স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলন
স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি
স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারা সবাই পাকিস্তান আন্দোলনে বিশেষ অবদান রেখেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান, সাইয়েদ নজরুল ইসলাম, জনাব তাজ উদ্দিনের নেতৃত্বেই বাংলাদেশ আন্দোলন পরিচালিত হয়। ছাত্র জীবনে আমি তাঁদের সমসাময়িক ছিলাম। পাকিস্তান আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকা কতো বলিষ্ঠ ছিল আমি তাঁর প্রত্যক্ষ সাক্ষী। মুসলিম জাতীয়তার পতাকাবাহী হিসেবেই তারা ভারতীয় কংগ্রেসের ভৌগলিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। গান্ধী এবং নেহেরুর নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের ভিত্তিতে অখন্ড ভারতের একটি মাত্র রাষ্ট্র কায়েমের কংগ্রেসি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পাকিস্তান কায়েমের আন্দোলনে তারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
তারা ছিলেন তখন তরুন ছাত্রনেতা। তারা মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সহ্রাওয়ারদীর ভক্ত ও অনুরক্ত হিসেবে পাকিস্তান আন্দলেন সক্রিয় ছিলেন। গোটা বংগদেশ পাকিস্তানের অন্তুরভুক্ত না হওয়ায় এবং কংগ্রেসের দাবী মেনে নিয়ে ব্রিটিশ শাসকরা পশ্চিম বঙ্গকে পূর্ব বঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভারতে শামিল করার ফলে পূর্ব বংগে হোসেন শহীদ সহ্রাওয়ারদীর নেতৃত্ব কায়েম হতে পারেনি।
অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগে দুইটি গ্রুপ ছিল। এক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদী ও জনাব আবুল হাশিম এবং অন্য গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মাওলানা আকরাম খান, খাজা নাজিমুদ্দিন ও জনাব নুরুল আমীন। বঙ্গদেশ বিভক্ত না হলে হয়তো জনাব হোসেন শহীদ সহ্রাওয়ারদী পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতেন। পশ্চিম বঙ্গ আলাদা হবার ফলে পূর্ব বংগে খাজা নাজিমুদ্দিন গ্রুপের হাতেই ক্ষমতা আসে।
শেখ মুজিব এবং জনাব তাজউদ্দীন সহ্রাওয়ারদী গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বলে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীন নাজিমুদ্দিন গ্রুপের প্রতি বিরূপ ছিলেন। সহ্রাওয়ারদী সাহেব কোলকাতায়ই রয়ে গেলেন বলে তারা নেতৃত্বহীন অবস্থায় পরে গেলেন। আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এসে এ গ্রুপের নেতৃত্বের অভাব পূরণ করেন এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে মুসলিম লীগের বিকল্প দল গঠন করেন। এভাবে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ দ্বারাই সরকার বিরোধী দল গঠিত হয়। ( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
সরকারের ভ্রান্ত নীতি
পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও কর্মী বাহিনী সরকারী এবং বিরোধী দলে বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম লীগ সরকার যদি ইসলামী আদর্শের প্রতি নিষ্ঠার পরিচয় দিতেন, মুসলিম জাতীওতাকে শুধু শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার না করতেন, গনতান্ত্রিক নীতি মেনে চলতেন এবং অর্থনৈতিক ময়দানে ইনসাফের পরিচয় দিতেন তাহলে জাতিকে যে ধরনের সংকটের মোকাবেলা করতে হয়েছে তা সৃষ্টি হতো না। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার সকল ক্ষেত্রেই ভ্রান্ত নীতি অবলম্বন করে দেশকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেন।
রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে
পাকিস্তানের মোট জনসংখার অধিকাংশ পূর্ব বঙ্গের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে অস্বীকার করা এবং বাংলা ভাষাভাষীদের উপরে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার ভ্রান্ত নীতিই সর্বপ্রথম বিভেদের বীজ বপন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষীরা বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষার দাবী তুলেনি। তারা উর্দু এবং বাংলা উভয় ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার দাবী জানিয়েছিল।
এই দাবী জানাবার আগেই জনসংখ্যার বিচারে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা সরকারের দায়িত্ব ছিল। অথচ দাবী জানানোর পর এটাকে ‘প্রাদেশীকতা’ বলে গালি দিয়ে সরকার সংগত কারনেই বাংলাভাষা ভাষীদের আস্থা হারালেন। ভাষার দাবীটিকে সরকার এমন রাষ্ট্র বিরোধী মনে করলেন যে, গুলী করে ভাষা আন্দোলনকে দাবিয়ে দিতে চাইলেন। এ ভ্রান্ত সিদ্ধান্তই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার জন্ম দেয়।
গণতন্ত্রের প্রশ্নে
গনতান্ত্রিক পন্থায় পাকিস্তান কায়েম হওয়া সত্ত্বেও সরকার অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে টিকে থাকার ষড়যন্ত্র করলেন। শাসনতন্ত্র রচনায় গড়িমসি করে নির্বাচন বিলম্বিত করতে থাকলেন। ১৯৫৪ সালে পূর্বাঞ্চলে প্রাদেশিক নির্বাচনে সরকারী মুসলিম লীগ দলের ভরাডুবির পর কেন্দ্রে ষড়যন্ত্র আরও গভীর হয়। পরিনামে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হয়।
আইয়ুব খান গণতন্ত্র হত্যা করার এক অভিনব পন্থা আবিস্কার করলেন। মৌলিক গণতন্ত্রের নামে জনগণকে সরকার গঠনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হল। কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত থাকায় এবং আসল ক্ষমতা আইয়ুব খানের হাতে কেন্দ্রীভুত থাকায় পূর্ব পাকিস্তানের সচেতন রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফলে, আইয়ুব বিরোধী গনতান্ত্রিক আন্দোলন আরও জোরদার হয় এবং এর পরিনামে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। আইয়ুব খানের দশ বছরের শাসনকালে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব দ্রুত বেড়ে যায়।
অর্থনৈতিক ময়দানে
শাসন- ক্ষমতায় জনগনের প্রতিনিধিত্ব না থাকায় এবং ক্ষমতাসীনদের স্বেচ্ছাচারী ভুমিকার দরুন শিল্প এবং বাণিজ্য নীতি প্রনয়নে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি সুবিচার হওয়া স্বাভাবিক ছিল না। মন্ত্রী সভায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে গনপ্রতিনিধিদের পরিবর্তে সুবিধাবাদীদেরই নেয়া হত। এর ফলে অর্থনৈতিক ময়দানে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে তারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হতেন। এভাবে গনতান্ত্রিক সরকারের অভাবেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি অর্থনৈতিক দিক থেকেও আস্থা হারাতে থাকে।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
ভুট্টো- ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র
উপরোক্ত কারনসমূহ স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি রচনা করলেও ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের গড়িমসি এবং অবশেষে দমনমূলক কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণই এ আন্দোলনের জন্ম দেয়। নির্বাচনের পর জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আমি বার বার সংবাদ পত্রে বিবৃতি দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার আহবান জানিয়েছি। জেনারেল ইয়াহিয়া ভুট্টোর দাবী মেনে নিয়ে ১ লা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য পার্লামেন্ট অধিবেশন মুলতবী করায় চরম রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়।
১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকায় ইয়াহিয়া- মুজিব সংলাপে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ নেতা সাইয়েদ নজরুল ইসলাম আমার মহল্লায় তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান করতেন। ছাত্র জীবনে বন্ধু হিসেবে তাঁর সাথে যে ঘনিষ্ঠতা ছিল এর সুযোগে তাঁর কাছ থেকে সংলাপের যেটুকু রিপোর্ট পেতাম, তাতে আমার এ ধারনাই হয়েছে যে, সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার জন্য ভুট্টোই প্রধানত দায়ী এবং ইয়াহিয়া খান দ্বিতীয় নম্বর দোষী।
নির্বাচনের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে আওয়ামী লীগের হাতেই কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব অর্পিত হত। সে অবস্থায় পরিস্থিতির চিত্র ভিন্নরূপ হতো। আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত থাকায় রাজনৈতিক সমস্যা অবশ্যই দেখা দিতো। কিন্তু ৭১- এ যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সৃষ্টি হল তা থেকে অবশ্যই রক্ষা পাওয়া যেতো। শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পার্লামেন্টের মাধ্যমেই হয়তো এক সময় দেশ বিভক্ত হবার প্রয়োজন হয়ে পড়তো। ঐ অবস্থায় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সহায়তার প্রয়োজন পড়তো না।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )