আবদুল মুত্তালিব বিন হশিমের সন্তান সন্তুতি
ইবনে হিশাম বলেন,
“আবদুল মুত্তালিব ইবনে হাশিমের ঔরসে দশ পুত্র ও ছয় কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। পুত্ররা হলেনঃ আল-’আব্বাস, হামযা, ’আবদুল্লাহ, আবুতালিব, যুবায়ের, হারেস,
১১.ইবনে হিশামের মতে নাদারের অপর নাম কুরাইশ। তার বংশধরই কুরাইশী বলে খ্যাত। তার বংশোদ্ভূত না হলে কাউকে কুরাইশী বলা চলে না। অন্যেরা বলেন ফিহির ইবনে মালিকের নাম কুরাইশ।
হাজলা, মুকাওয়েম, দিরা, আবু লাহাব (প্রকৃত নাম আবদুল উয্যা)। কন্যাগণ হলেনঃ সাফিয়া, উম্মে হাকিম আল বায়দা, আতিকা, উমায়মা, আরওয়া, বাররাহ।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতামাতা
আবদুল মুত্তালিবের পুত্র আবদুল্লাহর ঔরসে এবং ওয়াহাবের কন্যা আমিনার গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেন আদমের (আ) শ্রেষ্ঠতম সন্তান মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ বিন আবদুল মুত্তালিব। আল্লাহ তাঁর পরিবার পরিজনদের প্রতি অশেষ শান্তি, রহমত ও বরকত নাযিল করুন।
মাতার দিক থেকে তাঁর বংশ পরম্পরা নিম্নরূপ:
আমিনা বিনতে ওয়াহাব ইবনে আবদ মানাফ ইবনে যুহরাহ ইবনে কিলাব ইবনে মুররা ইবনে কা’ব ইবনে লুয়াই ইবনে গালেব ইবনে ফিহির ইবনে নাদার। আমিনার মাতা বারা বিনতে আবদুল উয্যা ইবনে উসমান ইবনে ‘আবদুদ-দার ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুররা ইবনে লুয়াই ইবনে গালেব ইবনে ফিহির ইবনে মালেক ইবনে নাদার।
সুতরাং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আদমের (আ) সন্তানদের মধ্যে পিতৃ মাতৃ উভয় কূলের দিক থেকে সম্ভ্রান্ততম, শ্রেষ্ঠতম, উচ্চতম ও মহত্তম।
যমযম কূপ খনন ও তদবিষয়ে সৃষ্ঠ মতবিরোধ
একদিন আবদুল মুত্তালিব পবিত্র কা’বার হাতীমের [১২. অর্থাৎ কা’বার ভিত্তির যে অংশ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃক স্থাপিত হয়েছিলো। কিন্তু কুরাইশরা তার ওপর আর কোন কিছু নির্মাণ করেনি।]মধ্যে ঘুমিয়ে আছেন এমন সময়ে স্বপ্নে যমযম কূপ খননের আদেশ পেলেন। এ সম্পর্কে স্বয়ং আবদুল মুত্তালিবের বর্নলা নিম্নরূপঃ আমি হাতীমের মধ্যে ঘুমিয়ে আছি। এমতাবস্থায় এক অচেনা আগন্তুক এলেন এবং আমাকে বললেন, পবিত্র কূপ খনন কর। আমি জিজ্ঞেস করলাম : কোন্ পবিত্র কূপ? আগন্তুক এর কোন জবাব না দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন পরদিন আমি নিজের শোয়ার ঘরে গিয়ে ঘুমালাম, এ রাতেও সেই আগন্তুক এসে বললেনঃ সংরক্ষিত কূপ খনন কর। আমি জিজ্ঞেস করলাম : কোন্ সংরক্ষিত কূপ? আগন্তুক কোন জবাব না দিয়ে অর্দশ্য হয়ে গেলেন। পরদিন আম উক্ত স্থানে ঘুমাতে গেলাম, সেই আগন্তুক আবার এলেন এবং বললেন : যমযম খনন কর। আমি বললাম : যমযম কি? তিনি বললেন : “যে কূপের পানি কখনো কমে না বা শুকায় না, যা সর্বোচ্চ সংখ্যক হাজীকে খাবার পানি সরবরাহ করতে পারবে, যা অবস্থিত গোবর ও রক্তের মাঝখানে সাদা ডানাবিশিষ্ট কাকের বাসার নিকটে।” [১৩.কথিত আছে যে, আবদুল মুত্তালিব যখন কূপ খনন করতে উদ্যোগী হলেন তখন তাঁকে খননের যে স্থান নির্দেশ করা হয়েছিল, সেখানে পিঁপড়ের ঢিবি ও কাকের গুহা দেখতে পেলেন। কিস্তু গোবর ও রক্ত দেখতে পেলেন না। ফলে তিনি দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় সহসা সেখানে একটি গাভীকে ছুটে আসতে দেখলেন। এক ব্যক্তি গাভীটি জবাই করতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু গাভীটি ছুটে পালিয়ে আসে। লোকটি পিছু পিছু ছুটে এসেও তাকে ধরতে পারলো না। গাভী শেষ পর্যন্ত মসজিদেহারামের চৌহদ্দির ভেতরে এসে ঢুকে পড়লো। চিহ্নিত স্থানটিতে এসে গাভী দাঁড়ালে লোকটি সেখানেই সেটিকে জবাই করলো। ফলে গাভীর রক্ত ও গোবর বেরিয়ে এল। আবদুল মুত্তালিবের কাছে সমগ্র ব্যাপারটা পরিস্কার হযে গেল এবং তিনি সেখানেই খনন কাজ শুরু করে দিলেন।]
আগন্তুক তাঁর কাছে যখন যমযম কূপের বৈশিষ্ঠ স্পষ্ট করে দিল ও স্থান নির্দিষ্ঠ হলো এবং স্বপ্নের সত্যতা সম্পর্কে আর কোন সন্দেহ রইলো না, তখন পরদিন সকালে পুত্র হারেসকে সাথে করে কোদাল নিয়ে সেখানে গেলেন। হারেস ছাড়া তখন তাঁর আর কোন পুত্র জন্মগ্রহণ করেনি। যমযম কূপ [প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আবদুল মুত্তালিব প্রকৃতপক্ষে যমযম কূপ পুনঃখনন করেন। এই কূপের আবির্ভাব ঘটে সর্বপ্রথম খৃস্টপূর্বে ১৯১০ সালে, হযরত ইসমাঈলের জন্মের বছরে। হিজরী সাল অনুযায়ী রাসূল (সা) এর জন্মের ২৫৭২ বছর আগে এটির আবির্ভাব ঘটে। পরে এক পর্যায়ে যমযম কূপ শুকিয়ে যায় ও মাটির নীচে চাপা পড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এর কোন চিহ্নই আর অবশিষ্ট থাকেনি। আবদুল মুত্তালিবের হাওত পুনঃখনন না হওয়া পর্যন্ত এর সন্ধান কেউ পায়নি। (মক্কা শরীফের ইতিকথা, পৃঃ২২,২৩ ও ২৪) ] খননের কাজ এগিয়ে চললো।যখন আবদুল মুত্তালিব সেই প্রস্তরটি দেখতে পেলেন যা থেকে কূপ উৎসারিত হয়েছে তখন আনন্দের আতিশয্যে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। কুরাইশরা ঐ ধ্বনি শুনে বুঝতে পারলো যে, আবদুল মুত্তালিব যা খুঁজছেন তা পেয়ে গেছেন। সবাই তাঁর কাছে এসে বললো, “হে আদুল মুত্তালিব, ওটা তো আমাদের পিতা ইসমাঈলের কূপ। এতে আমাদেরও হক আছে। আপনি আমাদের কে এই কূপের অংশীদার করুন!” আবদুল মুত্তালিব বললেন, “আমি তা পারবো না। এ জিনিসটা শুধু আমাকে দেয়া হয়েছে, তোমাদেরকে নয়।” তারা বললো, “আমাদের সাথে ন্যায় সঙ্গতভাবে ফায়সালা করুন। তা না হলে আমরা চূড়ান্ত বুঝাপড়া না করে আপনাকে ছাড়বো না।” আবদুল মুত্তালিব বললেন, “বেশ, তাহলে তোমাদের ও আমার মধ্যে এই বিরোধ মীমাংসার জন্য যাকে খুশী সালিশ মানো। আমি তার ফায়সালা মেনে নিতে প্রস্তুত।” তারা বললো, “বনু সা’দ গোত্রে হুযাইম নামে এক জ্যোতিষিণী আছে। সে-ই আমাদের সালিশ।” আবদুল মুত্তালিব বনু আবদ মানাফ গোত্রের কিছু লোককে সাথে নিয়ে সেখানে রওনা দিলেন। প্রতিটি কুরাইশ গোত্রের একজন করে লোক গেল তাঁর সাথে। সমগ্র যাত্রাপথটা ছিল মরু অঞ্চণের ভেতর দিয়ে। হিজাজ ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী এক মরুভুমিতে পৌঁছেতেই আবদুল মুত্তালব ও তাঁর দলের লোকদের পানি ফুরিয়ে গেল। পিপাসায় তাদের এমন শোচনীয় দশা হলো যে, বাঁচার আর কোন আশাই রইলো না। সহগামী কুরাইশ গোত্রগুলোর কাছে তাঁরা খাবার পানি চাইলে তারা দিতে রাজী হলোনা। তারা বললো, “আমরাও মরুভূমিতে আছি। আশংকা হয় আমাদের অবস্থাও তোমাদের মত হতে পারে।”
আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদের নিষ্ঠুর আচরনে মর্মাহত হয়ে এবং নিজেদের সম্ভাব্য শোচনীয় পরিনতির কথা চিন্তা করে সহযাত্রীদের কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন আমাদের কি করা উচিত বলে তোমরা মনে কর?” সহযাত্রীরা এক বাক্যে বললো, “আমরা শুধু আপনার মতানুসারে কাজ করবো। আপনি যা ভালো মনে করেন নির্দেশ দিন।” তিনি বললেন, “আমি মনে করি, আমাদের গায়ে এখনো যেটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে প্রত্যেকে নিজের কবর খুঁড়ে রাখি। অতঃপর যখন একজন মারা যাবে, তখন আমরা যারা জীবিত থাকবো তারা তাকে ঐ কবরে নিক্ষেপ করবো এবং মাটি ঢেকে দেবো। সবার শেষে মাত্র একব্যক্তি অবশিষ্ট থাকবে। গোটা কাফিলার লাশ নষ্ট হওয়ার চেয়ে একটিমাত্র লোকের লাশ নষ্ট হোক, তাও ভালো সবাই একবাক্যে আবদুল মুত্তালিবের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করলো এবং সবাই নিজ নিজ কবর খুঁড়লো। অতঃপর পিপাসার দরুন অবধারিত মৃত্যুর অপেক্ষঅয় সবাই বসে প্রহর গুনতে লাগলো। কিছুক্ষন পর আবদুল মুত্তালিব তাঁর সঙ্গীদেরকে বললেন, “আল্লাহর কসম, একবারেই নিশ্চেষ্ট বসে বসে কোথাও না গিয়ে এবং জীবন বাঁচানোর কোন অবলম্বন না খুঁজে অসহায়ভাবে মৃত্যুর কবলে নিজেদেরকে এভাবে সঁপে দেয় ভীষণ কাপুরুষতা। এমনও তো হতে পারে যে, আল্লাহ কোন স্থানে আমাদের জন্য পানির ব্যবস্থা করে দেবেন। অতএব, চল, যাত্র শুরু করা যাক।” যাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। সফরের সহযাত্রী অন্যান্য কুরাইশরা (যারা পানি দিতে অস্বীকার করেছিল) এতক্ষণ তাদের সমস্ত তৎপরতা নিরীক্ষণ করছিল। আবদুল মুত্তালিব সওয়ারীতে আরোহণ করলেন। যেই সওয়ারী চলতে আরম্ভ করেছ, অমনি তার পায়ের খুরের নীচ থেকে সুপেয় পানির একটি ঝর্ণা নির্গত হলো। তা দেখে আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর সঙ্গীরা ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে উঠলেন অতঃপর আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর সঙ্গীরা সওয়ারী থেকে নেমে পানি পান করলেন এবং মশকগুলো পূর্ণ করে পানি ভরে নিলেন। এরপর আবদুল মুত্তালিব কুরাইশদেরকে ডেকে বললেন, “এসো, আল্লাহ আমাদের পানি পান করিয়েছেন।তোমরাও পানি পান করে যাও ও মশক ভরে নিয়ে যাও।” তারা এলো এবং পানি পান করে ও মশক ভরে নিয়ে গেল। অতঃপর তারা বললো, “হে আবদুল মুত্তালিব, আল্লাহর কসম, আমাদের ওপর তোমার প্রাধান্য চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হয়ে গেছে। আমরা যমযমের ব্যাপারে আর কখনো তোমার সাথে কলহ করবো না। আমরা বুঝতে পেরেছি, যিনি আজ তোমাকে এই মরুভূমিতে পানি পান করিয়েছেন, তিনিই তোমাকে যমযমের পানি পান করিয়েছেন। অতএব তুমি পুনরায় তোমার পানি পান করানোর মহান কাজে দ্বিধাহীনভাবে নিয়োজিত হও।”
আবদুল মুত্তালিব ফিরে চললেন এবং সেই কাফিলার অন্য সবাই ফিরে চললো। জ্যোতিষিণীর নিকট কেউ গেল না এবং আবদুল মুত্তালিবকেও তার কাছে যাওয়া থেকে সবাই অব্যহতি দিল।
আবদুল মুত্তালিব কর্তৃক তাঁর পুত্রকে কুরবানীর মানত
আবদুল মুত্তালিব যমযম কূপ খননের সময় কুরাইশদের পক্ষ থেকে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মানত করেছিলেন যে, যদি তাঁর দশটি সন্তান জন্মে এবং তারা তাঁর জীবদ্দশায় বয়োপ্রাপ্ত হয়ে তাঁর রক্ষণাবেক্ষণ করতে সক্ষম হয় তাহলে তিনি একটি সন্তানকে আল্লাহর নামে কা’বার পাশে কুরবানী করবেন। সুতরাং তাঁর পুত্রের সংখ্যা যখন দশটি পূর্ণ হলো এবং তিনি বুঝতে পারলেন যে, তারা তাঁকে রক্ষা করতে পারবে তখন তিনি তাদের সবাইকে ডেকে একত্র করলেন এবং তাদেরকে নিজের মানতের কথা জানালেন। অত:পর তাদেরকে ঐ মানত পূরণের আহ্বান জানালেন। পুত্ররা সবাই সম্মতি প্রকাশ করলো। জিজ্ঞেস করলো।, “আমাদের কিভাবে কি করতে হবে?” তিনি বললেন, “তোমরা প্রত্যেকে একটা করে তীর নেবে। অতঃপর তাতে নিজের নাম লিখে আমার কাছে আসবে।” সকলে তাই করলো এবং তার কাছে এলো। আবদুল মুত্তালিব তাদেরকে সাথে নিয়ে ‘হুবাল’ নাম মূর্তির নিকট গেলেন। তখন হুবাল থাকতো কা’বার মধ্যবর্তী একটি গহ্বরের কাছে। এই গহ্বরেই জমা হতো কা’বার নামে উৎসর্গীকৃত যাবতীয় জিনিস।
হুবালের কাছে ৭টি তীর থাকতো। প্রত্যেক তীরেই এক একটা কথা উৎকীর্ণ ছিল। একটা তীরে উৎকীর্ণ ছিল “রক্তপণ।” যখন তাদের ভেতরে “রক্তপণ” কার ওপর বর্তায় (অর্থাৎ আমার হত্যাকারী কে) তা নিয়ে মতবিরোধ ঘটতো, তখন ৭টা তীর টানা হতো। যদি “রক্তপন” উৎকীর্ণ তীর বেরিয়ে আসতো তাহলে যার নাম বেরুতো,তাকেই “রক্তপণ” দিতে হতো। একটা তীরে লেখা ছিল “হাঁ”। যখন কোন কাজের ইচ্ছা পোষণ করা হতো, তখন একই নিয়মে তীরগুলো টানা হতো। যদি ঐ “হা” লেখা তীর বেরুতো তাহলে ইস্পিত কাজ করা হতো। আর একটা তীরে লেখা ছিল “না”। যে কোন কাজের ইচ্ছা নিয়ে তীরগুলো টানা হতো। যদি“না” লেখা তীর বেরিযে আসতো, তাহলে আর সে কাজ তারা করতো না। আর একটা তীরে লেখা ছিল “তোমাদের অন্তর্ভুক্ত বা তোমাদের মধ্য থেকে ” আর একটা তীরে লেখা ছিল “সংযুক্ত” আর একটাতে “তোমাদের বহির্ভূত” আর একটাতে “পানি”। কূপ খনন করতে হলে তারা এই তীর গুলোর মধ্য থেকে একটি টানতো যার মধ্যে এই তীরটিও থাকতো যা ফলাফল বেরুতো সেই অনুসারে কাজ করতো।
তৎকালে আরববাসী যখনই কোন বালকের খাত্না করাতে কিংবা কোন কন্যার বিয়ে দিতে ব্ াকোন মৃতকে দাফন করতে চাইতো অথবা কোন শিশুর জন্ম বৈধ কিনা তা নিয়ে সন্দেহে পড়তো, তখন তাকে ‘হুবাল’ নামক দেবমূর্তির নিকট হাজির করতো এবং সেইসাথে একশো দিরহাম ও একটা বলির উটও নিয়ে যেতো। টাকা ও উট তীর টানার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে দিত। অতঃপর যার ব্যাপারে নিষ্পত্তি কাম্য, তাকে মূর্তির সামনে হাজির করে বলতো, “হে আমাদের দেবতা, সে অমুকের পুত্র অমুক, তার ব্যাপারে আমরা তোমার নিকট থেকে অমুক বিযযে ফায়সালা কামনা করছি। অতএব তার ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত কী, তা আমাদের জানিয়ে দাও।” অতঃপর তীর টানার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে তারা তীর টানতে বলতো। যদি ‘তোমাদের অন্তর্ভুক্ত’ লেখা তীর বেরুতো, তাহলে তারা বুঝতো যে, সংশ্লিষ্ট শিশু বৈধ সন্তান, আর যদি ‘তোমাদের বহির্ভূত’ লেখা তীর বেরুতো, তাহলে ঐ সন্তান তাদের মিত্র বলে গণ্য হতো। আর যদি ‘সংযুক্ত’ লেখা তীর বেরুতো, তাহলে সে তাদের মধ্যে ঐ অবস্থাতেই থাকতো; তার বংশমর্যাদা বা মৈত্রী অনির্ধারিতই থেকে যেতো। আর যদি তাদের ইস্পিত অন্য কোন কাজের প্রশ্নে ‘হাঁ’ লেখা তীর বেরুতো, তাহলে ঐ কাজ অবিলম্বেই সম্পন্ন করতো। কিন্তু ‘না’ লেখা তীর বেরুলে ঐ বছরের জন্য কাজটি স্থগিত রাখতো। পরবর্তী বছর ঐ কাজ সম্পর্কে একই পন্থায় সমাধান চাইতো। এভাবে তীরের ফায়সালাই ছিল তাদের সকল ব্যাপারে চূড়ান্ত ফায়সালা।
আবদুল মুত্তালিব তীর টানায় নিয়োচিত ব্যক্তিকে বললেন, “আমার এই পুত্রদের ব্যাপারে তীর টেনে দেখুন তো।” তিনি তাকে নিজের মানত সম্পর্কেও অবহিত করলো। আবদুল্লাহ ছিলেন ঐ সময় আবদুল মুত্তালিবের কনিষ্ঠতম পুত্র। [পরবর্তী সময়ে জন্মগ্রহণকারী হামযা ও আব্বাস (রা) আবদুল্লাহ্রও ছোট ছিলেন।] তিনি ছিলেন আবদুল মুত্তালিবের সর্বাধিক প্রিয় সন্তান। তাই তিনি ব্যগ্রভাবে লক্ষ্য করছিলের যে, তীর আবদুল্লাহকে পাশ কাটিয়ে যায় কি না। পাশ কাটিয়ে গেলেই তো আবদুল্লাহ বেঁচে যান। তীর টানা লোকটি যখন তীর টানতে উদ্যত হলো, তখন আবদুল মুত্তালিব হুবাল দেবতার কাছে দাঁড়িয়ে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন। অতঃপর তীর টানা হলে দেখা গেল, তীর আবদুল্লাহর নামেই বেরিয়েছে। অলে আবদুল মুত্তালিব এক হাতে আবদল্লাহকে ও অন্য হাতে বড় একটা ছোরা নিযে তাকে জবাই করার উদ্দেশ্যে ইসাফ ও নায়েলার (দেব-দেবী) পাশে গেলেন। আসর জমিয়ে বসা কুরাইশ নেতারা তখন উঠে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ওহে আবদুল মুত্তালিব, ব্যাপার কি?” তিনি তখন উঠে গিয়ে বললেন, “আমার এই ছেলেকে জবাই করবো।” তখন কুরাইশগণ ও তার পুত্ররা একযোগে বলে উঠলো, “উপযুক্ত কারণ ছাড়া কিছেুতেই ওকে জবাই করো না। আর যদি তুমি এভাবে ছেলেকে জবাই করো, তবে অনাগত কাল পর্যন্ত তা চলতে থাকবে। লোকরো নিজ নিজ সন্তানকে এনে বলি দিতে থাকবে এবং মানব বংশ একে একে নিঃশেষ হয়ে যাবে।” আবদুল্লাহর মামাদের গোত্রীয় জনৈক মুগীরা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমার ইবনে মাখযুম বললেন, “একেবারে অনন্যোপায় হওয়া ছাড়া এমন কাজে প্রবৃত্ত হয়ো না। যদি আমরা মুক্তিপণ দিয়ে অব্যাহতি দিতে পারি তাহলে আমরা মুক্তিপণ দিতে প্রস্তুত।” পক্ষান্তরে, কুরাইশগণ ও আবদুল মুত্তালিবের পুত্ররা কললো, “তাকে জবাই করো না। বরং ওকে নিয়ে হিজাযে চলে যাও। সেখানে এক মহিলা জ্যোতিষী রয়েছে, তার অধীনে জ্বিন আছে। তাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও, কাজটা ঠিক হবে কিনা। এরপর আমরা বাধা দেব না। তুমি স্বাধীনভাবে যা খুশী ক’রো। মহিলা যদি জবাই করতে বলে জবাই করো, আর যদি অন্য কোন উপায় বাৎলে দেয় তাহলে সেটাই গ্রহণ করে নিও।” কুরাইশদের উপদেশটাই মেনে নিয়ে আবদুল মুত্তালিব ও তাঁর সহযোগীরা হিজায অভিমুখে রওয়ানা দিলেন। তাঁরা মদীনায় পৌঁছলেন ও খাইবারে সেই মহিলার সাক্ষাৎ পেলেন। আবদুল মুত্তালিব মহিলাকে তাঁর ও তাঁর পুত্রের সকল বৃত্তান্ত খুলে বললেন। মহিলা বললেন, “তোমরা আজ চলে যাও। আমার অনুগত জিন আসুক, তার কাছ থেকে আমি জেনে নিই”। সবাই মহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে আসলেন। বিদায় নিয়ে বেরিয়েই আবদুল মুত্তালিব আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করনৈ। পরদিন সকালে আবার সবাই মহিলার কাছে সমবেত হলেন। মহিলা বললেন, “আমি প্রয়োজনীয় তথ্য জেনেছি। তোমাদের সমাজে মুক্তিপণ কি হারে ধার্য আছে?” তারা জানেিলন, “দশটা উট।” মহিলা বললেন, যাও তোমাদের দেশে ফিরে যাও, অতঃপর তোমাদের সংশ্লিষ্ট মানুষটিকে মূর্তির নিকট হাজির কর ও ১০টা উট উৎসর্গ কর। অতঃপর উট ও তোমাদের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ভাগ্য বিধানের জন্য তীর টানো। যদি তোমাদের লোকের নামের বিপক্ষে তীর বেরোয় তাহলে উট আরো দাও, যতক্ষন তোমাদের মনিব খুশী না হন। আর যদি উটের নাতে বেরোয় তাহলে বুঝবে তোমাদের মনিব সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তোমাদের ব্যক্তিটি অব্যহতি পেয়েছে।”
এরপর সবাই মক্কায় চলে গেল। অতঃপর যখন তারা মহিলার কথা অনুযাী মূর্তির নিকট গিয়ে কর্তব্য সমাধায় প্রস্তুত হলো, তখন আবদুল মুত্তালিব দাঁড়িয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে লাগলেন। অতঃপর তারা আবদুল্লাহকে ও সেই সাথে দশটা উটকে যথারীতি হাজির করলো। আবদুল মুত্তালিব হুবালের নিকট দাঁড়িযে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন। অতঃপর তীর টানা হলো। তীর আবদুল্লাহর নমেই বেরুলে তারা আরো দশটা বৃদ্ধি করলো। ফলো উটের সংখ্যা দাঁড়ালো বিশ। আবদুল মুত্তালিব আবার আল্লাহর কাছে দোয়া করতে ’লাগলেন। পুনরায় তীর টানা হলো এবং এবারও আবদুল্লাহর নামে তীর বেরুলো। ফলে আরো দশটি উট বৃদ্ধি করে ত্রিশ করা হলো এবং আবদুল মুত্তালিব আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন। এবারও তীর টানা হলে আবদুল্লাহর নামে তীর বেরুলো। পুনরায় আরো দশটা উট বাড়িয়ে চল্লিশ করে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন আবদুল মুত্তালিব। এবার ও তীর টানা হলে আবদুল্লাহর নামে বেরুলো। পুনরায় আরো দশটা উট বাড়িয়ে পঞ্চাশ করা হলা এবং আবদুল মুত্তালিব আল্লাহর কাছে দোয়া করতে লাগলেন। এবারও তীর টানা হলো এবং তা আবদুল্লাহর নামে বেরুলো অতঃপর আরো দশটা উট বাড়িয়ে উটের সংখ্যা ষাট করার পর একই পন্থায় তীর টানা হলে তখনো আবদুল্লাহর নাম বেরুলো।আবার দশটা উট বাড়িয়ে উটের সংখ্যা সত্তর করার পর একই নিয়মে তীর টানা হলে আবারো হলো। এবারও আবদুল্লাহর নাম বেরুলো। এরপর আরো দশটা উট বাড়িয়ে উটের সংখ্যা আশি করা হলো এবারও আবদুল্লাহর নাম বেরুলো।অতঃপর আবার দশটা উট বাড়িয়ে নব্বই করা হলে আবার আবদুল্লাহর নামে তীর বেরুলো। অতঃপর আরো দশটা উট বাড়িয়ে একশো করার পর আবদুল মুত্তালিব একই নিয়মে আল্লাহর নিকট দোয়া করে তীর টানতে বললে এবার উটের নামে তীর বেরুলো। সমবেত কুরাইশগণ ও অন্য সবাই বলে উঠলো, “হে আবদলু মুত্তালিব, তোমার প্রভু এবার পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয়েছেন।”
অনেকের মতে আবদুল মুত্তালিব এরপর বললেন, “আমি আরো তিনবার তীর না টেনে ক্ষান্ত হব না।” ফলে আবদূল্লাহ ও উটের নামে তীর টানা হলো এবং আবদুল মুত্তালিব দাঁড়িয়ে দোয়া করতে লাগলেন। তীর উটের নামে বেরুলো। এভাবে দ্বিতীয়বার এবং তৃতীয়বারেও তীর উটের নামে বেরুলো। অবশেণে ঐ একশো উট কুরবানী করা হলো এবং কুরবানীর পর পশুগুলোকে এমনভাবে ফেলে রাখা হলো যেন কোন মানুষকে তার কাছে যেতে বাধা দেয়া বা ফিরিয়ে দেয়া না হয়।
মহানবীর (স্) আমিনার গর্ভে থাকাকালের ঘটনাবলী
প্রচলিত জনশ্রুতি থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মা আমিনা বিনতে ওয়াহাব বলতেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গর্ভে আসার পর তাঁর কাছে কোন এক অপরিচিত আগন্তুক আসেন এব্ং তাঁকে বলেন, “তুমি যাকে গর্ভে ধারণ করেছ, তিনি এ যুগের মানব জাতির মহানায়ক। তিনি যখন ভূমিষ্ঠ হবেন তখন তুমি বলবেঃ সকল হিংসুকের অনিষ্ট থেকে এই শিশুকে এক ও অদ্বিতীয় প্রভুর আশ্রয়ে সমর্পণ করছি। অতঃপর তার নাম রাখবে মুহাম্মাদ। [১৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পূর্বে মাত্র তিনজনের এনাম রাখা হযেছে। যথা: (১) কবি ফরাজদাকের দাদার দাদা মুহাম্মাদ ইবনে সুফিয়ান বিন মুজাশি। (২) মুহাম্মাদ ইবনে উহাইহা ইবনে আল জাল্লাহ (৩) মুহাম্মাদ ইবনে হিমরান ইবনে রাবিয়াহ। এ তিনজনের প্রত্যেকের পিতা জানতে পারেন যে, আল্লাহর এক রাসূলের আবির্ভাবের সময় ঘরিয়ে এসেছে এবং তিনি হিজাযে জন্মগ্রহণ করবেন। লোকমুখে একথা শুনে তাদের প্রত্যকে আকাক্সক্ষা জাগে যে, তিনি যেন তারই সন্তান হন। একবার তারা আসমানী কিতাবের জ্ঞান রাখে এমন এক বাদশাহর কাছে গমন করেন। তিনি তাদেরকে যানান যে, মাহাম্মাদ নামে একজন নবঢর আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে। এই সময় তাঁরা বাড়ীতে নিজ নিজ স্ত্রীকে গর্ভবতী দেখে এসেছিলেন। ফলে প্রত্যেকেই তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁদের পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট হলে তার নাম রাখবেন মুহাম্মাদ। এই সিধান্ত অনুসারেই তাঁরা তাঁদের তিন ছেলের নাম রেখেছিলেন।
তিনি গর্ভে থাকাকালে আমিনা স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর ভেতর থেকে এমন একটা আলোকরশ্মি বেরুলো যা দিয়ে তিনি সিরীয় ভূখ-ের বুসরার প্রাসাদসমূহ দেখতে পেলেন।
এরপর তিনি মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থাতেই অল্পদিনের মধ্যে তাঁর পিতা আবদুল্লাহ ইনতিকাল করেন।
রাসূলুল্লাহর (স) জন্ম
‘আমুল ফীল অর্থাৎ হস্তীবাহিনী নিয়ে আবরাহার কা’বা অভিযানের ঘটনা যে বছর ঘটে, সেই বছরের রবিউল আউয়াল মানের দ্বাদশ রজনী অতিক্রান্ত হবার শুভ মুহূর্তে সোমবারে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেন।
কায়েস ইবনে মাখরামা থেকে বণিৃত, তিনি কলেছেন, “আমি ও রাসূলুল্লাহ (সা) আবরাহার হামলার বছর জন্মগ্রহণ করি। তাই আমরা সমবয়সী”
হাসসান ইবনে সাবিত বলেন,
“আমি তখন সাত আট বছরের বালক হলেও বেশ শক্তিশালী ও লম্বা হয়ে উঠেছি। যা শুনতাম তা বুঝতে পারার ক্ষমতা তখন হয়েছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম জনৈক ইহুদী ইয়াসরিবের (মদীনার) একটা দুর্গের ওপর উঠে উচ্চস্বরে ওহে ইহুদী সমাজ!’ বলে চিৎকার করে উঠলো। লোকেরা তার চারপাশে জমায়েত হয়ে বললো, “তেমার কি হয়েছে?”আজ রাতে আমাদের জন্মে সেই নক্ষত্র উদিত হয়েছে।”
অতঃপর হয়রত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভূমিষ্ঠ হলে তাঁর মা আমিনা তাঁর দাদা আবুদল মুত্তালিবের নিকট এই বলে খবর পাঠালেন যে, “আপনার এক পৌত্র জন্মেছে। আসুন, তাঁকে দেখুন।” আবদুল মুত্তালিব এলেন, এসে তাঁকে দেখলেন। এই সময় আমিনা তাঁর গর্ভকালীন সময়ে দেখা স্বপ্নের কথা, নবজাতক সম্পর্কে যা তাঁকে বলা হয়েছে এবং তাঁর যে নাম রাখতে বলা হয়েছে তা সব জানালেন। অতঃপর আবদুল মুত্তলিব তাঁকে নিয়ে কা’বাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন এবং শিশুকে মায়ের কাছে দিয়ে ধাত্রীর সন্ধান করতে লাগলেন। অবশেষে বনু সা’দ ইবনে বাক্রের আবু যুয়াইবের কন্যা হালিমাকে ধাত্রী হিসেবে পাওয়া গেল।