পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মুসলমানদের পার্থিব উন্নতির মূলে
ইংরেজ আমলে বাংলাদেশের মুসলমান গোটা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে অনুন্নত ছিল। ১৯৪৭ সালে যখন দেশ ভাগ হয় তখন সশস্ত্র বাহিনীতে বাঙ্গালী মুসলমান ছিলনা বললেই চলে। অফিসার তো দূরের কথা জওয়ানের সংখাও ছিল অতি নগণ্য। পুলিশ কর্মকর্তা কিছু থাকলেও ১৯৪৭ সালে হিন্দু পুলিশ অফিসার ও সিপাহীরা ভারতে চলে যাবার পর এদেশের থানা পাহারা দেবার মতো পুলিশেরও অভাব দেখা দিলো। সিভিল সার্ভিসে একজন মাত্র আই, সি, এস মানের বাঙ্গালী মুসলমান ছিলেন। তিনি প্রমোশনের মাধ্যমে এ পদ পেয়েছিলেন। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমান শিক্ষকদের সংখ্যা অতি নগণ্য ছিল।
যদি ভারত বিভক্ত না হতো তাহলে আজকাল যারা সরকারী অফিসে বড় বড় পদ দখল করে বসে আছেন তাঁদের অনেকেই কেরানী থেকে প্রোমোশন পেয়ে বড় জোর সেকশন অফিসার পর্যন্ত উন্নতি করতে পারতেন। আজ যারা জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ার তাঁদের কয়জন অফিসার হরে পারতেন — তারাই হিসেব করে দেখতে পারেন।
আজ যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত থেকে মুসলিম জাতীয়তার নাম শুনলেই নাক সিটকান এবং কংগ্রেসিদের ভাষায় সাম্প্রদায়িক বলে গালি দেন তাঁদের কয়জন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী করার সুযোগ পেতেন তা বিবেচনা করার যোগ্যতাটুকু তারা রাখেন বলেই আশা করি।
ব্যবসা- বাণিজ্য, শিল্প- কারখানা ও আমদানী- রপ্তানির ময়দানে আজ যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা এ ময়দানে পাত্তা পাওয়ার কোন আশাও কি তারা করতে পারতেন ?
জীবনের সব ক্ষেত্রেই এই একই অবস্থা হতো যদি পাকিস্তান সৃষ্টি না হতো। সুতরাং নিজেদের স্বার্থেই একথা স্বীকার করা ছাড়া কোন উপায় নেই যে, মুসলিম জাতীয়তাই বাঙ্গালী মুসলমানদের বর্তমান পার্থিব উন্নতির মূলে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশ হবার সাথে সাথে মাড়োয়ারি ও পশ্চিম বঙ্গের দাদারা যে রকম তৎপরতা শুরু করেছিলেন, মুসলিম জাতীয়তাবোধই শেষ পর্যন্ত তাঁদেরকে নিরাশ করেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পরে মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনা আবার জাগ্রত না হলে বর্তমান বৈষয়িক অবস্থাটুকুও টিকে থাকতো না। সুতরাং মুসলিম জাতীয়তাবোধ বাংলাদেশের মুসলমানদের পার্থিব স্বার্থেরও সংরক্ষক।
মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত না হলে ঢাকা কখনো রাজধানীর মর্যাদা পেত না। অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কোলকাতার অধীনে ঢাকা এককালে একটি জেলা শহর মাত্র ছিল। পাকিস্তান হবার পর ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হওয়ায় এর উন্নয়ন শুরু হয়। বাংলাদেশ হবার পরে এর আরও উন্নতি হয়েছে এবং এ উন্নতি অব্যাহত থাকাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশে যে হারে শিল্প এবং বড় বড় কলকারখানা গড়ে উঠেছে তাও ভারত বিভাগের ফলেই সম্ভব হয়েছে। অবিভক্ত ভারতের অধীনে এদেশে শিল্প- বাণিজ্যে উন্নতি হলেও তাতে মুসলমানদের সামান্য প্রাধান্য লাভেরও সম্ভাবনা থাকতো না।
আজ মুসলমানদের নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্বে এদেশের সর্বক্ষেত্রে যে উন্নতি হয়েছে তা মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে ভারত বিভাগেরই প্রত্যক্ষ ফসল।
( আমার দেশ বাংলাদেশ )
পাকিস্তান আমলের কুশাসন
ইসলামের নাম নিয়ে মুসলমানদের ঈমানকে উজ্জীবিত করে পাকিস্তান হাসিল করা সত্ত্বেও এর শাসকগণ ইসলামের প্রতি আন্তরিকতার কোন পরিচয়ই দিতে পারেননি। ইসলামের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও যদি তারা অন্তত গণতন্ত্রকে চালু হতে দিতো তাহলে পাকিস্তানের এ দুর্গতি হতো না। একই সাথে পাক-ভারত স্বাধীন হল এবং একই গনতান্ত্রিক ভিত্তিতে পয়লা সরকার গঠিত হল। অথচ ভারতে দু’বছরের মধ্যেই শাসনতন্ত্র রচিত হয়ে গেলো এবং কয়েকটি নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হলো। আর পাকিস্তানে ২৫ বছরেও কোন স্থায়ী শাসনতন্ত্র হতে পারলো না। জনগনের নির্বাচিত সরকারও গঠিত হল না।
সামরিক এবং বেসামরিক যেসব চক্রান্তকারী গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই জঘন্য ষড়যন্ত্র করেছে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের মধ্যে দিন দিন এ ধারনা সৃষ্টি হতে লাগলো যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও বাঙ্গালী মুসলমানরা দেশ শাসন থেকে বঞ্চিত। যদি গনতান্ত্রিক শাসন চালু করা হতো তাহলে অর্থনৈতিক অবিচার এবং বৈষম্য নিয়ে আইন সভায় বিতর্ক হতো। পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জনগনের মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টি সুযোগ হতো না। জনগনের সরকার কায়েম হলে বৈষম্য এবং শোষণ দূর করা সহজ হতো। বাঙ্গালী মুসলমান তাঁর অধিকার আইনের মাধ্যমে হাসিল করতে পারতো।
গণতন্ত্রের ঐ দুশমনরা পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী বলে কি সেখানকার জনগন তাঁদেরকে সমর্থন করেছিলো। জনগন সেখানেও গণতন্ত্রের জন্যে সংগ্রাম করেছে। সুতরাং একথা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য যে, পাকিস্তানের অগনতান্ত্রিক শাসক চক্রই জনগনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেশকে ক্রমে ক্রমে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে।
( বাঙ্গালী মুসলমান কোন পথে )
আইয়ুব খানের যুগ
আইয়ুব খান জাঁদরেল শাসক ছিলেন। মুসলিম লীগের নামেই তিনি রাজত্ব করেছেন। অথচ তিনি তাঁর শাসনকালে মৌলিক গণতন্ত্রের নামে একনায়কত্তই চালিয়ে গেছেন। গনতন্ত্রকামী সব দলের সাথে মিলে জামায়াতে ইসলামীও আইয়ুব আমলের দশ বছর একনায়কত্তের বিরুদ্ধে আগা গোড়াই সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছে। ইতিহাস থেকে জামায়াতের এই বলিষ্ঠ ভূমিকা মুছে ফেলার সাধ্য কারো নেই।
আইয়ুব খান জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশী ক্ষেপা ছিলেন। কারন জামায়াত গনতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাবার সাথে সাথে আইয়ুব খানের ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের বিরোধিতা করতো। তাই ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের পর গনতান্ত্রিক আন্দোলন চলাকালে ১৯৬৪ সালের জানুয়ারী মাসে একমাত্র জামায়াতে ইসলামীকেই বেআইনি ঘোষণা করা হয় এবং ৬০ জন জামায়াত নেতাকে জেলে আটক করা হয়। ৯ মাস পর সুপ্রীম কোর্ট রায় দেন যে জামায়াতকে বেআইনি ঘোষণা করাটাই বেআইনি হয়েছে।
সরকারী অবহেলার ফলে ইসলামী চেতনা ও মুসলিম জাতীয়তাবোধ তো আইয়ুব আমলের পূর্ব থেকেই লোপ পাচ্ছিলো। আইয়ুবের আমলে ভাষা এবং এলাকা ভিত্তিক জাতীয়তা শূন্যস্থান পুরনে এগিয়ে এলো। পশ্চিমাঞ্চলে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের ভাষার পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ভৌগলিক দিক দিয়ে একসাথে থাকায় এবং ভারতের সাথে কয়েক দফায় যুদ্ধ হওয়ায় সেখানে মুসলিম ঐক্যবোধ কোনরকমে বেচে রইলো।
কিন্তু পূর্বাঞ্চলের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। ভৌগলিক দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থা কীসের ভিত্তিতে এখানকার মানুষ পশ্চিমের সাথে একাত্মতা বোধ করবে ? ইসলামই একমাত্র সেতুবন্ধন হতে পারতো। কিন্তু সরকারী এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামকে কোন স্থানই দেয়া হল না। যে মুসলিম জাতীয়তার চেতনা গোটা উপমহাদেশের মুসলিমদেরকে ১৯৪৬ সালে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো সে চেতনা বাঁচিয়ে রাখারও কোন প্রচেষ্টা দেখা গেলো না। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কায়েম হবার মাত্র ১০/১৫ বছর পর স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একথা জানারও সুযোগ রইলো না যে ভারত বর্ষ দু’ভাগ কেন হল ? পশ্চিম বাংলা এবং পূর্ব বাংলার ভাষা এক হওয়া সত্ত্বেও কেন বাংলা দু’ভাগ হল ? বাংলাভাষী অমুসলিমের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী মুসলমানদেরকে কেন বেশী আপন মনে করতে হবে ? ফলে ঈমান ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ বিনষ্ট হয়ে এলাকা এবং ভাষা ভিত্তিক ঐক্যবোধ জন্ম নিলো এবং বাংলাভাষী অঞ্চলে স্বাতন্ত্র্য বোধের বিকাশ অবধারিত হয়ে উঠলো।
রাজনৈতিক ময়দানে যে আদর্শিক শুন্যতা সৃষ্টি হল সেখানে সমাজতন্ত্র এগিয়ে আসার সুযোগ পেলো। রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে ইসলামের প্রভাব যাতে ব্যাপকভাবে না পরে সেজন্য ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ ময়দান দখল করতে এগিয়ে এলো। এভাবে এলাকা ভিত্তিক ভাষা ও জাতীয়তাবোধ, ধর্মনিরপেক্ষতাবোধ ও সমাজতন্ত্র রাজনৈতিক অংগনে মুসলিম জাতীয়তার স্থান দখল করতে লাগলো। ( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
মুসলিম জাতীয়তা পরিত্যাগের পরিণাম
মুসলিম জাতীয়তাবোধ চল্লিশের দশকে অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষী দশ কোটি মুসলমানকে এক বলিষ্ঠ জাতিতে পরিনত করেছিলো। এরই সুফল হিসেবে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি হল। কিন্তু ঐ জাতীয়তাবোধকে লালন না করার ফলে যে শুন্যতা সৃষ্টি হল তা ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবোধ এসে পূরণ করলো।
যেসব রাজনৈতিক দল এবং নেতৃবৃন্দ মুসলিম জাতীয়তার চিন্তাধারা পরিত্যাগ করে ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাকেই রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে গ্রহন করলেন তারা স্বাভাবিকভাবেই নিখিল পাকিস্তান ভিত্তিক রাজনীতি করার অযোগ্য হয়ে পড়লেন। কারন পাঠান জাতীয়তার পতাকাবাহী বাংলাভাষীদের নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সিন্ধী জাতীয়তাবাদী নেতা পাঠানদের নিকট নেতা হিসেবে গণ্য হতে পারেনা। তেমনি বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের রাজনৈতিক আদর্শ বলে গণ্য হওয়া অসম্ভব।
সুতরাং স্বাভাবিক রাজনৈতিক বিবর্তনেই আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগ হয়ে যাবার পর তাঁদের রাজনীতি পাকিস্তান ভিত্তিক না হয়ে শুধু পূর্ব পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো। গোটা পাকিস্তানকে একটি রাষ্ট্র হিসেবে চিন্তা করার পরিবর্তে তাঁদের সকল পরিকল্পনা শুধুমাত্র বর্তমান “বাংলাদেশ” এলাকাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠলো।
কিন্তু যারা রাজনীতি করেন তারা অবশ্যই ক্ষমতায় যেতে চান। ক্ষমতাসীন না হয়ে কোন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচীই বাস্তবায়ন করা যায় না। সুতরাং যারা শুধু পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁদের ক্ষমতায় যেতে হলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিছিন্ন হওয়া ছাড়া আর কোন পথ ছিল না।
ওদিকে মিঃ ভুট্টও ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে একই দেশে দুই মেজরিটি দলের অদ্ভুত দাবী তুললেন। দেশ ভাগ না হলে ভুট্টরও ক্ষমতাসীন হবার কোন উপায় ছিল না। ভুট্ট ক্ষমতায় যাবার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়ার সাথে যে ষড়যন্ত্র করলেন, তাতে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হওয়া ত্বরান্বিত হয়ে গেলো।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন
১৯৬৯ সালের শেষ দিকে প্রচন্ড গন-আন্দোলনের মুখে আইয়ুব খান ক্ষমতা ত্যাগ করে সেনাপতি ইয়াহিয়া খানকে সামরিক আইন জারির সুযোগ করে দিলেন। আইয়ুবের একনায়কত্তের বিরুদ্ধে দশ বছর ধরে যে গনতান্ত্রিক আন্দোলন চলেছিল এর ফলে বিনা নির্বাচনে আর দেশ শাসন করা সম্ভব ছিল না। তাই ইয়াহিয়া খান সাধারন নির্বাচন ঘোষণা করলেন। সমগ্র অবিভক্ত পাকিস্তানে এটাই প্রথম এবং শেষ সাধারন নির্বাচন।
যে টু-নেশন থিওরি ও পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়েছিলো এবং যে মুসলিম ঐক্যবোধের ভিত্তিতে পশ্চিমের চারটি প্রদেশের সাথে পূর্ব বাংলাকে মিলিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হয়েছিলো, সে জাতীয় চেতনা ও ঐক্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখার কোন সরকারী প্রচেষ্টা না থাকায় পাকিস্তান কায়েমের ২৩ বছর পর যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল তাঁর ফলাফল দেখে বুঝা গেলো যে, রাজনৈতিক দিক দিয়ে পাকিস্তান ৩ ভাগ হয়ে গেলো।
বাংলাদেশে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, সিন্ধু ও পাঞ্জাবে মিঃ ভুট্টর নেতৃত্বে পিপলস পার্টি এবং বাকী দুটো প্রদেশে অন্য দুটি দলের নিরঙ্কুশ বিজয় একথা প্রমান করলো যে, পাকিস্তানের ঐক্যের ভিত্তি আর বেচে নেই। যে ভিত্তিতে নির্বাচনের ফলে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিলো, সে ভিত্তি না থাকায় নির্বাচনের মাধ্যমেই পাকিস্তানের ভিত্তি ভেঙ্গে গেলো।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
১৯৭০ এর নির্বাচন এবং বাঙ্গালী মুসলমান
দীর্ঘ ২৩ বছর পর ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে গোটা পাকিস্তানে প্রথম সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যুক্ত নির্বাচনের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে হিন্দু ও মুসলমানের অংশগ্রহন সত্ত্বেও হিন্দুরা এক বিশেষ উদ্দেশ্যে যে দলটিকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে, বাঙ্গালী মুসলমান ভোটাররা সে দলটিকেই বিপুল সংখায় ভোট দিলেও তাঁদের উদ্দেশ্য ভিন্ন ছিল। বাঙ্গালী মুসলমানদের অধিকাংশের মনে এ ধারনা সৃষ্টি হয়েছিলো যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় একজন বাংগালীকে প্রতিষ্ঠিত না করতে পারলে এবং কেন্দ্রীয় আইন সভায় সেই নেতার পক্ষে অধিকাংশ সদস্যের সমর্থন না থাকলে তাঁদের ন্যায্য অধিকার আদায় করা সম্ভব হবে না।
এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে বিভিন্ন কারনে বাঙ্গালী মুসলমান নেতৃবৃন্দের মাঝে জনগন একমাত্র শেখ মুজিবকেই প্রাধান্য দেয়। শেখ সাহেবের নেতৃত্বে আস্থা স্থাপনের ফলে তাঁর দলকে একচেটিয়াভাবে জয়যুক্ত করা ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা হস্তগত করা সম্ভব ছিল না। কারন শেখ সাহেবের দলের পশ্চিম পাকিস্তানে কোন আসন লাভের আশা ছিল না। কিন্তু জনসংখার ভিত্তিতে আইনসভায় পূর্ব পাকিস্তানেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা হবার কথা। তাই পূর্ব পাকিস্তানের সব আসনে শেখ সাহেবের সমর্থক প্রার্থীকে ভোট না দিলে ঐ উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারেনা। একমাত্র একারনেই বাঙ্গালী মুসলমান ভোটারদের অধিকাংশই শেখ সাহেবকে ভোট দেয়া প্রয়োজন মনে করে।
যে কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তিও একথা স্বীকার করতে বাধ্য যে বাঙ্গালী মুসলমান জনগন পাকিস্তান থেকে আলাদা হবার উদ্দেশ্যে শেখ সাহেবকে ভোট দেয়নি। নির্বাচন অভিযানের প্রতিটি জনসভায় তিনি জনগণকে আশ্বাস দিয়েছেন যে, তিনি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চান না এবং যারা তাঁর সম্পর্কে এ অপপ্রচার চালাচ্ছে তারা জঘন্য মিথ্যাচার করছে। শেখ সাহেবকে জয়যুক্ত করার জন্য যারা বিরামহীন চেষ্টা করছে তাঁদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী লোক থাকলেও মুসলিম জনগন এ উদ্দেশ্যে তাকে ভোট দেয়নি—একথা নিতান্তই সত্য।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )