অষ্টম অধ্যায়
আমরা প্রাচ্যের অধিবাসীরা সাম্রাজ্রবাদী দাসত্বের প্রভাবাধীন জাতীয়তার খুবই ভুল অর্থ বুঝে থাকি। এইঅর্থ ইসরাম থেকে বহু দূরে নিয়ে যায়। কিন্তু আমাদের দেশসমূহে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং পাবলিক বক্তারা এর আলোচনায় মুখর থাকেন।
এই বিষয়ে ইমাম শহীদ একটা বিশেষ নিবন্ধ রচনা করেন। তিনি যা লিপিবদ্ধ করেছিলেন তার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল এইযে, যদি দেশপ্রেম ও জাতীয়তার অর্থ এই হয় কোন ব্যক্তি যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছে এবং যেখানকার আলো বাতাস ও নিয়ামত রাজি ভোগ করে সে বেড়ে উঠেছে সে দেশকে সে ভালবাসবে তাহলে তা কোন শরীফ ব্যক্তি অস্বীকার করবে না। এই মতাদর্শ সাদরে গ্রহণ করার মত। অনুরূপ যদি জাতীয়তা ও দেশ প্রেমের অর্থ করা হয় কোন ইসলামী রাষ্ট্রকে সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করে তার জনগণকে তাদের অধিকার ও মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়া এবং সে জন্য বড় বড় ত্যাগ স্বীকার করার আহ্বান জানানো হয় তাহলে তা হবে এমন আহ্বান ইসলাম যার শিক্ষা দিয়ে থঅকে। প্রত্যেক নিষ্ঠাবান মুসলিম এ ধরনের আহ্বানকে স্বাগত জানায়। আবার যদি দেশ প্রেমের আবেদ ব্যবহার করে মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি গড়ে তোলা উদ্দেশ্য হয় যেন তারা একটা শক্তিতে পরিণত হয়ে তাদের ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আগ্রাসন পরিচালনাকারীর পথে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। তবে তার চেয়ে ভাল কাজ আর কি হতে পারে? ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও বিজয় প্রতিষ্ঠা করার প্রতিটি প্রচেষ্টা এবং এই রাস্তায় অগ্রগামী প্রতিটি পদক্ষেপ শত সহস্র প্রশংসার অধিকারী। এরপর থাকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সেসব প্রপাগান্ডা ও প্রচরণা যার বুনিয়াদ গড়ে ওঠে এমন কোন দল বা জাতীয়তার ওপর ভিত্তি করে যা অন্যদের তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার তবে জেনে রাখুন এমন জাতীয়তা ও দেশ প্রেমের সাথে ইখওয়ানের দূরতম কোন সম্পর্কও নেই।
এ চিন্তাধারা কোন কোন সংবাদপত্র, সাময়িকী এবং রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে খুব ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। একে অন্যের ওপর মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করা এবং জাতিকে শতধা বিভক্ত করে ফেলা। এ ছাড়া এর আর কোন লাভ নেই। এই বিপজ্জনক প্রবণতা প্রকৃত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে জাতির দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিরর্থক বিষয় নিয়ে পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ির সৃষ্টি করেছে। এটা আমাদরে শত্রুদের একটা ষড়যন্ত্র। তারা এভাবে আমাদেরকে দুর্বল করে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করে। আমাদের সামনে উননত দেশসমূহের রাজনৈতিক দলসমূহের দৃষ্টান্ত রয়েছে। রাজনৈতিক মতবিরোধ এবং পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও তারা ককনো একে অন্যের ওপর দেশদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আরোপ করে না। তাদের পলিসি পরস্পর থেকে ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং দেশের নিরাপত্তার বিষয়টি সকলের কাছে সমান বলে বিবেচিত হয়ে থাকে।
মহান সন্তানের পরাজয়
আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, বিশ্বযুদ্ধে চার্চিল বৃটেনকে বিজয়ের গৌরবে গৌরবান্বিত করেন। দেশবাসী এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে যথাযোগ্য ভক্তিশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং তাঁকে তার উপযুক্ত মর্যাদা দান করে। তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে কনজারভেটিভ, লেভার ও লিবারেল সব পার্টিই ছিল একমত, তা সত্ত্বেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সারা দেশে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে জাতি এই মহাবীরকে ক্ষমতার মসনদ থেকে বঞ্চিত করে। ভোটদাতারা জানতো যে, যুদ্ধকালীণ সময়ের দাবী শান্তিকালীণ সময়ের দাবী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে থাকে। এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঐ জাতি তাদের উপকারীদের যথোপযুক্ত সম্মানদিয়ে থাকে সত্য কিন্তু অন্ধ অনুসরণের মাধ্যমেদেশ ও জাতির স্বার্থকে বীর পূজার যুপকাষ্ঠে বলি দেয় না। এটা জাগ্রত বিবেক ও সতর্কতার চমৎকার এক অনুপম দৃষ্টান্ত। আমরা পশ্চাত্যের অনুকরণ করি ভুল ও অর্থহীন বিষয়ে। আহ! আমরা যদি তাদের এই ভাল দৃষ্টান্তের অনুসরণ করতাম!
মু’মিনগণ একে অপরের ভাই
ইখওয়ানের দৃষ্টিতে ঈমান ও আকীদার ভিত্তিতে দেশ প্রেম এবং জাতীযতার সীমা নির্ধারিত হয়ে থাকে। ভৌগলিক সীমারেখা দ্বারা নয়। প্রতিটি মুসলিম দেশকে আমরা আমাদের নিজেদের দেশ বলে বিশ্বাস করি। আমরা ইসলামী রাষ্ট্রের জিহাদ এবং তার সীমান্ত রক্ষার ঘোষণা দিয়ে থাকি। কেননা আমাদের ঈমান আকীদার বুনিয়াদ হচ্ছে আল্লাহর কিতাব যা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করছে:
“এই মুসিলম জাতি একই জাতি। আর আমি হচ্ছি তোমাদের রব। অতএব আমাকে ভয় করো।”
আমরা একথা কখনো মেনে নিতে পারি না যে, কোন মুসলিম জাতি অন্য কোন মুসলিম জাতির ভৌগলিক এলাকা দখল করতে পারে। গোলাম বানাতে পারে কিংবা জোরপূর্বক নিজেদের ইচ্ছা তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে। প্রতিটি দেশে বসবাসকারী মুসলিম জনগোষ্ঠী তাদের নিজেদের ব্যাপারে ভালভাবে বুঝেন। যেমন প্রবাদে বলে: “মক্কার লোকেরাই মক্কার অলি গলি পাহাড়-পর্বত সম্পর্কে অবহিত।” আমরা সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরোধী এবং ইসলামী খেলাফতের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক। ইসরামী খেলাফতই পারে মুসলিম উম্মাকে তাদের শতধা বিচ্ছিন্ন অবস্থা দূরে করে সবাইকে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে এবং এভাবে পৃথিবী নামক গ্রহের ওপর এই কোটি কোটি মুসলিমকে একটি শক্তিতে রূপান্তরিত করতে।
মানুষ প্রথমে আমাদেরকে বুঝতেই পারেনি। আবার বুঝে থাকলেও ভুল বুঝেছে। আমরা দেশপ্রেম েএবং নিজেদের দেশ ও জাতির মঙ্গল চিন্তায় সমস্ত মানুষ থেকে অধিক নিবেদিত প্রাণ ও অকৃত্রিম। আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রত্যাশী। আর যদি সেই মহান সত্তা আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট না হন তাহলে আর কারো অসন্তুষ্টির কোন পরোয়া আমরা করি না। আমাদের সম্পর্কে অমূলক ধারণা পোষণ করা হয়ে থাকে অথচ আমরা সুস্পষ্টভাবে বলে থঅকি যে, ইসরাঈলের অস্তিত্ব লাভ কি সম্ভব ছিল যদি উম্মাতে মুসলিমা ঐক্যবদ্ধ হতো এবং একই নেতৃত্বে (খেলাফতে ইসলামীয়া)-এর নেয়ামত সে হাসিল করতে পারতো। তখন কি আর ইসরাঈল ও তার সহযোগী ফিলিস্তিন, সিরিয়া এবং লেবাননে সেসব কিছু করতে পারতো যা তারা বর্তমানে নির্লজ্জের মত করে যাচ্ছে। এখন অপেক্ষা করে দেখতে থাকুন আরো কত কি ঘটে। মুসলিমরা যদি এভাবে শতধা বিভক্ত থাকে তাহলে শত্রুরা আরো এক হাত দেখাতে থাকবে।
রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন ও ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও উত্তর আমেরিকার বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্ররাষ্ট্র এক জনরাষ্ট্র প্রধানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। কিন্তু অমুসলিমদেরকে এতটা সংগঠিত ও প্রশংসনীয় অবস্থায় দেখতে পাওয়া সত্ত্বেও মুসলমানদের সামান্য বিবেকবোধও কেন জাগ্রত হয় না? বস্তুত এটা খুবই সাদামাটা কথা কিন্তু বিবেক-বুদ্ধিকে কাজেই লাগানো হয় না। প্রবৃত্তি ও লালসা বিবেক-বুদ্ধির ওপর পর্দা টেনে দিয়েছে।
তোমরা সবাই আদমের সন্তান আর আদম ছিলেন মাটির তৈরী
জাতীয়তার ব্যাপারে ইখওয়ানের ধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট। এই ধারণা আমরা ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের শিক্ষা থেকে লাভ করেছি। ইমাম আমাদেরকে কুরআন মজীদ, সুন্নাতে রাসূল (স), খোলাফায়ে রাশেদীন (রা) ও সালফে সালেহীনদের ইজমার আলোকে প্রদান করেছেন। আমাদের মতে জাতীয়তার ভিত্তিতে ইসলাম। আমরা বলে থাকি ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে সামষ্টিক স্বার্থই আমাদের লক্ষ্য। সমগ্র ইসলামী দুনিয়ার প্রতিরক্ষা এবং তার হেফাজতের জন্য জিহাদ এবং ত্যাগ আমাদের জাতীয় শ্লোগান। জাতীয়তার ধর্মনিরপেক্ষ ও বস্তুগত ধারণা আমরা অস্বীকার করি। মানুষকে আর্য, ল্যাটিন অথবা অনুরূপ অন্যান্য কোন জাতি-গোষ্ঠীগত বিভক্তির ওপর ভিত্তিশীল জাতীযতা আমাদের কাছে চরম অপছন্দনীয় জাতি” বলে মনে করে। আমরা বিশ্বাস করি যে, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একই আদি পিতা আদমের সন্তান আর আদম আলাইহিস সালামকে তৈরী করা হয়েছিল মাটি থেকে। মানুষের মধ্যে তাকওয়া ব্যতীত আর কোন পার্থক্য নেই। যিনি যত বেশী মুত্তাকী তিনি ততবেশী শ্রেষ্ঠ। সুধী পাঠক! আপনি হয়তো এ আলোচনা থেকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন যে, আমাদের এবং বস্তুবাদীদের জাতীয়তার ধারণায় কত বিরাট ফারাক বিদ্যমান।
ইখওয়ানের ফিক্হী দৃষ্টিভংগী
এরপর থাকে মুসলমানদের ফিক্হী মতপার্থক্যের বিষয়টি। এ ব্যাপারেও আমাদরে মতামত অত্যন্ত সুস্পষ্ট। আমরা মনে করি চার ইমাম অর্থাৎ ইমাম আবু হানিফা (র), ইমাম মালেক (র), ইমম শাফেয়ী (র) ও ইমাম আহম্মদ (র) ইসলামী আইন এবং ফিকহার মূলনীতি ও ভিত্তি সম্পর্কে একে অপরের সাথে একমত এবং এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই। কোন মতানৈক্য থাকলে তা আছে শুধুমাত্র শাখা-প্রশাখা ও খুঁটি-নাটি বিষয়ে। অনুরূপ বিভিন্ন মাযহাব তথা চিন্তার অনুসারীগণ যদি ফিকাহ্ বিষয়ক এই বিভক্তিকে উম্মাতের মধ্যে মতপার্থক্য ও শত্রুতার ভিত্তি না বানায় তাহলে এই ধরনের ফিকহী মতভেদকে আমরা স্বাগত জানাই। সমস্ত ইসলামী সংগঠন আমাদের কাছে সম্মানের যোগ্য, প্রত্যেকেই নিজ নিজ গন্ডি ও পরিমন্ডলে সুকৃতি কল্যাণের ব্যপ্তি ঘটানোর কাজে নিয়োজিত। যদি কোন বিষয়ে তাদের সাথে আমাদের মতপার্থক্য হয়েও যায় তবুও তা অপবাদ আরোপ, কুধারণ পোষণ অথবা শত্রুতার রূপ পরিগ্রাহ করতে পারে না। বর্তমান রাজনৈতিক দলসমূহের প্রতি আমাদের কোন বিদ্বেষ নেই। আমরাশুধু তাদের কর্মপন্থার সাথে দ্বিমত পোষণ করি। তাদের কর্মপদ্ধতি হচ্ছে িএই যে, তারা তাদের সকল কথা ও কাজকে সঠিক মনে করে এবং অন্যদেরকে তা মানানোর জন্য যে কোন পন্থা ও কৌশল অবলম্বন করে এবং সাথে সাথে তাদেরকে বিরোধীদের সব কথার অবশ্যই বিরোধিতা করতে হয়। এসব পার্টি যেদিন এই নীতি ত্যাগ করে কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূলুল্লাহ(স) এর দিকে প্রত্যাবর্তন করবে সেদিন আমরাও তাদের সাথে কোন ব্যাপারে মতপার্থক্য করবো না।
আমরা মুসলিম। ভাই আমরা কখনো এইরূপ ইচ্ছা করিনি যে, কারো ওপর জুলূম করে বসি। আমাদরে সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ চিন্তা এই যে, সমগ্র উম্মাতে মুসলিমাহ ইসলামী শরীয়াতের অনুসারী হয়ে ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত হোক।
ইসলামে অমুসলিমদের অধিকার
আমাদের অমুসিলম ভাইয়েরাও আাদের নিকট সম্মানের পাত্র। তাদের ব্যপারে কুরআন মজীদে আমাদেরকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে যে, তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দিতে হবে। তাদের দ্বীনকেও কুরআন দ্বীন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (আরবী*****) “তোমাদরে জন্য তোমাদের দ্বীন আর আমার জন্য আমার দ্বীন” কিনতউ অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট একথা এভাবে ঘোষণা করেছেন যে, (আরব*ি***) ইসলামই একমাত্র দ্বীনে হক হিসেবে আল্লাহর নিকট মনোনীত ও স্বীকৃত। আলোচ্য আয়াত দু’টির মধ্যে কোন বিরোধ নেই। প্রথমোক্ত আয়াতে আল্লাহ তায়ালা গায়রে ইসরামকে দ্বীন বলে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু তা তার পছন্দ নয় বলে প্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তায়ালা দ্বীন ইসলামকে তার পছন্দনীয় দ্বীন রূপে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তা সত্ত্বেও অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতাকে মর্যদা দেয়া হয়েছে। মুসিরম মাত্রিই তাদের অমুসরিম ভাইদেরকে এই স্বাধীনতা প্রদান করতে বাধ্য।
ইমাম শহীদ এবং ইখওয়ানগণ তাদের চারদিকে দেখতে পেয়েছিলেন যে, ইসলাম ও ইসলামের অনুসারীদের ওপর অমানিশার অন্ধকার ছেয়ে আছে। তাই তারা এই বিধ্বংসী ও নিচ্ছিদ্র অন্ধকার রজনী থেকে উম্মাতকে মুক্তিদানের জন্য পথ খুঁতে থাকেন। তারা ইসলামের ওপর সকল দিক থেকে জাপটে ধরে আক্রমণকারীদের মোকাবিলা করার ইস্পাত কঠিন শপথ গ্রহণ করেন। সব হামলার লক্ষ ছিল একাধারে মুসলিম শাসক গোষ্ঠী ও জনসাধারণ উভয়ই। এই ভয়াবহ দৃশ্য দেখে বিস্ময় বিস্ফোরিত হয়ে যাচ্ছিলো।
করণীয় কি?
আমরা ইমামকে জিজ্ঞেস করেছি। এ অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় কি এবং এই ব্যাধির প্রতিকারই বা কি উপায়ে করা যেতে পারে? আমাদের এ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ভরা প্রশ্ন শুনে তিনি অত্যন্ত ধীর স্থির ও শান্তভাবে মৃদু হাসলেন। কত প্রিয় ছিল সেই হাসি! শুনুন এবং মনে রাখুন, পড়াশুনা করুন এবং প্রকৃত অবস্থা অবগত হোন। শহীদ ইমাম তাঁর ছোট্ট পুস্তিকা আমাদের পড়ে শুনান। তার ভংগী ছিল সহজ হৃদয়গ্রাহী এবং বিশ্বাস ছিল খুবই বলিষ্ঠ সান্ত্বনাদায়ক। তিনি বলেন: “আমাদের পূর্বেওএমন বহু জাতি অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে তাদের ওপর আমাদরে ন্যায় বিপদ-মুসিবতের পাহাড় ভেংগে পড়েছিলো। তারা তখন চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করে এবং তা থেকে নাজাত পাওয়ার উপায় খুঁজতে থাকে। সেগুলেঅকে বাস্তবে রূপায়িত করে এবং কামিয়াব হয়ে যায়।” মুর্শিদে আ’ম-এর অভিমত ছিল এই যে, আমাদের ওপর যে দুর্বলতা ও পশ্চাদপদতা জেঁকে বসেছে এবং আমাদেরকে অর্ধমৃত করে ফেলেছে তার প্রতিকার তিন ধরনের ব্যবস্থার মধ্যে আছে। এই পরীক্ষিত ব্যবস্থাগুলো তার মতে ছিল নিম্নরূপ:
প্রথম: ব্যথা ও রোগের স্থান নির্ধারণ করা। কেননা চিকিৎসার মৌলিক নীতিমালা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে রোগের প্রকৃত অবস্থা জেনে নিতে হবে।
দ্বিতীয়: ঔষুধের তিক্ততা এবং চিকিৎসাকালীণ কষ্ট ধৈর্যের সাথে সহ্য করতে হবে।
তৃতীয়: সুদক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক যিনি রোগ চিহ্নিত ও ঔষধ নির্ধারণে পুরো যোগ্যতা রাখেন এবং নিজের অক্লান্ত পরিশ্রম দ্বারা রোগীর দুর্বল শরীরে সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে পারেন।
আমরা বললাম“ আপনি কি রোগের স্থান নির্ধারণ করে আমাদেরকে তা বলবেন না?
প্রতত্তুত্যরে তিনি বললেন। “রোগের অনেক দিক রয়েছে।”
এক: রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ।
দুই: ধ্বংসাত্মক দলাদলি যা জাতিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে।
তিন: সুদের অভিশাপ পুরো সমাজকে গ্রাস করে ফেলা।
চার: বিদেশী কোম্পানীসমূহ যা আমাদের আয়ের উৎসসমূহ ও রাজস্বখাত সমূহকে দখল করে আমাদরে রক্ত চুষছে। আমদানীর উৎস ও আয়ের ওপর জেঁকে বসে আমাদের রক্ত শোষণ করে চলেছে।
পাঁচ: বিক্ষিপ্ত চিন্তাধারা, ব্যধিগ্রস্ত আকীদা িএবং উন্নত নৈতিক দৃষ্টান্তের অভাব।
ছয়: পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ যা জাতির দেহ ও আত্মার প্রাণ সংহারী বিষের মত প্রবাহিত হচ্ছে।
সাত: মানব রচিত আইন যা অপরাধ নির্মূল করে না এবং অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি দেয় না।
আট: লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা।
নয়: সাহস ও সংকল্পের মূলোৎপাটনকারী হতাশা।
এই তালিকা দেখেই আমরা বুঝতে পারি যেসব বিষ ফোঁড়ার বিষাক্ত পুঁজ গোটা শরীরকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট মুর্শিদে আ’ম তা গুণে গুণে বলে দিয়েছেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আদর্শিক, সামাজিক, আইনগত, শিক্ষাগত ও প্রশিক্ষণ মূলক মোদ্দকথা সকল ব্যধিকেই তিনি চিহ্নিত করে দিয়েছেন। কত গভীর ও সূক্ষ্মদৃষ্টির মূল্যায়ন। প্রকৃত সত্য সঠিকভাবে উদ্ধার করেছেন এবং উত্তম পদ্ধতিতে উপস্থাপন করেছেন। যদি সমরে সংকীর্ণতা না থাকতো তাহলে আমি প্রত্যেকটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করতাম।
ইসলামী শিক্ষা ও তার প্রভাব
ইমাম শহীদ তার অনুসারীদের ভালবাসতেন এবং তারাও তাঁর জন্য ছিল নিবেদিত প্রাণ। তিনি অনেক সময় আমাদের মধ্যেথেকে পঁচিশ বছর কিংবা তা থেকে কম বেশী বয়সের যুবকদেরকে মন্ত্রীদের সাথে তাদের দপ্তরে নয় বরং পার্লামেন্ট হাউজে গিয়ে সাক্ষাত করার জন্য প্রেরণ করতাম। এই অভিযানে আমাদের মধ্য থেকে যাকেই পাঠানো হতো সে অত্যন্ত নির্ভরতা ও আত্মবিশ্বাসের সাথেই যেতো এবং অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে পয়গাম পৌঁছে দিতো এবং উত্তম ফলাফল নিয়ে ফিরে আসতো।
তিনি আমাদের অন্তরকে আশায় ভরে দিয়েছিলেন। আমাদের আত্মসম্মান বোধ জাগ্রত করেছিলেন এবং আমাদের হৃদয়-মনে আত্মমর্যাদাবোধের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, যারাই আমাদের সাথে আছে তাদেরকে নিশ্চিত বিজয় ও সাহায্যের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও। এই মহান ব্যক্তির [হাসানুল বান্না শহীদ (র)] বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা চিন্তাক্লিষ্টদেরকে নবজীবন দান করেন এবং প্রাচ্যে এমন জোশ সৃষ্টি হয় যার বাস্পে লোহা ও ইস্পাতের মেশিনগুলোও সচল হয়ে উঠতো (অর্থাৎ বিপ্লব সৃষ্টি হয়ে যেতো)। যদি আজ পর্যন্ত তিনি জীবিত থাকতেন তাহলে অবশ্যই আজকের যুবকগণ এই পূত-পবিত্র দাওয়াতকে এমন অবস্থায় দেখতে পেতো যে দৃশ্য দেখে তাঁর মন সান্ত্বনায় ভরে যেতো। হয়তো আমি পরে কোথাও এসব ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করবো যে, এ দাওয়াত কিভাবে সফলতার দ্বারপ্রান্তে গিয়ে উপনীত হয়েছে। এই দাওয়াতেরই কৃতিত্ব যে, তা এমন সব অন্তরকে যা মৃত প্রায় গয়ে গিয়েছিলো, যাদের হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছিলো এবং জীবনের কোন লক্ষ্মণই তাদের মধ্যে ছিল না। পুনরায় তাদের মাঝে হৃদস্পন্দন সৃষ্টি করেছে। অতপর সেই হৃদপিণ্ডগুলোতে আবার এমনভাবে স্পন্দন সৃষ্টি হয়েছে যে, লোহার ওপা হাতুড়ির আঘাতের ন্যায় প্রচণ্ড আওয়াজ শুনা যেতে লাগলো। এখন এই আওয়াজ শোনা যেতে পারে এবং হৃদস্পন্দনও অনুভব করা যায়। এই ধ্বনি তাদের রাতের ঘুমহারামকরে দেয় যারা ইসরাম ও মুসলমানদের কোন কল্যাণ বরদাশত করতে পারে না। এখানে আমি যে বার বার ‘ইসলাম’ শব্দটি ব্যবহার করছি এটা রূপক অর্থে। এর দ্বারা আমি ইসরামের অনুসারীদেরকেই মুসলিম বুঝাতে চেয়েছি। কেননা ইসলাম কখনো দুর্বল হতে পারে না। কিংবা তার কোন পতনও আসতে পারে না। ইসলাম ততদিন কায়েম থাকবে যতদিন এই আসমান ও জমিন থাকবে। কাদেরে মতহলক নিজেই এর স্থায়ত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেছন। (আরবী**********) এটা এমন একটা ওয়াদা যে তাঁর সত্যতার ব্যাপারে কোন সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই। আমি মুসলিমদের প্রতি ইংগিত করছি। যখনই তারা ইলাহিয়াকে মজবুতভাবে ধারণ করেছে তখনই তাদেরকে ইজ্জত ও সম্মান দ্বারা ভূষিত করা হয়েছে। আর যখনই তারা তা থেকে দূরে থাকার নীতি অবলম্বন করেছে তাদের ইজ্জত-আবুর ধূলায় লুণ্ঠিত হয়েছে। এবং তারা লাঞ্ছনা ও অপমানের অসহায় শিকার হয়েছে। আমি অন্তরের অন্তস্থল থেকে দোয়া করছি যেন এই উম্মাত কখনো এমন পর্যায়ে গিয়ে উপনীত না হয় যে পর্যায় সম্পর্ক বলা হয়ে থাকে যে, “তুমি যদি কোন জীবন্তকে ডাকো তবে সে তোমার ডাকা শুনতে পারে কিন্তু যাকে তুমি আহ্বান জানাচ্ছো তার তো জীবনের অবসান হয়ে গেছে।”
একটা মজার ব্যাপার
মানুষ জিজ্ঞেস করে যে, এই মহাপ্রাণ দা’য়ী (হাসানুল বান্না) কিসের প্রতি মানুষকে দাওয়াত দিয়ে থাকেন? প্রত্যত্তুরে ইমাম শহীদ বাস্তব নমুনা পেশ করে থাকেন যে, মানুষ রকমারি স্বভাবের অধিকারী। কেউ উদর পূজা ও ভোগ বিলাস এবং রং রসকে জীবনের মূল উদ্দেশ্য বলে মনে করে আবার কেউ বাহ্যাড়ম্বর পোশাক-পরিচ্ছদ এবং কৃত্রিম সম্মানানুরাগী হয়ে থাকে। কেউ আবার ফিতনা-ফাসাদ ও পরচর্চা নিয়ে খুশী থাকে। তাই ইমাম এসব বিভিন্ন স্বভাবের মানুষের সাথে তাদের উপযুক্ত আচরণ করতেন। প্রসংগত একটা মজার ঘটনা মনে পড়ে গেলো। সুধী পাঠকদের সামনে তা তুলে ধরছি। মাকতাবে ইরশাদের সদস্যগণ ইমাম শহীদকে বললেন (এবং তখনকার দিনে আমি নিজেও মাকতাবে ইরশাদের সদস্য ছিলাম) যে ওমর তিলমেসানী বাহ্যিক শান শওকত ও টিপটপ হযে থাকতে খুব পছন্দ করেন। বিলাসিতা ও ফিটফাট থাকা তার অভ্যাস এবং ফ্যাশন ও সাজ-সজ্জার প্রতি তিনি খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ইমাম শুনেও নীরব থাকলেন। কিন্তু একদিন মাকতাবে ইরশাদে সদস্যগণের সমাবেশকালে তিনি আমাকে লক্ষ্য করে উচ্চেস্বরে বলতে রাগলেন, “সমাবেশে ছেঁড়া ফাটা জুতা, ময়লা টুপি এবং সাদাসিদা পোশাকে আসতে চেষ্টা করো।” একথা শুনে আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “দাওয়াতে হকের পথে এটা কি আপনার নির্দেশ?” উত্তরে বলতে লাগলন: “তোমার ভাইদের আকাংখা, তারা তোমাকে এই অবস্থায় দেখতে চান। আল্লাহ তায়ালা যেন তাঁর বান্দাদের জন্য সাজসজ্জা ও উত্তম রিযিক হারাম করেছেন সব বান্দাহদের আল্লাহ যেন তিনি তাঁর বান্দাকে যেসব নিয়ামত দান করেছেন তার কোন প্রকাশ বান্দার জীবনে না ঘটে। অর্থাৎ আল্লাহ যেন তাঁর ঈমানদার বান্দার জন্য দুনিয়ার জীবনে কো অংশই রাখেনি এবং মানুষের সামনে নিজেকে নোংরা ও কুৎসিতভাবে জপেশ করাই যেন মুসলমানের কর্তব্য। আল্লাহ তায়ালার এই বাণী কি আমরা ভুলে গিয়েছি। এরশাদ করেছেন-
(আরবী**********)
“হে রাসূল (স) আপনি বলে দিন বান্দার জন্য আল্লাহর সৃষ্ট সৌন্দর্যের উপকরণ কে হারাম করেছে—-?”
ধুমপান বর্জন
এটা ছিল এমন একটা প্রভাব সৃষ্টিকারী শিক্ষা যা আমরা শুনেছি এবং চিরদিন মনে রেখেছি। আমি সিগারেটও পান করতাম। দফতরে ইরশাদের ইখওয়ানগণ এ ব্যাপারে ইমামের কাছে অভিযোগ করেন। আমি জানতে পেয়ে নিজেই ইমামের কাছে আরজ করি, “আপনি যদি নির্দেশ দেন তাহলে আমি সিগারেট পানের অভ্যাস বর্জন করবো। আর যদি আপনি এ ব্যাারে কিচু না বলেন তাহলে আমি ধুমপান অব্যাহত রাখবো।”
তিনি বললেন: “আপনি আপনাকে আদেমও দিচ্ছি না নিষেধও করছি না।” সাধারণত মুর্শিদ এমন সব জিনিস থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিতেন যেগুলোর অভ্যাস হয়ে গেলে মানুষের জন্য সেগুলো ত্যাগ করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এমন কি তিনি চা কফি থেকেও বিরত থাকতে বলতেন। তবে আমার প্রশ্নের জবাবে তিনি যা বলেছেন তার কারণ হয়তো এই যে, তিনি আমার দুর্বল স্বভাব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তিনি হয়তো মনে ধারণা করে থাকবেন যে, এভাবে হঠাৎ করে আমাকে ধূমপান থেকে নিষেধ করলে তা আমার জন্য সমস্যা সৃষ্টি হবে কিংবা হয়তো এই কড়াকড়ির কারণে আমি সংগঠন থেকেই সরে পড়বো। এটাও কি শিক্ষাদানের একটা পদ্ধতি নয়? আর আল্লাহর শোকর যে আমি এখন আর মোটেই ধূমান করি না। এটা এই শিক্ষার প্রভাব ও ফল ছাড়া আর কিছুই।
প্রশংসনীয় নৈতিক চরিত্র
মুর্শিদ যখন খুশী থাকতেন তখন আমাকে সম্বোধন করতেন “হে ওমর”। আর যদি কোন সময় আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হতেন তখন বলতেন “উস্তাদ উমর!” অতএব কথার ধরণেই আমি বুঝে ফেলতাম এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করতাম “মুর্শিদ? আমার কি কোন অপরাধ হয়েছে?”
কিছু কিছু সৌভাগ্যবান মানুষ এমনও আছেন যাদের আল্লাহর সাথে বান্দার সাথে এমনকি নিজের সাথে খুব ভাল সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে থাকে। আমাদের ইমাম শহীদ এই প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এমন সহ্য শক্তি ও আত্মসংযোমের ক্ষমতা প্রদান করেছিলেন যে, অতি কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি উত্তেজিত হতেন না। অনুরূপভাবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এমন উন্নত নৈতিক গুণাবলীর মহাসম্পদ দান করেছিলেন যে, তিনি যার সাথেই মিলিত হওয়ার সুযোগ লাভ করতেন সেই-ই তাঁর ভক্তে পরিণত হতো। সর্বোপরি আল্লাহর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল অতিব ঘনিষ্ট ও বিনিড়। ছোড় বড় সকল ব্যাপারেই তিনি আল্লাহর হক ও তাঁর নির্দেশের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতেন। অতএব মহিয়ান গরিয়ান আল্লাহও তাঁর এই অনুগত ও নিষ্ঠাবান বান্দার সাহায্য এভাবে করতেন যে, কোন অতি বড় সমস্যা সঙ্কুল পরিস্থিতিতেও তার সাহস অবদমিত হতো না। হতাশা মুহূর্তের জন্যও তাঁর কাছে ঘেঁষতে পারতো না এবং অতিবড় লক্ষ্য অর্জনেও কখনো নিরাশা হতেন না।
অদম্য সাহস থাকলেও পাথর পানির মত মনে হয়
তাঁর নিকট সকল কাজই ছিল সহজ। আল্লাহ তায়অলাও বস্তুত সব কাজ সহজসাধ্য করে দিতেন। কেননা তাঁর ভরসা ছিল আল্লাহ তায়ালার প্রবুত্বের ওপর। মানুষের মধ্যে এমন কিছু দুঃসাহসী লোক থাকেন যারা সমগ্র জীবনকে তাওয়াতে হকের জন্য ওয়াক্ফ করে দেন। তাঁদের কাছে দাওয়াতের কাজ সর্বাগ্রে এবং তারপর অন্যান্য কাজ।
মুসলমানদের কাজ হচ্ছে দুনিয়ার নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত সহওয়া। কিন্তু এমন নেতৃত্ব বড়ত্ব ও আধিপত্য জাহির করার জন্য নয়। বরং শিক্ষা ও সংস্কারের জন্য। এই নেতৃত্ব সম্পর্কে যেসব মুসলমানের ধারণা নেই প্রকৃতপক্ষে তারা সেই বাণীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কেই অবহিত নয়। যার ধারকব ও বাহক করে তাকে পাঠানো হয়েছে এবং যার প্রতি আহ্বান জানানোর জন্য আল্লাহ তাকে নির্দেশ দিয়েছেন।
ইমাম শহীদকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল “আপনি কখন শয্যা গ্রহণ করেন?” তিনি জবাব দিলেন “দাওয়াত ও পয়গামের গুরু দায়িত্ব আমাদের জন্য কি এমন কোন অবকাশ রেখেছে যে, আমরা আরামের জন্য সটান শুয়ে পড়তেপারি? দায়িত্ব ও কর্তব্য কি সময়ের মোকাবেলায় অনেক বেশী নয়?”
যে নৈতিক উৎকর্ষ লাভ করতে চায় সে রাত্রি জাগরণ করে
সত্য কথা বলতে কি ইমাম শহীদের জন্য দিবারাত্রে সর্বাধিক চার থেকে পাঁচ ঘন্টার ঘুমই যথেষ্ট ছিল। তার কাছে লক্ষ্য অর্জনই ছিল মূল বিষয়। সকল কর্মতৎপরতা হচ্ছে লক্ষ্য অর্জনের উপায় মাত্র। তাঁর কাছে মু’মীন বান্দার জীবনের উদ্দেশ্য ছিল দুনিয়ার পথপ্রদর্শকের মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়া এবং পুরো মানবতাকে ইসলামের কল্যাণমূলক বিধান ও পূত-পবিত্র শিক্ষার ছায়াতলে স্থান করে দেয়া যা ব্যতীত আদম সন্তানের পক্ষে প্রকৃত সাফল্য লাভে ধন্য হওয়া সম্ভব নয়।
মু’মিনের আসল সম্পদ ঈমান
যদি মানুষ জিজ্ঞেস করে এবং কার্যত লোকজন সর্বদাই জিজ্ঞেস করে যে, “এই গরীব লোকগুলো তাদের ব্যয় নির্বাহ করে কিভাবে?”
“এ ক্ষেত্রে ইমাম তার জবাব দেন এই যে, দ্বীনের দাওয়াতের মৌলিক ভিত্তি ঈমান, সম্পদ নয়। যখন একজন ঈমানদার সত্যিকার ঈমানের দৌলত লাভ করেন তখন তার সফলতার জন্য যাবতীয় উপায় উপকরণ পর্যাপ্ত পরিমাণে যোগাড় হয়ে যায়।”
এমন অবস্থাও আমাদের ছিল যখন আমরা অতি কষ্টে এক আধটা ফ্লাট ভাড়া করতাম যাতে দাওয়াতের জন্য কার্যালয় স্থাপন করা যায়। তারপর প্রত্যেক ভাই তার সামান্য উপার্জন থেকে এয়ানত হিসেবে যে কয়েক টাকা নিয়মিতভাবে সংগঠনকে প্রদান করতেন তা দিয়ে আমরা আন্দোলনের জন্য হিলমিয়া জাদিদার দু’টো সুরম্য অট্টালিকা কিনি। মুহাম্মদ আলী স্ট্রীটে তৃতীয আরেকটি প্রাসাদও ক্রয় করি। দেখতে দেখতে বহু কোম্পানী আমাদের আন্দোলনের মালিকানাধীন এসে পড়ে—। ইখওয়ানের এসব সম্পদ জালিম সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেয়। আমাদেরকে যদি এর ক্ষতিপূরণ দেয়া হতো তাহলে তার পরিমাণ দাঁড়াতো কোটি কোটি টাকায়।
কর্মঠ লোক ধন-সম্পদ নিয়ে আসেন কিন্তু ধন-সম্পদের পাহাড় কর্মঠ ব্যক্তি নিজে সৃষ্টি করতে পারেন না।
আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করা
ইখওয়ান দাওয়াতের ওপর আস্থাশীল। তাই তারা এর জন্য পকেটে পয়সা অকপটে খরচও করে থাকে। অন্যান্য লোকদের অবস্থা হচ্ছে, তারা কোন দলে গিয়ে যোগদান করে এই উদ্দেশ্যে যে, সেখান থেকে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নেবে। এই দুই অবস্থার মধ্যে আসমান-জমিনের ফারাক রয়েছে। এরূপ ত্যাগ ও কুরবানীর বদৌলতেই ইখওয়ানের দাওয়াত সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করে। এবং এত অত্যাচার উৎপীড়ন সত্ত্বেও ইখওয়ানের ওপর অর্পিত এই দাওয়াত সমগ্র দুনিয়াতে বিস্তার লাভ করেছে। ইখওয়ানকে যত বিপদাপদ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে যদি অন্য কাউকে তা মোকাবেলা করতে হতো তবে তার নাম নিশানাও বাকী থাকতো না। কিন্তু যার একমাত্র লক্ষ্যই মহান আল্লাহর সত্তা সে প্রতিকূল পরিবেশ এবং নিঃসংগ পরিস্থিতিতেও মনযিলে মকসুদে গিয়ে উপনিত হতে পারে।
বাস্তবতা থেকে উদাসীন লোকেরা ইখওয়ানের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার কার্যক্রমকে রাজনৈতিক শ্লোগান বলে আখ্যায়িত করে থাকে। আফসোস এটা আমাদের সম্পর্কে মারাত্মক অমূলক ধারণা।
যদি শরীয়াতের বাস্তবায়নের দাওয়াত রাজনীতি হয় তাহলে জেনে নিন যে, এটাই আমাদের রাজনীতি। আর যেসব লোক তোমাদেরকে কিতাবুল্লাহকে মজবুতভাবে ধারণ করার দাওয়াত দিয়ে থাকে তারা যদি রাজনীতিবিদ হয় তাহরে আমরা রাজনীতির উস্তাদ। আর যদি তোমরা একথার ওপর অটল অবিচল থাকো যে আমাদের উদ্দেশ্য শুধু রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করা। তবে আমাদের জবাব হচ্ছে তোমরা যা কিছু বলে বেড়াচ্ছো তার জবাব দানের যিম্মাদারী তো তোমাদের ওপরই বর্তাবে। আর যা আমরা বলে যাচ্ছি তার বিনিময় তো আমরই পেয়ে যাবো। প্রত্যেকে তাই লাভ করবে যা তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে।
নাহাস পাশা ও ইংরেজদের রক্তচক্ষু
আমাদের ইমাম দু’বার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং দু’বারই বিদেশী সাম্রাজ্যবা ও সম্প্রসারণেবাদীদের শিবিরে ব্যস্ততা ও ব্যাকুলতা ছড়িয়ে পড়েছিল। ইংরেজরা নাহাস পাশা রহুমের নিকট দাবী করে যেন তিনি ইমাম ইসমাঈলিয়ার নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বিরত রাখেন। নাহাস পাশা ইমামকে সাক্ষাতকারের জন্য ‘মিনা হাউসে” ডেকে পাঠান। উভয়েল মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হয়। নাহাস পাশা যখন দেখেন যে, ইমাম নির্বাচন থেকে পিছিয়ে যেতে কোন অবস্থায়ই প্রস্তুত নন। তখন তিনি বৃটিশের পক্ষ থেকে প্রদত্ত হুমকি ও চোখ রাঙানির কথা উল্লেখ করেন এবং বলেন যে, এমতাবস্থায় দেশে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতিরি সৃষ্টি হবে। একথা শুনে ইমাম নির্বাচন থেকে বিরত থাকার ঘোষণা প্রদান করেন। কারণ তাঁর নিকট রাষ্ট্র ও দেশের নিরাপত্তা সর্বাধিক গুরুত্বের দাবীদার ছিল। তাঁর এই ফায়সালার ফলে ইখওয়ান অবশ্য তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। যারা এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি আমি নিজেও তাদের দলে ছিলাম। ফলে আমি অফিসে যাতয়াতও বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এভাবে দফতরে আমার অনুপস্থিতি সম্পর্কে ইমাম জানতে চান। তখন তাঁকে জানানো হয় যে, আমি তাঁর নির্বাচন থেকে বিরত হওয়ার সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়েছি। তিনি আমার নামে একটা পত্র পাঠান যাতে আমাকে তাঁর সাথে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি তাঁকে লিখিত জবাব পাঠাই যার বিষয়বস্তু ছিল। আমি আপনার সাথে সাক্ষাতের কোন ইচ্ছা পোষণ করি না। তারপর তিনি উস্তাদ আবদুল হাকীমে আবেদীন এবং হাজী আবুদহু কাসেম (র)-কে সাথে আমার নিকট প্রেরণ করেন। তারা দুঁজন আমাকে একরকম জোর করে সাবীনুল কানাতিরে ইমামের কাছে নিয়ে যান। তাঁর সাথে সাক্ষাত হলে তিনি আমাকে সতস্ত ঘটনা আদ্যন্ত খুলে বলেন। সত্য কথা বলতে কি আমি তাঁর গৃহীত পদক্সেপে সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত হই এবং পূর্বের ন্যায় আবার ইখওয়ানের সাথে দাওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করি।
দ্বিতীয়বার যখন তিনি নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন তখন সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সার্বক প্রয়াস প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাঁর পৃষ্ঠপোষক ও উপদেষ্টগণকে তাঁর সহযোগিতা থেকে বিরত রাখা যায়নি। এর ফলে প্রশাসন ভোট গণনার সময় এমন কারচুপি করে এবং এমন সন্ত্রাস সৃষ্টি করে যে তার কোন নজীর পাওয়া যায় না। এভাবে তার নিশ্চিত বিজয়কে ব্যর্থতা ও পরাজয়ে রূপান্তরিত করা হয়।
মতবিরোধের অধিকার
ইখওয়ানের মুর্শিদের সাথে তাদের আচরণ হতো এমনযে, তারা তাঁর সাথে মত-পার্থক্যও করতেন। আলোচনা পর্যালোচনাও হতো এবং প্রশ্নোত্তর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও। যদি তারা সন্তুষ্ট না হতো কিংবা মুর্শিদ তাঁর রায়ের ওপর অটল থাকতেন তাহলে ইখওয়ান মনে করতো যে, মুর্শিদকে আল্লাহ তায়ালা বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা, পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞার পর্যাপ্ত অংশদান করেছেন এবং তার বৃক্ষ প্রশস্ত করে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তারা নিজেদের মতামত ত্যাগ করে তাঁর হুকুম মেনে নিতো। এটা হতো পরিপূর্ণ আন্তরিকতার মধ্য দিয়ে।
হাসানুল বান্না ও হাসান আল হুদাইবি
সম্মানিত পাঠকগণের নিশ্চয়ই ভুলে যাওয়অর কথা নয় যে, আমি যা বলেছি তা ইমাম শহীদের পুস্তিকা থেকে হয় অবিকল নকল করছি নয়তো তার মর্মার্থ আমার নিজস্ব ভাষায় প্রকাশ করছি। আল্লাহ জাল্লা শানুহু স্বয়ং এই পবিত্র দাওয়াতের জন্য যথোপুযুক্ত ফঅয়সালা প্রকাশ করে থাকেন। প্রথমে ছিল শিক্ষা ও সংস্কারের স্তর। ঈমান-আকীদার সাহায্যে আল্লাহ তায়ালার সাথে মু’মিন বান্দার ঘনিষ্ঠ ও নিবিড় যোসূত্র সৃষ্টি করার প্রয়োজন ছিল। সেই সময় ছিল লাইব্রেরীগুলো মোটামোটা বই পুস্তকে ভর্তি করে রাখার পরিবর্তে ব্যক্তি মানুষের সমন্বয় সাধানের মুহূর্ত। আন্দোলন এমন নিবেদিত প্রাণ কর্মী বাহিনীর মুখাপেক্ষী ছিল যার দিকে দিকে তাওয়াতের পতাকা উত্তোলন করবে। ঘুমিয়ে পড়া মন ও নেতিয়ে পড়া বিবেকগুলোকে সতর্ক এবং সাবধান করে দেয়অর সুবর্ণ সুযোগ ছিল সেটা। হকের বুনিয়াদসমূহের ওপর একটা মজবুত সংগঠন গড়ে তোলা ছিল সময়ের দাবী। সেটা ছিল উম্মাতে মুসলিমাকে ইসলামের মৌলিক নীতিমালার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগটিত করা এবং প্রকৃত ঈমানের দিকে প্রত্যাবর্তনের উৎসাহ প্রদানের কাল। আহলে ইসলামকে এই শিক্ষা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য যে, জিহাদ ব্যতীত প্রকৃত সম্মান লাভ করা সম্ভব নয়। এই পর্যায় আল্লাহ তায়ালা ইখওয়ানের নেতৃত্বের জন্য ইমাম হাসানুল বান্না শহীদকে নির্বাচিত করেন। তিনি আনুসংগিক যাবতীয প্রয়োজনও উপায়-উপকরণ কানায় কানায় পুরো করে আন্দোলনকে মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেন।
তারপর শুরু হয় দ্বিতীয় স্তর যার দাবীও ছিল ভিন্ন। এ পর্যায়ে ধৈর্য স্থৈর্য এবং বীরত্বের প্রয়োজন ছিল। জুলুম ও বাতিলের মোকাবেলা এবং তাতে দৃঢ়পদ থাকার দরকার ছিল। আন্দোলনের মৌলিক শিক্ষামালঅকে বাস্তবে কার্যে পরিণত করে দেখানোর পর্যায় এসে গিয়েছিলো। ইসলামের দা’য়ীগণকে যুরোপুরি সাহস ও বীরত্বের সাথে জালেম শাসক ও আল্লাহদ্রোহী গোষ্ঠীর সামনে তাদের ইসলামী ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটানোর সময় এসে গিয়েছিলো। দাওয়াতে হককে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মুজাহিদদের নেতৃত্বে নিজ অস্তিত্ব সংরক্ষণের ভেলা ভাসাতে হয়। আল্লাহ তায়ালা হাসানুল বান্নার স্থলে এখন হাসান আল হুদাইবিকে বেছে নেন। আল্লাহ তার ওপর সন্তুষ্ট হোন। তিনি নেতৃত্বের হক এমনভাবে আদায় করেন যেভাবে তার অগ্রজ চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছিলেন।
মানুষ হচ্ছে খনি সদৃশ
এখানে আমি বলে দিতে চাই যে, সমগ্র মিসরে জামাল আবদুন নাসেরের পরিচয় ও স্বরূপ শুধু দু’ব্যক্তি যথাযথভাবে বুঝতে পেরেছেন। তাদের একজন হচ্ছেন ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মুর্শিদে আ’ম মরহুম হাসান আল হুদাইবি (র) আর অপর জন হচ্ছেন ওয়াফদ পার্টির প্রেসিডেন্ট মুষ্টার ফুয়াদ সিরাজ উদ্দীন।
১৯৫৪ সালে আমরা যখন সামরিক জেলখানায় বন্দী ছিলাম তখন আমাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে উম্মে কুলসুমের স্বরে স্বরে মিলিয়ে নাসেরের প্রশংসা গীতি গাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হতো। উম্মে কুলসুমের গানের রেকর্ড বাজানো হতো “ইয়া জামাল ইয়া মিসালুল আতনিয়া” (হে জামাল আবদুন নাসের হে স্বদেশ প্রেমের উত্তম দৃষ্টান্ত) এই নাটকে আবদুল কাদের আওদহা শহী (র)-কে ব্যান্ড মাষ্টার রূপে পৃথকভাবে আর আমাদের সকলকে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে দেয়া হতো। একদিন আমরা সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম এবং গান গাওয়া হচ্ছিল। ইত্যবসরে এক জেল অফিসার সাইয়েদ হাসান আল হুদাইবি (র)-এর নিকট এসে আদেশ দিল যে, “ঠিকমত দাঁড়ান এবং নির্দেশ মোতাবেক মাটির ওপর সজোরে পা ফেলুন।” জালেমদের জুলুম নির্যাতন এ সময় চরমে পৌঁছেছিল। কিন্তু সাইয়েদ হাসান আল হুদাইবি কখনো তাতে আমল দিতেন না। কারো নিকট অনুকম্পা ভিক্ষা করা কিংবা তোষামোদের ভংগী অবলম্বন করার কোন কৌশল তাঁর জানাই ছিল না। তিনি অকুতোভয়ে তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন : “আরে মিয়া চিন্তা করো না আমি মাটি ওপর এমনভাবে পা ফেলবো না যে পেট্রোল কিংবা তরমুজ বেরিয়ে আসে।” তিনি এমন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন না যারা জালিমদের সম্মুখে মাথা নত করে এবং বলে “আল্লাহ যা চান এসব সাহেবে সদর যা ইচ্ছা করেন।”
মানুষ ও খনির ন্যায় হয়ে থাকে। কোনটির ভেতর থেকে সোনা বেরিয়ে আসে আবার কোনটি থেকে লোহা। এই লোকদের মাহাত্ম কি ছিল? তাদের ঈমান ছিল মজবুত। আল্লাহর ওপর দৃঢ় বিশ্বাস চলমান ঝর্ণার মত তাদের অন্তরকে সিক্ত করে রাখতো। কঠিন পরিস্থিতিতেও আল্লাহ তায়ালা এই লোকদের অটল অবিচল থাকার সৌভাগ্য প্রদান করেছেন এবং তাদের মাধ্যমে দাওয়াতে হকের হেফাজত করেছেন।
দাওয়াতে হকের আলোচনা
আমি আমার এই স্মৃতিকথা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে অবশ্যই দাওয়াতে হকের আলোচনা করবো। এটা সেই আল্লাহর দাওয়াত যিনি আমাকে অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে অস্তিত্ব দিয়েছেন। এই দাওয়াত আমাকে আমার জীবনের স্বরূপ এবং তার প্রকৃত দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন এবং এর নিগুঢ় তত্ত্ব ও রহস্য সম্যক রূপে অবহিত করেছেন। আমি এর আলোচনা কেন করবো না। এই দাওয়াতই তো আমাকে এই শিক্ষা দিয়েছে যে, একজন মুসলিমের কাজ শুধু কিছু সংখ্যক আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, জীবনের সর্তক্ষেত্রে এবং প্রতি পদক্ষেপে কল্যাণ ও মংগলকে বিশেষ বিবেচনায় রাখবে। সম্ভাব্য সকল উপায়ে তা ব্যাপক, বিস্তৃত ও সর্বাঙ্গিন করতে চেষ্টা করা। আমাদের নিকট বৈষয়িক ও বস্তুগত কোন শক্তি না থাকলেও আমাদেরকে এই কাজ করে যেতে হবে। আমরা নিজেরা সকল অনিষ্ট থেকে দূরে থাকবো এবং সমগ্র মানবতাকে যাবতীয মন্দ থেকে রক্ষা করার সর্বাত্মক চেষ্টা করবো। এই কাজ দাওয়াতের সাহায্যে করা যাবে যদি তা মানুষ গ্রহণ করে নেয়। আর যদি তারা অনিহা প্রকাশ করে তথাপি তাদের ও আমাদের মাঝে কোন বিরোধ নেই। তারা তো জালেম। তার যদি জুলুমের হস্ত উত্তোলন করে তবে আমাদেরকে আত্মরক্ষা মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।হকের হিফাজত করা অত্যাবশ্যক; যদিও তা করতে হয় শক্তি প্রয়োগ করে। হকের সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য শক্তি ব্যবহার মানবীয় ও আল্লাহর সকল আইনেই বৈধ বলে স্বীকৃত। আমরা দাওয়াতে হকের কাজ শুধু মুখের কথা ও শ্লোগান দ্বারা করি না।
দা’য়ী ইলাল্লাহ কখনো কাল্পনিক ঘোড়ায় আরোহণ করে না। দা’য়ীর প্রয়োজন হচ্ছে, তাকে হতে হবে মজবুত স্নায়ুর অধিকারী।সে কখনো বেইজ্জতী ও অপমানকে কবুল করবে না। মহৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাঁর মধ্যে প্রবল ইচ্ছা শক্তি, অটল বিশ্বাস, ত্যাগ ও কুরবানীর অপরাজেয় উদ্দীপনা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পদ জ্ঞান এবং তার যথার্থতার প্রতি ঈমান ও এই পথে জীবন কুরবানী দিয়ে দেয়ার ইস্পাত কঠিন শপথের মত গুণাবলীঅবশ্যই থাকতে হবে। কোন জাতি প্রতিটা মানুষের মধ্যে যখন এসব উন্নত গুণাবলী থাকে যে জাতি কোন অবস্থায়ই অপমান ও লাঞ্ছনার জীবন বরণ করে না।
কেউ যদি এই মৌলিক নীতিমালার সাথে ঐকমত্য না হয় তাহলে আমরা সুস্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছি যে, হকের বিজয়ের জন্য এ ছাড়া আর কোন পথ নেই। আমরা যদি একটা শক্তিশালী জাতি রূপে আত্মপ্রকাশ করতে চাই তাহলে তার জন্য এটাই একমাত্র পথ। এইপথ সুকঠিন ও দীর্ঘ আর তা অতিক্রম করার সৎসাহস তার থাকতে পারে যাকে আল্লাহ তায়ালা তৌফিক দান করেন। আবার এই সৌভাগ্যও সেই ব্যক্তি লাভ করতে পারে যাকে আল্লাহ তায়ালা অফুরন্ত কল্যাণ প্রদানের জন্য বাছই করেন না বরং সবরের সাথে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ ও সন্তোষের গুণাবলীও প্রদান করেন।
চিন্তা ও কাজের সমন্বয়
আমাদের ব্যাপারে কিছু লোক মনে করে যে আমরা শুধু চিন্তা সর্বস্ব ও দার্শনিক সংগঠন বিশেষ। আমাদের কাছে বাস্তব সমাধান নেই। বস্তুত যে সম্পর্কে মানুষের সঠিক ধারণা থাকে না তারা সে জিনিসের দুশমনই হয়ে থাকে। সমগ্র মিসরে আপনি এমন কোন সংগঠনের দৃষ্টান্ত পেশ করতে পারবেন ন যা বাস্তবে ইখওয়ানের ন্যায় কর্মতৎপর। আমার এই দাবীর স্বপক্ষে আমি ইমাম শহীদের পুস্তিকা থেকেই কতিপয় দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি। ইখওয়ানের বাণিজ্যিক কোম্পানীসমূহের রেকর্ড খুবই প্রশস্ত। ইসমাঈলিয়া, শিবরাখিয়্যাত, মাহমুদিয়া এবং কায়রো প্রভৃতি শহর আমাদের এসব কোম্পানীর সংখ্যা ছিল প্রচুর। এসব ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কোম্পানী ছাড়াও আমাদের বিভিন্ন শিল্প ও পেশাগত কারখানা ছিল প্রচুর। বস্ত্রবয়নের জন্য অসংখ্য তাঁতশিল্প ছিল। বাণিজ্য ও কৃষি ক্ষেত্রেও ছিল বিস্তর কাজ কারবার। মিসর সরকার যদি একের পর এক আমাদের এসব প্রতিষ্ঠানকে বাজেয়াপ্ত করে ধ্বংস করে না ফেলতো তাহলে আজ ইখওয়ান মধ্য প্রাচ্যে অসংখ্য কোম্পানী ও মিল কারখানার সর্বপেক্ষা বড় মালিক হতো। বর্তমানে সারা দেশে যেসব বড় প্রতিষ্ঠান যেমন: ব্যাংক, সংবাদ সরবরাহ কেন্দ্র এবং মুদ্রণ ও প্রকাশনা কোম্পানী দেখা যায় তার ইতিহাসের দিকে যদি আপনি দৃষ্টিপাত করেন তাহলে তার পশ্চাতে ইখওয়ানের লোকদের সযত্ন প্রয়াস, প্রচেষ্টা ও অবদান সুস্পষ্টরূপে দৃষ্টিগোচর হবে।
ইখওয়ান তাদের দাওয়াতি তৎপরতা, সম্প্রসারণ তৎপরতা, সফর এবং অন্যান্য বিষয়ে যা খরচ করে থাকেনতার যোগান আসে তাদের নিজেদের পকেট থেকেই। ইখওয়ান বহির্ভূত কোন লোকের নিকট থেকে আমরা কখনো কোন পয়সা গ্রহণ করিনি। অবশ্য এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে ঐ পাঁচশত পাউন্ডের চাঁদা যা সুয়েজখাল কোম্পানী একটা মসিজদ নির্মাণের জন্য সাহায্য স্বরূপ প্রদান করেছিল। প্রসংগত েএটাও জেনে নিন যে, ইখওয়ানের সদস্যগণ যা কিছু এয়ানত দিয়ে থাকেন তা দেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে। এটা বাধ্যবাধকাতমূলক কোন ব্যাপার নয়। ইখওয়ান উম্মাতে মুসলিমাকে জিহাদের দাওয়াত দিয়ে থাকে। আর সর্বাপেক্ষা বড় দলিল এই যে, তারা কাজের লোক, জিহাদ এই দ্বীনে সর্বোচ্চ চূড়া এবঙ তার নিগুঢ় তত্ব হচ্ছে আমাদের দাওয়াত- দাওয়াতে জিহাদ। যদি তার জন্য আমাদের জান কুরবান করতে হয় তবুও।
এমন জীবনের কি মূল্য যার বুনিয়াদ ভীরুতা ও কাপুরুষতা। এভাবে বেঁচে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করে কি লাভ যদি জীবন লাঞ্ছনা ও অপমানের গ্রানিতে ভরপুর হয়ে যায়। এরূপ ছিদ্র অন্বেষণকারী ও সুযোগ সন্ধানীদের কি সম্মান মর্যাদা পাওয়া সম্ভব যারা সকল প্রকার জালিমের কাফেলায় গিয়ে শামিল হয়ে থাকে েএবঙ তার রিকাব ধরে বসে। প্রকৃত প্রস্তাবে এটা জীবন্ত সমাধিস্থ হওয়ারই নামন্তর। কবির ভাষায় :
(আরবী**********)
যে সত্যিই মৃত্যু বরণ করলো সে প্রকৃত মৃত নয়
বরং মৃত সেই যে জীবন্ত সমাধিস্থ হয়েছে ।
জিহাদের প্রকারভেদ
জিহাদ কয়েক প্রকার। মুসরিমদের অধপতিত অবস্থার জন্য আক্ষেপ ও অনুতাপের বহিঃপ্রকাশও এক প্রকার জিহাদ। মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে এবং তারা তা নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে এ অবস্থার জন্য অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করাও জিহাদের অন্তর্গত। মুসলিমদের স্বার্থ সংরক্ষণে আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা এবং তাদের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে মুসবিত থেকে তাদের মুক্তি দেয়ার চেষ্টাও জিহাদের পর্যায়ভুক্ত। সুকৃতির আদেশ এবং দুষ্কৃতির নিষেধও জিহাদ। যারা আমাদের দ্বীনের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে তাদেরকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা এবং তাদের সাথে কোন প্রকার আন্তরিক ও বন্ধুসূলভ সম্পর্কে না রাখার নামও জিহাদ। নিজেকে এমন এক কাতারে শামিল করেনেয়াও জিহাদ যা সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় দুর্ভেদ্য ও মজবুত। মানুষের যা কিছুই রয়েছে তা আল্লাহ তায়ালারই দান। তাই সবকিছু তাঁরই পথে ব্যয় করাও জিহাদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
যদি জনগণ নিবেদিত প্রাণ মুজাহিদদের সাথে গিয়ে শামিল হতে না পরে তাহলে তারা তাদের জন্য দোয়া করতে থাকবে। এটাও জিহাদ রূপেই পরিগণিত হবে। এটা আল্লাহরই বিশেষ অনুগ্রহ যে প্রত্যেক প্রকারের জিহাদই অন্য প্রকারের জিহাদের পথনির্দেশ করে। অতএব, নিজেকে মুজাহিদদের কোন না কোন কাতারে শামিল করা মুসলমানের জন্য অত্যন্ত সহজ।স কল প্রকার জিহাদকে আল্লাহ তায়ালার পবিত্র বাণী (আরবী********) “তোমরা জিহাদ করো আল্লাহর পথে জিহাদের পরিপূর্ণ হক আদায় করে” পবিত্র বাণীতে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। অতপর কোন মুসলিমের জন্য আর এমন কথা বলার সুযোগ নেই যে, সে মুজাহিদদের কোন কাতারেই জায়গা পাচ্ছে না।