বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত
মুহাম্মদ কুতুব
অনুবাদঃ মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম
স্ক্যান কপি ডাউনলোড
আমাদের কথা
সারা দুনিয়া জুড়ে চলছে এক মহাক্রান্তিকাল। যে জড়বাদী সভ্যতার চোখ-ঝলসানো চাকচিক্য একদিন বিশ্বের মানুষকে হকচকিয়ে দিয়েছিল, তার অন্তঃসারশূণ্যতা ইতিমধ্যেই সবার কাছে ধরা পড়ে গেছে। জড়বাদী সভ্যতার পুঁজিবাদী সংস্করণের মরণ-ঘণ্টা বহু আগেই বেজে উঠেছে। এর মার্কসবাদী সংস্করণ আজ মৃত। পশ্চিমা সমাজের দূরদর্শী চিন্তাবিদদের কাছে, জড়বাদী সভ্যতার মানবতা-বিরোধী রূপ চরমভাবে উদঘাটিত হয়ে গেলেও আমাদের দেশের এক শ্রেণীর হীনমন্যতাগ্রস্ত তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এখনও পাশ্চাত্য সমাজের বাহ্যিক চাকচিক্যের মায়া-মরীচিকাময় মোহগ্রস্ততা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না –এটা সত্যই এক দুর্ভাগ্যের কথা। তাদের মতে জড়বাদী সভ্যতারূপী আধুনিক জাহিলিয়াতের মধ্যেই নাকি বিশ্বমানবতার পরিত্রাণ নিহিত রয়েছে।
আরব বিশ্বের বিখ্যাত মনীষী মুহাম্মদ কুতুব এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী নামধারীর এই মোহগ্রস্ততা কাটিয়ে তোলার লক্ষ্যে এই পুস্তকে জাহিলিয়াতের নব রূপের স্বরূপ উদঘাটন করেছেন নির্মম হস্তে। এই সময়োপযোগী মূল্যবান গ্রন্থের বাংলা তরজমা করেছেন বাংলাদেশের মহান ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক আল্লামা মুহাম্মদ আবদুর রহীম (রহ)। এই গ্রন্থ পাঠে পাঠকবৃন্দ শুধু বর্তমান শতাব্দীর জাহিলিয়াতের স্বরূপের সঙ্গেই পরিচিত হবেন না, এই সব মানবতা বিরোধী মতবাদ কিভাবে আধুনিক সমাজ-মানসকে বিশেষ করে মুসলিম সমাজকে কিভাবে বিভ্রান্ত করে তুলতে উদ্যত হয়েছে লেখক তারও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ দিয়েছেন। এ ধরনের পুস্তক শিক্ষিত মুসলমান সমাজের ঘরে ঘরে পঠিত হওয়া অত্যাবশ্যক বলে মনে করি। এই বই পড়ে যদি আমাদের তরুণ সমাজ আধুনিক জাহিলিয়াতের সর্বনাশা স্বরূপ সম্বন্ধে সচেতন হতে পারে তবেই সার্থক হবে আমাদের এ প্রয়াস।
বইটির নাম নিয়ে হয়ত জনগণের মনে বিভ্রান্তি থাকতে পারে। যেহেতু বর্তমান শতাব্দী একবিংশ শতাব্দী। আমরা বিংশ শতাব্দীর লেখা লেখকের নামটিই রাখার পক্ষপাতি, কারণ, “জাহিলিয়াত কোন শতাব্দীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় –সময়ের বিবর্তনে শুধু রং পাল্টায়”। পাঠক বইটি পড়লেই বুঝতে পারবেন আশা করি।
-প্রকাশক
গ্রন্থ পরিচিতি
এই গ্রন্থখানি
‘বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত’ এই বইখানির নাম……..
এ নাম বহু লোকের মনে কঠিন প্রশ্নের উদ্রেক করবে। …..বিংশ শতাব্দীর এই যুগকে ‘জাহিলিয়াত’ বলা যায় কি করে? জাহিলিয়াত বলতে কি সেই একটি বিশেষ সময়কে বুঝায় না, যা জাজীরাতুল আরবে ছিল হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পূর্বে? কিংবা মানুষের সুদীর্ঘ ইতিহাসের কোন এক অধ্যায়ে –যা অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে? তা ছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতির এই চরম উন্নতির যুগকে –বস্তুগত উন্নতি-অগ্রগতির এই বিস্ময়কর বিকাশের সময়কে ‘জাহিলিয়াত’ বলে আখ্যায়িত করা কি ধৃষ্টতা নয়?………
গ্রন্থকার এই পর্যায়ে উল্লিখিত সকল প্রকারের প্রশ্নের অকাট্য জবাব দিয়েছেন। কিন্তু তিনি ‘জাহিলিয়াত’ শব্দের প্রচলিত অর্থের উপর নির্ভর করেন নি। শব্দটিকে সেই অর্থে ব্যবহারও করেন নি। তিনি শব্দটিকে একটি বিশেস পরিভাষারূপে দেখেছেন। আসলে গ্রন্থকার ইসলামী ভাবধারা ও কুরআনী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে নতুন নতুন পরিভাষা রচনা করে নিয়েছেন। ‘জাহিলিয়াত’ ও অনুরূপ একটি বিশেষ পরিভাষা।
এই সব প্রাথমিক আলোচনার পর গ্রন্থকার পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করেছেন এবং তাৎপর্যপূর্ণ শিরোনাম দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উপস্থাপিত করেছেন ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে….. আধুনিক জাহিলিয়াতের বৈশিষ্ট্য …..ধারণা বিশ্বাসে বিপর্যয়….. আচার-আচরণে ও জীবন-ধারায়ও বিপর্যয় ….কেননা ধারণা-বিশ্বাস বিপর্যয় সৃষ্টি করলে বাস্তব জীবন ধারায় ও আচার-আচরণে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী…….।
বিংশ শতাব্দীর এই যুগে জাহিলিয়াত মানুষের জীবনকে সর্বাত্মকভাবে গ্রাস করে ফেলেছে। বর্তমান দুনিয়ার মানুষের জীবনে কোনো একটি দিকও এমন নেই, যা এই জাহিলিয়াতের প্রভাব থেকে মুক্ত রয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। এই অবস্থায় অপরিহার্য ফলশ্রুতি স্বরূপ ইসলামের সম্মুখে আসা, পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে ইসলামকে গ্রহণ করা, দেশে দেশে ইসলামী বিপ্লব সাধিত হওয়া ছাড়া বিশ্বমানবতার পক্ষে গত্যন্তর থাকতে পারে না। কেননা জাহিলিয়াতের ঘন তমিশ্রায় আচ্ছন্ন নিশিথের অবসানে নবীন সূর্যের উদয় এক চিরন্তন ও স্বাভাবিক ব্যাপার। তার ব্যতিক্রম হতে পারে না, ইতিহাসে কখনোই হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না।
কিন্তু বর্তমানেও বহু লোক সেই ইসলামকে এড়িয়ে যেতে চায়, বহু লোক তাকে ঘৃণা করে। গ্রন্থকার অত্যন্ত নিপুণভাবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং দেখিয়েছেন যে, এড়িয়ে চলা বা ঘৃণা করার কারণ, জাহিলিয়াতে আচ্ছন্ন লোকেরা ইসলামী জীবনে নিজেদের স্বার্থান্ধতা, লালসার অন্ধ অনুসরণ এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার অপমৃত্যু ঘটতে দেখবার জন্যে প্রস্তুত নয়। কিন্তু সেদিন দূরে নয়, যখন তাদের এই মানসিকতাকে চূর্ণ করে দিয়ে ইসলামের অভ্যূদয় ঘটবে।
ইসলামের দিকে বিশ্বমানবতার প্রত্যাবর্তন এক অপরিহার্য ও অবধারিত সত্য। বর্তমান সময়ের মানুষ যত কুফরীতেই নিমজ্জিত থাকুক, জনগণ এই কুফরী ব্যবস্থায় যত কষ্ট পাচ্ছে, তাগুতী শাসনের যত দর্প ও ক্রুরতাই দেখা যাচ্ছে, ইসলামের আগমনের সাথে সাথে সব কিছুই বিলীন হয়ে যাবে –রাত্রি শেষে সূর্যোদয়ে যেমন করে মহাশূন্যে বিলীন হয়ে যায় রাতের পুঞ্জীভূত অন্ধকার।
সেই নতুন দিনের নির্মল সূর্য কিরণের সন্ধান করাই এই গ্রন্থের লক্ষ্য।
–অনুবাদক
শুরু কথা
এই গ্রন্থের নাম ‘বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত’। বহু লোক এই নামকরণ দেখে বিস্মিত হবেন, অন্য বহু লোক হয়ত তাকে সম্পূর্ণরূপে অপছন্দ করবেন….
বিংশ শতাব্দী সভ্যতা ও সংস্কৃতির শতাব্দী। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আবিস্কার উদ্ভাবনীর শতাব্দী! সংগঠন ও বিন্যাস স্থাপনের সময় কাল। প্রকৃতির ওপর মানুষের কর্তৃত্ব স্থাপনের যুগ। অণু ও পরমাণুশক্তি বিচূর্ণকরণ ও তার বিকাশ লাভের যুগ। তাহলে এই সবই কি জাহিলিয়াত?
এই যুগে মানুষ উন্নতি উৎকর্ষের চরম শিখরে আরোহণ করেছে। অতীতের সমগ্র ইতিহাসেও তার কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানুষ এ যুগে যে শক্তি, কর্তৃত্ব, আধিপত্য ও প্রতাপ-দাপট অর্জন করেছে, মাত্র কয়েক দশক পূর্বেও পৃথিবী গ্রহের মানুষ তার কল্পনাও করতে পারেনি। কয়েক শতক পূর্বে তা পারা তো সুদূর পরাহত ছিল। ….তাহলে এতদসত্ত্বেও মানুষ এই বিংশ শতাব্দীতে জাহিলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছে, তা আমরা কি করে বলতে পারি?
আজকের মানুষ যে মূল্যবোধের ছত্রছায়ায় বসবাস করছে, তা হচ্ছে মুক্তি ও স্বাধীনতা, সৌভ্রাতৃত্ব ও সাম্য, গণতন্ত্র ও সামাজিক সুবিচার, যুক্তি ও বিজ্ঞান। এরূপ অবস্থায় আমাদের এই যুগকে জাহিলিয়াত বলব কোন যুক্তিতে?
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
বহু লোকই সাধারণভাবে মনে করে, জাহিলিয়াত বলতে বুঝি কালের কোন একটি বিশেষ অধ্যায়কে বোঝায়, যা ইসলামের পূর্বে আরব উপদ্বীপে বিরাজমান ছিল।
……..এরা পবিত্র চরিত্রাশ্রয়ী! রাসূলে করীম (স)-কে প্রেরণের পূর্ববর্তী কালকে আল্লাহ তা’আলা ‘জাহিলিয়াত’ বলে অভিহিত করেছেন। মনে হচ্ছে, ওরা এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষন করতে প্রস্তুত নয়। তাই শুধু উক্ত সময়টিকেই তারা জাহিলিয়াত মনে করতে বদ্ধপরিকর। ওরা বাস্তবিকই বিশ্বাস করে, ইসলামের বিপরীতে এই যুগটি সত্যিই জাহিলিয়াত ছিল।
তবে খারাপ মনোবৃত্তির লোকদের প্রতিরোধ করে বহু সংখ্যক অনৈসলামী শক্তি। রাসূলে করীম (স) একটি হাদীসে বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************************************************)
যে লোক হিংস্র গোষ্ঠীপ্রীতির আহবান জানাবে, সে আমার উম্মতভুক্ত নয়। আর যে লোক এই হিংস্র বিদ্বেষী গোষ্ঠীবদ্ধতার ভাবধারা নিয়ে মৃত্যবরণ করবে, সেও আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়।
উক্ত লোকেরা এই ব্যাপারে বহু বিতর্কের অবতারণা করেছে। তারা সকলে তদানীন্তন আরবের জাহিলিয়াতকে আদর্শরূপে গ্রহণ করেছে। তাদের মতে কুরআন যদিও তাকে ‘জাহিলিয়াত’ বলেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নাকি জাহিলিয়াত ছিল না। তদানীন্তন আরব পরিবেশে অনেক বিশেষত্ব ছিল। ছিল ব্যক্তিগত অনেক মূল্যবোধ। ছিল জ্ঞান তথ্য, ছিল সভ্যতা ও সংস্কৃতি। আর তা সবই তখনকার দুনিয়ার প্রথম দুই সভ্যতা –রোমান ও পারসিক –এর সাথে আরবের গভীর সম্পর্ক ও যোগাযোগের ফলশ্রুতি। এসব তথ্য অবশ্য এ কালের প্রাচ্যবিদদের (orientalists) গভীর সূক্ষ্ম গবেষণার ফলে জানা গেছে। এ শ্রেণীর লোকেরা বলিষ্ঠ কণ্ঠে দাবী করছে, বিংশ শতাব্দীর এই জ্ঞানোজ্জ্বল যুগে ‘জাহিলিয়াত’ বলতে কিছু নেই, থাকতে পারে না।
তাদের নিজস্ব মানদণ্ডেই যদি সত্য-মিথ্যা বা ভালো-মন্দ নির্ধারিত হয়, তাহলে তাদের একথা মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, এই সব লোক ‘জাহিলিয়াত’ বলতে প্রকৃতপক্ষে কি বোঝায়, কি তার যথার্থ তাৎপর্য, তা আসলেই জানে না। জানে না কুরআন মজীদ ‘জাহিলিয়াত’ বলতে কি বুঝিয়েছে।
এই লোকদের ধারণা, সাদা-মাটা শিরক এবং মরুজীবন উপযোগী মূর্তিপূজা-ই হচ্ছে ‘জাহিলিয়াত’। সেই সাথে প্রতিরোধ গ্রহণও সেকালের আরব সমাজের যে নৈতিক বিপর্যয় ঘটেছিল, তা-ও জাহিলিয়াতের বাহ্যিক প্রকাশ। অন্য কথায় জাহিলিয়াতের বাহ্যিক প্রকাশ –প্রপঞ্জকেই তারা জাহিলিয়াত মনে করেন, যা তখনকার আরব সমাজে ব্যাপক হয়ে দেখা দিয়েছিল। এরা জাহিলিয়াতকে এই সীমাবদ্ধ অর্থে গ্রহণ করতেই অভ্যস্ত এবং তা ইতিহাসের দূর অতীত এক অধ্যায়ে আরব উপদ্বীপের বিচ্ছিন্ন নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর সেই কাল যেহেতু অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, তাই তা আর কখনোই –কোনো সময়ই এবং কোনো জনসমাজে পুনঃ প্রবর্তিত হতে পারবে না।
এ ক্ষেত্রে খারাপ মনোভাব সম্পন্ন লোকেরা মনে করে, জাহিলিয়াত হচ্ছে তাই, যা জ্ঞান ও বিজ্হাতের পরিপন্থী। যা সত্যতা ও সংস্কৃতির বিরোধী। যা প্রগতি বিরোধী, বস্তুগত অগ্রগতির পথে যা প্রতিবন্ধক। যা চিন্তা, সামষ্টিকতা, রাজনৈতিকতা কিংবা মানবিক মূল্যবোধের বিপরীত, তাই জাহিলিয়াত। এই কারণেই তাদের চেষ্টা-প্রচেষ্টা একান্তভাবে নিয়োজিত হয়েছে সেইসব জিনিস প্রতিরোধ সংগ্রামে। কিন্তু তা রাসূলে করীম (স)-এর নীতি আদর্শ ও সংগ্রাম রীতির সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। ফলে প্রকারান্তরে তারা প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে, তদানীন্তন আরব মূর্খ বা জাহিল ছিল না, তারা নানা তত্ত্ব ও তথ্যের ধারক বাহক ছিল। তারা ছিল না পশ্চাদপদ, প্রগতি বিরোধী। তারাও এক ধরনের সভ্যতা সংস্কৃতির ধ্বজাধারী ছিল। মূল্যবোধশূন্যও ছিল না তারা, তাদেরও নানা গুণ-বৈশিষ্ট্য ছিল –মহানুভবতা, বীরত্ব, বিপন্নের ফরিয়াদে সাড়া দান, সাহসিকতা, নির্ভীকতা, মর্যাদাবোধ ও অনুরূপ অন্যান্য ভালো কাজের জন্যে জীবন দান এবং প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার মহৎ গুণে তারা বিভূষিত ছিল। অতএব কুরআন যে এই যুগ বা সমাজকে ‘জাহিলিয়াত’ বলেছে তা যথার্থ নয়। আর এই কারণেই তারা বিংশ শতাব্দীতে জাহিলিয়াতের কোনো নাম-চিহ্ন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে না। বরং তাদের দৃষ্টিতে বর্তমান শতাব্দী তো উন্নতি-উৎকর্ষের আলোকোজ্জ্বল যুগ। এই যুগেই মানুষ পারে উচ্চতর স্বপ্ন দেখতে, মহান কিছু ভাবতে।
এ সত্ত্বেও আমরা বলব, এরা জাহিলিয়াতের প্রকৃতি তাৎপর্য জানে না। তারা বুঝতে পারেনি কুরআন কেন এই যুগকে জাহিলিয়াত বলছে, তার গভীর সূক্ষ্মতত্ত্ব এই লোকদের অগোচরেই রয়ে গেছে।
বস্তুত ‘জাহিলিয়াত’ বলতে –এরা যেমন মনে করেছে কোনো সুনির্র্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ প্রতিকৃতি নয়। ওদের ধারণা, তা অতীত কালের একটি সময়ের বিশেষ ব্যাপার, তা পুনঃ প্রবর্তিত হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এই ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। মূলত জাহিলিয়াত হচ্ছে একটি সুনির্র্দিষ্ট ভাবধারা –সারনির্যাস। তা বিভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে এবং তা হয়ে থাকে পরিবেশ-পরিস্থিতি সময়-কাল ও স্থানের অবস্থার প্রেক্ষিতে। তা সত্ত্বেও সেইসব রূপের অভিন্ন পরিচয় –তা জাহিলিয়াত। তার বাহ্য প্রকাশ (Phenomenon) যতই বিভিন্ন ও বিচিত্র হোক না কেন, আর বাহ্যিকভাবে সেসবের মধ্যে যত পার্থক্যেরই ধারণা করা হোক-না-কেন, মূল ব্যাপারের দিক দিয়ে তাতে বিন্দুমাত্রও তারতম্য ঘটে না।
আর তা জ্ঞান-বিজ্ঞান, অবিহিতি, অভিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি, বস্তুগত প্রগতি-অগ্রগতি এবং চিন্তা সামষ্টিকতা রাজনৈতিকতা ও সাধারণ মানবিকতার বিপরীতও কিছু নয়। যেমন এক শ্রেণীর লোক চিন্তা করেছে। তা আরব জাহিলিয়াতের প্রেক্ষিতেই হোক, কি অধুনা বিংশ শতকের জাহিলিয়াতের প্রেক্ষিতে। সেই মূল ভাবধারা সর্বত্রই লক্ষণীয়।
মূলক কুরআন মজীদ-ই এই শব্দটির ব্যভহার করেছে এবং তার সংজ্ঞা ও পরিচিতিও উপস্থাপিত করেছে। কুরআনের দৃষ্টিতে ‘জাহিলিয়াত’ হচ্ছে একটি মানসিক অবস্থা, যা আল্লাহর দেওয়া হেদায়েত মেনে নিতে পুরোপুরি অস্বীকার করে। তা এমন এক পরিবেশ ও সামাজিক সংগঠন যা আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করতে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ও বিচার কার্য সম্পাদন করতে সম্পূর্ণ অরাজী হয়ে দাঁড়ায়। এই কথাই প্রকাশ করা হয়েছে কুরআনের নিম্নোদ্ধৃত আয়াতটিতে-
(আরবী**************************************************************)
ওরা কি জাহিলিয়াতের কর্তৃত্ব সন্ধান করে? অথচ দৃঢ় প্রত্যয় সম্পন্ন লোকদের জন্যে আল্লাহর তুলনায় অধিক উত্তম ফয়সালাকারী আর কে হতে পারে?
এ আয়াত অনুযায়ী ‘জাহিলিয়াত’ হচ্ছে আল্লাহ পরিচিতি আল্লাহর দেওয়া হেদায়েত অনুযায়ী হেদায়েত গ্রহণ এবং আল্লাহর নাযিল করা বিধানের ভিত্তিতে শাসন-প্রশাসন চালানোর পরিপন্থী রীতি-নীতি ও আদর্শ। তা কথিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, বস্তুগত সভ্যতা-সংস্কৃতি ও বিপুল উৎপাদনের বিপরীত কিছু নয়।
০০০০০০০০০০০০
কুরআন কখনোই বলেনি যে, আরবরা ‘জাহিলিয়াতের’ মধ্যে নিমজ্জিত ছিল এইজন্য যে, তারা জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও চিকিৎসাবিদ্যা জানত না। অথবা এজন্যে যে, তারা রাজনৈতিক সংস্থা-ব্যবস্থার সাথে পরিচিতি ছিল না। কিংবা বস্তুগত উৎপাদনের ক্ষেত্রে তারা পশ্চাদপদ রয়ে গিয়েছিল। তারা বিশেষ বিশেষ কোনো গুণ-বৈশিষ্ট্যে ভূষিত ছিল না; কিংবা সাধারণভাবে মূল্যবোধ বঞ্চিত ছিল বলেও তাদের জীবনকে ‘জাহিলিয়াত’ বলে অভিহিত করা হয়নি। কুরআন যদি তাদের প্রসঙ্গে এরূপ কথা বলত তাহলে আল্লাহ তাদের জন্যে বিকল্প কিছুর ব্যবস্থা অবশ্যই করতেন। যেমন মূর্খতার বিকল্প বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও তথ্য বা জ্যোতির্বিদ্যা, প্রকৃতি বিজ্ঞান, রসায়ন ও চিকিৎসা বিদ্যাই তার বিকল্প হিসেবে মনে করা যেত। কিংবা রাজনৈতিক মূর্খতার পরিবর্তে বিস্তারিত অধীত রাষ্ট্রীয় মতবাদ মতাদর্শ ও বিকল্প হতে পারত। বস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা করা অসম্ভব ছিল না। এ কাজকে আরও উন্নত উৎকর্ষসম্পন্নও করা যেত। বিশেষ গুণ-বৈশিষ্ট্যের অভাব ও বিশেষ ধরনের মূল্যবোধের অনুপস্থিতিকেও নানাভাবে পূরণ করা যেত। তাতে কোনোরূপ অসম্ভাব্যতার অবকাশ ছিল না।
কিন্তু কুরআন তাদের সম্পর্কে এই পর্যায়ের কোন কথাই বলেনি। আর এই কারণেই কথিত ধরনের কোন বিকল্প ব্যবস্থাই তাদের জন্যে করা হয়নি।–[সন্দেহ নেই, উত্তরকালে ইসলামী অভ্যূদয়ের পরিণতিত এই সব কিছুই তাদের করায়ত্ত হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ যে মানুষকে জাহিলিয়াত থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন ঐগুলো তার বিকল্প ছিল না।]
কুরআন তাদের সম্পর্কে বলেছে, ওরা ‘জাহিল’। কেননা ওরা নিজেদের কামনা-বাসনা ধারণা-চিন্তাকে শাসক-নিয়ন্ত্রক রূপে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছে। আর আল্লহার হুকুম ও বিধানকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বস্তুত এটাই হচ্ছে জাহিলিয়াত এবং আল্লাহ তাদের এই জাহিলিয়াতের বদলেই দ্বীন-ইসলাম দান করেছেন।
মানব জীবনকে বিচার করার জন্যে এটাই হচ্ছে কুরআন অবলম্বিত মানদণ্ড (Measure)। এই মানদণ্ড জাহিলিয়াতের প্রতিপক্ষ। তা তদানীন্তন আরব জাহিলিয়াত হোক; কিংবা হোক ইতিহাসের অন্য কোনো অধ্যায়ে অপর কোনো জাহিলিয়াত।
প্রাচীনতম কালের অনেক সভ্যতা ও সংস্কৃতির কাহিনী কুরআন মজীদে উদ্ধৃত হয়েছে। যে সব সভ্যতা-সংস্কৃতি ইসলাম পূর্ব আরবদের তুলনায় বিপুলভাবে উন্নত মানের ও অগ্রসর ছিল। তা সত্ত্বেও কুরআন-ইসলাম তাকে ‘জাহিলিয়াত’ নামে অভিহিত করছে। কেননা সে সব সভ্যতা-সংস্কৃতি আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়েত অবলম্বনকারী বা তার অনুসারী ছিল না। এ পর্যায়ে কুরআনের এ আয়াতটি স্মরণীয়ঃ
(আরবী***********************************************************************************)
ওরা কি পৃথিবী পরিভ্রমণ করেনি? তাহলে তারা দেখতে পেত তাদের পূর্ববর্তী লোকদের পরিণতি কি হয়েছিল। তারা শক্তির দিক দিয়ে ওদের অপেক্ষা অধিক ছিল। তারা পৃথিবীকে উন্নত ও উৎকর্ষিত করেছে। তারা যতটা উন্নত-উৎকর্ষিত করেছে তার তুলনায় অনেক বেশী এবং তাদের কাছে তাদের রাসূলগণও এসেছিল অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ নিদর্শনাদি সহকারে। ফলে আল্লাহ তো তাদের ওপর জুলুম করেন নি, বরং তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর জুলুম করেছিল। পরে যারা চূড়ান্ত মাত্রায় খারাপ কাজ করেছে তাদের পরিণতিও খারাপ হয়েছে। আর সে খারাপ কাজ এই ছিল যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অসত্য মনে করেছিল এবং তারা সে সবের প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছিল।
এ আয়াতে কুরআন আরব ‘জাহিলগণ’কে প্রাচীণ ও পূর্ববর্তী জাহিলিয়াতের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করার আহবান জাহিয়েছে। সে দিকে দৃষ্টিপাত করলেই তারা দেখতে পাবে তার পরিণতি কি ভয়াবহ হয়েছে। তাহলেই তারা জাহিলিয়াতকে ভয় করবে, তাকে এড়িয়ে যেতে পারবে। আর তাহলে তারা আল্লাহর আয়াতকে অসত্য মনে করবে না, তা মেনে নেওয়ার বাধ্যবাধকতাকেও পারবে না অস্বীকার করতে। তখন তারা অবশ্যই তার প্রতি ঈমান আনবে, কুরআনের হেদায়েতকে তারা অবলম্বন করবে। উপরোক্ত আয়াতে যদিও ‘জাহিলিয়াত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি, কিন্তু তার তাৎপর্য ও ভাবার্থ যথাযথভাবে উপস্থিত। এ আয়াতে আরব ‘জাহিল’গণকে বলা হয়েছে, জাহিলিয়াতের ক্ষেত্রে ওরা সব তোমাদেরই মতো। যদিও তারা শক্তি-সামর্থ দাপট-প্রতাপ ও পৃথিবী আবাদকরণে, সভ্যতা-সংস্কৃতি সৃষ্টিতে তোমাদের তুলনায় অনেক অগ্রসর ও উন্নত ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও জাহিলিয়াতের মানদণ্ডে তোমরা ও তারা ভিন্ন। আর জাহিলিয়াতের এই সভ্যতা ও সংস্কৃতি তোমাদের সকলের পক্ষেই অত্যন্ত মারাত্মক। অতএব তোমরা এই জাহিলিয়াতের অক্টোপাস থেকে মুক্তি ও নিস্কৃতি লাভ করে আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়েতের পটভূমিতে ফিরে এসো। তোমরা সত্যিকার অর্থে মুসলিম –একান্তভাবে আল্লাহনুগত হয়ে যাওয়।
এ প্রেক্ষিতে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, জাহিলিয়াত মূলত একটি মনস্তাত্মিক অবস্থা, যা আল্লাহর দেওয়া হেদায়েত গ্রহণে অস্বীকৃতি হয়। তা এমন এক সাংগঠনিক সামষ্টিক রূপ, যা আল্লাহর নাযিলকরা বিধান অনুযায়ী সিদ্ধঅন্ত গ্রহণ ও শাসন-প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে সম্পূর্ণরূপে অবাধ্য ও অরাজী। আর এই রূপ অবস্থারই অনিবার্য ফসল হচ্ছে চরম মাত্রার বিকৃতি ও বিপর্যয় –deliquity perversion. এই বিকৃতি ও বিপর্যয়ের রূপ বিভিন্ন হতে পরে এবং বিভিন্ন রূপের বিকৃতি ও বিপর্যয়ের ফলাফলও হতে পারে বিভিন্ন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানব জীবনে বিকৃতি ও বিপর্যয় নিয়ে আসার ব্যাপারে অভিন্ন ভূমিকা পালন করে। জীবনকে চরমভাবে বিপর্যস্ত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। শান্তি সমৃদ্ধি ও শৃঙ্খলা হয়ে দাঁড়ায় সুদূর পরাহত।
এই কারণে এ জাহিলিয়াত ইসলাম পূর্ব আরব জাহিলিয়াতের রূপ ও প্রকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সীমিত নয় কাল ও যুগের কোনো একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যে। আসলে তা এমন একটি অবস্থা, যা কালের যে-কোনো সময়ে, দুনিয়ার যে-কোনো দেশে এবং মানুষের যে-কোনো সমাজ-সংস্থায় পাওয়া যাওয়া খুবই সম্ভভ। অনুরূপভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতির যে কোনো স্তরে –বস্তুগত উন্নতি-অগ্রগতি, মূল্যমান, চিন্তা, রাজনৈতিকতা, সামষ্টিকতা ও মানবিকতার যে কোনো ধাপে ও বাঁকেই তা বাস্তব হয়ে দেখা দিতে পারে। আর তা বাস্তব হয়ে দেখা দিতে পারে তখনই, যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হেদায়েত অবলম্বিত অনুসৃত হবে না, হবে অগ্রাহ্য ও উপেক্ষিত। আর তদস্থলে অনুসৃত হবে মানুষের নিজস্ব চিন্তাপ্রসূত মতাদর্শ, পরিপূরিত হবে মানুষের খাহেশ-কামনা-বাসনা, অস্বীকৃত হবে আল্লাহর দ্বীন, আল্লাহর নাযিল করা বিধান।
এ কারণেই বলা যায়, জাহিলিয়াত ও মানুষের খাহেশ, কামনা-বাসনা ও নিজস্ব চিন্তা প্রসূত মতবাদ মতাদর্শ এক ও অভিন্ন।
অতএব যারাই নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা চালিত হয়, অনুসৃত করে মানব-রচিত নিয়ম বিধান কার্যত তারাই অস্বীকার করে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান মেনে চলতে, অনসরণ করতে। আর তখনই তারা নিমজ্জিত হয়ে পড়ে জাহিলিয়াতের অতল গহবরে। কেননা তারা আল্লাহর হেদায়েতকে গ্রহণ ও অনুসরণ করতে অস্বীকার করেছে। মানবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের, সভ্যতা-সংস্কৃতির, বস্তুগত অগ্রগতি এবং রাজনৈতিক-সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংস্থা-সংগঠনের দিক দিয়ে উন্নতি ঊর্ধ্বগতির যত উচ্চতর স্তরেই পৌঁছে গিয়ে থাকুক-না কেন। আর এই জাহিলিয়াতের যা কিছু অনিবার্য পরিণতি, যা কিছু ফলাফল, তার সম্মুখীন তাদের হতেই হবে নিশ্চিতভাবে। অশান্তি-অস্থিরতা, দুর্ভাগ্য-হতাশা-বঞ্চনার অমোঘ পরিণতি থেকে তাদের নিস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব।
কাজেই স্পষ্ট ভাষায় বলা যায়, তদানীন্তন আরবরাই জাহিলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল না ইসলামের পূর্বে। বরং অনুরূপভাবে যে জন-গোষ্ঠীই আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা-মতবাদ অনুসরণ করে চলে, তারা অভিন্নভাবেই জাহিলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত।
যার মনে করে, ইসলাম-পূর্বকালীন আরবের জাহিলিয়াতই একমাত্র জাহিলিয়াত, তাদের সম্মুখে জাহিলিয়াতের প্রকৃত তাৎপর্য তুলে ধরাই আমাদের লক্ষ্য। এই বিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা সংস্কৃতির চরম উন্নতির আলোকোজ্জ্বল পরিবেশে জীবন যাপনের সঠিক রূপ কি তা তারা নির্ভুলভাবে বুঝতে পারবে জাহিলিয়াতের এই তাৎপর্যের আলোকেই। এ কালের যে সব লোক তদানীন্তন আরব জাহিলিয়াতের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করেন, সে জাহিলিয়াত থেকে তারা সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে আছে বলে অন্তরে আত্মশ্লাঘা বোধ করে, তাদের জন্য আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, তারা এজন্য যত চেষ্টাই করুক না কেন, বিংশ শতাব্দীর এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি রাজনৈতিক-সামষ্টিক-চৈন্তিক মূল্যবোধের এই চরম উৎকর্ষের যুগে তদানীন্তন আরব জাহিলিয়াত –যাকে তারা অনেক পশ্চাতে ফেলে এসেছে-তাদের স্পর্শমাত্রও করতে পারবে না। তাদের মনে রাখা উচিত বিংশ শতাব্দীর এই যুগ চৌদ্দশ বছর পূর্বেকার আরব জাহিলিয়াতের তুলনায় অধিক বীভৎস ও জঘন্য জাহিলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত। উপরন্তু অধিক সত্য কথা হচ্ছে, পৃথিবীর বুকে বসবাসকারী মানুষের ইতিহাসে বর্তমান বিংশ শতাব্দীই হচ্ছে সর্বাধিক জাহিলিয়াতের অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ।
তদানীন্তন আরবে জাহিলিয়াত ছিল খুবই সাদা-সিধা হালকা অপঞ্জীভূত এক পাত্রের তলদেশে অবস্থিত আবর্জনার মতো। তখনকার লোকেরা দৃশ্যমান মূর্তির পূজা করত। তাও ছিল অপরিপক্ক, সরল প্রকৃতির কল্পনার সাহায্যে মূর্তিগুলোর গাত্রে নানা বিচিত্র রঙ লাগিয়ে দিয়ে শোভা মণ্ডিত করে দিত। এইগুলোকে কেন্দ্র করে তাদের নানা প্রকারের অনুষ্ঠান হতো –যদিও সবই হলো পথভ্রান্ত, আদর্শ বিচ্যুত। কিন্তু সে বিচ্যুত ও বিভ্রান্তি ছিল অত্যন্ত সরল, অগভীর। আর এই সবই ছিল কোরায়েশ বংশের ষড়যন্ত্র ও শক্ত হস্তক্ষেপের ফল। সব কিছু তাদের নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে নিয়ন্ত্রিত হতো। তাদের শ্রেষ্ঠত্ব ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণই ছিল সবকিছুর মূলে নিহিত লক্ষ্য। আর এই সব কারণেই তারা শাশ্বত সত্য ও সুবিচারের পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর সর্বপ্রকারের জাহিলিয়াতের পশ্চাতেই এই রূপ কালো হাতের অস্তিত্ব অবশ্যম্ভাবী; তা প্রাচীন কালের হোক, কি আধুনিক কালের। তবে তা কখনো অশক্ত সহজ রূপও ধারণ করে থাকে, যদিওো তাতে তার বীভৎসতা পূর্ণ মাত্রায় নগ্ন হয়ে দেখা দেয়। তার কারণ, আসল প্রকৃতিতে এতটা বিকৃতি আসে না, যতটা তার বাহ্যিক প্রকাশে গোচরীভূত হয়। এরূপ অবস্থায় বাহ্যিক ছালের (বকল) সাথে মহাসত্যের ঘর্ষণে তা অবিলম্বেন বিলীন হয়ে যেতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত তা শাশ্বত সত্যের ধারক হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারে, পুঞ্জিভূত অন্ধকার হয়ে যেতে পারে বিলীন।
কিন্তু আধুনিক জাহিলিয়াত সুসংগঠিত ষড়যন্ত্র ও অপকৌশলের, সুগঠিত, সুপরিকল্পিত; বিশ্বমানবতাকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করার লক্ষ্যে একান্তভাবে নিয়োজিত। তার যাবতীয় কার্যকলাপই বিজ্ঞানভিত্তিক; বৈজ্ঞানিক কলা-কৌশল সমৃদ্ধ। এমন এক জাহিলিয়াত; যার দৃষ্টান্ত বিশ্ব ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বিংশ শতাব্দীর এই অভিনব জাহিলিয়াতের –তার প্রপঞ্চের বিস্তারিত অধ্যয়নই এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য।
এ গ্রন্থে অধ্যয়ন করব এর কার্যকারণের, তার চাকচিক্যময় বাহ্য প্রকাশ্যের, মানুষের ধ্যান-ধারণা ও আচার-আচরণের ওপর তার প্রতিফলন, মানব জীবন লব্ধতার ফলাফল; মানুষের ভবিষ্যত।
এই আলোচনায় আমাদের বক্তব্যের সমর্থনে যে সব সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপিত হবে; তা সবই সেই বাস্তব অবস্থা ও ঘটনাবলী থেকে সংগৃহীত; যার মধ্যে আমরা জীবন ধারণ করছি। তা প্রাচ্য হোক, কি পাশ্চাত্যে।
গোটা পৃথিবী থেকে সংগৃহীত সাক্ষ্য-প্রমাণ……
এ আলোচনার প্রকৃত লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের ধ্যান-ধারণা নির্ভুল করে তোলা।
আচার-আচরণকে সঠিকভাবে গড়ে তোলা। প্রগতি ও অগ্রগতির বা বিকাশ-এর নামে যে বিভ্রান্তির কুহক জালে বর্তমান বিশ্বমানবতা জর্জরিত, সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতারণায় সম্মোহিত, এ আলোচনার তীব্র কষাঘাতে তা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে, এ আমাদের দুরাশা নয়। এর ফলে মানবতা আত্ম-সচেতনতা ফিরে পাবে। তারা যে গভীর খাঁদের দিকে তীব্রগতিতে দৌড়ে যাচ্ছে, মনে করছে, তারা নির্ভুল পথেই অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের এ আলোচনায় তাদের এ ভুল ভাঙবে।
আর এই সব প্রেক্ষিতেই বিশ্ব মানবতার সম্মুখে শুভ সংবাদ উপস্থাপিত করাও আমাদের কাম্য।
সে এমন এক উজ্জ্বলতর ভবিষ্যৎ, যার প্রতি আমাদের রয়েছে প্রবল ঈমান। সে ভবিষ্যৎ অর্জন করা তখনই সম্ভব হবে, যখন মানবতা বর্তমান পুঞ্জীভূত অন্ধকারের বক্ষ দীর্ণ করে নির্মল আলোকের দিকে অগ্রসর হবে।
আমি অবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কে খুবই সচেতন। আমি জানি, আমাদের লক্ষ্যভূত কাজ মাত্র দু’-এক খানি কেন, হাজার খানি গ্রন্থেও সাধ্যায়ত্ত নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখানে আমি দুটি ব্যাপারকে পরপর সাজিয়ে দিচ্ছিঃ
প্রথম, আমি বিশ্বাস করি, অন্তর-নিঃসৃত কথা কখনোই নিস্ফল যায় না, যদিও তা সহসাই মানুষের কর্ণকুহরে ভেদ করে মর্মে গিয়ে পৌঁছায় না।
আর দ্বিতীয়, অন্ধকারের দুর্ভেদ্য জাল ছিন্ন করার কাজ যথারীতি শুরু হয়ে গেছে বেশ কিছুকাল আগে থেকেই।
পুঞ্জীভূত অন্ধকারের বক্ষ দীর্ণ করে নতুন সূর্যের আলোকচ্ছটা চতুর্দিকে বিচ্ছুরিত হয়ে পড়েছে। -আমি তা নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছি। আর সেই আলো উজ্জ্বল। তার মধ্যে বসেই আমি এই গ্রন্থ রচনার কাজ শুরু করে দিয়েছি। মহান আল্লাহই আমাকে মনযিলে পৌঁছিয়ে দিবেন।
–মুহাম্মদ কুতুব
(আরবী*****************************************************************************)
তবে ওরা কি জাহিলিয়াতের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চায়? অথচ দৃঢ় প্রত্যয় সম্পন্ন লোকদের জন্যে আল্লাহর তুলনায় অধিক উত্তম হুকুম দানকারী (কর্তৃত্ব সম্পন্ন) সত্তা আর কে হতে পারে? (সূরা মায়েদাঃ ৫০)
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ভূমিকা
আমরা যথার্থভাবেই জানতে পেরেছি যে, ইতিহাসের অধ্যায়সমূহের মধ্যে কোনো একটি বিশেষ ও সীমাবদ্ধ অধ্যায়কেই ‘জাহিলিয়াত’ নামে চিহ্নিত করা যায় না।
আমরা এ-ও জেনে নিয়েছি যে, তা জ্ঞঅন-বিজ্ঞান, সংস্কৃতি-সভ্যতা ও বস্তুগত উৎকর্ষ-অগ্রগতি বললে যা বুঝায় তার বিপরীত কোনো জিনিসকে জাহিলিয়াত বলা যায় না।
মূলত জাহিলিয়াত হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া হেদায়েত অবলম্বন ও অনুসরণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন, আল্লাহর নাযিল করা বিদান অনুযায়ী জীবন-সমাজ-রাষ্ট্র পরিচালনা করতে অস্বীকার করা।
এই প্রেক্ষিতে আমাদের মন-মানসিকতার মধ্যে এমন একটি প্রস্তুতি জেগে ও গড়ে উঠেছে, যার দরুন আমরা সহজেই বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত পর্যায়ে প্রকাশ্য ও উন্মুক্ত আলোচনার অবতারণা করতে পারি।
আমাদের এই প্রস্তুতি কারোর-কারোর জন্য বিব্রতকরও হতে পারে বটে! কেননা আধুনিককালের জাহিলিয়াত অনেক মানুষকে বিমোহিত, অবনত ও অধীন বানিয়ে দিয়েছে। তারা বলে, জাহিলিয়াত বলতে তুমি যখন এই শতাব্দীকেই বোঝাতে চেয়েছ তখন তা-ই সই। আমরা যে অবস্থায় রয়েছি তাতেই আমরা সন্তুষ্ট। এই শতাব্দীর প্রতি আমাদের পূর্ণ সন্তুষ্টি রয়েছে, তোমরা একে যতই জাহিলিয়াত বলে অভিহিত করো না কেন! শুধু তা-ই নয়, আমরা এর প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করছি, এর প্রতি লোলুপ হয়ে তাকিয়ে আছি। আমরা এই শতাব্দীর ভূষণ ও আয়োজন ত্যাগ করে ‘আল্লাহর হেদায়েত’ নামের কোনো জিনিসের দিকে প্রত্যাবতন করতে রাজি নই। কেননা, তোমরা ‘আল্লাহর হেদায়েত’ বলে যে-জিনিস পেশ করছ, তা তো মূর্খতা, কুসংস্কারে ভর্তি, পশ্চাদপদতা, পতনশীলতা, পচনশীলতা, অসভ্যতা, বর্বরতা। আমরা ইচ্ছা করেই তার অক্টোপাস থেকে বের হয়ে এসেছি। আমরা নবতর সংস্কৃতি পেয়েছি, উত্তরিত হয়েছি নবতর এক উচ্চমানের সভ্যতায়। ফলে আমরা অন্ধকার থেকে মুক্তি পেয়ে আলোকমণ্ডিত পরিবেশে এসে গেছি। না, না, তোমাদের কথা শুনছি না! এই জাহিলিয়াতই আমাদের পছন্দ, আমাদের কাছে অতিশয় প্রিয় সেই জিনিসের তুলনায়, যার দিকে তোমরা আমাদের ডাক দিচ্ছ।
এই মানসিকতার সাথে কুরআন মজীদের এই কথাটুকু পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল দেখতে পাচ্ছি। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************************)
এই লোকেরা অন্ধত্বকে অধিক পছন্দ করে নিয়েছে হেদায়েতের তুলনায়।
(হা-মীম সাজদাহঃ ১৭)
আল্লাহর এই কথাটিও যথার্থঃ
(আরবী***********************************************************************)
এমনিভাবেই যারা কিছুই জানে না, বুঝে না, তারা বলে ওদের মতোই কথা। আসলে ওদের সকলের অন্তরসমূহ পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ –অভিন্ন হয়ে গেছে….। (সূরা বাকারাঃ ১১৮)
সার কথা, জাহিলিয়াতের এই ধ্বজাধারী লোকেরা ইতিহাসের পটভূমিতে একই কাতারে দাঁড়িয়ে আছে। সেকালের ও একালের এই মনোভাবের লোকদের মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই –সবই একাকার।
আধুনিক কালের জাহিলিয়াত সম্পর্কে আলোচনা করার জন্যে আমাদের মন ও মগজ সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে আছে। আমাদের আলোচ্য বিষয়টি মোটেই বিস্ময়কর কিছু নয়, নয় অপরিচিত কিছু –যেমন প্রথম দিক দিয়ে মনে হয়েছিল। কিন্তু সেই সাথে একথাও সত্য যে, বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণমুখী আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
বরং সত্যি কথা এই যে, এ পর্যায়ে এত বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন যে, এই ধরনের আরও বহু সংখ্যক বই এ পর্যায়ে রচিত হওয়া একান্তই বাঞ্ছনীয়।
বস্তুত ‘জাহিলিয়াত’ মাত্রই –তা যে কালের ও যে-ধরনেরই হোক –আল্লাহর দেওয়া হেদায়েতকে অপছন্দ ও অগ্রাহ্য করে। হেদায়েতকে প্রত্যাখ্যান করে অন্ধত্বকে বুকে জড়িয়ে ধরে। আর মনে মনে ধারণা করে, তারা যে জিনিস অবলম্বন করেছে, তা সম্পূর্ণ কল্যাণময়। আর তাকে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর যে হেদায়েতের দিকে তাদের আহবান করা হচ্ছে তাতে ক্ষতি বা লোকসান ছাড়া আর কিছুই নেই।
কিন্তু তাদের অবলম্বিত জাহিলিয়াত ও অন্ধত্বে যে পথভ্রষ্টতা, বিকৃতি, বিপথগামিতা, ভাগ্যহীনতা ও অস্থিরতা নিহিত রয়েছে, সে সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রথম দিক দিয়ে সম্ভব হয় না, সম্ভভ হয় হেদায়েত পাওয়ার পর; তার পূর্বে নয়। অন্ধকারের গহবর থেকে মুক্তিলাভের পর আলোকের মধ্যে আসতে পারলেই বুঝতে পারা যায় আলোর মর্যাদা ও গুরুত্ব। জাহিলিয়াতের ধ্বংসকারিতা মর্মে মর্মে অনুধাবনের জন্যে একান্ত প্রয়োজন হচ্ছে মানব প্রকৃতিকে আল্লাহর হেদায়েতের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা।
আমাদের এই গ্রন্থের লক্ষ্যই হচ্ছে, বর্তমান মানবতা যে ভ্রষ্টতা, বিকৃতি, বিপথগামিতা, দুর্ভাগ্য ও মানসিক অস্থিরতার মধ্যে নিমজ্জিত, তা পূর্ণ মাত্রায় উদঘাটন করা। এটা স্পষ্ট করে চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যে, তাদের বর্তমান সর্বাত্মক দুর্দশা ও সর্বগ্রাসী পতনের একমাত্র কারণ হচ্ছে আল্লাহর দাসত্বকে অস্বীকার করা, আল্লহার নাযিল করা বিধান থেকে দূরে –অনেক দূরে চলে যাওয়া।
সন্দেহ নেই, আমার বক্তব্য হৃদয়ঙ্গম করা তাদের মন-মগজের পক্ষে খুব সহজ হবে না, কেননা বর্তমানের এই জাহিলিয়াত তার অনুসারীদের মনের পটে বহুবিধ বর্ণের ছটা বিক্ষেপণ করেছে। তাদের ধারণা ও আচরণে বিভিন্ন প্রকারের বিকৃতি ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে।
কোনো কোনো সময় তাদের এই প্রবোধ দেওয়া হয় যে, তাদের ধারনা ও আচার-আচরণ যা কিছুই রয়েছে, তাতে তারা আল্লাহর বিরোধিতা কিছু করছে না। তারা যা কিছু ভাবছে, যা কিছু করছে, তা আল্লাহর কাছ থেকেই স্থিরীকৃত হয়েছে। তাতে রয়েছে আল্লাহর নির্দেশ।
আবার কখনো বোঝানো হয়, তাদের ধারণা ও আচার-আচরণে যা কিছু বিকৃতি ও বিপর্যয় এসেছে, তাতে তাদের কোনো হাত নেই। এই সবকিছুই অবধারিত, ললাট লিখন। তারা তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে না, পারে না তা পরিবর্তন করতেও। তা সর্বদিক দিয়েই তাদের বুঝ দিতে সচেষ্ট বটে; কিন্তু যে বুঝ দেওয়ার মধ্যে আল্লাহর উল্লেখ অনিবার্য, তা সযত্নে পরিহার করে চলবে। আল্লাহরও যে বিধান রয়েছে মানবতার কল্যাণের মধ্যে, তা কখনোই তাদের বলা হবে না। ফলে দুনিয়ার প্রতিটি শক্তিই বিদ্রোহী, এমন প্রতিটি মক্তির বিরুদ্ধেই লড়াই করা অবশ্যম্ভাবী। এখানকার প্রত্যেক সংস্থা ও ব্যবস্থা অবশ্যই সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। কিন্তু তার কোনোটিই আল্লাহ প্রদত্ত মানদণ্ডে ওজন বা যাচাই করা হবে না। কেননা তাকে তো কোনো হিসাবেই গণ্য করা হয় না বর্তমান যুগের জাহিলিয়াতের পটভূমিতে।
জনগণ যখন প্রকৃতই আত্মসচেতনতা লাভ করবে, তাদের আত্মা যখন জেগে উঠবে, স্বচ্ছ দৃষ্টি হবে উন্মুক্ত, তখনই তারা বুঝতে ও জানতে পারবে যে, মানুষের সাথে এরূপ আচরণ কেল একালের এই জাহিলিয়াতেরই নয়; ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ের জাহিলিয়াতেরই এই প্রকৃতি, এই ধর্ম। কুরআন মজীদের নিম্নোদ্ধৃত আয়াত দ্বারা তাদের কথাই বলা হয়েছেঃ
(আরবী**********************************************************************)
এই লোকেরা যখন কোনো চরম নির্লজ্জতার কাজ করে তখন তারা বলে, আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের তো এইরূপ কাজে ব্যস্ত পেয়েছি –বরং আল্লাহ-ই আমাদের তা করার নির্দেম দিয়েছেন। (সূরা আ’রাফঃ ২৮)
(আরবী*********************************************************************)
শিরককারীরা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহ চাইলে তো আমরা শিরক করতাম না, আমাদের পতৃপুরষরাও নয়। (সূরা আন’আমঃ ১৪৮)
তাহলে দেখা গেল, জাহিলিয়াতের বাহ্যিক রূপ বিভিন্ন হয়ে থাকে। তা যেমন বস্তুগত হয়, তেমনি হয় পরিবেশগত। কিন্তু এ সম্পর্কিত মৌল ধারণা বিভিন্ন হয় না। ইতিহাসের ধারায় তার কার্যকারিতাও হয় না বিভিন্ন রূপ।
ব্যাপার যা-ই হোক, বর্তমান জাহিলিয়াতের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত লোকেরা কি কঠিন বিকৃতি ও বিপথগামিতার আবর্তে পড়ে গেছে তা অনুধাবন করা তাদের পক্ষে খুব একটা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। কেননা, এই বিকৃতি ও বিপথগামিতার মৌল কারণই হচ্ছে আল্লাহর হেদায়েত থেকে তাদের দূরে সরে যাওয়া, তার সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়া। তাদের কাছে এই ব্যাপারটি যখন প্রকট হয়ে উঠবে এবং তারা এ বিষয়ে পূর্ণ সচেতন হতে পারবে, ঠিক তখনই আল্লাহর হেদায়েত তাদের বর্তমান বিপর্যস্ত অবস্থা, অশান্তি, পীড়ন, জ্বালা ও অস্থিরতা থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে। অন্য কথায় আল্লাহর হেদায়েতের কার্যকারিতার জন্যে এই মানসিক চেতনা ও জাগরণ পূর্বশর্ত। তা হলেই তা তাদেরকে স্থিতি, নিশ্চিন্ততা, স্বস্তি, সৌভাগ্য ও সন্তুষ্টির দিকে নিয়ে যেতে পারবে।
কিন্তু তা কি খুব সহজসাধ্য ব্যাপার? ….মোটেই নয়। সেইজন্য সেই পরিমাণ চেষ্টা-সাধনা ও সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা প্রয়োজন, যতটা আধুনিক জাহিলিয়াত তাদেরকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার কাজে ব্যয় ও বিনিয়োগ করেছে। যা করে তারা তাদের মনে আল্লাহর হেদায়েতের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এখানে তাদের সম্মুখে জীবনের নবতর ব্যাখ্যা পেশ করতে হবে, অন্য সব ব্যাখ্যাকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যাত করতে হবে এবং তদস্থলে সেই ব্যাখ্যা মন-মগজে বসিয়ে দিতে হবে যা নাযিল করেছেন স্বয়ং বিশ্ব-স্রষ্টা আল্লাহ তা’আলা।
কিন্তু ব্যপারটির কঠিনতা-জটিলতা আমাদেরকে যেন নিষ্ক্রিয় করে দিতে না পারে সেজন্যে আমরা এই কথা বলা থেকেও বিরত থাকব না। এই বর্ণনা নিশ্চয়ই প্রকৃত কোনো অন্তরায় হয়ে যেন না দাঁড়ায় আল্লাহর সত্য হেদায়েত লাভ এ জনগণের মধ্যে। জনগণকে অবশ্যই আধুনিক জাহিলিয়াতের সব লোভনয়ি-আকর্ষনীয় কথাবার্তা ও জাঁকজমক থেকে দূরে সরে থাকতে হবে। তা হলেই আশা করা যায় তাদের হৃদয় উন্মুক্ত হবে মহাসত্য অনুধাবন ও গ্রহণের জন্যে। তখন বর্তমান জাহিলিয়াতের কুৎসিত চেহারা তাদের চোখের সামনে উদঘাটিত হবে। এই পরম সত্যকে যারা বালোবাসতে পারবে, তদনুযায়ী জীবন যাপন শুরু করতে ও তাকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে পূর্ণ শক্তি দিয়ে জিহাদও করতে সক্ষম হবে।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
শুরুতেই জনগণ হয়তো আমাদের সাথে একমত হবে না, আমাদের বক্তব্যকে সত্য বলে মেনে নেবে না।
একালের মানুষ যে চরম ব্যর্থতা, অস্থিরতা ও অশান্তির মধ্যে জীবন যাপন করছে, তা যেন আল্লাহর দিক থেকে তাদের দূরত্বে পড়ে যাওয়ারই অনিবার্য ফল, একথা অনুধাবন করা হয়তো তাদের পক্ষে কঠিনই হবে।
আধুনিক জাহিলিয়াত তাদের বুঝেয়েছে মূলধন বা পুঁজিবাদই হচ্ছে তাদের এ দুর্ভাগ্যের মূলীভূত কারণ অথবা তা শ্রেণী পার্থক্য ও শ্রেণীগত দ্বন্দ্বেরও ফলশ্রুতি। কিংবা ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থাই এই অশান্তির আসল স্রষ্টা বা পারস্পরিক নিশ্চিত বৈপরীত্য এর এক উদ্ভাবক। অথবা অর্থনৈতিক চাপ ও নির্যাতন মানুষকে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। …..এইভাবে অনেক জিনিসেরই উল্ল্রেখ করবে; কিন্তু কস্মিনকালেও এবং একারের তরেও বলবে না যে, মানব জীবনের বাস্তবতার সাথে আল্লাহর –আল্লাহর শাশ্বত নিয়মের –এই দুনিয়ায় আল্লাহর প্রবর্তিত নিয়মের গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং সম্পর্কে ব্যত্যয় ঘটেছে বলেই আজকের বিশ্বব্যাপী এই অশান্তি।
আধুনিক জাহিলিয়াত যতই পরিহাস করুন, জীবনের উত্থান ও পতন এবং সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের যে ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক, তার প্রকৃত ও নির্ভুল ব্যাখ্যা তো সম্ভব আল্লাহর সুন্নাত অনুযায়ী, আল্লাহর দেখানো পন্থা ও পন্ধতিতেই মানুষের মন ও মগজ থেকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কশীল সব কিছুকে উৎখাত করতে তা যতই চেষ্টা করুক, তারা তো সমগ্র জীবনের বাস্তবতাকেই শামিল করবে –তা মতাদর্শের ক্ষেত্রেই হোক, কি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে।
সর্বোপরি আল্লাহ ও তাঁর পদ্ধতি এবং মধ্যযুগ অন্ধকার যুগের মধ্যে একটা সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তা নিঃসসেন্দহে বলা যায়। যেমন তা সংযোগ স্থাপক করেছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তার পদ্ধতির মধ্যে, আল্লাহর পদ্ধতি থেকে দূরত্ব সৃষ্টির মধ্যে।
এই কারণে আধুনিক মন-মানসিকতার লোকেরা খুব সহজেই যে আমাদের এই আলোচনার যথার্থতা স্বীকার করবে না তা আগেভাগেই বলে রাখছি।
০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০
বক্ষ্যমান আলোচনায় আমরা যে পদ্ধতি অবলম্বন করছি তা হচ্ছে প্রথমে আমরা দেখাব, আধুনিক জাহিলিয়াতের উৎপত্তি কি করে হলো। তা ইতিহাসেরই একটি পাতা। দ্বিতীয়ত, আমরা বলব জাহিলিয়াতের যে সব মন-ভোলানো চাকচিক্যের কথা যার মধ্যে এখনকার লোকেরা জীবন অতিবাহিত করছে।…
তা একালের ইতিহাস।
অতঃপর আমরা সন্ধান করব, একালে সমস্ত মানুষের জীবনে সে চাকচিক্য কি করে অনুপ্রবেশ লাভ করেছে। অনুপ্রবেশ লাভ করেছে তাদের ধারণায়, তাদের আচার-আচরণে, রাজনীতিতে, অর্থনীতির ক্ষেত্রে, সমাজ সমষ্টিতে, মনোবিদ্যায়, চরিত্রে, শিল্পে, কলায়, জীবনের সকল র্পায়ের তৎপরতায়। …..তা-ও বাস্তব ঘটনা সমন্বিত।
সর্বশেষে আমরা বলব, এই সবকিছু কিভাবে সংঘটিত হলো ….হতে পারত না যদি তারা সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর প্রদর্শিত পন্থা ও পদ্ধতি অনুসরণ করত। …আর এক্ষণে তারা যদি নিজেদের জীবন থেকে এই সব কলংক-কালিমা মুছে ফেলে পবিত্র-পরিচ্ছন্ন পথ ও পন্থা অনুসরণ করতে ইচ্ছুক হয় যদি বলতে প্রস্তুত হয় আল্লাহ প্রদর্শিত উচ্চ-উন্নত পথে তাহলে তাদের জন্যে করণীয় কি আছে? এটা উন্নত ভবিষ্যতের আশা-ভরসায় ভরা পৃষ্ঠা। অতঃপর পর্যায়ক্রমিক এই আলোচনাই শুরু করা হয়েছে……।