বাংলাদেশের স্বাধীনতা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা
স্বাধীনতা মানুষের মৌলিক অধিকার। মানুষ জন্মগতভাবেই স্বাধীন। কিন্তু কিছু সংখ্যক মানুষ নিজেদের স্বার্থে বা ভ্রান্ত মতাদর্মের প্রভাবে সে স্বাধীনতা থেকে জনগনকে বঞ্চিত করে। মজার ব্যাপর হলো এই যে, স্বাধীনতার নামেই মানব জাতিকে পরাধীন করার চেষ্টা চলে। চিরকাল মানুষ এ স্বাধীন্তার জন্র বহু কুরবানী দিয়েছে, যেহেতু স্বাধীনতাই শ্রেষ্ঠতম অধিকার, সেহেতু এ অধিকার হাসিল করার জন্র মানুষ আর সব অধিকার কুরবানী দিয়েও সংগ্রাম করা প্রযোজন মনে করে।
স্বাধীনতার সাধারণ সংজ্ঞাঃ বিদেশী লোকের শাসনমুক্ত হওয়াকেই সাধারণত স¦াধীনতা বলা হয়। ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র বিংশ শতাব্দীর প্রথম কয়েকদশক পর্যন্তও পৃথিবীর অনেক দেশকে সামরিক শক্তিবলে দখল করে রেখেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে অধীনস্ত দেশ গুলো দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে এবং ত্যাগ তিরিক্ষর পরিণামে গোলামরি অক্টোপাস থেকে মুক্তি লাভা করে। এভাবে তারা সাধারণ অর্থে স্বাধীনাত পায়।
স্বাধীনতার গনতান্ত্রিক সংজ্ঞাঃ প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য শুধুমাত্র বিদেশীদের শাসনমুক্ত হওয়াই যথেষ্ট নয। দেশী স্বৈরাচারী শাসন কিংবা একনায়কত্ব থেকে মুক্ত হয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করার জন্য মানুষকে আবার নতুন করে সংগ্রাম চলাতে হয়। স্বাধীনতা তখন অর্থহীন হয়ে পড়ে যখন জনগণ এ স্বাধীনতার ফল ভোগ করতে অক্ষম হয়। আর জনগণের সত্যিকার প্রতিনিধিদের মাধ্যমে যাবতীয় অধিকার ভোগ করার সুযোগ পেলেই মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পেতে পারে।
একথা ঐতিহাসিক সত্য যে, বিদেশী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তির সংগ্রামের চাইতে দেশী স্বৈরাচারী শাসকের কবল থেকে মুক্তি লাভ করা কম কঠিন ও কম কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়।
স্বাধীনতার ইসলামী সংজ্ঞাঃ ইসলাম মনে করে বিদেশী শাসন থেকে মুক্তি কিংবা দেশী লোকের শাসন হলেই প্রকৃত স্বাধীনতা হয় না। মানুষের মনগড়া যাবতীয় বিধি-বান্ধব থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত মানুষ সত্যিকারভাবে স্বাধীন হয না।
একমাত্র আল্লাহর বিধান জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষের উপর থেকে মানুষের প্রভুত্ব খতম হওয়া সম্ভব। আল্লাহর দেয়া আইন জনগণের সঠিক প্রতিনিধিদের দ্বারা জারি করাতে পারলেই সম্পূর্ন ভারসাম্য রক্ষা করে জনগণ তাদের মৌলিক অধিকার পেতে পারে, তথা স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে পারে।
স্বাধীনতার আন্দোলনঃ ১৭৫৭ সারে পলামীর আ¤্রকাননে সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতার সূর্য যে অস্তমিত রয়ে গেল। এর মধ্যে অগণিত স্বাধীনতাকামী মানুষ বুকের তাজা রক্ত ঢেলেছে। কত মা-বোন ইজ্জত দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। অতপর ১৮৮৭ সারে জন্ম নিল নিখিল ভারত কংগ্রেস। ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদেরই অংশ হিসেবে বাংলার মুসলমানরাও মনে করেছিল যে, কংগ্রেসের সাথে মিলেই তাদের স্বাধীনতা আসবে। বাংলার মুসলমানদের এ স্বপ্ন কেবল স্বপ্নই রয়ে গেল। তারা দেখল অনেক বঞ্চনার পর পূর্ব বাংলার মানুষদের কিছুটা সুবিধার জন্য ১৯০৫ সালে যে প্রদেশ গছন করা হল কংগ্রেস তা বানচাল করে ছাড়ল। কারণ এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান এবং এ সুবিধা মুসলমানাই ভোগ করবে বেশী। সুতরাং কংগ্রেস বংগভংগের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে দিল। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯১১ সালে বংগ ভংগ রদ হয়ে গেল মুসলমানদের স্বপ্ন ভাংরো। মুসলমানদের স্বপ্ন ভাংগার ফলে মুসলিম লীগের মাধ্যমে শুরু হলো পৃথক আন্দোলন। সে আন্দোলনের ফলে ১৯৪৭ সালে জন্ম নিল পাকিস্তান। কিন্তু এদেশেরে জনগন ইংরেজ ও কংগ্রেস থেকে স্বাধীনতা লাভ করা সত্ত্বেও প্রকৃত আজাদী পেল না। শাসন ক্ষমতায়, অর্থনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে সমান অংশীদারিত্ব না পাওয়ায় তারা ইংরেজদের থেকে মুক্তির ২৫ বছর পর স্বাধীনতা লাভের আশায়ই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া প্রযোজন মনে করল।
স্বাধীনতা ও বাংলাদেশঃ স্বাধীনতার সাধারণ সংজ্ঞানুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশ একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এদেশের এখন এদেশবাসী দ্বারাই শাসিত।
গণতান্ত্রিক সংজ্ঞানুযায়ী স্বাধীনতা লাবের দেড়যোগ পর এখনও গনতন্ত্রের সামান্য সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। অগণতান্ত্রিক শক্তির মোকাবেলায় গণতন্থ্রের অগ্রগতি সম্ভব হলে জনগণ গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে বলে আশা করা যায়।
স্বাধীনতার ইসলামী সংজ্ঞা মোতাবেক স্বাধীনতা আরো বহু দূরে। দেশে গণতন্ত্র স্থিতিশীল হলে তবেই মানুষ নিজ স্বাধীন ইচ্ছয় প্রচলিত মানবরচিত মতাদর্শ পরিত্যাগ করতে পারে। কারণ এদেশের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম চাই এবং সত্যিকার গণতন্ত্র এলে শাসকগণ জনগণের আশা-আকাঙ্খা অগ্রাহ্য করতে পারবে না। তখন ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। মানুষকে আল্লাহ কারো গোলাম হিসেবে পয়দা করেন না বরং মানুষই মানুষকে দাসে পরিণত করে। তাই আল্লাহ পাক নবীগণকে পাঠিয়েছেন সকল প্রকারের দাসত্বকে অস্বীকার করে কেবল আল্লাহর দাসত্বের দিকে মানুষকে আহবান করার জন্যে। সকল নবীর একই আহবান ছিল- “হে আমার দেশবাসী, একমাত্র আল্লহর দাসত্ব কবুল কর। তিনি ছাড়া তোমাদের আনুগত্য পাওয়ার অধিকারী আর কেউ নেই।”
বর্তমানে আমাদের দেশের মাটি স্বাধীন হয়েছে মাত্র। দেশের মানুষ সাধারণ সংজ্ঞানুযায়ী স্বাধীন হলেও গণতান্ত্রিক সংজ্ঞায় এখ নপর্যন্ত স্বাধীন হয়নি। আর ইসলামী সংজ্ঞানুযায়ী স্বাধীনতা যে কত দুরে আছে তা ইসলামী আন্দোলনের সাথে যারা জড়িত তারাই উপলদ্ধি করতে সক্ষম।
প্রকৃত স্বাধীনতাঃ ব্যক্তিস্বাধীনতাই আসল স্বাধীনতা। ব্যক্তির ইজ্জত-আব্রু বজায় রাখা, তার আকীদা-বিশ্বাস ও ধর্মীয় কাজের সুযোগ দেয়া, তার পছন্দমতো পেশা গ্রহণের অধিকার দান, তার অর্জিত সম্পদের মালিকানা স্বীকার করা, তার ভাত, কাপড়, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষ ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি এমন মৌলিক মানবীয় প্রোয়োজন যা প্রত্যেক মানুষের প্রাণের দাবী। এ দাবী পূরণের জন্যেই স্বাধীনতার প্রয়োজন। পরাধীন মানুষ এসবের নিশ্চয়তা বোধ করে না। ব্যক্তির বিকাশের জন্য এসবই দরকার। দেশ স্বাধীন হবার পরও যদি এ জাতীয় ব্যক্তি-স্বাধীনতা কপলে না জোটে তাহলে এমন স্বাধীনতা দিয়ে মানুষের কি প্রয়োজন? পরাধীন থাকাকালে যতটুকু ব্যক্তি-স্বাধীনতা এদেশের মানুষ ভোগ করেছে সেটুকু কি এখন তারা পাচ্ছে?
স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক হয়েও কি আমরা স্বধীনতা অর্জন করতে পেরেছি? আমাদের দেশে যারা কাবুল ষ্টাইলে বিপ্লব ঘটাতে চান, যারা মার্কিন, ভারত কিংবা রাশিয়ার মতাদর্শ এদেশে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা কিংবা এদেশে ঐ সকল দেশের স্বার্থে কাজ করছেন তাঁরা কি পরোক্ষভাবে বাংরাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী কাজ করছেন?
যেহেতু কোন দেশের মাটি স্বাধীন হওয়াই স্বাধীনতার মূল কথা নয়, সেহেতু স্বধীনতার দীর্ঘ ১৮ বছর পর আমাদেরকে খতিয়ে দেখতে হবে আমরা জনগণকে কতটুকু স্বাধীনতা দিতে পেরেছি। বয়োবৃদ্ধ প্রবীন লোকেরা যাঁরা বৃটিশের যুগে যুবক কিংবা কিশোর ছিলেন, তাঁরা বলে থাকেন ইংরেজ আমালে তাঁরা আর্থিক প্রাচুর্যে ছিলেন, সুখ-সমৃদ্ধিতে ছিলেন, এমনকি পাকিস্তাণ আমলেও তারা আজকের তুলনায় অনেক শান্তিতে ছিলেন। একথঅ তাঁরা এজন্য বলেন না যে, তাঁরা আবার বৃটিশ কিংবা পাকিস্তানের শাসনে ফিরে যেতে চান বরং তাঁরা এজন্য বলেন যে, তাঁরা স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য খুঁজে পেতে আগ্রহী। তাঁরা চান জীবনের নিরাপত্তা, তাঁরা চান খ্যাদ্যাবাভ ও চিকিৎসার অভাব থেকে বাঁচতে। তাঁরা চান শিক্ষা-দীক্ষা নিয়ে ঈমানের সাথে বাঁচতে।
আমাদের দেশে স্বধীনতার সেই তাৎপর্য আছে কি? আর যদি না থাকে তবে নিছক মাটির স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা কি সম্ভব? আমাদের দেশে কোন প্রকার বিপদ এলেই আমরা বিদেশের প্রতি বিক্ষার হাত বাড়াতে বাধ্য হই। আমাদের বিপদের সুযোগে বিদেশীরা আমাদের সাহায্যের নামে এলে আমরা তাদের সামনে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে হাজির হই। এ অবস্থায় বিদেশীরা তাদের আদর্শ, সংস্কৃতি ও চরিত্র এদেশে চালুর সুযোগ পেলে এ মাটির স্বাধীনতাটুকু কি রক্ষা পবে? এ অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের স্বাধীনতা কি রক্ষা করতে সমর্ত হবো?
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি ১৯৪৭ সালে একবার এবং ১৯৭১ সালে দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে। কিনউত দু’দু বার স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও আমরা কেন স্বধীনতার স্বাদ পচ্ছি না তা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা প্রয়োজন।
দেশ শাসনের ক্ষমতা বিদেশীদের নিয়ন্ত্রণ তেকে কেড়ে এনে দেশী লোকদের নিয়ন্ত্রণে রাখাকেই স্বাধীনতার উদ্দেশ্য মনে করার ফলেই আমরা আজও সত্যিকার স্বাধীনতা পাইনি। শুধু নেতিবাচক উদ্দেশ্য কোন স্থায়ী সুফল এন দিতে পারে না। দেশকে কিভাবে গড়া হবে, দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো কিরূপ হবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ধরণা ও আন্তরিক নিষ্ঠা নিয়ে যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় তাদের ইতিবাচক কর্মসূচীই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে পারে।
দুর্ভাগ্যবসত আমাদের দু’টো স্বধীনতা আন্দোলনের বেলায়ই ঐ ইতিবাচক ভূমিকার অভাব ছিল। নেতৃব্ন্দৃ অবশ্য জনগণের মুখে কিছু ইতিবাচক শ্লোগান তুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু সে অনুযায়ী মন-মগজ ও চরিত্র বিশিষ্ট নেতৃত্ব ও কর্মীবাহিনী গছন করা হয়নি বলেই স্বাধীনতার আসল উদ্দেশ্য লাভ করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতাই
আমাদের দেশে জাতীয় আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভ সংক্রমিত হয়ে পড়েছে। (আমার দেশ বাংলাদেশ)
বাংলাদেশের প্রতিবেশী
প্রায় সব দেশেরই আশেপালে বিভিন্ন রাষ্ট্র রয়েছে। কোন কোন দেশের চার পাশে অনেক কয়টি দেশও আছে। বাংলাদেশের প্রায় চার পাশে ভারতই একমাত্র রাষ্ট্র। বার্মাও অবশ্য আমাদের সীমান্তে অবস্থিত। কিন্তু বার্মার সাথে ভারত। এমনকি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জও ভারতেরই অন্তরভুক্ত। সে হিসেবে বলতে গেলে ভারতই বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিবেশী।
প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করতে পারে না। প্রতিবেশী নিকটবর্তী বলে তার সাথে পণ্য বিনিময় সুলভ হওয়াই স্বাভাইবক। আমদানির ্ও রফতানির সঠিক পরিবেশ বহাল রাখার উদ্দেশ্যে ্ও পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ থাকা প্রয়োজন।
প্রতিবেশী রাষ্ঠের সাথে ঝগড়া -বিবাদ লেগে ধাকলে অশান্তি ্ও অস্থিরতা উভয় দেশের জনগণের মধ্যেই বিরাজ করে। এ অবস্থাটা কারো জন্যেই মঙ্গলজনক নয়। এ মহাসত্য স্বীকার করা সত্ত্বে একথ্ওা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দ্বন্দ্ব ্ও সংঘর্ষ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথেই হয়ে থাকে। সম্পর্ক থাকলেই সংঘষের কারণ ঘটে।দূরবর্তী রাষ্টের সাথে সংঘর্ষের সুযোগ কমই হয়। সাধারণত খো যায় যে,শক্তিমান প্রতিবেশী অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিবেশীর সাথে ভাল আচরণ করে না। একথা ব্যক্তি জীবনে যেমন সত্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়্ওে সমভাবে প্রচলিত কুপ্রথা। ১৯৪৭সালে ভারত বিভাগের পর থেকে আজ পর্যন্ত এদেশের সাথে ভারতের আচরণ এতটা আপত্তিকর যে, স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েমের ব্যাপারে ভারতের সাহায্য সহায়তাকেও জনগণ বিশেষ উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে করতে বাধ্য হয়েছে।
পাকিস্তান আমলে এ অঞ্চলের সাথে ভারতের যে ব্যবহার তা বন্ধু সূলভ না হওয়া কতকটা স্বাভাবিক বলা চলে। অখন্ড ভারতমাতা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল। মুসলিম জাতীয়তার ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হওয়া হিন্দু ভারতের পক্ষে খোলা মনে মেনে নেয়া কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তাই ভারতমাতার ব্যবচ্ছেদকারী দেশ হিসেবে সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করা তাদের জন্য অস্বাভাবিক ছিল না।
কিন্তু ভারতের ধর্ম-নিরপেক্ষতাবাদী আদর্শের অনুসারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম হবার পরও ভারতের নিকট কোন সম্মানজনক ব্যবহার না পাওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
ইন্দিরা গান্ধী আশা করেছিলেন যে, তাঁর সাহায্যে যে দেশটি একটি পৃথক সত্তা লাভ করল সে দেশ তাঁর আধিপত্য মানতে রাজী ছিল না তারা হিন্দু ভারতের আধিপত্য সহ্য করবে বলে ধারণা করা যে ইন্দিরা গান্ধীর কতবড় ভুল ছিল তা অল্পদিনের মধ্যে তিনি টের পেলেন।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্ধিরা গান্ধী পার্লামেন্টের অধিবেশনে দর্পভরে ঘোষণা করেছিলেন যে, “টু নেশান থিউরীই বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে”। একথাটি বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি হয়তো আশা করেছিলেন যে, তার ভারতমাতাকে যে টু নেশান থিউরী ত্রিখন্ডিত করেছে তা খতম হয়ে যাবার পর বাংলাদেশ কালক্রম ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের জনগণকে চিনতে তিনি বিরাট ভুল করেছিলেন বলেই এমন দুরাশা তিনি করতে পরেছিলেন। টু নেশান থিউরীই যে বাংলাদেশের আসল ভিত্তি সে কথা তিনি ভুলে গেলেন কী করে ? ভারত বিভক্ত না হলে বাংলাদেশের জন্ম কী করে হতো ? বাংলাদেশের ভবিষ্যত অস্তিত্বেও টু নেশান থিউরীর উপরই নিভর্রশীল।
১৯৭৫ সালের আগষ্টে টু নেশান থিউরী যেন নবজীবন লাভ করল এবং ভারতের আধিপত্য থেকে উদ্ধার পাওয়ার মহাউল্লাস জনগণকে স্বাধীনতার নব চেতনা দান করল। ৭৫-এর ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতা আরও বলিষ্ঠভাবে টু নেশান থিউরীর প্রদর্শনী করল। সুতরাং পাকিস্তান আমলে এদেশের প্রতি ভারত যে মনোভাব পোষণ করতো তা এখনও যথাযথই বহাল আছে। বরং ‘অকৃতজ্ঞ’ বাংলাদেশের প্রতি সে বিরূপ মনোভাব আরও বিক্ষুব্ধ রূপ লাভ করেছে।
ফারাক্কা বাঁধের ফলে অর্ধেক বাংলাদেশ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ একতরফাভাবে দখলের মাধ্যমে ভারতের আগ্রাসী মনোবৃত্তিরই প্রকাশ ঘটেছে। বেরুবাড়ী হস্তান্তর করে ভারতকে দিয়ে দেয়া সত্ত্বেও চুক্তি অনুযায়ী কয়েকটি ছিট মহল না দিয়ে ভারত চরম বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়েছে। সামান্য তিন বিঘা করিডোর নিয়ে ভারত যে ক্ষুদ্রমনার পরিচয় দিয়েছে তা বিষ্ময়কর।
গঙ্গার পানি বৃদ্ধি করে ফারাক্কার ছোবল থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য নেপাল ও বাংলাদেশের যৌথ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ভারত চরম হঠকারিতার প্রদর্শনী করেছে। গঙ্গার পানি নিয়ে বছরের পর বছর উভয় সরকারের যে প্রহসনমূলক বৈঠক চলছে তা এদেশের জনগণের মনকে বিষিয়ে তুলেছে। এ ব্যাপারে এ পর্যন্ত ভারতের সামান্য সদিচ্ছার পরিচয়ও পাওয়া যায়নি। গঙ্গার পানি কুক্ষিগত করে এখন ব্রহ্মপুত্রের পানিরও দাবী করা হচ্ছে কায়দা করে।
বাংলাদেশ ভারতের সাথে সামান্য তিক্ততাও সৃষ্টি করতে চায় না। তাই গঙ্গার পানি ন্যায্য হিস্যা দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করে আদায় না হওয়ায় ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ এ বিষয়টা জাতিসংঘের দরবারে পেশ করেছিল। সারা দুনিয়াকে শুনিয়ে ভারত জাতিসংঘে ওয়াদা করেছিল যে, দ্বিপাক্ষিক আলোচনা দ্বারাই এর মীমাংসা করা হবে। জাতিসংঘ থেকে সেদিন এ মামলা তুলে নিয়ে বাংলাদেশ সরকার দুবর্লতারই পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায় বলেই তা করেছে।
এ জাতীয় চরিত্রের বিশালদেহী প্রতিবেশী দ্বারা ঘেরাও থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কিভাবে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবে তা এদেশের জন্য এক বিরাট সমস্যা। ভারতের জনগণের সাথে প্রতিবেশী সূলভ মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলতে বাংলাদেশ অত্যন্ত আগ্রহী। কিন্তু একতরফাভাবে কী করে সে ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে? ভারতে যদি কোন দিন এমন কোন সরকার কায়েম হয় যারা ‘বীগ ব্রাদার’ মনোভাব ত্যাগ করবে কেবল তখনই সুসম্পর্ক কয়েম হতে পারে।
বাংলাদেশের সম্ভাব্য আক্রমণকারী
পৃথিবীর বড় রাষ্ট্রগুলোর ভয়ে আজ ছোট দেশগুলো আতংঙ্কগ্রস্ত। দূরপ্রাচ্য, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা প্রভৃতি স্থানে আমরার এর বাস্তব নযির দেখতে পাই। বাংলাদেশ সাম্প্রতিক কালে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এমন একটা রাষ্ট্র যার আযাদী এবং নিরাপত্তা যে কোন সময়ে বিপন্ন হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এ হামলা কোন্ দিক থেকে আসতে পারে ? সরাসরি (সম্ভাব্য) হামলাকারী কে হতে পারে ঃ এ প্রশ্নের উত্তরে প্রথমত প্রত্যেকেই একথা বলবেন যে, একমাত্র পার্শ্ববর্তী কোন রাষ্ট্র দ্বারাই এ কাজ সম্ভব। দূরবর্তী কোন রাষ্ট্রের পক্ষে এ কাজ আদৌ সম্ভব নয়। এদিক থেকে বিচার করলে একমাত্র ভারতের পক্ষ থেকেই এ আক্রমণ আসতে পারে। বাংলাদেশের সম্পূর্ণ পশ্চিম ও উত্তরে সীমান্ত এবং পূর্বদিকে আসাম পর্যন্ত ভারত বি¯তৃত। এমনকি দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জও ভারতের। সুতরাং বলা যায় বাংলাদেশের জলপথ, স্থলপথ ও আকাশপথ ভারতের দ্বারা পরিবেষ্টিত। আমরা একথা বলছি না যে, ভারত আক্রমণ করে বসবেই। কিন্তু একথা অস্বীকার করার কোনই উপায় নেই যে, আমাদের দেশ যেহেতু সাড়ে তিন দিক থেকেই ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত সেহেতু ভারতের পক্ষ থেকে আক্রমণ হওয়াই স্বাভাবিক বা সম্ভব।
অন্যদিকে বাংলাদেশের পূর্ব-দক্ষিণে সীমান্তে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বার্মার বর্ডার রয়েছে। এ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোন প্রকার আক্রমণ আসতে পারে কি না এটাও প্রশ্নের বিষয়। এ আগ্রাসনটা প্রকৃতপক্ষে নির্ভর করবে বার্মার সাথে অন্য কোন কম্যুনিষ্ট রাষ্ট্র সহযোগিতা করে কিনা তার উপর। কারণ বার্মার একার পক্ষে এ কাজ সম্ভবও নয়, স্বাভাবিকও নয়। বৃহৎ কোন কম্যুনিষ্ট রাষ্ট এ কাজ করলে তবেই বার্মা এ উদ্যোগে শরীফ হতে পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও ভারতের সম্মতির প্রয়োজন। সুতরাং এ ক্ষেত্রে বলা যায় যে, বাংলাদেশের আযাদী হরণ করার জন্য সরাসরি হামলা যদি কেউ করে তবে সে ভারত।
কোন বৃহৎ শক্তি হামলা করতে পারে ঃ কোন বৃহৎ শক্তি যদি বাংলাদেশের প্রতিবেশী কোন দেশের সহযোগিতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায় তবে তিনটি বড় বড় রাষ্ট্রই এ কাজ করতে পারে। রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে আমেরিকা, রাশিয়া ও চীন। প্রথমে আমেরিকার কথা ধরা যাক। ভৌলিক দিক দিয়ে সরাসরি এদেশ দখল করার সুযোগ সে দেশটির নেই। বরং যুক্তরাষ্ট্রকে এ কাজ করতে হরে তাকে এদেশের অভ্যন্তরে এমন এজেন্ট পেতে হবে যার সহযোগিতায় সে বাংলাদেশের উপর পরোক্ষভাবে কর্তৃত্ব করতে পারে। অতপর আসে চীনের কথা। এদেশটি সম্পর্কে এখনও এ ধারণা সৃষ্টি হয়নি যে, সে ভৌলিক দিক দিয়ে বাংলাদেশকে দখল করার চেষ্টা করবে। সুতরাং বাকী থাকে রাশিয়া। রাশিয়ার অতীতের এ জাতীয় বহু কার্যকলাপ বাদ দিলেও অতি সম্প্রতি সে জোট নিরপেক্ষ একটা স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিম দেশ আফগানিস্তান দখল করার হীন চেষ্ট করেছে।
রাশিয়া কর্তৃক বাংলাদেশ আক্রান্ত হলে সম্ভাব্য দু‘টো পথে হতে পারে। প্রথমত, ভারতের মধ্য দিয়ে, দ্বিতীয়ত, বর্মার মাধ্যমে। রাশিয়া ভারতের মধ্য দিয়ে এদেশে আক্রমণ করতে চাইলে সে ততক্ষণ পর্যন্ত এ কাজ করতে পারবে না যতক্ষণ না ভারত এ কাজে রাযী হয়। প্রকৃতপক্ষে ভারতের নিজের স্বার্থেই সে রাশিয়াকে এ সুযোগ দিতে পারে না। অন্য দিকে কমুনিষ্ট রাশিয়া যদি সমাজতান্ত্রিক বার্মার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে চায় সে ক্ষেত্রেও ভারতের সম্মতির প্রয়োজন দেখা দিবে। কারণ প্রায় সাড়ে তিন দিক ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত একটা দেশে ভারতের অসম্মতিতে আক্রমণ চালানো স্বাভাবিক নয়।
সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, বাংলাদেশ আক্রান্ত হলে সরাসরি একমাত্র ভারতের দ্বারাই হতে পারে। একথা যদি স্বীকৃত হয় তাহলে বলতে হবে আমাদের নিরাপত্তার উপর হামলা কেবল ভারতের দিক থেকেই আসতে পারে বা ভারতের সমর্থনেই হতে পারে।
ভারতীয় হামলায় প্রকৃতি কি হতে পারেঃ একথা ঠিক যে, আজকাল বিশ্বজনমত (ডড়ৎষফ ঙঢ়রহরড়হ) বলতে একটা কথা আছে। সে কারণেই ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতি সরাসরি আক্রমণের সম্ভাবনা কম। তাই আধুনিক যুগে কোন দেশে হামলা চালাতে হরে সে দেশে এমন তাবেদার সরকার বসাতে হয়, যে অন্যের স্বার্থ রক্ষ করবে এবং প্রয়োজনে আক্রমণ করবার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানাবে। এভাবেই বিদেশী শক্তি কোন দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ার সুযোগ গ্রহণ করে। আফগানিস্তানে রাশিয়ার আগ্রাসন এভাবেই হয়েছে। সে জন্যই বাংলাদেশে এমন সরকার হওয়া কোন মতেই সমীচীন নয় যার উপর জনগণের মনে সন্দেহ হয় যে, ঐ সরকারের নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে (দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে নয়) ভারত ডেকে আনতে পারে।
বাংলাদেশের আযাদী রক্ষা
স্বাধীনতা প্রধানত মনোবলের উপরই নির্ভরশীল। মনের দিক দিয়ে অধীন হলে ভৌগলিক স্বাধীনতা কোনভাবেই টিকতে পারে না। সে সব লোকই প্রকৃতপক্ষে জীবন দিয়ে হলেও স্বাধীনতা রক্ষা করতে চেষ্টা করবে, যারা মনের দিক থেকে স্বাধীন।
আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে, একমাত্র ভারতের পক্ষ থেকেই স্বাধীনতা বিপন্ন হতে পারে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার যথার্থ রক্ষক তারাই হতে পারে যারা ভারতের প্রতি কোন প্রকার দুর্বলতা পোষণ করে না।
ঐ সকল লোকদের মধ্যে সবচাইতে পয়লা নম্বরে গণ্য হবে তারাই যারা এদেশে কুরআনের বিধান ও রাসূল (সাঃ)-এর আদর্শে সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। এরাই ভারতের দিক থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন মানসিকতার অধিকারী। কারণ তারা জানে এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বহাল না থাকলে তাদের আদর্শ বাস্তবায়নের কোন সম্ভাবনাই নেই। তাই তারা ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বাইরে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং স্বাধীনতার প্রথম শ্রেণীর রক্ষক তারাই। কারণ এ সকল লোকের দ্বীনের প্রয়োজনেই দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করাকে ফরজ মনে করে। অন্য কথায় স্বাধীনতা রক্ষা তাদের নিকট ধর্মীয় কর্তব্য ও ঈমানী দায়িত্ব।
স্বাধীনতার প্রকৃত রক্ষকদের মধ্যে তারাও অবশ্য গণ্য হতে পারে যারা ঐতিহাসিক কারণেই হিন্দু প্রধান ভারতের প্রাধান্য স্বীকার করতে কোন অবস্থাতেই রাজী নয়। মুসলমানরা ছিল এদেশে শাসকের জাতি। গোটা উপমহাদেশে তারা শত শত বছর ধরে শাসন করেছে। ইংরেজরা তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অমুসলিমদের সহায়তায় দু’শ বছর মুসলমানদের গোলাম বানিয়ে রাখে। ঐতিহাসিক কারণেই মুসলমানরা হিন্দু কংগ্রেসের অধীনতা মানতে রাজী হতে না পারায় ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ সম্মেলনে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের প্রস্তাব অনুযায়ী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী গৃহীত হয়। অতপর ১৯৪৭ সালে এলো পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়েও বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ স্বাধীন রাষ্ট্র রয়ে গেল। যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত বতর্মানে আরও মজবুতভাবেই এদেশে বহাল রয়েছে।
এদেশে যারা দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী নন তারা পশ্চিম বাংলা তথা ভারত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা কিভাবে টিকিয়ে রাখবেন ? তাদের দ্বারা তা সম্ভব নয় বলেই মুসলিম জাতীয়তায় বিশ্বাসীরাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকৃত রক্ষক।
যারা দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী নয়, যাদের নিকট ধর্মের কোন গুরুত্ব নেই, যারা মুসলিম অমুসলিম মিলে এক জাতিতে বিশ্বাসী যারা বাংলাদেশের বাইরের বাংগালীদের সাথে মিলে এক বাংগালী জাতি গঠনে আগ্রহী, এদেশে কোন রাজনৈতিক হাঙ্গামা হয়ে যারা ভারতে আশ্রয় নেই যারা মনে করে যে, বাংলাদেশ ছাড়াও তাদের নিরাপদ স্থান আছে, এ বাড়ীটাই যাদের একমাত্র বাড়ী নয়, তাদের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিরাপদ হতে পারে কি ?
বলিষ্ঠ সরকার চাইঃ স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন মনোবৃত্তি সম্পন্ন বলিষ্ঠসরকার ছাড়া দেশের আযাদী নিরাপদ হতে পারে না। আমাদের দেশে এমন মজবুত মানসিকতা সম্পন্ন সরকার হতে হবে যে প্রতিবেশী দেশের কোন প্রকারের বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় দিতে রাযী নয়। প্রতিবেশী ভারতের লোক বাংলাদেশ সীমান্তের ফসল কেটে নিয়ে যায়, সীমান্তের অভ্যন্তরে ঢুকে গরু চুরি করে নিয়ে যায়, নিরীহ মানুষকে হয়রানি করে ও খুন খারাবি করে। তারা আমাদের সমুদ্রবক্ষে জেগে ওঠা দীবপ দখল করে বসে। আমাদের জনগণকে এ বিষয়ে অবহিত করে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়ার মতো সরকার চাই।
গঙ্গার পানি ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে আটককরার পর ভারত এখন আসামের ধুবরী থেকে মোমেনশাহী, পাবনা রাজশাহী, ্ও কুষ্টিয়ার উপর দিয়ে খাল কেটে পানি নেবার দাবী জানাচ্ছে। আমাদের হাজার হাজার একর জমি ভারতের প্রয়োজন খালের জন্য দিতে হবে। প্রতিবেশী ভারতের এহেন আবদার সম্পর্কে জনগণের মনোভাব কি প্রকাশ প্ওায়া উচিত নয় ? আসামের বিদ্রাহী আন্দোলনকে দমন করার প্রয়োজনে বিব্রত ভারত সরকার কোলকাতা থেকে অল্প সময়ে আসাম পৌঁছার জন্য জলপথ কিংবা স্থলপথে বাংলাদেশের উপর দিয়ে ‘করিডোর’ দাবী করলে যে বলিষ্ঠতার সাথে এ দাবী প্রত্যাখ্যান করা দরকার তার অভাব হলে এদেশের নিরাপত্তা কী করে টিকবে ?
মুজিব আমলে ভারতের সাথে ২৫ বছরের যে গোপন চুক্তি হয়েছিল তা যদি বাংলাদেশের স্বার্থের বিরোধী হয়ে থাকে তাহলে সত্ত্বর বাতিল করা প্রয়োজন। পার্বত্য চট্টগ্রামে যে বিদ্রোহীদেরকে ভারত সাহায্য করছে তাদের সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা কি প্রয়োজন নয় ? গোটা বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে। এটা বিপন্ন হরে যে মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি হবে তা দেশবাসীকে অবহিত করা প্রয়োজন।
শক্তিতে ভারতের সাথে পারব না, এমন দুর্বল মানসিকতা হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। আত্মসম্মানবোধই স্বাধীনতার রক্ষাকবচ। আজকে পৃথিবীতে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ মেলে। উদাহরণ স্বরূপ ইরানের কথা তুলে ধরা যায়। শক্তিমান প্রতিবেশীর বাড়াবাড়ি থেকে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন সরকারই জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় সক্ষম। আত্মসম্মানবোধে জাতিকে উদ্ধুদ্ধ করা সরকারেরই দায়িত্ব। তাদের ডাকেই জনগণ জীবন দেয়। অসম্মানের সাথে বেঁচে থাকার চেয়ে সম্মান নিয়ে মরাই আত্মসম্মানবোধের দাবী। দুর্বল মানসিকতা নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার হেফাযত কখনও হবে না।
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিরক্ষা ঃ ভারত এদেশের সম্ভাব্য আক্রমণকারি হলেও সশস্ত্র আক্রমণ করার চাইতে সাংস্কৃতিক আক্রমণের পথই সহজতর মনে করবে। বাংগালী জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে বিশ্বাসীদের মন-মগজ ও চরিত্রকে সাহিত্য, সংগীত, নাটক, সিনেমা, চারু-শিল্প, ললিত কলা ইত্যাদির মাধ্যমে পশ্চিম বংগের অমুসলিমদের সাথে এতটা ঘনিষ্ঠ করতে চেষ্টা করবে যাতে তারা মুসলিম জাতীয়তার প্রভাব থেকে মুক্ত থাকে। এ জাতীয় লোকদের হাতে যাতে দেশের শাসন ক্ষমতা থাকে সে উদ্দেশ্যে ভারত সকল প্রকার প্রচেষ্ট চালাবে।
ভারত যদি এদেশের শিক্ষিত মুসলমানদের একটা বড় অংশকে মুসলিম জাতীয়তা পরিত্যাগ করাতে সক্ষম হয় তাহলে যে সাংস্কৃতিক বিজয় তাদের লাভ হবে তাতে রাজনৈতিক ময়দানে তাদের তাবেদার শক্তির প্রাধান্য অত্যন্ত সহজ হবে।
তাই এদেশকে ভারতের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে হলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ভবিষ্যত শিক্ষিতদের মন-মগজ ও চরিত্রকে ইসলামী জীবনাদর্শে গড়ে তোলা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই।
(আমার দেশ বাংলাদেশ)
এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার রক্ষক কারা ?
বাংলাদেশ একটি পৃথক স্বাধীন দেশ হিসেবে কায়েম হবার দেড় যুগ পরেও যারা ৭১-এর ভূমিকা নিয়ে হৈ চৈ করার চেষ্টা করেন, তারা একটা কথা গভীরভাবে বিবেচনা করেননি।
৭১-এর ভূমিকার কারণে যারা এদেশে ভারতবিরোধী ও ইসলামপন্থী হিসেবে চিহ্নিত, তাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ হবার পর এমন কোন কাজ হয়েছে কি, যা এদেশের স্বাধীনতার সামান্য বিরোধী বলে প্রমাণ করা যায়? একথা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য যে, এদেশের স্বাধীনতার উপর যদি কোথাও থেকে আঘাত আসে, তা একমাত্র ভারত থেকেই আসতে পারে। দেশের চারপাশে যদি ভারত ছাড়া আরও কয়েকটি দেশ থাকত, তাহলে এ বিষয় ভিন্ন মত পোষণের সুযোগ হতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভারতের ভূমিকার কারণে যারা এ বাস্তবতা থেকে চোক বন্ধ করে রাখতে চান, তারা জনগণ থেকে ভিন্ন চিন্তা করেন। জনগণকে বাদ দিয়ে দেশ রক্ষা সম্ভব নয়। নিঃসন্দেহে এদেশের জনগণ ভারত সরকারকে বন্ধু মনে করে না। তাদের কোন আচরণই বন্ধুসূলভ বলে প্রামাণিত নয়। এমনকি স্বাধীনতার আন্দোলনে ভারতের ভুমিকাকেও এদেশের মংগলের নিয়তে পালন করা হয়েছে বলে জনগণ বিশ্বাস করে না।
সশস্ত্র বাহিনীর উদ্দেশ্যই হলো প্রতিরক্ষা বা ডিফেন্স। “ডিফেন্স এগেইনস্ট হুম” বা “কার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা” প্রশ্নটি আপনিই মনে জাগে। যেহেতু একমাত্র ভারত থেকেই আক্রমণের সম্ভাবনা, সেহেতু এ প্রশ্নের জওয়াব ও একটাই।
তাছাড়া শুধু সশস্ত্র বাহিনী দিয়েই দেশ রক্ষা হয় না। জনগণ যদি সশস্ত্র বাহিনীর পেছনে না দাঁড়ায়, তাহলে সে বাহিনী কিছুতেই প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করতে পারে না। জনগণও একথা বিশ্বাস করে যে, এদেশের স্বাধীনতা তাদের হাতেই নিরাপদ, যারা ভারতকে আপন মনে করে না এবং ভারতও এদেশে যাদেরকে তার আপন মনে করে না। তাই ৭১-এর ভূমিকা দ্বারা যারা এদেশে ভারতের বন্ধু নয় বলে প্রমাণিত, তারা জনগণের আস্থাভাজনই আছে। যারা বিশেষ রাজনৈতিক গরজে তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন, তারা এ বিষয়ে জনগণের মধ্যে কোন সমর্থন যোগাড় করতে পারবেন না।
এদেশের জনগণ ভারত সরকারকে বন্ধু মনে করে না বলেই রাশিয়াকেও আপন মনে করে না। কারণ, রাশিয়ার নীতি সবসময়ই ভারতের পক্ষে দেখ গেছে। তাছাড়া, রুশ-দূতাবাসের কার্যকলাপ সম্পর্কে মাঝে মাঝে পত্র-পত্রিকায় যেসব খবর প্রকাশিত হয়, তাতে তাদের সম্পর্কে সুধারণা সৃষ্টি হওয়ার কোন কারণ নেই। বিশেষ করে আফগানিস্থানে রাশিয়ার নির্লজ্জ ভূমিকা জনমনে তীব্র ঘৃণাই সৃষ্টি করেছে।
এদেশে কারা রাশিয়ার আগ্রাসী ভূমিকাকে সমর্থন করে এবং করা ভারতের নিন্দনীয় ভূমিকাকে নীরবে সমর্থন করে, তা কোন গোপনীয় ব্যাপার নয়। সুতরাং তরা যখন জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে ৭১-এর ভূমিকার দোহাই দিয়ে চিৎকার জুড়ে দেয়, তখন তাদের নিজেদের হীন মতলবই ফাঁস হয়ে পড়ে। তাদের এ চিৎকারের অর্থ দেশপ্রেমিক জনগণের বুঝতে বেগ পেতে হয় না।
এদেশের জনগণ একথা দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করে যে, ৭১-এ যারা ভারত বিরোধী বলে প্রমাণিত হয়েছে, তারা কোন অবস্থায়ই ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের উপর কোন হস্তক্ষেপ বরদাশত করবে না। আর যারা এদেশে ইসলামকে বিজয়ী দেখতে চায়, তারাই দেশরক্ষার জন্য প্রাণ দেবার বেলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। সুতরাং ৭১-এর ভূমিকার ভিত্তিতে তাদের সরকারের বন্ধু বলেই জনগণের নিকট বিবেচিত হবে।
আর একটা বাস্তবতা হলো এই যে, এদেশে কোন গৃহযুদ্ধ লাগলেও যারা ভারতের কোন আশ্রয় আশা করে না, তারাই এদেশকে রক্ষা করবে। যাদের আর কোথাও যাবার পথ নেই, তারাই মরিয়া হয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য এগিয়ে আসবে। কারণ, এছাড়া তাদের আর কোন উপায় নেই। তাদের জীবন ও মরণ এদেশেই নির্ধারিত। যারা সবসময় ভারতের আধিপত্যবাদী ভূমিকার বিরোধী তাদেরকেই জনগণ এদেশে স্বাধীনতার প্রকৃত রক্ষক বলে মনে করে। দেশে কোন রকমের রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলে যারা ভারত সরকারের মেহমান হিসেবে সে দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পান, তারা কী করে আশ্রয়দাতা দেশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন ? এদেশ ছাড়াও যাদের আশ্রয় আছে, তারা কি এদেশের হিফাযত করতে পারবেন ? (পলাশী থেকে বাংলাদেশ)
ইসলামপন্থীদের ৭১ পরবর্তী ভূমিকা
৭১-এর রাজনৈতিক মতপার্থক্য জিইয়ে রাখা অবান্তর। তখন এমন এক দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে দেশপ্রেকিদের মধ্যে দেশের কল্যাণ কোন পথে সে বিষয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়ে গেল। এক পক্ষ মনে করল যে পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়া ছাড়া মুক্তি নেই। অপর পক্ষ মনে করল যে পৃথক হলে ভারতের খপ্পরে পড়তে হবে। এক পক্ষ অপর পক্ষকে “পাঞ্জাবের দালাল” আর “ভারতের দালাল” মনে করত। কিন্তু এসব গালি দ্বারা কোন পক্ষের দেশপ্রেমই মিথ্যা হয়ে যায় না। ঐ সময়কার দুঃখজনক মতবিরোধকে ভিত্তি করে যদি এখনও বিভেদ জারী রাখা হয় তাহলে জাতি হিসেবে আমরা ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে যেতে বাধ্য হব।
দুনিয়ার মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কায়েম হবার পর সব ইসলামপন্থী দল ও ব্যক্তি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিয়ে নিজেদের জন্মভূমিতে সাধ্যমত ইসলামের খেদমত করার চেষ্টা করছে। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার নারায়ে তাকবীর- আল্লাহু আকবার ধ্বনি স্বাধীনতা বিরোধী চক্রান্তকে নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়। ১৯৭৭ সালে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ খতম করে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, আল্লাহর প্রতি ঈমান ও দৃঢ় আস্থা এবং সমাজতন্ত্রের ভিন্ন ব্যাখ্যা সংবিধানে সন্নিবিশীত করার পর জনগণ রেফানেন্ডামের মাধ্যমে তাকে স্বাগত জনাবার ফলে ইসলামপন্থী দলগুলো বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য শাসনতান্ত্রিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। এভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এদেশের মুসলমানদের জন্য তাদের ঈমান নিয়ে বেঁচে থাকার অনুকূলে পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছেন।
বাংলাদেশ ভৌগলিক দিক দিয়ে মুসলিম বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটা এলাকা। আর কোন মুসলিম দেশ এমন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় নেই। তদুপরি আমাদের এ প্রিয় জন্মভূমিটি এমন একটি দেশ দ্বারা বেষ্টিত যাকে আপন মনে করা মুস্কিল। তাই এদেশের আযাদীর হিফাযত করা সহজ ব্যাপার নয়। জনগণ এ ক্ষেত্রে একেবারেই বন্ধুহীন। আশপাশ থেকে সামান্য সাহায্য পাওয়ারও কোন আশা করা যায় না। এ দেশবাসীকে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে নিজেদের শক্তি নিয়েই প্রতিরক্ষার কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হবে।
যে কোন জাতির আদর্শ ও বিশ্বাসই তার শক্তির উৎস। সুতরাং এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনাদর্শ ইসলামেই স্বাধীনতার আসল গ্যারান্টি। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামপন্থী সকলেই এ মহান উদ্দেশ্যেই কাজ করে যাচ্ছে। তাই জনগণের নিকট তাদের চেয়ে বেশী আপন আর কেউ হতে পারে না। (পলাশী থেকে বাংলাদেশ)