উমরাতুল কাযাঃ ৭ম হিজরী সনঃ জিলকাদ মাস
খাইবার থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় রবিউল আউয়াল থেকে শাওয়াল মাস পর্যন্ত অবস্থান করেন। এই সময় তিনি বিভিন্ন সামরিক অভিযানে নিজে গমন করেন অথবা অন্য সাহাবীদের পাঠান।
এরপর যুলকা’দা মাসে তিনি আগের বছরের পরিত্যক্ত উমরার কাযা আদায় করার জন্য মক্কা অভিমুখে যাত্রা করেন্ আগের বছর এই মাসেই মুশরিকরা তাঁতে পথিমধ্যে বাধা দেয় ও উমরা বাদ দিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য করে। ঐ একই সফরে আগের বছর যেসব মুসলিম তাঁর সহচরবুন্দ অত্যন্ত অভাব অনটন ও দুঃখ-কষ্টের মধ্যে কালতিপাত করছে। ইবনে আব্বাস (রা) বলেনঃ কুরাইশরা রাসুলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবাদের দেখবার জন্র তাদের সম্মিলন গ্রহ ‘দারুন্ নাদওয়া’তে কারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ালো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন তখন তাঁর চাদর ডান বগলের নীচে ও বাম কাঁধের ওপর পেচিয়ে পরলেন এবং ডান হাত উঁচু করে ডান বগল ফাঁক করে বললেন, “আজকে যে ব্যক্তি নিজেকে শক্তিমান বলে জাহির করবে আল্লাহ তার ওপর রহমত করবেন।” একথা বলার পর তিনি হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন্ অতঃপর তিনি ও তাঁর সাহাবাগণ জোরে জোরে বীরোচিত ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগলেন। কা’বা ঘরের আড়ালে গিয়ে কুরাইশদের দৃষ্টির অন্তরালে গেলে রুকনে ইয়ামনী চুম্বন করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেছটে রুকনে আসওয়াদে পৌছে এক চক্কর সমাপ্ত করলেন। অতঃপর আগের মত বীরোচিত ভঙ্গিতে জোরে জোরে হাঁটলেন। এভাবে তিন চক্কর দিলেন এবং বাকী চক্করগুলি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে সম্পন্ন করলেন।
এই সফরেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওাসাল্লাম ইহরাম অবস্থায় মাইমুনা বিনতে হারিসকে (রা) বিয়ে করেন। আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা) এই বিয়ের উদ্যোক্তা ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনদিন মক্কায় অবস্থান করলেন। তৃতীয় দিন হুয়াইতিব ইবনে আবদুল উযযার নেদৃত্বে কুরাইশদের কয়েকজন এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো, “তোমরা মক্কায় থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। অতএব তুমি মক্কা ত্যাগ কর।” [৮০. অর্থাৎ হুদাইবিয়ার সন্ধি চুক্তিতে নির্ধারিত মেয়াদ ৩ দিন।]
কুরাইশরা তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এখানে তোমাদের উপস্থিতিতে আমি যদি বিয়ে সম্পন্ন করি এবং তোমাদের জন্য খাবারের আয়োজন করি আর তোমরা তাতে যোগ দাও তাহলে ক্ষতি কি?” তারা বললো “তোমার খাবারে আ,াদের প্রয়োজন নেই। তমি চলে যাও।”
রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা ত্যাপ করলেন। নিজের ভৃত্য আবু রাফেকে তিনি মাইমুনার (রা) দেখালোমানর জন্য রেখে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তানয়ীমের নিকটবর্তী সারেফ পৌছেলেন। আবু রায়ে মাইমুনাকে (রা) নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হলো। এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাহইমুনার (রা) নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হলো। এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাইমুনার (রা) সাথে বাসর রাত পাপন করলেন এবং পরে মদীনায় ফিরে গেলেন। ইবনে হিশাম বলেনঃ আবু উবাইদার বর্ণনা মতে এই সফর শেষেই আয়াত নাযিল হয়, “আল্লাহ তাঁর রাসূলুরে স্বাপ্ন সত্যে পরিনত করেছেন। (স্বপ্নে তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে) তোমরা অবশ্যই মসজিদুল হারমে নিরাপদে ও নির্ভিকভাবে শাথা মুন্ডিয়ে বা চুল ছেঁেট প্রবেশ করবে। তোমরা যা জানতে পারনি আল্লাহর রাসূল তা জেনেছেন। অতঃপর তার অব্যবহিত পরেই নির্ধারিত রেখেছেন আসন্ন বিজয়।” (আল ফাতহ, শেষ রুকু)
মুতার যুদ্ধঃ ৮ম হিজরী সনঃ জামাদিউল উলা
যুহাজ্জের বাকী অংশ এবং রবিউস্ সানী পর্যন্ত তিনি মদীনাতেই কাটালেন। এ বৎসর মুশরিকরা হজ্জে নেতৃত্ব ও তত্ত্বাবধান করলো। যায়িদ ইবনে হারিসার নেতৃত্বে জামাদিউল আউয়াল মাসে তিনি মুসলমানদের একটি বাহিনীকে সিরিয়া অভিানে পাঠান। এই বাহিনী মূতা নামক স্থানে যুদ্ধের সম্মীখীন হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ ছিল যে, যায়িদ যদি শহীদ কিংবা আহত হন তাহলে জাফর এবং জাফর শহীদ কিংবা আহত হলে আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা সেনাপতির দায়িত্ব নিয়োজিত হবেন।
তিন হাজার মুসলমান যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নিলেন। মুসলমানগণ তাদের বিদায় ও সালাম জানাতে এলে আবদুল্লাহ ইবনে রওয়াহা কেঁদে ফেললেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো, “আপনি কাঁদছেন কেন?” তিনি বললেন “দুনিয়ার মোহে কিংবা তোমাদের মায়ায় কাঁদছি না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওাসালাল্লামকে কুরআনের একটি আাত পড়তে শুনেছি। সে আয়াতে দোযখের উল্লেখ করে বলা হয়েছেঃ
“তোদমাদের প্রত্যেককে ঐ জাহান্নামের কাছে আসতে হবে। এটা তোমার প্রতিপালকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’ (মরিয়ম) আমি বুঝতে পারছি না জাহান্নামের পার্শ্বে যাওয়ার পর আমি কিবাবে তা থেকে উদ্ধার পাবো?” মুসলমানগণ তাঁকে সান্ত¦না দিয়ে বললেন, “আল্লাহ তোমাদের সঙ্গী হোন! তেনি তোমাদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের বাছে সহী সালামতে ফিরিয়ে আনুন।”
জবাবে আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এই কবিতা আবৃত্তি করলেনঃ
“আমি পরম করুণাময়ের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি আর কামনা করছি যেন
(কাফিরদের) রক্তক্ষয়কারী ব্যপিক আঘাত হানতে সক্ষম হই।
অথবা আমার (রক্ত) পিপাসু হাত দিয়ে বর্শার এমন আাঘাত হানতে পারি
যা (শত্রুকে) দ্রুত মৃত্যুর মুখে নিক্ষিপ্ত করবে ও তার কলিজা ও নাড়িভুঁড়ি
ছিন্নভিন্ন করে দেবে।
যেন আমার কবরের কাছে দেিয় অতিক্রমকারীরা বলতে পার যে, এই ব্যক্তিকে
আল্লাহ হিদায়াতের পথে চালিত করে গাজী বানিয়ে দিয়েছিলেন এবং সে
সুপথে চালিত হয়েছিল।”
অতঃপর বাহিনী রওনা হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাদের সাথে কিছুদুর গেলেন, কিছুদুর গিয়ে তিনি তাদেরকে বিদায় দিয়ে যখন ফিরে এলেন তখন আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা এই কবিতা আবৃত্তি করলেনঃ
“যে (মহান) ব্যক্তিকে বিদায় জানালাম,
আল্লাহ সেই শ্রেষ্ঠ বন্ধু ও সর্বোত্তম বিদায়কারীকে খেজুরের বীথিতে সুখে শান্তিতে রাখুন।” অতঃপর মুসলিম বাহিনী যাত্রা শুরু করলো। শামের (সিরিয়া) মায়ান নামক স্থানে পৌছে তারা যাত্রাবিরতি করলেন। সেখানে তারা জানতে পারলেন যে,, রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে বালকা এলাকার মায়াব নামক স্থানে শিবির স্থাপন করেছে। লাখাম, জুযাম, বাহরা ও বালী গোত্রের আরো এক লাখ লোক তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। তাদের নেতৃত্বে রয়েছে বালী গোত্রের এক ব্যক্তি এবং ইরাশ গোত্রের আর একজনস তার সহকর্মী। তার নাম মালিক ইবনে রাফেলা। মুসলিম বাহিনী এসব খবর জেনে মায়ানে দু’দিন অবস্থান করলো এবং তাদের করনীয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করলো। অবশেষে তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পত্র পাঠিয়ে শত্রুর লোক লস্করের সংখ্যা জানাবেন। তিনি হয় আরো সৈন্য পাঠিয়ে তাদের সাহায্য করবেন, নচেত যা ভাল মনে করেন নির্দেশ দেবেন এবং সেই মুতাবিক তারা কাজ করবেন।
আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা মুসলমানদেরকে উৎসাহিত করে বললেন, “হে মুসলিমগণ! আজ তোমরা যা অপছন্দ করছ সেটাই তোমরা কামনা করছিলে। আর তা হলো শাহাদাত। আমরা সংখ্যা-শক্তি বা সংখ্যধিক্যের জোরে লড়াই করি না। যে জীবনব্যবস্থার দ্বারা আল্লাহ আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন তার জন্য আমরা লড়াই করি। অতএব এগিয়ে যাও, বিজয় বা শাহাদাত এ দুটো উত্তম জিনিসের যেকোন একটা অবশ্যই আমাদের জন্য নির্ধারিত আছে।”
মুসলমানগণ সবাই বললেন, “আল্লাহর শপথ, ইবনে রাওয়াহা হক কথা বলেছে।”
অতঃপর মুসলমানগণ অগ্রসর হলেন। বালকা সীমান্তের কাছে পৌছতেই তারা হিরাক্লিয়াসের সম্মিলিত রোমক ও আরব বাহিনীর মুখোমুখি হলেন। বালকার সেই স্থানটির নাম মাশারিফ। শত্রুরা নিকটবর্তী হলো। মুসলমানরা একদিকে সরে গিয়ে মৃতা নামক একটি গ্রামে অবস্থান নিলেন্ বাহিনীর দক্ষিণ ভাগে বনু উযরাব কুতবা ইবনে কাতাদাকে (রা) এবং বাম অংশে আনসারী উবায়া ইবনে মালিককে (রা) দায়িত্ব দিয়ে মুসলমানগণ রণপ্রস্তুতি নিলেন। অতঃপর উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। প্রধান সেনাপতি যায়িদ ইবনে হারিসা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পতাকা বহন করে প্রাণপণ যুদ্ধ করে শাহাদাত বরণ করলেন। তারপর পতাকা হাতে নিলেন জাফর ইবনে আবু তালিব। তিনি ঘোড়া থেকে নেমে ঘোড়ার পা কেটে ফেললেন এবং যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। শাহাদাত বরণের প্রাক্কালে তিনি এই কবিতা আবৃত্তি করলেনঃ
“আহ! কি চমৎকার জান্নাত এবং তার সান্নিধ্য লাভ!
জান্নাত যেমন অতি উত্তম ও পবিত্র, তার পানীয়ও তেমনি।
রোমকদের আযাব ঘনিয়ে এসেছে, তারা কাফির এবং
আমার তুলনায় লনেক নিকৃষ্ট যদিও তাদের আঘাত খেয়েছি।”
ইবনে হিশাম বলেনঃ
নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমি জানতে পেরেছি যে, জাফর ইবনে আবু তালিব প্রথমে ডান হাতে পতাকা তুলে ধরলেন। শত্রুর তরবারীতে ডান হাত কাটা গেলে বাম হাতে পতাকা তুলে ধরলেন। সে হাতও কাটা গেল। তখন তিনি তা দুই ডানা াদয়ে চেপে ধরলেন্ এরপর শত্রুর আঘাতে শাহাদাত বরণ করলেন। আল্লাহ তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হোন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল তেত্রিশ বছর। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে জান্নাতে দুইখানা ডানা দেন যা দিয়ে তিনি যেখানে খুশী উড়ে বেড়াতে থাকেন। কথিত আছে যে, একজন রোমক সৈন্য তাঁকে তরবারীর আঘাতে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেছিল।
ইবনে ইসহাক বলেনঃ জা’ফর শহীদ হওয়ার পর আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা পতাকা তুলে ধরলেন এবং ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে সামনে অগ্রসর হলেন। তিনি ঘোড়া থেকে নেমে লড়াইতে অংশ নেবেন কিনা ভাবতে ও কিছুটা ইতস্ততঃ করতে লাগলেন। অতঃপর স্বগতভাবে বললেন,
“কসম খেয়ে বলছি, হে ইবনে রাওয়অহা, এই ময়দানে তোমাকে নামতেই হবে,
হয় তোমাকে নমাতেই হবে নচেত তোমাকে তা অপছন্দ করতে হবে।
সকল মানুষ যদি রণহংিকার দিয়ে জমায়েত হয়ে থাকে এবং তাদের মধ্যে
কান্নার রোলও পড়ে থাকে,
তোমাকে কেন জান্নাত সম্পর্কে নিস্পৃহ দেখছি?
সুখে শান্তিতে অনেকদিন তো কাটিয়ে দিয়েছো,
অথচ তুমি তো আসলে একটি পুরনো পাত্রে
এক ফোটা পানি ছাড়া আর কিছুই ছিলে না।
হে আমার আত্মা, আজ যদি নিহত না হও তাহলেও তোমাকে
একদিন মরতে হবে।
এটা (রণাঙ্গন) মৃত্যুর ঘর যাতে তুমি প্রবেশ করেছো।
তুমি এ যাবত যা চেয়েছো পেয়েছো।
এখন যদি ঐ দু’জনের মত (যয়িদ ও জাফর) কাজ কর
তাহলে সঠিক পথে চালিত হবে।”
অতঃপর তিনি ঘোড়ার পিঠ থেকে নামলেন। তখন তাঁর এক চাচাতো ভাই এক চুকরো হাড্ডি জড়িত গোশত এনে তাঁকে দিয়ে বললেন “নাও, এটা খেয়ে একটু শক্তি অর্জন কর। কেননা তুমি এই ক’দিনে অত্যধিক কষ্ট করেছো।” তিনি গোশতের টুকরোটা নিয়ে দাঁত দিয়ে কিছুটা ছিড়ে নিয়েছেন এমন সময় এক পাশে লোকজনের ভীষণ মারামারি হুড়োহুড়ির শব্দ শুনতে পেলেন। তখন তিনি বললেন “আমি বেঁচে থাকতে?” তিনি গোশতের টুকরোটা ছুড়ে ফেললেন। তরবারী হাতে অগ্রসর হলেন এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে গেলেন।
এরপর বনু আজলান গোত্রের সাবিত ইবনে আকরাম পতাকা হাতে নিলেন। তিনি বললেন, “হে মুসলমানগণ! তোমরা সর্বসম্মতভাবে একজন সেনাপতি বানাও।” সবাই বললো “আপনিই আমাদের সেনাপতি।” তিনি বললেন, “আমি এ দয়িত্ব পালনে সক্ষম নই।” তখন মুসলমানগণ খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে সেনাপতি বানালেন। তিনি পতাকা হাতে নিয়ে বীর বিক্রমে লড়াই করতে লাগলেন। সেনাবাহিনীকে নিয়ে একবার এক কিনারে চলে যান আবার এগিয়ে আসেন। এভাবে লড়াই চালাতে লাগলেন। একবার তিনি যেই এক কিনারে গিয়েছেন অমনি রোমক বাহিনীও কিনারে চলে গেল এবং রণেভঙ্গ দিল। পরে তিনি মুসলিম সেনাবাহিনীকে নিয়ে মদীনায় ফিরে গেলেন। বর্নিত আছে যে, মুসলিম বাহিনী যখন শত্রু কর্তক আক্রান্ত হচ্ছিল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছিলেন, “যয়িদ ইবনে হারিসা পতাকা তুলে ধরেছিল এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছে। এরপর জা’ফর পতাকা তুলে ধরেছিল এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছে।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম নীরব রইলেন। এতে আনসারদের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। তারা ভাবলেন, আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার একটা অপ্রীতিকর কিছু ঘটেছে হয়তো। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, “জাফরের পর আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা পতাকা তুলে ধরেছিল এবং যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছে।” অতঃপর বললেন “আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, এই তিনজনকে জান্নাতে সোনার পালংকে আরোহণ করানো হয়েছে। আমি দেখলাম আবদুল্লাহ৯ ইবনে রাওয়াহার পালংক খানিকটা বাঁকা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি কারণে হয়ে?ে আমাকে জবাব গেওয়া হলো যে, যায়িদ ও জা’ফর মুহুর্তে মাত্র বিলম্ব না করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।”
খালিদ লোক লস্কর নিয়ে মদীনায় ফিরে চললেন। মদীনার নিকটবর্তী হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাধারণ মুসলমানরা তাঁদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে গেলেন। বিশেষত শিশু ও বালক-বালিকারা অধিকতর দ্রুতগতিতে দৌড়ে এগুতে লাগলো। রাসূলুল।লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি জন্তুর পিঠে সওয়ার হয়ে মুসলিম জনসাধারণের সাথে এগিয়ে চলেছেন। তিনি বললেন, “তোমরা শিশুদেরকে নিজ নিজ সওয়ারীর পিঠে তুলে নাও। আর জাফরের ছেলেকে আমার কাছে দাও। আবদুল্লাহ ইবনে জা’ফরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আনা হলো। তিনি তাকে সওয়ারীর ওপর নিজের সামনে বসালেন।
এ সময় মদীনার মুসলমানগণ এই বাহিনীর দিকে মাটি ছুড়ে মারছিল আর বলছিল, “ওহে পলাতকের দল! তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদে গিয়ে পালিয়েছো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলরেন, “না তারা ভাগেন। বরং তারা নতুন করে হামলা চালবে ইনশাআল্লাহ।”
এই সময় হাস্সান ইবনে সাবিতের কবিতা শুনে মূতার যুদ্ধ-ফেরত সাহাবীরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কবিতাটির মর্ম নিম্নরুপঃ
“মদীনাতে আমি কাটিয়াছি অপেক্ষকৃত কষ্টদায়ক রজনী
সকল মানুষ যখন ঘুমিয়েছে তখন আমি ঘুমাতে পারিনি।
বন্ধুর স্মুতি আমার চোখে অশ্রুর বন্যা বইয়ে দিয়েছে,
বস্তুতঃ স্মৃতিই হলো কান্নার প্রধান উদ্দীপক।
সত্যিই বন্ধুকে হারানো একটা বিরাট পরীক্ষ,
তবে অনেক মহৎ ব্যক্তি আছেন যারা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে
ধৈর্য ধারণ করেন।
সর্বোত্তম মুসলমানদের দেখলাম একের পর এক দলে দলে
যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং তাদের পরপরই ঝাঁপিয়ে পড়লো তাদের উত্তর পুরুষগণ।
মূতায় একের পর এক শাহাদাত বরণকারী এই লোকদেরকে
আল্লাহ কখনো নৈকট্য লাভে বঞ্চিত করবেন না,
তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলো দুই ডানাধারী জাফর,
যায়িদ ও আবদুল্লাহ। বস্তুতঃ মৃত্যুর কারণগুয/েলা ছিল বড়ই ভয়াবহ।
একদা সকালে তারা মু’মিনদের নিয়ে যুদ্ধে যাত্রা করলো জনৈক ভাগ্যবান
ব্যক্তি ছিল তাদের অধিনায়ক।
বনু হাশিম গোষ্ঠির মধ্যে যিনি পূর্নিমার চা^ঁদের মত দীপ্ত,
যুলুমকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন যেই দুঃসাহসী বীর।
তারপর তিনি প্রচন্ড আক্রমণ চালালেন রণাঙ্গনের পরাজেয় পৌত্তলিকের ওপর।
অবশেষে এক সময় তিনি বেসালভাবে নুয়ে পড়ে গেলেন।
আর শহীদদের দলভুক্ত হলেন যার পুরস্কার জান্নাত
এবং সবুজ নিবিড় কাননসমুহ।
আমরা জা’ফরের মদ্যে লক্ষ্য করতাম মুহাম্মাদের অকুণ্ঠ আনুগত্য এবং
নির্দেশ প্রদানের বেলায় সুদৃড় অধিনায়কত্ব।
বনু হশিম বংশে মর্যাদা ও পৌরবের স্তম্ভ এখনো বিদ্যমান।
তারা ইসলামের পর্বত সদৃশ আর তাদের সহচরগণ
সেই সৌম্য দর্শন মহৎ সজ্জনদের মদ্যে রয়েছেন জা’ফর, আলী,
সর্বজনমন্য মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হামযা, আব্বাস ও আকীল।
বস্তুতঃ চন্দন বৃক্ষের যেখানেই নিংড়ানো হোক সেখান থেকে
চন্দনের (অর্থাৎ সুগন্ধিযুক্ত) নির্যাসই বেরুতে বাধ্য।
(অর্থাৎ বনু হামিমের বংশের যে পরিবারেই কোন সন্তান ভুমিষ্ঠ হোক
সে উল্লিখিত সন্তানদের মতই হবে। উক্ত বংশের যে পরিবারেই
সে জন্মলাভ করুক না কেন।)
কোন কঠিন সমস্যায় যখন লোকেরা নিরুপায় ও সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে,
তখন তাদের দ্বারাই সংকটের সুরাহা হয়।
তাঁরা সব আল্লহর আপনজন, তাঁদের ওপর আল্লাহ
তাঁর বিধান নাযিল করেছেন এবং
তাঁদের কাছেই সুরক্ষিত রয়েছে সেই পবিত্র গ্রন্থ।”
মক্কা বিজয়ঃ ৮ম হিজরী, রমাযান মাস
মূতার যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামাদিউস সানী ও রজব মাস মদীনায় অবস্থান করেন।
এই সময় বনু বকর বনু খুযায়া গোত্রের ওপর অন্যায়ভাবে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের কারণ ছিল ইসলাম আগমণের পূর্বে বনু হাদরামী গোত্রের মালিক ইবনে আব্বাদ নামক এক ব্যক্তি ব্যবসা উপলক্ষে খুযায়া গোত্রের বসতিস্থল অতিক্রম করার সময় তাদের লোকেরা তাকে হত্যা করে এবং তার কাছে যা কিছু ছিল ছিনিয়ে নেয়। এর ফলে বুন বকর জনৈক খুযায়ীর ওপর চড়াও হয়ে তাকে হত্যা করে। এর প্রতিশোধে খুযায়া গোত্র ইসলামের অভ্যুদয়ের প্রাক্কালে বনু বকরের একাংশ বনু দায়েলের সরদার আসওয়াদের তিন সন্তান সালমা, কুলসুম ও যুয়াইবকে হারাম শরীফের সীমানার কাছে হত্যা করে। কেননা আসওয়াদ ছিল হাদরামীর তি¤্র। এই বিষয় নিয়ে বনু বকর ও বনু খযায়ার মধ্যে তুমুল উত্তেজনা চলে আসছি। ইসলামের অব্যুদয় ঘটার ফলে উভয় গোত্রের এই উত্তেজনা স্তিমিত হয় এবং তাদের মনোযোগ চলে যায় ইসলামের দিকে। কুরাইশগণ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যে সম্পাদিত হুদাইবিয়ার সন্ধিতে একটি শর্ত ছিল এ যে, কোন তৃতীয় পক্ষ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম কিংবা কুরাইশদের সাথে মৈত্রী স্থাপন করতে পারবে। তদনুযায়ী বনু বকর কুরাইশদের এবং বনু খযায়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিত্রতার ঘোষণা করে।
চুক্তি সম্পাদিত হওয়অর পর বনু বকরের শাখা বনু দায়েল বনু খযায়ার দ্বারা আসওয়াদের উক্ত তিন সন্তানের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে বলে মনে করে। তাই বনু দায়েল পরিবারের প্রধান নাওফেল ইবনে মুয়াবিয়া প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্যোগ নেয়। উল্লেখ্য যে, এই লোকটির গোটা বনু বকরের ওপর কোন কর্তৃত্ব ছিল না। একদিন রাত্রে খুযায়া গোত্রের লোকেরা তাদের নিজস্ব ঝর্ণা ওয়াতীরে আবস্থানকালে নাওফেল ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা তিলে খুযয়ীদের একজনকে হত্যা করলো। আর যায় কোথায়। উভয় গোত্র অন্যান্য গোত্রের সাথে দল পাকিয়ে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হলো। কুরাইশরা এই সময় বনু বকরকে অন্ত্র দিল এবং তাদের সহযোগিতায় কুরাইশদের অনেকেই রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে খযায়ীদের সাথে যুদ্ধ করলো। গিশেহারা হয়ে খুযায়া গোত্র মসজিদুল হারামের নিষিদ্ধ গন্ডীর মধ্যে আশ্রয় নিল। নাওফেলের নেতৃত্বে প্রতিহিংসাপরায়ণ দায়েল গোত্রের লোকেরা তাদের ধাওয়া করে হারাম শরীফ পর্যন্ত এলো। বনু বকরের লোকেরা নাওফেলকে বললো “হে নওফেল, এবার থামো। আমরা এখন হারাম শরীফের অভ্যন্তরে আছি। খোদাকে ভয় কর।”
তখন নাওফেল একটা সাংঘাতিক কথা বলে বসলো। সে বললো, “আজকে তার কোন ইলাহ বা প্রভু নেই। হে বনু বকর, তোমরা প্রতিশোধ গ্রহণ কর। তোমরা তো হারাম শরীফে চুরি করতেও কুণ্ঠিত হও না। (উল্লেখ্য যে কা’বা শরীফের সোনার তৈরী বহু মূল্যবান মূর্তি চুরি করার অভিযোগ কুরাইশদের বিরুদ্ধে ছিল।) এখন এখানে প্রতিশোধ নিতে কুণ্ঠিত হও কেন?” ইতিপূর্বে ওয়অতীর ঝর্ণার কাছে রাতের আঁধারে ‘মুনাব্বিহ’ নামক জনৈক দুর্বলচিত্ত খুযারীকে হত্যা করেও তাদের পিপাসা মেটেনি। মুনাব্বিহ তামীম ইবনে আসাদ নামক তার গোত্রের অপর এক ব্যক্তিকে সাথে করে বেরিয়েছিল। মুনাব্বিহ বললো “হ তামীম, তুমি নিজেকে রক্ষার ব্যবস্থা কর। আমি তো মরতেই যাচ্ছি। তারা আমাকে হয় হত্যা করবে নয় ছেড়ে দেবে।” তামীম সেখান থেকে পালিয়ে গেল আর তারা মুনাব্বিহকে হত্যা করলো।
খুযায়ার লোকেরা মক্কায় তাদের এক মিত্র বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার সাবেক এক গোলাম রাফের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়া সত্ত্বেও বনু বকর ও কুরাইশদের মিলিত আক্রমণে খুযায়ার অনেকেই প্রাণ হারায়। এভঅবে কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অসাল্লামের মিত্র বনু খুযায়াকে হারাম শরীফের নিষিদ্ধ স্থানে হত্যা করে হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তি ভঙ্গ করে। এরপর আমর ইবনে সালেম খুযায়ী ও বনু কা’বের এক ব্যক্তি মদীনায় গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামের সাতে সাক্ষাত করে সব ঘটনা বিবৃত করে। এই ঘটনা ছিল মক্কা বিজয়ের অন্যতম কারণ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মসজিদে লোকজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় বসে ছিলেন তখন সে সেখানে গিয়ে উপনীত হয় এবং একটি কবিতা আবৃত্তি করে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করে। কবিতাটির মর্ম এই:
“হে প্রভু! আমি মুহাম্মাদের নিকট আমাদের পিতা ও তাঁর পিতার পুরানো মৈত্রীর কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ও তা কার্যকরী করার অনুরোধ জানাই। তোমরা সন্তান ছিলো। আর আমরা পিতা ছিলাম। সেখানে আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি এবং তা ত্যাগ করিনি। আল্লাহ তোমাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। আমাদেরকেত অবিলম্বে সাহায্য কর। আর আল্লাহর বান্দাদেরকে আহ্বান কর যেন সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। তাদের মধ্যে আল্লাহর রাসূল রয়েছেন যিনি (চুক্তি থেকে) বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছেন। তাকে যদি আবমাননা করা হয় তাহলে তাঁর মুখে কলংক লেপন করা হবে। তিনি রয়েছেন এমন একটি বাহিনীর সঙ্গে যা সমুদ্্েরর মত ফেনারাশি নিয়ে প্রবাহিত। জেনে রাখ) কুরাইশরা তোমার চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তারা তোমার সন্ধি লংঘন করেছে এবং কাদা নামক স্থানে আমার জন্য গুপ্ত ঘাঝটি স্থাপন করেছে। তারা সংখ্যায় অল্প ও শক্তিতে অপেক্ষাকৃত হীনবল। তারা আল ওয়াতীরে গোপন রাত্রি যাপন করেছে।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাহিনী শুনে বললেন, “ হে আমর, তোমাকে সাহায্য করা হবে।” এর অব্যবহিত পর তিনি আকাশে এক খন্ড মেঘ দেখে বললেন, “এই মেঘখন্ডটিই বনু কা’বের সাহায্যের সূচনা করবে।”
এরপর বুদাইল বিন ওয়ারাকা বনু খুযায়ার কতিপয় লোককে সঙ্গে নিয়ে মদীনায় গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাত করলো। তাঁকে তাদের বিপদ মুসিবতের কথা এবং কুরাইশরা বনু বকরকে তহাদের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নির্যাতন চালাচ্ছে তার কথা অবহিত করলো। অতঃপর মক্কায় ফিরে গেল। তার আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে জানালেন “তোমরা ধরে নিতে পার যে, আবু সুফিয়অন তোমেদের কাছে এসেছে এবং সন্ধি চুক্তি অলংঘনীয় করা ও তার মেয়াদ বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দিয়েছে।”
বুদাইল ইবনে ওয়ারাকা ও তার সাথীরা মক্কায় ফিরে যাওয়ার সময় উসফানে আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের সাথে তাদের সাক্ষাত হলো। কুরইশরা তাকে রাসূলুল্লাহর নিকট সন্ধি চুক্তিকে অলংঘনীয় ও তার মেয়াদ বৃদ্ধি করার জন্য াফিয়েছে। কেননা তারা বনু খুযায়ার সাথে যে আচরণ করেছে তাতে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আবু সুফিয়ান বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার সাথে দেখা হওয়া মাত্রই তাকে জিজ্ঞেস করলো, “বুদাইল, তুমি কোথা থেকে আসছো।” সে ধারণা করেছিল যে বুদাইল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের কাছেই গিয়েছিল। বুদাইল জবাব দিল, “এই এলাকায় বনু খুযায়ার লোকদের সাথে নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম।” আবু সুফিয়অন বললো “তুমি মাহাম্মাদরে কাছে যাওনি?” সে বললো ‘না।’ বুদাইল মক্কা চলে গেলে আবু সুফিয়ান বুদাইলের উট থামানোর জায়গায় গিয়ে তার গোবর পরীক্ষা করলো। গোবরের মধ্যে খেজুরের আটি দেখে বললো, “নিশ্চয়ই বুদাইল মুহাম্মাদের নিকট গিয়েছিল।” খেজুরের আটিকে সে তার মদীনায় যাওয়ার আলামত হিসেবে গণ্য করলো।
তারপর আবু সুফিয়ান রওনা হয়ে মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌছে নিজের কন্যা উম্মুল মুমিনীন উম্মে হাবীবার কাছে গেল। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিছানায় বসার উপক্রম করতেই উম্মে হবীবা বিছানা গুেিয় ফেললেন। তা দেখে আবু সুফিয়ান বললে, “হে আমার কন্যা তুমি কি আমাকে ঐ বিছানায় বসার যোগ্য মনে করনি?” উম্মে হাবীবা বললেন, “ওটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লামের বিছানা। আর আপনি একজন মুশরিক, অপবিত্র। আমি চাই না যে, আপনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিছানায় বনে।” আবু সুফিয়ান বললো “হ আমার কন্যা, আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার তুমি খারাপ হয়ে গিয়েছো।”
আবু সুফিয়ান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হাজির হলো এবং কথা বললো। কিন্তু তিনি তার কোন কথার জবাব দিলেন না। অতঃপর সে আবু বাকরের (রা) নিকট গিয়ে এ মর্মে অনুরোধ করলো যাতে তিনি রাসূলুল।লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তার সম্পর্কে সুপারিশ করেন। আবু বাক্র (রা) এ অনুরোধ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন।
অতঃপর সে উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) নিকট গিয়ে অনুরুপ অনুরোধ করলো। উমার বললেন “কি বলছ্!ো আমি তোমার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাøামের নিকট সুপারিশ করবো? আমি যদি ছোট ছাড়া কোন সহযোগী না পাই তবুও তোমার সাথে লড়াই করবো?”
এরপর সে আলী ইবনে আবু তালিবের (রা) নিকট গেল। সেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা ফাতিমা (রা) ছিলেন। তাঁর সামনে শিশু হাসান (রা) হামাগুড়ি দিচ্ছিলো। সে বললো, “হে আলি তুমি আমার প্রতি সর্বাধিক দয়ালু। আমি তোমার কাছে এসেছি একটা বিশেষ প্রয়োজনে। ব্যার্থ হয়ে ফিলে যেতে চাই না। কাজেই তুমি আমার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সুপারিশ কর।” তিনি বললেন, “ধিক তোমাকে হে আবু সুফিয়অন। আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম একটা ব্যাপারে সংকল্প গ্রহণ করেছেন, আমরা সে সম্পর্কে তাঁর সাথে কথা বলতে অক্ষম।”
অনন্যোপায় হয়ে আবু সুফিয়ান ফাতিমার (রা) দিেিক তাকালো। বললো, “হে মুহাম্মদের কন্যা।! তুমি কি এটা পছন্দ কর যে, তোমার এই শিশু পুত্র লোকজনকে রক্ষা করার নির্দেশ দেবে আর তার ফলে সে চেরকালের জন্য আরবের নেতা হয়ে থাকবে?” ফাতিমা (রা) বললেন, “আমার ঐ ছেলে লোকজনকে রক্ষ করার যোগ্য হয়নি। তাচাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ কাউকে রক্ষা করতে পারবে না।”
আবু সুফিয়ান বললো, “হে আলী! আমি দেখছি পরিস্থিিিত আমার প্রতিকূল। এখন আমাকে একটা সদুপদেশ দাও।” আলী (রা) বললেন, “তোমার উপকারে আসবে এমন কোন উপদেশ আমার জানা নেই। তবে তুমি তো বনু কিনানা গোত্রের নেতা। তুমি যাও, লোকজনকে রক্ষা কর। অতঃপর তোমার জন্মস্থানে অবস্থান করতে থাক।” সে বললো, “এতে আমার শেষ রক্ষা হবে তো?” আলী (রা) বললেন, “তা আমার মনে হয় ন্ াতবে এ ছাড়া তোমার জন্য আর কোন উপায়ও দেখছি না।” অতঃপর আবু সুফিয়ান মসজিদে গিয়ে ঘোষণা করলো “হে জনতা! আমি সকল মক্কাবাসীর রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছি।” এই বলেই সে উটে চড়ে প্রস্থান করলো। কুরাইশদের কাছে গেলে তারা জিজ্ঞোস করলো, “কি করে এসেছো?” সে সে বললো, “মাহাম্মাদের কাছে গিয়ে কথা বললাম। সে কোন কথারই জবাব দিব না। তারপর আবু বাকরের কাছে গেলাম। সেও কোন আশাপ্রদ কথা বললো না। তারপর গেলাম উমারের কাছে। তাকে সবচেয়ে কট্রর দুশমন পেলাম। তারপর আলীর সাথে দেখা করতে গেলাম। তাকে সবার টাইতে নমনীয় মনে হলো। আলী আমাকে একটা কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে। সে কাজ আমি করেছি। জানি না তাতে কিছু হবে কি না।”
সবাই বললো, “আলী তোমাকে কি করতে বলেছে?” আবু সুফিয়ান বললো সে আমাকে বলেছিল মক্কাবাসীকে রক্ষা করার ব্যবস্থা নিতে। সেটা আমি ঘোষণাদিয়ে এসেছি।” জনতা বললো, “মুহাম্মদ কি তোমাকে এ কাজ করার অনুমতি দিয়েছে?” সে বললো ‘না।’ জনতা বললো “তাহলে আলী তোমার সাথে তামাশা করেছে মাত্র। এ তোমার কোন উপকারে আসবে না।” সে বললো, “কিন্তু এছাড়া আমার কোন গত্যন্তুর ছিল না।”
রাসূলুল্লাহা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় সকল মুসলমান এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে সফরের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। আবু বাক্র (রা) তাঁর কন্যা আয়িশার (রা) কাছে গিয়ে দেখলেন, তিনি জিনিসপত্র গোছগাছ করভেন। তা দেখে তিনি বললেন, “হে আয়িশা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি তোমাদেরকে সফরের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন?” আয়িশা (রা) বললেন, “হাঁ আব্বা আপনিও প্রস্তুতি নিন।” আবু বাক্র বললেন, “তিনি কোথায় যেতে মনস্থ করেছেন বলে মনে কর।” আয়িশা বললেন, “জানি না।” এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদেরকে সুষ্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি মক্কা অভিমুখে যাত্রা করতে যাচ্ছেন। তিনি তাদেরকে সফরের জন্য তৈরী হতে বললেন। তিনি আরও বললেন,!“হে আল্লাহ! কুরাইশদের থেকে আমাদের প্রস্তুতির যাবতীয় খবর গোপন রাখুন যাতে আমরা তাদের ওপর আকস্মিকভাবে গিয়ে চড়াও হতে পারি।” মুসলমানগণ অল্পক্ষনের মাধ্যেই তৈরী হলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা অভিযানে রওনা হওয়ার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেছেন এমনস সময় সাহাবী হাতিব ইবনে আবু বালতায় (রা) জনৈক মহিলার মাধ্যমে কুরাইশদের কাছে একটা চিঠি পাফিয়ে দিলেন। চিঠিতে জানিয়ে দিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা অভিযানে যাওয়ার আয়োজন করেছেন। মহিলা চিঠিটা তার খোঁপার মধ্যে লুকিয়ে রওয়ানা হলো। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ওহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাতিবের কারসাজির রহস্য ফাঁস করে দিলেন। তিনি তৎক্ষনাৎ আলী ইবনে আবু তালিব (রা) ও যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে (রা) এই বলে পাঠিয়ে দিলেন যে, তোমরা পথিমধ্যে সেই মহিলাকে পাকড়রও করবে এবং তার কাছে থেকে হাতিবের চিঠি উদ্ধার করে নিয়ে আসবে- যাতে হাতীব মক্কাবাসীকে আমাদের অভিযান প্রস্তুতির সব খবর জানিয়ে সাবধান করে দেয়েছে।” তাঁরা উভয়ে রওনা হয়ে গেলেন এবং খলীফা নামক স্থানে গিয়ে তাকে ধরে ফেললেন। তারা তাকে উট থেকে নামিয়ে তার উটের হাওদার মধ্যে চিঠির সন্ধান করলেন। কিন্তু পেলেন না। আলী (রা) বললেন “আল্লাহর কসম্ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা মিথ্যা হতে পারে না এবং আমরাও মিথ্যা বলছি না। এই চিঠি বের করে দাও, নচেত আমরা তোমার দেহ তল্লাশী করবো।”
মহিলা যখন দেখলো আলী (রা) নাছোড়বান্দা, তখন সে বললো, তুমি অন্য দিকে মুখ ফিরাও।” তিনি মুখ ফিরালেন। মহিলা নিজের খোঁপা খুলৈ চিঠি বের করলো। আলী (রা) ও যাবাইর (রা) চিঠি নিয়ে রাসূলুল্লাহর দরবারে উপস্থিত হলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাতিবকে ডেকে তার চিঠি পাঠানোর কারন জিজ্ঞেস করলেন। হাতিব বললেন, “আল্লাহর কসম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের প্রতি আমার ঈমানে বিন্দুমাত্রও পরিবর্তন আসেনি। মক্কায় আমার কোন আত্মীয়-স্বজন নেই। অথচ কুরাইশদের মধ্যে আমার স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি রয়েছে। তাই এভাবে আমি তাদের সহানুভুতি লাভ করতে চেয়েছি।”
উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, সে মুনাফেকী করেছে। আমাকে অনুমতি দিন তার ঘাড় কেটে ফেলি।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে উমার, তোমার তো জানা নেই। এমনও তো হতে পারে যে আল্লাহ তায়ালা বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদেরকে বদরের দিন বলে দিয়েছেন যে, তোমরা যাখুশী কর, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম।”
আল্লাহ তায়ালা হাতিব সম্পর্কে সুরা মুমতাহিনায় আয়াত নাযিল করলেন: “হে মুমিনগণ! যারা আমার ও তোমাদের শত্রু তাদের প্রতি দরদ ও ভালোবাসা দেখিয়ে তাদেরকে বন্ধু হিসেবে পেতে চেয়ো না। ……… ইবরাহীম ও তার সহচরদের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে। সে তার জাতিকে বলেছিলো, আমরা তোমাদের ও আল্লাহ ছাড়া আর যাদের তোমরা দাসত্ব করছো- পরোয়া করি না। আমরা তোমাদের সম্পর্ককে অস্বীকার করলাম। আর আমাদের ও তোমাদের মাঝে স্থায়ী শত্রুতার উদ্ভব হয়েছে যতক্ষণ না তোমরা একমাত্র আল্লাহকে মা’বুদ বলে মেনে নাও।”
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা অভিযানে রওনা হলেন। এ সময় আবু বুরহুম গিফারীকে মদীনায় তাঁর খলিফা নিয়োগ কররৈন। রমযানের দশ দনি অতিবাহিত হবার পর তিনি যাত্রা করলেন। তিনি নিজে এবং মুসলমানগণ সকলেই রোযা রাখলেন। উসফান ও আমাদের মধ্যবর্তী কুদাইদ নামক স্থানে পৌছলে সকলে ইফতার করলেন।
এখান থেকে দশ হাজার মুসলমানকে সাথে নিয়ে তিনি আবার রওনা করলেন এবং মাররুয যাহরানে পৌছে যাত্রাবিরতি করলেন। পথিমধ্যে বনু সুলাইমের সাতশ মতান্তরে এক হাজার ও বনও মুযাইনার এক হাজার লোক তাঁর সাথে যোগ দিল। এ সময় আরবে এমন কোন গোত্র ছিল না যার বেশ কিছু সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেনি। মুহাজির ও আনসারদের সকলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা অভিযানে অংশগ্রহণ করেন এবং কোন একজনও পিছপা হননি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মাররুয যাহরোনে গিয়ে যাত্রাবিরতি করলেন। তখনো পর্যন্ত কুরাইশরা তাঁর যাত্রা বা তিনি কি করতে যাচ্ছেন তা ঘুনাক্ষরেও জানতে পারেননি। ঐ সময় এক রাতে আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, হাকীম ইবনে হিযাম ও বুদাইল ইবনে ওয়ারাকা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে খবরাখবর সংগ্রহ করতে বের হলো। পথিমধ্যে কোন এক জায়গায় আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব (রা) সালুলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করেছিলেন। আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস ও আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়া ইবনে মুগীরা পথিমধ্যে (মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী) নাইফুল উকাব নামক স্থানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সান্নিধ্যে উপনীত হলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাল্লামের সাক্ষাতপ্রার্থী হলে উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনা রচাচাতো ভাই ও শ্যালক এসেছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ ওদের দিয়ে আমার কোন প্রয়োজন নেই। আমার চাচাতো ভাই তো আমাকে অপমান করেছে। আর আমার শ্যালক (আবদুল্লাহ ইবনে উমাইয়া উম্মে সালামার সৎ ভাই) মক্কায় অবস্থানকালে আমার চরম বিরোধীত করেছে।”
তারা যখন উভয়ে এই জবাব পেলো তকন আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস বললো “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি আমাকে সাক্ষাত করার সুযোগ না দেন তাহলে আমি আমার এই ছেলে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে একদিকে চলে যাবো এবং ক্ষুধা তৃষ্ণায় ধুঁকে ধুঁকে মরবো।”
একথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মন বিগলিত হলো। তিনি অনুমতি দিলেন। তখন তার াউভয়ে তাঁর কাছে গেলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। আবু সুফিয়ান ইবনে হারেস ইতিপূর্বে রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিন্দাসূচক যেসব কবিতা আবৃত্তি করেছেন তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। ইসলাম প্রহণ করার পর নতুন কবিতা আবৃত্তি করলেন? এ কবিতার মর্ম নিম্ন রুপঃ
“আমি যেদিন সেনাপতি হয়ে লড়াই করবো, মুহাম্মাদের বাহিনী
মুশরিক বাহিনীর ওপর অবশ্যই জয়যুক্ত হবে।
(মুশরিক বাহিনী) রাতের আঁধারে দিশেহারা যাত্রীর মত।
আজ আমার পালা এসেছে যখন আমি হিদায়াত লাভ করেছি।
আমাকে সেই হিদায়াতকারী হিদায়াত করেছে, বদলে দিয়েছে
এবং আমাকে আল্লাহর সাহচর্য পৌছিয়ে দিয়েছে
যাকে আমি (একদিন) দূরে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম।
সেদিন আমি মুহাম্মাদের মাঝে আন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এবং
তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে রণপাঁয়তারা করেছিলাম,
আর আমাকে মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে ডাকা হচ্ছিলো
যদিও আমি তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট হইনি।
তিনি যে পথে চলছিলেন সে পথেই চলতে থাকলেন-মুশরিকদের
খেয়াল খুশী মুতাবিক কথা বললেন না
যদিও তিনি বিশুদ্ধ মতের অধিকারী হিসেবে কথা বলছিলেন
তথাপি তাঁকে মিথ্যুক বলে অভিহিত করা হয়েছিল।
যতক্ষন আমি হিদায়াত পাইনি ততক্ষণ প্রত্যেকে বৈঠকে তাদেরকে (মুশরিকদেরকে)
খুশী করতে চেয়েছিলাম এবং (মুসলিম) জনতার সাথে সংযুক্ত হইনি।
সুতরাং বনু সাকীফকে বলে দাও, আমি তাদের সাথে যুদ্ধ করতে চাই না।
বনু সাীফকে বলে দাও, আমাকে নয় অন্য কাউকে ভীতি প্রদর্শন করুক।
কেননা আমি সেই বাহিনীর ভেতরে ছিলাম না যে বাহিনী
জনপদকে আক্রমণ করেছিল
এবং সে আক্রমণ আমার জিহ্বা কিংবা হাতের দ্বারা সংঘটিত হয়নি।
সে বাহিনীতে ছিল দূরাঞ্চল থেকে আগত গোত্রসমূহ যে এবং
সাহাম ও সুরদাদ থেকে আগত অচেনা যোদ্ধারা।”
কথিত আছে যে, তিনি যখন কবিতার এই অংশটি আবৃত্তি করছিলেন, “আমাকে আল্লাহর সাহচর্যে পৌছিয়ে দিয়েছে সেই ব্যক্তি যাকে আমি বহু দূরে তড়িয়ে দিয়েছিলাম” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বুক চাপড়ে বলেছিলেন, তুমিই তো আমাকে দূরে তাড়িয়ে দিয়েছিলে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাররুয যাহরানে যাত্রাবিরতি করলে আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব প্রমাদ গুলেন। তিনি বুঝলেন যে কুরাইশরা যদি স্ব উদ্যোগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্রামের কাছে এসে সন্ধি না করে এবং তিনি যদি জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করেন তাহলে কুরাইশরা চিরতরে নির্মুল হয়ে যাবে।
আব্বাস (রা) বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাদা খচ্চরটিতে আরোহণ করে আরাক নামক স্থানে এস খোঁজ করতে লাগলাম কোন কাঠুরিয়া, দুধওয়ালা কিংবা আর কোন লোক মক্কায় যায় কিনা। তাহলে বলবো মক্কাবাসীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের খবর দিতে যাতে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জোরপূর্বক মক্কায় প্রবেশ করার আগে তাঁর কাছে এসে সন্ধি করে।
আমি এই অনুসন্ধানের কাজে ব্যাপৃত ছিলাম। ইতিমধ্যে আবু সুফিয়ান ও বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার কথাবার্তা শুনতে পেলাম। তারা উভয়ে কথাবার্তা বলছিল। আবু সুফিয়ান বলছিল “গতরাত্রে আমি যে রকম আগুন দেখলাম এমন আগুন আর কখনো দেখিনি এবং এত বড় বাহিনীও আর কখনো দেখিনি।” বুদাইল বলছিল, “এটা নিশ্চয়ই খুযায়া গোত্রের বাহিনী। তারা নিশ্চয়ই যুদ্ধের প্রস্ততি নিয়েছে।” আবু সুফিয়ান জবাব দিল, “খুযায়ার এত প্রতাপ ও জনবল নেই যে, এত আগুন জ্বালাবে এবং এত বড় বাহিনীর সমাবেশ ঘটাবে।” আমি আবু সুফিয়ানের কন্ঠস্বর চিনতে পেরে বললাম, “ওহে আবু সুফিয়ান।” সে বললো “কে আব্বাস নাকি?” আমি বললাম, ‘হাঁ।’ সে বললো “খবর কি?” আমি বললাম, “তুমি জান না? এই তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বাহিনী। আল্লাহর শপথ! কুরাইশদের জবীন বিপন্ন।” সে বললো “তাহলে এখন উপায় কি?” আমি বললাম,“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তোমাকে হাতে পান তাহলে খুন করে ফেলবেন। অতএব এই খচ্চরের পেছনে ওঠো। আমি তোমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে নিয়ে গিয়ে তোমার জন্য নিরাপত্তা প্রার্থনা করি।”
অতঃপর সে আমার পেছনে চড়ে বসলো। আর তার সঙ্গীদ্বায় ফিরে গেল। আবু সুফিয়ানকে নিয়ে আমি মুসলিম বাহিনীর এক এক অগ্নিকুন্ডের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। সবাই বলিেছলো, “এ কে?” কিন্তু একবার নজর বুলিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খচ্চরে আমাকে আরোহী দেখে প্রত্যেকেই শান্ত হয়ে যাচ্ছিল। আমার পেছনে যে আবু সুফিয়ান রয়েছে তা কেউ লক্ষ্য করছিল না।
উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) সামনে দিয়ে যখন অতিক্রম করলাম তখন তিনি আমার কাছে এগিয়ে এলেন। পেছনে আবু সুফিয়ানকে বসা দেখে বললেন, “আল্লাহর শত্রু আবু সুফিয়ান! আল্লাহর শুকরিয়া যে, কোন চুক্তি ছাড়াই তোমকে আমাদের হস্তগত করে গিয়েছেন।” একথা বলেই তিনি দৌড়ে চললেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট। এদিকে আমিও দ্রুত ছুটলাম। উমার ও খচ্চর কেউই তেমন দ্রুতগামী ছিল না। তথাপি খচ্চর একটু আগে গেল। খচ্চর থেকে নেমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লামের নিকট গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে উমার (রা) ও গেলেন সেখানে। তিনি বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! এই যে আবু সুফিয়ান। আল্লাহ ওকে অনায়াসেই জুটিয়ে দিয়েছেন। ওর সাথে আমাদের কোন চুক্তিও হয়নি। সুতরাং আমাকে অনুমতি দিন ওর গর্দান উড়িযে দিই।”
আমি বললাম, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি ওকে আশ্রয় দিয়েছি।” অতঃপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে বসলাম এবং তার মাথা আকর্ষণ করে বললাম, “আল্লাহর কসম, আজ রাতে ওকে আমি ছাড়া কারো সাথে একা থাকতে দেব না।”
উমার (রা) আবু সুফিয়ান সম্পর্কে অনেক কথা বলতে লাগলেন। তা শুনে আমি বললাম, “চুপ কর, উমার! আবু সুফিয়ান বনু কা’ব গোত্রের লোক হলে (বনু কা’ব উমার (রা) এর গোত্র) তুমি এ রকম বলতে না। বনু আবদ মানাফের লোক বলেই তুমি এ রকম বলছো।”
উমার বললেন, “আব্বাস! আপনি এ রকশ কথা বলবেন না। আমার পিতা যদি ইসলাম গ্রহন করতেই তবে তাঁর ইসলামের চাইতে আপনার ইসলাম গ্রহণ আমার কাছে অনেক বেশী প্রিয়।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আব্বাস, আবু সুফিয়ানকে তোমার কাছে নিয়ে যাও। সকালে তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।”
আমি আবু সুফিয়ানকে নিয়ে গেলাম। রাত্রে সে আমার কাছে থাকলো। সকাল বেলা তাকে নিয়ে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আবু সুফিয়ান, ধিক তোমাকে। আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই একথা মেনে নেয়ার সময় কি তোমার এখনো হয়নি?” সে বললো, “আপনার উদারতা, মহত্ত্ব, স্বজনবাৎসল্য অতুলনীয়। আমার ধারণা, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ যদি থাকতো তাহলে এতদিনে আমাকে সাহায্য করতো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার বললেন, “হে আবু সুফিয়ান, ধিক্ তোমাকে! আমি যে আল্লাহর রাসূল, তা কি এখন পর্যন্ত তুমি উপলদ্ধি করনি?” আবু সুফিয়ান বললো, “আপনার জন্য আমার মাতাপিতা উৎসর্গ হোক! আপনি এত উদার সহনশীল এবং আত্মীয় সমাদরকারী যে, তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারি না। তবে আপনার রাসূল হওয়া সম্পর্কে আমার একনো কিছু দ্বিাধা-সংশয় রয়েছে।” আব্বাস তখন বললেন, “ধিক তোমাকে! ইসলাম গ্রহণ কর এবং সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ রাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রাসূল। নচেত এক্ষুণি তোমার গর্দান মারা হবে।”
আবু সুফিয়ান সত্যের সাক্ষ্য দিল এবং ইসলাম গ্রহণ করলো। অতঃপর আব্বাস (রা) বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু সুফিয়ান একটু মর্যাদা লোভী। কাজেই তাকে গৌরবজনক একটা কিছু দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আল্ইাহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “বেশ, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে প্রবেশ করবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে। যে ব্যক্তি নিজের বাড়ীর দরজা বন্ধ করে রাখবে সেম নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি সমজিদুল হারামে প্রবেশ করবে তাকেও কিছু বলা হবে না।”
অতঃপর আবু সুফিয়ান মক্কায় ফিরে যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকট থেকে বের হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আব্বাস, তাকে উপত্যকার কিনারে পাহাড়ের মাথায় গিরিপথে একটু থমিয়ে রাখো। আল্লাহর সৈনিকরা তার সামনে দিয়ে যাক এবং সে তাদেরকে দেখুক।” আব্বাস বলেন, এরপর আমি গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে জায়গার কথা বলেছিলেন সেই গিরিপথে তাকে থামিয়ে রাখলাম। এরপর বিভিন্ন গোত্র নিজ নিজ পতাকার পেছনে সারিবদ্ধভাবে রওনা হলো। যখনই একটা গোত্র তার সামনে দিয়ে যায়, সে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, “হে আব্বাস! এরা কারা?” আমি বলি, “এরা বনু সুলাইম অথবা বনু মুযাইনা অথবা অমুক গোত্র, তমুক গোত্র।” আবু সুফিয়ান সঙ্গে সঙ্গে বলে, “ এদের সাথে আমার কোন তুলনাই হয়না।” এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর নিজের সবুজ বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন। [৮১. এই বাহিনীকে সবুজ বাহিনী বলা হয় এই জন্য যে, এতে লোহা নির্মিত জিনিসের সমাবেশ ঘটেছিল সর্বাধিক পরিমাণ। (ইবনে হিশাম)] এতে মুহাজির ও আনসারদের সমাবেশ ঘটেছিল। এ বাহিনীতে লোহার ধারালো অস্ত্র ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলনা। আবু সুফিয়ান বললো, “সুবহানাল্লাহ! সুবহানাল্লাহ! হে আব্বাস এর কার?” আমি বললাম “এ বাহিনীতে রয়েছেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা) এবং তাঁর সাথে আছেন মহাজির ও আনসরাগণ। সে বললো, “এ বাহিনীর মুকাবিলা করার ক্ষমতা কারো নেই। আল্লাহর শপথ, হে আব্বাস! তোমার ভ্রাতুষ্পুত্র আগামীকাল এক বিরাট সা¤্রাজ্যের অধিপতি হতে যাচ্ছেন।” আমি বললাম, “হে আবু সুফিয়ান! এটা কোন রাজকীয় ব্যাপার নয়। এটা নবুয়াতের প্রতাপ।” সে বললো, “তাহলে এটা কতই না চমৎকার।” আমি বললাম, “তুমি তাড়াতাড়ি কুরাইশদের কাছে চলে যাও।” আবু সুফিয়ান মক্কা গিয়ে ঘোষণা করে দিল, “হে কুরাইশগণ, মুহাম্মদ এমন এক বাহিনী নিয়ে এসেছে যার মুকাবিলা করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। এখন আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে যে আশ্রয় নেবে তার ভয় নেই।”
এই সময় উতবার কন্যা হিন্দ আবু সুফিয়ানের কাছে গিয়ে তার গোঁফ টেনে ধরে বললো, “হে কুরাইশগন, এই মোটা পেটুককে হত্যা কর। জাতির নেতৃত্বের মর্যাদায় থেকে সে কলংকিত হয়েছে।”
আবু সুফিয়ান বললো, “তোমাদের বিপর্যয় সম্পর্কে সাবধান হও। এই মহিলার কথায় তোমরা বিপথগামী হয়ো না। তোমাদের ওপর এক অপ্রতিরোধ্য বাহিনী সমাপত। এমতাবস্থায় আমার বাড়ীতে যে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ থাকবে।”
সবাই বললো, “তোর ওপর অভিসম্পাত! তোর বাড়ী আমাদের কি কাজে আসবে?” আবু সুফিয়ান বললো, “ যে ব্যক্তি নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকবে এবং যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করবে সেও নিরাপদ থকবে।”
লোকেরা সবাই যার যার বাড়ীতে অথবা মসজিদুল হারামে চলে গেল।
আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) যিতুয়ার পৌছে লাল ইয়ামানী কাপড় দিয়ে পাগড়ী বাধলেন এবং আল্লাহর অনুগ্রহের ফলে যে বিজয় লাভ করতে চলেছেন তার জন্য মাথা নীচু করে চলতে লাগলেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য তিনি মাথা এত নীচু করেছিলেন যে তাঁর দাড়ি উটের দেহ স্পর্শ করছিল।
আসমা বিনতে আবু বাক্র (রা) বলেনঃ রাসুলুল্লাহ (সা) যখন যিতুয়াতে থামলেন তখন আবু কুহায়া (আবু বাকরের (রা) পিতা) তার এক অল্প বয়ষ্কা কন্যাকে বললেন, “আমাকে আকু কুবাইস পাহাড়ের ওপর নিয়ে চল।’ আবু কুহাফা তখন দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। মেয়েটি তাকে পাহাড়ের ওপর নিয়ে গেল। তখন আবু কাহাফা তাঁর কন্যাকে বললেন, “ তুমি কি দেখছো?” সে বললো, “একটা বিরাট সনসমাবেশ দেখতে পাচ্ছি।” তিনি বললেন, “ঐ তো সেই বাহিনী।” মেয়েটি বললো, “আরো দেখতে পাচ্ছি এক ব্যক্তি ঐ জনসমাবেশের সামনে একবার আগে আর একবার পেছনে ছুটছে।” তিনি বললেন, “তিনি ঐ বাহিনীল অধিনায়ক।” মেয়েটি বললো, “এবার জনসমাবেশটি বিচ্ছিন্ন হয়েছে।” আবু কুহাফা বললেন, “তাহলে বাহিনীকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।” এবার আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ী নিয়ে চল। মেয়েটি তাঁকে নিয়ে পাহাড় থেকে নামলো।। আবু কুহাফা বাড়ী পৌছার আগেই বাহিনী তাঁর কাছে পৌছে গেল। মেয়েটির গলায় একটি রুপার হার ছিল, কে একজন তা ছিনিয়ে নিল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় পৌছে সমজিদুল হারামে প্রবেশ করলে আবু বাক্র (রা) তার পিতাকে নিয়ে তাঁর কাছে হাজির হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখে বললেন, “এই বৃদ্ধকে ঘরে রেখে এলে না কেন?” আমিই তার কাছে যেতাম।”
আবু বাক্র (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আপনার যাওয়ার চাইতে তাঁর আসাই অধিকতর শোভনীয়।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাাল্লাাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নিজের সামনে বসালেন। অতঃপর তাঁর বুকে তাহ বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন।” তঃক্ষনাঃ আবু কুহাফা ইসলাম গ্রহণ করলেন। এরপর আবু বাক্র তাঁকে নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলেন। এ সময় আবু কুহাফার মাথায় ‘সাগামা’ নামক সাদা এক ধরনের গুল্ম জড়ানো ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাঁর চুল থেকে এটা সরিয়ে দাও।”
অতঃপর আবু বাক্র তাঁর বোনের হাত ধরলেন। বললেন, “আল্লাহর কসম, আমার বোনের জন্য আজ ইসলামই গলার হার?” এর জবাবে কেউ কিছু বললো না। আবু বাক্র বললেন, “হে আদরের বোন! তোমার হার হারিয়ে যাওয়াতে মনে কষ্ট নিও না।”
মক্কা বিজয় ও তায়েফের যুদ্ধে দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ মুহাজিরদের জন্য ‘বনু আবদুর রহমান’ খাযরাজ গোত্রের জন্য ‘বনু আবদুল্লাহ’ এবং আওসের ‘বনু উবাইদুল্লাহ’ সাংকেতিক নাম রেখেছিলেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুসলমানদেরকে মক্কায় প্রবেশের নির্দেশ দেন তখন মুকলিম অধিনায়কগণের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, “হামলা না চালানো হলে কারো সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ো না।” কেবল কয়েকজন লোকরে নাম উল্লেখ করে বলেন যে, “এর কা’বার গিলাফের মধ্যে লুকিয়ে থকালেও তাদেরকে হত্যা করবে।” এদের একজন বনু আমেরের আবদুল্লাহ ইবনে সা’দ। এই ব্যক্তি প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করে। পরে ওহী লেখক হিসেবে নিয়োজিত হয়। তারপর পুনরায় ইসলাম ত্যাগ করে মুশরিকহয়ে কুরাইশদের কাছে ফিরে যায়। এ জন্য রাসূরুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাত তাকে হত্যা করাা নির্দেশ দেন। কিন্তু সে পালিয়ে তার দুধভাই উসমান ইবনে আফফানের কাছে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ কলে। উসমান (রা) তাকে লুকিয়ে রাখেন। পরে মক্কার অবস্থ াস্বাভাবিক এবং জনগণ শান্ত হয়ে আসলে তিনি তাকে রাসূরূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লেেমর নিকট হাজির করেন। উসমান (রা) তার প্রাণের নিরাপত্তা প্রার্থনা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাাম কোন জবাব না দিয়ে দীর্ঘ নীরবতা পালন করেন। অতঃপর বলেন “আচ্ছা।” পরে উসমান (রা) চলে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের বললেন, “আমি চুপ ছিলাম যাতে তোমরা কেউ তাকে হত্যা করার সুযোগ পাও।” আনসারী সাহাবাদের একজন বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে একটু ইংগিত দিলে পারতেন।” তিনি বলরেন, “কোন নবী ইংগীত দিয়ে মানুষ হত্যা করায় নসা।” [৮২.ইবনে হিশাম বলেন, এই ব্যক্তি পরে আবার ইসলাম গ্রহন করেন। উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) তাঁর খিলাফত আমলে তাকে সরকারী কাজে নিয়োজিত করেন। পরে তৃতীয় খলিফা উসমান (রা) তাঁকে সরকারী কাজের দায়িত্ব দেন।]
দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল বনু তামীম গোত্রের আবদুল্লাহ ইবনে খাতাল। তাকে হত্যার নির্দেশ প্রদানের কারণ ছিল, সে যখন মুসলমান ছিল তখন তাকে অপর এক ব্যক্তির সাথে যাকাত আদায় করতে পাঠানো হয়। তার সাথে একজন মুসলমান খাদেমও ছিল। পথিমধ্যে এক জায়গায় তারা যাত্রাবিরতি কলে। এই সময়ে সে ভৃত্যকে একটি ছাগল জবাই করে খাবার তৈরী করতে বলে। কিন্তু ভৃত্যটি খাবার তৈরী না করে ঘুমিয়ে পড়ে। তখন সে তাকে হত্যা করে ইসলাম ত্যাপ করে মুশরিক হয়ে যায়।
তার দ’জন দাসী ছিল। তারা রাসুলূল্লাহ সাল্লাাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিন্দাসূচক গান গাইত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুল্লাহ ইবনে খাতালকে তার দুই দাসীসহ তহ্যার নির্দেশ দেন।
আর একজন হলো ‘হুয়াইরিস ইবনে সুকাইজ’। সে মক্কায় অবস্থানকালে রাসূলুল্লাহকে উত্যক্ত করতো।
আর একজন মিকইয়াস ইবনে লুবাবা। একজন আনসারি সাহাবা ভুলক্রমে তার ভাইকে হত্যা করলে মিকইয়াস উক্ত আনসারীকে হত্যা করে। অতঃপর মুশরিক হয়ে কুরাইশদের কাছে চলে যায়। একজন্য তিনি তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেন।
আর একজন হলো বনু আবদুল মুত্তালিবের আবাদকৃত দাসী সারা। সেও মক্কায় অবস্থানকালে রাসূরুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাøামকে উত্যক্ত করতো।
আর একজন আবু জাহলের পুত্র ইকরিমা।
ইকরিমা ইয়ামানে পালিয়ে যায় এবং তার স্ত্রী উম্মে হাকীম বিনতে হারেস ইসলাম গ্রহণ করে। উম্মে হাকীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আল্াইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ইকরিমার নিরাপত্তা প্রার্থনা করলে তিনি তাকে নিরাপত্তা দেন। তখন সে ইকরিমাসে ইয়ামান থেকে ডেকে নিয়ে আসে। পরে ইকরিমা ইসলাম গ্রহণ করে।
আবদুল্লাহ ইবনে খাতাল ও মিকইয়াসকে হত্যা করা হয। তবে আবদুল্লাহর দাসীদ্বয়ের একজনকে হত্যা করা হয়। অপরজন পালিয়ে যায়। পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দেন। সারাকেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্ষমা করে দেন। কিন্তু পরে উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) খিলাফতকালে এক ব্যক্তি তাকে হত্যা করে। আলী (রা) হয়াইরিসকে হত্যা করেন।
আবু তালিবের কন্যা উম্মে হনী (রা) বলেনঃ মক্কা বিজয়ের প্রক্কালে বনু মাথযুম গোত্রের আমার দুই দবের পালিয়ে এসে আমার কাছে আশ্রয় নেয়। উম্মে হানীয় স্বামী ছিল মাখযুম গোত্রের হুবাইয়া ইবনে আবু ওয়াহাব। উম্মে হনী বর্ণনা করেনঃ তারা আমার কাছে আসার সাথে সাথে আমার ভাই আলী ইবেন আবু তালিব (রা) আমার কাছে এসে বললেন “আমি ওদেরকে হত্যা করবো।” আমি ঘরের দরজা বন্ধ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম। তিনি তখন গোসল করছিলেন। গোসলের পাত্রে খামীর করা আটা লেগেছিল। ফাতিমা তাঁকে কাপড় দিয়ে আড়াল করে দিলেন। গোসল সম্পন্ন করে তিনি আট রাকাআত যুহার নামায পড়লেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “খোশ আমদেদ হে উম্মে হানী! তুমি যাকে আশ্রয় দিয়েছো, আমিও তাকে আশ্রয় দিয়েছি। তুমি যাকে নিরাপত্তা দিয়েছো আমিও তাকে নিরাপত্তা দিয়েছি। কাজেই আলী যেন তাদেরকে হত্যা না করে।”
সাফিয়া বিনতে শাইবা বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং লোকজন শান্ত হলে তিনি সওয়ারীতে আরোহণ করে কা’বা শরীফে গিয়ে তাওয়াফ করলেন। এই সময় তিনি এক প্রান্ত বাঁকা একটি লাঠি দিয়ে ইশারা করে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন। তওয়াফ শেষ করে তিনি উসমান ইবনে তালহাকে ডেকে তার নিকট থেকে কা’বার চাবি নিলেন। দরজা খুলে দেয় হলে তিনি কা’বার ভেতরে প্রবেশ করলৈন। সেখানে কাঠের তৈরী একটি কবুতরের মূর্তি দেখতে পেলেন। তিনি তা ভেঙ্গে ছুড়ে ফেললেন। অতঃপর তিনি কা’বার দরজার ওপর দন্ডায়মান হলেন। লোকেরা এ সময় তাঁর পক্ষ থেকে প্রাণের নিরাপত্তা লাভের নিমিত্তে সমজিদুল হারামে আশ্রয় নিয়ে সেখানে অবস্থান করছিল।]
ইবনে ইসহাক বলেন: আমি বিশ্বস্ত লোকদের নিকট শুনেছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা’বার গরজার ওপর দাঁড়িয়ে নিম্নরূপ ভাষণ দিলেনঃ
“আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি এক ও লা-শরীক। তিনি তাঁর ওয়াদা পালন করেছেন, স্বীয় বান্দাকে বিজয়ী করেছেন এবং তিনি কাফিরদের সংগঠিত দলগুলোকে পরাস্ত করেছেন। শুনে রাখ, অতীতের যে কোন রক্ত, সম্পদ বা অর্থের দাবী আমার এই পায়ের তলায় দলিত করলাম। (অর্থাৎ রহিত করলাম) তবে কা’বায় সেবা এবং হাজীদের আপ্যায়নের রীতি চালু থাকবে। শুনে রাখ, ভুলক্রমে হত্যা ইচ্ছাকৃত হত্যার কাছাকাছি। চাই তা লাঠি দ্বারা হোক কিংবা ছড়ি দ্বারা হোক। এর জন্য চল্লিশটা গাভীন উটসহ একশত উট দিয়াত দিতে হবে। হে কুরাইশরা তোমাদের জাহিলিয়াতের আভিজাত্য এবং পূর্বপুরুষদের নামে বড়াই করার প্রথা আল্লাহ রহিত করে দিয়েছেন। সকল মানুষ আদমের সন্তান এবং আতম মাটির তৈরী।” অতঃপর এই আয়াত তিলাওয়াত করলৈন,
“হে মানব জাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ ও স্ত্রী থেকে সৃষ্টি করেছি। শুধুমাত্র পরিচিতির সুবিধার জন্য তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠিতে বিভক্ত করেছি। আসলে তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশী খোদাভীরু সে-ই আল্øাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানার্হ।” (হুজারাত) অতঃপর তিনি আরো বললেন, “হে কুরাইশগণ, তোমরা আমার কাছে কি ধরনের আচরণ প্রত্যাাশা কর?” সবাই বললো, “উত্তম আচরণ। কেননা তুমি আমাদের এক মহান ভ্রাতা এবং এক মহান ভ্রাতার পুত্র।”
তিনি বললেন, “যাও, তোমরা সকলে মুক্ত, স্বাধীন।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদুল হারামে বসলেন। তাঁর কাছে আলী ইবনে আবু তালিব এলন। তাঁর হাতে ছিল কা’বার চাবি। তিিন বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, হাজীদের আপ্যায়নের সাথে কা’বার দ্বার রক্ষকের দায়িত্বও আমাদের হাতে নিয়ে নিন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “উসমান ইবেন তালহা কোথায়?” উসমানকে ডাকা হলো। তিনি বললেন, “হে উসমান! এই নাও তোমার চাবি। আজকের দিন সৌজন্য ও সহৃদয়তা প্রদর্শনের দিন।”
ইবনে হিশাম বলেনঃ কিছুসংখ্যক জ্ঞানী রোকের নিকট থেকে আমি জানতে পেরেছি যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা’বা শরীফের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সেখানে ফিরিশতা ও অন্যান্য অনেক কিছুর প্রতিকৃতি দেখতে পেলেন। এমনকি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রতিকৃতি দেখতে পেলৈন। তার হাতে রয়েছে ভালমন্দ নির্ধারণের তীর সমূহ। তা দেখে তিনি বললেন, “আল্লাহর অভিশাপ হোক মুশরিকদের ওপর। আমাদের প্রবীনতম মুরব্বীকে ভালমন্দ নির্ধারনের তীর বানিয়ে ছেড়েছে। কোথায় ইবরাহীম আর কোথায় এসব?” অতঃপর এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন, “ ইবরাহীম ইহুদীও ছিলেন না খৃষ্টানও না। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম। তিনি মুশরিকও ছিলেন না।”
অতঃপর ঐসব প্রতিকৃতি বিনষ্ট করার নির্দেশ দিলেন এবং তা বিনষ্ট করা হলো। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিলালকে (রা) সাথে নিয়ে কা’বার ভেতর প্রবেশ করেন। তাঁকে আযান দিতে নির্দেশ দিলেন। তখন আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, আত্তাব ইবনে উসাইদ এবং হারেস ইবনে হিশাম কা’বার আঙিনায় উপবিষ্ট। আত্তাব ইবনে উসাইদ বললো, “ভাগ্যিস আল্লাহ (আমার পিতা) উসাইদকে সসম্মানে আগেভাগে সরিয়ে নিয়েছেন। তা না হলে আজ এই আযান শুনে সে এমন কিছু কথা বলে বসতো যা তার ক্রোধেরও উদ্রেক করতো।” হারেস ইবনে হিশাম বললো, “আমি যদি মনে করতাম সে (মুহাম্মাদ) হক পথে চলছে তাহলে আমি তার অনুসরণ করতাম।” আবু সুফিয়ান বরলো, “আমি কিছুই বলবো না। একটা কথাও যদি বলি তাহলে এই পাথরের টকরোগুলোও তা ফাঁস করে দেবে।”
এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে এলন। তিনি বললেন, “তোমরা যা বলাবলি করেছো আমি তা শুনেছি।” হারেস ও আত্তাব বললো, “আমরা সাকষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর রাসূল। আমাদের কাছে যারা ছিল তাদের কেউই তো এ কথা আপনাকে জানায়নি। কাজেই এ কথা আপনাকে জানানোর জন্য আমাদের কোন সঙ্গীকেই দোষারোপ করতে পারি না।” (তাই এটা নিশ্চয়ই আল্লাহ জানিয়েছেন এবং আল্লাহর রাসূল হলেই সেটা সম্ভব।)
ইবনে হিশাম বলেনঃ
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন স্বীয় সওয়ারীতে আরোহণ করে মক্কায় প্রবেম করে সবার আগে কা’বা শরীফ তাওয়অফ কররৈন। তখনো কা’বার চারপাশে সীসা দিয়ে সংরক্ষিত মূর্তিসমূহ বিরাজ করছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাতের লাঠি ুদয়ে মূর্তিগুলোর দিকে ইংগিত করে বললেন, “সত্য এসেছে এবং বাতিল উৎখাত হয়েছে। বস্তুতঃ বাতিল উৎখাত হওয়ারই যোগ্য।” একথা বলে যে মূর্তিটার দিকেই তিনি ইশারা করতে লাগলেন, তা চিৎ বা উপুড় হয়ে যেতে লাগলো। এভাবে এক একে সবক’টা মূর্তিই ধরাশায়ী হলো।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র আমাকে জানিয়েছে যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূরুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কা’বার তাওয়াফ করছিলেন তখন ফুজালা ইবেন উমাইর লাইসী তাকে হত্যা করার ফন্দি আঁটে। এই ফন্দি নিয়ে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটবর্তী হলেই তিন বললেন, “কে,, ফুজালা নাকি” সে বললো “হাঁ।” হে আল্লাহর রাসূল।” তিনি বললেন, “তুমি মনে মনে কি ভাবছিলে?” সে বললো, “কিছুই না, আমি আল্লাহকে স্মরণ করছিলাম।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেসে বললেন, “আল্লাহর কাছে তাওবাহ কর।” অতঃপর তার বুকের ওপর নিজের হাত রাখলেন। তাতে তার মন শান্ত হলো। পরবর্তীকালে ফুজালা বলতো, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মুহুর্তে আমার বুকের ওপর থেকে হাত তুলে নিলেন তখন থেকে পৃথিবীতে কোন জিনিস আমর কাছে তাঁর চাইতে প্রিয় বলে মনে হয়নি।”
ফুজালা আরো বলেনঃ এরপর আমি নিজ পরিবারের কাছে চললাম। যাওয়ার সময় এমন এক মহিলার কাছ দিয়ে গেলাম যার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে বললো, “এসো আমরা গল্প করি।” আমি বললাম, ‘না।’
এ প্রসঙ্গে ফুজালা নিম্নরুপ কবিতা আবৃত্তি করেন,
“মহিলাটি আমাকে কথা বলতে ডাকলো। আমি বললাম, আল্লাহ ও ইসলাম তোমার আহ্বানে সাড়া দিতে নিষেধ করেন। তুমি যদি বিজয়ের দিন মুহাম্মাদ ও তাঁর বাহিনীকে দেখতে – যেদিন মূর্তিগুলো ভেঙ্গে চ’র্ণবিচর্ণ করা হচ্ছিলো, তাহলে দেখতে যে, আল্লাহর দ্বীন উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে এবং শিরক অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গিয়েছে।”
ইবনে ইসসাক বলেনঃ মক্কা বিজয়ে অংশগ্রহন করেছিলেন কর্বমোট দশ হাকার মুসলমান। তম্মধ্যে বনু সুলাইম গোত্রের সাতশ মতান্তরে এক হাজার, বনু গিফার ও বনু আসলামের চার, মুফাইনার এক হাজার তিন জন, আর অবশিষ্ট সবাই কুরাইশ ও আনসার, তাদের মিত্র এবং তামীম, কাইস ও আদাস গোত্রত্রয় সহ আরব গোত্রসমূহের লোস।
মক্কা বিজয়ের দিন সম্পর্কে রচিত প্রসিদ্ধ কবিতা হলো হাসসান ইবনে সাবিত আনসারীর কবিতাঃ
“যাতুল আসাবি ও জিওয়া থেকে আযরা পর্যন্ত গোটা এলাকা উকাড় হয়ে গেছে। জিওয়ার ঘরবাড়ী বিরান হয়ে গেছে। বনু হাশহাশ গোত্রের এলাকা এখন উষর মরুভুমি। প্রবল বাতাস তার চিহ্ন মুছে দেয় এবং আকাশ সেখানে বারি বর্ষণ করে না। ইতির্পূবে সেখানে একজন ইপকারী বন্ধু ছিল, ঐ এলাকার শ্যামল বনানীতে উট মেষ চরে বেড়াতো। সেসব স্মৃতিচারণ এখন থাক। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে, রাত গভীর হয়ে এল আমার ঘুম আসে না। এর কারন সেই আলুলায়িত কুন্তলা (এলোমেলো বিশৃঙখল অবস্থা) যা তাকে জাপটে ধরেছিল, ফলে তার মনের শান্তি ঘুঁচাবার উপায় নেই। যেন বাইতুব বা’সের গুপ্ত বস্তু মধু ও পানি তার সাথে মিশানো হতো। একদিন যখন পানীয় বস্তুসমূহের পর্যালোচনা হবে, তখন দেখা যাবে, ঐগুলো উৎকৃষ্ট সুপেয় বস্তু এবং উৎসর্গীকৃত। তাকে তিরষ্কারের অধিকার দেবো যদি আমরা তিরষ্কারযোগ্য কোন কাজ করি-চাই তা গালাগাল বা প্রহার পর্যন্ত গিয়ে পড়াক। আমরা সেই সব পানীয় পান করবো ফলে তাৎক্ষনিকভাবে আমরা রাজা বাদশাহে পরিণত হবো, পরিনত হবো সেই সিংহে- যা কোন কিচুর সম্মুখীন হতে ভয় পায় না। আমাদের অশ্বারোহী বাহিনী থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি, যা ধুলা উড়িয়ে ছোটে এবং যার গন্তব্য হলো কা’দা (মক্কার উচ্চভ’মি), জানি না তোমরা তা দেখেছো কিনা। যে বাহিনী লাগাম নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হয় (কে আগে সওয়ার হবে সে জন্য) যা অতিশয় আগ্রহী এবং যার ষাড়ের ওপর রক্তপিপাসার বর্শা রয়েছে। আমাদের ঘোড়াগুলো অতি দ্রুতবেগে ছোটে। মহিলারা ওড়না গিয়েও তাকে হাঁকিয়ে নিতে পারে। তোমরা যদি আমাদের বাধা না দাও তা’হলে আমরা উমরা করবো- অবশ্য বিজয় অবধারিত হয়ে আছে এবং সমস্ত পর্দা ছিন্ন হয়ে গেছে। (অর্থাৎ বিজয়ের সুষ্পষ্ট আভাস পাওয়া গেছে) অন্যথায় ববিষ্যতের কোন যুদ্ধের জন্য অন্বেষা কর। আল্লাহর দূত জিবরীল আমাদের মধ্যে রয়েছেন। তিনি পরম পবিত্র আত্মা- যার সমতুল্য কেউ নেই। আল্লাহ বলেন যে, এমন এক বান্দাকে আমি পাঠিয়েছি যিনি বিপদ আপদে উকারী হক কথা বলে থাকেন। আমি তার কাযৃকলাপের সাক্ষী। তোমরা তাকে মেনে নাও। কিন্তু তোমরা (হে মক্কাবাসী০ জবাব দিলে, আমরা তাকে মানবো না, মানবার কোন ইরাদা আমাদের নেই। আল্লাহ আরো বললেন, আমি আনসার বাহিনীকে পাঠিয়ে দিয়েছি, তাদের লক্ষ্য হলো যুদ্ধ। আমাদের কিছু না কিছু মুকাবিলা করতে হয়-কখনো গালাগলি, কখনো যুদ্ধ, কখনো তিরষ্কার। যারা তিরষ্কার বা গালাগালি করে তাদেরকে ছন্দায়িত বাষায় দাঁতভাঙ্গা জবাব দিই, আর যারা আমাদের রক্তপাতে লিপ্ত হয় তাদের ওপর আঘাত হানি। আবু সুফিয়ানকে জানিয়ে দাও (আমাদের মক্কায়) প্রবেশ আসন্ন। আর এটা ষ্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আমাদের তরবারী তোমাকে গোলাম বানিয়ে ছেড়েছে এবং আবদুদ দার গোত্রের সরদারদেরকে দাস বানিয়ে ছেড়েছে। তুমি মুহাম্মাদকে গালাগালি করেছো। আর আমি তার জবাব দিয়েছি এবং আল্লাহর কাছে তার প্রতিদান রয়েছে। তুমি এক পরম কল্যানময় পরোপকারী ও একনিষ্ঠ সত্যপন্থী গালাগলি করেছো। যিনি আল্লাহর পরম বিশ্বস্ত এবং ওয়াদা পূর্ণ করা যার জীবন ব্রত। যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলকে গালাগাল করে আর যে ব্যক্তি তাঁর প্রশংসা করে ও সাহায্য করে সে কি সমান হতে পারে? বস্তুত আমার পিতা, দাদা এবং আমার সম্ভ্রমের বিনিময়ে মুহাম্মাদের সম্ভ্রমকে তোমাদের হাত থেকে রক্ষ করবো। আমার জিহ্বা অকাট্য এবং নির্দোষ। আমার সমুদ্রকে কোন বালতি দিয়ে কলুষিত করা সম্ভব নয়।”২৮২