গণতন্ত্র বনাম বিপ্লব
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ্ও সরকার গঠন পদ্ধতি সম্পর্কে যত মতপার্থক্যই থাকুক গণতন্ত্রের দোহাই সবাই দিচ্ছে। জনগণকে রাজনৈতিক শক্তির উৎস বলে স্বাকার করতে কেউ কার্পণ্য করে না। সামরিক অভ্যুত্থানের নায়করাও “গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মহান উদ্দেশ্য” নিয়েই সশস্ত্র বিপ্লব করে থাকেন। কোন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের গন্ধ না থাকলেও সমাজতন্ত্রী ভাইরা কি গণতন্ত্রের দোহাই কারো চেয়ে কম দেন ?
গণতন্ত্রের যত প্রকার বিকৃত ব্যাখ্যাই দেয়া হোক এর একটা বিশ্বজনীন সংজ্ঞা আছে। প্রধানতঃ তিনটি বৈশিষ্ট্য ছাড়া কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই গণতান্ত্রিক বলা চলে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ঃ
১। জনগণের স্বাধীন ইচ্ছা অনুযায়ী সরকারী ক্ষমতা হালিল করতে হয়।
২। প্রতিষ্ঠিত সরকারের দোষক্রটি প্রকাশ করার অবাধ সুযোগ জনগণের হাতে অবশ্যই থাকে।
৩। সরকার পরিবর্তনের জন্য নিয়মতান্ত্রিক পথে চেষ্টা করার সুযোগ ও অযাদী থাকে।
গণতন্ত্রের এ তিনটি বৈশিষ্ট্য না থাকলে মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার বহাল থাকতে পারে না। কিন্তু এ কাংখিত ব্যবস্থাটির প্রশংসা সবাই করলেও এর প্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীলতা সবচেয়ে কঠিন বলে দুনিয়ার প্রমাণিত হয়েছে। “সত্য কথা বলাই কর্তব্য” একথা কোন মিথ্যাবাদীও অস্বীকার করে না। কিন্তু সত্য বলা কি সবচেয়ে সুঃসাধ্য নয় ?
“বিপ্লব বনাম গণতন্ত্র” শিরোনাম থেকেই নিশ্চয়ই এটাই প্রতিপাদ্য বলে মনে হবে যে, বিপ্লব গণতন্ত্রের বিপরীত পদ্ধতি। আসলে বিপ্লব শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থবোধক। ব্যাপক পরিবর্তন বা মৌলিক পরিবর্তনকে বিপ্লব বলা হয়। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) চরিত্রহীন সমাজে উন্নত নৈতিক চরিত্রের লোক তৈরি করে তাদের জীবনে সত্যই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন। তিনি মদীনায় বিনা রক্তপাতে সরকারী ক্শতা গণ-সমর্থনের মাধ্যমে লাভ করে প্রচলিত গোটা সমাজ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেন। এ জাতীয় মৌলিক পরিবর্তনকে বিপ্লব বলা যায়। অবশ্য ‘দার্শনিক বিপ্লব’ই এ জাতীয় পরিবর্তনের সঠিক সংজ্ঞা।
বিপ্লব শব্দের ব্যবহার ঃ সাধারণভাবে “বিপ্লব” বললে সশস্ত্র বিদ্রোহ, সামরিক অভ্যুত্থান, শক্তি বলে সরকারকে উৎখাত ইত্যাদি বুঝায়। এভাবে ক্শতা দখলকারী সরকারকে গৌরবের সাথে “বিপ্লবী সরকার” নামে পরিচয় দেয়। এই কারণেই যখন কেউ বিপ্লবের আওয়াজ তোলে তখনই মানুষ শক্তির ব্যবহার হবে বলে স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করে।
অবশ্য আজকাল “বিপ্লব” শব্দটির যথেচ্ছ ব্যবহার অনেকেই করছেন। আন্দোলন করার অর্থেই তারা বিপ্লব শব্দ ব্যবহার করছেন। নিরক্ষরতা দূর করার ব্যাপক প্রচেষ্টাকে আন্দোলন বা অভিযান বলাই যুক্তিযুক্ত। এ কাজটি এত শ্রমসাধ্য ও সাধনা সাপেক্ষে যে, কয়েক বছরেও যদি কোন দেশ নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর করতে সক্ষম হয় তাহলে জাতীয় জাতয়ি জীবনে এটা অবশ্যই বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কিন্তু এ পরিবর্তন গায়ের জোরে হবে না। স্বাক্ষরতা আন্দোলন সফল হলেই তা সম্ভব। সেচ ব্যবস্থাকে ব্যাপক করার উদ্দেশ্যে এবং বন্যার পানিকে ধারণ করার প্রয়োজনে খালখননের গণ আন্দোলনকে “বিপ্লব” নাম দেয়া হচ্ছে। এক একটি শব্দের বিশেষ একটা ওজন আছে। যেখানে সেখানে কোন শব্দের প্রয়োগ সাহিত্যরস বা হাস্যরস সৃষ্টির উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
“বিপ্লব” শব্দটি কোথায় ব্যবহার করা উচিত বা অনুচিত এ বিষয়ে মতবেধ হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু যে দেশে সশস্ত্র বিপ্লবের আওয়াজ এমনকি কাবুল ষ্টাইলের বিপ্লবের শ্লোগান পর্যন্ত জনগণ শুনতে পাচ্ছে সেখানে বিপ্লবের সস্তা ব্যবহার চলতে থাকলে মানুষের মধ্যে অবাঞ্ছিত বিপ্লবের প্রতিরোধ স্পৃহা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কঠিন পরিস্থিতিতেও বিপ্লবের আওয়াজকে “খাল কাটা বিপ্লবের” মতই জনগণ নিরাপদ মনে করে অবহেলা করতে পারে। তাই “বিপ্লব সম্পর্কে সচেতন থাকার প্রয়োজনেই হালকাভাবে এর ব্যবহার অনুচিত।
যা হোক বিপ্লব শব্দের ব্যবহার আলোচ্য বিষয় নয়। ভাববার বিষয় হলো যে আমরা বিপ্লবী সরকার চাই, না গণতান্ত্রিক সরকার কামনা করি। দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে সরকারকে পরিবর্তন চাই, না গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাই। জনগণকেও এ বিষয়ে সজাগ হতে হবে যে, কাদেরকে সমর্থন করা উচিত। যাঁরা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই সর্বদিক দিয়ে কল্যাণকর মনে করেন তাঁদের কর্মপদ্ধতি এক ধরনের হবে। আর যারা শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা দখল করতে আগ্রহী তাদের কর্মনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের হওয়াই স্বাভাবিক।
গণতান্ত্রিক মনোভাব ঃ যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তাদের আচরণ গণতন্ত্র সম্মত হতে হবে। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বিরোধী দলের আন্দোলনকে অশালীন ভাষায় গালি দেয়া চলে না। গণতন্ত্রমনা লোকের ভাষাই জানিয়ে দেয় যে, তিনি অধৈর্য নন। সরকারী ক্ষমতা থেকে কোন বিরোধী দলকে অন্য দেশের দালাল বলে গালি দেয়া অর্থহীন। দালাল হয়ে থাকলে আইনের মাধ্যমে বিচার করুন। সরকারের হাতেই আইন রয়েছে। সে আইনের প্রয়োগ না করে অসহায়ের মত গালি দেয়া দুর্বলতারই পরিচায়ক। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এদেশে যে হারে একে অপরকে বিদেশী দালাল বলছে, তাতে দুনিয়ার মানুষ আমাদের সবাইকে শুধু দালালই মনে করবে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে রাজনীতিবিদদের পরম ধৈর্যশীল হতে হবে। দু॥খের বিষয়, এ ধৈর্যেরই অভাব সবচেয়ে বেশী। সরকারী ও বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দের পারস্পরিক সমালোচনার ভাষা যে নিুমানের লক্ষণ প্রকাশ করে তা গোটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। এ বিষয়ে সরকারী দলের দায়িত্বই বেশী। তাঁরা ক্ষমতায় থেকে যদি আদর্শ স্থাপনের চেষ্টা না করেন, তাহলে বিরোধীরা শিখবে কি করে ? যাঁরা ক্ষমতায় আছেন তাঁদের অধৈর্য হবার কোন প্রয়োজনই নেই। বিরোধীরা ক্ষমতায় যাবার জন্য যদি অধৈর্য হয় তাহলে কিছুটা এলাউন্স তাদেরকে দিলে তারা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সংশোধন হতে পারে।
বিরোধী দলের অবশ্যই ক্ষমতা পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু কিভাবে তারা ক্ষমতায় যেতে চান ? একটা নির্বাচন হয়ে গেল। তাঁরা নির্বাচনে অংশও নিলেন। আর একটি নির্বাচন পর্যন্ত ধৈর্যের সাথে তাঁদেরকে কাজ করে যেতে হবে। বর্তমান শাসন ব্যবস্থা গণতন্ত্রের দৃষ্টিতে নিঃসন্দেহে ক্রটিপূর্ণ। সরকার পরিচালকের হাতে এত ক্ষমতা থাকা অবস্থায় নির্বাচনে গণতান্ত্রিক নীতি চালু থাকতে পারে না। এসব সথধা যেমন সত্য তেমনি অগণতান্ত্রিক পন্থায় যে গণতন্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হতে পারে না সে কথাও সত্য। তাই যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী তাদের নিজেদের কার্যাবলী প্রতমে গণতন্ত্র সম্মত হতে হবে।
যারা বিরোধী দলে আছে তারাও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা গণতান্ত্রিক পন্থায় আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পেতে চাইলে তাদের কার্যক্রম এক ধরনের হবে। কিন্তু যদি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায় তাহলে সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ কর্মধারাই তারা অনুসরণ করবে। তাদের কর্মনীতি ও কর্মপন্থা থেকে নিজেদের প্রকৃত চেহারা সবার সামনে স্পষ্ট হতে বাধ্য।
গণতন্ত্রে বিশ্বাসী দলগুলোকে অত্যন্ত নিষ্ঠ ও ধৈর্যের সাথে জনগণকে তাদের কার্যাবলী দ্বারা এতটুকু রাজনৈতিক শিক্ষা দিতে হবে যাতে তারা তথাকথিত বিপ্লব ও গণতন্ত্রের পার্থক্য বুঝতে পারে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি যে সবার জন্যই নিরাপদ এ বিষয়ে রাজনৈতিক কর্মীদেরকে সজাগ করে তুলতে হবে।
বিপ্লবের অনিশ্চিত পথ ঃ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ত্যাগ করে যারা বিপ্লবের পথে গদিতে যেতে চান তাঁদের নিজেদের নিরাপত্তা কি নিশ্চিত ? তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিপ্লব যেখানেই এসেছে সেখানে গণতন্ত্র কোথাও দানা বাঁধতে পারেনি। বিপ্লবের পর বিপ্লব লাইন ধরে এসেছে। এটা কি নিরাপদ পথ ? শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতায় গেলে শক্তির উপর নির্ভর করেই শাসন চলে। এ ধরনের সরকার জনগণের সমস্যার কোন সমাধান করতে পারে না বলে যখন জনসমর্থন হারায় কথন সুযোগ বুঝে পাল্টা বিপ্লবীরা ক্ষমতা দখল করে তাই এ পথ একেবারেই অনিশ্চিত।
বিদেশী শক্তির সাহায্য নিয়ে যারা বিপ্লব করে তাদের অবস্থা আরও করুণ। আফগানিস্তানে নূর মুহাম্মদ তারাকী, হাফিজুল্লাহ আমীন ও কারমাল এ বিপ্লব দ্বারা কি পেলেন ? যারা কাবুল স্টাইলে স্বপ্ন দেখেন তারা এটাকে নিরাপদ পথ মনে করেন কোন যুক্তিতে ? তথাকথিত বিপ্লবের পথে দেশকে একবার ঠেলে দিলে ফিরিয়ে আনার উপায় থাকে না। এ বিপ্লব জনগণের পারস্পরিক আস্থা খতম করে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করে যার ফলে দেশ গৃহযুদ্ধের আগুনে ছারখার হতে থাকে।
তাই বিপ্লবের পথ ত্যাগ করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উপরই সবার আস্থা স্থাপন করা উচিত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেশে চালু করা প্রধান দায়িত্ব ক্ষমতাসীনদের। তারা যদি নিজেদের গদী ঠিক রাখার উদ্দেশ্যে তাদের রেশন করা মাপে গণতন্ত্র দেন তাহলে ময়দান বিপ্লবীদেরই পক্ষে যাবে। যদি আন্তরিকতার সাথে গণতন্ত্রকে বিকাশ লাভের সুযোগ দেন তাহলে গণতান্ত্রিক শক্তিই ময়দানে ক্রমে শক্তিশালী হয়ে বিপ্লবীদেরকে পরাজিত করতে সক্ষম হবে। ক্ষমতাসীনরা ১৯৪৭ সাল থেকে একই ধারায় গণতন্ত্রকে কোন ঠাসা করে বিপ্লবী মনোবৃত্তিকে সুযোগ করে দিয়েছে। এর কুফল ক্ষমতাসীনরাই বেশী ভোগ করেছে। কারণ ক্ষমতায় চিরদিন থাকা যায় না। গদী থেকে নামার পরও আবার উঠার সিঁড়িটা বহাল থাকে। একবার কোন প্রকারে কেউ ক্ষমতা পেলে অন্য কেউ যাতে সেখানে যাবার পথ না পায় সে উদ্দেশ্যে সিঁড়িটাই নষ্ট করে দেয়। ফরে নিরাপদে তারা নামার পথও পায় না। গদীতে উঠা-নামার পথটা পরিস্কার রাখাই গণতন্ত্রের পরিচায়ক।
পাক-ভারত-বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস আমাদেরকে সুস্পষ্ট শিক্ষা দেয়। কিন্তু মানুষ ইতিহাস থেকে কমই শিক্ষা গ্রহণ করে। গণতান্ত্রিক পথে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতা থেকে বেদায় হলেন। অনেকে মনে করেছিল যে, তিনি চিরবিদায় নিলেন। কিন্তু ঐ গণতান্ত্রিক পথেই আবার ফিরে আসার সুযোগ পেলেন। গণতন্ত্রের উপর আস্থা হারানো বুদ্ধির পরিচায়ক নয়। শেখ মুজিব ও ভুট্টো জনমসর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেও গণতন্ত্রের উপর আস্থা হারালেন। ফলে এমন পথে তাদেরকে যেতে হলো, যে পথে গিয়ে আর ফিরে আসবার উপায় থাকল না। ক্ষমতাসীনরা যদি এটা বুঝতে পারতো তাহলে ইতিহাসের অনেক করুণ ঘটনাই হয়তো ঘটতো না।
সরকারী ও বিরোধী সব দলকে অত্যন্ত স্থির মস্তিকে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার যে, দেশের জন্য, তাদের দলের জন্য, এমন কি নেতাদের জন্যও কোন পথটা মঙ্গলজনক ও নিরাপদ। নির্ভেজাল গণতন্ত্র দিলে সরকারী দলের গদীচ্যুত হবার আশংকা থাকলেও আবার জনসমর্থন নিযে গদী ফিরে পাওয়ার আশা থাকবে। বিরোধী দল এক নির্বাচনে ক্ষমতা না পেলেও আবার সে সুযোগ আসতে পারে। তাই গণতন্ত্রের এমন নিরাপদ পথই সবার কাম্য হওয়া উচিত।
গণতন্ত্র হলো যুক্তি, বুদ্ধি, যোগ্যতা ও খেদমতের প্রতিযোগিতা। আর বিপ্লব হলো বন্দুকের লড়াই। মনুষ্যত্বের উন্নয়নে বন্দুকের হাতে অসম্ভব। এ কথা ঠিক যে, পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের ক্রটি আছে। তবে প্রচলিত অন্যান্য শাসন ব্যবস্থা থেকে তা কম মন্দ। গণতন্ত্রকে প্রকৃতরূপে কল্যাণকর ব্যবস্থা রূপে দেখতে চাইরে ইসলামের কতক মৌলিক শিক্ষাকে গ্রহণ করতে হবে। আজ সবচেয়ে বড় কাজ হলে আমাদের যুব শক্তিকে তথাকথিত বিপ্লবের রোমান্টিক শ্লোগানের মোহ থেকে ফিরিয়ে রাখা। এ জন্যই ইসলামী বিপ্লবের শ্লোগান উঠছে। বিপ্লবই যদি চাও তাহলে আস ইসলামের ছায়াতলে। আল্লাহর রাসূল মক্কা বিজয় করলেন বিনা রক্তপাতে। গোটা আরবে তিনি মনুষ্যত্বের মহাবিপ্লব আনলেন গায়ের জোরে নয়, চরিত্রের বলে। এরই নাম গণতন্ত্র।
ইরানের বিপ্লব ঃ এ প্রসংগে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ইরানে ইসলামের নামে যে বিপ্লব হলো তা গণতন্ত্রিক মাপকাঠিতে কতটা সমর্থনযোগ্য। ইরানে ডঃ মুসাদ্দেকের স্বল্পকালীন শাসনের সময় দেশকে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে দেবার প্রচেষ্ট চলে। আমেরিকার সাহাযে শাহ পুনরায় ক্ষমতা পেয়ে দীর্ঘকাল ইসলামী আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টাকে যেরূপ নৃশংসভাবে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা করেছে, তার প্রতিক্রিয়ায় গোটা ইরানবাসী বিদ্রোহী হয়ে উঠে। জনাব খোমেনী রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেননি। শাহর রক্তপাতের মাধ্যমে বিদ্রোহ দমন ব্যর্থ হবার ফলে খোমেনীর দীর্ঘ আন্দোলন বিজয় লাভ করে।
ইরানের দীর্ঘ ইতিহাসে গণতন্ত্র না থাকা সত্ত্বেও চরম গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে জনাব খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু করারই চেষ্টা চলছে। শাপুর বখতিয়ার যদি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা খোমেনীর হাতে তুলে দিত তাহলে পরিস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য আরও উপযোগী হতো। আয়াতুল্লাহ খোমেনীর দীর্ঘ সাধনা ও আন্দোলনের আভ্যন্তরীণ শক্তির ফলেই বামপন্থীদের ব্যাপক অস্ত্র লুট সত্ত্বেও ইসলামী শক্তি শেষ পর্যন্ত ময়দান দখল রাখতে সক্ষম হলো। সুতরাং ইরানে ১৯৭৯ এর বিপ্লব হঠাৎ কতক লোকের সশস্ত্র ক্ষমতা দখল জাতীয় কোন ব্যাপার নয়। বরং ব্যাপক জনসমর্থনের মাধ্যমেই ইরানী বিপ্লব সফল হয়েছে।
(বাংলাদেশের রাজনীতি)
সামরিক বিপ্লব
বিপ্লবের নামে শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা দখলের যত ধরন হতে পারে তার মধ্যে রাজনৈতিক দৃষ্টিতে সামরিক বিপ্লব হলো সবচেয়ে বেশী জঘন্য। অন্যান্য ধরনের বিপ্লবে জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন হয় এবং তাদের একাংশের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া ক্ষমতা দখল করা সম্ভব হয় না। কিন্তু সামরিক বিপ্লবে জনগণকে জড়িত করার কোন দরকার হয় না। এমনকি জনসমর্থন ছাড়াই অস্ত্রবলে সামরিক শাসন চালু করা যায়।
সশসত্র বাহিনীর অফিসার ও জওয়ানগণ দেশ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারী কর্মচারী হিসেইে গণ্য। তাদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন এলাকায় ব্যারাকে রেখে পেশাগত যোগ্যতা বৃদ্ধির সুযোগ দেয়া হয়। দেশের স্বাধীনতার হেফাযতের জন্য তারা জীবন দিতেও প্রস্তুত বলে বাজেটের সবচেয়ে বড় অংশ তাদেরকে জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় উপকরণ বেশী পরিমাণে দেয়া হয় যাতে তারা নিশ্চিন্তে দেশরক্ষার মহান ব্রতে আত্মনিয়োগ করতে পারেন।
আইনগতভাবে যাদের হাতে বেসামরিক সরকারের দায়িত্ব অর্পিত হয় তারাই সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ন্ত্রিত করেন। এটা দুনিয়ার সব দেশে সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত বৈধ নীতি। দেশের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী গঠিত বেসামরিক সরকারের নির্দেশ পালন করাই সশস্ত্র বাহিনীর আইনগত কর্তব্য। এমন কি কোন দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার বৈধ দায়িত্বও বেসামরিক সরকারের হাতেই ন্যস্ত থাকে। সামরিক, বিমান ও নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠিত সরকারের অধীনস্থ কর্মচারী মাত্র। বেসামরিক কর্মচারীগণ যেমন সরকারের আনুগত্য করতে বাধ্য তেমনি সশস্ত্র বাহিনীর কর্তব্যও তাই।
সামরিক সরকার সরকার অবৈধ ঃ প্রত্যেক দেশেই সরকার গঠন ও সরকার পরিবর্তনের নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে। কোন দেশেই সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতা তুলে দেবার কোন আইনগত বিধান থাকে না। অথচ বিভিন্ন দেশে সশস্ত্র বাহিনীকে সরকারী ক্ষমতা দখল করতে দেখা যায়। এ জাতীয় ক্ষমতা দখল কোথাও বৈধ বলে স্বীকৃত নয়। সরকারী কর্মচারী হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর এভাবে ক্ষমতা দখল কোন অধকারই নেই। “জোর যার মুলুক তার” যদি বৈধ নীতি বলে আইনে গণ্য হতো তাহলেও সামরিক বিপ্লবকে কোন রকমে জায়েজ বলা যেতো। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে সামরিক আইন বৈধ কোন বিধানই নয়। সুতরাং সামরিক বিপ্লব নিঃসন্দেহে চরম দুর্নীতি ও জাতীয় পার্যায়ের ডাকাতি।
বেসামরিক সরকারী কর্মচারীরা শক্তিবলে কোন সরকারকে বেদখল করে সরকারী ক্ষমতা জবরদখল করতে পারে না। কারণ তাদের হাতে অস্ত্র নেই এব্ং তারা প্রথকভাবে সুসংগঠিত কোন শক্তিও নয়। সশস্ত্র বাহিনী জনগণ থেকে আলাদাভাবে সুসংগঠিত ও সুশৃংখল শক্তি হিসেবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে আধুনিক উন্নত মানের অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত। তারা উর্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ অন্ধভাবে পালনে অভ্যস্ত। তাই যখন এসব বাহিনীর দায়িত্বশীলগণ তাদের অধীনস্থ সবাই বিশ্বস্ততার সাথে তা পালন করেন। সশস্ত্র বাহিনীর এ ঐতিহ্যকে ব্যবহার করেই উচ্চাভিলাসী অফিসাররা সামরিক আইন জারি করার সুযোগ গ্রহণ করেন।
কিন্তু যে অস্ত্র বলে তারা বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন তা জনগণের টাকায় যোগাড় করা হয় এবং তা একমাত্র বেসামরিক সরকারের মরজী মতোই ব্যবহার করা কর্তব্য। এ অস্ত্র দ্বারা সরকারী ক্ষমতা দখল করা শুধু অবৈধই নয় চরম বিশ্বাসঘাতকতা। বৈদেশিক আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করে জনগণকে পরাধীনতার অফিশাপ থেকে হেফাযত করার উদ্দেশ্যেই তাদের হাতে এ অস্ত্র তুলে দেয়া হয়। অথচ সে অস্ত্র দিয়েই জনগণকে গোলাম বানানো হয়-এর চেয়ে বড় বেঈমানী আর কী হতে পারে ? জনগণের কর্মচারী (চঁনষরপ ঝবৎাধহঃ) হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিপরীত আচরণই হলো সশস্ত্র বিপ্লব। অস্ত্রবলে জনগণকে গোলাম বানিয়ে দেশ শাসনের অপর নামই হলো সামরিক আইন প্রশাসন।
সামরিক শাসনের অভিশাপ ঃ যে দেশে একবার সামরিক অভিশাপ নেমে আসে সে দেশে গণতন্ত্র ্ও আইনের শাসন চালু করা অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। বিদেশে শক্তির অধীনতা থেকে মুক্তি প্ওায়ার চেয়ে দেশী সামরিক শাসন থেকে উদ্ধার প্ওায়া কম কঠিন নয়।
সামরিক শাসকরা গণতন্ত্রের দোহাই কম দেন না। তারা সত্যিকার গণতন্ত্র কায়েমের মহান উদ্দেশ্যেই নাকি সামরিক আইন জারি করে থাকেন। সামরিক শাসন যে অবৈধ সে কথা অন্তরে তারা উপলদ্ধি করেন বলেই গণতন্ত্রের জপমালা হাতে নিতে তারা বাধ্য হন। কিন্তু গণতন্ত্রের নামে তারা এমন ধরনের বেসামরিক সরকার গঠন করেন যা সামরিক সরকারেরই বেসামরিক চেহারা মাত্র। তাদের হাতেই মূল ক্ষমতা থাকে- শুধু সামরিক উর্দি গায়ে থাকে না।
১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন চালু করার পর বর্তমান পাকিস্তান ও বাংলাদেশে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলন সত্ত্বেও জনগণের নির্বাচিত সরকার গঠন করা সম্ভব হয়নি। এ থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, সামরিক শাসনের কুপ্রথা একবার চালু হলে তা থেকে নিস্তার পাওয়া স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৮২ সালের সামরিক শাসন ঃ প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যার পর ১৯৮১ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে জনগণ বিপুল উৎসাহে অংশগ্রহণ করে। এ নির্বাচনে কারচুপির তেমন অভিযোগ শুনা যায়নি। বিপুল ভোটাধিক্যে বিচারপতি আবদুস সত্তার নির্বাচিত হন। চার মাস পর সেনাপতি এরশাদ কোন যুক্তিতে সামরিক শাসন চাপিয়ে দিলেন তা জনগণের নিকট অস্পষ্ট। বৃদ্ধ বিচারপতি যে বাধ্য হয়েই বন্দুকের নিকট আত্মসমর্পণ করেছেন সে কথা বুঝতে কারো অসুবিধা হয়নি।
সামরিক শাসনের অভিজ্ঞতা ১৯৫৮ সাল থেকেই দেশবাসীর যথেষ্ট হয়েছে। কোন সামরিক শাসনই সঠিকভাবে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনষ্ঠান করতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু জেনারেল এরশাদ যে যোগ্যতার সাথে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন এর কোন তুলনা নেই।
এ সামরিক শাসন রাজনীতিকে যে পরিমাণ কলুষিত করেছে, জনগণকে যেভাবে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, গদী রক্ষার প্রয়োজনে সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে যে পরিমাণ বাড়ার সুযোগ দিয়েছে এবং সুবিধাবাদী, নীতিহীন দলছুট ব্যক্তিদের দ্বারা যে ধরনে দুর্নীতিপরায়ন শাসন ব্যবস্থা চালু করেছে এর কুফল থেকে এদেশ কতদিনে উদ্ধার পাবে তা আল্লাহই জানেন।
(বাংলাদেশের রাজনীতি)
সশস্ত্র বাহিনী ও রাজনীতি
সশস্ত্র বাহিনীর সঠিক মর্যাদা বহাল রাখার প্রধান দায়িত্ব তাদেরই। সামরিক শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চয়ই তারা উপলদ্ধি করছেন যে যারা তাদেরকে নিয়ে রাজনীতি করেন তারা কোন কল্যাণ করেননি। সশস্ত্র বাহিনী রাজনীতিতে জড়িত থাকলে তারা কিছুতেই জনগণের আস্থাভাজন থাকতে পারবেন না। রাজনীতির ময়দানে দলাদলী ও মতভেদ থাকাই স্বাভাবিক। সশস্ত্র বাহিনী কোন এক দলের পক্ষে কাজ করলে অন্যসব দল কেমন করে তাদের প্রতি আস্থা রাখবে? সকল দলই যাতে সমভাবে সশস্ত্র বাহিনীকে আপন মনে করে সে পরিবেশ অবশ্যই বহাল রাখতে হবে।
জনগণের পক্ষ থেকে এ আস্থা বহাল করার যত আগ্রহই থাকুক সশস্ত্র বাহিনীর আচরণ এর প্রমাণ না দিলে এ আশা অন্য কোন পন্থায় পূরণ হতে পারে না। সশস্ত্র বাহিনীর দায়িত্বশীলগণ এ বিষয়ে সচেতন থাকলে পূর্বের ক্ষতি পূরণ হয়ে যাবে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস; জনগণকে একথা বুঝানো সম্ভব যে সরকারের নির্দেশেই সশস্ত্র বাহিনী কাজ করে থাকে। তাই সরকার যদি অন্যায় নির্দেশ না দেয় তাহলে তারা নিজেদের পক্ষ থেকে জনগণের অধিকার হরণ করার মতো কোন অন্যায় কাজ কখনো করে না। সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে জড়িত করার ভ্রান্ত মতবাদ দেশের জন্য যে কত মারাত্মক সে কথা সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যেককে অন্তর দিয়ে উপলদ্ধি করতে হবে।
ক্ষমতা দখলের পূর্বে জেনারেল এরশাদ দেশী ও বিদেশী সাংবাদিকদের সম্মেলন ডেকে ঐ ভ্রান্ত মতবাদ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, এদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মতো একটি সুশৃংখল শক্তিকে দেশ শাসনে যোগ্য ভূমিকা পালনের সুযোগ দিতে হবে।
এ দাবীর ধুয়া তুলে হয়তো তিনি তার ক্ষমতা দখলের পক্ষে সশস্ত্র বাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। কিন্তু এ চিন্তাধারা চালু থাকলে সশস্ত্র বাহিনী জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি রাজনৈতিক স্বার্থের বিশেষ শ্রেণীতে পরিণত হতে বাধ্য। তাদের প্রতি জনগণের আস্থা সৃষ্টি করতে হলে এ কুচিন্তা ‘থেকে সংশ্লিষ্ট সবার মন মগজকে সম্পূর্ণ পবিত্র রাখতে হবে। এ অন্যায় দাবীর পক্ষে সামান্য যুক্তিও তালাশ করে পাওয়া যায় না। দেশ শাসন ও পরিচালনায় সশস্ত্র বাহিনীকে কেন বিশেষ ক্ষমতা দিতে হবে? দেশের যারা মেধা ও প্রতিভার অধিকারী তারা সবাই কি সশস্ত্র বাহিনীতেই যোগদান করে? প্রথম বিভাগে পাশ করাও সেখানে ভর্তি হবার জন্য কোন শর্ত নয়। অথচ প্রথম বিভাগে পাশ না হলে মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন সুযোগই পাওয়া যায় না।
আজ পর্যন্ত দেশেরই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ, ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারগণ, কবি সাহিত্যিক ও সাংবাদিকগন, ব্যারিষ্টার ও ুকিলগন, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীগণ শ্রেণীগতভাবে এ উদ্ভট দাবী পেশ করেননি যে, তাদেরকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অংশীদার করতে হবে। অথচ মেধা ও প্রতিভার বিচারে তাদের মান কি সশস্ত্র বাহিনীর অফিসারদের থেকে নিু?
সুতরাং একথা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, অস্ত্র বলই ক্ষমতার দাবীর পেছনে আসল কারণ। কিন্তু এ অস্ত্র কি তাদের নিজস্ব? জনগণের রক্ত পানি করা শ্রমের প্রধান অংশই কি তাদেরকে সুসংগঠিত ও সশস্ত্র হবার যোগ্য বানায় নি? কী উদ্দেশ্যে এ গরীব দেশের বিরাট বাজেট তাদের জন্য বরাদ্ধ করা হচ্ছে ? দেশরক্ষার মহান দায়িত্ব পালনের জন্যই জাতি এতবড় ত্যাগ করছে। এ কুরবানী করতে হচ্ছে বলে জনগণ মোটেই অসন্তুষ্ট নয়। বরং হাসিমুখে আরও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত। কারণ সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের দেশের আযাদী রক্ষার জন্য জীবন দিতে হবে। যারা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে তাদের জন্য জাতি সম্পদ উৎসর্গ করতে দ্বিধা করবে কেন?
সশন্ত্র বাহিনীর সবার বিবেক ও সদিচ্ছার নিকট আকুল আবেদন জানাই যে, ক্ষমতায় অংশীদারিত্বের যে ভ্রান্ত মতবাদ তাদেরকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার আশংকা রযেছে সে কুচিন্তা ত্যাগ করে জনগণের প্রাণপ্রিয় হতে হবে।
রাজনীতি ও অস্ত্র ঃ এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, দেশের রাজনীতিকে অস্ত্রমুক্ত করতে হবে। পেশী ও অস্ত্রকেই যদি রাজনৈতিক ময়দান ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে দেশের আযাদী অবশ্যই খোয়াতে হবে। বিদেশের বলিষ্ঠতর পেশী ও শক্তিশালী অস্ত্র দেশী সশস্ত্র রাজনীতি সহজেই দখল করে নেবে।
রাজনীতিকে অস্ত্রমুক্ত করাতে হলে সশস্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই রাজনীতি মুক্ত করতে হবে। একথা যতি সশস্ত্র বাহিনী অন্তর দিয়ে উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হয় তাহলে দেশকে-গৃহযুদ্ধ থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। কারণ ১৯৮৬ সালে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন করা হয়েছে এর তিক্ত অভিজ্ঞতা
জনগণকে তাদের ভোটাধিকার হেফাযত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করবে। যেমন পুলিশ ডাকাত দমনে অবহেলা করলে জনগণ আইন তাদের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয় এবং নিজেরাই ডাকাতকে গ্রেফতার করে শাস্তি দেয়।
এরশাদ সাহেব দেশে যে রাজনীতি চালু করেছেন অবিলম্ েএর অবসান প্রয়োজন। তা না হলে এ রাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়েই অস্ত্রের চর্চা সীমাবদ্ধ রাখবে না।
অস্ত্রের রাজনীতি বন্ধ না হলে আইন শৃংখলায় আরও অবনতি অবশ্যই হবে। যে লোকদের হাতে ব্যালট ডাকাতির জন্য অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছে তাদেরকে দমন করার ক্ষমতা পুলিশ কোথায় পাবে? এরশাদ সাহেবের রাজনীতি চালু করার জন্য যে ছাত্র ও যুবকদেরকে অস্ত্র দেয়া হয়েছে তারা তো আইনশৃংখলা ভংগ করার সরকারী লাইসেন্সই পেয়ে গেছে।
এ দুরবস্থা থেকে নিস্তার পেতে হলে সর্বপ্রথম সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনীতির ময়দান থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আমার বক্তব্য দেশ দরদী সকল মহলের প্রাণের কথা। এমন কি সশস্ত্র বাহিনীর ভায়েরাও এসব কথা যুক্তি বিবেক-সম্মত বলে মনে করবেন।
সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণ
বাংলাদেশ আকারে ক্ষুদ্র একটি দেশ হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিরাট দেশ হিসেবেই গণ্য হবার যোগ্র। দশকোটি মানুষের একটি দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশ মোটেই নগণ্য নয়। এ দেশের মানুষ ১৯৪৭ সালে ইংরেজ থেকে আযাদ হয়ে পাকিস্তানে যেটুকু অধিকার ভোগ করছিল তাতে তারা সন্তুুষ্ট ছিল না বলেই পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগের আশায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে একটি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। স্বাধীনতার এ চেতনাবোধই দেশের আসল পুঁজি। এ পুঁজিই দেশের আসল রক্ষাকবচ।
একটি বিরাট দেশ বাংলাদেশকে প্রায় চারদিক দিয়ে ঘেরাও করে আছে। ঐ দেশের জনগণের সাথে সবসময়ই এদেশের পক্ষ থেকে সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা সত্ত্বেও ঐ দেশের কোন সরকারের আচরণেই বাংলাদেশের জনগণ বিক্ষুব্ধ না হয়ে পারেনি।
বাংলাদেশের মতো আর কোন দেশ ভৌগোলিক দিক দিয়ে এমন বেকায়দায় নেই। এদেশের চার পাশে যদি কয়েকটি দেশ থাকতো তাহলে দেশ রক্ষা সমস্যা এত কঠিন হতো না। চারপাশে একটি মাত্র দেশ থাকায় এবং সে দেশটি বিরাট হওয়ায় বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা অবশ্য দুঃসাধ্য। প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর সাথে ঐ দেশের আচরণের গত ৪০ বছরের ইতিহাস বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে নিরাপত্তা বোধ সৃষ্টি করতে পারে না। তাই দেশ রক্ষার সুষ্ঠ ব্যবস্থার গুরুত্ববোধ জনগণের মনে অত্যন্ত প্রবল।
বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ঃ প্রত্যেক স্বাধীন দেশেই দেশরক্ষার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান প্রতিরক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থারই দাবী রাখে। কোন কোন মহল এদেশের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে এমন অদ্ভুত ধারণা পোষণ করে যা দেশরক্ষার জন্য অত্যন্ত মারাত্মক। তারা বলে যে, “একমাত্র ভারতই এদেশ আক্রমণ করতে পারে। ভারতের বিরাট সশস্ত্র বাহিনীকে প্রতিহত করার মত শক্তিশালী দেশরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা বাংলাদেশের সাধ্যের বাইরে। তাই এ গরীব দেশে এত বড় বাহিনী পোষার প্রয়োজনই নেই। আধুনিক বিশ্বের এক দেশের পক্ষে প্রতিবেশী কোন রাষ্ট্র দখল করে রাখা সম্ভব নয়। বিশ্ব জনমত এ জাতীয় অন্যায় দখল মেনে নেবে না। জাতিসংঘ ও দেশের জনগণই দেশ রক্ষার জন্য যথেষ্ট।
প্যালেষ্টাইন, লেবানন, আফগানিস্তান ও বিশ্বের আরও অনেক উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও যারা এমন উদ্ভট ধারণা পোষণ করেন তাদেরকে ভারতীয় লবীর অন্তর্ভুক্ত মনের করা ছাড়া কোন উপায় নেই। এ লবীর প্রভাবেই হয়তো মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি এতটা গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন মনে করেননি। সম্ভবত ভারতের পক্ষ থেকে আক্রমণের তেমন কোন আশংকা তিনি করেননি। তাই দেশ রক্ষার প্রয়োজনের চেয়ে হয়তো তাঁর সরকারের প্রতিরক্ষার জন্যই রক্ষীবাহিনী গড়ে তোলা তিনি বেশী দরকার মনে করেছিলেন।
সশস্ত্র বাহিনী এ পলিসি কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। প্রধানত এরই মারাত্মক প্রতিক্রিয়ায় শেখ সাহেবকে জীবন দিতে হলো। রাষ্ট্র প্রধানকে এমন নির্মমভাবে স্বপরিবারে হত্যা করার মত করুণ ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও দেশের আপামর জনসাধারণের ঐ সময়কার আচরণ একথাই প্রমাণ করে যে, জনগণ শেখ সাহেবের নীতি সমর্থন করতে পারেনি।
যদিও দেশরক্ষার জন্য সশস্ত্র বাহিনীই যথেষ্ট নয় এবং স্বাধীনচেতা জনগণের আবেগপূর্ণ সক্রিয় সহযোগিতা ছাড়া প্রতিরক্ষা কিছুতেই সম্ভব নয়, তবুও সুসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনী ছাড়া দেশরক্ষার চিন্তাও করা যায় না। জনগণের মনোবলের প্রধান ভিত্তিই সুশিক্ষিত ও সুশৃংখল দেশরক্ষা বাহিনী। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের এলাকায় জনগণের মহব্বত, আবেগ ও সহযোগিতা সশস্ত্র বাহিনীকে দেশ রক্ষার জন্য অকাতরে প্রাণ দিতে যেভাবে উদ্ধুদ্ধ করেছে তা আমি নিজের চোখে না দেখলে এ বিষয়ে এতটা দৃঢ় অভিমত পোষণ করতে পারতাম কি না সন্দেহ। বাংলাদেশকে বিদেশী হামলা থেকে রক্ষা করার জন্য দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে সেনা, নৌ ও বিমাট বাহিনীকে অবশ্যই অত্যন্ত শক্তিশালী ও সুসজ্জিত করতে হবে। এরই পাশাপাশি জনগণকে বিশেষ করে যুবকদেরকে এতটিা সামরিক ট্রেনিং দিতে হবে যাতে দেশবাসী যোগ্যতার সাথে সশস্ত্র বাহিনীর সহায়কের দায়িত্ব পালন করতে পারে।
সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ঃ সশস্ত্র বাহিনীর উপর দেশ রক্ষার যে মহান দায়িত্ব রয়েছে তা সঠিকভাবে পালন করতে হলে তাদের প্রতি জনগণের পূর্ণ আস্থা থাকা প্রয়োজন। সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা যদি অনুভব করে যে, জনগণ তাদেরকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, তবেই তারা দেশের জন্য অকাতরে জীবন বিসর্জন দেবার প্রেরণা পাবে। জনগণ জানে যে, তাদের স্বাধীনতার হেফাজত করার পবিত্র দায়িত্ব সশস্ত্র বাহিনীর উপর রয়েছে। এ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের ব্যবস্থা না হলে বিদেশের গোলামে পরিণত হতে হবে। তাই সশস্ত্র বাহিনীকে যোগ্যতার সাথে এ দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিতেই হবে। জনগণের মধ্যে এ অনুভূতি থাকলে সশস্ত্র বাহিনীর প্রয়োজন পূরণ করার জন্য দেশের সবাই সব রকম ত্যাগ ও কুরবানী দিতে প্রস্তুত থাকবে।
সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি এ জাতীয় আস্থা ও ভালবাসা যাতে জনগণের মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে সেদিকে বিশেষ ও সতর্ক দৃষ্টি রাখার দায়িত্বও ঐ বাহিনীর দায়িত্বশীলদেরই। কারণ জনগণের আস্থা অর্জন করা ছাড়া তাদের পেশাগত সাফল্য কিছুতে সম্ভব নয়। এ আস্থা আপনা আপনিই সৃষ্টি হয় না। সশস্ত্র বাহিনীর কার্যকলাপ ও আচরণ যে রকম হয় জনগণের মনে তাদের সম্পর্কে ধারণাও সে রকমই সৃষ্টি হয়।
সাধারণত সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরা তাদের জন্য নির্দিষ্ট ব্যারাক এলাকায়ই থাকে। জনসাধারণের সাথে তাদের ঘনিষ্ট কোন যোগাযোগের সুযোগ হয় না। বেসামরিক ক্রিয়াকান্ডে তাদেরকে ব্যবহার করা হয় না। দেশ শাসনের কোন দায়িত্বও তাদের উপর থাকে না। তারা সেনানিবাস এলাকায় দেশের প্রতিরক্ষামূলক দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে পেশাগত ট্রেনিং নিয়েই নিয়মিত ব্যস্ত থাকেন। এটাই দুনিয়ার সব দেশে সাধারণ নিয়ম হিসেবে স্বীকৃত।
এ কারণেই তাদের বিরুদ্ধে জনগণের মনে কোন অভিযোগ সৃষ্টি হবার কারণ ঘটে না। বরং মাঝে মাঝে জাতীয় কোন দুর্যোগে যখন বেসামরিক সরকারের নির্দেশে সশস্ত্র বাহিনীর লোকদেরকে জনগণের খেদমতের জন্য সাময়িকভাবে নিয়োগ করা হয় তখন তাদের নিঃস্বার্থ সেবায় সর্ব সাধারণ মুগ্ধ হয় এবং তাদের প্রতি ভালবাসা আরও বেড়ে যায়।
এভাবেই সশস্ত্র বাহিনী জনগণের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে পারষ্পরিক আস্থা গড়ে উঠে। যেসব দেশে সামরিক শাসন চালু নেই সেখানে এ আস্থা বিনষ্ট হবার কোন কারণ ঘটে না। নির্বাচিত জন প্রতিনিধিরা দেশ শাসন ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করলে সশস্ত্র বাহিনীর সাথে জনগণের স্বার্থের কোন সংঘাতই সৃষ্টি হতে পারে না।
সামরিক শাসনের প্রধান কুফল ঃ আজ পর্যন্ত দুনিয়ার কোন দেশেই সামরিক শাসনের কোন সুফল দেখা যায়নি। একবার কোন দেশে সামরিক শাসন চালু হলে এ থেকে আর সহজে নিস্তার পাওয়া যায় না। বহু দেশেই এখনও সামরিক শাসন চালু আছে। প্রতিটি দেশেই দেখা যায় যে, যেসব সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে সামরিক শাসন জারী করা হয় সে সব সমস্যা তো সেখানে আরও বেড়েই চলে, তদুপরি অনেক নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়।
এখানে সামরিক শাসনের যাবতীয় কুফল ও ঐ সব কুফল দেখা দেবার কারণ আলোচনা করার অবকাশ নেই। সবচেয়ে বড় কুফলটি আলোচনা করাই আমার উদ্দেশ্য। সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণের মধ্যে পারষ্পরিক আস্থা ও ভালবাসার সম্পর্কের যে গুরুত্ব ইতিপূর্বে তুলে ধরেছি সামরিক শাসনে সেটাই বিনষ্ট হয়ে থাকে।
১৯৮২ সালে জনগণের নির্বাচিত একটি সরকারই এ দেশ শাসন করছিল। ভাল হোক মন্দ হোক জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী ও এম, পিদের দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছিল। জনগণ তাদের কাছে পৌছতে পারত, তাদেরকেও জনগণের কাছে যেতে হতো। হঠাৎ করে ২৪শে মার্চ সকালে জনগণ জানতে পারল যে, সামরিক আইন জারী হয়েছে। তারা দেখল তাদের নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে সামরিক লোকেরা তাদের শাসক সেজে বসেছে। নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে সামরিক লোকেরা তাদের শাসক সেজে বসেছে। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রী ও এম, পি এবং তাদের সাথে সম্পর্কিত অগণিত লোকেরা ভালবাসা থেকে সশস্ত্র বাহিনী বঞ্চিত হলো। দেশ শাসন ও পরিচালনা ব্যবস্থার সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্কহীন সামরিক অফিসারগণ সকল গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদে বেসামরিক অভিজ্ঞ অফিসারদের কর্তা হয়ে বসল। এতে বেসামরিক সকল সরকারী কর্মচারীর মনে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি মহব্বত
বৃদ্ধির কাম্য পরিবেশ আশা করা যায় না। এভাবেই সামরিক শাসন মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে উপর থেকে অস্ত্রবলে চাপিয়ে দেবার ফলে সশস্ত্র বাহিনীর ক্রমেই জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। যতই দিন যায় ততই সামরিক লোকদেরকে বেসামরিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জনগণের নিকট অপ্রিয় হতে হয়। কারণ শাসনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শাসিতদের নিকট জনপ্রিয় থাকা খুবই কঠিন ব্যাপার। এভাবেই সামরিক শাসনের পরিণামে সশস্ত্র বাহিনী ও জনগণের মধ্যে যে পারস্পারিক ভালবাসা থাকা স্বাভাবিক তা বিনষ্ট হতে থাকে। আর দেশ রক্ষার জন্য এ অবস্থাটা অত্যন্ত মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
গণতন্ত্রের নামে সামরিক শাসকদের কর্তৃত্ব ঃ যদি কোন দেশে বিশেষ পরিস্থিতিতে সামরিক শাসন সাময়িকভাবে কায়েম করার পর গণতন্ত্রের নামে স্থায়ীভাবে সামরিক শাসকদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না চলে তাহলে সশস্ত্র বাহিনীর জনপ্রিয়তা বিনষ্ট হয় না। যেমন কিছুদিন পূর্বে সুদানে জেনারেল সুয়ারুয্যাহাব জেনারেল নুমেরীকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে সামরিক আইন জারি করার এক বছরের মধ্যেই নিরপেক্ষভাবে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছেন। নির্বাচনে তিনি কোন দলের পক্ষ অবলম্বন না করায় জনগণ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করতে পেরেছে। ফলে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি জেনারেল আবদুর রহমান সুয়ারায্যাহার গণতন্ত্রের নামাবলী গায়ে দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার উদ্দেশ্যে প্রহসনমূলক নির্বাচনের অনুষ্ঠান করতেন তাহলে সুদানে অশান্তি আরও বেড়ে যেতো এবং সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে জনগণের মনে বিক্ষোভ সৃষ্টি হতো।
জেনারেল এরশাদ যদি তেমনিভাবে দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে তাদের মর্জি মতো সরকার গঠনের সুযোগ দিতেন তাহলে সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা আরও বেড়ে যেতো। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, এরশাদ সাহেব সম্পূর্ণ বিপরীত নীতিই অবলম্বন করেছেন।
১৯৮২ সালের মার্চ মাসে নিতান্ত অযৌক্তিকভাবে তিনি সামরিক শাসন দেশের উপর চাপিয়ে দিলেন। দেশে এমন কোন পরিস্থিতিই ছিল না যাতে তখন সামরিক আইন জারি করার সামান্য কোন অজুহাতও দেখানো চলে। প্রেসিডেন্ট আবদুস সত্তার সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেই তিনি ক্ষমতা দখল করেছিলেন। অথচ ক্ষমতা দখল করাটাই ছিল চরম দুর্নীতির পরিচায়ক এ জন্যই গত চার বছরের শাসনে দুর্নীতি যে কত বেড়েছে তা কারোরই অজানা নয়।
গণতন্ত্র হত্যা করে ক্ষমতা দখলের পর জনগণের সরকার কায়েমের দোহাই দিয়ে তিনি চরম অগণতান্ত্রিক ও সন্ত্রাসী পন্থায় পার্লামেন্ট নির্বাচন করে তার দলকে ক্ষমতাসীন করলেন। নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোন সম্ভাবনা না থাকায় উল্লেখযোগ্য সকল রাজনৈতিক দল ও নেতাই ১৯৮৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বর্জন করে। ফলে এক প্রহসন মূলক নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোসিত হন। এ দ্বারা তিনি সশস্ত্র বাহিনীর জন্য কোন সুনাম বয়ে আনেননি। তবে সামরিক আইন উঠে যাওয়ার সশস্ত্র বাহিনীর সাথে জনগণের সম্পর্ক পুনর্বহালের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। (বাংলাদেশের রাজনীতি)
গণতন্ত্রের দুর্গতি কেন ?
দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের পর ১৯৪৭ সালে এদেশে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটে। আশা করা গিয়েছিল যে, ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ১৯৪৭-এর আগষ্ট মাসে দেশ শাসনের দায়িত্ব পেলেন তারা জনগণের আশা-আকাঙ্খা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই চালু রাখবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েও শাসকগণ গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র করতে থাকলেন। ফলে ক্রমেই তারা জনপ্রিয়তা হারাতে লাগলেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা আমলাদেরকে এমনভাবে ব্যবহার করতে থাকলেন যে, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা বুঝতে পারলেন শাসকদল জনগণের সমর্থনের চেয়ে তাদের সাহায্যেই গদীতে বহাল থাকতে চান। তখন তারা নিজেরাই ক্ষমতা দখল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
এমনি এক পরিস্থিতিতে তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার সাথে যোগসাজশে সেনাপতি আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারী করে গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে দেন। জনগণ নিজেদেরই বেতনভুক্ত কর্মচারীদের হাতে বন্দী হয়ে ইংরেজ আমলের চেয়েও কঠোর রাজনৈতিক গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
১৯৬০ সাল থেকে নতুন করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। ইংরেজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের চেয়েও গণতান্ত্রিক আন্দোলন কঠিনতর সংগ্রামে পরিণত হলো। দীর্ঘ ৯ বছর আন্দোলনের পর ১৯৬৯ সালে যে গোলটেবিল বৈঠক হয় তা যদি সফল হতো তাহলে গণতন্ত্র হয়তো বহাল হতো। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যে দলটি নিরংকুশ বিজয় লাভ করলো তাদের হাতে ১৯৭২ সালে ক্ষমতা আসার পরও গণতন্ত্র কেন টিকে থাকলো না সে প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলে বড় হয়েই দেখা দেবার কথা।
দু’টো বিষয়ের বিশ্লেষণ ঃ আজও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতন্ত্রের পক্ষে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। আমাদেরকে ধীর মস্তিস্কে চিন্তা করতে হবে যে, দু-দু’বার স্বাধীনতা অর্জন করেও গণতন্ত্রের পথে আমরা সামান্য অগ্রগতিও কেন লাভ করতে পারলাম না। এ প্রসঙ্গে দু’টো বিষয় সম্পর্কে আমাদেরকে সুচিন্তিতভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। প্রথমত আমরা বিশ্লেষণ করে দেখব যে, স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ কেন হলো না। দ্বিতীয়ত আমরা হিসেবে নিয়ে দেখব যে, গণতন্ত্রের পথে আমাদের দেশে কী কী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। রোগের কারণ না জানলে সঠিক চিকিৎসা হতেই পারে না। আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলন করে যদি কোন প্রকারে একটি নির্বাচিত সরকার কায়েম করতে সক্ষমও হই, তবু আমরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বহাল রাখতে পারব না যদি ঐসব দোষ-ক্রটি ও প্রতিবন্ধকতা রাজনৈতিক নেরতা ও দলগুলোর মধ্যে থেকে যায়। গণতন্ত্রের পরিপন্থী বিষয়গুলো যদি আমাদের থেকে দূর করা না যায় তাহলে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে আমার নতুন করে গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করতে হবে। তাই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়েই উপরোক্ত দু’টো বিষয়ে আলোচনা করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।
আমি আশা করি সকল রাজনৈতিক মহলই নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে আমার বিশ্লেষণকে বিচার করবেন। গণতন্ত্রের প্রতি যাদের নিষ্ঠা আছে তরা এ আলোচনার মাধ্যমে আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ পাবেন। আসুন আমরা সবাই গণতন্ত্রের স্বার্থে আত্মবিশ্লেষণ করে দেখি।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র কেন বহাল রইল না ঃ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যে দলটি এককভাবে মহাবিজয় লাভ করে সে দলটিই বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়। গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত একটি দল বিপুল জনপ্রিয়তার অধিকারী হয়েও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কেন চালু রাখতে পারলো না তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার।
উদার দৃষ্টিতে এবং সত্য উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে বিচার-বিশ্লেষণ করলে এ কথা স্পষ্টভাবেই দেখা যায় যে, বাংলাদেশের রাজনীতি গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে না যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে ঃ
(১) একটি সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে এ নতুন রাষ্ট্রটি কায়েম হওয়ার দরুন স্বাভাবিকভাবেই রাজনীতিতে অস্ত্রের প্রভাব ও প্রাধান্য অনেকদিন পর্যন্ত বহাল থেকে যায়। স্বাধীনতা আন্দোলনের সুযোগ এমন বহু সুসংগঠিত গ্র“প ও উপদলের হাতে অস্ত্রশস্ত্র এসে যায় যারা “বন্দুকের বুলেট দ্বারা বিপ্লব সাধনের নীতিতে” আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে। ৭২ সালে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকার কায়েম হওয়া সত্ত্বেও ঐ সব উপদল অস্ত্রের প্রয়োগ বন্ধ করেনি। তাদের উৎপাত বন্ধ করার জন্য সরকারকেও রক্ষীবাহিনী ব্যবহার করতে হয়েছে। এমন কি বেসামরিক পর্যায়েও সরকার সমর্থক এবং সরকার বিরোধীদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ দেশের বহু জায়গায় অস্ত্র প্রয়োগ করতে দেখা গেছে। এ জাতীয় পরিস্থিতিতে যেভাবে রাজনৈতিক গোপন হত্যা চলেছে তাতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক ছিল।
(২) গণতন্ত্রের সঠিক পরিবেশের পূর্বশর্ত হলো জাতীয় আদর্শের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে বৃহত্তম ঐক্য থাকা। শাসনতন্ত্রের এমন সব মতবাদকে জাতীয় আদর্শ ঘোষণা করা হয়েছিল যা দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ঈমান আকিদার বিরোধী ছিল। ফলে গণমনে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় এবং সরকার বিরোধী যে কোন আওয়াজই জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। সরকারী দলেরই একাংশ নতুন দল সৃষ্টি করে চরম সরকার বিরোধী ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হয়। তারা এমন আকত্রমণাত্মক ভাষায় সরকারের সমালোচনা করতে থাকে যে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট হতে থাকে। কোন কোন সশস্ত্র উপদল এমন সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে থাকে যে, গণতান্ত্রিক শাসন স্বাভাবিক গতিতে চলতে ব্যর্থ হয়।
(৩) দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এমন মারাত্মক রূপ ধারণ করে যে, স্বাধীনতা লাভ করার দু’বছরের মধ্যেই মানুষ চরম দুরবস্থার সম্মুখীন হয়। এ অর্থনৈতিক সংকটের জন্য ভারতই দায়ী বলে জনগণের মধ্যে ধারণা সৃষ্টি হয় এবং সরকারকে ভারতপন্থী বলে বিবেচনা করার কারণে সরকারের জনপ্রিয়তা দ্রুত বিলীন হয়ে যেতে থাকে। কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা তখন ভারতের আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত গড়ে তোলেন। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের বিরুদ্ধে গণমনের এ তীব্র বিদ্বেষ সরকারকে চরম বেকায়দায় ফেলে দেয়।
(৪) এক শ্রেণীর অতি উৎসাহী ধর্ম নিরপেক্ষবাদী ও সমাজতন্ত্রীর আচরণ ও কার্যকলাপ এবং সরকারের কতক সিদ্ধান্ত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে এমন আঘাত হানে যে, দেশের ছোট-বড় ওয়ায়েজগণ জনগণের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ ও চেতনাকে সজাগ রাখার উদ্দেশ্যে যে আবেগময় বক্তব্য রাখেন তা-ও পরোক্ষভাবে সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত সৃষ্টি করতে থাকে।
(৫) উপরোক্ত কারণসমূহ সরকারের জন্য এমন কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যে, গণতান্ত্রিক পন্থায় এর মোকাবিলা করা অসম্ভব বলে সরকার মনে করে। শেষ পর্যন্ত সরকারী দল তাদের নেতার জনপ্রিয়তাকে সম্বল করে পূর্ণ একনায়কত্ব কায়েমের মাধ্যমে আত্মরক্ষার চেষ্টা করে। তারা এমন এক শাসন ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত নেয় যা প্রতিষ্ঠিত হলে দেশে গণতন্ত্রের সকল পথই বন্ধ হবার আশংকা দেখা দেয়। এ ব্যবস্থা চালু হবার প্রাক্কালেই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের দুর্ঘটনা ঘটে।
(৬) উপরে বর্ণিত কারণসমূহ ঐতিহাসিক সত্য। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, শেখ মুজিবের মতো জনপ্রিয় নেতা এবং তার ব্যাপক গণসমর্থন পুষ্ট দল জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেও দেশকে গণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে নেবার বদলে একনায়কত্ত্বের ভ্রান্ত পথে কেন পা বাড়ালেন ? শেখ মুজিব আজীবন গণতান্ত্রিক সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তিনি কেন জনগণের উপর আস্থা হারিয়ে ফেললেন এবং তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে কেন তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে এগিয়ে নিতে পারলেন না ?
পরলোকগত শেখ মুজিব সাহেবের প্রতি কোন প্রকার অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা আমার মোটেই উদ্দেশ্য নয়। তিনি এদেশের ইতিহাসে চিরদিনই উল্লেখযোগ্য হয়েই থাকবেন। তাই এদেশের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে তাঁর উল্লেখ না হয়েই পারে না। যারা আন্তরিকভাবে গণতন্ত্রের বিকাশ চান এবং যারা সাধ্যমতো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করা কর্তব্য মনে করেন। তাদের নিকট আমার বিনীত অভিমত প্রকাশ করা কর্তব্য মনে করছি। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এ বিষয়ে আলোচনা করা আমি অত্যন্ত প্রয়োজন মনে করি।
(ক) ইংরেজ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তান আমলে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চলতে না দেবার ফলে রাজনৈতিক ময়দানে যারা সক্রিয় ছিলেন তাদেরকে বাধ্য হয়ে অগণতান্ত্রিক শাসকদের বিরুদ্ধে অবিরাম আন্দোলন চালিয়ে যেতে হয়েছে। ফলে বিরোধী দলীয় রাজনীতি গঠনমূলক কর্মকান্ডের বদলে অমরঃধঃরড়হধষ চড়ষরঃরপং (বিক্ষোভের রাজনীতি)-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিরোধী দলের ভূমিকা গঠনমূলক হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক আন্দোলনের পক্ষে ইতিবাচক কর্মসূচী গ্রহণ করা প্রায় অসম্বব। এরই ফলে শেখ মুজিব সরকার বিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলেও দেশ শাসনের জন্য যে ধরনের সুস্থির নেতৃত্ব ও সুশৃঙ্খল কর্মীবাহিনী গড়ে তুলবার প্রয়োজন ছিল তা করা তাঁর পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। তাই দেশের নিরস্কুশ ক্ষমতা লাভ করা সত্ত্বেও তিনি জাতিকে গড়ে তুলতে সক্ষম হননি।
(খ) প্রায় আজীবন রাজনীতির ময়দানে সংগ্রামরত থাকার ফরে এবং বার বার কারাভোগ করার দরুন তাঁর মধ্যে আবেগ প্রবণতা এতটা প্রবল হয়ে পড়েছিল যে, জাতীয় পর্যায়ে বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে তিনি আবেগ দ্বারাই বেশী পরিচালিত হয়েছেন বরে আমার ধারণা। ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে ঘনিষ্টভাবে জানার আমার যথেষ্ট সুযোগ হয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একসাথে কাজ করা ও মত বিনিময় করার মাধ্যমে আমি তাঁকে যতটুকু বুঝেছি তাঁতে আমার যতটুকু বুঝেছি তাতে আমার এ ধারণা হয়েছে যে, আল্লাহ পাক তাঁর মধ্যে নেতৃত্বের যতগুলো গুণ দিয়েছিলেন যদি প্রজ্ঞার সাথে তিনি তা ব্যবহার করতে পারতেন তাহলে এদশের ইতিহাস ভিন্নরূপ হতো।
আমার ধারণায় নেতার মধ্যে প্রজ্ঞার চাইতে আবেগ বেশী থাকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। কর্মীদের মধ্যে আবেগই প্রবল থাকা দরকার যাতে তারা নেতার নিদের্শে জীবন দিতে দ্বিধা না করে।কিন্তুু নেতার মধ্যে প্রজ্ঞা ্ও দূরদশিতার চেয়ে আবেগ প্রবল হ্ওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারণ আবেগচালিত সিদ্ধান্তের মধ্যে ভ্রান্তির আশংকা প্রবল।
(গ) তাঁর সংগ্রামী জীবনে রাজনৈতিক নেতিবাচক কর্মকান্ডের প্রাধান্য থাকার দরূন তাঁর সংগঠনে বিভিন্ন চিন্তাধারা ্ও মতবাদের লোকের সমাবেশ ঘটেছিল। তাই দেশ গড়ার লক্ষ্যে আদর্শ কর্মনীতি ্ও কর্মসূচীর যে ঐক্য তার সংগঠনে থাকা প্রয়োজন ছিলো তার অভাবে তিনি শেষ পর্যন্ত যেন অনেকটা অসহায় হয়েই একদলীয় শাসন ব্যবস্থার আশ্রয় নিয়েছিলেন।
(ঘ) তাঁর দলে যারা কট্রর সমাজতন্ত্র ছিলেন তারা বুঝতে পারলেন যে, গণতান্ত্রিক উপায়ে এদেশে তাদের কাঙ্খীত সমাজ ব্যবস্থা চালু করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। তাই তারা বিভিন্নভাবে দল যেভাবে তার বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছিল তাতে হয়তো তিনি মনে করেছিলেন যে সমাজতান্ত্রীক পদ্ধতিতে এক দলীয় সরকার কায়েম করা হলে তাদের সমর্থন ্ও প্ওায়া যাবে।
গণতন্ত্র পথে প্রতিবন্ধকতা ঃ আমাদের দেশে গণতন্ত্রের পথে নিম্নরূপ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে যা দূর করা ছাড়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন সফল হতে পারে না ঃ
১। আইয়ুব খানের আমল থেকেই এ কুপ্রথা চলে এসেছে যে, সামরিক একনায়কগণ ক্ষমতা দখলের পর ক্ষমতায় দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল গঠনের অপচেষ্টার মাধ্যমে রাজনীতিতে চরম দুর্নীতি চালু করে। তারা প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো থেকেই স্বার্থের বিনিময়ে নেতৃস্থানীয় লোকদেরকে কিনে নেয়ার চেষ্টা করে। এর ফলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির বিপন্ন হয়।
২। সামরিক একনায়ক যেসব নেতাকে কিনতে সমর্থ হয় না, সেসব দলের নেতাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দলের মধ্যে ভাঙ্গন ধরিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে যাতে কোন দল তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী ভূমিকা রাখার যোগ্যতাই না রাখে।
৩। রাজনৈতিক ময়দানে এভাবেই সুবিধাভোগী এবং ক্ষমতালিপ্সুদের ভিড় বারতে থাকে ও এ জাতীয় লকেরাই নেতা হওয়ার জন্য নতুন নতুন দল সৃষ্টি করে। এ জাতীয় লোকদের কারনেই রাজনীতি করাকে অনেকে সুধী, জ্ঞানী এবং চরিত্রবান লোক শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে না এবং তারা রাজনৈতিক অঙ্গনে আস্তে চায় না। ফলে রাজনৈতিক ময়দানে নৈতিক এবং আদর্শিক মান হ্রাস পেতে থাকে।
৪। আমাদের দেশে ১০০ টিরও বেশী রাজনৈতিক দল আছে বলে জানা যায়। এটা মোটেই সুস্থ গণতন্ত্রের লক্ষণ নয়। গুটিকতক লোক নিয়ে দল গঠনের এ হিড়িকের পেছনে অগণতান্ত্রিক মনোভাবই প্রধানত দায়ী। যেসব মনোবৃত্তির জন্য কথায় কথায় দল সৃষ্টি হচ্ছে সে সবই গণতন্ত্রের পথে প্রতিবন্ধক। অগণতান্ত্রিক মনোভাবের ধরন কয়েক রকমের দেখা যায়। যেমন—–
ক। দলের নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব যার হাতে থাকে তিনি দলীয় সংবিধান, আদর্শ এবং নীতি অগ্রাহ্য করে নিজ খেয়াল খুশি মত সিদ্ধান্ত নিলে সংগত কারনেই দল ভেংগে যায়।
খ। দলের সাংগঠনিক পদ্ধতিতে নেতৃবৃন্দের সমালোচনা এবং সংশোধনের ব্যবস্থা না থাকার ফলে নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে উপদল সৃষ্টি হয় এবং তা ক্রমে দলে ভাংগন সৃষ্টি করে।
গ। দলীয় আদর্শ এবং নীতির চেয়ে নেতৃত্ব লাভের আকাঙ্ক্ষা প্রবল হবার কারনে নেতৃত্বের কোন্দল সৃষ্টি হবার ফলেও একদল ভেংগে কয়েক দল তৈরি হয়।
ঘ। দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থায় অধিকাংশ সদস্যের রায়ের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহন করাই গনতান্ত্রিক রীতি। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যগণ যদি সংগঠনের সংবিধানের চেয়ে নিজেদের মতকে প্রাধান্য দিয়ে অধিকাংশের মত মেনে না নেয় তাহলেও দল ভেংগে যায়।
ঙ। এদেশে এমন উদাহরণ পাওয়া যায় যে, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের শাস্তিস্বরূপ কোন ব্যক্তিকে দল থেকে বহিস্কার করা হলে সে ব্যক্তিই পাল্টা দল গঠনের ঘশনা দিতে একটুও লজ্জাবোধ করে না।
উপরোক্ত প্রতিটি মনোভাব সুস্পষ্টরূপে গনতান্ত্রিক চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ জাতীয় মনোভাবের দরুনেই এদশে প্রায় একই নামে আধা ডজন দলের অস্তিত্ব দেখা যায়।
৫। কোন সময় আদর্শের ঐক্য সত্ত্বেও কর্মনীতি এবং কর্মসূচীতে মতের পার্থক্য হতে পারে ও এর ফলে এক সংগঠনে কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। গনতান্ত্রিক নিয়মে এঅবস্থায় অধিকাংশ লোকের মতামতের উপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। যারা ভিন্ন মত পোষন করে তারা নিজেদের নিজস্ব কর্মসূচী ও কর্মনীতি নিয়ে ভিন্ন নামে দল গঠন করতে পারে। কিন্তু অধিকাংশের মতকে অগ্রাহ্য করে তারা যদি মূল দলের নামটিকে ব্যবহার করে তাহলে নিঃসন্দেহে তা গণতন্ত্র বিরোধী।
৬। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মাঝে মাঝে যে ভাষার পারস্পরিক আক্রমণ চলে, বিশেষভাবে সরকারী এবং বিরোধী দলের মধ্যে পারস্পরিক সমালোচনার যে নিম্নমান কখনো কখনো দেখা যায় তা- ও গণতন্ত্রের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
৭। গণতন্ত্রের রুপায়নের পথে সব চাইতে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা হল – দৈহিক শক্তির প্রয়োগ করে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরোধিতা করা। এ মারাত্মক রোগ যে দলে আছে সে দলে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ হলেও তারা শক্তির দাপটেই মীমাংসা করার চেষ্টা করে।
এ জঘন্য মনোবৃত্তিটি যাদের মধ্যে আছে তারা চিন্তার ক্ষেত্রে আসলেই দুর্বল। তারা যুক্তির বলে প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় অক্ষম বলেই শক্তির আশ্রয় নেয়। রাজনৈতিক ময়দানে শক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে এ কুপ্রথা এদেশে সরকারী দলেরই অবদান। পাকিস্তান আমল থেকেই তা চলে এসেছে। সরকারী দল বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার জন্য গুন্ডাদল পোষার এ জঘন্য প্রথা আজো পুরা দস্তুর চালু রেখেছে।
মানব জাতির দুর্ভাগ্য যে, রাজনৈতিক ময়দানে দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করা একটি আধুনিক মতবাদের কর্মনীতি হিসেবে স্বীকৃত। তারা আফগানিস্তানে রাশিয়ার অমানবিক হামলায় লজ্জাবোধ করেনি। এদেশেও কাবুল স্টাইলের বিপ্লব করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে তাদের গণতন্ত্রে কোন দোষনীয় কাজ মনে হয় না।
আমরা যদি সত্যিই গণতন্ত্র চাই এবং গনতান্ত্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে শান্তি, উন্নতি এবং প্রগতি কামনা করি তাহলে রাজনৈতিক অংগন থেকে উপরোক্ত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হতে হবে।
ক্ষমতার রাজনীতি বনাম আদর্শিক রাজনীতিঃ
আমাদের দেশে রাজনৈতিক ময়দানে উপরোক্ত প্রতিবন্ধকতাগুলো থাকার আসল কারন হলো ক্ষমতার রাজনীতি। যে কোন উপায়ে সরকারী ক্ষমতা দখল করাই যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হয়, তাহলে যা হওয়া স্বাভাবিক আমাদের দেশে তাই ঘটছে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থায় বিরোধীদলের যোগ্য ভুমিকার মাধ্যমেই যে দেশের যথেষ্ট সেবা এবং কল্যাণ করা সম্ভব সে কথা যদি আমাদের বুঝে আসে তাহলে ক্ষমতা দখল করার জন্য গণতান্ত্রিক এবং অরাজনৈতিক পন্থা অবলম্বন করার কুপ্রথা এদেশে এতোটা চালু থাকতে পারবে না।
আইয়ুব খানের কর্মচারীর মর্যাদা নিয়ে যেসব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মন্ত্রী এবং গভর্নর হয়েছিলেন তাদের মধ্যে যদি কোন রাজনৈতিক আদর্শ থাকতো তাহলে কিছুতেই এমন অরাজনৈতিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারতেন না। যে ব্যক্তি জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের রচিত শাসনতন্ত্র বাতিল করে এবং জাতীয় নির্বাচন বন্ধ করে দেশ রক্ষার মহান দায়িত্ব ফেলে রেখে দেশ শাসনের বোঝা অন্যায়ভাবে নিজের কাঁধে তুলে নিলো তার এ জঘন্য কাজে যদি রাজনৈতিক নেতারা সহযোগী না হতেন তাহলে পরবর্তীকালে এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো না।
যারা নিজেকে কায়েম করার জন্য রাজনীতি করে তারা যে কোন ভাবেই ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তালাশ করে। আর যারা দেশ এবং জাতির কল্যাণ লাভের মহান উদ্দেশ্যে রাজনীতি করে তারা ক্ষমতা লাভকে আসল লক্ষ্য মনে করেন না। দেশ সেবার আদর্শ যাদের আসল লক্ষ্য তারা কোন একনায়কের কাছে মন্ত্রিত্ব ভিক্ষা চাইতে পারে না। রাজনৈতিক ময়দানে এ জাতীয় ভিক্ষুকরাই সামরিক শাসনের জন্য আসল দায়ী। এ জাতীয় লোক বাজারে না পাওয়া গেলে সামরিক শাসন বার বার জাতির ঘাড়ে চেপে বসতে পারতো না।
ব্যক্তি ভিত্তিক রাজনীতিঃ
রাজনৈতিক দল আদর্শ, মত এবং চিন্তাধারার ভিত্তিতে গঠিত এবং পরিচালিত হওয়াই উচিত। কিন্তু কোন দল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যখন দলীয় নেতাকে সুবিধাবাদী ও স্বার্থপর নেতারা একনায়কের মর্যাদা দিয়ে বসে তখনই দলটি ব্যক্তি ভিত্তিক হয়ে পড়ে। “এক নেতা এক দেশ—বাংলাদেশ বাংলাদেশ” শ্লোগান দিয়ে যখন শেখ মুজিবকে অতি মানব বানিয়ে দেয়া হলো তখন সে ব্যক্তির নামটাই দলের আদর্শ হিসেবে গণ্য হয়ে গেলো।
জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী তার সমর্থকদেরকে নিয়ে আওয়ামী লীগ নামে আলাদা দল গঠন করার পরও তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের নামই নিলেন। ফলে মূল আওয়ামী লীগের সাথে পাল্লা দিতে তিনি ব্যর্থ হলেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা যখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহন করলেন তখন চৌধুরী সাহেব দলের নামই ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।
তেমনি অবস্থা নিএনপির মধ্যেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের আদর্শই যখন দলের আদর্শে পরিনত হয়ে গেলো তখন এ দলের নাম নিয়ে বেগম জিয়ার নেতৃত্বের সাথে প্রতিযোগিতা করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কোন ব্যক্তি ভিত্তিক দলের নেতৃত্ব ঐ বংশের হাতে থাকাই স্বাভাবিক। পাকিস্তানের মিঃ ভুট্টর দল পি, পি, পি- এর মধ্যে এ অবস্থাই বিরাজ করছে। এমনকি ভারতে গণতন্ত্র মোটামুটি চালু থাকা সত্ত্বেও পণ্ডিত নেহেরুর বংশেই কংগ্রেসের নেতৃত্ব এ পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে আছে। এটা কোন অবস্থাতেই গণতন্ত্রের লক্ষণ নয়। রাজতন্ত্রেরই পরিচায়ক। এতে বুঝা যায় যে, সত্যিকার গনতন্ত্র এখনো ভারতে কায়েম হয়নি।
( বাংলাদেশের রাজনীতি )