বাংলাদেশের রাজনীতি
রাজনীতির সংজ্ঞা ঃ
একটা দেশে সরকার গঠন ও নিয়ন্ত্রণ, সরকার পরিবর্তন ও জনগণকে সংগটিত করা ও তাদের মধ্যে নেতৃত্ব সৃষ্টির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি যাবতীয় কর্মকান্ডকে সাধারণ অর্থে রাজনীতি বলা হয়। রাষ্ট্র বা রাজ্য পরিচালনার সাথে সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাবলীই রাজনীতি।
বাংলা ভাষায় রাষ্ট্র ও সরকার সংক্রান্ত কার্যাবলীকে রাজ্যনীতি বা রাষ্ট্রনীতি বলা উচিত ছিল। কিন্তু পূর্ব যেহেতু রাজারাই রাষ্ট্র পরিচালনা করতো সে কারণেই হয়তো রাজার নীতিকেই রাজনীতি বলা হতো।
ইংরেজী ‘পলিটিকেল সাইন্স’ এর অনুবাদ বাংলায় রাষ্ট্র বিজ্ঞান চালু হয়েছে, রাজনীতি বিজ্ঞান বলা হয়না। সে হিসেবে পলিটিকস্ শব্দের বাংলা রাষ্ট্রনীতিও হতে পারতো। কিন্তু শব্দটি উচ্চারণে জনগগণের জন্য সহজ নয় বলে রাজনীতি শব্দই চালু হয়ে গেছে। বর্তমানে রাষ্ট্র ও সরকারে যে পার্থক্য স্বীকৃত সে পার্থক্য অনুযায়ী রাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়াদি রাষ্ট্রনীতি ও সরকার সম্বন্ধীয় কার্যাবলী রাজনীতি হিসেবে পরিচিত।
নীতির রাজাই রাজনীতি ঃ রাজনীতি শব্দটিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হলে পরিভাষা হিসেবে এর সঠিক মর্যাদা দেয়া যায়। একটি দেশের যাবতীয় ব্যাপারে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকর দিকে যত নীতি ও বিধি রয়েছে তা রাজনীতি দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। সে হিসেবে রাজনীতিই সেরা নীতি, বাকী সব নীতি তারই অধীন। তাই রাজার নীতি রাজনীতি নয় বরং নীতির রাজাই রাজনীতি। যেমন রাজার হাঁসকে রাজহাঁস বলে না বরং হাঁসের রাজাকে রাজহাঁস বলা হয়।
কদর্থে ‘রাজনীতি’ শব্দের ব্যবহার ঃ এক শ্রেণীর রাজনীতিকের চালবাজী ও ধোঁকাবাজী রাজনীতিকে এতটা কুলষিত করে ফেলেছে যে কূটকৌশলে অপরকে ঘায়েল করাকেও রাজনীতি বলা হয়। তাই অসৎ আচরণ, পেচানো কথা কুটিল চক্রান্ত দেখলে মন্তব্য করা হয় যে, আমার সাথে পলিটিকস্ করবেন না, আমি সরল সোজা ব্যবহার চাই।
এ দ্বারা একথা বুঝানো হচ্ছে যে, রাজনীতি মানেই প্রতিপক্ষকে কৌশলে পরাজিত করার জন্য নৈতিকতা, সততা, মনুষত্ব ও যাবতীয় মানবিক মূল্যবোধ বিসর্জন দেয়া। ব্যবসা-বাণিজ্য, লেন-দেন ও অন্যান্য যাবতীয় ব্যাপারে সততা ও সরলতাকে পলিসি হিসাবে গ্রহণ করা হয়। নীতির খাতিরে না হলেও অন্তত পলিসি (কৌশল) হিসেবেও সততা অবলম্বন করা হয়ে থাকে ঐড়হবংঃু রং ঃযব নবংঃ ঢ়ড়ষরপু রভ হড়ঃ ারৎঃঁব. সততা পুণ্য না হলেও অবশ্যই সেরা পলিসি হিসেবে গণ্য। কিন্তু রাজনীতিতে যেন পলিসিই হলো ধোঁকাবাজী। এভাবে রাজনীতি কদর্থেই বেশী ব্যবহৃত হচ্ছে। এর জন্য অসৎ রাজনীতিকরাই দায়ী।
অগণতান্ত্রিক রাজনীতির ধরন ঃ যাদের হাতে ক্ষমতা থাকে তারা সকল তৎপরতা, শ্রম ও সাধনা লাগিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। কিভাবে ছলেবলে কলে কৌশলে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় কেবল এটাই তাদের সার্বক্ষনিক চিন্তা। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা যে কোন কাজ করতে পারে। এ উদ্দেশ্যে সকল প্রকার চক্রান্ত করাও তারা তাদের জন্য জায়েজ মনে করে। তাদের নীতি হচ্ছে লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকল প্রকার কাজই বৈধ-হোক তা জুলুম, অন্যায়, অত্যাচার বা হত্যার মত জঘন্য পথ। মোটকথা ক্ষমতাকে টারগেট বানিয়ে রাজনৈতিক কার্যকলাপ করাই তাদের রাজনীতি।
দীর্ঘস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যা করা প্রয়োজন তারা সেটাকেই রাজনৈতিক কার্যকলাপ মনে করে। জনগণের কিছু খেদমত করেই হোক কিংবা জনগণের মধ্য থেকে একদল কায়েমী স্বার্থবাদী লোক তৈরী করেই হোক ক্ষমতায় টিকে থাকাটাই তাদের আসল রাজনীতি।
রাজনীতির গণতান্ত্রিক সংজ্ঞা ঃ জনগণের সম্মতি নিয়ে সরকার পরিচালনার উদ্দেশ্যে সুসংগঠিত প্রচেষ্ঠাকে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রাজনীতি বলা হয়। জনগণ গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে তাদের প্রতিনিধিদেরকে ক্ষমতার আসনে বসালে আন্তরিকতার সাথে তারা দেশ ও জনগণের সেবা করে। এ সেবার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সেবা হলো সরকার গঠন ও পরিবর্তনে জনগনের চূড়ান্ত ক্ষমতা কার্যকরী রাখা। যারা ক্ষমতায় গিয়ে সরকার গঠন, পরিচালনা কিংবা সরকার পরিবর্তনে জনগণের ক্ষমতা খর্ব বা ধ্বংস করতে চায় তারা আর যাই হোক গণতান্ত্রিক রাজনীতি করে না। সরকার পরিচালনায়, দেশের উন্নয়নে ও জনগণের সেবার ব্যাপারে অন্য সব দলের মতামতকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করাও গণতান্ত্রিক রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। কারণ গণতন্ত্রে বিরোধীদলও সরকারেরই অংশ হিসেবে বিবেচ্য।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য
অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন থেকেই এদেশে গণতন্ত্রের সূচনা হয়েছে। ৫০ বছরের বেশী হলো গণতান্ত্রিক রাজনীতি চলছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, জনগণের ভোটে যারা ক্ষমতায় যান তারা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার কাজই বেশী যোগ্যতার সাথে করার চেষ্টা করে এসেছেন।
আমাদের দেশে পরিকল্পিতভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতি চালু না হবার ফলে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের সৃষ্টি হতে পারেনি। এদেশে রাজনৈতিক দলের উপর থেকে বীচ পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র দলীয় বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিগণ দলীয় সংগঠনে গনতান্ত্রিক নীতিকে নিষ্ঠার সাথে পালন করেননি। যারা দলীয় সংগঠনে গণতান্ত্রিক নীতিকে নিষ্ঠার সাথে পালন করেননি। যারা দলীয় সংগঠনে গণতান্ত্রিক নীতিকে নিষ্ঠার সাথে পালন করেননি। যারা দলীয় সংগঠনে উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত তারা সম্ভাবনাময় নতুন নেতা ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকদেরকে গড়ে তোলার চেষ্টা না করে তাদের অগ্রগতিকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। ফলে দলগুলোর অভ্যন্তরে নেতৃত্বের কোন্দল সৃষ্টি হয়েছে এবং অনেক সম্ভাবনাময় নেতৃত্বের বিকাশ লাভ সম্ভব হয়নি। এ ধরনের লোক নির্বাচনের মারফতে ক্ষমতায় এলেও স্বাভাবিকভাবেই গণতন্ত্রকে বেশি ভয় করে। যারা নিজেদের দলেই অন্যায়ভাবে বিকল্প নেতৃত্বকে রুখে দাঁড়ায়, তারা ক্ষমতায় গিয়ে কিভাবে বিকল্প দলকে সুযোগ দিতে পারে? এভাবে দেশে ৫০ বছর গণতন্ত্রের নামে রাজনীতি চলা সত্ত্বেও এ দেশে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য গড়ে উঠেনি।
ইংরেজ শাসনের অধীনে অবিভক্ত ভারতে একই ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশ থাকলেও বর্তমানে খন্ডিত ভারতে যেটুকু গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে সে পরিমাণও এদেশে সৃষ্টি না হওয়ার প্রধান কারণ আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের আদর্শিক দুর্বলতা ও নিঃস্বার্থ নেতৃত্বের অভাব। ফলে আমাদের দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জননেতা যেমন সৃষ্টি হতে পারেনি, তেমনি জনগনের মধ্যেও সুস্থ গণতন্ত্রের ট্রেনিং সম্ভব হয়নি। বরং রাজনৈতিক ময়দানে এ ধরনের কার্যকলাপ চালু হয়ে গেছে যাতে ভ্রদ্র-রুচিসম্পন্ন উচ্চ শিক্ষিত ও উন্নত মানবিক চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিদের পক্ষে রাজনীতি করাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অধিকন্তু অলক্ষেই মানুষের মনে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়ে গেছে যে, পলিটিকস্ করতে হলে ডানপিটে মেজাজের লোক দরকার, প্রতিপক্ষকে গায়ের জোরে দমিয়ে রাখার যোগ্য নিজস্ব ভলান্টিয়ার বাহিনী সংগঠিত করা দরকার, অন্যদলের লোকদেরকে শানিত ভাষায় আক্রমণ করার যোগ্য ধারালো মুখ দরকার। ক্ষমতায় থাকাকারে এক ধরনের কথা বলায় অভ্যস্ত হতে হবে। আর ক্ষমতা থেকে অপসারিত হলেই ভিন্ন ধরনের কথা বলার যোগ্য হতে হবে। বস্তুতপক্ষে এসবই যদি রাজনীতির ‘নীতি’ হয় তাহলে যে ধরনের নেতৃত্ব কর্মীবাহিনী ও গণশিক্ষা চালু হওযা স্বাভাবিক, আমাদের দেশে নিঃসন্দেহে তাই চালু হয়েছে। তাই আমরা দেখতে পাই সরকারী দল এমন ভাষায় বিরোধী দলের সমালোচনা করেন যাতে তাদের সম্পর্কে সামান্য শ্রদ্ধা বোধেরও পরিচয় পাওয়া যায় না। আর এ সমালোচনায় যুক্তির চেয়ে শক্তি প্রদর্শনের মনোবৃত্তিই সুষ্পষ্ট। বিরোধী দল সম্পর্কে গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে গালি-গালাজের ভাষা প্রয়োগ করার ফলে জনগণের ধারণা হয় যে, সরকারের নিকট যুক্তি না থাকার কারণেই তারা বেসামাল হয়ে পড়েছে। অন্য দিকে বিরোধীদলও এমন ভাষায় সরকারের সমালোচনা করে যা শুনলে রুচিবান লোকদের রাজনীতির প্রতি ঘৃণা ধরে যায়। তাদের আষ্ফালন থেকে যে অধৈর্যের পরিচয় পাওয়া যায় তাতে মনে হয় যে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আর একটা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে এখনই কোন প্রকার গদি হাসিল করা তাদের লক্ষ্য। এ জাতীয় সরকার ও বিরোধীদলীয় রাজনীতিই এদেশের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অগণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিণাম ঃ উল্লেখিত অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি চর্চার পরিণামে ঃ
(১) রাজনীতিতে যে উন্নত ও নৈতিক মানের লোকের প্রয়োজন তারা রাজনৈতিক ময়দানে আসার সাহস পায় না। (২) যারা রাজনৈতিক ময়দানে আসে তারা এমন ধরনের প্রশিক্ষণ পায় যার মাধ্যমে নিঃস্বার্থ নেতৃত্ব ও কর্মী সৃষ্টি হয় না। (৩) রাজনৈতিক পরিবেশটাকে এমন একটা যুদ্ধের ময়দান বানিয়ে রাখা হয় যেখানে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নীতিজ্ঞানবর্জিত যে কোন কাজ করাই জায়েজ বলে বিবেচিত হয়। (৪) জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাদের জন্য আন্তরিক ভক্তি ও শ্রদ্ধার ভাব সৃষ্টি হয় না। তারা রাজনৈতিক হয়। জনগণের নিঃস্বার্থ খাদেম হিসেবে তাদের যে শ্রদ্ধা পাওয়া উচিত সেটা স্বাভাবিকভাবেই তারা পান না। (৫) রাজনৈতিক দিক দিয়ে জনগণও এমন শিক্ষা পায় না যার ফলে দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকতে পারে। জনগণকে কৃত্রিম উপায়ে রাজনৈতিক উস্কানির মারফত সরকার বিরোধী বানাবার যে চেষ্টা চলে তাতে প্রতিহিংসা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয় এবং রাজনৈতিক আন্দোলন রাজনৈতিক বিদ্রোহের রূপ নেয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বুদ্ধি ও যুক্তির লড়াই-এর স্থলে শক্তি প্রয়োগের লড়াই রাজনীতিকে সন্ত্রাসবাদের দিকে ঠেলে দেয়। এতে ক্ষমতা দখলই রাজনৈতিক আন্দোলনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। অথচ গণতন্ত্রে বিরোধী দলে থেকেও দেশ ও জাতির বিরাট খেদমত করা যায়। সরকারী দল ও বিরোধী দলে থেকেও দেশ ও জাতির বিরাট খেদমত করা যায়। সরকারী দল ও বিরোধীদল পরষ্পর পরিপূরক হিসেবে জনগণের নিকট পরিচিতি হলে রাজনৈতিক ময়দানে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয় না। (৬) অগণতান্ত্রিক পরিস্থিতিতেই গণতন্ত্রের দুশমনরা রাজনৈতিক ময়দানকে তাদের স্বার্থের পক্ষে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। বন্দুকের নলের মারফত বিপ্লবে যারা বিশ্বাসী, তারা গণতান্ত্রিক পরিবেশে কখনও তাদের উদ্দেশ্যে সফল করতে পারে না। অথচ তারাও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে থাকে। কারণ গণতন্ত্র এমন এক আদর্শ যার বিরুদ্ধে কথা বলে সর্মথন লাভ করা সম্ভব নয়।
গণতন্ত্র পেতে হলে যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বলে দাবী করেন, যারা এ ধরনের উগ্রপন্থী লোকদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে চান না, তাদেরকে অবশ্যই গণ উস্কানীমূলক রাজনীতি পরিহার করতে হবে। কারণ, অগনতান্ত্রিক পন্থায় কখনো গণতন্ত্র কায়েম হতে পারে না। মুখে গণতন্ত্র বলা সত্ত্বেও যারা বাস্তব ক্ষেত্রে অগণতান্ত্রিক কর্মপন্থা অবলম্বন করে তাদেরকে গণতন্ত্রের বন্ধু মনে করার কোনই কারন নেই।
যারা রাজনীতি করেন একমাত্র তাদের পক্ষেই রাজনৈতিক ময়দানে অসুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব। যারা রাজনীতি করেন না তারা রাজনীতির অসুস্থ পরিবেশ দেখে উদ্বিগ্ন হতে পারেন, রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হতে পারেন, কিন্তু রাজনীতি হতে দূরে থেকে সুস্ত রাজনৈতিক পরিবেশ আশা করা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। যারা অগণতান্ত্রিক রাজনীতি, উগ্র আন্দোলন ও নীতি বর্জিত রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে দেশকে মুক্ত দেখতে চান তারা রাজনীতিতে সরাসরি অংশ গ্রহণ করলেই এ পরিবেশ বদলানো সম্ভব। রুচিবান, জ্ঞানী, ধৈর্যশীল ও শালীন ব্যক্তিগণ রাজনীতির ময়দানে না এসে ঘরে বসে বর্তমান অসুস্থ রাজনীতির বিরুদ্ধে যতই ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করুক না কেন তার কোন মূল্য নেই। এ ধরনের লোকদের রাজনীতিতে অনুপস্থিতির কারণেই গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সৃষ্টি হচ্ছে না। এ ধরনের লোকেরা রাজনীতিতে অগ্রসর হলেই কেবল অবাঞ্ছিত লোকদেরকে রাজনীতি থেকে উৎখাত করা সম্ভব।
অনেক সুধিজন বলে থাকেন, আমি রাজনীতি করি না। তারা শিক্ষিত সমাজ সচেতন, বুদ্ধিমান ও গুনী। ঘরোয়া পরিবেশে রাজনীতি নিয়ে বেশ চর্চাও করেন। অথচ তারা বলেন যে, তারা রাজনীতি করেন না। সবাই কিন্তু একই ধরনের মনোভাব নিয়ে একথা বলেন না।
কেউ এ অর্থে বলেন যে, তিনি কোন রাজনৈতিক দলে সক্রিয় নন। কেউ রাজনীতি করা পছন্দ যে করেন না সেকথাই প্রকাশ করতে চান। কিন্তু আমি রাজনীতি করি না কথাটাও এক সুক্ষ্ম রাজনীতি। তিনি নির্বাচনে ভোট দিয়ে থাকেন। আলাপ আলোচনায় বুঝা যায় যে, কোন দলের রাজনৈতিক বক্তব্য তিনি পছন্দ করেন। অথচ দাবী করেন যে, তিনি রাজনীতি করেন না। তিনি অবশ্যই রাজনীতি করেন। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে যে ঝুঁকি আছে তা থেকে নিরাপদ থাকতে চান। এটা কিন্তু সুবিধাবাদী রাজনীতিরই এক বিশেষ ধরন।
সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির নীতিমালা
যারা রাজনীতি করেন, তাদের উপরেই ভাল-মন্দ প্রধানত নির্ভরশীল। ভ্রান্ত রাজনীতি গোটা দেশকে বিপন্ন করতে পারে। ভুল রাজনৈতি সিদ্ধান্তে জনগণের দুর্গতির কারণ হতে পারে। তাই সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে দেশ ও জাতিকে প্রতিযোগিতার এ দুনিয়ায় বাঞ্ছিত উন্নতির দিকে এগিয়ে নেবার ব্যাপারে আন্তরিকতা থাকলে সকল রাজনৈতিক দলের পক্ষেই নিুরূপ নীতিমালা অনুসরন করা কর্তব্য ঃ
১। সকল রাজনৈতিক দলকেই নিষ্ঠার সাথে স্বীকার করে নিতে হবে যে, আলÍাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে জনগণই খিলাফতের (রাজনৈতিক ক্ষমতার) অধিকারী ও সরকারী ক্ষমতার উৎস।
২। গণতন্ত্রের এই প্রথম কথাকে স্বীকার করার প্রমাণ স্বরূপ নির্বাচন ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে ক্ষমতা হাসিলের চিন্তা পরিত্যাগ করতে হবে।
৩। বাংলাদেশের সম্মান রক্ষা ও সুনাম অর্জনের উদ্দেশ্যে বিশ্বের স্বীকৃত গণতান্ত্রিক নীতিগুলোকে আন্তরিকতার সাথে পালন করতে হবে এবং এর বিপরীত আচরণ সর্তকতার সাথে বর্জন করতে হবে। অগণতান্ত্রিক আচরণ দেশকে সহজেই দুনিয়ায় নিন্দনীয় বানায়। তাই দেশের সম্মান রক্ষার প্রধান দায়িত্ব সরকারী দলের।
৪। অভদ্র ভাষায় সমালোচনা করা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অস্ত্র ব্যবহার করা এবং দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করাকে রাজনৈতিক গুন্ডামি ও লুটতরাজ মনে করে ঘৃণা করতে হবে। ব্যক্তি স্বার্থে লুটতরাজ ও গুন্ডামী করাকে সবাই অন্যায় মনে করে। কিন্তু এক শ্রেণীর ভ্রান্ত মতবাদ রাজনৈতিক ময়দানে এসব জঘন্য কাজকেই বলিষ্ঠ নীতি হিসেবে ঘোষণা করে। এ ধরনের কার্যকলাপের প্রশ্রয়দাতাদেরকে গণতন্ত্রের দুশমন হিসেবে চিহিৃত করতে হবে।
৫। সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোন ব্যক্তি বা দলকে স্বাধীনতার শত্র“, দেশদ্রোহী, বিদেশের দালাল, দেশের দুশমন ইত্যাদি গালি দেয়াকে রাজনৈতিক অপরাধ বলে গণ্য করতে হবে। সবাই যদি আমরা একে অপরকে এ গালি দিতে থাকি, তাহলে দুনিয়াবাসীকে এ ধারণাই দেয়া হবে যে, এদেশের সবাই কারো না কারো দালাল, এমন দেশের কোন মর্যাদাই দুনিয়ায় স্বীকৃত হতে পারে না।
উপরোক্ত নীতিমালার বাস্তবায়ন প্রধানত ক্ষমতাসীন দলের আচরণের উপর নির্ভরশীল। তাদের সহনশীলতা ও নিষ্ঠাই অন্যদেরকে এ বিষয়ে উৎসাহিত করবে। সরকারী দল ক্ষমতায় অন্যায়ভাবে টিকে থাকার উদ্দেশ্যে যদি এ নীতিমালা অমান্য করে, তাহলে তাদের পরিণাম পূর্ববর্তী শাসকদের মতই হবে একথা তাদের বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে।
রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা ঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠনকেই রাজনৈতিক দল বলে। যে দেশে গণতন্ত্র নেই এবং যেখানে সরকারী দল ছাড়া কোন দল গঠনের অধিকার দেয়া হয় না সেখানে ক্ষমতাশীনরা নিজেদেরকে রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচয় দেয়ার যতই চেষ্টা করুক রাষ্ট্র বিজ্ঞানে এ ধরনের কোন সংগঠনকে রাজনৈতিক দলরূপে গণ্য করা হয় না। তাই রাজনৈতিক দল একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই জন্ম নেয় এবং টিকে থাকে।
দলগঠনের গনতান্ত্রিক পন্থা ঃ আল্লাহর সৃষ্ট প্রতিটি বস্তু একটা বৃক্ষের বিকাশের ন্যায় গড়ে উঠে। কার্যত স্বাভাবিকতার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত। গণতন্ত্রেও দল গঠনের ব্যাপারে স্বাভাবিকতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। রাজনৈতিক গল গঠনের স্বাভাবিক কর্মপদ্ধতি হচ্ছে ঃ
১। এক বা একাধিক ব্যক্তি দেশের সমস্যাবলীর সমাধান বা দেশের উন্নয়নের জন্য বিশেষ কোন দৃষ্টিভংগী পোষণ করলে কিংবা কোন রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী হরে দল গঠনের উদ্যোগ নেয়।
২। উদ্যোগীর প্রথম কাজ হল তাদের চিন্তাধারা প্রকাশ করে কিছু লোককে এর সমর্থক বানানোর চেষ্টা করা।
৩। অতপর কোন ব্যক্তি কিংবা কমিটি দল গঠনের জন্য আহবায়ক হিসেবে কাজ করে এবং সম্মত ও সমচিন্তার লোকদেরকে কোন সম্মেলনে একত্রিত করে।
৪। সম্মেলনে যারা উপস্থিত হয় তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সংগঠনের স্বাভাবিক কাজ শুরু হয়।
৫। দলের গঠনতন্ত্র রচিত হলে জনগণকে সে অনুযায়ী সংগঠিত করার জন্য প্রচেষ্টা চালানো হয়।
দল গঠনের অগণতান্ত্রিক পন্থা ঃ পাকিস্তান আমল থেকে ক্ষমতাসীন এক নায়কের ইচ্ছা ও নির্দেশে অগণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনৈতিক দল গঠনের কয়েকটি নমুনা এদেশেই কায়েম হয়েছে।
১। ১৯৫৭ সালে ইসকান্দার মির্জা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট থাকা কালে সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিয়ে জাতীয় পরিষদ সদস্যদের দ্বারা রিপাবলিকান পার্টি নামে একটি দল গঠন করা হল এবং ফিরোজ খান নুনকে এর নেতা বানিয়ে প্রধান মন্ত্রী করা হল। ৫৮ সালে আইয়ুব খান ইসকান্দর মির্জাকে বিদেশে তাড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করার পর রিপাবলিকান পার্টি খতম হয়ে গেল।
২। ১৯৬২ সারে সামরিক আইন প্রত্যাহার করার পর সামরিক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নেতৃত্বে একটা রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। মুসলিম লীগের কতক নেতাকে বাগিয়ে নিয়ে তার দলের নাম রাখা হল মুসলিম লীগ। তার পতনের পর সে দল আপনিই মরে গেল।
একনায়কবাদী দলের বৈশিষ্ট্য ঃ দল গঠনের স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম এ দ’টো উদাহরণ থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ ধরনের দলের বৈশিষ্ট্য রাজনৈতিক দল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
(ক) ক্ষমতাসীন একনায়ক যাদেরকে নিয়ে দল গঠন করে, তারা কোন রাজনৈতিক দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে বা দেশের সমস্যার সমাধানের তাকিদে ঐ দলে যোগ দয়ে না। বরং একনায়কের অনুগ্রহ নিয়ে ব্যক্তিগত সুবিধা হাসিল করাই তাদের উদ্দেশ্য। এটাই তাদের আদর্শ।
(খ) রাজনৈতিক দল আগে গঠিত হয় এবং দলের মাধ্যমে ক্ষমতা হাসিল হয়। আর একনায়ক আগে ক্ষমতা দখল করে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রয়োজনে সুবিধাবাদীদের সমন্বয়ে দল গঠন করে।
(গ) একনায়কের তৈরী দল হল তার সেবক। একনায়ক দলের নির্বাচিত নেতা নয়, এ নেতাকে বদলাবার ক্ষমতাও দলের নেই। দলের আর সব ‘নেতা’ একনায়কের ব্যক্তিগত কর্মচারী। এ জাতীয় দলে সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নেতা হয় না। একনায়কই দলের স্বঘোষিত নেতা। তার ইচ্ছাই দলের ইচ্ছা। তার মর্জি পূরণ করাই দলের একমাত্র কর্মসূচী।
(ঘ) এ ধরনের দলের যেহেতু ক্ষমতা ভোগ করা ছাড়া কোন রাজনৈতিক দর্শন থাকে না, সেহেতু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সুবিধাবাদীরা একনায়ককে ঘিরে সংঘবদ্ধ হয়। বিভিন্ন চিন্তাধারার লোক একনায়কের নেতৃত্বে মেনে এক সংগঠনভুক্ত হলেও তাদের মধ্যে সত্যিকারের সাংগঠনিক ঐক্য সম্ভব হয় না। সুবিধাবাদ এবং ক্ষমতা ভোগই ঐক্যের একমাত্র ভিত্তি।
গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের নেতা দলের নির্বাচকমন্ডলী দ্বারা নির্বাচিত। দলের রীতি ও আদর্শের বিপরীত চললে তার নেতৃত্ব বিপন্ন হয়। নেতারা দলের আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য। দলের প্রাধান্য নেতাদেরকেও মানতে হয়। রাজনৈতিক দল দলীয় নেতৃত্ব একনায়কত্ব মানতে রাজী হয় না। একনায়কবাদী দলের নেতৃত্ব একনায়কেরই কুক্ষিগত, এমন কি দলের অস্তিত্বও তারই মরজীর উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল।
বর্তমান দলগুলোর অবস্থা ঃ বর্তমান দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা নির্ণয় করা দস্তুরমত মুশকিলের ব্যাপার। এক নামেও একাধিক দল আছে। রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা ও গঠন পদ্ধতি অনুযায়ী বর্তমান সরকারী দলকে কোন রাজনৈতিক দল হিসেবে গণ্য করা যায় কিনা তা অগণতান্ত্রিক একনায়কবাদী দল গঠনের যে আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে সে আলোকে বিচার করার দায়িত্ব পাঠকদের উপরই ছেড়ে দিলাম।
অন্যান্য দলগুলোকে শ্রেণী বিন্যাস করলে নিুরূপ চিত্র ফুটে উঠেঃ
১। সমাজতন্ত্রী দল ঃ তিন শ্রেণীতে বিভক্ত ঃ
(ক) রুশ পন্থী
(খ) চীনপন্থী
(গ) ভারতপন্থী (এরা অবশ্য রুশ পন্থীদের সহযোগী)
২। বাংলাদেশপন্থী দল ঃ যাদের রাজনীতি বাংলাদেশ ভিত্তিক, যারা অন্য কোন দেশপন্থী নয়, যারা বাঙালী জাতীয়তায় বিশ্বাসী নয় বরং বাংলাদেশী জাতীয়তায় বিশ্বাসী। তারা কয়েক শ্রেণীতে বিভক্ত ঃ
(ক) ইসলাম পন্থী ঃ যারা ইসলামকে দলের নামে এবং দলীয় আদর্শে প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করে।
(খ) দেশীয় সমাজতন্ত্রী ঃ এদের মধ্যে কোন কোন দল দেশীয় সমাজতান্ত্রিক বলেও দাবী করে এবং কোন দেশের লেজুড় বলে স্বীকার করে না।
(গ) ভারত রুশ বিরোধী ঃ যারা ভারতের আধিপত্য বিরোধী ও সমাজতন্ত্র বিরোধী হওয়ার কারণেই স্বাভাবিকভাবে মুসলিমপন্থী- তারা ধর্ম নিরপেক্ষ নীতির অনুসারী হয়েও মুসলিম জনতার সমর্থনের প্রয়োজনে মুসলিমপন্থী হতে বাধ্য হয় এবং ইসলামের কথাও মাঝে মাঝে বলে।
৩। আমেরিকাপন্থী দল ঃ যারা সমাজতন্ত্রী নয় তাদেরকেই সমাজতন্ত্রীরা মার্কিনপন্থী বলে গালি দেয়। যেহেতু সমাজতন্ত্রীরা কোন না কোন বিদেশপন্থী তাই বাকী সবাইকে মার্কিনপন্থী মনে করে। আমেরিকার কোন আন্তর্জাতিক আদর্শ নেই। কম্যুনিষ্ট রাশিয়া ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে বাধা দেয়াই তাদের নীতি। তাই যেসব দেশে সমাজতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েম হয়নি, সেখানে কোন কোন রাজনৈতিক নেতা বা দলকে ক্ষমতায় টিকে থাকা বা ক্ষমতায় আসার জন্য আমেরিকা পৃষ্টপোষকতা করে থাকে। অবশ্য কোন নিষ্ঠাবান ইসলামী আদর্শবাদী দলকে কোন অবস্থায়ই আমেরিকা পছন্দ করতে পারে না। কারণ প্রকৃত ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়িত হলে পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের কবর রচিত হয় এবং বস্তুুবাদ খতম হয়ে যায়।
সমাজতান্ত্রিক হওয়ার দাবীদারদের মধ্যে যারা নিষ্ঠাবান নয়, তাদেরকে যেমন আমেরিকা পৃষ্টপোষকতা করে থাকে তেমনি নামসর্বস্ব ইসলাম পন্থীদেরকেও আমেরিকা ব্যবহার করতে পারে।
উপরোক্ত কয়েক প্রকারের অগণিত দলের মধ্যে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সাংগঠনিক মজবুতি ও কর্মী বাহিনীর বিচারে মাত্র কয়েকটি দলকে জাতীয় মানের বলা চলে।
দেশে রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যত ঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের সংখ্যা এত বেশী হওয়াটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক। নেতৃত্বের কোন্দলের ফলে অথবা নেতা হওয়ার খায়েশের কারণেই দলের সংখ্যা এরূপ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজনীতিবিদের অনেকেই মনে করেন, যে সরকরী উদ্যোগেই সকল দলকে বিভক্ত করে প্রভাবহীন করে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। অবশ্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু থাকলে এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে দলের সংখ্যা ক্রমে সহজেই কমে যাবে? এখন প্রশ্ন হচ্ছে তা কিভাবে কমে যাবে। তার উত্তরে বলা যায়- যারা পার্লামেন্টে সিট পাবে তারা ছাড়া বাকী দলগুলোর কোন প্রভাবই জনগণের
মধ্যে থাকবে না। ১৯৭৯ সালে প্রায় ৩০টি দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। তার মধ্যে একটি দু’টি সিট পেয়েছে এমন দলসহ মোট মাত্র দশটি দলই সংসদে আসন পেয়েছে। ১৯৮৬ সারের সংসদ নির্বাচনে অনেক দলই অংশগ্রহণ করেনি। সরকারী দল ও ৮ দলীয় জোট ছাড়া ছোট বড় ১৫টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এ ১৫টি দলের মধ্যে মাত্র ২টি দল সংসদে আসনে পেয়েছে। নিয়মিত নির্বাচন চলতে থাকলে দলের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই কমতে থাকবে।
কিন্তু দল কমানোর জন্য যদি কোন কৃত্রিম পদক্ষেপ নেয়া হয় তবে এর সংখ্যা না কমে বরং আরো বেড়ে যাওয়ারই ভয় আছে। দলের সংখ্যা কমাবার আরো একটা কারণ ঘটতে পারে। এদেশের জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের আদর্শ হিসেবে ইসলামী রাজনীতি প্রভাব বিস্তার করলে ভিন্ন আদর্শের দলের সংখ্যা কমে যাবে। কোন আদর্শবাদী দল জনগণের উল্লেখযোগ্য সমর্থন পেয়ে গেলে নাম সর্বস্ব ইসলামী দলের সংখ্যাও আপনিই কমে আসবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবার প্রধান কারণই হলো গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি। একনায়কের শাসনামলে সুবিধাবাদী ও সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিকদের চাহিদা বেড়ে যায়। এক নায়ক নিজের দল গঠনের জন্য চালু রাজনৈতিক দলগুলোতে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং নেতৃত্বের কোন্দল বাঁধিয়ে এক একটি দলকে নেতৃত্বের ভিত্তিতে একাধিক দলে পরিণত করে। তাছাড়া একনায়কের নিকট ক্রয়মূল্য বৃদ্ধির আশায় অনেক পাতি নেতাও ভিন্ন ভিন্ন নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ বহাল হলে এ জাতীয় দল আপনিই মরে যায়। (বাংলাদেশের রাজনীতি)