পঞ্চম অধ্যায়
প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যাপারটা শিক্ষালাভের মত সহজ নয়। মানুষ শিক্ষা লঅভ করে এবং তারপর সাধারণত সে একটা গ্রন্থের রূপ পরিগ্রহ করে। বেশী পড়া-লেখা জানা লোকেরা কিছু সংখ্যক চলমান কিতাব বিশেষ হয়ে থাকে। ঐ সকল বইতে জ্ঞান থাকে কিন্তু সেই জ্ঞান প্রকৃত জ্ঞানী সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় না। েএ ধরনের শিক্ষিত লোকদের মধ্যে ইল্ম অনুযায়ী আমল করার তথ্য জীবন গঠন করার কোন গুরুত্ব থাকে না। একজন শিক্ষার্থীর জন্য এথেকে বড় জুলুম আর কিছুই হতে পারে না যে, তার উস্তাদ বাস্তব জীবনে সে সমস্ত মূলনীতি লংঘন করবেন। যার ওপর তিনি তার পাঠ কিংবা বক্তৃতায় কুব জোর দিয়ে থাকেন।
আপনি একজন শিক্ষার্থীকে অতি সহজেই নামায শিক্ষা দিতে পারে। নামাযের আরকান কি কি এবং কি কি কারণে নামায ফাসিদ হয়। নামাযের মধ্যে মুস্তাহাব আমল কোনগুলো আর জাগরুক রাখতেন যে, নামাযের বাহ্যিক আকৃতি-প্রকৃতি শিক্ষা দেয়ার পূর্বেই তার মূল উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করা দরকার। তিনি বলতেন: তোমরা যদি নামাযের বাহ্যিক শর্তাবলী পূরণ করো তা হলে বাহ্যত তোমাদের ফরয আদায় হয়ে যাবে সত্য কিন্তু নামাযের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনয়, নম্রতা এবং সততা। নিজেকে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহতে সোপর্দ করে দেয়া হচ্ছে নামাযের মগজ। ইমাম তার অনুসারীদের মনে এসব বিষয় বদ্ধমূল করে দেয়ার প্রচেষ্টা চালাতেন। তিনি বলতেন এসব গুণাবলী ব্যতীত আমাদের নামায আমাদের প্রকৃত কোন উপকারে আসবে না। সত্য বলতে কি ইমাম যে এই যুগ ও প্রজন্মের সর্বোত্তম মরুব্বী ছিলেন সে সম্পর্কে কোন মতোবিরোধ হতে পারে না।
আকীদাগত কারণে ইসরাঈলের সাথে শত্রুতা
কমিউনিজম, খৃস্টবাদ ও ইহুদীবাদ যেমন হাসানুল বান্না ও ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সাথে শত্রুতা পোষণ করে তেমন বৈরিতা তাদের অপ কারো সাথে নেই। এর কারণ হচ্ছে, হাসানুল বান্না ও ইখওয়ান এই অঞ্চলে কমিউনিজমের লুটপাট ও ধ্বংসের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে প্রমাণিত। খৃস্টবাদ ও ইহুদীবাদের জন্যও ইখওয়ান বিপজ্জনক। কারণ তারা তাদের দ্বীনের শিক্ষাসমূহকে শুধু জ্ঞানের পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রেখেই অধ্যয়ন করে না। বরং তা পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়িত ও কার্যকরী করার শিক্ষাও দিয়ে থাকেন। তারা প্রতিটি সামরিক ও মতাদর্শগত আগ্রাসনের বিষাক্ত প্রভাব ও পরিণাম থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে চায়। তাদের আপ্রাণ চেষ্টা হচ্ছে, মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি ব্যক্তি যেন মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বাদলাভ করতে পারে এবং মানবতা সামগ্রিকভাবে তাদের মৌলিক অধিকার ফিরে পায়। তারা এটা মোটেও পছন্দ করে না যে, মুসলিম জাতি দান খায়রাতের ও বিদেশী সাহায্যের আশায় বেঁচে থাকবে। অথচ মুসলিম দেশগুলোতে প্রত্যেকটি জিনিস এত অধিক পরিমাণে রয়েছে যে, (যদি ইনসাফভিত্তিক বন্টন করা যায়) তাহলে সমস্ত মানুষের প্রয়োজন খুব ভালভাবে পূরণ হতে পারে। ইখওয়ানের আকাংখা হচ্ছে তাদের এবং তাদের শাসকদের মধ্যে সম্পর্ক হবে পারস্পরিক সম্প্রীতি সুবিচার সম্মান বোধের ভিত্তিতে।
হাসানুল বান্না শহীদ আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, প্রজা সাধারণের ওপর রয়েছে শাসকগোষ্ঠীর অধিকার যেমন তাদের নির্দেশ পালন করা এবং তাদের আনুগত্য করা। (যদি তা আল্লাহ তায়ারার নাফরমানীর পর্যায়ে না পড়ে) অনুরূপ তিনি আমাদেরকে আরো বলেছেন যে, শাসকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, তারা আদল ও ইনসাফের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন এবং জুলুম-অত্যাচার ও নির্যাতন-নিপীড়নের পলিসি বর্জন করবেন।
সাইয়েদেনা ওমর ইবনুল খাত্তাবের (রা) তাঁর ভাই যায়িদ বিন খাত্বাবের হত্যাকারীকে ভাল লাগতো না। হন্তা যখন ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তিনি ওমর (রা)-কে বলেন: আমীরুল মু’মিনীন! আমার সম্পর্কে আপনার মানসিক অবস্থা ও অনুভূতি আমাকে আমার কোন অধিকার ও প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করবে না তো?”
তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “কখ্খনো না।”
অতপর সেই ব্যক্তি বলতে লাগলো, “যদি প্রকৃত ব্যাপার তাই হয় তাহলে আপনার আমাকে পছন্দ না করা কোন চিন্তার কারণ হতে পারে না। এমতাবস্থায় মেয়েরা কাঁদতে পারে, পুরুষ কাঁদতে পারে না। অবশ্য পুরুষদের জন্য এটা শোভনীয় নয় যে, তারা বসে বসে কাঁদতে থাকবে।
এ ঘটনার আলোকে মুর্শিদ আমাকে বলেছিলেন যে, শাসকদের পছন্দ অপছন্দের বিষয়টি কখনো কোন ব্যক্তিতে তার শরীয়াত স্বীকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। আমি একটা হাদীস পড়েছি। হাদীসটির নির্ভরযোগ্যতা অবশ্য আমি যাঁচাই করে দেখিনি। হাদীসটির সারমর্ম হলো, “যে ব্যক্তি কোন ন্যায় পরায়ণ সুলতানকে অপদস্ত করে তার তওবাও কবুল হয় না।
সাইয়েদ হাসানুল বান্না না ছিলেন সন্ত্রাসী না ছিলেন তথাকথিত বিপ্লবী।ভ বরং তিনি ছিলেন সত্যের দিকে আহ্বানকারী ও সংস্কারক। তিনি যেখানেই যেতেন এবং যার সাথেই মিলিত হতেন তাকেই ভালবাসা, শান্তি ও সহযোগিতার শিক্ষা দিতেন।
মাকরুহই বা কোনগুলো। এসব বিষয়ে শিক্ষা অত্যন্ত সহজ। কিন্তু শিক্ষার্থীর মন-মগজে এবং তার বাস্তব জীবনে এই অনুভূতি সৃষ্টি করে দেযা যে, (আরবী***********) (“নিশ্চয় সালাত মানুষকে অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে।)” অত সহজ কাজ নয়। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: (আরবী***********) (“যে ব্যক্তির সালাত তাকে পাপ ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখলো না সে তার সালাত দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার পরবর্তে আল্লাহর রহমত থেকে আরো দূরে সরে গেলো।”)
আমাদেরকে একথা ভেবে দেখতে হবে যে, যদি সালাতকে (রূহানী প্রেক্ষাপট) কেবল মাত্র যান্ত্রিক নিয়মে এবং গতানুগতিক প্রকি্রিয়ায় বিশেষ অংগ ভংগীর সাহায্যে আদায় করাও হয় তাতে রবের নৈটক্য লাভ করা সম্ভব হয় না। অথচ সালাতের সর্ব প্রথম ও সর্বপ্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে আল্লাহর নেকট্র লাভ। এ বিষয়টিকে সক্রিয় বিবেচনায় রেখে সাইয়েদ হাসানুল বান্না সালাতকে খুবই গুরতু্ব দিতেন। ইখওয়ানের প্রশিক্ষণের সময় এই অতুলনী ব্যক্তিত্বের অধিকারী মুর্শিদ সর্বদা মন ও মগজে এই নীতি
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই যে, ইসলামী জাহানের কোন কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এই বাস্তবতা থেকে চোখ বন্ধ করে থাকেন এবং ইখওয়ানুল মুসলিমুনে বিরুদ্ধে সংঘাত ও বৈরিতায় অবতীর্ণ হন। তাদের মধ্যে। এই কুধারণা বদ্ধমূল রয়েছে যে, দেশ ও সরকারের মধ্যে ইখওয়ান তাদের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী। (এবং যে কোন সময়ে তাদের ক্ষমতার মসনদ উল্টিয়ে তাদের হাত থেকে ক্ষমতার দন্ড ছিনিয়ে নেবে) অথচ প্রকৃত ব্যাপার এই যে, ইখওয়ানের মূল উদ্দেশ্য সংস্কার এবং বর্তমান অবস্থার উন্নতি বিধান। একটু লক্ষ করুন যে, ইখওয়ানের প্রকৃতরূপ এবং তার বিরুদ্ধে রটানো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন প্রপাগান্ডার মধ্যে কত ব্যবধান। কবির ভাষায়:
(আরবী***********)
(ওগো সুরাইয়া ও সুহাইল নক্ষত্রের মধ্যে মিলন সৃষ্টির অভিলাষী। তোমাকে আল্লাহ তায়ালা কিছু বিবেক বুদ্ধিমান করুন। এটা কি করে সম্ভব? সুরাইয়ার উদিত হওয়াকে মানুষ কুলক্ষণ বলে মনে করে আর সুহাইলের উদিত হওয়াকে কল্যাণের প্রতীক হিসেবে বরণ করে নেয়।)
[শেষ পংক্তির অর্থ এও হতে পারে যে, সুরাইয়া সিরিয়ার দিগন্তে উদিত হয় আর সুহাইল ইয়েমেনের আকাশে দৃষ্টিগোচর হয়। তার মানে উভয়ের মধ্যে বিস্তর দুরত্ব বিদ্যমান।]
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি যদিও ইমামের শাহাদাতের প্রায় তিরিশ বছর পর সম্পাদিত হয়েছে। কিন্তু ইমামের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই চুক্তি সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা আমি সমীচীন মনে করছি। এটা আমি এ জন্য জরুরী মনে করছি যে, এই সমঝোতা চুক্তির ব্যাপারে ইখওয়ানের ভূমিকা এবং তা রহিত করার নীতি সেই রাজননৈতিক শিক্ষার ফল। যা ইসলামী আকীদার ভিত্তিতে ইমাম আমাদেরকে দিয়েছেন। কারণ ইসলাম একাধারে দ্বীন ও হুকুমাত দু’টিই।
ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে যারা অবহিত তাদের এটা ভালভাবে জানা থাকা আবশ্যক যে, ইসলামকে সমূলে উৎখাত করার নীল নক্শা বাস্তবায়িত করার জন্যই এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটাই এর মূল উদ্দেশ্য। যে ব্যক্তি ইসরাঈল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে এ থেকে ভিন্ন ধারণা পোষণ করে যে ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে ব্যীক্ত আগন্তুককে ততক্ষণ পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারে না যতক্ষণ না তার তার পোশাক জ্বালিয়ে তার শরীরের অংগ প্রত্যংগ অবধি গিয়ে পৌঁছে। কারণ যদি শুধু মাত্র ইহুদীদের জন্য একটা পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই উদ্দেশ্য হতো তা হলে আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকায় কতিপয় বিস্তৃণ অঞ্চল ছিল এরূপ অস্বাভাবিত রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য ঐসব এলাকায় অনুকূল পরিবেশও পাওয়া যেতো। কিন্তু এ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠার জন্য পরিকল্পনা ও সতকর্কতার সাথে এই অঞ্চলটি বেছে নেয়া হয়েছিলো তার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। তাইতো তারা এমন এলাকা বেছে নেয় যেখানে ইসলামের অস্তিত্ব বহু পুরাতন। এই রাষ্ট্রের সাহায্যে তাদের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। বৃটেন তার অছিগিরির যুগে ইহুদীদেরকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ফিলিস্তিনে স্থানান্তর করতে শুরু করে এবং তাদেরকে পুরোপুরি সশস্ত্র অবস্থায় এখানে বসবাস করার সুযোগ করে দেয়্ অপর দিকে কঠোর আইন প্রবর্তন করে ফিলিস্তিনীজনগণকে সম্পূর্ণরূপে অস্ত্র থেকে বঞ্চিত করা হয়। এমনকি সবজি কাটার ছুরি রাখাও ফিলিস্তিনীদের জন্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
বৃটেনের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ইহুদীরা প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে এবং ফিলিস্তিনীদের (প্রতিরোধ আন্দোলনের) মোকাবিলায় তত্বাবধায়ক রাষ্ট্রের (বিকেন) সহযোগিতা গ্রহণ করতে থাকে। ফিলিস্তিন আযাদী আন্দোলন ও ইখওয়ান মুজাহিদগণের সাহায্য ও সহায়তায় তাদের অধিকার আদায়ের জন্য তৎপর থাকে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা পরে আসবে। আফসোস! যদি আমরা প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করতে পারতাম, আরো দুঃখ মুসলিম উম্মাহ এবং আরব জাহানের ক্ষমতাসীনরা যদি তাদের চোখ খুলে দেখতেন তাহলে দেখতে পেতেন যে, খৃস্টান, কমিউনিষ্ট ও ইহুদী শক্তি তাদের পায়ের তলায় চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে রেখেছে এবং ধ্বংসাত্মক গর্ত খুঁড়ে রেখেছে। হায়! যদি তারা সেই ভয়ানক গর্ত দেখতে পেতো যা তাদের এবং তাদের দেশ ও জাতির জন্য দুশমন তৈরী করে রেখেছে। অথচ তারা নিজেদের সরলতার কারণে তাদেরকে বন্ধু বলে মনে করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওরা তাদের জঘন্যতম শত্রু।
আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, ইসরামী দুনিয়া এবং আরব জাহানের প্রত্যেক দায়িত্বশীল (শাসক) উপরোল্লিখিত তিক্ত ও ভয়ার্বহ সত্য সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত রয়েছেন বরং হয়তো বা তারা আমাদের থেকেও অধিক অবহিত আছেন। তা সত্ত্বেও আমি বিস্ময় ও তিক্ততার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে যাই এই ভেবে যে, এমন জলজ্যান্ত সত্য ব্যাপারেও তারা চোখ বন্ধ করে আছে কেন।
ইহুদী কর্মনীতি হচ্ছে, তারা আমাদের সবাইকে এই স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করতে চায় যে, এখন এই অঞ্চল ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, আর এটা একটা জীবন্ত সত্য। এই সত্য অস্বীকার করার কোন উপায় নেই; আর এর ধ্বংস সাধনও সম্ভব নয়। তারপরও যতই আমরা মুসলিমগণ এই ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়ে ইসরাঈলের অস্তিত্ব ও বাস্তবতা মেনে নেব তখনই অশেষ ও চিরস্থায়ী বিপদ ও ধ্বংস আমাদের ভাগ্য লিপি হয়ে যাবে।
ইহুদীদের সাথে সম্পর্ক
ইহুদীদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা এমন একটা দুরূহ ব্যাপার যাতে সাফল্য অর্জন সম্ভবই নয়। কেননা মানুষের স্বভাব প্রকৃতি ও অভিজ্ঞতা এর নেতিবাচক দিকটিই প্রমাণ করে। কোন মানুষ কি এটা কল্না করতে পারে যে, ইহুদী জাতি কোন অইহুদী জাতির সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করবে? আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির প্রকৃতিকে কে পরিবর্তন করতে পারে। ইহুদীদের সাথে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ এবং বন্ধু প্রতীম সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা এমন এক নিষ্ফল অপপ্রয়াস যার পরিণতি এতদ্ব্যাতীত আর কিছুই হতে পারে না যে, সমস্ত মুসলিম জাহান একযোগে ধ্বংস ও বিনাশের শিকার হয়ে যাবে। আমরা মুসলিম। যে আল্লাহর ওপর আমরা ঈমান পোষণ করি তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন:
(আরবী***********)
“যারা ঈমান এনেছে তাদের সাথে নিকৃষ্ট শত্রুতা পোষণকারী লোক তুমি ইহুদীদেরকেই দেখতে পাবে।”
এটা তো আল্লাহ তায়ালারই ফায়সালা। এতে কোন প্রকার গোঁজামিল কিংবা গুপ্ত রহস্য নেই। বিদ্বেষের সূচনা হয় তাদের পক্ষ থেকেই আমাদের পক্ষ থেকে নয়। এ ব্যাপারে উপরোক্ত আয়াতটি সুস্পষ্ট দলীল। তারপরও কি আমরা ইহুদীদের স্বরূপ এবং ইসলামের অনুসারীদের সাথে তাদের দুশমনির ব্যাপারটা আল্লাহ তায়ালার চেয়েও বেশী জানি?
ইখওয়ানুল মুসলিমুন যাদের অন্তর ইসলামের রহমত ও সৌহার্দ সম্প্রীতিতে ভরা- কখনো বলে না যে, ইসরাঈলকে সাগরের অতল গহ্বরে ডুবিয়ে দিতে হবে। তারা এই শ্লোগানও দেয় না যে, সর্বশেষ ইহুদীকে সর্বশেষ পমিউনিস্টের অস্ত্রের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে হবে। রক্তপাত ইসলামের মেজাজের পরিপন্থী। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে এই যে, ইহুদীরা ফিলিস্তিনে সাধারণ নাগরিক হিসেবে বসবাস করতে পারে। বাকী থাকে এই বিষয়টি যে, আমরা তাদেরকে অত্র অঞ্চলে শাসন দন্ড পরিচালনা এবং ভয়-ভীতি ও সন্ত্রাসের সাহায্যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেবো তা কখনো হতে পারে না।
সারা বিশ্বে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগুরুদের সাথে শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করে থাকে। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব যে, আহলে ঈমানদারদের নিকৃষ্টতম দুশন মুসলিম প্রজাসাধারণের ওপর ন্যায় ও ইনসাফের সাথে সরকার পরিচালনা করবে। (তদুপরী সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও শাসন কার্য পরিচালনার কি অধিকার তাদের থাকতে পারে।) তাদের নিকট থেকে ইনসাফের প্রত্যাশা অবান্তর ও ভিত্তিহীন।
(আরবী************)
(যে ব্যক্তি প্রকৃতির বিধানসমূহকে তার স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে পরিচালনা করতে চায় সে যেন পানির মধ্যে অগ্নিস্ফুলিংগ দেখার চেষ্টা করে।)
অতএব অত্র অঞ্চলের সর্বস্তরের জনসাধারণ ও শাসকগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রয়াস প্রচেষ্টা হওয়া কর্তব্য এই হিংস্র নেকড়ের হাত থেকে নাজাত হাসিলের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই নেকড়ে ধীরে ধীরে তাদের রক্ত শোষণ করছে (অবশেষে একদিন তাদেরকে সম্পূর্ণ মৃত করে ছাড়বে) এই দুরারোগ্য ক্যানসার থেকে রক্ষা পাওয়া অত্যন্ত জরুরী যা পুরো পরিবেশকে ভীত ও সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখেছে। মর্যাদাবোধ সম্পন্ন স্বাধীন মানুষ হয় মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকে নয়তো মর্যাদা নিয়ে মৃত্যু বরণ করে।
যে ব্যক্তি সম্মানের সাথে মৃত্যু বরণ করে এবং যাকে অনাগত বংশধরগণ সম্মান এবং বীরত্বের কারণে স্মরণ করে থাকে তার এবং অপমান ও লাঞ্ছনার সাথে বেঁচে থাকার মানুষের মধ্যে পার্থখ্য হচ্ছে এই যে, একজন অপমানকে পদাঘাত করেছে আর অপরজন সন্তুষ্টচিত্তে তা মেনে নিয়েছে। এভাবে কি শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। যে ছিনতাইকারী যে সম্পদ ছিনিয়ে নিয়েছে তা তারই মালিকানাধীন থাকবে আর মজলুম তার সাথে সমঝোতা করবে? এটা কি ধরনের শান্তি? এ রকম আপোষ থেকে তো ধ্বংসাত্মক বিপদের মোকাবিলা করা অধিক উত্তম এবং সহজ। আমাদের অবস্থা যাই হোক না কেন? এমন শান্তি ও আপোষ-সমঝোতা কিছুতেই আমরা গ্রহণ করতে পারি না।
আমাদের বীর সৈনিকগণ এমন সহাসিকতার পরিচয় দিয়েছিলো যে (যদি আমরা বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজ করতাম তাহলে) তার ফলাফল সমগ্র েএলাকায় পরিদৃষ্ট হতো। আমরা একাই যখন এতবড় কৃতিত্ব দেখালাম তখন গোটা অঞ্চলের সব মুসলিম শাসক ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তার ফলাফল কি হবে তা অনুমান করুন। নিসন্দেহে ফলাফল গৌরবম ও মর্যাদাকর হবে। কিন্তু বিপদ হচ্ছে মানুষ দারিদ্রের ভয়ে দারিদ্রের মধ্যে ডুবে আছে। অদৃশ্য ভয় তাদেরকে আতঙ্কে নিমজ্জিত করে রেখেছে। লাঞ্ছনার ভয়ে তারা লাঞ্ছনার অসহায় শিকার হয়ে আছে।
আমাদের যুবশক্তির মধ্যে যোগ্যতা আছে। তাদেরকে যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হয় তাহলে তারা তাদের মধ্যেকার সুপ্ত পৌরুষের পরিচয় প্রদান এবং কৃতিত্বপূর্ণ ও গৌরবজ্জোল কর্ম সম্পাদন করতে পারবে। কিন্তু প্রচার প্রপাগান্ডার বর্তমান ব্যবস্থা তা হয়তো ইহুদী আধিপত্যের কারণে- এরূপ প্রজন্ম কস্মিনকালেও সৃষ্টি করতে পারবে না যারা তাদের আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে আত্মর্যাদাবোধ পোষণ করতে পারে এবং তাদের দেশ ও তার স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য গর্ব প্রকাশ করতে পারে অথবা স্বীয় হৃত অধিকার পুনরুদ্ধারের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। এটা কত দুঃখজনক যে, নিজের ব্যক্তিগত সম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধের কারণে যখনই মুসলিম যুবকেরা ইসরাঈলের বিরুদ্ধে নিজেদের তৈরী করেছে তখনই সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের সর্বত্র এই যুবকদেরকে (তাদের শাসকদের হাতে) অত্যাচার নির্যাতন ও জেল জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। এরূপ আচরণ শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য দূর দূরান্তের দেশগুলোতেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
ইসরাঈলের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার বিষয়টি অত্যন্ত চড়া মূল্য দাবী করে। এই সন্ধি এবং তাতে নির্ধারিত শর্তাবলী ইসরাঈলকে অত্যন্ত নির্বিঘ্নে তার সংকল্প ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়তা করবে।
বর্তমানে প্রতিটি মহাদেশে যেসব ইসলামী কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হচ্ছে তা ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের ইসলামী ঐক্য সৃষ্টির প্রয়াস ও প্রচেষ্টার ফল মাত্র। যদিও তাতে এখনও কিছু দুর্বলতা এবং দোষ-ত্রুটি রয়েছে। কিন্তু আমি আশা করি এর ফলাফল একদিন অবশ্যই প্রকাশ পাবে। এটাও কল্যঅণকর একটা দিক যে, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা মাঝে মধ্যে এক সাথে মিলিত হয়ে বসে। একে অপরের সাথে পরিচিত হয়। পরস্পর সহযোগিতার ইচ্ছা ব্যক্ত করে এবং একজন অন্যজনের শক্তি বর্ধনের কারণ হয়। এটা অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। বৃষ্টির সূচনা হয় একটি বিন্দু দিয়েই। কিন্তু তারপর তা মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে রহমতের রূপ পরিগ্রহ করে। অনুরূপ বান্দাহ যখন আল্লাহর পথে কর্মতৎপর হয়ে যায় এবং চেষ্টা-সাধনা শুরু করে তখন আল্লাহ অবশ্যই সেই বান্দাহর সাহায্র করেন। এমন কি বান্দা যখন তার জাগতিক সমস্ত উপায় উপকরণ ও চেষ্টা প্রচেষ্টা নিয়োজিত করে দেয় এবং আল্লাহ তায়ালা তার আন্তরিকতা সততা ও নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে যান, তখন সেই সর্বশক্তিমান ও মহাপরাক্রমশালী তার সাহায্যের হাত প্রসারিত করে দেন। (কে আছে এমন যে বিপন্নের আর্তনাদ শুনতে পায় এবং তার দুঃখ দূল করে দেয় এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে খেলাফত দান করে থাকে?) সর্বজয়ী ও প্রকৃত প্রজ্ঞার অধিকারী মহান সত্তা ছাড়া আর কেউ-ই এমন নেই। আমরা একান্তভাবে তার ওয়াদার ওপর দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করি। অবশ্য এটা আলাদা কথা যে, তিনি তার ফয়সালা এত তড়িঘড়ি করে প্রকাশ করেন না- বান্দা যত তাড়াতাড়ি তা প্রত্যাশা করে।