আচার-আচরণে বিপর্যয়
আধুনিক জাহিলিয়াত আল্লাহর দাসত্ব স্বীকার থেকে যখন বিপথগামী ও বিভ্রান্ত হলো তখন সম্ভবত এই ধারণা করতে পারেনি যে, আকীদা-বিশ্বাসের বিকৃতি বিশ্বলোক, মানুষ ও জীবন সম্পর্কিত ধারণায় চরম বিকৃতি ও বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে অনিবার্যভাভে। শুধু তাই নয়, শুরু থেকৈই তা বাস্তব কর্মজীবনে সূচিত যথার্থতা থেকে বিকৃত লক্ষ্য করতে পারেনি। কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতটিতে যেন তার অবস্থারই বাস্তব চিত্র অংকিত হয়েছেঃ
(আরবী************************************************************************************)
ওরা শয়তানদেরকে নিজেদের অভিভাবক রূপে গ্রহণ করেছে আল্লাহকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে। আর তারা মনে মনে ধারণা পোষণ করছে যে, তারা বুঝি সঠিক পথ প্রাপ্ত হয়েই আছে। (সূরা আল-আরাফঃ ৩০)
কিন্তু আমরা পূর্ববর্তী অধ্যায়ের আলোচনায় দেখেছি যে, আকীদা বিশ্বাসে সৃষ্ট বিপথগামিতা জাহিলিয়াতের সকল বিষয়ের ধারণা বিশ্বাসই ব্যাপক বিকৃতি ঘটিয়েছে। ফলে তার উপস্থাপিত যাবতীয় ধারণা বিশ্বাসেই চরমভাবে বিকৃত হয়ে গেছে। কোনো একটিও সঠিক নেই, কোনো যুক্তির ওপরই কোনো একটি ধারণাও দাঁড়িয়ে নেই। কোনো একটি ধারণাও নয় সত্য ও নির্ভুল। আসলে জাহিলিয়াতকে পরিচালিত করছে কতিপয় ব্যক্তির খাম-খেয়ালী, ভিত্তিহীন ধারণা-কামনা-বাসনা এমনকি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বাস্তব অভিজ্ঞতালব্ধ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বেও বিকৃত ঘটিয়েছে। অথচ জাহিলিয়াতের প্ররোচনায় অনকে লোকেরই ধারণা হচ্ছে, পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান ভিত্তিহীন ধারণা অনুমান থেকে অনেক অনেক দূরে অবস্থিত। কিন্তু আসলে তা সত্যের বাকচাতুর্য ও প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের ধারণায় বিজ্ঞানই হচ্ছে সকল ব্যাপারে পবিত্রতা। তা-ই সত্য মিথ্যা নির্ধারক। আর তাতে কোনোরূপ দ্বিধা সন্দেহের স্থান নেই।
আমরা বিজ্ঞানীদের দেওয়া সাক্ষ্যসমূহ ইতিপূর্বেই শুনতে ও পড়তে পেরেছি। জানতে পেরেছি তাদের উক্ত ধারণা কতই না ভিত্তিহীন। তা থেকে এ-ও নিঃসন্দেহে জানা যায় যে, বিজ্ঞান কখনোই চূড়ান্ত ও নিশ্চিত কথা বলে না, বলতেই পারে না। দিতে পারে না কোনো দৃঢ় প্রত্যয়পূর্ণ সত্যভিত্তিক বিশ্বাস। বিজ্ঞান শুধু সম্ভাব্যতার কথা বলে। তা মানুষের নিজস্ব কামনা-বাসনার পুরোপুরি অধীন। মানুষের ধারণার ভিত্তিতেই বিজ্ঞানের দিক নির্দেশ করা হয়, আর সর্বোপরি, বিজ্ঞান শুধু বস্তুর বাহ্যিক দিকের অধ্যয়নের ফসল, প্রকৃত অন্তর্নিহিত মহাসত্য পর্যন্ত তার গতি নেই।
কিন্তু লোকেরা জাহিলিয়াতের প্রভাবে পড়েই মনে করেছে যে, ধারণা বিশ্বাস বিকৃত ও বিপথগামী হলেও বাস্তব জীবন ও আচার-আচরণ অবশ্যই ঠিক হবে। রাজনীতি, সমাজ-ব্যবস্থা, অর্থনীতি, নৈতিকতা ও শিল্প সাহিত্য সবই ঠিকভাবে চলবে, কোথাও বিকৃতি দেখা দেবে না। কোনো চিন্তা ও মতাদর্শ এক জিনিস আর বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।
মতবাদ-মতাদর্শ তো মানুষের চিন্তার ফসল, মানুষের কামনা-বাসনারই ফলশ্রুতি, কিন্তু বাস্তবায়ন সম্পূর্ণ বাস্তব ও অভিজ্ঞতার ব্যাপার। তারই ওপর গড়ে ওঠে নানা সংগঠন ও সংস্থা। পূর্বে আকীদার কারণে যা বিপর্যস্ত হয়েছিল তা এক্ষণে সঠিক হয়ে ওঠে, ফলে তা সম্পূর্ণ নির্দোষ ও সুদৃঢ় হয়।
এই প্রেক্ষিতেই পাঠ করতে হয় কুরআন মজীদের এ আয়াতটিঃ
(আরবী*******************************************************************)
বলো, আমরা কি তোমাদেরকে জানিয়ে দেব, সেই লোকদের অবস্থা, যারা আমলের দিক দিয়ে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত। ওরা সেই লোক, যাদের সব চেষ্টা সাধনাই বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়ে গেছে দুনিয়ার জীবনে। অথচ ওরা মনে মনে ধারণা করেছে যে, তারা খুবই ভালো কাজ করেছে। (সূরা কাহাফঃ ১০৪)
প্রচীনকালে একজনের কথাঃ লাঠি বাঁকা হলে তার ছায়া কি কখনও সোজা ঋজু হতে পারে?
আর আসলে এটা হচ্ছে জাহিলিয়াত সৃষ্ট আর একটি ভিত্তিহীন ধারণা। বর্তমান জাহিলিয়াতের যুগে বাহ্যিকভাবে ভালো যা-ই সংঘটিত হয়, তা দেখেই ওরা প্রতারিত হয়। কোনো কোনো ব্যাপারে কিছু কিছু মানুষযদি আংশিকভাবে সত্য পথগামী হয়ও, তাহলে তাই দেখেই ওরা মনে করে নেয় যে, না, সবই ঠিক আছে। কিছুমাত্র ত্রুটি বা বিকৃতি ঘটেনি।
পূর্বে আমরা স্পষ্ট করে প্রকাশ করেছি যে, যে কোনো জাহিলিয়াতই সম্পূর্ণরূপে কল্যাণশূন্য হয় না। প্রতিটাতেই ফায়দার একটা দিক থাকে। ফলে তা দেখে লোকরা চরম বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। মনে করতে থাকে যে, না, সবই ভালো হচ্ছে, অন্যায় কিছুই হচ্ছে না। কিন্তু আসলে তা ক্ষয়িষ্ণু ভালো। প্রকৃত কল্যাণের তা কিছুমাত্র অনুকূল নয়, প্রকৃত কল্যাণের পথ উন্মুক্তকারীও নয় তা। তা মনযিলে পৌঁছিয়ে দেওয়ার পথেও চলছে না।
অনুরূপভাবে একথাও আমরা স্পষ্ট করে বলেছি যে, আধুনিক জাহিলিয়াত সৃষ্ট বিপদ অত্যন্ত ভয়াবহ এবং তা বিজ্ঞানেরই ফসল। জীবনকে সহজতর করার জন্যে এই বিরাট আবিস্কার উদ্ভাবন। কিন্তু তার বাহ্যিক কল্যাণধর্মী চেহারা দেখেই সমস্ত মানুষ গভীরভাবে প্রতারিত ও বিভ্রান্ত হয়েছে। এ কারণেই তারা মনে করেছে যে, প্রকৃত কল্যাণই বিজয়ী হয়ে আছে এবং সব কিছুই যথাযথভাবে চলছে ও অগ্রহর হচ্ছে।
হ্যাঁ, শয়তাহের বিরাট বিশাল উপায় উপকরণের কারণেই তারা অন্যায়, অসত্য ও পাপের প্রকৃত রূপ জানতে ও বুঝতে পারেনি। যদিও তারা তারই পরিবেষ্টনের মধ্যে জীবন যাপন করতে পারত, তাদের জীবনের বাস্তবতায় যে মারাত্মক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে তারা যদি তার পরিমাপ করতে সক্ষম হতো, তাহলে তারা অবশ্যই এই তত্ত্বও পেয়ে যেত যতটুকু কল্যাণ দেখে আধুনিক জাহিলিয়াত বাহাদুরী করে বেড়াচ্ছে তার ভিতরকার কুৎসিত চেহারাকে লুকোবার উদ্দেশ্যে –আসলে তা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরো হয়ে বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাতে এক বিন্দু সত্য নিহিত নেই। তারা এও জানতে পারবে যে, অন্যায় জুলুম ও পাপের এই মহাসমুদ্রে এই সামান্যটুকু কল্যাণও ডুবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তারা আরও জানতে পারবে, মানুষের আসল জীবনটাই ধ্বংসের মুখে এসে গেছে। পাপ ও অন্যায়ের বিরাটত্বের চাপে গোটা পৃথিবীই এই মুহুর্তে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ধুলিকণায় পরিণত হতে যাচ্ছে।
কোনো কোনো লোক আধুনিক জাহিলিয়াতের মান রক্ষার্থে বলে বেড়ায় যে, যা কিছু খারাপ দেখা যাচ্ছে, তা তেমন মারাত্মক কিছু নয়। এ বিপর্যয় সমগ্র জীবনকে গ্রাস করেনি; বরং জীবনের কোনো কোনো দিকে হয়ত কিছু বা বিকৃতি লক্ষ্য করা যায় মাত্র। নৈতিকতার ক্ষেত্রে চরম বিকৃতি ও বিপর্যয়ের প্রশ্ন তুললে তারা বলে, হ্যাঁ! নৈতিকতার ক্ষেত্রে কিছুটা বিকৃতি এসেছে বটে, কিন্তু তা ছাড়া সমগ্র জীবনই তো পবিত্র ও সুস্থ-সঠিক রয়েছে।
শুধু তাই নয়, সব কিছুই অতি উত্তমভাবে চলছে। সবকিছুই উন্নতির উচ্চতর পর্যায়ের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে যে, তার ওধারে উন্নতির আরও অনেক স্তর বা দিক বাকী আছে, তা মনেই করা যায় না। না, তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন। আধুনিক জাহিলিয়াত এমন এক সর্বাত্মক সর্বগ্রাসী বিপর্যয় নিয়ে এসেছে মানুষের জীবনে, যার ব্যাপকতা ধারণার আওতার মধ্যেও আসে না। জীবনের দূরতম কোনো একটি দিকও তার কলুষতা থেকে মুক্ত ও পবিত্র থাকতে পারেনি।
বক্ষ্যমান অধ্যায়ে আমরা এই বিপর্যয়ের ব্যাপকতা –রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, নৈতিকতা, দুই লিঙ্গের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকল দিক ও বিভাগ পরিব্যাপ্ত বিপর্যয়ের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরব। কি করে তা সম্ভব হলো, তা-ও বলা হবে।
কিন্তু সে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করার পূর্বে এই সুস্পষ্ট সত্য উপস্থাপিত করতে চাই যে, এভাবে সব ধারণা বিশ্বাস বিপর্যস্ত হবে আর তারপরও বাস্তব জীবন ও জীবনের আচার-আচরণ সুস্থ ও সঠিক থাকবে, তা কখনোই সম্ভব হতে পারে না। এই সত্যের সত্যতা অবিসংবাদিত ও প্রশ্নাতীত।
সেরূপ হওয়া কিরূপেই বা সম্ভব হতে পারে?
আধুনিক জাহিলিয়াত তার ক্রমবর্ধমান বিরাট-বিপুল প্রকাশ ও প্রচারের উপায় উপকরণের সাহায্যে প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে প্রচার চালিয়ে এই ধারণা বিশ্বাসের বিকৃতি বিপথগামিতা থেকে লোকদের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফিরিয়ে রাখার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েছে। তা লোকদিগকে বোঝাতে চাচ্ছে যে, তারা যে বাস্তব অবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করছে, তা সর্বতোভাবে সুষ্ঠ সঠিক হওয়ার উচ্চমার্গে উন্নীত।
কিন্তু জনগণ যখন কোনো কোনো ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করল, তারা দেখাতে লাগল যে, এটা আল্লাহর ঘোষনার পরিপন্থি –এটা সত্য ও ন্যায়পরতার বিপরীত অথবা নৈতিকতার পক্ষে মারাত্মক তখন জাহিলিয়াত তার সর্বাত্মক প্রচার যন্ত্র লাগিয়ে জবাব দিতে ওঠে পড়ে লেগে যায়….।
বোঝাতে চায় যে, আরে, এ তো উন্নতি, অগ্রগতি ও ক্রমবিকাশ। তোমরা কি তা জানোনা, বোঝ না? ক্রমবিকাশের দ্রুত গতিশীলতার দিকে কি তোমার কোনো দৃষ্টি নেই? তুমি কি বিংশ শতাব্দীতে বাস করো না? ….এই শতাব্দী হচ্ছে বুদ্ধিমানদের চরম উন্নতির শতাব্দী। …তাহলে তুমি কি প্রতিক্রিয়াশীল? কি ব্যাপার! কি মুসিবত! সর্বক্ষেত্রেই প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখা যাচ্ছে! …বড়ই আফসোসের কথা! এখনও মানুষ প্রাচীনতার আবর্তে বন্দী হয়ে পড়ে আছে। ….সবই সহ্য করা যায়; কিন্তু বিংশ শতাব্দীর ক্রমোন্নতির চরম শীর্ষে ওঠে প্রাচীনত্ব ও প্রতিক্রিয়াশীলতা কিছুতেই সহ্য করা যায় না। ইত্যাদি ইত্যাদি….
আধুনিক জাহিলিয়াতের প্রচার যন্ত্র ও প্রচার মাধ্যম; উপায়-উপকরণের কোনো সীমা-শেষ নেই। কি না আছে জাহিলিয়াতের হাতে! পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা –এই সব কিছুই এক সাথে লেগে যায় সেই ব্যক্তির কণ্ঠ রুদ্ধ করার জন্যে, যে বর্তমান জাহিলিয়াতের কোনো দোষ বা অনিষ্টকারিতা সম্পর্কে টু শব্দ করবে।
যে ব্যক্তিই জনগণকে প্রকৃত সত্যের পথ দেখাতে এবং এ জাহিলিয়াতের বিপর্যয় ও বিকৃতির কথা বলে জনগণকে সজাগ ও জাগ্রত করতে চেষ্টা করবে, তার ইশারায় প্রতিক্রিয়াশীলতার এই বোমা বিস্ফোরিত হবে।
হায়রে প্রতিক্রিয়াশীলতার গালি!
সত্য, কল্যাণ ও ন্যায়পরতাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে যে লোকই দাঁড়িয়েছে, তারই হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে এই অস্ত্র। …বিরোধীদের মুখ বন্ধ করার জন্যে প্রতিক্রিয়াশীলতার গালি। আর বোকা জনগণকে বিভ্রান্তি করার জন্যে উন্নতি, প্রগতি ও ক্রমবিকাশের লোভনীয় বুলি।
কিন্তু জাহিলিয়াতের বিপদ এ পর্যন্তই থেমে যায় নি। জাহিলিয়াত পরিস্থিতিকে অত্যন্ত জটিল ও দুসমাধ্য করে দিচ্ছে। সত্য ও মিথ্যা –হক ও বাতিলকে সংমিশ্রিত করেছে প্রতি মুহুর্তে। স্বয়ং মজলুম মানবতাকেও নানাভাবে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তাদেরকে বোঝাতে চাইছে যে, তারা পরম ন্যায়পরতার ও সুবিচারের মধ্যে জীবন যাপন করছে। গুমরাহ পথভ্রষ্ট লোকদেরকে বোঝাতে চাইছে, তারা যেন মনে করে যে –তারা ঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। যাদের ওপর অন্যায় জুলুম পীড়ন ও নির্যাতন ভেঙ্গে পড়ছে, তাদের আসল অবস্থা থেকে বিভ্রান্ত করে বোঝাতে চাচ্ছে যে, তারা সর্বাত্মক কল্যাণের মধ্যেই দিনাতিপাত করছে।
সত্যি কথা হচ্ছে, ইতিহাসের সব কয়টি জাহিলিয়াতের তুলনায় বর্তমান জাহিলিয়াত এক কঠিনতর রুঢ়তা, অকল্পনীয় বীভৎসতা ও নির্লজ্জতার মধ্যে ফেঁসে গেছে। এ অবস্থা থেকে তার মুক্তিলাভের কথা চিন্তাও করা যায় না।
জাহিলিয়াতের মারাত্মক ব্যাপকতা ও প্রাধান্য সত্ত্বেও তার বর্ণনা দান কঠিন কিছু নয়। কোনো যা সত্য ও বাস্তব, তা স্বীকৃত না হয়েই পারে না। তার একটা নিজস্ব ওজন ও ভারিত্ব রয়েছে। তা অস্বীকৃত হওয়া সম্ভব নয়।
জাহিলিয়াতের যতই প্রভাব-প্রতিপত্তি হোক, লোকদের চোখ থেকে সত্যকে চিরদিন লুকিয়ে রাকা কোনো জাহিলিয়াতের পক্ষে সহজ নয়। সম্ভব নয়।
এ জাহিলিয়াতের সর্বাত্মক কুফল ও ব্যাপক দুষ্কৃতি সম্পর্কে জনগণ ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠছে। পরবর্তী আলোচনায় একথা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
মানব জীবনের বিশাল ক্ষেত্রে বর্তমান জাহিলিয়াত যে ব্যাপক গভীর অন্যায়, দুষ্কৃতি ও পাপের স্তুপ জমা করে দিয়েছে, তার মারাত্মকতা সম্পর্কে বর্তমান দুনিয়ার বিভিন্ন জাতি খুবই সচেতন হয়ে উঠেছে।
তবুও ব্যাপার যে খুবই সহজসাধ্য, খুব শীঘ্র তা সম্ভব হবে, সে কথা মনে করা উচিত নয়। জাহিলিয়াতের ব্যাপকতা-গভীরতা এবং তার অনিষ্টতার বিরাটত্বের পরিমাণ অনুপাতে হক ও বাতিল –সত্য ও মিথ্যার চরম সংগ্রাম একান্তই অনিবার্য এবং এই অত্যাসন্ন সংঘর্ষে জয়ী হওয়ার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা ও সাধনার একান্ত প্রয়োজন।
কিন্তু একটি নির্দিষ্ট জিনিস আমাদের সকলকেই জানতে বুঝতে এবং তাকে বিশ্বাস করতে হবে। তা হচ্ছে, বাতিলের বিপুল স্তুপ –কখনোই সত্যে পরিবর্তিত হয়ে যাবে না। অন্যায় ও পাপের ব্যাপকতা কখনোই কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে না।
এই মহাসত্যের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখেই আমরা বাস্তব কর্ম-জীবনে আচার-আচরণে বর্তমান জাহিলিয়াত সৃষ্ট ব্যাপক বিপর্যয়ের বর্ণনা ও বিশ্লেষণ পেশ করতে চাচ্ছি। এর পূর্বে আমরা ধারণা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সৃষ্ট বিপর্যয়ের বিশদ বর্ণনা পেশ করে এসেছি।
মানুষের ধারণা-বিশ্বাসের বিপর্যয় যেমন আল্লাহর মহাসত্যতা সম্পর্কিত ধারণাকেও গ্রাস করেছে, শামিল করেছে বিশ্বলোক, জীবন ও মানুষ সম্পর্কিত ধারণাকেও, তাদের পরস্পরের সাথে সম্পর্কের ধারণাকেও, ঠিক তেমনি বাস্তব আচার-আচরণের বিপর্যয় পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে সমগ্র জীবন-জীবনের সকল দিক ও বিভাগকে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, নৈতিকতা, দুই লিংগের মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক এবং শিল্প সংস্কৃতি কোনো কিছুকেই নিষ্কৃতি দেয়নি।
অতঃপর প্রতিটি বিষয়ের স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা পেশ করা যাচ্ছে।
রাজনীতিতে বিপর্যয়
এই যুগটি নাকি মুক্তি ও স্বাধীনতার যুগ! কিন্তু তা সত্ত্বেও এ যুগের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে ইতিহাসের প্রচণ্ডতম স্বৈরতন্ত্র –ডিকটেটরবাদ। অন্ধশক্তি ও মরণাস্ত্র সৃষ্ট নির্বিচার ধ্বংসযজ্ঞ।
বেশি দিনের কথা নয়, সমগ্র ইউরোপে ব্যাপক হয়ে বসেছিল জায়গীরদারী সামন্তবাদী ব্যবস্থা। মানুষ প্রকৃতপক্ষেই ছিল ভূমি-দাস –ভূমি-দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী। সামন্তবের দাস ছিল সাধারণ মানুষ। তারা একটি জমি ত্যাগ করে অন্য জমিতে চাষ করতে যাওয়ার অধিকার থেকেও বঞ্চিত ছিল। আর যদি কেউ চলে যেত, তাহলে তাকে পলাতক সাব্যস্ত করা হতো এবং আইনের শক্তি প্রয়োগ করে তাকে ঘরে এনে সেই জমি চাষাবাদ করতে বাধ্য করা হতো, যা ত্যাগ করে সে চলে গিয়েছিল। তার দেহে আগুনে উত্তপ্ত দগদগে লৌহ শলাকা দিয়ে দাগ দিয়ে দাসত্বের দূরপনেয় কলংক বসিয়ে দেওয়া হতো। তার অপরাধ ছিল শুধু এই যে, সে তার ‘ছোট খোদা’ সামন্তের অবাধ্য হয়ে তার দাসত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন করে বেরিয়ে যাওয়ার দুঃসাহস করেছিল। এখানে তাকে কঠিন বন্ধনে বেঁধে রাখা হতো যেন আবার কখনও ছুটে যেতে না পারে।
এ-ই ছিল তখনকার ভূমি-দাসদের অবস্থা। আর এই সামন্ত প্রত্যেক ভূমি-দাসের জন্যে এক-এক খণ্ড জমি নির্দিষ্ট করে দিত, সে তা চাষাবাদ করত, সেখানেই সে বসবাস করত। কিন্তু সে জমির ওপর তার কোনো মালিকত্ব বা স্থায়ী ভোগ-দখল স্বত্ব ও স্বীকৃত হতো না। এসব পশুদের মধ্যে চারণভূমি বণ্টন করার মতো ব্যাপার। পশু সেখানেই বিচরণ করে খাদ্য গ্রহণ করে, দুগ্ধ ও মাখন দেয়। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট ভূমি খণ্ডের চৌহদ্দী অতিক্রম করার কোনো সাধ্যই তার হয় না। কোনো পশুটি তো সেখানে শক্ত রশি দিয়ে বাঁধা রয়েছে।
সামন্তবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন স্বাধীন হয় না কখনও। তার জন্যে পার্থক্যকারী বিষয় হচ্ছে অধীনতা (Serfdom)। তারা জানত যে, তা এমন এক ব্যবস্থা, যার ছত্র-ছায়ায় থেকে প্রত্যক্ষ উৎপাদক তার মালিক মনিবের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর ইত্যাদির বিনিময়ে ভূমি চাষের সুযোগ লাভ করত। সেই দেয় ‘কর’ হয় মনিবের বিনা পারিশ্রমিকে কাজ দেওয়ার মাধ্যমে আদায় করত কিংবা আদায় করত নগদ অর্থ বা জিনিসপত্র দিয়ে –ফসল দিয়ে।
এ কথাটির অধিক বিশ্লেষণের জন্যে আমরা বলব, সামন্তবাদী সমাজ দুইটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল।
প্রথম শ্রেণীতে ছিল স্বয়ং ভূমি-মালিকরা, সামন্তরা।
আর দ্বিতীয় শ্রেণীতে গণ্য হত চাষাবাদকারী লোকেরা-কিষাণ, শ্রমিক, দাস, চাষী ইত্যাদি। এদের মর্যাদা হতো বিভিন্ন।
যদিও এই দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকদের সংখ্যা খুব দ্রুতগতিতে হ্রাস পাচ্ছিল, এই কৃষক চাষীরা –প্রত্যক্ষ উৎপাদনকারীরা ভূমির একটি নির্দিষ্ট খণ্ড দখল করে থাকার অধিকার পেত। তাদের জীবিকার্জনের জন্যে তার যাবতীয় উপায় উপকরণসহ তারই ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকত। জীবন যাত্রার সুবিধার জন্যে প্রয়োজনীয় উপকরণাদিও তারা উৎপাদন করতে পারত। তারা নিজেদের ঘরে কৃষি সংক্রান্ত হালকা যন্ত্রপাতিও গার্হস্থ্য শিল্প হিসেবে বানাতে পারত। কিন্তু তার বিনিময়ে তাদেরকে বহু কয়টি জিনিস দিতে বাধ্য থাকতে হতো। যেমন মালিকের জমিতে নিজের কৃষি যন্ত্রপাতি দিয়ে সপ্তাহে একবার করে বিনা পারিশ্রমিকে চাষ করে দিতে হতো। এ ছাড়া কৃষি মৌসুমেও তাদের অতিরিক্ত কাজ করতে হতো। আর উৎসব, পার্বন ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ ভেট-উপঢৌকনও পেশ করতে হতো। অনুরূপভাবে মনিবের ফসল মাড়াই ক্ষেত্রেও তারা কাজ করতে দিতে বাধ্য হতো। মদ্য কেন্দ্রে তাদের মালিকদের জন্যে মদ চোলাই করে দিতেও বাধ্য হতো তারা।
সামন্ত সকল প্রশাসনও বিচার কার্যের নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী হতো। এক কথায়, সামন্ত সমগ্র সামষ্টিক জীবন অধীনস্থ এলাকার সমস্ত মানুষের রাজনীতির ওপর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব করত।
“এই সামন্তবাদী ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ উৎপাদনকারী কখনোই সেই অর্থে স্বাধীন হতো না, স্বাধীনতার যে অর্থ উত্তরকালে আমরা জানতে পেরেছি। তারা ভূমির পুরোপুরি মালিক হতো না। তা বিক্রয়, উত্তরাধিকার নিয়মে বণ্টন, হস্তান্তর বা দান ইত্যাদি করারও তাকের কোনো ক্ষমতাই ছিল না। সে তো সামন্তের নির্দিষ্ট জমিতে শুধু লাঙ্গল চলাতে বাধ্য হতো তার নিজের ইচ্ছা ও কল্যাণ চিন্তার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। এ ছাড়া তাকে করও দিতে হতো। তার পরিমাণ কখনোই নির্দিষ্ট থাকত না। এর কর দিয়ে তারা অধীনতার সম্পর্কের স্বীকৃতি দিত। তার জন্যে নির্দিষ্ট জমি হস্তান্তরিত কিংবা অন্য কোনো মনিবের খিদমতের কাজে জড়িত হওয়ার কোনো অধিকার থাকত না। এখানে তারা সেই প্রাচীন কালের দাসপ্রথা এবং আধুনিক কালের স্বাধীন চাষীদের মধ্যবর্তী অবস্থার প্রতীক হয়েছিল”।–[সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ গ্রন্থ থেকে। লেখক রাশিদুল বারী।]
বস্তুত মধ্যযুগীয় জাহিলিয়াতের যে অন্ধকারে ইউরোপ অবস্থান করত তারই বীভস চিত্র এখানে অংকিত হয়েছে। তখনই এই বিশাল অঞ্চল ছিল ইউরোপীয় গীর্জার কঠিন নির্মম শাসনের অধীন। কিন্তু একমাত্র ইসলামী জগতেই এরূপ অবস্থার কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। প্রশাসন ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে মুসলমানদের আংশিকভাবে যত বিপর্যয়ই হোক-না কেন, তারা ওরূপ অবস্থার সাথে মাত্রই পরিচিত নয়, যদিও বাস্তব জীবনে আল্লাহর শরীয়ত এই সময় আংশিকভাবে জারী হয়েছিল, তখন এই জালিম কাফের সমাজ আল্লাহর নাযিল করা বিধানের ভিত্তিতে শাসিত হচ্ছিল না। শাসিত হচ্ছিল প্রখ্যাত রোমান আইনের ন্যায় বিচারের দ্বারা।
উত্তরকালে এমন একটা সময় আসে, যখন সামন্ত ব্যবস্থার অবসান ঘটে। কিন্তু তা এ কারণে নয় যে, তদানীন্তন ইউরোপীয় আত্মা মানবতার চরম দুর্গতি দেখে ব্যথিত হয়ে উঠেছিল। কোনো তা ছিল জাহিলিয়াতে আচ্ছন্ন। আর জাহিলিয়াতে আচ্ছন্ন আত্মা ওসব দেখেও কখনোই ফরিয়াদ করে ওঠে না। সামন্তবাদের অবসান ঘটেছিল ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার অনিবার্য দাবি হিসেবে। আর এই ব্যাখ্যা ইতিহাসের গতিশীলতায় মানুষের জাহিলিয়াতের পক্ষে যথার্থ ব্যাখ্যা। সামন্তবাদের অবসানের কারণ অর্থনৈতিক বিবর্তন যন্ত্রের আবিস্কারে এক নবতর অর্থ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল বলে।
বস্তুবাদী বিবর্তন-আবর্তনের অনিবার্য কারণে উন্নয়নশীল শ্রেণী সেই শ্রেণীকে খতম করে দেয়, যার ভূমিকা পালন শেষ হয়ে গেছে বস্তুবাদী পরিবেশের দাবিতে। তখন তার চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়াই ললাট লিখন হয়ে যায়। আর এ কারণেই তার অবসান লাভ ছিল একান্তই নিশ্চিত ও অনিবার্য।
এই বস্তুগত শ্রেণী-আবর্তনের সত্য-মিথ্যার প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। কোনো ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যাই সত্য বা মিথ্যা, হক বা বাতিল বলে কোনো জিনিসই নেই।
যদিও সামন্তবাদী ব্যবস্থার অবসান নেই –অবসান বাঞ্ছনীয়ও নয়; কেননা তা জালিম। কিন্তু যেহেতু তা তার বস্তুগত ও শ্রেণীগত ভূমিকা পালন করে শেষ করেছে, আর নবতর ব্যবস্থা কায়েম হতে পারছে না –এক জুলুম তারই মতো আর এক জুলুমকে নির্মূল করতে পারে না বলে। কিন্তু যেহেতু তার বস্তুগত শ্রেণীভিত্তিক ভূমিকা রীতিমত পালিত হয়ে গেছে; অন্য কথায়, ঐতিহাসিক নিশ্চিত অনিবার্যতা কার্যকর হয়েছে, তাই তার অবসানও হয়েছে নিশ্চিত ও অনিবার্যভাবে এবং নবতর অর্থ ব্যবস্থার জন্যে পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা উৎপাদন উপায়ের বিবর্তনে গড়ে ওঠা অর্থ ব্যবস্থা ও শাসক-শ্রেণীর মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না। শাসক শ্রেণীই তথায় প্রধান ও প্রভাবশালী। যেহেতু একসাথে বাস্তব ও ব্যাখ্যাগত জাহিলিয়াত মানুষকে আল্লাহর নাযিল করা বিধান অনুযায়ী শাসন করে না, শাসন করে নিজেদের ইচ্ছা ও খামখেয়ালী ভিত্তিতে, এ কারণে মালিক শ্রেণীই হয় কর্তৃত্বশালী জালিম শাসক ও শোষক। আর জনগণ সেখানে চিরদিনের তরে নির্যাতিত হয় বিবর্তনের ধারাবাহিকতায়।
আর বাস্তব বা ব্যাখ্যাগত জাহিলিয়াত কখনোই এমন অবস্থার ধারণাও করতে পারে না, যখন অর্থ ব্যবস্থা এক স্তর থেকে ভিন্নতর স্তরে চয়ে যাবে উৎপাদন উপায়ে বৈজ্ঞানিক পরিবর্তন সূচিত হওয়ার কারণে এবং তা স্বভাবতই বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করতে থাকবে –তাতে একটি শ্রেণী অপর শ্রেণী থেকে অবৈধভাবে ফায়দা লুটে না। কোনো জাহিলিয়াত –পাগলেরা নিজেদের সুদীর্ঘ জাহিলিয়াতকালে কখনোই আল্লাহর নাযিল করা বিধান কার্যকর করেনি। আর এই বিধানের অধীন ব্যবস্থায় সমস্ত ব্যাপার হক ও ইনসাফ সহকারে কি করে সুসম্পন্ন হয়ে থাকে, তাও দেখতে পায়নি –কিছুক্ষণের জন্যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে দৃষ্টিতে রাখা হলেও। কেননা আল্লাহর নাযিল করা বিধান ক্রম বিবর্তনের কোনো একটি স্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। তা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতেও বিস্তৃতি লাভ করেনি। তার বিস্তৃতি হয়েছে মানুষের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ অনুপাতে, বিবর্তনের স্তর-পার্থক্যে মানুষ যেখানেই পৌঁছে থাকে-না-কেন।
সে যা-ই হোক, ইউরোপীয় সামন্ত ব্যবস্থা নবতর উৎপাদন যন্ত্রের আবিস্কার তিরোহিত হয়ে গেল এবং সমাজে এক নবতর আবর্তন সূচিত হলো।
যান্ত্রিক উৎপাদনের কেন্দ্রসমূহে, শিল্প-কারখানাসমূহে শ্রমিক কর্মচারীর প্রয়োজন দেখা দিল। তারা আসতে পারত কেবল মাত্র গ্রামাঞ্চল থেকেই। এরই ফলে সামন্তবাদী ব্যবস্থার বিলীন হয়ে যাওয়া অপরিহার্য হয়ে উঠল। কেননা কৃষিজীবীরা তো তারই অধীন জমির সাথে বাঁধা পড়েছিল। তারা জমির দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভ করে গ্রামাঞ্চল থেকে দলে দলে শহরে আসতে শুরু করল। কেননা এখানেই গড়ে উঠেছে নতুন কর্মব্যবস্থা নতুন শিল্প নগরে।–[ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা সামন্তবাদের অবসানের এই ব্যাখ্যাই দিয়েছে। অথচ এখন ভুলে গেছে যে, ইউরোপীয় কৃষকরা ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই স্বভাবের তীব্র তাড়নার কারণেই –সামন্তবাদের জালিম ভূমিদাস প্রথার বিরুদ্ধে অমানুষিকভাবে নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত হচ্ছিল এবং ধৈর্য্য ধারণের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেছিল যদিও উৎপাদন উপায়ে তখন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তারা যখনই জমি ত্যাগ করে পালিয়ে যাচ্ছিল, তখন নবতর অর্থ ব্যবস্থার কোনো অস্তিত্বই ছিল না।]
অতঃপর মানুষ কার্যত ভূমি-দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে গেল। তারা গ্রাম্য দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভ করে নাগরিক জীবনের মুক্ত পরিবেশে এসে গিয়েছিল।
অবশ্য প্রথম দিক দিয়ে তারা তা-ই মনে করে নিয়েছিল।
মনে করেছিল যে, তারা তাদেরকে বন্দী করে রাখার সব বাঁধা-বন্ধনই ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে, আর আজ তারা সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। যা ইচ্ছা হয়, তা-ই তারা করতে পারে। কিন্তু মূলত তারা এক জাহিলী বিবর্তন-স্তর থেকে অপর এক জাহিলী বিবর্তন স্তরে চলে এসেছিল মাত্র। মৌলিক কোনো পরিবর্তনই ঘটেনি তাদের জীবনে। তারা তখন পর্যন্তও তাদের জন্যে অপেক্ষমান নবতর দাসত্ব শৃঙ্খলকে দেখতে পায়নি। হ্যাঁ, সে সব বন্ধন তাদের জন্যে অপেক্ষাই করছিল। আর তারা নিজেদের পা ও গলদেশ নিয়ে সেখানেই উপস্থিত হয়ে গিয়েছিল নতুন করে দাসত্বের সুকঠিন শৃঙ্খল পরবার জন্যে।
ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা বলেছে, উৎপাদন যন্ত্র যে নতুন শ্রেণীর সৃষ্টি করল এবং উৎপাদন কার্যক্রম সামন্তবাদী প্রক্রিয়া থেকে পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হলো। এই দুটিই এক নবতর দাসত্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলল এবং তার পরিধি ক্রমশ সংকীর্ণ করে আনতে আনতে এতদূর নীচে নামিয়ে আনল যে, মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসেই রুদ্ধ করে দিতে লাগল।
কিন্তু ইতিহাসের এই বস্তুবাদী ব্যাখ্যা বাহ্যিক অবস্থার যতটা বর্ণনা দিয়েছে, প্রকৃত অবস্থা ছিল তার চাইতেও গভীরতর। এ ব্যাখ্যাতে যা মনে করেছে, তাতে বুদ্ধিমত্তার চমর পরাকাষ্ঠা ঘটেছে। এবং অবস্থার ব্যাখ্যাদানে তা বিস্ময়কর কীর্তি দেখাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার তো ভিন্নতর।
প্রকৃত ব্যাপার এই হয়েছিল যে, নবতর জাহিলিয়াত তো পুঁজিবাদের অধীন সমাজে আল্লাহর নাযিল করা বিধান দিয়ে শাসনকার্য চালাত না। তা ছিল সেই প্রাচীন জাহিলিয়াতেরই সম্প্রসারণ মাত্র, যা সামন্তবাদের অধীন অনুরূপভাবে আল্লাহর বিধান দ্বারা রাষ্ট্র শাসন না চালানো।
মূল শাসন প্রতিভা ছিল সেই একই নফসের খাহেশ লালসা-কামনা, যা এক্ষণে ছিল বিবর্তিত। সেই একই খামখেয়ালীপনা, যা কৃষককুলের নামে বিপুল মুনাফা লুটে নিত।
আর আসলে তা সেই তাগুত, যা প্রতিটি জাহিলিয়াতেই প্রবলতর, যা মানুষকে শাসন করে খামখেয়ালীর ভিত্তিতে। আর মানুষ যতদিন না আল্লাহর বিধান দ্বারা শাসনকার্য চালাতে শুরু করবে, ততদিন এরূপ অবস্থাই অব্যাহত হয়ে থাকবে। তার থেকে নিস্কৃতি নেই।
মুসলিম জাহানেও এই তাগুতী শক্তি দেখা গেছে, দেখা যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। মানুষ যতটা আল্লাহর দেওয়া পদ্ধতি থেকে বিভ্রান্ত, তাগুত শক্তি ততটাই বিস্তার ও প্রসার লাভ করেছে তা-ও নিঃসন্দেহ। কিন্তু মানুষ আল্লাহর শরীয়ত অনুযায়ী শাসনকার্য চালাতে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় যতটা বিকৃতি সহকারেই হোক-না-কেন-মানুষকে কোথাও অতটা দাসত্ব শৃঙ্খলে বাঁধতে পারেনি, যতটা বাঁধতে সক্ষম হয়েছে ইউরোপ। তথায় তো মানুষের গোটা জীবনকেই জাহান্নামে পরিণত করে দেওয়া হয়েছিল।
মুসলিম জাহানের কোথাও ইউরোপের ন্যায় বীভৎস ও জঘন্য ধরনের সামন্তবাদী ব্যবস্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। ইসলাম মৌলিকভাবেই স্বাধীনতাবাদী। তাই তা পূর্বে যেমন সামন্তবাদের তাগুতকে নিয়ন্ত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিল, অনুরূপভাবেই পুঁজিবাদের তাগুতের হাত-পা বেঁধে তাকে অক্ষম করে রাখতেও পেরেছিল –পেরেছিল জনতা যদ্দিন পর্যন্ত আল্লাহর শরীয়তের শাসন চালিয়েছিল, তা যতই আংশিকই হোক-না কেন।–[(আরবী*****) গ্রন্থের (আরবী**************) অধ্যায়ে]
তা যা-ই হোক, আমরা সেই ইউরোপেই ফিরে যাচ্ছি। যেখানে জাহিলিয়াতের ধারাবাহিকতা অব্যাহতভাবে চলেছে একের পর আর এক।
সেখানে যা কিছু ঘটেছে তা কোনো অর্থনৈতিক নিশ্চিত অনিবার্য বিবর্তনের ধারা ছিল না। এ বিষয়ে মার্কসীয় জাহিলিয়াতের ধারণা যেমন অবান্তর, তেমনি ভিত্তিহীন। আসলে তাগুতী শক্তি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পদচারণা করেই যাচ্ছিল। এই নবতর বিবর্তন উৎপাদন উপায়ে শোষণকে অত্যন্ত ভারী ও ব্যাপক করে তুলেছিল। তাতে তার সীমালংঘনমূলক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেল, মানুষকে আরও শক্ত করে দাসত্ব শৃঙ্খলে বাঁধতে সক্ষম হলো।
তা কোনো বাধ্যতামূলকভাবে হয়নি। তা ছিল স্থিতিশীল পরিবেশের স্বাভাবিক পরিণতি মাত্র। অথবা বলা যায়, তা নিশ্চিত অনিবার্য ছিল একটি মাত্র দিক দিয়ে। আর তা হচ্ছে, মানুষ যতদিনে আল্লাহর নাযিল করা বিধান দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা না করছে, ততদিন পর্যন্ত একটি মাত্র বিকল্প হিসেবে অবশ্যই তাগুত দ্বারা শাসিত হবে এবং তা জনগণকে দাসত্ব ও অপমান-লাঞ্ছনার তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করাতেই থাকবে। এর অন্যথা অকল্পনীয়।
উদীয়মান পুঁজিবাদী শ্রেণীও বিলীয়মান সামন্তবাদী শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত শেষোক্তদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার অর্থ এ থেকে ভিন্নতর কিছু নয় যে, উত্তম অবস্থায়ই আসল শাসন হয়ে রয়েছে সেই তাগুতী শক্তিই। কোনো তাগুত ব্যক্তিগতভাবে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম নয়। নয় তা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর নাম। তাগুত বলতে যে কোনো জালিম ক্ষমতাধরকেই বোঝায়। তা জনগণের ওপর খুব দ্রুততার সাথে ক্ষমতা স্থাপন করে এবং সমস্ত মানুষকে দাসানুদাস বানিয়ে নেয়। এ সময় পারস্পরিকভাবে কঠিন দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় না, এমন নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা সেই মুষ্টিমেয় জনগোষ্ঠীর হাতেই একান্তভাবে এসে যায়, যাদের আনুকূল্য করে অর্থনৈতিক পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা যেমন তদানীন্তন আরব জাহিলিয়াতের কুরায়শরা তাদেরই মতো পথভ্রান্ত ও শিরকে নিমজ্জিত গোত্রসমূহের সাথে বহুবার দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এবং শেষ পর্যণ্ত তাগুতী কর্তৃত্ব একান্তভাবে তাদের হাতেই চলে এসেছে। অথচ অর্থনৈতিক পরিবেশের ওপর তাদেরই কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছিল। তারাই মালিক হয়েছিল, হয়েছিল শাসন কর্তৃত্বের অধিকারী। আর নানাবিধ উপায়ে মানুষকে কঠিনভাবে দাসত্ব শৃঙ্খলে বন্দী করে নিয়েছিল।
ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা এক তাগুতের হাত থেকে অপর তাগুতের কাছে ক্ষমতা চলে যাওয়ার পরিস্থিতিরই শুধু ব্যাখ্যা দিতে পারে; কিন্তু সে ব্যাখ্যায় গভীরতা বলতে কিছুই নেই। মূলত তাগুতের অস্তিত্ব কি করে হয়, তার কার্যকারণ কি, সে ব্যাখ্যা থেকেই তা কখনোই জানা যেতে পারে না। আসলে পৃথিবীতে তার অস্তিত্ব নিশ্চিত অনিবার্য কিছুই নয়। …মানুষ যখন তার ইচ্ছা করে, তখনই তা ঘটে।
আসলে সে ব্যাখ্যাটা নিছক জাহিলী ব্যাখ্যা মাত্র। তা শুধু জাহিলিয়াতেরই ব্যাখ্যা দিতে পারে, প্রকৃত কারণের সন্ধান দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। শুরুতে নবতর দাসত্ব প্রথার দিক ও রূপ কিছু মাত্র স্পষ্ট ছিল না। বাহ্যত তারা যাত্রা করেছিল মুক্তি ও স্বাধীনতার নামে পাগলপারা হয়ে, তা ছিল জমির শৃঙ্খল থেকে শ্রমিক জনতার মুক্তি। সামন্তবাদের শৃঙ্খল থেকে জাতিসমূহের নিষ্কৃতি।
আর এ সময় রাজনৈতিক ও সামাজিক আবর্তনও সংঘটিত হয়। তার ওপর স্বাধীনতার সীলমোহরও লেগেছিল। সে আবর্তনসমূহের নাম দেওয়া হয়েছিল গণতন্ত্র।
সন্দেহ নেই, এই নবতর জাহিলিয়াত অপেক্ষাকৃতভাবে কিছুটা মুক্তি ও স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে এসেছিল। অপেক্ষাকৃতভাবে কিছুটা কল্যাণও নিয়ে আসেনি, তা বলা যায় না, কিন্তু জনতা তাতে চরমভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। এই সুযোগে নবতর তাগুত জনগণকে ধীরে ধীরে ও ক্রমাগতভাবে দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে নিচ্ছিল। নবতর তাগুত এই কর্মটাই করেছে অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতা সহকারে। চিন্তা করা যেতে পারে, এক ব্যক্তি যখন আইনসম্মতভাবে তার জন্যে নির্দিষ্ট ভূমিখণ্ড ত্যাগ করে চলে যেতে পারে না, বস্তুগত ও আদর্শগত উভয় দিক দিয়েই যখন তাকে জমির সঙ্গে শক্ত করে বাঁধে, কিংবা যে ব্যক্তি সামজেরই নৈতিক ও সামাজিক বন্ধনসমূহ ছিন্ন-ভিন্ন করে বের হয়ে আসার সাহস করতে পারে না, সে নৈতিক-সামাজিক বন্ধনসমূহ ভালো হোক, কি মন্দ –যদিও সেই সমাজের লোকেরা এমন বন্ধনকে আন্তরিকভাবে কোনো গুরুত্বই দেয় না কিংবা যে ব্যক্তি গীর্জার নিপীড়নের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারছে না –করলে তাকে ধর্মত্যাগী, অভিশপ্ত বলে আখ্যায়িত করা হতো; অভিশাপ বর্ষণকারীরা চতুর্দিক থেকে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত।…
এরূপ এক ব্যক্তিকে যদি ধরে কোনো শহরে মুক্তভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়, কোনো-রূপ পাহারাদারীরও ব্যবস্থা তার ওপর রাখা না হয়, তা হলে সে যে অলিতে গলিতে উচ্ছৃঙ্খলতা করে বেড়াবে এবং সে নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন বলে মনে করবে তা আর বিচিত্র কি? সেখানে তো তাকে বাঁধবার বা গীর্জার কঠোরতার ভয় করার এবং তাকে ধর্মত্যাগী বলে অভিশাপ দেওয়ারও কেউ নেই।
তার বলছিলাম, নবতর জাহিলিয়াত সদ্য বন্ধনমুক্ত মানুষকে শহর নগরে নিয়ে এই স্বাধীনতার মধ্যেই ছেড়ে দিয়েছিল। এখানে সে এমন স্বাধীনতা পেয়ে গিয়েছিল যার কোনো অস্তিত্বই ইতিপূর্বে তার জীবনে ছিল না। এখানে সে যত্রতত্র যাওয়ার, ঘোরাফেরা করার স্বাধীনতা পেয়েছে। যে-কোনো কাজ করার স্বাধীনতা পেয়েছে। একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার, সভা সম্মেলন সংগঠন করার স্বাধীনতা লাভ করেছে। কথা বলার, সমালোচনার স্বাধীনতাও আছে। সাংবাদিকতার স্বাধীনতাও স্বীকৃত। সেই সাথে এমন স্বাধীনতাও পেয়ে গেছে যার কোনো অস্তিত্বই পূর্বে ছিল না।
তারা পেয়ে গেল অকারণে অভিযোগ আরোপ থেকে নিরাপত্তা, তদন্তের নিরাপত্তা এবং বিচারের নিরাপত্তাথ।
এসব বাস্তব স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা পেয়ে কেউ যদি মনে করে যে, সে সত্যিকার স্বাধীনতা পেয়ে গেছে তা হলে তাকে তো দোষ দেওয়া যায় না।
হ্যাঁ, তারপরও রয়েছে পার্লিয়ামেন্ট –সংসদ, জাতীয় সংসদ। সেই সাথে নির্বাচন। এটাও স্বাধীনতার একটা বড় দিক। জাতীয় প্রতিনিধিত্বের ব্যাপার, এ কি কম কথা। সরকার গোটা জাতির প্রতিনিধিত্ব করে, শাসনকার্য চালায় জাতির ইচ্ছানুযায়ী। হ্যাঁ, হ্যাঁ….
হ্যাঁ, জনতা পূর্ণ স্বাধীনতাই তো পেয়ে গেছে।
কিন্তু আসলে এসবই হচ্ছে আকাশ কুসুম কল্পনা, ভ্রান্ত মনের ধারণা, মনের বিভ্রান্তি মাত্র। পুঁজিবাদের যুগে নবতর জাহিলিয়াতই এই সব ভুল ধারণার সৃষ্টি করেছে।
সন্দেহ নেই, এ জাহিলিয়াতের বাহ্যিক দিকটি দিকটি খুবই সুন্দর। এতদূর সুন্দর যে, তা বলে শেষ করা যায় না। তা জনগণের চোখ ঝলসিয়ে দিয়েছে, হৃদয় মনকে পাগল বানিয়ে দিয়েছে। এরপরই আসে বিজ্ঞান, বস্তুগত উন্নতি, অগ্রগতি। ফলে এ জাহিলিয়াতের রূপ ও সৌন্দর্য পূর্ণাঙ্গ হয়, অধিকতর চাকচিক্যময় হয়ে ওঠে।
এক্ষণে মানুষ কেবল ভূমি দাসত্বের শৃঙ্খল থেকেই মুক্ত হয়নি, কেবল নৈতিকতার বন্ধন থেকেই মুক্ত হয়নি, শুধু গীর্জার আধিপত্যের অধীনতা থেকেই নিষ্কৃতি পায়নি, এক্ষণে কেবল প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ও আইন পরিষদই কায়েম হয়নি, এ সময় মানুষ অমানুষিক দৈহিক শ্রম থেকেও মুক্তি পেয়ে যায়। কোনো ও বস্তুগত অগ্রগতি দৈহিক প্রাণান্তকর শ্রম থেকেও মানবীয় শক্তিকে মুক্তি দিয়েছে। কোনো এক্ষণে যন্ত্রপাতি সেই সব শ্রমকেই প্রায় সামলে নিয়েছে, যা দৈহিকভাবে করতে মানুষ বাধ্য হতো। ফলে মানুষ অনেক হালকা কাজের সুযোগ পেল। হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম থেকে মুক্তি পেল। আর আনন্দ উৎফুল্লতা সহকারে জীবনীশক্তির পূর্ণ সংরক্ষণের মহা অবকাশ পেয়ে গেল।
এ পর্যায়ে আমরা এই নতুন জাহিলিয়াত সৃষ্ট চিন্তা-নৈতিকতা, অর্থনৈতিক বা সামাজিক বিপথগামিতা-বিকৃতি সম্পর্কে কোনো কথাই বলব না। যদিও জীবনের এই সব দিক বাস্তবক্ষেত্রে পরস্পর গভীরভাবে সম্পৃক্ত, সব দিক ও বিভাগ পরস্পর ওতপ্রোত বিজড়িত। একটি দিক বা বিভাগ অন্য দিক বা বিভাগ থেকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। মানব জীবনে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, নৈতিক ব্যবস্থা ও চিন্তা পদ্ধতি থেকে আদৌ বিচ্ছিন্ন কোনো জিনিস নয়। কোনো মানুষের মন ও জীবন বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ও পরস্পর সম্পর্কহীন খণ্ডে কোনো মতেই বিভক্ত করা যায় না। কিন্তু তবুও এ পর্যায়ে আমরা প্রয়োজনের তাগিদেই রাজনীতি বিষয়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সৃষ্ট বিপর্যয় সম্পর্কেই আলোচনা করব, আমাদের মূল আলোচনাকে অধিকতর স্পষ্ট করে তোলার উদ্দেশ্যে।
রাজনীতির ক্ষেত্রে নবতর জাহিলিয়াত যদিও গীর্জার কর্তৃত্ব থেকে বাঁচার লক্ষ্যে। জনমত ও গণ-সন্তুষ্টির পথ অবলম্বন করেছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই জাহিলী রাজনীতি জনমতের ভিত্তিতে শাসনকার্য চালাত না। গোটা রাজনীতিই চলছে, এমন একটা ধারণার ভিত্তিতে, বাস্তবে যার কোনো নাম চিহ্নও কোথাও ছিল না। কেননা নবতর জাহিলিয়াত যখন আল্লাহর বিধানকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাল, তখন তার মুখে তাগুতের ইচ্ছানুযায়ী শাসনকার্য চালানো ছাড়া আর কোনোই উপায় ছিল না।
“জাতির ইচ্ছা ও তার দোহাই ছিল বর্তমান জাহিলিয়াতে রাজনীতির বাহ্যিক দিক, লোক দেখানো দিক”। কিন্তু এই ঘৃণ্য জাহিলিয়াতের আসল ও প্রকৃত রূপ হচ্ছে তাগুতের ইচ্ছানুযায়ী চরম স্বেচ্ছাচারিতা সহকারে রাষ্ট্র শাসন ও সরকার পরিচালনা।
ইতিহাসের বস্তুবাদী দর্শন জাহিলিয়াতসমূহের ব্যাখ্যাদানে খুবই সততার পরিচয় দিয়েছে। তার ব্যাখ্যানুযায়ী যে শ্রেণীর মুঠির মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা-সার্বভৌমত্ব থাকে তা-ই ক্ষমতার জোরে অন্যান্য সব শ্রেণীর লোকদের স্বার্থের সম্পূর্ণ বিপরীত নিজ স্বার্থকে পুরোপুরি রক্ষা করেই দেশ শাসনের কাজ সম্পন্ন করে।
তার গড়া সংস্থাসমূহ হচ্ছে নির্বাচন, পার্লামেন্ট, পার্লামেন্টারী সরকার, সংবিধান ইত্যাদি। মূলত এসব লোক-দেখানো সংস্থার পশ্চাত থেকে অলস জাহিলিয়াতই দেশ শাসন করে।
প্রথম দিক দিয়ে এই সব ব্যাপার একটা স্পষ্ট ছিল না। বরং আধুনিক জাহিলিয়াতের অধীন জীবন-যাপনকারী কতিপয় সাদা হৃদয়ের লোক মনে করছিল যে, তারা তাদের এই নবতর জীবনকে অতীব উত্তম ও উন্নত ও মানবীয় উচ্চতার সাথে সামঞ্জস্যশীল ভিত্তিসমূহের ওপর সুদৃঢ়ভা নির্মাণ করছে। ব্যবস্থাপনার বাহ্যিক চাকচিক্যই তাদেরকে এই কঠিন ভুল ধারণার মধে নিমজ্জিত করেছিল।
এই বেচারারা মনে করছিল যে, তারা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করছে এবং নির্বাচিত এই প্রতিনিধিরা অবশ্যই জনগণের ইচ্ছানুযায়ী ও তাদের কল্যাণের দৃষ্টিতেই আইন প্রণয়ন করবে। কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার ছিল এই যে, মূলধনের ‘তাগুত’ই নিরংকুশ কর্তৃত্ব সহকারে শাসনকার্য পরিচালনা করছিল।
এই ব্যাপারটি বর্তমানে এতই প্রকট হয়ে উঠেছে যে, তা কারোর কাছেই অজানা থাকেনি। ফলে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার কোনো প্রয়োজনই হয় না। বিগত বছরগুলোতে দুনিয়ার প্রত্যেক দেশে সকল প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে পুঁজি বাদ সম্পর্কে যা কিছু প্রচার করা হয়েছে, তার ভিতরে যে অনিষ্ট, সীমালংঘনমূলক জঘন্যতা ও বিপর্যয় রয়েছে, তা বোঝার জন্যে তা-ই যথেষ্ট। এ পর্যায়ে বিগত বছরগুলোতে অনেক কিছু লেখাও হয়েছে। পুঁজিবাদী তাগুত তার বিশেষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে কত যে বাড়াবাড়ি করেছে, তাও আজ কারোর কাছে গোপন নেই। বিশেষ করে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমজীবীদের রক্ত কিভাবে শুষে নেওয়া হয়, তা আজ সকলের কাছেই স্পষ্ট। প্রকৃত স্বাধীনতাকামী ও প্রকৃত সুবিচার ও ন্যায়পরতার পক্ষপাতী লোক এবং তাগুতের হাত থেকৈ যারা কর্তৃত্ব কেড়ে নিতে চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে কি ভয়াবহ কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল –যার ফলে সকলে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়েছিল, বর্তমানে তা কারোরই অজানা নেই।
এখানে এই জুলুম নির্যাতন-নিপীড়নের কয়েকটি হালকা ধরনের দৃষ্টান্ত পেশ করছি।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ইংলণ্ডে আহুত ধর্মঘট বন্ধ ও ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্যে সরকার সম্ভাব্য সকল উপায়ই অবলম্বন করেছিল। পুঁজিবাদ ঘোষণা করেছিল এ ধর্মঘট বেআইনী। অতঃপর পুলিশ ও সেনাবাহিনী ধর্মঘটীদের ওপর ট্যাংক ও কামান দিয়ে আক্রমণ করল। ধর্মঘট বন্ধ করার জন্যে বহু শত পন্থাও গ্রহণ করা হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবক ছাত্ররা এসে বাস ও ট্রাক চালাল। রেডিও ও পত্র-পত্রিকায় ধর্মঘট বিরোধী প্রচারণা চালানো হলো। গোটা সরকারযন্ত্র শিল্প-মালিখদের হাতে এসে গিয়েছিল। জনগণ ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে হিসেব পেশ করতে বাধ্য করার এবং তাদের নেতাদের গ্রেফতার করার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।…
এ ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল গণতন্ত্রের সুতিকাগার ইংলণ্ডে। উক্ত বিবরণ কোনো শত্রুর দেওয়া নয়, একজন ইংরেজেরই দেওয়া।–[হেনরী নোয়েল ব্রেইলজ ফোর্ড]
আমেরিকার অবস্থা ইংল্যাণ্ড অপেক্ষাও অধিকতর বীভৎস। সেখানকার পেশাদার বিলটিজী দলসমূহ তথাকথিত গণতন্ত্রের পথ প্রশস্ত করে চলছিল। কোনো লোক যদি পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, তা হলে তাদেরকে কারাগারে বন্দী করে কঠিনভাবে শাস্তি দেয়। প্রয়োজনবোধে হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। হ্যারল্ড লাস্কি ‘আধুনিক যুগের বিপ্লবসমূহ’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেনঃ ‘নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া বিস্তারিত বিবরণ লোকদের পাঠ করা উচিত। যথা ‘লাফলুত’ সমিতির সিদ্ধান্ত। আমেরিকার লর্ডদের মজলিস তা এই জন্যে মোতায়েন করেছিল যে, এই সমিতিটি নাগরিক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপকারীর পর্যালোচনা করে। সে হস্তক্ষেপ কতদূর সম্প্রসারিত হয়েছে সে বিষয় পরিমাপ করবে। ঘুষ, গোয়েন্দাগিরি, প্রতারণা, ঠকবাজি ও বিচার বিভাগীয় দুর্নীতি এমন সব ব্যাপার, আমেরিকান নেতা ও কর্মীগণ যা করতে খুব বেশী অভ্যস্ত।
বড় বড় শিল্প সমিতিসমূহের উদ্দেশ্য হচ্ছে তারা যেন ট্রেড ইউনিয়নের শ্রমিকদেরকে নিষ্পেষিত ও নির্মূল করার জন্যে বন্দুক ও টিয়ার গ্যাসে সমৃদ্ধ সৈন্য নিয়োগ করতে পারে।
‘এতদ্ব্যতীত সিনেটর লঙ-এর সময়ে লুয়েজানা, জার্সিও, ক্যালিফর্নিয়ার কোনো কোনো এলাকায় অধিকার ধোষণার কোনো প্রভাব পড়েনি। কোনো ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতি সর্ব প্রকারের স্বার্থ একান্তভাবে নিজেদের জন্যে মনে করত। তার কারণ এই ছিল যে, অর্থনীতির গোটা উৎসই ছিল তাদের মুটির মধ্যে। আমি তো মনে করি, ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত আমেরিকান ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিদের মনে ফ্যাঁসিবাদী মনোবৃত্তি মারাত্মকভাবে সংক্রমিত হয়েছিল। অবশ্য গণতন্ত্রের একটা সূক্ষ্ম আবরণ ফেলে রেখে ছিল সব কিছুর ওপর।–[আধুনিক যুগের বিপ্লবসমূহ –হ্যারল্ড লাস্কি।]
সে যাই হোক আমেরিকার অবস্থা এতই স্পষ্ট যে, সে জন্যে বইয়ের উদ্ধৃতি দেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না।
আমেরিকার পুঁজিবাদ এত নিকৃষ্ট ধরনের যে, তথায় দিন রাত অসংখ্য অপরাধ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অনুষ্ঠিত হচ্ছে পুঁজিপতিদের ইংগিতে।। এমন কি পুঁজিপতিদের সন্তুষ্ট করার জন্যে দিবালোকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডীকে হত্যা করা হলো। কোনো পুঁজিপতিরা ভয় করছিল, বিশ্ব উত্তেজনা হ্রাস করার জন্যে কেনেডীর পুঁজিবাদী চেষ্টা-সাধনার কারণে শিল্পোৎপাদন প্রবণতা যুদ্ধ সামগ্রীর দিক থেকে সরে দিয়ে সাংস্কৃতিক-তমদ্দুনিক সামগ্রী উৎপাদনের দিকে ঘুরে যাবে। কিন্তু সাংস্কৃতিক তমদ্দুনিক সামগ্রী দ্বারা পুঁজিপতিরা এত বেশী মুনাফা লুটতে পারে না, যতটা তারা উপার্জন করতে পারে যুদ্ধ সামগ্রী উৎপাদন করে।
এই হলো পুঁজিবাদের অপরাধসমূহের গুরুত্বহীন চিত্র। নতুবা চরিত্র নষ্ট করণ, লোকদের জীবিকা হরণ এবং বিভিন্ন জাতিকে দাসানুদাসে পরিণত করণের লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণ নীতি তো স্বতন্ত্র দিক। আমেরিকা সেজন্যে যথেষ্ট খ্যাতিও অর্জন করেছে।
মোটকথা, একথা অনস্বীকার্য যে, কাল্পনিক গণতন্ত্র আসলে পুঁজিপতিদের স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়ে গেছে। আর এই স্বৈরতন্ত্র একটি তাগুত হয়ে তা জনগণকে দাসানুদাস বানিয়ে রেখেছে। মানুষকে পদে পদে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করছে।
কিন্তু এই মারাত্মক ধরনের বিপর্যয় যে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী হওয়ার কারণে ঘটেছে, জাহিলিয়াত তা কিছুতেই স্বীকার করবে না। তা মূলতই আল্লাহর পথ চিনে না, জাহিলিয়াত তা কিছুতেই স্বীকার করবে না। তা মূলতই আল্লাহর পথ চিনে না, গ্রহণ করতেও প্রস্তুত নয়। তার গোটা জীবনটাই আল্লাহর পথ ও তাঁর ওহীর মাধ্যমে নাযিল করা বিধান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়েই অতিবাহিত হচ্ছে। তা সমস্ত ব্যাপারকে মাটির দ্বন্দ্ব, স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও শ্রেণীগত দ্বন্দ্বের সংকীর্ণ বেষ্টনীর সীমিত পরিসরেইদেখে থাকে ও বিচার বিবেচনা করে।
আল্লাহ তা’আলা তাঁর রাব্বানী বিধানে যখন সুদ ও মওজুদকারীকে হারাম ঘোষণা করেছিলেন, তখন তিনি মানুষ সম্পর্কে এত বেশী জানত, যা মানুষও তাদের নিজেদের সম্পর্কে জানত না। তিনি তো মানুষের কল্যাণই চান কিন্তু তা যে কল্যাণ, মানুষ তাও জানে না। যে পথে মানুষের কল্যাণ ভারসাম্যপূর্ণ, যাতে প্রকৃত সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সীমালংঘনমূলক তৎপরতা বন্ধ থাকে, আল্লাহ তো তাদের জন্যে তারই নির্দেশ করছিলেন।
রাজনীতি আলোচনা এ অধ্যায়ে সুদ সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত কিছু বলব না। অর্থনীতি পর্যায়ের আলোচনাই তার উপযুক্ত স্থান। কিন্তু এখানে আমরা শুধু এতটুকুই বলে রাখতে চাই যে, পুঁজিবাদের সীমালংঘনকারী স্বৈরতন্ত্র মানুষকে ধ্বংসের শেষ সীমায় পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু এই সুদ ও মওজুদকারীর পন্থা কার্যকর না হলে তা কখনোই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারত না। মূলত এই দুটিই হচ্ছে পুঁজিবাদের দুটি বড় স্তম্ভ, বড় দুটি ভিত্তি। আর আল্লাহর বিধানে এ দুটিই হচ্ছে নিষিদ্ধ ও হারাম। ফলে রাজনীতি ও অর্থনীতি –উভয় ক্ষেত্রে তাও মানুষের দাসত্বের মধ্যে প্রতিবন্ধক হতে পারে কেবলমাত্র আল্লাহর বিধান ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা ইতিহাসের আরো কয়েকটা অধ্যায় আমরা অতিক্রম করতে চাচ্ছি। পুঁজি ও পুঁজিবাদের সীমালংঘনমূলক তৎপরতা যখন কঠিন হয়ে দাঁড়াল তখন তা দেখে মানুষ ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। তখন জনতার বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করে দিল।
কিন্তু এই জিহাদকারীরা তো চিরদিন জাহিলিয়াতের মধ্যেই নিমজ্জিত ছিল। আল্লাহ প্রদর্শিত পথ থেকে অনেক দূরে পড়েছিল। চূড়ান্ত মাত্রার শ্রম ও কার্য স্বীকার করার পর তারা নিজেদেরকে পুঁজিবাদের তাগুতের অক্টোপাশ থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করে নিল। কিন্তু এই সুদীর্ঘকালের নির্যাতনে নিষ্পেষণ ভোগের পরও তারা কোনো শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করতে সক্ষম হলো না বরং যে মুহুর্তেই তারা পুঁজিবাদের অক্টোপাস থেকে নিস্কৃতি পেল, তখনই তাদেরকে গ্রাস করে ফেলল আর এক তাগুত। এ তাগূতের মুখে গণতন্ত্রের নেকাবটাও ছিল না। তা হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর স্বৈরতন্ত্র (Dictatorship of the Proletariats)
জনগণ পুঁজিবাদের স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তি পেতেই শ্রমিক শ্রেণীর স্বৈরতন্ত্রের গ্রাসেরমধ্যে পড়ে গেল। একটি তাগুত থেকে মুক্তির পর পরই অপর এক তাগুতের পায়ের তলায় পড়ে নিষ্পেষিত হতে লাগল। আর আসল কথা, তারা আল্লাহর পথ থেকে বহু দূরেই পড়ে থাকল।
ইতিহাসের জাহিলী ব্যাখ্যা অবোধগম্য কার্যকারণ ও সেসবের ফলাফল সম্পর্কে এক দীর্ঘ আলোচনার পর শ্রেণী-সংগ্রামের উল্লেখ করে। তারপরে বলে অনিবার্যভাবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। অতঃপর জাহিলিয়াতের পাগলরা ভাঙ্গের নেশা খেয়ে শ্রমিক শ্রেণীর স্বৈরতন্ত্রের ছত্রছায়ায় পাওয়া কাল্পনিক স্বর্গের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন দেখায় মগ্ন হয়ে পড়ে। সে স্বর্গ তো পাওয়া যাবে তখন, যখন শ্রেণীসমূহ নির্মূল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে এবং অবশিষ্ট থাকবে শুধু প্রোলেটারিয়েটরা।
অতঃপর নিশ্চিত অনিবার্যথা হিসেবে মূলধন ও শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সে যুদ্ধ সত্য ও সুবিচারের নামে হচ্ছিল না। কেননা ফ্রেডারিক এ্যাঞ্জেলস তো সত্য ও সুবিচারকে সব সময়ই ঠাট্টা ও বিদ্রূপ করেছে। এ যুদ্ধের ভিত্তি ছিল পরস্পর বিরোধী ভাবধারার বাধ্যতামূলক বিরোধ।
পুঁজিবাদ সকল প্রকার আইন ও বে-আইনী উপায় অবলম্বন করে শ্রমিকদের রক্ত শোষণ করছিল নির্মমভাবে। বিচার বিভাগ ও প্রশাসনকেও তা এজন্যে ব্যভহার করেছে। কিন্তু নিশ্চিত অনিবার্যতা শেষ পর্যন্ত দেখা দেওয়া ছিল একান্তই জরুরী। সেই কারণে শ্রমিক শ্রেণী সরকারতন্ত্র দখল করে প্রোলেটারিয়েটদের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত করে। পরে তা উৎপাদন উপায়ের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা খতম করে দেয় আর তদস্থলে সামষ্টিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করে। এর ফলে সমস্ত শ্রেণী নিঃশেষ হয়ে যায়। প্রোলেটারিয়েটদের স্বার্থ রক্ষার নীতি সরকার পরিচালনা করতে থাকে। তা সত্য ও ন্যায়ের দাবি হিসেবে করা হয়নি। করা হয়েছে এজন্যে যে, গ্রোলেটারিয়েটরাই এখন শাসনদণ্ডের ধারক। প্রোলেটারিয়েটরা প্রত্যেক ব্যক্তির কাছ থেকে সামর্থ্যানুযায়ী সম্পদ ও শক্তি কেড়ে নেয় এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে তা দিয়ে থাকে তার প্রয়োজনমতো।
এভাবে চলতে থেকে শেষ পর্যন্ত সরকার ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে বলে নিঃশেষ হয়ে যায়। তখন ভাঙ্গ ও আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থেকে হারানো স্বর্গ লাভ ঘটে।
ইতিহাসের বস্তুবাদী দর্শন এই বিষয়ে যে পৌরাণিক তত্ত্ব রচনা করেছে, তা অবশ্যই প্রশংসনীয় মনে করতে হবে।
কার্লমার্কস ভবিষ্যৎ বাণী করেছিল যে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সর্বপ্রথম ইংল্যাণ্ডেই কায়েম হবে। কেননা ইংল্যাণ্ড শিল্পোন্নতির দিক দিয়ে অধিকতর অগ্রসর। সেখানেই ইতিহাসের নিশ্চিত অনিবার্য সংঘর্ষ সংঘটিত হবে, যার ফলে সরকার পুঁজিবাদীদের হাত থেকে সড়কে গিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর হাতে চলে যাবে। অথচ লক্ষণীয় হচ্ছে, যে সব দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, তার প্রত্যেকটি দেশই শিল্পোন্নতির দিক দিয়ে অত্যন্ত পশ্চাদপদ। রাশিয়া ও চীন তা থেকে ব্যতিক্রম ছিল না কিছুমাত্র। আর ইংল্যাণ্ড মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণীর একশত বৎসর পরও এই বিংশ শতাব্দীর যুগে একটি পুঁজিবাদী দেশ হয়েই আছে।
এর সাথে যোগ করা যেতে পারে এই পৌরাণিক কল্পকথা যে, সুদূর ভবিষ্যতে রাষ্ট্র ব্যবস্থাই বিলীন হয়ে যাবে। সমস্ত যেন কল্পিত ফেরেশতা হয়ে যাবে। তাদের হৃদয় হবে স্বচ্ছ দর্পনের ন্যায় পরিচ্ছন্ন। কোনো লোভ-লালসাই তাদের বিপথগামী করতে পারে না।
সত্যি কথা হচ্ছে, সমাজতন্ত্র তার পঞ্চাশ ষাট বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতার পর লেনিন ও স্ট্যালিনের অনুসৃত নীতি থেকে অনেকখানি বাধ্যবাধকতা সহকারে। মজুরী ও পারিশ্রমিকের মধ্যেও আকাশ-পাতাল পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। সামষ্টিক কৃষি কাজের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে ধরা পড়েছে। এখন সমাজতন্ত্রই জমির ব্যক্তিগত মালিকানা প্রবর্তনের স্বপক্ষে এসে গেছে।
এসব পৌরাণিক কথাবার্তা উল্লেখের পরিবর্তে আমরা এখানে শুধু রাজনীতি সম্পর্কেই কথা বলব। এখানে আমরা অবশ্যই উল্লেখ করব ক্রুশ্চেভের সেই ভাষণ, যা সে কমিউনিষ্ট পার্টির দ্বাবিংশতম অধিবেশনে পেশ করেছিল।
ক্রুশ্চেভ বলেছিলঃ
স্ট্যালিনের শাসনকালে দলীয় নেতৃত্ব, সরকার এবং অর্থনৈতিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে অনেক কিছু দোষত্রুটি প্রবেশ করেছিল। একদিক থেকে শুধু নির্দেশ জারী করা হতো। ত্রুটি-বিচ্যুতি গোপন করে রাখা হতো। ভয়ে ভয়ে কাজ করা হতো। প্রতিটি নতুন জিনিসকেই ভয় করা হতো। আর এরূপ পরিস্থিতিতে বহু সংখ্যক তোশামোদ ও ধোঁকাবাজ তৎপরতা শুরু করে দিয়েছিল।
সম্ভভত লোকেরা এখনো ভুলে যায়নি যে, স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর রাশিয়ার পত্র-পত্রিকায় তাকে খুনী, অপরাধী ও সমাজতন্ত্রের বিশ্বাসঘাতক প্রভৃতি উপাতে ভূষিত করা হয়েছিল।
প্রোলেটারী স্বৈরতন্ত্র যে তার কঠোরতা, নির্মমতা, পাষণ্ডতা ও পাশবিকতার ক্ষেত্রে এতো বেশী অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল, যা মানুষ কল্পনা করতেও রীতিমত ভয় পেয়ে যেত।
ইচ্ছা হলো কাউকে অনির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত কারাগারে বন্দী করে রাখলো, এমন এমন শাস্তি দিতে শুরু করল যে, তার কল্পনায়ও রোমাঞ্চিত হতে হয়। এমন সব বিচারালয় গড়ে তোলা হয়েছিল, যার প্রতিটা মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কয়েদ করার দণ্ড দেওয়া হতো। সমাজতান্ত্রিক দেশে এ সব ব্যাপার তো অত্যন্ত সাধারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল্ যে কোনো লোক তার খপ্পরে পড়ে যেতে পারে। যার মনে সমাজতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে লেশমাত্র ভাব জেগে উঠবে, তাকেই মর্মান্তিক পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে।
এ সময় গোটা সরকারই গোয়েন্দাগিরির আড্ডাখানায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। তাতে লোকদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে এবং মানবীয় বিশেষত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে সরকারের একান্ত বাধ্য অনুগত বানাতে চেষ্টা করা হচ্ছিল।
এসব অমানুষিক কাণ্ড-কারখানা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল ভেতরে ভেতরে আর বাইরে ছিল লোক দেখানো গণপ্রতিনিধিত্ব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুত্বের দুর্ভেদ্য আচরণ বাইরের দিকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
সমাজতান্ত্রিক স্বাধীন সাংবাদিকতা সমাজতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দের প্রশংসা ও গুণ বর্ণনায় সব সময়ই পঞ্চমুখ হয়ে থাকে। কিন্তু সেই নেতাই যখন দুনিয়া থেকে চলে যায় তখন তারই ওপর অভিশাপ বর্ষণের ডংকা বাজানো হয়।
প্রোলেটারী স্বৈরতন্ত্রের অধীন রাজনীতির বাস্তব অবস্থা এরূপই। প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক দেশেই এরূপ অবস্থা বিরাজমান। সমাজতান্ত্রিক দেশ ও সমাজে এ থেকে ভিন্নতর কিছু হওয়া কখনোই সম্ভব নয়।
ভাল ধারণা পোষণকারী সাদা হৃদয়ের লোকেরা স্থুল দৃষ্টিসম্পন্ন বলে ব্যাপারগুরোর গভীর সূক্ষ্মতা অনুধাবন করতে অক্ষম। চিন্তার জাহিলিয়াতে জীবন যাপনকারী লোকেরা প্রকৃত সত্যের সন্ধান এবং তার প্রতিবিধান করতে সম্পূর্ণ অসমর্থ।
এরা মনে করে, তাদের কামনাও এই হয় যে, পুঁজিবাদী স্বৈরতন্ত্র এবং প্রোলেটারী স্বৈরতন্ত্রের সব দোষত্রুটি ও ভুল-ভ্রান্তির প্রকার শুধু এভাবেই হতে পারে যে, সেখানে কিছুটা স্বাধীনতার সুযোগ-সুবিধা ও গণতান্ত্রিকতা সূচিত হোক। তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যও শুধু এতটুকু।
বস্তুত আল্লাহর হেদায়েত ও আল্লাহর পথ থেকে বিভ্রান্ত-বঞ্চিত হওয়া ও জাহিলিয়াতের পুঞ্জীভূত অন্ধকারে জীবন যাপনকারী লোকেরা জাহিলিয়াতের গোটা ব্যবস্থায় নিহিত যাবতীয় দোষত্রুটি দেখতে পায় না। জাহিলিয়াত যে তাগূতের অনুসারী, জাহিলিয়াত যে আল্লাহর দেখানো পথে চলে না, আল্লাহর আইন অনুযায়ী কোনো কাজও করে না, তা এই লোকদের মোটেই জানা নেই।
তাগুতী শক্তিসমূহের অস্তিত্ব এমন নয় যার প্রতিকার করা খুব সহজ কাজ। কিছুটা স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিকতার দ্বারা এই প্রতিকার কাজ সম্পন্ন হতে পারে না। তাগুত স্বতঃই এক পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা। তার ভিত্তিসমূহ মাটির গভীর তলায় নিহিত ও বিস্তীর্ণ।
পুঁজিবাদ অবশ্যই স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা হবে। আর সমাজতন্ত্রও স্বৈরতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয় –হতে পারে না। আসল কথা, যা আল্লাহর সার্বভৌমত্বভিত্তিক শাসন নয়, তা অনিবার্যরূপেই তাগুত, তাই স্বৈরশাসন। ইসলামী শাসন ব্যবস্থা ছাড়া আর সব শাসন ব্যবস্থা –সকল প্রকারের শাসন ব্যবস্থাই পুরা মাত্রার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। কোনো তাগুতী বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সাথেই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংমিশ্রণ করা হলে তা এমন হবে না যে, তার মধ্যে নিহিত তাগুতী দোষ-ত্রুটি দূরীভূত হয়ে যেতে পারে এবং স্বাধীনতা ও শাসনতন্ত্রের পূর্ণ কল্যাণ লাভ করা যেতে পারে। কোনো আসল দোষ তো এসব ব্যবস্থার বাস্তবায়ন উপায়ের মধ্যে নয়, ত্রুটি-বিচ্যুতি তো এসব ব্যবস্থার মূলে ও ভিত্তির মধ্যেই নিহিত। ফলে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংমিশ্রণ ও সংযোগের ফলে সে ত্রুটি-বিচ্যুতি তো এসব ব্যবস্থার মূলে ও ভিত্তির মধ্যেই নিহিত। ফলে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংমিশ্রণ ও সংযোগের ফলে সে ত্রুটি-বিচ্যুতি দূরীভূত হওয়া সম্ভব হয় না। তা ছাড়া আসল কথা হচ্ছে, এসব জাহিলিয়াত সুলভ শাসন ব্যবস্থার সাথে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংমিশ্রণ আদপেই সম্ভব নয়। তার প্রতিবিধান একটি মাত্র উপায়ে হওয়াই সম্ভব। আর তা হচ্ছে, জাহিলিয়াতের এই সব ব্যবস্থাকেই সমূলে উৎপাটিত করে দূরে নিক্ষেপ করতে হবে এবং তদস্থলে এমন একটি নবতর ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার ভিত্তি হবে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তাঁর বানানো সিরাতিম মুস্তাকীম অনুযায়ী এবং তার নাযিল করা বিধানের ভিত্তিতে।
পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র উভয় স্বৈরতন্ত্রই স্বাধীনতা হরণ ও লোকদের জীবন সংকীর্ণ করে দেয়। আর তা ব্যাখ্যা দেয় এই বলে যে, আমরা এখানে পবিত্র সংগ্রামে লিপ্ত।
পুঁজিবাদী –মূলধন ভিত্তিক স্বৈরতন্ত্র যে নিতান্তই স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা তা কখনোই স্বীকার করবে না। তার ধারণা এবং দাবি হচ্ছে শতকরা একশত ভাগ গণতান্ত্রিক। তা জাতির জনগণের ইচ্ছা ও আগ্রহের সারনির্যাস। কিন্তু পুঁজিবাদের কাছে তার দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে –শ্রমিক ও তাদের ইউনিয়সমূহকে ভীত-সন্ত্রস্ত ও কোনঠাসা করা, প্রকৃত স্বাধীনতাকামী লোকদেরকে পথ থেকে হটিয়ে দেওয়া এবং এই ধরনের লোকদেরকে প্রধান পদ ও স্থান থেকে বিচ্যুত করা কিংবা তাদের জীবনকেই চিরদিনের তরে খতম করে দেওয়া ইত্যাদি কার্যকলাপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে (যে, এই ধরনের গণবিরোধী কাজ কেন করা হয়?) জবাবে বলে, সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিসমূহকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার উদ্দেশ্যেই এই সব করা হয়। (অন্যথায় সমাজতন্ত্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্র শেষ হয়ে যাবে!)
প্রোলেটারী ব্যবস্থারও দাবি বা ধারণা হচ্ছে, তা-ও নাকি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যদিও তার ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক নামই হচ্ছে প্রোলেটারী ডিকটেটরশীপ। কিন্তু সমাজতন্ত্র সম্পর্কে লোকদিগকে ভীত-সন্ত্রস্ত করা এবং বিরোধী পক্ষের জীবনটাকেই শেষ করে দেওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হরে নিতান্ত বাধ্য হয়েই এই জবাব দেয় যে, তারা প্রতিক্রিয়াশীলতা ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
এই উভয় মতের লোকেরাই যুদ্ধের ময়দানে পবিত্র যুদ্ধে লিপ্ত! প্রত্যেক মনের লোকেরাই মনে করে, প্রতিপক্ষের লোকেরা তাদের ব্যবস্থাকে খতম করতে বদ্ধপরিকর। অতএব তাদেরকে এই ব্যবস্থা রক্ষার খাতিরে অত্যন্ত কঠোর হস্তে দমন করতে হবে, যেন গণ-কল্যাণ ও গণ-স্বার্থ রক্ষার চলমান প্রচেষ্টা সংরক্ষিত হতে পারে।
এই ব্যবস্থাগুলো যে কোনোরূপ সমালোচনাই বরদাশত করতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য। কোনো ইতিহাসে চিরদিন এরূপই হয়ে এসেছে যে, কোনো প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাইরে অথবা ভেতরে শত্রু হয়ে উঠল কিছু লোক, তারা সেই বস্থাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ ও উৎপাটিত করার লক্ষ্যে অন্যান্য যুধ্যমান লোকদের শিবিরে একত্রিত হয়ে গেল –যেন সম্মিলিত ও ঐক্যবদ্ধ চেষ্টা-প্রচেষ্টার দ্বারা সে ব্যবস্থাকে উৎপাটিত করতে পারা যায়।
কাজেই জাহিলিয়াতের উপরোক্ত বক্তব্য হাস্যকর, ভিত্তিহীন এবং যৌক্তিকতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
কেননা এরূপ ঘটনা এই দুনিয়ার কিছুমাত্র নতুন নয়। তা তো খুবই স্বাভাবিক। তাই তার বিরুদ্ধে অমানুষিক দমন নীতি গ্রহণ করা নিতান্তই বর্বরতা এবং জাহিলিয়াতের তাগুতী আচরণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
তবু এ বিষয়ে ইসলাম ও জাহিলিয়াতের চিন্তাধারা অভিন্ন নয়। ইসলা মতার জন্ম মুহুর্ত থেকে এক প্রচণ্ড যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছে। এক মুহুর্তের জন্যেও সে যুদ্ধ সীমালংঘন থেকে বিরত থাকেনি।
সে যুদ্ধ ছিল আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, তেমনি রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে প্রচণ্ডরূপে পরিগ্রহ করেছিল। যুদ্ধ নৈতিক চরিত্রের ক্ষেত্রে। চিন্তাধারায় ইসলামের সুসংবদ্ধ সারিগুলোকে ভেঙ্গে দেওয়ার উদ্দেশ্যে জাহিলিয়াত সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল, সকল ইসলাম বিরোধী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, সে জন্যে দৈহিক নির্যাতন, অভুক্ত রাখা এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে গোটা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশল গ্রহণ –কোনোটাই বাদ রাখা হয়নি এবং এই সব কিছুই আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, ইসলামের আকীদা যাতে লোকেরা গ্রহণ না করে এবং গ্রহণ করে থাকলে যাতে তা ত্যাগ করে তার জন্যে অবিলম্বিত হয়েছিল।
উত্তরকালে মদীনায় যখন ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠল, তখন ইসলামের বিরুদ্ধেও এই নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রটিকে অংকুরেই খতম করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে তার ওপর আক্রমণ করা হয়েছিল, সর্বশক্তি দিয়ে যুদ্ধ করা হয়েছিল। সে যুদ্ধ যেমন ছিল প্রকাশ্য, তেমনি অধিকতর রুঢ় ও নির্মম।
মুসলিম সমাজে সৃষ্ট মুসাফিরদেরকে ধন-দৌলত দিয়ে, লোকজন দিয়ে এবং সর্বপ্রকারের বস্তুগত প্রস্তুতি দিয়ে সাহায্য করা হয়েছিল। সময় সুযোগ মতো নানা ধরনের সামাজিক ফিতনার সৃষ্টি করা হয়েছিল, জনগণের মনে অস্থিরতা, উদ্বেগ ও ভয়-ভীতির সঞ্চার করা হয়েছিল –অর্থনৈতিক বয়কট করা হয়েছিল। খাদ্যের উৎস থেকৈ মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল।
আরও পরে গোটা আরব উপদ্বীপটি ব্যাপী যখন ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হয়ে গেল, ইসলাম তার আসল স্বদেশ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত এবং এই নবতর ইসলামী দাওয়াত ও বিপ্লবের চেষ্টা রোধ করার যখন আর সুযোগ থাকল না, তখন যুদ্ধ পূর্বাপেক্ষা অনেক বেশী ভয়াবহ, সর্বধ্বংসী এবং খুবই মারাত্মক হয়ে দেখা দিল।
একদিকে রোমান সাম্রাজ্যবাদ ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে দিল, প্রস্তুতি গ্রহণ করল ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ করার। আর অপরদিকে পারস্য সাম্রাজ্য ঘাঁটিতে ওৎ পেতে বসে থাকল।
অতঃপর কার্যত সংঘর্ষের সৃষ্টি হলো। যুদ্ধ হলো ততই প্রচণ্ড, যতটা প্রচণ্ড হওয়া সম্ভব ছিল। ইসলাম এই পবিত্র জিহাদে নেমে পড়ল। ইসলামের দৃষ্টিতে এ যুদ্ধ প্রকৃতই পবিত্র ছিল। কেননা তা ছিল আল্লাহর পথে, আল্লাহর কালেমার বিস্তৃতি ও বিজয়ীকরণের জন্যে। কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই ছিল তার চূড়ান্ত লক্ষ্য। এরূপ জরুরী অবস্থায় মুসলিম জাহানের অভ্যন্তরে সরকারের নীতি ও ভূমিকা কি হওয়া শোভন ছিল।
হযরত উমর ফারূক (রা)-এর খিলাফতের আমল। তাঁরই খিলাফত আমলে উপরোক্ত দুটি মহা ও পরাশক্তির সাম্রাজ্যবাদী নীতি সৃষ্ট এই মারাত্মক যুদ্ধসমূহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই উভয় পরাশক্তিই ইসলামকে ধ্বংস করার জন্যে গোপন ও প্রকাশ্য যত ষড়যন্ত্র করা সম্ভব ছিল, তা সবকিছুই করেছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে খলীফা উমর (রা) তাঁর সরকারাধীন মুসলিম জাহানের প্রতি কিরূপ আচরণ করেছিলেন?
ঐ যে মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছেন উনি কি উমর নন? ভাষণে কি বলছেন তিনি? …বলছেন –হে জনতা! আমার কথা শোন….। মান্য করো…।
সহসাই একজন মুসলমান –তিনি আরব ভাষাভাষী কেউ নন। তিনি সালমান ফারসী –দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেনঃ না, আপনার কথা শুনতে ও তা মানতে আমরা বাধ্য নই –যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার এই –এই কাজের যথার্থ ব্যাখ্যা দিবেন, বুঝিয়ে না বলবেন, আপনি তা কেন করেছেন?-[ব্যাপারটি ছিল এই যে, ইয়ামন থেকে সদ্য আসা কাপড় জনগণের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল। তাতে উমর ও অন্যান্য মুসলিম সমপরিমাণ কাপড় ভাগে পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দীর্ঘদেহী ব্যক্তি ছিলেন বলে প্রাপ্ত পরিমাণ কাপড়ের তাঁর কোর্তা তৈরী হওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁর পুত্রের প্রাপ্ত অংশটিও তাঁকে দেওয়া হয়েছিল বলে তাঁর মাপের জামা তৈরি হতে পেরেছিল। আর তা দেখেই হযরত সালমান (রা) আপত্তি তুলেছিলেন, আপনি এত বেশী কাপড় কোথায় পেলেন? তিনি তাঁর পুত্র আবদুল্লাহকে ডেকে এই আপত্তির জবাব দিতে বললেন। তিনি দাঁড়িয়ে প্রকৃত ব্যাপার যখন খুলে বললেন এবং প্রমাণ করলেন যে, খলীফা কারো চাইতে বেশী নেয়নি। তখন ব্যাপারটি পরিস্কার হয়ে গেল।]
কিন্তু খলীফা এই কথা শুনেও একবিন্দু ক্রুব্ধ ও উত্তেজিত হলেন না। তখন তিনি একথাও বললেন নাঃ “আমি ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্রের ধ্বংস করতে চায় এমন সব শত্রুর সাথে কঠিন যুদ্ধ কাজে লিপ্ত আছি। আর এই সময়ই তুমি আমার বিরুদ্ধে এরূপ কথা বলছ, আমার কাজে বাঁধা দিচ্ছ! না, তিনি এই তাগুতী কথা না বলে প্রকৃত ব্যাপার প্রকাশ করার ব্যবস্থা করে তাকে শান্ত করলেন। তখন সালমান ফারসী বললেন, হ্যাঁ, এখন আপনার বক্তব্য বলুন, আমরা শুনব এবং মানবও”।
তিনি কি সেই উমরই ছিলেন না, যিনি নামাযের খুতবা দিচ্ছিলেন মিম্বরে দাঁড়িয়ে। তখন একজন মহিলা দাঁড়িয়ে বাঁধা দিলেন। বললেন, ‘তুমি ভুল করছ’।
জবাবে তিনি বললেন, “হ্যাঁ, উমর ভুল করেছে আর একটি মেয়েলোক ঠিক কথাই বলেছে”।
তিনিও কি উমর ফারুক খলীফাতুল মুসলিমীন নন, যিনি ‘ফাই’ সম্পদ বিজয়ী মুসলিম মুজাহিদদের মধ্যে বণ্টন করা না –করার বিষয়ে মুসলিম কল্যাণের দিকের একটি বিশেস মত পোষন করতেন, (তিনি বণ্টন না করার মত পোষণ করতেন, (তিনি বণ্টন না করার মত পোষন করতেন, ভবিষ্যৎ বংশধরনের জন্যে রেখে দেওয়াই ছিল তাঁর ইচ্ছা) কিন্তু হাবশী ক্রীতদাস বিলাল অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় তাঁকে বাঁধা দিলেন। অন্যান্য বিরোধী মতের লোকদেরও তিনি একত্রিত করছিলেন। কিন্তু বিলালের বিপরীত মতের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার কোনো পথই থাকল না। অথচ তিনি তাঁর মতের যথার্থতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ও দৃঢ় মনোভাব সম্পন্ন ছিলেন। কেননা তিনি তো সাধারণ মুসলিমের কল্যাণের জন্যেই সেই মত পোষণ করছিলেন। তিনি নিরুপায় হয়ে স্বীয় আল্লাহর সমীপে হাত তুলে কাতর কণ্ঠে প্রার্থনা করলেনঃ
(আরবী********************************************************************************)
হে আল্লাহ! তুমি বিলাল ও তাঁর সঙ্গীতের বিরুদ্ধে আমার জন্যে যথেষ্ট হয়ে যাও।
এ-ই হচ্ছে আল্লাহর প্রদর্শিত পথ ও পন্থা। এই পন্থাই পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত হয়েছিল। এরই আলোকে জাহিলিয়াতে কার্যকরী তাগুতী সরকারের বীভৎস রূপ উদঘাটিত হয়।
জাহিলিয়াতে যে যুদ্ধকে পবিত্র যদ্ধ বলে মানবতা বিধ্বংসী যুদ্ধ চালায়, তা মূলত এবং আদপেই কোনো পবিত্র যুদ্ধ নয়। স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে দেওয়া যুক্তি মূলত এবং আদপেই কোনো পবিত্র যুদ্ধ নয়। স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষে দেওয়া যুক্তি আদপেই কোনো যুক্তি নয়, চরম স্বেচ্ছাচারিতা, পাশবিকতা ও বলাৎকার মাত্র।
জাহিলিয়াতের কথিত যুদ্ধ নিতান্তই অপবিত্র, অপরিচ্ছন্ন, অভদ্রজনোচিত এবং অমানবিক। করায়ত্ত করা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে তা একান্তই তাগুতী যুদ্ধ।
পুঁজিবাদী ও মূলধন ভিত্তিক স্বৈরতন্ত্র বর্ণিত কার্যকলাপ ছাড়া অন্য কিছুই করতে পারে না। প্রোলেটারিয়েটের স্বৈরতন্ত্রের কার্যকলাপও তাই হতে বাধ্য, যা উপরে দেখানো হয়েছে। সকল স্বৈরতন্ত্রই মানবীয় সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক। মানুষের ওপর মানুষের সার্বভৌমত্ব। তা ছাড়া অন্য কিছু হওয়া তার পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়।
তাই বলতে হচ্ছে, মানুষ যদ্দিন পর্যন্ত আল্লাহর দেওয়া আদর্শ ও নীতি অনুযায়ী রাষ্ট্র ও সরকার গঠন না করছে, তদ্দিন স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ছাড়া মানুষের ভাগ্যে আর কিছুই জুটতে পারে না।
মূলধন যদ্দিন মানুষের ওপর প্রধান প্রভাবশালী নিয়ন্ত্রক ও নীতি-নির্ধারক হয়ে থাকবে, তদ্দিন তা জাহিলিয়াত ছাড়া আর কিছুই হবে না। তদ্দিন তার পক্ষে আল্লাহর নাযিল করা বিধানের ভিত্তিতে রাজনীতি হড়ে তোলা ও পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তদ্দিন পর্যন্তই জাহিলিয়াতের দুর্ধর্ষ স্বৈরতন্ত্র থেকে মানবতার মুক্তি নেই। তদ্দিন পর্যন্ত বিদ্রোহী শ্রেণীর পক্ষ তার হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া কখনোই সম্ভব হবে না। তদ্দিন পর্যণ্ত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সেই মুখোমুখি দাঁড়ানো শ্রেণীকে স্বৈরতন্ত্রের নিষ্পেষণ থেকে রক্ষা করতে পারবে না। তদ্দিন তা এমন সব আইন কার্যকর করবে, যা তাদের রক্ষা করতে পারবে না। তদ্দিন তা এমন সব আইন কার্যকর করবে, যা তাদের ক্ষমতাকেই সুদৃঢ় করবে, শাসক পুঁজিপতিদের স্বার্থই রক্ষা করবে, সর্বাঙ্গীনভাবে।
তা থেকে মুক্তি ও নিষ্কৃতি সম্ভব নয় এজন্যে যে, সেই অবস্থাটা মূলধনের কর্তৃত্ব কায়েম করার নিশ্চিত অনিবার্য ফলশ্রুতি।
তবে তা ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যানুযায়ী নিশ্চিত অনিবার্য নয়। কেননা মূলধনের ব্যাপারটাই ঐ রূপ। ‘ব্যক্তি’ ওমানুষের দিকে না দিয়েই একথা বলা হয়েছে। ঐ কথা নিশ্চিত অনিবার্য হচ্ছে আল্লাহর জারীকৃত সুন্নাতের দৃষ্টিতে। আল্লাহর সুন্নাত হচ্ছে, মানুষ যদ্দিন পর্যন্ত আল্লাহর নাযিল করা বিধান ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম না করবে তদ্দিন পর্যন্ত তাগুতী শক্তিই তাদের শাসন করবে।
পুঁজিবাদী অবস্থায় তার ব্যাখ্যা হচ্ছে, মানুষ শুরু থেকেই আল্লাহর পদ্ধতি অনুযায়ী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে অস্বীকার করেছে। কেননা তা সুদ ও মুজদদারীকে সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করেছে। অথচ এ দুটিই হচ্ছে পুঁজিবাদের প্রধান স্তম্ভ। এ দুটির ওপর ভিত্তি করে পুঁজিবাদ গড়ে ওঠে। আল্লাহর পদ্ধতি মুষ্টিমেয় ধনী লোকদের হস্তে মূলধনের আবর্তন সীমিত হয়ে যাওয়াকেও হারাম ঘোষণা করেছে। কিন্তু লোকেরা যখন সে বিধান অমান্য করে বসল, তখন তাগুতই তাদের ওপর শাসক ও ধন-মালের মালিক হয়ে বসল। আর মানুষ হলো তারই নিকৃষ্ট লাঞ্ছিত দাস। এই দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে তাদের মুক্তিলাভ কখনোই সম্ভব নয়।
তাগুত মানুষকে দাসানুদাস বানানো থেকে কখনোই বিরত থাকবে না। কেবলমাত্র দুটি উপায়েই মানুষ এই অপমানকার অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে পারে। হয় মানুষ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর পথে ফিরে আসবে। তা হলে তখনই মূলধনের তাগুত ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে। অতবা মানুষ অপর এক তাগুতের সন্ধান করবে। তা এসে পুঁজিবাদের ওপর কঠিন আঘাত হানবে। মূলধনের কর্তৃত্ব খতম হয়ে যাবে।
আধুনিক জাহিলিয়াতের এই শেষোক্ত অবস্থারই একটি তাগুত এগিয়ে এসে মানুষের জানপ্রাণ ও ধন-মালের নিরংকুশ মালিক হয়ে বসেছে। এটাও আর একটি জাহিলিয়াত।
এই নতুন তাগুত যদ্দিন পর্যন্ত জাহিলিয়াতের মধ্যে থেকে শাসন ও নিয়ন্ত্রক হয়েই থাকবে, আল্লাহর নাযিল করা বিধানের ভিত্তিতে শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে না, তদ্দিন পর্যন্ত এই তাগুতকে মাথা ও বুকের ওপর দিয়ে সরিয়ে দেওয়া কখনোই সম্ভব হবে না। বিদ্রোহী শ্রেণীর পক্ষেও সম্ভব হবে না সেই শাসন কর্তৃত্ব তার হাতথেকে কেড়ে নেওয়া। তথাকথিত স্বাধীণতা ও গণতন্ত্র সম্পূর্ণ অর্থহীন হয়েই থাকবে তাদের জীবনে। এই সুযোগ এই তাগুত নিজের স্বার্থেই আইন প্রণয়ন করবে। তার হাত থেকে এই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার ও তার স্বৈরশাসনের পথে বাধার সৃষ্টি করার কোনো সুযোগ তা দেবে না।
না, তা কখনোই হবে না।
এই প্রেক্ষিতেই বলতে হচ্ছে, স্বৈরশাসন –তা মূলধন তথা পুঁজিবাদেরই হোক কিংবা হোক প্রোলেটারিয়েটের অথবা অন্য কোনো নামই ধারণ করুক –কোনো হালকা ও অস্থায়ীভাবে সওয়ার হয়ে বসা জিনিস নয় যে, সহসাই তা দূর হয়ে যাবে। আর জাহিলিয়াতের আকাশ থেকে লোকদের ওপর স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বর্ষণ হবে এই তাগুতের ছায়াতলে, তা কোনো ক্রমেই কল্পনা করা যায় না।
ইতিহাসের জাহিলী বস্তুবাদী ব্যাখ্যায় সবচেয়ে প্রধান সমস্যা –সব সমস্যারই গোড়ার কথা –হচ্ছে ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থা ও তজ্জনিত রাজনৈতিক ফলাফল।
পুঁজিবাদী স্বৈরতন্ত্র সীমা-নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তি মালিকানার অবাধ সুযোগ দিয়েছে, আর যদ্দিন তা এমনি সীমা ও নিয়ন্ত্রণহীন থাকবে তার রপ যা-ই হোক –তার নিশ্চিত অনিবার্য ফলশ্রুতি হচ্ছে, তারই হস্তে ধীরে ধীরে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়বে। পরে তা এই ক্ষমতাকে সংরক্ষিত করার জন্যে সর্বশক্তি নিয়োজিত করভে। এ ক্ষমতা ক্রমবর্ধমান, ক্রমবর্ধমানতা-ই তার প্রকৃতি। ফলে সুদ ও সুদী কারবার সম্পদকে ক্রমাগতভাবে চক্রবিদ্ধ হারে বাড়িয়ে দিবে তিন-চারগুণ বেশি-মুনাফা লাভের সুযোগ দিয়ে (আর পুঁজিবাদী স্বৈরতন্ত্র তো এরই ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়।) শেষ পর্যন্ত তা মজুদদারী ব্যবসায়কে জমজমাট করে দেবে।–[সুদ ও মজুদদারী থেকেই উত্তরকালে অর্থনীতির ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে। কিন্তু আমরা এখানে তার শুধু রাজনৈতিক কুফলের কথা বলেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছি।] বর্তমান দুনিয়ার পুঁজিবাদ দেশসমূহে আমরা তাই ঘটতে দেখছি। আর তারই দরুন প্রভাব ও কর্তৃত্ব খুবই মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। তারা খুব ভালো করেই জানে যে, তারা জীবিত মানুষের তাজা-তৃপ্ত রক্ত নিঃশেষ শুষে নিচ্ছে। একথাও তার জানা আছে যে, জনগণকে পুরোপুরি স্বাধীনতা দেওয়া হলে তারা এই মুষ্টিমেয় লোকদের খতম করে তাদের ধন-মাল, শ্রম-মেহনত ও ঘাম-রক্তের প্রতিশোধ অবশ্যই নেবে।
এই কারণে পুজিবাদের গোষ্ঠী আইন প্রণয়নের সমস্ত ক্ষমতা নিজেদের মুঠির মধ্যে রেখে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার পুরোপুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করা। শুধু তা-ই নয়, সরকার যন্ত্র দখল করে কিংবা রাজনৈতিক দল গঠন করে আইন কার্যকর করার ক্ষমতাটাও নিজেদের মুঠির মধ্যে ধরে রাখে, আর জনগণকে কিছুটা সামাজিক ন্যায়বিচার ও অন্যান্য কিছু আনন্দানুষ্ঠানের স্বাধীনতা দিয়ে মশগুল রাখে যেন তাদের অন্যায় গণ-স্বার্থবিরোধী ও শোষণমূলক কার্যকলাপের প্রতি তাদের দৃষ্টি না পড়ে।
হ্যাঁ, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বেশ সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়।
সেই সুযোগ-সুবিধা নৃত্যগীত, নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা, মদ্যপান, জুয়াখেলা ও জেনা-ব্যভিচারের। তার ঘোষণাই হলো, যা ইচ্ছা করতে পারো। এটা তোমার ব্যক্তি স্বাধীণতার ব্যাপার। তোমাকে কেউ কোনো কাজে বাধা দিতে পারবে না, বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারবে না। কারুর কর্তৃত্ব হলোবা না তোমার ওপর। মনে যেমন ভালো লাগে পোষাক পরিধান করো আর ন্যাংটা হতে চাও? তাতেও কোনো বাঁধা নেই। তোমার যৌন সম্পর্ক করো যেমন তোমার ইচ্ছা –যার সাথে ইচ্ছা। তুমি তো স্বাধীনতার ছত্রছায়ায় বাস করার সুযোগ পাচ্ছ।
এই ধরনের সম্ভাব্য সকল উপায় অবলম্বন করেই পুঁজিবাদ টিকে তাকে। জনগণের বুকের ওপর চাপা থাকে তাগুতের জগদ্দল পাথর।
প্রোলেটারী স্বৈরতন্ত্র অবশ্য ব্যক্তিগত মালিকানা ও খতম করে দেয়। আর যদ্দিন এই ব্যক্তিগত মালিকানা বন্ধ থাকবে, তদ্দিন তার অনিবার্য ফলশ্রুতিতে কর্তৃত্ব ও আধিপত্য সম্পূর্ণ রূপ শাসন ক্ষমতার হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকবে। এই শাসন যদ্দিন স্থায়ী থাকবে, কোনো ব্যক্তিই একবিন্দু জিনিসেরও মালিক হতে পারবে না। একমুঠি খাবারও পেতে হবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে। এই পথ ছাড়া অন্য কোনো পথেই এক মুঠি খাবারও পাওয়া যাবে না। এরই নিশ্চিত অনিবার্য ফলে ব্যক্তি হবে রাষ্ট্রের নিকৃষ্টতম গোলাম। এই গোলামীর বিনিময়ে সে পাবে এক মুঠি খাবার মাত্র। তার পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে বা তার কোনো আচরণের প্রতিবাদী হয়ে দাঁড়ানো তার পক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে তা তার কোনো আচরণের প্রতিবাদী হয়ে দাঁড়ানো কোনোদিনই সম্ভব হবেনা। কেননা তার জীবিকা –তার বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় একমুঠি খাবার তো সরকারের কাছ থেকে তাকে পেতে হচ্ছে। তার কর্তৃত্বের আওতার বাইরে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। কোনো তা গেলে তাকে না খেয়ে মরতে হবে। এরূপ অবস্থায় প্রোলেটারী পত্র-পত্রিকার সরকারী মালিকানাধীন থেকে প্রত্যেক জীবিকা থামা শাসনের খুবই পবিত্র চরিত্র নিঃস্বার্থ ও আন্তরিক একনিষ্ঠ হওয়ার কথা বলো। আর সে মরে গেলেই কিংবা ক্ষমতাচ্যুত হলেই তাকে বর্বর, নির্মম, বিশ্বাসঘাতক, খুনী ও মানুষের দুশমনরূপে চিত্রিত করে। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে মৌলিকভাবে কোনোই পার্থক্য নেই। কার্যত এটা ওটা দুটোই সমান। এটা হলেও কিছু যায় আসে না, ওটা হলেও কোনো লাভ নেই। কেননা স্বৈরতন্ত্র কেবল মাত্র শাসক ব্যক্তির মধ্যে নিহিত নয়। এই গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তিই রক্ষিত হয়েছে স্বৈরতন্ত্রের ওপর। তাতে একজন শাসক চলে গেলে আর একজন এসে তারই মতো স্বৈরতন্ত্র চালায়। জনগণ যে অবস্থায় পূর্বে ছিল পরেও ঠিক সেই অবস্থায়ই পড়ে থাকে। বিন্দুমাত্র পার্থক্য কোথাও লক্ষ্যগোচর হয় না।
অবশ্য প্রোলেটারী স্বৈরতন্ত্র –সমাজতান্ত্রিক শাসন –বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলে বেড়ায়, তা সেইসব মানুষকে সম্পূর্ণ মুক্তিদান করেছে যারা সামন্তবাদের অধীন অপমানকর অবস্থার বাস করত ভূমিহীন ছিল বলে এবং মূলধনের পুঁজিবাদের নিকৃষ্ট গোলামী থেকেও। তথায় মানুষ এক মুঠি খাবারের জন্যে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হচ্ছিল। …হ্যাঁ, মুক্তি পেয়েছিল বটে; কিন্তু কিছু সময় যেতে না যেতেই আবার সেই লাঞ্ছনা ও অপমানের মধ্যে পড়ে গেল সেই একমুঠি খাবারের জন্যে। একজন মালিক চলে গেল, আর একজন এসে গেল, জনগণ যেমন নিকৃষ্ট দাস পূর্বে ছিল, পরেও তাই থাকবে। মৌলিকভাবে অবস্থার কিছুমাত্র পরিবর্তন হলো না। শুধু তাগুতের আকৃতি বদলে গেল। জনগণ পূর্বের মতই পূঞ্জীভূত জাহিলিয়াতের মধ্যে নিমজ্জিত থাকল। নিতান্তই দাস হয়ে থাকল।
সমাজতন্ত্রও জনগণকে তার স্বৈরশাসন থেকে গাফিল বানিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে পুঁজিবাদের মতোই জনগণকে কিছুটা স্বার্থ, কিছুটা সুযোগ-সুবিধা, কিছুটা সামাজিক সুবিচার ও আনন্দ লাভের নানা অনুষ্ঠান পালনের অনুমতি দিয়েছে। তা-ও সেই নৃত্য-গীত, নারী পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা, যৌন-প্রবৃত্তির অবাধ নির্বিঘ্ন চরিতার্থতা ইত্যাদি। সমাজতন্ত্র ও জনগণকে বলে যা ইচ্ছা হয় করো, এখন তো তোমরা মুক্ত ও স্বাধীন।
পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক উভয় স্বৈরতান্ত্রিক কিছু কিছু প্রকৃত সুযোগ-সুবিধাও জনগণ লাভ করে বটে –তাতে সন্দেহ নেই। কিছু আংশিক ন্যায়পরতাও পায়, পায় কিছুটা আনন্দ স্ফুর্তি। যেমন কুকুরের ঘেউ থামাবার জন্যে তার সম্মুখে কিছু মাংসহীন হাড় ছুড়ে দেওয়া হয়, এইভাবে জনগণকে সম্পূর্ণ বেখেয়াল অপ্রতিবাদী বানিয়ে রেখে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম তাগুতের নিরংকুশ শাসন কায়েম হয়ে যায়। আর স্বয়ং শাসকগোষ্ঠী সর্বপ্রকারের ফিসক ফুজুরী পাপানুষ্ঠানের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে থাকে।
পুজিবাদী তাগুতের অধীন মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যক্তির হাতে এত ধন-সম্পদ ও শক্তি-ক্ষমতা পুঞ্জীভূত হয়ে যায় এবং তাদের জীবনে বিলাস-ব্যসন ও আনন্দ গৌরবের তত সীমা-সংখ্যহীন সামগ্রী ও তার চাকচিক্য এসে যায় যে, তা দেখে লোকদের চোখ ঝলসে যায়।
আর সমাজতান্ত্রিক তাগুতী ব্যবস্থায় কর্তৃত্ব সম্পন্ন ও শাসনদণ্ড ধারণকারী কতিপয় দলীয় নেতা ও কর্মী দুনিয়ার সীমাহীন আনন্দ ও ভোগ-সম্ভোগ সামগ্রী দুই হাতে লুটেপুটে নেয়। আর অভাব-অনটন দারিদ্র্য দেশের আপামর জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে বণ্টন করে দেয়। এরা কোনো দিনই সুখের মুখ দেখে না। আর কর্তারা কোনো দিনই জানতে পার না অভাব ও ক্ষুধা কাকে বলে।
এই উভয় ধরনের স্বৈরতন্ত্রই প্রচারযন্ত্রসমূহ নিজেদের ইচ্ছামতো প্রোপাগাণ্ডা চালানোর কাজে ব্যবহার করে। জনসাধারণ তাদের দয়ায় কি কি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে, সরকার তাদের খিদমতে কিভাবে দিন-রাত ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছে –তার ব্যাপক প্রচার চালানো হয়, যা শুনে জনগণ স্তম্ভিত ও হতবাক হয়ে থাকতে বাধ্য হয়। তারা শাসক গোষ্ঠীর অন্যায়-অত্যাচার ও অনাচার দেখাবার ও তার বিরুদ্ধে বলার কোনো সুযোগই কখনও পায় না। তারা যে মানুষগুলোকে নির্বাক জন্তু-জানোয়ারে পরিণত করে রেখেছে তাদের সকল মানবিক মর্যাদা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করে –তা বোঝার সামর্থ্যও অনেকেরই হয় না।
ইতিহাসের জাহিলী ব্যাখ্যায় এসব কিছুই বিপ্লব ও উন্নতির নামে চলে আসছে আবহমানকাল ধরে।