সামাজিক বিপর্যয়
সমাজবিদ্যার মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ব্যক্তি ও সমষ্টির পারস্পরিক সম্পর্ক।
আধুনিক জাহিলিয়াত যেমন রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে, তেমনি ব্যক্তি ও সমষ্টির পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মতাদর্শ নির্ধারণেও মারাত্মক বিপর্যয় ঘটিয়েছে। এক্ষেত্রে তার বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীর বাস্তবায়নেও কোনো শৃঙ্খলা ও নিয়ম রক্ষিত হয়নি। তার কারণ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ প্রকৃতপক্ষে পরস্পর গভীরভাবে জড়িত। একটিকে অন্যটি থেকে বিন্দুমাত্রও বিচ্ছিন্ন করে চিন্তা করা যায় না।
পূর্বের আলোচনায় আমরা অর্থনীতি ও রাজনীতির পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখে এসেছি। এক্ষণে সমাজের সাথে এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার স্বরূপ আলোচনা নিশ্চয়ই বস্তুবাদী জাহিলিয়াতের দৃষ্টিকোণ দিয়ে হবে না। বরং তার ভিত্তি হবে এই যে, অর্থনীতি এক দিক যেমন সমাজ গঠন করে, তেমনি অপরদিক দিয়ে রাজনীতি ও সমাজ গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, এই সব কিছু মানব সত্তার বাহ্যিক প্রকাশ ও প্রপঞ্চ মাত্র। সুসংবদ্ধ সত্তারই বিভিন্ন দিক। আর সে সত্তা হচ্ছে মানুষ।–[(আরবী***************) এর (আরবী*********) অধ্যায় দ্রষ্টব্য।]
ব্যক্তি ও সমাজ সমষ্টির সম্পর্কে সম্পর্কিত ধারণার ক্ষেত্রে আধুনিক জাহিলিয়াত যে বিপর্যয় নিয়ে এসেছে সে দিকে ইতিপূর্বে ইঙ্গিত করেছি –তা আসলে মূল মানুষ বা মনুষ্যত্ব সম্পর্কে ভুল ধারণা গ্রহণেরই ফলশ্রুতি। আর মানুষ বা মনুষ্যত্ব সম্পর্কে ধারণা গ্রহণে বর্তমান যুগের জাহিলিয়াত ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। আর এ ভারসাম্য হারানোর একমাত্র কারণ হচ্ছে আল্লাহর বিধান ও প্রদর্শিত পথ থেকে বিভ্রান্তি বা বিপথগামিতা।
ব্যক্তি ও সমাজ পর্যায়ে আধুনিক জাহিলিয়াতের ধারণা হচ্ছেঃ
ব্যক্তির গুরুত্ব স্বীকার করে যে সমাজ সংস্থা গড়ে ওঠে, সেই সমাজের একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, তা ব্যক্তিকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে, ব্যক্তির গুরুত্বে যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করে এবং ব্যক্তির সত্তাকে সীমাহীনভাবে মহান পবিত্র জানিয়ে দেয়। জনমনে এই ধারণা জন্মিয়ে দেয় যে, তাকে কেউ স্পর্শও করতে পারে না। তার মনে যা-ই জাগে তা-ই সে করে। আর এই ইচ্ছার কোনো সীমা নেই। যে-কোন ভাবেই হোক, তার ইচ্ছাই কার্যকর হয়, সে যেমন চায় তেমনি চিন্তা-বিশ্বাস, চরিত্র ও রীতিনীতি গ্রহণ করতে পারে। সমাজের কোনো অধিকার নেই তার পথে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার। সমাজ তার কোনো কাজকে বলতে পারবে না এটা ভুল কিংবা এটা ঠিক। সমাজ কি? ব্যক্তির ওপর কর্তৃত্ব বা মুরুব্বীগিরি করার তার কি অধিকার থাকতে পারে?
এখানে ব্যক্তি ‘খোদা’ হয়ে বসেছে। আর এ কারণেই প্রত্যেক ব্যক্তিখোদা যা ইচ্ছা হয় তাই করে। এই সকল ‘খোদা’র জন্যে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ক্ষেত্রে উদার, উন্মুক্ত এবং তাদের অনস্বীকার্য অধিকার।
পক্ষান্তরে সমাজের সর্বাধিক গুরুত্ব স্বীকার করে যে ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তা সমাজকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তার প্রতি সম্মান প্রদর্শনে স্বাভাবিকতার সীমা লংঘন করে অনেক দূরে চলে যায়। এখানে সমাজ যেমন এক পবিত্র দেবতা। ব্যক্তির জন্যে এখানে কোনো পবিত্রতা নেই, গুরুত্ব নেই, নেই কোনো অধিকার ও মর্যাদা। কোনো জিনিসের মালিক হওয়ারও তার অধিকার নেই। তার নিজের চিন্তা-মর্যাদা। কোনো জিনিসের মালিক হওয়ারও তার অধিকার নেই। তার নিজের চিন্তা-বিশ্বাস, নৈতিকতা ও রীতিনীতি নির্ধারণ ও অনুসরণ করার অধিকারও স্বীকৃত নয়, কোনো ব্যক্তি সমাজ সমষ্টির কোনো কাজের ওপর প্রশ্ন তুলতে বা আপত্তি জানাতে পারে না। তার কোনো কাজ মন্দ তো বলতেই পারে না, পারে না ভালো ও সঠিক বলতেও। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, ব্যক্তি কি, কে ব্যক্তি? …তার কি অধিকার থাকতে পারে সমাজের ওপর কোনোরূপ মাতব্বরী করার?
এখানে সমাজ যেতন এক মহাদেবতা। ফলে যা-ই ইচ্ছা তা-ই করারই তার অধিকার রয়েছে এবং করেও। আর ব্যক্তি নিতান্তই দাসানুদাস।
উক্ত দুই প্রকারের প্রতিটিই বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে বলিষ্ঠ কণ্ঠে দাবি করছে।
কিন্তু তা যে নিতান্তই ভুল, ভুল বিজ্ঞানের ভিত্তি, আর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, উক্ত দুটি সমাজ ব্যবস্থাই পরস্পর বিরোধী। একটির বিপরীতমুখী অপরটি। এ দুটি ব্যবস্থার মধ্যে কোনো মিলমিশ –কোন সন্ধি-সমঝোতা কখনোই হতে পারে না। তাহলে একই সময় এ দুটিই কি করে সঠিক ও যথার্থ হতে পারে; -হয় এর যে-কোনো একটা কিংবা এর দুটিই অবশ্যই ভুল হবে। …আর এ-ই হচ্ছে আসল সত্য কথা।
ব্যক্তির পবিত্রতা পৌরাণিক ধারণা গড়ে উঠেছে সেই বিবর্তন ও অগ্রগতি থেকে, যা ইউরোপ রেনেসাঁর সময় থেকে অর্জন করেছে।
মধ্যযুগের জাহিলিয়াতে ইউরোপীয় জনগণ কঠিন চাপের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, সে চাপ ছিল অত্যন্ত খারাপ ধরনের, যা প্রত্যেক মানব সত্তাকেই চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছিল। জনগণ জুলুম-নিপীড়নের তলায় পড়ে আর্তনাদ করে উঠেছিল। একদিকে জনগণের কাঁধের ওপর গীর্জা ও ধর্মীয় লোকদের কর্তৃত্ব-আধিপত্যের জোয়ার চেপে বসেছিল। তখন সাধারণ মানুষের সরাসরিভাবে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের কোনো অধিকার ছিল না। পাদ্রী-পুরোহিতদের মধ্যস্থতা ছিল একান্তই অপরিহার্য। এই পাদ্রী-পুরোহিতদের সুপারিশ ছাড়া কারোর ক্ষমতা পাওয়াও সম্ভব ছিল না। কেউ যদি আল্লাহর কাছে স্বীয় গুনাহ-খাতার স্বীকারোক্তি করতে প্রস্তুত হয়, তারলে খোদ পাদ্রীর সম্মুখে নিজের গুনাহকে স্বীকার করাই ছিল তার জন্যে একমাত্র উপায়। মোটকথা মানুষ ব্যক্তিগতভাবে কোনোরূপ মাধ্যম ছাড়া আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের কথা ভাবতেও পারত না।
অপরদিকে রাজন্যবর্গ ও লর্ডদর প্রভুত্ব ও প্রাধান্য জনগণের মাথার ওপর সওয়ার হয়ে বসেছিল। এই রাজন্যবর্গই ছিল সমাজের সব চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ লোক। আর তাদের সমস্ত চাপ ছিল জনসাধারণের ওপর। অথচ সেই জনগণের না ছিল কোনো অধিকার, না মর্যাদা, তবে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যে কত ছিল তা হিসেব করেও শেষ করা যায় না।
এই সমাজে ব্যক্তির কোনো গুরুত্ব নেই। প্রকৃতপক্ষে সে কোনো কিছুর মালিক নয়, সামন্তই হচ্ছে সব কিছুর একচ্ছত্র মালিক ও মুখতার। ব্যক্তি সাধারণভাবে সরাসরি কোনো পারস্পরিক কার্যক্রম গ্রহণ করারও অধিকারী নয়। রাষ্ট্রের সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনেরও কোনো অধিকার নেই তার। রাষ্ট্র তো তাকে চিনে-ই না, চিনলেও তা চিনে সামন্তের মাধ্যমে, সেই তাকে অগ্রসর করতে পারে, পারে পিছনে ফেলে রাখতেও। পারে সমাজে তার জন্যে একটা মর্যাদা গড়ে তুলতে, পারে তার অস্তিত্বকেই বিলীন করে দিতে। এ কারণেই সামন্ত ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মাঝখানে সম্পর্কের একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়, ঠিক যেমন পাদ্রী ও পুরোহিতরা ব্যক্তি ও খোদার মধ্যকার সম্পর্ক স্থাপনে একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এখানে ব্যক্তির কোনো রাজনৈতিক অধিকারই নেই, জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই, নিরাপত্তা নেই কোনোরূপ সুবিচার পাওয়ার …মোটকথা কোনো ধরনের কোনো নিরাপত্তা পাওয়ারও তার অধিকার নেই।
উপরন্তু মূল সমান্ত ব্যবস্থাই তার জাহিলিয়াতের রূপ পরিগ্রহ করেছিল ইউরোপে। তা ব্যক্তিত্বের ওপর কিছুমাত্র নির্ভরশীল ছিল না। সামন্ত ব্যবস্থার সব কিছু কেবলমাত্র সামন্তকে কেন্দ্র করেই সামন্ত ব্যক্তিই সেখানকার সর্বেসর্বা। এই ব্যবস্থায় সমস্ত গুরুত্ব ছিল সামন্তবাদভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার ওপর। ব্যক্তির কোনো স্বাতন্ত্র্যই স্বীকৃত ছিল না তথায়। এই সমাজের সাংগঠনিক অবস্থা ছিল স্থায়ী, স্থবির। কোনোরূপ পরিবর্তনের কোনো প্রশ্নই উঠত না সাধারণভাবে। চাষের জমি-কেন্দ্রিক জীবন সেখানে সম্পূর্ণ স্থির, নিস্তব্ধ,গতিহীন, পুঁতিগন্ধময়। শত শত বছর অতীত হয়ে যেত, কিন্তু তথায় জীবন যাত্রায় এক বিন্দু পরিবর্তনও আসত না। ব্যক্তি আসত ব্যক্তি চলে যেত। মনে হত, কেউ আসেও নি, কেউ যায়ও নি। ফলে ব্যক্তি তার নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কেও সচেতন হতে পারত না, তার যে কোনো অস্তিত্ব আছে, সে বেঁচে আছে, তা বুঝবারও কোনো কারণ ঘটত না। তা চালু করার রীতি নিয়মের বন্ধনে জনগণকে আষ্ট্রেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলত। সে রীতি নিয়মের বন্ধনে বাঁধা হলে তাদের ব্যক্তিত্ব স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট হয়ে উঠবে এমন কোনো বিশ্বাসও তাদের ছিল না। রীতি-নিয়ম তাদের হেঁচড়িয়ে টেনে নিয়ে চলত। ঠিক যেমন কলুর বলদ নিজেরই চতুষ্পার্শ্বে ঘুরে বেড়ানোর কাজে চব্বিশ ঘন্টা বন্দী হয়ে থাকে।
ইউরোপের ক্রুসেড যুদ্ধ এবং মাগরিব ও আন্দালুসিয়া (স্পেন)-এর জ্ঞান কেন্দ্রসমূহের মাধ্যমে যখন ইউরোপের নিষ্প্রাণ তুহিন হিমদেহে নব জীবনের সঞ্চার হয়েছিল। জনগণের কাঁধে আবহমান কাল থেকে চেপে থাকা সমস্ত দুর্বহ বোঝা ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছিল। সর্বপ্রথম তারা গীর্জার জগদ্দল পাথরকেই সরিয়ে নামিয়ে নিক্ষেপ করল। আর সেই সাথে নেমে গেল পাদ্রী পুরোহিতদের গোলামী লাঞ্ছিত জোয়াল।
তখন তারা গীর্জার দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়ে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিল প্রকৃতি পূজার আর এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে। প্রকৃতি হয়ে পড়েছিল তাদের জবরদস্ত দেবতা, তারই নামে –তারই দোহাই দিয়ে মানুষ মানুষের ওপর দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন ও কর্তৃত্ব চালায়। এই নূতন দাসত্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় উপাসক ও উপাস্য –দাস ও মনিব পরস্পরের সাথে সরাসরি কোনোরূপ মাধ্যম ছাড়াই মিলিত হওয়ার সুযোগ পেল।
আমরা এখানে ইতিহাসের কতিপয় ঘটনার উল্লেখ করছি মাত্র। ইতিহাসের ঘটনাবলীর ‘সাফাই’ পেশ করার উদ্দেশ্যে নয়। গীর্জার দাসত্ব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার পর প্রকৃতি পূজার অর্থহীন শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে পড়ার কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি পেশ করারও কোনো উদ্দেশ্যই আমাদের নেই। পলায়ন ও বিভ্রান্তি নিতান্তই মানসিক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। এর পক্ষে কোনো যুক্তিই পেশ করা যায় না। অবশ্য গীর্জার ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব প্রতিপত্তি দূর করা ও তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া কালে জনগণের জন্যে একটা বিরাট ও সুবর্ণ সুযোগ ছিল মহান আল্লাহর ইবাদত কবুল করার। খুব সহজেই তা তারা পারত। কিন্তু তা না করে তারা নতুন কিছু দেবতা উপাস্য বানিয়ে নিল, যা ক্ষয়িষ্ণু, বিলীয়মান, সত্তাহীন এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা সেই গুলোরই উপাসনা-আরাধনা আর দাসত্ব করতে শুরু করেছিল।
অতঃপর তারা সামন্তবাদী ব্যবস্থার অভিজাত শ্রেণীর প্রভুত্ব কর্তৃত্বের বোঝাও দূরে নিক্ষেপ করার ও তার শৃঙ্খল থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার সুযোগও পেয়ে গেল।
ফরাসী বিপ্লব ছিল এই পরিবর্তন সৃষ্টি প্রধান হোতা। তা জমির মালিকানা ও সামন্ত সমাজের অভিজাত শ্রেণীর শৃঙ্খল চূর্ণবিচূর্ণ ও ছিন্ন ভিন্ন করে দিল ইউরোপীয় বা ফ্রান্সের নিজস্ব পদ্ধতিতে। কেননা তা-ই বিপুল জনতাকে দাসত্ব শৃঙ্খলে বন্দী করে রেখেছিল।
অতঃপর ব্যক্তি কিছুটা চেতনা লাভ করতে পারল। সচেতন হলো তার স্বাতন্ত্র সম্পর্কে। কিন্তু এই জাহিলিয়াতই তাকে আল্লাহর সাথে পরিচিত হতে দিল না। ফলে এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের চেতনাটা আল্লাহর হেদায়েত লাভ করতে অক্ষম থেকে গেল। পাদ্রী পুরোহিতদের মধ্যস্থতা ছাড়াই সরাসরি আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার কোনো চেষ্টাই তারা করেনি। তারা একতরফাভাবে গীর্জা ও গীর্জার খোদা উভয় থেকেই বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল।
তারা সমাজের পুরাতন পচা-দুর্গন্ধময় রীতি নিয়মকে ছাটাই বাছাই করে দূরে নিক্ষেপ করে উত্তম ও পবিত্র আদর্শ রীতিনীতি গ্রহণ করার এবং এই পথে এক আদর্শবিশিষ্ট ব্যক্তিসত্তা গড়ে তুলতে আদৌ ইচ্ছা করেনি, সেজন্যে কোনো চেষ্টাও চালায়নি। তারা বরং রীতিনীতি ঐতিহ্য নামে চরিত্র সমষ্টির যা কিছু পেয়েছে, সবকিছুই নষ্ট ও অকেজো মনে করে দূরে নিক্ষেপ করেছে।
এটা ছিল রীতিমত একটা পাগলামী। এই ভাঙ্গাচোড়ায় ব্যক্তি কোনো বুদ্ধিমত্তারই পরিচয় দিতে পারেনি। মাথার উপরের সব বোঝা থেকেই নিষ্কৃতি পাওয়ার নামে তারা ভালো মন্দ নির্বিশেষে সব কিছুই দূরে নিক্ষেপ করে দিল।
অতঃপর এলো শিল্প বিপ্লবের যুগ। তা সমাজ সংস্থার গোটা প্রাসাদের অবশিষ্ট ভিত্তিটিকেও চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল।
শিল্প বিপ্লব সমাজ সংস্থায় পূর্ণমাত্রায় পরিবর্তন নিয়ে এলো। সবকিছুতেই পরিবর্তন। সমাজকে নবতর ভিত্তিতে গড়ে তুলতে শুরু করে দিল। …মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য গড়ে তোলায় শ্রমিক কর্মচারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
শ্রমিক কর্মচারীরা গ্রাম থেকে ব্যক্তিগতভাবেই ছুটে চলে এসেছিল কল-কারখানায় কাজ করার –শ্রমের বিনিময়ে উপার্জন করার –উদ্দেশ্যে। তারা পরস্পর পরিচিত ছিল না, ছিল না তাদের পরস্পরের মধ্যে কোনো সম্পর্ক, কোনো যোগাযোগ। শহর-নগর শিল্প-কেন্দ্রে এসেও তারা বিচ্ছিন্ন ভাবেই বসবাস ও জীবন যাপন করতে লাগল। কেবল শ্রম-কেন্দ্রসমূহেই তারা পরস্পরের সাক্ষাৎ পেত, পরস্পরের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেত। কিন্তু গ্রামে কৃষক ও ভাইদের পরস্পরের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, এখানে তা গড়ে উঠল না। গ্রামে জনগণ স্বাভাবিকভাবেই পরস্পরের পরিচিত ও সম্পর্কশীল হয়ে থাকত। নৈকট্য-নিকটবর্তিতা, আত্মীয়তা ও পাশাপাশি কাছাকাছি বসবাসের কারণে একটা স্থায়ী মিলমিশ ও সম্পর্ক সম্বন্ধ গড়ে উঠত। এমন সব রীতিনীতি ঐতিহ্যও সেখানে চালু হয়ে থাকত, যা অন্তরের দিক দিয়ে অভিন্ন সত্তায় পরিণত করে দিত। চিন্তা-ভাবনায় ও রীতিনীতি রেওয়াজে তারা পরস্পর সুপরিচিতি হয়ে থাকত।
কিন্তু শিল্প-বিপ্লবের পর তারা গ্রামাঞ্চল ত্যাগ করে কল-কারখানার দেশে এসে বিচ্ছিন্ন একাকী পরিবার পরিজনবিহীন অবস্থায় পড়ে গেল। প্রথম পর্যায়ে যে সব শ্রমিক গ্রাম ত্যাগ করে শহরাঞ্চলে যেতে পেরেছিল, তাদের সঙ্গে তাদের পরিবার পরিজন না থাকায় তারা নিশ্চিত জীবন যাপন করার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত চিল। তারা শুন্য গর্ভ পরিবেশে দিন কাটাতে লাগল। এদের অধিকাংশই ছিল যুবক, অবিবাহিত। বৈবাহিক সম্বন্ধে তারা তখনও বন্দী হয়নি। কোনো রূপ বৈবাহিক দায়িত্বও তাদের স্কন্ধে পড়েনি।
এভাবে শহরাঞ্চলে এসে প্রত্যেক শ্রমিকই তার একাকীত্বে নিজের স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা সম্পর্কে চেতনা লাভ করেছিল। সামাজিক সম্পর্কশীলতা সম্পর্কে এখানে তাহা কোনো চেতনা বা অনুভূতিই পায়নি।
এই অবিবাহিত যুবক শ্রমিকদের সাথে কাজে যোগ দিয়েছিল অসংখ্য মেয়েলোকও। তারাও এই একাকীত্বের দুর্বহ চাপে জর্জরিত হচ্ছিল। এই সব মেয়েরা ইতিপূর্বে যথেষ্ট উপেক্ষা ভোগ করে এসেছে। তাদের অস্তিত্ব, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা বলতে কোনো কিছুর সাথে পরিচিত হওয়ার কোনো সুযোগই পায়নি। নিছক অধীন অনুসারী ব্যক্তিজীবন ছিল তাদের। তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক ও চিন্তাগতভাবে তারা একটা ভিন্ন ধরনের জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল। তারা তাদের নিজস্ব ব্যাপারাদি নিয়ে ও নিজস্বভাবে চিন্তা করার অধিকার বা সুযোগ পায়নি। তাদের জন্যে যা কিছু ভাবনা চিন্তার ব্যাপার ছিল, তা করতে তাদের পিতামাতা, বড় ভাই-বোন বা তাদের স্বামীরা, তারা সমাজ নিয়েও মাথা ঘামাত না। বৃহত্তর সমাজের সাথে তাদের কি সম্পর্ক? সমাজের প্রতি তাদের কি কর্তব্য দায়িত্ব বা সমাজের ওপরই বা তাদের কি অধিকার? এ সব জটিল বিষয়ে তারা কখনোই চিন্তা করেনি, চিন্তা করার কোনো প্রয়োজনও তারা বোধ করেনি। যদিও কখনও কিছু চিন্তা করতেও, তবে তা করত তাদের স্বামীর চিন্তাধারা অনুযায়ী। কেননা স্বামীই তাদের কাছে সমস্ত তৈরী করা দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে আসত। সে সব জিনিস প্রস্তুত করতে স্ত্রীলোকের কিচুই করতে হতো না। তাছাড়া পূর্ববর্তী সমাজে নারী স্বতন্ত্রভাবে কোনো কিছুর মালিক হতো না, কোনো কিছুতে নিজস্বভাবে কোনো হস্তক্ষেপও করত না। পুরুষই হত সব কিছুর মালিক। যা চাইত স্বামী তাই করত। চলতি প্রথা অনুযায়ী চলতো নারীর জীবন। আর চলতি নিয়মের বাধ্যবাধকতা পুরুষের তুলনায় মেয়েদের ওপরই আরোপ হতো অনেক বেশী। পুরুষ হতো সম্পূর্ণ স্বাধীন। নারী না বুঝে শুনেই অন্ধবাবে সামাজিক নিয়ম নীতি মেনে চলত। আর নিতান্ত ভাগ্যলিপি মনে করেই যেমন তেমন ভাবে জীবনটা অতিবাহিত করে দিত।
কিন্তু এই নারী যখন সম্পূর্ণ মুক্ত অবস্থায় শ্রম করতে শুরু করেছিল, তখন তার মনে মগজে বিরাট বিপ্লব ও আমূল পরিবর্তন সূচিত হলো।
এক্ষণে তার হাতে অর্থ এসে গেল। স্বোপার্জিত অর্থ সম্পদের সে হলো মালিক। এ মালিকানা প্রত্যক্ষ, পূর্ণাঙ্গ ও প্রকৃত। যা ইচ্ছায় আসে তাই করতে সে হলো পূর্ণ মাত্রায় সক্ষম।
এখন সমাজ সমষ্টির সাথে তার কার্যক্রমের সম্পর্ক স্থাপিত হলো একান্তই ব্যক্তিগত এবং প্রত্যক্ষভাবে। শিল্প কারখানার অভ্যন্তরে, ব্যবসায় কেন্দ্রে ও রাস্তাঘাটে –সর্বত্রই সে এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন।
পুরুষদের সাথেও এই স্বাধীনতা নারীর কার্যক্রম সম্পর্ক সরাসরিভাবেই স্থাপিত হলো। যদিও এ সম্পর্কে তারা পুরুষদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াল না। অত্যন্ত তাতে নিতান্তই অধীন অনুসারী ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যহীন হয়ে দেখা দিল না। তারা স্বাতন্ত্র্য সত্তা লাভ করে পুরুষদের সমান কাতারে এসে কর্তৃপক্ষের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হলো।
এইসব ক্ষেত্রের কোনো স্থানেই তারা নিজেদেরকে অস্বিত্বহীন মনে করল না। তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য পুরাপুরিভাবে বিকশিত ও অনস্বীকার্য হয়ে উঠল।
অল্প বয়সের বালকরাও এই অবস্থার মধ্যেই এসে গেল। তারাও ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য লাভ করল। এই বাচ্চা বয়সের লোকেরাও হয়ে ওঠল এক একজন ব্যক্তি। তারা তাদের বাচ্চা বয়স থেকেই মাথার ঘাম ফেলে স্বাধীনভাবে উপার্জন করতে লাগল। যদিও তাদের উপার্জনের পরিমাণ হতো খুবই সামান্য। এই যুবক, নারী ও বালক-বালিকা সকলেই স্বাধীন স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা লাভ করেছিল। প্রত্যেকেই এক একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব।
কিন্তু এই ব্যক্তিবাদ ভয়ংকরভাবে বিপথগামী হয়ে গেল। ডেকে আনল মারাত্মক ধরনের পরিণতি।
এটাও কোনো স্বাভাবিক ও নিশ্চিত অনিবার্য ব্যাপার ছিল না। এই স্বতন্ত্র মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিসত্তাগুলোর বিভ্রান্ত-বিপথগামী হওয়ার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণও ছিল না। তারা তো সুস্থ মানব সমাজেরই এক-একটি অংশ। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে বিপথগামী হয়ে পড়ল। কেননা তার জন্মই হয়েছে জাহিলিয়াতের অন্ধকারে, যা আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত হয়ে অনেক দূরে সরে গেছে। তা ছাড়া বহু যুগ ও শতাব্দী কাল ধরে সামন্তবাদী ব্যবস্থা যে ব্যক্তিসত্তা গড়ে তুলেছিল, হঠাৎ করে তা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া দেখা দিল অত্যন্ত রুঢ়, ভারসাম্যহীন হয়ে।
এ সব লোক তাদের মুক্ত স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার একাকীত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে শুরু করল সম্পূর্ণ ভ্রান্ত অসমান পথে। তারা এমন পথের সাক্ষাৎ পেল না, যা তাদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের অনুভুতিসহ একটা ভারসাম্য দিতে পারত তাদের ন্যায্যা অধিকার, অনুসরণ এবং স্বাধীনতা ও সামাজিক বাধ্যবাধকতা পালনসহ।
পরবর্তীতে এই নতুন শহর-নগরের অধিবাসীরা ধীরে ধীরে এমন একটি জনগোষ্ঠীতে পরিণত হল, যার সাথে দ্বীন-ধর্ম-নৈতিকতা ও ঐতিহ্য বলতে কিছুই থাকল না। তারা হলো এই সব কিছু থেকে মুক্ত ও সম্পর্কহীন। যেহেতু তারা গ্রামাঞ্চলের রুগ্ন শুষ্ক বিচ্ছিন্ন জীবন ধারা থেকে সহসাই মুক্ত হয়ে নাগরিকত্বের উন্মুক্ত ও বাধা বন্ধনহীন জীবন ধারার চোখ ঝলসানো চাকচিক্যের মধ্যে এসে পড়েছিল। আর তাতে দ্বীন-ধর্ম থেকে ক্রমাগতভাবে বিচ্ছিন্নতা হতে হতে তা একটা স্থায়ী অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখানে তারা মানুষ সম্পর্কে একটা নবতর ব্যাখ্যাও লাভ করল, যার দৃষ্টিতে মানুষ মানুষ থাকল না, পশু হয়ে গেল। ডারউইন এই ভ্রান্ত ধারণা জনগণের মনে বদ্ধমূল করিয়ে দিয়েছিল। এখানে তারা ফ্রয়পের কাছ থেকে যৌন সম্পর্কের নবতর ব্যাখ্যাও জানতে পারল, তারা ছিল প্রবল শৃঙ্খলমুক্ত যৌবন শক্তির অধিকারী। যৌবনের নবজোয়ার বাঁধভাঙ্গা, দুকুল ছাপিয়ে দেওয়া জোয়ারের উন্মাত্ততা সকলের মনে ও দেহে মহাউল্লাসেরও সৃষ্টি করেছিল। তাদের কেউ পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিল না যদিও পারিবারিক বন্ধনে তাদেরকে পাপ পথ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখতে পারত। ফলে এই স্বতন্ত্র স্বাধীন ব্যক্তিসত্তাগুলো অবাধ-অনিয়ন্ত্রিত যৌন চর্চায় মশগুল হয়ে গেল। শহর নগরে গড়ে উঠল যৌন ব্যবসার বড় বড় আড্ডা।
ওদিকে নারীরাও ক্রমাগতভাবে পূর্ণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অধিকারী ছিল। এই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য তাদেরকে চরম বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতার গড্ডালিকা প্রবাহে নিক্ষেপ করল। এক্ষণে তারা সত্তা-স্বাতন্ত্র্যহীন অবস্থা থেকে মুক্ত। সকল ব্যাপারেই তাদের পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃত। এই রূপ অবস্থায়ই তারা তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নিয়ে সকল বাধা বন্ধনকেই ছিন্ন ভিন্ন করে দেওয়ার সংগ্রামে নেমে গেল।
সে বন্ধন ভালো ছিল কি মন্দ ছিল, তার কোনো বিচার বিবেচনাই তারা করেনি। তারা সেই সাথে ধর্ম, নৈতিকতা ও ঐতিহ্যও ধ্বংস করে দিতে লেগে গেল। কেননা সে সবগুলোই তাদের বর্তশান মুক্ত স্বাধীন জীবনের পথে প্রবল বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে এজন্যে যে, পুরুষরা সেগুলোকে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছিল, যেন নারীরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াতে না পারে। যদিও পুরুষরা নিজেরা সকল প্রকারের ধর্ম ও নৈতিকতার বন্ধন থেকে আগেই সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে বসেছিল।
পরে পুরুষ যখন স্ত্রীলোকদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করাও ত্যাগ করল, মেয়েরা বাধ্য হলো কর্মক্ষেত্রে বের হয়ে আসতে, তখন তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নৈতিকতাকে এমন একটা প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখতে পেল, যা তাদের স্বাধীন উপার্জনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, পুরুষরা জাহিলী ধারণানুযাযী আদতেই পশুত্ব গ্রহণ করেছিল। তারা তাদের কাছে থেকেই শ্রমোপার্জন করছিল। কিন্তু তারা মেয়েদেরকে কাজ করার সুযোগ দিতে রাজি হতো তখন, যখন তারা এই পুরুষদের সেই দাবি পূরণে প্রস্তুত হতো, যে দাবি পুরুস পশু নারী পশুর কাছে করে থাকে। -তাছাড়া তারা নিজেরাও পুরুষদের সাথে পূর্ণ সাম্য ও সমকক্ষতারও দাবি করে আসছিল। সে সমকক্ষতার দাবি প্রথমে ছির শুধু মজুরীর ব্যাপারে। পরে তা এলো সর্ববিষয়ে, সর্বক্ষেত্রে। আর এই সমকক্ষতাই এই নারী ও পুরুষ সকলকেই চরম যৌন উচ্ছৃঙ্খলতার রসাতলে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
এই নারী ও পুরুষের বর্তমান মনোভাবের পিছনে কাজ করছিল সেই ষড়যন্ত্রকারী ইহুদীদের মতাদর্শ, যার চরম লক্ষ্য ছিল উম্মী জনসাধারণকে চরমভাবে ধ্বংস করা। সে ছিল কার্ল মার্কসের চিন্তাধারা, ফ্রয়ড ও দরখায়েম-এর চিন্তাধারা। আর তা হচ্ছে এই যে, নৈতিকতা নিছক একটা প্রতিবন্ধকতা মাত্র। আসলে তার কোনো অর্থ নেই, তাৎপর্য নেই। যৌনতা তো মানুষের অস্তিত্বের সাথে অংগীভূত, তাকে কোনো ক্রমেই বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। আর নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাই হচ্ছে অবাধ যৌনতার একমাত্র পথ।–[(আরবী***************) দ্রষ্টব্য।]
অতঃপর সব বাঁধনবন্ধন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। রসাতলে ভেসে গেল সব নারী পুরুষ। গোটা সমাজ পড়ে গেল পংকিলতার সীমাহীন সুগভীর আবর্তে।
এর ফলে সমাজের বন্ধনও চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। পারিবারিক বন্ধন বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকল না। এখানে যৌন সম্পর্কই হলো মানুষে মানুষে নারী ও পুরুষে একমাত্র সম্পর্ক। নৈতিকতার কথা বাদ দিলেও এই যৌনতার সম্পর্ক নারী ও পুরুষকে প্রেম-ভালোবাসার বন্ধনে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বেঁধে একত্র করে রাখতে পারল না। থাকল না কোনো সম্মিলিত ও অভিন্ন নিয়ম-নীতি, ঐতিহ্য। মুহুর্তের মধ্যে নিঃশেষিত হওয়া দৈহিক সম্পর্কই প্রধান হয়ে দাঁড়াল। পাশবিক প্রবৃত্তির চরিতার্থতার পরই তা ছিন্ন হয়ে যেতে লাগল। আর দৈহিক কামনার তাগিতে পুরুষের জন্যে তা নিত্যনতুন নারী এবং নারীর জন্যে নিত্য নতুন পুরুষের প্রয়োজন দেখা দিল।
নৈতিকতার দিকে দৃষ্টি না দিয়েও প্রেম-ভালোবাসা ও মানসিক বৃত্তিসমূহ রোমান্টিক ব্যাপার রূপে গণ্য হলো। লালসার রোগ –বাস্তবে যারকোনো অস্তিত্ব বা স্থিতি নেই। বাস্তবে থাকল শুধু পাশবিক দৈহিক সম্পর্ক। আর দেহ একটা যৌন কামনা-লালসা সর্বস্ব হয়ে থাকল।
ডারউইনীয় জাহিলিয়াতই তাদের মনে এই ধারণার সৃষ্টি করে দিল। ফ্রয়েডের দ্বারা তারই সম্প্রসারণ সম্পন্ন হল। আর তাদের ছাত্ররা ও সমর্থকরা জীবনের সর্বত্রই এই ধারণাকে ছড়িয়ে দিল।
পুরুষ ও নারীর গোটা সত্তাই চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেল। ফলে এই নারী ও পুরুষ সে রকম নারী ও পুরুষ থাকল না, যে রকম মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’আলা তাদের সৃষ্টি করেছিলেন।
পুরুষরা তাদের সামাজিক সম্পর্ক সম্বন্ধ হারিয়ে ফেলল। তাদের মনে পরিবারে প্রতি থাকল না কোনো আগ্রহ, আকর্ষণ। অবশিষ্ট হয়ে থাকল শুধু যৌন সংসর্গ। অতঃপর তারা মানুষ না থেকে উৎপাদনের একটা যন্ত্র বা বিরাট যন্ত্রের নিষ্প্রাণ অংশে পরিণত হল। চিন্তা করার অনুভূতি লাভের শক্তিও হারিয়ে ফেলল। প্রতি মুহুর্তে তাদের জীবন অতিহাবিহ হতে থাকল উদ্দেশ্যহীন, লক্ষ্যহীন। মানুষের সাথে নিছক মানবিক সম্পর্ক বলতেও কিছু থাকল না। বস্তুগত উৎপাদন তাদের সাথে জীবন্ত সত্তাকে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ফেলে দেয়। তার মধ্যকার প্রাণ স্পন্দনকে স্তব্ধ করে দেয়। কেননা যান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাই এমন। তারা যখন এই উৎপাদনের কাজ থেকে অবসর পেত, তখন তাদের দেহে ও মনে জাগ্রত হিংসা পাশবিক প্রবৃত্তির চরিতার্থতা ছাড়া আর কোনো কাজ –কোনো ব্যস্ততাই থাকল না। ফলে তাদের সমগ্র জীবনের একমাত্র চূড়ান্ত লক্ষ্যে পরিণত হলো এই দুটি কাজঃ একটি, যান্ত্রিক উৎপাদন আর দ্বিতীয়টি, পাশবিক লালসার চরিতার্থ।
এদিকে নারীদের অবস্থাও ভিন্নতর কিছু থাকল না। তারাও ভেতরের দিক চরম বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
ডঃ চিনতে শাতী মিসরের ‘আল-আরহাম’ পত্রিকার ‘তৃতীয় লিংগের আত্মপ্রকাশ’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে লিখেছেনঃ
আমি এক সপ্তাহকাল ধরে পাঠাগারে পুরাতন আরবী পত্র-পত্রিকা পড়ায় ব্যস্ত ছিলাম। এই শ্রমসাধ্য অধ্যয়নের পর রোববারের ছুটিতে আমি আমার এক বান্ধবীর সাথে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা করলাম। আমার এ বান্ধবী ‘ফীনা’ নগরীর উপকণ্ঠে মহিলা ডাক্তার হিসেবে কাজ করছিল। আমি মনে করেছিলাম, রোববার তো দেখা-সাক্ষাতের উপযুক্ত দিন। কিন্তু আমার বিস্ময়ের কোনো সীমা থাকল না এই দেখে যে, আমার সে বান্ধব, যখন আমার জন্যে দরজা খুলে দিল, তখন তার হাতে ছিল আলু। সে আলুর খোসা ছড়াতে ব্যস্ত ছিল। সে আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। আমরা সেখানে বসলাম। আমার বান্ধবী আমার বিস্ময়ের ভাব বুঝতে পেরে বললঃ এখন মহিলা ডাক্তার রোববারের ছুটির দিনে রান্নাঘর ঢুকে আছে এই দেখে বোধ হয় তুমি খুবই বিস্মিত হয়ে পড়েছ? আমি হাসতে হাসতে বললামঃ হ্যাঁ, তবে রোববারের দিনে ব্যস্ত থাকাটা তো বুঝলাম, কিন্তু আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি এই দেখে যে, তুমি তোমার শ্রমসাধ্য পেশার কাজ করেও এই রান্নাঘরে আসতে পেরেছ।
সে বললঃ কথাটি যদি উল্টিয়ে দিতে, তাহলে সম্ভবত সঠিক কথা হতো। কেননা রোববারে কাজ করাটাই আমাদের সমাজে আশ্চর্যের ব্যাপার। কিন্তু কি করা যাবে। রোববারটাতেই তো অবসর পাওয়া যায়। তারপর রান্নাঘরের কাজ! আসলে আমার ন্যায় অন্যান্য জাতীয় খিদমতের কাজে নিয়োজিত মহিলারা যে মানসিক অস্থিরতার শিকার হয়েছে, রান্নাঘরে প্রবেশ করা হচ্ছে তারই চিকিৎসা ব্যবস্থা।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই মানসিক অস্থিরতার প্রকৃত কারণ কি? অথচ সামষ্টিক জীবন পুরোপুরি পাশ্চাত্যের নারীর মন-মেজাজের সাথে সামঞ্জস্যশীল!
বলতে লাগলঃ আধুনিক প্রাচ্যা নারীর নতুন দায়িত্বের সাথে এই মানসিক অস্থিরতার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং এ তো আসন্ন মানসিক বিপ্লবের প্রতিধ্বনি মাত্র। সমাজ বিজ্ঞানী, ফিজিয়লজিস্ট ও জীবতত্ত্ববিদরা বলছেন, নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ঘরের বাইরের জীবনের অংশ গ্রহণকারী মেয়েদের সন্তানাদি খুব কমই হয়। আগে তো মনে করতাম যে, বাইরে যাতায়াতকারী মেয়েরা গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব ও স্তন দানের ঝামেলায় বুঝি পড়তে চায় না। কেননা এসব ঝামেলায় তাদের কর্মজীবন খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু পরে খুব চিন্তা ভাবনা করে পরিসংখ্যান যাচাই করে দেখলে জানা গেল, সন্তান সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় মেয়েদের কোনো দায়িত্ব নেই। জন্মহার হ্রাস পাওয়ার কারণ হচ্ছে বন্ধ্যাত্ব। তাও আমার নারীর বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোনো ত্রটির কারণে হয় না। আসল কথা হচ্ছে, ঘরের বাইরে কর্মব্যস্ত মহিলারা ব্যক্তিসত্তা মা হওয়ার যোগ্যতা পরিহার করে চলেছে এবং বস্তুগত মানসিক ও স্নায়ুবিক দিক দিয়ে মাতৃসুলভ ব্যক্তিসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পুরুষদের সাথে সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্য রক্ষার চেষ্টা এবং কর্মক্ষেত্রে তাদের সাথে একত্র হওয়াও নারীর মা হওয়ার যোগ্যতাকে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত করে দিচ্ছে।
জীববিজ্ঞানীরা এ পর্যায়ে সুপরিচিত প্রাকৃতিক আইনের বিশেষ মতাদর্শের উল্লেখ করেছে। আর তা হচ্ছে, কাজ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সৃষ্টি করে। তার অর্থ হচ্ছে, নারীর মাতৃত্বের কাজ, যা স্ত্রীলোকের বিশেষত্ব হিসেবে মা হওয়ার মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছিল, এখনকার নারীদের মাতৃত্বসুলভ কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার এবং পুরুষদের সংস্পর্শে ঢুকে পড়ার কারণে অনিবার্যভাবে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বিজ্ঞানীগণ আরও চিন্তা-গবেষণায় রত হলে অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাদের আরও সম্মুখের দিকে নিয়ে গেল। এক্ষণে বিজ্ঞানীগণ খুবই নিশ্চিন্ততা সহকারে বলছে যে, পৃথিবীতে এক তৃতীয় লিঙ্গের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে। তাতে মেয়েলোকদের মাত্র এমন কয়েকটি বিশেষত্ব অবশিষ্ট থাকবে, যা দীর্ঘ চর্চার কারণে মেয়েদের ব্যক্তিসত্তার সুদৃঢ় হয়ে বসেছে।
এই মতের ওপর অনেক ধরনের আপত্তি ও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রথম প্রশ্ন এই উঠেছে যে, ঘরের বাইরে অবস্থানকারী বহু সংখ্যক মেয়েলোকই বন্ধ্যাত্বকে অপছন্দ করে। সন্তান কামনা করে (এ সত্য হলে উক্ত মতো সত্য হতে পারে না।)
দ্বিতীয় আপত্তি এই তোলা হয়েছে যে, সন্তানসম্ভবা মেয়ে শ্রমিক কর্মচারীকে কাজে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। আর আইনসম্মতভাবেই তারা স্বীয় স্বাভাবিক কর্তব্য পালনের অনুমতি পেয়ে থাকে। তৃতীয় প্রশ্ন এই যে, নারী তার জন্যে নির্দিষ্ট বিশেষ পরিবেশ থেকে বাইরে বরে হয়ে এসেছে খুব বেশী দিন হয়নি –এর মধ্যে বহু কয়েকটি বংশের সৃষ্টি হয়নি। অথচ নারীর মা হওয়ার যোগ্যতা শত সহস্র বৎসর কাল ধরে রয়েছে।
প্রথম প্রশ্নের জবাব এই দেওয়া হয়েছে যে, সন্তান পেতে চায় এমন মেয়ে লোকের মনে সন্তান প্রসবজনিত কষ্টের ভীতিটাও সমানভাবে রয়েছে। তা ছাড়া বাচ্চা জন্ম ও লালন-পালন তারকাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে, নারীর সন্তান প্রসব ও লালন-পালনের অনুমতিদান আইনের কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকে। অনেক শিল্প-মালিকই কাজের জন্যে এমন মেয়েলোক বাছাই করে নেয়, যাদের সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তৃতীয় প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়েছে এই বলে, নারীর ঘরের বাইরে চলে যাওয়ার বয়স খুব বেশি দিন হয়নি একথা ঠিক; কিন্তু নারী পুরুষদের সমতা সমকক্ষতা ও সাদৃশ্য গ্রহণে মাত্রাহীন আগ্রহ প্রদর্শন করেছে, তাদের স্নায়ুমণ্ডলীর ওপর দিন-রাত এই চিন্তাই সওয়ার হয়ে রয়েছে এবং তাদের মন-মগজে শক্ত হয়ে বসে আছে, এই কারণে জীবতাত্ত্বিক পরিবর্তনও খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হয়ে পড়বে।
বর্তমানে এই বিষয়ে বিশেষ অধ্যয়নকারীরা স্ত্রীলোকদের মধ্যে প্রকাশমান পরিবর্তনসমূহের গভীর পর্যবেক্ষণ করছে, এ বিষয়ে পরিসংখ্যানেরও যাচাই করা হচ্ছে যে, শ্রমজীবী মেয়েলোকদের বন্ধ্যাত্ব, স্তনে দুধ শুকিয়ে যাওয়া ও মা হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলার কারণ সমূহ কি?
আলোচ্য সর্বগ্রাসী তুফানের মাঝে যে বালকরা নিজেদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের অনুভূতি ও চেতনা লাভ করেছে, তারা আসলে মারাত্মক বিপর্যয় ও বিপথগামিতার মধ্যে পড়ে গেছে।
যে পরিবারের পুরুষ ও মেয়ে শিল্প কারখানা ও ব্যবসায় কেন্দ্রে কাজের জন্যে ঘরের বাইরে চলে যায়, সেই পরিবারের বাচ্চা-বালকদের জন্যে স্নেহ মমতার আকর্ষন বলতে কিছুই থাকতে পারে না। অথচ তা-ই ছিল এমন জিনিস যা তাদের শক্তভাবে বেঁধে রাখতে পারত, তাদের হৃদয়ে প্রেম-ভালোবাসা-স্নেহ-মমতার বীজ বপন করতে পারত। তাদের চিন্তা ও চেতনা ভারসাম্য রক্ষা করে উন্মোচিত হতে পারত। যৌনতার নিয়ম-কানুন তারা শিখতে পারত। বংশবৃদ্ধির লক্ষ্য যে যৌন সম্পর্ক, তার প্রতি শ্রদ্ধবোধ শেখা দরকার। যৌন লালসা চরিতার্থ করার নামই নয় যৌনতা। তার মাধ্যমেই মানবতার মর্যাদানুরূপ সম্পর্কসমূহ সুদৃঢ় হয়ে ওঠে।
পরিবার থেকে মা’র সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে গেলে মানুষের মন-মানসিকতা অনুভূতির সম্পর্কও ছিন্ন হওয়া অবধারিত। তখন ঘরটা একটা হোটেলে পরিণত হয়। তাতে পুরুষ ও নারীর বসবাস করে বটে; কিন্তু পিতা ও মাতা হয় যেন দুইজন বেতনভুক্ত কর্মচারী। একজন পিতৃত্বের দায়িত্ব পালন করে, অপরজন করে মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন। সবকিছুই বাহ্যিক প্রদর্শন মাত্র, ঠিক যেমন বেতনভুক্ত কর্মচারীরা কাজ করে থাকে। এ দায়িত্ব পালনের সাথে মন ও অন্তরের কোনো সম্পর্ক থাকে না। এ কাজ স্থায়ীভাবে করে যাওয়ারও কোনো আনন্দ কেউ পায় না। এ যেন রুটিনবদ্ধ কাজ। জীবনের ওপর একটা বড় দুর্বহ বোঝা যেন।
এরই ফলে সন্তানের বিপথগামিতা অনিবার্য পরিণতি হয়ে দেখা দেয়। তারা ঘরে চাকর বা ধাত্রীর হাতে লালিত পালিত হোক কিংবা কোনো শিশু সদনে আরও বহু পরিত্যক্ত শিশুর সাথে একত্রে লালিত হোক, তাতে মূলগতভাবে কোনোই পার্থক্য হয় না। কেননা এরা সকলেই মা-বাবা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন –পিতামাতার স্নেহ-বাৎসল্য থেকে বঞ্চিত।
আলেকসিল ক্যারেল লিখেছেনঃ
আধুনিক যুগের সমাজ পরিবার লালন-পালনের কাজটিকে শিক্ষা-নিকেতনের হাতে সোপর্দ করে এক বিরাট ভুল করে বসে আছে। এক্ষণে মায়েরা তাদের বাচ্চাদের শিশুসদনে ফেলে চলে যাচ্ছে, যেন সহজেই তাদের কাজের ক্ষেত্রে ফিরে যেতে পারে। অথবা কোনো সামাজিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কিংবা শিল্প সাহিত্য সংক্রান্ত অনুষ্ঠানাদিতে নিশ্চিত মনে যোগাযোগ ও অংশ গ্রহণ করতে পারে। ব্রীজ খেলা বা সিনেমা দেখার ব্যস্ততাও তো কম নয়। এমনিভাবে চরম আলস্যের মধ্য দিয়ে তাদের মহামূল্যবান সময় অতিবাহিত করে। পরিবারের একত্বতা খণ্ড খণ্ড করা ও বাচ্চাদের সাথে একসাথে বসা ও শিক্ষামূলক আলোচনায় সময় কাটানোর অবসরকে হারিয়ে ফেলার জন্যে তারাই দায়ী।
কুকুরের বাচ্চাগুলোকে সমবয়সী কুকুর বাচ্চাদের সাথে একটি ঘরে বন্দী করে রাখা হলে এগুলোর ক্রমবৃদ্ধি অত দ্রুত হতে পারে না, যতটা হয় সেই বাচ্চাদের যারা মা-বাবার সাথে ঘুরে বেড়ায়। যেসব মানুষের বাচ্চারা তাদের সমবয়সীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে, আর যেসব বাচ্চা বড়দের সাথে থাকে, এই দুই ধরনের বাচ্চাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য অবশ্যম্ভাবী। কেননা বাচ্চা ফিজিয়লজি; বিবেক-বুদ্ধি ও স্বজ্ঞার দিক দিয়ে তা-ই শিখে, যা তাদের চতুষ্পার্শ্বে দেখতে ও শুনতে পায়। সমবয়সী বাচ্চাদের কাছ থেকেও অনেক শিখতে পারে। বিশেষ করে স্কুলে একাকী হলে বাচ্চা সম্পূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী হবে।একটি ব্যক্তির পরিপূর্ণ শক্তি লাভে তার জন্যে কিছুটা একাকীত্বেরও প্রয়োজন আছে। সেই সাথে প্রয়োজন পরিবারের সকলের সাথে একত্রিত হয়ে থাকার সুযোগ পাওয়া’।–[The man is the unknown]
আমেরিকান দার্শনিক ওয়াল দেরবাস্ট লিখেছেনঃ
“(আধুনিক সমাজে পুরুষ ও নারীর) বিয়ে প্রকৃত অর্থে কোনো বিয়ে নয়। কেননা তাদেরমধ্যে বাপ-মার ভাবধারা সঞ্চারিত হওয়ার পরিবর্তে একটি যৌন সম্পর্ক মাত্র গড়ে ওঠে। ফলে জীবন রচনাকারী ভিত্তিসমূহ ধ্বসে যায়। দাম্পত্য সম্পর্ক হয়ে পড়ে অত্যন্ত দুর্বল। কেননা জীবন ও প্রজাতীয় সম্পর্ক না থাকার দরুন এই বিয়ে সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়। ফলে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কহীন একক সত্তায় পরিণত হয়, যেন তাদের মধ্যে প্রকৃতই কোনো সম্পর্ক নেই। প্রেম-ভালোবাসায় যে আত্মসম্ভ্রম থাকে, তা নিঃসম্পর্ক ঠাট্টা-বিদ্রূপের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়”।–[দর্শনের পদ্ধতি।]
এই দীর্ঘ সময় ব্যাপদেশে সৃষ্ট বুর্জোয়া শ্রেণীর ব্যক্তিদের আরও অধিক স্বাধীনতা দানের চেষ্টা করতে থাকে। পূর্বে তো সমস্ত কর্তৃত্ব আধিপত্য ছিল সামন্তদের হাতে। তারা যেভাবে ইচ্ছা জনগণের রক্ত শোষণ করত। গীর্জা ব্যবস্থাও এই সামন্তবাদী ব্যবস্থার সহায়ক ও সমর্থক ছিল। আর জনগণকে আধ্যাত্মিকভাবে নিজেদের কর্তৃত্বাধীন বানাবার জন্যে নিজস্ব কল্যাণ হিসেবে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, যেন পাদ্রী পুরোহিতরা নিরংকুশ কর্তৃত্বের আসনে আসীন হয়ে থাকতে পারে; ডুবে থাকতে পারে প্রাচুর্যের স্তুপের মধ্যে।
পর শহর-নগর যখন বিকাশ ও সম্প্রসারণ লাভ করতে থাকল তখন বেতনভুক্ত কর্মচারী, কর্মকাণ্ডারী, কর্মাধ্যক্ষ ও ছোট ছোট পুঁজিপতি তথায় ভিড় জমাতে লাগল। তখন তারা লক্ষ্য করল যে, তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। জাতীয় পার্লামেন্টের ওপর সেই সামন্তবাদীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।
কথা বলার, সভা-সম্মেলন-সমিতি গড়ার ও ব্যক্তিগত মতো প্রকাশ ও প্রচার করার অধিকার ও স্বাধীনতার প্রকৃতপক্ষেই কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে এসব অধিকার প্রতিষ্ঠার জনে ধীরে ধীরে সামন্তবাদীদের সাথে কঠিন দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়।
এই দ্বন্দ্বে গণতন্ত্র প্রত্যেক দিন নবতর সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে ব্যক্তির জন্যে অধিকতর স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করতে থাকল।
দ্বন্দ্ব সংগ্রামের মার্কসীয় ব্যাখ্যা হচ্ছে, তা সবই হচ্ছে শ্রেণী-সংগ্রাম। নতুন জেগে ওঠা বুর্জোয়া পুরানো সামন্তবাদী শ্রেণীর সাথে নিরন্তর দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামে লিপ্ত। …এই তত্ত্বকে সঠিক ধরে নিলেও এটা অসম্ভব নয় যে, শহর নগরবাসী এই বুর্জোয়ারা একটাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংগ্রাম মনে করেছিল। এ সংগ্রাম তাদের প্রত্যেকের এবং প্রত্যেক ব্যক্তির এ সংগ্রামে লিপ্ত তার স্বতন্ত্র ব্যক্তিগত মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। নিজস্ব ব্যক্তিত্ব এর উদ্দেশ্যে। যেন সে মনে করতে পারে যে, সে স্বয়ং প্রতিষ্ঠিত একজন মানু। সে কারুরই অধীন নয়।
এই দ্বন্দ্বের ফলে সামন্তবাদীদের কাছ থেকে যতটা স্বাধীনতাই অর্জিত হতো, তার অর্থ এই দাঁড়াত যে, প্রত্যেক ব্যক্তিই তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে এক নবতর পর্যায়ে সম্প্রসারিত করে নিয়েছে অর্থাৎ সে নবতর পরিবেষ্টনে ব্যক্তিগতভাবে যা-ইচ্ছা করতে সক্ষম হয়েছে।
এই মুক্তি স্বাধীণতা কেবলমাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রেই অর্জিত হয়নি। এটা কার্যত ছিল দ্বীন-ধর্ম নৈতিকতা ও ঐতিহ্যিক রীতিনীতির সকল বন্ধন থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্তি ও নিষ্কৃতি। সেই সাথে পাচ্ছে আইনের নিরাপত্তা, প্রশাসনিক সহযোগিতা ও বিচার বিভাগীয় সমর্থন। আর এ সবই ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপোষক।
বুর্জোয়া শ্রেণী এমনিভাবেই সামন্তবাদীদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার রাজনৈতিক সংগ্রামে মুক্ত-স্বাধীন-নিরংকুশ ব্যক্তিসত্তার ওপরই নির্ভরশীল হয়েছিল, প্রতিটি মুহুর্ত তারা আরও অধিক স্বাধীনতা –আরও অধিক ক্ষমতা লাভের জন্যে সংগ্রামরত ছিল।
আর এই সময়ই মানুষ নিজেকে দেবতার স্থানে বসিয়ে দেয়। নিমগ্ন হয় সর্বাত্মক আত্মপূর্জায়। আল্লাহর দাসত্ব গ্রহণের দিকে ভ্রুক্ষেপ মাত্র করে না।
ইতিমধ্যে পুঁজিবাদ এসে ময়দান দখল করে নিল। এই পুঁজিবাদও ব্যক্তিস্বাধীনতার ভিত্তিতে গড়ে উঠল। তাতে রয়েছে প্রত্যেক ব্যক্তির পূর্ণ স্বাধীনতা। প্রত্যেক ব্যক্তিই ধন-সম্পদের নিরংকুশ মালিক হতে পারছে, মালিক হতে পারছে অর্থোৎপার্জনের সকল উপায়-উপকরণের। নিজের সম্পদের পরিমাণ যত ইচ্ছে বৃদ্ধি করার পূর্ণ স্বাধীনতা তার স্বীকৃত। আর সেই সাথে সে জনশক্তিও বাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পেল। নিয়োগ করল বিপুল সংখ্যক শ্রমিক কর্মচারী।
পুঁজিপতিরা ব্যক্তি স্বাধীনতার সংরক্ষণে প্রবল শক্তি প্রয়োগ করল। তারা ব্যক্তি মানুষের অধিকারের পক্ষে অনেক সুন্দর সুন্দর মুখরোচর ও চিত্ত হরণকারী কথা বলতে শুরু করল। সকল প্রকার স্বাধীনতার অভিভাবক হয়ে বসল তারা। জীবনে প্রাপ্তব্য সকল পবিত্রতা ও মহানত্বকেও তারা প্রতিষ্ঠিত করল।
সমাজ যেন তার কার্যকলাপের জন্যে কোনোরূপ টু শব্দ করতে না পারে এবং তার কাজের পথে না পারে কোনোরূপ বাধা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে –এই অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, এটা তাদের ঐকান্তিক দাবি।
তারা এই শ্লোগান ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলেছিল –তাকে কাজ করতে দাও, তাকে চলতে দাও Laissez faire –Laissez passer –এই শ্লোগানের মধ্যেই একত্রীভূত হয়েছিল তাদের সমস্ত দাবি। তার অর্থ ছিল, ব্যক্তিকে সকল প্রকার বাধা –প্রকৃতিবদ্ধকতামুক্ত কাজ করার অধিকার দিতে, সুযোগ দিতে হবে।
এ ছিল সকল প্রকারের বাধা-বন্ধন ও বাধ্যবাধকতা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্তিলাভের আহবান।
কিন্তু ব্যক্তির স্বাধীনতা, ব্যক্তির পবিত্রতা, মাহনত্ব এবং ব্যক্তির অধিকার পর্যায়ে এই যে সুন্দর সুন্দর কথা বলা হচ্ছিল, এগুলো আল্লাহর জন্যে আল্লাহর বিধান মতো তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ছিল না। সবই ছিল শয়তানের জন্যে, শয়তানী উদ্দেশ্যে। সব কিছুরই মূল লক্ষ্য পুঁজিবাদরূপী ‘তাগুত’কে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে, তার মক্তি ও দাপট ক্রমশ সমৃদ্ধ করে তোলার মতলবে। কেননা পুঁজি বাদ কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই যা ইচ্ছা করতে পারছিল না। তা করা সম্ভব ছিল না। তা করা সম্ভব ছিল সকল বাধা-বন্ধনমুক্ত ব্যক্তি স্বাধীনতার উন্মুক্ত পরিবেশেই মাত্র।
পুঁজিবাদী তাগুতের সীমালংঘনমূলক স্বেচ্ছাচারী শক্তি-মর্যাদা অর্জনের পথে এছাড়া আর কোনো বাধা ছিল না। এ কারণে নিরুপায় হয়েই তা এই স্বাধীনতার ধ্বনি তুলেছিল, যেন গোটা সমাজই সম্পূর্ণ মুক্ত ও স্বাধীন হয়ে যায়। সমাজের ওপর যেন তা থাকে কোনো ধর্মীয় অনুকরণ, কোনো নৈতিক বা ঐতিহ্যিক প্রতিবন্ধকতা।
সমাজের পুরুষ, নারী ও বালক-বালিকা, পরিবার ও জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায় সকলেই যেন এই স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করার অবাধ সুযোগ লাভ করতে পারে। কেননা পুঁজিবাদের সবচাইতে বড় চিন্তার বিষয় ছিল বেশি বেশি ও বড় পরিমাণে মুনাফা লুণ্ঠন করা আর তা সম্ভব ছিল যা ইচ্ছা হয় তাই করার মাধ্যমে। এই পথে বাঁধা-প্রতিবদ্ধকতা থাকলে তাদের অবাধ ও যথেষ্ট মুনাফা লাভের পথ বিঘ্নিত হয়। বরং গোটা সমাজের সর্ব প্রকারের বাধা-বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়াটাই তাদের বড় লাভ। কেননা তা হলেই তো জনগণের মধ্যে যৌন লালসাকে উচ্ছ্বসিত করে তোলার জন্যে বিপুল অর্থ ব্যয় করা তাদের পক্ষে সম্ভব। আর তা করতে পারলেই দ্বিগুণ-তিনগুণ-চারগুণ বেশি মুনাফা লুঠবার সুযোগ তারা পেতে পারে।
এভাবে পুঁজিবাদী মনোবৃত্তি এক নতুন পূর্ণাঙ্গ দর্শন তৈরি করে নিল। সে দর্শনের শিক্ষাদানের জন্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, গ্রন্থকার, সাংবাদিক, লেখক ও শিল্পীগোষ্ঠীও গড়ে তোলা হলো। সকলেরই সম্মিলিত আহবান ছিল নিরংকুশ ব্যক্তি স্বাধীনতার দিকে। আর এই পাগলপরা মুক্তি ও স্বাধীনতার সকল বাঁধা-বন্ধনকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার দিকে।
এই বিভ্রান্ত বিপথগামী দর্শনের ছত্রছায়ায় এক নতুন সমাজ গড়ে উঠল। এ সমাজ অত্যন্ত বিভৎস ও জঘন্য রূপ পরিগ্রহ করলে তখন বলা হল, সমাজ ব্যক্তির এই স্বাধীনতা হরণ করতে চায়। অতএব ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে তার সর্বশক্তি নিয়ে তার এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্যে চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানো। সমাজকে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে তার সাথে শত্রুতার পূর্ণ মাত্রার প্রতিশোধ গ্রহণ করা।
এই দার্শনিক, চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক ও শিল্পীগোষ্ঠী কোথাও থামল না। থেমে একটু চিন্তা-বিবেচনা করারও প্রয়োজন মনে করল না। একটুও চিন্তা তারা করল না যে, এই যে সমাজটিকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেওয়ার জন্যে বদ্ধপরিকর হয়েছে ব্যক্তি মানুষকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এই সমাজটি আসলে কি? ….ব্যক্তি-ই বা কি? ব্যক্তি ও সমাজ কি দুই, না ব্যক্তিগণেরই সামষ্টিক রূপ হচ্ছে সমাজ! মানুষ একই সময় একজন ব্যক্তি ও সমাজেরই অংশ নয় কি? ….সমাজের মধ্যে মানুষ নেই? ব্যক্তিদের সমন্বয়েই কি সমাজ গড়ে ওঠেনি? সমাজবদ্ধ হয়ে থাকা কি ব্যক্তির মানসিক ভাবধারার ঐকান্তিক দাবি নয়? অন্যদেরসাথে মিলিত একত্রিত হয়ে বসবাস করাই কি নয় ব্যক্তির মনে ঐকান্তিক দাবি? মানুষ কি অন্য মানুষের প্রতি কোনো ঝোঁক –কোনো আকর্ষণ বোধ করে না? কোনো প্রয়োজনের জন্যেই এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির প্রতি মুখাপেক্ষী নয়? …তা হলে এই সমাজটিকে যখন ভেঙ্গে ফেলা হবে, তখন ব্যক্তি কোথায় থাকবে? কি অবস্থা হবে তার? …কোন বেষ্টনীর মধ্যে বাস করবে এই ব্যক্তি?
আসলে এই দার্শনিক-চিন্তাবিদ-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-লেখক-শিল্পী গোষ্ঠী এক অন্ধ জাহিলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল। আল্লাহর পথ তারা চিনতে পারেনি, আল্লাহর নূর থেকে তারা বঞ্চিতই রয়ে গেছে। তারা জানতে পারেনি যে, পুঁজিবাদ আসলেই একটা মহাধ্বংসকারী তাগুত। এই তাগুতেই তাদের মনে এই সব ভিত্তিহীন মতবাদ বদ্ধমূল করে দিচ্ছে। এর ফলে এই সমাজ ও সামাজিক বন্ধন যদি সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়, তাহলে এই ব্যক্তিরা চরমভাবে অসহায় ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে। তখন কার্যত এই তাগুত ব্যক্তিকে পেয়ে বসবে, তাকে সম্পূর্ণ রূপে গ্রাস করবে। অন্যান্য মানুষের প্রতি ঘৃণা পোষণকারী এই একক ব্যক্তিকে দাসানুদাস বানিয়ে নেওয়া তার পক্ষে খুবই সহজসাধ্য ব্যাপার হবে। কেননা সমাজ তো নেই, লোকগুলোর পরস্পরের কোনো সম্পর্ক বা বন্ধন বলতে কিছুই নেই। নেই তাদের পরস্পরের মধ্যে কোনো দয়া, ভালোবাসা, সহানুভূতি। এক্ষণে এই বিচ্ছিন্ন নিঃসম্পর্ক মানুষের পালনে পুঁজিতান্ত্রিক ও পুঁজির স্বার্থ সংরক্ষক এই তাগুতের পক্ষে দাসত্ব শৃঙ্খলে বন্দী করা কতই না সহজ হবে। তখন পুঁজিবাদের পতাকা উচ্চে তুলে ধরতে বাধ্য হবে এই ব্যক্তিরা। আর তাগুত তাদেরকে পশুপালের রাখালের মতো যে দিকে ইচ্ছা চালিয়ে নিয়ে যাবে লালসা-কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে।
একদিকে ব্যক্তিতন্ত্রের প্রতি এই চরম মাত্রায় পৌনপুনিক দাবি। আর অন্যদিকে তার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সামষ্টিকতার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা। দুই বিপরীতের পারস্পরিক ভয়াবহ সংঘর্ষের ব্যাপার।
সামষ্টিকতাবাদী মতবাদ ঘোষণা করছে, ব্যক্তির স্বতন্ত্র কোনো অস্তিত্ব নেই। স্বতন্ত্রভাবে তার কোনো তাৎপর্য বা মাহাত্মও নেই। সমাজের মধ্যেই ব্যক্তির অস্তিত্ব, সমাজের মধ্যেই সে লালিত-পালিত, তার জীবন যাপন এই সমাজের মধ্যেই সম্ভব। সমাজকে তার নিশ্চিত-অনিবার্য গতিপথ থেকে ফিরিয়ে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়, সেজন্যে চেষ্টা করারও কোনো অধিকার নেই তার।
এদিকে দরখায়েম মানব জীবনের সামষ্টিক ব্যাখ্যা পেশ করছিল। আর কার্ল মার্কস ইতিহাসের বস্তুগত ব্যাখ্যায় তারই সমর্থন যুগিয়েছিল। এদের বক্তব্য ছিল, অর্থনৈতিক ভিত্তিই সমাজ গড়ে তোলে। আর সমাজই ব্যক্তি সৃষ্টি করে।
দরখায়েম বলেছেঃ
সামষ্টিক চেতনা থেকে উদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা নিশ্চিতরূপে সেই অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর, যা ব্যক্তির চেতনা থেকে বের হয়। বরং ব্যক্তির চেতনা অন্যান্য ব্যক্তি থেকেও স্বতন্ত্র জাতীয়। সামষ্টিক বিবেক-বুদ্ধি ব্যক্তিগত বিবেক-বুদ্ধি থেকে ভিন্নতর, তার জন্যে বিশেষ নিয়ম-কানুন শুধু তারই জন্যে প্রযোজ্য।–[সামষ্টিক বিদ্যার পদ্ধতিগত নিয়মঃ ডঃ মাহমুদ কাসেম অনূদিত। ডাঃ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ নদভী দ্রষ্টব্য।]
…অপরদিকে সামষ্টিক চিন্তাধারা ও কার্যক্রম বিভিন্ন পথে চলে। তা ব্যক্তিগণের চিন্তার বাইরে প্রাপ্ত সত্য। ব্যক্তিগত প্রতি মুহুর্তে সেই সত্যের সম্মুখে মাথা নত করে থাকতে বাধ্য।–[পূর্ব সূত্র।]
সম্মিলিত কাজ থেকেই সামষ্টিক প্রপঞ্চের প্রকাশ ঘটে। তা ব্যক্তির চেতনার বাইরে পূর্ণত্ব পায়। কেননা তা বহু সংখ্যক ব্যক্তির মন-মানসিকতার ফল।–[দরখায়েম এখানে স্বীকার করছে যে, সামষ্টিক প্রপঞ্চ বিপুল সংখ্যক ব্যক্তিগত মন-মানসিকতা থেকে উৎসারিত হয়। অথচ একটু পরেই সে এই কথা ভুলে গিয়ে এর বিপরীত মত প্রকাশ করেছে। কোনো ব্যক্তিসত্তাকে অস্বীকার সম্পর্কিত মতবাদের জন্যে সে খ্যাতিমান হয়েছে।] এই সম্মিলিত কাজই কর্ম ও চিন্তার পথ নির্দিষ্ট করে। আর এই পথসমূহ আমাদের অস্তিত্বের বাইরে পাওয়া যায়। তা ব্যক্তির ইচ্ছা দ্বারা কিছুমাত্র প্রভাবিত হয় না।–[পৃষ্ঠা ৫]
সামষ্টিক প্রপঞ্চের প্রাণ পর্যায়ের বিশেষত্ব যেহেতু বাইরে থেকে ব্যক্তিগণের মনের ওপর প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, এই প্রপঞ্চসমূহ ব্যক্তিগণের মনের উৎপন্ন নয়।–[পৃ. ১৬৬]
লক্ষণীয়, সামষ্টিক বাহ্যিক প্রপঞ্চ ব্যক্তিগণের আভ্যন্তরীণ চেতনার ওপর কিভাবে প্রভাবশালী হয়ে দাঁড়ায়।–[পৃ. ৬৬]
তবে মার্কস, এঙ্গেলস এবং ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা আরও সম্মুখের দিকে অগ্রসর হয়ে গেছে। তা মানুষের অত্যন্ত জঘন্য কুৎসিত কিমাকার চিত্র অংকন করেছে।
বস্তুগত জীবনে উৎপাদন পদ্ধতিই সমস্ত সামষ্টিক র্কাক্রমের, রাজনীতি ও জীবনের আধ্যাত্মিক রূপ গড়ে তোলে। (মার্কস)
উৎপাদন ও উৎপন্ন পণ্যাদির পারস্পরিক বিনিময়ই হচ্ছে সমস্ত সামষ্টিক ব্যবস্থার ভিত্তি। (এঙ্গেলস)
তাহলে মার্কস ও এঙ্গেলসের মতে মানুষের নিজস্ব সত্তা বলতে কিছুই নেই। নেই তার নিজস্ব কোনো চিন্তা-চেতনা, না ব্যক্তিগত কর্মের উদ্দীপক বা কারণ।
তা হচ্ছে নিছক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রচ্ছায়া, যা মানুষের নিজস্ব সত্তার বাইরে পাওয়া যায়।
মানুষ যে সামষ্টিক উৎপাদনে অভ্যস্ত, তারাও পরস্পরে একটা সীমিত পর্যায়ে সম্পর্ক গড়ে তোলে, সে সম্পর্ক গড়ে না তুলে তাদের কোনো উপায় নেই। কিন্তু সে সম্পর্ক তাদের ইচ্ছার অধীন নয়, তা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও ভিন্নতর। জনগণের চেতনা তাদের সত্তা নির্ধারণ করে না। তাদের সত্তাই নির্ধারণ করে তাদের স্বরূপ (মার্কস)
চূড়ান্ত পর্যায়ের পরিবর্তন কিংবা মৌলিক আবর্তনসমূহ সম্পর্কে চিন্তাধারা ও আলোচনা-পর্যালোচনা করা জনগণের বিবেক-বুদ্ধির ব্যাপার নয়। কিংবা তারা যদি চিরন্তন সত্য ও ন্যায়পরতা সহকারেও চেষ্টা চালায় তবু তা কখনোই সফল হতে পারে না, কেবলমাত্র উৎপাদন উপায়-প্রক্রিয়া ও পণ্য বিনিময়ের পন্থাসমূহে সৃষ্ট পরিবর্তনসমূহ চিন্তা-বিবেচনা করলেই বুঝতে পারা যেতে পারে।
কিন্তু এখানে সবচেয়ে বড় মুশকিল হলো, ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা মানুষ সম্পর্কে যখন কথা বলে, তখন ব্যক্তি সম্পর্কে কথা বলে না। তা সামষ্টিক কার্যক্রম নিয়েই ব্যস্ত। তার দৃষ্টিতে ব্যক্তির কোনো অস্তিত্বই স্বীকৃত নয়। আছে শুধু সামষ্টিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে।
মোট কথা, মার্কস ও এঙ্গেলস-এর মতে ব্যক্তির কোনো অস্তিত্বই নেই। তাকে অবশ্যই কোনো-না-কোনো শ্রেণীর মধ্যে শামিল ও গণ্য হতে হবে। আর এই শ্রেণীর যা কল্যাণ তাকেই তার নিজের জন্যে কল্যাণরূপে গণ্য করতে হবে। আর এই শ্রেণীর প্রবণতা ও রীতিনীতি অনুযায়ী তার আচার-আচরণ ও চিন্তা-বিশ্বাসও গড়ে নিতে হবে। শ্রেণীর চরিত্র ও ঐতিহ্য, জীবন সম্পর্কে শ্রেণীর দৃষ্টিকোণকেই পরম সত্য ও চূড়ান্ত বলে মেনে নিতে হবে। কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি ব্যক্তিগত জীবন চিন্তা করে, তাকে স্বতন্ত্র স্বাধীন ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সত্তা বলে মনে করে, আর এই নিয়মে তার নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিকোণ গড়ে ওঠে, তাহলে ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা তা একটি বড় সমস্যা হিসেবে গণ্য হবে।
স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সম্পর্কে ইতিহাসের ঘটনাবলী যা কিছু বলে ও প্রচার করে, তা মানুষের গড়া কল্পকাহিনী মাত্র। (কিন্তু কেন?….) বৈজ্ঞানিক অধ্যায় যে প্রকৃত ব্যাপার উপস্থাপিত করে এই ধরনের কোনো ব্যক্তি কখনোই পাওয়া যায়নি। অতীত ইতিহাসের সকল পর্যায়েই ব্যক্তি সব সময়ই শ্রেণীভুক্ত ছিল। অনাগত শ্রেণীর দিকে দৃষ্টিপাত করলে যার আগমনকে বস্তুগত ও অর্থনৈতিক বিপ্লবসমূহ অবশ্যম্ভাবী করে দিয়েছে –দেখা যাবে, ব্যক্তি একজন মানুষই বটে, যা আসন্ন নিশ্চিত অনিবার্যতার সুসংবাদ দেয়।
মনে হচ্ছে, মানুষ অর্থনৈতিক ও বস্তুগত নিশ্চিত অনিবার্য বিপ্লবসমূহের অধীন। এ কারণে ব্যক্তি সমাজের অধীন। আর সামজ এসব বিবর্তন বিপ্লবের অধীন।
মানুষ ব্যক্তিতন্ত্র থেকে সমাজতান্ত্রিকতায় এসে এক নতুন খোদা বানিয়ে নিল। আর বস্তুগত অনিবার্যতা ও বাধ্যবাধকতাই তাদের ‘খোদা’ হরো।
সমাজতান্ত্রিকতাও একটি জাহিলী বিপর্যয়, তা চরমবাদিতায় পূর্ববর্তী জাহিলিয়াত থেকে কোনো অংশেই কম নয়, যে জাহিলিয়াতে সমাজের তুলনায় ব্যক্তির গুরুত্ব স্বীকৃত।
সমাজতান্ত্রিকতা হোক, কি ব্যক্তিতান্ত্রিকতা, উভয়ই পূর্ববর্তী বিপর্যয়ের প্রতিক্রিয়া মাত্র। উভয়ই চরমবাদের দ্বারা আচ্ছন্ন।
ব্যক্তি যে সমাজেরই একটা অংশ, তা উভয় জাহিলিয়াতই বুঝতে পারেনি, বুঝতে অক্ষম। আসলে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ই সত্য। ব্যক্তিগণের সমষ্টিই তো সমাজ। ব্যক্তি না হলে সমাজ হবে কেমন করে?
মানব জীবনকে সমাজতান্ত্রিকতার মধ্যে আবদ্ধ করে দিলে একটা বড় বুল ও বিভ্রান্তি এই হয় যে, তাতে জীবনের একটি মাত্র দিকই লক্ষ্যভূত হয়। তা হচ্ছে, ব্যক্তি তার নিজের ইচ্ছা কামনা-বাসনার সম্পূর্ণ বিপরীত সমাজ-আরোপিত নিয়ম-কানুন ও দায়-দায়িত্ব মেনে চলতে বাধ্য হয়।
এটা সত্য বটে! কিন্তু এ সত্য কি প্রমাণ করে?
দরখায়েম স্বীকার করেছে (যদিও স্বীকার করার পরই আবার তা অস্বীকার করেছে), সামষ্টিক প্রপঞ্চ প্রকাশমানতা বিপুল সংখ্যক ব্যক্তির মন-মানসিকতারই ফলশ্রুতি। অন্য কথায়, ব্যক্তি কোনো-না-কোনোভাবে সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করে। আর তার এই প্রতিনিধিত্ব সমাজের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
আর সমাজ যে কিছু ব্যাপার ও বিষয় ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেয়, তা যদি স্বীকার করেও নেওয়া হয়, তাহলে তার দুটি দিকঃ
হয় বিপুল সংখ্যক সৎ, নেককার ও চরিত্রবান ব্যক্তির মন মিলিত হয়ে কোনো কথা একজন বিপথগামী ব্যক্তির জন্যে বাধ্যতামূলক করে দেয় এবং বলে –দেখো, কখনোই এই সীমালংঘন করতে পারবে না –এর বাইরে যেতে পারবে না।
অথবা কিছু সংখ্যক অসৎ, দুষ্কৃতিকারী ব্যক্তির মন একত্রিত হয়ে সৎচরিত্রবান ব্যক্তিদেরকে নিজেদের কথা মানতে বাধ্য করে দেবে এবং বলবে, হয় আমাদের সাথে চলো, না হয় আমরা তোমাদেরকে পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেবো।
উভয় অবস্থায়ই তা বিপুল সংখ্যক ব্যক্তি মানুষের মনের সম্মিলন, একটি মতের ভিত্তিতে একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ। এই সম্মিলন ও ঐক্যবদ্ধতার দরুন তার শক্তি বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তা শেষ পর্যন্ত মনুষ্য প্রকৃতি থেকে তো বাইরে চলে যায় না। তাই ব্যক্তি ও সমষ্টি উভয়ই মানুষ। আর এককভাবে ব্যক্তি বা এককভাবে সমাজ সমষ্টির মধ্যেই মানুষ হওয়ার গুণটি সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে না।
আর সামষ্টিক ব্যাখ্যা বা বস্তুগত ব্যাখ্যা উভয় দর্শনই বিষয়টিকে এমনবাবে সংমিশ্রিত করে দেয় যে, তাতে ব্যক্তিসত্তার বিশেষত্ব স্বতন্ত্র ও বিশেষত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয় না। কেননা যেমন বলেছি উভয়ই জীবনের একটি মাত্র দিকের ওপরই দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। আর তা হচ্ছে সকল অবস্থায়ই ব্যক্তি সমষ্টির অধীন হয়ে থাকে।
কিন্তু উক্ত দুটি দর্শনই জাহিলিয়াতের অন্ধত্বের মধ্যে পড়ে প্রকৃত বাস্তবতাকে অস্বীকার করে। সেই বাস্তবতাকে, যেখানে ব্যক্তিরা তাদের সমষ্টির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে থাকে এবং তারা সমাজ-সমষ্টির সাথে যুদ্ধ ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়।
যদি বলা হয়, সমাজও তো বিদ্রোহী ব্যক্তিগুলোকে নিষ্পেষিত ও নিশ্চিহ্ন করে দেয়, তাহলে আমরা বলব, এটা মূল বিষয়ের কোনো প্রমাণ হলো না। এখানে মূল আলোচ্য বিষয় হল, ব্যক্তি তার স্বতন্ত্র সত্তার অস্তিত্ব অনুভব করে এতদূর চলে যায় যে, তারা সমাজ-সমষ্টির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায়, তার সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়, তার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে এবং তার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে।
তাছাড়া সমাজ-সমষ্টি প্রতিবারেই বিদ্রোহী ব্যক্তিদেরকে নিষ্পেষিত করতে পারে –এমন কথাও সত্য নয়। সত্য নয় ভালোর ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি মন্দের ক্ষেত্রেও। আসলে এটা একটা হিংস্র ধর্মীয় ধারণা মাত্র, যা প্রকৃত সত্যকে অস্বীকার করে।
খারাপ ক্ষেত্রের একটা দৃষ্টান্ত এখানে তুলতে চাই। কেননা তা-ই এই হিংস্র জাহিলী ব্যাখ্যার বাস্তবতার অতীব নিকটবর্তী ব্যাপার।
স্ট্যালিনের নির্মমতার ইতিহাস সম্পর্কে কি বলতে চাও?
ক্রুশ্চেভ তাকে কিভাবে চিত্রিত করছে?
সে কি বলেনি যে, স্ট্যালিন হচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যক্তিত্ববাদের নিকৃষ্ট ও জঘন্যতম দৃষ্টান্ত, সে গোটা সমাজকেই একান্তভাবে বাধ্য করেছিল তার দাসত্ব করার জন্যে, একথা কি সত্য নয়?
তা কি পরে সম্ভবপর হলো?… ইতিহাসের জাহিলী ব্যাখ্যাদাতারা তার কি ব্যাখ্যা দিতে পারে?
বিশ্বস্ত একনিষ্ঠ ক্রুশ্চেভ যেভাবে তাকে চিত্রিত করেছে, তা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, আসলে সে সমাজ-সমষ্টির কল্যাণের প্রতিনিধিত্ব করেনি। পরন্তু সে (নীতিগতভাবে) শাসক শ্রেণীর অর্থাৎ প্রোলেটারিয়েট শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বও করেনি।
আসলে সে ব্যক্তিগত ক্ষমতা লাভের প্রতিনিধিত্ব করেছে। সে ছিল ‘তাগুত’, সীমালংঘনকারী, কোনোরূপ দয়া-মায়া বলতে কিছুই ছিল না। ইতিহাসের ব্যক্তিত্ববাদী ব্যাখ্যাকে যদি আমরা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করি তাহলে এই ব্যাপারটা কি ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে?
আর ভালোর ক্ষেত্রে নবী-রাসূলগণ, পবিত্র আত্মা, দ্বীনের আহবানকারী ও সমাজ সংস্কারক ব্যক্তিবর্গ তারা সমাজের তাগুতী ব্যবস্থার মধ্যে এককভাবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁরা সমাজের জন্যে সত্য প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আত্মনিয়োগ করেন। তারা সমাজের কল্যাণে, সত্যনীতি ও ন্যায়পরতা-সুবিচার কায়েমের জন্যে চিরন্তন ও শাশ্বত ব্যবস্থা হিসেবেই প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে থাকেন। অতঃপর সে বিজয় হয়ে দাঁড়ায় …ইতিহাসের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাখ্যাকে বাদ দিলে এসব বাস্তব ঘটনার কি ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে?
একথা অবশ্য অনস্বীকার্য যে, মানবীয় ইতিহাসের ব্যাখ্যা কেবলমাত্র ব্যক্তিকেন্দ্রিক দেওয়া উচিত নয়। উচিত নয় কেবলমাত্র সমাজ-সমষ্টির ভিত্তিতে। এই উভয়টিই জাহিলী ব্যাখ্যা, মূল বাস্তব ইতিহাসের বিকৃতি মাত্র।
মানুষের সত্যিকার ব্যাখ্যা হতে পারে যদি ব্যক্তি ও সমষ্টি –উভয়ের ভিত্তিতে একসাথে অভিভাজ্যভাবে দেওয়া হয়। কেননা ব্যক্তি ও সমষ্টি উভয় পারস্পরিক গভীর সম্পর্কের ভিত্তিতে কাজ করে বাস্তব জীবনের ক্ষেত্রে। বিচ্ছিন্ন ও নিছক এককভাবে কারোরই কিছু করার নেই।
কখনও ব্যক্তি প্রধান হয়ে দেখা দেয়, কখনও সমাজ প্রভাবশালী হয়ে পড়ে। কিন্তু এখানে এমন সুস্পষ্ট সত্য বর্তমান যা এই জাহিলী মতবাদগুলোর জ্ঞানের আওতার মধ্যেই আসেনি, সে বিষয়ে তা সম্পূর্ণ অন্ধ। তা হচ্ছে, মানুষের উভয় দিক –ব্যক্তিগত দিক ও সমাজগত দিক –সম্মিলিতভাবে এক সাথে ও পারস্পরিক সহযোগিতা-সহমর্মিতা সহকারে কাজ করে প্রতি মুহুর্তে, ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়। কখনোই তার অন্যথা হয় না। ..এ এক অনস্বীকার্য সত্য।
ব্যক্তি সমাজ-সমষ্টির মধ্য থেকে …তারই সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে কাজ করে। আর সমাজ-সমষ্টি কাজ করে ব্যক্তিগণের বাস্তব অংশীদারিত্ব ও সাহায্য-সহায়তা নিয়ে, একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির কোনো অস্তিত্ব বা ভূমিকা নেই, থাকতে পারে না। তাই ইতিহাসের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাখ্যা যেমন ভুল, তেমনি জাহিলী সামষ্টিক ব্যাখ্যাও। উভয়ই সমানভাবে চরম ভুলের মধ্যে নিমজ্জিত।
আধুনিক জাহিলিয়াতের অধীন আজকের মানবতার বাস্তব অবস্থা হচ্ছে –খোদাদ্রোহিতা, সীমালংঘন ও নাফরমানীর কোনো-না-কোনো কাজে –ইচ্ছায় হোক-অনিচ্ছায় হোক –জড়িয়ে পড়তে একান্তভাবে বাধ্য হচ্ছে।
হয় মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক আল্লাহ দ্রোহিতাকে গ্রহণ করবে আর তার পরিণতিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী পুঁজিতান্ত্রিক দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকবে। আর না হয় মানুষ সমাজ-সমষ্টির আল্লাহ দ্রোহিতার আশ্রয় গ্রহণ করবে, আর তার অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের অধীনতা গ্রহণ করবে। …তাও তখন, যদি কোনো কিছু গ্রহণ করার তার স্বাধীনতা আছে বলে স্বীকার করে নেওয়া হবে। কেননা কোনো জাহিলিয়াতের অধীনেই মানুষ গ্রহণ বা বর্জনের কোনো স্বাধীনতাই পেতে পারে না। তাগুত শক্তিই তাদের শাসক ও পরিচালক হয়ে বসে। সামষ্টিক অবস্থাই তাকে ক্ষমতাসীন করে দেয়।
আর মানুষের এই ধ্বংস ও বিপর্যস্ত অবস্থা আল্লাহকে পরিহার করে চলার অনিবার্য পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়। এর সারকথা হচ্ছে, মানুষের প্রকৃতি সত্তাই আজ চরম ধ্বংসের মুখে এসে গেছে।
যে ব্যক্তি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও সম্পর্কহীন, সে তো তার বিরাট অংশ থেকেই বিচ্ছিন্ন। এক্ষণে সে নিতান্তই এককভাবে নিজ সত্তার বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামে লিপ্ত। পরিণতিস্বরূপ তার পাগল হয়ে যাওয়া, আত্মহত্যার উদ্যোগী হওয়ার, ব্লাড প্রেসার বা স্নায়ুবিক অসুস্থতার রোগে আক্রান্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। এ পরিণতি নিতান্তই অযৌক্তিক।
পক্ষান্তরে, যে সমাজ তার ব্যক্তিদের স্বতন্ত্র মর্যাদা বিনষ্ট ও অধিকার হরণ করে, পরিণামে তা নিজেকেই ধ্বংস করে। এ সমাজে জনসংখ্যার আধিক্যেরও কোনো মূল্য হতে পারে না। কেননা এই সমাজের ওপর তাগুতী শক্তিই সর্বাত্মক শাসক হয়ে বসেছে। সে ই হয়ে পড়েছে এই সমাজের একমাত্র চিন্তানায়ক, নিরংকুশ মাধ্যম। তার ক্ষমতা সীমাহীন, পরিণামহীন। সে যখন মরে যায় কিংবা ক্ষমতাচ্যুত হয়, তখন তাকে বড় অপরাধী ও নির্মম পশুরূপে চিত্রিত করা হয়।
এই জাহিলিয়াত উদাত্ত কণ্ঠে নিজের সম্পর্কে দাবি করছে যে, তা বর্তমানে মানবীয় বিবর্তনের উন্নতির চরম উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছে। এখন তার জন্যে আল্লাহর বিধান –আদেশ-উপদেশের কোনো প্রয়োজন নেই।