অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিপর্যয়
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে ব্যক্তি মালিকানা ও সামজের রাজনৈতিক অবস্থায় তার প্রভাবের দিকে আমরা ইঙ্গিত করেছি। আমরা বলে এসেছি-
আমরা ‘মালিকানা’ শব্দের ব্যাখ্যায় মূল জাহিলী যুক্তি গ্রহণ করেছি। কিন্তু তার চিন্তা-বিশ্লেষণে এই যুক্তির অনুসরণ আমাদের ইচ্ছা নয়। কেননা তা কারণ ও ফলকে ওলট-পালট করে দেয়। আরও ভালো ভাবে বললে বলা যায়, তা শিকলের ধারার মধ্য হতে একটি মাত্র কড়া গ্রহণ করে এবং মানব জীবনের বাস্তবতায় তার স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা থেকে সেটিকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়। তা রাজনৈতিক অবস্থার ব্যাখ্যা করে অর্থনৈতিক রূপরেখা দিয়ে। অর্থনীতিকে তার নিজস্ব পরিমণ্ডলে রেখে ব্যাখ্যা করতে তা আদৌ প্রস্তুত নয়। মানুষের চিন্তা-বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়েও তার ব্যাখ্যাদান তার অনভিপ্রেত। কোনো ইতিহাসের জাহিলী ব্যাখ্যায় মানুষ অর্থনৈতিক সংস্থা ও অবস্থার অধীন। অর্থনৈতিক সংস্থা ও অবস্থা মানুষের অধীন নয়।
“সামষ্টিক উৎপাদন –যা লোকেরা করে আসছে, মানুষ তার ভিত্তিতে একটা সীমাবদ্ধ সম্পর্ক গড়ে তোলে, যা থেকে তাদের নিষ্কৃতি নেই। তা তাদের ইচ্ছা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন। অতএব বস্তুগত জীবনে উৎপাদন পদ্ধতিই জীবনে আধ্যাত্মিক, রাজনৈতিক ও সামষ্টিক কার্যক্রমের রূপ নির্ধারণ করে। মানুষের নিজের চেতনা তাদের অস্তিত্ব নির্ধারণ করে না বরং তাদের অস্তিত্বই তাদের চিন্তা-চেতনা নির্ধারণ করে”। -(কার্লমার্কস)
আমরা পূর্বে ধারণা ক্ষেত্রে সৃষ্ট বিপর্যয় সম্পর্কিত আলোচনায় এই জাহিলী ধারণার মধ্যে নিহিত বিপর্যয় সম্পর্কে বলে এসেছি। তাতে মানুষের মেধা ও মূল্যবোধ এবং তার কর্মশীলতার ইতিবাচকতা সম্পূর্ণ গাফিল হয়ে যায়। আর এই মানুষ যে যন্ত্রপাতি উৎপাদন করেছে, ইতিহাসের বস্তুগত ব্যাখ্যা অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিবর্তনের সবকিছুকে তারই ফলশ্রুতি বলে দাবি করছে। এই মানুষ তার নিজের মধ্যে নিহিত আগ্রহ ও প্রতিরোধক উদ্দীপতাকে অস্বীকার করে।
যন্ত্রপাতি উৎপন্ন হওয়ার পর সমগ্র জীবনের বিবর্তন সৃষ্টি করে এই কথা তার উৎপাদনকারী যখনতা উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, তখন আদৌ চিন্তা করেনি। কিন্তু এই কথা বস্তুবাদী ব্যাখ্যার এই কথাকে সত্য বলে স্বীকার করে না যে, এই বিবর্তন মানুষের ইচ্ছাবাসনা থেকে স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন। এই বিবর্তন পূর্ণমাত্রায় দৃষ্টিগোচরও ছিল না যখন তা উৎপাদন করা হচ্ছিল। কাজেই তা স্বয়ং মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই চলতে পারে। পারে তাকে উন্নত করতে, পারে অধঃপতনে পৌঁছে দিতে। মানব মনের সকল সোজা ও আঁকা বাকা পথ ধরেই তার গতিবিধি হলো একান্ত জরুরী। তার বাইরে তার জন্যে আদৌ কোনো পথ খোলা নেই। কোনো তা শূন্য –বায়ুলোক কাজ করতে পারে না। তা সব সময়ই মনের পথে মনের মধ্য দিয়েই কাজ করে।
মানুষ যখন উড়োজাহাজ আবিস্কার করল, তখন বস্তুগত কোনো প্রতিবন্ধক ছিল না, যা মানুষের বিবেক-বুদ্ধিকে বিরত রাখতে পারত। মানব মনে প্রাচীনকাল থেকেই একটা উদ্ধুদ্ধকরী আগ্রহ কাজ করছিল। বলছিল, সে পাখির ন্যায় শূন্যলোকে উড়ে বেড়াবে। এই আগ্রহ উৎসাহই শুরুকালীন বহু প্রকারের চেষ্টা সাধনায় রূপায়িত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তার বৈজ্ঞানিক পন্থা উদ্ভাবিত হলো, যখন মানুষের জ্ঞান ও অর্জিত তত্ত্ব ও তথ্য বৈজ্ঞানিকভাবেই এই আগ্রহ বাস্তবায়নে তাকে সক্ষম করে দিল। এই আগ্রহ ও উৎসাহের মূলে আর একটি কারণ ছিল এক স্থান থেকে অন্যস্থানে খুবই দ্রুততা সহকারে যাতায়াত করতে পারার সুবিধা লাভ। তার এটাও স্বভাবসিদ্ধ আগ্রহই বটে! শুরুতে সাহসিকতা সহকারেই তা পূরণের চেষ্টা হয়। পর সে একটি জন্তুর পিঠে সওয়ার হয়। পরে চেষ্টা-প্রচেষ্টায় রত হয় কোনো দ্রুত উপায় উদ্ভাবনে। আর তার এই চেষ্টা-প্রচেষ্টাই তাকে উড়োজাহাজ উৎপাদনে সক্ষম করে দিল।
তারপর রকেট আবিস্কৃত হলো।
উড়োজাহাজ যখন কার্যতই উৎপাদিত ও নির্মিত হলো, তখন সমাজে একটি বিপ্লবাত্মক বিবর্তন ঘটিয়ে দিল। যুদ্ধ ও শান্তি –উভয় অবস্থায়ই তার ব্যবহার হতে লাগল।
কিন্তু তাতে বিবর্তন ঘটল কেমন করে? এ বিবর্তন কি মানুষের মনের দিকটাকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে, তার আগ্রহ-উৎসাহ এবং তার সোজা ও বাঁকা গতিবিধিকে বাদ দিয়ে ভিন্নতর কোনো পথ ধরে চলেছে? এবং চলে এসে মানুষের জন্যে এই কাজ করেছে?
বস্তুত উড়োজাহাজ উৎপাদন সহজতর হওয়ার পশ্চাতে আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা-ধারণা ও সংস্কৃতি-সভ্যতার ব্যাপক সংযোগ রয়েছে। তা কি নতুন কোনো ব্যাপার যা উড়োজাহাজ মানুষের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে? কিংবা তা অতীব প্রাচীনকালীন অন্তর্নিহিত বাসনা, যা পূরণের জন্যে মানবতা প্রাথমিক সহজ যন্ত্রপাতি দ্বারা চেষ্টা চালিয়েছিল প্রাচীনকালে। পরে এ পর্যায়ে বড় ও ব্যাপক আকারে চেষ্টা চালিয়েছে, যখন তার জন্যে সমস্ত সম্ভাবনাই গড়ে তোলা হয়েছিল। এ সম্ভাবনাই তা নিজ হস্তে গড়ে তুলেছে।
কোনো এক সভ্যতা-সংস্কৃতিকে অপর কোনো সভ্যতা-সংস্কৃতি প্রধান প্রভাবশালী ও কর্তৃত্বশালী বানিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে উড়োজাহাজকে বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। এক সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধ্বংস করার কাজেও তা ব্যবহৃত হয়নি, তা বলার উপায় নেই। তা করা হয়েছে যুদ্ধ করে, যুদ্ধের উপায় অবলম্বন করে। তাহলে তা কি এমন কিছু নতুন ব্যাপার যা উড়োজাহাজ ঘটিয়েছে কিংবা ইতিহাসের গভীরে তার জন্যে বহু সাক্ষ্য রয়েছে।
মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের জন্যে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উদার উন্মুক্ত করে খুলে দিয়েছে এই উড়োজাহাজ। কিন্তু তা প্রকৃতপক্ষে যা করেছে যা করেছে তা হচ্ছে বাড়তি সম্ভাবনা ও আগ্রহ উৎসাহ বাস্তবায়ন, যা এতদিন প্রচ্ছন্ন হয়ে ছিল; কিন্তু কার্যকর হওয়ার পথ পাচ্ছিল না। কিন্তু তা এমন কিছুই নতুন করে সৃষ্টি করেনি, যা পূর্ব থেকেই মানুষের মনে প্রচ্ছন্ন বা প্রকাশমানভাবে বিরাজ করছিল না। তা কোনো নতুন মানুষও সৃষ্টি করেনি। যদিও বস্তুগত ব্যাখ্যা এই সব কিছুই ধারণা করে নিতে বলতে চেয়েছে!
এখান থেকেই আমরা চিরন্তন মানুষের কাছে ফিরে যাব এবং মানবীয় দৃষ্টিকোণ দিয়ে অর্থনীতির ব্যাখ্যা করব, -অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে মানুষের ব্যাখ্যা নয়।
মালিকানা ব্যাপারটি অর্থনীতির জগতে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মালিকানা কি করে হয়, তার ফলাফল কি?
বস্তুবাদী ব্যাখ্যা ইতিহাসের স্তরসমূহের জন্যে কতগুলো নিশ্চিত অনিবার্য রূপ নির্দিষ্ট করে দেয় মালিকানার জন্যে নিশ্চিত রূপ ও প্রকারের মধ্য থেকে।
ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ দিয়েই ইতিপূর্বে আমরা দেখিয়েছি যে, এই ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক নিশ্চিত অপরিহার্যতা নিতান্তই যুক্তিহীন ও দুর্বল কথা।
ইসলাম যখন তার মৌল নীতিসমূহ সহকারে তার এই জমিনে এই অবকাশের মধ্যে ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যঅ প্রদত্ত নিশ্চিত অনিবার্যতার একবিন্দু সহায়তা ও আনুকূল্য ছাড়াই আত্মপ্রকাশ করল, তখন একবার আমরা ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক নিশ্চিত অনিবার্যতার সর্বাত্মক কৃত্রিমতা ধরতে পেরেছিলাম। তখন কোনো ক্রীতদাস মুক্তিলাভের জন্যে উদগ্রীব হয়ে যায়নি। তখন এমন কোনো অর্থনৈতিক নিশ্চিত অনিবার্যতাও ছিল না, যা তাকে মুক্ত করতে পারত –যেমনটা ইউরোপে ঘটেছে ইসলামের সাত শতাব্দী পর। তখন কোনো তারীও মুক্তির জন্যে পাগল হয়ে ওঠেনি। তাকে মুক্ত করার কোনো নিশ্চিত অর্থনৈতিক অনিবার্যতাও ছিল না। ছিল না তাকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় অভিষিক্ত করার, মালিকানার অধিকার দেওয়ার অধিকার দেওয়াবার পক্ষে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টির কোনো কিছুই কোথাও ছিল না। এইগুলো এমন সব মৌল অধিকার যা ইউরোপ নারীকে দিয়েছে এই সেদিন –ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে মাত্র। তাও আবার নৈতিকাতর ক্ষেত্রে বীভৎস দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ ও ধ্বংসকারী বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়ার পর।
তখন সাধারণ জনগণও মুক্তি চায়নি গোত্রীয় কর্তৃত্ব আধিপত্য থেকে কিংবা স্বেচ্ছাচারী শাসনের গোলামী থেকে। কোনো অর্থনৈতিক নিশ্চিত অনিবার্যতাও এই মুক্তির ব্যবস্থা করেনি। ধন-মাল ও শাসন সংক্রান্ত রাজনীতিতে সম্পূর্ণ অভিনব তাৎপর্য নিয়ে আসারও তখন কোনো বাধ্যকারী কারণ কোথাও ছিল না। ইউরোপে। যার অনেকগুলোর প্রকাশ ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর পূর্বে ঘটতে পারেনি। তাও ঘটেছিল মালিক ও অ-মালিকদের মধ্যে বহু রক্তাক্ত সংঘর্ষ সৃষ্টি হওয়ার পর।
এই সব ক্ষেত্রের মধ্যে কোনো একটিতেও নিশ্চিত অপরিহার্যতা বলতে কোনো কিছুই ছিল না।
আমরা আর একবার এই নিশ্চিত অনিবার্যতার কৃত্রিমতা ও ভিত্তিহীনতা দেখতে পেয়েছি, যখন দুটি শিল্প-কারখানার দিক দিয়ে অত্যন্ত বেশী পশ্চাদপদ সামন্তবাদী দেশে কমিউনিজম শিকড় গেড়ে বসল, সে দেশ দুটি হচ্ছে রাশিয়া ও চীন। অথচ যে ইংল্যাণ্ডে তার শৈল্পিক অগ্রবর্তিতার কারণে সমাজতন্ত্র কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা ছিল একান্তই নিশ্চিত অপরিহার্য ব্যাপার। কিন্তু সেখানে তা কায়েম হয়নি বরং এখন পর্যন্ত সেই পুঁজিবাদই মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে ইংল্যাণ্ডের বুক জুড়ে।
তাই মালিকানার সেই রূপ পরিগ্রহ করাও কিছুমাত্র নিশ্চিত অনিবার্য নয়,যা বর্তমান জাহিলিয়াতের স্থলে গ্রহণ করেছে। তা পুঁজিবাদী স্বৈরতন্ত্রের হোক কিংবা হোক সমাজতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রে। …এ সবকিছুই ভিত্তিহীন কথাবার্তা।
ইউরোপে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাহিলিয়াতের ছত্রছায়ায়, যা সামন্তবাদ প্রতিষ্ঠার কারণে পূর্ব থেকেই আনুকূল্য পেয়ে গিয়েছিল। পূর্বে ঠিক যে নিয়মে ও দারায় সামন্তবাদ কায়েম হয়েছিল, পুঁজিবাদও ঠিক সেই নিয়মে ও ধারায় কায়েম হয়েছিল, আর তা হচ্ছে মালিকানার সীমাহীনতা ও নিরংকুশ স্বাধীনতা-সর্বতোভাবে।
ইউরোপীয় জাহিলিয়াতেরও আনুকূল্য তার জন্যে নিশ্চিত অনিবার্য ব্যাপার ছিল না। এ পর্যায়ে যা বলা যায় তা শুধু এতটুকুই যে, তা কার্যত সংঘটিত হয়েছে। তার বাস্তবমুখী শক্তি ছিল বলেই তা হয়েছে। কিন্তু তা তার কল্যাণময় হওয়ার পক্ষের কোনো যুক্তি নয়। কোনো সীমালংঘনের সাফাই গাওয়ার জন্যে কোনো কিছুই প্রস্তুত নয়।
আর পুঁজিবাদী জাহিলিয়াতে যে বিবর্তনই ঘটেছে, তা হচ্ছে প্রকৃতির বিবর্তন। তাগুত তার দ্বারাই মানুষকে গোলাম বানিয়ে ছেড়েছে। পূর্বে তারা ছিল ভূমিদাস। উত্তরকালে তারাই হলো শিল্প-কারখানার শ্রমিক দাস, মূলধন ও পুঁজিবাদের ক্রীতদাস। কিন্তু মৌলিকতা ও সারবত্তার দিক দিয়ে সীমালংঘন ও আল্লাহ-দ্রোহীতার প্রকৃতি এক ও অভিন্ন। আর দাসানুদাস হওয়ার –লাঞ্ছিত অবমানিত হওয়ার দিক দিয়ে দাসত্ব প্রকৃতিও অনুরূপভাবে সম্পূর্ণ অভিন্ন।
মূলধনের প্রকৃতি অর্থনৈতিক রূপ পরিগ্রহের ক্ষেত্রে জমির প্রকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। কিন্তু দখল, আয়ত্তকরণ, মালিকত্ব ও কর্তৃত্ব লাভের আগ্রহ উৎসুকের দিক দিয়ে তা ভিন্নতর কিছু নয়।
যন্ত্রপাতি উদ্ভাবিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কার্যকরতার জন্যে নগদ মূলধনের প্রয়োজন দেখা দিল অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে।
কিন্তু এ পর্যন্ত চলে আসা ভূমি মালিকদের পক্ষে হঠাৎ করে মূলধন ও শিল্পপতি হয়ে যাওয়া প্রথম দিক দিয়ে খুব একটা সহ ব্যাপার ছিল না। কোনো ঝোঁক-প্রবণতা ও অভ্যাস দুটোই মানুষের মনের সাথে সম্পৃক্ত। সামন্তবাদীরা তো এতদিন সম্পূর্ণ শান্ত ও নিশ্চিতভাবে সেই পথে কাজ করে আসছিল, যে পথে তারা ধন-মাল আয়ত্ত করার সাথে সাথে ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসেছিল। এই ক্ষেত্রে ক্রমাগত কয়েক শতাব্দীকালের বাস্তব অভিজ্ঞতা তাদের ছিল। এদিকে সামন্তবাদীদের তাগুত শিল্পের ক্ষেত্রে নেমেছে মাত্র কয়েকশ বছর হলো। তাই এক্ষেত্রের চড়াই-উৎরাইয়ের অভিজ্ঞতা অনেক বিলম্বে অর্জিত হয়েছে। এটা কোনো ব্যক্তিগত নিশ্চিত অনিবার্যতার ব্যাপার নয়। বরং তা জনগণের একান্তভাবে সেদিকে ঝুঁকে পড়ার কারণেই সম্ভব হয়েছে, …যদিও আল্লাহর পথ থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়ার পরিণামে।
প্রয়োজনীয় মূলধন সংগ্রহের জন্যে জমির মালিকানার পথ বাদ দিয়ে নতুন একটি পথের বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। ….আর সেই সুযোগেই সুদখোর বেনিয়া ইহুদীরা পুঁজিবাদ সৃষ্টি সংক্রান্ত কার্যক্রমে দুই হাতে ঋণ বিতরণ করতে শুরু করল। যদিও ঋণের বিনিময়ে সুদখোর সমাজের সৃষ্টি নতুন কিছু ছিল না, যা পুঁজিবাদ সৃষ্টি করেছে। ইহুদীরা এই কাজ করে এসেছে ইতিহাসের সেই সূচনাকাল থেকেই। সুদ তাদের দেহের শিরা-উপশিরায় রক্তর মতই সদা প্রবহমান। যদিও আল্লাহ তাদেরকে তাওরাত কিতাবে এই সুদখোরীথেকে বিরত থাকার জন্যে আদেশ করেছিলেন, সুদী কারবার করতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু তারা মুহুর্তের তরেও এই কাজ থেকে বিরত থাকেনি। বরং তারা এই কারবার নিয়ে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বত্র সূদী কারবারের এই জাহিলিয়াত একমাত্র ইহুদীদেরই সৃষ্টি।
তাওরাত তাদের বলেছিল; তোমার ভাইয়ের খাতিরে তুমি সুদী কারবার করো না। তখন তারা নিজেদেরকে বললে –অথবা বলা যায়, তাদের লোব ও লালসাই তাদের মনে জাগিয়ে দিল এই কথাঃ “তোমার ভাইয়ের জন্যে অর্থাৎ ইহুদীদের সঙ্গে সুদী কারবার করতে নিষেধ করা হয়েছে। খুব ভালো কথা! কিন্তু অ-ইহুদী উম্মীদের সাথে সুদী কারবার করে সর্বতোভাবে তাদের রক্ত শুঁষে নিতে তো কোনো দোষ নেই”। কুরআন মজীদে তাদের এই কথাটিই উদ্ধৃত হয়েছে এই ভাষায়ঃ
(আরবী******************************************************************************)
তা এই ভাবে যে, তারা বলেছিল যে, উম্মী লোকদের মধ্যে আমাদের জন্যে কোনো নিষেধ ও বাধ্যবাধকতা নেই। (সূরা আলে-ইমরানঃ ৭৫)
সুদের ভিত্তিতে ঋণ দানের কারবারী এই ইহুদীদের জন্যে প্রয়োজন ছিল তাদের ঋণ ও সুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা। যেমন ঋণ গ্রহণকারীর জন্যে জরুরী ছিল এমন মুনাফা লাভ, যা ঋণ শোধ দেওয়ার সাথে সাথে তার সুদ আদায় করার ব্যবস্থা করে দেবে। আর সেই সাথে ব্যক্তিগত মুনাফার একটা অংশ তার নিজের হাতে অবশিষ্ট থাকা। আর এখান থেকেই সূচিত হলো পুঁজিবাদ গড়ে ওঠা –সেই প্রথম দিন থেকেই। বিপুল মুনাফা লাভের আগ্রহই হলো এর মূল নিয়ামক। আর তা খুব সহজ পথেই হতে লাগল।
কিন্তু তা ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় কথিত কোনো ঐতিহাসিক বা অর্থনৈতিক নিশ্চিত অনিবার্যতার ব্যাপার ছিল না।
সংশ্লিষ্ট সকলের পূর্ণ সহযোগিতায় পুঁজিবাদ গড়ে উঠার পথে সেখানে কোনো প্রতিবন্ধকই ছিল না। এই সময় ইউরোপীয় সমাজের ব্যবসায়ীরা যে ধন-মালের মালিক ছিল, তা শিল্প উৎপাদনের কাজে বিনিয়োগকৃত ছিল। তারাই আরও মূলধন সংগ্রহ করল ইহুদীদের কাছ থেকে সুদের ভিত্তিতে।
এই সময় জনগণ ইচ্ছা করলে আল্লাহর পথে ফিরে আসতে পারত। আর তা এভাবে যে, আল্লাহর পথ –ইসলাম সুদকে সম্পূর্ণরূপে হারাম করে দিয়েছে। আর তদস্থলে সম্পূর্ণ ঘোষণা করেছে নির্দোষ শর্তে ব্যবসায়ী সহযোগিতা।
তাই বলতে হয়, পুঁজিবাদ সৃষ্টি কোনো নিশ্চিত অনিবার্যতার ফলশ্রুতি ছিল না। এটা পুরাপুরি বিপথগামিতা, গুমরাহী ও বিভ্রান্তি মাত্র। আল্লাহর দাসত্ব কবুল করেনি বলেই জাহিলিয়াতের এই মারাত্মক বিভ্রান্তি।
জাহিলিয়াত অর্থনৈতিক কায়-কারবারে সুদী ব্যবস্থাকে অবাধ ও নির্বিঘ্ন করে দিয়েছে। আর এটাই ছিল মানবতার জন্যে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনার নিশ্চিত অনিবার্যতা। একটু পরেই আমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত বলব। কিন্তু আমরা তার পূর্বে বলতে চাচ্ছি যে, ইতিহাসের জাহিলী ব্যাখ্যা যেমন বলে, অর্থনৈতিক কায়-কারবার জনগণের নৈতিক মূল্যমান ও আধ্যাত্মিক ভাবধারা থেকে কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার ছিলনা।
যে জাহিলিয়াত আল্লাহর পথের বিপরীত গিয়ে যে সুদী কারবারের প্রচলন করেছে, তারও পূর্বে ধোঁকা, প্রতারণা, অপহরণ, অধিকার কেড়ে নেওয়া ও লুণ্ঠনের কাজ করতে সিদ্ধহস্ত হয়েছিল সামন্তবাদী ব্যবস্থার ছত্রছায়ায়। এক্ষণে সেখান থেকে ফিরে এসে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ঠিক সেই কাজই করছে। নতুন কিছু নয়।
যে জাহিলিয়াত কৃষক চাষীদেরকে ভূমি চাষের কাজে একান্তভাবে মশগুল করে রেখেছিল, যেখানে তাদের সমস্ত কর্মশক্তি নিঃশেষ নিয়োজিত হয়েছিল, একমুঠি খাবারের বিনিময়ে, ঠিক সেই জাহিলিয়াতই শ্রমিক কর্মচারীদের মশগুল করে রেখেছে শিল্প কারখানার চার দেওয়ালের মধ্যে, যেন তাদের সমস্ত কর্মশক্তি এখানে নিঃশেষ হয়ে যায়, ঠিক সেই একমুঠি খাবার পাওয়ার বিনিময়ে।
না, জাহিলিয়াত নতুন কোনো সৃষ্টি হিসেবে গড়ে ওঠে না, যা পূর্বে ইউরোপীয় জাহিলিয়াতে বর্তমান ছিল না। মূলত তা ছিল, বর্তমানের রূপটা তারই সম্প্রসারণ মাত্র।
সুদী কারবারের অন্তর্নিহিত কথা হলো, তার ফলে মূলধন দ্রুততা সহকারে দুইগুণ তিনগুণ চারগুণ বৃদ্ধি পায়। এটাই তার স্বভাব। জমি থেকে প্রাপ্ত মুনাফা তার সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারে না। তার তুলনায় অনেক অনেক বেশী এবং দ্রুত মূলধন বৃদ্ধি পায় এই সুদী কারবারে। আর এই কারণে পুঁজিবাদের হাতে সামন্তবাদী জাহিলিয়াতের নৈতিকতাও বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। অবশ্য এই বৃদ্ধিটা বীভৎসতা, কদর্যতা ও অধপতনে গমনের দিকে।
পুঁজিবাদ তার অগ্রগতিতে বিপুল সাহায্য ও সহযোগিতাও পেয়েছে। তার সীমালংঘনমূলক কার্যকলাপ ক্রমশ বৃদ্ধিই পেয়ে গেছে চতুর্দিক থেকে ব্যাপক আনুকূল্য পেয়ে। জ্ঞান-বিজ্ঞান তার সমস্ত সম্ভাবনা দিয়ে পুঁজিবাদেরই সহায়তা করেছে। ফলে তার পথের সব প্রতিবন্ধকতাকে চূর্ণবিচূর্ণ করার ক্ষমতা ও মারাত্মকতাও অনেক বৃদ্ধি পেয়ে গেছে।
কিন্তু তাও কোনো ঐতিহাসিক বা অর্থনৈতিক নিশ্চিত অনিবার্যতার কারণে হয়নি।
উত্তর ইউরোপীয় রাষ্টগুলো অন্যান্য বহু সংখ্যক ব্যাপারে তার বিপথগামিতা ও জাহিলিয়াত থাকা সত্ত্বেও পূর্ণ সহযোগিতামূলক পুঁজিবাদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিটি দেশে পুঁজিবাদের সম্প্রসারণ ও অগ্রগতিতে পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া গেছে।
এসব দেশের জনগণই তা করতে ইচ্ছা করেছে এবং তা-ই কার্যকর করেছে। ফলে পুঁজিবাদের সহযোগিতা করার পথে কোনোরূপ প্রতিবন্ধকতারই সম্মুখীন হয়নি। এমন কোনো দুর্ঘটনাই ঘটেনি, যার দরুন বীভৎস রক্তপাতকারী খুনীর ভূমিকা পালন করতে কোনোরূপ অসুবিধা দেখা দিতে পারে।
এটা কোনো নিশ্চিত অনিবার্যতা নয়। এটা নিতান্তই বিপথগামিতা মাত্র। পুঁজি বাদ ক্রমশ সমৃদ্ধ, বিরাট বপু ও ক্রমবর্ধমান হতে থাকল। আর পাশাপাশি চলতে থাকল বিজ্ঞানের বেশি বেশি অগ্রগতি ও উন্নতি। ফলে এমন একদিন এলো, যখন বড় বড় পুঁজিদার বৈজ্ঞানিক পন্থায় সম্ভাব্য বিপুল মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে ছোট ছোট পুঁজিদারের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াল। এরই ফলে বড় পুঁজি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজিকে খেয়ে ফেলল। অথবা তাকে বাধ্য করল তার সাথে ঐক্যবদ্ধ হবার জন্যে তার ভিতরে ঢুকে যেতে। আর শেষ পর্যণ্ত এক এক দেশে এক এক স্থানে পুঁজির স্তুপ জমা হয়ে গেল। পূর্ণ ইজারাদারী বা একচেটিয়া ব্যবসায় কর্তৃত্ব গড়ে উঠল। কোনো শিল্পে নিয়োজিত মূলধন যখন পারস্পরিকভাবে অনুপ্রবিষ্ট হলো, একটা আর একটার সাথে মিলিত হয়ে একটি একক ঐক্যবদ্ধতা গড়ে তুলল, তখন সেই শিল্পের ওপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব অনিবার্যভাবে কায়েম হয়ে গেল সেই ঐক্যবদ্ধ পুঁজিবাদের। ফলে অপর কোনো মূলধন সেই ক্ষেত্রে তার সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে সাহস পেল না। কোনো তাতে ইতিমধ্যেই একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে এবং তার সেই একচেটিয়া কর্তৃত্ব সর্বদিক দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু এর-ও কোনো নিশ্চিত ঐতিহাসিক বা অর্থনৈতিক অনিবার্যথা ছিল না। উত্তর ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কার্যত সহযোগিতা যত বেশী বৃদ্ধি পেল, এই দেশগুলোর মধ্যে বসবাসকারী ব্যক্তিগণের পরস্পরেও তত বেশী সহযোগিতা গড়ে উঠল। অনুরূপভাবে সবগুলো দেশে একই ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল ও সেইগুলো পরস্পরের মধ্যেই ব্যাপক সহযোগিতার কাজ করতে থাকল। বিনিয়োজিত হলো পরস্পর সহযোগিতাকারী বিরাট বিরাট মূলধন। তখন পণ্য ব্যবহারকারীদের অপেক্ষা পণ্য মূল্য নির্ধারণে একচেটিয়া কর্তৃত্ব করাটাই লক্ষ্য থাকল না। এ সব যৌথ কারবারের অংশীদারদের সকলের বিপুল মুনাফা লাভ করিয়ে দেওয়াই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল। যদিও এই সব লোকই ছিল পণ্যের ব্যবহারকারীও। তাই এক্ষণে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি বা হ্রাসপ্রাপ্তিতে কল্যাণ বা ক্ষতি কোনোটাই তেমন থাকল না। তাই এই ব্যবসায় কোম্পানীসমূহের অংশীদাররা নিজেরাই যদ্দিন ব্যবহারকারীও তদ্দিন সর্বাবস্থায় অভিন্ন ফল দেখা দেওয়া অনিবার্য হয়ে দাঁড়াল। শিল্পোৎপাদনের গতি বৃদ্ধি পেল, নিত্যনতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠল এবং উৎপন্ন পণ্যের স্তূপ জমা হয়ে গেল। তখন এই পণ্য দেশ-বিদেশের জনগণের মধ্যে বিস্তীর্ণ করা একান্তই অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াল। আর তখন থেকেই পুঁজিবাদী দেশগুলো সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টি, তার সম্প্রসারণ ও ব্যাপকতা সৃষ্টির দিকে মনোযোগ দিল। যেন উদ্ধৃত পণ্যদ্রব্য সাম্রাজ্যের অধীন দেশসমূহে বিক্রয় করা সম্ভব হয়।
ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দাবি করছে, এই সবই হয়েছে ঐতিহাসিক ও অর্থনৈতিক নিশ্চিত অনিবার্যতার কারণে। ….কিন্তু তার এই কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন।
পুঁজিবাদ ও উদ্ধৃত্ত পণ্যসম্ভার সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি করেনি। তাই যদি হবে, তা হলে ইতিহাসখ্যাত রোমান সাম্রাজ্যবাদের কি ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে? …আসলে সাম্রাজ্যবাদ জাহিলী সমাজের বিভ্রান্ত ও বিপথগামী কামনা বাসনারই অনিবার্য ফল। আর প্রতিটি জাহিলী সমাজই বিশেষ শক্তি সামর্থ্য ও আধিপত্য কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে থাকে।
উদ্ধৃত পণ্যসম্ভারকে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে সাম্রাজ্যবাদই একমাত্র উপায় ও পন্থা নয়, যাকে নিশ্চিত অনিবার্য মনে করা যেতে পারে।
ব্যবসায় বাণিজ্যই তার স্বাভাবিক গতিতে উদ্ধৃত্ত গণ্য বিস্তারের জন্যে যথেষ্ট মাধ্যম। আর উৎপাদন নিয়ন্ত্রিত হলেই উদ্ধৃত পণ্যের কোনো প্রশ্ন থাকে না,যাকে দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতে পারে।
এসবই হচ্ছে পুঁজিবাদের ছত্রছায়ায় সৃষ্ট নিশ্চিত অনিবার্যতা। আরও ভালোভাবে বললে, পুঁজিবাদ সমৃদ্ধ জাহিলিয়াতের ছত্রছায়ায় তা সম্ভব। পরে তার সকল ফলাফলই তাকে অধিকতর সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করেছে। ফলে এটাই নিশ্চিত অনিবার্যতায় পর্যবসিত হয়েছে। কোনো তার সীমালংঘনমূলক বাড়াবাড়িকে রুদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করতে পারে, এমন কোনো জিনিসই কোথাও ছিল না।
অবশ্য একটু একটু করে চেষ্টা করা হলে এ বিপথগামিতা ও বিভ্রান্তিকে নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক পথে পরিচালনা করা সম্ভব হতো। অবশ্য জনগণ যদি তা চাইত, যা চেয়েছি তা না চেয়ে এবং তারা যদি আল্লাহর পথে চলতে প্রস্তুত হতো। কুরআন মজীদে এই কথাই বলা হয়েছেঃ
(আরবী*************************************************************)
গ্রাম জনপদবাসীরা যদি সত্যিই ঈমান আনত এবং তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করত, তাহলে আমরা ওপর পৃথিবী ও আকাশমণ্ডল থেকে বরকত বিপুলতা-ব্যাপকতার দুয়ার উন্মুক্ত করে দিতাম। (সূরা-আরাফঃ ৯৬)
অতঃপর এই জাহিলিয়াত অপর একটি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। …আর তা হচ্ছে, এই সকলের থেকেই মালিকানা কেড়ে নেওয়া হলো….।
পূর্ববর্তী জাহিলিয়াতকালে এই ধারণা করা হয়েছিল যে, ব্যক্তিগত মালিকত্বই বুঝি পৃথিবীতে সার্বিক বিপর্যয় সৃষ্টির আসল কারণ। আসলে বিপর্যয় কে সৃষ্টি করল –কোন দিক থেকে বিপর্যয়টা এলো, জাহিলিয়াত তা আদৌ ধারণা করতে পারেনি। মানুষই যে সকল বিপর্যয়ের মূলে –বিপর্যস্ত হয়েছে খোদ মানুষ –তা এই জাহিলিয়াতের পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। আসলে সংশোধন যদি কাউকে করতে হয়, তাহলে তা করতে হবে এই মানুষকে। আর মানুষের সংশোধন কেবল একটি উপায়েই সম্ভব। তা হচ্ছে, মানুষকে আল্লাহর পথের পথিক হতে হবে। আল্লাহর পথের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করেই তার গোটা জীবনকে –সামগ্রিক জীবনকে গড়ে তুলতে হবে। তা হলে মানুষ তার নিজের নিগূঢ় সত্যতা ও যথার্থতা বুঝতে সক্ষম হবে, তার মধ্যে নিহিত যাবতীয় শক্তি-সামর্থ্য ও মেধা-প্রতিভা সম্পর্খে অবহিত হওয়া ও তাকে সঠিক পথে পরিচালিত করা সম্ভব হবে, সম্ভব হবে জীবন ও বিশ্ব প্রকৃতি পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের কেন্দ্রীয় মর্যাদার কথা জানতে ও বুঝতে পারা।
কিন্তু জাহিলিয়াত তার ইতিহাসের জাহিলী ব্যাখ্যার আলোকে মনে করে দিয়েছে যে, অর্থনীতিই বুঝি মানুষ গড়ে, তাই অর্থনীতি ঠিক হলেই মানুষও ঠিক হয়ে যাবে স্বতঃস্ফুর্তভাবে। তখন কোনোরূপ হস্তক্ষেপ বা স্বতন্ত্রভাবে কোনো সংশোধনী প্রচেষ্টা চালানোর কোনো প্রয়োজন হবে না। কোনো এই ব্যাখ্যানুযায়ী যান্ত্রিক নিশ্চিত অনিবার্যথাই জীবনকে তার দাবি ও তাগিদ অনুযায়ী পরিচালিত করে এবং তা যান্ত্রিকরূপেই তার নিশ্চিত অনিবার্য ফলাফল প্রকাশিত হয়। গোটা বিশ্ব প্রকৃতিও সেই অনুসারে সংশোধিত হয়ে যায়, যখন লোকদের কাছ থেকে তাদের মালিকানা অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।
কিন্তু এটা কোনো বিজ্ঞান ছিল না। এ ধারণা কোনোক্রমেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। এটাকে নিতান্ত নির্বুদ্ধিতা, বোকামী ও জাহিলিয়াত ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের একটা অত্যন্ত খারাপ প্রতিক্রিয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী। তারই অন্তর্ভুক্ত ছিল জাহিলিয়াতের সকল প্রতিক্রিয়া। তার সাথে বাড়তি জিনিস ছিল মানব মনে নিহিত যাবতীয় মেধাশক্তি ও প্রতিভা সম্পর্কে চরম অজ্ঞতা ও মূর্খতা, জীবন ও বিশ্বপ্রকৃতির সাথে একদিকে এবং অন্যদিকে মানব সমষ্টির সাথে তার কার্যক্রম সম্পর্খেও চরম অজ্ঞানতা একটা বিরাট কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল।
বস্তুত অর্থনীতি ও অর্থব্যবস্থার নিজস্ব গুরুত্ব যতই বেশী হোক, তা মানব জীবনের একটি অংশ মাত্র। তার অধিক কোনো গুরুত্বই তা পেতে পারে না। অবশ্য সে অংশ নিতান্তই মৌলিক, অত্যন্ত প্রভাবশালী ও নেহায়েত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা তো আর গোটা জীবনটা নয়। জীবনের ওপর একমাত্র প্রভাবশালী অংশও তা নয়।
কিন্তু আধুনিক জাহিলিয়াত তাতে অত্যন্ত বেশী অস্বাভাবিক রকমের বাড়াবাড়িমূলক গুরুত্ব আরোপ করেছে। আর জীবনের অন্যান্য সব দিকের গুরুত্বকে অনেক বেশী কম ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে পশ্চিমা পুঁজিবাদ ও প্রাচ্যদেশীয় সমাজতন্ত্র সমান ও অভিন্ন ভূমিকাই পালন করেছে। আর তারই দরুন মানব জীবনে মারাত্মক ধরনের বড় বড় গণ্ডগোল ও বিঘ্নতার সৃষ্টি করেছে। তার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত মানুষের কেবল ধ্বংসই অনিবার্য হয়ে উঠবে। আর বেশীর ভাগে উৎপাদন যন্ত্রপাতিও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। কোনো যন্ত্রপাতির মূল্য নির্ধারণ হবে তা বস্তুগতভাবে কতটা উৎপাদন করতে পারছে সেই দৃষ্টিতে। মানুষের মূল্যায়ন মানবীয় মূল্যমানের দৃষ্টিতে হবে না।
উপরে যে বিশৃঙ্খলা, বিঘ্নতা ও দোষত্রুটির কথা বলা হয়েছে, তা অত্যন্ত ব্যাপক। সে বিষয়ে আমরা পরবর্তী সমাজ ব্যবস্থা, নৈতিকতা ও দুই লিঙ্গের মধ্যকার সম্পর্কের বিকৃতি পর্যায়ের আলোচনায় বিস্তারিত কথা বলব। এখানে শুধু এতটুকুই বক্তব্য যে, উক্ত বিঘ্নতা ও দোষত্রুটির কারণে আধুনিক জাহিলিয়াত ব্যক্তিগত মালিকানা অধিকার কেড়ে নিয়ে সমস্যার সমাধানে যে বিশেষ পন্থায় প্রয়োগ করেছিল,তা তাদের ধারণানুযায়ী কোনো সুফল দিতে পারেনি, যদিও তারা সেটাকেই সকল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানের একমাত্র চাবিকাঠি মনে করে বসেছিল।
আসলে বর্তমান জাহিলিয়াত বিকৃত বিপথগামী বলে তা মানব প্রকৃতির মৌলিক ভাবধারার সাথে প্রচণ্ড সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। ব্যক্তিগত মালিকানা (দখলী অধিকার) কেড়ে নিয়ে তার সমস্ত বৈশিষ্ট্যকেও খতম করে দিতে উদ্যত হয়েছে। আর দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক ঝগড়ার সৃষ্টি করেছে। তার দাবি হচ্ছে, মালিকানা প্রবণতা কোনো স্বাভাবিক –প্রকৃতিগত –প্রবণতা নয়, তা সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের উত্তরাধিকার মাত্র। মানব প্রকৃতিতে তা মৌলিকভাবে নিবদ্ধ নয়। …এখানেই থেমে যায়নি। তা যখন বুঝতে পারল, বিরোধীয় বিষয়টিকে অকাট্যভাবে প্রমাণ করার জন্যে তাদের উপস্থাপিত যুক্তি কিছুমাত্র যথেষ্ট নয়, তখন তা প্রকৃতি বিরুদ্ধ দিকে আর এক ধাপ এগিয়ে গেল। তখন তা মানুষের আসলেই কোনো প্রকৃতি বা স্বভাব আছে, একথাই অস্বীাকর করে বসল। মনে হচ্ছে, মানুষের মধ্যে এই প্রকৃতিটাকে তার গভীরে বিস্তীর্ণ শিকড় সহ উপড়িয়ে ফেলতেই বদ্ধপরিকর হয়েছে। বলতে শুরু করল, মানুষ প্রকৃতিগত কোনো প্রবণতা ব্যতিরেকেই জন্ম গ্রহণ করেছে। (কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস প্রমুখ এই মতই প্রকাশ করেছে।) বিশেষ করে মানুষের জন্মকালে মালিকানা লাভের কোনো প্রবণতাই তার প্রকৃতিতে ছিল না। সমাজ-ব্যবস্থা এই খারাপ চিন্তার বীজ তার মনের জমিনে বপন করে দিয়েছে। এখানে তা উৎপাটিত করা একান্তই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কেননা তা-ই মানুষের সকল দুর্ভাগ্যের মৌলিক কারণ।
কিন্তু জাহিলিয়াতের এ ধ্বজাধারীরা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো আলোচনা করতেই প্রস্তুত হয়নি। অথচ বিষয়টির ঐতিহাসিক দাবি ছিল তা করার। প্রশ্ন রয়েছে, সমাজই যদি এ প্রবণতা মানব-প্রকৃতিতে বদ্ধমূল করে থাকে, তাহলে সামজ তা করল কেন? …এই সমাজ জিনিসটাই বা কি? যা এই কর্মটি করেছে? ..তা কি খোদা মানুষকে বাদ দিয়ে ভিন্নতর কোনো জিনিস? …হ্যাঁ, একথা সত্য যে, সমাজ ব্যক্তি থেকে স্বতন্ত্র। ব্যক্তি যেসব গুণ-বৈশিষ্ট্যে স্বাতন্ত্র্যের মর্যাদা পায়, সমাজের গুণ-বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব তা থেকে অনেকটাই ভিন্নতর হয়। …কিন্তু তবু তা কি মানুষ ছাড়া কিছু?
তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নেই যে, মার্কস ও দরখায়েম যেমন মনে করে, সমাজ-কাঠামো ব্যক্তির ওপর অনেক কিছুই চাপিয়ে দেয়, মানুষের মনের কোনো তাগিদ ছাড়াই –কোনো ইচ্ছা ও উদ্যোগ ব্যতীতই ব্যক্তির মনে ভালো ও খারাপ উভয় ধরনেরই ভাবধারার সৃষ্টি করে, তা হলে প্রশ্ন ওঠে, কেবল একজন ব্যক্তিই মানুষ, সমাজ নয়। এই ধারণা কে সৃষ্টি করেছে? ….সমাজ তো মানুষেরই সমষ্টি। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো সৃষ্টির সমন্বয়কে কি সমাজ বলা হয়?
না, তা কখনোই নয়। অবশ্য জাহিলিয়াতের ধ্বজাধারীরা এই তর্কে এগিয়ে আসেনি। অথচ তারাই সর্বশক্তি প্রয়োগে ব্যক্তির মন মগজ থেকে এই ব্যক্তি-মালিকানার ভাবধারা ও প্রবণতাকে সমূলে উৎপাটিত করার জন্যে ওঠে পড়ে লেগে গিয়েছে। তাদের ধারণা হচ্ছে, প্রাথমিক কালের মানুষ ব্যক্তিগত মালিকানা চিনত না, জানত না সমাজরে সকলের মধ্যে উৎপাদনের যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ার –যার অস্তিত্ব এখন নেই, ছড়িয়ে ছিল। আর উৎপাদন হতো অনুরূপভাবে সামাজিক সামষ্টিক পদ্ধতিতে। পরে যখন কৃষ্টি ও চাষাবাদের কাজ শুরু হলো, কেবল তখনই ব্যক্তি মালিকানার প্রশ্ন দেখা দিল, লোকেরাও তার সাথে পরিচিতি লাভ করল। মানুষ তখন জমির মালিকানা লাভের জন্যে আগ্রহী হয়ে উঠল। আর সেই সাথে উৎপাদন যন্ত্রের মালিকত্বও করায়ত্ত করতে চাইল। তা উৎপাদনকারী জনগণের মালিকানা, যা দাসত্ব স্তরে কার্যকর ছিল, পরে সামন্তবাদী স্তরেও তা ছিল, পুঁজিবাদের স্তরে এসেও তা অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে।
জাহিলিয়াতের এই অন্ধ লোকগুলোকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্যে যা যুক্তি পেশ করা হয়, তা কিছুমাত্র যথেষ্ট ছিল না।
প্রথম সূচনাকালীন যুগে মালিক হওয়ার যোগ্য –যার মালিক হওয়া যায় কোন জিনিসটি ছিল?
প্রস্তরখণ্ড ….চাকুর মতো শানিত, তীক্ষ্ম। তার মালিক হলে কার কি লাভ? কাঁচা মাংস কেটে খণ্ড করার কাজে দাঁত ও নখ যখন ব্যর্থ হয়ে যেত, তখন এই ধারালো পাথর খণ্ড ব্যবহার করা হতো। কিন্তু খোদা এই মাংস ও মাছ –যা টুকরা করা হতো এর মালিক হওয়া যেত কেমন করে? কোনো জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনের অতিরিক্ত হলে সংগৃহীত মাছ ও মাংস দুর্গন্ধময় হয়ে যেত, পঁচে যেত। তা খাওয়ার যোগ্য হতো না, ….তা হলে তা পুঞ্জীত করে দখল করেই বা রাখা হতো কেন? কেনই বা তা সংরক্ষণের প্রশ্ন দেখা দিত। কি ভাবে তা সংরক্ষিত হতো?
এ পর্যায়ে মালিকত্ব মূলতই অর্থহীন ছিল। কোনো মালিক হওয়ার মতো কোনো জিনিসই তখন ছিল না। মালিক হওয়ার কোনো প্রবণতা মানব প্রকৃতি নেই, এ কারণে নয়, জাহিলিয়াতের ধ্বজাধারীরা কি এই নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করেছে যে, সেই প্রাথমিক সমাজে কোনো জিনিসেরই মালিকত্ব নিয়ে কখনোই কোনো ঝগড়ার সৃষ্টি হয়নি? …তা হলে? কোনো নির্দিষ্ট মেয়েলোকের মালিকত্ব লাভ নিয়ে কি তখনকার লোকদের মধ্যে কখনোই কোনো পাশবিক দ্বন্দ্ব ও বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়নি? যার চোখে সে মেয়েটি অধিক সুশ্রী, সুন্দর গণ্য হতো, তার প্রেম পাওয়ার জন্যে সে হতো পাগল। তখন সে তাকে নিজের একক দখলে পাওয়ার জন্যে চেষ্টা শুরু করে দিত। গোত্রপতি কিংবা সম্প্রদায়ের কোনো সাহসী যুবক যদি তাই হতো, তা হলে শক্তি পরীক্ষায় অন্য সকলের ওপর জয়ী হয়ে সে মেয়েটিকে রীতিমত দখল করে নিত।
গোত্রপতি কি নিজেকে অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করত না? …অন্ততঃ বাহ্যিক পোশাকে, মাথায় একটি পাখির পালক লাগিয়ে? অন্যদের থেকে তার মালিকত্ব কি ভিন্নতর ছিল না? অন্যদেরকে তা ব্যবহার করতে কি নিষেধ করা হতো না?
হ্যাঁ, খুব সামান্য ও জঘন্য জিনিসেই এই মালিকত্ব প্রতিফলিত হতো। তবু তাও মালিকত্ব, ব্যক্তিগত মালিকানার ব্যাপার নয় কি তা?… এ তো সেই সময়ের কথা যখন সেই প্রাথমিক যুগে সকল মানুষ যখন সমান মানে জীবন যাপন করত? তখনও ঠিক যতটা সম্ভব হতো, ব্যক্তিরা তার মালিক হয়ে বসত। ..তা কি অস্বীকার করা যায়?
ক্রমশ এই মালিকত্বের ভাবধারার বিকাশ ঘটে। মনস্তাত্ত্বিকতার দিক দিয়ে তা ক্রমশ অধিকতর পরিপক্ক হয়ে ওঠে। তাদের বস্তুগত শক্তি সম্ভাবনাও অনেক বড় হয়ে ওঠে। আর তাদের জ্ঞানগত সামর্থ্য হয় দিগন্ত বিস্তীর্ণ। তখন তারা মালিকানা লাভ করতে লাগল প্রশস্ত বেষ্টনীতে। মালিক হলো জমির, মালিক হলো জমির, মালিক হলো জমি চাষের যন্ত্রপাতি ও হাতিয়ারের।
তারপরই সূচিত হয় বিভ্রান্ত, বিপথগামিতা।
কিন্তু তাদের এই বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতা এজন্যে ছিল না যে, তারা কিছু না কিছুর মালিক হয়ে বসেছিল, এর পূর্বেই তারা তাদের মনস্তাত্ত্বিক, বস্তুগত ও জ্ঞানগত মানের সীমার মধ্যেই কিছু না কিছুর মালিক হয়েছিল।
পরে তারা যখন জমির ও উৎপাদন যন্ত্রের মালিকত্ব চিনল, জানল, ঠিক তখনই তাদের বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতা শুরু হয়ে যায়নি।
এ বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতা অনেক পুরাতন ব্যাপার। মানুষ যত পুরাতন, তাও ততটাই প্রাচীন।
তারা যখন একটি নারীর মালিকত্ব নিয়ে পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হলো, গোত্রপতিত্ব নিয়েও –তা লাভ করার জন্যেও তারা পরস্পরের সাথে কঠিন দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছিল। যে পাখির পালক মাথায় লাগিয়ে স্বীয় শোভা বর্ধন করা হতো ও অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় ভূষিত হতো, তার মালিক কে হবে, তাই নিয়ে ছিল তাদের পারস্পরিক ঝগড়া, দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা।
পরে দৈহিক শক্তিবলে এই সব কিছু অর্জনে তারা প্রবৃত্ত হয়। যে বিজয়ী হতো সেই হতো তাদের প্রধান কর্তৃত্বশালী। …হ্যাঁ, এটাও ছিল বিভ্রান্তি, বিপথগামিতা। আসলে মানুষের মালিক হয়ে বসার এই বাসনা, পরে তারা নিজেরাই নিজেদের মালিক হতো? তারই জন্যে এই কামনা ও লোভ। মনুষ্যত্বের সূচনাকালীন এই বাসনা-কামনাই হচ্ছে মূল বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতা।
আর বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতা তো কোনো সময়ই কোনা চূড়ান্ত অনিবার্য শক্তি ছিল না। মানুষের জন্যে তা-ই একমাত্র উপায় ছিল না কখনোই।
বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতা –তা যে সময়ই হোক –একটা মানবীয় সম্ভাবনা মাত্র। তা ঘটে, ঠিক যেমন ঘটে ভারসাম্যতা, সৎপথে হলো। এ দুটো ব্যাপারই সমান।
আর এ দুটিই মূল মানব প্রকৃতি থেকে উৎসারিত। সেই প্রকৃতি যেমন হেদায়েত গ্রহণের যোগ্যতার ধারক, তেমনি ধারক গুমরাহীর পথ গ্রহণের যোগ্যতারও। তাই মানব প্রকৃতি বিভ্রান্তিতে পড়ে, যেমন তা গ্রহণ করে ভারসাম্যতা, ঠিক নির্ভুল পথ।–[(আরবী****) দ্রষ্টব্য।]
ইতিহাসের জাহিলী বস্তুবাদী ব্যাখ্যার একটা নিতান্তই পৌরাণিক কথা হচ্ছে, ব্যক্তিগত মালিকানা প্রবণতা সূচিত হয়েছে কেবল তখন, যখন কৃষি ও চাষাবাদের সূচনা হয়েছে। আর এই মালিকত্বই হচ্ছে বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতার আসল কারণ। …আসলে এটা একটা ভিত্তিহীন পৌরাণিক কল্প-কাহিনী মাত্র। জাহিলিয়াত মানব প্রকৃতি যথার্থভাবে জানতে ও অনুধাবন করতে পারেনি বলেই তা ঘটেছে।
ইতিহাসের এমন কোনো অধ্যায়ই খুঁজে পাওয়া যাবে না, যখন এই ব্যক্তিগত মালিকানা প্রচলিত ছিল না। কিন্তু কেবল তাই বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতার মৌল কারণ নয়, তা হতেও পারে না। যখন তা পড়েছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ অবস্থায়, তখন সেটিকে কল্যাণের দিকে চালিত করলে তা হতো অতীব কল্যাণকর উপকরণ। কর্মতৎপরতা ও অগ্রগতি উন্নতি সাধিত হতো জীবনের সর্বক্ষেত্রে। অবশ্য তা তখন খারাপ দিকেও নিয়ে যাওয়া যেত আর তাই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে আজ তা ধ্বংস, বক্রতা চূড়ান্ত বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যক্তিগত মালিকানাই নিশ্চিত অনিবার্য হিসেবে সামন্তবাদ বা পুঁজিবাদের সৃষ্টি করেনি (পূর্বে এ সম্পর্কে বিস্তারিত কথা বলা হয়েছে)। কামনা বাসনা লালসাই তার আসল উদ্ভাবক। এই কামনা-বাসনা লালসাই মানুষকে দাসানুদাস বানানোর জন্যে মালিকানাকে উপায় হিসেবে অবলম্বন করেছে। মানুষের ওপর নিজের প্রাধান্য ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত করেছে। গৌরব-অহংকার করেছে। আর তারই মধ্যে নিহিত রয়েছে মানুসের বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতার মৌল কারণ। আর তা সেই প্রাচীনতম কাল থেকেই।
পরে মার্কসীয় জাহিলিয়াত ব্যক্তিমালিকানা অধিকার চূড়ান্তভাবে হরণ করেছে, হরণ করেছে অত্যন্ত ভুলভাবে এই কথা মনে করে যে, বিপর্যয়ের কারণটা বুঝি ওখানেই লুকিয়ে রয়েছে। তা মানুষের নিজের মধ্যে নেই, যে মানুষ জাহিলিয়াতের ইউরোপে তখন বাস করত। …অতঃপর বিগত অর্ধ শতাব্দীরও বেশিকাল সময়ের এই অভিজ্ঞতার বাস্তব ফল কি পাওয়া গেছে, কি হয়েছে তার পরিণতি?
ব্যক্তিমালিকানা হরণ করে মার্কসীয় জাহিলিয়াত কি কর্তৃত্ব লাভের স্বভাবগত কামনা-বাসনা-লালসাকে নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছে?
…আমরা বললে তো দোষ হয়। তাই এ বিষয়ে আমাদের কথা বলা উচিত নয়। এ বিষয়ে মার্কসীয় জাহিলিয়াতের বড় পাণ্ডা ক্রুশ্চেভই আসল কথা বলে দিয়েছেন। ক্রুশ্চেভের পূর্বসূরির মৃত্যুর পর সে তার সম্পর্কে মুখ খুলতে সাহস পেয়েছিল। অবশ্য তখন সে ক্ষমতাসীন ছিল বলেছিল –সে ছিল অপরাধী, রক্তপাতকারী, খুনী, ইতিহাসের বীভৎস চরিত্রের এক স্বৈরাচারী।
এই কথা বলা হচ্ছে এমন সময়, যখন ব্যক্তিগত মালিকানা বলতে কোনো নাম চিহ্নও কোথাও নেই। সব কেড়ে কুড়ে নেওয়া হয়েছে। …কিন্তু আল্লাহর পথে না হলো এই জাহিলী মানুষের প্রকৃতিতে নিহিত বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতা পুরোপুরি রয়ে গেছে। তা বিলুপ্ত করার জন্যে কোনো পদক্ষেই গ্রহণ করা হয়নি। সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করা হয়নি। আর এই বিভ্রান্তি ও বিপথগামিতারই অনিবার্য ফলশ্রুতিতে এই স্বৈরতন্ত্রীর বীভৎসতা সম্ভব হয়েছিল (এ বিষয়ে, ‘রাজনীতিতে বিপর্যয়’ অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করে এসেছি)। এই স্বৈরতন্ত্র মহান নেতা, বন্য অপরাধী, ব্যাপক রক্তপাতকারী দ্বারা অনুষ্ঠিত হোক কিংবা স্বয়ং এই নীতি ও আদর্শের দ্বারাই হোক, তাতে কার্যত তো কোনোই পার্থক্য সূচিত হয় না। কেননা সেখানে মানুষের গোটা সত্তাকেই তো অস্বীকার করা হয়েছে। তাকে করা হয়েছে লাঞ্ছিত, অবমানিত। বিনিময়ে দেওয়ার ওয়াদা করা হয়েছে শুধু এক মুঠো খাবার। তাকে দাসানুদাস বানিয়ে দেওয়া হয়েছে অত্যাচারী নিরংকুশ রাষ্ট্রযন্ত্রের। তারই হাতে পুঞ্জীভূত হয়ে আছে সমস্ত ক্ষমতা।
এ জাহিলিয়াত নানা বিঘ্নতা ও দোষ-ত্রুটির সমন্বয়।
অর্থনৈতিক দিকটাকে মানুষের গোটা সত্তার ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। মানুষের আসল সত্তাকে করা হয়েছে অস্বীকৃত। মানবীয় সত্তা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ভাবধারা সম্পন্নই নয়। তাতে রয়েছে আরও অনেক কল্যাণকামী ভাবধারা। মানুষ তার দেহ, বিবেক ও রূপ এই সব কিছু নিয়েই তো মানুষ। তাতেই নিহিত রয়েছে এই সকল ভাবধারা সমন্বিতভাবে, মানুষ তার পূর্ণ গভীরতা নিয়ে এক মৌল সত্তা।
বিপর্যয়ের মৌল উৎস নিহিত রয়েছে মালিকানা লাভের উপায় ও পন্থায়। সবকিছুকে সীমাহীনভাবে ‘মুবাহ’ গণ্য করেই হোক কিংবা পুঁজিবাদ অনুসৃত ভিন্নতর পন্থায়ই হোক অথবা সকল পথ বাতিল করে দিয়েই হোক –যেমন হয়েছে সমাজতন্ত্রের, অন্তত নীতিগতভাবে হলেও। যদিও মানব প্রকৃতির বাস্তবতার চাপে পড়ে মার্কসীয় লেনিনীয় দর্শনের মৌল তত্ত্ব থেকে সরে এসে হলেও কিছুটা ব্যক্তি মালিকানাকে স্বীকৃতি দিতে হয়েছে, মজুরীর মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে –আর ক্রুশ্চেভের কথানুযায়ী চরম বাস্তব ব্যর্থতা স্বীকারের পর কৃষিক্ষেত্রে ভূমির সামষ্টিক মালিকানাও নিঃশেষ করে দিতে হবে, -তবু এই মালিকানার পন্থার মধ্যেই নিহিত রয়েছে বিপর্যয়ের আসল কারণ।
এই বিভ্রান্ত মানবতা যদি নির্ভুল সঠিক পথে ফিরে আসতে রাজি হয়, যদি সংশোধন বা চিকিৎসা করার ইচ্ছা হয় এই কঠিন রোগের, তাহলে উভয় রোগের চিকিৎসা এক সাথে কিছুতেই সম্ভব নয়। আর যে মূল উৎস থেকে এই রোগ বিপর্যয় উৎসারিত, সেই মৌল উৎসের চিকিৎসা ও সংশোধন ব্যতিরেকে উক্ত রোগ দুটির চিকিৎসা কখনোই সফল হতে পারে না।
এজন্যে একদিকে মালিকানা লাভের উপায় ও পন্থার চিকিৎসার প্রয়োজন। সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজমের সততা কখনোই হরণ করা যাবে না। আবার কোনোরূপ সীমা নিয়ন্ত্রণ ব্যতীতই তাকে উন্মুক্তভাবে হলোতে দিতে সেই নির্বুদ্ধিতাও করা যেতে পারে না –যেমন করা হয়েছে পুঁজিবাদে।
অপরদিকে মানব জীবনে অর্থনৈতিক স্বভাবসম্মত যে স্থান, মর্যাদা ও গুরুত্ব ঠিক ততটুকু স্বীকা রকরে জীবনটাকে পুরোপুরি ভারসাম্যপূর্ণ করতে হবে। আর তা যদি সত্যিই করা সম্ভব হয় তা হলে মানব জীবনে বস্তুগত ও অর্থনৈতিক কোনো নতুন বিপর্যয় কোনো দিনই দেখা দেবে না। অর্থনীতিকে তার আসল ও সঠিক স্থানে বসাতে হবে। তা হলে তা স্ফীত হয়ে বিপর্যয়ের কারণ ঘটাবে না। তারই পার্শ্বে তার সংরক্ষক –নিয়ন্ত্রক হিসেবে অত্যন্ত জাগ্রত ও তেজস্বী করে তুলতে হবে মানুষের আধ্যাত্মিক সত্তাকে, তার নৈতিক চেতনাকে, হালাল হারাম বোধকে।
মূলত মানুষ এমনি এক সমন্বিত গুণাবলী সম্পন্ন বিশেষ সৃষ্টি। ডারউইনের ক্রমবিকাশ তত্ত্ব মানুষের এই মৌল সত্তাকে অস্বীখার করেছে। তাই মানুষ মানবীয় মর্যাদা থেকে পশুর স্তরে নেমে গেছে। মানবীয় মহৎ গুণাবলী হারিয়ে হিংস্র পশুতে পরিণত হয়েছে।
সোজা কথা হচ্ছে, মানুষকে আল্লাহর পথে ফিরে আসতে হবে। সমগ্র জীবনকে পুনর্গঠিত করতে হবে আল্লাহর দেওয়া বিধান –পূর্ণাঙ্গ ইসলামের ভিত্তিতে।