আদর্শিক রাজনীতি
ডুগডুগি বনাম আদর্শের রাজনীতি
সম্মানিত পাঠকবর্গ মাফ করবেন। ডুগডুগির চেয়ে কোন শালীন উদাহরণ যোগাড় করতে পারলাম না। রাজনীতির ময়দানে এদেশে দলের সংখ্যার হিসেব নেই। অনেকেই আদর্শের নাম নেয়। তবুও একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, আদর্শভিত্তিক রাজনীতি এদেশে অতি দুর্বল। এর আসল কারন বিশ্লেষণ করতে হলেই ডুগডুগির উদাহরণ দিতে হয়। বানর বা ভল্লুক নাচে এখনো ডুগডুগির ব্যবহার চালু আছে। আমি যে উদাহরণের জন্য “ডুগডুগি” শব্দ ব্যবহার করছি সে ময়দানে কিঞ্চিত উন্নতি হয়েছে। আজকাল সেখানে মেগাফোন বা মাইক ব্যবহার করা হয়। ময়দানটা হল হাতুড়ে চিকিৎসার।
দেশে জনসংখ্যার তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা নগণ্য। চিকিৎসার অভাব থাকায় রোগ বেড়েই চলেছে। যেটুকু চিকিৎসা আছে তাও পয়সার অভাবে অনেকেই পায় না। জনগনের মধ্যে শিক্ষার অভাব। তাই হাতুড়ে চিকিৎসার ময়দান এখনো যথেষ্ট প্রশস্ত। শহরে বন্দরে বাজারে আজকাল মেগাফোন, মাইক লাগিয়ে হাতুড়ে ডাক্তার বা তার এজেন্ট চিকিৎসা চালায়। আগে এক্ষেত্রেই ডুগডুগির ব্যবহার করা হতো।
ডুগডুগি এবং মাইক দিয়ে লোকজন জড়ো করার জন্য কোন খেলা বা যাদুর নামেও ডাকা হয়। লোক জড়ো হয়ে গেলে বেশ কায়দার সাথে কথা বলা হয়। মানব দেহে যত রোগ আছে যোগ্যতার সাথে তা এক নিঃশ্বাসে সব বলার পর একটি মাত্র তাবিজ, গাছের শিকড় বা স্বপ্নে পাওয়া ঔষধ দ্বারা রোগমুক্ত হওয়ার এমন আশার আলো দেখানো হয় যে, শ্রোতা নিজের কিংবা পরিবারস্থ রোগীর চিকিৎসা করতে অক্ষম হওয়ার ফলে এ হাতুড়ে চিকিৎসাই সম্বল বলে মনে করে।
হাতুড়ে রাজনীতিঃ
যেসব কারনে মানুষ হাতুড়ে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হয় সে ধরনের পরিবেশেই জনগন হাতুড়ে রাজনৈতিকদের পাল্লায় পড়ে। রাজনৈতিক ডুগডুগি বাজিয়ে বিরাট হই চৈ সৃষ্টি করে জনসভায় লোক জমায়েত করা হয়। যোগ্য হাতুড়ে ডাক্তার মঞ্চে অতি নিপুনতার সাথে জনগনের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে দেশে যত সমস্যা আছে সব একনাগাড়ে শুনিয়ে দিয়ে শ্রোতাদেরকে মুগ্ধ করে দেয়। সমস্যা জর্জরিত মানুষ সে দরদী আওয়াজ কান লাগিয়ে শুনে। সমাধান তারা জানে না। কিন্তু সমাধান পেতে চায়। সমস্যার সুচিকিৎসক কারা তা চিনবার ক্ষমতাও তাদের নেই। যারা তার রোগ নিয়ে এতো দরদ দেখাচ্ছে তাদের কাছ থেকেই চিকিৎসা আশা করছে। হাতুড়ে রাজনীতিবিদ তখন তার দলকে ভোট দিলেই যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে সে কথা জানিয়ে দিয়ে জনগনের প্রতি পবিত্র দায়িত্ব পালন করে।
হাতুড়ে ডাক্তারের তাবিজে বা ঔষধে যে রোগ সারে না বরং রোগ বাড়ায় এ অভিজ্ঞতা যদি কারো চোখ খুলে দেয় তাহলে সে পাশ করা আসল ডাক্তার তালাশ করে। তেমনি হাতুড়ে রাজনীতির কুফল ভোগ করার পর যদি জনগনের বুঝবার যোগ্যতা হয় কিংবা সুচিকিৎসকগণ যদি তাকে বুঝাতে সক্ষম হয় তাহলে হাতুড়ে রাজনীতিবিদদের হাত থেকে বাচার উপায় হতে পারে।
ডুগডুগি রাজনীতির আর বড় একটা লক্ষণ আছে। রাজনৈতিক ময়দানে সুস্থ পরিবেশ এবং মুক্তবুদ্ধি তাদের জন্য একেবারেই অনুপযোগী। তারা মানুষের এমন এক ভাব প্রবণতার সৃষ্টি করে যাতে জনগন জোশের বশবর্তী হয়ে হুশ হারিয়ে তাদের ডুগডুগির তালে নাচতে থাকে। আবেগময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, চিন্তাশক্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তিকে আচ্ছন্ন করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারই তাদের রাজনীতি।
গণতান্ত্রিক রাজনীতিঃ
সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে, দেশের সমস্যাবলীর সত্যিকারের সমাধান দিতে হলে এবং জনগনের সুখসমৃদ্ধি আন্তরিকভাবে চাইলে এ জাতীয় রাজনীতি পরিত্যাগ করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, সমাজতন্ত্র নামক আদর্শের নাম নিয়েও ডুগডুগি রাজনীতি করতে দেখা যায়। সমাজতন্ত্র যদি কল্যাণের আদর্শই হয় তাহলে মানুষকে ধীরভাবে বুঝানো যাবে না কেন ? মানুষের মনে শ্রেনী বিদ্বেষ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ময়দানে হিংসার আগুন জ্বালানোর কারন কি ? শোষকের সংখ্যা সামান্য- শোষিতই প্রায় সবাই। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণকে তাদের স্বার্থের কথা বুঝাতে বেগ পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারা এ পথ পছন্দ করেন না। বন্দুকের নল ছাড়া মানুষকে নাকি বুঝানো যায় না। তাই তাদেরকেও ডুগডুগির আশ্রয় নিতে হয়।
এ বিষয়টাকে সুস্পষ্ট করার জন্য আরো একটু বিশ্লেষণ করা দরকার। মানুষ রাজনীতি করে কেন ? উদ্দেশ্যহীনভাবে কেউ কাজ করে না। রাজনৈতিক ময়দানে কে কোন উদ্দেশ্যে নেমেছেন তার ভিত্তিতেই একের রাজনীতি অন্যের থেকে পৃথক হয়। মুখে নীতি কথা যাই বলুক, একটি দলের কর্মনীতি এবং কর্মপদ্ধতি থেকেই তার উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি বুঝা যায়। জনগন যে পর্যন্ত এসব কথা বুঝবার যোগ্য না হবে ততদিন তাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হবে না। এসব কথা বুঝবার জন্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করা জরুরী নয়। ছাত্র সমাজের একাংশ কি শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও ডুগডুগি রাজনীতির হাতিয়ার নয় ? আসল হল রাজনৈতিক চেতনা এবং অভিজ্ঞতা। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু থাকলে অশিক্ষিত জনগণও এ শিক্ষা পেতে পারে।
রাজনীতির উদ্দেশ্য
রাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকলে রাজনীতিও থাকবে। প্রশ্ন হচ্ছে রাজনীতির উদ্দেশ্য কি ? রাজনীতির প্রাথমিক উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে সরকারী ক্ষমতা অর্জন। এক্ষনে জিজ্ঞাসা সরকারী ক্ষমতা চাইবারই বা উদ্দেশ্য কি ? সরকারী ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যও একাধিক হতে পারেঃ
*১। ক্ষমতার উদ্দেশ্যে ক্ষমতা
ক্ষমতার উদ্দেশ্যে ক্ষমতা চাওয়া জঘন্যতম কাজ। এটাকে বলা যায় জাতীয় ডাকাতি এবং জনগনের বিরুদ্ধে এক মহা ষড়যন্ত্র। জনগনের সেবার দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে শক্তির ব্যবহার দেখানো এবং জনগনের ক্ষমতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গোষ্ঠী বিশেষের মর্জি ও স্বার্থ মোতাবেক কাজ করাকে জাতীয় ডাকাতি না বলে আর কি-ই বা বলা যেতে পারে ? ক্ষমতা হাতে পেয়ে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা, স্বজনপ্রীতি এবং ভোগবিলাসের মাধ্যমে সরকারী সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার, জনগনের স্বার্থের অপচয় এবং তাদের উপরে নিজেদের প্রভুত্ব কায়েমের চেষ্টা যারা করে তাদের এ সমস্ত কার্যাবলী নিঃসন্দেহে জনগনের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র এবং বিশ্বাসঘাতকতা। প্রকৃতপক্ষে এটা ক্ষমতালোভীদের স্বভাব। এটাই হচ্ছে ক্ষমতার রাজনীতি।
*২। জনসেবার উদ্দেশ্যে ক্ষমতা
জনসেবার দায়িত্ব কঠিন এবং ত্যাগ সাপেক্ষ। বিনা স্বার্থে ব্যক্তিগত গরজে মানুষ এ দায়িত্বের বঝা কাঁধে নেয় না। কেননা এ দায়িত্বের কামনা করা নিঃস্বার্থ লোকদের জন্য অস্বাভাবিক।
শুধু জনসেবার দোহাই দিলেও এটাই ক্ষমতার একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে না। জনসেবার নামে ক্ষমরা দখল করে পার্থিব যাবতীয় স্বার্থেই কাজ করা হয়। অবশ্য বুদ্ধিমানরা এক্ষেত্রে জনসেবা এতোটুকুই করে যেতোটুকু করলে ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে। এক কথায় এখানেও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাই রাজনীতির মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাড়ায়।
*৩। আদর্শের উদ্দেশ্যে ক্ষমতা
আদর্শের দোহাই দিয়েও অনেকে ক্ষমতা লাভ করে। বিশেষত উন্নয়নশীল দেশে এটা প্রায়শই ঘটে থাকে। কিন্তু মুখে আদর্শের কথা আওড়ালেও তাদের কাজে কিংবা চরিত্রে সে আদর্শের প্রতিফলন না ঘটলে তাদের কুমতলব ধরা পড়ে যায়। এ ধরনের লোক আদর্শের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে। সুতরাং কোন জনপ্রিয় আদর্শের দোহাই দিলেই কাউকে বিশ্বাস করা উচিত নয়।
পর্যবেক্ষণ করে দেখা দরকার যে, যে আদর্শের দোহাই দেয়া হচ্ছে বাস্তব কার্যকলাপে তার নিদর্শন পাওয়া যায় কি- না।
গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের দোহাই
ক। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে অনেকে ক্ষমতা পায়। কিন্তু গণতন্ত্রের দোহাই দিলেই কেউ গণতন্ত্রী হয়ে যায় না। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র আছে কি- না, দলের কর্মীদের সাথে গণতান্ত্রিক আচরণ করা হয় কি- না, দলের রাজনৈতিক কার্যকলাপে গণতান্ত্রিক নীতিমালা মেনে চলা হয় কি-না তার উপরই নির্ভর করে ঐ দলের গণতন্ত্রের প্রকৃতি। যে দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র নেই সেই দল ক্ষমতায় গিয়ে গনতন্ত্রকে ক্ষতম করাই প্রধান কর্তব্য মনে করে।
গণতান্ত্রিক নেতার ভাষা এবং বক্তৃতার ভঙ্গী থেকেই তাকে এবং তার দলকে চেনা যায়। যুক্তির বদলে যারা শক্তির হুমকী দেয়, হৃদয়ের আবেদন বাদ দিয়ে যারা হাত ও পায়ের দাপট দেখিয়ে বক্তৃতা করে, প্রতিপক্ষকে যারা গায়ের জোরে দমাতে চেষ্টা করে, গ্রেনেড এবং হাতবোমা দিয়ে যারা “রাজনৈতিক শত্রুর মোকাবেলা করে” তাদের পরিচয় স্পষ্ট।
খ। সমাজতন্ত্রের পতাকাবাহী হয়ে যারা গণতন্ত্রের দোহাই দেয় তারা অশিক্ষিত লোকদেরকে কিছুদিনের জন্য বোকা বানাতে সক্ষম হলেও রাজনীতি সচেতন লোকদেরকে ধোঁকা দিতে অক্ষম। কারন সচেতন লোকেরা জানে সমাজতন্ত্রীরা একবার কোথাও ক্ষমতায় আসতে পারলে সে দেশে চিরদিনের জন্য গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়ে যায়। শুধু তাই নয় সমাজতন্ত্রের পতাকাবাহীগন গণতন্ত্রের মাধ্যমে একবার কোনরকমে ক্ষমতায় যেতে পারলে গনতন্ত্রকে হত্যা করাকেই তারা নিজেদের পহেলা নম্বর কর্তব্য বলে মনে করে।
গ। ইসলামের নামে রাজনীতিঃ ইসলামের আদর্শবাদী না হয়েও কেউ কেউ ইসলামের নাম নিয়ে রাজনীতি করে থাকেন। তাই ইসলামের নাম নিয়ে ক্ষমতা পেলেই ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়িত হতে পারে না। এই উপমহাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসই এর সাক্ষী। ইসলামের নামে মুসলিম জনতাকে পাগল করে, অসংখ্য মুসলমানের রক্তের উপর ভিত্তি করে, হাজার হাজার মা- বোনের ইজ্জত আব্রু বিকিয়ে লক্ষ লক্ষ মুসলমানদের ধন সম্পদ বাড়ী ঘর ধংস করে তাদেরকে পথের ভিখারী বানিয়ে যারা ক্ষমতায় বসলেন তাদের হাতেই ইসলামের দুর্দশা ঘটলো।
যারা ইসলামের জ্ঞান রাখে না, ইসলামকে জানার চেষ্টা করেনা, যেটুকু জানে তাও বাস্তবে মেনে চলে না, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কেবল মুখে ইসলামের কথা বলে, তাদের দ্বারা সমাজে কিভাবে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়িত হতে পারে ? যারা নিজেদের সাড়ে তিন হাত দেহে, কয়েক ইঞ্চি জিহ্বায় এবং দেড় ইঞ্চি চোখে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে অক্ষম, তাদের দ্বারা একটা দেশে কিভাবে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়িত হতে পারে ? কক্ষনো হতে পারে না। যারা নিজেদেরকে ইসলামী নীতিতে চালাতে পারে না। তারা গোটা জাতিকে কি করে ইসলামের আদর্শে পরিচালিত করতে পারে ? তাদের এ অধিকার বা যোগ্যতা কোনটাই নাই। এ জাতীয় লোকদের দ্বারা ইসলামের নামে ধোঁকাবাজি কিংবা প্রতারণা বৈ আর কিছুই হতে পারে না।
ইসলামের নামে যে দল ক্ষমতা চাইবে তাকে সমর্থন করার পূর্বে দেখা দরকার যে সে দলের নেতারা ইসলামের জ্ঞান রাখে কি- না ? তাদের সে ইলেম যদি বাস্তবিকই থেকে থাকে তবে সে জ্ঞান অনুযায়ী তারা আমল করছে কি-না ? তাদের কর্মী বাহিনীর মধ্যে ইসলামী জ্ঞান এবং চরিত্র সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হচ্ছে কিনা। ইসলামকে প্রচার এবং প্রসার করার যে মৌলিক দায়িত্ব তাদের উপরে রয়েছে তা তারা আমানতদারীতার সাথে পালন করছে কিনা। উল্লেখিত কার্যাবলী যদি তারা নিষ্ঠার সাথে করে থাকে কেবল তখনই সে দলকে ইসলামী দল হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। শুধু তাই নয় এমতাবস্থায় তাদেরকে সহযোগিতা করা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর উপর অপরিহার্য কর্তব্য হয়ে দাড়ায়।
আদর্শের রাজনীতিঃ
দক্ষিন এশিয়ার ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশ বাংলাদেশ। ভৌগোলিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে এদেশটি এমন একটা অবস্থানে আছে যার অস্তিত্ব নির্ভর করে সুস্থ রাজনীতির উপর। আর সুস্থ রাজনীতি আদর্শের উপরই নির্ভরশীল। কোন রাজনৈতিক দর্শন ব্যতীত রাজনীতি করা যেমন অসততা, তেমনি আসল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে গোপন রেখে কোন আদর্শের দোহাই দেয়া চরম ধোঁকাবাজি।
যিনি যে আদর্শই কায়েম করতে চান তা জনগনের নিকট পরিস্কারভাবে তুলে ধরতে হবে। এখানে চোরাকারবারীর কোন অবকাশই থাকতে পারে না। রাজনৈতিক আদর্শ এবং দর্শনের প্রতি যাদের নিষ্ঠা আছে তাদের প্রতিপক্ষের অন্তরেও তাদের জন্য শ্রদ্ধাবোধ থাকে এবং আদর্শের লড়াই সত্ত্বেও দেশে সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ বজায় থাকে। যদি প্রকৃতই আদর্শের রাজনীতি দেশে আন্তরিকতার সাথে চালু করা হয় তবেই জাতি এবং দেশ হিসেবে আমাদের টিকে থাকা সম্ভব।
( বাংলাদেশের রাজনীতি )
রাজনীতি এবং নৈতিকতাঃ
যারা রাজনীতি করে তারা যে দলেই থাকুন, অবশ্যই নিজেদের হাতে সরকারী ক্ষমতা চান। তারা দেশের সেবা যেভাবে করতে চান তা ক্ষমতা হাতে পেলেই সম্ভব হতে পারে। ক্ষমতা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত তাদের কর্মসূচী বাস্তবে রূপলাভ করতে পারে না। আবার নইতিকতা জাতির সেবার জন্য একটা অপরিহার্য গুন। নৈতিকতা ব্যতীত ক্ষমতার ন্যায়ভিত্তিক ব্যবহার সম্ভব নয়। ক্ষমতার অপব্যবহার হলে জাতি সেবার পরিবর্তে জুলুমই ভোগ করে। পক্ষান্তরে ক্ষমতা না পেলেও নীতিবান রাজনীতিক দ্বারা দেশ এবং জাতির কিছু না কিছু খেদমত অবশ্যই হয়।
সরকারী ক্ষমতা যাদের হাতে থাকে তাদের নৈতিক মানের উপরই দেশ এবং জাতির প্রকৃত উন্নয়ন নির্ভর করে। সমাজে নৈতিক অবনতি বাড়তে থাকলে নিঃসন্দেহে এজন্ন ক্ষমতাসীনদের দায়ী করা যায়। কারন ক্ষমতাসীনরা হচ্ছেন চলন্ত গাড়ির ড্রাইভারের মত—যার বুদ্ধি, বিচক্ষণতা, দক্ষতা, কর্তব্যপরায়ণতা এবং নৈতিকতার উপরে নির্ভর করে অসংখ্য যাত্রীর জীবন। দেশ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যাদের উপরে থাকে তাদের নৈতিক মান, নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পলিসি স্বাভাবিকভাবে সমাজে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। জনগনের চিন্তা, ধ্যান-ধারনা, তাদের কর্মতৎপরতা এমনকি জাতির পোশাক- পরিচ্ছদ, শিক্ষা-দীক্ষা, উন্নতি- অবনতি, বহির্বিশ্বে তার সম্মান এবং মর্যাদা এসব কিছুই ক্ষমতাসীনদের নৈতিক মানের উপরে নির্ভর করে। এ কারনেই আরবীতে বলা হয়েছে—“আননাসু আলা দীনি মুলুকিহীম” অর্থাৎ জনগন শাসকদেরই জীবন ধারা অনুসরণ করে।
চরিত্রের গুরুত্বঃ
মানব জীবনে চরিত্রের গুরুত্ব কোন কালেই অস্বীকার করা সম্ভব হয় নাই। উন্নত চরিত্রের নেতৃত্ব ব্যতীত কোন দেশই সত্যিকার উন্নতি করতে পারে না। মানুষ বিবেকবান জীব হিসেবে ভালোমন্দের একটা সার্বজনীন ধারণা পোষণ করে। এরই নাম মনুষ্যত্ব। এটাই মানুষকে পশু থেকে পৃথক মর্যাদা দিয়েছে। দেশ এবং সমাজের নেতৃত্বের অধিকারী যারা তাদের চরিত্রের মান উন্নত না হলে জনগনের চারিত্রিক উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। কতক ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান উন্নত মানের চরিত্র সৃষ্টির চেষ্টা করে তা স্বল্পসংখ্যক লোকের মধ্যেই সাফল্য লাভ করতে পারে। কিন্তু সরকারী ক্ষমতা যাদের হাতে তারা চরিত্রবান না হলে রাষ্ট্রীয় উপায়- উপকরণের মাধ্যমে দেশের অধিকাংশ লোককে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। পক্ষান্তরে উন্নত চরিত্রের লোকেরা ক্ষমতাসীন হলে সমগ্র রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে জাতির ভবিষ্যৎ নাগরিকদেরকে আদর্শ এবং চরিত্রবান রূপে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
তাই রাজনৈতিক ময়দানেই উন্নত চরিত্রের প্রয়োজন সব চাইতে বেশী। চরিত্রহীন লোক যদি রাজনীতিতে প্রাধান্য পেতে থাকে তবে জাতীয় চরিত্রের অবক্ষয় হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। জাতীয় এ অবক্ষয়ের কারনেই দেশে খুন- খারাবী, হত্যা, ধর্ষণ, রাহাজানি, ব্যাভিচার, ঘুষ, দুর্নীতি, শোষণ- বঞ্চনা নিত্য- নৈমিত্তিক হয়ে দাড়ায় এবং জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠে।
পলিটিক্স মানে ধোঁকাবাজিঃ
আমাদের দেশে এমন অনেক নীতিবিদ ও চরিত্রবান লোক রয়েছেন যারা রাজনীতি করাকে রুচিবিরুদ্ধ মনে করেন। কারন অধুনা রাজনৈতিক কার্যকলাপে চরিত্রের যে রূপ দেখা যাচ্ছে তা নীতিবান সম্পন্ন লোকের নিকট ঘৃণার বিষয় ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা। রাজনীতিটা আমাদের দেশের চরিত্রবান লোকদের নিকট এতোটাই ঘৃণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, সাধারনভাবে অনেক ভদ্রলোকই বলে থাকেন “আমি ভাই পলিটিক্স করি না”। আবার কেউ যদি কোন বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য গোপন করে কায়দা করে কথা ফাঁকি দিয়ে সরে যেতে চায় তাহলে বলা হয় “দেখুন আমার সাথে পলিটিক্স করবেন না”। এরদ্বারা পলিটিক্স করা মানে ধোঁকাবাজি করাকেই বুঝানো হয়।
নৈতিকতা বর্জিত রাজনীতির পরিনামঃ
১। যে নেতারা মুখে নীতি বাক্য আওড়ান আর বাস্তবে কর্মীদেরকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ শেখান তারা পরবর্তী সময়ে কর্মীদের হাতেই অপদস্থ হন। কর্মীরা এধরণের দলে বিভেদ সৃষ্টি করে পাল্টা দল গঠন করে। এভাবেই এদেশে একটি দল স্বার্থের জন্য এবং নেতৃত্বের কোন্দলের জন্য বহু দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একই নামে বহু দল এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে।
২। নীতিহীন দল এবং নেতৃত্ব ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এমন সব অবাস্তব ওয়াদা করে যা ক্ষমতায় গিয়ে তারা পূরণ করতে পারে না। ফলে জনগন হতাশ হয়। কর্মীরা নেতাদের উপরে বীতশ্রদ্ধ হয়। নেতাদের ছলে বলে কলে কৌশলে ক্ষমতায় যাওয়ার পদ্ধতি দেখে জনগন ভাবতে শুরু করে যে, রাজনীতি করা মুনাফেকী এবং অসভ্য স্বভাবের কাজ। উন্নয়নশীল বিশ্বে এসব নীতিহীন দল এবং নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে গনঅসন্তোষ গণবিক্ষোভে পরিনত হয়। দেশের অর্থনীতি পর্যন্ত রাজনৈতিক সংকটের আবর্তে নিপতিত হয়। ফলে সামরিক সাসন জারি হয় এবং দেশের সংকট জটিল থেকে জটিলতর রূপ ধারণ করে।
৩। অসৎ দুর্নীতিপরায়ণ এবং স্বার্থপর লোকদের হাতে শাসনক্ষমতা এলে তারা সরকারী কর্মচারীদের নির্লজ্জভাবে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে। সরকারী দলের পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগে কর্মচারীরা জনগণকে শোষণ করার লাইসেন্স পেয়ে যায়। যে কোন অন্যায় করেও তারা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। ফলে দুর্নীতি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ে যে, জনজীবন একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
৪। সরকারী দল নৈতিকতা বিবর্জিত হলে তারা ক্ষমতার প্রভাবে শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অন্যায় সুবিধা আদায় করে। মোটা অংকের টাকা ছাড়া যেখানে মন্ত্রীরাও কাজ করতে চায় না সেখানে অফিসাররা আরো বেশী সুযোগ নেয়। এর ফলে ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিরা যাবতীয় ঘুষের মোটা অংক কারখানা ও ব্যবসায়ের খরচে শামিল করে জিনিসের দাম বাড়ায়। তাই সরকার এ দাম বাড়ানোর বিরুদ্ধে কিছুই বলে না। নির্বাচনের সময় এজাতীয় রাজনীতিকরা যে মোটা অংকের টাকা ব্যয় করে তাও এপদ্ধতিতেই শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করে নেয়। আর ব্যবসায়ীরা শেষ পর্যন্ত তা দ্রব্যমূল্যের আকারে জনগনের ঘাড়ে চাপায়। এভাবেই জনজীবন হয়ে পড়ে কঠিন থেকে কঠিনতর।
৫। নীতিজ্ঞান বর্জিত রাজনীতির ফলে দুষ্ট লোকদের সকল প্রকার অপকর্ম বৃদ্ধি পায়। “দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন”- শাসকবর্গের কর্তব্য বলে চিরদিন স্বীকৃত হলেও চরিত্রহীন রাজনীতিকরা এর উল্টোটাই চালু করে থাকে। বিচারের বানী সেখানে নিরবে নিভৃতে কাঁদে। ফলে সমাজে “জোর যার মুল্লুক তার” নীতিই প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাজনৈতিক ডাকাতিঃ
যদি কেউ জাতির উন্নতির জন্য রাজনীতি করতে চান তাহলে তার হাতে অবশ্যই জাতীয় চরিত্রের মানোন্নয়নের কর্মসূচী থাকতে হবে। চরিত্রবান কর্মী বাহিনী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ছাড়া যারা রাজনীতি করেন, শুধু ডানপিটে কর্মীদল নিয়ে জোর করে ক্ষমতা দখলের যারা চেষ্টা করেন, যুক্তির বদলে শক্তির ব্যবহারের দ্বারা যারা প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করতে চান তারা আর যাই হোক দেশ গঠনের জন্য কোন পরিকল্পনা হাতে রাখেন না। মনোবৃত্তির দিক দিয়ে তারা ডাকাত। সাধারন ডাকাত আইন এবং প্রশাসনের বাধা এবং জেল- গণপিটুনির ঝুঁকি নিয়ে ডাকাতি করে। কিন্তু যারা রাজনৈতিক ডাকাত তারা সরকারী ক্ষমতা হাতে নিয়ে গোটা দেশের উপর ডাকাতি করে। তাতে আইন এবং প্রশাসনকে ডাকাতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই এরা জাতীয় ডাকাত।
রাজনৈতিক ময়দানে নৈতিকতার প্রাধান্য না হওয়া পর্যন্ত দেশবাসী সরকারের কাছ থেকে সত্যিকার খেদমত বা সেবা কিছুই পাবে না। জনগন যদি সত্যিই শান্তি পেতে চায় তাহলে চরিত্রহীন নেতা এবং রাজনৈতিক দলকে জাতীয় ডাকাত মনে করতে হবে। চরিত্রহীন লোকদের হাতে যারা নেতৃত্ব দিয়ে খেদমত পাওয়ার আশা করে তারা প্রকৃতপক্ষে আত্মহত্যাই করে। আল্লাহর কুরআন এবং রাসুলের হাদীসে এজন্যই সৎ, খোদাভীরু এবং চরিত্রবান লোকদের হাতে ক্ষমতা দেয়ার জন্য তাকিদ দেয়া হয়েছে।
( বাংলাদেশের রাজনীতি )
সুস্থ রাজনীতির ভিত্তি
একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমার বিশ্বাস, রাজনীতিকে যারা পেশা হিসেবে গ্রহন করেন, তাদের কোন স্থায়ী আসন জনগন এবং কর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় না। যারা দেশ এবং জাতিকে খেদমত করাকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন, এ ময়দান তাদেরই উপযোগী। পেশাদার রাজনীতিবিদরা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন, তারা সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য সংগ্রাম এবং ত্যাগের পথে এগিয়ে যেতে পারেন না। রাজনীতি যাদের নেশা তারাই সংগ্রামী হয়। তারা কোন মতবাদ বা আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েই এর জন্য যে কোন কুরবানী স্বীকার করতে প্রস্তুত হয়। এরাই দঢ় প্রতিজ্ঞ কর্মী এবং নেতা হয়।
তাই এ ময়দানে যারাই অবতীর্ণ হবেন তাদের পহেলা কর্তব্য হবে কোন আদর্শ ও মতবাদকে জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা। নিজকে কায়েম করাই যাদের লক্ষ্য তাদের এ ময়দানে অবতীর্ণ না হওয়াই উচিত। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত একটি দেশে কোন আদর্শ স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। যেখানে বিভিন্ন মতবাদ এবং আদর্শের লড়াই ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে এসেছে, সেখানে সুবিধাবাদী ধরণের কোন রাজনীতির স্থান নেই। কোন প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থায় পেশাদার রাজনীতিবিদের স্থায়ী আসন হাসিল করা যেতে পারে। কিন্তু এ দেশের পরিবেশে সাময়িকভাবে নেতা হিসেবে স্বীকৃত হলেও কারো পক্ষে স্থায়ী নেতৃত্ব অর্জন করা অসম্ভব।
সুতরাং যারাই এদেশের সত্যিকার খেদমত করতে চান এবং যারা রাজনীতির কঠিন ও অনিশ্চিত ময়দানে মূল্যবান জীবন ও সময় নিয়োজিত করতে ইচ্ছুক, তাদের প্রথম বিবেচ্য বিষয় হল রাজনৈতিক মতাদর্শ।
সবদিক বিবেচনা করে যে আদর্শকেই গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত করুন, তার প্রতি নিষ্ঠাবান হয়ে রাজনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হউন। সুস্থ রাজনীতির এটাই প্রথম ভিত্তি।
আদর্শের বাছাই- প্রথম ভিত্তি
দেশে যারাই রাজনীতি করতে চান, তাদেরকে তিনটি বিকল্প আদর্শের মধ্যে একটিকে বাছাই করতে হবে। আদর্শ বাছাই করার মানদণ্ড নিয়ে এখানে আলোচনা করতে চাই না। কিন্তু যে আদর্শই বাছাই করুন, ধীরভাবে বিবেচনা করে এবং দেশের সার্বিক কল্যাণকে সামনে রেখেই বাছাই করতে হবে। এ তিনটি আদর্শের মধ্যে প্রথমটি হলঃ
১। ইসলামঃ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বজনীন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জীবনের মৌলিক প্রয়োজন পুরনের নিশ্চয়তা ও সম্পদের ইনসাফপূর্ণ বণ্টনের নীতিসহ একটি পূর্ণাংগ জীবন বিধান হিসেবে ইসলামকে ভালোভাবে বুঝবার চেষ্টা করতে হবে। শুধু তাই নয়, যারা ইসলামের নৈতিক বিধানকে পালন করার মতো চারিত্রিক সবলতা অনুভব করেন না, তাদের পক্ষে ইসলামী আদর্শকে পছন্দ করা সত্ত্বেও এর জন্যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া সম্ভব নয়।
এদেশের শতকরা আশি জন নাগরিকের ঐতিহ্য ও মানসিক প্রস্তুতি বিবেচনা করলে এবং সর্বোপরি মুসলিম হিসেবে চিন্তা করলে ইসলামী আদর্শকেই রাজনৈতিক লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।
২। ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র বা জনকল্যাণমুলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা
যে কোন কারনেই হোক যারা ইসলামকে সামগ্রিকভাবে গ্রহণ করতে অক্ষম কিন্তু জাতির কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে প্রতিজ্ঞ তারা “গণতান্ত্রিক জনকল্যাণমূলক” রাষ্ট্রকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। জনগনের আস্থাভাজন সরকার কায়েম করে পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে “বৃহত্তর সংখ্যক নাগরিক সর্বাধিক কল্যাণ সাধনকে” ব্রত হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। দেশকে অশান্তি এবং বিশৃঙ্খলা থেকে বাঁচাবার জন্য নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলনের উদ্দেশ্যে “গণতান্ত্রিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র” একটি আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। অবশ্যই কোন নিষ্ঠাবান মুসলমানের পক্ষে এটুকু আদর্শ মোটেই যথেষ্ট হতে পারে না। তবুও মন্দের ভালো হিসবে ইসলামের পর এটাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য আদর্শ।
৩। ইসলাম এবং গণতন্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞতার দরুন হোক বা বর্তমান যুগের সমাজতন্ত্রের ব্যাপক প্রসারের ফলেই হোক, যারা সমাজতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করবেন তাদেরকেও এ আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান হওয়া প্রয়োজন। তারা যদি “ইসলামী সমাজতন্ত্র” বা “গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র” এর ন্যায় উদ্ভট নাম দিয়ে এদেশের মাটিতে দখলী সত্ত্ব কায়েম করতে চান, তাহলে মানুষের সামনে ধোঁকাবাজ হিসেবে পরিচিত হওয়া ছাড়া আর কোন লাভ হবে না। অবশ্য ধোঁকা দেয়া সমাজতন্ত্রী আদর্শে কোন নীতিবিরুদ্ধ কাজ নয়। কিন্তু সমাজে ধোঁকাবাজ হিসেবে পরিচয় লাভ করাটা নিশ্চয়ই সে আদর্শের জন্যও লাভজনক নয়।
সমাজতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে যারা নিষ্ঠার সাথে গ্রহণ করবেন, তাদের কথা অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে যে, এদেশে বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া সমাজতন্ত্র বাস্তবায়িত হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই সমাজতন্ত্রীরা চীনপন্থী কিংবা মস্কোপন্থী হতে বাধ্য। জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রী কিছু লোক থাকলেও বৈদেশিক সাহায্যের অভাবে তাদের কোন সংগঠন এখনো দানা বাঁধতে পারেনি।
দ্বিতীয় ভিত্তিঃ
যারা সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করতে চান এবং আন্তরিকভাবে দেশের মঙ্গল কামনা করেন তাদের দ্বিতীয় প্রধান বিবেচ্য বিষয় হল- “রাজনৈতিক কর্মপন্থার ধরন”। জনগনের সমর্থনের মাধ্যমে নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকারী ক্ষমতা দখল করা যুক্তিযুক্ত মনে হয়, তাহলে গণতন্ত্রের দোহাই না দিয়ে সরাসরি ফ্যাসিতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের মাধ্যমেই রাজনীতি করা উচিত।
রাজনৈতিক কর্মপন্থার ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক বিষয়ের মীমাংসা যদি যুক্তির বদলে শক্তি দিয়েই করার প্রচেস্তা চলে, তাহলে কোনদিনই জনগনের সরকার কায়েম হওয়ার কথা নয়। শক্তি প্রয়োগের নীতি চালু হলে যারা গুণ্ডামির প্রতিযোগিতায় যারা শ্রেষ্ঠ বলে প্রমানিত তারাই রাষ্ট্র পরিচালক হবে। এরপর রাজনৈতিক ময়দান গুণ্ডাদের আখড়ায় পরিনত হবে। আজ পর্যন্ত দুনিয়ার যেখানেই শক্তিবলে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা হয়েছে, সেখানেই যুক্তির অপমৃত্যু ঘটেছে, ব্যক্তিস্বাধীনতা বিপন্ন হয়েছে এবং ক্ষমতাসীনদের দুষ্কৃতির সমালোচনার পথ বন্ধ হয়েছে। মানব সমাজের জন্য এর চেয়ে জঘন্যতম পরিস্থিতি কল্পনাও করা যায় না। তাই মনুষ্যত্বের বিকাশের প্রয়োজনে শক্তিবলে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের রীতি অবশ্যই বর্জনীয়।
তাই এ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে আন্তরিকতার সাথে আমাদের সবাইকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে যে, জ্ঞান-বুদ্ধি এবং যুক্তির মাধ্যমে জাতীয় সমস্যাবলীর সমাধান করার স্বাভাবিক রীতিই দেশে চালু করবো এবং একমাত্র গণতান্ত্রিক পন্থায়ই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করবো। গণতান্ত্রিক রীতিনীতি দেশে চালু থাকলে ক্ষমতাসীন না হয়েও সরকারকে বহু জনকল্যাণমূলক কাজে বাধ্য করা যায়। শক্তির পরিবর্তে যুক্তি প্রতিযোগিতা মানবতার দিক দিয়ে সমাজকে ক্রমেই উন্নতির দিকে এগিয়ে দেয়। এ পরিবেশে সব দল এবং নেতাই জনগনের মনে উন্নতম আদর্শ ও কর্মসূচী পেশ করার প্রতিযোগিতায় লেগে যায়। একবার যারা ক্ষমতাসীন হয়, তাদেরকে কয়েকবছর আবার নির্বাচনে সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে জনকল্যাণের চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করতে হয়। বিরোধীদল তার চেয়েও অধিক কল্যাণব্রতী কর্মসূচী পেশ করে। তাই স্বাভাবিকভাবেই সমাজ মঙ্গল এবং কল্যাণকর নীতির দিকে এগিয়ে চলে।
বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত কোন সরকারই এরূপ কল্যাণকর নীতি চালু করার চেষ্টা করেনি। বরং অধিকাংশই এর বিপরীত পন্থায়ই কাজ করেছেন। এর ফলে বিরোধী মহলেও শক্তি দ্বারা প্রতিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা চালু হয়েছে। এ জঘন্য পদ্ধতির প্রবর্তনের স্বাভাবিক পরিনাম এদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা গেছে। এক নায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত দলগুলির মধ্যেই কোন কোন দল অপর গনতন্ত্রকামী দলের উপর বিভিন্নভাবে বল প্রয়োগ করে এবং যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে শক্তি দ্বারা ফায়সালা করার চেষ্টা করে। এমনকি কোন কোন নেতা অন্যান্য দলের নেতাদের বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ জনতাকে শুধু এজন্য ক্ষেপিয়ে দিয়েছেন যে, তারা উক্ত নেতার অযৌক্তিক মত গ্রহণ করতে রাজী হয়নি। এরই ফলে কারো কারো উপরে দৈহিক আক্রমণও হয়েছে। যারা সরকারী ক্ষমতায় পৌছুবার পূর্বেই এমনি শক্তির দাপট দেখাবার চেষ্টা করেন তারা ক্ষমতাসীন হলে আরও যে কি কি করতে পারেন, তা ধারণা করা মোটেও কঠিন নয়।
এ ব্যাপারে সমাজতন্ত্রী মহলের উল্লেখ করা অপ্রাসংগিক। কারন বলপ্রয়োগ দ্বারা ক্ষমতা দখল করাই তাদের একমাত্র নীতি। এ কারনে “জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো” “সংগ্রাম শুধু সংগ্রাম” “ধরো মারো দখল করো” ইত্যাদি মন্ত্র তাদের পক্ষেই শোভন। কাজেই যারা গণতন্ত্রের দোহাই দেয় তাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, সমাজতন্ত্রের কর্মপন্থায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। একমাত্র গণতান্ত্রিক কর্মনীতির মাধ্যমেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
রাজনৈতিক আদর্শ এবং কর্মনীতি বাছাই করার সাথে সাথে আমাদেরকে একথাও মনে রাখতে হবে যে, দেশের জন্য অকল্যাণকর মতবাদ ও অগণতান্ত্রিক কর্মপন্থার মোকাবেলা করার জন্য গণতান্ত্রিক নীতিতে বিশ্বাসীদেরকেও অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। আপনার পক্ষে কারো সভা পণ্ড করতে চেষ্টা করা নিশ্চয়ই অন্যায়। কিন্তু আপনার সভায় যারা গুণ্ডামি করতে আসবে তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা অবশ্যই দিতে হবে। শক্তির বলে আপনার মতামত যেমনি অন্যের উপর চাপানো অন্যায়, আপনার উপর অপরের মতামতকে চাপাবার হীন প্রচেষ্টাকে প্রশ্রয় দেয়াও তেমনি দোষের। যে সত্য মিথ্যা থেকে আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করে না সে সত্য সত্যের মর্যাদা পেতে পারে না। তাই সঠিক আদর্শ এবং কর্মনীতি গ্রহণ করার পর মযবুত সংগঠন অপরিহার্য। সৎপন্থীরা আজ সুসংগঠিত নয় বলেই অন্যায়ের দাপট এতো প্রবল। অভদ্রতাকে প্রশ্রয় দেয়া কোন দিকে দিয়েই ভদ্রতার পরিচায়ক নয়। মযবুত সংগঠনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের বলিষ্ঠ প্রতিরোধ ব্যতীত সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি অসম্ভব।
ইসলামী দলের কর্মপন্থা
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করার ব্যাপারে ইসলামী দলের পক্ষে ইসলাম বিরোধীদের মত নীতিহীন এবং মানবতাবিরোধী কর্মপন্থা গ্রহণ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তারা যখন ইসলামী দলের সভা- সমাবেশ কিংবা মিছিলে হামলা করে তখন প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলাকারীদের সাথে প্রয়োজনীয় মেহমানদারী করতে বাধ্য হয়।
কিন্তু তারা যে সন্ত্রাসী কায়দায় চোরাগুপ্তা হামলা করে এবং রিক্সা বা বাস থেকে নামিয়ে, রেলস্টেশনে একা পেয়ে, অফিসে, বাড়িতে, হোস্টেলে ও হলের কামরায় নিরস্ত্র লোকদের উপর কাপুরুষের মত অতর্কিত হামলা চালায় এর প্রতিরোধ ইসলামী দলের জন্য বড়ই কঠিন। কারন এমন অমানবিক পন্থা কোন মুসলিমের পক্ষে অবলম্বন করা সম্ভব নয়। তাদের এ জাতীয় পাষণ্ড সুলভ তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রবল জনমত সৃষ্টি করে সমাজে এদেরকে অপাংক্তেয় করে দিতে হবে এবং ইসলামী দলকে গনসংগঠনে পরিনত করতে হবে যাতে সন্ত্রাসীরা অপকর্ম করে পালাবার সুযোগ না পায়। ( বাংলাদেশের রাজনীতি )
রাজনীতি এবং সমাজ সেবা
রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্যই সমাজ সেবা। সমাজকে সেবা করার মহান ব্রত নিয়েই রাজনীতির ক্ষেত্রে অবতরণ করা উচিৎ। প্রকৃতপক্ষে একটি গণতান্ত্রিক দেশে সর্বসাধারণের খেদমত ব্যতীত রাজনীতি চর্চার অপর কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। রাজনৈতিক আন্দোলন বাহ্যত ক্ষমতা দখলেরই প্রচেষ্টা, কিন্তু ক্ষমতা অর্জনই এর চরম লক্ষ্য নয়। দেশের জনগনের খেদমত করতে হলে রাজনৈতিক ক্ষমতা অপরিহার্য। কিন্তু যে রাজনীতির পরম কাম্য ও প্রধান উদ্দেশ্য ক্ষমতা লাভ করা, তা দ্বারা স্বার্থপর রাজনীতিকদের কিছু খেদমত হলেও জনসেবার কোন সম্ভাবনাই সেখানে নেই।
আমাদের এই দুর্ভাগা দেশে রাজনীতিকের অভাব নেই। রাজনৈতিক আন্দোলনের দাপটে সাধারন মানুষের জীবন অস্থির। ক্ষমতার রদবদলও কম হয়নি। অথচ জনসেবা যে কতটুকু হয়েছে তা আর বলার প্রয়োজন নেই। আমাদের রাজনীতিকগন সাধারনত ব্যক্তি, স্বজন ও দলকেই জনগনের স্থলাভিষিক্ত মনে করে জনসেবার কর্তব্য পালন করে। ফলে সমাধানের পরিবর্তে দেশের সমস্যা আরও জতিলতর হয়েছে এবং এমন সব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে যা কিছুদিন পূর্বে ধারনারও অতীত বলে মনে হতো।
রাজনৈতিক আন্দোলন যেভাবে জনসেবার পরিবর্তে পাইকারী জুলুম এবং সুপরিকল্পিত অত্যাচারের হাতিয়ারে পরিনত হয়েছে তাতে প্রত্যেক নিঃস্বার্থ রাজনৈতিক কর্মী ও চিন্তাশীল সমাজকর্মীদের হুঁশিয়ার হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কিছু সংখ্যক নিঃস্বার্থ কর্মীদল ব্যতীত কোন রাজনৈতিক আন্দোলনই সফল হতে পারে না। সুতরাং যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতা লাভ করেও জনসেবার পরিবর্তে গন জুলুম করেছে সেসব দলও নিঃস্বার্থ কিছু কর্মী ব্যতীত ক্ষমতা লাভ করতে সক্ষম হয়নি। এসব নিঃস্বার্থ কর্মীদেরকে গভীরভাবে চিন্তা করে দেখতে হবে যে, তাদের অক্লান্ত শ্রম এবং ত্যাগের ফলে যারা জনসেবার ওয়াদা করে ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করেছেন, তারা কেন এরূপ স্বার্থপরতা ও স্বজন প্রীতির আশ্রয় গ্রহণ করে চরম বিশ্বাসঘাতকের পরিচয় প্রদান করেন। ত্যাগী এবং নিঃস্বার্থ কর্মীদের মধ্যে এই তিক্ত অভিজ্ঞতা গভীর নৈরাশ্যের সৃষ্টি করেছে।
একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে যে, এ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের এ লজ্জাকর পরিনাম এক স্বাভাবিক প্রতিফল ব্যতীত আর কিছুই নয়। এতে নিরাশ হবারও যেমন কোন কারন নেই, এ পরিনাম রোধ করার পন্থা আবিস্কার করাও তেমনি অসাধ্য নয়। আসল ব্যাপার হল এই যে, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার সময় থেকেই আমাদের রাজনীতি হুজুগ প্রধান হয়ে পড়ে। সকল দিক থেকেই কেবল ভাংগ ভাংগ রব উঠতে থাকে। কিন্তু ভেংগে গড়ার কোন সুস্থ পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করায় আমরা এখনো অভ্যস্ত হইনি। বিশেষ করে রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতিবাচক কর্মপন্থাই এর জন্য প্রথমত দায়ী।
গদী দখল করলে সেবা করবো বলে যেসব রাজনৈতিক দল ওয়াদা করে, তারা নিঃস্বার্থ কর্মীদেরকেও ধোঁকা দেয়, জনগণকেও বেওয়াকুফ বানায়। জনগনের খেদমত করাই যে রাজনীতির উদ্দেশ্য তার কর্মসূচীতে জনসভা এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করা উচিত। কারন অভিজ্ঞতা ব্যতীত কোন কাজই মানুষের পক্ষে সঠিকভাবে সম্পাদন করা সম্ভব নয়। আর নিঃস্বার্থ জনসেবার ন্যায় কঠিন দায়িত্ব বিনা অভিজ্ঞতায় পালন করার চিন্তা করাও অজ্ঞতার পরিচায়ক। “সাতদিনের মধ্যেই ডাল- ভাতের ব্যবস্থা” করার ওয়াদা এবং “পনের দিনের মধ্যেই খাদ্য সমস্যার সমাধান” করার আশ্বাস যারা দেন তাদের ধূর্ততা, অসাধুতা এবং ভণ্ডামি যেমন ক্ষমার অযোগ্য তাদের কথায় যারা বিশ্বাস করেন তারাও তেমনি খেদমত পাওয়ার অনুপযুক্ত।
প্রকৃতপক্ষে সংগঠনের কর্মসূচী থেকেই রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। যদি সত্যই কোন দল জাতির, দেশের এবং মানুষের খেদমত করার ব্যাপারে আন্তরিক আগ্রহ রাখে তাহলে কর্মী সংগ্রহ এবং নেতৃত্ব গঠনের পর্যায়েই এর সঠিক পরিচয় পাওয়া যাবে। যে দল কর্মীদের দেশের খাদেম হিসেবে গড়ে তোলার কর্মসূচী গ্রহণ করেনি সে দল ক্ষমতা দখল করলে নিজেদের সেবা ব্যতীত আর সকলের উপরই জুলুম করবে।
কর্মীদের জন্য জনসেবামূলক কর্মসূচী থাকলে বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্ষুদ্র পরিসরে যে অভিজ্ঞতা লাভ হবে, ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বৃহৎ আকারে ঐ অভিজ্ঞতা বাস্তবে কাজে লাগবে। যে দল রাজনৈতিক কর্মী বাহিনীকে জনগনের সেবক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে সে দল ক্ষমতায় গেলে তাদের কাছে থেকে জনগন সত্যিকার সেবাই পাবে।
( বাংলাদেশের রাজনীতি )
চরিত্রবান লোকদের শাসন
দেশের শাসন ক্ষমতা যাদের হাতে থাকে তারা চরিত্রবান না হলে জনগনের চরিত্রের উন্নতি অসম্ভব। ক্ষমতাসীনরা যে মানের চরিত্রের অধিকারী হয় সে মানেই দেশ পরিচালিত হয়।
তাই রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে চরিত্র গঠনের আন্দোলন সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। রাজনৈতিক সংগঠনে যদি চরিত্র সৃষ্টির কর্মসূচী থাকে তবেই কেবল চরিত্রবান লোকদের হাতে শাসন ক্ষমতা আনবার সম্ভাবনা থাকে।
এদেশে অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিলেন এবং এখনো যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের চরিত্রের মান জনগনের নিকট উন্নত বলে কতটুকু স্বীকৃত তা যে কোন সাধারন লোকের মতামত নিলেই সহজে বুঝা যায়।
আমরা যদি দুনিয়ায় উন্নত জাতি হিসেবে দাড়াতে চাই তাহলে যেসব রাজনৈতিক দলে ব্যক্তি চরিত্র উন্নত করার কর্মসূচী রয়েছে তাদের সাফল্যের উপরেই নির্ভর করতে হবে। যে কোন প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে যারা রাজনৈতিক দল গঠন করেন তাদের হাতে চরিত্র বিপন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং চরিত্রের অভাব দূর করতে হলে চরিত্রবান নেতৃত্ব এবং কর্মী বাহিনীর হাতেই ক্ষমতা তুলে দিতে হবে।
( আমার দেশ বাংলাদেশ )