বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
পাকিস্তান পূর্ব- বাংলাদেশ
বাঙ্গালী মুসলমানদের ইতিহাস
ভারতের বহু স্থানেই মুসলিম শাসনের ফলে নতুন মুসলমানের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু বাংলা ও আসামের যে ভূখণ্ডটি ২৫-২৬ বছর আগে স্বেচ্ছায় পাকিস্তানের অংশ হিসেবে যোগদান করেছিলো সেখানে এতো বেশী মুসলমান কি করে হল সে ইতিহাস অনেকেরই জানা নেই। দিল্লীতে শত শত বছর মুসলিম শাসকদের রাজধানী থাকা সত্ত্বেও চারপাশে বহুদূর পর্যন্ত মুসলমানদের সংখ্যা সব সময়ই কম ছিল। কিন্তু বাংলার মাটিতে মুসলিম শাসন চালু হবার বহু পূর্ব থেকেই বিপুল সংখ্যক স্থানীয় জনতা মুসলমান হয়। ইসলাম প্রচারক আরব বনিকদের প্রচেষ্টায় চাটিগা দিয়ে এই এলাকায় ইসলামের আলো পৌঁছে। স্থানীয় অধিবাসীরা ব্যবসায়ে লেনদেনের সাথে সাথে তাঁদের নিকট মানবিক অধিকার ও মর্যাদার সন্ধান পেয়ে মুসলিম হওয়া শুরু করেছিলো। এমন উর্বর জমির খোঁজ পেয়ে ইসলামের লো নিয়ে আরো অনেক নিঃস্বার্থ মুবাল্লিগ এদেশে আগমন করেন। এভাবে নদীমাতৃক বাংলায় ক্রমে ক্রমে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলেই বখতিয়ার খলজী মাত্র ১৭ জন আগ্রগামী অশ্বারোহী সেনা নিয়ে গৌড় আক্রমন করলে গৌড়ের রাজা ভীতু লক্ষ্মণ সেন বিনা যুদ্ধে পলায়ন করে এবং বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা হয়। বাংলার সাথে সাথে আসামের দিকেও যখন মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো তখন বর্তমান সিলেট অঞ্চলের রাজা গৌরগোবিন্দের মুসলিম- বিরোধী চক্রান্তকে খতম করার জন্য হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী ( র ) ৩৬০ জন মুজাহিদ নিয়ে এদেশে আগমন করেন।
সুতরাং ইতিহাস থেকে একথাই প্রতীয়মান হয় যে, শাসকের ধর্ম হিসেবে এলাকার মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেনি। বরং ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই মানুষের মতো ইজ্জত নিয়ে বাঁচার তাগিদেই তারা মুসলমান হয় একারনেই এ অঞ্চলের সাধারন মানুষ এতো বেশী ইসলাম প্রিয়। ধর্মের নামে শাসকদের অধর্মের ফলে বর্তমানে যুব শক্তির একাংশে যে ধর্ম বিরোধী তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা সাময়িক এবং তাঁর বিপরীত প্রতিক্রিয়া ইতোমধ্যেই পরিলক্ষিত হচ্ছে।
( বাঙ্গালী মুসলমান কোন পথে )
উপমহাদেশে ইংরেজ রাজত্ব
১৭৫৭ সালে স্বাধীন বাংলার নবাব সিরাজুদ্দৌলার সেনাপতি মীর জাফর ইংরেজের সহযোগিতায় নিজে নবাব হওয়ার যে কুমতলব করেছিলো তাঁরই ফলে এদেশে ইংরেজ রাজত্বের সূচনা হয়। যে ব্যক্তি নিজের ক্ষমতার জন্য আপন দেশ এবং জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো, তাকে সংগত কারনেই ইংরেজরাও বিশ্বাস করতে পারেনি। এভাবেই মীর জাফরের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ইংরেজ রাজত্ব কায়েম করা হল।
১৮৫৭ সালে দিল্লীর শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ইংরেজ রাজত্ব গোটা ভারত উপমহাদেশে মযবুত করা হল। এভাবে উপমহাদেশে ইংরেজ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করতে একশো বছর লেগে গেলো। এভাবেই ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে স্বাধীনতার যে বীজ বপন করা হয়েছিলো, তা একশো বছরে বিরাট মহীরুহে পরিনত হল।
১৮৩১ সালে পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের সীমানায় বালাকোটের যুদ্ধে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী ( র ) ও শাহ ইসমাইল ( র ) এঁর নেতৃত্বে পরিচালিত ভারতের প্রথম সত্যিকার ইসলামী আন্দোলনের ফলেই ১৮৫৭ সালে ইংরেজ বাহিনীতে নিযুক্ত মুসলিম সিপাহীরা বিদ্রোহ করার প্রেরনা লাভ করেছিলো।
এঁর পরের ইতিহাস মুসলিম জাতিকে চিরতরে গোলাম বানানোর জন্য ইংরেজদের জঘন্য ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। এ উপমহাদেশে প্রায় ৬০০ বছর মুসলিম শাসন চলেছে। তাঁদের হাত থেকে পূর্ণ ক্ষমতা কেড়ে নিতে ইংরেজদের ১০ বছর লেগেছে। তাই দিল্লী দখলের পর এদেশে ইংরেজ রাজত্ব স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে ইংরেজরা মুসলমানদেরকে সকল ময়দান থেকে উৎখাত করে অমুসলিম জাতিগুলোকে শিক্ষা, সরকারী চাকুরী, ব্যবসা- বাণিজ্য ও জমিদারিতে এগিয়ে দিলো। ফলে ৫০ বছরের মধ্যে এদেশের মুসলিম শাসক জাতি, দাস জাতিতে পরিনত হয়ে গেলো। ইংরেজ লেখক উইলিয়াম হান্টারের “দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস” বইটি একথার বিশ্বস্ত সাক্ষী।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
ইংরেজ আমলে মুসলিম নির্যাতন
মীর জাফরের স্বার্থপরতা ও ষড়যন্ত্রের পরিনামে ইংরেজ বেনিয়ারা শাসক হয়েই সর্বক্ষেত্রে অমুসলিমদের সুযোগ- সুবিধা প্রদান ও মুসলমানদের সব ব্যাপারে চরমভাবে বঞ্চিত করার নীতি গ্রহন করেছিলো। দীর্ঘকাল শাসকের মর্যাদায় আসীন থাকার পর মুসলমানেরা যে কিছুতেই গোলামী মেনে নেবে না, একথা ইংরেজরা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল। তাই মুসলমানদেরকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা ছাড়া ইংরেজ রাজত্ব যে স্থায়ী হওয়া সম্ভব ছিল না এ বাস্তবতা অনুধাবন করেই তারা মুসলিম নিপীড়ন শুরু করে।
ইংরেজ রাজত্ব শুরু হবার পঞ্চাশ বছর পরে লিখিত “দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস” গ্রন্থে উইলিয়াম হান্টার বাঙ্গালী মুসলমানদের যে দুরাবস্থার চিত্র অংকন করেন তা থেকেই তৎকালীন মুসলমানদের সামগ্রিক অবস্থার অনুধাবন করা যায়। তিনি লিখতে বাধ্য হয়েছেন যে, “পঞ্চাশ বছর আগে কোন দরিদ্র ও অশিক্ষিত বাঙ্গালী মুসলমান খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল, আর এখন কোন শিক্ষিত ও ধনী মুসলমান তালাশ করে পাওয়ায় অসম্ভব।” ইংরেজ ও অমুসলিমদের যোগসাজসে ইংরেজদের সরকারী কর্মচারী হিসেবে হিন্দুরা জেঁকে বসলো। রাষ্ট্রভাষা ইংরেজীকে তারা মনিবের ভাষা হিসেবে গ্রহন করে সর্বক্ষেত্রে উন্নতি করলো। চরম বিদ্বেষ নিয়ে ইংরেজরা মুসলমানদেরকে ব্যবসা- বাণিজ্য, শিল্পকলা ও জমিজমা থেকে বঞ্চিত করে হিন্দুদেরকে মহাজন ও জমিদারে পরিনত করলো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামক কালাকানুনের মারফতে বাঙ্গালী মুসলমানকে হিন্দুর অর্থনৈতিক গোলামে পরিনত করা হল।
ইংরেজ শাসনের ফলে গোটা ভারতেই মুসলমানদের জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে মুসলমানদের মতো এতো দীর্ঘকাল এমন ব্যাপক নির্যাতন ভারতের কোন এলাকার লোকই ভোগ করেনি। কারন ইংরেজ শাসন বাংলার মাটি থেকেই শুরু হয় এবং দিল্লী পর্যন্ত দখল করে বসতে বসতে তাঁদের ১০০ বছর লেগে যায়। তাই বাঙ্গালী মুসলমানরা পৌনে দুইশ বছর ইংরেজ ও হিন্দুদের যৌথ গোলামী করতে বাধ্য হয়। এ গোলামীর প্রতিবাদ যে হয়নি এমন নয়, মুসলমানরা কোন দিনই ইংরেজ শাসন মনে প্রানে গ্রহন করেন নি। আর এ প্রতিবাদের ফলেই ইংরেজরা মুসলমানদেরকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে পংগু করে রাখার চেষ্টা করতে থাকে।
( বাঙ্গালী মুসলমান কোন পথে )
ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন
শিক্ষায়- দীক্ষায়, ধন- দৌলতে, প্রভাব- প্রতিপত্তিতে মুসলিম জাতিগুলো অগ্রসর হবার পর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের পরিচালনায় ও অমুসলিম নেতৃত্বে যখন দেশকে ইংরেজের গোলামী থেকে স্বাধীন করার আন্দোলন শুরু হল তখন অর্ধমৃত অবস্থায়ও মুসলিম জাতি তাতে সাড়া দিলো। ইংরেজ বিদ্বেষ তাঁদের মজ্জাগত ছিল। কারন তাঁদের হাত থেকেই ইংরেজরা ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল।
কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই মুসলিম নেতৃবৃন্দ বুঝতে পারলেন যে, এ স্বাধীনতা দ্বারা ইংরেজের অধীনতা থেকে মুক্তি পেলেও মুসলমানদেরকে অমুসলিমদের অধীনেই থাকতে হবে।
গোটা ভারতে তখন ৪০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ১০ কোটি মুসলমান ছিল। তাই গনতান্ত্রিক সরকার কায়েম হলেও সংখ্যালঘু মুসলমানরা চিরদিনই অমুসিমদেরই অধীনে থাকতে বাধ্য হতো।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে যখন ব্রিটিশ সরকার কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভা কায়েম করে জনগনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে স্বায়ত্ত শাসনের নামে আংশিক ক্ষমতা তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করলো, তখন মুসলমানরা পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা আদায় করে কিছুটা আত্মরক্ষার বন্দোবস্ত করলো। মুসলিম জনগনের প্রতিনিধি যাতে শুধু মুসলিমদের ভোটে নির্বাচিত হতে পারে, সে ব্যবস্থার নামই পৃথক নির্বাচন। যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থায় মুসলিম এবং অমুসলিমদের মিলিত ভোটে নির্বাচিত হলে কংগ্রেসের অমুসলিম নেতাদের মর্জি হিসেবে কিছু সংখ্যক মুসলিম আইন সভায় নির্বাচিত হলেও জাতি হিসেবে মুসলিমদের কোন পৃথক সত্ত্বা থাকবে না আশংকা করেই মুসলমানরা পৃথক নির্বাচন দাবী করেছিলো।
১৯৩৫ সালের ঐ আইন অনুযায়ী ১৯৩৬ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ভারতের ৭ টি প্রদেশে কংগ্রেসের রাজত্ব কায়েম হয়। পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু ছিল বলে অবিভক্ত বাংলা সহ ৪ টি প্রদেশে মুসলিম জনসংখা বেশী থাকায় আনুপাতিক হারে এ ৪ টি আইন সভায় মুসলিম সদস্য সংখ্যা অমুসলিমদের চেয়ে বেশী হয়।
মিঃ জিন্নাহ মুসলিম জাতির নেতৃত্ব গ্রহন করার পরে মুসলমানরা তাকে কায়েদে আযম ( শ্রেষ্ঠ নেতা ) হিসেবে বরন করে নেয়। তাঁরই নেতৃত্বে এবং মুসলিম লীগের উদ্যোগে ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে লাহোরে ঐতিহাসিক মহা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। শেরে বাংলা ফযলুল হকই ঐ সম্মেলনে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম সংখাগুরু প্রদেশগুলো নিয়ে ভারত থেকে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রপুঞ্জ গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন, যা সর্বসম্মতভাবেই গৃহীত হয়। ঐ প্রস্তাবটিই ইতিহাসে পাকিস্তান প্রস্তাব নামে বিখ্যাত হয়ে আছে।
১৯৪৫ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় আইন সভা ও ১৯৪৬ সালে প্রাদেশিক আইন সভা সমূহের যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে মুসলিম লীগ ঐ পকিস্তান প্রস্তাবকেই নির্বাচনী ইস্যু বানায়। সারা ভারতে মুসলিমগন একটি পৃথক জাতিসত্তার মর্যাদা সহকারে ঐ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা না থাকলে এ বিজয় কিছুতেই সম্ভব হতো না। এ বিজয়ের ফলে বাধ্য হয়ে ইংরেজ সরকার পাকিস্তান দাবী মেনে নেয় এবং ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারত ও মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম হয়।
( পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
পাকিস্তান আন্দোলন ও ইসলাম
“পাকিস্তানের অর্থ কি—লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। এ শ্লোগানই মুসলমানদেরকে এ আন্দোলনে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। এমনকি ভারতের যে ৭ টি প্রদেশ ভারতের সাথে থাকবে বলে জানাই ছিল, সেখানেও মুসলমানরা ইসলামের আকর্ষণে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবীকে নিরংকুশভাবে সমর্থন করেছে। এর পরিনামে লক্ষ লক্ষ মুসলমান শহীদ হয়েছে এবং জন্মভূমি ও সহায়- সম্পদ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। ভারতে বসবাসকারী মুসলমানরা এখনো তাঁদের ঐ অন্যায়ের কঠোর শাস্তি ভোগ করে চলেছে।
কিন্তু অতঃপর দুঃখের বিষয় যে, “পাকিস্তান আন্দোলন” ইসলামের নামে চলা সত্ত্বেও তা “ইসলামী আন্দোলন” হিসেবে গড়ে উঠেনি। পাকিস্তান কায়েম হবার স্বাধীন মুসলিম দেশটিতে ইসলামী আইন, ইসলামী শিক্ষা, ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা চালু করার কোন পরিকল্পনাই আন্দোলনের নেতারা করেননি। এর ফলে যা হবার তাই হয়েছে। যারা ইসলামকে জানেননা বা যারা নিজের জীবনে ইসলামকে মেনে চলেন না, তারা সমাজ রাষ্ট্রে কী করে ইসলাম কায়েম করবেন ? ইসলামের ব্যাপারে এ ধোঁকাবাজি করার ফলে নেতারা অল্প দিনের মধ্যেই তাঁদের জনপ্রিয়তা হারালেন। সেনাপতি আইয়ুব খান সে সুযোগে ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা দখল করলেন।
(পলাশী থেকে বাংলাদেশ )
বাংলাদেশ ও পাকিস্তান আন্দোলন
অবিভক্ত ভারতে ১৯৪৫ ও ১৯৪৬ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে ভারতের ১০ কোটি মুসলমান একটি আলাদা জাতি হিসেবে পাকিস্তান দাবীকে নির্বাচনী ইস্যু বানায়। ঐ দাবীতে প্রমানিত হয় যে, মুসলিম জাতি অখন্ড ভারত রাষ্ট্রে বিশ্বাসী নয়। অবিভক্ত বাংলার মুসলিম আসনগুলোর শতকরা ৯৭ টিতে পাকিস্তানবাদীরাই বিজয়ী হয়। বর্তমান পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের কোথাও এমন বিপুল সংখায় বিজয় সম্ভব হয়নি। সুতরাং এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙ্গালী মুসলমানদের অবদানই সবচাইতে বেশী। এর যুক্তিসংগত কারণও রয়েছে।
ইংরেজ শাসন সর্বপ্রথম বাংলায়ই কায়েম হয়। দিল্লী দখন পর্যন্ত ইংরেজদের আরো একশো বছর লেগে যায়। সে হিসেবে এদেশের মানুষ সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ইংরেজদের গোলামী করতে বাধ্য হয়। ইংরেজরা মুসলমানদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেবার পর স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের রাজত্ব স্থায়ী এবং মজবুত করার উদ্দেশ্যে এদেশের অধিবাসীদের মধ্যে অমুসলমানদের মধ্য থেকে সহায়ক শক্তি তালাশ করতে থাকে। রাজ্যহারা ও ক্ষমতাহীন মুসলমানদের পক্ষে ইংরেজদের দাসত্ব মেনে নেয়া যেমন সম্ভব ছিল না, ইংরেজদের পক্ষেও মুসলমানদেরকে বিশ্বাস করা সম্ভব হচ্ছিলো না। বিশেষ করে সব জায়গায়ই মুসলমানরা সাধ্যমত প্রতিরোধ গড়ে তোলায় তারা একশ্রেণীর হিন্দুদের সহযোগিতাই একমাত্র নির্ভরযোগ্য মনে করলো। মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই দেখা গেলো যে, সরকারী চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারী ইত্যাদি ক্ষেত্রে যেভাবে পূর্বে মুসলমানরাই প্রাধান্য বিস্তার করেছিলো সেখানে হিন্দুরা একচেটিয়া ভাবে একচ্ছত্র কর্তৃত্বের আসন পেয়ে গেলো। এ কারনেই বাঙ্গালী মুসলমানরা প্রায় দেড়শ বছর ইংরেজদের রাজনৈতিক গোলামী, হিন্দুদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গোলামী সহ্য করেছে। এ ডাবল দাসত্ব মুসলমানদের মধ্যে এমন তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে যে, বাঙ্গালী মুসলমানদের মনে দ্বিজাতি তত্ত্বের বানী অতি সহজেই জনপ্রিয় হয়ে যায়। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় মুসলমানদের প্রাধান্যে আলাদা রাষ্ট্র কায়েম না হলে ইংরেজদের দাসত্ব থেকে মুক্তি পেয়েও হিন্দুদের অধীনতা থেকে রক্ষা পাওয়া যে কিছুতেই সম্ভবপর হবেনা সে কথা বুঝতে বাঙ্গালী মুসলমানদের কোন বেগ পেতে হয়নি।
এ কারনেই বাঙ্গালী মুসলমানদের দীর্ঘ তিক্ত অভিজ্ঞতা তাঁদেরকে পাকিস্তান দাবীর যৌক্তিকতা উপলব্ধি করতে বাধ্য করেছে। পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের মুসলমানদের এতো বেশী তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়নি।
পাকিস্তান আন্দোলন ১৯৪০ সালে সুস্পষ্ট কর্মসূচী নিয়ে শুরু হয় এবং মাত্র সাত বছরের মধ্যে বিজয় লাভ করে। ঐ আন্দোলনের সময় যাদের বয়স ১৫/২০ বছরের নীচে ছিল না। তাঁদের এ বিষয়ে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা থাকার কথা।
১৯৪০ সালে যাদের বয়স অন্তত ১৫ বছর ছিল তারা একথার সাক্ষী যে, অফিস- আদালতে, স্কুল- কলেজে, জমিদারী- কাচারিতে মুসলমানদের সাথে হিন্দুরা কীরূপ আচরন করতো।
আমাদের এলাকায় ( ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানা ) কৃষ্ণ নগর জমিদার বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে কোন মুসলমানের ছাতা মাথায় ও জুতা পায়ে দিয়ে চলার অনুমতি ছিলনা। বরকন্দাজ লাঠিয়ালরা এ নিয়ম অমান্যকারী মুসলমানদেরকে গ্রেফতার করে জমিদার বাড়ির নায়েবের নিকট বিচারের জন্য পেশ করতো।
কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানা কেন্দ্রে ১৯৩৬ সালে আমার বাবা চাকুরী উপলক্ষে বদলী হয়ে যান। তখন চান্দিনা হাইস্কুলে একজন ব্রাহ্মণ হেড মাস্টার ছিলেন এবং আরবীর শিক্ষক ছাড়া মাত্র একজন মুসলমান শিক্ষক ছিলেন। ছাত্র সংখ্যা অনুপাতে স্কুল কমিটিতে মুসলমান ছাত্রদের অভিভাবকদের দু’জন নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। কমিটির বৈঠকের সময় সবার জন্য চেয়ারের ব্যবস্থা থাকলেও মুসলমান সদস্য দুজনকে গোল টুলেই বসতে বাধ্য হতে হতো। পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হবার পর সুস্পষ্ট দাবীর ফলে মুসলমানদের ভাগ্যে চেয়ার জুটে।
এখনো এমন অনেক লোক বেচে আছে যারা এককালে নিজেদের এলাকায় জমিদারদের দাপটের দরুন গরু কোরবানী দিতে পারেনি। জমিদারদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত পূজা-পার্বণে মুসলমানদেরকেও খাজনার সাথে বাধ্য হয়ে পূজার চাঁদা দিতে হতো। খাজনা ও ঋণের দায়ে মুসলমান কৃষকের বেশীর ভাগ লোকের জমি জমা ও ভিটেমাটি নিলামের মাধ্যমে জমিদার ও টাকা লগ্নীকারী সাহাদের ঘরে চলে যেতো। ১৯৩৭ সালে শেরে বাংলা ফযলুল হক ও খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিত্বের সময় প্রজাতন্ত্র আইনের ফলে এ জাতীয় চরম জুলুম থেকে মুসলমানরা রেহাই পায়।
এসব কথা ঐতিহাসিক সত্য। উচ্চ বর্ণের ঐ হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন বাংলাদেশে নেই। যারা আছে তারা তাঁদের পূর্বপুরুষদের কৃতকর্মের জন্য অবশ্যই দায়ী নয়। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের বিদ্বেষ পোষণ করার সংগত কোন কারন নেই। তারা এদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের দেশীয় ভাই। কিন্তু হিন্দুদের সাথে মিলে অখন্ড ভারতে একই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হতে কেন মুসলমানরা রাজী হতে পারেনি, সে কথা বুঝতে হলে ঐ ইতিহাসের আলোচনা না করে কোন উপায় নেই।
আজকের মুসলমানদের যুবকদের মধ্যে যারা হিন্দু মুসলিম মিলিত জাতীয়তার সমর্থন করছে তারা ঐ ইতিহাস জানেনা। না জানার জন্য তারা অবশ্যই দায়ী নয়। পাকিস্তান হবার পর এদেশের মুসলমানদের পরবর্তী বংশধরদেরকে শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেই জানানো উচিৎ ছিল যে, কী কারনে ভারত বিভক্ত হল, কিভাবে বাংলাভাষী অঞ্চলটি পর্যন্ত দু’ভাগ হয়ে গেলো এবং শত শত বছর এক দেশে বাস করেও হিন্দু-মুসলমান-শিখ মিলে কেন এক জাতির সৃষ্টি হতে পারল না।
যারা পাকিস্তানের উপর ২৫ বছর নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্ব করেছেন তারা যদি দ্বিজাতি তত্ত্বের মর্ম বুঝতেন এবং সে অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করতেন তাহলে যাদের ভোটে ভারত বিভক্ত হয়েছিলো তাঁদের সন্তানদের মধ্যে চিন্তার বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতো না।
( আমার দেশ বাংলাদেশ )