যৌন সম্পর্কে বিপর্যয়
এ পর্যায়ে আমরা ‘যৌন সম্পর্কে সৃষ্ট বিপর্যয়’ সম্পর্কে নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ দিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি। এ বিষয়ে পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা বিশদ আলোচনা করেছি। এশন আমরা ‘যৌন সম্পর্কে বিপর্যয়’ বিষয়ে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র ও মানুষের সামষ্টি জীবনে সৃষ্ট চরম গণ্ডগোলের দৃষ্টিতে আলোচনা করব। নৈতিকতার দৃষ্টিতে যৌন সম্পর্কে সৃষ্ট বিপর্যয় এতই প্রকট যে, সে বিষয়ে অধিক আরও কিছু আলোচনার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না।
বস্তুত যৌন সম্পর্কে সৃষ্ট বিপর্যয় যে প্রকৃতপক্ষে নৈতিকতারই বিপর্যয়, এই তত্ত্ব গোপন রাখার জন্যে আধুনিক জাহিলিয়াত ফ্রয়েড, মার্কস ও দরখায়েম উপস্থাপিত বৈজ্ঞানিক (?) মতাদর্শ ও ইতিহাসের বস্তুগত ব্যাখ্যাকে সামনে তুলে ধরেছে। লোকদেরকে এই ভুল বোঝাতে চেষ্টা চালিয়েছে যে, যৌনতা মূলত একটা জীবতাত্ত্বিক বা জৈবিক কার্যক্রমে মাত্র। নৈতিকতার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
সেই সাথে গল্প-উপন্যাস, নাটক, সিনেমা, রেডিও, টেলিভিশন ও সাংবাদিকতা প্রভৃতি সকল প্রচার মাধ্যমই একযোগে গোটা জীবনে যৌনতার কুৎসিৎ অশ্লীল চিত্র তুলে ধরেছিল এবং লোকদের মনে বদ্ধমূল করতে চেয়েছিল যে, নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্ক একান্তভাবে স্বাভাবিকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। তাতে কোনোরূপ বিকৃতি বা বিপর্যয়ের প্রশ্নই উঠতে পারে না।
এই ধরনের যাবতীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টার পরও সত্য মধ্যাহ্নের সূর্যের মতোই দেদীপ্যামান হয়ে আছে যে, যৌন-উচ্ছৃঙ্খলতা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা নৈতিক বিপর্যয়েরই ব্যাপার।
ইহুদী পণ্ডিতবর্গের প্রোটকলে লিখিত রয়েছেঃ
সর্বত্র আমাদের লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যেই যৌনতাকে সকলের সম্মুখে নিয়ে আসার কাজে প্রতিনিয়ত কাজ করে যেতে থাকবে। ফলে যুবকদের সম্মুখে ‘পবিত্র জিনিস’ বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না এবং নিজেদের যৌন লালসা-কামনা চরিতার্থ করাই হবে তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় চিন্তা-ভাবনা। আর তার ফলেই চরিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে।
উক্ত প্রোটকল-এ একথাও বলা হয়েছে যে, আমরা ডারউইন, মার্কস ও নিটশের চিন্তাধারাকে ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও প্রসারিত করার কাজে বিশেষ সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। তাদের চিন্তাধারা অ-ইহুদী জনগণের চরিত্রকে যে মারাত্মকভাবে ধ্বংস করে, তা আমাদের কাছে দিবালোকের মতোই প্রকট।
উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ থেকেও এই কথাই জানা যায় যে, যৌন বিপর্যয় মূলত নৈতিক চরিত্রেরই বিপর্যয় ও ধ্বংস।
কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বিষয়ে আমরা এখানে মৌলিকভাবে আলোচনা করে এটা দেখাবার প্রয়োজন মনে করছি না যে, তা নৈতিক বিপর্যয়ের ব্যাপার। কেননা লোকেরা জাহিলী ধারণার বশবর্তী হয়ে নৈতিক চরিত্র ও জীবনের মাঝখানে পার্থক্যের দুর্লংঘ্য সুউচ্চ প্রাচীর দাঁড় করে দিয়েছে। অথচ প্রকৃতপক্ষে এ দুটির মধ্যে আদৌ কোনো পার্থক্য নেই।
বস্তুত নৈতিক চরিত্র জীবনের বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো জিনিস নয়। চরিত্র নয় এমন মতাদর্শমূলক মৌলনীতি, যা যত্র তত্র স্বতঃস্ফূর্তবাবে পাওয়া যেতে পারে। বাস্তব জীবনের আইন-কানুন ভিন্নতার জন্যে ভিন্নতর কোনো আইন নেই। জীবনের সুস্থ ও স্বচ্ছন্দ, সক্রিয় ও গতিবান হয়ে চলবে, সেই সাথে তাদের নৈতিক বিপর্যয়ও থাকবে, এটা কোনো ক্রমেই সম্ভব নয়।
সত্যিকথা, নৈতিক বিপর্যয় জীবনের বিপর্যয়েরই অনিবার্য ফলশ্রুতি, তা অবিচ্ছিন্নও। সেই সাথে জীবনের বিকৃতি ও বিপর্যয়ের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে নৈতিক বিপর্যয়ের। মূলত দুটিই অভিন্ন ও এক। এক ও অভিন্ন আইনের অধীন এই দুটিই। মানুষের পূর্ণাঙ্গ সত্তা ও মানবীয় প্রকৃতিই জীবন ও চরিত্র উভয়েরই উৎস।
এখানে আমরা যখন –লিঙ্গদ্বয়ের সম্পর্কে বিশৃঙ্খল পর্যায়ে –বাস্তব জীবনের উপর কি প্রভাব বিস্তার করে সেই দৃষ্টিকোণ দিয়ে অধ্যয়ন করছি, তখন শেষ পর্যন্ত এই কথার তাৎপর্যও ব্যাখ্যা করতে হবে যে, নৈতিকতার বিপর্যয় বলতে আসলে কি বোঝায়?
মানব জীবনের অন্যান্য সব জিনিসের মতই দুই লিঙ্গের -নারী ও পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কেও চরম বিপর্যয় সংঘটিত হয়েছে, যদিও তাতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়েছে এবং খুবই ধীরে ও ক্রমিক পদ্ধতিতে অগ্রসর হয়েছে।
মধ্যযুগে সমগ্র ইউরোপের খ্রিষ্টীয় বিকৃতি ভাবধারাই বিজয়ী ও কর্তৃত্বশালী হয়েছিল। ইউরোপীয় গীর্জাসমূহেই জনগণের ওপর এই কর্তৃত্ব চালিয়েছে। সন্দেহ নেই, হযরত ঈসা (আ)-ও এক ধরনের বৈরাগ্যবাদের আহবান জাহিয়েছেন। দৈহিক কামনা-বাসনা-লালসারও ঊর্ধ্বে ওঠার জন্যে উৎসাহ প্রদান করেছেন। যদিও তা সর্বকালেই নবীর ও প্রত্যেক দ্বীনের দাওয়াতের অংশ ছিল। কিন্তু হযরত ঈসার শিক্ষাসমূহে বৈরাগ্যবাদী জীবন যাপন সংক্রান্ত হেদায়েত অধিকতর প্রভাবশালী ছিল। কেননা খ্রিষ্টধর্মকে তদানীন্তন ইহুদীদের নৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে দূরে রাখা ও রোমান জগতের বস্তুবাদী আল্লাদ্রোহিতা ও সীমালংঘনকারী কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে হয়েছে। এই কারণে ইনজীল গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ
তোমাদের চোখ পাপ করলে সে চোখকে উপড়িয়ে ফেল। কেননা দেহের একটি অঙ্গ থেকে বঞ্চিত হওয়া গোটা দেহের জাহান্নামের ঈন্ধন হওয়া থেকে উত্তম।–[ইনজিল-মথি, ৫ অধ্যায়, ২৪ স্তোত্র।]
এ ধরনের কথার ভিত্তিতেই গীর্জাকেন্দ্রিক নৈতিকতা গড়ে উঠেছে এবং এরই ফলে বৈরাগ্যবাদের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। ফলকথা, বৈরাগ্যবাদ তাদের নিজেদের মনগড়াভাবে রচিত। কুরআন মজীদ এই কথাই বলেছেঃ
(আরবী*********************************************************************)
আর বৈরাগ্যবাদ… তা ওরা নিজেরাই মনগড়াভাবে বানিয়ে নিয়েছে। আমরা তা কস্মিনকালেও তাদের জন্যে বাধ্যতামূলক করে দেইনি। (সূরা হাদীদঃ ২৭)
তাদের সাধারণ ধারণা ছিল, যৌনতা স্বতঃই অপবিত্র ও মলিনতা মাত্র। আর মেয়েলোক একটা শয়তানী সৃষ্টি, অত্যন্ত পুঁতিগন্ধময়। তা থেকে দূরে সরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। বিয়ে জনগণের জন্যে একটি স্বাভাবিক ও পাশবিক প্রয়োজন মাত্র। কিন্তু অতীব পূণ্যময় ও সৌভাগ্যশালী হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে বিয়ে করবে না এবং তার অনেক ঊর্ধ্বে নিজেকে স্থাপন করবে।
মোটকথা, একদিকে রোমান সাম্রাজ্যে ব্যাপক বীভৎস চরিত্রতা ও নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা চলছিল, আর অপরদিকে ছিল বিশ্বব্যাপী বৈরাগ্যবাদ বন ও গ্রামীণ এলাকায়। শহর-নগরেও বিপর্যয় থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে তা-ই আদর্শ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।
‘ইউরোপীয় চরিত্রের ইতিহাস’ গ্রন্থে ল্যাকি বলেছেনঃ
মধ্যযুগের লোক দুই প্রান্তিক সীমায় অবস্থান করছিল। একদিকে ছিল চরম বৈরাগ্যবাদ, আর অপরদিকে ছিল চরমবাদী পাপ নাফরমানীর কার্যকলাপ। যে জনবসতিতে বড় বড় বৈরাগ্যবাদী পরহিযগার, মুত্তাকী বিপুল সংখ্যক লোকের বসতি, তাতেই ছিল পাপ ও কুসংস্কারের ব্যাপক বিস্তৃতি। আর এই উভয় অবস্থাই মানবীয় মর্যাদার শত্রু।–[‘মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কি হারিয়েছে’: লেখক- আবুল হাসান আলী নদভী।]
উক্ত লেখক বৈরাগ্যবাদের অধীন যৌনতা চিন্তা ও তার বিভিন্ন সম্পর্কের পরিবেশের প্রতি মানব মনে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষের চিত্র এভাবে অংকিত করেছেঃ
ওরা (সেখানকার পুরুষরা) স্ত্রীলোকের ছায়া থেকেও পালিয়ে বেড়াত। তাদের নিকটে যেতেও তাদের সাথে একত্রিত হওয়াকেও তারা পাপ মনে করত। তারা এ বিশ্বাসকেও পোষন করত যে, ওরা যদি মা, স্ত্রী ও বোনও হয় আর পথে-ঘাটে ওদের সাথে মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা ঘটে, তা হলে তাদের সব নেক আমল ও তাদের আত্মিক আধ্যাত্মিক উন্নতি বরবাদ হয়ে যাবে।
মওলানা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদূদী তাঁর ‘পর্দা’ নামক বইতে পাশ্চাত্য চিন্তাবিদদের কিছু কিছু কথার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেনঃ
ওদের প্রাথমিক ও মৌলিক মতাদর্শ এই ছিল যে, নারী হচ্ছে পাপের জননী ও খারাবির মৌল উৎস। সব কদর্যতার মূল। পুরুষের জন্যে গুনাহ নাফরমানীর উদ্বোধন ও জাহান্নামের দুয়ার। মানুষের সমস্ত দুঃখ বিপদের সূচনা তো নারী থেকেই হয়েছে। তার নারী হওয়াই তার লজ্জাজনক হওয়ার জন্যে যথেষ্ট। তার রূপ ও সৌন্দর্য্যের জন্যে তার লজ্জিত হওয়া উচিত। কেননা সে তো শয়তানের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। তার তো উচিত চিরদিনের জন্যে স্থায়ীভাবে প্রায়শ্চিত্ত করতে থাকা। কেননা দুনিয়া ও দুনিয়াবাসীর ওপর সে-ই তো বিপদ টেনে এনেছে।
প্রাথমিক কালের প্রথম পর্যায়ে খ্রিষ্টান পাদ্রী ও বড় নেতাদের মধ্যে একজন ছিল টরটুলীয়ান’ (Tortulian)। সে নারী সম্পর্কে খ্রিষ্টীয় ধারণা এ ভাষায় পেশ করেছেনঃ
নারী হচ্ছে মনের মধ্যে শয়তানের প্রবেশ লাভের ফটক। সে-ই তো পুরুষকে নিষিদ্ধ বৃক্ষের কাছে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল। আল্লাহর আইন লংঘনকারী তো সে। আল্লাহর প্রতিকৃতি অর্থাৎ পুরুষকে সেই তো বিকৃত করেছে।
খ্রিষ্টধর্মের আর একজন বড় ওলী হচ্ছে ক্রাইসোসটেম (Chrysostem)। সে নারী জাতি সম্পর্খে বলেছেঃ
সে এক অনিবার্য পাপ। প্রকৃতিগতভাবেই শয়তানের প্ররোচনার এক আকর্ষণীয় মহাবিপদ। পরিবার ও ঘরের জন্যে আচ্ছন্ন হয়ে আসা বিপদের ঘনঘটা। এক মহাধ্বংসকারী প্রেয়সীয়তা। এক সুসজ্জিত মুসীবত।
নারীদের সম্পর্কে তাদের দ্বিতীয় পর্যায়ের মতাদর্শের সারকথা হচ্ছে পুরুষ ও নারীর পারস্পরিক সম্পর্ক স্বতঃই ও মূলতই একটা মহা অপবিত্রতা। অতএব তা পরিহার করা ও এড়িয়ে চলা বাঞ্ছনীয়। তার সাথে সম্পর্ক বিয়ের মাধ্যমে হোক কিংবা শরীয়তসম্মত রক্ত সম্পর্কের কারণে –সবদিক দিয়েই সে বর্জনীয়।–[পর্দাঃ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী।]
এ সবই হচ্ছে বিকৃত ও বিপথগামী জাহিলিয়াত কর্তৃক উদ্ভাবিত ধারণা বা মত। তাদের ধর্ম এরূপ ধারণা তাদের ধর্ম এরূপ ধারণা তাদের দেয়নি, এরূপ মত পোষণের কোনো আদেশও করেনি। কোনো নবী-রাসূল এ ধরনের কথা বলতে পারেন না, এরূপ মত রাখার নির্দেশও দিতে পারেন না। আসলে তা চূড়ান্ত পরিণতিতে রুক্ষ্ম জাহিলী প্রতিক্রিয়া মাত্র।
এ প্রতিক্রিয়া খুব ধীরে ধীরে প্রকাশমান হওয়ার মূলে নানা কারণ রয়েছে। এই প্রতিক্রিয়ার একটি কারণ হচ্ছে নেতিক চরিত্রের বিকৃতি ও বিপর্যয়। গীর্জার লোকেরা নিজেরাই তার শিকার হয়েছিল। সেই যৌন বিকৃতিও একটা কারণ, যা পাদ্রী পুরুষ ও পাদ্রী মেয়েদের গ্রাস করে ফেলেছিল। গীর্জার ইমারতটাই তার দরুন কম্পমান হয়ে উঠেছিল। আর বৈরাগ্যবাদের সমস্ত মূল্যমান ধূলায় মিশে গিয়েছিল। লোকেরা যখন এই অন্তঃসারশূন্য কৃত্রিম পবিত্রতা দেখতে পেল, তখন তারাও যৌন লালসা চরিতার্থ করার নানা উপায় সন্ধান ও অবলম্বন করতে শুরু করেছিল।
মানুষকে পশু বা জন্তু বলে ব্যাখ্যা করার পরিণতি এটা। আর ফ্রয়েড কর্মের যৌন ব্যাখ্যা দিয়ে তারই সমর্থন যুগিয়েছেন। আর এই ব্যাখ্যাই সহসা গোটা মানব জীবনকে চরম বিকৃতি ও ধ্বংসের পথে ঠেলে দিল।
শিল্প-বিপ্লবও ছিল এই জাহিলী প্রতিক্রিয়ার একটা মৌলিক কারণ। তাই পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে নব্য যুবকদেরকে গ্রাম এলাকা থেকে শহর-অঞ্চলে এনে ফেলেছিল। এখানে নৈতিক বন্ধন ছিল সম্পূর্ণ শিথিল। এ যুবকরা তথায় পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনের ভিত্তি স্থাপন ও রক্ষা করতে পারার মত আয় করতেও পারেনি। এই কারণে তারা তা বাদ দিয়ে সস্তা ও সহজ উপায়ে যৌন লালসা চরিতার্থ করার চরিত্র বিধ্বংসী পথ অবলম্বন করল।
আর ঠিক এই সময়ই মেয়েদেরকে কর্মক্ষেত্রে হাযির করা হলো এবং একমুঠি খাবারের বিনিময়ে নৈতিক চরিত্রহীনতার কাজ করতে তাদের বাধ্য করা হলো।
সাথে সাথে নারীদের সাম্যের মন্ত্রেও দীক্ষিত করা হয়েছিল। নির্লজ্জতা ও পাপাচারও এই সাম্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এসব কারণ মানবজীবনকে এক সর্বাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষেপ করে দিতে শুরু করেছিল। ঠিক এই সময়ই বিশ্ব ইহুদীবাদ এই জীবন ধারাকে নিজেদের উদ্দেশ্য সফল করার কাজে প্রয়োগ করল। মার্কস, ফ্রয়েড ও দরখায়েম নৈতিক-চরিত্রকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে করে চরমভাবে লাঞ্ছিত করল। নারীদের আহবান জানাল যৌন উচ্ছৃঙ্খলতার পথে চলতে। তাদের বোঝাল, তারা এ কাজ করলেই পুরুষের পাশে থাকতে পারবে সমান অধিকার নিয়ে।
এসবই ছিল চরম বিপর্যয়ের দিকে অত্যন্ত শক্ত রুঢ় ধাক্কা। এসবই বিশ্ব ইহুদীবাদ কর্তৃক উদ্ভাবিত। তা মতাদর্শের জগতে হোক, কি হোক বাস্তব জগতে –এই কারণেই মার্কস, ফ্রয়েড ও দরখায়েম প্রমুখ বিজ্ঞানী-দার্শনিক বলে খ্যাতি অর্জনকারী, ব্যক্তি-চরিত্রের গোটা ব্যাপারটাকে লজ্জাস্করভাবে অপমানিত করেছে, তাকে করেছে ঠাট্টা ও বিদ্রূপ। আর সেই সাথে নারীদেরকে আহবান জানিয়েছে তারা যেন চারদিক থেকে ও সকল পথে বেরিয়ে এসে যৌন কাজে-কর্মে বেশি বেশি অংশ গ্রহণ করে। তাহলেই তারা খুব সহজেই পুরুষদের নিকটবর্তী ও সমমর্যাদার হয়ে যেতে পারবে।
অতঃপর সিনেমা আবিস্কৃত হয়। মূলত তাও একটি ইহুদী শিল্প। তারই উত্তরসূরি হচ্ছে রেডিও, টেলিভিশন। এসব কয়টিই মানুষের নৈতিক বাঁধনকে ঢিলা করে দেয় এবং বেশি বেশি যৌন স্বাদ আস্বাদনের জন্যে মানুষকে পাগল বানায়।
সাজঘর, রূপচর্চার কেন্দ্র এবং নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার সামাজিক-সামষ্টিক অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানসমূহও ইহুদীদেরই উদ্ভাবিত ও প্রতিষ্ঠিত এবং তাদের দ্বারাই পরিচালিত। আর এসব ক্ষেত্রে চলে যৌন আস্বাদন ও ব্যভিচারের বীভৎস লীলাখেলা।
হ্যাঁ, ইহুদীরা উপরোক্ত অত্যাধুনিক প্রচার মাধ্যমসমূহ তাদের চরিত্র-বিধ্বংসী মতবাদ চিন্তাধারা ব্যাপকভাবে প্রচার কাজে পুরামাত্রায় ব্যবহার করেছে। তারাই ছিল এসবের একমাত্র কর্তৃত্বশালী। সেই সাথে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা –যা একান্তই ইহুদী উদ্ভাবিত –তারাই চালু করেছিল, তা যুবকদিগকে তাদের যৌবনের স্বাভাবিক দাবি অনুযায়ী সৎভাবে বিয়ে করার ও সংসার পরিচালনা করার কোনো সুযোগই দিচ্ছিল না। বরং অবিবাহিত যুবকদিগকে সর্বপ্রকারের যৌন উচ্ছৃঙ্খলতার জন্যে উদ্বুদ্ধ ও পাপ পথে আকৃষ্ট করছিল। সে সমাজে যৌন-স্বাদ আস্বাদনের জন্যে নারী লাভ ছিল অত্যন্ত সহজসাধ্য। মেয়েরা তো কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষাক্ষেত্রে পুরুষদের পাশেই অবস্থান নিয়েছিল এবং তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছিল।
সাথে সাথে সাংবাদিকতা, রেডিও, সিনেমা ও টেলিভিশন মেয়েদেরকে হাস্য-লাস্য-নৃত্য, মান-অভিমান ও অনুরাগ-বিরাগের সকল পন্থা ও প্রক্রিয়া শিখিয়ে যুবকদের যৌনতার আকর্ষণে আকৃষ্ট করার যোগ্য বানিয়ে দিচ্ছিল।
সরকারী ও বেসরকারীভাবে দেহ ব্যবসায়ের বড় বড় আড্ডা গড়ে উঠছিল। চিত্ত বিনোদনের ও নারী-পুরুষের মিলন কেন্দ্রসমূহ প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল। সেসব স্থানে দালালরা কু-কর্মের জন্যে লোক সংগ্রহ করত।
এসব পাপাচার ব্যাপকভাবে প্রসারিত হওয়ার পর লোকদের মনে এই চিন্তা জাগিয়ে দেওয়া হলো যে, কেবলমাত্র ভোগ-সম্ভোগ ও স্বাদ-আস্বাদনকেই বলা হয় জীবন। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত এই কাজে পূর্ণ মাত্রায় পরিতৃপ্ত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সেই ভোগ-সম্ভোগে আত্মনিমগ্ন হয়ে থাকাই বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু মানুষের এই জীবন, ফিরিয়ে পাওয়া না-পাওয়ার এক মহামূল্য সম্পদ। কাজেই তাকে যত বেশি বোগপূর্ণ করা সম্ভব কারুর পক্ষে, তা তার অবশ্যই করা উচিত। এক্ষেত্রে কোনো বাধা-নিষেধের কাছে পরাজয় বরণ করা উচিত হতে পারে না।
আসলে এই সবকিছুই বিকৃত-বিপর্যস্ত জাহিলিয়াতেরই কারসাজি। আর আধুনিক জাহিলিয়াত তারই ফসল। ফলে গোটা সমাজ নানাভাবে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে পড়ল। সমাজের কঠিনতম বন্ধনসমূহও ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। আর তথায় চরম মাত্রার উচ্ছৃঙ্খলতা ও চারিত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তাকে প্রতিরোধ করার কোথাও কিছু থাকল না।
নারী হলো এই সমাজে মুক্ত বিহঙ্গ। অন্যান্য মানুষও ধর্ম-নৈতিকতা ও চারিত্রিক ঐতিহ্যের বন্ধন থেকেও মুক্ত হয়ে গেল। বন্ধনসমূহ যৌন স্বাদ আস্বাদই তাদের স্বীকৃত ধর্ম হয়ে দাঁড়াল। রাষ্ট্র সরকার সেজন্যে সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যেতে লাগল। সর্বপ্রকারের প্রচার-যন্ত্র ও মাধ্যমসমূহ ব্যাপকভাবে এই সব বিষয়েরই প্রচারণা চালাতে পূর্ণভাবে নিয়োজিত হয়ে গেল।
দ্রল ডিউরাস্ট তার ‘দর্শনের বৈচিত্র্য’ গ্রন্থে বলেছেনঃ
আমরা আবার ঠিক সেই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছি, যার সম্মুখীন হয়েছিল সক্রেটিস, আসমানী কড়া শাসনের যোগ্য স্বভাবগত চরিত্র আমরা কোথায় পাব। তার প্রভাব বর্তমানে মানুষের জীবন থেকে বিলীন হয়ে গেছে। আর নৈতিক বিকৃতি, অধঃপতন বিপর্যয় আমাদের সামাজিক সামষ্টিক মূলধনকে ধ্বংস করে যাচ্ছে। (প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা ৬)
জন্ম নিয়ন্ত্রণের ঔষধ ও প্রক্রিয়াসমূহও আমাদের নৈতিক বিপর্যয়ের একটা বড় কারণ। অতীতে নৈতিক বিধান যৌন সম্পর্ককে বিবাহের শর্তাধীন করে দিয়েছিল। কেননা বিবাহই হচ্ছে সম্ভাব্য একমাত্র উপায়, যার দরুন পিতাকে তার সন্তানের জন্যে দায়ী বানানো যেতে পারে। কিন্তু বর্তমানে যৌন সম্পর্ক ও বংশ বিস্তারের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। এরই ফলে নারী ও পুরুষের মধ্যকার সকল সম্পর্কও পরিবর্তিত হয়ে যেতে শুরু করেছে। (১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১২০)
নাগরিক জীবন বিয়ে-শাদীর পথে প্রতিবন্ধকতা দাঁড় করিয়ে দিয়ে যৌন-উচ্ছৃঙ্খলতা ও স্বেচ্ছাচারিতার অসংখ্য উপায় ও পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তখন যৌন বয়ঃপ্রাপ্ততাও ছিল বিলম্বিত। সামন্তবাদী অর্থ ব্যবস্থতায় যৌন-লালসা দমন করা যুক্তিসম্মত ব্যাপার মনে হতো। কিন্তু এক্ষণে শিল্পভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় তা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। কেননা শিল্প ব্যবস্থা লোকদিগকে ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত বিয়ে করার সুযোগ হতে দেয় না। ফলে লোকদের মধ্যে যৌন –উত্তেজনা জাগে, কিন্তু আত্মসংযমের যোগ্যতা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এখন অবস্থা এই দাঁড়ায় যে, সতীত্ব ও চারিত্রিক পবিত্রতা একটা ঠাট্টা ও বিদ্রূপের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। লজ্জা-শরমের নামচিহ্ন কোথাও থাকল না। পুরুষরা নিজেদের চারিত্রিক উচ্ছৃঙ্খলতার জন্যে গৌরব বোধ করত। নারীকূল নির্লজ্জতায় পুরুষের সমকক্ষতার দাবি করছিল। বিয়ের পূর্বেই যৌন সঙ্গম একটি সর্বজনজ্ঞান রীতি হয়ে দাঁড়াল।
এতদিন সামন্তবাদী ব্যবস্থার নৈতিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল। একালের শিল্পস্তরে এ নৈতিকতার কোনোই মূল্য নেই।–[এখানে মনে রাখা আবশ্যক যে, গ্রন্থকার আলোচনা করেছেন ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার আলোকে। অর্থনৈতিক বিপ্লবকে তিনি নৈতিক বিপর্যয়ের কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন অথচ এই মূল সত্যতার দৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেছে যে, যে সমাজতন্ত্র লোকদের জীবিকাদানকারী, এবং যা মানুষকে পুঁজিবাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে, তা যুবকদেরকে যথাসময়ে বিয়ে করার দিকে উদ্ধুদ্ধ করেনি। অথব ওর দাবি হল তা মানুষের স্কন্ধ থেকে অর্থনৈতিক বোঝা তুলে নিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তা অর্থনৈতিক বিপ্লব নয়, মনুষ্যত্ব ও মানবতাকে চিরদিনের জন্যে ধ্বংস করার একটা ষড়যন্ত্র মাত্র।] (পৃ. ১২৬-১২৭)
বিবাহিত জীবনের এই বিলম্বের দরুন সমাজের ক্ষেত্রে কি কি ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে, তা অনুমান করা কঠিন। তবে বিবাহিত জীবনের স্বাভাবিক বিলম্ব সামাজিক বিপর্যয়ের মূলগত ও অধিক গুরুতর কারণ, সন্দেহ নেই। তাছাড়া বিবাহিত জীবনের পরবর্তীকালে যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা ও বাধা-বন্ধনহীনতা বিবাহের পূর্বেই এই অভ্যাস হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আমরা এই চাকচিক্যময় শিল্প যুগে কখনও কখনও জীবন ও সামাজিকতার কারণে সন্ধান করি এবং কখনও এই চিন্তা করে পড়ে থাকি যে, এটা এমন একটা জগৎ, যেখান থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোনোই উপায় নেই। আধুনিক কালের সমস্ত চিন্তাবিদও এই মতই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমেরিকার অর্ধমিলিয়ন মেয়ে নিজেদেরকে চরম যৌন-উচ্ছৃঙ্খলতার ও বন্ধনহীনতায় উৎসর্গ করে দিয়েছে। ক্লাব বানিয়ে দেবার কাজে সতত নিয়োজিত। সেই সাথে শিল্প যুগের আইনহীনতার শিকারও তারাই হয়েছে।
ছবির অপর দিকটিও কম দুঃখজনক নয়। কেননা যারই বিবাহিত জীবন গ্রহণে বিলম্ব হবে, সেই বাজারের মেয়েদের দিকে ঝুঁকে পড়বে। আর এই সময়ে নিজেদের যৌন লালসা চরিতার্থ করার জন্যে সাজসজ্জার নিত্য নতুন সরঞ্জাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে সুসংগঠিতভাবে পাওয়া শুরু হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে, যৌন আগ্রহ সৃষ্টি ও তাকে চরিতার্থ করার কাজে সাহায্যকারী উপায় ও পন্থা হিসেবে যা কিছু সম্ভব, মানুষের সাধ্যানুযায়ী তা সবই উদ্ভাবিত হয়েছে। (পৃ. ১২৭-১২৮)
স্পষ্ট ধারণা করা যাচ্ছে, ধর্মবিশ্বাসের ওপর ডারউইনের আক্রমণমূলক চিন্তাধারার কারণেই যৌন স্বাদ আস্বাদনের প্রবণতা অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। যুবকরা যখন দেখল যে, ধর্ম তাদের যৌন স্বাদ আস্বাদন প্রবণতার বিরোধী, তখন তারা ধর্মকেও অকেজো ও হীন-নগণ্য প্রমাণ করার শত-সহস্র কার্যকারণ সন্ধান করে নিল। (পৃ. ১৩৪)
কেননা বর্তমান যুগে বিবাহ তার যথার্থ বিশেষত্বসহ বেঁচে নেই। তা এখন নিছক একটা যৌন সম্পর্ক মাত্র হয়ে রয়েছে। এই কারণে দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবনের ভিত্তিই ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে; এক্ষণে পারিবারিক ও বিবাহিত জীবনে জীবনের লক্ষণসমূহ নিঃশেষ হয়ে গেছে। ফলে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে এক ধরনের অপরিচিত ও দূরত্ব লালিত-পালিত হয়ে উঠছে। বিবাহ বিচ্ছেদও ঘটছে। পুরুষের স্বভাবগত লালসা নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কেননা তা চরিতার্থ করতে তার স্ত্রী অক্ষম প্রমাণিত হয়েছে। (পৃ. ২২৫)
আসুন একালের জ্ঞানী-বিজ্ঞানীদের কাছে আমাদের কার্যকলাপের ফলাফলটা জিজ্ঞেস করলে কি জবাব পাওয়া যায়, তা আবার দেখি। একথা তো স্পষ্ট যে, তা নিশ্চয়ই আমাদের মনোবাঞ্ছা অনুরূপ হবে না। কেননা আমরা তো বিচিত্র ধরনের পরিবর্তন ও রদবদলের শিকার, তার পরিণতি নিশ্চিত ও অপরিহার্য।
অভ্যাস, প্রচলন ও বিভিন্ন ব্যবস্থাপনার এই সীমাহীন বন্যা প্রবারের পরিণতি কি আর হতে পারে, যখন পারিবারিক জীবন প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। একজন স্ত্রী গ্রহণের রীতি সকল গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে, তখন তো যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে বংশধারা রক্ষার লক্ষ্য চূড়ান্তভাবে ব্যাহত হয়ে পড়বে। যদিও এই ধরনের স্বাধীনমুক্ত সম্পর্ক স্থাপনের কাজটি বেশির ভাগ পুরুষই করবে, তবু নারীরা নিঃসঙ্গ জীবন যাপনের পরিবর্তে সেই পদ্ধতিকে এক মহা সুযোগ মনে করে দুই হাতে আঁকড়ে ধরবে ও বুকে জড়িয়ে রাখবে।
দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। নারী ও পুরুষ বিয়ের পূর্বেই যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অভিজ্ঞতা অর্জনে উদ্ধুদ্ধ হয়ে উঠবে। তালাকের ব্যাপকতা দেখা দেবে।
অতঃপর বিবাহ-ব্যবস্থাকে পুনরায় গড়ে তোলা হবে, যাতে থাকে অনেক বেশি সহজতা ও সুযোগ-সুবিধা। জন্ম নিয়ন্ত্রণ সাধারণ রেওয়াজে পরিণত হবে। সন্তান লালন-পালনের জন্যে ঘরের পরিবেশের পরিবর্তে সরকার চালিত শিশু পালন কেন্দ্রসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। (পৃ. ২৩৫-২৩৬)
এ সব উদ্ধৃতি পাশ্চাত্যের একজন গ্রন্থকারের বই থেকে নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অংকিত ঘৃণ্যতম চিত্র সম্মুখে প্রকট হয়ে ওঠার পর আর কি বলার থাকতে পারে?
গ্রন্থকার যে সব দোষ-ত্রুটি চিহ্নিত করেছেন, তা সেগুলোই, যা বাস্তবিকপক্ষেই যৌন উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে মানুষের মন ও সমাজের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। আধুনিক জাহিলিয়াত সম্পর্কে চক্ষু উন্মীলিত করার জন্যে তা-ই যথেষ্ট। এ সব দোষ গোটা মানবতাকে চূড়ান্ত ধ্বংসের মুখে এনে উপস্থিত করে দিয়েছে। কেবল নৈতিক চরিত্রই নয়, মানবীয় মন ও সমাজের কোনো একটি দিকও চরম বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায়নি। লেখক এই বইখানি ১৯২৯ সনে লিখেছিলেন। আর আমরা এখন বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের (শেষ প্রান্তে) পৌঁছে গেছি। এ হচ্ছে মহাজাহিলিয়াতের শতাব্দী। আমরা লক্ষ্য করছি, গ্রন্থকার যা কিছু বলেছেন, এতদিনে তা সবই সংঘটিত হয়ে গেছে, পৃথিবীর সকল দেশে তা ছড়িয়ে পড়েছে। জাহিলিয়াত নিজেও যদি তা খতম করতে চায়, তবু তা খতম করার কোনো সাধ্য তার নেই। কেননা লাগাম তার হাত থেকে ছুটে গেছে। এই ব্যাপক বিপর্যয়ের ওপর তার কর্তৃত্বও এখন নেই।
কিন্তু উপরোদ্ধৃত উদ্ধৃতিসমূহ বিপর্যয়ের সর্ব ব্যাপারের দিকে ইঙ্গিত করেনি কিংবা তাতে তার বিস্তৃতি রূপও বিধৃত নয়। এই বিষয়ে এ গ্রন্থকার ‘বস্তুবাদ ও ইসলাম’ শীর্ষক গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছে ‘যৌন সমস্যা’ শীর্ষক অধ্যায়ে। আলোচ্য বিষয়ের আমি অপর এক দৃষ্টিকোণ দিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেছি ‘বিবর্তন ও স্থিতি’ নামের গ্রন্থে। কাজেই এখানে সেসবের পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। এখানে এই পাগলা জাহিলিয়াতের একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র অংকিত করাই যথেষ্ট হবে। জাহিলিয়াত যখন যৌন-সংক্রান্ত ব্যাপারাদিতে মানুষের সম্পর্ক ‘মনুষ্যত্ব’ থেকে ছিন্ন করে পশুত্ব বা পাশবিকতার সাথে যুক্ত করে দিয়েছে, তখন তার পরিণতি কতটা সাংঘাতিক হতে পারে, তা এ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় প্রকট হয়ে উঠবে।
আল্লাহ তা’আলা মানবীয় প্রকৃতিকে একটি মানদণ্ড ও নিয়ম-শৃঙ্খলা সমন্বিত সত্তা করে সৃষ্টি করেছেন। তা জীবনীশক্তিকে যেমন নিয়ন্ত্রিত করে, তেমনি তার পরিমাণও সুনির্দিষ্ট করে। তাই যখনই তার মানদণ্ডত্ব শেষ হয়ে যাবে, নিঃশেষ হয়ে যাবে তার নিয়ম-শৃঙ্খলা, তখন তা আর কল্যাণময় থাকবে না, মানুষ নিজে বা তার সমাজ তা থেকে একবিন্দু কল্যাণ লাভ করতে পারবে না। যে সৌভাগ্য অর্জন তাদের লক্ষ্য, তা পাওয়া থেকেও তাদের বঞ্চিতই থাকতে হবে।
প্রকৃতির বিরোধিতা করেও কোনো লাভ হবে না। কেননা সকল বাতিল দলীলের ওপর প্রকৃত দলীলই বিজয়ী হয়ে থাকে। তা রোধ করার সাধ্য কারোরই নেই। এখানে ইচ্ছা ও কামনা-বাসনার কোনো যুক্তি চলতে পারবে না।
পূর্ববর্তী ভয়াবহ জাহিলিয়াতের বন্ধন থেকে মানুষ যখন মুক্তি পেল ও নফসের কামনা-লালসার সামগ্রীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, থাকল না কোনো বাধা বা প্রতিবন্ধকতা, তখন বাস্তব ক্ষেত্রে কি ঘটেছিল? …এক্ষণে এই বিষয়ে চিন্তা-বিবেচনা করতে হচ্ছে।
….যৌন লালসা চরিতার্থ করে লোকেরা কি পরম পরিতৃপ্তি লাভে ধন্য হয়েছে? স্বাধীনতা ও বন্ধনমুক্তি আন্দোলনের নেতারা বলত, যে কোনো প্রকারের প্রতিবন্ধকতা ও বিধি-নিষেধই মানুষের মনে সেই প্রচণ্ড যৌন-লালসা ও ক্ষুধা জাগিয়ে দেয়, যা কখনোই পরিতৃপ্ত হয় না। তখন মানুষ স্থায়ীভাবে যৌন কর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়, যার দরুন স্নায়ুমণ্ডলী নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, সমস্ত শক্তি-ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যায়।
হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে, যুক্তিসঙ্গত সীমারংঘন করে বেশি দিন যৌন পরিতৃপ্তি থেকে বিরত থাকলে সে অবস্থার সৃষ্টি হওয়া কিছুমাত্র অসম্ভব নয়। তার স্বভাবসম্মত কোনো কারণ নেই। কিন্তু এর বিপরীত সীমা ও বাধা-বন্ধনহীন যৌন লালসা চরিতার্থ করার পরিণতি কি হতে পারে।
সকলেরই জানা, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশসমূহের সর্বত্র যৌন সামগ্রীকে সর্বসাধারণের জন্যে সহজলভ্য করে দেওয়া হয়েছে। সরকার সে দিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না কিংবা নানাভাবে সেকাজকে অধিকতর উৎসাহিত করে যাচ্ছে। এই বিধি-নিষেধ, ভয়-ভীতি ও শাস্তি-দণ্ড বিমুক্ত স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ কি এ ব্যাপারে মানুষকে কিছুমাত্র পরিতৃপ্ত করেছে?
নিরংকুশ পরিতৃপ্তি পেয়েও যৌন-ক্ষুধা কি তার তীব্রতা কমাতে পেরেছে এক বিন্দু?
এ কালের লোকেরাই বা কেন যৌন সংক্রান্ত ব্যাপারাদি নিয়ে এত জটিল সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছে?
চারদিকে কত ফিল্ম, কত বই-পত্র… কত গল্প-উপন্যাস …কত নগ্ন নির্লজ্জ ছবি ও চিত্র, রেডিও-টেলিভিশনে যৌন লালসাপংকিল কত অনুষ্ঠান, ….কত গান, কত বাজনা ও বাদ্য …নগ্নদের সত সভা-সমাবেশ, কত অর্ধগ্ন নারী-পুরুষের মিলিত নৃত্য সমাবেশ …উভয় লিঙ্গের মিলিত যৌবন জোয়ারের কত না প্রবাহ….
আর এ সব ক্ষেত্রে কত শত-সহস্রবার যৌন সঙ্গম ও মিলন সংঘটিত হচ্ছে অবাধে ও অতীব সহজে….
কিন্তু দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা যৌন-লালসার এ আগুন কেন নিভছে না?
না, না, আমরা চরিত্রের প্রশ্ন তুলছি না! আমরা মানসিক শান্তি, স্বস্তি ও স্থিতির কথাই বলছি, যা প্রতিটি মানব মনের প্রচুরভাবে থাকা একান্তই অপরিহার্য। কেননা মানুষকে তো এই দুনিয়ায় এক বিরাট দায়িত্ব পালন করতে হবে, সে দায়িত্ব জন্তু-জানোয়ারের জন্যে নয়। মানুষ তো ভিন্নতর, তার দায়িত্বও স্বতন্ত্র প্রকৃতির! আমরা অবশ্য মানবীয় মূল্যমানের কথা বলছি। কেননা তা-ই তো মানুষের অন্তরকে গঠন করে। সুউচ্চ সঠিক লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে তা হচ্ছে অপরিহার্য জীবন মান। তা মানুষকে সার্বিকভাবে সম্মুখের দিকে এগিয়ে নেয়।
এ হেন পাশবিক যৌন ক্ষুধা পরিতৃপ্তি লাভের সর্বপ্রকারের সুযোগ সুবিধা পেয়েও যে পরিতৃপ্তি হচ্ছে না, তার পরিণতি কি হতে পারে?
বর্তমান মানুষের মনে এক স্থায়ী অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা বাসা বেধেঁছে। স্নায়ুবিক চাপ মানুষকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে, এ যে চরম মাত্রার পাগলামী। এ যে ধ্বংস …আত্মহত্যা… যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা ও বাধা-বন্ধনহীনতার এক বিশেষ অবদান, বিশ্বমানবতা আজ পর্যন্ত তার এই ফলই তো পেয়েছে …নয় কি?
হ্যাঁ, পারিবারিক জীবনের প্রশ্ন উঠেছে।
সীমা ও বাধাবন্ধন মুক্ত যৌন লালসা পরিতৃপ্তির এই নিরংকুশ প্রবাহ থেকে পরিবার কি লাভ করেছে?
না, পারিবারিক জীবনে কোনো শান্তি নেই, নেই কোনো স্বস্তি স্থিতি, স্বামীতে-স্ত্রীতে নেই সত্যিকার কোনো সম্পর্কের বন্ধন, নেই পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা। কেননা যে কচি শিশু সন্তান এই বন্ধনকে অত্যন্ত গভীর ও হৃদয়াসীন বানিয়ে দেয়, সেই শিশুই তো এখন অনুপস্থিত। এমতাবস্থায় সে বন্ধন কি করে সুদৃঢ় হতে পারে, হৃদয়ের সাথে সে সম্পর্ক কি করে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হতে পারে?
এক্ষণে তো পারিবারিক জীবনটা ঠিক পশুকুলের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন অনেক পশুও তো রয়েছে, যারা উভয় মিলে একত্রে বসবাস করে জীবন কাল ব্যাপী। কিন্তু মানুষ তা থেকেও আজ নির্মমভাবে বঞ্চিত।
কিন্তু কেন? ওয়াল ডেভরাষ্টের মতে তার কারণ হচ্ছে নারী-পুরুষের এই অবাধ যৌন চর্চা।
একালের যুবক-যুবতীরা নৃত্যগীতের অনুষ্ঠানে, ঘরে বাইরে নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশার সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে, পথে-ঘাটে, রাজপথে, পাঠাগারে, লাইব্রেরী ও ক্লাস কক্ষে, শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রে, বনে-জঙ্গলে ও সমুদ্রতীরে সাময়িক বা স্থায়ী ক্যাম্পসমূহে রাত ও দিনে যুবক-যুবতীরা অবাধ মেলা-মেশার বিপুল সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে।
অবশ্য তার স্বপক্ষে যুক্তি স্বরূপ বলা হয়, এমন মিলনকেন্দ্রে জরুরী হচ্ছে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করার জন্যে। এখানেই প্রত্যেক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সাথে গভীরভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এমন কি যুবক-যুবতীরা পরস্পরের সাথে যৌন মিলন ঘটিয়ে মেজাজ প্রকৃতি ও যৌন ক্ষমতার সামঞ্জস্যও খুঁজে নিতে পারছে। এরূপ অভিজ্ঞতা ভিন্ন মিলিত দাম্পত্য জীবন শুরু করা হলে নাকি অনভিজ্ঞতার দরুন তা ব্যর্থ হয়ে যেতে বাধ্য হয়।
কিন্তু পরে এ লক্ষ্য আর সম্মুখে থাকে না। তখন উপলক্ষটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। শুধু অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে কেবল একজন হলেই চলে না, বহুজনের সাথে মিলিত হয়েই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হয়। শেষ পর্যন্ত এই অভিজ্ঞতা অর্জনই অভ্যাসে পরিণত হয়। বিয়ের স্থায়ী বন্ধন কারুর সাথে কখনোই গড়ে ওঠে না।
হ্যাঁ, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে নিজের জীবনসঙ্গী সংগ্রহ করে নেওয়া হয়ত যুবক-যুবতীর পক্ষে সম্ভবপর হয়। পরস্পরের মিলিত হয়ে ঘর বাঁধে খুব কচিৎ সংখ্যক নারী-পুরুষ। কিন্তু সে ঘরের আয়ু বড় জোর কয়েক মাস। কিংবা কতিপয় বছরেই শেষ হয়ে যায়।
অতঃপর সে সম্পর্কের অবসান ঘটে। কেননা সেটা তো মানবীয় সম্পর্ক নয়, যা স্থায়িত্ব পেতে পারে। এ হচ্ছে নিছক পাশবিক যৌন সম্পর্ক মাত্র। এ হচ্ছে যৌন উত্তেজনায় উত্তেজিত ও উত্তপ্ত দুটি দেহের মিলন ঘটিত সম্পর্ক। এই যৌন সম্পর্কই ছিল বন্ধুত্বের ভিত্তি। বৈবাহিক বন্ধনের ফলে যদি পুত্র বা কন্যা সন্তান জন্মে তবেই তাদের অনুভূতির ওপর প্রভাব প্রতিফলিত হয়। কিন্তু তা তো এখানে হতে পারছে না।
এরূপ অবস্থায় বিবাহ একটা বন্ধন বা জেলখানার রূপ পরিগ্রহ করে, সেখানে গতিশীলতা বলতে –জীবনের স্পন্দন বলতে কিছুই থাকে না।
এই পুরুষ ও নারী স্বামীত্ব-স্ত্রীত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত সেই প্রাথমিক বন্ধুতে ফিরে যায়। তখন কেউ কারোর স্বামী নয়, কেউ স্ত্রী নয় কারুর, দুই ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব, তার একজন পুরুষ, আর অপরজন স্ত্রী। এ-ই তাদের চূড়ান্ত পরিচয়। নারী তো নিজের হাস্যে-লাস্যে চিরদিন ভরপুর হয়ে থাকে। পুরুষও থাকে সব সময় নারীদের জন্যে আকর্ষণীয় হয়ে। তখন নূতন করে ‘বন্ধুত্বের’ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই সম্পর্কই ঠিক ততদিনই স্থায়ী হয়, যতদিন তাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক রক্ষার ক্ষমতা স্থায়ী থাকে।
এ ভাবেই স্বামী-স্ত্রীর স্বরূপ বদলে দিয়ে বন্ধু ও বান্ধবীতে পরিণত হয়। তখন তারা স্বামী-স্ত্রী নয়, প্রেমিক-প্রেমিকা মাত্র। …অথবা এক সময় দুজন এমনভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যে, পারস্পরিক পরিচিতিরও কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।
আমেরিকায় এই কলংকময় যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, সরকারী আইনের সাহায্যও তার অনুকূলে রয়েছে বলে তা যেমন অবাধ, তেমনি নির্ভীক, সকল প্রচার-মাধ্যমের উপায়-উপকরণ লোকদেরকে এদিকে আকৃষ্ট করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে সেজন্যে একান্তভাবে নিয়োজিত হয়েছে। এটিকে রীতিমত একটি পূর্ণাঙ্গ দর্শনে পরিণত করা হয়েছে। লেখকগণ তাদের প্রকাশ ক্ষমতা ও বর্ণনা বিশ্লেষণের প্রতিভা এই কাজে লাগিয়ে দিয়েছে পুরামাত্রায়। ফলে এখানে ব্যাপকভাবে তালাক সংঘটিত হচ্ছে। আমেরিকান ক্যাথলিক রাজ্যসমূহে তালাক নিষিদ্ধ হলেও অ-ক্যাথলিক রাজ্যসমূহে প্রত্যেক একশত দম্পতির মধ্যে চল্লিশটিতেই তালাক সংঘটিত হচ্ছে। এই হার ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু তার অর্থ কি দাঁড়ায়? ….দাম্পত্য জীবন সেখানে ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে, তাই নয় কি?
আর এই তালাক সংঘটিত দম্পতির সন্তানদের অবস্থা কি? অত্যন্ত মর্মান্তিক; এই সন্তানরা হয় হতচ্ছাড়া। তারা তাদের স্বাভাবিক লালনকেন্দ্র থেকে বঞ্চিত হয়ে এমন ছন্নছাড়া হয়ে পড়ে যে, পারিবারিক বন্ধন বা পিতামাতার স্নেহের সম্পর্ক বলতে কোথাও কিছু পায় না। সবকিছু থেকেই তারা বঞ্চিত হয়ে পড়ে চিরদিনের জন্যে। তখন এসব আশ্রয়হীন সন্তানদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেওয়ার জন্যে কি ব্যবস্থা হতে পারে, কোথায় সেই সামাজিক নিরাপত্তা? …কোথায় মানসিক শান্তি ও স্বস্তি?
এসব ছাড়াও সন্তানরা আর এক কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়ে যায়। আর তা হচ্ছে, এসব ছেলেমেয়ে যেহেতু সীমালংঘনমূলক যৌন উত্তেজনাপূর্ণ পংকিল সমাজ পরিবেশে পড়ে যায়, এই কারণে তাদের মধ্যেও তাদের প্রকৃত যৌবনের উন্মেষের পূর্বেই তারা যৌনতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন তাদের ঘর বাঁধার সামর্থ্যও হয় না, হয় না পারিবারিক জীবন যাপনের কোনো অভিজ্ঞতা। স্থায়ী দাম্পত্য জীবন গড়ে তোলা তাদের পক্ষে কোনো দিনই সম্ভব হয় না। তারা পূর্ণ বয়স্ক হওয়ার পূর্বেই যৌন সংস্পর্শে এসে নিতান্তই পাপ পংকিল জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। তাদের যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা রোধ করতে পারে এমন নিয়ম-কানুন বা আইন-শাসনও কোথাও নেই। ….শেষ পর্যন্ত তারা যৌন উচ্ছৃঙ্খলতার শিকার হয়ে চূড়ান্ত ধ্বংসের মুখে নিপতিত হয়।
এই ক্রমবর্ধমান উচ্ছৃঙ্খলতা সেই সব দেশেই প্রবল আকার ধারণ করেছে, যেসব দেশে যৌন সম্পর্ককে বাধা বন্ধনমুক্ত করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এই পর্যন্ত যে মারাত্মক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তা এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা সম্ভব নয়। আমেরিকা যৌন জীবন সম্পর্কে ‘কানরী’-র ভাষণ সর্বপ্রথম বৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন। কিন্তু তাতে শুধু পরিসংখ্যানেরই উল্লেখ হয়েছে। এ অবস্থায় প্রকৃত কারণ কি? তা যেমন তাতে উল্লেখ করা হয়নি, তেমনি অবস্থার প্রতিকারের উপায় বা পন্থাও বলা হয়নি।
যেসব দেশে যৌন মিলনকে সর্বপ্রকার বাধা বন্ধনমুক্ত ও উদার করে দেওয়া হয়েছে এবং তা সর্বত্র ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়ে পড়েছে, যে সমাজে মেয়েরা পুরাপুরিভাবে নগ্ন হয়ে ঘরে ও সমাজে পূর্ণ যৌনতার প্রতীক হয়ে বসেছে, সেই সব সমাজের বিস্তারিত কলম-চিত্র আমার লিখিত অন্যান্য গ্রন্থাদিতে অংকিত করেছি। এখানে তার পুনরুল্লেখ না করে একটি মহাসত্য উদ্ভাসিত করে তুলতে চাই।
বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা এবং আধুনিক জাহিলিয়াত উদ্ভাবিত যৌন উদারতার সাথে সেই সত্যের সুস্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। পরিসংখ্যানের আলোকে সে সত্য উদঘাটিত হবে।
এই যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা উদারতার সৃষ্টি নৈতিক পতনের দরুনই বর্তমানের বিশ্ব জাতিসমূহ অধঃপতনের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে টিকে থাকা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এক্ষণে নৈতিক বিপর্যয় সরকারের প্রশাসন যন্ত্রকে প্রভাবিত করেছে। অবস্থার পতন এতদূর হয়েছে যে, শুধু যৌন স্বাদ আস্বাদনের লোভে পড়ে রাষ্ট্রের সামরিক গোপন তথ্য শত্রু পক্ষের গোয়েন্দাদের কাছে বিক্রয় করে দিতেও কুণ্ঠা বা লজ্জা বোধ করা হচ্ছে না। ইংল্যাণ্ডের প্রফোমো ও আমেরিকার রাজনৈতিক কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গের চারিত্রিক ভূমিকা বিশ্ব সমক্ষে প্রতিভাত।
একালে আমেরিকা ও রাশিয়া দুটি প্রধান পরাশক্তি। কোনো একটিও নিজ নিজ দেশের যুবকদের নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতার কারণে তাদের ওপর একবিন্দু আস্থা রাখতে পারেনি। ভবিষ্যতে নিজেদের র্দেশকেও যে তারা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে, তার ওপর একবিন্দু বিশ্বাস স্থাপন করা যাচ্ছে না।
এ হচ্ছে প্রতিশোধ …প্রকৃতির চ্যালেঞ্জ।
এটা সংকীর্ণ অর্থে নিছক চারিত্রিক সমস্যাই নয়। প্রকৃতপক্ষে এ হচ্ছে গোটা মানবতার ভবিষ্যতের প্রশ্ন।
নৈতিক উচ্ছৃঙ্খলতা ও বন্ধনহীনতা যৌন উদারতাই সমগ্র মানব গোষ্ঠীকে টুকরা টুকরা করেছে, ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে। মানুষকে বানিয়ে দিয়েছে একেবারে পশু! পশুদের যেমন যৌনতার ব্যাপারে কোনো নিয়ম-নীতির বাধা নেই, এদের সমাজেও আজ অনুরূপ অবস্থা…. হয়ত বা তার চাইতেও মারাত্মক।
আমার লিখিত ‘বিবর্তন ও স্থিতি’ নামের গ্রন্থে আমি বলেছি, এই যৌন বাধা-বন্ধনহীনতা ও তার নিশ্চিত অনিবার্য পরিণতি কেবলমাত্র বর্তমান জাহিলিয়াতেরই কোনো বিশেষ ব্যাপার নয়। পৃথিবীর বুকে আজ পর্যন্ত যখন যেখানেই যে-জাহিলিয়াতই বর্তমান ছিল বা আছে, সেইসব জাহিলিয়াতে এই অবস্থায়ই দেখা দিয়েছে অনিবার্যভাবে। গ্রীক জাহিলিয়াত, রোমান জাহিলিয়াত, পারসিক জাহিলিয়াত –এই সব কয়টি অবস্থা সম্পূর্ণরূপে অভিন্ন। সে সব ক্ষেত্রে যা সাধারণ অবস্থা ছিল বর্তমান নব্য জাহিলিয়াতেও ঠিক সেই অবস্থায়ই বিরাজিত। তা গোটা মানবীয় সত্তাকেই ধ্বংসের মুখে পৌঁছিয়ে দিয়েছে।
তবে একথা অবশ্যই স্বীকৃতব্য যে, ধ্বংসকারিতার দিক দিয়ে আধুনিক জাহিলিয়াতের শক্তি ক্ষমতা অবদান অন্যান্য জাহিলিয়াতের তুলনায় অধিক বীভৎস, কঠিন ও জঘন্য। কেননা তা পূর্বের জাহিলিয়াতগুলোর ন্যায় বিপর্যয় সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হয় না, তাকে সর্বপ্রকারের বৈজ্ঞানিক সহযোগিতাও দিয়ে যাচ্ছে, যার কোনো লক্ষণ পূর্বে কখনোই দেখা যায়নি।
হ্যাঁ, বিপর্যয় ও বিপথগামিতাকে যেসব মতবাদ ও ধর্মবিশ্বাস সমর্থন দেয় এবং নৈতিকতার বন্ধন ঢিলা করণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে তা অবশ্য পূর্বের প্রতিটি জাহিলিয়াতেই ছিল। কিন্তু তাকে কখনোই বৈজ্ঞানিক পোশাক পরাতে কোনোটিই চেষ্টা করেনি। এ দিক দিয়ে আধুনিক জাহিলিয়াত অনন্য ভূমিকা পালন করছে। এখন ধ্বংসকে বিজ্ঞানের ভূষণে সজ্জিত করে জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করে দেওয়া হচ্ছে।
সেই সাথে রয়েছে সব আধুনিক প্রচার মাধ্যম –সাংবাদিকতা, রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা, ভি.সি.আর, ইত্যাদি নিত্য সব আবিস্কৃত উপায়-উপকরণ, এগুলো পূর্বে কোথাও ছিল না। বর্তমানে বিশ্ব ইহুদীদের রয়েছে এসব ধ্বংসাত্মক উপায়-উপকরণের পেছনে। তা এই বিপর্যয়কে ‘সাবাস’ দিচ্ছে। উম্মী লোকদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তার দুটি হাত অত্যন্ত আনন্দ সহকারে কাজ করে যাচ্ছে।
আমরা বিষয়টিকে নৈতিক চরিত্রের সংকীর্ণ অর্থে গ্রহণ করতে কখনোই চাইনি। লোকেরা যে মনে করে, চরিত্র ‘জীবন’ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর একটা জিনিস, তা আমরা কখনোই সত্য বলে গ্রহণ করতে রাজি হইনি।
কিন্তু বিংশ শতাব্দীর জাহিলিয়াতের যে বাস্তব সত্য আমরা স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করছি, তা হচ্ছে নৈতিক চরিত্রের বিপর্যয় মানুষের মন সমাজ ও জীবনের চূড়ান্ত ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর নৈতিক বিপর্যয় মুহুর্তের মধ্যে সমস্ত বাস্তব জীবনকে গ্রাস করে ফেলে।
বাস্তব জীবনের বিপর্যয় মূলত ণৈতিক চরিত্রেরই বিপর্যয়। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও যৌন যে কোনো পর্যায়েরই বিপর্যয় হোক –মূলত তা মানব প্রকৃতিরই বিপর্যয়। কেননা নৈতিকতা বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কহীন কোনো মতাদর্শমূলক ব্যাপার নয়। বস্তুত নৈতিকতা হচ্ছে প্রকৃতির স্থায়ী অপরিবর্তনীয় মৌল নীতি। প্রকৃত মানব জীবনেই তা সতত কার্যকর।
হ্যাঁ, বর্তমান কালের নবতর জাহিলিয়াত জ্ঞান-বিজ্ঞানে ধন্য, সমুদ্ভাসিত, আলোকোজ্জ্বল। অথচ প্রকৃতির বুকে নিহিত নিগূঢ় সত্য সম্পর্কে তা-ই হচ্ছে সবচাইতে বেশি অজ্ঞ ও মূর্খ। যে প্রাকৃতিক নিয়মাবলী মানুষের চরিত্র গড়ে তোলে, সে সম্পর্কেও তা কিছুই জানে না।