গণতন্ত্র ও ইসলাম
বিশ্ব নবীর জীবনে রাজনীতি
রাসুলুল্লাহর ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ) জীবনে রাজনীতির স্থান সম্বন্ধে আলোচনা করা আজ নানা কারনে অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ পরাধীনতার পরিনামে ধার্মিকদের মধ্যেও আজ এমন লোক সৃষ্টি হয়েছে যারা দ্বীনদার এবং পরহেজগার বলে সমাজে পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও “রাজনীতি” করাকে নিন্দনীয় মনে করেন, অথবা অন্তত পক্ষে অপছন্দ করেন। তারা দেশের রাজনীতি থেকে পরহেজ করাকে ( নিজেদেরকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখাকে ) দ্বীনদারি এবং তাকওয়ার জন্য জরুরী মনে করেন। আবার আর এক শ্রেনীর লোক পাশ্চাত্য চিন্তাধারা, মতবাদ এবং জীবন দর্শনের অনুসারী হওয়ার ফলে ইসলামকেও খ্রিস্ট ধর্মের ন্যায় এক অনুষ্ঠান সর্বস্ব পুজা পার্বণ বিশিষ্ট ধর্মমত বলে মনে করেন। তাদের ঈমান মতে ধর্ম এবং রাজনীতি সম্পূর্ণ পৃথক। খ্রিস্ট ধর্মযাজকদের সাথে জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধকদের আড়াই শত বছরের দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ইউরোপ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে মতবাদ হিসেবে গ্রহণ করে। ইউরোপের পদানত থাকা অবস্থায় প্রায় সকল মুসলিম দেশেই সে মতাদর্শ প্রতিস্থিত হয়।
ইসলামের সঠিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত থাকা অবস্থায় যেসব মুসলিম পাশ্চাত্যের শিক্ষা এবং জীবন দর্শনের দীক্ষা গ্রহণ করেছেন প্রধানত তারাই আজ স্বাধীন মুসলিম দেশগুলোর পরিচালক। ইসলামকে পূর্ণাংগ জীবন বিধান হিসেবে সমাজ এবং রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে যে কয়টি ইসলামী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে এর প্রত্যেকটিই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী শাসক গোষ্ঠীর গাত্রদাহ সৃষ্টি করেছে। তারা ইসলামকে খ্রিস্ট ধর্মের মতই শুধু কেবলমাত্র ব্যক্তিগত জীবনে পালন যোগ্য একটি ধর্মে পরিনত করতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন এবং রাজনীতির বিশাল ক্ষেত্রটিকে ধর্মের আওতা থেকে পৃথক করার পরিকল্পনা এঁটেছেন।
এভাবে কতক ধার্মিক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের দিকে লক্ষ্য না করে তাকে এমন ভাবে চিত্রিত করেন যেন আল্লাহর নবী কোন সংসারত্যাগী কোন বৈরাগী ছিলেন ( নাওউজুবিল্লাহ )। ওদিকে মুসলিম নামধারী শাসকেরাও রাসুলকে ( সাঃ ) শুধু ধর্মীয় নেতা হিসেবেই স্বীকার ( গ্রহণ নয় ) করতে প্রস্তুত। মহানবীর সামগ্রিক জীবনকে একক এবং পূর্ণাংগ সত্ত্বা হিসেবে গ্রহণ না করার মনোভাবটি উদ্দেশ্য মূলক হলেও কিছু সরল মুসলমান এর দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে থাকে।
বিশেষ করে ধর্মীয় এবং সমাজসেবামূলক বহু প্রতিষ্ঠান রাজনীতি থেকে দূরে থেকে ইসলামের নামে আন্তরিকতার সাথে খেদমত করেছেন বলে উপরোক্ত স্বার্থপর লোকেরা ইসলামকে নিয়ে রাজনীতি না করার পক্ষে ঐ সকল প্রতিষ্ঠানের নজীর পেশ করেন। তাদের মতে দুনিয়ার সব মত এবং পথ নিয়ে রাজনীতি করা যায়েয হলেও ইসলামী আদর্শকে নিয়ে রাজনীতির ময়দানে অবতীর্ণ হওয়া একেবারেই অন্যায়। এসব ভ্রান্ত ধারণা দূর করার উদ্দেশ্যে “বিশ্ব নবীর জীবনে রাজনীতি” ছিল কি-না এবং ইসলামে রাজনীতি জরুরী কি- না তা আলোচনা করা প্রয়োজন।
রাজনৈতিক কার্যকলাপ
সরকারী ক্ষমতা যাদের হাতে থাকে তাদেরকে সংশোধন করা, তাদের কার্যাবলীর সমালোচনা করা, সরকারী নীতির ভ্রান্তি প্রকাশ করে জনগণকে সচেতন করা এবং এ জাতীয় যাবতীয় কাজকেই রাজনৈতিক কার্যাবলী হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের প্রচেষ্টাই হল সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক কাজ, ভ্রান্ত নীতি এবং আদর্শে রাষ্ট্র পরিচালিত হতে দেখলে সরকারী কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতাচ্যুত করে সঠিক শাসন ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টাই প্রধান রাজনৈতিক কার্যকলাপ।
বিশ্ব নবীর দায়িত্ব
এখন দেখা যাক, আল্লাহ পাক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে বিরাট কাজ কররা দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন, তা পালন করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালাতে হয়েছিল কি- না। যদি তিনি নবী হিসেবে রাজনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত হয়েছিলেন বলে জানা যায় তাহলে রাজনীতি করা ইসলামের তাগিদ বলেই মনে করতে হবে। নবী বলে ঘোষিত হবার পর থেকে যদি তার গোটা জীবনই আমাদের জীবনে আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয় তা হলে তার রাজনৈতিক কাজগুলো অনুসরণ করতে কি বাধা থাকতে পারে ? হযরতের উপরে কি দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল এবং তিনি কিভাবে তা পালন করেছিলেন তা আলোচনা করলেই বিশ্ব নবীর জীবনে রাজনীতি কতটা ছিল সে কথা স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাবে।
আল্লাহ পাক তার রাসুলকে কোন কর্তব্য দিয়ে পাঠিয়েছিলেন, কুরআন মাযীদের বহুস্থানে বিভিন্নভাবে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তা সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ বলেনঃ
আয়াত***
“তিনিই ঐ সত্ত্বা যিনি তার রাসুলকে হেদায়াত এবং দ্বীনে হক সহ পাঠিয়েছেন, যাতে আর সব দ্বীনের উপর একে ( দ্বীনে হক ) বিজয়ী করে তুলতে পারেন। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালাই সাক্ষী হিসেবে যথেষ্ট।”
এ আয়াতের শেষাংশটুকু অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আল্লাহ তার রাসুলকে প্রধানত কোন কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছেন সে সম্পর্কে আল্লাহর চেয়ে বেশী কারো পক্ষে জানবার উপায় নেই। সুতরাং সে বিষয়ে অন্য কারো সাক্ষ্যই গ্রাহ্য নয় – আল্লাহর সাক্ষ্যই সেখানে যথেষ্ট।
রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) এর জীবনকে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার করে কোন একটা দিক বা বিভাগকে নিজেদের রুচীমত প্রধান দিক বলে সাব্যস্ত করতে গিয়ে অনেক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। সাত অন্ধের হাতী দেখার ন্যায় কেউ তার বিশাল জীবনের একাংশ থেকে শুধু হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন দিকটিকেই প্রধান বলে গ্রহণ করেছেন। কেউ তার নামায- রোযা, তাসবীহ- তেলাওয়াত এবং তাহাজ্জুদের দিকটাই প্রধান বলে গ্রহন করেছেন। কেউ তাকে একজন আরব জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবেই দেখেছেন। আর কেউবা শুধু সর্বহারাদের নেতা হিসেবে চিত্রিত করে নিজ নিজ মত এবং পথের সমর্থনে রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) কে দলীল হিসেবে পেশ করার চেষ্টা করেছেন।
এ জাতীয় সবাই রাসুলের গোটা জীবনকে একসাথে বিবেচনা করে রাসুলের জীবনের মূল লক্ষ্যটুকু বুঝতে সক্ষম হননি। তারা অন্ধের মতই হাতিয়ে যেটুকু দেখতে পেয়েছেন সেটুকুই রাসুলের গোটা জীবন বলে ধারণা করেছেন। এদের অনেকেই হয়তো সাত অন্ধের ন্যায় আন্তরিকরার সাথেই নিজ নিজ সিদ্ধান্তে পৌছেছেন। কিন্তু মহান আল্লাহ সয়ং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামকে যে উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছেন বলে ঘোষণা করেছেন তার সাথে এদের ধারণার কোন মিল নেই।
হেরাগুহায় হযরতের ধ্যানমগ্ন থাকা, নামায- রোযায় মশগুল হওয়া, শেষ রাতে তাহাজ্জুদে নিমগ্ন হওয়া এবং সর্বহারাদের দুর্গতি দূর করার চেষ্টা চালান – এসবই তার জীবনে লক্ষ্য করা যায় সত্য। এগুলো তার কর্মবহুল জীবনের বিভিন্ন ঘটনা হলেও এর কোনটিই বিচ্ছিন্ন নয়। এসবই হযরতের মূল দায়িত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং তার মূল লক্ষ্যে পৌছার উপযোগী। কিন্তু ঐ সব কাজের কোনটাই রাসুলকে পাঠাবার প্রধান উদ্দেশ্য নয়।
রাসুলের প্রধান দায়িত্ব
পূর্বোল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ পাক তার রাসুলকে পাঠাবার যে উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন সেটাই নবী জীবনের প্রধান দায়িত্ব। উক্ত আয়াতে বলা হয়েছে যে, রাসুলকে একমাত্র দীনে হক দিয়ে দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে এবং মানব রচিত যাবতীয় দীনের উপর আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করার উদ্দেশ্যে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এতে স্পষ্ট বুঝা গেলো যে, রাসুলকে কেবলমাত্র একজন প্রচারক বা ধর্ম নেতার দায়িত্ব দেয়া হয়নি। দীন ইসলাম রূপ পূর্ণাংগ জীবন বিধানটিকে একটি বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করাই হযরতের প্রধান দায়িত্ব ছিল। দীন ইসলামকে মানব সমাজে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠা করাই নবী জীবনের মূল উদ্দেশ্য ছিল। তিনি যখন করেছেন একমাত্র সে লক্ষ্যে পৌছার জন্যই করেছেন এবং সে চরম লক্ষ্যে পৌঁছাবার উদ্দেশ্যেই একটি বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনা করেছেন।
রাসুলের বিপ্লবী আন্দোলন
মানব সমাজে কোন না কোন ব্যবস্থা কায়েমে থাকেই। সামাজিক রীতি- নীতি, আইন, শাসন, বিচার, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় প্রথা ইত্যাদি সমাজে প্রচলিত থাকে। যে সমাজ ব্যবস্থা পূর্ব থেকেই প্রতিষ্ঠিত থাকে তা যেমন আপনীই কায়েম থাকে না তেমনি তা আপনা আপনিই উৎখাত হয় না। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং ধর্মীয় নেতৃত্বই প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে কায়েম রাখে। যখন কেউ এ ব্যবস্থাকে উৎখাত করার আওয়াজ তুলে তখনই সর্ব শ্রেনীর নেতৃত্ব একজোট হয়ে এর বিরোধিতা করে। কারন এসব নেতৃত্বের স্বার্থ প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম থাকার মধ্যেই সম্ভব। এগুলোই প্রচলিত সমাজের কায়েমী স্বার্থ ( Vested Interest )। প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থাকে উৎখাত করার জন্য যখনই কোন প্রচেষ্টা চলে তখনই কায়েমী নেতৃত্বের সাথে সংঘর্ষ বাধে। ধর্মীয় এবং সামাজিক রীতি- নীতি, আইন ও শাসন এবং অর্থনৈতিক কাঠামো মিলে যে সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকে তাকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে নতুন রূপে নতুন ধরনের নীতি এবং আদর্শে সমাজকে গঠন করার আওয়াজ উঠবার সংগে সংগেই কায়েমী নেতৃত্ব চঞ্চল হয়ে উঠে এবং এ আওয়াজকে বন্ধ করার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। সমাজে এ ধরনের ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করাকে বিপ্লব বলে। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ব্যতীত উত্থান পতন বা দল বিশেষের নাটকীয় ক্ষমতা দখলকে বিপ্লব নাম দিলেও তাকে প্রকৃত বিপ্লব বলা চলে না। গোটা সমাজে মৌলিক এবং ব্যাপক পরিবর্তনকেই বিপ্লব বলে। এ ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য যে আন্দোলনের প্রয়োজন তারই নাম বিপ্লবী আন্দোলন।
রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) আরব ভূমিতে যে ব্যাপক বিপ্লব সৃষ্টি করেছিলেন তা হঠাৎ সংঘটিত হয়নি। আরবের প্রচলিত সমাজকে সম্পূর্ণরূপে বদলিয়ে দেয়ার জন্য রাসুলকে কালেমা তাইয়েবার ভিত্তিতে এক বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করতে হয় এবং দীর্ঘ তেইশ বছরের অবিরাম চেষ্টায় সে আন্দোলন সফল হয়।
দুনিয়ার ইতিহাসে এরূপ কোন নযীর পাওয়া যায় না যে, কায়েমী নেতৃত্ব কোন বিপ্লবী আওয়াজ শুনেই নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়বার জন্য খুশী হয়ে নেতৃত্বের আসন ত্যাগ করে সরে দাঁড়িয়েছে। বরং সব সমাজেই সর্বকালেই দেখা গেছে যে, কায়েমী নেতৃত্বের অধিকারীরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতা আঁকড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেছে এবং বিপ্লবী আন্দোলন ক্রমে ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করে তাদেরকে উৎখাত করেছে।
রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) এর বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ইসলামী আদর্শে সমাজ ব্যবস্থাকে গড়ে তুলবার যে দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত ছিল, তা পালন করার প্রথম পদক্ষেপেই মক্কার নেতৃত্ব অস্থির হয়ে উঠলো। পহেলা পহেলা লোভ দেখিয়ে তাকে এ পথ থেকে নিবৃত করার চেষ্টা করলো। কালেমা তাইয়্যেবার বিপ্লবী দাওয়াত থেকেই সমাজের কায়েমী স্বার্থের অধিকারীরা বুঝতে পারলো যে, এ আওয়াজ তাদের বিরুদ্ধেই স্পষ্ট বিদ্রোহ। নেতৃত্বের লোভ, অরথ- সম্পদ, নারীর লালসা ইত্যাদির ( যা তাদের জীবনের চরম লক্ষ্য ) বিনিময়ে তারা হযরতকে এ পথ থেকে ফিরাতে চেষ্টা করলো। হযরত সে প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজী হলে তাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকেও মেনে নিতে বাধ্য হতেন।
কিন্তু আদর্শভিত্তিক আন্দোলন যারা করেন তাদের পক্ষে এ ধরনের প্রস্তাবে রাজী হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তাই এ ধরনের আন্দোলনের সাথে প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের সংঘর্ষ অনিবার্য। দীর্ঘ এবং কঠোর সংগ্রামের পর নবী করিম ( সাঃ ) বিজয়ী হন এবং ইসলামী আদর্শে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
ইসলামী আন্দোলন এবং রাজনীতি
অনৈসলামী সমাজ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে মানব সমাজকে পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে আল্লাহর নবী ( সাঃ ) যে আন্দোলন পরিচালনা করেন তাই হচ্ছে আদর্শ ইসলামী আন্দোলন। এ ধরনের আন্দোলন রাজনৈতিক কার্যকলাপ ব্যতীত কি করে সম্ভব হতে পারে ? সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং আধুনিক আদর্শবাদী আন্দোলনের ইতিহাস যারা কিছুটা চর্চা করেন এবং মানব সমাজের সমস্যা নিয়ে যারা একটু চিন্তা- ভাবনা করেন তাদের পক্ষে একথা বুঝা অত্যন্ত সহজ। যারা স্থূল দৃষ্টিতে ইসলামকে দেখেন তারা এটাকে একটা ধর্ম মাত্র মনে করে রাজনীতিকে ইসলাম থেকে আলাদা করতে চান। তারা হয় আন্দোলনের অর্থই বুঝেন না, আর না হয় আন্দোলনের সংগ্রামী পথে চলার সাহস রাখেন না। ইসলামকে একটা পূর্ণাংগ জীবন বিধান হিসেবে বুঝেও যারা রাজনীতি করা পছন্দ করেন না, তারা নিশ্চয়ই পার্থিব কোন স্বার্থের খাতিরে অথবা কায়েমী নেতৃত্বের নির্যাতন থেকে আত্মরক্ষার জন্য এরূপ নিষ্ক্রিয় পন্থা অবলম্বন করেন।
নবী করিম ( সাঃ ) যে আন্দোলন চালিয়েছেন তাতে প্রকৃতপক্ষে চরম রাজনৈতিক কার্যকলাপ অপরিহার্য ছিল। দেশের নেতৃত্ব যদি অনৈসলামী লোকদের হাতে থাকে তাহলে ইসলাম কিছুতেই একটি বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ পেতে পারে না। তাই ইসলামী আদর্শের বিজয় মানেই নেতৃত্বের পরিবর্তন এবং নেতৃত্ব পরিবর্তনের চেষ্টাই চরম রাজনীতি। রাজনীতি করাকে যারা দীনদারীর খেলাফ মনে করেন তারা রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) এর চরম রাজনীতিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন ? যারা এ নীতি অবলম্বন করেন তারা কি নিজেদেরকে রাসুল ( সাঃ ) এর চেয়েও বেশী দীনদার বলে মনে করেন ? তা নিশ্চয়ই তারা করেন না। প্রকৃতপক্ষে তারা রাজনীতির অর্থই বুঝেন না এবং দীনের দাবী সম্পর্কেও পূর্ণ চেতনা রাখেন না।
রাসুলের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য
আজকাল রাজনীতি করাকে নেক লোকেরা যে কারনে ঘৃণা করেন তা অত্যন্ত স্পষ্ট। পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের অনুকূলে বিভিন্ন মুসলিম দেশে যে রাজনীতির প্রচলন হয়েছে তা কোন ভদ্রলোকের পক্ষেই পছন্দ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি এবং দলীয় স্বার্থকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে ক্ষমতা দখলের জঘন্য কোন্দলই এক শ্রেনীর লোকের নিকট রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ টাকার জোরে, কেউ ভোটের বলে, আর কেউ অস্ত্রের দাপটে ক্ষমতা দখল করতে সর্বপ্রকার অন্যায় পন্থা অবলম্বন করে রাজনীতি করে থাকেন। এসব লোকেরা জঘন্য রাজনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে গদী দখল করার পর তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনার অধিকারটুকুও হরণ করেন। নীতি এবং আদর্শের ভিত্তিতে জাতি গঠনের প্রচেষ্টাকেও এরা রাজনৈতিক কার্যকলাপ বলে দমন করতে চান।
শেষ নবীর ইসলামী আন্দোলনকেও এ মনোভাব দিয়ে দমন করার চেষ্টা চলেছিল। শুধু শেষ নবীই নয়, হযরত ইব্রাহীম ( আঃ ), হযরত মুসা ( আঃ ), এবং অন্যান্য নবীর আন্দোলনের সাথেও একই ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা নবীদের আন্দোলনের পরিনতি যে নেতৃত্বের পরিবর্তন সে কথা বুঝতে ক্ষমতাসীনদের আর বাকী ছিল না। কিন্তু নবীদের রাজনৈতিক প্রধান বৈশিষ্ট্য হল- তাদের চারিত্রিক এবং নৈতিক শক্তি। বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করার পূর্বে নবীদের নিষ্কলঙ্ক দীর্ঘ জীবন যে নিঃস্বার্থতার পরিচয় বহন করে তা ইসলাম ব্যতীত আর কোন আদর্শবাদী আন্দোলনে সমপরিমানে পাওয়া যায় না। সমাজে এ নৈতিক প্রতিষ্ঠাই তাদের আন্দোলনের প্রধান মূলধন। শেষ নবীর রাজনীতিতে এ নিঃস্বার্থতা এবং নৈতিকতার বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল ছিল। এ জন্যই তার বিরুদ্ধে কোন সস্তা স্লোগান কার্যকরী হয়নি। তার নিঃস্বার্থ চরিত্রের প্রভাবকে শুধু রাজনৈতিক কার্যকলাপের দোহাই দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না।
হযরতের রাজনীতির দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ছিল উপায় উপকরণের পবিত্রতা। তিনি কোন অন্যায় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী পন্থা অবলম্বন করে রাজনীতি করেন নি। তার রাজনৈতিক দুশমনদের সাথে তিনি ব্যক্তিগত আক্রোশ পোষণ করতেন না। কঠিন রাজনৈতিক শত্রুও যদি ইসলামের আদর্শ গ্রহণ করে তার নেতৃত্ব মেনে নিতে রাযী হতো তা হলে তিনি পূর্বের সব দোষ মাফ করে দিতেন।
তার রাজনীতির তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হল- উদ্দেশ্যের পবিত্রতা। ইসলামের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাই তার কাম্য ছিল। ব্যক্তি প্রতিষ্ঠা যদি তার উদ্দেশ্য হত তাহলে আন্দোলনের শুরুতেই তিনি মক্কার নেতৃবৃন্দের প্রস্তাব মেনে নিয়ে বাদশাহ হতে পারতেন।
চারিত্রিক পবিত্রতা, উপায় এবং পন্থার পবিত্রতা এবং উদ্দেশ্যর পবিত্রতা — এই তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রাসুলের রাজনীতিকে স্বার্থপর ও দুনিয়াদারদের রাজনীতি থেকে পৃথক মর্যাদা দান করেছে। যদি কেউ ইসলামী রাজনীতি করতে চায় তাহলে তাকে মহানবীর এই তিনটি রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যকে মূলধন হিসেবে গ্রহণ করতেই হবে। যাদের চরিত্র, কর্মপন্থা ও উদ্দেশ্য অপবিত্র বলে বুঝা যায় তারাও যদি ইসলামের নামে রাজনীতি করে তাহলে ইসলামের উপকারের চাইতে অপকারই বেশী হয়। এদের রাজনীতি অন্যান্য স্বার্থবাদী রাজনীতির চেয়েও জঘন্য।
কায়েমী নেতৃত্ব পরিবর্তনে রাসুলের কর্মপন্থা
কোন নবীই প্রচলিত নেতা বা শাসকদের নিকট নেতৃত্বের গদী দাবী করেননি। হযরত ইব্রাহীম ( আঃ ) নমরুদের নিকট, হযরত মুসা ( আঃ ) ফিরাউনের নিকট এবং শেষ নবী মক্কায় অন্যান্য স্থানের নেতৃবৃন্দ এবং শাসকগণের নিকট ইসলামের দাওয়াতই পেশ করেছেন, তাদেরকে গদী পরিত্যাগ করার আহবান জানাননি। তবুও প্রত্যেক রাসুলের সংগেই কায়েমী নেতৃবৃন্দের সংঘর্ষ বেধেছে। সমাজের সর্ব শ্রেনীর শোষকই রাসুলগনকে সকল দিক দিয়েই আদর্শস্থানীয় বলে স্বীকার করা সত্ত্বেও ইসলামের আহবান জানানোর পর সকল কায়েমী স্বার্থই যুক্তফ্রন্ট করে তাদের বিরোধিতা করেছে।
প্রচলিত সমাজের নেতৃবৃন্দ কোনকালেই ইসলামের আহবান গ্রহণ করতে রাজী হয়নি। কেননা, তাদের পার্থিব যাবতীয় স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত ছিল। তবু নবীগন ইসলামের দাওয়াত সর্বপ্রথম তাদের নিকটেই পেশ করেছেন। পবিত্র কুআনের সুরা আরাফের অষ্টম রুকুতে আল্লাহ পাক নূহ ( আঃ ), হুদ ( আঃ ), সালেহ ( আঃ ), লুত ( আঃ ), শোয়াইব (আঃ ) ও মুসা ( আঃ ) এর ইসলামী আন্দোলনগুলোর যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতেও দেখা যায় যে, প্রত্যেক রাসুলই সমাজের নেতৃস্থানীয়দের কাছে দাওয়াত পেশ করতে আদিষ্ট হয়েছেন। সেখানে একথাও প্রমানিত হয়েছে যে, সমাজপতিগণ প্রত্যেক রাসুলেরই বিরোধিতা করেছে।
নেতৃবৃন্দের নিকট প্রথম দাওয়াত পেশ করার কারন
নেতৃত্বের অধিকারী ব্যক্তিগত কোন আদর্শকে গ্রহণ না করলেও তা বাস্তবায়িত হতে পারে না। এটা কিছুতেই সম্ভব নয় যে, কোন আদর্শের বিপরীত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় সমাজে সে আদর্শ কায়েম হবে। তাই নবী করিম ( সাঃ ) পহেলা নেতাদেরকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতে লাগলেন। নেতাগন এ দাওয়াত কবুল না করলেও তাদের নিকট দাওয়াত পৌঁছাবার ফলে সমাজের অনেক লোকের নিকটই ইসলামের আওয়াজ পৌছবার সুযোগ হল।
ইসলামী আদর্শের উপযুক্ত নেতৃত্ব ব্যতীত দীন ইসলামকে বিজয়ী করা কিছুতেই সম্ভব নয়। অথচ প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব ইসলামকে কবুল করতে রাজী নয়। এ অবস্থায় যেসব লোক ইসলামের দাওয়াত কবুল করতে রাজী হলেন তাদেরকে নিয়েই আন্দোলন পরিচালনার মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করা ব্যতীত রাসুলুল্লাহ ( সাঃ ) এর নিকট আর কোন পথই রইলো না।
প্রকৃতপক্ষে আদর্শবাদী নেতৃত্ব কোন কালেই তৈয়ার ( Readymade ) পাওয়া যায় না। আদর্শের আন্দোলনই নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করে এবং সমাজে যখন আদর্শবাদী নেতৃত্ব কায়েম হয় তখনই আদর্শকে বাস্তবে রূপদান করা সম্ভব হয়। নেতৃত্বের এ পরিবর্তন হযরতের আন্দোলনের মাদানী স্তরে গিয়ে সম্ভব হল। অতঃপর আট বছরের দীর্ঘ সংগ্রামের পর আরবের বুকে ইসলামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। বিশ্ব নবীর এ কার্যক্রম যে সুস্থ রাজনীতির সন্ধান দেয় তা প্রত্যেক আদর্শবাদী বিপ্লবী প্রানকেই সংগ্রামমুখর করে তোলে। মহানবীর বিপ্লবী জীবনকে অধ্যয়ন করার পর কারো মনে এ ধারণা হওয়া সম্ভব নয় যে, তিনি রাজনীতি করেননি।
শেষ কথা
বিশ্ব নবীর দায়িত্ব পালন করার জন্য রাজনৈতিক কার্যকলাপ যে অপরিহার্য ছিল তা ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে প্রমানিত। রাজনীতির চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত না পৌছতে পারলে তিনি ইসলামকে বিজয়ী দীন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষমই হতে না। আজ যদি কেউ দীন ইসলামকে বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাহলে রাজনীতির পথে অগ্রসর হওয়া ছাড়া তার আর কোন বিজ্ঞান সম্মত পন্থা নেই।
কিন্তু স্বার্থপর, পদলোভী ও দুনিয়া পূজারিদের রাজনীতি ইসলামের জন্য কোন দিকে দিয়েই সাহায্যকারী নয়। ইসলামের নামে যারা এককালে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা রাজনীতি ক্ষেতেরে নবীর নীতি এবং কার্যক্রম অনুসরণ করেননি বলেই পাকিস্তানে ইসলামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।
স্বার্থপর এবং গদী ভিত্তিক রাজনীতি যেমন ইসলাম বিরোধী, নবীর অবলম্বিত রাজনীতি থেকে পরান্মুখ হওয়াও তেমনি অনৈসলামী। বরং রাসুলগন যে ধরণের রাজনীতি করেছেন সে ধরণের রাজনীতি করা সকল মুসলমানের জন্য অপরিহার্য ফরয। এ ফরযটির নাম হচ্ছে জিহাদ। জিহাদ মানেই ইসলামী আন্দোলন এবং রাজনীতিই এ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান অবলম্বন। সুতরাং কতক লোক পরহেজগারের দোহাই দিয়ে রাজনীতি করা অপছন্দ করলেও রাসুলের খাটি অনুসারীদের পক্ষে তা পছন্দ না করে কোন উপায়ই নেই।
দীনদার লোকেরা যদি রাজনৈতিক ময়দানে কাঝ না করেন তাহলে তাদের এ আচরণ এ কথাই প্রমান করে যে, তারা ধার্মিক হওয়ার কারনে রাজনীতি করা পছন্দ করেন না। এ মনোভাব যারা পোষণ করেন তাদেরকে রাজনীতি নিরপেক্ষ ধার্মিক লোক বলা যায়। অথচ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি যেমন ইসলাম নয়, তেমন রাজনীতি নিরপেক্ষ ধর্মও ইসলাম নয়। রাসুল ( সাঃ ) এর জীবনাদর্শ এ দুটিরই বিরোধী।
( বাংলাদেশের রাজনীতি )
গণতন্ত্র ও ইসলাম
গণতন্ত্র বিশ্বজনীন একটি রাজনৈতিক পরিভাষা। জনগনের অবাধ ভোটাধিকারের প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার গঠনের পদ্ধতিকে গণতন্ত্র বলা হয়। নীতিগতভাবে এ পদ্ধতির যৌক্তিকতা সবাই স্বীকার করে। সরকারের প্রতি জনগনের সমর্থন থাকুক এটা সব সরকারেরই ঐকান্তিক কামনা। তাই সামরিক স্বৈরাচাররাও জনগনের দ্বারা নির্বাচিত বলে স্বীকৃত হবার উদ্দেশ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। এমনকি যে সমাজতন্ত্র মতবাদ হিসেবে রাজনৈতিক ক্ষেতের গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত পদ্ধতির প্রবর্তক তারাও গণতন্ত্রের দোহাই দিতে বাধ্য হয়। গণতান্ত্রিক আদর্শের জনপ্রিয়তা এবং সার্বজনীনতাই এর প্রধান কারন। অবশ্য সমাজতন্ত্রীরা গণতন্ত্র থেকে নিজেদের মতাদর্শকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে “জনগনতন্ত্র” নামে অদ্ভুত এক পরিভাষাও ব্যবহার করে। অথচ “জন” এবং “গন” একই অর্থের দুটি শব্দ।
গণতন্ত্রের মূলনীতি
গণতন্ত্রের মূলনীতি হচ্ছে পাঁচটি। যেমনঃ
১। নির্বাচনের মাধ্যমে অধিকাংশ নাগরিকের সমর্থন যারা পায় তাদেরই সরকারী ক্ষমতা নেয়ার অধিকার রয়েছে।
২। এ নিরবাচন যাতে নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হতে পারে এর বাস্তব ব্যবস্থা অপরিহার্য। নিরপেক্ষ পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারই আত্মবিশ্বাসের সাথে দেশ পরিচালনা করতে পারে। বিরোধীদলও এমন সরকারের বৈধতা এবং নৈতিক অবস্থানের স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
৩। সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়া এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে সরকারের করনীয় সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করার জন্য জনগনের অবাধ স্বাধীনতা থাকতে হবে। দেশের আইন এবং শৃঙ্খলার সীমার মধ্যে থেকে নিয়মতান্ত্রিক বিরোধীদলের ভূমিকা পালনের সুযোগ থাকা গণতন্ত্রের প্রধান লক্ষণ।
৪। জনগনের মতামত ছাড়া অন্য কোন উপায়ে ক্ষমতা দখল করা গণতান্ত্রিক নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত।
৫। সরকার গঠন, পরিবর্তন এবং পরিচালনার ব্যাপারে মৌলিক নীতিমালা শাসনতন্ত্র অনুযায়ী বিধিবদ্ধ হতে হবে। শাসনতন্ত্র বিরোধী কোন নিয়মে সরকার গঠন, পরিবর্তন এবং পরিচালিত হলে তা অবৈধ বিবেচিত হবে।
ইসলামের গণতন্ত্র
ইসলামের রাজনৈতিক নীতিমালার সাথে গণতন্ত্রের উপরোক্ত পাঁচটি মুলনীতির কোন বিরোধ নেই। জনগনের উপর শাসক হিসেবে চেপে বসার কোন অনুমতি ইসলামে নেই। রাসুল ( সাঃ ) এর পড়ে যে চারজন রাষ্ট্রনায়ক খোলাফায়ে রাশেদীন হিসেবে বিখ্যাত তারা নিজেরা চেষ্টা করে শাসন ক্ষমতা দখল করেননি। জনগনের মতামতের ভিত্তিতে এবং তাদের ইচ্ছা ও আগ্রহের কারণে তারা দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তাদের নির্বাচনের পদ্ধতি একই ধরণের ছিল না কিন্তু তারা প্রকৃতপক্ষে নির্বাচিতই ছিলেন। তারা কেউ এ পদের জন্য চেষ্টা করেননি। আল্লাহর রাসুলের (সাঃ ) এর ঘোষণা অনুযায়ী পদের পদের আকাংখী ব্যক্তিকে পদের অযোগ্য মনে করতে হবে।
এ কারনেই হযরত আলী ( রাঃ ) এর পর হযরত মুয়াবিয়া ( রাঃ ) সাহাবীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও খোলাফায়ে রাশেদীনের অন্তর্ভুক্ত নন। কারন তিনি নিজে চেষ্টা করে শাসন ক্ষমতা দখল করেছেন। অথচ হযরত উমর বিন আব্দুল আযীয ( রঃ ) সাহাবী না হওয়া সত্ত্বেও খোলাফায়ে রাশেদীনের মধ্যে গণ্য বলে বিবেচিত। এর কারন এটাই যে, রাজ বংশের রীতি অনুযায়ী তার পূর্ববর্তী শাসক তাকে মনোনীত করার পর ঐ পদ্ধতিতে ক্ষমতাসীন হওয়া ইসলাম সম্মত নয় বলে তিনি পদত্যাগ করেন এবং জনগন তারই উপর আস্থা জ্ঞাপন করায় তিনি দায়িত্ব গ্রহনে বাধ্য হন।
ইসলামে শাসন ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা করা নিষিদ্ধ। কিন্তু দায়িত্ব থেকে পালানোরও অনুমতি নেই। এ নীতি গণতন্ত্রের প্রচলিত আধুনিক পদ্ধতির চেয়েও কতো উন্নততর।
ইসলামে সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়া জনগনের পবিত্র দায়িত্ব। নামাযে পর্যন্ত ইমাম ভুল করলে মুক্তাদির লুকমা দেয়া ওয়াজিব। ইসলামের দৃষ্টিতে শাসক হলেন রাসুলের প্রতিনিধি। নামাযের ইমাম যেমন রাসুলের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ভুল করলে তাকে সংশোধন করার দায়িত্ব মুক্তাদিদেরকে পালন করতে হয়, তেমনি রাসুল ( সাঃ ) যে নিয়মে শাসন করতেন এর ব্যতিক্রম হতে দেখলে সংশোধনের চেষ্টা করা জনগনের কর্তব্য।
এসব দিক বিবেচনা করলে গণতন্ত্রের বিশ্বজনীন নীতি ও ইসলামে শুধু মিল নয়, ইসলামের নীতি- রীতি গণতন্ত্রের চাইতেও অধিক আধুনিক এবং উন্নততর – ত্রুটিমুক্ত।
ইসলাম এবং গণতন্ত্রের পার্থক্য
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইসলাম এবং গণতন্ত্রের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামে সার্বভৌমত্ব আল্লাহর আর গণতন্ত্রে জনগনই সার্বভৌমত্বের অধিকারী। সার্বভৌমত্ব মানে আইন রচনার চূড়ান্ত ক্ষমতা। আইন সার্বভৌমশক্তিরই ইচ্ছা ও মতামত। গণতন্ত্রে জনগন বা তাদের নির্বাচিত আইন সভাই সকল ক্ষেত্রে আইন দাতা। আইনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ক্ষমতা তাদেরই হাতে। ইসলামে আল্লাহর দেয়া আইন এবং বিধানের বিপরীত কোন সিদ্ধান্ত নেবার বৈধ অধিকার জনগনের বা পার্লামেন্টের নেই। ইসলাম এবং গণতন্ত্রের এ মৌলিক পার্থক্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভালো ও মন্দ, ন্যায়- অন্যায়, সত্য ও মিথ্যা, হালাল ও হারাম ইত্যাদির ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকেই সীমা ঠিক করে দেয়া প্রয়োজন। মানুষ যে কোন ক্রমেই নৈতিকতা এবং ইনসাফের সামান্যতমও মানও বজায় রাখতে পারে না তা দুনিয়ায় সুস্পষ্টরূপে প্রমানিত।
প্রকৃতপক্ষে আইনের নিরপেক্ষ শাসন একমাত্র আল্লাহর আইনের অধীনেই চালু হওয়া সম্ভব। মানব রচিত আইনের এমন নৈতিক মর্যাদা সৃষ্টি হতে পারে না যা পালন করার জন্য মানুষ অন্তর থেকে উদ্ভুদ্ধ হতে পারে। মানুষের তৈরি আইনকে ফাঁকি দিয়ে পুলিশ থেকে বেচে যাওয়ার চেষ্টাকে কেউ বড় দোষ মনে করে না। কিন্তু আল্লাহর আইনের বেলায় পুলিশ থেকে বেঁচে গেলেও আল্লাহর হাত থেকে রক্ষা নেই বলে এর নৈতিক প্রভাব অত্যন্ত গভীর। এদিক বিবেচনা করলে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সার্থকস্বরূপ ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায়ই সবচেয়ে বেশী সম্ভাবনাময়।
( বাংলাদেশের রাজনীতি )