একবিংশতম অধ্যায়
এখন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের দাওয়াত মিসরের বাইরে বহুদূর ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হচ্ছে অব্যাহতভাবে। এমনকি বিশ্ববাসী আমাকে সুদুর ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনুষ্ঠিত সভা-সমিতি ও সেমিনার সিম্পোজিয়ামে যোগদান করার আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন ক্রমাগতভাবে। আমরা শারীতিক অবস্থা এখন সফরের কষ্ট সহ্য করার উপযুক্ত নয়। বার্ধক্য আমাকে দুর্বল করে ফেলেছে তথাপি আমি এসব সম্মেলনে হাজির হচ্ছি। এসব ভ্রমণের সময় ভ্রাতৃপ্রতীম ইবরাহীম শারফ আমার সফর সংগী হিসেবে থাকেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে উত্তম পুরস্কার প্রদান করুন। কারণ তিনি সর্বদা আমার বিশ্রাম ও আরামের প্রতি পুরোপুরি খেয়াল রাখেন। এসব সম্মেলনে আমি যা দেখেছি তাতে আমার মন খুশীতে ভরে গেছে। ইসলামী দাওয়াতের সম্যক ধারণা ও বাস্তব প্রেরণা যুব সমাজের অন্তরে শিকড় গেড়ে বসেছে এবং সর্বদাই আমি যুবকদেরকে দেখতে পেয়েছে। তারা তাদের মিসরীয় ভাইদেরকে হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা দ্বারা সিক্ত করেছে। এসব সম্মেলনে সারা পৃথিবী থেকে হাজার হাজার লোক অংশগ্রহণ করে থাকে। এভাবে সর্বত্র মুসলিম অপর মুসলিম ভাইদের সাথে হৃদ্যতা ও নৈকট্য সৃষ্টি করে নেয়ার সুযোগ লাভ করে থাকে। এই ইসলামী ভ্রাতৃত্ব মস্তবড় এক নিয়ামত।
কৌশলের জন্য ত্যাগ ও তিতিক্ষা অত্যাবশ্যক
“আদ দাওয়া” সাময়িকী যোগসূত্র স্থাপন এবং ঘনিষ্টতা সৃষ্টির উত্তম মাধ্যম মিসরে এই সাময়িকীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর যখন তা ইউরোপ থেকে প্রকাশিত হতে থাকে তখন তা পাওয়ার জন্য সকল জায়গা থেকে প্রাহকগণ চাঁদা পাঠাতে থাকেন। সুদূর নরওয়ে, সুইডেন, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান মোটকথা প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ স্বতঃস্ফুতভাবে এর গ্রহক হয়। সাময়িকীটির অফিসে পেশাজীবি সাংবাদিক এবং বিশেষ বুৎপত্তি সম্পন্ন সাহিত্যিক ও যোগ্য সম্পাদক কোনটাই বড় একটা ছিল না। সাময়িকীটির সম্পাদনা, প্রকাশনা ও পরিচালনা এবং পরিবেশনার সার্বিক দায়-দায়িত্ব ছিল যুবকদের ওপর। যারা অতি সম্প্রতি গণসংযোগ বিষয়ক কলেজ থেকে ডিগ্রী লাভ করে বেরিয়ে এসেছে কিংবা শিক্ষারত আছে। লক্ষ্য অর্জনের একাগ্রতার ফলে এসব কৃতিত্ব অর্জিত হয়েছে যা দেখে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা চোখ কপাল তুলতে বাধ্য হয়েছেন।
প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় যখন পত্রিকা আমাদের হাতে এসে পৌঁছতো তখন আমরা সকলে একত্রে মিলে বসতাম এবং তাতে থেকে যাওয়া ভুল-ভ্রান্তি ও ক্রটি-বিচ্যুতি চিহ্নিত করতাম। আপনি বস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন যে, “আদ দাওয়া” ই এ ধরনের একমাত্র পত্রিকা যার কোন নিয়মিত গ্রুপ লিডার ছিল না। কিন্তু তারপরও প্রকাশনা অব্যাহত থাকে। মিসরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পূর্ব পর্যন্ত পত্রিকাটি কায়রো থেকেই প্রকাশিত হতো। এরপর অষ্ট্রিয়া থেকে প্রকাশ হতে থাকে।
কারাগার থেকে আমাদের মুক্তি লাভের সময় থেকে নিয়ে ১৯৮১ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কাল ছিল অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ। যদিও এ সময়েও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মাঝে মধ্যে কোন কোন বিষয়ে আপত্তি করতো। কিন্তু সার্বিকভাবে পত্রিকার প্রকাশনার ক্ষেত্রে কোন অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়নি।
আরব এবং মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ এমনকি অমুসলিম দেশসমূহের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীর প্রতিনিধিগণ “আদ দাওয়ার” দফতরে আসতো। তারা আমার থেকে সংবাদপত্র, রেডিও টেলিভিশন ইত্যাদির জন্য সাক্ষাতকার প্রদানের অনুরোধ জানাতো। এসব লোক অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও নাজুক বিষয়ে আলোচনার অবতারণা করতো এবং আশা করতো যে, আমি বিভিন্ন সরকারের সমালোচনা করাবো। অথবা তাদের গৃহিত পলিসির ওপর হামলা করে বসবো। অথচ আপনারা ভাল করেই জানেন যে, এসব ক্ষেত্রে অসন্তোষের দাবানল প্রজ্জ্বলিত করতে আমি কখনো অভ্যস্ত নই। আমি তাদের সে মানসিকতাকে এড়িয়ে যেতাম। আমার জবাব শুনে তারা সন্তুষ্ট হতে পারতো না। সে যাই হোক আমি নিজেকে কিছুতেই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি করতে চাই না যার ফলে পরক্ষণে শুধু আফসোস অনুতাপ প্রকাশ করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার না থাকে।
একবার লন্ডনে জনৈক সাংবাদিক আমাকে এ পর্যন্ত বলে ফেলেন যে, আপনি প্রশ্নাবলীর সুস্পষ্ট জবাব পাশ কাটিয়ে যান। আমি তাকে বললাম, পাশ কাটিয়ে যাওয়া আমার অভ্যাস নয়। দেশের বাইরে গিয়ে সরকারের সামালোচনা করা আমার স্বভাব বিরুদ্ধে। আমি কখনো আমার দেশের সরকারের কোন ভ্রান্ত পদক্ষেপের সমালোচনা করতে চাইলে মিসরের ভেতরে থেকেই সততা ও নিষ্ঠার সাথে তা করতে পারি। দেশের বাইরে গিয়ে নিজ দেশের সরকারের সমালোচনা করা নীতিগতভাবে আমি ঠিক বলে মনে করি না। কিছু লোকের ধারণা, আমি রাজনৈতিক কারণে এরূপ ভূমিকা পালন করে থাকি। কিন্তু তা ঠিক নয়। বরং এটা আমাদের অন্যতম মূলনীতি।
ব্যক্তিত্বের লালন ও খ্যাতির আনন্দ
কিছু লোক যারা নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে জ্ঞাত নয়- তারা মানুষকে খুশী করার জন্য অধিকাংশ সময় নিজেদের আকীদা-বিশ্বাসের পরিপন্থি কথাবার্তা বলে থাকে। কিন্তু আমার কর্মনীতি এরূপ নয়। সত্য কথা বলার ব্যাপারে আমার মতে কপটতার কোন সুযোগ নেই। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন! সত্য প্রকাশের ক্ষেত্রে ইখওয়ানুল মুসলিমুন কোন দিন কপটতার নীতি গ্রহণ করেনি। মানুষ দেখেছে ভীতি এবং নৈবাজ্যের জঘন্যতম সময়েও আমরা পিছ পা হইনি। আমি আল্লাহর শোকর আদায় করছি যিনি তার অফুরন্ত রহমতের সাহায্যে আমাকে এমন সৌভাগ্য দান করেছেন যে, আমি বাতিলের সম্মুখে মস্তকাবনত করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতে সক্ষম হয়েছি। আবদুন নাসেরের শাসনামলে একটা বিদয়াত প্রসার লাভ করেছিল।
প্রত্যেক ব্যক্তি তার প্রতি বিশ্বস্ততার ঘোষণা দিতো। ইখওয়ানুল মুসলিমুন কারাগারে কঠোর নির্যাতন ভোগ করছেল। ইত্যবসরে সরকারী কর্তাব্যক্তিরা আবদুন নাসেরকে সমর্থনদানের দাবী করেন। এরূপ কঠিন পরিস্থিতিতেও আমি আমার দ্বীন ও নৈতিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে জালিমের সমর্থন করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিলাম। এর ফলে যা কিছু ভোগ করতে হয়েছে তা সবই হাসি মুখে বরণ করে নিয়েছি। আমি জানতাম কুরআনের বহু পাঠক এমন রয়েছেন যারা না বুঝে শুনেই-এর শাব্দিক তেলাওয়াতে মশগুল থাকেন। অথচ কুরআন তাদের ওপর অভিশাপ দিতে থাকে। তারা পাঠ করে থাকে- জেনে রাখো জালিমদের ওপর আল্লাহ্র লা’নত বর্ষিত হয়ে থাকে। তারপরও হয়তো নিজেই জালিমে কিংবা জালিমদের সহযোগিতা দানকারীতে পরিণত হয়।
এমনিভাবে উভয় অবস্থাতেই তারা এই আয়াতের সত্যতা প্রমাণ করে নিজেদের কর্মে ও আচরণে। এই বিষয়ে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আবদুন নাসের জঘন্যতম জুলুম করে যাচ্ছে। আমি এ ব্যাপারে অত্যন্ত সর্তকতা অবলম্বন করছিলাম যে, আমি যেন নিজেই নিজেকে আল্লাহ্র লা’নতের উপযুক্ত না করে ফেলি। নাসেরের সমর্থন করা ছিল আল্লাহ তায়ালার লা’নতেরই নামান্তর। আল্লাহ্র লা’নতের অর্থ হচ্ছে, মানুষ আরহামুর রাহেমীনের রহমত থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়বে। অথচ আমি আল্লাহর রহমতের মুখাপেক্ষী সবচেয়ে বেশী। এতদ্ব্যতীত কোন জালিমের সহযোগিত করা নিজেই নিজেকে তার সামনে অপমাণিত করার সমার্থক। এই পৃথিবীতে এমন কোন জিনিস নেই যা আমাকে দুনিয়ার বিনিময় দ্বীন বিক্রি করতে বাধ্য করতে পারে। জালিমের সম্মুখে কাকুতি মিনতি করা জঘন্যতম অপমানের শামিল। কোন সত্যিকার মুসলমান এত নীচে নামতে পারে বলে আমি মনে করি না। দাওয়াতে হকের পথে আমাকে যত দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তা একথারই প্রমাণ যে, আল্লাহর ব্যাপারে আমি কাউকে ভয় করি না। তা না হলে আমার জন্য কি কঠিন কাজ ছিল যে আমি দাওয়াত ছেড়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে যাওয়া। সে ক্ষেত্রে না কোন মুসিবত ভোগ করতে হতো আর না কোন পরীক্ষা নিরীক্ষার মুখোমুখি হতে হতো।
মু’মিন বান্দা তার মৌলিক আকীদা-বিশ্বাস থেকে কখনো বিচ্যুত হতে এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে কারো ভয়-ভীতির তোয়াক্কা করতে পারে না। পরিবেশ পরিস্থিতি যত প্রতিকূলই হোক না কেন। জালিম যখন দেখে যে, একজন মু’মিন বান্দা তার দুর্বলতা ও প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তার সামনে মাথা নত করতে প্রস্তুত হচ্ছে না তখন তার স্নায়ু অস্বাড় হয়ে যায়। জালিমের জন্যে এটা চরম পরাজয় যে, সে একজন প্রশান্ত আত্মার মু’মীনের মর্যাদাবোধের সামনে তার শক্তি ও প্রতাপকে অসহায় দেখতে পায়। এই মু’মিন না তীর-তলোয়ারকে ভয় করে, না ধন-দৌলত ও বিত্ত বৈভবের লালসা তাকে প্রলুব্ধ করতে পারে। আমি নিজে দাবী করছি না যে, আমি আমার বীরত্ব শৌর্য বীর্য ও নির্ভীকতার ভিত্তিতে এমন প্রদর্শনী করতে সক্ষম। বস্তুত প্রত্যেক মু’মিন বান্দা সবসময় আল্লাহ তায়ালার প্রদত্ত দৃঢ় চিত্তাত এবং অবিচল ধৈর্যর বদৌলতেই হকের ওপর টিকে থাকতে পারে। আল্লাহ্ বলেনঃ (*******)
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি
সাদাতের আমলে আমরা শুরু থেকেই ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির বিরোধিতা করেছিলাম। এই বিষয়ে প্রথম থেকেই সাদাতের তৎপরতা ছিল আমাদের মতে অমংগলের কারণ। আমরা তার জেরুজালেম যাওয়ার ব্যাপারে তীব্র বিরোধীতা করেছিলাম। অথচ শুধু আমরা ছাড়া সমগ্র মিসরে তখন আর কেউ মুখ খোলেনি। আমরা একাধারে ক্যাম্প ডেভিড এবং শান্তি চুক্তি উভয়ের বিরুদ্ধেই আমাদের মতামত খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করেছিলাম। এ ব্যাপারে আমাদের অত্যন্ত পরিষ্কার ও সহসিকতাপূর্ণ ভূমিকা কারো অজানা ছিল না। এই সময়ে সাদাতের পদলেহী ও সেবাদাস সাহিত্যিক ও সাঙ্গপাঙ্গরা আমাদের ওপর তীর বর্ষাতে থাকেন। তারা আমাদেরকে রাজনীতিতে অদক্ষ বলে অভিহিত করেন এমনকি শান্তি ও নিরাপত্তার দুশমন বলে অভিযুক্ত করে ছাড়েন।
অনন্তর যখন এসব চুক্তি বাস্তবে রূপায়িত করার উদ্যোগ শুরু হয় তখনও আমরা যথারীতি তাদের প্রতিহত করার জন্য উঠে পড়ে লেগে যাই। “আদ দাওয়া” সাময়িকীর এক সম্পাদকীয়তে আমি লিখেছিলাম যে, এসব চুক্তি বাস্তবায়ন সার্বিক অকল্যাণ ডেকে আনবে। আমার এই মন্তব্যের স্বপক্ষে আমি ক্রমান্বয়ে বিশটি কারণ উল্লেখ করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে রুকনুল কানাতিরিল খাইরিয়াতে আমার সাথে যখন সাদাতের সাক্ষাত হয় তখন সে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, আমি কেন এই চুক্তির বিরোধিতা করছে? আমি প্রত্যুত্তরে তাকে বললাম যে, আমি শুধু মাত্র রাজনৈতিক সতপার্থক্যের কারণেই এই চুক্তিগুলোর বিরোধিতা করছি না। কেননা আজকাল জনসাধারণ রাজনীতির যে অর্থ বুঝে থাকেন-এমন রাজনীতির সাথে আমার দূরতম সম্পর্কও নেই। আমি শুধু মাত্র দ্বীনি দৃষ্টিভংগীতেই এই চুক্তিসমুহের বিপক্ষে কথা বলছি। কারণ ইসলাম কখনো স্বীকার করে না যে, কোন অমুসলিম সাম্রাজ্যবাদকে মাথা পেতে মেনে নিক। বরং যখনই মুসলিমদের কোনও অঞ্চলে কোন অমুসলিম ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তখন মুসলিম উম্মার প্রতিটি সক্ষম নরনারীর ওপরই জেহাদের জন্য বেরিয়ে পড়া ওয়াজিব হয়ে যায়।
মুসলমানদের ঘাড়ের শিরা ও ইহুদী থাবা
আমি আল্লাহ্র নামে কছম করে বলতে পারি যে, সাদাত আমার কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় এবং আমাকে বলে যে- “এই ধারায় যত ইচ্ছা লিখে যাও।” এটা সাদাতের মহত্বের পরিচায়ক যা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। সে যতকিছুই করে থাকুক না কেন এ পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে সে আস্তরিক ও মানসিকভাবে আমার যুক্তির সাথে সম্পূর্ণ একমত ছিল। সাদাত তার বেশ কিছু সাংবাদিক সম্মেলনে এ ব্যাপারে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল যে, ইস্রাঈল মূলত তত্বগত ও বাস্তব উভয় দিক থেকেই শান্তিচুক্তি লংঘন করেছে। তদুপরি রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত কর্ণধারগণও অনুরূপ বক্তৃতা বিবৃতি প্রদান করতে থাকেন। বিরাজমান এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ইস্রঈলের ঘৃণা সংকল্প উপেক্ষা করার কোন কারণ কি অবশিষ্ট থাকে? ইস্রঈলের তার সীমানা সুদূর মদীনা মনোয়ারা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার নীল নকশা, পশ্চিম তীর, গাজা ভূখন্ড এবং গোলান মালভূমিকে ইহুদী আগ্রসনের রংগে রাংগিয়ে তোলার অবিরত প্রচেষ্টা, দক্ষিণ লেবাননের ওপর তার জবর দখল সাবেরা ও শাতিলার তার পাশবিক হত্যাকান্ড কি আমাদের চেখ খুলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়?
আমরা অবশ্য এমন কোন কৃতিত্বের দাবী করি না যে, শান্তিচুক্তির ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভংগী ও তার যে বাস্তবতা সময় প্রমাণ করে দিয়েছে-তা আমাদের বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতার প্রমাণ। বরং আমাদের বক্তব্য হলো, আমাদের কাছে এমন একটি দ্বীন রয়েছে যা সরল সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দান করে থাকে। আমরা যদি তা মজবুত রশিকে শক্ত হাতে ধারণ করতে পারি তাহলে কিছুতেই পথভ্রষ্ট হওয়া সম্বব নয়। আজ ইসলমী জগতের যে ক্রান্তিকাল চলছে এবং ইরাক ও ইরান যেভাবে একটা অর্থহীন যুদ্ধে নিজেদের শক্তির অপচয় করছে তা দেখে বাস্তবিকেই খুব দুঃখ হয়। এই ভ্রাতৃঘাতি ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের নেপথ্যে আমেরিকা রাশিয়া ও ইস্রাঈলের সক্রিয় হাত রয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যদি মুসলিম রাষ্ট্র প্রধানগণ সম্মিলিতভাবে নিজ নিজ দেশে ইসলামী শরীয়াতকে কার্যকরী করেন তাহলেই কেবল মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের ওপর ছেয়ে থাকা বিপদের ঘনঘটা একদম কেটে যাবে। মানুষ যে জিনিসের আকাংখা করে তাই-ই লাভ করা সহজসাধ্য নয়। তথাপি ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় সকল বিপদকেই কাবু করা যায়। এখন তো আল্লাহ্ তায়ালার পরিশুদ্ধ করে দেবেন। আমরা যদি তা দিকে প্রত্যাবর্তন করি তাহলে করি তাহলে এই আকাংখা পূরণ হতে দেরী হওয়ার কথা নয়।
সাংবাদিকতার ইসলামী নীতি
“আদ দাওয়া” সাময়িকীর ডিক্লরেশন ছিল আলহাজ্জ সালেহ আসমাভী মরহুমের নামে। তিনিই ছিলেন এর প্রধান সম্পাদক। সম্পাদক মন্ডলীর মধ্যে আলহাজ্জ মোস্তফা মরহুম শাইখ সালেহ আসমাভী মরহুম ও আমি ছাড়া বাকী সবাই ছিলেন যুবক ছাত্র। আমরা প্রতি রবিবারে সন্ধ্যায় পত্রিকার পান্ডুলিপি শেষবারের মত দেখার জন্য বসতাম। বিষয় ও ভাষাগত ভুল-ভ্রান্তি চিহ্নিত করা হতো। হ্রাস বৃদ্ধি এবং অন্যান্য অনেক বিষয়ই আলোচনায় স্থান পেতো এবং প্রত্যেক বারই পত্রিকার শ্রী বৃদ্ধি ও মানোন্নয়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হতো।
মতানৈক্যের পরিবেশ সৃষ্টি হলে অত্যন্ত ধীর স্থির ও শান্ত পরিবেশে আলোচনা অব্যাহত থাকতো। এই আলোচনা চলাকালে আমি স্বভিাবত নীরবতা অবলম্বন করতাম-যাতে কিছু শিখতে পারি। কারণ সাংবাদিকতার ময়দানে আমার কোন অজ্ঞিতা ছিল না। অবশ্য আলোচনার পরিসমাপ্তি টানা যায়। তখন পর্যন্ত আমি হস্তক্ষেপ করতে হতো। যাতে আলোচনার সাময়িকীতে প্রকাশিত লেখার জন্য সম্মানী প্রদান করা হয়ে থাকে। পরবর্তীতে আমি তা জানতে পারি। সংবাদপত্র সেবীদেরকে বিনিময় প্রদান করা হবে এতে আমার অবশ্য কোন প্রকার আপত্তি ছিল না। তথাপি আমি কখনো কোন সাময়িকী ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত আমার কোন প্রবন্ধের জন্য কোন বিনিময় প্রহণ করিনি। পত্রিকা ও সাময়িকী কোন বিশেষ বিষয়ে আমার নিকট প্রবন্ধ চাইলে আমি বহুবার দিয়েছি কিন্তু তারা আমাকে বিনিময় দিতে চাইলে আমি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছি। কেননা আমি একজন দা’য়ী, সাংবাদিক নই। আমার অভ্যাস হচ্ছে, আমার সাথে সাক্ষাত করার জন্য যখন কেউ সময় চায় তিনি রাষ্ট্রের কর্ণধার কিংবা কোন সাধারণ মনুষ যা-ই হোন না কেন সর্বাবস্থায়ই আমি সেজন্য প্রয়োজনীয় স্থান ও সময় নির্ধারণ করার ইখতিয়ার তার ওপরই ছেড়ে দিয়ে থাকি। এই অভ্যাস আমি আমার জন্য রপ্ত করে নিয়েছি। কারণ, আমি নির্ধারিত স্থানে নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট পূর্বেই গিয়ে পৌঁছাতে চাই্ যখন নিরাপত্তা বিভাগের লোকজন“আদ দাওয়া” পত্রিকার অফিসে হামলা করে তখন সবকিছুই তছনছ করে ফেলে। সমস্ত কাগজপত্র ও নথিপত্র সাময়িকীর সাথে তার কোন সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক তার প্র্রতি কোন প্রকার ভ্রুথিপত্র না করেই নিয়ে যায়। আমার বার বার দাবী করা সত্ত্বেও আজ পর্যন্তও ঐ সমস্ত কাগজপত্র ফেরত দানের কোন ব্যবস্থা হয়নি।
স্বৈরাচারীরি সাবধান
আভ্যন্তরীণ শান্তি শৃংখলা রক্ষা কর্তৃপক্ষ পত্রিকার অফিসে হমলা চালানোর সময় কিছু সংখ্যক ইখওয়ানীকেও পাকড়াও করে নিয়ে যায়। তারা আমাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায়। আমি তাদের প্রতিটা প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব প্রদান করি। তারা বার বার বলছিলো যে, ইখওয়ান বেআইনিভাবে সংগঠন চালু রেখেছে। এই লোকগুলোর অবস্থা দেখলে আশ্চার্য হতে হয়, যকনই কোন ইখওয়ান অন্য কোন দেশ থেকে ফিরে আসে এবং তার সাথে কোন জরুরী কাগজপত্র থাকে তখন শান্তির এসবচ রক্ষকরা তাদেরকে গ্রেফতার করে হাজতে বন্দী করে। এভবে সপ্তাহর পর সপ্তাহ এবং মাসের পর মাস এই নিরাপরাধদেরকে কোন অভিযোগে অভিযুক্ত না করেই বন্দীশালায় আটক রাখার পর যখন আদালতে হাজির করা হয় তখন আদালত তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বেকসুর খালাস প্রদানের নির্দেশ দেয়। কেননা আদালত এমন কোন সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পায় না যা তাদের শাস্তির উপলক্ষ হতে পারে। তা সত্ত্বেও তারা বার বার এরূপ আচরণ করেছে। এমন কি এই ধারা অব্যাহত রেখেছে আজও। আমি চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে গিয়েছিলাম তখন একটি পত্রিকা এই সংবাদ পরিবেশন করে যে, আমি রণক্ষেত্র থেকে পলিয়ে গেছি। আমি যখন এই সংবাদ পাঠ করি তখন আমার চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রেখেই চলে আসি। রাত সোয়া নয়টার সময় (প্লেন) বিমান বন্দরে এসে পৌঁছে। ইমিগ্রেশনে পাসপোর্ট অফিসার আমার পারপোর্ট নিয়ে নেয় এবং আমাকে অপেক্ষা করতে বলে। আমি এয়ারপোর্টের অভ্যন্তরের হল রুমে রাত দু’টা পর্যন্ত বসে অপেক্ষা করতে বলে। আমি একবার চিন্তা করলাম যে এই ঘটনার রিপোর্ট লিপিবদ্ধ করাই। কিন্তু পরক্ষণে আমি ভেবে দেখলাম যে, এই পাসপোর্ট অফিসার বেচারার কি দোষ। সে তো হুকুমের দাস মাত্র। তাকে টেলিফোনের হুকুম দেয়া হচ্ছে অথচ পরবর্তী সময় হুকুম দাতা সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে সমূদয় দায়দায়িত্ব অস্বীকার করে বসে। আর যদি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করাও হয় তাহলে কোন দুর্বল শরীর সর্দি কাশির ন্যায় ছোট কর্মচারীকেই পাকড়াও করা যায়। অগত্যা আমি আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকি। এই অন্যায় আচরণের কারণ যাই হোক না কেন আমি গোটা ব্যাপারটা আল্লাহ্র ওপর সোপর্দ করে দিয়েছি। আমি আমার বাম হাঁটুর যে চিকিৎসা করিয়েছিলাম এবং যার ফলে অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছিল- এক নাগাড়ে এই সুদীর্ঘ পাঁচ ঘন্টা সময় প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে পুনরায় তা সফরের পূর্বের মতই হয়ে যায়। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম- এই লোকগুলো আমার সাথে এমন আচরণ করছে কেন? অথচ তারা খুব ভাল করেই জানে যে, এরূপ অসম্মানজনক আচরণের ফলে নাতো আমি আমার ভুমিকায় কোনরূপ পরিবর্তন সাধনকারী আর না কোন প্রকার আবেগ উত্তেজনা প্রদর্শনকারী। তাদের আরো চিন্তা করে দেখা উচিত যে, আল্লাহ তায়ালার সম্মুখে তাদের নিজেদের এ ধরনের আচার ব্যবহারের কারণে বিপজ্জনক ফলাফল ও মারাত্মক পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু তখনকার সেই আক্ষেপ অনুতাপের কোন সুফল তারা ভোগ করতে পারবে না।