ইসলাম ছাড়া গতি নেই
প্রখ্যাত দার্শনিক বৈজ্ঞানিক বার্ট্রাণ্ড রাসেল বলেছিলেনঃ শ্বেত চর্মের ব্যক্তিদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের দিন শেস হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি এই কথাটি বলে কোনো অভিনব খবর পরিবেশন করেন নি। আসলে তাঁর এই প্রখ্যাত কথাটির মাধ্যমে বর্তমান পৃথিবীকে বিরাজমান প্রকৃত বাস্তব ও সত্য কথাই প্রচার করেছেন। সমকালীন প্রখ্যাত দার্শনিক তাঁর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে যে মহাসত্য দেখতে পেয়েছিলেন, তা-ই তিনি উক্ত বাক্যটির মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন মাত্র। যদিও সাধারণ মানুষ এই মহাসত্যকে উপলব্ধি করতে পারেনি, তা সত্ত্বেও তাদের নেতৃত্বদানের জন্যে বিপুল সংখ্যক শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী দুনিয়ায় কর্মব্যস্ত হয়ে রয়েছে।
কিন্তু উক্ত দার্শনিকের কথাটিতে পূর্ণ সত্য ধরা পড়েনি। তাতে অবশ্য অতীব আংশিক সত্যেরই স্বীকৃতি রয়েছে। পূর্ণ সত্য ধরা না পরার কারণ তিনি নিজেই তো আধুনিক জাহিলিয়াতের অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে বসবাস করছেন। এই জাহিলিয়াতের ভাবধারা ও চিন্তা প্রবাহ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে থাকা তাঁর পক্ষেও সম্ভব হয়নি। জাহিলিয়াত নিজেই যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তা অনুভব করা তার পক্ষে অসম্ভব রয়ে গেছে।
আসল সত্য হচ্ছে, শ্বেতাংঙ্গদের বিপথগামী এবং তা-ই ধ্বংসের মুখে এসে গেছে। অতঃপর চূড়ান্তভাবে তার অবসান অনিবার্য হয়ে পড়েছে। তাকে রক্ষা করা আর কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।
কিন্তু পূর্ববর্তী অধ্যায়ের শেষ ভাগে যেমন বলেছি, বর্তমান জাহিলিয়াতের অবসানের পর অনিবার্য ও নিশ্চিতভাবেই কল্যাণময় ব্যবস্তা স্বতঃই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, তারও কোনো সম্ভাবনা নেই।
কেননা যে কোনো জাহিলিয়াতের অবসানে জনগণের জন্যে একটি মহাসুযোগ এসে যায় মাত্র। তখন তারা ইচ্ছা করলে কল্যাণময় বিধানের ওপর তাদের জীবনকে পুনর্গঠিত করতে পারে। আর তাও সম্ভব হয় যদি তারা আল্লাহর দেখানো পথে ও পদ্ধতিতে এই ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করে। যদি বিশ্বাস করে যে, এ ব্যবস্থাটি প্রকৃত সত্য এবং তা তাদের মহান আল্লাহর কাছে থেকে এসেছে। তবেই তা তাদের জন্যে মুক্তি ও নিষ্কৃতি পথ হতে পারে –যদি তারা নিজেরাই তা অন্তর দিয়ে সত্য বলে বিশ্বাস করে।
কিন্তু এই সুযোগ ও অবকাশকে যদি তারা গুরুত্ব না দেয়, পৃথিবীতে আল্লাহর পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্যে যদি সঠিক পথে প্রাণপণ চেষ্টা না চালায়, তা হলে সে কল্যাণময় বিধান কখনোই প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। কেননা কোনো বিধানই স্বতঃই মানুষের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় না। আর তা প্রতিষ্ঠিত হয় না। আর তা প্রতিষ্ঠিত না হলে মানুষ অনিচ্ছা সত্ত্বেও এক জাহিলিয়াত থেকে মুক্তি পেয়ে আর একটি জাহিলিয়াতের অধীনে চলে যেতে বাধ্য হয়। বাধ্য হয় এক তাগুতের গোলামীর পরিবর্তে আর এক তাগুতী শক্তির গোলামী করতে।
তবে এবার বর্তমান জাহিলিয়াতের অবসানের পর বিশ্বমানবতা আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়েতের পথ গ্রহণ করবে বলে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে। কেননা এবারে বাছাই করে অন্য কিছু গ্রহণের আদৌ কোনো অবকাশ নেই।
এ জাহিলিয়াতের অধীন দুনিয়ার মানুষ সম্ভাব্য সব কটি ব্যবস্থা ও বিধানেরই বাস্তব পরীক্ষা শেষ করে ফেলেছে, লাভ করেছে সব কয়টি সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিবাদ, সামষ্টিকবাদ, পুঁজিবাদ, কমিউনিজম, সমাজতন্ত্র, ব্যক্তিমালিকানা, সমষ্টিক মালিকানা, রাজতন্ত্র ও অরাজতন্ত্র –মানুষের চিন্তায় আসতে পারে বা এসেছে এমন সব কয়টি ব্যবস্থারই বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষা পূর্ণ মাত্রায় হয়ে গেছে। এখন এমন কিছুই অবশিষ্ট নেই, যার পরীক্ষা নতুন করে করার প্রয়োজন থাকতে পারে। সব কয়টি বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করে ও তার অধীন জীবন যাপন করে তার ভালো বা মন্দ সব কিছুই প্রত্যক্ষভাবে বুঝে নিয়েছে।
মানুষ খাদ্য, পানীয়, আশ্রয়, পরিধেয় ও যৌন প্রভৃতি অনুভবযোগ্য সব কয়টি বস্তুরই পরীক্ষা করেছে, সব কয়টি বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।
মানুষের গড়া সব কয়টি ‘খোদা’র প্রতিই ঈমান এনে মানুষ নিজেই নিজের খোদা হয়ে এবং সকল খোদাকে অবিশ্বাস ও অস্বীকার করেও রূঢ় নাস্তিকতাবাদী জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। কিন্তু কি পেয়েছে মানুষ………?
প্রতিটি অভিজ্ঞতায়ই তার দিশাহারা অবস্থা, তার দুর্ভাগ্য, অস্থিরতা, সম্পর্কসমূহের তিক্ততা যা হয়েছে বা হতে পারে –অত্যধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ কারণে এক্ষেত্রে নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর কোনো অবকাশ-ই নেই, থাকতে পারে না।
এক্ষণে বিশ্বমানবতা এক চূড়ান্ত অবস্থা –চূড়ান্ত ফয়সালার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
হয় আল্লাহ, না হয় চূড়ান্ত ধ্বংস, চিরতরে বিলীন হয়ে যাওয়া …হয় আল্লাহর দেখানো পথকেই শক্ত করে ধরতে হবে নতুবা পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়ে যেতে হবে….।
তবে আমরা তো ভবিষ্যৎ জানি না, মানবতার ভবিষ্যৎ …আগামীকাল…. কি ঘটবে, তা নিশ্চিত অনিবার্য হিসেবে বলা তো কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কেননা তা ‘গায়ব’। আরঃ
(আরবী*****************************************************************************)
বলো, হে নবী! আসমান জমিনে যারা রয়েছে তারা কেউই গায়ব জানে না, তা জানেন একমাত্র আল্লাহ। (সূরা নমলঃ ৬৫)
(আরবী********************************************************************************)
মানুষ আগামীকাল কি অর্জন বা উপার্জন করবে, তা সে জানে না।
(সূরা লোকমানঃ ৩৪)
হ্যাঁ, আমরা গায়ব জানি না, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা আল্লাহর প্রবর্তিত সুন্নাত –নিয়ম-নীতি অধ্যয়ন করতে অবশ্যই পারি, যে সুন্নাত সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই বলেছেনঃ
(আরবী****************************************************************************)
অতীত হয়ে যাওয়া লোকদের মধ্যে আল্লাহর একটা সুন্নাত কাজ করেছে, সে সুন্নাতে তুমি (ভবিষ্যতেও) কোনো পরিবর্তন (বা ব্যতিক্রম) পাবে না।
(সূরা আহযাবঃ ৬২)
আর আধুনিক জাহিলিয়াতের মধ্য দিয়ে মানুষ যে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জণ করেছে, তার প্রেক্ষিতে আল্লাহর সুন্নাত অকাট্যভাবে বলে দিচ্ছেঃ
হয় হেদায়েতের পথ গ্রহণ করো,
না হয়, চূড়ান্ত ধ্বংসের জন্যে প্রস্তুত হয়ে যাও।
জাহিলিয়াত একের পর এক আসে। অবস্থান করে তার মধ্যে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কল্যাণের পরিমাণ অনুপাতে। অতঃপর অকল্যাণ ও অশুভ সীমালংঘন করে, সর্বাত্মকভাবে সবকিছু গ্রাস করে নেয়। তখন সেই পরিবেশ ‘বিক্ষিপ্ত কল্যাণ’ কোণঠাসা হয়ে পড়ে, তার জন্যে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা হয়ে দাঁড়ায়। সেখানে শ্বাস-প্রশ্বাস করা ও অন্ততঃ বেঁচে থাকাও তার পক্ষে সম্ভব হয় না।
ব্যাপার যখন খারাবির এই শেষ সীমায় পৌঁছে যায় ঠিক তখনই আল্লাহ তার মধ্যে হস্তক্ষেপ করেন, তখন ‘পরিবর্তন’ সূচিত হয়। কিন্তু আল্লাহর এই হস্তক্ষেপ হয় মানুষের নিজের চেষ্টা সাধনা অনুপাতে। মানুষ নিজেরা যা করে, আল্লাহ সেই কাজ সফল বা কার্যকর করে দেন মাত্র। এ কথাই বলা হয়েছে এ আয়াতটিতেঃ
(আরবী**************************************************************************)
মানুষ নিজেরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন না করলে আল্লাহ নিজেই কারো অবস্থার পরিবর্তন নিশ্চয়ই করে দেন না। (সূরা রা’আদঃ ১১)
তবে আল্লাহর একটা চূড়ান্ত পর্যায়ের হস্তক্ষেপ রয়েছে। মানুষ যখন সীমালংঘন ও আল্লাহদ্রোহিতার চরম পর্যায়ে পৌঁছায় তখন আল্লাহ ভূমি ধ্বংস ঘটিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধ্বংস করে দেন। কিংবা অন্যভাবে সে সীমালংঘনতার অবসান ঘটান।
আর মানুষ যদি আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে, তাঁর বিধানক অবলম্বন করে, তখন সম্পূর্ণ ভিন্নতর দৃশ্য গোচর হয়। তখন মানুষ দলে দলে আল্লাহর দ্বীনের অধীনতা গ্রহণ করে।
বর্তমানে আমরা এমন দ্বারপথে উপনীত, যেখানে মহান আল্লাহর ইচ্ছার হস্তক্ষেপ সর্বাত্মকভাবে কার্যকর হতে পারে। কেননা বর্তমান দুনিয়ার ক্ষমতাসীন লোকেরা আল্লাহদ্রোহিতার চরম পর্যায়ে পৌছে গেছে। কল্যাণের সবদিক ও বিভাগ এখন এমনভাবে বন্দীদশায় পড়ে গেছে যে, এই তাগুতের অধীন কোনো কিছু করা তার পক্ষে সম্ভবপর হচ্ছে না। এক্ষণে জনগণের বাছাই করার কঠিন মুহুর্ত উপস্থিত।
হয় মানুষ চূড়ান্ত ও সর্বাত্মক ধ্বংসের কবলে পড়বে, সত্য পথ পরিহার করে চলার বর্তমান অবস্থার মধ্যেই যদি তারা থেকে যায় এবং এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন না করে।
না হয় তাকে আল্লাহর দ্বীনের হেদায়েত পূর্ণ মাত্রায় অবলম্বন করতে হবে, তাতেই স্থির হতে হবে, পূর্ণ মানসিক শান্তি, স্বস্তি ও স্থায়িত্ব সেখান থেকেই গ্রহণ করতে হবে।
আমরা অবশ্য মানুষের প্রতি ভালো ধারণাই পোষণ করি। আমাদের বিশ্বাস আছে আল্লাহর নির্ধারণ তাকদীরএর ওপরও। আমরা মহান আল্লাহর কাছে পানাহ চাই এরূপ ধারণা থেকে যে, বিশ্বমানবতা ধ্বংসের পথটিকেই বাছাই করবে।
তাহলে অতঃপর একটি মাত্র পথ বা উপায়ই অবশিষ্ট থাকে। আর তা হচ্ছে ইসলাম। আল্লাহও তাই ঘোষণা করছেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
মানুষ বর্তমানে কঠিন জাহিলিয়াতের মধ্যে পড়ে চরম মাত্রার বিভ্রান্তির আবর্তে হাবু-ডুবু খাচ্ছে। তার দুর্ভাগ্যের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থা এখন তার। তার মনে ভয়াবহ উৎকণ্ঠা, অশান্তি ও অস্থিরতা তাকে প্রকম্পিত করছে। তার জীবন, চিন্তা ও আচার আচরণ সভ্যতা সংস্কৃতি সবকিছুই ছিন্নভিন্ন ও টুকরা টুকরা হয়ে আছে। এই করুণ অবস্থা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে কেবলমাত্র ইসলাম। ইসলাম ছঅড়া মানুষের বাঁচার আর কোনো পথ নেই।
এই কথা কেবল আজকেই যে সত্য ও প্রকট, তা নয়। ইতিহাসের সবকয়টি জাহিলিয়াতেও প্রকৃত মুক্তি কেবল ইসলামের দ্বারাই সম্ভব ছিল।
তবে আমরা এখানে ইসলাম বিস্মৃত বা সংকীর্ণ অর্থে গ্রহণ করিনি। তা আমরা ব্যাপক ও সর্বাত্মক অর্থেই ব্যবহার করছি। আমরা সেই দ্বীন ইসলামের কথাই বলছি, যা নিয়ে এসেছিলেন –প্রচার করেছিলেন হযরত নূহ, হযরত ইবরাহীন, হযরত মূসা ও হযরত ঈসা (আ) এবং সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (স)।
এই দ্বীন ইসলাম সর্বশেষ পর্যায়ে এসে সর্বশেষ নবীর মাধ্যমে পূর্ণত্বপ্রাপ্ত হয়েছে। আল্লাহ এই ঘোষণাটি তার সর্বশেষ কালামের মাধ্যমে দিয়েছেন এই ভাষায়ঃ
(আরবী*******************************************************************************)
আজকের দিনে আমি পূর্ণ পরিণত করে দিলাম তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে, সম্পূর্ণ ও নিঃশেষ করে দিলাম তোমাদের প্রতি আমার এই নেয়ামতকে এবং তোমাদের জন্যে জীবন বিধান হিসেবে আমি ইসলামকেই পছন্দ ও মনোনীত করে দিলাম। (সূরা মায়িদাঃ ৩)
আল্লাহর এ ঘোষণানুযায়ী দ্বীন-ইসলামের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ রূপই পৃথিবীর সকল প্রকারের জাহিলিয়াত থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায়। বিশেষভাবে বর্তমান যুগের এই প্রতিষ্ঠিত জাহিলিয়াত থেকে মুক্তির উপায় এই ইসলাম ছাড়া আর কিছুই নেই, থাকতে পারে না।
জাহিলিয়াত দুনিয়ার যত বিপর্যয় ঘটিয়েছে, ইসলাম তার প্রতিটি জিনিসকে যথাস্থানে প্রতিস্থাপিত করে, যথাযোগ্য মর্যাদা ও গুরুত্ব দিয়ে। ইসলামের এই পুনর্গঠন ও প্রতিস্থাপনের কাজ যেমন ধারণা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, তেমনি বাস্তব আচার-আচরণেও। যেমন রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতিতে তেমনি নৈতিকতায়, শিল্প-সাহিত্য, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে, তেমনি দুই লিঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। জীবনের কোনো একটি জিনিসও ইসলামের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার আওতাবহির্ভূত নয়।
আমরা এ পর্যায়ে এই সব বিষয় সংক্রান্ত ইসলামের মৌল আদর্শ, তাৎপর্য ও ব্যবস্থাপনার ব্যাখ্যা পেশ করব। এই ব্যাখ্যার মাধ্যমে আমরা দেখব, আধুনিক জাহিলিয়াত মানুষের সত্তা ও জীবনকে সর্বাত্মকভাবে ধ্বংস করেছে, তার জীবনের সবদিকে অশান্তি অস্থিরতা ভাংচুর বিশৃঙ্খলতার সৃষ্টি করেছে, কিন্তু দ্বীন-ইসলাম অস্পষ্টতার বদলে স্পষ্টতা, বাকা-চোরা দুর্বল নীতির পরিবর্তে সুদৃঢ় সুষ্ঠু সরল ঋজুপথ প্রতিস্থাপিত করছে। ফলে সামষ্টিকভাবে মানবজীবন পুনর্গঠিত ও সুদৃঢ় হয়ে উঠছে, সমগ্র ও শাখা-প্রশাখা, অংশ ও মূল সবকিছুই সঠিক নির্ভুল ও যথার্থভাবে প্রতিস্থাপিত হয়ে প্রকৃত মানবীয় জীবন হিসেবে গড়ে উঠছে।
এ জাহিলিয়াত আল্লাহ সম্পর্কিত ধারণাকেও বিকৃত করেছে। এই বিশ্বলোক প্রাকৃতিক জগৎ, এখানে জীবন এবং মানুষ কোনো কিছু সম্পর্কেই নির্ভুল ধারণা দেয়নি, দিতে পারেনি। শুধু তা-ই নয় যা ছিল সম্পূর্ণ নির্ভুল, সঠিক, তাকেই বিস্মৃত ও অস্পষ্ট করে দিয়েছে এই জাহিলিয়াত।
এই সংক্রান্ত ধারণা বিকৃত হওয়ার কারণেই এসব ক্ষেত্রে মানুষের কর্মনীতি ও আচার-আচরণও বিকৃত হয়ে পড়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, নৈতিককতা ও শিল্প-সংস্কৃতি কোনো ক্ষেত্রেই মানুষের আচরণ নির্ভুল থাকতে পারেনি।
কিন্তু এই সব সম্পর্কে সঠিক নির্ভুল ধারণা যখন মানব মনে দৃঢ় প্রতিস্থাপিত হবে, সঠিক ও নির্ভুল হবে, তখন এসব বিষয়ও নির্ভুল পথে চলতে থাকবে। থাকবে না কোনো বিকৃতি, ভুল ও বিভ্রান্ত। তার কারণ এই যে, মানুষের বাস্তব আচার-আচরণের মৌল প্রেরণায় উৎস হচ্ছে তার ধারণা ও বিশ্বাস। ধারণা-বিশ্বাস নির্ভুল হলে জীবন-চরণও নির্ভুল হবে, আর ধারণা-বিশ্বাস ভুল হলে জীবনাচরণও অনিবার্য ভাবে ভুল ভ্রান্তিপূর্ণ হবে, তা থেকে রক্ষা নেই।
ইতিহাসের একটি অধ্যায়ে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স)-এর নেতৃত্বে মানবতা একবার জীবন, মানুষ, বিশ্বলোক ও বিশ্বস্রষ্টা সম্পর্কে নির্ভুল ধারণা লাভ করেছিল। মুসলিম উম্মতের মাধ্যমেও সেই নির্ভুল ধারণা বিশ্ববাসীর সম্মুখে উপস্থাপিত হয়েছে, যে মুসলিম উম্মত মুহাম্মদ (স)-এর নেতৃত্বে গঠিত ও তাঁর কাছে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মাথা উঁচু দাঁড়িয়েছিল। এদের সম্পর্কেই বিশ্বমালিক আল্লাহ উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষনা করেছেনঃ
(আরবী************************************************************************************)
তোমরাই হচ্ছে সর্বোত্তম জনগোষ্ঠী, তোমাদেরকে গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্বমানবতার কল্যাণ সাধণের লক্ষ্যে। তোমরা সব ভালো কাজের আদেশ করো, সব মন্দ কাজের নিষেধ করো এবং সর্বাবস্থায়ই আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করে চলো। (সূরা আলে ইমরানঃ ১১০)
এ তো সেই সময়ের কথা, যখন বাস্তবিকই মুসলিম উম্মত সঠিকরূপে গড়ে উঠেছিল, তাদের জীবনের সব দিক সঠিকভাবে গঠিত ও পুনর্গঠিত হয়েছিল। তা ছিল মানবতার ইতিহাসে এক সর্বাত্মক আন্দোলন। সে আন্দোলনের স্রোত প্রবাহে সব আবর্জনা ভেসে গিয়েছিল। সবকিছু হয়েছিল পরিচ্ছন্ন, পূত ও পবিত্র। এ আন্দোলন ছিল আল্লাহর হেদায়েত ভিত্তিক। দুনিয়ার সর্বত্র আল্লাহর বিধান ব্যাপকভাবে প্রচার করার মাধ্যমে জাহিলিয়াতের অবসান ঘটানো হয়েছিল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও এই মুসলিম উম্মত আল্লাহর পথ থেকে ক্রমশ ও ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে ও বিপথগামী হতে থাকে। যদিও তারা ছিল নীল আকাশের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা, পৃথিবীর প্রতিটি দিক উজ্জ্বল উদ্ভাসিত করে দিচ্ছিল তারা। মানুষকে শিক্ষাদান করছিল আল্লাহর বিধান, তাদের পরিচালিত করছিল সঠিক, নির্ভুল ও ভারসাম্যপূর্ণ পথে। কিন্তু পথে তাদের পরিচালিত করছিল সঠিক, নির্ভুল ও ভারসাম্যপূর্ণ পথে। কিন্তু পরে তাদের নিজেদের ভেতরেই অবক্ষয় শুরু হয়ে যায়। ত্যাগ করে আন্দোলন। গতিশীলতা ও কর্মতৎপরতা হারিয়ে ফেলে। আর ঠিক এই সময়েই তাদের ওপর চেপে বসে আধুনিক জাহিলিয়াত। তার বাড়াবাড়িপূর্ণ ও সীমালংঘনমূলক আচরণ তাদেরকে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। আর শেষ পর্যন্ত তারা দ্বীন ইসলাম থেকেই বের হয়ে যায় এবং জীবনের সমগ্র ক্ষেত্রে অনুসরণ করতে থাকে।–[‘আমরা কি মুসলমান’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।]
আজকের মুসলমানদের ব্যাপার যা-ই হোক, ইসলাম তো কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর হাতে বন্দী নয়, নয় একান্তভাবে তাদের ওপর নির্ভরশীল। ইসলাম তো আল্লাহর ‘নূর’ এবং তা সব মানুষের জন্যে। প্রতিটি মানুষের জন্যেই তার দ্বার সদা উন্মুক্ত। আল্লাহর ঘোষণাঃ
(আরবী*******************************************************************************)
হে নবী, আপনাকে তো নির্বিশেষে সমগ্র মানুষের জন্যে সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শন করে পাঠিয়েছি। (সূরা সাবাঃ ২৮)
হে নবী, আপনাকে সারাজাহানের জন্যে রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি। (সূরা আম্বিয়াঃ ১০৭)
আধুনিক জাহিলিয়াত যত বিপর্যয়ের সৃষ্টি করুক না কেন, ইসলাম তাকে সহীন নির্ভুল ও ত্রুটি-বিচ্যুতিমুক্ত করে দেবে।
সব কয়টি জাহিলিয়াত সবচেয়ে বড় যে বিকৃতি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে এবং তদ্দরুন জনগণের আকীদা, ধারণা ও বাস্তব জীবনাচরণে যে বিপর্যয় সংঘটিত হয়েছে, আসল কারণ হচ্ছে মানুষের জীবনে নেমে এসেছে যে দুর্ভাগ্য, হতাশা, বিভ্রান্তি ও অস্থিরতা, তার প্রকৃত ইলাহ সম্পর্কেই ভুল ধারণা। ‘ইলাহ’ সম্পর্কিত এই ভুল ধারণার কারণেই আল্লাহর ইবাদ থেকে মানুষের বিপথগামিতা ঘটেছে। জীবন কেবলমাত্র আল্লাহর দেওয়া পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমেই সেই ইবাদত বাস্তবায়িত হতে পারত। কিন্তু সেই পদ্ধতি থেকেও তাদের বিচ্যুতি ঘটেছে।
এই মূল কেন্দ্রবিন্দু থেকেই ইসলামের সূচনা। এখান থেকেই শুরু হয় ইসলামের সংশোধন, পুনর্গঠন ও প্রতিস্থাপনের অভিযান।
বিশৃঙ্খলভাবে নয়, দুর্ঘটনা হিসেবেও নয়, বিশেষ পরিকল্পনার ভিত্তিতে কুরআন সুদীর্ঘ তেরটি বছর শুধু একটি মাত্র ব্যাপারেই –যা মৌল ও আমল অতিবাহিত করেছে। এই পর্যায়ে তার যে একটি মাত্র কাজ ছিল, তা হচ্ছে আল্লাহ সম্পর্কিত নির্ভুল বিশ্বাস সৃষ্টি, আকীদাকে যথার্থরূপে গড়ে তোলা।
তদানীন্তন আরব সমাজ গভীর পৌত্তলিকতায় নিমজ্জিত ছিল, কেবল এই কারণেও নয়। তা ছাড়াও আসল কারণ ছিল, যা সব কিছুরই পূর্বে সম্পাদিত হওয়া একান্তই বাঞ্ছনীয় ছিল। কেননা আকীদাকে কেন্দ্র করেই তো মানুষের গোটা জীবন গড়ে ওঠে সুবিন্যস্ত হয়। মানবমনে যতক্ষন পর্যন্ত এই ব্যাপারটি যথার্থভাবে শক্ত হয়ে গড়ে না উঠবে, মনে ও মগজে তা সুদৃঢ়ভাবে না বসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সমগ্র জীবন প্রাসাদটি সঠিকরূপে গড়ে তোলা কিছুতেই সম্ভবপর হতে পারে না। প্রাসাদ শক্ত ও স্থিতিশীলও হতে পারে না। সমগ্র জীবন প্রাসাদ তো এই ভিত্তির ওপরই গড়ে উঠতে পারে।
আধুনিক জাহিলিয়াতের বাস্তবতায় আমরা এই সহাসত্যের সত্যতার অকাট্য প্রমাণ দেখতে পাচ্ছি। কেবলমাত্র আল্লাহ সম্পর্কিত ধারণাটি বিপর্যস্ত হওয়ার দরুন সমগ্র মানুষের গোটা জীবনটাই কি ভাবে বিপর্যয়ের গ্রাসে পড়ে গেল, তা আমরা এখানে লক্ষ্য করতে পারছি। এরই কারণে মানুষের জীবন পথ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। তাদের পক্ষে নির্ভুল হেদায়েতের দিকে ফিরে আসা আর সম্ভবপর হয়নি, কোনো স্থির আকীদাকে স্থায়ীভাবে আঁকড়ে ধরা এবং তার দরুন মনে-মগজে পূর্ণ নিশ্চিন্ততা ও স্থিরতা লাভও তাদের ভাগ্যে জুটেনি।
ঠিক এই কারণেই মক্কায় অবতীর্ণ কুরআন কেবল আল্লাহ সম্পর্কিত সঠিক ধারণার কথা জনগণকে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছে। প্রধানত এই আকীদা সঠিক করা ছাড়া মক্কায় কুরআনের আর কোনো লক্ষ্য বা কাজ ছিল না।
এই আকীদার নির্ভুল হওয়ার পর এরই ভিত্তিতে যখন একটি সমাজ গঠিত হলো, অতঃপর মদীনায় একটি ইষলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন কুরআন দ্বিতীয় পর্যায়ে আইন ও বিধান নাযিল করার ও তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দানের কাজ শুরু করল। সে আইন বিধান ছিল ইবাদত সম্পর্কে, ছিল ‘মুয়ামিলাত’ (পারস্পরিক কার্যাদি) সম্পর্কে। মুসলিম উম্মতের ওপর ধার্য করা ফরযসমূহও তাতে বর্ণিত হয়েছে। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলিম উম্মতকে বৃহত্তর মানব গোষ্ঠীর জন্যে করণীয় দায়িত্ব যথার্থরূপে পালনযোগ্য করে তৈরি করা। কিন্তু তাই বলে এ পর্যায়েও হয়নি। কেননা কুরআনের আইন বিধানকে বাস্তবভাবে মেনে চলা ও অনুসরণ করা সম্বভ হতে পারে, যদি আকীদা সঠিক থাকে। এ ব্যাপারটি সব সময়ই শেষ মুহুর্ত পর্যন্তও অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে লেগে রয়েছে। বরং তা-ই ছিল ভিত্তি, তার ওপর আইন-বিধান স্থাপিত হয়েছে জীবনের যাবতীয় আচরণে ও মুয়ামিলাতে।–[সাইয়েদ কুতুব লিখিত ‘ফী যিলালিল কুরআন’ সূরা মায়িদা, সূরা আনআম ও সূরা আরাফ দ্রষ্টব্য।]
আল্লাহ সম্পর্কিত ধারণা ইসলাম সুস্পষ্টরূপে উপস্থাপিত রয়েছে। বলেছে, তিনিই স্রষ্টা, তিনিই বিশ্বলোক ব্যবস্থাপক পরিচালক, তিনিই মৌলিকভাবে রিযিকদাতা, তিনিই সবকিছুর মালিক, তিনিই সার্বভৌম, আর তিনিই একমাত্র মা’বুদ।
অতীব সহজ পদ্ধতিতে, সরল ভাষায় স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে এসব জরুরী কথা।
বলেছে, তিনি ছাড়া কেউ ইলাহ নয়, নেই। সমগ্র বিশ্বলোকেও তিনি ছাড়া ইলাহ অন্য কেউ নেয়, মালিকও কেউ নেই। বিশ্বব্যবস্থাপকও কেউ নেই। মালিকানা, রিযিকদান বা সৃষ্টি ও ব্যবস্থাপনা পরিচালন কোনো ক্ষেত্রেই তাঁর শরীক কেউ নেই, তিনি লা-শরীক।
অতএব তিনি ছাড়া মা’বুদও নেই, থাকতে পারে না। সমগ্র বিশ্বলোকে তিনিই একমাত্র –একা তিনি-ই মা’বুদ।
এই সহজ সরল সংক্ষিপ্ত স্পষ্ট আকীদার ওপরই গোটা দ্বীন-ইসলাম দাঁড়িয়েছে। আর এই দ্বীন নিয়েই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে মুসলিম উম্মত। শুরু থেকে এই মুসলিম উম্মতের ইতিহাসই হচ্ছে ইসলামের ইতিহাস।
আল্লাহ মহান, পবিত্র তাঁর একার ‘ইলাহ’ হওয়ার অর্থ-ই হল, সমস্ত সৃষ্টি একমাত্র তাঁরই বান্দা, তিনিই একমাত্র মা’বুদ। আসমান, জমিন এবং তাতে যারা এবং যা কিছুই আছে সবকিছুরই স্রষ্টা ও মা’বুদ তিনি ছাড়া কোথাও কেউ নেই।
সেই সাথে আরও একটি সহজ সরল সংক্ষিপ্ত বিষয় হচ্ছে, তিনি একাই যখন স্রষ্টা, একাই মালিক, রিযিকদাতা, সার্বভৌম, তখন সৃষ্টিলোকের কোনো জিনিসই তিনি ছাড়া আর কাকে মা’বুদ বানাতে পারে? তাঁকে ছাড়া আর কার দাসত্ব করা সম্ভব মানুষের পক্ষে?
কে আছে তেমন……….?
কে, মানুষ? মানুষ কি? মানুষ কি এক আল্লাহরই একটি সৃষ্টি নয়? আল্লাহ-ই-তো তাকে শক্তি দিয়েছে, স্থিতিশীল বানিয়েছেন। তারই কল্যাণে তিনি নিয়ন্ত্রিত করেছেন, কর্মে নিয়োজিত রেখেছেন আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী এবং তাতে যা কিছু আছে, সবকিছুকেই। মানুষই কি সৃষ্টি করেছে এই আসমান জমিন এবং তাতে যেখানে যা আছে, তা সব? সমগ্র প্রাকৃতিক জগত নিরংকুশ ও নিরবচ্ছিন্নভাবে যে আইন ও নিয়ম-কানুন মেনে চলছে, তা কি মানুষ তৈরি করেছে? ….জারী করেছে? তা মানতে সবকিছুকে বাধ্য করেছে? সে সব নিয়ম ও আইনে একবিন্দু পরিবর্তন করার কোনো শক্তি বা ক্ষমতা কি মানুষের আছে? ‘বস্তু’ বা ‘জড়’ এর যা মৌলিক বিশেষত্ব, সেগুলোকে বাদ দিয়ে নতুন কোনো বিশেষত্ব সৃষ্টি করে দেওয়া কি মানুষের পক্ষে সম্ভব? …আছে মানুষের সাধ্য? আল্লাহর কার্যকর করা এসব প্রাকৃতিক নিয়মকে বাদ দিয়ে ভিন্নতর কোনো নিয়মের ওপর বিশ্বলোককে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষমতা কি মানুষের আছে?…….
না, তা নেই, তা আছে কেবলমাত্র এক আল্লাহর।
তাহলে সেই এক আল্লাহ ছাড়া আর কে মা’বুদ হতে পারে?
আল্লাহর মা’বুদ হওয়ার ব্যাপারে তাঁর সাথে শরীক হওয়ার যোগ্যতা আর কা-র আছে? ….কারোর আছে কি?
কে সে…..?
নিশ্চিত অনিবার্যতার?…. নিশ্চিত অনিবার্যতা কি? কে নিশ্চিত অনিবার্য বানিয়েছে?…. তাকে সত্য মেনে নিলেও প্রশ্ন জাগে, তাকে এই নিশ্চিত অনিবার্যতার মর্যাদা কে দিয়েছে? …তা কি সারা সৃষি।টলোকে আল্লাহর ‘নির্ধারণ’ নয়? মানুষ ও সব জিনিস তা মেনে চলছে –মেনে চলতে বাধ্য হচ্ছে কেন? …..তা নিশ্চিত অনিবার্য হয়ে থাকলে তা তো শুধু এই কারণে যে, আল্লাহ তার ‘নির্ধারণ’ করেছেন। তা স্বতঃই তো আর নিশ্চিত অনিবার্য হতে পারেনি। আল্লাহ তাই চেয়েছেন বলেই তা হয়েছে। তাহলে আল্লাহ ছাড়া মা’বুদ আর কে হতে পারে? আল্লাহর সাথে শরীক মা’বুদ কে হতে পারে?
কে?……………..
একমাত্র আল্লাহ ছাড়া মানুষ আর কাকে মা’বুদ বানাবে, গোটা সৃষ্টিলোক তিনি ছাড়া আর কার দাসত্ব করবে?
এই মা’বুদ হওয়ার অনিবার্য দাবি হচ্ছে, সার্বভৌমত্ব কেবলমাত্র সেই এক আল্লাহর জন্যেই নির্দিষ্ট হতে হবে। আর আইন-দর্শনের মৌল কথা হচ্ছে, সার্বভৌমের আদেশ-নিষেধই হচ্ছে আইন, অতএব আল্লাহর কাছ থেকেই যাবতীয় আইন-বিধান গ্রহণ করতে হবে।
মানুষের ইতিহাসে সৃষ্ট প্রতিটি জাহিলিয়াতই এই বিষয়ে বিশেষ বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।
এমনকি যে জাহিলিয়াত দাবি করত যে, তা আল্লাহকে জানে, চিনে, এমনকি, যে জাহিলিয়াত দাবি করত যে, আল্লাহর দাসত্ব বা ইবাদত করে, এমনকি, যে জাহিলিয়াত মনে করত যে, তা সত্যিকার ইবাদত করছে আল্লাহর জন্যে। …এই সব কয়টি জাহিলিয়াতই এই সার্বভৌমত্ব ও আইনের উৎস পর্যায়ে বিরাট বিতর্কের অবতারণা করেছে। এই সব কয়টিরই ধারণা হচ্ছে আল্লাহর দাসত্ব করা –তাঁর মা’বুদ হওয়া এক কথা, আর সার্বভৌমত্ব কেবল এক আল্লাহর –এই স্বীকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। আল্লাহর কাছ থেকেই আইন গ্রহণ এবং তাঁর কাছে ছাড়া আর কারোর কাছ থেকে আইন গ্রহণ না করার ব্যাপারটির সাথেও কেবল তাঁরই ইবাদত করার সাথে কিছুমাত্র সম্পৃক্ত নয়।
আসলে,
(আরবী********************************************************)
ওরা আল্লাহকে যথাযথ মর্যাদা দেয়নি, দিতে পারেনি। (সূরা আন’আমঃ ৯১)
তাদের ধারণানুযায়ী তারা ইবাদত তো করে এক আল্লাহর, তাহলে তারাই আবার জীবন বিধান গ্রহণ করে অন্য কারোর কাছ থেকে, তা কি করে সম্ভব হচ্ছে? আল্লাহ যদি তাদের জন্যে আইন না-ই দেন, কিংবা তিনি যদি বলে দিয়ে থাকতেন যে, তোমরা নিজেরাই তোমাদের জন্যে প্রয়োজনীয় আইন বানিয়ে নাও, তাহলে না হয় একটা কথা হতে পারত।
না, তা নয়। আল্লাহ তো শুধু সৃষ্টি করেই শেষ করেন নি। তিনি তো মানুষের জন্যে আইনও দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমার দেওয়া আইন তোমরা মেনে চলো। তাঁর ঘোষণা হচ্ছেঃ
(আরবী*************************************************************************)
যারাই আমার নাযিল করা আইন অনুযায়ী বিচার-ফায়সালা ও রাষ্ট্র পরিচালনা করবে না, তারাই কাফের। (সূরা মায়িদাঃ ৪৪)
(আরবী****************************************************************)
যে লোকেরাই আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করে না, তারাই ফাসেক। (সূরা মায়িদাঃ ৪৭)
(আরবী***********************************************************************)
যে সব লোকই আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিচার-ফয়সালা করে না, তারাই জালেম। (সূরা মায়িদাঃ ৪৫)
(আরবী*******************************************************************************)
এবং হে নবী! শাসন প্রশাসন চালাও লোকদের মধ্যে সেই বিধান অনুযায়ী যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং লোকদের কামনা-বাসনা ইচ্ছার অনুসরণ করো না। আর তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকো –নিজেকে তাদের থেকে বাঁচাও, এই দিক দিয়ে যে, তারা তোমার প্রতি আল্লাহর নাযিল করা কোনো কোনো আইনের ব্যাপারে তোমাকে বিপদে ফেলতে পারে। (সূরা মায়িদাঃ ৪৯)
এতসব স্পষ্ট অকাট্য নির্দেশ ও ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর নাযিল করা বিধানকে বাদ দিয়ে লোকেরা কি একান্ত নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার ভিত্তিতে শাসন প্রশাসন (হুকুমত) চালাতে পারে, আইন জারী করতে পারে? …কার অধিকার আছে তা করার?
কুরআন মজীদে এই ব্যাপারটিকে খুব বেশী গুরুত্ব দিয়েছে। তাই বারবার স্পষ্ট ভাষায় আইন প্রসঙ্গের প্রতিটি সূরা বা আয়াতে ঘোষণা দিয়েছে যে, আইন প্রণয়ন কেবলমাত্র আল্লাহর অধিকারের ব্যাপারে। তিনিই ইলাহ এবং আইন কেবল তাঁরই চলবে, চলতে পারে। তিনি আইন দিয়েছেনও। আল্লাহকে একমাত্র ‘ইলাহ’ মানা হলে আইনও কেবল তাঁরই কাছ থেকে নিতে হবে। আর আল্লাহ ছাড়া ইলাহ যদি আর কেউ না হয়ে থাকে, তা হলে আইন-দাতাও কেবল তিনিই হবেন, অন্য কেউ হতে পারবে না। এ দুটি মর্যাদা একই সময় স্বীকৃতব্য। ‘ইলাহ’ একা তিনি, অতএব সার্বভৌম ও আইনদাতাও তিনি একাই। অতএব এ দুনিয়ায় আইনদাতা হিসেবে আল্লাহর সাথে কেউ-ই শরীকও হতে পারে না, ‘ইলাহ’ হওয়ার ব্যাপারে তাঁর সাথে কেউ-ই শরীক নেই। এর বিপরীত হলে আল্লাহর সাথে শিরক করা হবে। শরীককারী হবে মুশরিক। আর তার অনুসারী লোকেরাও মুশরিক রূপে গণ্য হবে।–[ফী যিলালিল কুরআন, ৬-৮ খণ্ড।]
জাহিলিয়াতের একটি সবচেয়ে বড় ও মারাত্মক পর্যায়ের গুমরাহী হচ্ছে ‘শরীয়ত’ (আইন)-কে আকীদা (ঈমান) থেকে বিচ্ছিন্ন করা –আল্লাহকে ‘সার্বভৌম’ রূপে না মেনে ভিন্ন এক সত্তাকে সার্বভৌম রূপে চিহ্নিত ও নির্দিষ্ট করা।
আর এরই ফলে মানব জীবন আল্লাহদ্রোহীতা ও সীমালংঘনমূলক কার্যকলাপের দাপটে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে।
বিগত শতাব্দীসমূহের বাস্তব অভিজ্ঞতার এটাই ফলশ্রুতি।
বস্তুত আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ যখন মানুষের জন্যে আইন রচনা করে, তখন সে নিজেকে ‘ইলাহ’ বানিয়ে নেয়। নিজেকে ‘ইলাহ’ মনে না করলে তার পক্ষে কোনো জিনিস হালাল আর কোনো জিনিস হারাম ঘোষণা করা সম্ভব হতে পারে না। আর আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কেউ ‘ইলাহ’ হবে –নিজেকে ‘ইলাহ’ বানিয়ে নেবে, কার্যত সে-ই ‘তাগুত’ হয়ে বসবে। কুরআনের ভাসায় সে-ই তাগুত, যে আল্লাহর বিধানকে বাদ দিয়ে হুকুম চালায়। কুরআনে তাকে (আরবী*******) বলা হয়েছে সর্বাবস্থায়ই। এই (আরবী******) ‘ব্যক্তিগত মানসিক কামনা-বাসনা’ এক ব্যক্তির হতে পারে, একটি শ্রেণীর হতে পারে, একটি জনসমষ্টির হতে পারে, হতে পারে ক্ষমতাসীন ও শাসক উম্মতের। আধুনিক জাহিলিয়াতের বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণে আমরা দেখেছি, মানুষ মানুষের ওপর শাসনকার্য চালাতে গিয়ে যে কিভাবে ‘তাগুত’ হয়ে বসেছে। আর মানুষ যখন আল্লাহর পরিবর্তে তার দাসত্ব ও হুকুম পালনে রাজি হয়েছে, যখন তাকে আল্লাহ ছাড়া আল্লাহর বিধান ছাড়াই আইন রচনার ও অর্ডার অর্ডিন্যান্স জারী করার অধিকার দিয়েছে, তখন সকল ব্যাপারই মানুষের ইবাদতে পরিণত হয়েছে, মানুষের যিল্লাতীর আর কোনো সীমা পরিসীমা থাকেনি। তাগুতী শক্তি প্রবল বিক্রমে মানুষকে তারই মতো মানুষের দাসানুদাস হয়ে জীবন যাপন করতে বাধ্য করেছে।
এ পর্যায়েও এই অভিজ্ঞতা ছাড়া ভিন্নতর কোনো অভিজ্থতা হতে পারে না। এই অভিজ্ঞতা লাভ করা গেছে ধর্মহীন গণতন্ত্রে ও স্বৈরতন্ত্রে সমানভাবে।
ইসলাম আল্লাহ ও সার্বভৌম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা উপস্থাপিত করেছে। সে ধারণা সংকীর্ণ বা সীমাবদ্ধ নয়। তা বিস্তীর্ণ ও ব্যাপক সমগ্র বিশ্বলোক, প্রাকৃতিক জগৎ, জীবন ও মানুষ সবকিছু পরিব্যাপ্ত।
প্রাকৃতিক জগৎ ‘ইলাহ’ নয়। নয় উদ্দেশ্যহীন ও ব্যবস্থাপকহীন কোনো সৃষ্টি। তা নিজের ইবাদত করেনা। তা নিজের জন্যে থেকেই কোনো নিশ্চিত অপরিহার্যতা লাভ করেনি। তার অস্তিত্ব ও অস্তিত্বের নিশ্চিত অনিবার্যতা একমাত্র আল্লাহ থেকেই পাওয়া গেছে।
আল্লাহ-ই তা সৃষ্টি করেছেন। এই কারণে সে স্বতঃই আল্লাহর বান্দা ও ইবাদতকারী। আল্লাহর বিধান মেনে ও অনুসরণ করেই তা চলছে। আল্লাহর জারীকৃত নিয়মই তার জন্যে প্রাকৃতিক নিয়ম।
এরশাদ হয়েছেঃ
(আরবী*****************************************************************)
অতঃপর ভারসাম্যপূর্ণভাবে স্থিত হলেন আকাশমণ্ডলে, তখন তো ছিল ধুম্র। পরে তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, এসে যাও, ইচ্ছাপূর্ণক হোক বা বাধ্য হয়ে হোক। জবাবে দুটিই বলল, হ্যাঁ, আমরা এসে গেছি স্বতঃস্ফুর্তভাবে আনুগত্যশীল হয়ে। (সূরা হা-মীম-আসসিজদাঃ ১১)
বস্তুত বিশ্বলোক তথা প্রাকৃতিক জগৎ নিরর্থক সৃষ্টি করা হয়নি, তাৎপর্যহীনভাবেও নয়। তা সৃষ্টি করেছেন পরম সত্যতা সহকারে।
(আরবী*********************************************************************************)
আল্লাহ তা’আলা আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী এবং এ দুয়ের মাঝে যা কিছু আছে তা পরম সত্যতা ছাড়া অন্য কোনোভাবে সৃষ্টি করেন নি।
(আরবী********************************************************************************)
এবং আমরা আকাশ ও পৃথিবী এ দুইয়ের মাঝে যা কিছু আছে তা তাৎপর্যহীনভাবে সৃষ্টি করিনি।
(আরবী*******************************************************************************)
নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি ও রাত্র দিনের আবর্তনে সেই বুদ্ধিমান লোকদের জন্যে বিশেষ নিদর্শন সমূহ নিহিত রয়েছে, যারা আল্লাহর যিকির করে দাঁড়িয়ে, বসে ও পার্শ্বে শায়িত অবস্থায় এবং চিন্তা করে আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টির ব্যাপারে। (প্রকৃত যথার্থতা অনুধাবন করে বলে ওঠে) –হে আমাদের রব্ব, তুমি এই সবকিছু নিরর্থক সৃষ্টি করোনি, তুমি অতীব মহান, পবিত্র….।
কোন পরম সত্যতা সহকারে এই বিশ্বলোক –আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী –সৃষ্টি করেছেন, তার পরিধি ও ব্যাপ্তি কতদূর, তা অনুধাবন করার বুদ্ধিশক্তি মানুষের নেই।
বিবেক-বুদ্ধিগত অনুভূতি শক্তি মানুষকে যেখানে পৌঁছাতে পারে না, সেখানে হেদায়েতপ্রাপ্ত রূহ মানুষকে পৌঁছিয়ে দেয়, পৌঁছিয়ে দেয় আল্লাহ পর্যন্ত। কেননা ‘রূহ’ ও বিশ্বলোক পারস্পরিকভাবে এই জীবন্ত চির সক্রিয় অনুভূতিতে সমানভাবে শরীক রয়েছে যে, উভয়ই আল্লাহর ইবাদতে মশগুল ও ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছে। উভয়ই স্বীয় স্রষ্টার দিকে উন্মুখ। উভয়ের অস্তিত্বের উৎস কেবলমাত্র আল্লাহ –আল্লাহর মহান সত্তা। এই কারণে রূহ অনুধাবন করতে পারে, আল্লাহ কিভাবে বিশ্বলোককে ‘পরম সত্যতা সহকারে’ সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবী ও আকাশমণ্ডলে এই পরম সত্যের গভীরতা ও বিশ্বলোকে এই সত্যের ব্যাপকতা বিশালতা কতটা, তা-ও।
অতঃপর মানুষের জ্ঞঅন যতই বৃদ্ধি পায়, বিশ্বলোকে বিশালতা-বিস্তীর্ণতা সম্পর্কে আরও অধিক ধারণা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এই জ্ঞান সেই মহান সত্য পরিব্যাপ্ত করতে অসমর্থ। কেননা মানুষের এ জ্ঞান বাহ্যিক জগৎ সম্পর্কিত যে মহান বিরাট সত্যতার ভিত্তিতে আল্লাহ তা’আলা বিশ্বলোক, জীবন ও মানুষের সৃষ্টি করেছেন, তা ‘রূহ’-ই অনুধাবন করতে পারে, মানবীয় বিবেক নয়।
জীবন সৃষ্টিও উদ্দেশ্যহীন ও নিরর্থক নয়ঃ
(আরবী***************************************************************************************)
তোমরা কি মনে করে নিয়েছ যে, আমরা তোমাদেরকে উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেছি আর এই কারণে তোমরা আমার কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে না?
ইসলাম জীবন সংক্রান্ত বিষয়াবলী নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ও স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করেনি, জীবনকে পূর্ণাঙ্গ রূপেই সম্মুখে নিয়ে এসেছে। স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে যে, মানুষের জীবন পরিপূর্ণ, পূর্ণাঙ্গ ইহকাল ও পরকাল এই দুইটি ভাগকে নিয়েই। তা যেমন অভিনব, তেমনি তা উদ্দেশ্যপূর্ণ। সকল প্রকার বাতুলতা, অর্থহীনতা, উদ্দেশ্যহীনতা ও নিরর্থকতা থেকেই ইসলাম অতীত পবিত্র।
দুনিয়ার জীবনটাই তার একমাত্র জীবন নয়। এই জীবনে যা কিছু প্রকাশমান তা-ই চূড়ান্ত নয়, ঘটনাবলীর বিবর্তন তাতেই নয়। অন্যথায় তা বাতিল ও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে যেত।
দুনিয়ার জীবনটা জীবনের প্রথম ভাগ –অগ্রবর্তী অংশ মাত্র। এই প্রাথমিক জীবন অংশের যাবতীয় কার্যকলাপের ওপর প্রবর্তিত হয় তা তার ফল। পরকালীন জীবনের পরিণতি ফলশ্রুতি, অতএব তা-ই প্রকৃত ও পরম সত্য জীবন।
(আরবী**************************************************************************************)
পরকালীন উপরভাগে যা কিছুই আছে তার শোভা ও চাকচিক্যের অলংকারূপে বানিয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের পরীক্ষা করা এই দিক দিয়ে যে, তাদের মধ্যে সর্বোত্তম আমলকারী কে। (সূরা কাহাফঃ ৭)
(আরবী*******************************************************************************)
আমরা তোমাদের ভালো ও মন্দ দিয়ে পরীক্ষা করব, আমার দিকেই তো তোমারা প্রত্যাবর্তিত হবে। (সূরা আম্বিয়াঃ ৩৫)
(আরবী**********************************************************************************)
সেই আল্লাহই মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে যে, তোমাদের মধ্যে উত্তম আমলকারী কে? (সূরা মুলকঃ ২)
(আরবী***********************************************************************)
এবং আল্লাহ আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী পরম সত্যতা সহকারে সৃষ্টি করেছেন। উদ্দেশ্য এও যে, প্রত্যেককে তার উপার্জন অনুযায়ী কর্মফল দেওয়া হবে এবং তাদের ওপর কোনো জুলুম করা হবে না। (সূরা জাছিয়াতঃ ২২)
(আরবী*****************************************************************************)
প্রতিটি প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে। আর তোমাদের কর্মফল পুরা মাত্রায় দেওয়া হবে কেয়ামতের দিন। (সূরা-আলে ইমরানঃ ১৮৫)
এই হচ্ছে জীবন সম্পর্কে ইসলামের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ ধারণা। মানব মন এ সম্পর্কে পূর্ণ মাত্রায় আশ্বস্ত। কেননা মানুষ যখন বুঝতে পারে যে, এই জীবনটাই সবকিছু নয় –এখানেই ভালো বা মন্দের চূঢ়ান্ত রূপ দেখা যাবে না, এর পরও আর একটি জীবন –জীবনেরই আর একটি পর্যায় রয়েছে, তখন সে একদিকে ইহকালীন জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাদ-আনন্দে পাগলের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে না –এই জীবনটাই যদি চূড়ান্ত ও সবকিছু হতো, তাহলে এখানের কোনো কিছু থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখতে মানুষ কিছুতেই রাজি হতো না, যা কিছু পাওয়া নেওয়া সম্ভব, তাই পেতে ও নিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করত। এ সুযোগ হারাতে কিছুতেই প্রস্তুত হতো না।
অপরদিকে মানুষ এই স্পষ্ট আকীদার ইসলামের কারণে দ্বিখণ্ড বিশিষ্ট জীবন দর্শনের দরুন নৈরাশ্য ও হতাশার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পায়। কেননা মানুষ যখন এই দুনিয়ার নিপীড়ন-বঞ্ছনা ও বিপর্যয় দেখতে পায়, দুনিয়ার দুঃখ-দুর্দশা, অস্থিরতা ও আযাবের স্বাদ গ্রহণ করে, মনে করে অবস্থার পরিবর্তন হওয়া এখন আর সম্ভব নয়, এই জুলুমের প্রতিকার যেমন কিছু করার নেই, না এই দুর্ভাগ্যের দূর করার কোনো উপায় আছে, তখন মানুষ এই অবস্থার প্রতিকারের উদ্যোগী না হয়ে নিরস্ত্র-নিশ্চেষ্ট হয়ে যায় এবং নৈরাশ্য ও হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে। ইসলামের পরকাল বিশ্বাস মানুষকে এই অবস্থা থেকে রক্ষা করে।
এরূপ পরকাল বিশ্বাসের তৃতীয় কল্যাণময় দিক হচ্ছে মানুষের মন কখনোই ভেঙ্গে পড়ে না। ইনসাফ ও সুবিচার পাওয়ার ওপর তার ভরসা কখনোই নিঃশেষ হয়ে যায় না। তার আমল ও চরিত্রও বিনষ্ট হয় না। পরকাল বিশ্বাস না করলে নিজের ওপরই জুলুম করা হয়, জুলুম করে ও জুলুম সহ্য করে। লক্ষ্য হাসিলের জন্যে সকল পন্থা ও উপায় অবলম্বন করে, কিন্তু সে উপায় ও পন্থা পবিত্র হয় না যেমন, তেমনি লক্ষ্যও হয় না সুস্থ, সঠিক।
চতুর্থ এই যে, পরকাল বিশ্বাসের দরুনই মানুষ আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহর সাথে পবিত্র-স্বচ্ছ সাক্ষাৎ লাভের আশায় নিজের সমস্ত আমল পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে নেয়।
এই কারণেই ইসলাম পরকালের উল্লেখ করেছে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে। কুরআন মজীদ পরকালীন সংঘটিতব্য দৃশ্যাবলী বার বার তুলে ধরেছে, পরকালীন জীবনের সাথে এই জীবনের গভীর সম্পর্কের কথা বলেছে, পরকালীন জীবনের কল্যাণ ইহজীবনের সঠিক আমলের শর্ত আরোপ করেছে। ইহজীবনের ভিত্তি নির্ভুল আদর্শের ওপর স্থাপনের তাগিদ করে।
বস্তুত ইসলাম মানুষকে এক অভিনব ও ভিন্নতর রূপরেখায় পেশ করে। মানুষ ‘ইলাহ’ নয়, জন্তু-জানোয়ার ও শয়তানও নয়। মানুষ মানুষই, মানুষ ছাড়া অন্য কিছু নয়। মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি। সমগ্র সৃষ্টির ওপর মানুষকে আল্লাহ তা’আলা বিশেষ মর্যাদা ও ইযযত-সম্মান দিয়েছেন। তাকে নিজের খলীফা বানিয়েছেন।
জাহিলিয়াত মানুষ পর্যায়ে বড্ড দিশেহারা। কখনও তাকে ‘ইলাহ’ বানিয়েছে, কখনও বানিয়েছে জন্তু-জানোয়ার। আবার কখননও তাকে নিশ্চিত বাধ্যবাধকতার ও অনিবার্যতার দেবতাগণের সম্মুখে নিকৃষ্ট-হীন-লাঞ্ছিত দাসানুদাস বানিয়ে রেখেছে।
কিন্তু ইসলাম মানুষকে সঠিক ও যথার্থ মর্যাদা দিয়েছে। তাতে যেমন বিকৃতি বা বিপথগামিতা নেই, প্রকৃত সত্য রাজপথ থেকে একবিন্দু বিচ্যুতিও নেই তাতে।
(আরভী******************************************************************************)
স্মরণ করো, তোমার রব্ব যখন ফেরেশতাদের বললেনঃ আমি পৃথিবীতে খলীফা নিয়োগকারী। (সূরা বাকারাঃ ৩০)
(আরবী**************************************************************************)
তোমার রব্ব যখন ফেরেশতাদের বললেন, আমি মাটি থেকে একজন মানুষ সৃষ্টি করব। তবে যখন তাকে পুরোপুরি বানালাম এবং তার মধ্যে আমার থেকে রূহ ফুঁকে দিলাম, তখন তারা সকলে তাঁর জন্যে সিজদায় পতিত হলো।
(সূরা সোয়াদঃ ৭১-৭২)
(আরবী********************************************************************************)
এবং নিশ্চয়ই আমরা আদম বংশ সম্মানিত বানিয়েছি এবং তাদের বহন করে নিয়ে গেছি স্থল ও জলভাগে। আর তাদের পবিত্র জিনিস পত্রগুলো রিযক হিসেবে দিয়েছি এবং তাদের উন্নত মর্যাদাবান বানিয়েছি আমার অনেক সৃষ্টির ওপর। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৭০)
(আরবী*************************************************************************************)
এবং তিনিই তোমাদের আকার-আকৃতি দিয়েছেন এবং খুবই উত্তম বানিয়েছেন তোমাদের আকার-আকৃতি। (সূরা তাগাবুনঃ ৩)
ইসলাম মানুষকে মলিনতা পংকিলতার মধ্যে নিক্ষেপ করেনি, যেমন করেছে জাহিলিয়াত। তবে মানুষের জন্মের মৌল উপাদানের নিকৃষ্টতার কথা বলেছে।
(আরবী***************************************************************)
আমরা মানুষকে পঁচা-গলা মাটির শুষ্ক গুড়া দিয়ে সৃষ্টি করেছি।
(সূরা হিজরঃ ২৬)
(আরবী********************************************************************)
আমরা কি তোমাদেরকে মূল্য ও মর্যাদাহীন জলীয় পদার্থ থেকে সৃষ্টি করিনি?
(সূরা মুরসালাতঃ ২০)
মানুষের প্রথম সৃষ্টিকালীন ব্যবহৃত ‘পচা-গলা মাটি’ ও পরে ‘অপবিত্র তরল পদার্থ’-এর মতো হীন ও সামান্য জিনিস আর কি হতে পারে? ডারউইনও অবশ্য মানুষকে জন্তু জানোয়ারের বংশধর প্রমাণ করতে চেয়ে মানুষকে হীন নীচ বানিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু আল্লাহর ওহী কুরআন মানুষের প্রাথমিক সৃষ্টি প্রসঙ্গের উল্লেখ করে যা বলেছে, তার লক্ষ্য এই নয় যে, মানুষের এই হীনতা নীচতাকে প্রকট করে দুনিয়ায় মানুষকে দিশাহারা জীবন যাপনে বাধ্য করা হবে –ডারউইন মানুষকে জন্তু জানোয়ারের বংশধর বলে তাকে দিশাহারাই বানিয়ে দিয়েছে। কুরআন তো সৃষ্টির পর্যায়সমূহের উল্লেখ করেছে এবং প্রথম পর্ব যদিও হীন ও নীচ; কিন্তু তার পরবর্তী সৃষ্টিকর্মের মহান সত্য ও গভীরে নিহিত তত্ত্বসমূহ মানুষকে বিশিষ্ট ও উন্নত সৃষ্টি প্রমাণ করেছে। কুরআনের ঘোষণায় মানুষকে অতী উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন, তুলনাহীন, সুন্দর আকার-আকৃতি ও গুণ-বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন এবং আল্লাহর পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফার মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার কথা উদাত্তভাবে বলেছে। তাকে আল্লাহ অর্পিত মহান আমানতের ধারকও বলা হয়েছে।
কুরআনের বর্ণনার এই বিশ্লেষণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উদঘাটিত হয়েছেঃ আল্লাহর মহানত্ব, বিরাটত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব এবং মানুষের উচ্চ মর্যাদাশীল হওয়া –বস্তুত এই দুটি সত্যই মানুষকে আল্লাহর সাথে সংশ্লিষ্ট রাখে, আল্লাহর খিলাফতের উচ্চ মর্যাদা অর্জনের যোগ্য বানিয়ে দেয় তাকে, সেই সাথে একথাও যে, মানুষ যেন অহংকার ও আত্মগৌরবে মত্ত হয়ে না যায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ মাটি –বস্তু ও রূহ –এই দুই উপাদানের সমন্বয়। উভয় দিকের প্রকৃতি ও ভাবধারা মানব সত্তায় বিরাজমান। এ দুইয়ের সংমিশ্রণ মানুষের ক্ষেত্রে চিরন্তন, কখনোই শেষ হবে না, এ সংমিশ্রণ কখনোই ছিন্ন হয়ে যাবে না।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ কেবলমাত্র মাটির সৃষ্টি নয়। তাই প্রস্তর ও জন্তুকুল মানুষ গণ্য হতে পারে না। মানুষ নিছক ‘রূহ’ সৃষ্টো নয়। ফলে সে ফেরেশতা গণ্য হবে না, হবে না ‘ইলাহ’।
মাটি-জড় পদার্থ ও রূহ এ দুইয়ের সমন্বয়ে সৃষ্ট হওয়ার কারণেই মানুষ এই সৃষ্টি লোকের অন্যান্য সব জিনিসের অপেক্ষা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্বসম্পন্ন।
এই বিশেষত্বের দরুন মানুষ যেমন ঊর্ধ্বপানে উন্নতি লাভের যোগ্যতার অধিকারী, তেমনি নিম্বের দিকে পতন গ্রহণের যোগ্যতাও তার আছে। বলা হয়েছেঃ
(আরবী***************************************************************)
শপথ মানুষের প্রাণের এবং সেই মহান সত্তার, যিনি তাকে ঠিকটাক ভারসাম্যপূর্ণ বানিয়েছেন, পরে তার দুষ্কৃতি ও পরহেযগারী উভয় ভাবধারা তার মধ্যে সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এখন সাফল্য পেয়েছে যে, যে তার নফসকে পবিত্র পরিশুদ্ধ করেছে, আর ব্যর্থ মনোরথ হয়েছে সে যে তাকে খারাপ ও ধ্বংস করেছে।
(সূরা আস-শামসঃ ৭-১০)
(আরবী***************************************)
এবং আমরা তাকে দুটি খাঁটি পথ দেখিয়েছি। (সূরা বালাদঃ ১০)
(আরবী*************************************************************************)
আমরা মানুষকে পথ দেখিয়েছি –হয় শোকর আদায়ের, নয় কুফরের। (সূরা দাহরঃ ৩)
মানুষের এই জড় উপাদানা ও রূহ-এর সংমিশ্রণজনিত বিশেষত্বেই নিহিত রয়েছে মানুষের পরীক্ষা গ্রহণ ওতার কর্মফল দেওয়ার নিগূঢ় তত্ত্ব। কেননা মানুষ হীনতার দিকেও যেতে পারে, যেতে পারে উচ্চতর মহানত্বের দিকেও। এই কারণেই তাকে এই দুনিয়ায় কর্মের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, যেন পরকালে তার যাবতীয় কাজের হিসাবান্তে প্রতিফল দেওয়া যেতে পারে।
মানুষকে এছাড়াও উচ্চতর জগত থেকে আরও অতিরিক্ত কতগুলো বিশেষ বিশেষত্ব দান করা হয়েছে।
আল্লাহ মানুষকে এই পৃথিবীতে তাঁর খলীফা নিযুক্ত করেছেন। সেই সাথে খিলাফতের দায়িত্ব পালনোপযোগী উপায়-উপকরণও তাকে দেওয়া হয়েছে।
(আরবী*********************************************************************)
এবং আমরা আদমকে সমস্ত নাম শিক্ষাদান করেছি। (সূরা বাকারাঃ ৩১)
(আরবী************************************************************************************)
এবং বানিয়েছি তোমাদের জন্যে শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তঃকরণ।
(সূরা নহলঃ ৭৮)
মানুষ এই সব উপায়-উপকরণের –যা মহান আল্লাহর বিশেষ দান –সাহায্যে পৃথিবী আবাদকরণ, পুনর্গঠনের কাজ করে এই দুনিয়ায় আল্লাহর অর্পিত খিলাফতের দায়িত্ব পালন করবে। আর যে আমানত বহনের দায়িত্ব কেউ-ই গ্রহণ করেনি, করেছে শুধু মানুষ, সেই একক দায়িত্ব যথাযথ পালনের ব্যবস্থা করবে।
(আরবী***********************************************************************************)
আমরা উপস্থাপিত করেছি আমানত আকাশমণ্ডল, পৃথিবী ও পর্বতের কাছে, এ সবই সে আমানত গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে এবং সে ব্যাপারে এসব ভয় পেয়েছে। পরে মানুষ তা বহন করতে স্বীকৃত হয়েছে……।
(সূরা আহযাবঃ ৭২)
এই আয়াতসমূহে বলা স্পষ্ট কথাসমূহের অনিবার্য দাবি হচ্ছে মানুষকে এই পৃথিবীতে এক সক্রিয় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে, কোনো নির্বোর্ধ অবিবেচক সত্তা হিসেবে কতগুলো অর্থহীন নিশ্চিত অনিবার্যতার নিয়মাধীন হয়ে থাকা তার জন্যে কিছুমাত্র বাঞ্ছনীয় নয়। মানুষ এই সবের কাছে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হতে থাকবে, তা মানুষ সম্পর্কে অকল্পনীয়। বস্তু পৃথিবীতে আল্লাহর ‘নির্ধারণ’ মানুষের কাজ ও তৎপরতার মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আল্লাহ মানুষের কাজকেই উপায় ও মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
(আরবী****************************************************************************)
নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জনগোষ্ঠীর অবস্থা পরিবর্তন করে দেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজেরাই নিজেদের অবস্থার সাধন করছে।
(সূরা রা’আদঃ ১১)
(আরবী****************************************************************)
মানুষের পরস্পরককে পরস্পরের দ্বারা আল্লাহর প্রতিরোধ করার কাজটি সদা সক্রিয় না থাকলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। (সূরা বাকারাঃ ২৫১)
আল্লাহ গোটা বিশ্বপ্রকৃতিকে মানুষের জন্যে কর্মে নিরত করে রেখেছেন। এই দৃষ্টিতে মানুষই হচ্ছে বিশ্বপ্রকৃতির আপেক্ষিক কার্যকারণ।
(আরবী****************************************************************************)
এবং তোমাদের জন্যেই আকাশমণ্ডল ও পৃথিবীতে যা যা আছে তার সব কিছুকেই জোরপূর্বক কর্মে নিরত করে রেখেছেনঃ (সূরা জাছিয়াহঃ ১৩)
ইসলামী মতাদর্শ মানুষকে এই উচ্চতর মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছে। তাই মানুষ আল্লাহর শত্রু হয়ে বসবাস করে না, তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েও থাকে না। এটাই স্বাভাবিক, বরং এই উচ্চতর মর্যাদায় পৌঁছে মানুষ আল্লাহকে অধিকতর ভয় করে এবং ভালোবাসেও বিপুলভাবে।
মানুষের জন্যে মহান আল্লাহর এই তুলনাহীন দান ও অনুগ্রহ মানুষের কাছে শোকর ও গভীর পরিচিতির দাবি করে। তাই হয় মানুষের স্বাভাবিক কর্তব্য। কেননা মানুষ নিজেই নিজেকে এইসব মহাদানে ধন্য করেনি, করতে পারেনি। সে নিজেই নিজেকে আল্লাহর খলীফা বানায়নি। সে নিজেই নিজেকে সৃষ্টিও করেনি। আল্লাহ নিজেই যদি মানুষকে সৃষ্টি করার সংকল্প না করতেন, তাহলে তাতে আল্লাহর কিছুই আসত না, কোনো ক্ষতি-বৃদ্ধি হওয়ার বিন্দুমাত্র কারণও ছিল না। আল্লাহ মানুষকে যে সীমা-সংখ্যা ও পরিমাপহীন দান দিয়েছেন, তা না দিয়ে তা অর্জন করার কোনো শক্তি-সাধ্যই ছিল না মানুষের। এরূপ অবস্থার এতসব দান-অনুগ্রহ পেয়ে মানুষের একনিষ্ঠ কর্তব্য হতে পারে মহান আল্লাহর অকৃত্রিম শোকর আদায় করা, তাঁর একনিষ্ঠ বান্দা হওয়া। আল্লাহ বিরোধিতা করা, তাঁর সাথে বিন্দুমাত্র শত্রুতা করা বা তাঁর সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া কখনোই বাঞ্ছনীয় হতে পারে না। গ্রীক জাহিলিয়াত এবং বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াতের ওপর মানুষ ও আল্লাহর পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে দীর্ঘ গভরি কালো ছায়া বিস্তার করেছে, ইসলামে আল্লাহ ও মানুষের পারস্পরিক ক্ষেত্রে তা যেমন অবাঞ্ছনীয়, তেমিন কল্পনারও অতীত।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ এক সুসংবদ্ধ সত্তা। তার জন্মগত প্রকৃতিও ঠিক তাই। অতএব মানুষ সংমিশ্রণের মৌল উপাদান ‘মাটি’ ও ‘রূহ’ –এই দুইয়ের মাঝে কখনোই বিচ্ছিন্নতা আসতে পারে না, বিচ্ছিন্নতা ভিত্তিক কোনো মতবাদ গ্রহণযোগ্যও হতে পারে না। বিচ্ছিন্নর্ভাবে শুধু দেহ কোনো কাজেরই নয়, নয় ‘রূহ’ এই দুনিয়ায় টিকে থাকার বা কোনো কাজ করার উপযোগী। অতএব মানুষের চেতনা ও বাস্তব কাজ, চিন্তা-বিশ্বাস আকীদা ও ব্যবহারিক আমল এই দুইয়ের মধ্যেও কোনো বিচ্ছিন্নতা পার্থক্য বা বৈপরিত্য স্বীকৃত নয়। মানুষের আমল ও চরিত্র হতে হবে পার্থক্যহীন। মানুষের আদর্শ হবে এক আর কাজ হবে ভিন্নতর, তাও বাঞ্ছনীয় নয়। তার আকীদার সাথে শরীয়ত অবিচ্ছেদ্য এবং তার দুনিয়া ও আখেরাত –ইহকাল ও পরকাল অভিন্ন।
এ এক সমন্বিত সত্তা, এক অভিন্ন মর্যাদার সৃষ্টি তার দেহ ও রূহ –দেহসত্তা ও আত্ম-সত্তা একই মুহুর্তে অভিন্ন, পার্থক্যহীন। তার চেতনা ও বাহ্যিক আচার-আচরণ মিলিত হয়েই এক অভিন্ন সত্তা গড়ে ওঠে। তা একই সময় চেতনাভিত্তিক আচরণ, চেতনাজনিত আচরণ, যা চেতনা, তা-ই তার আচরণ। আমল ও চরিত্র পরস্পর বৈপরিত্যহীন। তা হচ্ছে অবিচ্ছিন্ন কর্মীর চরিত্র বা চরিত্রমূলক কর্ম। মানুষের আকীদা ও শরীয়াত সমন্বিত হয়েই ‘দ্বীন’ এক অবিচ্ছিন্ন জীবন বিধান।
মানুষের ইহকাল ও পরকাল তার সুদীর্ঘ ও অশেষ জীবনের দুইটি পর্যায় অভিন্ন, পরস্পরের পরিপূরক এ দুটির মধ্যে বিচ্ছেদ ও বিভিন্নতার কোনো স্থান নেই।
মানুষ এক পুরোপুরি ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বিত সত্তা, বস্তুতপক্ষেও তার ভারসাম্যপূর্ণ হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
দেহ রূহ-এর ওপর বিজয়ী হবে না। বাস্তবে হবে না চিন্তার ওপর প্রভাবশালী, ব্যক্তিতান্ত্রিক ভাবধারা সামষ্টিকতার ভাবধারাকেও প্রভাবিত করবে না, তা বিপরীতটাও নয়। তার নেতিবাচক প্রবণতা ইতিবাচক প্রবণতাকে করবে না বিজিত, পরাজিত। তার দুনিয়া হবে না তার পরকাল বিনষ্টকারী। তাকে মাটির দিকে টেনে নিতে পারবে না, পারবে না ঊর্ধ্ব আকাশ পানে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে। উভয় দিকের তীব্র আকর্ষণ ঠিক তেমনি ভারসাম্যপূর্ণ করে রাখবে, যেমন মাধ্যাকর্ষণ ভারসাম্যপূর্ণ করে রেখেছে সূর্য ও পৃথিবীকে, পৃথিবী ও চন্দ্রকে।
আর এই মহান ভারসাম্যতাই ভারসাম্যপূর্ণ বানিয়ে দেয় ব্যক্তিকে, সমষ্টিকে, ধারণা-বিশ্বাস আদর্শ ও বাস্তব আচার-আচরণ ও বাস্তব কার্যাবলীকে। বস্তুত মানুষের হৃদয় মনে যখন এই সুস্পষ্ট উজ্জ্বল ও আলোকোজ্জ্বলকারী চিন্তা-বিশ্বাস-ধারণা দৃঢ়মূল হয়ে বসবে, তখন তার গোটা জীবন ও পৃথিবীর বুকে সরল ঋজুপথে সুদৃঢ়-অবিচলভাবে চলবে অব্যাহতভাবে।
মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ (স) এই ভারসাম্যপূর্ণ জীবন বিধানের ধারক ছিলেন। তাঁর মনে ও মগজে সুদৃঢ়ভাবে বসেছিল এই চিন্তা-বিশ্বাস এবং তিনি নিজের চেষ্টা ও প্রশিক্ষণে গড়ে তুলেছিলেন অনুরূপ ভারসাম্যপূর্ণ এক আদর্শ জনগোষ্ঠী –উম্মতে মুসলিমা। ফলে পৃথিবীতে এমন বিস্ময়কর ঘটনাবলী সংঘটিত হতে থাকল, যার কোনো দৃষ্টান্ত মানবেতিহাসে পাওয়া যায় না।
আরবের ছিন্নভিন্ন ও জাহিলিয়াতে নিমজ্জিত অসংখ্য গোত্র-কবীলা এই ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাদর্শ গ্রহণ করে এক অভিন্ন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল আর তাই হচ্ছে উম্মতে মুসলিমার ইতিহাস।
আবহমান কাল থেকে চলে আসা জাহিলিয়াত প্রভাবিত মানুষ তাদের প্রাচীনতম প্রীতি আকর্ষণ ও ঝোঁক-প্রবণতা পরিহার করে। বদলে যায় তাদের আদত অভ্যাস, পরিচিতি ও জীবনাচরণ। তাদের বিকৃতি কামনা-বাসনা, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও কিংবদন্তী সবকিছু হয়ে যায় আমূল পরিবর্তিত। তারা সমানভাবে দাঁড়িয়ে যায় আল্লাহর প্রদর্শিত সীরাতে মুস্তাকীম-এর ওপর। দুনিয়ায় জেগে ওঠে এক সম্পূর্ণ নতুন ধরনের নতুন প্রকৃতির ও নতুন স্বভাব চরিত্রের মানুষ। ইসলামই এই মানুষদের একমাত্র জীবনাদর্শ, ইসলামই তাদের নিয়ামক নিয়ন্ত্রক। এ যেন হঠাৎ করে জন্ম নেওয়া এক নতুন মানবগোষ্ঠী; মানব জন্ম সার্থক হয়ে উঠল।
এই মুসলিম উম্মাহ এক অভিনব পন্থা ও পদ্ধতিতে নিজেদের ও নিজেদের বাস্তব জীবন গড়ে তোলে। সে পন্থা ও পদ্ধতির কোনো নিদর্শন অতীতে ছিল না। কোনো অতীত ধারাবাহিকতারও উত্তরসূরী ছিল না তারা। সে পরিবেশের অভ্যাস আজও আচার-আচরণ বা জাহিলী রীতিনীতিরও ছিল না কোনো প্রতিফলন। নিতান্ত প্রয়োজনের কারণেও তা হয়নি, যেমন পৃথিবীতে অসংখ্য প্রকারের প্রয়োজন বা ঐতিহাসিক কার্যকারণ দেখা দিয়ে থাকে।
এই মুসলিম উম্মত সকল ‘তাগুত’-এর গোলামী থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়েছিল। তা পরিবেশ বা পরিস্থিতিগত কোনো কারণে নয়। বৈষয়িক কারণে এক-একটা জনগোষ্ঠীর যেমন স্বাধীনতা লাভ হয়, এটা তেমনও নয়।
তা হলে এই বছরগুলোর মধ্যে কি পরিবর্তনটা সাধিত হলো?
ইসলাম ছাড়া আর কিছু কি তাদের এই নবতর জীবন গড়েছে?
ছিল ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো আদর্শ?
ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু কি এই লোকগুলোকে আল্লাহ সম্পর্কিত ধারণাকে পরিচ্ছন্ন ও আবিলতা মুক্ত করেছিল? …অথচ এই মানবতাই বর্তমান বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত আল্লাহ সম্পর্কিত ধারণা-বিশ্বাসে চরম দিশাহারা অবস্থায় পড়ে আছে, তা থেকে মুক্ত হয়নি।
মানুষের নিরংকুশ দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে তাদের মুক্তিলাভের মূলে কি কারণ নিহিত ছিল? …মানুষ তো অনৈসলামী পরিবেশে এই দাসত্বের নিগড়ে বন্দী হয়ে আছে, পরস্পর পরস্পরের দাসত্ব করে চলছে। মানুষ মানুষের অধীনতা করছে, মানুষ মানুষের জন্যে ইচ্ছামতো নিজেদের কামনা-বাসনা ও প্রয়োজন মতো আইন রচনা করছে, আর তা-ই অন্ধভাবে নির্বাক হয়ে মেনে চলেছে মানুষ। মানুষ মানুষেরই কাছে নিতান্ত অসহায় হয়ে আছে, বিনয়াবনত হয়ে সিজদায় ভূ-লুণ্ঠিত হয়ে পড়ছে তাদেরই মতো অন্য মানুষের কাছে। মানুষ চালিত রাষ্ট্রে সরকারের দাপট –অত্যাচার-নিপীড়নে মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত। স্বৈরতান্ত্রিক অর্ডার-অর্ডিনেন্স মানুষকে দাসানুদাস বানিয়ে রাখছে। মূলধন তথা পুঁজিবাদী শোষণে মানুষের কাছেই মানুষ অসহায়, রক্তশূন্য। তাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রদায়ণবাদী শোষণ নির্যাতন চলছে সমানভাবে। কেউ তাদের এ মর্মান্তিক অবস্থা থেকে রক্ষা করতে পারছে না, এগিয়ে আসছে না মুক্তিদূত হিসেবে নবতর কোনো আদর্শ বা জীবন বিধান।
মানুষ ছিল তার চরম মাত্রায় লালসার দাস। উম্মতে মুসলিমা এই দাসত্ব শৃঙ্খল থেকেও সম্পূর্ণ মুক্তিলাভ করেছিল। কিন্তু কে –কোন জিনিস তাদের মুক্তি দিয়েছিল? ….অথচ মানুষ তো অনৈসলামী সমাজে চিরকালই লালসার নিকৃষ্ট দাস হয়ে জীবন যাপন করেছে চিরকাল এবং এখনও করছে ইসলাম গ্রহণ না করার কারণে। আর আল্লাহর থেকে বিপথগামী হলেই লালসার দাস হওয়া মানুষের পক্ষে অনিবার্য পরিণতি। এই দাসত্বের তীব্রতা, গভীরতা ও ব্যাপকতা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে।
কেননা পরিবর্তনের কারণে মানুষ বিশ্ব প্রকৃতির বুকে হঠাৎ করে যথার্থ মর্যাদা পেয়ে গেল? অথচ ইসলামের পূর্বে এই মর্যাদা ছিল না। অনৈসলামী সমাজে মানুষকে তো কখনও দেবতার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, বাস্তবতার সাথে যার কোনো সম্পর্ক বা সামঞ্জস্যই নেই, যা একান্তই অন্তঃসারশূন্য, ধোঁকা মাত্র। কখনও মানুষকে এই বিশ্ব প্রকৃতির হীন নীচ গোলাম বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কখনও নিশ্চিত অনিবার্যতা মানুষকে আরও অধিক মাত্রার মলিনতা ও পুঁতিগন্ধময় আবর্জনার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মানুষ এই সব লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, অসহায়তা ও অক্ষমতা বাতিল সরকারের মানুষকে বরদাশত করতে হয়েছে।
তা ছাড়া ইসলামের যুগে হঠাৎ করে মানুষের নৈতিক চরিত্রের কেননা জিনিস বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন এনে দিল? –সব অনৈতিকতার পবিত্রহীনতা থেকে মানুষ মুক্তি পেয়ে গেল? –সব অনৈতিকতার পবিত্রহীনতা থেকে মানুষ মুক্তি পেয়ে গেল? অথচ অনৈসলামী সমাজে মানুষ চিরকাল পবিত্রহীন হয়ে থাকতেই বাধ্য হয়েছে। সেখানে কেবলমাত্র স্বার্ত ও সুযোগ-সুবিধা লাভই হয়ে থাকতেই বাধ্য হয়েছে। সেখানে কেবলমাত্র স্বার্থ ও সুযোগ-সুবিদা লাভই হয়ে রয়েছে মানুসের চরিত্রের ভিত্তিতে।
ব্যক্তি ও সমষ্টির পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যাপারটি অত্যন্ত পুরাতন। কোনো দিনই সঠিক ছিল না, ভারসাম্যহারাই ছিল সর্বত্র। কিন্তু ইসলামের সূচনাতেই হঠাৎ করে সব ঠিক হয়ে গেল। ব্যক্তি বুঝল সমাজ সমষ্টির গুরুত্ব, সমাজ সমষ্টি বুঝল ব্যক্তির গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা। কিন্তু গায়র ইসলামী সামজে এই সম্পর্ক কখনও বাম দিকে ঝুঁকে পড়েছে, কখনও ডান দিকে। কখনও ব্যক্তি সমাজ কর্তৃক নিষ্পেষিত হয়েছে, কখনও সমাজ সমষ্টি হয়েছে ব্যক্তির দাপটে তার অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত।
নারী ও পুরুষের সম্পর্কেই বা এই পরিবর্তন হঠাৎ করে ঘটল কি করে? অথব অনৈসলামী সমাজে বিশ্বমানবতা এই সম্পর্কের ভুলের কারণে চরম দুরবস্থার মধ্যে পড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে। এই সম্পর্ক একটা বাস্তবিক ব্যাপার হিসেবেই গণ্য করা হয়েছে। মানুষ তাতে শান্তি বা স্বস্তি –অন্তরের তৃপ্তি কখনোই পায়নি। ফলে মানুষের শক্তি-সামর্থ্য নিঃশেষ হয়ে গেছে।
তখন কোন শক্তি শাসককে –সে ব্যক্তি হোক, শ্রেণী হোক, জাতি হোক স্বেচ্ছাচারিতার সাথে শাসনকার্য চালাতে নিষেধ করেছেও তা থেকে বিরত রেখেছে? স্বেচ্ছাচারিতা ও সীমালংঘনমূলক আচরণ গ্রহণ করতে দেয়নি? –অথচ ইসলাম ছাড়া যত সমাজই ছিল ও আছে, সর্বত্রই ‘তাগুত’ চরম স্বেচ্ছাচারিতা সহকারেই শাসনকার্য চালিয়েছে, কোনো শাসনতন্ত্র বা মানবতাবাদ তাকে তা থেকে বিরত রাখতে পারেনি, তা তথাকথিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই হোক, কি কোনো নির্লজ্জ স্বৈরতন্ত্র।
তাহলে এই কয়টি বছরে কেমন করে সব ওলট-পালট হয়ে গেল? …তেমন কিছুই না। …সবকিছুর মূলে একটি মাত্র কারণই ছিল এবং তা হচ্ছে মত-আদর্শ-আকীদা-চিন্তা ও বিশ্বাস নির্ভুল হওয়া, ঠিক হওয়াই তার একমাত্র কারণ। তা-ই যেমন মানুষের মন ও মগজকে ঠিক করেছে, তেমনি তা-ই মানুষের আচার-আচরণ কর্মতৎপরতা –গোটা জীবনকেই সঠিক ও দৃঢ় ভিত্তিক করে দিয়েছিল।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) নিজের সম্মুখে রেখেও সর্বপ্রকারের চেষ্টা-যত্নের মাধ্যমে যে মুসলিম উম্মতকে গড়ে তুলেছিল, তা ছিল আল্লাহর কাছ থেকে আসা ওহীভিত্তিক। তাদের সবকিছুই ঠিক তাই, যা আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে নাযিল করেছিলেন।
লোকদের জিন্দেগীতে এক বিস্ময়কর দৃঢ়তা ও অবিচলতা এনে দিয়েছিল। হ্যাঁ, অস্বীকার করছি না, তখনও মানুষের মধ্যে স্বভাবগত দুর্বলথা ছিল। কেননা তাঁরা মানুষ, ফেরেশতা নয়। কিন্তু একটি আদর্শকে পুরোপুরি গ্রহণ করে তার ভিত্তিতে নিজেদেরকে গড়ে তোলার সর্বোচ্চ-সর্বশেষ চেষ্টা যা হতে পারে, তা তাঁরা করেছিলেন। তাঁরা পুরোপুরিভাবে ইসলামী আদর্শের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
তখন মানুষের পরস্পরের মধ্যে এক বিস্ময়কর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাই বলে মানবীয় দুবর্লতা থেকেও তাঁরা মুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন এমন দাবি করা হচ্ছে না।
প্রতিটি মানুষই নিজেই নিজের জন্যে বেশি কল্যাণ চাইবে, এ তো স্বাভাবিক। আল্লাহ নিজেই বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************)
মানুষ কল্যাণ, ধন-মালের লোভে অত্যন্ত শক্ত। (সূরা আল-আদিয়াতঃ ৮)
এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক প্রবণতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও তখনকার লোকেরা পরস্পরের জন্যে নিজেদের হৃদয়কে সম্পূর্ণ পরিচ্ছন্ন, নিষ্কলুষ, একনিষ্ঠ ও উদার আন্তরিক বানিয়েছিলেন। সে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা এত উচ্চমানের ছিল, যার কোনো দৃষ্টান্তই ইতিহাসে পাওয়া যেতে পারে না।
(আরবী*************************************************************************)
যারাই তাদের কাছে হিজরত করে এসেছে তাদের অন্তর দিয়ে ভালোবাসে, তাদের হৃদয়ে কোনো হিংসা বোধ করে না, যা সেই মুহাজিরদের দেওয়া হয় তার প্রতি এবং তাদেরকে তারা নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয়, তারা নিজেরা অভুক্ত থাকলেও। (সূরা হাশরঃ ৯)
(আরবী*************************************************************************)
মুমিন লোকেরা পরস্পর ভাই (এছাড়া আর কিছু নয়) (সূরা হুজরাতঃ ১০)
(আরবী************************************************************************)
মুমিন পুরুষ ও নারী পরস্পরের পৃষ্ঠপোষক-সাহায্যকারী। (সূরা তওবাঃ ৭১)
এই মুসলিম উম্মত যে মানবিক চেতনা লাভ করেছিল, তা ছিল নির্বিশেষে সামষ্টিক মানবতা।
(আরবী***********************************************************************)
কোনো জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে এই অপরাধে অপরাধী বানাতে না পারে যে তোমরা তাদের প্রতি সুবিচার করবে না। না অবশ্যই সুবিচার করবে, তা-ই তাকওয়ার নিকটবর্তী নীতি। (সূরা মায়িদাঃ ৮)
(আরবী***************************************************************************)
যে সব লোক দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি এবং তোমাদেরকে বহিস্কৃতও করেনি, আল্লাহ তাদের সাথে ভালো আচরণ গ্রহণ করতে ও তাদের প্রতি সুবিচার নীতি গ্রহণ করতে তোমাদেরকে নিষেধ করছেন না। (সূরা মুমতাহানাঃ ৮)
(আরবী*************************************************************************************)
তোমাদেরকে মসজিদে হারাম –বায়তুল্লাহ থেকে বিরত রাখে বলে কোনো কোনো জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ পোষন যেন তোমাদেরকে এই অপরাধে অপরাধ হতে উদ্ধুদ্ধ না করে যে, তোমরা সীমালংঘনমূলক কাজ করবে…. (সূরা মায়িদাঃ ২)
মুসলিম উম্মত এমন এক সমাজ গড়ে তুলেছিল, যেকানে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ই ছিল পুরোপুরি ভারসাম্যপূর্ণ। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ছিল স্বতন্ত্র, বিশিষ্ট এবং সকল বাড়াবাড়ি থেকে সুরক্ষিত। তার ভূমিকা ছিল ইতিবাচক ও সম্মানজনক। ইসলামী সামজে ব্যক্তির ওপর দায়িত্ব অর্পিত ছিল যে, তারা যেন সমাজ ও শাসক উভয়ের ওপর সমানভাবে শ্যেন দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে, ন্যায় কাজের আদেশ ও মন্দ কাজের নিষেধ করার কর্তব্য যথারীতি পালন করে। পক্ষান্তরে সমাজ সমষি।ট পরস্পর সংযোজিত, সুসংবদ্ধ ছিল। ব্যক্তিগণকে সঠিক পথে পরিচালন, তাদের মন-মগজ ইসলামী আদর্শানুযায়ী গড়ে তোলা এবং আল্লাহর হারাম করা কাজসমূহ থেকে তাদের বিরত রাখার দায়িত্ব সমাজের ওপর অর্পিত ছিল।
উম্মতে মুসলিমা এমন এক অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, যেখানে ব্যক্তিগত ঋণ গ্রহণ ও গ্রনীমত প্রাপ্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষিত ছিল। ধনী ও গরীব প্রতিটি ব্যক্তির জন্যেই ছিল সামাজিক নিরাপ্তাত। তারা এমন এক জনগোষ্ঠী ছিলেন, যাঁদের পরস্পর পরস্পরের জন্যে দায়িত্বশীল ছিলেন। কল্যাণময় কাজ –সামষ্টিক ধন-মালে সকলেই শরীক চিলেন। অল্প সংখ্যক লোক জাতীয় সম্পদকে গ্রাস করে ফেলতে পারত না। কেননা ইসলামের বিধান হচ্ছেঃ
(আরবী*************************************************************)
ধন-সম্পদ যেন কেবলমাত্র তোমাদের ধনী লোকদের করায়ত্ত হয়েই না থাকে। (সূরা হাশরঃ ৭)
সে সমাজে মৌলিক প্রয়োজন থেকে কেউ বঞ্চিত থাকত না। রাষ্ট্র, সরকার ও বায়তুলমাল সকল লোকের জন্যে দায়িত্বশীল ছিল।
উম্মতে মুসলিমা এমন এক নৈতিক চারিত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, যা ছিল সমগ্র জীবন পরিব্যাপ্ত। জীবনের কোনো একটি দিকও তার বাইরে ছিল না। এখানকার রাজনীতি ছিল নৈতিক আদর্শ ভিত্তিক। মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি হোক, কি বৈদেশিক –মুসলিম ও তাদের শত্রুদের পারস্পরিক ব্যাপারই হোক, সবকিছুই এই নৈতিক বিধানের ভিত্তিতে গঠিত ও পরিচালিত ছিল। ওয়াদা পূরণ করা হতো, চুক্তিসমূহকে যথাযথভাবে রক্ষা করা হতো। সমাজের পারস্পরিক সম্পর্ক নৈতিকতার ওপর স্থাপিত ছিল। অর্থ ব্যবস্থাও নৈতিক ভিত্তিতে গড়ে তোলা হয়েছিল। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত উভয় ধরনের লেনদেন নৈতিক বিধান অনুযায়ী সম্পন্ন হতো। নারী ও পুরুষ দুই লিঙ্গের সম্পর্কেও নৈতিক চরিত্র ভিত্তিক ছিল। তাতে এমন এক পবিত্রতা কার্যকর ছিল, যার কোনো দৃষ্টান্ত ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ঠিক এই কারণে উম্মতে মুসলিমার ভিত্তি এতই সুদৃঢ় হয়েছিল যে, এই সামজ এক হাজার বছর পর্যন্ত টিকেছিল –ইসলামের দুশমনদের দ্বারা সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও নানা ক্ষতি সাধিত হওয়া সত্ত্বেও।
এই ধরনের এক ইসলামী সমাজ কাঠামো শুধুম্রতা আরব উপদ্বীপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি। মুসলিম উম্মতের লোকেরা দুনিয়ার যেখানে যেখানেই গেছে, আল্লাহর দ্বীনের সুসংবাদ সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। তা দ্বীন-ইসলামেরই এক বিস্ময়কর অবদান বটে।
মুসলিম উম্মতের লোকেরা দুনিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানেই তারা ক্ষেত্রও প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারা পৃথিবীর একদিক থেকে অপরদিক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে অর্ধশতকালের মধ্যে। তাদের এই বিস্তৃতি এতই দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়েছিল যে, দুনিয়ার গবেষক মনীষীরা পর্যন্ত বিমূঢ়। দুনিয়ার কোনো আন্দোলনই এত দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করতে পেরেছে বলে ইতিহাসের কোনো প্রমাণই নেই।
এই বিশাল বিস্তীর্ণ পৃথিবীর অসংখ্য সম্প্রদায়, জাতি ও জনগোষ্ঠী সম্মিলিতভাবে ইসলামী আদর্শে এক অখণ্ড উম্মত হয়ে গড়ে উঠেছিল।
ইতিহাসের বহু সাম্রাজ্যবাদের সন্ধান পাওয়া যায়। রোমান সাম্রাজ্যবাদ, পারস্য সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ, চীনা সাম্রাজ্যবাদ, আর আধুনিক কালের বৃটিশ ও রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদ। কিন্তু তার কোনো একটির বিস্তৃতিও ইসলামের সাথে তুলনীয় নয়।
এসব সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিছুদিন পর তা শেষও হয়ে গেছে। কিন্তু দুনিয়ার বিভিন্ন অংশে অবস্থিত মানব গোষ্ঠী সমষ্টি ও জাতিসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি উম্মত বানানো কোনো একটির পক্ষেই সম্ভব হয়নি। কেননা ওগুলো তো রাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ ছিল। কিন্তু ইসলামী রাজ্য রাজতান্ত্রিক ছিল না। সারা দুনিয়ার ইসলামে বিশ্বাসী মানুষ এক অভিন্ন উম্মত হয়ে গড়ে উঠেছিল কোনো চাপ বা কোনো শাসকের দুঃশাসনের কারণে নয়। তার কারণ ছিল সহজ সরল।
ওসব সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়ার জাতিসমূহকে জোরপূর্বক অধীন বানায় এবং অধীনতা করতে বাধ্য করে। তখনই এসব জাতির লোকেরা অনুভব করতে থাকে যে, তারা পরাধীন, স্বাধীন নয়, অতএব তাদের স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করতে হয়। কেননা বিজয়ী জাতির ভাবধারা পরাধীন জাতির জনগণের জীবনকে পরিপ্লাবিত করে। তাই স্বীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে হলে গোলামীর নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে হবে।
কিন্তু মুসলিম উম্মত সামষ্টিকভাবেই আল্লাহর অধীন ও অনুগত থাকে। ফলে অধীন লোকেরা নিজেদেরকে পরাধীন মনে করে না, মনে করার কোনো কারণও থাকে না। তখন বিজয়ী বিজিত সব মানুষ মানবিক মর্যাদায় একাকার হয়ে থাকে, ফলে কোনো স্বাধীনতার আন্দোলনেরই প্রয়োজন হয় না। কেননা তারা নিজেদের জাতীয় আদর্শ ও রীতিনীতি অনুযায়ী পূর্ণ স্বাধীনতা সহকারেই জীবন যাপন করার পূর্ণ সুযোগ পেয়ে থাকে, -যতক্ষণ পর্যন্ত ইসলাসের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় না। এইসব লোক একই চেতনা ও ভাবধারায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে থাকে। সকলেরই আকীদা এক ও অভিন্ন। আর এই কারণে ইসলামের আদর্শে সকল মানুষ সংযুক্ত –আজও দুনিয়ার মুসলমান সেই একই সূত্রে গাঁথা। যদিও এই চেতনাকে শেষ করে মুসলিম উম্মতকে খণ্ড-বিখণ্ডিত করার জন্যে শত-সহস্র ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও তা এখন পর্যন্ত টিকে আছে।
ইসলামী ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের ছত্রছায়ায় এক সু-উচ্চ ও মহান ইসলামী সভ্যতা অস্তিত্ব লাভ করেছিল, যদিও ইসলামের পূর্বে আরবদের তেমন কোনো সভ্যতা ছিল না। কেননা আরবদের যাযাবর জীবন যাত্রা এবং তাদের ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও জ্ঞানগত অবস্থান কোনো সভ্যতার ভিত্তি স্থাপনের সুযোগ দেয়নি।
এ কথা সত্য যে, এই উপদ্বীপ প্রাচীনকালীন সভ্যতা অনেক কয়টি অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে এবং প্রতিবেশী রোমান ও পারস্য সভ্যতার সাথেও তাদের নৈকট্য ও নানাভাবে যোগাযোগ ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইতিহাস যে বাস্তবতা দেখতে পেয়েছে, তা হচ্ছে মুসলমানরা এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরন ও প্রকৃতির সভ্যতা সৃষ্টি করেছেন। তার সাথে পূর্ববর্তী আর উপদ্বীপ কেন্দ্রিক কোনো একটি সভ্যতার বিন্দুমাত্র সাদৃশ্য নেই। এমন কি তখনকার সমসাময়িক দুনিয়ার অপর কোনো সভ্যতার সাথেও নেই একবিন্দু মিল। অবশ্য একথা স্বীকার্য যে, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ও ধরন তাঁরা অনেক কিছু রোমান ও পারসিকদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সেই সব প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ও অবকাঠামো সম্পূর্ণরূপে পরিচালিত ইসলামী আদর্শ ও নিয়ম নীতির ভিত্তিতে। এ-ও সত্য যে, পরবর্তীতে অন্যান্য সভ্যতা থেকেও ইসলাম অনেক কিছুই গ্রহণ করেছে। পরবর্তী সময় বিগত এক সহস্র বছরের মধ্যে ইসলামী সভ্যতা পাশ্চাত্য সভ্যতা থেকেও অনেক কিছু নিয়েছে, যদিও খোদ পাশ্চাত্য সভ্যতার মূল স্থাপিত হয়েছিল ইসলামী সভ্যতারই প্রেরণায়।
আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতা যে ইসলামী সভ্যতার প্রেরণারই ফসল, তা ঐতিহাসিক মাত্রই স্বীকার করতে বাধ্য। ব্রে ফো তাঁর Making of Humanity ‘মানবতার নির্মাণ’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেনঃ ‘ইউরোপীয় সভ্যতার উৎকর্ষের এমন কোনো দিক নেই, যার মূলে ইষলামী সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাব নিশ্চিতরূপে অনুপস্থিত’।–[আল্লামা ইকবাল লিখিত ‘ইসলামী সংস্কৃতির পুনর্গঠন’।]
মুসলমানরা যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রবল বন্যা প্রবাহের সৃষ্টি করেছিলেন, তা-ও ছিল ইতিহাসের এক তুলনাহীন আন্দোলন।
একথা সর্বজনবিদিত যে, ইসলাম পূর্ন আরবরা জ্ঞান বিজ্ঞান ও বিদ্যা শিক্ষার প্রতি তেমন কোনো গুরুত্ব আরোপ করেনি। কেননা তারা সব সময় কথা বলার বিদ্যায় খুবই পারদর্শী ছিল। তাদের সব চেষ্টা-যত্ন তাতেই নিয়োজিত ছিল। কাব্য রচনা তারই এক পর্যায়। কিন্তু মুসলিম উম্মতের অভ্যুদয়ে তাদের মধ্যে জ্ঞান-চর্চার প্রবণতা জেগে ওঠে এবং বিদ্যাশিক্ষার একটা আন্দোলন চারিত্রিক তীব্র চেতনা জাগিয়ে দিয়েছিল। এর মূলেও ছিল ইসলাম।
ইসলামের তাগিদেই মুসলমানরা সমসাময়িক সকল জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে বৈষয়িক ব্যাপারাদি সম্পর্কে বিপুল জ্ঞান আহরণ করেছিলেন। প্রাচীন গ্রীক বিদ্যা, দর্শন, রোমানদের জ্ঞান ও মিসরীয় ও ভারতীয় জ্ঞান থেকেও তাঁরা অনেক কিছুই পেয়েছিলেন। ভুগোল, খগোল, জ্যোতির্বিদ্যা, অংকশাস্ত্র, চিকিৎসাশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে তারা যেমন সূক্ষ্মতা অর্জন করেন, তেমিন ব্যাপকতা ও গভীরতা।
কিন্তু তাঁরা অন্যদের কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞানটুকু নিয়েই ক্ষান্ত হননি। না পরিমাণে, না প্রকারে।
মুসলমানরা তখনকার জ্ঞানের চেহারাটাই বদলে দিয়েছিলেন। তাঁরাই ইসলামের তাগিদ ও প্রেরণায় বিজ্ঞানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিলেন। আর আধুনিক ইউরোপীয় বিজ্ঞানে চরম উৎকর্ষের মূলে নিহিত রয়েছে মুসলমানদের কাছ থেকে গৃহীত এই পরীক্ষার পদ্ধতি।
পূর্বোক্ত গ্রন্থে গ্রন্থকার লিখেছেনঃ
আরব ইসলামী সভ্যতা আমাদেরকে যা কিছুই দিয়েছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান ছিল জ্ঞান ও বিজ্ঞান পর্যায়ের অবদান। যদিও ইউরোপীয় উৎকর্ষের কোনো একটি দিকও এমন নেই যে, যার মূল খুঁজতে গেলে ইসলামী সংস্কৃতিরই সাক্ষাৎ মিলবে না নিশ্চিতভাবেই। তবে সবচেয়ে বেশি ও সবচেয়ে স্পষ্ট ইসলামী প্রবাব সেই শক্তিতে দৃশ্যমান, যা আধুনিক দুনিয়াকে একটি বিশিষ্ট শক্তিতে ধন্য করেছে, যাতে নিহিত রয়েছে আধুনিক কালের তত্ত্ব। তা হচ্ছে পদার্থবিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক আলোচনা গবেষণার প্রাণশক্তি বা মৌল ভাবধারা।
আরব মুসলিম কোনো নবতর মতাদর্শের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। আমাদের বিজ্ঞান কেবল এই দিক দিয়ে তাঁদের কাছে ঋণী নয়; বরং আমাদের সমস্ত অস্তিত্বই মুসলিম আরবদের কাছে ঋণী। বরং বলা দরকার, আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অস্তিত্বই মুসিলম আরবদের সাথে সংশ্লিষ্ট, কেননা প্রাচীন দুনিয়ায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের তেমন কোনো অস্তিত্বই ছিল না। গ্রীকদের কাছে জ্যোতিষশাস্ত্র ও অংকশাস্ত্র যা ছিল তাও ছিল বাইরে থেকে পাওয়া, কিন্তু তা কোনো দিনই গ্রীক সংস্কৃতির অংশ হতে পারেনি।
গ্রীকদের বিভিন্ন চিন্তাকেন্দ্র (School of thought) গড়ে তুলেছিল। আইনসমূহকে সাধারণ রূপ দিয়েছে। নানা দৃষ্টিকোণ ও মতাদর্শ নির্ধারণ করেছে। দায়িত্বজ্ঞান সম্ভূত আলোচনা-গবেষণা, ইতিবাচক জ্ঞান সংগ্রহ, জ্ঞানের বিস্তারিত পন্থা ও পদ্ধতির বিশ্লেষণ, সূক্ষ্মদর্শিতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনমূলক প্রয়োগ এই সবের কোনো সামঞ্জস্য ছিল না গ্রীকদের মেজাজ প্রকৃতির সাথে।
আমরা যাকে জ্ঞান বা বিজ্ঞান বলি, তা ইউরোপে নবতর আলোচনার প্রেরণা, আয়ত্তকরণের নবতর পন্থা-অভিজ্ঞতা বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা মূল্যমান এবং অংকশাস্ত্রের উন্নতি লাভেল পর অস্তিত্ব লাভ করেছে এই প্রাণশক্তি ও এই বৈজ্ঞানিক পন্থা ও পদ্ধতি মুসলমানদের মাধ্যমে সেই ইউরোপে পৌঁছেছে।
আমেরিকান লেখক ড্রিপার তার ‘ধর্ম ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ মুসলিম বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, বুদ্ধিগত ও চিন্তাগত পদ্ধতি উন্নতি উৎকর্ষের ধারক নয়। প্রকৃত সত্যের অনুসন্ধানে মূল ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ অধ্যয়ন জরুরী। এই কারণে মুসলমানদের কর্মপদ্ধতি ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক।–[ইসলাম চিরন্তন ধর্মঃ ফরীদ আজদী।]
আর বাস্তবিকই মুসলিমগণ আল্লাহ সম্পর্কিত ধারণাকে সঠিক ও সুদৃঢ় করে নিয়ে এবং আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও অবিকল আস্থা স্থাপন করেই দুনিয়ার বুকে বাস্তবতার মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
এ এমন এক দৃষ্টান্তহীন ঘটনা, যা দেখে ইতিহাসও স্তম্ভিত হয়ে গেছে। তা যেমন পরিমিতির দিক দিয়ে, তেমিন প্রকারের দিক দিয়েও।
কিন্তু এক্ষণে সেই মুসলিম উম্মত আল্লাহর পথ থেকে অনেকখানি বিভ্রান্ত ও বিচ্যুত হয়ে পড়েছে।
ক্রমশ এবং ধীরে ধীরে জাহিলিয়াতের মূর্খতা তাদের গ্রাস করেছে। প্রথমেই আকীদা-বিশ্বাস শরীয়ত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। দ্বীনকে অন্তরে প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকা এই বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে নিল। বাস্তবতার সাথে তার কেননা সম্পর্ক থাকল না। আর এরই মধ্যে অবস্থার এই অধোগতিও ঘটে গেল যে, দ্বীন-ইসলাম ছাড়া ভিন্ন মুসলিম উম্মতের জন্যে আল্লাহর পথ বাস্তবভাবে অনুসরণীয় হয়ে থাকল না। শুধু তা-ই নয়, অতঃপর তারা উম্মতে মুসলিম গণ্য হওয়ার সব যোগ্যতাই হারিয়ে ফেলল, যদিও তাদরে মুসলমানী নাম এখনও রয়েছে। তারা নামাযও পড়ে, বেশির ভাগ লোক কখনও কখনও। আর রোযাও থাকে, অন্ততঃ ইফতার যে করে তাতে সন্দেহ নেই।
পতনের ধারা এ পর্যন্ত এসেও থেমে যায়নি। অতঃপর তারা তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনন্যতারও সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলেছে। তারা মন-মানসিকতার দিক দিয়ে এতই দুর্বল সাহসহীন হয়ে পড়ল যে, দ্বীন-ইসলাম পালন তাদের দ্বারা আর সম্ভব থাকল না।
দ্বীন-ইসলাম পালন না করলে চারিত্রিক অধঃপতন একান্তই অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াবে, তাতে কোনোই সন্দেহ থাকতে পারে না। তারা সত্য কথা বলা ত্যাগ করল, অন্তরের নিষ্ঠা কর্পূরের মত উবে গেল। পারস্পরিক লেনদেন তারা সততা, ন্যায়পরতা বজায় রাখতে পারল না। মানুষের পরস্পরের মধ্যে যে সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক, তাও আর টিকে থাকল না।
অধোগতি এত তীব্র হয়ে দাঁড়াল যে, তারা যৌনতার কলুষিত আবর্তে গড়ে হাবুডুবু খেতে লাগল। ঠিক ইহুদীদের ন্যায় যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা তাদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে নিয়ে গেল।
ফলে শেস পর্যন্ত ইসলামের সম্পূর্ণ বাইরে চলে গেল।
বর্তমানে দ্বীন-ইসলাম এই মুসলমানদের থেকেই অনেক দূরে সরে গেছে। ইসলাম তো আল্লাহর শাশ্বত জীবন পথ। তা নাযিল হয়েছিল হযরত মুহাম্মদ (স)এর প্রতি ইসলামের ধারক বলে দাবিদার বা পরিচিত ব্যক্তিদের বিপথগামিতায় ইসলাম নিশ্চয়ই বিপথগামী হয়নি, হারায়নি তার একবিন্দু গুরুত্ব ও মূল্য।
বস্তুত ইসলাম মানবতার জন্যে চিরন্তন উদ্বোধক, নির্ভুল পথের পরিচালক ও চলার পথে তীব্র গতিদানকারী। ইসলাম মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোকের দিকে আসার জন্যে একমাত্র পথ। তাগুতী শক্তির গোলামী লাভ করে আল্লাহর দিকে আসার জন্যে ইসলাম ছাড়া ভিন্নতর কোনো পথই কোথাও নেই।
বর্তমান জাহিলিয়াতের সর্বাত্মক বিপর্যয় থেকে নিষ্কৃতি লাভ করতে হলে ইসলামকেই গ্রহণ করতে হবে। জাহিলিয়াতের সংশোধনকারী বিপরীত শক্তিরূপে রয়েছে একমাত্র ইসলাম। আর সে জন্যে সর্বপ্রথম সকল জরুরী বিষয়ে ধারণাকে সঠিক ও সুদৃঢ় করতে হবে, যেমন ইতিপূর্বে আমরা বিস্তারিত বলে এসেছি। আর তা করতে পারলেই আমাদের জীবনাচরণ সঠিক ও যথার্থ হতে পারবে।
পথভ্রষ্ট বিশ্বমানবতা যখন আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করবে তখনই তার জীবন সঠিক ও সুদৃঢ় পথে চলতে শুরু করবে। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, নৈতিকতা, শিল্প ও দুই লিঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্কে যে মারাত্মক বিপর্যয় এসেছে, তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া কেবল তখনই সম্ভভপর হবে। পূর্ণাঙ্গ মানব জীবন তার আসল রূপ পরিগ্রহ করতে পারবে।
বর্তমান জাহিলিয়াত আল্লাহ ও মানবতার মধ্যে একটি দুর্ভেদ্য প্রাচীর-একটি গাঢ় অন্তরাল সৃষ্টি করেছে।
বিবর্তনবাদ হচ্ছে একটি প্রধান আবরণ, যা মানুষকে আল্লাহ থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে। তথাকথিত উন্নতি মানুষকে তার দ্বীন থেকেও অনেক দূরে নিক্ষেপ করেছে। এই ধারণা সৃষ্টি করেছে মানুষের মনে যে, চৌদ্দশত বছর পূর্বে যা মানুষের জীবনে কল্যাণ নিয়ে এসেছিল, আজকের দিনে তা মানুষের কোনো কল্যাণই করতে পারে না। কেননা এই সময়ের মধ্যে মানুষের অবস্থার নাকি অকে পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষ নাকি বিবর্তিত হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নতর অবস্থার মধ্যে চলে গেছে। পুরাতন আদর্শ এখন নাকি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে।
আসলে উন্নতি ও বিবর্তনের এই ধারণাটিই মানুষের জীবনে মারাত্মক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। তা বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে মানুষের ধারণায়, মন-মানসিকতায়, চিন্তা ও বিশ্বাসে এবং বাস্তব জীবনাচরণে (এই কথার বিস্তারিত বিশ্লেষণ তো আমরা এই গ্রন্থের বিগত দুটি অধ্যায়ে দিয়ে এসেছি)। মানব জীবনের দূরতম কোনো ক্ষেত্রকেও –মানুষের মনকেও মারাত্মক বিপর্যয় থেকে তা রক্ষা পেতে দেয়নি।
এই বিবর্তনবাদ –এই উন্নতি অগ্রগতি সংক্রান্ত ধারণাই –গোটা মানবতাকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে।
অথচ কুরআনের ভাষায়ঃ ‘ওরামনে করে যে, ওরা সঠিক পথেই এগিয়ে চলেছে’। -না, তা সত্য নয়।
তবে আল্লাহর দেখানো বিধান অবলম্বন করে, তার হেদায়েত অনুসরণ করে চলে, তবেই আসন্ন ধ্বংস থেকে মানুষের রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
সেজন্যে মানুষকে সর্বপ্রথম আল্লাহর প্রতি সত্যিকারভাবে ঈমান গ্রহণ করতে হবে। কেবলমাত্র তাঁরই ইবাদত ও বন্দেগী করতে হবে। তাঁর সাথে কাউকেই একবিন্দু শরীক করা চলবে না। দুনিয়ার মাথা উঁচু করে থাকা তাগুতী শক্তিগুলোকে স্পষ্ট ভাসায় অস্বীকার করতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে পূর্ণ সাহসিকতা সহকারে বিদ্রোহ করতে হবে। আল্লাহর শরীয়াতকে অমান্য করে আইন রচনার কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে আল্লাহর প্রতি দৃষ্টতা দেখানো চলবে না। সার্বভৌমত্ব নিরংকুশভাবে আল্লাহর অধিকারের জিনিস, তাকে তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া চলবে না।
আর তা করতে পারলেই বর্তমানের সব বিপথগামিতা, বিপর্যয় এবং জুলুম বঞ্চনা দূর হয়ে যাবে। মানুষ নিস্কৃতি পাবে সকল দুর্ভাগ্য ও অমানুষিক আযাব ও নিপীড়ন থেকে; শোষন ও নির্যাতন থেকে। কেননা এ সব তো মানুষের জীবনকে গ্রাস করেছে তারা নির্ভুল আকীদা-বিশ্বাস যথার্থ ইবাদত থেকে বিপথগামী হয়েছে বলে, আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে নিজেদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে বলে। মানুষ পরস্পর পরস্পরকে মা’বুদ বানিয়েছে খোদাকে বাদ দিয়ে। এই কারণে এখন মানুষই মানুষের জন্যে এই রচনা করে আর বোকা নির্বোধ অন্ধ মানুষেরা তাদেরই মতো মানুষের রচিত আইনকে বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে চলছে।
অথচ ইসলামই হচ্ছে প্রথম দিন থেকেই মানবতার সকল প্রকারের বিপথগামিতা থেকে মুক্তিদানকারী, সিরাতুল মুস্তাকীমে পরিচালনাকারী।
তা আজও ঠিক তাই আছে, যা ছিল আজ থেকে তের-চৌদ্দশত বছর পূর্বে।তা সেকালে যেমন সত্য ও মিথ্যা –হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যকারী ছিল, আজও তা-ই আছে। আজও একমাত্র তা-ই আদর্শ মানুষ সৃষ্টিকারী। সকল প্রকারের বিপর্যয় বিপথগামিতা ও বিদ্রোহ সীমালংঘন থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র ইসলাম।
তবে সেজন্যে সর্বপ্রথম শর্ত হচ্ছে মানুষকে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। তা করতে পারলেই জীবনটা ভারসাম্যপূর্ণ হবে, সঠিক পথে দ্রুত অগ্রসরমান হবে।
এখানে অবশ্য ইসলামের তাৎপর্য বিস্তারিত রূপে ব্যাখ্যা করার কোনো অবকাশ নেই। এখানে আবার নতুন করে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, নৈতিকতা, শিল্প-সংস্কৃতি ও দুই লিঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্কগত অবস্থার বিস্তারিত আদর্শ তুলে ধরার কোনো প্রয়োজনও দেখা দেয় না।
তা সত্ত্বেও আমরা এখানে ইসলামের কতগুলো বড় বড় দিক তুলে ধরেছি সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে। তা হবে সমস্যার সমাধানের কুঞ্চিকাতুল্য।
পূর্বে আমরা জীবনের বিভিন্ন দিকে জাহিলিয়াত যে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ পেশ করে এসেছি। জাহিলিয়াত সম্পর্কে আমরা ঠিক ততটাই আলোচনার শামিল করেছি যতটা বিপথগামিতার তত্ত্ব রহস্য উদঘাটন এবং জটিল বিষয়ের বিশ্লেষণের জন্যে প্রয়োজনীয় ছিল। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামকে আমরা পেশ করেছি সেই প্রয়োজনের অনুপাতে যতটা দরকার মনে হয়েছে। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই কথা খুব একটা বিস্তারিত করে বলা হয়নি। বিপর্যয় ও বিপথগামিতা থেকে নিষ্কৃতি লাভের পন্থা বাতলানোর যতটুকু দরকার বোধ হয়েছে ঠিক ততটাই আলোচনায় নিয়ে আসা হয়েছে।
ইসলামের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, নৈতিকতা ও শিল্প-সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বইপত্র রয়েছে। বিশেষ বিষয়ে বিশেষ গ্রন্থ মওজুদ রয়েছে, বাজারে ক্রয় করার জন্যে পাওয়া যাচ্ছে। আর বাজার সকলেরই কাছে খোলা আছে, যে যত সংগ্রহ করতে ইচ্ছুক, অনায়াসেই করতে পারে।
মওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদুদী লিখিত ‘ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদ’ নামে একখানি বই রয়েছে। আর আবদুল কাদের আওদা শহীদ লিখিত ‘আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা’ ও ‘ইসলামে অর্থনীতি ও শাসননীতি’ নামে দুখানি বই রয়েছে। এছাড়া ইসলামের অর্থনীতি পর্যায়ে মওলানা মওদূদী ও সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ লিখিত আরও কয়েকখানি গ্রন্থ আছে, যা এই বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তুলেছে।–[মওলানা মওদূদী লিখিত তিনটি প্রধান বইঃ ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তি, সূদ ও ইসলাম, জমির মালিকানা এবং সাইয়্যেদ কুতুব শহীদ লিখিত ‘ইসলামের সামাজিক সুবিচার’ উল্লেখ্য। (এই অনুবাদক লিখিত দুই তিনখানি বইও পঠনীয়ঃ (১) ইসলামের অর্থনীতি (২) ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন এবং (৩) ইসলামী সমাজে মজুরের অধিকার। এ ছাড়াও আছে (১) ‘কমিউনিজম ও ইসলাম’ (২) সমাজতন্ত্র ও ইসলাম এবং (৩) পাশ্চাত্য সভ্যতা ও ইসলামী সমাজ।] এ ছাড়াও এই গ্রন্থকার লিখিত ‘স্থিতি ও বিবর্তন’ ‘মানবীয় মনস্তত্ত্ব অধ্যায়’ ‘ইসলামী প্রশিক্ষণ পদ্ধতি’ ইসলামী শিল্প নীতি’ প্রভৃতি বই ইসলামের সামষ্টিক মনস্তাত্ত্বিক, প্রশিক্ষণমূলক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদির ওপর বিস্তারিত আলোকসম্পাত করেছে।
এই কারণে এ পর্যায়ে বিস্তারিত আলোচনার অবতারণা করার কোনোই প্রয়োজন নেই। শুধু সংক্ষেপে ও প্রয়োজন পরিমাণ কথা বলাই যথেষ্ট।
রাজনীতিতে জাহিলিয়াত সৃষ্ট সমস্যা হয়েছে, তা আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র চালায় না, শাসনকার্য পরিচালনা করে না।
এ পর্যায়ে আল্লাহ যে বিস্তারিত বিধান নাযিল করেছেন, এখানে তার উল্লেখ না করেও আমরা বলব, প্রথম কথা, আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা ও শাসনকার্য না চালানোই এমন একটি পদক্ষেপ যা শুরুতেই বিপর্যয় ও বিপথমাগিতা সূচিত করে। কেননা মানব রচিত আইনের ভিত্তিতে রাষ্ট্র চালানো ও শাসনকার্য পরিচালনের সোজা অর্থ, কিছু সংখ্যক মানুষের শাসন বিপুল জনতার ওপর কার্যকর করা। তারই ফলে মুষ্টিমেয় আইন রচনাকারী বা শাসক প্রশাসকের স্বার্থ বিপুল জনগণের কল্যাণ-ব্যবস্থার ওপর অগ্রাধিকার পেয়ে গেল। অল্প সংখ্যক মানুষ হলো বিপুল জনতার শাসক।
না, একথা যে কেবল আমরা বলছি আমাদের দৃষ্টিকোণ দিয়ে, তা নয়। জাহিলিয়াতের বড় বড় হোমড়া-চোমড়ারাই এই কথা বলেছে। এ সাক্ষ্য তাদের নিজেদেরই পরস্পর সম্পর্কে পরস্পরের। তাদের মধ্যকার জনৈক সাক্ষীর সাক্ষ্য।
রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, অর্থনীতির ক্ষেত্রে তাদের সমষ্টিগত মত হচ্ছে, মালিক শ্রেণীর লোকেরাই দেশের শাসক হবে, তারা এই শাসনকার্য চালাবে, কেবলমাত্র নিজস্ব স্বার্থ ও কল্যাণের বিবেচনায় –এ তো একান্তই স্বাভাবিক কথা, আর তা অবশ্যই অন্যান্য সকল শ্রেণীর মানুষের কল্যাণের বিপরীত হবেই।
যেমন পুঁজিবাদের মুষ্টিমেয় লোক ধন-মালের একচ্ছত্র মালিক। আবার তারাই দেশের সর্বাত্মক শাসক। তাদের এই শাসনকার্য নিশ্চয়ই পুঁজিবাদের অনুকূলে ও পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষার পক্ষে সম্পন্ন করে। হবে শ্রমিক-কর্মচারী, শ্রমজীবী প্রভৃতি পর্যায়ের লোকদের স্বার্থের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণীই সবকিছুর ওপর কর্তা, তারাই আবার শাসকও। তাদের এ শাসকার্য নিশ্চয়ই শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে চলবে এবং চলবে মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে।
এদর প্রত্যেকেই নিজেদের জন্যে অধিকার ও মর্যাদা সংরক্ষণ করে। আর অন্যান্য লোকদের মর্যাদা ও স্বার্থকে তারই বেদীমূলে বলিদা করে। আর এ কথায় এক বিন্দু সন্দেহ নেই যে, মানুষের শাসন কখনোই নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জন্যে কল্যাণকর হতে পারে না, সকলেরই স্বার্থ রক্ষিত হতে পারে না।
সকলেরই জন্যে –সকলেরই নির্বিশেষ কল্যাণে শাসনকার্য পরিচালিত হতে পারে কেবলমাত্র তখন, যখন মানুষ একমাত্র আল্লাহর নাযিল করা বিধানের ভিত্তিতে শাসনকার্য চালাবে। কেননা তখন এক শ্রেণীর লোকদের শাসন নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের ওপর মানুষের জন্যে। আল্লাহ নিজে কোনো শ্রেণী নন, নেই তাঁর কোনো নিজস্ব শ্রেণী। তখন কিছু সংখ্যক লোক আইন রচনা করবে না অন্য বিপুল জনতার জন্যে। আল্লাহর কল্যাণ চিন্তায় কোনো শ্রেণীবিভেদ নেই, নেই কারুর প্রতি তাঁর একবিন্দু বিদ্বেষ। কেননা তিনি সমস্ত মানুষের স্রষ্টা, সমানভাবে সমস্ত মানুষের ওপর তাঁর শাসন সম্পূর্ণরূপে সার্বজনীন, পক্ষপাতমুক্ত।
আল্লাহ যখন সমস্ত মানুষকে একমাত্র তাঁরই বন্দেগী করার আহবান জানিয়েছেন, ইলাহ ও সার্বভৌম কেবল তাঁকেই বানাতে বলেছেন, তখন তার এই দাওয়াত হচ্ছে মান-সম্মান লাভ, শক্তি-সামর্থ্য লাভ ও মুক্তি লাভের আহবান, কেননা এই ঘরের কোনো কিছুই অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় কেবল মাত্র এক আল্লাহর দাসত্ব স্বীকার করা হলো।
কেননা আল্লাহ তো নিজের স্বার্থে মানুষক তাঁর দাসত্ব কবুল করতে বলেন নি। মানুসের এই দাসত্বের কোনো প্রয়োজন তার নেই, তিনি নয় মানুষের দাসত্বের একান্ত মুখাপেক্ষী। তিনি নিজেই বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************************)
না, আমি তাদের কাছ থেকে কোনো রিযক পেতে চাই না, আশা করি না যে, তারা আমাকে খাওয়াবে (কেননা আমার খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই)।
(সূরা যারিয়াতঃ ৫৭)
সত্যি কথা হচ্ছে সৃষ্টির কর্তব্য তার স্রষ্টার প্রতি, তার রিযিকদাতার প্রতি অবিসংবাদিত। তিনিই তাদের একমাত্র মালিক, মালিক তাদের যাবতীয় ব্যাপারের, তাদের জীবনের ও মৃত্যুর। আর সে কর্তব্য হচ্ছে, কেবলমাত্র তাঁরই দাসত্ব করা।
কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাগণের প্রতি তাঁর যে দয়া, অনুগ্রহ ও রহমান স্বরূপ এই কর্তব্য পালনে সেই বান্দাগণের কল্যাণ নিহিত রেখেছেন, তাদের সার্বিক কল্যাণ কেবল এই ইবাদতেই নিহিত। অতএব মানুষ আল্লাহর দাসত্ব করবে এই হিসেবে যে, তিনিই তাদের স্রষ্টা, তিনিই তাদের একমাত্র রব্ব, তাদের একমাত্র ইলাহ। তা হলেই আল্লাহর জন্যে নিবেদিত তাদের ইবাদত তাদের জন্যেই কল্যাণকর হবে। এতে আল্লাহর নিজের কল্যাণ-অকল্যাণের কোনো প্রশ্ন নেই। কেননা তিনি এসব কিছুরই ঊর্ধ্বে। তাই আল্লাহ বলেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************************************)
যে লোকই জিহাদ করবে, সে জিহাদ করবে নিজের কল্যাণের জন্যে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সারেজাহানের প্রতি অমুখাপেক্ষী। (সূরা আনকাবুতঃ ৬)
অতএব আল্লাহর যখন সমস্ত মানুষের প্রতি আহবান জানালেন একমাত্র তাঁকেই ইলাহ –সার্বভৌম শাসক ও আইন প্রণয়নকারীরূপে গ্রহণ করার জন্যে, তাদের নিজেদের কারুর তৈরি আইন দ্বারা শাসনকার্য না চালাতে, তখন তাদের কর্তব্য হচ্ছে কেবলমাত্র আল্লাহর নাযিল করা বিধানের ভিত্তিতে শাসনকার্য সম্পন্ন করা –সর্বক্ষত্রে ও সর্বব্যাপারে তাকেই আমল ও বিচারের একমাত্র ভিত্তিরূপে গ্রহণ করা। তাই তিনি তাঁর রাসূলকেও বলেছেনঃ
(আরবী*****************************************************************)
হে নবী, তুমি ঐ লোকদের ব্যাপারে সতর্ক থাকো, তারা তোমাকে আল্লাহর তোমার প্রতি নাযিল করা কোনো কোনো বিধান সম্পর্কে বিপদে ফেলতে পারে।
(সূরা মায়িদাঃ ৪৯)
আল্লাহ মানুষের কাছে যখন একনিষ্ঠ দাসত্বের দাবি করলেন, তখন তাদেরকে পরস্পরের দাসত্ব থেকে মুক্ত রাখবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাগুতী শক্তি যেমন মানুষকে তার দাস বানিয়ে বসতে না পারে তার উপায় ও পন্থাও তিনি মানুষকে দেখিয়েছেন।
আধুনিক জাহিলিয়াতে তাগুত কিভাবে জনগণকে দাসে পরিণত করেছে, তার বীভস নমুনা ইতিপূর্বে আমরা দেখে এসেছি, কেবল বর্তমানের জাহিলিয়াতই নয়, ইতিহাসে সৃষ্ট যে কোনো জাহিলিয়াতেই মানুষের সেই দুরবস্থা হওয়া একান্তই অনিবার্য।
আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করুক, কিন্তু মানুষ নিজেদের জন্যে যে বিধান ও ব্যবস্থা রচনা করে নেয়, তার ভিত্তিতে উক্ত স্বাধীনতা লাভ ও ভোগ করা কখনোই সম্ভব নয়। তাতে বরং অবস্থা এই হয়, মানুষের মধ্য থেকেই মুষ্টিমেয় কিছু লোক ওঠে সর্বাত্মক ক্ষমতা দখল করে বসে ও অন্যান্য কোটি কোটি মানুষকে নিজেদের দাসানুদাসে পরিণত করে রাখে। তার ক্ষমতা দখল করে জনগণের নামে, কিন্তু সে ক্ষমতার দ্বারা কেবল নিজেদেরই হীনস্বার্থ উদ্ধার করে, জনগণের স্বার্থ ও অধিকার সেখানে চরমভাবে পদদলিত, উপেক্ষিত ও ভূলুণ্ঠিত হয়ে থাকে।
আল্লাহ তা’আলা নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্যে চেয়েছিলেন সম্মান ও মর্যাদা। কিন্তু একই সম্মান ও মর্যাদা লাভ সম্ভব কেবলমাত্র তখণ, যখন সমস্ত মানুষ সমানভাবে এক আল্লাহর প্রকৃত দাসত্ব কবুল করবে। তাহলে তাদের মধ্য থেকে কেউ-ই তাগুত হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে না, বলতে পারবে নাঃ আমি জনগণের জন্যে আইন রচনা করছি, আমিই জনগণের ওপর একমাত্র কতৃত্বশালী। বলতে পারবে নাঃ সব মানুষ আমার অধীন, আমার ইচ্ছা ও কামনা বাসনার অধীন হয়ে থাকতে বাধ্য। আর আমি আমার ইচ্ছামতো কাজ করব, জনতা তা মেনে নেবে এবং তার বিরুদ্ধে ‘টু’ শব্দও করতে পারবে না।
আল্লাহ তাদের বিজয় ও শক্তিমত্তাও চেয়েছিলেন। কিন্তু মানুষ বিজয় ও শক্তিমত্তা লাভ করতে পারে কেবল তখন, যখন প্রতিটি মানুষ আইনের প্রকৃত মৌল উৎস স্বয়ং আল্লাহ-এর সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করবে এবং একবিন্দু সে সম্পর্ক থেকে বাইরে থাকবে না। এইরূপ সম্পর্ক স্থাপনের দ্বার প্রতিটি মানুষের জন্যে উন্মুক্ত। তবে তা সম্ভব হবে মানুষ তার সাধ্যানুযায়ী আল্লাহর নৈকট্য পেতে যত বেশী চেষ্টা করবে সেই অনুপাতে। আললাহ সেই নৈকট্যের কথা বলেছেন এই ভাষায়ঃ
(আরবী***********************************************************)
তোমাদের মধ্যকার সেই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সবচাইতে বেশি সম্মানার্হ, যে লোক তোমাদের মধ্যে সবচাইতেবেশি মুত্তাকী –আল্লাহ ভীরু।
(সূরা হুজরাতঃ ১৩)
আল্লাহর কাছে এই মর্যাদা ও শক্তি কারোর হস্তস্থিত ধন-মাল বা শক্তি ক্ষমতার জোরে কখনোই পাওয়া যেতে পারে না।
বস্তুত ইসলামের এই বিধান ও ব্যবস্থা সর্বতোভাবে একক ও অনন্য, যার মধ্যে বাস করে মানুষ প্রকৃত মর্যাদা, সম্মান ও শক্তির অধিকারী হতে পারে, প্রকৃত মুক্তি ও স্বাধীনতা লাভ কেবল এই জীবন বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করেই পাওয়া সম্ভব। কেবল তখনই তারা নিজেদের মধ্য থেকে নেতা ও শাসক নির্বাচন করার স্বাধীন ও অবাধ সুযোগ পাবে। এ নির্বাচন হবে স্বাধীন বায়’আতের মাধ্যমে। এই স্বাধীন নির্বাচনের মাধ্যমে যাকেই তারা নির্বাচিত করবে, তার হাতে সমস্ত জাতীয় ব্যাপার সোপর্দ করতে পারবে নিশ্চিন্তে।
এই নির্বাচিত নেতা বা রাষ্ট্র পরিচালক নিজের জন্যে নিজের আইন তৈরী করবে না, তা করার কোনো অধিকারও থাকবে না তার। সে মানুষকে নিজের দাস বানিয়ে তাদের দণ্ড-মুণ্ডের মালিক হওয়ার কোনো অধিকার বা সুযোগ পাবে না। মানুষ তার ইচ্ছার দাসত্ব করতে, তার কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হবে না।
সে নেতৃত্ব দান ও শাসন কার্য পরিচালননা করবে আল্লাহর নাযিল করা বিধানের ভিত্তিতে। যে সব গুরুত্বপূর্ণ কাজে লোকদের কাছ থেকে বায়’আত গ্রহণ করা হবে, সে বায়’আত তার নিজের জন্যে হবে না, হবে আল্রাহর জন্যে তার ক্ষমতা কাজ করবে শুধু আল্লাহর আইন জারী করার। আল্লাহর আইন তো তারই বানানো, তা বানানো নয় কোনো ব্যক্তির বা কোনো শ্রেণীর কিংবা জনগোষ্ঠীর। আর সে আইনে কোনো বিশেষ শ্রেণীর বা ব্যক্তির কিংবা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, তা নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জন্যে মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্যে রচিত হয়েছে।
এই নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান যে-ই হোক, সে সর্বসাধারণ মানুষের মধ্যকার একজন ব্যক্তিমাত্র, তার জন্যে স্বতন্ত্রভাবে কোনো বিশেষত্ব নেই।
সে বিশেষ কোনো শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করবে না। বিশেষ কোনো শ্রেণীর লোকও তাকে নির্বাচিত করবে না। তাকে নির্বাচিত করার জন্যে বিশেষ শ্রেণী বা গোষ্ঠীর লোকরাই উদ্যোগ-আয়োজন বা সহায়তা করবে না। কেননা বিশেষ কোনো শ্রেণী বা গোষ্ঠীর লোকদের কোনো স্বার্থ বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে নির্বাচিত করার মধ্যে নিহিত নেই। কোনো একজনকে মর্যাদাবান বানালে তাতে তাদের বিশেষ স্বার্থরক্ষা পাওয়ার কোনো সুযোগই থাকবে না। তবে হ্যাঁ, যদি কোনো লোককে কেউ মনে করে সে নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার বিশেষ ও প্রকৃত যোগ্যতা তার আছে এবং ক্ষমতা লাভ করলে সে লোক সকলের প্রতিই ন্যায়পরতা ও সুবিচার রক্ষা করতে পারবে, সে বিশেষ কোনো শ্রেণী বা গোষ্ঠীর প্রতি বিন্দুমাত্র পক্ষপাতিত্ব করবে না –অন্যদের তুলনায় তাকে অগ্রাধিকার দেবে না, তাহলে ভিন্ন কথা (তখন সে তার পক্ষে মত প্রকাশ করতে থাকবে।)
কোনো বিশেষ শ্রেণীর লোকদের হাতে সাধারণ মানুষের তুলনায় অধিক শক্তি ও কর্তৃত্ব না যাওয়া পর্যণ্ত তারা জনগণকে বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপ্রধান বা ক্ষমতাশীল বানাতে পারবেই বা কি করে এবং কাউকে নির্বাচিত হওয়া থেকে বিরতই বা রাখতে পারবে কেমন করে? কেননা ইসলামী সমাজে বিশেষ কোনো শ্রেণী বা গোষ্ঠীর লোকদের হাতে বিশেষ কোনো ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়া কখনোই সম্ভব হতে পারে না।
তবে ভুল করে এমন কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপ্রধান বানিয়ে ফেলা অসম্ভব নয়, যে বাস্তবিকই রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার যোগ্য নয় এবং পরে জানা যাবে যে, লোকটি আসলে দুর্বল, ব্যক্তিত্বহীন ও অনভিজ্ঞ। কোনো বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট রায় দেওয়া বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার যোগ্যতাও তার নেই। এরূপ অবস্থায় সমস্ত দায়-দায়িত্ব সর্বসাধারণ মুসলমানকে গ্রহণ করতে হবে। কেননা তারাই তো স্বাধীন মত জানিয়ে তাকে নির্বাচিত করেছে এবং তারা যখন ইচ্ছা করে, তাকে পদচ্যুতও করতে পারবে। তখন সমস্ত দায়িত্ব আবার মুসলিম জনগণের ওপরেই বর্তাবে। এ অধিকার তাদের রয়েছে, চিরকালই তা থাকবে। তারা নির্বাচিত ব্যক্তিকে বলবে, আমরাই তোমাকে নির্বাচিত করেছিলাম, কিন্তু অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমাদের সম্মুখে স্পষ্ট হয়েছে যে, তুমি আসলে এই পদের দায়িত্ব বহনের বা এই আসনে আসীন হওয়ার যোগ্য নও। অতঃপর তাকে পদচ্যুত করে তারা আর একজনকে নির্বাচিত করে নেবে।
ইসলামের এই অকাট্য বিধানের আলোকে এ কথা প্রতিভাত হয় যে, ইসলামী সমাজে কেবল নীতিগতভাবেই নয়, প্রকৃত বাস্তবতার মধ্যেই রয়েছে সত্যিকার স্বাধীনতা, ইজ্জত, মান-মর্যাদা ও সম্মান।
হ্যাঁ, কখনও এমন অবস্থা দেখা দিতে পারে যে, রাষ্ট্রপ্রধান আর তার সাথে সাথে জনগণও কোনো বিশেষ নাযিল হওয়া শরীয়তের মৌল নীতিতে সমস্যার সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না, তখনও সে বা তারা যা ইচ্ছা হয়, তাই করতে পারবে না। এরূপ অবস্থার জন্যে শরীয়তে যে পন্থা নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তা-ই অনুসরণ করতে হবে। এখানে অবশ্য বিস্তারিত আলোচনা আমরা করব না। তবু সংক্ষেপে বলা যায়, এরূপ অবস্থার সুন্নাত, ইজমা, কিয়াস, ইজতিহাদের এই উপায়সমূহ অবলম্বন করে শূরার ভিত্তিতে এমনভাবে আইন রচনা করতে হবে যে, আল্লাহর অনুমতি ও পথ প্রদর্শনর সাহায্যে সম্মুখবর্তী বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, যা অবশ্যই শরীয়তের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকবে, তা লংঘিত হবে না।–[‘মানবীয় জীবনে বিবর্তন ও স্থিতি’ শীর্ষক গ্রন্থে আমি উল্লেখ করেছি সেই উপাদানসমূহের কথা, যা মানবীয় মনে ও জীবনে বিবর্তন ও পরিবর্তনের সৃষ্টি করে এবং যা তথায় স্থিতি নিয়ে আসে। ইসলাম আল্লাহর দ্বীন এই উভয় ধরনের উপাদান সমূহের মধ্যে কি ভাবে পূর্ণ মাত্রার সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে তাও বর্ণনা করেছি। তারই ফলে স্থিতিশীল বিষয়গুলো সম্পর্কে স্থায়ী বিস্তারিত বিধানকে, যা কোনো দিনই পরিবর্তন হয় না। কেননা সেই বিষয়গুলোই এমন, যা কোনোদিনই পরিবর্তিত হয় না। পক্ষান্তরে পরিবর্তনশীল ব্যাপারাদিতে একটি বিবর্তনশীল মৌলনীতির বেষ্টনী দেয়, যা সাধারণ ও স্থায়ী ও পরবর্তীকালসমূহ তার পরিপক্কতা ও বিবর্তনের অনুপাত ও সমাজ পরিস্থিতি অনুযায়ী বিবর্তনশীল আইন তৈরীর মাধ্যমে একটা স্থায়ী বেষ্টনী সৃষ্টি করে। এরই দরুন শরীয়ত স্থায়িত্ব পায় এবং ফিকাহ ক্রমবৃদ্ধি লাভ করে মানুষের প্রয়োজন অনুপাতে। যেমন উমর ইবনে আবদুল আজীজ বলেছেন, যে রকম সমস্যা আসে, মানুষ সেই অনুযায়ী সমস্যার ফয়সালাও পেয়ে যায়।]
আল্লাহর পদ্ধতি অনুযায়ী রাজনীতির উপরোক্ত মৌল নীতিই মূলত মানুষের স্বাধীনতা ও সম্মান বিধানাকরী। তা-ই মানুষকে তাগুতী শক্তির গ্রাস থেকে রক্ষা করে।
জনগণের দোহাই দিয়ে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করবে, এমন কোনো শ্রেণী এই রাজনীতির অধীন থাকতে ও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের কাছ থেকে স্বাধীনভাবে আনুগত্যের বায়’আত গ্রহণ করে, লোকদের মধ্য থেকে বিশেষ কোনো শ্রেণী তা আয়ত্ত করতে পারে না। আইন রচনার অধিকারও পায় না সমাজের বিশেষ কোনো শ্রেণীর লোকেরা।
সে হুকুম দেয় –শাসন কার্য পরিচালনা করে আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী। তার সমস্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সীমিত থাকে আল্লাহর শরীয়ত জারী ও কার্য করার দায়িত্ব পালনের মধ্যে। নাযিল হওয়া শরীয়তের কোনো বিষয়ে যদি সে কোনো অকাট্য দলীল না পায়, তাহলে তখনও সে স্বেচ্ছাচারিতা করতে পারে না, সে সেই নিয়মাবলী মেনে চলতে বাধ্য হয়, যার ফলে শেষ পর্যন্ত তার হুকুম-আইন বা সিদ্ধান্তটা আল্লাহর নাযিল করা বিধানের সীমার মধ্যেই থাকে।
আল্লাহর পদ্ধতি অনুযায়ী রাজনীতির এগুলোই হচ্ছে সাধারণ নীতি। এইগুলো যেমন একক, তেমনি অনন্য। এইগুলোই মানুষের জন্যে প্রকৃত স্বাধীনতা, সম্মান ও মর্যাদা নিশ্চিত করে, কোনো তাগুতী শক্তি তার ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনের একবিন্দু সুযোগ পায় না।
সাধারণভাবে সমস্ত জাহিলিয়াত বিশেষভাবে আধুনিক জহিলিয়াতের বাস্তবতার আলোকে উক্ত মৌলনীতিসমূহ চিন্তা-বিবেচনা করলেই আমরা বুঝতে পারি, আল্লাহ তা’আলা সার্বভৌমত্ব ও আইন রচনার নিরঙ্কুশ অধিকারকে কেবলমাত্র নিজের জন্যে সংরক্ষিত করে রাখার অন্তর্নিহিত তত্ত্ব ও কারণ।
নির্বোধ লোকদের জাহিলিয়াত নিজেরই ধোঁকায় পড়ে গেছে এবং মানুষকেও কঠিন বিপদে ফেলে দিয়েছে এই কারণে যে, তা মনে করেছে, আল্লাহর কাছ থেকে জীবনের বিধান গ্রহণের কোনো প্রয়োজন নেই, মানুষ তার মুখাপেক্ষীই নয়। এ জাহিলিয়াত তো আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে ঘৃণা বোধ করেছে এবং সার্বভৌমত্বের অধিকার ও কর্তৃত্ব আল্লহার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে। আর তারই পরিণতিতে আজকের মানুষ চরম মাত্রার দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে পড়ে গেছে। পুঁজিবাদী স্বৈরতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রবাদী প্রোলেটারীয় স্বৈরতন্ত্রের অধীন মানুষের জীবন কি মর্মান্তিক অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে, তা দেখলেই আমরা সেই পরিণতির মর্মান্তিকতা অুধান করতে পারি, এসব সমাজে মানুষ চরম মাত্রার লাঞ্ছনা ও অপমান ভোগ করছে।
কেবলমাত্র আল্লাহর সার্বভৌমত্বই বিশ্ব মানবতাকে এই আল্লাহদ্রোহী ও সীমালংঘনমূলক স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি দিতে পারে। তাদেরকে তাদের মায়েরা প্রসব করেছিল। তাতেই জনগণের যাবতীয় ব্যাপার তাদের হাতেই এসে যায়। আল্লাহর শরীয়তই তাদেরকে তা দেয়। কোনো সময় যদি কোনো বিদ্রোহী দল তাদেরকে অধীন বানিয়ে নিতে চায়, তা হলে তাদের প্রত্যাখ্যান করার অধিকার তাদের সব সময়ই থাকে। কেননা তরা বিলীয়মান কোনো ‘নিশ্চিত অনিবার্যতাকে’ মেনে নিতে বাধ্য নয়। কোনো বিশেষ শ্রেণীর লোকদের স্বার্থ ও সুবিধা তাদেরকে বাধ্য করতে পারে না ইতিহাসের কোনো নিশ্চিত অনিবার্য পর্যায়ের গ্রাসে পড়ে যেতে। হ্যাঁ, যদি কোথাও তাতে মানুষ পড়ে গিয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে যে, তা পড়ে নিয়েছে শুধু এজন্যে যে, তারা তার প্রতিরোধ করে আল্লাহর শরীয়ত প্রতিষ্ঠিত করতে সাহস পায়নি, তার মোকাবিলায় তারা চরম দুর্বলতা দেখিয়েছে। তবে সব সময়ই তারা ফিরে আসতে পারে, তার উৎখাত সাধন করে আল্লাহর শরীয়ত বাস্তবায়িত করতে পারে, তাতে তাদের যত ত্যাগ স্বীকার করতে ও কুরবানী দিতে হোক-না-কেন এবং যত কঠিন বিপদের ঝুঁকিই তাদের মাথায় টেনে নিতে হোক-না-কেন। সে ত্যাগ ও কুরবানী হবে সেই তাগুতী দুঃশাসনের অধীনতার যিল্লতী ও অপমানের মূল্য দান যা তাদেরকে নিশ্চিত অনিবার্যতার দোহাই দিয়ে ভোগ করতে বাধ্য করছে, তা থেকে পালিয়ে যেতে পারছে না।
এ ছাড়া মানুষের অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, নৈতিকতা, নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও শিল্প-সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে আল্লাহর পদ্ধতির ছায়াতলে ইসলামী শরীয়ত তাদেরকে দেয় পরিপূর্ণ ন্যায়পরতা ও সুবিচার, নির্বিশেষে সমস্ত মানবতার জন্যে নির্ভেজাল কল্যাণ। তবে আমরা প্রথম দিক এই রাজনীতি সম্পর্কেই কথা বলেছি, কেননা মানব জীবনে তা অত্যন্ত পূর্ণ, তা-ই তো সামগ্রিকভাবে মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
এ পর্যায়ে আমাদের কথা হচ্ছে, মানুষকে সর্বপ্রথম স্বাধীনতা পেতে হলে মানুষের নিজেদের আইন রচনার অধিকার অস্বীকার করতেহবে এবং নিজ স্বভাবে আইন রচনার কর্তৃত্বশালীকে পদচ্যুত করতে হবে। কেননা তা চিরদিনই অত্যাচারী। তা তারা দখল করে যখন আল্লাহর নাযিল করা দ্বীন-ইসলাম অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করে না।
আল্লাহর শরীয়ত মানুষের মর্যাদা, তার প্রতিভা, কর্মশীলতা, তাদের পরিপক্কতা ও অগ্রসরতাকে কখনোই খাটো করে দেখেনি। বরং এই সব কিছুই প্রকৃত উৎকর্ষ লাভ করে যখন তারা নিজেদের জন্যে আইন রচনার কাজকে হারাম মনে করে নেয়। তখনই তা একটি উপায় দেখা দেয় সকল প্রকার সীমালংঘনমূলক কার্যক্রম থেকে প্রকৃতভাবে মুক্ত করার জন্যে। এ ছাড়া অন্য কোনো পন্থা বা উপায়ই নেই।
উপরে আলোচিত সত্যনিষ্ঠ কথাগুলো আমাদের গভীরভাবে অনুধাবন করা উচিত এবং তা নিজের মনে-মগজে দৃঢ়ভাবে স্থিতিশীলও করে নেওয়া আবশ্যক। তা করতে পারলেই আমরা অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা ও নৈতিকতা ইত্যাদির ক্ষেত্রে আল্লাহর শরীয়তের বিরাট অবদানের মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে সক্ষম হবো।
জাহিলিয়াতের সীমালংঘনমূলক পরিবেশে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুটি ব্যাপার চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে।
তার একটি দিক হচ্ছে নিরংকুশ ব্যক্তি-মালিকানা পদ্ধতি আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, যারাই ধন-সম্পদের একচ্ছত্র মালিক, তারাই সেখানকার নিরংকুশ শাসক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সর্বোচ্চ ধারক।
আল্লাহর পদ্ধতি একই সঙ্গে এই দুটি মারাত্মক ব্যাপারে প্রতিবিধান করে এবং তার ফলেই মানুষের কল্যাণ সাধিত হয়।
প্রথমত, ইসলাম এমন কোনো শ্রেণীকে ক্ষমতায় আসতে দেয় না –এসে থাকলেও ক্ষমতাচ্যুত করে দেয়, যে স্বৈরতন্ত্র চালাতে চায়। সেখানে তার পরিবর্তে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে নিরংকুশ ও অবিসংবাদিত করে প্রতিষ্ঠিত করে। মানুষকে সকল প্রকার সার্বভৌমত্ব বা নিরংকুশ ক্ষমতা থেকে সম্পূর্ণ রহিত করে দেয়।
ইসলাম মালিকদের ক্ষেত্রে একটি পরম ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে। পুজিবাদী জাহিলিয়াতে ব্যক্তিগত মালিকানাকে সীমাহীনভাবে নিরংকুশ করে দেয়। তারই ফলে মালিকবিহীন সর্বহারা লোকেরা –স্বল্প বিত্তের অধিকারীরা –সেই সম্পদ-মালিকদের দাসত্ব করতে বাধ্য হয়।
আর সামষ্টিক জাহিলিয়াত –কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্রে –এই ব্যক্তিগত মালিকানা বন্ধ করে অনুরূপভাবে মালিকানাহীন কোটি কোটি মানুষকে নিকৃষ্ট দাসানুদাসে পরিণত করে।–[পূর্ববর্তী অধ্যায় দ্রষ্টব্য।]
ইসলাম ব্যক্তিগত ‘মালিকানা’ নিষিদ্ধ করেনি তবে তাকে সীমাহীনভাবে নিরংকুশও করে দেয়নি। (ইসলামে ব্যক্তিগত মালিকানার অর্থ নিশ্চয়ই আল্লাহর মালিকানাধীন আমানতদারীর খিলাফত।–অনুবাধক)
ইসলাম ব্যক্তিগত ‘মালিকানা’ বন্ধ বা নিষিদ্ধ করেনি এই জন্যে যে, তা করা হলে সমস্ত মানুষের জীবন-জীবিক সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রের করায়ত্ত হয়ে পড়বে। তখন রাষ্ট্র তাদেরকে দাসানুদাস বানিয়ে রাখবে একমুঠো খাবারের বিনিময়ে। রাষ্ট্রই হবে একমাত্র রিযিকদাতা।
ইসলাম তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে এই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে যে, জনগণ হবে রাষ্ট্রপ্রধানের ‘পাহারাদার’। তারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য রাখবে আল্লাহর শরীয়ত কার্যকর করার ব্যাপারে সে কি ভূমিকা পালন করছে। কোনো সময় যদি তা কার্যকর করণে ভুল করে, তা হলে তারাই তাকে সতর্ক করে দেবে, ভুল করা থেকে বিরত রাখবে। আর নিষেধ ও সতর্ককরণ সত্ত্বেও যদি শরীয়ত বিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ-ই করে, তাহলে জনগণই তখন তাকে পদচ্যুত করবে।
(আরবী***********************************************************************************)
তোমাদের মধ্য থেকে অবশ্যই এমন একটি গোষ্ঠী বের হবে, যারা প্রকৃত কল্যাণের দিকে আহবান জানাতে থাকবে, ভালো কাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজ থেকে লোকদেরকে বিরত রাখবে। (সূরা আলে ইমরানঃ ১০৪)
রাসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
যে লোক কোনো শরীয়ত গর্হিত কাজ হতে দেখবে, সেটিকে তার নিজ হাত দ্বারা শক্তিবলে পরিবর্তন করে দেওয়া উচিত। তা না পারলে মুখে তা পরিবর্তনের কথা বলতে হবে। আর তা-ও যদি না পারে, তা হলে অন্তর দিয়ে তার পরিবর্তন কামনা করতে হবে। তবে এটা হলো দুর্বলতম ঈমানের লক্ষণ।
হযরত আবূ বকর (রা) খলীফা নির্বাচিত হয়ে প্রথম নীতি নির্ধারণী ভাষণে বলেছিলেনঃ
(আরবী***********************************************************************)
আমাকে তোমরা মেনে চলবে যতক্ষণ আমি মেনে চলতে থাকব আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে। আর আমিই যদি আল্লাহ ও রাসূলকে অমান্য করি, তাহলে তোমাদের জন্যে আমার আনুগত্যের বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
কিন্তু এরূপ সমাজে পরিবেশ ও গণ-স্বাধীনতা বাস্তবায়িত হতে পারে না, যদি সমাজের জনগণ এক মুঠি খাবারের জন্যে রাষ্ট্র-সরকারের গোলামী করতে বাধ্য হয়।
বস্তুত ইসলাম একটি বাস্তব জীবন বিধান। তা মানুষকে ফেরেশতা মনে করে না, মানুষই মনে করে এবং তারা সকলেই চির উন্নত মানের বলিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র সম্পন্ন হবেই –এমন একটা কথাও ধরে রাখেচি, ইসলাম মানবীয় সমস্ত তত্ত্ব লক্ষ্য করে সেই হিসেবেই আচরণ গ্রহণ করে। মানুষ কখনও দুর্বল হয়, কখনও হয় শক্তিসম্পন্ন, একথা ইসলাম কখনই ভুলে যায় না। এটাও অসম্ভব মনে করা না যে, মানুষ যেমন উন্নতমানের চরিত্র বিশিষ্ট হতে পারে, তেমনি নৈতিকতার নিম্নতম অংশেও তারা নেমে যেতে পারে। ইসলাম মানবীয় বাস্তবতার এই ভিত্তির ওপরই তার পূর্ণাঙ্গ বিধানকে কার্যকর করে, মানুষ যদি অত্যাচারী স্বৈরতন্ত্রী শাসকের কাছে দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে ইসলাম তাকে সহযোগিতা দেয়, সমর্থন দেয় তাকে পদচ্যুত করার কাজে। ইসলাম চায় লোকদের রিযিকের উত্তম উৎপাদন, বণ্টন ও পারস্পরিক বিনিময়ের কাজটা জনগণ নিজেদের হাতেই রাখুক এবং সব আদৌ কায়েম হতে না পারে। কেননা রাষ্ট্র-সরকার যেখানে জনগণের রিযিক পাওয়ার একমাত্র উৎস বা মাধ্যম হয়, সেখানে মানুষের স্বাধীনতা বলতে কিছু থাকতে পারে না।
অপরদিকে ইসলাম বাস্তবতার দৃষ্টিতে ব্যক্তি-মালিকানার সীমিত অনুমতি দিয়েছে এই লক্ষ্যে, যেন কতিপয় মানুষ অন্য সমস্ত মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দিতে না পারে।
এই কারণে অনুমতি দেওয়া ব্যক্তি মালিকানার ওপর এমন সব শর্ত ও বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে, যা কারোর হাতে বিপুল পরিমাণ ধন-মাল পুঞ্জীভূত হতে বাধা দেয়, মুষ্টিমেয় লোকের পক্ষে সমস্ত জাতীয় সম্পদ করায়ত্ত করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই শর্ত ও বিধি-নিষেধ পর্যায়ে প্রথম উল্লেখ হচ্ছে, প্রতিটি ব্যক্তিকে নিতান্ত হালাল ও পবিত্র উপায়ে তা অর্জন করতে হবে, হারাম উপায়ে নয়। প্রত্যেক সম্পদ-সম্পত্তির মালিকের জীবনাবসানে তা তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী বণ্টন হবে। তাই মীরাস বাবদ প্রাপ্ত সম্পদ-সম্পত্তির হালালভাবে অর্জিত মনে করে। এক বছরকাল মালিকানাধীন থাকার পর তার ও তার মুনাফার ওপর যাকাত ফরয হয়, এই যাকাত বাবদ প্রাপ্ত সম্পদও হালাল। আর নিষেধের বড় দিক হচ্ছে সূদ ও পণ্য মওজুদকরণ। এসব ক্ষেত্রে যেখানেই বিপথগামিতা লক্ষ্য করা যাবে তাকে সংশোধন করার পূর্ণ কর্তৃত্ব ইসলাম দেয় রাষ্ট্র-শাসককে। তবে এই কর্তৃত্ব কার্যকর করতে গিয়েও ইসলামের দিক দিয়ে জীবনের যে ভিত্তি ও মূল তাকে কিছুতেই ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না। ব্যক্তির জন্যে রিযিকের দুয়ার এমনভাবে উন্মুক্ত থাকবে যার ওপর সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, যতক্ষন পর্যন্ত তা শরীয়তের সীমালংঘন না করছে।
সুদী ব্যবস্থা ও মওজুদকারী, একচেটিয়া কারবার পুঁজিবাদের একটা সীমালংঘনমূলক কার্যকলাপ বিশেষ। এর মধ্যে সেই পুঁজিপতিরা ধীরে ধীরে বিন্দু বিন্দু করে সম্পদ পুঞ্জীভূত করে নেয়ে এবং অন্য সমস্ত মানুষকে বঞ্চিত করে তাদের মৌল জীবন-জীবিকা থেকেও।
ইসলাম যে আল্লাহর বিধান ও সর্বাধিক কল্যাণকর, এই কথা প্রমাণের জন্যে যদি কোনো দলীলের বা সাক্ষ্যের প্রয়োজন অনুভূত হয়, তাহলে আমরা বলব উক্ত ব্যবস্থাই তার অকাট্য প্রমাণ। কেননা আজকের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সবকিছুই সীমালংঘনমূলক ও বিপর্যস্ত ব্যবস্থা। মানবতার জন্যে চরম অপমানকর। পৃথিবীর জাতি ও মানব গোষ্ঠীসমূহের ওপর বীভৎস সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রধান হাতিয়ার। ইসলাম যখন নাযিল হয়েছিল, তখন মানুষের কাছে পুঁজিবাদের এই বীভৎস রূপ স্পষ্ট ও প্রকট ছিল না। এই পুঁজিবাদের ভিত্তি যে সুদ ও ইজারাদারী ব্যবস্থা তা-ও তখন কারুরই জানা ছিল না।
কিন্তু ইসলাম এই দুটোকেই সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে। ইসলামের আল্লাহ প্রদত্ত বিধান হওয়ার কথা প্রমাণের জন্যে এই কথাটি যথেষ্ট। সাক্ষ্য-সাবুতের প্রয়োজন বোধ করলে যে-কেউ উক্ত পদক্ষেপ গ্রহণকে বিবেচনা করে নিঃসন্দেহে বুঝতে পারে যে, ইসলাম নিঃসন্দেহে আল্লাহর ব্যবস্থা।
এখানে অবশ্য ইসলামের অর্থ ব্যবস্থঅ বিস্তারিত পেশ করার অবকাশ নেই। পূর্বে যেমন বলেছি, এই নির্দিষ্ট ও বিশেষ বিষয়ে বহু কয়টি মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে, যা অধ্যয়ন করলে এ বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব।
তবু ইসলামী বিধানের অর্থনীতির মৌল ও প্রধান-প্রধান নীতিসমূহের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ এখানে করে দিচ্ছিঃ
ইসলামী অর্থ ব্যবস্থার সাধারণ মতাদর্শের ভিত্তিগত কথা হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলা এই পৃথিবীতে মানব প্রজাতিকে তাঁর খলীফা বানিয়েছেন। তাকে ধন-মালও দিয়েছেন, কিন্তু তার ‘মালিক’ সে নয়, এসব কিছুরই প্রকৃত মালিক একমাত্র আল্লাহ। আর মানব সমাজ নির্বিশেষে আল্লাহর খলীফা। মানুষকে এই খিলাফতের দায়িত্ব পালন করতে হবে শরীয়তের বর্ণিত শর্তসমূহ অনুযায়ী। শরীয়তে এই শর্ত হয় মৌল সামগ্রিক নীতি হিসেবে উদ্ধৃত হয়েছে, না হয় বিস্তারিত খুঁটিনাটিসহ আইন দেওয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের মৌল-নীতিই অনেক বেশী।
ব্যক্তি এই ধন-সম্পদের বেতনের শর্তে নিযুক্ত। ব্যক্তি এই মাল-সম্পদ নিয়ে যে চেষ্টা-সাধনা ও কষ্ট স্বীকার করছে ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রিত মালিকানার ভিত্তিতে, তার-ই কারণে উক্ত বেতন প্রাপ্তির অধিকার সে লাভ করে। সেই সাথে তাকে উত্তম নীতিতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেই অধিকার উত্তমভাবে ভোগ করার শর্ত হচ্ছে সে তা থেকে বেতন বাবদ গ্রহণ করতে পারবে তার যা প্রয়োজন। এই নির্ভুল হস্তক্ষেপের শর্ত ব্যক্তির ওপর যেমন, তেমনি সমাজ-সমষ্টির ওপরও। উভয়েরই কল্যাণ এরই উপর নির্ভর করে। আল্লাহর আরোপিত এসব শর্তে পরিপূরণ ব্যতীত কোনো কল্যাণই লাভ করা যেতে পারে না। কোনো ব্যক্তি যদি ধন-সম্পত্তি হাতে পেয়ে নির্বুদ্ধিতা করে, খারাপভাবে ব্যয়-ব্যবহার করে, বেহুদা ব্যয় করে তাহলে তার এই ব্যয় অধিকারকে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। তখন সে অধিকার সমাজ-সমষ্টির হাতে ফিরে আসবে। কেননা এটা তো পূর্বেই প্রমাণিত যে, মানব সমষ্টিই হচ্ছে আসলে পৃথিবীতে আল্লাহর খলীফা, কোনো ব্যক্তি হিসেবে তা নয়। সমাজ-সমষ্টির এই হস্তক্ষেপ অধিকার প্রয়োগে ব্যক্তি-মালিকানা ব্যবস্থা –ইসলামে যা এবং যতটুকু আছে –কিচুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কেননা এখানে কেবল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই নয়, সমস্ত ব্যবস্থাতেই ব্যক্তিত্ব স্বীকারের সাথে সাথে সমষ্টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে অর্থ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে উত্তম ব্যয় ব্যবহার করার অধিকারের নিরাপত্তা বিধানকারী হচ্ছে এই শর্তসমূহ। এগুলোর কারণে সমষ্টির স্বার্থও –যা ব্যক্তিগণের হাতে রক্ষিত সম্পদের ওপর আরোপিত –রক্ষা পায়, যাকাত আদায়ের মাধ্যমে, কেননা যাকাত ইত্যাদি তো সমষ্টির প্রয়োজন পূরণের জন্যে তা প্রয়োজন পরিমাণে গ্রহণ করা হয় ব্যক্তিগণের বিভিন্ন হাতে রক্ষিত সম্পদ থেকে। এরূপ অবস্থায়ও ব্যক্তির অধিকার কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন হয় না। তবে যে সব সম্পদ সম্পত্তিতে সাধারণ মালিকানায় রাখা হয়েছে সেগুলোর কথা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
(আরবী**********************************************************************)
এবং দাও তাদের আল্লাহর সেই ধন-মাল থেকে, যা তিনি তোমাদেরকে দান করেছেন। (সূরা আন-নূরঃ ৩৩)
(আরবী***************************************************************************)
এবং তোমরা দিও না নির্বোধ লোকদেরকে তোমাদের ধন-মাল, যাকে আল্লাহ তোমাদের জন্যে জীবিকার বাহন বানিয়েছেন। (সূরা আন-নিসাঃ ৫)
সমাজের মধ্যে সম্পদ বণ্টনের একটি স্থায়ী নিয়ম গ্রহণ করেছে ইসলাম। সে পর্যায়ের মৌল নীতি হচ্ছেঃ
(আরবী****************************************************************************)
যেন ধন-সম্পদ তোমাদের মধ্যকার কেবল ধনী লোকদের মধ্যেই আবর্তনশীল হয়ে না থাকে। (সূরা হাশরঃঞ ৭)
এসব মৌল নীতির কারণে ধনীগণ ধন-সম্পদকে নিজেদের করায়ত্ত ও কুক্ষিগত করে রাখবে, তার কোনো অধিকারই নেই। বরং তাদের মালিকানা সম্পদ ও সম্পত্তিকে বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে বিতরিত ও বণ্টিত হতে হবে। আর তাহলেই ধন-সম্পদ তার স্বাবাবিক ভূমিকা পালন করতে পারবে জাতির বিপুল সংখ্যক লোকদের মধ্যে।
এভাবেই সমাজের বঞ্চিত ও অভাবগ্রস্থ লোকেরা তাদের প্রাপ্য ‘হক’ সমাজের কাছ থেকে পেয়ে যাবে। ইসলামী আদর্শে গঠিত সমাজই এই হক যথারীতি আদায় করতে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করবে। অভাবগ্রস্তদের মধ্যে তা নিয়মিতভাবে বণ্টন করে দেবে। আল্লাহর ঘোষণাঃ
(আরবী*************************************************************************)
এবং তাদের ধন-মালে বঞ্চিত ও ভিক্ষুকদের ‘হক’ রয়েছে। (সূরা যারিয়াতঃ ১৯)
এই ‘হক’ হচ্ছে যাকাত। আল্লাহর তরফ থেকে নিয়মিতভাবে আদায় করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে ধনী লোকদের ওপর এবং সমষ্টিগতভাবে গোটা ইসলামী সমাজের ওপর। তা হিসাব করে দিতে ও আদায় করতে হয়, যখনই ধনীদের কাছে সঞ্চিত নগদ সম্পদ বা নতুন ফসল আসবে।
অর্থ-উপার্জনের জন্যেও বহু নিয়ম-নীতি নির্ধারিত হয়েছে। অর্থের পারস্পরিক লেন-দেনও নিশ্চয়ই সেই নিয়ম-নীতি অনুযায়ী সম্পাদিত হতে হবে। অতএব উপার্জন প্রক্রিয়া বা পারস্পরিক লেন-দেন পদ্ধতিতে এমন পন্থা কিছুতেই গ্রহণ করা যাবে না, যাতে ব্যক্তির বা সমাজের অন্যান্য লেকাদের ক্ষতি হওয়ার বা শোষণের কোনো দিক থাকবে। এই কারণেই চুরি, ডাকাতি, লুটপট, ছিনতাই, অপহরণ, ধোঁকা, প্রতারণা –কম মাল দিয়ে বেশি মূল্য নেওয়া বা খারাপ মাল দিয়ে ভালো মালের মূল্য গ্রহণ এবং মওজুদদারী করে সমাজকে কষ্ট দেওয়া ও বিপুল মুনাফা লুণ্ঠনের কৌশল অবলম্বন করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। অনুরূপভাবে সুদও হারাম। শুধু তা-ই নয়, তা হচ্ছে অর্থোপার্জনের নিকৃষ্ট ও বীভৎসতম উপায়। আল্লাহর নির্দেশঃ
(আরবী*****************************************************************************)
হে ঈমানদারগণ! তোমরা ভয় করো আল্লাহকে এবং সুদের অবশিষ্ট অংশ পরিহার করে যদি তোমরা প্রকৃত মুমিন হও। যদি তা না করো, তাহলে তোমরা আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে প্রস্তুত হও। (সূরা বাকারাঃ ২৭৮-২৭৯)
ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় পারস্পরিক নির্দোষ সহযোগিতার বিধান করা হয়েছে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি সময়মত ঋণ ফেরত দিতে না পারলেঃ
(আরবী******************************************************************************)
ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি অভাবের মধ্যে পড়ে তাহলে তার স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে অবকাশ দেওয়া কর্তব্য। আর যদি দান-ই করে দাও, তাহলে তা-ও তোমাদের জন্যে অতীব উত্তম, যদি তোমরা জানো। (সূরা বাকারাঃ ২৮০)
এসব সাধারণ নিয়ম। এসব নিয়মের বেষ্টনীর মধ্যেই ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা পরিপক্ক, প্রবৃদ্ধ, উন্নত ও অগ্রসর হয় কোনোরূপ বাধা-প্রতিবন্ধকতা ব্যতিরেকেই। তবে বিপথগামিতা ও বিপর্যয় রোধ করার জন্যে এ নিয়মগুলো সদা সক্রিয়।–[‘স্থিতি ও পরিবর্তন’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।]
এই পথ ও পন্থায়ই ইসলাম বিবর্তনের সকল স্তরেই যাবতীয় অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করে থাকে। এর দরুন মানুষের জুলুম ও শোষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব এবং সে ব্যবস্থায় দুনিয়ার কোনো বিদ্রোহী সীমালংঘনকারী ব্যক্তির দাস হতে হয় না জনগণকে।
উপরে যেসব সাধারণ নিয়ম-নীতির উল্লেখ করা হয়েছে, তার সাথে অপর একটি মহাসত্য কথা যোগ করা বাঞ্ছনীয় মনে হয়, যার দরুন অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইসলাম স্বতন্ত্র ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
তা হচ্ছে, ইসলামী আকীদা বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা মানুষকে কোনো প্রকারেই নিশ্চিত অনিবার্যতার দাস বানায় না, তা জড়বাদের নিশ্চিত অনিবার্যতা হোক, কি অর্থনৈতিক অথবা ঐতিহাসিক নিশ্চিত অনিবার্যতা।
ইসলামে মানুষই হচ্ছে তাদের সমাজ ও অর্থনীতির আসল হোতা। তথায় কোনো নিশ্চিত অনিবার্য স্তর নেই, যা মানুষের জীবনে কোনো নির্দিষ্ট কাঠামো গড়ে দিতে পারে এবং একটি শ্রেন অপর শ্রেণীর ওপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের নিশ্চিত অনিবার্যতার দরুন বিজয়ী হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
তা হতে পারে কেবল বিপথগামি জাহিলিয়াতের স্থান। কেননা তা আল্লাহ প্রদর্শিত পন্থায় অনুসারী নয়।
কিন্তু ইসলামী পন্থায় মানুষ এক আল্লাহর বান্দা হয়, ইবাদত কেবল তাঁরই করে। কোনো প্রকারের নিশ্চিত অনিবার্যতার দাসত্ব করে না।
ইসলাম মানুষের এই পতন যুগেও বিভ্রান্তি ও বিপর্যয় অনেকখানি প্রতিরোধ করেই বলেছে। ইউরোপের ভয়াবহ সামন্তবাদ ইসলাম অধ্যুষিত দুনিয়ায় স্বীয় বাধ্যবাধকতা মুসলমানদের ওপর এমনভাবে চাপাতে পারেনি, যতটা ইউরোপে চেপে বসেছিল।
ইসলামী আদর্শের মানুষই হচ্ছে আসল সক্রিয় শক্তি। সমগ্র বিশ্বলোক তার সমস্ত শক্তি-সামর্থ্য বিনিয়োগের ক্ষেত্র, তার ব্যবহারাধীন।
(আরবী***********************************************************************)
এবং আল্লাহ তোমাদের জন্যে কর্মে নিরত রেখেছেন আকাশমণ্ডলে যা আছে ও পৃথিবীতে যা আছে তা সবই। (সূরা জাছিয়াতঃ ১৩)
এভাবেই মানুষ তার আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণানুযায়ী তার অর্থ ব্যবস্থাকে পূর্ণাঙ্গভাবে গড়ে তোলে। আল্লাহ তা’আলা নিজ ইচ্ছানুক্রমেই মানুষকে এরূপ করার সুযোগ দিয়েছেন। ফলে মানুষ কখনোই অর্থনৈতিক নিশ্চিত অনিবার্যথার অধীন অপমানিত ও লাঞ্ছিত হবে না। এমন কেউ কোথাও থাকবে না, যে মানুষকে বিনীত দাসানুদাস বানাতে পারে এবং তাকে বিনয়াবনত বানিয়ে তার ওপর কোনো নিশ্চিত অনিবার্যতা চাপিয়ে দিতে পারে।
ইসলাম যখন মানুষকে এই ইতিবাচক সক্রিয় ভূমিকা পালনের সুযোগ দিয়েছে, তখন তা অবশ্যই তাকে সম্মানিত করবে ধারণা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এবং তার বাস্তব জীবনাচরণও যথার্থ ও নির্ভুল করে দেবে। তার ফলে গোটা মুসলিম সমাজ হবে জুলুম-শোষণ বিপর্যয় ও বিপথগামিতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র।
দ্বীন-ইসলাম সামাজিক সামষ্টিক ব্যাপারাদিতে প্রথম থেকেই ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে পূর্ণ মাত্রার ভারসাম্য বাস্তবায়িত করেছে। সেই সাথে সমাজের পুরুষ ও নারীর পারস্পরিক জটিল সমস্যাটিরও সুষ্ঠু সমাধান করেছে।–[এখানে আমরা যৌন সম্পর্কের কথা তুলছি না, আলোচনা করছি না সমষ্টি সম্পর্কের পর্যায়ে। যৌন-সম্পর্ক যদিও তারই একটা অংশ কিন্তু তার প্রকৃতি স্বতন্ত্র। এই কারণে এখানে স্বতন্ত্রভাবে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।]
ইসলামের দৃষ্টিতে ব্যক্তি ও সমষ্টি দুই সাংঘর্ষিক যুধ্যমান বাহিনী নয়। আর তা হওয়াও নিশ্চয়ই বিন্দুমাত্র বাঞ্ছনীয় নয়।
আল্লাহ তা’আলা মানুষকে যে খিলাফতের দায়িত্ব ও মর্যাদা দান করেছেন, তা যেমন ব্যক্তির জন্যে তেমনি সমাজ সমষ্টির জন্যেও। মানুষ যখন একজন ব্যক্তি ঠিক সেই সময়ই সে সমাজেরই একজন। ব্যক্তি তার খিলাফতের মর্যাদা প্রয়োগ করবে সামষ্টিক খিলাফত রক্ষা করে, তাকে লংঘন বা ক্ষুণ্ন করে নয়।
অতএব এই দুয়ের মধ্যে কোনো শত্রুতা বা হিংসা বিদ্বেষের কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। এই দুটির একটির অপরটির ওপর প্রাধান্য পাওয়ার কথাও একেবারে অবাস্তব।
যে মতাদর্শ সমাজকে ব্যক্তির শত্রু হওয়ার ধারণা দেয়, তা নিশ্চয়ই ব্যক্তিকে ধ্বংস করতে চায়। পক্ষান্তরে যে মতাদর্শ ব্যক্তিকে সমাজ সমষ্টির শত্রু হওয়ার প্ররোচনা দেয়, তা-ও ব্যক্তিকে সমাজ সমষ্টির অফুরন্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রাখতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ দুটি মতাদর্শই ভারসাম্যহীন, চরমবাদী ও বিপর্যস্ত।
ভারসাম্যপূর্ণ পথ হচ্ছে ব্যক্তি সমষ্টিরই একজন এবং সমাজ ব্যক্তিদেরই সমন্বয়ে গঠিত। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির চিন্তা করাও সম্ভব নয়। এ দুইয়ের মাঝে নেই কোনো বিচ্ছিন্নতা বা পার্থক্য।
বিপর্যস্ত অবস্থায়ই কেবল বিদ্রোহী ও তাগুতী স্বভাব সম্পন্ন ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ সম্ভব। তার এই বিদ্রোহ যে ধরনেরই হোক-না-কেন। এ ব্যক্তিও হবে বিপর্যস্ত, চরিত্রহীন, লোভী। সে মনে করবে যে, সামাজিক নিয়মতন্ত্রের বাধাবন্ধন তাকে তার বিপথগামিতা ও বিপর্যয়মূলক কার্যকলাপ চালাবার স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে। এই কারণে সে এই সমাজ-সমষ্টিকে ও তার নিয়ম-শৃঙ্খলাকে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। অথবা সে চেষ্টা করবে সমাজের ওপর নিজের নিরংকুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে ও তাকে নিজের ইচ্ছেমতো পরিচালিত করতে –তার মধ্যে নিহিত বিপদগামী ভাবধারা অনুপাতে। কিন্তু ইসলামী সমাজে তা সম্ভব নয়।
অনুরূপভাবে সমাজও হতে পারে আল্লাহদ্রোহী, সীমালংঘনকারী। পরম ভারসাম্যপূর্ণ পথ থেকে বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত। সে সমাজ ব্যক্তিকে কখনোই কোনো সরল ঋজু আদর্শের পথে চালাতে পারে না, তাকে সে দিকে আহবান জানানো বা উৎসাহ দেওয়াও তার পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে তা ব্যক্তিগণকে ধ্বংসের দিকেই ঠেলে দেয়।
কিন্তু ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তি ও সমষ্টি সমান মর্যাদা সহকারে অবস্থান করে। একদিকে ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিত্বকে বিকাশ ও উৎকর্ষ লাভের সুযোগ দেয় এবং অন্যদিকে সমাজকে সুসংবদ্ধ ও স্বতন্ত্র করে গড়ে তোলে এবং উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য পুরোপুরি রক্ষা করে।
ইসলাম স্বাভাবিকভাবেই ও একই সময়ই ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে এবং উভয়ের প্রতি সমান গুরুত্ব আরোপ করে।
ইসলাম একদিকে ব্যক্তিকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। আর সেই সাথে সুসংবদ্ধ সমাজও গড়ে তোলে। দুটের ওপর সমাজ গুরুত্বই আরোপ করা হয়।
ইসলমা ব্যক্তিকে সরাসরি সম্বোধন করে, তাকে দেয় অনেকগুলো অধিকার এবং তার ওপর কিছু দায়িত্বও অর্পণ করে। ফলে তার ব্যক্তিত্ব স্বতন্ত্র মর্যাদা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে।
অনুরূপভাবে ইসলাম সমাজকেও স্বতন্ত্র ও প্রত্যক্ষভাবে সম্বোধন করে। তার জন্যে বিশেষ বিশেষ অধিকার নির্ধারণ করেছে, তার ওপরও অর্পিত হয়েছে অনেক দায়-দায়িত্ব। আর এ সবের মধ্য দিয়েই সুসংবদ্ধ সমাজ গড়ে ওঠে।
ইসলামে ব্যক্তি সরাসরি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। মাধ্যম হিসেবে কাউকেই গ্রহণ করা হয় না, তার কোনো প্রয়োজনও নেই। ব্যক্তি আল্লাহসে সরাসরি সম্বোধন করে, তাঁর সাথে গোপনে কথা বলে, তাঁরই বন্দেগী করে, তাঁর নৈকট্য চায় ও অর্জন করে, এই সব কাজই সে করে এক স্বতন্ত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যক্তিসত্তা হিসেবে। সুনির্দিষ্ট ও বিশেষত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বরূপে। ইসলাম তারমধ্যে এই চেতনা স্থায়ীভাবে জাগিয়ে দেয় যে, আল্লাহ তাকে ব্যক্তি হিসেবেই গুরুত্ব দিয়েছেন পূর্ণ মাত্রায়। তিনি ব্যক্তিকে ব্যক্তি হিসেবেই সৃষ্টি করেন তার পিতা-মাতার ঔরসে। আল্লাহ তাকে নিজ কুদরতেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সত্তা হিসেবে বানিয়েছেন। তিনিই তাকে রিযিক দিয়ে বাঁচিয়েছেন একজন ব্যক্তি হিসেবে। যদিও তার রিযিক পাওয়ার যাবতীয় উপায়ের সাথে গোটা সমাজ জড়ত; জড়িত গোটা বিশ্ব প্রকৃতি। কিন্তু রিযিকটা তো এককভাবে ব্যক্তির জন্যে ব্যক্তি হিসেবেই। আল্লাহর কাছে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের জন্যেই পরিমিত রিযিক লিখিত রয়েছে। যার জন্যে যে রিযিক যে পরিমাণে লিখিত আছে, তা তারই জন্যে, অন্য কেউ তা পেতে পারে না। ব্যক্তি যখন আল্লাহর কাছে দো’আ করে, আল্লাহ তা শুনেন, কবুল করেন। তিনি ব্যক্তির বৈষয়িক জীবনের প্রয়োজন পূরণ করে দেন। অবশ্য যদি তিনি চান। অথবা তার জন্যে পরকালে দেওয়ার সিদ্ধান্ত লিখে দেন। কিন্তু উভয় অবস্থাতেই আল্লাহ ব্যক্তির দো’আ কবুল করেন ব্যক্তি হিসেবেই, সে ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিদের সাথে একাকার নয়, তাদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আর শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি ব্যক্তি হিসেবেই আল্লাহর সম্মুখে হাযির হবে। বলেছেনঃ
(আরবী**********************************************)
সমস্ত লোকই কেয়ামদের দিন আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে একান্তই ব্যক্তিগতভাবে। (সূরা মারইয়ামঃ ৯৫)
আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবেন তার নিজের সম্পর্কে, তার ব্যক্তিগত কাজকর্ম সম্পর্কে। অন্য কারোর সম্পর্কে নয়।
(আরবী***************************************************************************************)
প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের কার্যকলাপ দ্বারাই বন্দী। (সূরা মুদ্দাসসিরঃ ৩৮)
(আরবী****************************************************)
কোনো বোঝা বহনকারীই অন্য কারোর বোঝা বহন করবে না।
(সূরা আনআমঃ ১৬৪)
এইসব ব্যবস্থাপনার কারণেই ব্যক্তির মধ্যে স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা হওয়ার একট চেতনা পূর্ণ মাত্রায় জেগে ওঠে সরাসরি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে।
ইসলমা ব্যক্তির ওপর ব্যক্তিগত পর্যায়ের বহু কাজের দায়িত্ব অর্পন করেছে, যেন ব্যক্তির মধ্যে স্বাতন্ত্র্যবোধ জেগে ওঠে। প্রত্যেকেই এক একজন ব্যক্তি। ব্যক্তি হিসেবেই তার দায়িত্ব আল্লাহর নিয়ম-নীতি ও শরীয়তকে বাস্তবে কায়েম করবে। সে সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিদেরও সেই দিকে আহবান জানাবে। সমাজের মধ্যে শরীয়ত পরিপন্থী কাজগুলোর মোকাবিলা ও প্রতিরোধ করার জন্যেও সে দায়িত্বশীল। সে কাজ তাকে তরতে হবে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে, তার ঈমানী বলিষ্ঠতা দিয়ে, এই দায়িত্ব পালনের পথে কোনো বাধা দেখা দিলে তখন প্রত্যেক ব্যক্তিই সমষি।টগতভাবে তার প্রতিরোধ করবে। তখন তা আর ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকবে না, তা সামষ্টিক দায়িত্বের ব্যাপাহর য়ে যাবে। ইসলামেও সমষ্টির দায়িত্ব আল্লাহর শরীয়ত প্রতিষ্ঠিত করা। আল্লাহর হেদায়েত মোতাবেক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা। ভারসাম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা চালু করা। আদর্শ ও আদর্শানুসারে সমাজ গড়ে তোলা। সমাজের মধ্যে নৈতিক মূল্যমান প্রচার করা, সমাজকে সকল ণৈতকি বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা, তাকে পবিত্র ও পরিচচ্ছন্ন করা, নৈতিকতার ব্যাপক ও সংকীর্ণ (কেবল যৌন পাপ) অর্থ ইসলামে সমান তাৎপর্যপূর্ণ। শাসক ও নেতাদের কার্যাবলীর ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা, যেন তারা আল্লাহর শরীয়ত থেকে বিপথগামী না হয়ে যায়। সত্য সুবিচার সমাজের সকলের জন্যে। এভাবেই প্রত্যেক ব্যক্তি ইতিবাচকভাবে বাস্তব জীবনে –কেবল মতাদর্শ বা চিন্তার দিক দিয়েই নয় –স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রতিভাত হবে, ব্যক্তির লালন প্রশিক্ষণ এভাবেই হওয়া সম্ভব মনস্তাত্ত্বিকভাবে, নৈতিক ও সামষ্টিকভাবে এবং প্রত্যেক ব্যক্তির তার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বসমূহ পালনের যোগ্য হতে পারে।
ইসলমা ব্যক্তিকে ধন-সম্পত্তির আমানতি মালিকানা দেয়। এই দিক দিয়েও ব্যক্তির মধ্যে স্বতন্ত্র স্বকীয় গুণ-বৈশিষ্ট্য-প্রতিভাত হয়ে ওঠে। এই মালিকানা বাস্তবেই কারোর হোক, আর না-ই হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। অধিকার তো স্বীকৃত, তা অর্জনের জন্যে প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধাও যথারীতি সকলের জন্যে উন্মুক্ত রয়েছে। এই অধিকার ও তা অর্জনের সুযোগ-সুবিধা –উভয়ই ব্যক্তির মধ্যে স্বকীয়তার গুণাবলী সৃষ্টি করে। সে একদিক দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে সম্পদের মালিক। তা তার ব্যক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট। এর মাধ্যমে ব্যক্তি তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে। আর সেখানেই অপর দিক দিয়ে তার জন্যে আল্লাহর নির্ধারিত রিযিক তার ব্যক্তিসত্তাকে গড়ে তোলে। সে তা নিজ হাতেই নাড়াচাড়া করে, তখন সে তার নিজের স্ততা স্বাতন্ত্র্যের চেতনা লাভ করে। আর তৃতীয় দিক দিয়ে রিযিক উপার্জনের উপায় উপকরণও তার নিজের হাতে থাকে বলে তার দ্বারা সে বিপথগামী শাসকদের বা সমাজের দিক থেকে কৃত বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘনমূলক আচার-আচরণেরও মোকাবিলা করতে পারে।
আর ব্যক্তি-মালিকানা যদি বাস্তবতার মুখ না দেখে অধিকার ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তবু ইসলাম সে ব্যক্তিকে অসহায়ভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার জন্যে কখনোই ছেড়ে দেয় না। তখন তার জন্যে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা বায়তুলমালের সরাসরি সাহায্য দান কাজ করতে শুরু করে। তাকে ধ।বংস থেকে বাঁচায়। ইসলামে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার তাৎপর্য হচ্ছে, তাকে কল্যাণকর ও মুনাফা দানকারী কোনো কাজের যোগ্য বানানো। তাকে উপার্জনশীল বানিয়ে দেওয়া রাষ্ট্র সরকারের কর্তব্য। কোনো ভালো কাজের প্রয়োজন পরিমাণ বেতনের বিনিময়ে লাগিয়ে দেওয়া। আর তার জন্যে উপার্জনের কোনো ব্যবস্থা করা যদি সম্ভবই না হয়, অথবা সে নিজেই উপার্জন করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, কাজকর্ম বা শ্রম-মেহনত করতে অক্ষম হয়ে পড়ে, স্বাস্থ্যহীনতা বা বার্ধক্যের কারণে কিংবা অল্প বয়স হওয়ার দরুন –এই সকল অবস্থায়ই সে তার প্রয়োজন পূরণে উপযোগী প্রাপ্য অবশ্যই পেতে থাকবে। আল্লাহ-ই তা তার জন্যে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এটা কারুর কোনো অনুগ্রহ নয়, সে কারোর কাছ থেকে ভিক্ষা স্বরূপও কিছু গ্রহণ করবে না। কেননা মানুষ নিজেরাই নিজেদেরকে রিযিক দেয় না। রিযিক দেন একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ তা’আরা প্রত্যেকের জন্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ রিযিক ঠিক করে রেখেছেন। পাওনাদার তা আল্লাহর নির্ধারণ অনুযায়ীই গ্রহণ করবে।
কোন সমাজ ব্যবস্থা যে শেষ পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারে বলে ধারণা করা যায়, ইসলামের এই হচ্ছে সর্বশেষ চূড়ান্ত ব্যবস্থা। ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে সর্বতোভাবে রক্ষা করার জন্যে এর চাইতে উত্তম ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা দুনিয়ার অপর কোনো বিধান বা মতাদর্শই করতে পারেনি। ইসলাম এক্ষেত্রে একক ও অনন্য।
এরই পাশাপাশি ইসলাম সমাজ সমষ্টির স্বাতন্ত্র্যকেও সংরক্ষিত ও প্রকটতর করে তুলেছে।
ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য প্রতিভাত করার জন্যে যেমন ব্যক্তির ওপর কর্তব্যের ভার চাপিয়েছে, ঠিক তেমনি সমাজ-সমষ্টির ওপরও বহু দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। এই সব দায়-দায়িত্ব যথাযথ প্যালনের মাধ্যমেই সুসংবদ্ধ সমাজ গড়ে ওঠে এবং সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
সমাজ সামষ্টিকভাবেই আল্লাহর শরীয়ত পূর্ণাঙ্গভাবে কায়েমের জন্যে দায়ী। শুধু জারী করেই ক্ষান্ত হওয়া যাবে না, তা যথার্থভাবে পালিত ও অনুসৃত হচ্ছে কিনা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তা লক্ষ্য করা –না হতে থাকলে তা পালিত ও অনুসৃত করিয়ে দেওয়াও সমাজের দায়িত্ব।
এই সমাজই যাবতীয় সামষ্টিক ব্যাপারে প্রধান দায়িত্বশীল নিযুক্ত করে। সমাজের কাছ থেকেই আনুগত্যের বায়’আত গ্রহণ করা হয়। ব্যক্তিগণের কাছ থেকে আলাদা আলাদাভাবে নয়। সমাজই তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টিতে লক্ষ্য রাখে রাষ্ট্রপ্রধান শাসনকার্যে শরীয়তকে পুরোপুরি অনুসৃত করছে কিনা। সমাজই তার কাছ থেকে জবাবদিহি করে বাঁকা পথে চলতে শুরু কর্যেল তাকে সঠিক পথে নিয়ে আসে। সমাজই তাকে পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা কার্যকর করে।
(আরবী*****************************************************************************)
তোমাদের মধ্য থেকে এক লোকসমষি।ট অবশ্যই এমন দাঁড়াতে হবে, যারা কল্যাণের দিকে আহবান জানাবে, ভালো কাজের আদেশ করবে ও মন্দ কাজ থেকে লোকদের বিরত রাখবে। (সূরা আলে-ইমরানঃ ১০৪)
(আরবী******************************************************)
তাদের সামষ্টি কাজকর্ম পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়। (সূরা শূরাঃ ৩৮)
(আরবী***********************************************)
এবং সমাজের লোকদের সাথে সামষ্টিক ব্যাপারাদিতে পরামর্শ করো।
(সূরা আলে-ইমরানঃ ১০৯)
কুরআন মুসলিস সমাজকে বারবার উদাত্ত কণ্ঠে আহবান জানিয়েছেঃ (আরবী******************************) –‘হে ঈমানদার লোকেরা’ বলে।
(আরবী**************************************************************)
হে ঈমানদার লোকেরা, নরহত্যার ব্যাপারে কিসাস তোমাদের জন্যে ফরয করে দেওয়া হয়েছে। (সূরা বাকারাঃ ২০৮)
(আরবী****************************************************************)
হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা পরস্পরের ধন-মাল বাতিল উপায়ে ভক্ষণ করো না। (সূরা আন-নিসাঃ ২৯)
(আরবী************************************************)
হে ঈমানাদর লোকেরা, তোমাদের আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করো। অতএব তোমরা বের হয়ে পড় দলে দলে বিভক্ত হয়ে, অথবা সকলেই এক সঙ্গে।
(সূরা আন-নিসাঃ ৭১)
(আরবী************************************************************)
হে ঈমানদার লোকেরা, জেনে রাখো, মদ্য, জুয়া, মূর্তি ও মূর্তি স্থাপনের প্রস্তুরসমূহ বেদী এবং আদেশ বা নিষেধ আগাম জানার জন্যে রক্ষিত তীরসমূহ শয়তানের কাজের চরম অপবিত্রতা। অতএব তোমরা এর প্রত্যেকটি পরিহার করো। (সূরা মায়েদাঃ ৯০)
এইসব ডাক ও আহবানে –যা বারবার করা হয়েছে –শামিল হয়েছে তাদের জন্যে দেওয়া আইন বিধানসমূহ যথাযথভাবে কার্যকর করে। তাদের এই প্রেরণাও দেওয়া হয়েছে যে, তার যেন ঐক্যবদ্ধ, সুসংগঠিত ও সুসংবদ্ধ হয়ে থাকে এবং প্রদত্ত আইন বিধান অনুযায়ী তারা নিজেরা যেন চলে। তাদের বংশধরদেরও যেন তারই আলোকে প্রশিক্ষিত করে তৈরি করে। কেননা এরাই হচ্ছে সমাজ সংস্থার ব্যক্তি, এদের সমন্বয়েই সমাজ গঠিত। উপরোদ্ধৃত আয়াতসমূহে তাদের ওপর এই দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে যে, তারা যেন দলবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ হয়েই এই নির্দেশসমূহ যথাযথভাবে পালন করে।
(আরবী**************************************************************************)
তোমরা সকলে মিলিত ঐক্যবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জু শক্ত করে ধরো এবং তোমরা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যেয়ো না, থেকো না। (সূরা আলে-ইমরানঃ ১০৩)
(আরবী********************************************************************)
এবং তোমরা পরস্পরের সহযোগিতা করো পূণ্যময় ও আল্লাহ ভীরুতার ব্যাপারে এবং পরস্পরের সহযোগিতা করো না গুনাহ ও সীমালংঘনমূলক কাজে। (সূরা মায়িদাঃ ২)
এসব আয়াতে যে যে কাজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা সবই সমষ্টিগতভাবে করণীয়। সেজন্যে ব্যক্তিগণের সমাজদ্ধ হয়ে সামষ্টিক জীবন যাপন করা আবশ্যক এবং সে সমাজকে অবশ্যই সুসংবদ্ধ, পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত ও মিলে-মিশে একাকার হতে হবে। আর সেই সাথে এসব সামষ্টিক কার্যাবলীও আঞ্জাম দিতে হবে।
ইসলাম ব্যক্তি সমন্বয়ে সমাজ গঠন করে। উপরোক্ত আয়াতসমূহে যে মুমিন সমাজকে ডাক দেওয়া হয়েছে তারই ওপর অর্পিত হয়েছে সেইসব কাজ করার, যেসব কাজের কথা উক্ত ডাক ও আহবানের পরই উল্লেখিত হয়েছে। আর সেসব কাজ কেবল মুমিন ব্যক্তিদের পক্ষে করাই সম্ভব। সম্ভব সেই সমাজের পক্ষে করা যার প্রতিটি ব্যক্তিই ঈমানদার স্বতন্ত্র ও ব্যক্তিগতভাবে। ব্যক্তিগতভাবেই তারা প্রত্যেকে আল্লাহর সাথে সম্পর্কশীল, ব্যক্তিগতভাবেই উক্তরূপে সম্বোধন বা আহবান পাওয়ার উপযুক্ত। ইসলাম ঈমানদার ব্যক্তিগণের সমন্বয়ে গঠিত এই সমাজকে একটি স্বতন্ত্র সত্তারূপে গ্রহণ করেছে, তাকে এই কর্তৃত্বও দিয়েছে যে, সমাজের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন কোনো ব্যক্তি যদি ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের অহংবোধে বিভ্রান্ত হয় ও ইসলামের নির্ভুল ভারসাম্যপূর্ণ পথ ত্যাগ করে বিণ্নতর পথে চলতে শুরু করে তা হলে এই সমাজই তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবে। এই সমাজই হবে তার পাহারাদার। সমাজই ব্যক্তিগণের কর্তব্য পথের নির্দেশ করবে। এই সমাজের হাতেই রয়েছে সেই ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব যা আল্লাহ কর্তৃত্ব প্রদত্ত, রাষ্ট্রপ্রধান ব্যক্তি হচেছ এই সমাজের প্রতীক, প্রতিনিধিত্ব সম্পনন্। তাই এই সমাজ-সমষ্টিই ব্যক্তিকে বিভ্রান্তির পথে যেতে নিষেধ করবে, যাওয়া থেকে বিরত রাখবে এবং সঠিক নির্ভুল পথে চলতে বাধ্য করবে। আল্লাহ প্রদত্ত এই ক্ষমতাবলেই সমাজ ব্যক্তিকে সীমালংঘনমূলক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখবে এই ইসলামী সমাজের মধ্য থেকেই। তা-ই সকল অবস্থায় আল্লাহর শরীয়তকে কার্যকর করবে, কোনোরূপ স্বেচ্ছাচারিতা করার কোনো অধিকার তাকে দেওয়া হয়নি। আর আল্লাহর শরীয়ত তো মানুষের জন্যেই নাযিল হয়েছে, নাযিল হয়েছে ব্যষ্টি ও সমষ্টি সমানভাবে সকলের জন্যেই।
অনুরূপভাবে ইসলামী সমাজই ইসলাম অধ্যুষিত দেশ, সে দেশে কায়েম থাকা শরীয়ত বেং তার অধিবাসীগণকে সমর্থন দান ও সর্বতোভাবে রক্ষা করার জন্যে দায়িত্বশীল। এ দায়িত্ব তাকে পালন করতে হবে এক সুসংবদ্ধ পরস্পর জড়িত ও সুবিন্যস্ত সংস্থা হিসেবেই।
আদর্শগত ও নীতিগতভাবে সমাজই হচ্ছে ধন-মালে ওপর প্রথম কর্তৃত্বশালী। কেননা ব্যক্তিকে ধন-মালে হস্তক্ষেপ করার অধিকার ও ক্ষমতা তো সমাজ-সমষ্টির কাথ থেকেই পেতে হয়। আর বাস্তবতার দিক দিয়ে সমাজই হচ্ছে ব্যক্তির ধন-মালের ওপর প্রতিষ্ঠিত হস্তক্ষেপ ও ব্যয় ব্যবহারের অধিকারকে হরণ করে নেওয়ার অধিকারী –সাময়িকভাবে কিংবা স্থায়ীভাবে ও চিরতরে যদি ব্যক্তি তার আয়ত্তাধীন ধন-মালে উত্তম ও ন্যায়নীতি ভিত্তিক হস্তক্ষেপ না করে বা করতে অক্ষম হয়। কুরআনের আয়াত তা-ই স্পষ্ট করে বলছেঃ
(আরবী**************************************************************************)
এবং তোমরা নির্বোধ লোকদেরকে তোমাদের সেই ধন-মাল দিও না যাকে আল্লাহ তোমাদের জন্যে বেঁচে থাকার উপকরণ বানিয়েছেন এবং তাতে তাদের জন্যে রিযিক দেওয়ার ব্যবস্থা করো। তাদের পরিধেয় দাও এবং তাদের ভালো কথা বলো। (সূরা আন-নিসাঃ ৫)
ইসলামী আদর্শভিত্তিক সমাজের আর একটি দায়িত্ব হচ্ছে, সরকারী সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দেওয়ার পূর্বেই সমাজের দুর্বল অক্ষম ব্যক্তিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজে বহন করবে। কেননা সরকার তো হলো এই লোকদের সর্বশেষ আশ্রয়। এই সামষ্টিক নিরাপত্তা দান ব্যবস্থা প্রথমে পরিবার বেষ্টনীতে, পরে সামষ্টিক পর্যায় এবং শেষে গোটা মুসলিম উম্মতের সীমানার মধ্যে কার্যকর হওয়া বাঞ্ছনীয়।
ইসলামে সামাজিক সামষ্টিক রূপের কার্যকরতা এমনিভাবেই সম্পন্ন হওয়া সম্ভব হয়।
সত্যি কথা, জনগণের বাস্তব জীবনধারা ততটা সহজ নয়, যতটা সহজ হচ্ছে এই কথাগুলো লেখা। বাস্তবে যা ঘটে থাকে, তা হচ্ছে অনেক সময় ব্যক্তি সীমালংঘন করে যেমন, ঠিক তেমনই সীমালংঘনমূলক কার্যকলাপ করে সমাজ সমষ্টিও। কিন্তু এ সত্যের চূড়ান্ত পরিণতি তো জনগণেই ঘটে। কোনো বিশেষ ব্যবস্থা বা নীতিকে সেজন্যে দায়ী করা চলে না। এটাই হচ্ছে অত্যন্ত তিক্ত সত্য।–[কথাটি সত্য বলে মেনে নিলেও প্রশ্ন জাগে, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কি স্বভাবতই নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র সৃষ্টির জন্যে দায়ী নয়? এ ব্যবস্থার কি গণতন্ত্র চলে? -অনুবাধক]
মানুষের মধ্যে যেমন বিপথগামী হওয়ার স্বাভাবিক ভাবধারা রয়েছে তেমনি স্বাভাবিক ভাবধারা রয়েছে সঠিক ভারসাম্যপূর্ণ পথে চলারও। কিন্তু নীতি ও বাস্তবতা –এই উভয় দিক দিয়ে একসাথে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, এ দুইয়ের মাঝে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। কেননা অবস্থার কারণে কোথাও জনগণের বিভ্রান্ত হওয়া কখনোই এক কথা হতে পারে না, যেখানে অবলম্বনের কারণে জনগণের বিভ্রান্ত হওয়া কখনোই এক কথা হতে পারে না, যেখানে অবলম্বিত নীতি ও আদর্শের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতা রয়েছে, সেখানে মানুষ একান্তভাবে বাধ্য হয়েই বিভ্রান্ত হয় ও থাকে। সেই বিধান ও ব্যবস্থা সমূলে উল্টিয়ে বা পাল্টিয়ে না দেওয়া এবং তদস্থরে নবতর কোনো ব্যবস্থা কায়েম না করা পর্যন্ত জনগণ নিজেরা বিভ্রান্তি থেকে নিজেদেরকে বাঁচাতে পারে না।
পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তি সীমালংঘন করে এই নীতি ও ব্যবস্থার কারণেই। কারণটি এই ব্যবস্থারম ধ্যেই নিহিত। মানুষ তা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে না শত চেষ্টা করলেও। বাঁচাতে চাইলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকেই খতম করতে হবে সমূলে। এই ব্যবস্থার অধীন থেকে জনগণের ওপর কৃত অত্যাচার শোষণ প্রতিরোধ করাও তার অনিবার্য ক্ষতি থেকে নিজদিগকে বাঁচানো কখনোই সম্ভবপর হতে পারে না। পারে না সীমালংঘনকারী অত্যাচারী ব্যক্তিদিগকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে।
সমাজতান্ত্রিক সমূহবাদী ব্যবস্থার ঠিক এই ব্যবস্থায় স্বভাবগত প্রকৃতির কারণে সমাজ সীমালংঘন করে, অত্যাচার নিপীড়ন চালায় নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের ওপর। ব্যক্তিরা এই ভয়াবহ দুর্বার সর্বধ্বংসী ব্যবস্থার ভারে নিষ্পেষিত ও নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় পেতে পারে না। কেননা এই ব্যবস্থাই তার নিজস্ব নীতি ও আদর্শের চাপে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকেই সহসাই ধ্বংস করে দেবে যে, তার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবে। অতবা সত্যি কথা এই যে, রাষ্ট্রপ্রধানের মুখোমুখি যে-ই দাঁড়াবে, তাকে নিমেষের মধ্যে খতম হয়ে যেতে হবে। কেননা সে-ই হচ্ছে প্রকাশ্য নির্লজ্জ নিরংকুশ কর্তৃত্বের মালিক, স্বৈরাচারী। রাষ্ট্রযন্ত্রটি তার হাতে নিষ্প্রাণ পুতুল মাত্র। এর কারণেই সম্ভবত এই ব্যবস্থার নামকরণ করা হয়েছে ‘প্রোলেটারিয়েটদের স্বৈরতন্ত্র’।
কিন্তু ইসলামে ব্যক্তিও যেমন নীতি ও ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত প্রকৃতির কারণে সীমালংঘন করে না, তেমনি সমাজ সমষ্টিও তা করে না ইসলামের কারণে; বরং এই সীমালংঘন –অত্যাচার-জুলুম-স্বেচ্ছাচারিতা-স্বৈরশাসন ইত্যাদি সবকিছুই ঘটে মানুষ বা সমাজ নিজেই যখন ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়, ইসলাম অনুযায়ী কাজ করা ত্যাগ করে। এরূপ অবস্থায় এই বিপর্যয় ও বিপথগামিতার সমস্ত দায়িত্ব লোকদের নিজেদের ওপরই বর্তে এবং এই বিপর্যয় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়াও একান্তভাবে তাদের নিজেদেরই চেষ্টা-সাধনা সংগ্রামের ওপর নির্ভর করে। তখন আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরে আসাও তাদের নিজেদেরই দায়িত্ব। যদি তারা ইসলামের দিকে ফিরে আসে তা হলে তাদের সব ব্যাপার আবার ঠিকঠাক হয়ে যাবে।
(আরবী**********************************************************************)
হে ঈমানদার লোকেরা! তোমরা আনুগত্য স্বীকার করো আল্লাহর, অনুসরণ করো রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে জেগে সামষ্টিক দায়িত্বশীলদেরও। অতঃপর কোনো বিষয়ে যদি তোমরা মতপার্থক্যে লিপ্ত হও, তাহলে সেই বিষয়টি ফিরিয়ে দাও আল্লাহ ও রাসূলের দিকে যদি তোমরা ঈমানদার হয়ে থাকো আল্লাহ ও পরকালের প্রতি। (সূরা আন-নিসাঃ ৫৯)
এখানে লক্ষণীয় যে, আল্লাহ ও রাসূলই হচ্ছেন ইসলামের আইন প্রণয়নের কর্তৃত্বের অধিকারী। কাজেই সকল ব্যাপারে চূড়ান্ত নির্দেশ ও বিধান পাওয়ার জন্যে সেই আল্লাহ ও রাসূলের দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে এবং সরাসরিভাবে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করতে হবে। তবে “সামষ্টিক কাজের দায়িত্বশীলদের আনুগত্য হবে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যের শর্তভিত্তিক”। এই কারণেই মূল আয়াতে (আরবী******) –‘আনুগত্য করো’ কথাটি আল্লাহ ও রাসূলের ক্ষেত্রে স্পষ্ট করে উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু সামষ্টিক কাজের দায়িত্বশীলদের আনুগত্যকে আল্লাহর ও রাসূলের আনুগত্যের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয়েছে নতুন করে ‘আনুগত্য করো’ কথাটি বলা হয়নি। পরে বলা হয়েছে, কোনো বিষয়ে মুমিনদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে তখন প্রত্যাবর্তন ও চূড়ান্ত নির্দেশ পাওয়ার কেন্দ্র হচ্ছে কেবলমাত্র সেই আল্লাহ ও রাসূল। কেননা আইন প্রণয়নের একক ও নিঃশর্ত অধিকার ও কর্তৃত্ব হচ্ছে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের।
এইরূপ চিন্তা-বিশ্বাস ভিত্তিক সমাজে ও রাষ্ট্রে ব্যক্তি ও সমাজ কখনোই পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী ও সংঘর্ষকারী দুটি পক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারে না, বরং এ দুটি শক্তিই পরস্পর সংযোজিত ওতপ্রোত, একটির মধ্যে অপরটি প্রবিষ্ট মূলতও তাই। ফলে এ দুটি শক্তি ইসলামী সামজে পরস্পর সম্পূরক, পরস্পর সাহায্যকারী। অন্তত তাই হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাদের উভয়ের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। কাজ ও চিন্তা-বিশ্বাসের দুটি শক্তির মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। কাজেই সেখানে কোনো দ্বন্দ্ব হতে পারে না যেমন দুই শক্তির পরস্পরের মধ্যে, তেমনি একটি অপরটির ওপর সীমালংঘন করেও যেতে পারে না।
ইসলামী সমাজে পুরুষ, মেয়েলোক ও বালক শিশুদের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তাদের সঠিক কল্যাণময় প্রতিপালন ও প্রশিক্ষণ হওয়া একান্তই কাম্য। জাহিলিয়াতে তাদের প্রতি যে উপেক্ষা প্রদর্শিত হয় এবং তাদের জীবনে যেভাবে বিপর্যয় ও বিপথগামিতা দেখা দেয় এবং যার ফলে তারা চরম কষ্টে ও পীড়নে পড়ে, হয়রান ও পেরেশান হয়ে পড়ে, ইসলামী সমাজে তা কখনোই ঘটে না।
ইসলামী সমাজের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সেখানে সমস্ত ক্ষেত্রেই সাধারণভাবে কর্মবণ্টন চলে। বিভিন্ন কাজে বিভিন্ন লোক নিয়োগ করা হয়, বিভিন্ন দায়িত্ব বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর অর্পণ করা হয়।
পুরুষ সেখানে দায়িত্বশীল হয় আয়-উপার্জন ও উৎপাদন করার জন্যে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্যেও এই পুরুষরাই প্রধানত দায়ী। আর মেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই মানব বংশ উৎপাদনের কাজ সঠিক ও সুষ্ঠুরূপে করার জন্যে একান্তভাবে দায়িত্বশীল। এজন্যেই পরিবারের অভ্যন্তরীণ কার্যাবলী সম্পাদনের দায়িত্বও তার ওপর অর্পিত। সন্তান গর্ভে ধারণ, সন্তান প্রসব ও সন্তান লালন পালনের দায়িত্ব পালনের স্বাভাবিক যোগ্যতা আল্লাহ তা’আলা তাদেরকেই দিয়েছেন। এই কাজ নির্ভুল নিয়মে করা, কল্যাণময় ভাবে করা নারীদের পক্ষেই সম্ভব। তাহলে শিশুরাও পরিবারিক পরিবেশে, মায়ের ক্রোড়ে, মায়ের স্নেহ-যত্নে সুরক্ষিত থেকে লালিত-পালিত হওয়ার নির্ভরযোগ্য সুযোগ পাবে। বস্তুত এটাই তাদের স্বাভাবিক লালনক্ষেত্র।
কর্মবণ্টনের এই কাজটি কোনো দিক দিয়ে কারোর ওপর অযথা-অকারণে দায়িত্ব চাপানোর চেষ্টা করা হয়নি। এ ব্যাপারে কোনো অন্ধ বিদ্বেষও কাজ করেনি। পুরুষ ও নারীর স্বভাবগত গুণ ও বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতা কর্মক্ষমতার প্রতি লক্ষ্য রেখেই কর্মবণ্টনের এই মহতি কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছে।
নারী স্বাভাবিক জীবতাত্ত্বিক যোগ্যতার দিক দিয়ে গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব ও স্তন দিয়ে সন্তান লালন-পালনের একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তিসত্তা। তাকে এই কাজের অনুকূল ও সাহায্যকারী মনস্তাত্ত্বিক ভাবধারা দিয়েই তৈরি করা হয়েছে। নারীর মধ্যে সর্বাধিক শক্তিশালী ভাবধারা হচ্ছে মাতৃত্বজনিত স্নেহ বাৎসল্য, সন্তানের জন্যে তীব্র মায়া ও আকর্ষণ। সন্তানের জন্যে যাই সর্বাধিক ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করতে সক্ষম। তার অর্থ অবশ্য নয় যে, মেয়েরা ঘরোয়া পরিবেশের বাইরে কোনো কাজের যোগ্যতা রাখে না, গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব প্রভৃতি স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন ছাড়া অন্য কোনো কাজ মেয়েরা করতেই পারে না –এমন কথাও বলা হচ্ছে না। তবে আমরা পূর্ববর্তী আলোচনা অস্ট্রিয়ার মহিলা চিকিৎসাবিদের সাক্ষ্য থেকে প্রমাণ করে দিয়েছি যে, মেয়েরা যখনই পুরুষদের সাথে তাদের সমস্ত কাজে ও দায়-দায়িত্ব পালনের যোগ্যতাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে। ফলে মেয়েলোক আর মেয়েলোক থাকতে পারে নি, আর তারা পুরুষও হয়ে যেতে পারেনি –কেননা পুরুষ হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় দৈহিক আঙ্গিকতা ও মনস্তাত্ত্বিক ভাবধারার কোনো কিছুই অর্জন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তখন তারা না পুরুষ, না মেয়ে –এক তৃতীয় লিঙ্গে পরিণত হলো। তারা এমন লিঙ্গের হয়ে গেল, যার দরুন তাদের মানসিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা তাদেরকে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষেপ করল।
আর তা ছিল প্রকৃতির অমোঘ প্রতিশোধ, জাহিলিয়াতের নির্বুদ্ধিতা ও খাম-খেয়ালীর কাছে তা কখনোই পরাজয় মানতে প্রস্তুত হয় না। কেননা প্রকৃতি তো আল্লাহর সৃষ্টি, আর আল্লাহই তো সবকিছু সৃষ্টি করে তার মধ্যে তার প্রকৃতিকেও শামিল করে দিয়েছেন, তাকে প্রয়োজনীয় হেদায়েত নির্ভুল কাজের প্রেরণা ও ঝোঁক-প্রবণতাও সৃষ্টি করে দিয়েছেন। মানুষের মধ্যকার এই প্রকৃতি কখনোই একবিন্দু পরিবর্তিত হতে পারে না।
এই প্রেক্ষিতে বলতে হয়, আধুনিক নারীরা যা কিছু বলছে তা তাদের চরম নির্বুদ্ধিতা ও অপরিণামদর্শিতারই প্রমাণ করছে। যে সব পুরুষ তাদেরকে তাদের স্বভাবসম্মত সাম্রাজ্য ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে আসার জন্যে প্রলুব্ধ ও প্ররোচিত করছে, তাও তেমিন তাদের জন্যে খুবই মারাত্মক। আসলে এই পুরুষরা মেয়েদেরকে ঘরের বাইরে পেতে চায়, কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই তারা চায় তাদের ভোগ করতে। যা কেবল নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সমাজ বেষ্টনীতে খুবই সহজ ও নির্বিঘ্ন। অথচ এই কাজ প্রকৃতির সাক্ষ্যের দৃষ্টিতে চরম নির্বুদ্ধিতার। কেননা প্রকৃতি বুঝে না যে, সময়ের কাঁটা সম্মুখের দিকে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এখন তা পিছনের দিকে নিয়ে আসা কিছুতেই সম্ভব নয়। বস্তুত প্রকৃতির সাথে ঘড়ির কাঁটার কোনো সম্পর্ক নেই। আর প্রকৃতির বিরুদ্ধে সময়ের কাঁটা যদি খারাপ হয়ে যায়, তাহলে নারী পুরুষ শিশু সকলেই চরম ধ্বংসের মধ্যে পড়ে যাবে। দুর্ভাগ্য তাদের জীবনকে বিধ্বস্ত করে দেবে। তাই নারীরা যখন ঘরের বাইরে পথে-ঘাটে ছন্নছাড়া দিশেহারা হয়ে বের হয়ে পড়ে, তখন গোটা সমাজ তেমনিই হয়ে যায় যেমন বলেছেন ওয়াল ডেভাস্টটঃ
সর্বাত্মক দুর্ভাগ্য, ব্যাপক ধ্বংস ও বিলয়। ঘর নেই, বাড়ি নেই, পরিবার নেই, নেই একবিন্দু স্থিতি –শান্তি ও স্বস্তি।
ইসলাম জাহিলিয়াতের এই নির্বুদ্ধিতা ও খামখেয়ালীকে কখনোই অনুসরণ করতে পারে না। ইসলাম নারীকে সেই ধ্বংসোন্মুখ তৃতীয় লিঙ্গ হতে কখনোই দিতে প্রস্তুত নয়। আল্লাহর সৃষ্টি প্রকৃতিতে অস্বীকার করেই জাহিলিয়াত এই চরম মাত্রার বিকৃতি, বিপর্যয় ও ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে নারী সমাজকে। এই বিপথগামিতা তাদের কোনোরূপ কল্যাণ দেয়নি, এমন পথও তাদের পরিচালিত করেনি যার ফরে তারা সৌভাগ্য ও স্থিতি লাভে ধন্য হতে পারে।
তাই ইসলাম নারীদের তাদের স্বভাবগত দায়িত্ব পালনের দিকেই আহবান করতে পারে, তার পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থাও গ্রহণ করছেন।
নারীর রিযিক –জীবিকার পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়েছে। কিন্তু উপার্জন কাজের দায়িত্ব তাদের ওপর অর্পণ করা হয়নি।
তার মানবীয় মান-মর্যাদা অধিকার পাওয়ার পূর্ণ নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা দিয়েছে, ঘর ও বাইরের কাজের দুই পাহাড়ের মধ্যে ফেলে তাদের নিষ্পেষিত করে তাদের চেষ্টা সাধনার অপচয় করা থেকে তাদের রক্ষা পাওয়ারও নিরাপত্তা দিয়েছে।
তাদের ণৈতিক চরিত্রের পূর্ণ সংরক্ষণের নিরাপত্তা দিয়েছে। নারী-পুরুষের মিলিত বৈঠকসভা অনুষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রে তাদের নিয়ে গিয়ে নৈতিক চরিত্রের ওপর কঠিন বিপদ ডেকে আনার সর্বনাশা অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ারও পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়েছে। কেননা মানুষ্যত্বকে ধ্বংস করার জন্যে মানবতার দুশমনেরা নারীদের কঠিন বিপদে ফেলে দেওয়ার জন্যে প্রতি মুহুর্তে মারাত্মক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
পুরুষের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সব রকমের ব্যয়ভার বহনের। বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া, বিয়ের অনুষ্ঠান করা ও পরিবারের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা পুরুষদেরই কর্তব্য বলে ঘোষণা দিয়েছে। নারীকে ব্যক্তিগতভাবে ধন মালের ‘মালিক’ হওয়ার অধিকার দিয়েছে। তা নিজ ইচ্ছামতো শরীয়ত এই উভয় দিকের জন্যে প্রয়োজনীয় বিধি-বিধানও তৈরি করেছে। আধুনিক জাহিলিয়াত নারীকে এ সবের কোনো একটিরও অধিকার দেয়নি, …দিয়ে থাকলেও তা শেষের দিকে, বেশি দিন অতিবাহিত হয়নি। তবে তাও অসম্পূর্ণ ও অশোভন ভাবে। তা লাভ করতে গিয়ে নারীরা তাদের শুধু নারীত্বই হারিয়ে ফেলেছে তা-ই নয়, তাদের সুস্থ প্রকৃতি ও নৈতিকতাও হারিয়ে ফেলেছে।
সে যাই হোক, ইসলাম শুরু থেকেই নারীকে ধন-সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার অধিকার দিয়েছে। তার ধন-মাল তার স্বেচ্ছামূলক অনুমতি বা সম্মতি ছাড়া কোনো ক্রমেই ব্যয় করা যেতে পারে না।
ইসলামী আইন ও বিধি বিধান সবই নারীকে মানবীয় মর্যাদা দিয়েছে –তা রক্ষার নিরাপত্তাও দিয়েছে।
মালিকানা অধিকার, ব্যয়-ব্যবহার দান ইত্যাদি হস্তক্ষেপ করার সরাসরি অধিকার নারীর জন্যে নিশ্চিত করা হয়েছে।
(আরবী************************************************)
পুরুষরা যা উপার্জন করতে তা থেকে তার অংশ প্রাপ্য রয়েছে। অনুরূপভাবে মেয়েরা যা উপার্জন করবে তা থেকেও তাদের অংশ প্রাপ্য রয়েছে।
(সূরা আন-নিসাঃ ৩২)
(আরবী**********************************************************************************)
হে ঈমানদার লোকেরা! তোমাদের জন্যে নয় যে, তোমরা জোরপূর্বক নারীদের উত্তরাধিকারী হয়ে বসবে। আর তোমরা তাদের পথও বন্ধ করে দিও না এই উদ্দেশ্যে যে, তোমরা তাদের যা দিয়েছ তার কিছু অংশ কেড়ে নিয়ে যাবে।
(সূরা আন-নিসাঃ ১৯)
মানুষ মানুষে পরম সাম্য ও অভিন্নতা আল্লাহর কাছ থেকৈই নিশ্চিত করা হয়েছে, তার নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
(আরবী******************************************************************************)
পুরুষ বা নারী যে-ই নেক আমল করবে ঈমানদার হওয়া অবস্থায়, তাকেই আমরা অতীব উত্তম পবিত্র জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখব। (সূরা নহলঃ ৯৭)
(আরবী***************************************************************)
অতঃপর তাদের আল্লাহ তাদের দো’আ কবুল করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আমি তোমাদের মধ্যকার পুরুষ বা নারী কোনো আমলকারীরই আমলকে বিনষ্ট করে দিই না। তোমরা তো পরস্পর থেকে….। পরিবারের অভ্যন্তরে পারস্পরিক সম্মানও নিশ্চিত। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৯৫)
তোমরা –হে পুরুষরা –মেয়েলোকদের সাথে অতীব উত্তম নিয়মে একত্রে বসবাস গ্রহণ করো। (সূরা আন-নিসাঃ ১৯)
এমনকি অপছন্দ হওয়া অবস্থায়ও নারীর সাথে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না।
(আরবী****************************************************************)
তোমরা –পুরুষরা –যদি তাদের অপছন্দ করো, তা হলে জেনে রাখবে, অসম্ভব নয় যে, তোমরা কোনো জিনিস অপছন্দ করবে, কিন্তু আল্লাহ তাতেই বিপুল কল্যাণ নিহিত করে রেখেছেন। (সূরা আন-নিসাঃ ১৯)
এমনি ভাবেই চেতনা ও কর্মে, অর্থনীতিতে ও সমাজ ক্ষেত্রে নারীদের এই নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে যে, তারা তাদের স্বাভাবিক দায়িত্বপূর্ণ স্বাধীনতা সহকারে –কোনোরূপ জোর জবরদস্তি ব্যতিরেকেই পালন করবে। তাতে করেই তাদের স্বভাবগত প্রচ্ছন্ন গুণাবলী ও যোগ্যতা-প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ হওয়া সম্ভব। যদিও আধুনিক জাহিলিয়াত নারী-পুরুষের মোহময় ও প্রতারণাপূর্ণ সমতার শ্লোগান দিয়ে সেই স্বাভাবিক গুণ-গরিমা ও যোগ্যতা-প্রতিভাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
এতদসত্ত্বেও কর্মের এই বণ্টনটা মেয়েদের বেলায় এমন চূড়ান্ত ও অকাট্য নয় যে, তাতে একবিন্দু রদ-বদল বা পার্থক্য-তারতম্য হতে পারে না। কেননা মেয়েদের জন্যে কোনো কাজ করা –উপার্জনের কোনো উপায় অবলম্বন করা একেবারেই নিষিদ্ধ বা হারাম নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলমা নারীদের উপার্জনের কাজে অংশ নেওয়া খুব একটা ভালো দৃষ্টিতে দেখেনি। তবে প্রকৃতপক্ষেই তার প্রয়োজন দেখা দিলে –তা একান্তই অপরিহার্য হয়ে পড়লে ভিন্ন কথা। এই প্রয়োজনটা যেমন ব্যক্তিগত হতে পারে, তেমনি হতে পারে পরিবারগত ও সমাজগত। তবে তা অবশ্যই এই প্রয়োজনের সীমার মধ্যে সম্পন্ন হতে হবে।
কিন্তু সমস্ত মানবীয় জীবন সংগঠন ও পরিচালনা সামাজিক, অর্থনৈতিক, চিন্তাগত, আত্মিক ও নৈতিক –সর্বদিক দিয়ে তার পুনর্গঠনের ব্যাপারে নারীদের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া যে মারাত্মক ধরনের বিধ্বংসী জাহিলিয়াতের নির্বুদ্ধিতা, তা বাস্তবভাবে আমরা ইতিপূর্বে দেখতে পেয়েছি, দেখেছি তার লক্ষণ, নিদর্শন ও চদরম অশুভ পরিণতি।
আমরা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি, কর্মজীবী মহিলারা সাধারণতই তৃতীয় লিঙ্গে পরিণত হয়, জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক, সংবেদন, হৃদয়ানুভূতি, নৈতিক ও যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা তাদের জীবনে অনিবার্য হয়ে পড়ে, বাচ্চারা মা-হারা হয়ে চাকর ধাত্রীর হাতে বা শিশু সদনে লালিত-পালিত হয়ে অনুরূপ মারাত্মক পরিস্থিতির দুঃখ সাগরে হাবুডুবু খাবে। তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। এই ধরনের মেয়েলোক ও বাচ্চাদের দ্বারা ভবিষ্যতে যে সমাজ গড়ে উঠবে, তা যে কি ধরনের মানবতা বিবর্জিত সমাজ হবে তা বুঝতে একবিন্দু অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
তার অর্থ তো এই দাঁড়াবে যে, সামান্য বৈষয়িক স্বার্থ লাভের লোভে পড়ে আমরা গোটা মানব সত্তাটিকেই ধ্বংস করে দিতে রাজি হব, বৈষয়িক স্বার্থটা যত বড়ই হোক,তা মনুষ্যত্বের মৌল সত্তা ও সার নির্যাসের তুলনায় খুব সামান্য ও নগণ্য। আজকের দুনিয়ার সমস্ত বস্তুগত উৎপাদন এবং আগামীকালের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সংগৃহীত সমস্ত উপায়-উপকরণ মিলিত হয়েও মহান মনুষ্যত্বের প্রকৃত মূল্যের একটি ক্ষুদ্র অংশেরও সমান হতে পারে না।
না, না, ইসলাম জাহিলিয়াতের খামখেয়ালী ও নির্বুদ্ধিতার অন্ধ অনুসরণ কখনোই করবে না। ইসলাম পুরুষ নারী শিশু –প্রত্যেককে তার যথোপযুক্ত স্থানেই রেখে দেবে।
পুরুষরা পুরোপুরিভাবে উৎপাদন উপার্জনের কাজে আত্মনিয়োগ করভে। সেই সাথে যাবতীয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দায়-দায়িত্বও পালন করবে।
আর মেয়েরা একান্তভাবে নিয়োজিত হবে মানব বংশ উৎপাদনের মহান ব্রতে, সেই সাথে আনুসঙ্গিক সন্তান লালন-পালন, প্রশিক্ষণ ও প্রবৃদ্ধিদান প্রভৃতি কাজও তাকেই সম্পন্ন করতে হবে।
শিশুরা তাদের স্বাভাবিক লালন-পালন ক্ষেত্র –মাতৃক্রোড় পাবে। তা থেকে বাচ্চাদের দূরে সরিয়ে নেওয়া ভবিষ্যতের মানব বংশকে ধ্বংস করা ছাড়া আর কিছুই নয়। পরিবারই হচ্ছে শিশুদের জন্যে কল্যাণকর একমাত্র পরিবেশ। তাকে স্থিতিশীল হতে হবে, তার সাথে নারীর মনের সংবেদনের গভীর সম্পর্ক থাকতে হবে। নারীর নিঃস্বার্থ স্নেহ বাৎসল্য সমৃদ্ধ ক্রোড়ই হলো শিশুদের স্থিতিলাভের একমাত্র আশ্রয়। তাতেই গড়ে উঠবে আদর্শ মানুষের ভবিষ্যৎ।
এই দায়িত্ব পালন ও এই ব্যবস্থা নারীকে নিতান্ত প্রয়োজনের সময় কাজ ও উপার্জনে অংশ নেওয়া থেকে নিষেধ করবে না। কিন্তু নারীর জন্যে তা স্থায়ী ব্যস্ততা হতে পারে না। তা এমন ভাবেও হতে পারে না, যার ফলে নারীর শক্তি-সামর্থ্য নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে, ধ্বংস ও কলুষিত হয়ে যেতে পারে তার চরিত্র।
ইসলামে নারী ও পুরুষ পরস্পরের সাথে সরাসরি মিলিত হতে পারে কেবল মাত্র পারিবারিক পরিবেষ্টনীতে। এই মিলন সামাজিক সমর্থনের আওতার মধ্যে সংঘটিত হবে উনন্ত সুদৃঢ় পবিত্র সামষ্টিক লক্ষ্যে।
নারী ও পুরুষ আনন্দ-স্ফুর্তি, খেল-তামাসা ও পশুর মত ভোগ-সম্ভোগের জন্যে পরস্পর মিলিত হতে পারে না। এখানে ওখানে নীতি গর্হিত কার্যকলাপে মশগুল হওয়ার উদ্দেশ্যেও তারা একত্রিত ও মিলিত হতে পারে না। তাদের পারস্পরিক মিলনের উদ্দেশ্য হতে হবে উন্নত সত্যাদর্শী সমাজ কায়েম ও গঠনের লক্ষ্যে।
মা এই পরিবারের কেন্দ্রীয় মর্যাদায় অভিষিক্ত। সে শুধু সন্তান গর্ভে ধারণ ও প্রসবই করবে না, সে তার সন্তানদের ইসলামের নৈতিক আদর্শানুযায়ী প্রশিক্ষণ দিয়ে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করবে।
পুরুষ এই পরিবারের কর্তা হিসেবে উক্ত কাজে তারই সহযোগী। এই পবিত্র পারিবারিক পরিমণ্ডল পাগলের ন্যায় উদ্দেশ্যহীনভাবে পুরুষ নারীর মিলন হতে পারে না। কেননা তা নৈতিক ক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্যয়েই সৃষ্টি করে, তা পুরুষ নারী যুবক-যুবতীর স্বাভাবিক স্বাস্থ্য ও চরিত্রের জন্যে কোনো ক্রমেই কল্যাণকর হতে পারে না।
আধুনিক জাহিলিয়াত নৃত্য সঙ্গীত ইত্যাদির অনুষ্ঠানে কত যে মূল্যবান সময় ও সম্পদের অপচয় করছে, তা একবার হিসেব করে দেখা আবশ্যক। এই সব অনুষ্ঠানের সর্বশেস ফল পাশবিক লালসার চরিতার্থতা ও নৈতিক বিপর্যয় ছাড়া আর কিছু হতে পারে কি?
এসব করে জাহিলিয়াতের সমাজ নারীদের জীবতাত্ত্বিক বিপর্যয় এবং পুরুষ ও শিশুদের জীবনে কঠিন দুর্দিন নিয়ে আশা ছাড়া আর কি লাভ করছে?
নৈতিক চরিত্র বলতে এখানে সেই নিয়ম-নীতি ও রীতি-পদ্ধতিকেই বোঝানো হচ্ছে, যা সমাজ তার যাবতীয় কার্যাদি সুসম্পন্ন করার ক্ষেত্রে বাস্তবে অনুসরণ করে চলে।
ইসলাম মানুষের ক্ষেত্রে নৈতিক চরিত্রের প্রশ্নের প্রতি কখনোই বিন্দুমাত্র উপেক্ষা প্রদর্শন করবে না, করতে পারে না। কেননা তা করা হলে মানুষ বিকৃতি ও বিপথগামিতার অতল গহবরে তলিয়ে যাবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে নৈতিক চরিত্র বিশ্বমানবতার প্রতি মহান আল্লাহর একটি বিরাট অবদান, তা জীবন গঠনকারী ও সমাজ পরিচালনাকারী আইন বিধান থেকে কখনোই বিচ্ছিন্ন বা বিচ্যুত হতে পারে না।
ইসলাম যেমন সবচাইতে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছে আল্লাহর তাওহীদের ওপরে –আল্লাহ একমাত্র ইলাহ এবং একমাত্র সার্বভৌম –এই আকীদাহর ওপর, ঠিকে তেমনি নৈতিকতার উৎস হিসেবেও একমাত্র আল্লাহকেই গ্রহণ করেছে। আল্লাহ যা ঠিক করে দিয়েছেন তা-ই নৈতিকতা। কেননা এই চরিত্র সম্পর্কে সর্বশেষ জবাবদিহি তো একমাত্র আল্লাহর কাছেই করতে হবে।
জাহিলিয়াত যখনই আল্লাহর এক ইলাহ ও সার্বভৌম হওয়ার আকীদা থেকে বিপথগামী হয়ে গেছে, ঠিখ তখনই তা মানুষকে সেই কঠিন সর্বগ্রাসী দুর্বিপাকে ফেলে দিয়েছে, যার বিস্তারিত রূপ আমরা পূর্ববর্তী আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেছি। সে দুর্বিপাক ঘটেছে রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, সমাজ ক্ষেত্রে, তেমনি আল্লাহর ঘোষিত নৈতিক বিধি-বিধানসমূহ পালন থেকে যখন বিপথগামী হয়ে পড়ল, তখনই তারা নানা বিপর্যয় ও দুঃখ-বিপদের আবর্তে পড়ে গেল। কেননা তা মূলত একই ব্যাপার। এ দুয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কিছুই নেই।
যে তাগুতী শক্তি রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ইত্যাদির ক্ষেত্রে মানুষের ওপর কর্তৃত্ব চালায়, তা-ই যখন ইসলাম থেকে বিপথগামী হয়, তখন সেই তাগুতই মানুষের নৈতিকতাকে ধ্বংস করে। কেননা নৈতিকতার নিয়ন্ত্রণও তো তারই হাতে। সে-ই কাজ ইচ্ছামতো ভিন্ন প্রকৃতির নৈতিক নিয়ম-নীতি রচনা করে। অতএব ণৈতিকতার বিপর্যয় সেই তাগুতেরই কারসাজি।
তাহলে মূলত নৈতিকতা কি? ….চরিত্র কাকে বলে?
ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা নৈতিক চরিত্রের ব্যাখ্যায় বলেছে, চরিত্র হচ্ছে অর্থনৈতিক অবস্থার প্রতিবিম্ব। বলেছে তা কোনো স্থায়ী ও অপরিবর্তনশীল জিনিস নয়, তা হচ্ছে পরিবর্তনশীল, বিবর্তনমূখী। বিবর্তন ও পরিবর্তনের নিশ্চিত অপরিহার্যথাই তার বিশেষত্ব। কেননা তা নিত্য নবোদ্ভুত অর্থনৈতিক পর্যায়সমূহকে বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করে।
এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণরূপে বাতিল সন্দেহ নেই। তবে অন্তত, একটি দিক দিয়ে তা সত্য মনে করা যায়।
একথা সত্য যে, বিপর্যয় জাহিলিয়াতের দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক পরিবর্তিত পর্যায় বাস্তবসমূহ অনুসরণ করাই চরিত্র বা নৈতিকতা। সেই সাথে তার বিবর্তনশীলতাও তার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কেন? তা এজন্যে নয় যে, তা একটি নিশ্চিত ও স্বভাবগত ব্যাপার। ইতিহাসের জাহিলী ব্যাখ্যাদাতারা অবশ্য তা-ই মনে করে। বরং তা এজন্যে যে, বাস্তবে যা ঘটে তা হলো –তাগুত-ই অর্থনৈতিক নিয়ম-নীতি রচনা ও নির্ধারণ করে বিশেষ এক শ্রেণীর লোকদের কল্যাণের জন্যে। অবশ্য দোহাই জনগণেরই দেওয়া হয়। সেই তাগুতই নৈতিকতার বিধি-বিধানও রচনা এবং চালু করে। তাও করে সাধারণ গণ-মানুসের দোহাই দিয়ে নির্দিষ্ট একটি শ্রেণীকে সন্তুষ্ট ও ধন্য করার লক্ষ্যে। ইতিহাসের জাহিলী ব্যাখ্যা এখান থেকেই বিপরীত ফল দেখতে পায়। কেননা মনে করে যে, অর্থ ব্যবস্থা ও নৈতিকতার মধ্যে সম্পর্ক হচ্ছে কারণ ও ফলের মধ্যকার সম্পর্ক। কিন্তু তা ভুল। আসলে বিপর্যস্ত জাহিলিয়াতের পাশ্চাত্য সমাজে অর্থ ব্যবস্থা ও নৈতিকতার মৌল উৎস এক ও অভিন্ন। আর তা হচ্ছে সেই তাগুতী শক্তি। কাজেই অর্থনীতি যা হবে, নৈতিকতাও তা-ই হবে স্বাভাবিকভাবেই।
কিন্তু ইসলাম আল্লাহর দেখানো পথে রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ নীতির মধ্যে যেমন নিবিড় সম্পর্ক, তেমনি নৈতিকতাও এরই সাথে জড়িত। কিন্তু আবার বলছি, এখানে এই সম্পর্ক ‘কারণ ও তার ফল’ –এই দুয়ের মধ্যকার সম্পর্ক নয়। তাতে সেই বিপরীত কালের মতাদর্শে দেখা যায়, যা ইতিহাসের জাহিলী ব্যাখ্যার দরুন তৈরি হয়েছে। এখানেও এই সবের পারস্পরিক নিবিড় সম্পর্ক এই কারণে যে, এই সবেরই মৌল উৎস এক ও অভিন্ন এবং তিনি হচ্ছেন মহান আল্লাহ। ইসলামের সব ব্যাপারই এমনি হয়ে থাকে।
কেননা যে সত্তাই মানুষের সমগ্র জীবনের জন্যে আইন বিধান দেয়, রাজনীতি, অর্থব্যবস্থা, সমাজ ও নৈতিকতার নিয়ম-কানুন এবং দুই লিঙ্গের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ধারণ –সেজন্যে প্রয়োজনীয় নীতি-রীতি সবকিছু সেই একই সত্তা দিয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেই মৌল উৎস কি হবে, কাকে এই সব ক্ষেত্রের জন্যে প্রয়োজনীয় আইন-বিধানের উৎসরূপে গ্রহণ করা হবে?
এই উৎস হয় হবেন আল্লাহ তা’আলা, না হয় হবে ‘তাগুত’।
আধুনিক ইউরোপীয় জাহিলিয়াতের নৈতিকতা যখন তার আসল তাৎপর্য হারিয়ে ফেলল তারপরই সেখানে সে ক্ষেত্রে চরম বিপর্যয় ও বিপথগামিতা ঘটল। আর সে আসল তাৎপর্য যে কেলমাত্র ইসলামেই নিহিত। আল্লাহই হচ্ছেন নৈতিকতার প্রকৃত উৎস তা বলাই বাহুল্য। তা থেকে আধুনিক ইউরোপে যে বিপর্যয়টা ঘটল, তা খুবই ধীরে ধীরে, ক্রমান্বয়ে সংঘটিত হলো। কেননা আগেই বলেছি, নৈতিকতার ক্ষেত্রে যে বিপর্যয় ঘটে, তা কখনোই হঠাৎ করে হয় না, ধীরে ধীরে ও ক্রমশঃই হয়। কেননা তার সম্পর্ক থাকে মানব মনের গভীরতর অভ্যন্তরের সাথে। তা সহসা নড়ে না, মুছে যায় না। যদিও বাইরের দিকে অনকে ওলট-পালট হয়ে যায়, চরম অস্থিরতা ও ভাংগাচোরা ঘটে যায়। যা কোনোক্রমেই সামলানো যায় না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গোটা প্রাসাদটাই এক সাথে ধ্বসে পড়ে।
প্রথমে রাজনীতি নৈতিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। তারপর বিচ্ছিন্ন হলো অর্থব্যবস্থা, তারপর যৌনতা, অতঃপর মুনাফাবাদী ও সুবিধাবাদী চরিত্রই হয়ে দাঁড়ালো জাতীয় চরিত্র, পরে পাশ্চাত্যে নবোদ্ভুত বংশধরতের হাতে এই মুনাফাবাদী ও সুবিধাবাদী চরিত্র সবকিছু নিয়ে চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে চলে গেল।
অবশ্য পূর্বে গোটা নৈতিকতাই চরমভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে এমন ঘটনা কখনোই ঘটেনি। না, ইতিহাসে এরূপ দৃষ্টান্ত মেলে না, কেননা মানব মন তার যৌন ও মিলিত প্রকৃতির কারণে সম্পূর্ণ ও সামষ্টিকভাবে ও পূর্ণ মাত্রায় পাপপ্রবণ হয়ে যেতে পার না। শেষ পর্যায়েও ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু নিদর্শন অবশিষ্ট থেকেই যায়। তবে শেষের দিকে পাপপ্রবণতা প্রবল হয়ে যখন অন্যান্য গুণের ওপর বিজয়ী হয়ে ওঠে, তখনই গোটা প্রাসাদই ধুলিসাৎ হয়ে পড়ে।
ইসলামী নৈতিকতার প্রতিটি বিষয় ও ব্যাপারই তার সত্য সঠিক ও স্বাভাকি স্থানে স্থাপন করা হয়। কেননা অন্যান্য সব জিনিসের ন্যায় নৈতিকতার উৎসও কেবলমাত্র আল্লাহ তা’আলা, আল্লাহর দ্বীন। ফলে তথায় তাগুতী খেলা চলতে পারে না, তার দাপট থেকে তা মোটামুটি সংরক্ষিতই থাকে। যদিও জাহিলী তাগুত তার নামকরণ করেছে বিবর্তন বা পরিবর্তন –উন্নতি। এ নামকরণের আসল কারণ হচ্ছে তাগুতী শয়তানীকে গোপন করা এবং মানব মনের ওপর সহজেই তার প্ররোচনার কার্যকর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়া।
কিন্তু ইসলামী নৈতিকতা মূলত রাব্বানী (খোদায়ী) নৈতিকতা। সে নৈতিকতা মানুষের রচতি বা কল্পিত নয়। তা কখনই কারোর খামখেয়ালীর প্রভাবাধীন হয় না; তার সুদৃঢ় স্তম্ভসমূহ কখনোই নড়ে যায় না। লোকদের মধ্য থেকে কোনো বিশেষ শ্রেণী বা জনগোষ্ঠীর সাথে তা পরিবর্তিত-ও হয়ে যায় না। মানুষের খামখেয়ালী ও কামনা বাসনার অনুসরণ করতে তা কখনোই প্রস্তুত হয় না। তা পরিবর্তনশীল প্রদর্শনীতেও পরিণত হয় না কখনোই।
ইসলামী নৈতিকতা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী নৈতিকতা। এই কারণে তা মানবিক নৈতকিতা। মানবিক এই অর্থে যে, তা রক্ষিত হবে নির্বিশেষে সকল মানব সন্তানের দ্বারা। কোনো জাতীয়তার দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়, নয় বংশীয় বা শ্রেণীগত অথবা সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ দিয়ে, বৈষয়িক স্বার্থের ভিত্তিতেও তা আচরিত হবে না। ইউরোপীয় নৈতিকতা আল্লাহ প্রদত্ত পন্থা থেকে বিভ্রান্ত হয়ে যে কদর্যতার মধ্যে পড়ে গেছে, নৈতিকতার সেই বিভ্রান্তিসমূহের মধ্যের কোনো একটির ধরনেও তা চলবে না।
সর্ব মানুষের সাথে তা আচরিত হবে মানুষ হিসেবেই, বর্ণ, বংশ, ভাষা, ভৌগোলিক জাতীয়তা বা শ্রেণীগত পার্থক্যের কিংবা আকীদা-বিশ্বাস অর্থাৎ ধর্মগত বৈষম্যের দৃষ্টিতেও এ ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য করা হবে না। এই বিশ্বাস নিয়ে তা অবলম্বিত হবে না, সকল মানুষ মূলত একই মানুষ আদমের সন্তান, সেই একজন থেকেই সূচিত হয়েছে সমস্ত মানুষের মহাযাত্রা। তার থেকেই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে। অতঃপর এই দুজন থেকেই সৃষ্ট হয়েছে দুনিয়ার শতকোটি মানুষ। দুনিয়ার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এই মানুষ পুরুষ ও নারী হিসেবে সংখ্যাতীত।
(আরবী*****************************************************************************)
হে মানুষ! তোমরা ভয় করো তোমাদের সেই মহান সৃষ্টিকর্তা –প্রতিপালককে, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একজন মাত্র মানুষ থেকে। তারই থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং অতঃপর এই দুজন থেকে অসংখ্য পুরুষ ও নারী ছড়িয়ে পড়েছে। (সূরা আন-নিসাঃ ১)
(আরবী******************************************************************************)
এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি শুধু এই উদ্দেশ্যে যে, তোমরা পরস্পরের সাথে পরিচিত হবে। কিন্তু তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানার্হ সেই ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহ-ভীরু।
(সূরা হুজরাতঃ ১৩)
এ নৈতিকতার নিয়ম-বিধানসমূহ সর্বাবস্থায়ই স্থায়ী ও অপরিবর্তিত থাকে। এমন কি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও তাতে কোনোরূপ তারতম্য ঘটে না, কেননা ইষলামে এই সব কিছুই মানব জীবনে চিরস্থায়ী এক মৌল উৎস থেকে উৎসারিত। আর তা হচ্ছে মানুষ হিসেবেই সব মানুষ সমান, মনুষ্যত্বের দিক দিয়ে মানুষ পরস্পর অভিন্ন। তাদের মান-মর্যাদা ও বাড়াবাড়ি সীমালংঘনমূলক আচরণ থেকে তা সংরক্ষিত হওয়ার অধিকারের দিক দিয়ে পরস্পর সমান, সম্পূর্ণ অভিন্ন।–[(আরবী*********) গ্রন্থের (আরবী************) অধ্যায় দ্রষ্টব্য।]
ইসলামের ইতিহাসে উক্ত চরিত্রের বাস্তব দৃষ্টান্ত উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। পাশ্চাত্যের নৈতিকতা নিছক মুনাপা ও স্বার্থ ভিত্তিক। বিশেষ শ্রেণী বা বিশেষ জাতির স্বার্থ অন্যান্য সব মানুষের স্বার্থের চাইতে অনেক বড় করে দেখাই সে নৈতিকতার ভিত্তি। ইসলামী নৈতিকতা ও সেই নৈতিকতার মধ্যে এই কারণেই বিপুল পার্থক্য।
ইহুদীরা ইসলামের প্রাথমিক সময়েই তার ওপর যে জঘন্য যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল, মুমিনের ঈমান নষ্ট করার ও এই নবতর আকীদা হৃদয় কন্দরে সুদৃঢ় হয়ে আসীন হওয়ার পূর্বেই তা উৎপাটিত করার লক্ষ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, ষড়যন্ত্র, কলা-কৌশল, বিক্ষোভ প্রচার, পরস্পর কর্তৃত্ব, পরস্পরে মনে সংশয় সৃষ্টি, মুসলিম পুরুষ ও নারীর ইজ্জতে কলংক লেপন ইত্যাদি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছিল। সেই সাথে যুক্ত হয়েছিল যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহারের আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ, যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করা, চুক্তি ভঙ্গ করা, মর্যাদা হনন করা ইত্যাদি –কোনো কিছু বাদ রাখেনি। এত সব সত্ত্বেও ইসলাম ইহুদীদের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি, একজন ইহুদীর ওপরও আক্রমণ করা হয়নি। এই সময়ই এক মারাত্মক মিথ্যা অভিযোগ তোলা হলো। এই কারণে তাদের ওপর আক্রমণের পরিস্থিতি অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তখনও তাদের নির্দোষিতা প্রমাণের লক্ষ্যে নিম্নোদ্ধৃত আয়াতসমূহ ওহীর মাধ্যমে নাযিল হয়েছিলঃ
(আরবী***************************************************************************************************************************************************************)
নিঃসন্দেহে আমরা আপনার প্রতি এই গ্রন্থ পাঠিয়েছি পরম সত্যতা ও বাস্তবতা সহকারে, যেন আপনি লোকদের মধ্যে সেই অনুযায়ী শাসন ও বিচার ফয়সালার কার্য সম্পাদন করেন। সেই অনুসারে তা করেন, যা আল্লাহ আপনাকে দেখিয়ে দিয়েছেন এবং আপনি সেই খেয়াতনকারী লোকদের পক্ষ সমর্থন করবেন না। আপনি মাগফেরাত প্রার্থনা করুন আল্লাহর কাছে। কেননা আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, অতীব দয়াবান। যারা নিজেদের প্রতি খেয়ানতমূলক আচরণ করে তাদের পক্ষে আপনি জবাবদিহি করবেন না। কেননা যারা বড় খেয়ানতকারী, পাপী, আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না। যাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, লোকদের থেকে তো লুকোয়, কিন্তু আল্লাহকে লজ্জা পায় না, অথচ তিনি তাদের সঙ্গেই রয়েছেন। তারা যখন আল্লাহর মর্জীর বিপরীত কাজের ষড়যন্ত্র করায় লিপ্ত হয় –আল্লাহ তো তাদের কার্যাবলী নিজের আয়ত্তের মধ্যে নিয়ে নিয়েছেন। হ্যাঁ, তোমরা তো এমন যে, তোমরা বৈষয়িক জীবনে তো তাদের পক্ষ থেকে জবাবদিহি করছ; কিন্তু কেয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে তাদের পক্ষে কে জবাবদিহি করবে? কিংবা কোন ব্যক্তি তাদের কার্য সম্পাদন করবে? অথবা যে ব্যক্তি কোনো খারাপ কাজ করল কিংবা নিজের ওপরই জুলুম করল পরে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইল, সে আল্লাহকে বড়ই ক্ষমাদানকারী ও অতীব দয়াবানই পাবে। যে লোক কোনো গুনাহ করছে, সে গুনাহের শাস্তি তারই ওপর পতিত হবে। আর আল্লাহ তো বড়ই বিজ্ঞ, সুবিজ্ঞানী। যে লোক কোনো ভুল করে বসল কিংবা কোনো গুনাহ করল, পরে সেই দোষ চাপিয়ে দিল কোনো নির্দোষ ব্যক্তির ওপর। সে তো সুস্পষ্ট গুনাহ ও মিথ্যা অভিযোগের বোঝা নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিল।
আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত যদি তোমার প্রতি না থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই ওদের মধ্য থেকে একটি গোষ্ঠী তোমাকে পথভ্রষ্ট করার জন্যে পূর্ণ চেষ্টা চালাত। তবে তার পরিণামে নিজেদের ছাড়া আর কাউকেই পথভ্রষ্ট করতে পারত না এবং তারা তোমাকে এক বিন্দু ক্ষতিগ্রস্তও করতে পারবে না। আর আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হিকমত নাযিল করেছেন এবং তোমাকে জানিয়ে দিয়েছেন তা, যা তুমি জানতে না। আর তোমার প্রতি তো আল্লাহর অনুগ্রহ অনেক বড় ও বিরাট। (সূরা আন-নিসাঃ ১০৫-১১৩)
এই মোট নয়টি আয়াত বিস্তারিত বর্ণনা, বারবার করা কঠোর তাগিদ ও বিশ্লেষণসহ নাযিল হয়েছিল সেই নির্দোষ ইহুদীর ওপর অবিচার করার কাজ থেকে রাসূলে করীম (স)-কে বিরত রাখার জন্যে। ইহুদীটি মূলত নির্দোষ হলেও সমস্ত লক্ষণ ছিল তাকে দোষী প্রমাণের পক্ষে। অথচ প্রকৃতপক্ষে সে এই অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারে না।
এই বাস্তব ঘটনা দ্বারা ইসলাম এই চিরন্তন মানবীয় মৌলনীতি দাঁড় করিয়েছে, ইসলাম ছাড়া অন্য কোথাও তার নাম-চিহ্ন বা লেশমাত্রও পাওয়া যাবে না কখনোই।–[(আরবী*******) গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।]
এটা তো ছিল দ্বীনি আত্মচেতনা বোধের ব্যাপার।
আর আভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে হযরত উমর ফারূক (রা)-এর আচরণ আমাদের সম্মুখে ইতিপূর্বেই প্রতিভাত হয়েছে। তখন তিনি ইসলামের শত্রুদের আরদ্ধ ইসলাম-বিরোধী যুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত হয়েছিলেন।
বৈদেশিক রাজনীতির দিক দিয়েও একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা যেতে পারে। হযরত আবূ উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা) ‘হীরা’র নিকটবর্তী কয়েকটি জনপদের লোকদের সাথে চুক্তি করেছিলেন। তাতে লিখিত হয়েছিলঃ
আমরা যদি তোমাদেরকে আক্রমণকারীদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করি, তাহলে তোমরা আমাদেরকে জিজিয়া দেবে, নতুবা নয়। পরে হিরাক্লিয়াস যখন এই অঞ্চলের ওপর আক্রমণ চালাবার জন্যে সৈন্যবাহিনী তৈরি করল, তখন হযরত আবূ উবায়দা সিরিয়ার বিজিত এলাকাসমূহের কর্মকর্তাগণকে লিখে পাঠালেন যে, এই সব এলাকার লোকদের কাছ থেকৈ যে জিযিয়া নেওয়া হয়েছে তা তাদের পেরত দিয়ে দাও। সেই সাথে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজনকেও জানিয়ে দিলেন, আমরা তোমাদের কাছ থেকে গৃহীত ধন-মাল তোমাদেরকেই ফেরত দিচ্ছি এই কারণে যে, আমরা শুনতে পেয়েছি যে, এই এলাকার ওপর আক্রমণ করার জন্যে বিরাট বাহিনী তৈরি হচ্ছে, এদিকে তোমরা আমাদের সাথে শর্ত করেছিলে যে, আমরা তোমাদেরকে বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষা করব। কিন্তু এক্ষণে তা করতে আমরা অক্ষম। এই কারণেই তোমাদের কাছ থেকে আমরা যা কিছু গ্রহণ করেছিলাম, তা তোমাদের ফেরত দিলাম। আমরা তোমাদের সাথে কৃত ওয়াদার ওপর অবিচল রয়েছি। যে চুক্তি আমাদের পরস্পরে লিখিত হয়েছিল, তা অপরিবর্তিত এই আশায় যে, আল্লাহ তোমাদেরকে সেই আক্রমণকারীদের ওপর বিজয় দান করবেন।–[(আরবী***************) টি, ও আরনল্ড লিখিত।]
লক্ষণীয়, রাজনীতি তার উভয় দিকসহ নৈতিকতার বেষ্টনীর মধ্যে এভাবেই পড়ে যায়, তাকে নৈতিকতার বন্ধন থেকে বের করে নেওয়ার কোনো মোকিয়াভেলী অপকৌশল ইসলামে আদৌ স্বীকৃত নয়।
অর্থনীতি সম্পর্কেও আধুনিক জাহিলিয়াত ধারণা করে নিয়েছে যে, তার কোনো সম্পর্কই নৈতিকতার সাথে নেই। তার ওপর নিয়ন্ত্রণ চালায় তার সেসব নিশ্চিত অপরিহার্যথার নিয়মাবলী, যাকে ভালোও বলা যায় না, বলা যায় না তা মন্দ। তাকে উন্নতও বলা যায় না, বলা যায় না তা হীন। কেননা প্রতিটি জিনিসের মানদণ্ড তার নিজের মধ্যেই বিরাজিত, যতক্ষণ পর্যন্ত তার ওপর কার্যকর নিশ্চিত অনিবার্য স্তর বহাল থাকবে। আবার নিশ্চিত অনিবার্যতার কারণে সে স্তর যখন শেষ হয়ে যাবে, তখন সেই প্রথম মানদণ্ডই ফিরে আসবে ও নবতর মানদণ্ড গড়ে উঠবে। ফলে গতকাল যা উত্তম ভালো ও উপযোগী ছিল, আজ তা-ই অভিশপ্ত ও পরিত্যক্ত হয়ে যা নতুন দিনের পরিবেশে। এখানে কোনো স্থায়ী নৈতিক ভিত্তি নেই। এই দৃষ্টিতে সামন্তবাদ তার স্তরে যথার্থ ছিল, ছিল সর্বজনগৃহীত। এটা তার নিজস্ব বিবেচনার মানদণ্ড। পরে তার নিশ্চিত অনিবার্য স্তর যখন শেষ হলো, তখন এলো পুঁজিবাদ। এই পুঁজিবাদী সমাজে সামন্তবাদ অত্যন্ত ঘৃণ্য, বীভৎস। তা এজন্যে নয় যে, তা তার জন্যে নির্দিষ্ট ও প্রতিশ্রুতি সময় পরিমাণের পরও দাঁড়িয়ে থাকতে চায়। তার সময়ই ফুরিয়ে গেছে। এখন তারটিকে থাকার কোনো অধিকার নেই। তখন তো পুঁজিবাদই যথার্থ। যতক্ষণ পর্যন্ত তা তার স্বাভাবিক সময়ের মধ্যে টিকে থাকবে এবং যতই অসৎ কর্ম সম্পাদন করতে থাকুক না কেন সেই সময়টা অতিবাহিত হয়ে গেলেই পাল্লা উল্টে যাবে, নতুন মানদণ্ড দাঁড়িয়ে যাবে। এটাই হচ্ছে ইতিহাসের গতি ধারা। তার মূল সত্তার বাইরেথেকে গৃহীত কোনো মানদণ্ডের ভিত্তিতে তাকে বিচার করা চলবে না। আর নৈতিকতা তো হচ্ছে সর্বশেষ বিষয়, যার ভিত্তিতে বিষয়গুলোর ওজনও যাচাই করা যেতে পারে।
এসব কথা উন্নতি, অগ্রগতি ও প্রগতি সংক্রান্ত।
কিন্তু ইসলাম তো আল্লাহর কালেমা। তা শুরু থেকেই মানবজীবনের কোনো একটি ক্ষুদ্রতম জিনিসেরও সম্পর্ক নৈতিকতার সাথে নেই একথা স্বীকার করতেই রাজি নয়।
এ কারণেই সুদ সম্পূর্ণ হারাম করা হয়েছে। তা যেমন ইসলামী নৈতিকতার ভিত্তিতে হারাম, ঠিক সেই একই সময় তা হারাম অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ দিয়েও। কেননা মৌল আইন-প্রণয়নর দিক দিয়ে এ দুয়ের মাঝে কোনোই পার্থক্য নেই। পার্থক্য নেই জীবনের বাস্তবতার দিক দিয়েও।
(আরবী***************************************************************************)
হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা ভয় করো আল্লাহকে। আর ছেড়ে দাও সুদের অবশিষ্ট অংশ –যদি তোমরা মুমিন হও। যদি তা না করো, তাহলে আল্লাহ তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে তোমরা প্রস্তুত হও। আর তোমরা যদি তওবা করো, তাহলে তোমাদের মূলধন তোমরা ফেরত পাবে। …না তোমরা জুলুম করবে, না তোমাদের ওপর জুলুম করা হভে। আর ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি কঠিন দারিদ্র্যে পড়ে গিয়ে তাকে, তাহলে তার সচ্ছলতা লাভ পর্যস্ত অবকাশ দাও। আরযদি গোটা ঋণের টাকাটাই সাদকা করে দাও, তাহলে তা তোমাদের জন্যে খুবই উত্তম, যদি তোমরা জানো। তোমরা ভয় করো সেই দিনকে, যেদিন তোমরা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে। অতঃপর প্রতিটি ব্যক্তিকে পূর্ণ মাত্রায় দিয়ে দেওয়া হবে যা সে অর্জন করেছে, তাদের ওপর কোনো জুলমু করা হবে না। (সূরা বাকারাঃ ২৭৮-২৮৯)
আইন প্রণয়নের কারণ এমনি ভাবেই বিশ্বাস করা হয়েছে সবকিছু মিলিয়ে এক সাথে। তাতে নৈতিক চরিত্র যুক্ত রয়েছে রাজনীতির সাথে, অর্থনীতির সাথে কোনোটির অপর কোনোটি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।
সুদ হারাম এজন্যে যে, তা জুলুম। এ জুলুম যেমন অর্থনৈতিক, তেমনি সামাজিকও। আর ঠিক সেই একই সময় তা এক নৈতিক নির্লজ্জতা, বীভৎসাতও বটে। হারাম করার মূল কারণের মধ্যে এইসব দিক সমানভাবে লক্ষ্যভূত। নৈতিক দিক দিয়ে তার নির্লজ্জতার কারণে হারাম হওয়াটা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তার জুলুম ও শোষণ হওয়ার কারণে তার হারাম হওয়ার তুলনায় বিন্দুমাত্র কম গুরত্বপূর্ণ নয়, নয় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি অপরটি থেকে ভিন্নতর কিছু নয়। আবার সেই মুহুর্তেই সুদ নৈতিকতার বিরোধী, তার সাথে সাংঘর্ষিক তাকওয়া ও আল্লাহভীরুতার দৃষ্টিকোণ দিয়ে। সুদের বিরুদ্ধে জিহাদ একটা বড় সওয়াবের কাজ। এই কারণে সুদখোরদের বিরুদ্ধে আল্লাহ ও রাসূল অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্র জিহাদ করবে তার রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও বিচার বিভাগীয় শক্তির পূর্ণ প্রস্তুতি সহকারে উভয় দিক দিয়েই সুদবিরোধী যুদ্ধ সমান গুরুত্বপূর্ণ। এটা নয় যে, নৈতিকতা বিরোধী কারণে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধটা কম বা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে। আর শরীয়ত আইন ও শাস্তির দিক দিয়ে তার মাত্রা কম বা বেশি হবে। দুটো একই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে অভিন্ন মূল সূচনা থেকে শেষ পর্যায় পর্যন্ত। এ দুয়ের মধ্যে কোনো পর্যায়েই কোনো পার্থক্য নেই –বৈপরীত্য নেই।
অ-সুদী ব্যবস্থার ভিত্তিতে অর্থ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক ভিত্তির সাথে নৈতকিতার সম্পর্ক এই পূর্ণাঙ্গ সংমিশ্রিত ধারায় প্রথম ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তার অর্থনৈতিক ভিত্তিটি ছিল নৈতিকতার বেষ্টনীর মধ্যে। আর ব্যক্তি ও সমষ্টি পর্যায়ের যাবতীয় পারস্পরিক কাজকর্ম সুস্পষ্ট অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছিল।
ইসলামী সমাজের অর্থব্যবস্থা সুদ হারাম হওয়ার ওপর ভিত্তিশীল ছিল। মওজুদকারী পুঁজিবাদও তথায় সম্পূর্ণ হারাম ছিল। অপহরণ, ছিনতাই, লুঠপাট, ডাকাতি, চুরি ও আত্মসাৎ -এ সবও ছিল হারাম। অধিকার প্রয়োগকে বাধাগ্রস্ত করা বা খারাপভাবে অধিকার প্রয়োগ করা –উভয়ই সেখানে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। আর এসবই ছিল সুস্পষ্ট অনিবার্য নৈতিকতার ভিত্তিতে। এটাই ইসলামের আদর্শ অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপনের জন্যে।
ইসলামের কায়েম করা এই নৈতিক আদর্শ থেকেই বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তি হয়ে গেছে বলে পাশ্চাত্য অর্থনীতি, সামন্তবাদী বর্বরতা, পুঁজিবাদী শোষণ, নির্যাতন-নিষ্পেষণ এবং সামাজিক সামষ্টিক স্বৈরতন্ত্র –প্রভৃতি বিভিন্ন দিকে চলে গেছে। যদিও জাহিলিয়াত নিষ্পেষিত মানবতা এখন পর্যস্ত জাহিলিয়াতের মারাত্মক ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেনি। তারা নিজেরাই নিজেদের অর্থ ব্যবস্থায় যে জুলুম পীড়ন ও সীমালংঘনমূলক স্বভাব বিরোধী ঘটনা-দুর্ঘটনা স্বাদ আস্বাদন করেছে এবং দীর্ঘদিন ধরে করছে, তার একমাত্র কারণ হচ্ছে, তাদের অর্থনীতির গোটা ব্যবস্থাই নৈতিক ব্যবস্থা ও আদর্শ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নৈতিকতা ও অর্থ ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্যের উঁচু পাহাড় দাঁড় করে দেওয়া হয়েছে। জাহিলিয়াতের ধারণা হচ্ছে, অর্থনীতির নিজস্ব ও বিশেষ নিশ্চিত-অনিবার্য নিয়ম-বিধি রয়েছে, যার সাথে নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক আসলেই নেই।
কিন্তু ইসলাম একান্তই আল্লাহ নির্ধারিত পথ বলে তার প্রথম আদর্শিক পর্যায়েই অতীব উত্তম পবিত্র পরিচ্ছন্ন নৈতিকতা গুরুত্ব সহকারে প্রতিষ্ঠিত করেছিল অর্থ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও। মানবতার ইতিহাসে তার কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। তখন সামষ্টিক ধন-সম্পদে আনসার ও মুহাজির মুসলমানরা উভয়ই পরম আন্তরিকতা সহকারে সমান অংশীদারীত্যে শরীক হয়েছিলেন। এ ব্যাপারে সরকারকে কোনো হস্তক্ষেপ করতে হয়নি। সে জন্যে বিশেষ কোনো চেষ্টা যত্নও নিতে হয়নি। এই সময় যাকাত দিয়ে দেওয়ার ব্যাপারেও মুসলমানদের মধ্যে প্রবল প্রতিযোগিতা চলত। কেননা এই যাকাত হচ্ছে ইসলামী সমাজে সামাজিক-রাষ্ট্রীয়-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভিত্তি। তার লক্ষ্য মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের হিসেব নিজে করতেন, নিজের ঈমানের তাগিদে প্রত্যেকেই যাকাত দিয়ে দিতেন, আল্লাহর পথের নেক আমল হিসেবেও তাঁরা অনেক দান-সদকা করতেন।
হযরত আবূ বকর (রা) যখন খলীফা নিযুক্ত হলেন, তখন প্রশ্ন উঠল, তিনি নিজের জীবিকার জন্যে যে ব্যবসায় করতেন তা করতে না পারলে তাঁর জীবিকার ব্যবস্থা কোত্থেকে হবে? মুসলিম জনগণের পক্ষ থেকে বলা হলো, খিলাফতের দায়িত্ব পালন করতে হলে ব্যবসায়ে মশগুল থাকা চলবে না। তিনি প্রশ্ন করলেন, তা হলে আমার চলবে কি করে? তখন মুসলমানরাই তাঁর জন্যে বায়তুলমাল থেকে তাঁর জীবিকা প্রয়োজন পূরণ পরিমাণের সমান মাত্র কয়েকিট দিরহাম নির্দিষ্ট করে দিলেন, কিন্ত উত্তরকালে তাঁর জীবনের শেষভাগে তিনি বায়তুলমাল থেকে খলীফাতুল মুসলিমীন হিসেবে ভাতা বাবদ গৃহীত সম্পূর্ণ অর্থ বায়তুলমালে ফেরত দিয়েছিলেন এই বলে যে, এটা বায়তুলমালে তাঁর ঋণ এবং এই ঋণই ফিরিয়ে দেওয়া হলো। তাঁর পর হযরত উমর ফারূক (রা) যখন খলীফা হলেন, তাঁর জন্যেও বায়তুলমাল থেকে একটা ভাতা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। কেননা তাঁর জীবিকার নিজস্ব কোনো উপায় ছিল না। তাঁর গোলাম সেই ভাতার অর্থ দিয়ে কিছু পরিমাণ ঘি ক্রয় করেছিল। হযরত উমর (রা) সেই ঘি গরীব জনগণের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন এই বলে যে, সাধারণ মানুষ যখন খেতে পায় না, তখন উমর ঘি খাবে, তা হতে পারে না। তা খাওয়া হালাল হবে না। হযরত আলী (রা) খলীফা হলে তিনি বায়তুলমাল থেকে এক বস্তা আটা গ্রহণ করতে গিয়ে তার ওপর সিল মেরে বললেন –সিল এজন্যে মারা হলো, যেন আমার পেটে কতটা যাচ্ছে তা আমার জানা থাকে। আরও পরে উমর ইবনে আবদুল আজীজ খলীফা নির্বাচিত হলে মারওয়ান বংশ তাঁর জন্যে যে সব জমি-জায়গা লিখে দিয়েছিল তা সব মুসলমানদের বায়তুলমালে ফিরিয়ে দিলেন। উমাইয়া বংশের লোকেরা ইতিপূর্বে জনগণের কাছ থেকে যা কিছু কেড়ে কুড়ে নিয়েছিল, তা-ও ফেরত দিয়ে দিলেন, কেননা তা নেওয়ার কোনো অধিকারই তাদের ছিল না, তা তাদের জন্যে হালাল ছিল না।
ইতিহাসের পরবর্তী পর্যায়সমূহে মুসলমানরা যদিও বিপথগামিতা ও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল, তখনও সামন্তবাদী প্রথার বিরুদ্ধে ইসলাম বাধার সৃষ্টি করেছিল, পাশ্চাত্যের কাছে যা ছিল অর্থনীতির নিশ্চিত অপরিহার্য স্তর। ঐতিহাসিক বিচার একথা জোর দিয়ে বলা যায়, ইউরোপীয় অর্থনীতিতে সামন্তবাদী ব্যবস্থা যে ভয়াবহ ও অর্থনৈতিক রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সমগ্র মুসলিম জাহানে তা কখনোই দেখা যায়নি। যদিও মুসলিম সমাজেও বিভিন্ন দিক দিয়া আংশিকভাবে অনেক বেশি বিপথগামিতা দেখা দিয়েছিল, তবুও এমন বিপথগামিতা কখনোই আসেনি যে, গোটা অর্থ ব্যবস্থাটাই তার নৈতিকতার ভিত্তিতে হারিয়ে ফেলবে। অথচ পাশ্চাত্যের জাহিলী সমাজ ব্যবস্থার গোটা ইতিহাসে এক মুহুর্তের তরেও মানবিক ব্যবস্থার স্বাদ গ্রহণ করার কোনো সুযোগই মানুষ পায়নি।
কি সামন্তবাধী জায়গীরদারী ব্যবস্থা, কি পুঁজিবাদী আর কি সমূহবাদী স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা –কোথাও একবিন্দু মানবিকতার সংবেদনশীলতা দেখতে পাওয়া যায়নি। অন্তত এ সবের যে আদর্শ স্তর ছিল, তাতেও নয়।
কমিউনিস্ট সমাজতান্ত্রিক দল প্রতিটি কমিউস্টি সমাজতান্ত্রিক দেশে বিশেষ কিছু অধিকার ভোগ করে, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে স্বপ্নেও চিন্তা বা আশা করা সম্ভব নয়। কমিউনিস্ট সমাজতাতিন্ত্রক সমাজের ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছদ ও বসবাসের ঘর-বাড়ি সাধারণ মানুষের থেকে অনেক উন্নতমানের হয়ে থাকে। জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অনেক উচ্চে তাদের বসবাস ও অবস্থান। এমন কি এই ক্ষমতাসীন দলের লোকদের প্রয়োজনীয় ঔষধ পত্র ও বিপুল অর্থ ব্যয় দেশের বাইরে থেকে আমদানী করা হয়। আর সাধারণ মানুষের নির্ভরতা কেবলমাত্র দেশীয় ঔষধের ওপর, সে ঔষধ যেমনই হোক। বর্তমান দুনিয়ার পরাশক্তি রাশিয়ায় এই ব্যবস্থাই কার্যকর।
এর একমাত্র কারণ এই যে, এসব সমাজ ব্যবস্থা অর্থনীতির ক্ষেত্রে কোনো নৈতিকতার প্রতিই বিশ্বাসী নয়। মোকিয়াভেলীর জাহিলী নীতিরই অনুসরণ হচ্ছে সর্বত্র। সেখানে লক্ষ্য উপায়কে পবিত্র করে দেয়, মূলত উপায়টা যতই খারাপ হোক না কেন। আর সে লক্ষ্যটাও কোনো নৈতিক মানেই যাচাই করার পক্ষপাতীও তারা নয়।
কিন্তু দ্বীন-ইসলাম মহান আল্লাহর নাযিল করা দ্বীন। উপরোক্ত সর্বাত্মক বিপর্যয় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার তা-ই হচ্ছে একমাত্র পথ, এক মাত্র উপায়।
ইসলামের অর্থ ব্যবস্থা যখন মানবিক নৈতিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় তখন জুলুমের সখল পথ স্বতঃই রুদ্ধ হয়ে যায়। তাগুতী শক্তির সম্মুখে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বর্তমানের জাহিলিয়াত সমাজে যে সামান্য নৈতিকতা ও মানবিক নগণ্য গুণাবলী দেখতে পাওয়া যায় –যেমন সততা-সত্যবাদিতা, আমানতদারী বিশ্বস্ততা, নিষ্ঠা, কর্মতৎপরতা ও দৃঢ়তা, অবিচলতা ইত্যাদি –এগুলো আসলে ইসলামী নৈতিকতারই ভগ্নাংশ ও অবশেষ। ইউরোপীয় সমাজের লোকেরা মুসলমানদের সমাজের সাথে যোগযোগের ফলে মুসলমানদের কাছ থেকেই গ্রহণ করেছে (যদিও আজ যারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবি করছে, তারা এসব নৈতিকতা ও গুণ-বৈশিষ্ট্যকে ত্যাগ করেছে বা হারিয়ে ফেলেছে।) কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা বলতে বাধ্য যে, ইউরোপে এই সব ইসলামী নৈতিকতার ভিত্তি হচ্ছে মুনাফা লাভ ও সুবিধা লাভের লোভ। ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুনাম রক্ষার জন্যেই তারা প্রয়োজনমতো এগুলো ব্যবহার করে। কিন্তু ইসলামে এ নৈতিকতা নিতান্তই মানবিক।
বস্তুত ইসলামের সমস্ত নৈতিকতা মানবিকতা উচ্চ উন্নত মহান আদর্শের ওপর ভিত্তিশীল। তাতে যেমন ব্যক্তিগত স্বার্থ বা সুবিধার প্রশ্ন নেই, তেমনি নেই বিদ্বেষ কলুষিত কোনো পার্থক্যবোধ। কেননা ইষলামী নৈতিকতা আসলে রাব্বানী নৈতিকতা, আল্লাহর দেওয়া ও আল্লাহর জন্যে এই নৈতিকতা। ফলে তা সকল মানুষের জন্যেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
মানুষ যখন আল্লাহ প্রদর্শিত সীরাতে মুস্তাকীমে চলতে শুরু করে, তখনই সে এই চরিত্র অর্জন করে। পাশ্চাত্য তো মাত্র একটা দিকই পেয়েছে, সম্পূর্ণ নৈতিকতা তাদের থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। কিন্তু ইসলামী আদর্শ অনুসরণকারীর নৈতিকতা তো অনেক উচ্চতর মানে হয়ে থাকে। পরে এই নৈতিকতার বেষ্টনীর মধ্যে মানব জীবনের মাত্র কয়েক দিক নয় –সমস্ত বিষয় ও দিকই এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তার আওতার বাইরে কিছু থাকে না। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, যৌনতা –এর কোনো একটিও ইসলামী নৈতিকতার বাইরে থাকে না, থাকতে পারে না। কেননা নৈতিকতাই হচ্ছে সাধারণ আচরণ বিধি, তা এমন নয় যে, জীবনের কোথাও তা অনুসৃত হবে আর কোথাও হবে না।
যৌনতা সম্পর্কে বিশেষ আলোচনার বহু কয়টি দিক রয়েছে। সাধারণভাবে নৈতিক চরিত্র বলতে যা বোঝায়, আমরা এখানে সেই সংকীর্ণ নৈতিকতা সম্পর্কে কোনো আলোচনা করব না। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে নৈতিকতা অনেক বড় ও বিশাল ব্যাপার। লোকেরা যা মনে করে এবং নৈতিকতা সম্পর্কে যে ধরনের কথাবার্তা বলে তা ইসলামের দৃষ্টিতে মোটেই গ্রহণীয় নয়। লোকদেরও এরূপ সংকীর্ণ ধারণার কারণ হলো, তারা পুরুষ-নারীর মধ্যকার যৌন-সম্পর্ককে পর্যন্ত তার বাইরে রেখে তাতে চরম মাত্রার বিপর্যয় ঘটাতে ইচ্ছুক।
ইসলামের দৃষ্টিতে চরিত্র হচ্ছে সমগ্র মানুষ। তার যত দিকের সাথে সম্পর্ক রয়েছে তার নিজের সাথে নিজের, তার আল্লাহর সাথে এবং জনগণের সাথে যে সম্পর্ক রয়েছে তা সবই এই নৈতিকতার অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম কেবল যৌন সংক্রান্ত ব্যাপারকেই নৈতিকতার আওতায় গণ্য মনে করে না, লোকদের সাথে পারস্পরিক সম্পর্কটুকুর মধ্যেই নৈতিকতাকে সীমাবদ্ধ করে না। বরং তাতে শামিল রয়েছে সেই সব গোপন চিন্তা ও ভাবধারাও, যা মানুষ সাধারণত লোকদেরকে জানাতে পর্যন্ত রাজি হয় না। অনেক সময় সে হয়ত নিজেকেও তা জানায় না। এমন সব ব্যাপারও নৈতিকতার মধ্যে, বাইরে নয়। তবু নৈতিকতার মৌল নীতিসমূহ সঠিক, নির্দিষ্ট ও সুদৃঢ় হওয়া আবশ্যক। কেননা আল্লাহ তো-
(আরবী*******************************************************************************)
জানেন সব গোপন ও প্রচ্ছন্নতম ব্যাপারও। (সূরা ত্ব-হাঃ ৭)
(আরবী******************************************************************************)
তিনি জানেন দৃষ্টির বিশ্বাসঘাতকতাকেও এবং অন্তর যা লুকিয়ে রাখে তাও।
(সূরা মুমিনঃ ১৯)
অতএব আল্লাহ মানুষের যতটা জানেন ততটার মধ্যে মানুষের উচিত পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও গুণাহমুক্ত হওয়া। তাতে মানুষের সব গোপন ও প্রচ্ছন্নই সম্পূর্ণরূপে শামিল। এই কারণে ইসলামের নিতান্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক কোনো চতির্র সমর্থিত নয়; এমন চরিত্র যে, একজন ব্যক্তির সাথে এক রকমের আচরণ গ্রহণ করা হবে আর অন্যান্য মানুষের সাথে ভিন্নতর আচরণ অবলম্বন করা হবে। কেননা ইষলামে এটা সুস্পষ্ট মুনাফিকী ছাড়া আর কিছুই নয়।
সে যাই হোক দুনিয়ার মানুষ প্রাচীনতম কাল থেকেই যৌনতার সাথে চরিত্রের নিবিড় সম্পর্কের কথা স্বীকার করে এসেছে, এটা হঠাৎ করে ঘরে যাওয়া কোনো ব্যাপার নয়। এমনকি ব্যাপার এতদূর গড়িয়ে ছিল যে, তারা মনে করত, বিশেষভাবে যৌনতার নৈতিকতাই হচ্ছে একমাত্র নৈতিকতা। তাই বলছিলাম, এটা কোনো নতুন ব্যাপার নয়। যদিও এই সংকীর্ণ বেষ্টনীর মধ্যে নৈতিকতাকে সীমাবদ্ধ করে তারা সঠিক কাজ করেনি। কেননা তরা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় জানতে পেরেছিল যে, যৌন ব্যাপারে মানুষ বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত হলে নৈতিকতা তার ব্যাপক তাৎপর্যসহ টিকে থাকতে পারবে না। আর যে লোক যৌন ব্যাপারে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়, দীর্ঘমেয়াদী তার কোনো চরিত্রই থাকতে পারবে না।
এই বিষয়টি নিয়ে আধুনিক জাহিলিয়াত একটা রূঢ় ঝগড়ার সৃষ্টি করে বসেছে। তার কথা হচ্ছে, সাধারণভাবে যৌনতার সাথে নৈতিকতার আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। যৌনতার ক্ষেত্রে মানুষ যা ইচ্ছা হয় তা-ই করতে পারে। এটা করেও তারা চরিত্রের বড় বড় সংরক্ষক হওয়ার গৌরবও করতে পারে।
পূর্বে আমরা আমাদের মতামত জাহিলিয়াত পর্যায়ের আলোচনায় পেশ করেছি। আমরা দেখেছি, মানুষ যখন লালসার গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে গেয়ে বিপথগামী হয়, তখন আল্লাহর নিয়ম এক চূড়ান্ত অনিবার্যতা সহকারে কার্যকর হয়।
এখানে আমরা ইসলাম সম্পর্কে কথা বলব। জাহিলিয়াতের সাথে একটি তুলনামূলক আলোচনা উপস্থাপিত করাই আমাদের ইচ্ছা। এবং এই দৃষ্টিকোণ দিয়ে আমরা যৌন বিষয়ে বক্তব্য পেশ করব। জনগণ অভ্যাসবশত নিতান্ত সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণ দিয়ে ‘নৈতিক চরিত্র’ বাক্যটি ব্যবহার করে আমরা সে সংকীর্ণ দৃষ্টিতে এখানে কোনো কথা বলতে চাইনে।
আমরা ইসলামের ধারণানুযায়ী ব্যাপক অর্থে নৈতিকতা সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করছি। কেননা ইসলামের দৃষ্টিতে নৈতিকতার সংকীর্ণ কোনো অর্থ নেই। ইসলামী নৈতিকতার তাৎপর্য সমগ্র মানবীয় সত্তাকে শামিল করে। যার দরুন এই চরিত্রের কারণে একজন মানুষ অপর জন থেকে স্বতন্ত্র প্রতিভাত হয়, পাশবিকতার স্তর থেকেও অনেক ঊর্ধ্বে তার অবস্থান প্রমাণিত হয়।
যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা –জিনা –সংকীর্ণ তাৎপর্যের নৈতিক নিয়মাদির বিপরীত। শুধু এই কারণেই ইসলাম জিনাকে হারাম ঘোষণা করেনি। বরং তা মানুষ উপযোগী মান থেকেও অত্যন্ত নীচ ও হীন কাজ বলেও ইসলাম তাকে হারাম ঘোষণা করেছে। নৈতিক চরিত্রের সংকীর্ণ ধারণা ও ব্যাপক পূর্ণাঙ্গ ধারণার মধ্যে এটাই হচ্ছে পার্থক্য।
মানুষ আল্লাহর খলীফা। তারা আল্লাহর অর্পিত আমানত ধারণ করেছে, অথচ আসমা-জমিন-পাহাড় সবই তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। কেননা সে আমানত গ্রহণ করতে তারা সাংঘাতিকভাবে ভয় পেয়েছিল তাদের পক্ষে তার বোঝা বহন করা সম্ভব নয় বলে।
খলীফা হিসেবে মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে পৃথিবীকে আবাদ করা, আদর্শভিত্তিক খিলাফত যথাযথভাবে কায়েম করা, সত্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত করা। আদর্শানুসারী রাজনীতি, সুষ্ঠু অর্থ ব্যবস্থা ও আদর্শভিত্তিক মানবসমাজ গড়ে তোলা মানুষেরই দায়িত্ব। এই সমস্ত কাজের জন্যে জিহাদ করার দায়িত্ব মানুষের ওপরই অর্পিত। কেননা উপরোক্ত কাজগুলো জিহাদ ছাড়া কিছুতেই সম্পন্ন করা যেতে পারে না।
এ-ই হচ্ছে মানুষের পরিচয়। এই মানুষ যদি যৌনতার কলংকময় গহবরে পড়ে যায়, তা হলে পৃথিবীর অবস্থা কি দাঁড়াবে?
খিলাফতে রাশেদা কায়েম করা তাঁর দ্বারা কি করে সম্ভব হবে, সেজন্যে জিহাদই বা হবে কি করে?
মানুষকে এই দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে যে, তাকে তার ও জন্তু-জানোয়ারের মধ্যে বাস্তব পার্থক্য সৃষ্টি করতে হবে। যৌনতার গহবরে ডুবে গেলে সে পার্থক্য থাকবে কোথায়, সে-ও তো ঠিক পাশবিকতার হীন নীচ পর্যায়ে নেমে যাবে। অথচ আল্লাহ তাকে অনেক ঊর্ধ্বে ওঠার শক্তি-সামর্থ্য ও যোগ্যতা-প্রতিভা দান করেছেন।
এই মানুষ যদি তার আসল দায়িত্বের কথা ভুলে যায়, তা পালন না করে, পাশবিকতার ঊর্ধ্বে ওঠার শক্তি-সামর্থকে সে যদি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়, তা হলে নৈতিকতার ইসলাম উপস্থাপিত সেই ব্যাপক তাৎপর্যের পরিণতি কি হবে?
মানুষ যদি লালসার দাসত্ব করতে গিয়ে জ্বলে-পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়, তা হলে তার চরিত্র বলতে কিছু অবশিষ্ট থাকবে কি? সে লালসা তো চির অতৃপ্ত, কোনো দিনই তার পূর্ণ মাত্রার চরিতার্থতা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। বরং তার ফলে একদিকে তার বৃহত্তম মানবীয় শক্তির মর্মান্তিক অপচয় হবে তার পাশবিক তৎপরতার পরিণতিতে। সে তখন মানে নেমে যাবে যা কেবল জন্তু-জানোয়ারের জন্যেই শোভন হতে পারে। তার ইচ্ছাশক্তির বিশেষত্বও নিঃশেষ হয়ে যাবে, অথচ আল্লাহ তা’আলা তার সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে কেবল মানুষকেই এই গুণে গুণান্বিত করেছেন। এমন কি, শেষ পর্যন্ত সাধারণ জন্তু-জানোয়ারের যে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক নিয়মতন্ত্র রয়েছে সেটুকু রক্ষা করাও তার পক্ষে সম্ভব হবে না। ফলে মানুষ জন্তু-জানোয়ারেরও নীচে চলে যাবে।
ইসলাম জিনাকে হারাম করেছে, কেননা ইসলাম চায় মানুষের ইজ্জত। চায় আল্লাহর খলীফা হওয়ার অতীব উচ্চ ও মহান সম্মানার্হ মর্যাদায় মানুষকে অভিষিক্ত দেখতে।
হারাম কাজের প্রতি লালসা ও ঝোঁক, কেবল এই হিসেবেই জিনাকে হারাম করা হয়নি। বান্দাগণের জীবনকে সংকীর্ণ ও কষ্টের মধ্যে ফেলে দেওয়াও এই হারাম করণের উদ্দেশ্য নয়। কেননা আল্লাহ মানুষের প্রতি এই ধরনের আচরণ করেন না। তিনি নিজেই বলেছেনঃ
(আরবী*********************************************************************)
সেই আল্লাহই তোমাদেরকে বাছাই করে পছন্দ করেছেন এবং দ্বীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের ওপর কোনো সংকীর্ণতা চাপিয়ে দেননি। (সূরা হজ্জঃ ৭৮)
(আরবী***************************************************************************)
আল্লাহ তোমাদের ওপর কোনো সংকীর্ণতা চাপিয়ে দিতে চান না। বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান, চান যেন তাঁর নেয়ামত তিনি তোমাদের প্রতি পূর্ণ করতে পারেন। এবং তোমরা যেমন শোকর করো। (সূরা মায়িদাঃ ৬)
(আরবী************************************************************************************)
আল্লাহ তোমাদের প্রতি প্রত্যাবর্তন (রহমত দান) করতে চান। পক্ষান্তরে লালসা-কামনার অনুসারীরা চায় যে, তোমরা খুব বেশী করে অন্যদিকে ঝুঁকে পড়। আল্লাহ চান তোমাদের বোঝা হালকা করে দিতে। আর মানুষকে তো দুর্বল সৃষ্টি করা হয়েছে। (সূরা আন-নিসাঃ ২৭-২৮)
(আরবী**********************************************************************)
আল্লাহ কোনো লোকের ওপর তার সামর্থ্যের অতিরিক্ত কোনো কাজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না। (সূরা বাকারাঃ ২৮৬)
(আরবী*************************************************************************)
তোমরা যদি শোকর করো ও ঈমান আনো, তাহলে তোমাদেরকে আযাব দিয়ে আল্লাহর কিছুই করার নেই। আল্লাহ তো শোকর কবুলকারী মহা বিজ্ঞ।
(সূরা আন-নিসাঃ ১৪৭)
না, আল্লাহ মানুষের জীবনে সংকীর্ণতা বা অচলাবস্থার সৃষ্টি করতে চান বলে যেনা-ব্যভিচার হারাম করেন নি। আল্লাহ তো মানুষকে পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও দোষ-ত্রুটিমুক্ত সত্তারূপে গড়ে তুলতে চান, তাদেরকে সত্যিকার মানবীয় মানে উন্নীত করে রাখতে চান। কেননা আল্লাহ তো মানুষকে উন্নত মানের সৃষ্টিরূপে গণ্য করেছেন, তাকে সম্মানিত করেছেন, তাঁর বহু সংখ্যক সৃষ্টির ওপর তাকে প্রাধান্য ও বিশিষ্টতা দান করেছেন।
(আরবী*******************************************************)
আর সত্য সত্যই আদম সন্তানকে আমরা অতীব সম্মানিত করেছি এবং তাদের বহন করে নিয়ে গেছি স্থলভাগে এবং তাদের পবিত্র রিযিক দিয়েছি। আর তাদেরকে খুব বেশী মাত্রায় উচ্চ মর্যাদা দিয়েছি আমাদের বহু সংখ্যক সৃষ্টির তুলনায়। মানুষতে তার প্রথম সৃষ্টি মুহুর্তে তাকে স্বতন্ত্র ও একক মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ৭০)
(আরবী********************************************************************************)
স্মরণ করো, তোমার সৃষ্টিকর্তা-প্রতিপালক যখন ফেরেশতাদের বললেন, আমি মৃত্তিকাসার থেকে একজন মানুষ সৃষ্টিকারী। আমি যখন তাকে সৃষ্টি করার পর সম্পূর্ণ ঠিকঠাক ও ভারসাম্যপূর্ণ দেহসত্তা বানিয়ে দিলাম তখন আমার রূহ-এর থেকে ফুঁকে দিলাম। পরে ফেরেশতারা তার উদ্দেশ্যে সিজদায় পড়ে গেল।
(সূরা ছোয়াদঃ ৭১-৭২)
অথাৎ মানব দেহ মৃত্তিকা নির্যাস ও রূহ –এই দুই জিনিসের সমন্বয়ে গঠিত। এই সমন্বিত স্বাভাবিক সত্তাই হচ্ছে মানুষ। ফলে সে স্বাভাবিক সুস্থ ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় নিয়ম-শৃঙ্খলাহীন লালসা বৃত্তি চরিতার্থতায় কখনোই মগ্ন হতে পারে না। অপরদিকে দৈহিক চাহিদা পূরণ অপেক্ষা করে কেবলমাত্র রূহ-এর দাবি মেটানোর কাজে মগ্ন হওয়াও এর পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা সমন্বয়ের উপাদান দ্বয়ের কোনো একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির অস্তিত্ব ও মার্যকরতা এই দুনিয়ায় কখনোই সম্ভব নয়। বাঞ্ছনীয়ও নয়।
বরং এই জগতে তার সকল কাজে-কর্মেই এই উভয় মৌল উপাদানের সমন্বিত রূপ-ই দেখা যাবে। যৌনতার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম অকল্পনীয়।
ইসলাম নৈতিকতাকে মানব জীবনের সকল কাজে সম্প্রসারিত করেছে, যৌনতাকেও তার আওতার মধ্যে শামিল করে নিয়েছে। মানুষের সমন্বিত সত্তার প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল এই ব্যবস্থা। কেননা মানবীয় প্রকৃতি সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ম শৃঙ্খলামুক্ত যৌন-লালসা চরিতার্থতার পন্থাকে কখনোই বরদাশত করতে প্রস্তুত হয় না। পক্ষান্তরে দেহের স্বাভাবিক দাবিকে অস্বীকার করে কেবলমাত্র রূহ সর্বস্ব হয়ে থাকাও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক পরিপন্থী ব্যাপার।
ইসলামে নৈতিকতা স্বতঃস্ফুর্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ও কার্যকর হতে পারার মত কোনো বিধান নয়। মানুষের মৌল সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হলে তার কোনো মূল্য বা ব্যবহারিকতা তাকে না। তার নিজ সত্তার বাইরে থেকে জোরপূর্বক ও ক্ষমতার দাপটের বিহবলতায় তা প্রতিষ্ঠিত ও কার্যকর করতে চাইলে তা যথার্থভাবে কাজ করতে পারে না। মূলত তা মানুষের নিজের সুস্থ-স্বভাবসম্মত প্রকৃতির বিধান। মানব প্রকৃতির স্বতঃস্ফুর্ত দাবি হচ্ছে মানুষের প্রকৃতি স্বতঃই তাকে শক্তিশালী করে, তার নিজের ছাড়া বাইরের অপর কোনো জিনিসের প্রকৃতির চাপে তা চলতে পারে না।
ফেরেশতাদের চরিত্র, জীব-জন্তুর চরিত্র, ফেরেশতা ও জীবন জন্তুর সাথে জড়িত (অবশ্য তাদের ব্যাপারে ‘চরিত্র’ শব্দটি পরোক্ষভাবেও যদি ব্যবহার করা চলে) তা সম্পূর্ণ ভিন্নতর জিনিস। মানবীয় চরিত্রের সাথে তার কোথাও কোনো দিক দিয়েও একবিন্দু মিল নেই। চরিত্র প্রতিটি সৃষ্টির নিজস্ব ও অবিচ্ছিন্ন প্রকৃতি থেকেই উৎসারিত হয়ে থাকে। মানুষের চরিত্রও ঠিক তাই।
ফেরেশতারা আল্লাহর একটি বিশেষ সৃষ্টি। তাদের ইচ্ছা ও নিজস্ব হৃদয়াবেগ ও উচ্ছ্বাস বলতে কিছুই নেই। তাদের চরিত্রও ঠিক তাদের স্বাভাবিক প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল।
(আরবী**********************************************************************)
আল্লাহ তাদের যে আদেশ করেন তারা তা কখনোই অমান্য করে না এবং যাই করতে বলা হয়, তাই তারা করে। (সূরা তাহরীমঃ ৬)
(আরবী***********************************************************)
তারা রাত-দিন তাসববীহ করে, কোনো সময়ই তা বাদ দেয় না। (সূরা আম্বিয়াঃ ২০)
জন্তু-জানোয়ারও আল্লাহ তা’আলার এমন একটি সৃষ্টি, যারা স্বাভাবিক ঝোঁক প্রবণতার মধ্যেই পরিবেষ্টিত। নিজস্ব ইচ্ছা বলতে তাদের কিছু নেই। ওরা দৈহিক প্রবণতার তাগিদেই চলে। ওদের চিন্তা-ভাবনা করার কোনো ক্ষমতা নেই, ওদের সাধারণ কাজে-কর্মে তার কোনো প্রয়োজনও দেখা দেয় না।
মানুষও আল্লাহরই এক বিশেষ সৃষ্টি যপার অভ্যন্তরীণ স্বভাবগত তাগিদ আছে, আছে তার বাস্তবায়নের জন্যে নিয়ম-কানুনও। তা তার মাটির নির্যাস ও ফুঁকে দেওয়া রূহ-এর সংমিশ্রণে গঠিত সমন্বিত প্রকৃতি নিঃসৃত। সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় তাদের চরিত্র প্রকৃতির দাবিতে সাড়া দেয় বটে তবে তা তাদের সাধ্যানুযায়ী। তাদর প্রকৃতি নিহিত অবস্থাগত ইচ্ছার নিয়মাবলী তাকে বাধাগ্রস্ত করে। তার কার্যাবলী দৈহিক তাগিদে হওয়া সত্ত্বেও রূহ-এর প্রভাব থেকে কখনোই মুক্ত থাকে না।
এই কারণে মানুষের কার্যাবলী কখনোই নিয়ম-শৃঙ্খলা ব্যতীত সম্পন্ন হতে পারে না, অনিবার্য লক্ষ্য ছাড়াও হয় না তার কোনো কাজ এবং জীব-জন্তুর মতো নিছক তীব্র দৈহিক দাবিতেই মানুষের কোনো কাজ সম্পন্ন হতে পারে না।
মানুষের ক্ষেত্রে তার চরিত্র সর্বাত্মক, সর্বব্যাপক। তার কোনো একটি কাজও তার যৌনতাও –চরিত্র মুক্ত হয় না। তার অর্থ, তার চরিত্র হচ্ছে স্বভাব-প্রকৃতির দাবি নিয়ম-তন্ত্রের মধ্যে সংযত অবস্থা, সুস্পষ্ট ও অনুভবযোগ্য লক্ষ্য সহকারে এবং মাটির নির্যাসের তাগিদ মিশ্রিত রূহ-এর প্রবণতা রক্ষা সহকারে।
তাই মানুষের বেলায় যৌন-চরিত্র তার জীবনের অন্যান্য যাবতীয় কর্মের চরিত্রের মতোই। রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজ ইত্যাদি কোনো একটাও তার বাইরে থাকতে পারে না। মানুষ নিছক লালসার বশবর্তী হয়েই যৌন প্রবৃত্তির ডাকে সাড়া দিতে পারে না, তার সাথে প্রেম-ভালোবাসাও মিশ্রিত থাকে। নিছক যৌন-লালসা চরিতার্থ করাও তার একক লক্ষ্য হয় না, যার জন্যে মানুষ পাগলের ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাহলে লক্ষ্য অর্জনের উপায়। তবে তা-ও নিয়ম-প্রণালী ছাড়া হতে পারে না। এই নিয়ম-প্রণালীই তাকে এমনভাবে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করে যে, তাতে ব্যক্তির ধ্বংস ডেকে আনা হয় না, সমাজ সমষ্টির জন্যেও তা হয় না বিপর্যয়কারী।
ফল কথা, মানব জীবনের সকল দিকে ও সকল ক্ষেত্রেই নৈতিকতার ব্যাপক প্রতিপত্তি অনিবার্য। খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান, ধন-সম্পত্তির মালিকানা, দেশ শাসনের ক্ষমতা, যুদ্ধ ও প্রদর্শনী কোনো কিছুই চরিত্রের আওতা-বহির্ভূত নয়।
আর এই সর্বাত্মক চরিত্র রক্ষা করেই মানুষ মানুষ হয়, মানুষ থাকতে পারে। তা ব্যতিরেকে মানুষ নিকৃষ্টতম জীব মাত্র, জন্তু-জানোয়ারের অপেক্ষাও হীন ও নীচ।
(আরবী*****************************************************)
এই মানুষদের হৃদয় আছে; কিন্তু তাকে অনুধাবনের কাজে লাগায় না। ওদের চক্ষু আছে; কিন্তু কিন্তু তদ্দারা দেখার কাজ করে না। ওদের কর্ণ আছে, কিন্তু তার দ্বারা শ্রবণের কাজ করে না। ওরা ঠিক জন্তু-জানোয়ারেরই মতো। বরং তাদের চাইতেও অধিক ভ্রষ্ট। ওরা আসলে অজ্ঞতা-অচেতনতার মধ্যে হারিয়ে গেছে।
(সূরা আরাফঃ ১৭৯)
এই ব্যাপকভিত্তিক নৈতিকতায় যৌনতার কোনো বিশেষ ধরনের নিয়ম প্রণালীর প্রয়োজন পড়ে না। মানুষের অন্যান্য যাবতীয় কর্মতৎপরতায় যেমন, এক্ষেত্রেও ঠিক তেমনি। ইসলাম এভাবেই যৌন সমস্যার সমাধান করেছে –এ প্রেক্ষিতেই ইসলাম মানুষের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা নিয়েছে।
ইসলাম যৌনতা নিঃশর্তে ও সাধারণভাবে হারাম করেনি। তাকে ঘৃণ্য পরিতাজ্য রূপেও গণ্য করেনি। ইসলাম তাকে কোনো হীনতা নীচ বা জঘন্য জিনিস বলেও মনে করে না। মানবীয় চেতনাকে তার প্রতি বিদ্বেষ পোষন করতেও বলে না। হিন্দু সমাজে এবং গির্জা বিরচিত খ্রিষ্টীয় মতে যৌনতা ঘৃণ্য হলেও তার বিধি-নিষেধ মুক্ত ব্যবহার মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব করেছে। তা সম্পূর্ণরূপে বিকৃত ধারণ ও মানসিকতার ফলশ্রুতি। বাহ্যত দেহকে কোণঠাসা করেই এক ধরনের পবিত্রতা ও উৎকর্ষ লাভের চেষ্টা চালায়, তার প্রতি ঘৃণাও প্রকাশ করে।
কিন্তু ইসলামে তা নির্দোষ। মানুষের প্রকৃতিগত সব দাবি ও জৈবিক কাজকর্ম সবই মূলত দোষমুক্ত, অঘৃণ্য।
তবে ইসলাম তাকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন করে। সুসংবদ্ধ করে। তাকে সুসংবদ্ধ করার জন্যে প্রয়োজনীয় নিয়ম-বিধানও তৈরি করেছে। তা অনিষিদ্ধ থাকা পরিবেষ্টনীতেও এই নিয়মতন্ত্র কার্যকর। তার অনিষিদ্ধতা ও নিষিদ্ধতা দুটোই বাহ্যিক সীমারেখা। এই সীমারেখা ধ্বংস থেকে রক্ষা করে। কিন্তু তা যৌন সম্পর্খের সার্বিক নৈতিকতা নয়, তা মানুষের জন্যে জরুরী। বৈধ ও অবৈধ –নিষিদ্ধ ও অনিষিদ্ধ –এর মধ্যে পার্থক্যকারী সীমারেখা শুধু যৌনতার ক্ষেত্রেই নয়, পানাহারের ক্ষেত্রেও পরিব্যাপ্ত।
রক্ত, লাশ, শূকর ও অ-আল্লাহর নামে যবাই করা জন্তু হালাল নয়, হারাম। এ ছাড়াও অন্য সব জিনিসই সাধারণভাবে ও নিঃশর্তে জায়েয নয়। কেননা খাদ্য নিশ্চয়ই চুরি করা, লুটে নেওয়া ও অপচয় পর্যায়ের না হওয়া একান্ত জরুরী।
(আরবী*********************************************************************************)
তোমাদেরকে আমাদের দেওয়া পবিত্র রিযিক তোমরা খাও। (সূরা আরাফঃ ১৬০)
(আরবী******************************************************************)
তোমরা খাও, পান করো, কিন্তু অপচয় করোনা। (সূরা আরাফঃ ৩১)
এই খাদ্য গ্রহণের কতগুলো নিয়ম-নীতি অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। কেননা মানুষ যেসব পাত্র ভর্তি করে, তার মধ্যে পেট-ই হচ্ছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ধরনের পাত্র। মানুষের জন্যে মাত্র কয়েক মুঠো খাবারের প্রয়োজন, যাতে তার মেরুদণ্ড সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে।–[(আরবী*************************)]
হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিতঃ
(আরবী*******************************************************************************)
নবী করীম (স) পানপাত্র বা খাদ্যপাত্রে শ্বাস ছাড়তে বা ফুঁ দিতে নিষেধ করেছেন।
এভাবে খাদ্য শ্বাস-প্রশ্বাসের মলিনতা থেকে মুক্ত ও পবিত্র হয়ে ওঠে এবং তা এমন জীবন্ত কাজ হয়ে যায় যা মানুষের উপযোগী। তাতে একই সময় তার দেহ ও রূহ উভয়ই সম্মিলিত হয়ে দাঁড়ায়।
যৌনতাও এমনিই। মানব জীবনের কোনো কিছুই উক্ত নিয়মের বাইরে নয়।
ফলে যৌনতার মধ্যেও কিছু বিধি-নিষেধ আছেঃ
(আরবী****************************************************************)
তোমাদের প্রতি হারাম করা হয়েছে তোমাদের মা’দের, তোমাদের কন্যাদের, তোমাদের বোনদের, তোমাদের ফুফুদের, তোমাদের খালাদের এবং ভাই ও বোনের কন্যাদের …..আর বিবাহিতা অবস্থায় থাকা মেয়েদের। (সূরা আন-নিসাঃ ২৩-২৪)
এ ছাড়া অবশিষ্ট সব মেয়েরাই মুবাহ অ-নিষিদ্ধ। কিন্তু তাও শর্তহীনভাবে নয়। এই পর্যায়ে এমন সব কারণকে তুলে ধরা হয়েছে যা যৌনতাকে পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও উন্নতমানের করে দেয়। তা বিজয়ী ও প্রভাবশালী দৈহিক তাড়নাকে নিছক নৈদিক লালসা হওয়া থেকে মুক্ত রাখে।
(আরবী****************************************************************************)
হে নবী! লোকেরা তোমাকে ঋতুবতী মেয়েলোক সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে, তুমি বলে দাও, তা একটি নষ্ট-অপবিত্রতা, তাই হায়েজ অবস্থায় স্ত্রীর (সঙ্গম) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকো। তাদের নৈকট্য নিও না যতক্ষন তারা পবিত্র না হচ্ছে। পরে তারা যখন পুরো মাত্রায় ভালো হয়ে যাবে, তখন তোমরা তাদের কাছে আসো, যেখান থেকে যাওয়ার অনুমতি আল্লাহ তোমাদের দিয়েছেন। কেননা আল্লাহ তওবাকারী লোকদের ভালোবাসেন, সেই সাথে ভালোবাসেন পবিত্র রক্ষাকারীদেরও। (সূরা বাকারাঃ ২২২)
সেই সাথে সেসব কথাবার্তাও স্মরণীয়, যা অনুভুতির তীব্রতাকে হ্রাস করে। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা) নবী করীম (স) থেকে এই পর্যায়ের বেশ কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। এই হাদীসসমূহ উপরোক্ত কথাকে অধিকতর তাগিদপূর্ণ করে দেয়।
পরে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, যৌন সম্পর্ক স্থাপন ও সঙ্গম কার্যের একটা বিশেষ ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য রয়েছেঃ
(আরবী********************************************)
তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের ফসল উৎপাদনের ক্ষেত বিশেষ।
এরূপ কথা বলে আসলে আল্লাহ বুঝিয়েছেন, ক্ষেতে চাষ করে যেমন বীজ বপন করা হয়, স্ত্রী সঙ্গমেও বীজ বপন লক্ষ্য থাকতে হবে ও তা থেকে সন্তান উৎপাদন চাইতে হবে। অর্থাৎ বৈধভাবে সন্তান উৎপাদন ও বংশের ধারা রক্ষা এই কার্যক্রমের মাধ্যমেই চালু রাখতে হবে।
পরে আল্লাহ-ও জানিয়েছেন যে, যৌন সঙ্গম নিছক একটা দৈহিক কর্মই নয়; বরং তার সাথে অবশ্যই যুক্ত থাকতে হবে আনুভূতিক, আত্মিক ও প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক।
(আরবী*******************************************************************)
আল্লাহর অনুগ্রহ অস্তিত্বের একটি অন্যকতম নিদর্শন হচ্ছে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই জুড়ি বানিয়েছেন, যেন তোমরা সেই জুড়ির কাছে মনের গভীর প্রশান্তি লাভ করো। তিনি তোমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব-প্রীতি-ভালোবাসা ও দয়া-সহমর্মিতার ভাবধারা সৃষ্টি করেছেন। (সূরা রূমঃ ২১)
মানবীয় উত্থানের এই উন্নত ও উচ্চতর পর্যায়ে যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা এমন একটা কাজ হয়ে যায়, যা মনুষ্যত্বের মান থেকে সবদিকের বিচারেই অত্যন্ত নীচ ও হীন হয়ে পড়ে। মানুষের কোনো গুণের এক বিন্দু সমর্থন সে কাজে পাওয়া যায় না, না রূহ-এর আলো, না সংযম শক্তি, না উদ্দেশ্যের চিন্তা, না সমাজের আদর্শভিত্তিক খিলাফতের সীমার মধ্যে রূপায়ণ, যা আল্লাহ তা’আলা মানুষের জন্যে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
এসব কারণে ইসলাম যেনা-ব্যভিচারকে হারাম করেছে। হারাম করেছে, কেননা সে কাজ আল্লাহর খলীফার জন্যে শোভা পায় না। মানুষের ওপর সংকীর্ণথা ও অসুবিধা চাপিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই কাজ করেনি। সেই সাথে যে-সব কাজ বা ব্যবস্থাপনা ব্যভিচারকে সহজ করে দেয়, তাকে লোভনীয় বা অধিকতর চাকচিক্যময়, আকর্ষণীয় বানিয়ে দেয়, মানুষকে সেদিকে ঠেলে দেয়, সেইসব কাজ ও ব্যবস্থাপনাও সম্পূর্ণ হারাম। এই কারণে পুরুষ নারীর পাগল করে দেওয়া, মিল-মিশ ও অপ্রয়োজনীয় দেখা-সাক্ষাৎ, যোগাযোগ ইত্যাদিও হারাম। উলঙ্গ-অবাধ চলাফেরা নারী-পুরুষ উভয়কেই এই বিপদে নিক্ষেপ করে। গায়র-মুহাররম পুরুষের সম্মুখে নারীদেহ ও দেহ-সংলগ্ন অলংকারাদি প্রদর্শনও এই জন্যে হারাম।
এই কারণে লালসা পংকিল দৃষ্টিদান ও নির্লজ্জ কথাবার্তাও নিষিদ্ধ। এ কারণে জেনা-ব্যভিচার কার্যত করা তো আরও বেশি করে নিষিদ্ধ হবে অতি স্বাভাবিকভাবে।
নারী-পুরুষের যৌন মিলনের একটি মাত্র পথই উন্মুক্ত রয়েছে, তা হচ্ছে বিবাহ। এই পথটাই পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও নির্দোষ।
আমার লিখিত গ্রন্থে-[(আরবী***************) গ্রন্থের (আরবী***********) অধ্যায় এবং (আরবী************) এবং (আরবী************************) গ্রন্থগুলো দ্রষ্টব্য।] একটি কিংবদন্তী উদ্ধৃত করেছি। উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, এতটা পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নত বর্তমান পরিবর্তনশীল জীবনে কি করে সম্ভব? কেননা বর্তমানে তো মানুষ বিংশ শতাব্দীর আলোকোজ্জ্বল সময়ে জীবন যাপন করছে।
এটা সত্যিই কিংবদন্তী। একটি ভিত্তিহীন কথা। ইসলামের উপরোদ্ধৃ উন্নত মানের মানবিক আদর্শ সব সময় এবং চিরকালই মানুষের পক্ষে পালন করা সম্ভব। সম্ভব যদি মানুষ মানুষের স্তরে থাকে। পশুর স্তরে পৌঁছে গেলে তো সম্ভব নয়, তা বলাই বাহুল্য।
একালে যেসব অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন ও চাহিদার দোহাই দেওয়া হয়, তা নিতান্তই অর্থহীন কথা। আধুনিক জাহিলিয়াতই তা মানুষকে দৈহিক স্বাদ আস্বাদন ও যৌন-লালসার গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসিয়ে দেওয়া। এটাই হচ্ছে সেই আল্লাহদ্রোহিতা, যা মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে তাদের দাসানুদাস বানায়।
ও যে সত্যিই অর্থনৈতিক ও সামাজিক নয়, তার অকাট্য প্রমাণ হচ্ছে, সর্বগ্রাসী সমাজবাদী রাষ্ট্র রাশিয়াও ব্যক্তিগণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তাদের পানাহার, বাসস্থান ও বস্ত্রের ব্যবস্থা করেছে, সেই সাথে বিবাহের দায়িত্ব নেওয়া যেত। তাহলে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাই বা হবে কেন এবং জিনা-ব্যভিচারের ঘটনাই বা ঘটবে কোন কারণে?
কিন্তু রাশিয়া অন্যান্য কাজ করলেও বিবাহের দায়িত্ব নেয়নি। বরং সেখানেও নারী-পুরুষ কোনোরূপ অর্থনৈতিক প্রয়োজন ব্যতিরেকেই জন্তু-জানোয়ারের মতোই মেলামেশা ও ঢলাঢলি করে চলছে। সরকার সেজন্যে তাদের বিরাট ও ব্যাপকভাবে উৎসাহ যোগচ্ছে, সুযোগ করে দিয়েছে এবং কোনোরূপ নিয়ম-শৃঙ্খলা ব্যতীতই পুরুষ-নারী যৌন-সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছে।
এটা জাহিলিয়াত ছাড়া আর কিছু নয়। এ জাহিলিয়াত নৈতিকতার সব সীমা লংঘন করেছে। তা মানুষকে জন্তু-জানোয়ারের মতো যৌন লালসার প্লাবনে ভেসে বেড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। দিয়েছে এই জন্যে যে, মানুষ যেন আত্মসম্বিত হারিয়ে ফেলে তাগুতী শক্তির দাসানুদাস হয়ে থাকতে স্বতঃই বাধ্য হয়।
কিন্তু ইসলাম যৌন উচ্ছৃঙ্খলতার পথে প্রবল ও দূরতিক্রম্য বাধার সৃষ্টি করেছে। কেবল এই ক্ষেত্রেই তো নয়, প্রত্যেক স্বভাবগত প্রবৃত্তির যথেচ্ছা চরিতার্থতার পথেই ইসলাম বাধার প্রাচীর দাঁঢ় করিয়েছে। এই পথ বাধাগ্রস্ত করে দিয়ে অবাধ ও উন্মুক্ত করে দিয়েছে বৈধ ও পবিত্র পথ। যেন মানুষ এই পবিত্র পরিচ্ছন্ন পথেই স্বীয় স্বাভাবিক যৌন-প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করতে পারে এবং তাতে মানবীয় উচ্চতর মর্যাদা রক্ষা পায়, এক বিন্দু নৈতিক পতনের কারণ না ঘটে।
ইসলাম বিবাহকে সহজ করে দিয়েছে। সেজন্যে বিপুল উৎসাহ যুগিয়েছে –অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে, চিন্তাগত ও আধ্যাত্মিকভাবে সর্বোপরি নৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ দিয়ে। ইসলাম বিয়েকে একটি ইবাদত গণ্য করেছে। এর মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারে।
এই কারণে ইসলাম একসাথে কয়েকটি বিষয়ের নিরাপত্তা দিয়েছে। মানুষের মন-মানসিকতা ও স্নায়ুমণ্ডলির পরম শান্তি ও সুস্থতার নিরাপত্তা দিয়েছে। প্রবল স্বভাবগত দাবিকে দমন করলে যে স্নায়ুবিক অসুস্থতা দেখা দেওয়া অনিবার্য, ইসলাম তার পক্ষপাতী নয়। ইসলামের এই চেষ্টা চিরন্তন যে, সমাজকে অবশ্যই পবিত্র ও নিষ্কলুষ রাখতে হবে। এমন অবস্থার সৃষ্টি যেন না হয় যে, লোকেরা ধৈর্য্য-সহ্যের সীমা লংঘন করে বিদ্রোহ করে বসবে। বরং ইসলাম বিয়ের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে তাতে একটা নিয়মতন্ত্র অনুসরণ করাকে জরুরী মনে করে। এটা মন-মানসিকতার সুস্থতা ও প্রশান্তির জন্যে একান্তই সহায়ক। নির্ঝঞ্ঝাট নির্বিঘ্ন ও স্থিতিশীল জীবন ও সমাজও ইসলামের কাম্য। অবশ্য ইতিপূর্বে অল-ডেড-র্যান্টের উক্তি উদ্ধৃত করে আমরা দেখিয়েছি যে, আধুনিক জাহিলিয়াত মানবতাকে চরম স্নায়ুবিক, মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক বিপর্যয় ও চরম অশান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
ইসলাব বিবাহিত ও দাম্পত্য জীবনের নিরাপত্তা দেয়। পূর্বে আমরা দেখেছি, পাশ্চাত্য নৈতিকতার বন্ধন খুলে গেছে। ফলে দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনের সব ভিত্তিই নড়ে গেছে। পুরুষ ও নারীর পথহারা আশ্রয়হারা পঙ্গপালের মতো যত্রতত্র ঘুরে ও মধুপান করে বেড়াচ্ছে।
মানব সন্তান যাতে করে স্নেহ-বাৎসল্যের পরম-প্রশান্ত ক্রোড়ে লালিত পালিত হতে পারে, ইসলাম তারও ব্যবস্থা করেছে। সকল প্রকারের বিপর্যয় ও অশান্তি থেকে দূরে থাকার জন্যে এই ক্রোড় শিশুদের অতিবড় আশ্রয়।
ইসলাম যখন মানুষকে মনুষ্যত্বের উচ্চতর উন্নততর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে, তখন এই মর্যাদা রক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় যাবতীয় ব্যবস্থাপনা পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করে, তার পরিপূরণের উপায় ও পন্থারও নির্দেশ করে।
শিল্পকলা ও সংস্কৃতিও আল্লাহ প্রদর্শিত পথে ও আদর্শে গড়ে তোলা একান্তই আবশ্যক। আমার লিখিত ‘ইসলামী শিল্প পদ্ধতি’ শীর্ষক গ্রন্থে আমি সেসব লোকের বিস্তারিতভাবে জবাব দিয়েছি, যারা মুখ বাঁকা করে ও নাক উঁচু করে বলে বেড়ায় যে, শিল্প সংস্কৃতির সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।
এখানে সেসব কথার পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। ইশারা-ইঙ্গিতে ইতিপূর্বে আমরা বলে এসেছি যে, এ অধ্যায়ে আমরা ইসলামী জীবন পদ্ধতির বিস্তারিত রূপ নিয়ে আলোচনা করব না। এখানে শুধু দ্বার উন্মুক্ত করে দিচ্ছি এবং পথকে উজ্জ্বল করার মত সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করছি মাত্র।
ইতিপূর্বে আমরা যেমন রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা নৈতিকতা ও পুরুষ নারীর পারস্পরিক সম্পর্ক পর্যায়ে আল্লাহ প্রদর্শিত পন্থার প্রাথমিক কথাগুলো বলে এসেছি, ঠিক তেমনি এখানেও শিল্প সংস্কৃতির পদ্ধতি সম্পর্কেও প্রাথমিক মৌলনীতিসমূহ পর্যায়ে কথা বলব।
শুরুতেই আমরা সেই মুখ ভ্যাংচিয়ে ও নাক উঁচু করে কথা বলার লোকদের সম্পর্কে বলতে চাই, শিল্প-সংস্কৃতি একটি মানবীয় তৎপরতা ও ব্যস্ততা, মানুষ তা নিয়ে জীবন-পথে চলে। আর মানুষের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও নৈতিকতা –সবই যখন আল্লাহ প্রদর্শিত পদ্ধতি –ইসলামের অন্তর্ভুক্ত, এবং এখানে তা গড়ে তোলার ও তাকে মানবোপযোগী মানে উন্নত করার সব ব্যবস্থাই রয়েছে, তখন শিল্প সংস্কৃতিও অনুরূপভাবে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কেননা তাও অন্যান্য গুলোর মতোই মানবীয় তৎপরতা ছাড়া আর তো কিছুই নয়। সেগুলো আল্লাহ প্রদত্ত নিয়মে গড়ে উঠতে পারলে এটাও সেই নিয়মেই গড়ে তোলা যাবে। কেননা এটাকেও মানবোপযোগী মানে উন্নীত করার ওতাকে সুসংগঠিত করে তোলার সব ব্যবস্থাই আল্লাহর পদ্ধতি ইসলামে রয়েছে।
এই মুখ ভ্যাংচানো ও নাক সিটকানো লোকদের আবার বলছি, শিল্প-সংস্কৃতিকে আল্লাহর পদ্ধতির অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা যে নিছক ধর্মীয় ওয়াজ ও মিম্বরের ওপর দেওয়া খোতবায় পরিণত হবেই, তার মাধ্যমে মানুষের বিকৃত চিত্র বানানো হবেই এমন কথা বলার কোনোই যুক্তি নেই। বরং এই সবই এক সাথে স্পষ্ট প্রকাশমান পবিত্র, পরিচ্ছন্ন, উন্নত ও উৎকর্ষ প্রাপ্ত হয়ে উঠবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
উক্তরূপ ধারণা একেবারেই ভিত্তিহীন। চিন্তার অন্তঃসারশূন্যতার কারণেই এই ধানের ধারণা পোষণ করা হয়। এটা সম্পূর্ণ জাহিলী মানসিকতার প্রকাশ। শিল্প-সংস্কৃতিকে আল্লাহর পদ্ধতি অনুযায়ী গড়তে দিতে তারা রাজি নয় বলেই এরূপ কথা তারা বলছে।
শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আল্লাহর পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলে তাকে উন্নতির চরম পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব, আল্লাহর পদ্ধতি মানব জীবনের বিভিন্ন দিকে উন্নতির যে চরম সীমা নির্ধারণ করেছে, সেখানে নিয়ে যাওয়াও কিছু মাত্র অসম্ভব হবে না। পরে তা আরও ….আরও উন্নত হবে। এটাই বাস্তব সত্য কথা। কোনোরূপ ব্যতিক্রম ছাড়াই গোটা সত্তাকে নিয়ে আল্লাহর পদ্ধীতর কারবার।
আল্লাহ বিশ্বলোক, জীবন এবং মানুষ এই সবই ইসলামী শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্র। তা আরও যতটা বিশাল হওয়া সম্ভব এতটা বিশালতা সহকারেই তা চলবে।
এই সবই স্বভাবতই ইসলামী দৃষ্টিকোণ দিয়ে গৃহীত। শিল্প সংস্কৃতি তার বিভিন্ন রূপসহ মানুষের চেষ্টা সাধনা বলে সেই বাস্তবতাকে চিত্রিত ও রূপায়িত করার লক্ষ্যে, যা তাদের অনুভূতিতে অস্তিত্বের মধ্যে নিহিত মহা সত্য সম্পর্কে ধরা পড়ে। অতীব উন্নত, নিখুঁত ও প্রভাবশালী চিত্র সন্দেহ নেই।
আল্লাহর সাথে মানুষের সম্পর্ক, বিশ্বলোকের সাথে মানুষের সম্পর্ক। জীবনের সাথে, তার নিজে ও অন্যদের সাথে তার সম্পর্ক এই সবই হচ্ছে শিল্প-সংস্কৃতির প্রকাশ ক্ষেত্র। তা ইসলামী শিল্প সংস্কৃতি হোক কিংবা হোক অন্য কোনো শিল্প ও সংস্কৃতি।
শিল্পকে ইসলামী পদ্ধতি অনুযায়ী গড়ে তোলা হলে যা ঘটবে, তা হচ্ছে এই যে, উক্ত সম্পর্কগুলোর সবই ইসলামী দৃষ্টিকোণ দিয়ে নতুন করে গড়ে তোলা হবে। ইসলমী চিন্তাধারা ও আচরণ-বিধির অনুসারী হবে তা, এ কথায় কোনোই অস্পষ্টতা বা গোজামিল নেই। একজন মুসলিম ইসলামী আচরণ-বিধি অনুযায়ী –ই তাকে গ্রহণ প্রকট হয়ে রয়েছে। অন্যরা যা অনুভব করে, তার কোনো গুরুত্বই সে মেনে নিবে না। এটাই স্বাভাবিক।
একজন মুসলিম অন্তরে যে বিধি-বিধান ও বাস্তবতার অনুভব করে, তা হচ্ছে মহান আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও ভয়। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার সাথে সাথে তার সাথে জীবন্ত অংশীদারিত্বের অনুভূতিও থাকে আর জীবনের সাথে ভালোবাসার সাথে মিশ্রিত থাকে জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্যের প্রতি গভীর ঐকান্তিকতা। ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের অবিচ্ছিন্নতা ও পরিব্যাপ্ততা, যা দুনিয়ার জীবনে কখনোই ভিন্নতর হয় না।
হ্যাঁ, ইসলাম এক বাস্তব জীবন পদ্ধতি। এই পদ্ধতিরই ঘোষণা হচ্ছেঃ
(আরবী*****************************************************************************)
মানুষের কতক দ্বারা অপরক কতককে প্রতিরোধ করা যদি আল্লাহর স্থায়ী নীতি না হতো, তাহলে দুটিয়াটা মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যেত।
(সূরা বাকারাঃ ২৫১)
আরও বলেছেঃ
(আরবী*****************************************************************)
হে মানুষ! তুমি নিশ্চয়ই তোমার আল্লাহর দিকে পৌঁছার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা ও সাধনা করে চলেছ। ফলে তোমরা অবশ্যই তাঁর সাক্ষাত লাভ করবে।
(সূরা ইনশিক্বাকঃ ৬)
(আরবী**********************************************************)
নিঃসন্দেহে আমরা মানুষকে খুব বেশী কষ্ট ও কাঠিন্যের মধ্যে সৃষ্টি করেছি।
বস্তুত ইসলাম পৃথিবীর বুকে কোনো ‘স্বর্গ’ রচনার কথা বলে প্রতারণা দেয় না। একথাও বলে না যে, তোমরা দুনিয়ার জীবনে পায়ের তলায় স্বতঃই মওজুদ পেয়ে যাবে জীবনের প্রয়োজনীয় সব নেয়ামত। বরং ইসলাম ঘোষণা করেছে, এ জীবনটা বড্ড কষ্টের, প্রাণপণ চেষ্টা-সাধনা-সংগ্রাম দিয়েই এই জীবনকে গড়তে হবে। এ জীবনে রয়েছে দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ও প্রতিরোধ।
মানুষের নিজ সত্তার দিক দিয়ে ইসলাম এক বাস্তব জীবন পদ্ধতি। ইসলাম মানুষকে বলে না যে, তুমি ফেরেশতা, অনেক উচ্চে ও ঊর্ধ্বে তোমার অবস্থান।
একথাও বলছে না যে, সমস্ত মানুষই দৃঢ় সংকল্প ও প্রত্যয়ের অধিকারী। বরং বলেছে (আরবী******************************) –“এবং মানুষ খুবই দুর্বল সৃষ্ট হয়েছে”। আরও বলে, (আরবী******************) –সমস্ত মানুষই ভুল-ভ্রান্তিতে ভরা।
এই প্রেক্ষিতেই বলতে হচ্ছে, ইসলামী পদ্ধতি অনুযায়ী গড়ে তোলা শিল্প সংস্কৃতি মানুষ ও জীবনে ভুল মিথ্যা বিকৃত ও প্রতারণাপূর্ণ কোনো চিত্র প্রতিকৃতি গড়ে তুলবে না। কোনো অসত্য ও ভিত্তিহীন কাল্পনিক রূপও দেবে না তার। কোনো উজ্জ্বল ঝকঝকে চেহারা দিয়েও মানুষকে উপস্থাপিতও করবে না। কেননা তার মূলে কোনো সত্য বা বাস্তবতা নিহিত নেই।
ইসলামী আদর্শ ভিত্তিক শিল্প-সংস্কৃতি পৃথিবীতে মানুষের দ্বন্দ্বের জীবনের জটিলতা ও সমস্যাসমূহের এবং ভালো ও মন্দের মাঝে যে টানাহেচড়া চলছে, আছে যে উত্থান ও পতনের ব্যাপার, এই সব কিছুরই অত্যন্ত বাস্তব ও বস্তুনিষ্ট চিত্র তুলে ধরে।
এই বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠে, তাহলে ইসলামী শিল্প-সংস্কৃতি ও জাহিলিয়াতের শিল্প-সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য থাকল কি?
জবাবে বলল, হ্যাঁ, বহু বিষয়ে ও অসংখ্য দিক দিয়েও এই দুইয়ের মধ্যে প্রকৃত পক্ষেই পার্থক্য রয়েছে।–[(আরবী**********) গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।]
প্রথম, ইসলামী বাস্তবতা বস্তুতই কোনো সংকীর্ণ বাস্তবতা নয়। যদিও আধুনিক জাহিলিয়াতে শিল্প-সংস্কৃতি চরম সংকীর্ণতায় পড়ে রয়েছে। কেননা সেখানে শিল্প ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত ধারণাটি মানুষ সম্পর্কিত পাশবিক ব্যাখ্যা থেকেই গৃহীত।
কিন্তু ইসলামে মানুষের মানবীয় –মানবোপযোগী ব্যাখ্যাই গৃহীত। সে ব্যাখ্যায় মানুষের পতন, উত্থান, ভালো ও মন্দ সবই শামিল, শামিল মানুষের এক মুঠি মাটিও রূহ-এর সমন্বিত সত্তা হওয়ার কথা। এক সাথে এই সব কিছুই তাতে স্বীকৃত।
পার্থক্যের দ্বিতীয় দিক হচ্ছে কেন্দ্রীয় লক্ষ্য। (Central point)।
ইসলামী শিল্প-সংস্কৃতি মানব জীবনের যে চিত্র অংকিত করে, তাতে সাদা-কালো-উজ্জ্বল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন দুটি দিকই জীবনের বাস্তবতা হিসেবে স্বীকৃত।
পার্থক্যের দ্বিতীয় দিক হচ্ছে কেন্দ্রীয় লক্ষ্য (central point)।
ইসলামী শিল্প-সংস্কৃতি মানব জীবনে যে চিত্র অংকিত করে, তাতে সাদা-কালো-উজ্জ্বল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন দুটি দিকই জীবনের বাস্তবতা হিসেবে স্বীকৃত।
হ্যাঁ বুঝলাম। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ দুটির মধ্যে কোনটির ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়?
জাহিলিয়াতের শিল্প-সংস্কৃতি মানুষের পাশবিক ব্যাখ্যা থেকে উদ্ভুত বলে তা মানুষের কালো-অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকগুলোর ওপরই সমস্ত লক্ষ্য নিবদ্ধ করে। সে দৃষ্টিতে অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকগুলোই যেন মানব জীবনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক’ বলে আমরা কোনো সীমাবদ্ধ নৈতিক দিক বোঝাতে চাচ্ছি না। সকল ব্যাপার সম্পর্কে আমরা বলছি ইসলামী দৃষ্টিকোণ দিয়ে।
আবার যখন দেখানো হবে, মানুষ অবনত মস্তকে দাঁড়িয়ে, চিরদিনের জন্যে এই অবনত অবস্থা অর্থনৈতিক, সামষ্টিক ও ঐতিহাসিক নিশ্চিত অনিবার্যতার সম্মুখে তা থেকে মুক্ত হতে পারছে না, তার লক্ষ্য ইতিবাচক নয়, সে বন্ধনের মোকাবিলা করারও কোনো দৃঢ় সংকল্প তার নেই, তাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হচ্ছে না, তার লক্ষ্যও সহীহ করা হচ্ছে না, বলব, এটাও মানুষের সেই কালো দিকই।
অনুরূপভাবে যখন জীবনকে চিত্রায়িত করা হবে বিভ্রান্ত, দিশেহারা, লক্ষ্যহীনরূপে। যার কোনো তাৎপর্য, লক্ষ্য ও বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানুষ হাতড়ে মরছে এক চিরন্তনী তীহ ময়দানে, সঠিক পথের সন্ধান জানা নেই, নেই মনের স্থিতি প্রশান্তি, নেই দৃষ্টির আলো, এইরূপ জীবন –মানব জীবনের এইরূপ নিঃসন্দেহে কালোদিকেরই প্রকাশ।
তেমনি মানুষকে যদি চিত্রিত করা হয় এভাবে যে, সে লালসার বহ্নিতে জ্বলছে কিংবা যৌন-কামনার স্রোতে ভেসে যাচ্ছে, তার নিজের মধ্যে মর্মান্তিক পরিণতির এক বিন্দু চেতনা জাগছে না, না তাকে সচেতন বানানো যাচ্ছে, তাহলেও বুঝতে হবে, মানবতার একটি কলংকময় দিকই এতে চিত্রিত করা হয়েছে।
মানুষের মধ্যে এই কলংকময় দিকগুলো রয়েছে, সেটা একান্তই বাস্তব, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে মানুষের মৌল সত্তার প্রকৃতির দিক দিয়ে, তার শক্তি-সামর্থ্যের প্রকৃত অবস্থিতি ও তার জীবন লক্ষ্যের মহাসত্যের দিক দিয়ে বিচার করলে। নিঃসন্দেহে বোঝা যাবে –প্রমাণিত হবে যে, মানুষের এই অবস্থা কোনো স্থায়ী ও চিরন্তন বাস্তবতা নয়, অনুরূপভাবে তা নয় মানুষের আসল ও প্রকৃত রূপ। যা দেখানো হচ্ছে, তা মানুষের বিকৃতি, চরিত্র হনন ও চির উজ্জ্বল মুখে কলংক লেপন মাত্র।
এই প্রেক্ষিতে আমাদের করণীয় হচ্ছে ইসলামী পদ্ধতিতে আমাদের বাস্তবতায় ঘটনাটিকে আমরা যেমন দেখছি তেমনিই চিত্রিত করব বটে; কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত পদ্ধতির ছত্রছায়ায় মানুসের আসল ও অন্তর্নিহিত মহাসত্য যেভাবে অনুভূত হবে, আমরা তারই ওপর আলোকসম্পাত ঘটাব, তাতে মানুষের কেবল কালো দিকটিই নগ্ন ও প্রকট হয়ে উঠবে না, পাশাপাশি তার সত্যরূপ –উজ্জ্বল উদ্ভাসিত দিকটিও প্রকটিত হয়ে উঠবে।
আর কালো দিকটিকে আমরা চিহ্নিত করব একটি বিকৃতি, বিপথগামিতা ও পথভ্রষ্টতা অথবা বিপর্যয় হিসেবে। মানুষের অকৃত্রিম ও আসল রূপ হিসেবে নয়। আমরা বলব, এটা মানুষের দুর্বল মুহুর্ত, দুর্বলতার দিকিটই তাতে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু তা একান্তই সাময়িক –মুহুর্তের ব্যাপার। পরক্ষণেই মানুষের হুঁশ ও কাণ্ড-জ্ঞান ও চেতনা ফিরে আসবে। সে দুর্বলতা কাটিয়ে অধোগমনের বদলে ঊর্ধ্বে গমন শুরু করবে। বলব, মানুষের দুর্বলতা চিরন্তন ব্যাপার নয়, নয় নিয়মিত লেখন। তা মানুষের মধ্যে অনুতাপ জাগায়। নাক সিঁটকানো না হলেও দুঃখানুভূতির আর্তনাদ অবশ্যই আকাশ-বাতাস মথিত করবে। যেমন আল্লাহর কথাঃ
(আরবী*******************************************************************)
আফসোস বান্দাদের জন্যে! তাদের কাছে যখনই কোনো রাসূল এসেছে, তারা তারই প্রতি ঠাট্টা ও বিদ্রূপ করেছে। (ইয়াসীনঃ ৩০)
মনে রাখা আবশ্যক, মানুষের দুর্বলতা কখনোই তার ‘সাহসিকতা’ বা বীরত্ব নয়। জাহিলিয়াতের শিল্প-সংস্কৃতি তো সে ভাবেই চিত্রিত করেছে।
আর উভয় ধারার মাঝে পার্থক্যের এ একটা বড় দিক।
এছাড়া অন্যান্য বিকৃতি বিপর্যয় যা আছে, তার সব কয়টি থেকেই ইসলামী পদ্ধতি সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র।
তাতে আল্লাহ ও মানুষের মাঝে সেই ঘৃণা মুসলিমের অনুভূতিতে কখনোই প্রকট হয়ে উঠতে পারে না। কেননা ইসলামী শিল্প এই দ্বন্দ্বকে প্রকট করে না। দ্বন্দ্ব থাকলেও তা আছে বিকৃত ও বিপথগামী মনমানসিকতায়। ইসলামী শিল্প তাকে একটি বিকৃতিরূপেই চিহ্নিত ওচিত্রিত করবে।
ইসলামী শিল্পে অ-আল্লাহর প্রতি কোনো প্রীতি বা মুগ্ধতার স্থান নেই। আল্লাহ ছাড়া কাউকে ‘ইলাহ’ বানাতে প্রস্তুত নয়।
মানুষের প্রকৃতি স্বভাবতই উত্তম, সুন্দর, নিখুঁত, প্রিয়তর, বিচিত্র প্রতিকৃতির সংগ্রাহক, পরিবেশক। মানুষের চেতনা তা দেখে নিশ্চয়ই বিস্ময় রসে আপ্লুত। কিন্তু তা প্রকৃতিকে ইলাহ বানায় না কখনোই। গির্জার ঈশ্বর থেকে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়ে যে রোমান্টিকতার উদ্ভব করেছিল, তারা প্রকৃতিকেই ইলাহ বানিয়ে নিয়েছিল। কেননা ইতিপূর্বে তারা পৌত্তলিকতায় মগ্ন থাকার পর খ্রিষ্টীয় পাদরী পুরোহিতদের থেকে অনেক দূরে সরে পড়েছিল।
ইসলামী শিল্পের দৃষ্টিতে মানুষও ইলাহ নয়। ইলাহ হওয়ার কোনো যোগ্যতাও তার নেই, যদিও তাকে বহু বড় বড় কাজের যোগ্যতা দেওয়া হয়েছে। মানুসের যা কিছু আছে তা সবই আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত, সবই আল্লাহর সৃষ্টি। তার জবাবে মানুষের কর্তব্য আল্লাহর শোকর করা। কিন্তু সে যদি আল্লাহর প্রতি কুফরী করে ও তাঁর শোকর আদায় না করে, তাহলে বুঝতে হবে, তার বিপর্যয় ঘটেছে, সে বিপদগামী হয়ে পড়েছে, যা মানুষের বলা অসম্ভব কিছু নয়। ….ইসলামী শিল্পকলা এই চিত্রও তুলে ধরবে। লোকদের জানিয়ে দেবে যে, এটা একট বিপর্যয়।
নিশ্চিত অপরিহার্যতা বা অনিবার্যতাও ইলাহ নয়, ইলাহ হওয়ার কোনো যৌক্তিকতা তার নেই। মানুষের উচিত নয় তার অনিবার্যতার বলি হওয়া ও তার অধীন হয়ে নিজেকে লাঞ্ছিত অপমানিত করা। ইতিহাসের জাহিলী ব্যাখ্যা ও সামষ্টিক মতসমূহ ভিত্তিক শিল্প ও সাহিত্য মানুষকে এই নিশ্চিত অনিবার্যতার দাসানুদাস নিয়ে চিত্রিত করেছে।
ইসলামী শিল্প নীতি ব্যাখ্যার জন্যে বিশাল ক্ষেত্র লাভ করে। জীবনের কোনো একটি ব্যাপারও তার আওতার বাইরে থাকে না।
অসাধারণভাবেই শিল্পের যে ক্ষেত্র, তার তুলনায় ইসলামের ক্ষেত্র বিশালতর, ইসলামী শিল্পের ক্ষেত্রে আল্লাহ সমগ্র বিশ্বলোক, জীবন ও মানুষের আর এই সকলের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য আরও বহু বিষয়ে বিস্তীর্ণ।
কিন্তু ইসলামী পদ্ধতিতে অন্যান্য সব জিনিসের ন্যায় এক্ষেত্রেও সব কিছু ভারসাম্যপূর্ণ, পবিত্র, পরিচ্ছন্ন, উচ্চতর-উন্নততর মানে গৃহীত। সে মান নিশ্চয়ই তা যা আল্লাহর খলীফার উপযোগী। অবশ্য সেই বাস্তবতার প্রতি লক্ষ্য রেখে, যে মানুষের জীবনে ‘খিলাফতে রাশেদা’ থেকে বিচ্যুতি ঘটতে পারে, সেই সাথে মানুষের স্বভাবগত দুর্বলতাকেও ভুলে যাওয়া হয়নি। কেননা তা মানুষের ক্ষেত্রে কিছুমাত্র অসম্ভব নয়।
আল্লাহর পদ্ধতি এমনিভাবে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা, নৈতিকতা, নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও শিল্প –এই সব কিছুতেই পরিব্যাপ্ত। কোনো কিছুই তার বাইরে নয়।
মানুষ এই জমিনের বুকে যা কিছুই করে, যে কর্ম তৎপরতাই চালায়, তার কোনো একটিও আল্লাহর পদ্ধতি ইসলামের বাইরে নয়, হতে পারে না। ইসলাম সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আর ত্রুটি-বিচ্যুতি, অসম্পূর্ণতা অক্ষমতা ও বিপর্যয় থেকে মুক্ত যদি কোনো পদ্ধতি সত্যিই থেকে থাকে, তা হলে তা হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর পদ্ধতি –ইসলাম।
এ ছাড়া আর যা কিছু, তা সবই জাহিলিয়াত। পিছনের দুটি অধ্যায়ে যে সব বিপর্যয়ের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দিয়ে এসেছি, সেই সবই পুরোপুরি বিপর্যয়, বিপথগামিতা। মানুষের জীবনে সেগুলো যে অন্যায়, পাপ, নির্মমতা ও দুঃখ পীড়নের উদ্ভব করেছে, তা বর্ণতা করে শেষ করা যাবে না।
এসবরে বিশ্লেষণ থেকে একথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে, মানুষ যদ্দিন পর্যন্ত আল্লাহর দিকে –আল্লাহর প্রদত্ত জীবন পদ্ধতির দিকে ফিরে না আসবে, পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ না করবে ইসলামকে তাঁর প্রতি ঐকান্তিক ঈমান গ্রহণের সাথে সাথে, ততদিন পর্যন্ত জীবন নৌকা টলটলায়মান থাকবেই, ভারসাম্য কখনোই ফিরে আসবে না।
(আরবী**************************************************************)
জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনে ও তাকওয়ার পথ অবলম্বন করে, তাহলে তাদের প্রতি আমরা আসমান-জমিনের বরকতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেবো…. কিন্তু তারা অসত্য মনে করেছে, ফলে আমরা তাদের পাকড়াও করলাম তাদের নিজেদেরই কৃতকর্মের দরুন। (সূরা আরাফঃ ৯৬)
বস্তুতই মানুষের সম্মুখে শুধুমাত্র দুটি পথ রয়েছে। তার যে কোনো একটা তাকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।
হয় ঈমান আনবে, তাকওয়ার পথ অবলম্বন করবে। তার ফলে আল্লাহ তাদের জন্যে আসমান-জমিনের অফুরন্ত নেয়ামত ও বরকতের দ্বার খুলে দেবেন। অথবা তারা সত্যকে অবিশ্বাস ও অগ্রাহ্য করার পথ ধরবে। তা হলে আল্লাহ তাদেরই কৃতকর্মের ফল হিসেবে তাদের পাকড়াও করবেন। এ দুটি ছাড়াও তৃতীয় পথ বলতে কিছুই নেই।
এতদসত্ত্বেও …এই বিষয়টির অন্তর্নিহিত সত্যটি স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরও একটি কথা থেকে যায় –যেমন পূর্ববর্তী তিনটি অধ্যায়ে আমরা বলে এসেছি। কথাটি হলো, অন্ধকারে নিমজ্জিত জাহিলিয়াত পাগলের ন্যায় চির আবর্তনশীল। এক মুহুর্তের তরেও এই জাহিলিয়াত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেতে পারে না। এর তলে মানুষ এতই গাফিল হয়ে পড়ে আছে যে, তাদের চেতনা কোনো দিন ফিরে আসবে, তারা কতখানি বিপর্যয় ও ধ্বংসের মুখে পৌঁছে গেছে তার চেতনাটুকু লাভ করবে এবং অতি দ্রুত ও অবিলম্বে এই ধ্বংসোন্মুখ মানবতার রক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর হওয়া একান্ত জরুরী তার অনুভূতি তাদের মধ্যে জেগে উঠবে, তা এক সুদূর পরাহত ব্যাপার মনে হয়।
ব্যাপার বোধ হয়, তার চাইতেও খারাপ………..
তবে আল্লাহর বিধান ইসলাম মানুষের বাস্তব অবস্থা ও অবস্থান থেকে কিছুমাত্র দূরে নয়।
শুধু এতটুকুই নয়, জাহিলিয়াতের বর্তমান প্রবল চাপে জনগণ ইসলামকে জানতেই পারেনি বলে তাকে গ্রহণ করতে আগ্রহী হচ্ছে না। বরং তাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যেই সচেষ্ট।