স্বাধীন বাংলাদেশে ৭২ সালের সমস্যা ও সমাধান
বর্তমান সমস্যার কারন
অদ্ভুত জনপ্রিয়তা, একদলীয় একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং বিশ্বের নিরঙ্কুশ সমর্থন ও আমেরিকা, রাশিয়া, ভারতের ব্যাপক সাহায্য পাওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিব দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা মানুষের জান-মালের নিরাপত্তা এবং কোনরকমে খেয়ে পরে বেচে থাকার ব্যবস্থা করতেও ব্যর্থ হলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা হিসেবে নতুন দেশ গড়ার সমস্যা অনেক— এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু দিন দিন আবস্থা কেন উন্নতির দিকে যাচ্ছে না ? দেশের সম্পদ ব্যাপকভাবে বিদেশে চলে যাচ্ছে। চাউল, কাপড়, মাছ, খাবার তৈল, কেরোসিন, ঔষধ ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম কেবল বেড়েই চলল। অরাজকতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতায় দেশে নিরাপত্তা বোধ খতম হয়ে গেলো।
আমাদের বাপ-মা-ভাই-বোন ও বিবি-বাচ্চা- ছোট-বড় সবাই এর ভুক্তভোগী। সরকার ও জনগন সবাই চান যে অবস্থার উন্নতি হোক। কিন্তু শুধু চাইলেই কি তা হয়ে যাবে ? আর এসব সমস্যা নিয়ে যারা হৈ চৈ করে তাঁদেরকে দালাল বলে গালি দিলেই কি এর সমাধান হবে?
সত্যিই যদি আমরা এই দুরবস্থা থেকে মুক্তি চাই তাহলে বর্তমান অবস্থার মূল কারন তালাশ করতে হবে। রোগের কারন না জানলে সুচিকিৎসা অসম্ভব। যারা এখন দেশ শাসন করছেন তাঁদের মধ্যে ভাল-মন্দ সব ধরনের লোকই হয়তো আছে। কিন্তু আগে থেকে তাঁদের আন্দোলনে কর্মীদেরকে শৃঙ্খলা শিক্ষা দেবার পরিবর্তে উচ্ছৃঙ্খলতা, বেয়াদবী, অশালিনতা এমনকি গুন্ডামী করতে পর্যন্ত উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে দেশে বিক্ষোভ সৃষ্টি করা যেতে পারে, শান্তিপ্রিয় নাগরিকদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত করা যেতে পারে, জোর করে ক্ষমতা দখলও সম্ভব, নির্বাচনকে প্রহসনে পরিনত করাও সহজ—কিন্তু এ ধরনের শিক্ষার মাধ্যমে তৈরি লোকদের দ্বারা দেশ শাসন এবং জনসেবা করা করা কিছুতেই সম্ভব নয়।
যে কর্মী বাহিনীকে একসময় বিরোধী দলের সভায় লাঠি ও ইটপাটকেল দিয়ে আক্রমনের প্রেরনা যোগানো হয়েছে আজ তাঁদের হাতে অস্ত্র রয়েছে। সুতরাং সে হারেই অরাজকতা বাড়ছে। এক পক্ষ এ পথে গেলে অপর পক্ষও বাধ্য হয়েই সে পথে যাবে। তাছাড়া “বন্দুকের নল থেকে বিপ্লব” এর নীতিতে যারা বিশ্বাসী এবং “জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো” যাদের কর্মসূচী তারা এধরনের পরিবেশেই এগিয়ে আসার সুযোগ পায়। তাই বর্তমান অরাজক পরিবেশের পরিবর্তন সহজে হবে না।
( বাঙ্গালী মুসলমান কোন পথে )
সমাধানের উপায়
যদি জনগন শান্তি চায় তাহলে বেসরকারীভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অস্ত্রের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে। আইন ও শৃঙ্খলার দায়িত্বশীলগণ একমাত্র শান্তি রক্ষার জন্য অস্ত্র ব্যবহার করবেন। সরকারী এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সবাইকে অস্ত্রের ভাষায় রাজনীতি করা বন্ধ করতে হবে। এমন রাজনৈতিক দল গঠন করতে হবে যাদের নেতৃবৃন্দ ভদ্র এবং শালীন ভাষায় সমালোচনা করতে সক্ষম। গালিগালাজের পরিবর্তে যারা যুক্তির অস্ত্রে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করবে। এমন কর্মী দল গঠন করতে হবে যারা গুন্ডামীকে ঘৃণা করে, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, শৃঙ্খলাকে ভালোবাসে এবং আইনের শাসন কায়েম করার জন্য বদ্ধপরিকর। বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলো যদি এসব নীতি পালন করতে রাজী না হয় তাহলে শান্তিপ্রিয় নাগরিকদেরকে দেশ ও জনগনের কল্যাণের খাতিরে শত বিপদের ঝুকি মাথায় নিয়ে হলেও এ ধরনের দল গঠন করতেই হবে। আর না হলে মারামারি কাটাকাটি করে ধ্বংস হতে হবে।
এ পথে দেশকে ধাবিত করতে নিশ্চয়ই সময় লাগবে। যারা এ নীতিতে চলবেন তাঁদের বহু বিপদের মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু জনগন শেষ পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে তাঁদের সাথেই মিলবে। জনগন কখনো অরাজক পরিবেশ ভালোবাসে না। দুনিয়ার কোন দেশই উচ্ছৃঙ্খলতার মাধ্যমে উন্নতি করেনি। তাই শৃঙ্খলা বা ধ্বংস জনগন এই দুটি পথের একটি অবশ্যই বেছে নেবে।
( বাঙ্গালী মুসলমান কোন পথে )
বাঙ্গালী মুসলমানদের করণীয়
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাঙ্গালী মুসলমানদের জন্য তিনটি করণীয় রয়েছে। যেমন—
১। ভারতের সাহায্যে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এমনকি সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও স্বাভাবিকভাবে ভারতের যে প্রাধান্য সৃষ্টি হয়েছে এবং প্রায় চারিদিক থেকে ভারতের মতো একটা রাষ্ট্রের দ্বারা পরিবেষ্টিত হবার ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তাকে ভাগ্যের দান বলে মেনে নিয়ে ভারতের একটি উপরাষ্ট্র হিসেবে বেঁচে থাকা।
কিন্তু ঐতিহাসিক কারনে এবং আযাদী পাগল মনস্তত্ত্বের দরুন বাঙ্গালী মুসলমান এ অবস্থাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা। নিজেদের পূর্ণ অধিকার হাসিলের জন্য যারা মুসলমান ভাইদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে তারা ভারতীয় প্রাধান্যকে মেনে নিতে পারেনা।
২। রাশিয়া বা চীনের সহায়তায় ভারত থেকে মুক্ত একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র গড়ে তোলা।
এ পথ বিভিন্ন কারনে বাঙ্গালী মুসলমানদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য তো নয়ই বরং এপথে এ অঞ্চলে আর একটি ভিয়েতনামই সৃষ্টি হবে মাত্র। ভারত কেরালা এবং পশ্চিম বংগে যেমন কমিউনিস্ট শাসন বরদাশত করেনি এখানেও তা করবে না। এটা ভারতের অস্তিত্বের পক্ষেও বিপদজনক বলে তারা মনে করবে। সুতরাং এপথ চির অশান্তির পথ এবং বৃহৎ শক্তিসমূহের আখড়ায় পরিনত হবার পথ। রাশিয়া বা চীন যদি ভারতের মর্জির বিরুদ্ধে এগিয়ে আসে তাহলে আমেরিকাও ভারতকে সাহায্য করবে। সুতরাং বাঙ্গালী মুসলমানদের এ এলাকাকে অবিরাম যুদ্ধের ময়দানে পরিনত হতে দেয়া আত্মহত্যারই শামিল।
৩। বাঙ্গালী মুসলমানদের জন্য একমাত্র পথ হল ভারতের প্রভাব মুক্ত অকমিউনিস্ট সরকার গঠন করে সত্যিকার আযাদ রাষ্ট্রের মর্যাদা অর্জন করা। পাকিস্তানের অংশ হিসেবে যেটুকু আযাদী ছিল তাঁর চেয়েও বেশী রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে না পারলে এতোসব খুইয়ে কি লাভ হল ? দেশের মানুষের জন্য ভাত- কাপরের ব্যবস্থা করতে না পারলে আযাদীর কি মূল্য রইলো ? বাঙ্গালী মুসলমান যদি নিজস্ব মুসলিম সাংস্কৃতিক ও কৃষ্টি হারিয়ে হিন্দুদের সাথে এক হয়ে যায় তাহলে ভারতের গোলামী আরও স্থায়ী হবে।
কিন্তু এসব কিভাবে সম্ভব ? আজ এটাই বাঙ্গালী মুসলাম্নদের মনে সবচেয়ে বড় এবং কঠিন প্রশ্ন। যারা দেশের ভিতর বর্তমান অরাজক ও সমস্যা জর্জরিত পরিবেশে জীবন কাটাচ্ছে তাঁদের আজ দিশেহারা অবস্থা। আমরা যারা বিদেশে আছি – ভিতরের আগুন বাইরে এসে আমাদেরকেও অস্থির করে তুলছে। প্রিয় জন্মভূমিকে কিভাবে স্থিতিশীল করা যায়, দেশবাসী কিভাবে নিরাপত্তাবোধ নিয়ে বাঁচতে পারে এবং জনগন কিভাবে স্থায়ী শান্তি ভোগ করতে পারে এ চিন্তা প্রতিটি দেশপ্রেমিককে — দেশের ভেতরে ও বাইরে অস্থির করে তুলেছে। দেশ ও দেশবাসীর জন্য যাদের প্রান কাঁদে, অনাগত ভবিষ্যতে দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধির যারা স্বপ্ন দেখে এবং সত্যিকারের আযাদীর জন্য যাদের পিপাসা রয়েছে তাঁদের জন্য কি কোন পথই নেই ? ভারতের গোলামীর হাত থেকে মুক্তির কি কোন উপায়ই নেই ?
( বাঙ্গালী মুসলমান কোন পথে )
মুক্তির একই পথ
মানুষের সত্যিকারের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ নির্ভর করে মানসিক মুক্তি চেতনার উপর। মন যদি গোলাম না হয় তাহলে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সকল প্রকার গোলামী থেকে মুক্তি সম্ভব। বাঙ্গালী মুসলমানকে আজ মনের গভীরে নেমে খুঁজতে হবেঃ মুক্তির উৎস কোথায় ?
শুধু বাঙ্গালী হওয়ার মনোভাব নিয়ে আমরা কোনক্রমেই হিন্দুর প্রভাব থেকে মুক্তি পাব না। আর হিন্দু থেকে পৃথক সত্ত্বা হিসেবে চিন্তা করা ছাড়া ভারতের গোলামী থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। বাঙ্গালী মুসলমান হিসেবে আমাদের পৃথক সত্ত্বাকে জাগ্রত না করে আমরা মুক্তির পথে পা-ই দিতে পারবো না।
ভারত আমাদের মনে এ চিন্তা ঢুকানোর চেষ্টা করছে যে, পাকিস্তান হওয়াটাই ভুল হয়েছে। কারন এ চিন্তা না ঢুকালে গোলামীর জিঞ্জির মজবুত হতে পারে না এবং “হিন্দু মুসলমান এক জাতি” একথা মুসলমানরা স্বীকার না করলে ভারতের প্রভাব স্থায়ীও হতে পারে না।
কিন্তু বাঙ্গালী মুসলমানরা একথা ভালো করে জানে যে পাকিস্তান না হলে অবিভক্ত বাংলা ভারতের একটা প্রদেশ হতো মাত্র। আজ বাঙ্গালী মুসলমান প্রধান একটি পৃথক দেশ কায়েম হবার কি কোন সুযোগ হতো যদি পাকিস্তান না হতো ? সুতরাং দূর প্রাচ্যের এলাকায় সাত কোটি মুসলমানের একটি নিজস্ব দেশ গঠনে পাকিস্তানের জন্ম অপরিহার্য ছিল। অবশ্য এখনো সে নিজস্ব দেশটি দেশটি হাসিল হয়নি—হওয়ার পথে এক ধাপ অগ্রসর হয়েছে মাত্র।
একথা আমাদের ভুললে চলবে না যে, হিন্দু ও মুসলমান যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও পৃথক দুটি জাতি তা পাক- ভারতের ইতিহাসের এক অমোঘ সত্য। পৌত্তলিক এবং তৌহিদবাদী কোন দিন এক হতে পারে না। উপমহাদেশে ১২ শো বছরের বেশী হল হিন্দু- মুসলমান এক সাথে বসবাস করছে। জাতি হিসেবে উভয়ই এতো আত্তসচেতন যে, কোন দিন এরা এক হতে পারেনি। ব্যক্তি হিসেবে কোন হিন্দু মুসলমান হয়ে গেলেও বা কোন মুসলমান হিন্দু মেয়ে বিয়ে করলেও বা হিন্দু কৃষ্টি গ্রহন করলেও জাতি হিসেবে দুটি পৃথক সত্ত্বা অত্যন্ত স্পষ্ট।
ভারতীয় সভ্যতার নামে “শকহুন দল—- পাঠান- মোঘলকে” এক দেহে লীন করার মতো যতো মিষ্টি বুলিই আওড়ানো হোক, বাদশাহ আকবরের মতো দীনে ইলাহী কায়েম করে এই দুই জাতিকে এক করার যতো চেষ্টা করাই হোক — এ দুটো জাতির মানসিক চেতনা ও কৃষ্টির মধ্যে এতো মৌলিক তফাত রয়েছে যে, তাঁদেরকে এক জাতি বানাবার কোন উপায়ই নেই।
মুসলিম জাতীয়তাবোধ যেমন একদিন ইংরেজ এবং কংগ্রেসের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারত বিভাগ করতে সক্ষম হয়েছিলো আজও আবার ঐ চেতনাবোধই সত্যিকারের আযাদীর পথে এগিয়ে নেবে। যারা এটাকে সাম্প্রদায়িকতা বলে তারা মানসিকভাবে ভারতের গোলাম। এটা সাম্প্রদায়িকতা নয় সচেতন জাতীয়তা। ভারতের বিরুদ্ধে এটা যুদ্ধ ঘোষণা নয়—ভারতের মানসিক গোলামী থেকে মুক্ত হয়ে সত্যিকারের স্বাধীনতারই এটা উদাত্ত আহবান। স্বাধীন হয়ে বাঁচতে হলে এ ডাকে সাড়া দিতেই হবে।
( বাঙ্গালী মুসলমান কোন পথে )
জনগনের দাবী
বর্তমান দুরবস্থায় জনগন কিছুতেই উদাসীন থাকতে পারে না। বর্তমান অবস্তাহকে পরিবর্তনের চেষ্টা না করে ঘরে বসে থাকা এক মারাত্মক নৈতিক অন্যায়। তাই আশাহত দেশবাসীর উচিত তাঁদের ন্যায্য দাবী আদায় করার জন্য সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা। শান্তিপূর্ণ উপায়ে দাবী জানাতে হবেঃ
- ১। আমরা সত্যিকার স্বাধীনতা চাই। আযাদীর সুফল আমাদের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হবে। প্রতিটি বাঙ্গালী মুসলিম পরিবারকে খেয়ে পরে ইজ্জতের সাথে বাঁচতে দিতে হবে। ক্ষমতার বলে, অস্ত্রের বলে শাসক সেজে রাতারাতি বড়লোক হবার নীতি বর্জন করতে হবে।
- ২। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুন্ডামী, অস্ত্র প্রয়োগ ও গায়ের জোরে সরকারী ক্ষমতা দখলের চেষ্টা বন্ধ করতে হবে। শান্তিপূর্ণ গনতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আইনের শাসন চালু করতে হবে।
- ৩। রাজনৈতিক মতবিরোধ গণতন্ত্রের পরিচায়ক। তাই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিরোধী দলকে দালাল দেয়ার ঘৃণ্য অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। গালাগালির রাজনীতি দেশকে ধ্বংস করতে পারে, গড়তে পারেনা।
- ৪। ভারতের গোলামী থেকে মুক্তির সংগ্রাম চলবেই চলবে।
- ৫। ভারতের প্রভাব মুক্ত গনতান্ত্রিক সরকারই আমাদের একমাত্র কাম্য। অন্য কোন সরকার জনগনের কল্যাণ করতে পারে না।
( বাঙ্গালী মুসলমান কোন পথে )