শিল্পকলায় বিপর্যয়
শিল্পকলা জীবনেরই একটি রূপ। তার অধিক কিছুই নয় তা।
বাস্তববাদী চিন্তাবিদগণ মনে করে, জীবনের জন্যে শিল্প। শিল্পের জন্যে শিল্প –এর কোনো অর্থ নেই।
তাদের অবশ্যই চিন্তা করতে হবে, ইতিহাসের যে অধ্যায়েই শিল্প অস্তিত্ব লাভ করে এবং যখন ধারণা জন্মে যে, শিল্পের জন্যেই শিল্প অস্তিত্ব লাভ করে থাকবে, ঠিক তখনই শিল্পে জনগণের জীবনই প্রতিবিম্বিত হয়েছে। কেননা লোকেরাই যদি সে শিল্পের প্রতি কোনো কারণে আগ্রহী না হতো, তাহলে তা অস্তিত্বই লাভ করতে পারত না। লোকদের মধ্যে তা পরিব্যাপ্তও হয়ে পড়ত না। কাজেই ‘শিল্পের জন্যে শিল্প’। দৃষ্টান্তস্বরূপ রোমান্টিসিজম-এর উল্লেখ করা যেতে পারে। তাতে রয়েছে জীবনের কঠোর কঠিন বাস্তবতা থেকে পলায়নি ভাবধারা ও কল্পনা বিলাস। আর তা এজন্যে যে, ‘তা শিল্পের জন্যে শিল্প’ ধারণা বা মতের ফলশ্রুতি। তার আর একটি কারণ হচ্ছে, তখন জনগণ বাস্তবিকই জীবনের রূঢ় বাস্তবতা থেকে পলায়োনি মনোভাবসম্পন্ন ও কল্পনাবিলাসীই ছিল।
এই কারণেই আমরা মনে করি, শিল্প, সাহিত্য ও কলা জীবনেরই একটা রূপ। তাতে জীবন থেকে পলায়োনি ভাবধারারই প্রতিফলন ঘটুক না কেন।
এই প্রাথমিক কথাগুলো বক্ষমাণ আলোচনায় খুব সামান্যই কাজে আসবে। তার উপযুক্ত ক্ষেত্র হচ্ছে শিল্প সমালোচনার ক্ষেত্র।–[আমার লিখিত ‘ইসলামী শিল্প পদ্ধতি’ নামের গ্রন্থে শিল্পকে দৃঢ় ও বিপথগামী –এই ভাবে ভাগ করে তার তাৎপর্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে মাত্র কয়েকটি মৌল নীতির উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হচ্ছি।] কিন্তু এখানে এ বিষয়ের আলোচনার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, একটি জাহিলিয়াতের সমাজে লালিত-পালিত ও ক্রমবর্ধিত জাহিলী শিল্প যে কুসংস্কার ও কিংবদন্তীর সৃষ্টি করেছে, তা জানতে পারা।
কেননা শিল্প মূলত জীবনেরই দর্পণ …প্রতিবিম্ব। এই কারণে জীবন যতটা বিপর্যয়ের শিকার হবে, শিল্প সাহিত্যেও ঠিক ততটাই বিকৃতি ও বিপর্যয় সংঘটিত ও রূপায়িত হয়ে উঠবে। এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার।
পাশ্চাত্য শিল্পকলার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে প্রথমেই লক্ষ্য করা যায়, তা হচ্ছে পৌত্তলিক ভাবধারা সম্পন্ন শিল্প। এই ধরনের শিল্প কেবলমাত্র পৌত্তলিক পরিবেশের মধ্যেই লালিত-পালিত ও বিকশিত হতে পারে। আর এই শিল্ডেপর সাহায্যে যে মানুষ গড়ে উঠবে তা অবশ্যই পৌত্তলিক হবে। বরং পৌত্তলিক হওয়াই তার বিকাশের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
সন্দেহ নেই, এসব শিল্পে মানবীয় ভাবধারায়ও প্রকট ও উদ্ভাসিত থাকবে, সে ভাবধারা যেমন গভীর সূক্ষ্ম হবে, তেমনি হবে উচ্চতর মানসম্পন্ন। তাতে মানব মনের গভীর সূক্ষ্ম তত্ত্বসমূহ প্রতিফলিত হবে, তার মনের দরদ, ভালোবাসা, সংবেদনশীলতা, আশা ও আকাঙ্ক্ষা এবং তার আনন্দ ও দুঃখ এসবের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটবে। মানবীয় চেতনা ও বিশেষত্বকে উচ্চতর জগতে উন্নীত করে দেবে।
এসব উচ্চতর মহিমামণ্ডিত শৈল্পিক নিদর্শনসমূহ দেখে লোকেরা মনে করে, শিল্পকে অবশ্যই পৌত্তলিক ভাবধারা সম্পনন্ হতে হবে। কেননা পৌত্তলিকতাই কোনো শিল্পকে সুন্দরতর ও মহিমামণ্ডিত করে তুলতে পারে। কিন্তু এই শিল্পরীতি যে বিপর্যস্ত, সেদিকে খুব কম সংখ্যক লোকেরই দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়।
এসব শিল্পের বিপর্যস্ত হওয়ার সাথে সাথে তার উচ্চতর মানের নিদর্শন হওয়ার ব্যাপারটি ঠিক জাহিলিয়াতের মতোই। কেননা জাহিলিয়াত পুরোপুরি ভাবে ‘মন্দ’ হবে, তাতে একবিন্দু ‘ভালো’র অস্তিত্বও থাকবে না। তা কখনোই হতে পারে না। আসলে মানব মন সম্পূর্ণরূপে ‘খারাপ’ হতেই পারে না। তার অস্তিত্বের কোনো-না-কোনো কোণে কোনো-না-কোনো সত্য ও ভালো অবশ্যই লুকিয়ে থাকবে। অবশ্য এটা ঠিক যে, তা থাকে অসংবদ্ধ ও ক্ষীণ-দুর্বল। তা না থাকার মতোই। আর তা কোনোরূপ শক্তিসম্পন্ন নয় বলেই তা থেকেও মানুষকে জাহিলিয়াতের ধ্বংসকারিতা থেকে রক্ষা করতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, এই ‘ভালো’ বা সত্যটুকুও জাহিলিয়াতের ধ্বংসকারিতার প্রতিবন্ধক না হয়ে বরং সহায়তাকারীই হয়ে দাঁড়ায় এবং মানুষকে ক্রমাগতভাবে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
ইতিহাসের সকল অধ্যায়েই পাশ্চাত্য শিল্পের একটি বিশেষত্ব প্রকট হয়ে থাকতে দেখা গেছে। হয় তা বহু সংখ্যক খোদায় বিশ্বাসী হবে, না হয় মানুষ ও খোদাগণের মধ্যকার কঠিন দ্বন্দ্বের প্রকাশ ক্ষেত্র হবে। …এই বিষয়ে আমি এখনও ব্যাপক অধ্যয়ন ও গবেষণা করিনি বলে এখনই এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না। আমি চাই, অন্য কেউ এ বিষয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন ও চিন্তা-গবেষণা করুক। এই পৌত্তলিকতাবাদী শিল্পালয়ে পাশ্চাত্যের শিল্পীগণ যতটা শ্রম ও সাধনা করেছে, তারা যদি আল্লাহ ও মানুষের মধ্যকার যথার্থ সম্পর্কের প্রকাশ মাধ্যম বানাবার জন্যে তার শতাংশর একাংশেও করে, তাহলে শিল্প তখন কি রূপ পরিগ্রহ করবে, তা উক্ত কারণে এখনই বলা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।–[ভারতীয় শিল্প মানুষের লীন হওয়ার ভাবধারা পূর্ণ। অথবা পরমাত্মায় লীন হওয়ার ভাবধারা। পরমাত্মা বলতে তারা আল্লাহকে বুঝিয়েছেন। অন্য কোনো শিল্পে আমি এই ভাবধারা দেখিনি। এ বিসয়ে কারুর গভীর সূক্ষ্ম অধ্যয়ন ও গবেষণা করা উচিত।]
আর বিশেষভাবে এই বিশেষত্বের কারণেই পাশ্চাত্য শিল্প বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কেননা তাতে দেবতাদের ও মানুষের দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটেছে। আর শিল্পও যে আকীদা বিশ্বাসে ধীরে ধীরে ও স্তরে স্তরে সংঘটিত বিপর্যয়সমূহ দ্বারা প্রভাবিত হয়, তা তো অনস্বীকার্য।
ইউরোপীয় ইতিহাসে গ্রীক শিল্প-সাহিত্যে দেবতা ও মানুষের পারস্পরিক কঠিন দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটেছিল। সমস্ত প্রখ্যাত গ্রীক নাটকেও এই বিশ্বাসের ছাপ লক্ষ্য করা যায়।
মানুষ নিজেকে প্রকাশ করতে চায়, করতে চায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত। ফলে সে ভাগ্য ও দেবতাদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়। এসব যুদ্ধে মানুষ সব সময়ই সত্যপন্থী ও দেবতারা বাতিল পন্থী প্রমাণিত হয়। এই দেবতারা অবৈধ উপায়ে মানুষের শাসক হয়ে বসতে সচেষ্ট থাকে। শাসক হওয়ার এই লালসার পেছনে কোনো যুক্তি নেই, নেই বোধগম্য কোনো কারণ। এই ট্রাজেডি, পরিণতি হয় তখন –যখন সত্যপন্থী বীর –মানুষ, ভাগ্য ও দেবতাদের কাছে পরাজিত হয়। আর অত্যাচারী দেবতা তার প্রতি একবিন্দু দয়াও প্রদর্শন করে না; বরং সে যে দেবতাদের বিরুদ্ধে নিজের সত্তাকে –নিজের ব্যক্তিত্বকে নিজেরই দেবতা নিজ সত্তা ও ইতিহাসের স্রষ্টা বানাতে চায়, এই পাপের জন্যে তাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করে।
এই ট্রাজেডির শেষে মনে হয়, মানুষ সৎপন্থী মজলুম। আর দেবতারা সব অন্যায়কারী, পাপিষ্ঠ, অত্যাচারী। একদিকে এই প্রবল জালিম ও অপর দিকে মজলুম সত্যপন্থীর মধ্যে সন্ধি সমঝোতার কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যায় না।
এই জাহিলী ধারণার ছত্রছায়ায় শিল্পগত অনন্যতা ও চাকচিক্য উদ্ভুত হয়েছে, যা মানব মনের গভীরতম কন্দরে পৌঁছে যায়। আবার কখনও কখনও মানুষকে দিকচক্রাবালের উচ্চতায় নিয়ে যায়। কিন্তু দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধজনিত বিষাক্ত পরিবেশ এই শিল্পগত সৌন্দর্যকে ম্লান ও মূল্যহীন বানিয়ে দেয়।
মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হিসেবে তার কারণ দর্শানো যায় এভাবে যে, এই বিপর্যয় মূলত মানুষের শৈশবকালীন বিপর্যয়। গ্রীক যুগে তারই প্রতিকৃতি গোচরীভূত হয়।
বালক তার ওপর আরোপিত ভেঙ্গে স্বীয় সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কেননা সে মনে করে, এই নিয়ন্ত্রণ তাকে অষহায় করে রেখেছে। তখন সে নিজেকে বড় প্রমাণ করার জন্যে নিজের বয়সের যারা বড় তাদের অমান্যতা ও তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে উদ্ধুদ্ধ হয়। এই বিকৃতি যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন বালক মনে করে যে, বড়রা তার ব্যক্তিত্বকে চূর্ণ করতে সচেষ্ট। সে যতই বিদ্রোহ করতে পদ্ধপরিকর হয়, বড়রা তার নিয়ন্ত্রণ ও দেখাশুনা ততবেশি করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তার মনে বড়দের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও প্রতিহিংসা জেগে ওঠে এবং বড়দের ওপর দিয়ে সে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে সংকল্পবদ্ধ হয়।
এ এক কঠিন বিপজ্জনক বিপর্যয়। বিশ্লেষণমুখী মনস্তত্ত্ব এই বিষয়ে দৃঢ় জ্ঞান পেয়েছে।
ঠিক এই বিপর্যয়ই সংঘটিত হয়ছিল গ্রীক জাহিলিয়াতে। যদিও সে জাহিলিয়াত রূপায়িত হওয়া শিল্পে কিছু কিছু অতীব উত্তম নিদর্শনও ছিল। কিন্তু তাও বিপর্যয়ের প্রচ্ছায়া থেকে কিচু মাত্র মুক্ত ছিল না। কেবলমাত্র প্রোমিথিউস-এর কাহিনীতেই এই দ্বন্দ্বের প্রতিফলন নেই। তা ছাড়া গ্রীক নাকটসমূহে যত কাহিনীই রয়েছে, তার সবই এই ধরনের।
সে যাই হোক, মানবতার বাল্যকালে সংঘটিত হওয়া সত্ত্বেও তা বিপর্যয় ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা একে তো সব বালকের মধ্যেই এরূপ অনুভূতি থাকেনা। বরং বাচ্চারাও বড়দের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা-ভালোবাসার আচরণই করে থাকে। তাছাড়া বাচ্চারা যদি কখনও বড়দের দেওয়া বাধা ও মন্দ চলাকে খারাপ মনে করেও, তবু ঘৃণা ও প্রতিহিংসা জাগিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা হয় তখন, যখন বিপর্যয় ও বিপথগামিতা প্রকট হয়ে উঠে। বড়দের শাসনকে খারাপ লাগার কারণ হচ্ছে মানব মন সমালোচনাকে সব সময় অপছন্দ করেই এবং প্রশংসা শুনলে স্বাভাবিকবাবেই খুশী হয়ে ওঠে। এটা বালক বয়সের প্রকৃতি। অবশ্য সেই সাথে বালকরা এ-ও চায় যে, আত্মবিশ্বাসের বলেও বড়দের সাহায্যের মুখাপেক্ষিতা ছাড়াই সে বড় হয়ে উঠুক। এটাও প্রকৃতিগত ভাবধারা বটে।
গ্রীক জাহিলিয়াতের এটাই ছিল বিপর্যয় ও বিকৃতি। আর তা গ্রীকদের শিল্পে পূর্ণ মাত্রায় প্রতিফলিত। কেননা শিল্প তো মনের প্রকৃতি যেমন, তেমনি তা জীবনেরও প্রতিচ্ছবি।
জীবন ও শিল্পে গ্রীক জাহিলিয়াতের এটি হচ্ছে প্রথম নিদর্শন। আর দ্বিতীয় নিদর্শন হচ্ছে দেহপূজা। সুন্দর দেহকে উপাস্য বানিয়ে তার বন্দেগী করা। লোকেরা মনে করে, এটাও একটা শিল্প। এর আকর্ষণে মানুষ সে দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। লোকেরা মনে করে, ওটা কোনো যৌন লালসা নয়। তা এমন একটা শিল্প যা কোনো মানুষের দেহে প্রতীকী হয়ে উঠলেও নিছক সৌন্দর্যের কারণেই তা শিল্প হিসেবে গণ্য।
জাহিলিয়াতসমূহে এই ধরনের এমন এমন ধারণা রয়েছে, যা সমালোচনার কষ্টিপাথরে যাঁচাই করলে টিকতে পারে না।
গ্রীক জীবনের বাস্তবতা হচ্ছে সৌন্দর্যকে নিছক সৌন্দর্য হিসেবে পূজা করা হলেও তা-ই দেহের যৌন লালসা মাত্র। আর এই সৌন্দর্য পূজার ফলশ্রুতি গোটা সমাজ চরিত্রহীনতার শিকার হয়ে পড়েছিল। আর সমগ্র গ্রীক সভ্যতা ধ্বংসের মুখে এসে গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত। গ্রীকদের প্রেম-ভালোবাসা ও রূপ যৌন সংক্রান্ত কিংবদন্তীসমূহে এই ধরনের চরিত্রহীনতা ভরপুর হয়ে রয়েছে, যাতে মানুষ ও দেবতা সকলেই আপাদমস্তক নিমজ্জিত হয়ে আছে।
আসলে সৌন্দর্য পূজার আড়ালে দৈহিক ও যৌন লালসাই প্রবল হয়ে উঠেছিল। প্রাচীন গ্রীক জাহিলিয়াতের এই দুটি জাহিলী বিপর্যয় দীর্ঘ হতেও দীর্ঘ ছায়া বিস্তার করেছে চতুর্দিকে। পাশ্চাত্য শিল্প পূনর্জাগরণের সময় থেকে বর্তমানে যুগ পর্যন্ত সেই ছায়াতেই আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
হযরত ঈসা (আ)-এর পর কিছুকালের জন্যে শিল্পে আল্লাহ মুখী হয়েছিল বলে মনে হয়। তবে পশ্চিমা গীর্জা আল্লাহর যে আকৃতি বানিয়েছিল সে-ই আল্লামুখী হয়েছিল। আর তাতেই গ্রীক ও রোমান জাহিলিয়াতদ্বয় দেবতার দেহ নির্মাণ এবং অনুভব ও স্পর্শযোগ্য প্রতিমূর্তিরূপে তার পূজার ছায়া বিস্তার করে দিয়েছিল। বহু কতগুলো প্রতিকৃতিতে এই পূজার রূপ প্রতিফলিত হয়েছে।–[উল্লেখ্য এই যে, মধ্যযুগে মুসলমানদের সাথে খ্রীষ্টানদের যোগাযোগ হওয়ার পর ইউরোপের মূর্তি ধ্বংসের আন্দোলন শুরু হয়, যা ইতিহাস খ্যাত ব্যাপার। লিউ তৃতীয় The Iconielast ছিল তার নেতা অষ্টম শতাব্দীতে। ১২০ বছর পর্যন্ত তা আল্লাহর মূর্তি নির্মাণের স্পৃহা খতম করতে পারেনি।]
পরে এই যুগের অবসানে হেলেনীয় সভ্যতা নতুন করে চিন্তা ও শিল্পগত ঝোঁক প্রবণতার বিজয়ী হয়ে পড়ে। লোকেরা আবার সেই গ্রীক মূর্তি পূজার দিকে দ্রুতবেগে এগিয়ে গেল। খ্রিষ্টান মানুষেরা আবার রীতিমত মূর্তিপূজা করতে শুরু করে দিল, তারা হয়ে গেল পূর্ণ মাত্রায় মূর্তি পূজারী।
ইউরোপে এমন একটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, যখন প্রত্যেক ব্যক্তি খ্রিষ্টীয় ও হেলনীয় উভয় ভাবধারায় সমন্বিত ছিল একই সময়। আকীদার দিক দিয়ে ছিল খ্রিষ্টান আর চিন্তা ও শিল্পে ছিল হেলেনীয় উত্তরকালে ক্রমিক নিয়মে সর্বক্ষেত্রেই পুরামাত্রায়ই হয়ে গেছে।
এক সময় ইউরোপীয়রা প্রকৃতিরও পূজা করেছে। তখন তারা গির্জা ও তার ‘খোদা’ থেকে পালাচ্ছিল। কেননা এই গির্জা ও তার খোদা জনগণকে দাসানুদাস বানিয়ে রেখেছিল।
এই সময়টা ইউরোপীয় ইতিহাসে রোমান্টিকতার আন্দোলনের যুগ ছিল। তাতেও দেবতা স্বীকৃত ছিল শিল্পক্ষেত্রে। যদিও তা ‘খোদা’ সম্পর্কিত বিকৃত ধারণার ভিত্তিতে। কেননা রোমান্টিকতায় প্রকৃতির প্রতি শুধু আকর্ষণ ছিল না, তার পূজাও করা হতো, আর তার থেকৈই বিপথগামিতা সূচিত হয়েছিল।
প্রকৃতির আহবানে সাড়া দেওয়া মানুষের মৌল চেতনা। তা স্বভাবের গভীরে প্রোথিত। মানুষ এমন স্বভাবে সৃষ্ট যে, তারা স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃতি ও গোটা সৃষ্টিলোকের আহবানে সাড়া না দিয়ে পারে না। সৌন্দর্যে প্রচ্ছন্ন আনন্দ ও সুখ মানুষের প্রকৃতি নিহিত। সে সৌন্দর্যের যত দিক ও তার প্রকারই থাক-না-কেন।
কাজেই সৌন্দর্য অবিভূত হওয়াটা বিপর্যয় নয়। সৌন্দর্যপ্রিয়তা তো মানব প্রকৃতি নিহিত ব্যাপার। তা না থাকলে মানবীয় সত্তায়ই ত্রুটি রয়েছে মনে করতে হয়। সুস্থ প্রকৃতি থেকেও তা একটি বিকৃতি।
কিন্তু সৌন্দর্য পূজা –তা যে রূপে ও যে ধরনেরই হোক –একটি পৌত্তলিক বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। সুস্থ মানব প্রকৃতি তা কখনোই মেনে নিতে পারে না। কেননা তাতে সৌন্দর্যের আকৃষ্ট হয়ে তার পূজা করা ও সৌন্দর্যকে প্রতিকৃতিতে রূপায়িত করে তার দাসত্ব করা –এই দুটির মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।
এই পৌত্তলিকতাকে যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ করার জন্যে যে সুন্দরতম বাক্য আবৃত্তি করা হয় তা হচ্ছে, ‘সৌন্দর্য আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা’ (Channel) সৌন্দর্য আল্লাহর প্রতিকৃতি, আমরা তো আল্লাহর পূজা করি তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ইত্যাদি…. এই সব বাক্য নিশ্চয়ই রোমান্টিকতায় ভরপুর। কিন্তু এসব বাক্য পৌত্তলিকতায় নিমজ্জিত ভাবধারাকে গোপন করতে পারে না। এই ভাবধারার ধারক তো প্রকৃত মূর্তিপূজার প্রবর্তক। কেননা তা রূহ-এর সাহায্যে আল্লাহকে পেতে পারে না। ‘রূহ’ তো ইন্দ্রিয়গাহ্য বস্তুর মুখাপেক্ষী নয়।
উক্ত তাৎপর্যের দিক দিয়ে রোমান্টিকতা একটি বিকৃত বিপর্যস্ত পৌত্তলিক আন্দোলন। অবশ্য বাস্তববাদীদের দৃষ্টি ভিন্নতর। তা জীবনের বাস্তবতার সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে চলেনি। তা ছিল জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানোর আন্দোলনের প্রতীক।–[পূর্বেই বলে এসেছি, রোমান্টিকতার আন্দোলনে জীবন থেকে বিকৃতি ছিল না। বরং সেই সময়ের লোকেরাই ছিল পলায়নী মনোবৃত্তিসম্পন্ন। তখন লোকেরা সামন্তবাদ ও গির্জার অত্যাচার থেকে বাঁচার পথ খুঁজছিল। তখন পাশ্চাত্যের যে অবস্থাই ছিল, তা ছিল অপরিবর্তনীয়। লোকেরা তাই গির্জার খোদা ত্যাগ করে প্রকৃতিপূজায় বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আসলে তা ছিল পৌত্তলিকতা, যার দরুন লোকেরা আল্লাহর ইবাদত ত্যাগ করে একটা ইন্দ্রিয়গাহ্য জিনিসের ইবাদত বা পূজা করতে শুরু করে দিয়েছিলেন।]
ইউরোপ বিকৃত বিপর্যস্ত রোমান্টিকতা থেকে এক নতুন শিল্পগত জাহিলিয়াতের দিকে চলে গেল।–[মানদণ্ড সংক্রান্ত বিভ্রান্তি। চলতি অধ্যায়ে সেই বিষয়টি আলোচিত হয়। ইউরোপীয় শিল্পগত মানদণ্ড নয়। কেননা তার প্রকৃতিতে কি বিভ্রান্তি আছে তা অনুভব নয়।] আর তাই হচ্ছে জীবনের বাস্তবতার বিকৃতি। এখানে ‘খোদা’ পরিবর্তিত হয়ে গেল। পরিবর্তিত হলো তার পূজা উপাসনা।
এ পর্যায়ে প্রকৃতি পূজা প্রত্যাহৃত হলো। কেননা ততক্ষণে তাতে নিহিত সমস্ত রহস্য যথারীতি উদঘাটিত হয়ে গেছে। ইউরোপ যেমন ধারণা করে মানবীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান তার ওপর কর্তৃত্বশালী হয়ে বসেছিল, তখন তার সমস্ত উষ্ণতাই ঠাণ্ডা ও শীতল হয়ে গিয়েছিল। তখন মানুষ শিল্প বিপ্লবের ছত্রছায়ায় এক নতুন পূজার দিকে চলে গেল। তাতে বৈজ্ঞানিক উন্নতি উৎকর্ষ এবং মানবীয় শক্তির ছত্রছায়ায় এক ‘নতুন খোদা’ বানিয়ে নেওয়া হলো। সে নতুন খোদা হলো স্বয়ং মানুষ।
এক্ষণে সেই সময় উপস্থিত হলো যখন মানুষ নিজেদের গলদেশ থেকে আল্লাহর ইবাদতের রজ্জু খুলে ফেলল। যা তারা জাহিলিয়াতের অক্ষমতা ও মুর্খতার যুগে নিজের গলায় পরে নিয়েছিল। এখন তো মানুষ নিজেই নিজের খোদা হয়ে বসল।
এরপর পাশ্চাত্য শিল্প নতুন এক খোদার সন্ধান আবার শুরু করে দিল। তখন সে প্রকৃতিগত পরিবর্তে মানুষের দিকেই আকৃষ্ট হয়ে গেল। আমরা আবারও বলব, মানুষের নিজের প্রতি গুরুত্বারোপ স্বতঃই কোনো বিকৃতি বা বিপর্যয় নয়। না শিল্পে, না জীবনের বাস্তবতায়। মানুষ নিজের প্রতি গুরুত্বারোপ করবে, এটা তো প্রকৃতিগত স্বতঃস্ফূর্ত ব্যাপার। মানুষ নিজ জীবনের ছবি ও ভাবধারায় প্রভাবিত হবে, তার সমস্যাবলী, দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ, তার চেষ্টা-সাধনা, কষ্ট স্বীকার ও পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার জন্যে তার সংগ্রাম –এই সবকিছুই তার কাছে গুরুত্ব পাবে, এটা তো কোনো জাহিলিয়াত নয়।
আসলে জাহিলিয়াত হলো মানুষের দাসত্ব করা, মানুষের নিজের পূজা নিজে করা। এই কালেই পাশ্চাত্য শিল্পে মানুষের প্রতি গুরুত্বারোপ ‘দেবতা’র জন্যে একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
তাই শুধু শিল্পক্ষেত্র থেকেই আল্লাহকে বিতাড়িত করা হয়নি, ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-আচরণ ও সুদৃঢ় চিন্তাকে শিল্পক্ষেত্রে নিষিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি। বরং তার প্রতি চরম ঠাট্টা ও বিদ্রূপকে উদ্দেশ্যমূলক ও সচেতনভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর প্রতি লক্ষ্য দান ও ঠাট্টার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
বিকৃত ধর্মীয় ব্যক্তিদের প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রূপ করার উদ্দেশ্য শুধু এতটুকুই ছিল না যে, তারা ধর্মীয় আদর্শ থেকে বিভ্রান্ত হয়ে গেছে বলেই তা করা হচ্ছে এবং শিল্পী সেই ব্যক্তির প্রতি ঠাট্টা ও বিদ্রূপ করে তাকে প্রকৃত ধর্মের দিকে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে, তাকে তার পরিচ্ছন্ন ও অনাবিল ভাবধারায় সুদৃঢ় করে জনগণের হৃদয়ে ও অনুভূতিতে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়াও তার লক্ষ্য ছিল না। ধর্মীয় ব্যক্তিদের ঠাট্টা বিদ্রূপ করে তাদেরকে প্রকৃত সহীহ ধর্মের দিকে তার গুরুত্ব, পরিচ্ছন্নতা-নির্মলতা ও পবিত্রতার দিকে ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে প্রকৃতপক্ষে ধর্মের মৌল ও সহীহ ধারণাকে বিদ্রূপ করা ও আল্লাহর প্রতি ঈমান গ্রহণের সরলতাকে হাসি ঠাট্টা করে মূল্যহীন বানিয়ে দেওয়াই ছিল তাদের শিল্পের আসল উদ্দেশ্য।
অতঃপর সারা দুনিয়ায় নাস্তিকতাবাদী সাহিত্য ছড়িয়ে পড়ে। সে সাহিথ্য ছিল আল্লাহর প্রতি নির্লজ্জ গালাগালে সমৃদ্ধ। আল্লাহর ইবাদতে কঠিন বিদ্রূপ বাণে জর্জরিত করা হয়েছে তাতে। আর তাকেই তারা নাম দিয়েছিল ‘স্বাধীন বিমুক্ত চিন্তা’ বা ‘মুক্ত বুদ্ধি’। অন্য কিছু নয়। ঠিক সেই সময়ই অপর দুটি জাহিলী ভাবধারা ও প্রবাহ শিল্পকে বিকৃত করে দিচ্ছিল, তা ছিল বিপর্যয়ের পথে রুঢ় বাস্তববাদী।
তাতে মানুষকে নিতান্ত পশু প্রমাণ করতে চাওয়া হয়েছে। আর আচার-আচরণে মানুষকে বানানো হয়েছে যৌনতাবাদী।
মানুষকে পশু সাব্যস্ত করার ব্যাখ্যায় এক ধরনের বাস্তববাদী শিল্প গড়ে তোলা হয়েছে। এই শিল্পের কর্তারা তার নামকরণ করেছে ‘প্রাকৃতিক’ বা ‘প্রকৃতিবাদী’। তাতে মানুষকে নিতান্তই নিম্ন শ্রেণীর হীন ভাবধারার সমষ্টি করে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কোনো সীমাকেও রক্ষা করা হয়নি। সে অনুযায়ী মানুষ স্বভাবতই নিম্ন শ্রেণীর, হীন নীচ চরিত্রের, দ্বিমুখী, প্রতারক, সুবিধাবাদী, সুযোগ-সন্ধানী -তার কোনো নীতি বা আদর্শ নেই, নেই কোনো চরিত্র। মানুষ নিজেকে চরিত্রবান প্রকাশ করতেই অভ্যস্ত। তার নীতি হচ্ছে মুনাফিকী, তাও আবার সমাজ সমষ্টির জন্যে, (অবশ্য ওদের সকলে মধ্য থেকে এমন কেউউ বের হয়ে আসেনি একথা বলার জন্যে যে, সমাজবদ্ধ মানুষ কেন বাহ্যত নৈতিক চরিত্রবান ও নীতিবাদী হওয়ার কথা প্রকাশ করতে সচেষ্ট হয়? তাকে সত্য ধরে নিলেও প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি মানব প্রকৃতিরই একটি বিশেষত্ব নয়?)
মানুষকে যৌনতার আবেগ সম্পন্ন প্রমাণ করার ব্যাখ্যায় এক স্বয়ংসম্পন্ন ও পূর্ণাঙ্গ শিল্প গড়ে তোলা হয়েছে। তা হচ্ছে উন্মুক্ত বা খোলা সাহিত্য। নগ্ন চিত্রসমূহ, উলঙ্গ দৃশ্যাবলীতে ভরা সিনেমা, নগ্ন যৌন কাহিনী, যৌন উত্তেজক গান –সঙ্গীত। মানবদেহের গোপন স্থানসমূহ ন্যাংটা করে দেখানো…. ইত্যাদি….।
এই শিল্পই প্রচলিত হয়ে পড়েছিল সর্বত্র। কিংবা এই শিল্পকে নানা কৌশলে প্রচলিত করা হয়েছিল। যেন ইতিহাসে এমন কথা আর কখনোই বলা হয়নি এমনভাবে, আর তার অন্তরালে বসে বিশ্ব ইহুদীবাদ ‘উম্মী’ লোকদের গোটা সত্তাটিকেই ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করে চলছিল।
কিন্তু এ সব বিপর্যয় কোনো সীমায় এসে থেকে যায়নি।
শিল্প অনিবার্যভাবেই ধারণা ও আচার-আচরণে সকল প্রকারের বিপর্যয়কে মেনে নেয় ও অনুসরণ করে। কেননা তার অবস্থা যা-ই হোক, তা-যে জীবনেরই প্রতিচ্ছবি, তাতে কোনো সংশয় নেই।
মানবীয় মনের জন্যে মানবীয় ধারণায় ‘আংশিকতা’ স্বভাবগত হয়ে পড়েছে। শিল্পের ওপরও তার ছায়া বিস্তার করেছে।
অবচেতন (unconscious) সম্পর্কে ফ্রয়েপের মতবাদ হচ্ছে, তা আয়ত্তকারী বিবেক মানুষের প্রকৃতি পরিচিতি নয়। সাহিত্য ও শিল্পে তা বিমূর্ততাকে সঞ্চারিত করেছে, গড়ে উঠেছে বিমূর্ত শিল্প। সেই আধুনিক শিল্পে অন্যান্য নতুন ধারাও আত্মপ্রকাশ করেছে। এই সব কিছুরই ভিত্তি হচ্ছে এই ধারণা যে, সচেতন বিবেক মানব সত্তার একটা মিথ্যা অংশ মাত্র। তা মানুষের নিগূঢ় মৌল অন্তর্নিহিত মহাসত্যের প্রতিনিধিত্বকারী নয়। তা শুধু সেই প্রচ্ছন্ন বিবেকেরই প্রকাশ মাত্র। তা ঘোলানো, অসংবদ্ধ, অবিন্যস্ত, যা মানুষের গভীরতায় সংগৃহীত।
আর এটাই হচ্ছে সেই বিপর্যয়, যার বাতিল হওয়া অনস্বীকার্য, সুস্পষ্ট। তাহলে বিবেকের প্রচ্ছন্ন ও সচেতন উভয়েরই সমন্বয়ে মানব সত্তা গড়ে ওঠার পথে মানুষের কোন যুক্তিটা বাঁধ সাধতে পারে?
মানুষ প্রথম যেদিন নিজেকে চিনতে চেষ্টা করেছে, সেই দিনই এই প্রাথমিক ও সহজ সরল মহা সত্যকে চিনতে পেরেছে। ফ্রয়েডের দর্শনের কোনো নাম চিহ্নও তখন ছিল না। ফ্রয়েডের এ দর্শন একটা বিস্ময় নিয়ে এসেছে। অথচ মানুষ জানে, তার কিছু কিছু চিন্তা সুসংবদ্ধ, সুবিন্যস্ত। সেই সাথে রয়েছে কতগুলো যুক্তিহীন ভাবধারা, চিন্তা-ভাবনা, যা মনের যুক্তিবাদের ভিত্তিতে সুবিন্যস্ত নয়। আর এ দুটি নিয়েই মানুষের সত্তা সমন্বিত।
বিকৃত ব্যক্তিবাদ এমন শিল্প রচনা করেছে, যা সমাজবদ্ধতাকে ভেঙ্গে ফেলতে ও পরাজিত করতে সচেষ্ট, তার সূচনাতে রয়েছে অস্তিত্ববাদ। তা ব্যক্তির পূজার প্রবর্তক। ব্যক্তি একাই হচ্ছে তার সম্মুখবর্তী সব ব্যাপারেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকারী, নির্দেশদাতা। সে ব্যক্তি সমাজের কেউ নয়। সমাজ তার ওপর কর্তৃত্বশালী হতে পারে না। তার চরিত্র, আদত অভ্যাস ও অন্যান্য কর্মতৎপরতায় সমাজ তাকে পথ-নির্দেশ করতে বা নিয়ন্ত্রিত করতে পারে না।
এই ব্যক্তিবাদী মতাদর্শ পোষণকারী নির্বোধরা এতটুকুও বুঝে না যে, সমাজই যদি ধ্বংস হয়ে গেল, তা হলে তখন ব্যক্তি তার যাবতীয় মাহাত্ম্য-মহানত্ব ও পবিত্রতা লয়ে কোথায় দাঁড়াবে? আর সেখানে শুধু ব্যক্তি থাকবে, প্রত্যেকেই নিজ ইচ্ছামত হুকুম চালাবে। থাকবে না কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা, কোনো রীতি-প্রচলন, সর্বজিনিসের জন্যে কোনো স্থায়ী মানদণ্ড –এটা কি সম্ভব? …এটা কি কোনো ক্রমেই বাঞ্ছনীয় হতে পারে?
ক্রমবিকাশবাদ একটা দিশেহারা মতবাদ। সে মতে বিশ্বলোক স্বতঃই অস্তিত্ব লাভ করেছে। তার পরিচালক স্রষ্টাও যেন নেই, তেমনি নেই জন্ম ও জীবনের কোনো লক্ষ্য। ব্যক্তিত্ববাদী মতাদর্শের একটি শাখা হিসেবেই তা গড়ে উঠেছে। তা আসলে ধ্বংসের প্রতিনিধি।
ইচ্ছা করলে প্রশ্ন করা যেতে পারে, ধ্বংসের মধ্যে অস্তিত্ব বা সত্তা কি করে প্রতিনিধত্ব করতে পারে?
প্রধান অস্তিত্ববাদী চিন্তাবিদ দার্শনিক ‘আলবীর কামু’কে জিজ্ঞেস করো। সে তো বিশ্বলোকের সম্মুখে মানুষের বিস্ময় ও হতবাদ হওয়ার কথা বলিষ্ঠভাবে প্রচার করে। এই মহাবিশ্বের বুকে মানুষ কিভাবে নিজেকে অত্যন্ত হীন ও নগণ্য করে এবং মানুষ কি সাংঘাতিক উৎকণ্ঠা ও মানসিক অস্থিরতার শিকারে পরিণত হয়েছে –সে অনুভভ করে যে, কোনো যৌক্তিকতা ও উচ্চতর পরিকল্পনা ব্যবস্থাপনার ফলে তার অস্তিত্ব হয়নি এই চিন্তায় মানুষ ধ্বংস ও গুমরাহীর শিকার হয়ে যায়। এই কথা তো সেই দার্শনিকই প্রচার করে বেড়াচ্ছে।
অতঃপর শিল্পক্ষেত্রে একটি মৌলিক বিপর্যয় সংঘটিত হয়েছে। তা হলে, অতঃপর মানুষ আর ‘উপাস্য’ বা ‘মা’বুদ’ থাকল না। সেখানে একজন নতুন উপাস্য প্রতিষ্ঠা লাভ করল।
মানুষের পূজা –উপাসহা বাতিল বা পরিত্যাক্ত হয়ে গেল। তার পরিবর্তে নতুন উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করা হলো নিশ্চিত অনিবার্যতাকে।
শিল্প বাহ্যিকভাবে খোদায়ী প্রতিকৃতির উপাসনায় মশগুল থাকলেও এই নিশ্চিত অনিবার্যতার পূজা-উপাসনায় আত্মনিবেদিত হলো এবং তারই মাধ্যমে মানুষের স্বরূপ ব্যাখ্যা করা হতে লাগল।
এক্ষণে মানুষ স্বতঃই শিল্পের কোনো বিষয়বস্তু থাকল না এই নতুন মত ও পথে। এগুলো নিজস্বভাবে নাম ধারণ করেছে সামষ্টিক মতাদর্শ কিংবা এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কোনো নাম।–[অপরিহার্য সাহিত্য আধুনিক জাহিলিয়াতের প্রচারিত বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে একটি বিশেষ মত। তা বাধ্যতামূলকভাবে মানবজীবনের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দেয় এবং তাকেই সামষ্টিক মূল্যমান সম্পর্কিত বাধ্যবাধকতা বলে নামকরণ করে।] তবে মানুষ এখানে ‘নতুন খোদার’ নিছক বেষ্টনীভুক্ত হয়েই থাকল। এরই মাধ্যমে সামষ্টিক নিশ্চিত অনিবার্যতা কিংবা অর্থনৈতিক নিশ্চিত অনিবার্যথা অথবা ঐতিহাসিক নিশ্চিত অনিবার্যতা অধ্যয়ন করা হয়।
এ শিল্পে মানুষের জীবন একটা গৌণ জিনিস, মুখ্য নয়। তবে প্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সামাজিক বা অর্থনৈতিক কিংবা ঐতিহাসিক বিবর্তন। তা-ই এই জীবনটাকে রূপায়িত করেছে। মানুষ নিষ্প্রাণ লাশ মাত্র। এইসব নিশ্চিত অনিবার্যতাই তাকে নাড়ায়-চাড়ায়। তার প্রতি জোর প্রয়োগ করা হচ্ছে যেন তা তার নিশ্চিত অনিবার্য স্থান থেকে রূপ ধারণ করে। তার কর্মতৎপরতায় তার নিজের কোনো ইচ্ছা প্রয়োগ তা স্বাধীনতার এখতিয়ার কিছুই নেই।
এসব নিশ্চিত অনিবার্যতাই নিয়তি বা নতুনতর মানদণ্ড। এরই ভিত্তিতে মানুষের জীবন চলবে ও যাঁচাই করা হবে। কিন্তু এবারে প্রাচীন গ্রীক মানদণ্ড গৃহীত হয়নি। কেননা তা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে। তা অনুভবের আওতার মধ্যেই নেই। কিন্তু এখনকার মানদণ্ড তো অনুভবযোগ্য, দৃষ্টিগোচর, প্রকার ও পরিমাণে তার পরিমাপ করা যায়। তার দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থও ধর্তব্য।
তা সত্ত্বেও মানুষ ও তার সত্তার মাঝখানে একটি দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ দাঁড়িয়ে যায়। যা মানুষ ও প্রাচীন মানদণ্ডের মাঝে দাঁড়িয়ে যেত। তবে দুটির মধ্যে পার্থক্য আছে। এখানে নিশ্চিত-অনিচার্য দেবতাগণ যা করে তা সবই ঠিক। সে বিভ্রান্ত হয় না, হয় না দিশাহারা। আরও একটি পার্থক্য আছে, যা এর চাইতেও খারাপ।
তা হচ্ছে, এখন মানুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে আর দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম করে না। সে নিজে তো বিলুপ্ত এই নিশ্চিত-অনিবার্যতার চাপে। এখানে মানব সত্তার কোনো স্থাননেই। নতুন সে দ্বন্দ্ব করে নিতান্তই ভুল বলে।
জাহিলিয়াতের এই ধারাবাহিক ও নিরবচ্ছিন্ন সূত্রের ছত্রছায়ায় ইউরোপীয় শিল্প গড়ে উঠেছে যোগ্য সৌন্দর্যমণ্ডিত মানবতাবাদ হিসেবে।
কিন্তু বিপর্যয়ের কারণে সে সৌন্দর্যসমূহ বিকৃত।
এখানে যা কিছু সৌন্দর্য তা শুধু টেকনিকে প্রকাশ-কৌশলে। মানব মনের বিভিন্ন দিকের প্রতিকৃতি নির্মাণের সৌন্দর্য।
মানুষ যেন জীবনের সূক্ষাতিসূক্ষ্মতা গ্রহণ করে, সেই জন্যে। তখন তার কামনা হয়, এসব জাহিলিয়াতের বিপর্যয়সমূহ থেকে যদি তা রক্ষা পেতে পারত। কেননা তা তো সব সৌন্দর্যকেই বিকৃত ও বিনষ্ট করে দেয়।
সন্দেহ নেই, তার খুব সামান্য অংশই বিপর্যয়ের অভিশাপ থেকে রক্ষা পেতে পেরেছে। পূর্বেই যেমন বারবার বলেছি –মানব মন কখনোই অন্যায়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয় না, নিরংকুশ ভালোর দিকের প্রবণতাও তার মধ্যে থাকে না, তাই তা-ও সম্ভব হয় না।
এই বিরল স্বল্প সংখ্যকই হচ্ছে সুপরিচ্ছন্ন প্রকৃত শিল্প। শিল্পগত মানবতার পর্যায়ে গণ্য হওয়ার উপযুক্ত সত্তা।
কিন্তু এদিক ও ওদিক থেকে আসা বিপর্যয় অধিকাংশ সৌন্দর্য চাকচিক্যকেই কলংকিত ও আবিলতাপূর্ণ করে দিয়েছে। ফলে তা এমন হয়ে গেল, যেন একখানি সুন্দর মুখাবয়ব, যাকে আগুনের দগ্ধের দাগ বীভৎস করে দিয়েছে। তুমি অনুভব করো সে সুন্দর ছিল। কিন্তু তুমি তার চেহারা কলংকের চিহ্নগুলোও দেখতে পাচ্ছ।
আর যা অসুন্দর, অ-চাকচিক্যময়, পরিমাণের দিক দিয়ে সমকালীন পাশ্চাত্য শিল্পের বিরাট অংশই হচ্ছে তা (সকল প্রকারের শিল্পের)। তাতে আসল মূলধন সৌন্দর্য নয়। আসলেই তা বিপর্যয়ের শিকার।
এই পর্যায়ে রয়েছে সমগ্র যৌন সাহিত্য। তাতে মানুষের গোটা জীবনকে চিত্রিত করা হয়েছে এভাবে, যেন তা জ্বলতে থাকা সীমালংঘনকারী যৌন মুহুর্ত। তা কোনো শিল্পও নয়, নয় কোনো সৌন্দর্য। তাতে কোনো সত্যতাও নিহিত নেই। তা সেই ক্ষুধার্ত কুকুরবৎ, যার জিহবা সব সময়ই বাইরে ঝুলতে ও মুখ থেকে লালা ঝরতে থাকে। তাতে মানবীয় নিগূঢ় সত্য কিছু নেই।
তা যৌন লালসাপূর্ণ সাহিত্য। তাতে অন্তর্নিহিত বিবেক শক্তির নির্বুদ্ধিতা ও আহাম্মকী চিত্রিত হয়েছে। বলা হয়েছে, তা-ই হচ্ছে আসল মানুষ, মানুষের মৌল সত্য। ….আসলে তা কোনো শিল্প নয়, নয় সৌন্দর্য বা সত্যতা। অতএব মানুষকে কোনো যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই নিতান্তই নির্বোধ প্রমাণ করায় মানুষের নিগূঢ় সত্য নিহিত নয়, তা স্বীকৃতব্যও নয়। কেননা তা যুক্তিহীন বকবকানী ছাড়া আর কিছুই নয়।
এই সব বিকৃতি ও বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে পাশ্চাত্য শিল্প একটি সর্বাত্মক ‘বুদ্ধিহীনতা’ বা ‘অযৌক্তিক’ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
আর আধুনিক ইউরোপের তা-ই হচ্ছে কৃতিত্বের চরম মাত্রার উন্নতি। আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত মানবতার সব অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা ধ্বংস নৈরাশ্য ও হতাশাই নিয়ে এসেছে।
আল্লাহর পথ অগ্রাহ্য করে বিশ্বমানবতার পথভ্রষ্ট হয়েছে সকল ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। সকল পথেই চলে দেখেছে, কিন্তু তার মারাত্মক পদস্খলন ঘটেছে। দুকদমও সঠিক পথে চলতে পারেনি।
মানুষ আল্লাহদ্রোহী বস্তুবাদের পরীক্ষা করেছে। অনুরূপভাবে পুঁজিবাদের পরীক্ষা করেও যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। হ্যাঁ, কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। সীমালংঘনকারী ব্যক্তিতন্ত্রের এবং সর্বগ্রাসী সামষ্টিকতাবাদের পরীক্ষাও হয়ে গেছে।
কিন্তু এই সব পরীক্ষা বিশ্বমানবতাকে নিশ্চিন্ততা, মানসিক স্বস্তি ও শান্তি এবং দৃঢ় প্রত্যয় যুগিয়ে দিয়ে ধন্য করতে পারেনি।
আর এই কারণেই এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে মানবীয় বুদ্ধি-বিবেক দ্বারা সম্পন্ন করেছে –শেষ পর্যন্ত তাকেই অস্বীকার করে বসেছে।
মানবীয় বিবেক-বুদ্ধিকে অস্বীকার করে শেষে তারা আশ্রয় নিয়েছে অ-বুদ্ধি-বিবেক বা বুদ্ধি-বিবেকহীনতা –অযৌক্তিকতার।
হৃদয়াবেগ ও চেতনার সমগ্র দুনিয়া এখানে ‘বুদ্ধিমত্তা’ থেকে ‘নির্বুদ্ধিতা’র দিকে ছুটে চলেছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। অন্ধ নিরুদ্দেশ হৃদয়াবেগকে কোনো বুদ্ধির যুক্তি দিয়ে ঠেকানো গেল না। অন্তর্নিহিত নির্বুদ্ধিতাও তা রোধ করতে পারেনি। কেননা তাকে কোনো সুসংবদ্ধ চিন্তা-বিবেচনা পরিচালিত বা নিয়ন্ত্রিত করে না।
আর তা-ই হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞান-আলোকোদ্ভাসিত জগতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এক নবতর জাহিলিয়াত। তা কোনো দৃঢ় নিশ্চিত প্রত্যয়ের সন্ধান পায় নি। তাই তার পদচারণা ও গতি উৎকণ্ঠা, দিকবিদিক জ্ঞানশূন্যতা, অস্থিরতা ও সন্দেহ-সংশয়ে জড়িত, কুণ্ঠিত ও দ্বিধান্বিত।
এ আলোচনা পাশ্চাত্য শিল্প সম্পর্কে বলতে গেলে একটি পৃষ্ঠাই মাত্র। অথচ তার চাকচিক্য চতুর্দিকের মানুষের চোখ ঝলসিয়ে দিয়েছে।
গ্রীক জাহিলিয়াত থেকে শুরু করে বর্তশান বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত পর্যন্ত সুদীর্ঘ ইতিহাসের একটা পৃষ্ঠাতুল্য বটে আমাদের এই আলোচনাটুকু।
এ জাহিলিয়াতের প্রতিটি জিনিসই চোখ ঝলসানো চাকচিক্যময় বটে। কিন্তু তা ধ্বংসমুখী। ধ্বংসমুখী এই জন্যে যে, তা নির্ভুল কল্যাণের পথ চিনে না।
এ বিদ্রোহী-সীমালংঘনকারী জাহিলিয়াতের ছত্রছায়ায় থেকে শিল্প নিজেকেও বাঁচাতে পারেনি। খুবই দ্রুত গতিতে তা বিকৃতি ও বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে নিশ্চিহ্নতার অতল গহবরে।
তবু মনে রাখতে হবে, শিল্প সর্বাবস্থায়ই জীবনের প্রতিকৃতি, জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। অন্যথায় তাকে কখনোই শিল্প বলে মনে করা যেতে পারে না।