স্বাধীনতা আন্দোলনে কার কী ভূমিকা
স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলন
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ভারতে আশ্রয় নিলেন। অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ এবং সমাজতান্ত্রিক দলের অধিকাংশ নেতাই তাই করলেন। পাক সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে এবং অন্যান্য স্থানে হিন্দু বসতীর উপরও আক্রমন করায় তাঁরাও দলে দলে ভারতে পাড়ি জমালেন। পাক সেনাবাহিনীর ভ্রান্ত নীতির ফলে দেশের গোটা হিন্দু সম্প্রদায় পাকিস্তান বিরোধী হয়ে গেলো। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী এবং অধিকাংশ সমাজতন্ত্রী দল পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার জন্যে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হল।
মেহেরপুর জেলার মফস্বলে ( যে স্থানের বর্তমান নাম মুজিবনগর ) আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার কায়েম করার পর স্বাধীনতা আন্দোলন যে রূপ পরিগ্রহ করলো, তা কোন বিদেশী সরকারের সাহায্য ছাড়া চলা সম্ভব ছিল না। তাই কোলকাতা থেকেই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত হয়।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
বামপন্থীদের ভূমিকা
রুশপন্থী হউক আর চীন পন্থী হউক কমিউনিস্ট এবং তথাকথিত বামপন্থীরা কোন দিনই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নয়। গনতান্ত্রিক পন্থায় কমিউনিজম কোন দেশেই কায়েম হয়নি এবং কোন কমিউনিস্ট দেশেই গণতন্ত্র নেই। তাই জনগণকে ধোঁকা দেবার জন্য গণতন্ত্রের এ দুশমনেরা সমাজতন্ত্রের শ্লোগানই দেয়। কমিউনিজমের নাম নিতে সাহস পায়না। বিশেষ করে মুসলমানদের নিকট কমিউনিস্টরা কখনোই গ্রহনযোগ্য নয়।
আযাদী আন্দোলনের সময় এরা ভারত বিভাগের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল এবং পাকিস্তানের পক্ষে ক্ষতিকর প্রতিটি ব্যাপারে এরা উৎসাহের সাথে কাজ করেছে। ইয়াহিয়া- মুজিব আলোচনা ব্যর্থ করার জন্য এরা উঠেপড়ে লাগে। এরা ভয় পাচ্ছিলো যদি জনগনের সরকার কায়েম হয় তাহলে এদের কোন সুযোগ থাকবে না। এরা নির্বাচনে কোন পাত্তাই পায়না। এদের দুটি দল তো নির্বাচন থেকে পালিয়েই যায়। মস্কোপন্থী ন্যাপ দু’একটি আসন ছাড়া সর্বত্র জামানত পর্যন্ত হারিয়েছে এবং ৮-৯ টি দলের মধ্যে এরা সবচেয়ে কম ভোট পেয়েছে। নির্বাচনে যারা জয়লাভ করলো তারা যখন রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য চেষ্টা করছিলো তখন গণতন্ত্রের এ দুশমনেরা তা ব্যর্থ করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করলো এর পরিণাম আজ যখন বাংলার মানুষ কঠিন বিপর্যয়ের সম্মুখীন তখন এরাই ঘলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। অথচ এদের নিকট দেশের কোন সমস্যারই সমাধান নেই। বিদেশী কোন রাষ্ট্রের লেজুড় বানিয়ে দেশকে একনায়কত্তের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা ছাড়া এদের আর কোন পথই বা জানা আছে ? রুশপন্থী এবং চীনপন্থী পরিচয় কি বিদেশী হবার প্রমান নয় ?
( বাঙ্গালী মুসলমান কোন পথে )
ভারতের ভূমিকা
পাকিস্তানের চির দুশমন ভারতের সম্প্রসারনবাদী কংগ্রেস সরকার এই মহাসুযোগ গ্রহন করলো। প্রবাসী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে কোলকাতায় প্রতিষ্ঠিত করা হল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের গেরিলা ট্রেনিং দেয়া, তাঁদেরকে অস্ত্র এবং গ্রেনেড দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানো, রেডিওযোগে প্রবাসী সরকারের বক্তব্য বাংলাদেশের ভেতরে প্রচার করা ইত্যাদি সবই ভারত সরকারের সক্রিয় উদ্যোগ ও সহযোগিতায় চলতে থাকলো। রুশ সরকারও এ বিষয়ে ভারতের সাথে এক সহযোগিতা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং বহু দেশ সফর করে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন যোগানোর চেষ্টা করেন। নিঃসন্দেহে এ সবই বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিনত করতে সাহায্য করেছে। কিন্তু ভারত সরকার তাঁর স্বার্থেই এ কাজে উদ্বুদ্ধ হয়েছে বলে সবাই স্বীকার করতে বাধ্য।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
ভারত বিরোধীদের পেরেশানী
পাকিস্তান আন্দোলনের সময় থেকে যারা ভারতীয় কংগ্রেসের আচরন লক্ষ্য করে এসেছে, পাকিস্তান কায়েম হবার পর ভারতের নেহেরু সরকার হায়দ্রাবাদ এবং কাশ্মীর নিয়ে যে হিংস্র খেলা দেখিয়েছেন, মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমিকে পঙ্গু করার জন্য যতরকম প্রচেষ্টা ভারতের পক্ষ থেকে হয়েছে, পূর্ব বাংলার সীমান্ত নিয়ে ভারত বার বার যে ধোঁকাবাজি করেছে, সর্বোপরি ফারাক্কা বাধ দিয়ে গংগার পানি আটকে রেখে উত্তরবঙ্গকে মরুভূমি বানাবার যে ব্যবস্থা করেছে, তাতে এদেশের কোন সচেতন মুসলিমের পক্ষে ভারত সরকারকে এদেশের বন্ধু মনে করা কিছুতেই সম্ভব ছিল না।
যেসব রাজনৈতিক দল এবং নেতা ভারতের আধিপত্যবাদী মনোভাবের দরুন আতংকগ্রস্থ ছিল, তারা মহাসংকটে পরে গেলো। তারা সংগত কারনেই আশংকা করলো যে, বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সাহায্য করে ভারত একদিকে মুসলমানদের উপর “ভারত মাতাকে” বিভক্ত করার প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে, কোলকাতার এককালের অর্থনৈতিক পশ্চাৎভূমি বাংলাদেশ অঞ্চলকে পুনরায় হাতের মুঠোয় আনার মহাসুযোগ গ্রহন করেছে। এ অবস্থায় ভারতের নেতৃত্বে ও সাহায্যে বাংলাদেশ কায়েম হলে ভারতের আধিপত্য থেকে আত্মরক্ষার কোন উপায়ই হয়তো থাকবে না। বাংলাদেশের চারিদিকে ভারতের যে অবস্থান তাতে এ আশংকাই স্বাভাবিক ছিল।
বিশেষ করে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর যে হিংস্র আচরন অব্যাহতভাবে চলছিলো, তাতে প্রত্যেক সচেতন মুসলিমের অন্তরেই পেরেশানী সৃষ্টি হলো। ভারতের সম্প্রসারনবাদী মনোভাব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কারো পক্ষে আতংকগ্রস্ত না হয়ে উপায় ছিল না।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
ইসলামপন্থীদের সংকট
যারা মুসলিম জাতীওতায় বিশ্বাসী ছিল এবং যারা চেয়েছিল যে, দেশে আল্লাহর আইন ও রাসুলের প্রদর্শিত সমাজব্যবস্থা চালু হোক, তারা আরও বড় সংকটের সম্মুখীন হল। তারা তো স্বাভাবিক কারনেই ভারতের ব্রাহ্মন্যবাদী চক্রান্তের বিরোধী ছিল। তদুপরি স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনকারীদের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রী চেহারা তাঁদেরকে চরমভাবে আতংকিত করে তুললো। তারা মনে করলো যে, ইসলামের নামে পাকিস্তান কায়েম হওয়া সত্ত্বেও যখন ইসলাম বিজয়ী হতে পারলো না, তখন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী ও সমাজতন্ত্রীরা যদি ভারতের সাহায্যে কোন রাষ্ট্র কায়েম করতে পারে, তাহলে সেখানে ইসলামের বিজয় কী করে সম্ভব হবে?
ভারতে মুসলমানদের যে দুর্দশা হচ্ছে, তাতে ভারতের সাহায্যে বাংলাদেশ কায়েম হলে এখানেও কোন দুরবস্থা নেমে আসে, সে আশংকাও তাঁদের মনে কম ছিল না।
স্বাধীন বাংলাদেশ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ যদি শুধু রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের প্রশ্ন তুলতেন, ধরমনিরপেক্ষতবাদ ও সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা যদি তারা না হতেন এবং ভারতের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া যদি আন্দোলন পরিচালনা করতে সক্ষম হতেন, তাহলে ইসলামপন্থীদের পক্ষে ঐ আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা খুবই স্বাভাবিক ও সহজ হতো।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
ভারত বিরোধী এবং ইসলামপন্থীদের ভূমিকা
ভারত বিরোধী এবং ইসলামপন্থীরা উভয় সংকতে পড়ে গেলো। যদিও তারা ইয়াহিয়া সরকারের সন্ত্রাসবাদী দমননীতিকে দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর মনে করতেন, তবু এর প্রকাশ্য বিরোধিতা করার কোন সাধ্য তাঁদের ছিল না। বিরোধিতা করতে হলে তাঁদের নেতৃস্থানীয়দেরকেও অন্যদের মতো ভারতে চলে যেতে হতো— যা তাঁদের পক্ষে চিন্তা করাও অসম্ভব ছিল।
তারা একদিকে দেখতে পেলো যে, মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা আক্রমন করে ইয়াহিয়া সরকারকে বিব্রত করার জন্য কোন গ্রামে রাতে আশ্রয় নিয়ে কোন পুল বা থানায় বোমা ফেলেছে, আর সকালে পাকবাহিনী গিয়ে ঐ গ্রামটিই জ্বালিয়ে দিয়েছে। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা কোন বাড়িতে উঠলে পরদিন ঐ বাড়িতেই সেনাবাহিনীর হামলা হয়ে যায়। এভাবে জনগন এক চরম অসহায় অবস্থায় পড়ে গেলো।
ভারতবিরোধী এবং ইসলামপন্থীরা শান্তি কমিটি কায়েম করে সামরিক সরকার ও অসহায় জনগনের মধ্যে যোগসূত্র কায়েম করার চেষ্টা করলেন, যাতে জনগণকে রক্ষা করা যায় এবং সামরিক সরকারকে যুলুম করা থেকে যথাসাধ্য ফিরিয়ে রাখা যায়। শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে সামরিক শাসকদেরকে তাঁদের ভ্রান্ত নীতি অন্যায় বাড়াবাড়ি থেকে ফিরাবার যথেষ্ট চেষ্টা করা হয়েছে।
একথা ঠিক যে, শান্তি কমিটিতে যারা ছিলেন, তাঁদের সবার চারিত্রিক মান এক ছিল না। তাঁদের মধ্যে এমন লোকও ছিল, যারা সুযোগ মতো অন্যায়ভাবে বিভিন্ন স্বার্থ আদায় করেছে।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ভূমিকা
ইসলামের নামে পাকিস্তান কায়েম হলেও পাকিস্তানের কোন সরকারই ইসলামের ভিত্তিতে দেশকে গড়ে তুলবার চেষ্টা করেনি। জামায়াতে ইসলামী যেহেতু ইসলামকে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে একটি বিজ্ঞান সম্মত কর্মসূচী অনুযায়ী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল, সেহেতু কোন সরকারই জামায়াতকে সুনজরে দেখেনি।
তদুপরি ইসলামের নীতি অনুযায়ী গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করার জন্য জামায়াতে ইসলামী প্রতিটি গনতান্ত্রিক আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে এসেছে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের সামরিক আইন তুলে নেবার পর আইয়ুবের তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে সর্বদলীয় গনতান্ত্রিক আন্দোলন চলেছিল, তাতে জামায়াত কোন দলের পেছনে ছিল না।
এভাবেই জামায়াতে ইসলামী আইন এবং গনতান্ত্রিক পদ্ধতির শাসনের জন্য নিষ্ঠার সাথে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলো। ১৯৬২ সাল থেকে ৬৯ সাল পর্যন্ত আইয়ুব আমলের ৮ বছরের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ছাড়া আর কোন দলকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়নি। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারীতে জামায়াতকে বেআইনি ঘোষণা করে ৯ মাস পর্যন্ত ৬০ জন নেতাকে বিনা বিচারে জেলে বন্দী করে রাখা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে সুপ্রীম কোর্টের রায়ের ফলে সরকারের ঐ বেআইনি ঘোষণাটি বাতিল হয়ে যায়।
জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস ইসলামী আদর্শ এবং গনতান্ত্রিক পদ্ধতির পক্ষে একনিষ্ঠ ও বলিষ্ঠ সংগ্রামেরই গৌরবময় ইতিহাস। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী রাজনীতির ময়দানে যে ভূমিকা পালন করছে, তা সবার সামনেই আছে। জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ভূমিকা পাকিস্তান আমলে যেমন স্বীকৃত ছিল, তেমনি বর্তমানেও সর্বমহলে প্রশংসিত।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
৭১- এ জামায়াতের ভূমিকা
জামায়াতে ইসলামীর অতীত এবং বর্তমান ভূমিকা থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, আদর্শ নীতির প্রশ্নে জামায়াত আপোষহীন। দুনিয়ার কোন স্বার্থে জামায়াত কখনো আদর্শ বা নীতি সামান্যও বিসর্জন দেয়নি। এটুকু মূলকথা যারা উপলব্ধি করে, তাঁদের পক্ষে ৭১- এ জামায়াতের ভূমিকা বুঝতে কোন অসুবিধা হবার কথা নয়।
প্রথমতঃ আদর্শগত কারনেই জামায়াতের পক্ষে ধর্মনিরপেক্ষমতবাদ ও সমাজতন্ত্রের ধারক এবং বাহকদের সহযোগী হওয়া সম্ভব ছিল না। যারা ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে সচেতনভাবে বিশ্বাস করে, তারা এই দুইটি মতবাদকে তাঁদের ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী মনে করতে বাধ্য। অবিভক্ত ভারতে কংগ্রেস দলের আদর্শ ছিল ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ। জামায়াতে ইসলামী তখন থেকেই এ মতবাদের অসারতা বলিষ্ঠভাবে যুক্তি দিয়ে প্রমান করেছে। আর সমাজতন্ত্রের ভিত্তিই হল ধর্মনিরপেক্ষতা।
দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তান সরকারের প্রতি ভারত সরকারের অতীত আচরন থেকে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে ইন্দিরা গান্ধীকে এদেশের এবং মুসলিম জনগনের বন্ধু মনে করাও কঠিন ছিল। ভারতের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সংগত কারনেই তাঁদের যে আধিপত্য সৃষ্টি হবে এর পরিণাম মঙ্গলজনক হতে পারে না বলেই জামায়াতের প্রবল আশংকা ছিল।
তৃতীয়তঃ জামায়াত একথা বিশ্বাস করতো যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে বেশী হওয়ার কারনে গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হলে গোটা পাকিস্তানে এ অঞ্চলের প্রাধান্য সৃষ্টি হওয়া সম্ভব হবে। তাই জনগনের হাতে ক্ষমতা বহাল করার আন্দোলনের মাধ্যমেই জামায়াত এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার অর্জন করতে চেয়েছিল।
চতুর্থতঃ জামায়াত বিশ্বাস করতো যে, প্রতিবেশী সম্প্রসারনবাদী দেশটির বাড়াবাড়ি থেকে বাঁচতে হলে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে এক রাষ্ট্রভুক্ত থাকাই সুবিধাজনক। আলাদা হয়ে গেলে ভারত সরকারের আধিপত্য রোধ করা পূর্বাঞ্চলের একার পক্ষে বেশী কঠিন হবে। মুসলিম বিশ্ব থেকে ভৌগলিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ভারত দ্বারা বেষ্টিত অবস্থায় এ অঞ্চলের নিরাপত্তার প্রশ্নটি জামায়াতের নিকট উদ্বেগের বিষয় ছিল।
পঞ্চমতঃ পাকিস্তান সরকারের ভ্রান্ত অর্থনৈতিক পলিসির কারনে এ অঞ্চলে স্থানীয় পূঁজির বিকাশ আশানুরূপ হতে পারেনি। এ অবস্থায় এদেশটি ভারতের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক খপ্পরে পড়লে আমরা অধিকতর শোষণ এবং বঞ্চনার শিকারে পরিনত হবো বলে জামায়াত আশংকা পোষণ করতো।
জামায়াত একথা মনে করতো যে, বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে ভারতের সাথে সমমর্যাদায় লেনদেন সম্ভব হবে না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যেসব জিনিস এখানে আমদানী করা হতো, আলাদা হবার পর সেসব ভারত থেকে নিতে হবে। কিন্তু এর বদলে ভারত আমাদের জিনিস সমপরিমানে নিতে পারবে না কারন রফতানির ক্ষেত্রে ভারত আমাদের প্রতিযোগী দেশ হওয়ায় আমরা যা রফতানি করতে পারি ভারতের তাঁর প্রয়োজন নেই। ফলে আমরা অসম বাণিজ্যের সমস্যায় পড়বো এবং এদেশ কার্যত ভারতের বাজারে পরিনত হবে।
ষষ্ঠতঃ জামায়াত পূর্ণাঙ্গ ইসলামী সমাজ কায়েমের মাধ্যমেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সৃষ্ট সমস্যা এবং সকল বৈষম্যের অবসান করতে চেয়েছিল। জামায়াতের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর আইন এবং সৎ লোকের শাসন কায়েম হলে বে- ইনসাফী, যুলুম এবং বৈষম্যের অবসান ঘটবে এবং অসহায় বঞ্চিত মানুষের সত্যিকার মুক্তি ঘটবে।
এসব কারনে জামায়াতে ইসলামী তখন আলাদা হবার পক্ষে ছিল না। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর থেকে এদেশে যারাই জামায়াতের সাথে জড়িত ছিল, তাঁর বাস্তব সত্য হিসেবে বাংলাদেশকে একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই মেনে নিয়েছে। আজ পর্যন্ত জামায়াতের লোকেরা এমন কোন আন্দোলন বা প্রচেষ্টার সাথে শরীক হয়নি যা বাংলাদেশের আনুগত্যের সামান্যতম বিরোধী বলেও বিবেচিত হতে পারে। বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তারা বাস্তব কারনেই যোগ্য ভূমিকা পালন করছে। তারা কোন প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় পাবে না। তাই এদেশকে বাঁচাবার জন্য জীবন দেয়া ছাড়া তাঁদের কোন বিকল্প পথ নেই।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )