একত্রিশতম অধ্যায়
সত্যের পথে আহবানকারীর জীবন চরিত্র
ইমাম হসানুল বানা শহীদের জীবন ছিল অ্ত্যন্ত সাধাসিধে এবং সব রকম প্রমর্শনী থেকে মুক্ত। তিনি অল্পদামী কাপড় পরিধান করতেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতেন। তার নিকট গাঢ় রং এবং কারুকার্য খচিত পোশাকের পরিবর্তে সাদা ও দরবেশী রং ছিল অধিকতর পছন্দনীয়। কথাবর্তার সময় তার বাচনভংগি সর্বজন বোধগম্য সহজ-সরল ও জটিলতা মুক্ত হতো। তার কথাবর্তা অশিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত সর্বস্তরের লোকদের জন্য সমান বোধগম্য ও প্রভাব সুষ্টিকারী হতো। সাক্ষাতকারের সময় তিনি থাকতেন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও হাসি খুশী। কোন অতি সাধারণ লোকও তার সাথে মিলিত হতে আসতো তার পক্ষেও এরূপ কিছু উপলব্ধি করা সম্ভব হতো না যে, সে একজন মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্বের সম্মুখে বসে রয়েছেন। কারণ তিনি ছিলেন ভয়-ভীতির পরিবর্তে প্রেম-ভালবাসার মূর্তপ্রতীক। অনুরূপ কোন অতি বড় এবং শক্তিশালী ব্যক্তিও যদি কখনো তার নিকট আগমন করতেন তিনি তাদের সামনেও নিজেকে ছোট হিসেবে পেশ করতেন না। তার জন্য সকল কাজই ছিল অত্যন্ত সহজ। কেননা আ্ল্লাহর ওপর ভরসা ছিল তাঁর কাছে থেকেই তিনি শক্তি ও সম্মান লাভ করতেন।
তার সরলতা ও শালীনতার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে যে, তিনি তার দাওয়াতী কাজের সূচনা করে ছিলেন হোটেল রেষ্টুরেন্টে গিয়ে জনসাধারণের সাথে আলাপ আলোচনা ও কাথাবার্তার মাধ্যমে। সে দৃশ্য কতই নপা বিস্ময়কর। যখন একজন সাধারণ শিক্ষক একটা ছোট্র ব্লাকনোর্ড নিয়ে একটা কফিখানা থেকে অপর রেষ্টুরেন্টের মাঝে যাতায়াত করতেন। তিনি প্রথমে কফিখানায় উপবিষ্ট সর্বসাধারণের পরিচয় গ্রহণ করতেন। তারপর বিভিন্ন ক্লাব, লেক ও সুইমিংপলিসমূহে গিয়ে জনসাধারণের নিকট দাওয়াত পৌঁছাতে চেষ্টা করতেন। একজন মাত্র ব্যক্তির নিষ্ঠাপূর্ণ প্রয়াস এমন সুফল বয়ে আনলো যা কোন বড় সংগঠন এমনকি সরাকারের দ্বারাও সম্ভব ছিল না।
আজহার শরীফে রয়েছে দুনিয়া জোড়া সুখ্যাতি। এর দায়িত্বশীলদের সর্যাদা ও অবস্থানও অত্যন্ত সম্মানজনক। কিন্তু ইসলামের পুনর্জাগরণ আন্দোলনের শুভু সূচনা হয় এই প্রাচীন ইসলামী প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে একটা প্রাইমারী স্কুলের অজ্ঞাত একজন শিক্ষকের হাতে। তিনি তার কাজে মগ্ন থাকতেন এবং কোন ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা না করেই দাওয়াতী কাজের প্রচার ও প্রসারে নিয়োজিত থাকতেন। যখন তিনি কায়রোতে স্থানান্তরিত হয়ে আসেন তখন জাতীয় সংসদভবনের নিকটস্থ একটি হোটেলের নীচ তলায় ছোট্র একটা অফিস স্থাপন করেন। সেখানে কোন বৃহদায়তন সাইনবোর্ড লগানো ছিল না। কিংবা বিজলী বাতিও ছিল না। এ প্রাথমিক অস্থায় তিনি লাগাতর সফরে থাকতেন। দূরদূরান্তের গ্রামাঞ্চল ও পাহাড়ী এলাকায় ঘুরে ফিরতেন। ভ্রমণের যে দুঃখ কষ্ট তিনি বরণ করেছিলেন তারই ফলে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের আন্দোলন আজ এত ফুলে-ফলে, পত্র-পল্লবে সুশোভিত ও সুসজ্জিত হয়ে উঠেছে। তিনি যেখানেই যেতেন সর্বপ্রথম স্থানীয় মসজিদে উপনীত হতেন। দূর দূরাঞ্চলের গ্রাম ও ছোট ছোট শহরে অবস্থান কালে তিনি চাটাই কিংবা ইট ও মাটি নির্মিত শক্ত বেঞ্চের ওপর বসে পড়তেন। এমনকি অনেক সময় শুধু মাটির ওপরই শুয়ে পড়তেন।
তাঁর শত্রু ও বন্ধু সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে, তিনি ছিলেন যুগের কৃতিসন্তান, অতুলনীয় প্রতিভা ও অসাধারণ যো্গ্যতার অধিকারী। কোন পাশ্চাত্য লেখক ও সাহিত্যিক প্রথমদিকেই মন্তব্য করেছিলেন যে, হাসানুল বান্না কেবলমাত্র মিসরেই নয় বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের দিশারী ও পথপ্রদর্শক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যাবে। এ অনন্য সাধারণ যোগ্যতা ও প্রতিভা শয়তানী চক্রের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ কারণেই তারা তাকে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করার পূর্বেই অন্যায়ভাবে হত্যা করে। যদি এ দাওয়াত হাসানুল বান্নার দাওয়াত হতো তাহলে তাঁর হত্যাকান্ডের সাথে সাথেই তা শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু এটা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তায়ালার নিজের দাওয়াত। তাই যে কেউ এর বিরোধীতা করবে তাকেই লাঞ্ছিত ও অপমাণিত হতে হবে। যে এর সাথে সহযোগিতা করবে সে অমর জীবন লাভ করতে পারবে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা শ্রেষ্ঠত্ব মর্যাদা দান করেন যাকে ইচ্ছা অপমাণিত ও লাঞ্ছিত করে ছাড়েন।
হাসানুল বান্না তার নিজের অস্বাভাবিক যোগ্যতার সাহায্যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন। তাঁর অনুসারীগণ বিভিন্ন শিক্ষাগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমিতে থাকার পরও সমানভাবে তাঁর প্রতি ভালবাসা পোষাণ করতেন এবং তার প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতেন। সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ তাঁর সম্মুখে এমনভাবে আসন গেড়ে বসতেন যেভাবে কোন শাগরিদ তার উস্তাদের সামনে অথবা কোন মুরীদ তার মুর্শিদের সম্মুখে আসন পেতে বসে। এই সম্মান কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট ছিল না। বরং সর্বসাধারণের হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত ছিল। প্রত্যেক ব্যক্তিই মনে করতো যে, ইমামের সাথে রয়েছে তার অত্যন্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক। তাঁর সাথী সংগীগণ তাঁর সাথে যে সম্মান, ভালবাসা ও আমানতদারী পরিচয় দিতো তা দেখে আমার সেই হাদীসটি মনে পড়ে যায় যাতে রাসূলুল্লহ (সা) বলেছেনঃ “আল্লাহ তায়ালা জিবরাইল (আ)-কে বলেন যে, আমি অমুক ব্যক্তিকে ভালবাসি। অতএব তুমিও তার প্রতি ভালবাসা পোষণ করতে থাকো। তখন জিবরাইলও তাকে মহবাবত করতে শুরু করে। তারপর সে আকাশ রাজ্যের সমস্ত ফেরেশতাদের মাঝে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করতে থাকে যে, অমুক ব্যক্তি আল্লাহর মাহবুব বান্দা। তোমরা তাকে মহব্বত করতে থাকো। অনন্তর আকাশ ও জমিদেন অধিবাসীগণের নিজটও এ বাণী পৌঁছে দেয়। তখন সে মাহবুবে এলাহী বিশ্ববাসীরও প্রিয়পাত্র হয়ে যায়। এটা আল্লাহ তায়ালার অফুরন্ত নিয়ামতের মধ্যে সস্তবড় নিয়ামত।”
বাহুবল ও শক্তি প্রয়োগ
তিনি আল্লাহ তায়ালার অপার অনুগ্রহের বদৌলতে দাওয়াতে হকের পথে পুরোপুরি লাভের সন্ধান করেন। ইসলামী দিবস পালন, যেমন হিজরাতে নববী ইত্যাদি উপলক্ষে তিনি বিশেষ জনসমাবেশের আয়োজন করতেন যাতে ছাত্র, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশার বিপুল সংখ্যক লোক অংশগ্রহণ করতো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতো যে, হাসানুল বান্না গণমানুষের হৃদয়ের স্পন্দন এবং তিনি তাদের মনের কথাই বলে থাকেন। তিনি মানুষের মনের আশা-আকাংখা জীবিত রাখার প্রয়াস পেতেন এবং তাদের ক্লান্তি-শ্রান্তি ও অবসন্নতার পূর্বেই আপন বক্তব্য সমপ্ত করতেন।
আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব ও প্রভুত্বের ওপর তার ছিল প্রগাঢ় আস্থা। তার অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য অন্য সকলের বৈশিষ্ট্য থেকে ছিল ব্যকিক্রমধর্মী। তার এ অকৃত্রিম বিশ্বস্ততা ও নির্ভযোগ্যতাই তার মধ্যে এমন আত্মিক শক্তি সৃষ্টি করেছিলো যার কোন তুলনা ছিল না। তাঁকে দেখে এমন একজন সত্যিকার মুজাহিদের চিত্র দৃষ্টির সম্মুখে প্রতিভাত হয়ে উঠতো যিনি কোন বাহ্যিক ও বৈষয়িক উপায় উপকরণ ব্যতীতই আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের ওপর ভরসা করে ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার রবের সাহায্য-সহযোগিতার ওপর থাকে অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস। মানুষ যে কাজকে স্বভাবত অসম্ভব বলে মনে করে থাকে তাকেই তিনি সম্পূর্ণ সম্ভব ও বাস্তব করে দেখাতেন।
আল্লাহ তায়ালার ওপর তাঁর ভরসা ও নির্ভরতার একটা কাহিনী আমি এবার আপনাদের সম্মুখে আরজ করছি। “তিনি কেন্দ্রীয় দপ্তরের জন্য ইমারত ক্রয় করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যার মূল্য সাব্যস্ত হয়েছিল আট হাজার পাউন্ড। তখন তার পকেটে পাঁচ পাউন্ডের বেশী ছিল না। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই পুরো অর্থ তার হাতে এসে যায়। ঐ অর্থ দিয়ে তিনি আন্দোলনের জন্য বিল্ডিং ক্রয় করেন। অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের ওপর ভরসা ও প্রবল আত্মবিশ্বাসের বদৌলতে তিনি শেষ পর্য়ন্ত তার চাকুরী জীবন থেকেও ইস্তফা দেন। তখন তাঁর নিকট দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্য কোন আয়েরও ব্যবস্থা ছিল না।
মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও পৌরুষ নামক দু’টি মহৎ গুণ তাঁর মধ্যে এত অধিক মাত্রায় বিদ্যমান ছিল যে, সেগুলোই তাঁকে প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা দান করে এবং তার ওসব স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করে যার রূপায়ণে বড় বড় প্রতিষ্ঠান এবং সরকারও ছিলো। তার মর্যাদা কোন ব্যক্তি বিশেষের নয় বরং তা ছিল একটি বিশ্বমানের শিক্ষাগার সদৃশ্য। তিনি প্রতিশ্রুতি পালনে যেমন ছিলেন সত্যবাদী তেমনি আকাংখা পূরণেও ছিলেন পাকা ও সুদক্ষ, লেন-দেন ও আচার-আচরণে বিশ্বস্ততার মূর্তপ্রতীক এবং ত্যাগ ও কুরবানীর জীবন্ত নমুনা। জবিনের সমস্ত মূল্যবান সামগী তিনি তার মহৎ লক্ষ্য অর্জনের স্বার্থে নির্মোহ, ইবাদাত, সরলতা, বিনম্রতা, তাহযীব-তামাদ্দুন, মার্জিত ও বিশুদ্ধ মাধ্যমের কথাবার্তা তার ব্যক্তিত্বকে এমন আকর্ষণীয় বানিয়ে দিয়েছিল যে, যে কেউ একবার তার সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পেয়েছে সারা জীবন তা ভুলতে পারেনি। তিনি মৌলিক বিষয়সমূহের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতেন এবং খুঁটিনাটি ও গুরুত্বহীন ব্যাপারসমূহ থেকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতেন। তিনি সকলের সাথে বন্ধুত্ব ও মহব্বতের আচরণ করতেন। কখনো কোন ব্যাপারেই কাউকে ধোঁকা দেননি। কিংবা সত্যকে গোপন করার চেষ্টা করেননি। তিনি কোনরূপ কূটিলতা ও শঠতার আশ্রয় না নিয়েই প্রতিটি কথা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করতেন। দাওয়াত পেশ করতে গিয়ে তিনি শুরুতেই দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে জানিয়ে দিতেন যে, এ পথ বড় বন্ধুর। এ পথের পথিকদেরকে ইসলামের শত্রুদের আক্রমণের শিকার হওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হয়্ যে ব্যক্তি নিজের মধ্যে বিপদ-মুসিবত সহ্য করার এবং প্রতিশ্রুতি পূরণ করার মত হিম্মত ও ভরসা পায় সেই যেন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে সওয়াবের আশায় নিজের জাহাজ তরংমালায় সোপর্দ করে দেয়। আর যদি কেউ এরূপ সৎসাহস ও যোগ্যতা বোধ না করে তাকে গোড়াতেই অক্ষমতা প্রকাশ করে সরে যাওয়া উচিত।
তার এ উক্তি কত বাস্তব। হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন যে, জান্নাত লাভ করা সম্ভব বিপদসস্কুল ও কন্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করার পরেই। আর দোজখ থেকে বাঁচতে হলেও কামনা-বাসনা ও স্বাদ-আহলাদ ত্যাগ করতে হবে। তিনি তার মাওলার সম্মুখে একটা সত্য অংগীকার গ্রহণ করেছিলেন সে ওয়াদার আলোকেই তিনি ছিলেন নম্রতা-শালীনতা ও শিষ্টাচারের মুর্তপ্রতীক, যাদুকরী ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং আদেশ ও নিষেধের পুরো অনুসারী। আল্লাহ তায়ালার অনুগত ও অবাধ্য প্রত্যেকের মর্যাদা তিনি দিতে জানতেন। তাঁর বড় বড় দুশমনও তাঁকে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করেও তাকে নীতিচ্যূত করতে পারেনি।
সা’দ জগলুল পাশার গাম্ভীর্য
মিসর জাতির ইতিহাসে অপর এক সমকালীন ব্যক্তিত্ব সা’দ জগলুল পাশাও ধৈর্য ও সহ্য গুণের জন্য বিখ্যাত। তথাপি তাকে এমন সব নাজুক ও জটিল পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হয়নি যাকে অতিক্রম করে সামনে এগুতে হয়েছিল হাসানুল বান্নাকে। আমার মনে পড়ে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বৃটেন মিসরের তৎকালীন প্রধান সন্ত্রীর সাথে একটা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল। চুক্তিতে চারটি বিষয়ে গ্যারান্টি প্রদানের শর্তে মিসরকে আভ্যন্তরীণভাবে স্বায়ত্বশাসন দেয়ার কথা উল্লেখ ছিল। তৎকালীন উজীরে আযম আবদুল খালেক সারওয়াত পাশা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে ছিলেন। কিন্তু সাদ জগলুল এসব নিশ্চয়তামূলক মর্তবলীর কঠোর সমালোচনা করেন এবং দেশবাসীকে ক্ষেপিয়ে তোলেন যে, এ অসম চুক্তি ও অপমানকর সন্ধি বাতিল করতে হবে। সা’দ জগলুলের মতে মিসরকে কোন প্রকার শর্ত ছাড়াই পুরোপুরি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রাণাস্তকর প্রচেষ্টা চালানো উচিত। শর্তবলীর মধ্যে নিন্মে বির্ণত তিনটি আমার মনে পড়ছেঃ
১-ইংরেজ প্রণীত ও প্রবর্তিত আইন-কানুনের পরিপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ।
২- সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান।
৩- মিসরের মধ্য দিয়ে বৃটেনের অবশিষ্ট উপনিবেশিক এলাকার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার অধিকার প্রদান।
সা’দ জগলুলের আক্রমণের জবাবে সারওয়াত পাশা তার নিকট এ মর্মে দাবী করেন যে, তিনি এ সমস্যাকে যেন আদালতে পেশ করেন এবং সেখান থেকে ডিক্রি নিয়ে আসেন। সা’দ জগলুল তার এ আহবানের জবাবে সংবাদ পত্রে এক বিবৃতি প্রদান করেন যাতে তিনি এ প্রস্তাবকে অত্যন্ত ঘৃণাভারে প্রত্যাখ্যান করেন। এ বিবৃতিতে সা’দ যে ভাষা ব্যবহার করেন তার প্রতিটি শদ্ব আমার আজও মনে আছে।
“তোমাদের সামনে মিম্বার ও মঞ্চ রয়েছে যদি শ্রোতা মন্ডলী যোগাড় করতে পারো তাহলে তোমরা মিম্বারে দাঁড়িয়ে তোমাদের বক্তব্য শুনিয়ে দাও। তাছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এবং মাসয়িকীও রয়েছে তোমাদের হাতে। যদি পাঠকগণ তোমাদের লিখনী পড়তে প্রস্তুত থাকে তাহলে তোমাদের বক্তব্য লিখিত আকারে তাদের হাতে তুলে দাও তারপর অবশিষ্ট থাকে আদালাতে মামলা মোকদ্দমায় লড়ার পালা তো সেখানকার জন্য আমি তোমাদের সমকক্ষ নই।
আমার স্মরণ আছে যে, সা’দ জগলুল সম্পুর্ণ অসুস্থ অবস্থায়ও তাঁর স্নায়ুর ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম ছিলেন এবং কখনো ক্রোধান্বিত হতেন না। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে, মিসর ও সুদানে বৃটিশ সেনাবাহিনী প্রধান স্যার দার লিটাক যখন নিহত হয় তখন মিসরে নিযুক্ত বৃটিশ সরকারের ভাইসরয় জেনারেল আমীনবি সামরিক পোশাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গমন করেন। সা’দ জগলুল তখন তার দপ্তরে উপস্থিত ছিলেন। ইংরেজ জেনারেল সাহেব অনুমতি কামনা না করেই সোজা দরজা খুলে ভিতরে চলে যান এবং তীব্র ক্রোধভরে বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে সা’দ জগলুলকে হুমকী ধমকী দিতে থাকেন। জেনারেল সাহেবের মুখে যা আসলো কোন প্রকার চিন্তা-বিবেচনা না করেই তিনি তা উগলে দিতে লাগলেন। তার একটা হুমকী এটাও ছিল যে, সুদানের মাটি থেকে মিসরীয় সেনাবাহিনীকে কাল বিলম্ব না করে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু সা’দ জগলুল তার স্বভাব সুলভ আচরণ অনুযায়ী অত্যন্ত শান্তশিষ্টভাবে লাট সাহেবের সকল হুমকী ধমকী হজম করে যেতে লাগলেন এবং নিজের আসনের ওপর বসে তার মুখ পানে তাকিয়ে থাকলেন। অবশেষে কখন হুমকী ধমকী শেষ হয়ে যায় তখন অত্যন্ত ধীর স্থিরভাবে কৌতুক মিশ্রিত কন্ঠে বলতে লাগলেন, লাট সাহেব আর কি উত্তম খবর আছে? লড়াই ছড়িয়ে পড়েনি তো? লাট বাহাদুর সাহেব ঘৃণাভরে ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য সহকারে অগ্নিশর্ম হয়ে প্রত্যুত্তর না দিয়ে দপ্তর থেকে বেরিয়ে যান।
মিসরের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর আমি আমার স্মৃতিকথাগুলোকে সন্নিবিষ্ট করার প্রাক্কালে এবার আমি অফদ পার্টি সম্পর্কে কিছুকথা আরজ করতে চাই। “এ পার্টির ব্যাপক স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল গণমানুষের নিকট। এতদসত্ত্বেও ১৯২৪ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২৮ বছর সময়ে এ পার্টি শুধু ৮ বছর পর্যন্ত ক্ষমতার সমনদে সমাসীন ছিলেন। এর মৌলিক কারণ এই ছিল যে, হিযবুল অফদ ইংরেজদের সুরে হা কিংবা না বলার তাল মিলাতো। তাদের আট বছরের শাসনামলে এ পার্টিও বেশ কিছু ভুল-ভ্রান্তি করে বসে। তথাপি সামষ্টিকভাবে এ দল অন্যান্য মন্ত্রীসভার তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভাল ছিল।
সামরিক বিপ্লবের পর নতুন শাসকগোষ্ঠী মিসরের ইতিহাসসে মারাত্মকভাবে রদ-বদল করে দেন। রাজ্যের সমস্ত পদস্থ কর্মকর্তাই স্থীয় প্রতিকৃতি নির্মাণ করার জন্য মিসরের স্বানামধন্য ও বিখ্যাত ব্যক্তিগণ যেমন হাসানুল বান্না, আহমদ হোসাইন, সা’দ জগলুল, হাসান আল হুদাইবি,মোস্তফা এবং অন্যান্য বিদগ্ধ ব্যক্তিত্বগণের নাম চিহ্নও মুছে ফেলার প্রয়াস পান। বর্তমান হোসনী মোবারকও এ গতিরোধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
কিন্তু ইখওয়ানের পথপ্রদর্শক অদ্যাবধি এরূপ আচরণের উপযুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। যা বিগত সরকারগুলোর শাসনামলে মিসরীয় সকল মহাপ্রাণ ব্যক্তির সাথে করা বৈধ মনে করা হতো। প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারককে ইতিহাসের ঋণ পুরোপুরিভাবে আদায় করে দিতে হবে। আধা সংস্কার সংশোধন কার্যক্রমের সাহায্যে এ ঋণ কখনো্ শোধ হবে না কিছুতেই শোধ হতে পারে না।
শাহ অপেক্ষাও অধিক শাহ পূজারী
সকল সমাজে ও পত্যেক দেশেই “শাহ থেকেও বেশী শাহের পূজারী” উপাদানসমূহ সর্বকালেই বর্তমান থাকে। ইখওয়ানকে যখন জিন্দানাখানায় শৃংখলিত করা হয় তখন কারাগারের অফিসারগণ তাদের সিনিয়র অফিসারগণের মনস্তুষ্টি অর্জন করার লক্ষ্যে একে অন্যের তুলনায় অধিকতর অগ্রনী হয়ে আমাদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাতো। নিজেদের এ জঘন্য আচরণসমূহের তারা বড়ই গর্ভভরে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত গোপন প্রতিবেদন আকারে পৌঁছাতো। এসব লোকের আচরণ সৌজন্য ও আভিজাত্যের সকল মানদন্ডে নিন্দনীয় এবং বর্বরতা ও পাষান্ডতার ছিল নিকৃষ্টতম উদাহরণ। এরূপ অশালীন তৎপরতার সাহায্যে তারা সরকারের দৃষ্টিতে ইজ্জত সম্মান এবং অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির উপযুক্ত বলে বিবেচিত হতো। বাস্তবিকই অধিকাংশ লোকের পদোন্নতি ও ভাগ্য প্রসন্ন করার ক্ষেত্রে এসব কৃতিত্ব ও কার্যকলাপ, বুনিয়াদী বৈশিষ্ট্য ও মৌলিক গুণাবলী রূপে পরিগণিত হতো।
আলওয়াহাত জেলখানায় আমাদের ঠাই হয়েছিল। শাবান মাসের শেষের দিকে কারাগারের দারোগা যার নাম আমি বর্ণনা করতে চাই না। একটা সুখবর শুনান। তিনি বলেন, পবিত্র রমজান মাস সমাগত প্রায় তাই তোমরা যদি বাড়ী থেকে খাবার আনাতে চাও তাহলে আমাদের কোন আপত্তি নেই। এ মোবারক মাসে তোমাদের ঘর থেকে প্রেরিত খাদ্য কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা ব্যতিরেকেই তোমাদের নিকট পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এ সংবাদে আমরা কিছুটা আনন্দবোধ করি এবং প্রবল উৎসাহ ও কৌতুহল ভরে আমরা আমাদের পরিবার পরিজনের নিকট এ খবর পৌছে দেই। আমাদের আত্মীয়-স্বজনগণ আমাদেরকে নিয়মিত খানা পাঠাতে শুরু করে। কিন্তু তা একদিনের জন্যেও আমাদের হাতে পৌছতে পারেনি। দারোগা সাহেব আনীত সকল খাদ্য সামগ্রী পরিপূর্ণ হেফাজতের সাথে তার নিকট রেখে দিতেন এবং রমজানের শেষ ভাগে যখন সেসব কিছু পঁচে গলে একাকার হয়ে গিয়েছিল তখন প্যাকেটে করে আমাদের বাড়ীর লোকদের নিকট ফেরত দিয়ে দেয় এবং বলে যে এগুলো কয়েদীদের হাতে পৌছানোর অনুমতি নেই। সুধী পাঠকমন্ডলী। আপনারা এতে অনুমান করতে পারেন যে, এ আচরণের ফলে আমাদের অন্তরে কতবড় আঘাত লেগেছিল। আর আমাদের পরিবার পরিজনের মনের অবস্থাই বা কেমন হয়েছিল।
রিজিক ধ্বংস করা এমনিতেই মস্তবড় অপরাধী তদুপরী এ জন্য যেসব টারা পয়সা ও মাল-দৌলত খরচ করা হয়েছে এবং আন্তরিকতা ও মহব্বতের সাথে আমাদের ঘরের লোকজন সে খাদ্য তৈরী করেছে ও আমাদের প্রিয়জনেরা উহা প্রত্যহ যে কষ্ট ক্লেশে জেলখানা পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে তা একটু ভেবে দেখুন ও কল্পনা করুন। বিপরীত দিকে জেলখানার উক্ত ফেরাউনের আচরণ এবং কর্মকান্ড খতিয়ে দেখুন। ছোট ছোট ফেরাউনের বাচ্ছারা বড় বড় ফেরাউনদের খুশী করার জন্য কিসব কাজ করে চলছিল। এসব লোভ-লালসার বান্দারা মানুষ নামের কলম্ক; মানবতা ও মনুষ্যত্বের দুশমন মানবীয় গুণাবলী এবং আল্লাহ তায়ালার ভয়-ভীতি শূন্য এসব মাহমানবগণ তাদরে কৃতকর্মের প্রতিফল অবশ্যই ভোগ করতে বাধ্য হবে।
ইখওয়ানী শহীদগণেকে ইহুদীদের ইংগীতেই ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে
মিসরের জাতীয় ইতিহাসের সকল ছাত্রই এ বেদনাদায়ক বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যকরূপে অবহিত রয়েছে যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুনের যেসব নেতা পরিচালকগণ ফিলিস্তিন যুদ্ধে ইস্রাঈলদের দাঁতভাংগা জবাব দেন। তারা সকলেই তাদের সরকারের পক্ষ থেকে শিরচ্ছেদের শাস্তির শিকার হয়। ইমাম হাসানুল বান্নাকে ইবরাহীম আবদুল হাদীর সরকার শহীদ করে দেয়। শাইখ মুহাম্মাদ ফারাগলী শহীদ, জনাব ইবরাহীম আল তীব শহীদ ও আল আখ তথা ভ্রাতৃপ্রতীম ইউসুফ তালাত শহীদ প্রমুখকে জামাল আবুদন নাসেরের সরকার ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে দেন। এগুলো কি কোন দৈবক্রমে সংগঠিত ঘটনা ছিল? পরিস্থিতি ও ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে অবগত ব্যক্তিগণ খুব ভাল করেই জানেন যে, এসব ধীর স্থির ও শান্তশিষ্ট মস্তিষ্কের ষড়যন্ত্রেরই ছিল ফলশ্রুতিমাত্র কোন আকস্মিকভাবে সংঘটিত কোন দুর্ঘটনা ছিল না।
১৯৬৭ ঈসায়ী সালের লড়াই স্বয়ং জামাল আবদুন নাসেরই শুরু করেছিলো। যা সমস্ত মুসলিম উম্মাহর ললাট কলম্কের টীকা স্বরূপ হয়ে রয়েছে। এ যুদ্ধড সম্পর্কে বহু বিষয় গুরুত্বের সাথে লক্ষণীয় ও সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। অনাগতকালের ঐতিহাসিকগণ লড়াইর অনেক কষ্টিপাথরে যাচাই করে ফায়সালা করবে যে, এ যুদ্ধে কে কি ভূমিকা পালন করেছে? অনেক কথাই বলা হয়ে থাকে কিন্তু আমি প্রামাণ্য, বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সূত্র ব্যতীত কোন বিবরণ পেশ করতে অভ্যন্ত নই। অবশ্য একটা বিষয় তো ইতিমধ্যে প্রমাণীত হয়েই গিয়েছে যে, আমাদের যুবকদের হাতে যেসব অস্ত্রশস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছিল তা ছিল সম্পূর্ণ অকেজো ও ব্যবহারের অনুপযোগী। যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আমাদের যুবক শ্রেণীকে জেনে বুঝে সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবেও এটা সন্দেহাতীতরূপে প্রমাণিত হয়ে গেছি যে, এ যুদ্ধের পূর্বে নাসের ও কোন কোন ইহুদী দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মাঝে শারমুস শাইখ এবং অন্যান্য স্থানে একান্ত সংগোপনে দেখা সাক্ষাত, শল্য পরামর্শ ও ষড়যন্ত অনুষ্ঠিত হতে থাকতো। ওসব লোক যারা কোবরা ছোগরা প্রয়োগের মাধ্যমে গনে পড়ে ফলাফল বের করতে সিদ্ধহস্ত তারা এসব ঘটনাবলী কেন মূল্যয়ন করে না। ওপর বর্ণিতঘটনা প্রবহ এবং ইখওয়ানুল মুসলিমুনের নেতৃস্থাণীয় ব্যক্তিদের হত্যাকান্ডের মধ্যে কি কোন যোগসূত্রের সন্ধান করা যায় না? ইখওয়ানের ওসব নেতৃবৃন্দ যারা ইহুদীদের আরাম হারাম করে দিয়েছিলেন কার অদৃশ্য হাতের সূক্ষ্ম ইংগিতে এসব ক্ষমতাশীন শাসক গোষ্ঠীতে নিষ্ঠুর হস্তে মৃর্ত্যুর ঘাটে উপনীত করা হয়েছিল।
আমি একথা কখনো ভুলে যেতে পারছি না যে, নাকরাশী পাশা ইখওয়ানের শীর্ষস্থনীয় ব্যক্তিগণকে ঘোরতর যুদ্ধচলাকালীন সময়ে গ্রেফতার করায়। ফিলিস্তিনের সম্মুখ সমর থেকে এসব মুজাহিদগণকে সোজা মাসরের কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঐতিহাসিক সামালোজকগণ এ ঘটনার কি বিশ্লেষণ পেশ করে থাকেন? আমি যদি ইখওয়ানূল মুসলিমুনের অন্তর্ভুক্ত না হতাম তাহলে এ বিষয়ে অনেক কিছুই বলতে পারতাম। এখন যদি আমি কিছু বলার চেষ্টা করি তাহলে উহাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে কথা বলার অভিযোগে অভিযুক্ত করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আমি এমন অনেক নিষ্ঠুর বাস্তব সত্য উদঘাটন করে দিতে পারি যা বড় বড় আমলাদের মজবুত দুর্গসমূহকে ভূ-গর্ভে প্রোথিত করে দিতে পারে । সত্য কথা এই যে, এসব আমলাদের কৃত্রিমকেতাদূরন্ত কীর্তিকলাপের স্বরূপ সকলেরই জানা আছে। আমরা শুধু আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করে থাকি। তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই সর্বোত্তম কর্মনীতি প্রণয়নকারী। আমদের শহীদগণও জান্নাতুল ফেরদাউসে পৌঁছে গেছেন। আর তাদের ওরপ যারা অত্যাচার নির্যাতনের ষ্টীমরোলার পরিচালনা করেছে তারাও তাদের উপযুক্ত কর্মফলের মুখোমুখি হয়ে গেছে। এখন আর কিছু বললে কি আর এসে যাবে। প্রত্যেকেই নিজ গনিজ কর্মফল পেয়ে থাকবে। কবির ভাষায়ঃ
হে গালেব! নৌকা যখন কূলে এসে ভীড়ে গেছে তখন আর আল্লাহর ওপর উম্মা ও ক্ষো্ভ প্রকাশ করে কি লাভ আর মাঝির দুর্নাম করেই বা কি হবে?
বিশ্রী ও ন্যক্কারজনক খেলা
ইতিহাসের কাজ হচ্ছে সত্য ও বাস্তবতাকে কোন প্রকার কম-বেশী না করে যথাযথ ও সঠিকভাবে উপস্থাপন করা। কিন্তু অনেক সময় ইতিহাস এর প্রকৃত দায়িত্ব পালনে অপারগ ও অক্ষম হয়ে পড়ে। ইতিহাস ওসব জঘন্য বিশ্রী ও সদর্য চেহারা জগদ্বাসীকে দেখাতে অনেক বিলম্ব করে ফেলেছে যাদের হাত মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে ইতিমধ্যে কিছু কথাবার্তা মানুষের সম্মুখে উদঘাটিত হয়ে পড়েছে আর বাকীগলোও শীগ্রই প্রকাশিত হয়ে যাবে। সংবাপত্রে এখন প্রত্যহ প্রবন্ধ ছাপা হচ্ছে “অমুক এবং অমুকের সম্পর্কে”- ইনি কার পুত্র এবং কারই বা জামাতা যাদের সম্বন্ধে কারুণের দৌলতের উপন্যাস ও উপাখ্যান তপ্ততাজা হয়ে উঠেছে? কোটি কোটি পাউন্ডের ধনদৌলত, বিত্তবৈভব ও সহায়-সম্পত্তি যেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করতে ক্ষোভ ও ঘৃণায় মন ভরে উঠে কোথা থেকে নাজিল হয়েছে তারপর আবার এগুলো কি করে মিসরের বাইরে স্থানান্তরিত হয়ে গিয়েছে? ইউরোপে বড় বড় মহল ও বালাখানাসমূহ এবং পত্র-পত্রিকা ও সাহিত্য সাময়িকী ওসব লোক কিভাবে কিনে নিয়েছে? ওরা অস্ত্রশস্ত্রের বিশ্ব বাণিকে কিরূপ পরিণত হয়েছে? সকল প্রকার হালাল হারাম কারবারে তারা কেমন করে তাদের পাঞ্জা গেড়ে বসেছে? রেখে দিন, হালাল হারামের আলোচনা তো এসব লোকের জন্য অর্থহীন। তারা তো পয়সার পূজারী। ইহার আমাদানী কোত্থেকে কিভাবে হচ্ছে সে প্রশংগই তাদের জন্য অবান্তর। তাদের লাজ লজ্জা কোথায় যেন উরে গেছে? গুনাহ কিংবা পাপের কোন প্রকার ভয়-ভীতি এবং ময়দানে হাশরের আদালতের কোন ডর ও শংকা কি তাদের মনে উদয় হয় না?
১৯৫২ সালে সংঘটিত বিপ্লব অভ্যুত্থান ছিল আমাদের সযত্ন প্রয়াস-প্রচেষ্টারই ফসল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিপ্লবের নেতৃত্ব ইহার সঠিক গতিপথ থেকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। যা জাতির মুক্তি ও দেশবাসীর নাজাতের জামিন হতে পারে। শানদার বাংলো, বড় বড় স্থল পথ ও নৌপথের অফুরন্ত সহায় সম্পদ আসলো কোত্থেকে? এসব বিপ্লবী শ্লোগানে মুখরিত ব্যক্তিগনের অবস্থান প্রতি দৃষ্টিপাত করে দেখুন। সাথে সাথে নিরপরাধ নিরীহ লোকদের ওপর তাদের ক্ষোভ ও দোষারোপের প্রতি লক্ষ্য করুন। আমি তাদের জিজ্ঞেস করতে চাই যে, অভ্যুত্থানের পূর্বের অবস্থা ও বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতির তুলনা করে বলুন যে, এসব প্রচুর্য ও ধন-সম্পদ কি তাদের জন্য ভূ-গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছে নাকি আকাশ থেকে বৃষ্টিরূপে বর্ষিত হয়েছে? এসব চাঁদের দেশ থেকে এসব দৌলত তাদের হাতে এসে ধরা দিয়েছে?
আল্লাহ তায়ালার শোকর যে, এসব কলম্কিত লোকদের সহিত না আমাদের কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে এবং না বংশীয় কোন যোগসুত্র। আল্লাহ তায়ালা তাদের সকল অপকর্ম থেকেও আমাদের রক্ষা করেছেন। এমনকি তাদের উঠে পড়া অংগুলিসমূহ থেকে আমাদের নিরাপদ রেখেছেন। এসব লোক এতবেশী বাদনাম ও কুখ্যাত হয়ে পড়েছে যে, তাদের কুকীর্তি ও অপকর্মসমূহ সর্বস্তরের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন তাদের সম্পর্কে যদি কোন ভিত্তিহীন অবন্তর গুজবও সত্য যে আগুনের অস্তিত্ব ব্যতীত ধোয়ার কল্পনাও করা যায় না। তেমনিভাবে উটের উপস্থিতি ছাড়া উটের বিষ্ঠা অচিন্তনীয়।
পি, এইচ, ডি-এর থিসিস ও ইখওয়ান
স্বীয় স্মৃতিচারণের এ সন্ধিক্ষণের সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে আমি উস্তাদ মুহাম্মাদ ফাতী শীর বিরচিত প্রবন্ধের উল্লেখ করতে চাই। যার ওপর ভিত্তি করে তাকে ডক্টরেট ডিগ্রীর দুর্লভ সম্মানে ভূষিত করা হয়। তার নিবন্ধের শিরোনাম ছিল “ইখওয়ানের প্রচার প্রসার ও সুনাম সুখ্যাতি মুদ্রণ মাধ্যম।” বিজ্ঞ নিবন্ধকার অত্যন্ত পান্ডিত্যপূর্ণভাবে ও জ্ঞানগর্ভ ভংগীতে বিষয়বস্তরি পুরোপুরি হক আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি প্রকৃত সত্য ও নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে তার বলিষ্ঠ লিখনীর মাধ্যমে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। যাতে তিনি তার ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দকে কোন প্রভাব সৃষ্টি করার ও নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ করার সুযোগ দেননি। প্রসংগক্রমে একানে আমি ওসব গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি যা আলোচ্য প্রবন্ধে উপস্থাপন করা হয়েছে।
১- ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস………. এ সম্পর্কে আমি বলতে চাই যে, এটা আমাদের সেই মজবুত কেন্দ্রীয় প্রতিপাদ্য বিষয় যার ভিত্ কখনো নড়বড়ে হয়ে যায়নি। আমি আল্লাহ তায়ালার সমীপে অন্তরের অন্তস্থল থেকে করছে যে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে পুরোপুরি নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে ইসলামের বুনিয়াদী আকীদা-বিশ্বাসের ওপর কায়েম রাখুন। নির্ভেজাল তাওহীদ ও রিসালাতে মুহাম্মাদী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম –এর ওপর মজবুত একীন, মুতাশাবিহাত থেকে রক্ষা এবং খুঁটিনাটি ও গুরুত্বহীন বিষয়াবলীল ওপর আলোচনা সমালোচনায় জড়িয়ে পড়া থেকে দূরে থাকা আমাদের মৌলিক আকীদা বিশ্বাসের অংশ বিশেষ।
২- আনুগত্য ও অনুসরণে আপ্রাণ প্রয়াস প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা……………ইহার সহিত আমি আরও যোগ করতে চাই যে আকীদা বিশ্বাসের নিরাপত্তার বাস্তব দলিল ও কার্যকরী প্রমাণ হচ্ছে এ’তেকাদের দাবী পূরণ করে চলা এবং আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য অনুসরণে সতত যত্মশীল হওয়া।
৩- আল্লাহর জন্যেই মহব্বত ও প্রেম ভালবাসা ………..এর সাথে আমি আরো যোগ করতে চাই যে, প্রকৃত মুসলিম হচ্ছে সে ব্যক্তি যে শুধুমাত্র আল্লাহরই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পরস্পরের সাথে মিলিত হয় এবং পারস্পরিক মহব্বত ও ভালবাসার পরিচয় দিয়ে থাকে এবং আল্লাহর দুশমনদের প্রতি তাদের ঘৃণাবোধ থাকে সমভাবে।
৪- ইত্তেহাদে ইসলামীকে বালিষ্ঠভাবে ধারণ করা……….. আমি বলতে চাই যে, আল্লাহ তায়ালার সাহায্য সহযোগিতার পর মিল্লাতে ইসলামীল ঐক্য ও সংহতিই হচ্ছে সর্ববৃহৎ শাক্তি যা মুসলিম জাতির হৃত গৌরব হারানো ঐতিহ্য সম্মান ও মর্যাদা পুনর্বহাল করার নিশ্চয়তা দিতে পারে।
৫- প্রশিক্ষণ ও আত্মশুদ্ধি ……………….এ প্রসংগে আমার বক্তব্য হচ্ছে এই যে, এ মূলনীতিকে বাস্তবে রূপদান করতে হলে বিশ্বস্ততা সদাচরণ, আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পুরো করা, বান্দা ও আল্লাহর মাঝে সুগভীর গড়ে তোলা, কর্মীর সাধারণ মানুষের সাথে এমনকি স্বয়ং তার নিজের অস্তিত্বের সাথে প্রগাঢ় সত্য ও সুসম্পর্ক সৃষ্টি করতে আপ্রাণ চেষ্টা করা বাধ্যতামূলক ও অত্যাবশ্যকীয় পথের সম্বলের মর্যাদা রাখে।
৬- দাওয়াত প্রচার ও প্রসারের প্রাণান্ত প্রয়াস-প্রচেষ্টা ……..এখানে আমি বলতে চাই যে, দাওয়াতে হকের দীর্ঘ স্থায়ীত্বের জন্য উহার প্রচার গও প্রসারে সকল আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা অতীব জরুরী।
৭- ইসলামী শিষ্টাচার ও শালীনতা রপ্ত করা……….জীবনের আদাব আখলাক আমার দৃষ্টিতে ইসলাম যে উন্নত মানদন্ডের ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে তার তুলনা কোথাও মেলে না।
৮- নিজস্ব মূলনীতি ও আদর্শের ওপর অটল অবিচল হয়ে থাকা…….. আমার বক্তব্য হচ্ছে যে, নিবেদিত প্রাণ ও নিষ্ঠাপূর্ণ ঈমান কখনো টলটলায়মান হতে পারে না। সবর ও ধৈর্য, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কুরবানী এবং শৌর্যবীর্য ও বীরত্ব এমন মৌলিক যুগান্তকারী ও অনন্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য যা জালেম ও অত্যাচারী এবং ইসলামের দুশমনদের মোকাবেলায় মুমীন বান্দাকে পেশ করতে হয়। এগুলোই তার ঢাল ও শিরস্ত্রান আবার এগুলোই তার অস্ত্রশস্ত্র ও হাতিয়ার।
৯- হক ও খাইর তথা সত্য ও কল্যাণের প্রতি অনুরাগ………..আমি বলতে চাই যে, এ দু’টো জিনিসই ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণের বুনিয়াদী পাথর সদৃশ্য। ঈমানের কোন অস্তিত্বই লাভ করা সম্ভব নয় যে পর্যন্ত আপনি আপনার ভাইয়ের জন্য ওসব কিছু পছন্দ করতে না পারবেন যেগুলো আপনার নিজের জন্য আপনি পছন্দ করে থাকেন।
যাতে করে আল্লাহর দ্বীনের পতাকাই থাকে সমুন্নত
ইখওয়ানুল মুসিলিমুন তাদের দাওয়াতী কার্যক্রম সম্প্রচার করার জন্য শরীয়াত সম্মত সকল উপায় উপকরণ অবলম্বন করার প্রয়াস পায়। ইমাম শহীদ বিশটিরও বেশী সংখ্যক ইসলামী সাহিত্য-পুস্তিকা লিপিবব্ধ করেন। এগুলোতে তিনি সমস্ত মুসলিম জাহানের সমস্যাবলীর ওপর আলোকপাত করেন। তিনি শুধুমাত্র মিসর ও ফিলিস্তিন সমস্যার ওপরই তার লিখনীকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং তার আকাংখা ছিল সমগ্র বিশ্বব্যপী ইসলামী আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে দেয়ার প্রতি। আমরা বহুবার বলেছি ও লিখেছি যে, আমরা ক্ষমতার লোভী নই আর না রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব ও অবস্থানের বিরোধী। আপনারা অনুগ্রহপূর্বক ১৯৪৮ সলের ১৩ই জুন তারিখে উজীরে আযমের উদ্দেশ্যে ইমাম শহীদের লিখিত এ অংশটির প্রতি লক্ষ্য করুন।
যদিও আপনার আমলে আমাদের ওপর ও আমাদের প্রাণপ্রিয় আন্দোলনের ওপর যুগপৎভাবে কঠোর দমননীতি চালানো হয়েছে। এতদসত্ত্বেও আপনার বিরুদ্ধে আমাদের কোন শত্রুতা ও ক্ষোভ নেই। আপনার সংস্কারমূলক মহতী পদক্ষেপসমূহ এবং সেগুলোর সফলতার স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকৃতি আমরা জ্ঞাপন করছি। ইতিহাসের পাতায় সোনালী অক্ষরে আপনার এসব মহতী কার্যবলী লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে। আর আমরাও এগুলো মনে রাখবো। আমরা এমন এক পুত-পবিত্র দাওয়াতের দায়ী ও আহবায়ক যা ব্যক্তিগতভাবে কারো সাথে বৈরিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, শত্রুতা ও প্রতিহিংসা পোষণ করাকে আদৌ জায়েযৈই মনে করে না।
সুধী পাঠক! আপনারা কি দেখার সুযোগ পাননি যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন তাদের ওপর অত্যাচার নের্যাতনের ষ্টীমরোলার পরিচালনাকারীদের ব্যাপারে কিরূপ আচরণ ও কর্মনীতি অবলম্বন করেছে? তথাপি আমাদের ওপর এরূপ অভিযোগ আরোপ করা হয় যে, আমরা সন্ত্রাসবাদী এবং মানুষের পিপাসু।
“ওগো আল্লাহ! আপনি মেহেরবানী করে আমাদের ও আমাদের জাতির মধ্যে ন্যায়সম্মত ফায়সালা করে দিন আর আপনি তো সর্বোত্তম ফয়সালাকারী” মিসর ও মুদানের মধ্যে উত্তেহাদ তথা ঐক্য ও সংহতির আওয়াজ সর্বপ্রথম ইমাম হাসানুল বান্না শহীদই তুলেছিলেন। তার জানা ছিল যে, সার্বিক উন্নতি অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাচ্ছন্দ উভয় দেশের একীভূত করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। দু’দেশই এ লক্ষ্যে পারস্পরিকভাবে একে অপরের খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছিলো। তারপর আসে আবদুন নাসেরের শাসনকাল। তিনি না বুঝে না শুনেই মিসর ও সুদানকে আলাদা আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত করে দেন। তিনি ভ্রাতৃপ্রতীম দু’দেশের মাঝে একটা খোঁড়া অজুহাতকে ভিত্তি বানিয়ে সিদ্ধান্তকরী অন্তরায় ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে দেন। তিনি তার সাধারণ অনুমান দ্বারা তার এ সিদ্ধান্তকে জনগণের মুক্তি ও স্বাধীনতার নামান্তর বলে স্থির করেন। মিসরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক এবং সুদানের প্রেসিডেন্ট জাফর নিমেরী উত্তম দেশের একত্রীকরণের জন্য প্রেচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, নসের যে ন্যক্কারজনক ভুল করে ছিলেন এখন গিয়ে তারই সংশোধনের চেষ্টা করা হচ্ছে।
ওপরে আমরা দাওয়াতে প্রসার ও প্রচারের আলোচনা করে এসেছি। সংবাদপত্র প্রসার ও প্রচারের সর্বাপেক্ষা কার্যকরী মাধ্যম এবং ইখওয়ান এ ময়দানে নেহায়েত শীর্ষস্থানীয় ও উত্তম উদাহরণসমূহ স্থাপন করেছে। কোন কোন ইখওয়ান “কাশকুলুল জাদীদ” নামক সাময়িকী চালু করেন এবং পর্যায়ক্রমিক সংবাদপণ্যের ন্যায় উহাকে বিন্নস্ত করে প্রকাশ করেন। ইমলাম এবং ইসলামী আন্দোলনের সংবাদপত্র অংগনেও একটা নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। ইমাম শহীদ যখন সংশ্লিষ্ট সাময়িকীল ক্রমিক সংখ্যা দেখতে পান তখন তিনি উহার সম্পদকের নামে এ মর্মে চিঠি লিখেনঃ
“তোমরা যে প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি অবলম্বন করেছো উহার সাথে আমি একমত হতে পারছি না। যে আংগিকে আমি “আল কাশকুলুল জাদীদ” কে দেখতে পেয়েছি তা আমার মোটেও ভাল লাগেনি। আমি আশা করি যে, তোমারা বর্তমান রীতি ও ধারা বাদ দিয়ে নিজেদের আন্দোলনের দৃষ্টিভংগি সংবাদপত্রে উপস্থাপনের সযত্ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।”
(বজ্ঞ নিবন্ধকার ১৯৪৭ সালের ২৯শে আগষ্ট তারিখে প্রকাশিত সংখ্যায় ইমামের লিখিত উল্লেখিত পত্রেরও উল্লেখ করেন।)
আরশ পর্যন্ত পরিব্যপ্ত সাহস প্রয়োজন
ইখওয়ানের সাথে সরকারের বিরোধ ছিল দীর্ঘ দিনের। আমাদের আকীদা বিশ্বাস হচ্ছে এই যে, ইসলাম দ্বীনও এবং একই সময় রাজনীতিও। দ্বীনের ব্যাপারে এটাই সঠিক দৃষ্টিভংগী। কিন্তু সরকার আমাদের এ দৃষ্টিভংগির সম্পূর্ণ বিরোধী। আমাদের মাজহার পূজা পার্বণের মাযহার নয় বরং এটা পূর্ণঙ্গ একটা জীবনব্যবস্থার নাম। ইহা পুরো জীবনের সংস্কার ও সংশোধন কামনা করে। ইহার দৃষ্টিতে দুনিয়ার এ জীবন শস্যক্ষেত্রেরই নামান্তর। যার ফল লাভ করা যাবে আখেরাতে। এখানে আমরা যা কিছু বপন করবো সে ফসলই পরকালে কর্তন করবো। মানুষের সকল কাজ-কর্ম এবং তার জীবনের সকল দিক ও বিভাগ ইসলামের প্রদর্শিত হেদায়াত ও রৌশরীতে সমুজ্জল। সরকারের সাথে আমাদের এ আচরণ সম্ভবত এভাবেই চলতে থাকবে যতদিন পর্যন্ত না আল্লাহ দ্বীনের সঠিক ধারণা দান করবেন। সুদুর দিগন্তে উজ্জল রশ্মির আভা ও কিরণমালা পরিদৃষ্টি হচ্ছে এবং পরিবর্তনের লক্ষণ অত্যাসন্ন প্রায়। যে সমস্ত কথাবার্তার কারণে আমাদেরকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছিলো আজ ওসব কথাই সর্বস্তরের গণমানুষের মুখে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মিসরের সকল রাজনীতিবিদগণই এখন ইসলামী শরীয়াত প্রবর্তনের দাবী জানিয়ে আসছে। ইহা ইখওয়ানের কামিয়াবী ও সফলতা এবং বিজয়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ। মূলনীতির ব্যাপারেও মৌলিকভাবে সকলেই একমত হয়ে গেছেন। এখন বাস্তবায়ন ও কার্যকরী করার শুভ সূচনাই শুধুমাত্র বাকী রয়েছে যার জন্য আমরা তীর্থের কাকের ন্যায় অধীর আগ্রহে প্রতিক্ষার প্রহর শুনছি।
(আর সে বহু প্রত্যাশিত সুদিন কেবল তখনই আসতে পারে যখন আল্লাহ তায়ালার অপার অনগ্রহে লব্ধ বিজয়ের ওপর বিশ্ব মুসলিম হর্ষোৎফুল্ল হয়ে ওঠবে। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাকেই সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করে থাকেন। তিনি মহাপরাক্রমশালী এবং দয়ালু। এ ওয়াদা আল্লাহ নিজেই করে রেখেছেন। আর আল্লাহ তো কখনো তার অংগীকার ভংগ করেন না। কিন্তু এ সত্য অধিকাংশ লোকই জানে না। মানুষ তো জানে দুনিয়ার জীবনের বাহ্যিক দিক মাত্র আর আখেরাতের ব্যাপারে তারা নিজেরাই গাফেল- উদাসীন ও অমনোযোগী।)
আমরা আমাদের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও অভিষ্ট বস্তুকে ফল-ফুল ও পত্র-পল্লবে সুশোভিত ও সুসজ্জিত হতে দেখতে পাচ্ছি। ইসলামী মূল্যবোধের আমলে নতুন সূ্র্য উদিত হওয়ার আর কোন দেরী নেই। বাতিলের অন্ধকার কেটে যাওয়ার জন্য উদ্যত। অগণিত শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। এ জগত আবার ইমলামের উজ্জল দীপ্তিতে ইনশাআল্লাহ ঝলমলিয়ে উঠবে।
ওগো আল্লাহ! এসব স্মৃতিচারণের সময় আমি যা কিছু লিপিবদ্ধ করেছে এবং বলার চেষ্টা করেছে একে তুমি বিশেষভাবে তোমার জাতে করীমের জন্য কবুল ও মনজুর করে নাও। আর হে পরওয়ারদিগার! যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে আমার থেকে কোন ভুল-ত্রুটি প্র্রকাশ পেয়ে থাকে তুমি নিজ গুণে তা ক্ষমা করে দাও। বস্তুত তুমি ব্যতীত আর কেইবা মাগফিরাত ও দয়া অনুগ্রহ প্রদান করতে পারেন?