেকে বের হলেন এবং সেই ব্যক্তির জাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞস করলেন যে, তার কি প্রয়োজন! সে জানালো যে, তার গাড়ীর পেট্রোল ফরিয়ে গেছে তাই সে নিকটবর্তী পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত যাওয়ার মত পেট্রোল দেয়ার অনুরোধ করছে। তৎকালে বর্তমান সময়ের ন্যায় গাড়ীতে হর্ণ থাকতো না। বরং একটা ধাতু নির্মিত নল থাকতো যার এক প্রান্তে লাগানো থাকতো রবারের বেলুন। হর্ণ দেয়ার জন্য ড্রাইভার সে রাবারের বেলুনের ওপর চাপ দিতো তখন বাতাস হর্ণের মধ্যে আওয়াজ সৃষ্টি করতো। ইমাম সাথে সাথে তার গাড়ীর হর্ণ খুলে নিলেন। কয়েকবার তাতে পেট্রোল ভর্তি করে উক্ত অজ্ঞাত পরিচয় মুসাফিরের গাড়ীর টেম্কিতে ঢেলে দিলেন। অথচ ইমাম সে ব্যক্তির নিকট তার নামটি পর্যন্ত জানতে চাইলেন না। কিংবা তার মর্যাদা ও ধর্ম সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করার প্রয়োজন বোধ করলেন না ……………….. সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের কাজই এই যে, তারা মহৎকার্যাবলী সম্পাদন করেও নীতির ওপর অটল থাকেন। এ আচরণে সেই অচেনা ব্যক্তি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে। সে নিজেই ইমাম শহীদকে জানালো “আমার নাম মুহাম্মাদ আবদুর রাসূল? আমি কায়রো আদালাতের আকজন জজ। আপনার পরিচয়? “ইমাম শহীদ তার স্বভাবসুলভ বিনয়ী ভংগীতে আরজ করলেন, “আমার নাম হাসানুল বান্না, আমি সাবতিয়া প্রাইমারী স্কুলের একজন শিক্ষক।” জজ সাহেব অনুসন্ধানী ভংগীতে জিজ্ঞেস করলেন, “হাসানুল বান্না! ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মর্শিদে আ’ম !!” ইমাম শহীদ জানালেন, “জি-হা।” সেদিন থেকে দিয়ে মুহাম্মাদ আবদুর রাসূল মরহুম আদালত এলাকার মহল্লায় ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সব চেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ও হিতাকাংখী হয়ে যান। শাবিনুল কানাতির আদালতের জজ থাকাকালে মরহুম জজ সাহেব নিজে এ ঘটনা তার এক বন্ধুকে শুনিয়েছিলেন।
এই ছিলেন সেই হাসানুল বান্না যাকে বিপজ্জনক, সন্ত্রাসী এবং সকল অনিষ্টের মূল নায়ক বলে অবিহিত করা হয়ে থাকে। সারা বিশ্বের মুসলিম সরকারগুলো তার নাম নিশানা মুছে ফেলতে চেষ্টারত। এই মহাপ্রাণ ব্যক্তির মহৎচরিত্র ও অক্ষায় কীর্তিকলাপের ওপর পর্দা টেনে দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছো। কিন্তু সূর্যর উজ্জ্বল দীপ্তির সামনে দীপ শিখার মর্যাদা কি হতে পারে?
আযাদ অফিসার –এর বিশ্বাসঘাতকা
আযাদ অফিসারের জন্য যদি কোন ব্যক্তির স্মৃতিচারণ করার বৈধতা থাকে তাহলে মিসরের ইতিহাসে সে রকম এক ব্যক্তি আছেন অর্থাৎ ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মুর্শিদে আ’ম হাসানুল বান্না। এ ব্যক্তিই তাদের জন্য পথপ্রদর্শন ছিলেন। তাদের প্রোগ্রামকে কার্যতরী করার জন্য তার সাহায্য- সহযোগীতা এবং তাদের আন্দোলনেকে সর্বসাধারণের নিকট গ্রহণযোগ্য করার জন্য জনগণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করেন তিনিই। যদি হাসানুল বান্নার আন্তরিক প্রচেষ্টা না থাকতো তাহলে আযাদ অফিসার কিছুতেই তাদের উদ্দেশ্য লাভে সফল্য হতো না। যাদিও ইমাম শহীদের শাহাদাতের তিন বছর পর এই আন্দোলন সাফল্যমন্ডিত হয় তথাপি আযাদ অফিসার ইমাম শহীদ ও তাঁর সহকারী মেজর মাহমুদ লাবীব মরহুম –এর সাথে তাদের সাক্ষাতের কথা কি ভুলে গেছেন? আযাদ অফিসার কি একথাও ভুলে গেছেন যে, তারা যে ফার্মে গোপন অনুশীলন করতেন তা ছিল ইখওয়ানের একজন রুকনের। আলহামদু লিল্লাহ! ইখওয়ানের সে রুকন আজও বেঁচে আছেন এবং পার্লামেন্টের সদস্যও। তিনি ইচ্ছা করলে অনেক কিছুই করতে পারেন। কিন্তু ইখওয়ানুল মুসলিমুনের স্বভাব এমন নয় যে, আল্লাহর পথে তারা যা কিছু নজরানা পেশ করেছেন। তজ্জন্য কাউকে ঋণী করবেন। তাদের চরম ও পরম উদ্দেশ্য শুধু আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন্ আযাদ অফিসারগণ কি জেনারেল সালাহ শাদী, জনাব ফরিদ আবদল খালেক, জনাব সালেহ আবু রাকীক এবং জনাব হাসান আল আসমাভী মরহুমের সাথে তাদের সাক্ষাত ও ইখওয়ানের পক্ষ থেকে তাদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা এবং পরিপূর্ণ ঐক্য ও সংহতির কথা বেমালুম ভুলে গেছেন?
আমি আযাদ অফিসারগণকে আর কি স্বরণ করাবো? তাদের কি সেই সব সম্মেলন- সমাবেশের কথা মনে নেই, যা মহামান্য শাইখ মাহাম্মাদ হাসান আল আউনের বাড়ীতে অনুষ্ঠিত হতো? ঐসব সমাবেশে আযাদ অফিসারগণ ফাদিলাতুস শাইখ মাহাম্মাদ হাসানের সাথে সালাত আদায় করতেন এবং নামাযের পর তারা নিয়মিত শপথও করতেন যে তারা সফলতা লাভ করলে শরীয়াতে ইলাহিয়া পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করবেন। ইখওয়ানের সাথে যে কথার উপর তাদের ঐকমত্য হয়েছিলো। যদি নিষ্ঠাত সাথে তা বাস্তবায়িত করা হতো তাহলে কেবল মিসরেই নয় বরং পুরো অঞ্চলের অবস্থাই ভিন্নরূপ পরিগ্রহ করতো। আজ অত্র এলাকয় যে অশান্তি, দুর্বলতা এবং নৈরাশ্য ও নৈরাজ্য বিরাজ করছে তদস্থনে শক্তি ও বীরত্ব, শৌর্যবীর্য, শান্তি ও নিরাপত্তা এবং সচ্ছলতা ও স্বাবলম্বিতার জোয়ার আসতো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাই ঘটে যা আল্লাহ তায়ালা চান।
তাকওয়াই সর্বোত্তম পথের সম্বল
হাসানুল বান্না শহীদ একটা ভ্রাম্যমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বরং ইউনিভারসিটির সম মর্যাদার অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি অধিকাংশ সময়ই সফরে ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু সফল সরঞ্জাম থাকতো খুবই সংক্ষিপ্ত। একদিকে আমি দেখি এমন সবলোকদেরকে যারা কখনো সফরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে তাদের সম্মুখে পশ্চাতে মোটর সাইকল শোভাযাত্রা এবং নিরাপত্তা কারসমূহের সারি লেগে যায়। গরীব জাতির পয়সা অত্যন্ত নির্দয়ভাবে অপব্যয় করা হয়ে থাকে। অথচ তাতে লাভ কিছুই হয় না। এসব রাষ্ট্রীয় কর্তাব্যক্তিরা কেউ যখন দৃশ্যপট থেকে সরে যান তখন তার আকাশ। ছোয়া মূর্তি তৎক্ষণাৎ ভুতলে লুটিয়ে পড়ে। না কেউ তার আলোচনা করে, না করো অন্তরে থাকে তার প্রতি অবশিষ্ট এতটুকু সম্মানবোধ। পক্ষান্তরে ইমাম শহীদকে দেখুন, তিনি ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে হাতের থাকে মামুলি ধরনের একটা ব্যাগ। তাতে থাকে কয়েকটা জরুরী জিনিসপত্র যেমন একটা আয়না একটা চিরুনী এবং রাত্রিযাপনের পোশাক। এতদসত্ত্বেও আজ হাসানুল বান্না মানুষের মনের মণি কোঠায় চির জাগরুক আর তার প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনই তার যোগ্য উত্তরাধিকারী।
আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব
হাসানুল বান্না এখন কারো প্রশংসার অনেক উর্ধে। কেননা তিনি মহত ও নেক জীবন অতিবাহিত করে তাঁর রবের সমীপে পৌঁছে গেছেন। যেখানে মহান আল্লাহ তাঁকে তার কার্যকলাপের উত্তম বিনিময় দিয়ে থাকেন। এ মহাপ্রাণ ব্যক্তির জীবনেতিহাস আলোচনার দ্বারা নিশ্চয়ই সেইসব লোকের উপকার হবে যারা সত্যের পথে চলে নিজের আখেরাত গড়ে নিতে চায়। বর্তমানে পয়গামে মুহাম্মাদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার কোণে কোণে তার দীপ্তি ছড়িয়ে চলেছে্। এতে হাসানুল বান্নার ভূমিকা ভুলে যাওয়ার মত নয়। অতএব হকের অনুসন্ধানীদের জন্য এ ব্যক্তির পরিচিত লাভ করা সংকল্পের বলিষ্ঠতা সৃষ্টি ও মনোবল বৃদ্ধির সহায়ক হবে। তিনি তাঁর মহত চরিত্র এবং কর্মের নিষ্ঠা দ্বারা আলোক স্তম্ভ নির্মাণ করে দিয়েছেন।
ইমাম শহীদ কোন বিশেষ বেশভুষা ও পোশাক পরিচ্ছদেও অভ্যস্ত ছিলেন না। কখনো কখনো তিনি আবা পরিধান করতেন আর মাথায় পরতেন পাগড়ি। অধিকাংশ সময় তাঁকে ও তুর্কী টুপি পরিহিত অবস্থায় দেখা যেতো। তিনি ও ব্যাপারে বিশেষ কোন আড়ম্বরের পক্ষপাতি ছিলেন না। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় যাদূকরী ব্যক্তিত্ব দান করেছিলেন। তিনি যে কোন ধরনের পোশাকই পরিধান করতেন তাতেই তাঁকে বেশ মানাতো। তিনি ছিলেন পোশাকের সৌন্দর্য বর্ধক।
উন্নত নৈতিক চরিত্রের নমুনা ও বীরত্বের উদাহরণ
এই মর্দে মু’মিন আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে ভয় করতেন না। অথচ তাঁর ভাল করেই জানা ছিল যে, জন্য চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে। তথাপি তিনি অতসব বিপদাপদের কোন তোয়াক্কা না করেই দাওয়াতে হকের কাজ জারী রাখেন। তিনি জানতেন তার বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তৎপর নয় বরং সরকারের পুরো মেশিনারী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, মৃত্যুর জন্য একটি সময় নির্ধারিত আছে যা এক মুহূর্ত আগে বা পরে হতে পারে না। আমি এসব ঘটনাবলী হাসানুল বান্নার ব্যক্তিগত সাহসিকতা বর্ণনা করার জন্য আরজ করছি না। কারণ তার শৌর্যবীর্য ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে যা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ বর্ণনার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীগণ ও থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং উপলব্ধি করবে যে, এ পথ বিপদসংকুল পথ। মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে এ পথে নামতে হয়। এ মহত উদ্দেশ্য হাসিল করতে হলে নিজের প্রিয়তম সম্পদ কুরবানী করে মানুষকে বুঝতে হবে যে, আমি ঠকবার মত সওদা খরিদ করিনি।
হাসানুল বান্না (র) চা বা কফি কোনটাতেই অভ্যস্ত ছিলেন না। কিন্তু কোন ইখওয়ানী কিংবা অইখওয়ানীর সাথে সাক্ষাত করতে গেলে যা কিছু পেশ করা হতো তাই আগ্রহ ভরে খেতেন। পানাহারের ক্ষেত্রে তাঁর কর্মনীতি ছিল সুন্নাতে নববী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সার্থক রূপায়ন। যে কোন জিনিসই পেশ করা হতো তিনি সর্বদা তার প্রশংসা করতেন এবং কখনো কোন খাদ্যের দোষ ধরতেন না। মেজবান ও তার পরিবার পরিজনের জন্য কল্যাণের দোয়া করতেন। সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসার পর বারী তায়ালার প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন। তিনি এমন মনোযোগ দিয়ে তা শ্রবণ করতেন যেন কোন বড় বক্তার বক্তৃতা শুনছেন। আল্লাহ তায়ালা এ মহাপ্রাণ ব্যক্তিকে বহু গুণে গুণান্বিত করেছিলেন। এমন ব্যক্তি কি প্রতিদিন কোথাও জন্মগ্রহণ করে?
কালের অবদান যুগ স্রষ্টা
হাসানুল বান্না যেভাবে তার সংগঠনকে বিন্যস্ত করেন- বিভিন্ন বিভাগে তা বিভক্ত করেন প্রত্যেক বিভগের জন্য নীতি-পদ্ধতি ও বিধি-বিধান এবং প্রত্যেক ময়দানের জন্য যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মী নির্বাচন করেন। এগুলো এবং অনুরূপ অন্যান্য কার্যক্রম দেখে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি কত উন্নত চিন্তাধারার অধিকারী মহাপ্রাণ নেতা এবং যোগ্যতম সংগঠন ছিলেন। সম্পূর্ণ প্রাথমিক যুগেই তিনি ছাত্র সংগঠন লেবার ইউনিয়ন, চাষী সংগঠন, শিক্ষাক ও অন্যান্য পেশাজীবি সংগঠন, মুক্তপেশা ব্যক্তিগণের বিভাগ, দাওয়াত সম্প্রসারণের বিশেষ অধিদপ্তর এবং ইসলামী জাহান ও সমগ্র দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিদেশ বিষয়ক দফতর স্থাপন করেছিলেন। এই কর্ম বন্টন দেখে আপনি সহজেই সে প্রতিভার অনুমান করতে পারবেন যা এসব বিভাগ ও দফতর সংস্থাপনের পশ্চাতে সক্রিয় ছিল। সরকারী কর্মকর্তাগণ আজ পর্যন্তও এ কালের অবদান এবং যুগ স্রষ্টা ইসলামী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতার ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার জন্য সদা সচেষ্ট রয়েছেন। এ ব্যক্তিত্ব কেবলামত্র মিসরের সীমানায়ই মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। বরং সমকালীন ইতিহাসে সমগ্র বিশ্বের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের মোকাবিলায় আপন দীপ্তিতে ছিলেন ভাস্বর। সরকারী কর্মকর্তাগণ এরূপ জঘন্য চেষ্টায় কোন নিয়োজিত রয়েছেন তার জবাব হয়তো আমি দিতে সক্ষম কিন্তু দেশের প্রচলিত আইন পথে অন্তরায় হয়ে আছে। যা হোক একদিন সমস্ত গোপন রহস্য আপনা থেকেই উদঘাটিত হবে এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ন্যায় পরায়ণের আদালত থেকে ফায়সালা ঘোষণা করে দেয়া হবে।
সমস্যাবলীর সমাধান করার উত্তম যোগ্যতা
সমস্যা সামাধানের বিশেষ যোগ্যতা আল্লাহ তায়ালা ইমাম শহীদকে প্রদান করেছিলেন। একবার পরিস্থিতি এক ভাইকে কায়রো থেকে কোন এক ছোট শহরে বদলি হয়ে যেতে বাধ্য করে। এ ভাই সেখানে গিয়ে পৌছার পর স্থানীয় সংগঠনের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। স্থানীয় আমীল উপলব্ধি করেন যে, নবাগত ভাই ইলম, তাকওয়া এবং যোগ্যতার দিক থেকে তাদের চেয়ে অনেক অগ্রসর। তাঁরা সে ভাইয়ের নিকট প্রস্তাব করেন যেন তিনি ইমারতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন কিন্তু তিনি তা অস্বীকার করেন। উভয়ে বার বার মত বিনিময় করেন কিন্তু নবাগত ভাই দায়িত্ব গ্রহণ করতে সর্বদা অপারগতাই প্রকাশ করতে থাকেন। ইত্যবসরে ঘটনাক্রমে ইমাম শহীদ ঐ শহরে পর্যবেক্ষণে গমন করেন। সমাবেশ চলা কালে স্থানীয় আমীর ইমামকে বললেন, “আপনি ইরশাদ করেছিলেন যে, যদি অপেক্ষাকৃত উপযুক্ত ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোক পাওয়া যায় তাহলে এ শহরের ইসারতের দায়িত্ব তার ওপর অর্পণ করা হবে। এখন এ ভাই সৌভাগ্যবশত এখানে শুভগমন করেছেন। তিনি আমার চেয়েও অধিকতর যোগ্য ও জ্ঞানী। আপনি তাকে নির্দেশ করুন যেন তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন।” তিনি সে ভাইয়ের দিকে তাকালেন এবং উপলব্ধি করলেন যে, তিনি এ দায়িত্বের বোঝা বহন করার জন্য আদৌ প্রস্তুত নয়। অতএব তিনি স্থানীয় আমীরকে মম্বোধন করে বললেনঃ “আপনি এখানকার আমীর। আপনি যদি কোন ভুল করে বসেন তা হলে কে আপনাকে সংশোধন করবে?” আমীর সাহেব সেই নবাগত ভাইয়েল নাম বললেন। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, “যদি তিনি আমীর হয়ে যান এবং ভুল করে ফেলেন তবে তার পরিশুদ্ধি করবে কে? একথা স্থানীয় আমীর নিশ্চুপ হয়ে গেলেন এবং ইমারতের দায়িত্ব পালন করার জন্য ইস্পাত কঠিন শপথ গ্রহণ করলেন।
এ ঘটনা অত্যন্ত মামলি ধরনের। তথাপি তা বর্ণনা করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সংগঠনের কর্মীরা কত সুন্দরভাবে মতানৈক্যকে দূর করে, যদি তা কোন মূলনীতির পরিপন্থী না হয়। ইমাম শহীদের প্রশিক্ষণের প্রভাব হয়েছে এই যে, সাধঘারণত ইখওয়ানের হয় এবং মতবিরোধের সামাধান সহজেই করা যায়। যদি মতানৈক্য দীর্ঘায়িত হয় এবং ঐক্যের কোন উপায় খুঁজে না পাওয়া যায় তাহলে যে ভাই সন্তুষ্ট হতে পারতেন না তিনি কোন বাক বিতন্ডা না করে নীরবে সংগঠন থেকে আলাদা হয়ে যান।
ঈমান প্রবৃদ্ধিকর ঘটনাবলী
একবার একজন ইখওয়ানী ভাই তার নাম ফিলিস্তিন জিহাদের স্বেচ্ছাসেবকদের দফতরে লিপিবদ্ধ করান এবং সম্মুখ সমরে যোগদান করেন। তার পিতা ইখওয়ানী ছিলেন না। তিনি এ ঘটনায় বড়ই ক্রুব্ধ হন। তিনি ধারণা করেছিলেন যে, মুর্শিদে আ’ম-এর অনুপ্রেরণা ও উৎসাহে তার ছেলে জিহাদ অংশগ্রহণ করার জন্য চলে গিয়েছে। তিনি তার সাথে দেখা করার জন্য কেন্দ্রীয় অফিসে আগমন করেন। ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি সহা্প্রাণ ব্যক্তি মুর্শিদে আ’মকে মন্দ কথা বললেন। ইমাম উপলব্ধি কররেন যে, লোকটির মধ্যে অতিমাত্রায় সন্তান বাৎসল্য রয়েছে এবং তিনি তার সন্তানকে ডেকে পাঠাতে চাচ্ছেন। তাঁর অন্তর বিগলিত হয়ে যায় এবং তিনি অত্যন্ত কোমল স্বরে আরজ করেলেন, “আমি আপনার আবেগ অনুভূতির প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করছি। আপনার ছেলেকে ফিলিস্তিন থেকে ডেকে আপনার খেদমতে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।” বর্ণিত ব্যক্তি একথা শুনে প্রশান্ত হয়ে যায়। তার দৃষ্টিশক্তি ছিল কিছুটা ক্ষীণ। কামরায় প্রবেশ করার সময় লোকজন দরজায় জুতা খুলে রেখে আসতো। এ বুজুর্গ যখন ফেরত যেতে উদ্যত হলো তখন ইমাম সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তার পাদুকা তুলে নিয়ে তার পায়ে লগিয়ে দেন। মেহমানের এমন প্রত্যাশা মোটেও ছিল না যে, তার এত কঠোর ও নির্মম কথাবার্তার পরও মুর্শিদে আ’ম তার সাথে এরূপ মহত আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। উক্ত ব্যক্তি নিজেই প্রকাশ করেছেন যে, মুর্শিদে আ’ম এর এমন উত্তম ব্যবহারই আমার ওপর যেন ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। সাথে সাথে আমার মনের সকল ক্ষোভ নিমিষেই বিদূরিত হয়ে যায়। কাফেলার প্রধান। এমনি ছিলেন সৃজনশীল প্রতিবার অধিকারী যার চিত্তাকর্ষক ও মনোহরী কথাবার্তা এবং অকৃত্রিম ভালবাসার প্রভাব সর্বস্তরের মানুষ তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসতো।
এ ঘটনাও খুবই সাধারণ প্রকৃতির। তারপরও আমি এত গুরুত্ব সহকারে এটি এজন্য বর্ণনা করলাম যেন মানুষ জনতে পারে ক্রোধান্বিত ব্যক্তিদেরকে কিভাবে ধৈর্য ও মিষ্টি-মধুর কথা দ্বারা বশীভূত করা যায়। উত্তম আচরণ এমন এক মহৎগুণ যার সাহায্যে মানুষের অন্তর জয় করা সম্ভব। আমাদের শাসকগণ যদি ইসলামী চরিত্র রপ্ত করে নিতে পারে এবং প্রজাসাধারণের মধ্যে থেকে কেউ তাদেরকে কোন প্রকার প্রশ্ন করে, তাদের নিগৃহিত করার পরিবর্তে সহানুভূতি ও সহমর্মিতার সাথে তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্ষোভের দেয়াল ধসে পড়বে এবং পারস্পরিক ভালবাসার দিগন্ত বিস্তার লাভ করতে থাকবে।
ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াতের প্রতি যুবকরা অত্যন্ত উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এ দাওয়াত যুবসমাজের সম্মুখে কোন বস্তুগত সুযোগ সুবিধা পেশ করেনি যা তাদেরকে সবুজ শ্যামল বাগান দেখতে পারে। এরূপ গণসমর্থন ও স্বীকৃতির কারণ যুব মানসের এ আস্থা যে, ইখওয়ান উম্মতে মুসলিমার জন্য সম্মানের অভিলাষী, তারা সকল সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের চির অবসান কামনা করে। তাদের দাওয়াতের দাবী হচ্ছে, মুসলিম উম্মাহ সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সকল প্রকার গোলমীর গোলক ধাঁধাঁ থেকে মুক্তিলাভ করুক। ইমাম শহীদ তাঁর কর্মীদের এ শিক্ষই দিতেন যে,“নিশ্চিতই আল্লাহ তায়ালা এমন কারো কর্মফল বিনষ্ট করেন না যারা উত্তম আমলকারী।” বিরুদ্ধবাদীদের জন্যও তার জবাব ছিল কুরআন মজীদ থেকেই গৃহীত “নিশ্চিয়িই মহান আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের কর্মনীতি সংশোধন করেন না।”
এভাবে ইমাম শহীদ আমাদের মনের মণিকোঠায় এ মূলনীতি বদ্ধমূল করে দেন। আমাদেরকে এ পথে ধৈর্য, দৃঢ়তা, আনুগাত্য, সন্তুষ্টি এবং আত্মতৃপ্তির যে শিক্ষা তিনি প্রদান করেন তাই আমাদের শ্রেষ্ঠতম পুজি। কবি বলেছেনঃ (*************)
আমার জীবনের উদ্দেশ্য তোমার দ্বীনের উৎকর্ষতা সাধন আমি এ জন্যই মুসলিম আর এ কারণেই নামযী।
কার কাছে এ দাওয়াতের মোকাবিলায় কোন জিনিসেরই কোন মর্যাদা ও মূল্য ছিল না। এ জন্যে নিসন্দেহে সবকিছু কুরবান করে দেয়াই ছিল তার জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য। নাকরাশী পাশা নিহত হওয়ার পর চরম সংকট সৃষ্টি হলে তিনি হিযবুস সাদীর মন্ত্রীসভার সাথে সাক্ষাত করার চেষ্টা করেন যাতে সান্নিধ্য থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে চাইতেন। তিনি কোন মন্ত্রীর দফতরে কয়কবার যেতেন। মন্ত্রী সাহেবের পিএ তাঁকে ঘন্টা দেড়েক বসিয়ে রাখার পর অপারগতা প্রকাশ করে বলতো যে, মন্ত্রী সাহেব জরুরী কাজে বাইরে চলে গেছেন। কিন্তু সেজন্য তিনি কখনো কোন বিরক্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করতেন না। তিনি ছিলেন সম্ব্রান্ত মেজাজের অধিকারী। তিনি খুব ভাল করেই অন্যদের সম্মান করেত জানতেন। কোন পরিস্থিতিতে তিনি তার মেজাজের ভারসাম্য হারাতেন না্ কয়েকবার তিনি এসব মন্ত্রীদের সাথে দেখা করতে গিয়েছেন কিন্তু তারা তাঁকে এড়িয়ে যেতে থাকে। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাঁকে শহীদ করা হয়।
ইমাম হাসানুল বান্নার অসংখ্য গুণাবলীর মধ্যে একটা দুর্লভ গুণ এই ছিল যে, তিনি মানুষের পছন্দ-অপছন্দ, মেজাজ ও রুচিশীলতা এবং আবেগ ও আগ্রহের প্রতি পুরোপুরি লক্ষ্য রাকতেন। সাধারণ লোকেরা এসব দিকে খুব বেশী গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু ইমামের ভাল করেই জানা ছিল যে, দায়ী ইলাল্লাহর জন্য লোকদেরকে দাওয়াতের প্রতি আকৃষ্ট করার ব্যাপারে ব্যক্তিগত মনযোগের গুরুত্ব অনেক বেশী। এই মনযোগ ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয় যতক্ষণ না আপনি ব্যক্তির রুচি অভিরুচির ব্যাপারে সম্যক জ্ঞাত না হতে পারবেন।
উস্তাদ ওমর বাহাউদ্দীন আল আমিরী দাওয়াতে হকের বিখ্যাত মুজাহিদগণের অন্যতম। এ পথে তাঁর কৃতিত্ব ও অনুপম ত্যাগ এবং কুরবানী সবার জন্য অনুপ্রেরণারে উৎস হয়ে থাকবে। ইমাম শহীদের জীবদ্দশায় উস্তদ ওমর আল আমিরীর সাথে তাঁর অত্যন্ত বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক ছিল। ওমর আল আমিরীর ওয়ালিদ মুহাতারাম ছিলেন বড়ই কৌতুক প্রিয় এবং পরিচ্ছন্ন স্বভাবের অধিকারী সম্মানী ব্যক্তিত্ব। দামী পুস্পসজ্জিত ফুলদানীর অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন তিনি। এক সময় এ মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্ব কায়রো গমন করেন এবং একাধারে কয়েকদিন পর্যন্ত এখানে অবস্থান করেন। যেদিন তিনি তার বাড়ীতে ফিরে যাওয়ার জন্য ট্রেনে আরোহণ করেন সেদিন তাঁর পুত্র জনাব ওমর আল আমিরীও রেলষ্টেশনে বিদায় জানাতে যান। গাড়ী রওয়ানা হতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকী। ওমরও গাড়ীর বগীতে উপবিষ্ট ছিলন। ইত্যবসরে তিনি প্লাট ফরমের ওপর মুর্শিদে আ’মকে দেখতে পেলেন যে, তিনি দ্রুত গতিতে কামরার দিকে ছুটে আসছেন। জানালার পাশে এসে তিনি খুব সুদৃশ্য অত্যন্ত সুঘ্রাণ যুক্ত এবং তরতাজা ফুলের অনেক বড় ফুলদানী শুভেচ্ছান্তে বড় মিয়ার খেদমতে পেশ করেন। পিতা পুত্রের ওপর এ তোহফার যে প্রভাব পড়ে তার ফল হয়েছিল এই যে, এ উত্তম আচরণের কথা পুরো পরিবার সর্বদা স্বরণ করতেন। তিনি সবসময় একথা আলোচনা করতেন যে, মুর্শিদে আ’ম তাঁর রকমারী দায়িত্ব কর্তব্য পালনের সাথে সাথে সংগীদের অতি সাধারণ অভ্যাসের প্রতিও যথেষ্ট খেয়াল রাখাতেন এবং সেগুলো পূরণ করার জন্য সময় বের করে নিতেন।
এ ঘটনাও উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য শুধু এই জন্য যে, এ থেকে আমরা যেন শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। অধির্কাংশ লোক অনেক সময় প্রশ্ন করে যে, দাওয়াতের কাজ কিভাবে সম্প্রসারিত করা যায়। এ সমস্ত ক্ষুদ্র ঘটনা প্রভাব বিস্তারের দিক থেকে খুবই সুদূর প্রসারী। এই উদাহরণ আমাদের সামনে এ বাস্তবতা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, দায়ীর প্রতিভা ও যোগ্যতা এবং তার প্রশিক্ষণ পদ্ধতি সর্বদা তাকে দাওয়াতী কার্যক্রম সম্প্রসারণের কাজেই ব্যস্ত রাখে। জনসাধারণের আবেগ-অনুভূতির প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং তার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা দায়ীর মৌলিক গুণাবলীর অন্যতম। সাথে সাথে তার অন্যান্য দায়িত্ব কর্তব্য ও বাধাগ্রস্ত হতে না দেয়া ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বেরই পরিচায়ক। নেতার উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীব মধ্যে অন্যতম প্রধান গুণ হচ্ছ, তিনি যুদ্ধ জয় লাভ করার সমস্ত কলা কৌশল খুব ভাল করেই জানবেন। এখানে হৃদয়ের আবদ্ধ দুর্গের সমস্ত দ্বার খোলার কৌশল জানতে হয়। আর এ জন্য এমনসব মহৎগুণাবলীর প্রয়োজন যা ইমাম শহীদের চরিত্র ও সামগ্রিক কর্মতৎপরতায় পরিদৃষ্ট হয়। কবির ভাষায়ঃ (*************)
তোমার জীবনে ছিল আমার জন্য অনেক গ্রহনযোগ্য উপদেশ মরণের পর আজ তুমি আমার নিকট হয়ে উঠেছে আরও আকর্ষণীয় তোমার জীবনাদর্শ আমাকে তোমার বক্তৃতা বিবৃতি থেকেও বেশী হেদায়াত ও পথ নির্দেশনা দিচ্ছে।
আল্লাহর এ দুনিয়াতে মানুষ এক প্রকারের নয় কিছু লোক রয়েছে এমন যাদের দেখে চক্ষু বিস্ফরিত হয়। দিল ও দেমাগ পেরেশান হয়ে যায়। পক্ষান্তরে কিছু লোক আবার এমনও রয়েছে যার চক্ষুর আড়ালে চলে গেলেও তাদের স্মৃতি অন্তর থেকে মুছে ফেলা যায় না। তাদের হৃদয় গ্রাহী স্মৃতি এবং মহৎ ঘটনাবলী ঈমানকে উদ্দীপ্ত করে এবং অন্তরকে প্রশান্তি দান করে। হাসানুল বান্না এমন অনুপম ব্যক্তিত্ব যে, তার স্মৃতি হৃদয় মনে সদা জাগরুক ও প্রাণবন্ত হয়ে থাকবে এবং প্রেমের এ কাফেলাকে লক্ষ্য অভিমুখে পথ প্রদর্শন করতে থাকবে।