আধুনিক জাহিলিয়াতের নিদর্শন
ইতিহাসের প্রতিটি জাহিলিয়াতের একটা নিজস্ব নিদর্শন ও বিশেষত্ব রয়েছে, যদ্দারা তা বিশিষ্ট হয়ে প্রতিভাত হয়। আসলে সে নিদর্শন হয় সেই সমাজ পরিবেশের, যার মধ্যে জাহিলিয়াত অবস্থান গ্রহণ করে অথবা তা হয় তার চতুষ্পার্শ্বের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতকি অবস্থার নিদর্শন। সেই সাথে এমন কিছু মৌলিক বিশেষত্বও থাকে, যা সব জাহিলিয়াতেই অভিন্ন মূল্যমান হিসেবে থাকে এবং সামষ্টিকভাবে তা জাহিলিয়াতের একটা সুস্পষ্ট নিদর্শন হয়ে দাঁড়ায়।
পরবর্তী দুটি অধ্যায়ে আমরা ধারণা-বিশ্বাস ও বাস্তব আচার-আচরণে আধুনিক জাহিলিয়াতেরবিপর্যয় ও বিকৃতি সম্পর্খে বিস্তারিত আলোচনা পেশ করব। কিন্তু সেই বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে আধুনিক জাহিলিয়াতের এমন কয়েকটি বিশেষত্বের উল্লেখ করা খুবই উত্তম হবে বলে মনে হয়েছে, যেমন করে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা বলে এসেছি, আধুনিক জাহিলিয়াত কবে অস্তিত্ব লাভ করল এবং তার বিকাশ ও প্রবৃদ্ধি কি করে সংঘটিত হয়েছিল বিগত শতাব্দীগুলোর মধ্যে।
সত্যি কথা, কোনো জাহিলয়াতই মহান আল্লাহর সত্যিকারভাবে ঈমানদার হয় না।
ইতিহাসের সব কয়টি জাহিলিয়াতের মধ্যে এটাই হচ্ছে অভিন্ন ও বড় বিশেষত্ব। বরং এটার ভিত্তিই আল্লাহকে অস্বীকার করে এক একটি জাহিলিয়াত গড়ে ওঠে। আর তার ওপর ভিত্তি করেই ধারণা-বিশ্বাস ও আচার-আচরণের ক্ষেত্রে অন্যান্য সকল প্রকারের বিপর্যয় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
সহীহ ও নির্ভুল আকীদা হচ্ছে তাই, যা এই বিশ্বলোকে মানুষকে তার যথার্থ স্থান ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। স্থান ও কালে তার যাবতীয় ভুল-ভ্রান্তিকে সঠিক ও সুষ্ঠু করে দেয়। তার জন্যে সঠিক দিক নির্দেশ করে, তার জন্য সুদৃঢ় সরল সোজা পথ চিহ্নিত করে দেয়। তাহলেই তার অনুভূতি, মন-মানসিকতা, আচার-আচরণ, গতিবিধি ও তৎপরতা সঠিক হতে পারে, সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে তার নীতি ও বাস্তবতা, ফলে বাঞ্ছিতভাবেই তার এই সব কিছুই পরস্পর ভারসাম্যপূর্ণ, পরিপূরক ও নির্ভুল পথে অগ্রসর হতে পারে।
কিন্তু এই আকীদা যখনই বিকৃত হয়, তখনই মানুষের গোটা সত্তায় বিপর্যয় দেখা দেওয়া অবশ্যম্ভাবী হড়ে পড়ে। ঠিক যেমন চুম্বক-সূচ থরথর করে কাঁপতে ও দিগ্বিদিকহারা হয়ে পড়ে যখন তার ও তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যের মাঝখানে কোনো অন্তরাল সৃষ্টি করে দেওয়া হয়। তখনই সুসংবদ্ধ মানব সত্তা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। স্থান ও কালে তার পদচারণা হয়ে পড়ে দিশেহারা। অস্থির ও সামঞ্জস্যহীন হয়ে পড়ে তার আচরণ ও তৎপরতা, অনুভূতি, স্বজ্ঞা, মৌলনীতি ও বাস্তবতা। অতঃপর সেই বাঞ্ছিত ঐক্যবদ্ধতা ও সুসংবদ্ধ আর কখনোই ফিরে আসে না, তার গোটা সত্তাই স্থিরতা ও শাস্তি নিরাপত্তা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়ে পড়ে। অথচ এই দুই জিনিসের নিশ্চিত সুফল মানুষ লাভ করতে পারে সুস্থ সঠিক বিশ্বাসের ছত্রছায়ায় এবং সঠিক কর্মপথ গ্রহণে।
উক্ত বঞ্চনা ও অস্থিরতার ফলেই জাহিলিয়াতের দেখা দেয়।
বোঝা গেল, মহান আল্লাহর দাসত্ব করা থেকে বিপথগামী হওয়ারই নাম হচ্ছে জাহিলিয়াত। আল্লাহর এই দাসত্ব জীবনের সমগ্র ক্ষেত্রের জন্যে কেবলমাত্র এক আল্লাহর কাছ থেকে আইন-বিধান গ্রহণ ও আইন-বিধান ভিত্তিক বিচার-ফয়সালা গ্রহণও শামিল রয়েছে। এ সবের মধ্য দিয়েই আল্লাহর ইবাদত –দাসত্ব প্রতিফলিত ও বাস্তবায়িত হয়। এই নীতিতে যে বিপথগামিতা সংঘটিত হয়, তা-ই মানব জীবনে নিয়ে আসে অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলতা, ছিন্নভিন্ন হওয়া, দলে দলে বিভক্তি। তা নিয়ে আসে সংগঠনে বিপত্তি, চিন্তায় বিচ্যুতি। আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্কের, গোটা সৃষ্টিলোকের সাথে, চতুষ্পার্শ্বের জীবনের সাথে ও তার ভাই ও অন্য মানুষের সাথে সম্পর্কের ব্যতিক্রম ঘটে, বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়।
ইতিহাসে যখনই মহান আল্লাহর ইবাদত থেকে বিপথগামিতা সংঘটিত হয়েছে, তার পরিণতিতে বিপর্যয় ঘটেছে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কে, সংযোজনে, ধারণায় ও চিন্তা-ভাবনায়। অতএব, এই আকীদাই হচ্ছে সেই শক্তি যা মানুষের এসব দিককে সুসংগঠিত ও সুসংবদ্ধ করে। মানুষ তা জানতে ও বুঝতে সক্ষম হোক আর না-ই হোক, এ ব্যাপারে তার ইচ্ছার কোনো ভূমিকা থাক আর না-ই থাক। আর আকীদা যখন যথার্থ ও সঠিক হয়, তখনই মানুষের গোটা সত্ত্বা সুসংবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তার পদচারণা ও জীবনযাত্রা সবই সঠিক পথে অগ্রসর হতে থাকে। আকীদা-বিশ্বাসের বিপর্যয় গোটা জীবনেই বিস্তার লাভ করে।
তাই বলা যায়, আল্লাহর ইবাদত যখন সঠিকরূপে হতে থাকে, তখন পৃথিবীতে কোনো বিপর্যয় ঘটে না।
তবে অনেক সময় আকীদা হয়ত ঠিক থাকে, কিন্তু শুধু আকীদাটুকু থাকাই তো এই ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তকারী শক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আকীদাকে অবশ্যই জীবন্ত, গতিশীল, সক্রিয়, ইতিবাচক, সর্বব্যাপক হতে হবে, এমন হতে হবে যা মানুষের গোটা জীবন পরিব্যাপ্ত হবে, জীবনের কোনো একটি খুঁটিনাটি ব্যাপার বা দিকও তার আওতার বাইরে থাকবে না। একই সময় ব্যক্তিই গোটা চিন্তা-ভাবনা, মূল্যবোধ ও আচার-আচরণ পরস্পর সম্পৃক্ত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। নীতি ও বাস্তবতার মধ্যেও কোনো পার্থক্য থাকবে না। যা-ই হবে ধারণা ও বিশ্বাস, তা-ই হবে তার কাজ।
এর বিপরীত অবস্থা –তাতে আল্লাহমুখী আকীদা থাক আর না-ই থাক,এ এক প্রকারের জাহিলিয়াত। ‘জাহিলিয়াত’ শব্দটিই তার ওপর প্রযোজ্য হবে এবং তার নিশ্চিত পরিণতিই ভোগ করতে হবে। তার ব্যতিক্রম সম্ভব নয়। কেননা তাই হচ্ছে আল্লাহর সুন্নাত –স্থায়ী প্রাকৃতিক নিয়ম।
০ ০ ০ ০ ০
আরব জাহিলিয়াতের লোকেরা আল্লাহকে জানত, চিনত। তাঁর অস্তিত্বের প্রতিও তারা বিশ্বাসী ছিল। তাঁর প্রতি লক্ষ্য নিবদ্ধ করতে ও তাকেঁ স্মরণ করতেও তারা অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু সে লক্ষ্য দান ও স্মরণ যথার্থ ছিল না, ছিল ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ।
এই জাহিলিয়াতের আরবদের সম্পর্কেই আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************************************)
তুমি যদি ওদের জিজ্ঞেস করোঃ বলো তো আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? ….তাহলে ওরা জবাবে নিশ্চয়ই বলবেঃ সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ।
(আরবী**************************************************************************)
তুমি যদি ওদের জিজ্ঞেস করোঃ বলো তো এই লোকেদের কে সৃষ্টি করেছেন? তারা নিশ্চয়ই বলবে –আল্লাহ। (সূরা –যুখরুফঃ ৮৭)
(আরবী*****************************************************************)
জিজ্ঞেস করোঃ তোমাদের আসমান ও জমিন থেকে কে রিযিক দেয় বা শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তির মালিক কে এবং জীবন্তকে মৃত থেকে বা মৃতকে জীবন্ত থেকে কে বের করে, কে ব্যবস্থা করে যাবতীয় ব্যাপারের? তাহলে তারা অবশ্যই বলবে –আল্লাহ। (সূরা ইউনুসঃ ৩১)
(আরবী*************************************************************************************)
জিজ্ঞেস করোঃ এই পৃথিবী ও এর মধ্যে বসবাসকারীরা কার?…. বলো, যদি জানো। নিশ্চয়ই তারা বলবেঃ আল্লাহর। বলো, তোমরা কি একথা মনে প্রাণে গ্রহণ করছ না? জিজ্ঞেস করো, সপ্ত আকাশের রব্ব কে, কে মহান আরশের রব্ব? তারা অবশ্য বলবে, আল্লাহর জন্যেই আরশ। বলো, তাহলে তোমরা কি সে আল্লাহকে ভয় পাও না? বলো, সব জিনিসের প্রকৃত কর্তৃত্ব কার হাতে? তিনিই তো আশ্রয় দেন, তাঁর ওপর আশ্রয় দানের কাজ কেউ করে না যদি তোমাদের জানা থাকে, তারা নিশ্চয়ই বলবে, তা একমাত্র আল্লাহর জন্যে –বলো, তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে তোমরা কোন দিক থেকে প্রতারিত হচ্ছ?
(সূরা মুমিনুনঃ ৮৪-৮৯)
এ সবয় কয়টি আয়াত একসাথে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, আরব জাহিলিয়াতের লোকেরা বাস্তবিকই আল্লাহকে জানত। তারা এ-ও বিশ্বাস করত যে, সৃষ্টিকর্তা ব্যবস্থাপক তিনিই, তাঁর হস্তে সবকিছুর প্রকৃত কর্তৃত্ব নিবদ্ধ।
কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা জাহিলিয়াতে নিমগ্ন ছিল। তাদের জাহিলিয়াত দিয়ে তারা আল্লাহকে যথার্থভাবে জানত না, তাঁর প্রতি প্রকৃত কার্যকর ঈমান রাখত না।
তাদের যাবতীয় ব্যাপারে তাঁকেই একমাত্র আইন-বিধানদাতা, শাসক, প্রশাসক, বিচার-ফয়সালাকারী রূপে মানতো না –গ্রহণও করত না।
এই কারণেই আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************************)
তারা আল্লাহকে সেই মূল্য-গুরুত্ব-মর্যাদা দিত না, যা তাঁর অধিকার। যা তাঁর জন্যে উপযুক্ত ও শোভন। (সূরা আন’আমঃ ৯১)
হ্যাঁ, তারা আল্লাহকে জানত। কিন্তু তাদের এই জানা তাদের জীবনে প্রতিফলিত ছিল না। জানার স্বাভাবিক ও যৌক্তিক পরিণতি যা হওয়া বাঞ্ছনীয়, তা হতো না।
তারা এক আল্লাহকে জানা সত্ত্বেও একই সাথে অন্যান্য বহু ইলাহর পূজা উপাসনা করত, দাসত্ব করত। …..তা ছিল তাদের অনুভূতিক ও স্বজ্ঞাজনিত আকীদা।
তারা আল্লাহকে জানত, কিন্তু তাঁরা শরীয়ত –আইন-বিধান কার্যকর করত না। তাঁরই কাছে আইন-বিধান বা বিচার-ফয়সালা চাইত না, তাদের জীবনে তাঁরই আইন-বিধান একান্তভাবে মেনে নিতো না, মেনে চলত না। -এ ছিল তাদের বাস্তব জীবন-আচরণের অবস্থা।
আর এসব কারণেই তারা ‘কাফের’ আখ্যায়িত হয়েছে। তারা ছিল সত্যিকারভাবে জাহিল। কুরআন তাদের সে-জাহিলিয়াতের গোমর ফাঁস করে দিয়েছে। তাতে এই সব কিছুই শামিল ছিল।
আকীদার ক্ষেত্রে কুরআন তাদের সমর্থন করেনি, তা সম্ভবও ছিল না। তারা যেসব মূর্তি ও দেবদেবী –খোদা-ভগবানের ইবাদত বা পূজা-উপাসনা করত, তার লক্ষ্য সেইগুলোই ছিল না। তারা তা করত এইজন্যে যে, তারা মনে করত, এইগুলো তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে। অথচ আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্যে তো খালেস তাঁরই ইবাদত একান্ত প্রয়োজন। তাই কুরআন বলেছেঃ
(আরবী****************************************************************************************)
জেনে রাখো, আল্লাহর জন্যেই হবে খালেস দ্বীন। আর যারা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্যান্যকে বন্ধু-পৃষ্ঠপোষকরূপে গ্রহণ করেছে এই মনোভাব পোষণের দাবি নিয়ে যে, আমরা তো ওদের ইবাদত করি না, আমরা ওদের কাছে শুধু এতটুকু চাচ্ছি যে, ওরা আমাদেরকে আল্লাহর অতি নিকটে পৌঁছে দেবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন সেই সব বিষয়ে, যাতে তারা পরস্পর মতপার্থক্য রয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ হেদায়েত করেন না কোনো কাফের মিথ্যাবাদীকে। (সূরা যুমারঃ ৩)
শরীয়ত বা আইন পালনের ব্যাপারে কুরআন অত্যন্ত কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। কেননা বাস্তব জীবনে আইন পালন ও মনে আকীদা পোষণের মধ্যে একবিন্দু বিচ্ছিন্নতা বা বৈপরীত্য কুরআন মেনে নিতে আদৌ প্রস্তুত নয়। আর বস্তুতই শরীয়ত পালন থেকে বিপথগামী হলে তার ঈমান আছে বলে বিশ্বাস করা এক অসম্ভব ব্যাপার। জীবনের বিভিন্ন দিকে আল্লাহ ছাড়া অন্যের দেওয়া আইন-বিধান পালন করা হবে, অথচ আল্লাহর প্রতি ঈমানদার হওয়ার দাবি করা হবে, তা নিতান্তই হাস্যকর। এই কথাই তো বলেছেন আল্লাহর নিম্নোদ্ধৃত আয়াতেঃ
(আরবী********************************************************************************************************************************)
আমরা তওরাত নাযিল করেছি। তাতে আছে হেদায়েত ও নূর। ইসলাম গ্রহণকারী নবীগণ, আল্লাহওয়ালা ও আলিম-বুদ্ধিমান লোকেরা ইহুদীদের জন্যে তারই ভিত্তিতে বিচার-ফয়সালা করে সেই অনুযায়ী, যা তারা আল্লাহর কিতাব থেকে হেফয করে রেখেছে, যার সংরক্ষক তাদের বানানো হয়েছিল। আর তারা তার সত্যতার সাক্ষী ছিল। অতএব তোমরা লোকজনকে ভয় পেয়ো না, ভয় আমাকেই করো। আর আমার আয়াত স্বল্পমূল্যের জিনিসরূপে বিক্রয় করো না। বস্তুত যারাই আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী ফায়সালা করে না, তারাই কাফের, তাতে তাদের জন্যে এই আইন আমরা লিখে দিয়েছিলাম যে, জানের বদলে জান, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, নাকের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত দিতে হবে। সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই কিসাসের আওতাভুক্ত। তবে যদি কেউ তা মাফ করে দেয়, তাহলে তা তার জন্যে কাফফারা হবে। আর যে লোকেরা বিচার-ফয়সালা করে না আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী, তারা জালিম। তাদের পরে পরেই আমরা নিয়ে এলাম মরিয়ম-পুত্র ঈসাকে। তাদের কাছে তওরাতের যে অংশ রয়েছে তার সত্যতা ঘোষণাকালী হিসেবে। এবং তাঁকে আমরা ইনজিল দিলাশ। তাতে যেমন হেদায়েত আছে, তেমনি নূর। আর তা সত্যতা প্রমাণকারী তওরাতের যা বর্তমান আছে তার। এবং তা হেদায়েত ও উপদেশ মুত্তাকী লোকদের জন্যে। ইনজিল-বিশ্বাসীদের উচিত আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করা। আর যারাই আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করে না, তারাই ফাসিক। অতঃপর আমরা তোমার প্রতি –হে নবী কিতাব নাযিল করেছি পরম সত্যতা সহকারে। পূর্ববর্তী কিতাবের অবশিষ্টের সত্যতা বিধানকারী, তার সংরক্ষক। অতএব তুমি তাদের মধ্যে হুকুমত চালাও আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী, আর তাদের ইচ্ছা-বাসনার অনুসরণ করে আল্লাহর দেওয়া বিধান থেকে দূরে সরে থেকো না। তোমাদের জন্যেই একটা শরীয়ত ও একটা প্রশস্ত পথ বানিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ চাইলে তোমাদের এক উম্মতভুক্ত বানিয়ে দিতেন। কিন্তু তা বানান নি, যেন তিনি তোমাদের যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন। অতএব তোমরা সকলে সকল কল্যাণময় কাজের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়ে যাও। আল্লাহই তোমাদের সকলেরই চূড়ান্ত পরিণতি। তখন তিনি তোমাদের পারস্পরিক বিরোধিতার বিষয়ের মধ্যে প্রকৃত সত্য কোনটি তা জানিয়ে দেবেন। আর তুমি তাদের মধ্যে হুকুমত চালাও আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী, আর তাদের ইচ্ছা-বাসনার অনুসরণ করে আল্লাহর দেওয়া বিধান থেকে দূরে সরে থেকো না। তোমাদের জন্যেই একটা শরীয়ত ও একটা প্রশস্ত পথ বানিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ চাইলে তোমাদের এক উম্মতভুক্ত বানিয়ে দিতেন। কিন্তু তা বানান নি, যেন তিনি তোমাদের যা দিয়েছেন, তাতে তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন। অতএব তোমরা সকলে সকল কল্যাণময় কাজের দিকে দ্রুত অগ্রসর হয়ে যাও। আল্লাহই তোমাদের সকলেরই চূড়ান্ত পরিণতি। তখন তিনি তোমাদের পারস্পরিক বিরোধিতার বিষয়ের মধ্যে প্রকৃত সত্য কোনটি তা জানিয়ে দেবেন। আর তুমি তাদের মধ্যে হুকুমত চালাও আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী। তাদের কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। তাদের ব্যাপারে তুমি সতর্ক থাকবে, কেননা তারা তোমার প্রতি আল্লাহর নাযিল করা কোনো কোনো বিধানের ব্যাপারে তোমাকে বিপদে ফেলতে পারে। ওরা যদি পৃষ্ঠপ্রদর্শনও করে, তবু তুমি জানবে যে, আল্লাহ চাহেন তাদের কোনো কোনো গুনাহের জন্যে তাদেরকে মুসীবতে নিমজ্জিত করবেন। যদিও বেশির ভাগ লোকই ফাসিক। ওরা কি জাহিলিয়াতের আইন-শাসন-প্রশাসন পেতে চায়? অথচ দৃঢ় প্রত্যয় সম্পন্ন লোকদের জন্যে আল্লাহর চাইতে অধিক উত্তম বিধানদাতা –বিচার ফয়সালাকারী আর কে হতে পারে?
(সূরা মায়িদাঃ ৪৪-৫০)
অন্যত্র বলেছেনঃ
(আরবী***************************************************************************************)
যার ওপর যবেহ কালে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়নি, তা তোমরা খেয়ো না –তা খাওয়া নিশ্চয়ই ফিসক। আর শয়তানেরা তাদের বন্ধু চেলাদের প্রতি অবশ্য গোপন কথা পাঠায়। যেন তারা তাদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয়। আর তোমরা যদি তাদের আনুগত্য করো, তাহলে তোমরা নিশ্চয়ই মুশরিক হয়ে যাবে। (সূরা আন’আমঃ ১২১)
এ দীর্ঘ উদ্ধৃত আয়াত থেকে অকাট্যভাবে জানা গেল, শরীয়ত আইন পালনের ব্যাপারটি প্রকৃতপক্ষে আকীদা বিশ্বাসেরই ব্যাপার, এ দুটির মধ্যে কোনোই তারতম্য হতে বা বিচ্ছিন্নতা হতে পারে না। হয় আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী আইন বিধান জারী ও বিচার-ফয়সালা করা হবে, না হয় হবে জাহিলিয়াত ও শিরক অনুযায়ী। অতএব আল্লাহর সত্যিকার পরিচিতি লাভ তাঁর প্রতি যথার্থ ঈমান গ্রহণ –এর অনিবার্য ফলশ্রুতি হচ্ছে একান্তভাবে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া, ইলাহ হিসেবে কেবল তাঁকেই গ্রহণ করার মতোই ব্যাপার। কেননা তিনি একাই তো সৃষ্টিকর্তা, মালিক। কাজেই তিনি একাই এই মর্যাদায় অভিষিক্ত যে, কেবল তাঁকে মান্য করা হবে, মেনে চলা হবে কেবল তাঁরই দেওয়া বিধান। মান্য করা কর্তব্য কেবল তাঁকেই। আকীদা বিশ্বাস ও শরীয়াতের বিধান পালন এক অভিন্ন ব্যাপার, যার দুই অংশ বা দিক হলেও তা এক অভিন্ন মৌল থেকে নির্গত। একই পরিণতির দিকে অগ্রসরমান। সে অভিন্ন মৌল হলো আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং অগ্রসর হওয়ার পথ বা পন্থা হচ্ছে ইসলাম।
পক্ষান্তরে প্রতিটি জাহিলিয়াতের নির্দিষ্ট দিক আছে। সেই দিকটিই তাকে জাহিলিয়াতরূপে নির্ধারিত করে। জাহিলিয়াতের সে দিকটি হচ্ছে আল্লাহর প্রতি সত্যিকার ঈমান না আনা অথবা যে কোনো বিষয়ে ইসলাম পালন না করা। এখানে আকীদা ও শরীয়ত, শরীয়ত ও আকীদা অভিন্ন, অবিচ্ছিন্ন। এ দুয়ের মধ্যে যেমন বিচ্ছিন্নতা আসতে পারে না, তেমনি পারে না কোনোরূপ পার্থক্য সৃষ্টি হতে।
ঈমানের ঐকান্তিক দাবি হচ্ছে আল্লাহকেই এককভাবে ‘ইলাহ’ মেনে নেওয়া। আর ইসলামের দাবি হচ্ছে এককভাবে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্বীকার করা, কেবল তাঁরই দেওয়া আইন বিধানকে একমাত্র আইন বিধানরূপে গ্রহণ ও অবলম্বন করা।
আর আল্লাহকে একক ইলাহ ও একক সার্বভৌম না মানলেই জাহিলিয়াত উদ্ভূত হয়। তখন আল্লাহর সাথে শরীক করা হয় অন্যান্য অনেক ইলাহকে। আর তখন এক আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বিচার-ফয়সালাকরণও সম্ভব হয় না।
বস্তুত জাহিলিয়াত যখন আল্লাহর বিধান অনুযায়ী নীতি নির্ধারণ ও বিচার-ফায়সালা করে না, তখন তা অনিবার্যভাবে লোকদের নিজেদের চিন্তা-ভাবনা ইচ্ছা কামনারই অনুসরণ করতে বাধ্য হয়।
আর এটাই হচ্ছে প্রতিটি জাহিলিয়াতের দ্বিতীয় লক্ষণ। তা মৌলিকভাবে এক আল্লাহর প্রতি সত্যিকার ঈমান না থাকা এবং তাঁরই কাছে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পিত না হওয়া থেকেই উৎসারিত।
এবং হুকুমত করো তাদের মধ্যে আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী। তাদের ইচ্ছা-বাসনা অনুসরণ করো না। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকো। তারা তোমাকে তোমার প্রতি অবতীর্ণ কোনো কোনো বিধানের ব্যাপারে বিপদে ফেলতে পারে।–[আল মায়িদাঃ ৪৯।]
তাহলে বোঝা গেল, গোটা ব্যাপারটাই পরস্পর সম্পৃক্ত, অবিভাজ্য। হয় আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে হবে –আর এ থেকেই ইসলাম, একান্তভাবে তাঁর কাছে আত্মসমর্পিত হওয়া এবং তাঁরই নাযিল করা বিধান পালন অনিবার্য ফলশ্রুতিস্বরূপ প্রাপ্ত। পক্ষান্তরে জাহিলিয়াত হচ্ছে লোকদের কামনা-বাসনা-ইচ্ছার অনুসরণ। এর প্রতিটি বিধান আল্লাহর বিধান থেকে সম্পূর্ণরূপে ভিন্নতর এবং নিছক কামনা-বাসনা মাত্র। এটা আল্লাহরই নির্ধারণ, জীবনের ইতিহাস থেকেই এক কথার সত্যথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত।
হ্যাঁ,লোকদের কামনা-বাসনা-চিন্তা এক যুগ থেকে যুগান্তরে, এক পরিবেশ থেকে ভিন্নতর পরিবেশে পার্থক্য সম্পন্ন হয়ে থাকে। এক জনগোষ্ঠী থেকে অপর জনগোষ্ঠীতেও এই ভিন্নতা অবশ্যই লক্ষণীয়। কিন্তু সর্বক্ষেত্রেই তা ইচ্ছা-বাসনা জনগণের মধ্য থেকে এক অংশের মাত্র। তা দিয়েই সমগ্র জনগোষ্ঠীকে শাসন করা হয়, সকলকে তা অকুণ্ঠিতভাবে মেনে চলতে বাধ্য করা হয়। তাতে বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির কল্যাণ সাধিত হলেও হতে পারে; কিন্তু অবশিষ্ট সমস্ত সৃষ্টি এই কামনা-বাসনা-ইচ্ছা অনুপাতেই অধীনতা বা গোলামী করতে বাধ্য হয়।
শরীয়াতের বিধান এক আল্লাহ প্রদত্ত। তাতে লোকদের কামনা-বাসনা-ইচ্ছার একবিন্দু স্পর্শও লাগেনি। কেননা আল্লাহর নিজের জন্যে কল্যাণের চিন্তা নেই এই জনগোষ্ঠীর সাথে। ফলে তাঁর পক্ষপাতিত্বও নেই। তিনি নিজেই বলেছেনঃ
(আরবী**************************************************************************************)
আমি তো তাদের কাছ থেকে কোনো রিযিক পেতে চাই না, তারা আমাকে খাওযাবে এমন কোনো ইচ্ছাও নেই আমার। (সূরা যারিয়াতঃ ৫৮)
সব মানুষই তাঁর সৃষ্ট, সকলেই তাঁর কাছে সমান। কারোর ওপর কারোর কোনো মর্যাদাধিক্য বা অগ্রাধিকার নেই তাঁর কাছৈ। তা পাওয়ার একমাত্র ভিত হচ্ছে তাকওয়া।
(আরবী****************************************************************************************)
হে মানুষ! আমারই তোমাদের একজন পুরুষ ও নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, আর বিভিন্ন গোষ্ঠী ও গোত্রে তোমাদের বিভক্ত করেছি শুধু এজন্যে, যেন তোমরা পরস্পরের পরিচিতি লাভে সক্ষম হও। নিশ্চিত কথা, তোমাদের মধ্যকার সর্বাধিক মুত্তাকী ব্যক্তিই তোমাদের মধ্য থেকে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানার্হ। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহাজ্ঞানী, সর্ববিষয়ে অবহিত।
(সূরা হুযরাতঃ ১৩)
অতএব হয় আল্লাহর শরীয়ত পালন করা হবে –আর তা-ই ইসলাম। অথবা লোকদের চিন্তা-ইচ্ছা-কামনা-বাসনার অনুসরণ করা হবে। আর তা-ই জাহিলিয়াত। সর্বকালে ও সর্বস্থানেই এই কথা যথার্থ, শাশ্বত।
তৃতীয় নিদর্শনটি সকল জাহিলিয়াতের ক্ষেত্রে অভিন্ন। আর তা হচ্ছে আল্লাহদ্রোহী সীমালংঘনকারী ক্ষমতাসীনদের অবস্থিতি। তারাই সর্বক্ষণ ও সর্বতোভাবে সচেষ্ট থাকে মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদত থেকে এবং এক আল্লাহর দেওয়া শরীয়ত পালন থেকে বিরত রাখতে। যেন তারা বাধ্য হয়ে সেই আল্লাহদ্রোহী-সীমালংঘনকারী লোকদের দাসত্ব করতে এবং তাদের বানানো শরীয়ত-বিধান, আইন-পালন করতে (যা তারা নিজেদের খাহেশ-কামনা-বাসনা-ইচ্ছার ভিত্তিতে রচনা করছে) বাধ্য হয়। এই কথাই বলা হয়েছে এ আয়াতেঃ
(আরবী*****************************************************************)
আল্লাহ বন্ধু পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন ঈমানদার লোকদের। তিনি তাদের অন্ধকার থেকে আলোকের দিকে বের করে নিয়ে আসেন। আর কাফেরদের বন্ধু পৃষ্ঠপোষক হয়েছে আল্লাহদ্রোহী-সীমালংঘনকারী লোকেরা। তারাই তাদের বের করে আনে আলো থেকে পুঞ্জীভূত অন্ধকারের দিকে। (সূরা বাকারাঃ ২৫৭)
(আরবী*******************************************************************************)
যারা ঈমানদার, তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে। আর যারা কাফের তারা যুদ্ধ করে আল্লাহদ্রোহী-সীমালংঘনকারীদের পথে…। (সূরা নিসাঃ ৭৬)
এই আল্লাহদ্রোহী-সীমালংঘনকারী লোকদের কর্তৃত্ব থাকাটা একটা অবিচ্ছিন্ন লক্ষণ আল্লাহর পথ থেকে দূরে নিঃসম্পর্ক হয়ে থাকার। তাই মানুষ যখনই সত্যিকার ইবাদত থেকে বিপথগামী হবে, তখন তারা অন্যান্য সত্তার ইবাদতে আত্মনিয়োগ করবে –এটা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি অনিবার্য। তা একক সত্তার ইবাদত হতে পারে, হতে পারে আল্লাহর সাথে শিরক সহকারে। আর আল্লাহ ছাড়া এ সব মা’বুদ তখনই আল্লাহদ্রোহী সীমালংঘনকারী হয়ে দাঁড়ায়।
সে ‘তাগুত’-আল্লাহদ্রোহী-সীমালংঘনকারী এক ব্যক্তি হতে পারে। একটি গোষ্ঠী হতে পারে, হতে পারে একটি জনসমষ্টি। প্রচলিতভাবে হতে পারে, হতে পারে অন্ধ অনুসরণ হিসেবে। অথবা অন্য কোনো শক্তিও মানুষকে দাস বানিয়ে রাখতে পারে। তখন তাদের পক্ষে সেই শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভ সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে পড়ে।
‘তাগুত’-সে এক ব্যক্তি হোক, কি হোক এক গোষ্ঠী বা দল, জনগণ এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনুক এবং কেবল মাত্র তাঁরই ইবাদত করুক যেমন করে তাঁর ইবাদত করতে হয়, তা কোনো দিনই বরদাশত করবে না। কেননা যেখানে আল্লাহর কর্তৃত্ব প্রাধান্য-সার্বভৌমত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা সাধারণভাবে স্বীকৃত ও মান্য, তথায় ‘তাগুত’ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না, টিকতে ও বসবাস করতেও পারে না। তাই তাকে মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে ফিরাবার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করে চেষ্টা করতে হয়। তারপরই তার নিজ ইচ্ছা বাসনার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া বা করা সম্ভব।
এই কারণে তাগুত সব সময়ই সত্য নির্ভুল আকীদার সাথে চরম শত্রুতা করতে বাধ্য থাকে। কেননা জনগণের বন্ধুত্ব-পৃষ্ঠপোষকতা, কর্তৃত্ব –সব কিছু তার নিজের জন্যে একান্ত করে রাখতে বদ্ধপরিকর। সত্য-সঠিক আকীদা তো এ সবকে একমাত্র আল্লাহর জন্যে একান্ত করে দেয়।
আর এই জন্যেই জাহিলিয়াত –আল্লাহর ইবাদত থেকে বিপথগামিতা –অনিবার্যভাবে ‘তাগুতকে’ বহাল তবিয়তে প্রতিষ্ঠিত রাখে। ‘তাগুত’ ছাড়া জাহিলিয়াত হয় না, জাহিলিয়াত তাগুত ছাড়া চলতে পারে না।
চতুর্থ নিদর্শনটিও সকল ক্ষেত্রে সমানভাবে বর্তমান। তাও আল্লাহর নীতি ও পদ্ধতি থেকে দূরত্বের ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে। যদিও তার কারণসমূহ মানব প্রকৃতি নিহিত। আর তা হচ্ছে লালসা-কামনার স্রোতে ভেসে যাওয়া।
লালসা-কামনা মানুষের খুবই প্রিয় জিনিস। কুরআনে বলা হয়েছেঃ
(আরবী********************************************************)
জনগণের কাছে খুবই প্রিয় বানিয়ে দেওয়া হয়েছে লালসা-কামনা স্ত্রীলোক, পুত্র সন্তান, আর স্বর্ণ-রৌপ্যের স্তুপীকৃত সম্পদ, চিহ্নযুক্ত অশ্ব, গৃহপালিত পশু, ক্ষেতখামার ইত্যাদি বিষয়। এসব হচ্ছে বৈষয়িক জীবরে জন্যে জরুরী সামগ্রী। (সূরা আলে-ইমরানঃ ১৪)
বস্তুত আয়াতে উল্লেখিত দ্রব্যাদির সব কিছুরই একটা পরিমাণ মানব জীবনের জন্যে একান্তই অপরিহার্য। অপরিহার্য সেই খিলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্যে, যার দেহসত্তায় কতকগুলো জৈবিক দাবি একত্র করে রেখে দেওয়া হয়েছে। যেমন খাদ্য, পানীয়, বাসস্থান, পোশাক, যৌন প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা, প্রকাশ ও মালিকানা দখল।–[(আরবী*************) গ্রন্থের (আরবী**************) অধ্যায় দ্রষ্টব্য।] ব্যক্তিকে জীবনের সাথে সম্পৃক্ত রাখার জন্যে এবং তাকে জীবনের পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্যে এগুলোর অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য।
কিন্তু এগুলোর পরিমাণ যখন যুক্তিসঙ্গত পরিমাণের তুলনায় অনেক বেশী হয়ে যায়, আর লালসা-কামনা যদি মানব সত্তার ওপর আধিপত্যশীল হয়ে বসে, তখন সে তার স্বভাবসম্মত দায়িত্ব পালন করতে অক্ষম হয়ে পড়ে, যার জন্যে আল্লাহ এগুলোকে উদ্ভাবিত করেছেন। তখন মানব সত্তাটিকেই তা ধ্বংস করে। তার শক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়। খিলাফতের দায়িত্ব পালন থেকে তাকে বিরত রাখে। ভিন্ন দিকে ফিরিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত মহান মানবীয় মর্যাদা থেকেও অনেক নীচে নামিয়ে দেয়। (অথচ আল্লাহ তাকে মহা সম্মানিতই বানিয়েছিলেন) তখন তাকে জন্তু-জানোয়ার আর শয়তানের পর্যায়ে পৌঁছিয়ে দেয়।
এই মানব সত্তাটিকে এই পরিণতি থেকে রক্ষা করতে পারে কেবলমাত্র তার আল্লাহতে বিশ্বাস এবং এমন এক জীবনধারা যা আল্লাহর শরীয়াতের বাস্তব ব্যবস্থার অধীন অতিবাহিত হয়।
অতীত শতাব্দীসমূহে মানব সংক্রান্ত সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা এই সত্যকে অনস্বীকার্য করে দেয়। হয় হেদায়েত অবলম্বন হবে আল্লাহর দেওয়া হেদায়েতে, না হয় লালসা-কামনার খরস্রোতে রসাতলে ভেসে যাওয়া হবে। তখন এই লালসা-কামনাই সবকিছু, সকল প্রকার বাসনা-কামনাই তখন প্রকট। তন্মধ্যে যৌন লালসা সর্বাগ্রে। মানুষ এই যৌন লালসার তীব্র আকর্ষন থেকে নিজেকে কখনোই বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। …হ্যাঁ পারে কেবলমাত্র আল্লাহর জন্যে –আল্লাহর ভয়ে, তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্যে।
তবে আইন ও শাসন এবং শাস্তির ভয়টাও এ ব্যাপারে কম ভূমিকা পালন করে না। এই কারণে মানুষ অপরাধ করে গোপনে, লোকদের না দেখিয়ে। যেন তারা ধরা পড়ে আইনের শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য না হয়।
প্রচলিত আইন যে কাজকে অপরাধ গণ্য করে, অপরাধীরা সেই সব কাজ গোপনেই করতে চেষ্টা করে। আর লোকভয় থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্যে লোকদের না দেখিয়ে সে কাজ করে। কিন্তু সে অপরাধ থেকে নিজেকে প্রকৃতপক্ষে দূরে রাখতে পারে না। পারে কেবল তখন, যখন আল্লাহর ভয় তার মনে প্রবল হয়ে ওঠে। কেননা আল্লাহর কাছ থেকে কিচু লুকোনো যায় না।
ইতিহাসের পৃষ্ঠায় একথা অকাট্যরূপে প্রতিষ্ঠিত যে, দুনিয়ার জাহিলিয়াতসহ নৈতিক নির্লজ্জতা –জ্বিনা-ব্যভিচারকে চূড়ান্তভাবে বন্ধ করার জন্যে কখনোই কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। এক্ষেত্রে আরব জাহিলিয়াত, পারসিক জাহিলিয়াত, ভারতীয় জাহিলিয়াত, গ্রীক, রোমান ও ফিরাউনী জাহিলিয়াত এবং তখনকার এই বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াত সবই একাকার, অভিন্ন। অবশ্য কারণ বিভিন্ন।
কখনও কারণ হয়, শাসক-প্রশাসক তাগুত একান্তভাবে তার নিজের কল্যাণের বিষয়াদিতে গভীরভাবে আত্মনিমগ্ন হয়ে পড়ে; তার বাইরে অন্য সব ব্যাপারাদির প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার অবসরই পায় না। আল্লাহর বিধান ছাড়া যে শাসন-প্রশাসন, আসলে তা-ই তাগুত। ফলে সাধারণ মানুষ যৌনতার ক্ষেত্রে কোনো গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে, তা লক্ষ্য করার মতো কোনো অবকাশই তা পায় না। ফলে এই বিপথগামিতা থেকে তাদের রক্ষা করার কেউ থাকে না।
অনেক সময় ‘তাগুত’ নিজেই নির্লজ্জতা জ্বিনা-ব্যভিচারের প্রসারতা ঘটানোর জন্যে সচেষ্ট হয়, যেন সে নিজেই একদিকে হারাম সম্পদ আহরণ করে ভোগ-বিলাস করার সুযোগ পেতে পারে, অপরদিকে জনগণের ওপর তার চাপানো জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো কোনো মন-মানসিকতা বা ঈমানী সাহসিকতা কারুর মধ্যেই না থাকে। তার গোটা শাসন প্রশাসনই তো জুলুম। আল্লাহর বিধান ছাড়া যে শাসন, তা জুলুম ছাড়া আর কিছুই নয়। এই কারণে জনগণের যৌন-উচ্ছৃঙ্খলতায় ডুবে যাওয়া থেকে চক্ষু ভিন্ন দিকেই ফিরিয়ে রাখে। ফলে জনগণও তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না, আর তাগুতি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠা থেকে দূরে সরে থাকে।
সে যা-ই হোক, প্রতিটি জাহিলিয়াতেই যৌন লালসা-কামনা-স্রোতে মানুষের বিপথগামী হওয়া এক অনিবার্য ও অবধারিত অবস্থা।
ইতিহাসে আজ পর্যন্ত যতগুলো জাহিলিয়াতের অভ্যুদয় ঘটেছে তার প্রতিটিতেই এই লক্ষণটি প্রকটভাবে বর্তমান দেখা গেছে। তার প্রতিটিই সেই বড় ও প্রধান কারণ থেকে উৎসারিত, যা প্রতিটি জাহিলিয়াতেই অনিবার্যভাবে বিরাজিত। আর তা হচ্ছে আল্লাহর ইবাদত থেকে বিপথগামিতা।
এ এক অভিন্ন ও সম্মিলিত লক্ষণ। কোনো জাহিলিয়াতই তা থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। যা আরব জাহিলিয়াতে ছিল। পারসিক, গ্রীক, রোমান ও ফিরাউনী জাহিলিয়াতে তা পুরামাত্রায় বর্তমান ছিল। আর আধুনিক জাহিলিয়াতেরও তা রয়েছে পুরোপুরিভাবে। তবে বাহ্যিক প্রকাশ হয়ত বিভিন্ন হতে পারে কখনও কখনও। কখনও আবর তা-ও হয় না।
আরব জাহিলিয়াতে আল্লাহর ইবাদত থেকে বিপথগামিতা ছিল আকীদার দিকে যেমন, তেমনি শরীয়াতের ক্ষেত্রেও। আল্লাহর ঘরে ও আশে-পাশে মূর্তি-প্রতিমূর্তির হরদম পূজা হচ্ছিল। তথায় জাহিলিয়াতের আইন কার্যকর ছিল আল্লাহর শরীয়তের পরিবর্তে। মানুষের ওপর, তাদের যাবতীয় কর্ম তৎপরতার ওপর খাহেশ-কামনা-বাসনার প্রাধান্য ও আধিপত্য ছিল। তথায় শক্তিমান দুর্বলের ওপর অন্যায়ভাবে জয়ী হতো। বিচার ক্ষেত্রে সত্যতার কোনো যোগ ছিল না। যা কিছু হতো তা হতো শক্তির জোরে, শক্তির পক্ষে। কুরায়শবংশের সরদারই সেখানে ‘তাগুত’ হয়ে বসেছিল। যারা গণকদার ও প্রাচীন রীতিনীতির পুনরুজ্জীবনকারী, তা যেমন বিপথগামী, তেমনি পিতৃপুরুষের অন্ধ অনুসরণের নামান্তর। তারা যা ইচ্ছা করত, হারাম ঘোষণা করত। যা পছন্দ হতো, তাকেই হালাল বানিয়ে দিত। কেবল তাই নয় –অনেক সময় এক বছর যা হারাম ঘোষণা করত, পরবর্তী বছর তাই হালাল ঘোষণা করে দিত। যখন তাদের মন যা চাইত, পরবর্তী বছর তাই হালাল ঘোষণা করে দিত। যখন তাদের মন যা চাইত, তাই করত। বাতিল শাসকরা ক্ষমতাসীন হয়ে জনগণকে অকথ্যভাবে লাঞ্ছিত অপমানিত করত। তারা সাধারণ মানুষের গরদানের ওপর সওয়ার হয়ে বসেছিল। আর লালসা কামনার শক্তি মদ্য, নারী, জুয়া, হত্যা, লুটপাট, অধিকার হরণ, ছিনতাই, আত্মম্ভরিতা ও সীমালংঘনমূলক অহংকার গৌরব করার মাধ্যমে পূর্ণমাত্রায় কার্যকর ছিল এবং তার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে চলছিল।
আর আজ চৌদ্দশ বছর পর আধুনিক জাহিলিয়াত ঠিক সেই বিশেষত্ব ও লক্ষণাদি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আল্লাহর ইবাদত থেকে বিপথগামী হওয়ার ব্যাপারটি আকীদা ও শরীয়তের বিধান উভয় ক্ষেত্রেই সর্বজনবিদিত ব্যাপার। সেদিকে শুধু ইঙ্গিত করাই যথেষ্ট। কিন্তু একালের জাহিলিয়াতে বিপথগামিতা বহু সত্যের ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র আকীদা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি। শরীয়ত পরিহারের ব্যাপারটিও তার সকল নিদর্শনসহ ব্যাপকভাবে কার্যকর। এ জাহিলিয়াত পূর্ণমাত্রায় নাস্তিকতা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। মানুষ ব্যক্তিগতভাবেই সে নাস্তিকতা গ্রহণ করে থাকুক, অথবা তাগুতী শক্তি জনগণের ওপর চাপিয়েই দিক। আর শয়তানের সকল অবস্থাতেই তার মাত্রা অনেক বৃদ্ধি করে দিয়েছে।
লালসা-কামনা ও নিজস্ব মনের চিন্তা-ভাবনার অনুসরণে বর্তমান শতাব্দীর জাহিলিয়াত শীর্ষস্থান দখল করে বসেছে। অতীতের কোনো জাহিলিয়াতেই নফসের লালসা প্রবৃত্তির এতটা দাসত্ব আর কখনোই করা হয়নি। প্রতিটি ব্যাপারেই তা লক্ষণীয়। আর পূর্বে ও পশ্চিমে কোনোই পার্থক্য নেই এ ব্যাপারে। সর্বত্রই আকীদার বিশ্বাসকে পদদলিত ও চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হয়েছে। যা কিছু পবিত্র, সম্মানার্হ, তার প্রতি চরম উপেক্ষা প্রদর্শন করা হয়েছে, তাকে বিদ্রূপ করা হয়েছে। মানুষের কাজ-কর্মের সমস্ত নিয়ম-নীতি লংঘন করা হয়েছে। আর নিছক ধারণা-অনুমানের ভিত্তিতে নিতান্তই বেহুদা ও অপ্রয়োজনীয় তত্ত্ব উদ্ভাবন করা হয়েছে।
একালের ‘তাগুত’দের সংখ্যা যে কত, তা হিসেব-নিকেশের আওতা ছাড়িয়ে গেছে। পূঁজিতন্ত্র, প্রোলেটারিয়েট, মিথ্যা কল্পিত কিসসা-কাহিনী ও তাৎপর্যহীন মূল্যমান ও মূল্যবোধ, এসবই কি একালের বড় বড় তাগুত নয়?
আর একালের লালসা-বাসনা-কামনার প্রচণ্ডতার কথা বরং না বলাই ভালো।
এই নিদর্শনসমূহ এতই সাধারণ যে, দুনিয়ার বুকে সৃষ্ট ইতিহাসের কোনো জাহিলিয়াতই এই সব থেকে মুক্ত থাকতে পারে না।
সমস্ত জাহিলিয়াতে সমানভাবে বর্তমান থাকা অভিন্ন মূল্যায়ন ও নিদর্শনসমূহের সাথে পরিচিত হওয়ার পর, আধুনিক জাহিলিয়াতের বিশেষত্বসমূহের সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করব, যেন আমাদের মানসপটে সে সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণার সৃষ্টি হয়। এই বিশেষত্বসমূহ সেই প্রধান বড় ও মৌল নিদর্শন থেকেই উৎসারিত। আর তা হচ্ছে আল্লাহর ইবাদত থেকে বিপথগামিতা। কিন্তু আধুনিক জাহিলিয়াত এই ক্ষেত্রেও তার রূপ ও খুঁটিনাটি দিক দিয়ে বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র স্থান দখল করেছে। এর কারণ হচ্ছে পরিবেশগত পরিস্থিতি আর জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থার বিবর্তন এবং সেই চিন্তা যা আল্লাহ প্রদত্ত পন্থা ও পদ্ধতি থেকে দূরবর্তিথা এবং তার সাথে শত্রুতা গ্রহণের দরুন উদ্ভুত হয়েছে।
ইতিহাসের প্রতিটি জাহিলিয়াতে এমন একটা বিশেষ বিশেষত্বও রয়েছে, যা তার অভিন্ন ও সর্ব জাহিলিয়াতের বর্তমান বিশেষত্ব থেকে তাকে পৃথকভাবে প্রতিভাত করে।
দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, আরব জাহিলিয়াতের একটি বিশেষত্ব ছিল সন্তান হত্যা ও তাকে জীবন্ত সমাধিস্থ করা, নারী ও পুরুষের এক মহা উলঙ্গ ও বস্ত্রহীন অবস্থায় আল্লাহর ঘরের তওয়াফ করা, কোনো কোনো ফসল ও জীবজন্তু কোনো কারণ ছাড়াই হারাম বলে নির্দিষ্ট করা ইত্যাদি। এই কাজ নিতান্ত হাস্যকর। তবু এগুলোই ব্যাপক প্রচলিত ছিল তখনকার সময়ে।
(আরবী**********************************************************************************************************)
এবং এই লোকেরা আল্লাহর জন্যে তাঁর নিজেরই পয়দা করা ক্ষেত খামারের ফসল ও গৃহপালিত পশুর একটি অংশ নির্দিষ্ট করেছে এবং বলেছে এটা আল্লাহর জন্যে আসলে এটা হচ্ছে তাদের নিজেদের ধারণা অনুমান –আর এটা আমাদের বানানো শরীক মা’বুদের জন্যে। কিন্তু যে অংশ তাদের বানানো শরীক মা’বুদদের জন্যে, তা আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, অথচ যা আল্লাহর জন্যে, তা তাদের বানানো শরীকদের পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কতই না খারাপ এই লোকদের সিদ্ধান্ত। এমনিভাবে তাদের শরীকেরা বহু সংখ্যক মুশরিকদের জন্যে তাদের নিজেদের সন্তানকে হত্যা করার কাজকে খুবই আকর্ষণীয় ও চাকচিক্যময় বানিয়ে দিয়েছে, যেন তারা তাদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিমজ্জিত করে। আল্লাহ চাইলে তারা এরূপ করত না। কাজেই তাদের ছেড়ে দাও, তারা নিজেদের মিথ্যা রচনায় নিমগ্ন থাকুক। তারা বলে, এই জন্তু ও এই ক্ষেত ফসল সুরক্ষিত। এগুলো কেবল তারাই খেতে পারবে, যাদের আমরা খাওয়াতে চাইবে। অথচ এই বিধি-নিষেধ তাদের নিজেদের কল্পিত। এছাড়া কিছু জন্তু, জানোয়ার এমন আছে যেগুলোর ওপর সওয়ার হওয়া ও মাল বোঝাই করাকে হারাম করে দেওয়া হয়েছে। আর কিছু কিছু জন্তুর ওপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে না। এসব কিছুই তারা আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বানিয়ে নিয়েছে। অতিশীঘ্র আল্লাহ তাদেরকে মিথ্যা রচনার প্রতিশোধ দেবেন। আর তারা বলে, এই জন্তুগুলোর গর্ভে যা আছে, তা আমাদরে পুরুষদের জন্যে বিশেষভাবে রক্ষিত এবং আমাদের নারীদের জন্যে তা হারাম। কিন্তু তা যদি মৃত হয়, তবে উভয়ই তা খাওয়াতে শরীক হতে পারে।…. (সূরা আন’আমঃ ১৩৬-১৩৯)
গ্রীক জাহিলিয়াতের পার্থক্যসূচক বিশেষত্ব ছিল জ্ঞানবুদ্ধির দাসত্ব ও দেহের পূজা। আর রোমান জাহিলিয়াতের বিশেষ লক্ষণ ছিল পাশবিক ধরনের মারামারির খেলার প্রতিযোগিতা। আর ভারতীয় জাহিলিয়াতের বশেস নিদর্শন হচ্ছে সেবা দাসী ব্যবস্থা যা এখন পর্যন্ত চালু রয়েছে। তাতে এই মেয়েরা নিতান্ত বেশ্যা হয়ে মন্দিরসমূহের পরিচর্যার কাজে নিযুক্ত থাকে এবং দেহদানের কাজকে ধর্মীয় কাজ মনে করে। মিসরীয় জাহিলিয়াতের বিশেষ বিশেষত্ব ছিল ফিরাঊনের ইবাদত –দাসত্ব ও আনুগত্য এবং তার খেদমত করতে গিয়ে চরম মাত্রার লাঞ্ছনা ভোগ করতে বাধ্য হওয়া। আর মধ্যযুগীয় জাহিলিয়াতের বিশেষত্ব ছিল গীর্জার সীমালংঘন, বিদ্রোহ, গীর্জার আভ্যন্তরীণ চারিত্রিক উচ্ছৃঙ্খলতা এবং ক্ষমতার সার্টিফিকেট বিতরণ।
অনুরূপভাবে আধুনিক জাহিলিয়াত কতকগুলো যৌথ ও অভিন্ন বিশেষত্বের ধারক হওয়ার সঙ্গে কিছু কিছু পার্থক্যসূচক বিশেষত্বেরও অধিকারী। এখানে সেগুলোর উল্লেখ করা যাচ্ছেঃ
উচ্চমানের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে মানবতাকে আল্লাহর হেদায়েত থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার, পথভ্রষ্ট করার এবং আল্লাহর সৃষ্টিকুলকে চরম দুঃখ-কষ্টে নিমজ্জিত করার কাজে পুরোপুরি ব্যবহার করা।
বৈজ্ঞানিক আবিস্কার ও উদ্ভাবন ও বস্তুগত উন্নতি উৎকর্ষতার নেশায় মত্ত হয়ে মানুষকে আল্লাহর সাথে মোকাবিলায় লাগিয়ে দেওয়া। আর এই কথা মনে করা যে, বর্তমানের এই চরম উন্নীত যুগে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন মানুষের নেই। সেই সাথে এ কথাও যে, একালে স্বয়ং মানুষই আল্লাহ হয়ে গেছে। -বৈজ্ঞানিক মতবাদ ও মতাদর্শসমূহ। বর্তমানে এগুলোই সমাজবিদ্যা, অর্থনীতি ও মনস্তত্ত্ব –জীবনের সকল বিভাগেই মানব জীবনকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে।
-নারী সমাজের স্বাধীনতার নামে চরম মাত্রায় উচ্ছৃঙ্খলতা
এ অধ্যায়ে আমরা আধুনিক জাহিলিয়াতের পার্থক্যসূচক বিশেষত্ব কিংবা অপরাপর অভিন্ন ও সাধারণ বিশেষত্ব পর্যায়ে বিস্তারি আলোচনা করছি না। পরবর্তী অধ্যায়সমূহে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। কিন্তু এ পর্যায়ে আধুনিক জাহিলিয়াত সৃষ্ট মহাবিপদ সম্পর্কে কথা বলছি।
এ জাহিলিয়াত যে সবচেয়ে বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার কারণ এ জাহিলিয়াতের সমর্থনে নিয়োজিত রয়েছে সীমাহীন জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সীমাতিরিক্ত বস্তুগত শক্তি-সামর্থ্য। এ জাহিলিয়াত মানুষের জন্যে কতিপয় সাংস্কৃতিক ও বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা ও আরাম-আয়াসের সরঞ্জাম যোগাড় করে দিয়েছে। এগুলো বাহ্যতঃ খুবই কল্যাণকর মনে হয় বটে! কিন্তু আসলে তা-ই জাহিলিয়াতের বড় ধারক পরিপোষক।
এ কারণেই এ গ্রন্থের ভূমিকায় আমরা বলে এসেছি যে, আধুনিক জাহিলিয়াত ইতিহাসের অন্যান্য সকল জাহিলিয়াতের তুলনায় অধিক কর্দমাক্ত, অধিক জঘন্য এবং অধিক রূঢ়, নির্মম। প্রাচীন জাহিলিয়াতসমূহে ‘বাতিল’ ছিল সুস্পষ্ট, প্রকট। তার বাতুলতা জনতে বুঝতে কোনোই অসুবিধা হতো না। তা সত্ত্বেও প্রাচীন জাহিলিয়াতসমূহে জনগণের বিবেক-বুদ্ধির ওপর মুর্খতার প্রাধান্য ও প্রতিপত্তি থাকত। বাতিল সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা তাদের হতো না বা ছিল না। তখন তারা বুঝতে পারত যে, যে সত্যের আহবান তাদের দেওয়া হচ্ছে, তা নিতান্তই বাতিল ও ক্ষতিকর ছাড়া কিছুই নয়।
এতদসত্ত্বেও সে সব জাহিলিয়াত অজ্ঞতা-মুর্খতা, অন্যায় ও বাতিলের পরিমাণ ও মাত্রা কমই ছিল এবং জাহিলিয়াতের সাথে এক প্রচণ্ড যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব সংগ্রামের শেষে চূড়ান্ত পর্যায়ে হেদায়েতই সাফল্যমণ্ডিত হতো। অতঃপর সত্যকে সত্য বলে চিনে নিতে লোকদের কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতো না। তাদের দ্বিধা-সংকোচেরও কোনো প্রয়োজন দেখা দিত না।
বস্তুগত শক্তিও এই বিপদের অন্যতম দিক।
একথা সত্য যে, ইতিহাসের প্রতিটি জাহিলিয়াতই কোনো-না-কোনো প্রকারের বস্তুগত শক্তির সমর্থনপুষ্ট ছিল। আর তাগুতরা সে শক্তির সহায়তা ও আনুকূল্য নিয়ে মানুষের মনের ওপর আধিপত্য স্থাপক করত। এ কারণেই তাগুতের বলা কথাকে চূড়ান্ত ফয়সালা ও সর্ববাদী সমর্থিত মনে করে নেওয়া হতো এবং সে বিষয়ে কোনো আলোচনা বা বিতর্কের একবিন্দু অবকাশ দেওয়া হতো না। তার পিছনে থাকত যেমন ভয় তেমিন আগ্রহ। কোনোরূপ প্রতিরোধ বা বিরোধিতা ছাড়াই বা তার চিন্তা না করেই তার আধিপত্য ও কর্তৃত্বকে মাথা পেতে মেনে নেওয়া হতো। তা সত্ত্বেও প্রাচীন জাহিলিয়াতে বস্তুগত শক্তি ছি কম ভয়াবহ ও কম মারাত্মক। সংগঠনের দিক দিয়েও তা এখন আজকের মতো সর্ববিধ্বংসী ছিল না।
আজ কেবল সম্পদের প্রাচুর্যই নেই, কেবল ধ্বংসাত্মক অস্ত্রশস্ত্রই নেই। আজ সেই সাথে রয়েছে সংবাদ পৌছানোর ও প্রচার করার ব্যাপক উপায় ও মাধ্যম। মানুষের মন ও মগজকে নির্দিষ্ট একটি দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যে একাত্ম হয়ে লেগে আছে। এরই ফলে আজ লোকেরা বাতিলকেই হক (সত্য) বলে মনে করছে। আর ‘সত্য’কে মনে করছে এক অচিন বা বিরল পাখী, বাস্তব দুনিয়ায় যার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
কেননা মানব সমাজ যতই বিকৃত ও বিপথগামী হোক, তা সর্বতোভাবে বিকৃতির সমষ্টি হতে এমনটা অসম্ভব। হ্যাঁ, ব্যক্তি হয়ত এ রকম হতে পারে, সমস্ত খারাবি তার ওপর বিজয়ী হয়ে দাঁড়াতে পারে এমনভাবে যে, তাতে কল্যাণের একবিন্দু সম্ভাবনাও থাকবে না।
তবে মানব সমষ্টি সম্পর্কে এরূপ ধারণা করা যায় না। তাতে সকল অবস্থায় কিছু না কিছু কল্যাণের দিক অবশ্যই থাকবে। আর মানবীয় মনের এই অবশিষ্ট সৌন্দর্যের কারণে নিকৃষ্টতম অবস্থায়ও প্রতিটি জাহিলিয়াতেই কোনো-না-কোনো বাহ্যিক কল্যাণ ও ভালো দিক অবশ্যই থাকবে। বাহ্যিক এজন্যে বলছি যে, তা কখনও সত্যের আশ্রয় গ্রহণ করে না। সঠিক পথেও তা উৎসারিত হয় না। এই কারণে এই বাহ্যিক সৌন্দর্য ও ভালো দিকও কার্যত বাস্তব জীবনে এসে প্রভাবহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু এই বাহ্যিক সৌন্দর্যই লোকদের চক্ষুকে ঝলসিয়ে দেয় এবং তারা মনে করে –আমরা কোনো জাহিলিয়াতের মধ্যে নেই। যেমন কুরআনে বলা হয়েছেঃ
(আরবী************************************************************************)
তারা মনে মনে ধারণা করে যে, তারা হেদায়েতপ্রাপ্ত লোক। (সূরা আরাফঃ ৩০)
আধুনিক জাহিলিয়াতের এই মহা বিদ্রোহ মানুষের মধ্যে এই চরম মাত্রার ফিতনা ও বিপদ সৃষ্টি করেছে। তা আল্লাহর দ্বীন থেকে বিপথগামী হওয়ার তীব্রতা ও প্রচণ্ডতা থেকেই সৃষ্ট। তাই লোকদের বিপথগামিতার অনুপাতেই তাগুতের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। আর এই কারণেই এ কালের মানুষ আল্লাহর পথ ও পন্থা থেকে অত্যধিক মাত্রায় বিপথগামী হয়ে পড়েছে। মানুষের গোটা ইতিহাসেও এর কোনো নজীর নেই। আর এই কারণেই একালের ‘তাগুত’ অতীতের সকল পর্যায়ের তাগুতদের তুলনায় অনেক বেশী ও উচ্চতর শক্তির অধিকারী হয়ে বসেছে।
মোটকথা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শক্তি ও সংগঠন এ যুগের বিশেষ নিদর্শন এবং এ যুগের প্রতিভার প্রকাশ মাধ্যম। এ সবই আজকের তাগুতের খেদমতে একান্তভাবে নিয়োজিত। একালের তাগুত মানুষকে বিপথগামী বানাবার লক্ষ্যে এগুলো পুরা মাত্রায় ব্যবহার করছে। আর এগুলোও স্বভাবতঃই তারই কাজ করে, যে এগুলোকে নিজের অধীনে বানিয়ে নেয় ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
ভবিষ্যতে মানব সমাজ মহান আল্লাহর দিকে হেদায়েত প্রাপ্ত হয়ে এ সব উপায় উপকরণ ও মাধ্যম মানবীয় কল্যাণের পথে পূর্ণ মাত্রায় ব্যবহার করবে। তখনই প্রকৃত কল্যাণ সাধিত হবে সমস্ত মানব প্রজাতির।
আধুনিক জাহিলিয়াতকে পেয়ে যারা মত্ত ও উল্লসিত, তাদের চিন্তা করা উচিত যে, এই জাহিলিয়াত তাদের অবস্থা ও প্রকৃতিকে কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছে। তাকে চূড়ান্তভাবে ধ্বংসও করেছে। প্রকৃত কল্যাণের সকল পথ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে। আজকের জাহিলিয়াত মাত্র তাদের সম্মুখে যে কল্যাণ নিয়ে এসেছে (তাদের ধারণা অনুযায়ী)-যেমন জীবন-যাত্রার সুখ-সুবিধা; চিকিৎসাগত সামাজিক ও আদালতী সুবিধা যা কিছুই দিয়েছে, মূলত তা সবই তাম্রের কয়েকটা মুদ্রা মাত্র। তাগুত তা মানুষের সম্মুখে ছড়িয়ে দিয়েছে শুধু এই উদ্দেশ্যে যে, সে নিজেকে যেন রক্ষা করতে পারে মানুষের রোষ-আক্রোশের সর্বধ্বংসী আগুন থেকে। যেন জনতা সেগুলো লুটপাট করার মধ্যে মশগুল হয়ে থাকে। আর ওদিকে সে ভয়াবহ তাগুতী রাজত্বের সাথে সাথে জনগণের গর্দানের ওপর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব কায়েম রাখার অবাধ ও নির্বিঘ্ন সুযোগ পেয়ে যায়। সে এমন কর্তৃত্ব, ইতিহাসে যার কোনো তুলনা নেই।
একথা যদি একালের লোকেরা অনুধাবন করতে পারে, তা হলে তারা অবশ্যই বুঝতে পারবে যে, তারা এক সর্বগ্রাসী ও মহাবিধ্বংসী জাহিলিয়াতের করালগ্রাসে পড়ে গেছে এবং এ জাহিলিয়াতকে অবশ্যই খতম করতে হবে, তাকে অবশ্যই খতম হতে হবে। অন্যথায় চূড়ান্ত ধ্বংস থেকে নিস্তার নেই।
পরবর্তী দুটি অধ্যায়ের বর্তমান জাহিলিয়াতের সৃষ্টি নিম্নোদ্ধৃত দুই বিপর্যয় সম্পর্কে কথা বলবঃ
চিন্তার ক্ষেত্রে বিপর্যয়।
বাস্তব কর্মক্ষেত্রে বিপর্যয়।