নবুওয়াত লাভ
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বযস যখন চল্লিশ বছর হলো, আল্লাহ তাঁকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য করুণাস্বরূপ এবং গেটা মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা করে পাঠালেন। ইতিপূর্বে পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল এসছেন তাঁদের প্রত্যেকের নিকট থেকে আল্লাহ তায়ালা এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, তাঁরা নাকি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনবেন, তাঁকে সমর্থন করবেন এবং তাঁর বিরোধীদের মুকাবিলায় তাঁকে সাহায্য করবেন। আর তাদের প্রতি যারা ঈমান আনবে ও সমর্থন জানাবে তাদরেকেও এ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেবেন। সেই অঙ্গীকার অনুসারে প্রত্যেক নবী নিজ নিজ অনুসারীদেরকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মেনে নেয়া ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়ে যান।
আয়িশা (রা) বর্ণনা করেন, “আল্লাহ তায়ালা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মানিত করতে ও মানব জাতিকে তাঁর দ্বারা অনুগৃহীত করতে মনস্থ করলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াতের অংশ হিসেবে নির্ভুল স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তখন তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের সূর্যোদয়ের সমই বাস্তব হয়ে দেখা দিত। এই সময় আল্লাহ তায়ালা তাকে নির্জনে অবস্থান করার প্রতি আগ্রহী করে দেন। একাকী নিভৃতে অবস্থান তাঁর কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় হয়ে ওঠে।”
আবদুল মালিক ইবনে উবাইদুল্লাহ বর্ণনা বলেনঃ
আল্লাহ তায়ালা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান ও মার্যাদায় ভূষিত করতে মনস্থ করলেন ও নবুওয়াতের সূচনা করলেন, তখন তিনি কোন প্রয়োজনে বাইরে বেরুলে লোকালয় ছেড়ে অনেক দূরে মক্কার পার্বত্য উপত্যকায় ও সমভূমিতে চলে যেতেন। তখন যে কোন পাথর বা গাছের পাশ দিয়েই তিনি অতিক্রম করতেন ঐ পাথর বা গাছ বলে উঠতো, “আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ!” ( হে আল্লাহর রাসূল, আপনার প্রতি সালাম)। এ কথা শোনা মাত্রই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশে-পাশে ডানে-বামে ও পেছনে ফিরে তাকাতেন। কিছুদিন কেটে গেল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে শুন্তে ও দেখতে থাকলেন। অতঃপর রমযান মাসে তিনি যখন হেরা গুহায় [২০. মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত একটি পাহাড়ের গুহার নাম হেরা।] অবস্থান করছিলেন, তখন তাঁর কাছে আল্লাহর তরফ থেকে পরম সম্মান ও মর্যাদার বাণী বহন করে জিবরীল আলাইহিস্ সালাম এলেন।
উবাইদ ইবনে ‘উমাইর থেকে বর্ণিত আছে যে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বছর এক মাস হেরা গুহায় কাটাতেন। জাহিলিয়াতের যুগে কুরাইশরাও এই একইভাবে মূর্তিপূজা বাদ দিয়ে নিভৃত তপস্যায় মগ্ন হতো। প্রতি বছর একটা মাস তিনি এভাবে নির্জনে ইবাদাত করে কাটাতেন। উক্ত মাসে তাঁর কাছে যত দরিদ্র লোকই থাকতো তাদেরকে তিনি খাবার দিতেন। এক মাসের এই নির্জনবাস সমাপ্ত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের বাড়ীতে ফিরে যাবার আগে সর্বপ্রথম কা’বা শরীফে প্রবেশ করে সাতবার বা ততোধিক বার তাওয়াফ করতেন এবং একাজ করার পরই কেবল বাড়ীতে ফিরে আসতেন। অতঃপর আল্লাহ কর্তৃক তাঁকে পরম সম্মানে ভূষিত করার মাসটি অর্থাৎ নবুওয়াত প্রাপ্তির বছরের রমযান মাস সমাগত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথারীতি হেরায় অবস্থানের জন্য রওয়ানা হলেন। অবশেষে সেই মহান রাতটি এলো, যে রাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে রিসালাত দিয়ে গৌরবান্বিত করলেন। এই সময় আল্লাহর নির্দেশে জিবরীল আলাইহিস্ সালাম তাঁর কাছে আসলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এই অবস্থায় জিবরীল একখ- রেশমী কাপড় নিয়ে আবির্ভূত হলেন। ঐ রেশমী বস্ত্রখ-ে কিছু লেখা ছিল। জিবরীল আমাকে বললেন, “পড়ুন”! আমি বললাম, “আমি পড়তে পারি না।”
তখন তিনি আমাকে এমন জোরে আলিঙ্গন করলেন যে, আমি ভাবলাম, মরে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “পড়ুন!” আমি বললাম, “আমি পড়তে পারি না।” তিনি পুনরায় আমাকে সজোরে আলিঙ্গন করলেন। এবারও চাপের প্রচ-তায় আমার মৃত্যুর আশংকা হলো। আবার তিনি ছেড়ে দিলেন এবং বললেন, “পড়ৃন”! আমি বললাম, “কি পড়বো?” তিনি বললেন, “ইকরা বিসমি রাব্বিকা….। অর্থাৎ পড়ুন আপনার সেই প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পড়ুন, আর আপনার প্রভু সদাশয় অতি। তিনিই কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে সেইসব জিনিস শিক্ষ দিয়েছেন যা সে জানতো না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, অতঃপর আমি শোনানো আয়াত কয়টি পড়লাম। এই পর্যন্ত পড়িয়েই জিবরীল থামলে এবং তারপর চলে গেলেন। এরপর আমি ঘুম থেকে উঠলাম। মনে হলো যেন আমি আমার মানসপটে কিছু লিখে নিয়েছি এরপর আমি হেরা গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম। পর্বতের মধ্যবর্তী এক স্থানে পৌঁছে হঠাৎ ওপর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম “ হে মুহাম্মাদ, আপনি আল্লাহর রাসুর এবং আমি জিবরীল।” আমি ওপরে আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম. জিবরীল একজন মানুষের আকৃতিত আকাশের দূর দিগন্তে ডানা দু’খানা ছড়িয়ে দিয়ে আছেন এবং বলছেন, “হে মুহাম্মাদ আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আমি জিবরীল।” আমি স্তব্ধ হযে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আকাশের অন্যান্য প্রান্তে তাকিয়ে দেখি, সর্বত্রই তিনি একই আকৃতিতে বিরাজমান। এইরূপ নিশ্চলভাবে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি পিছনে সরতে বা সামনে এগুতে সক্ষম হচ্ছিলাম না। এই সময় খাদীজা আমাকে খুঁজতে লোক পাঠালো। মক্কার উঁচু এলাকায় পৌঁছে তারা আবার খাদীজার কাছে ফিরে গেল। অথচ আমি তখনো ঐ একই স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এরপর জিবরীল অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে চললাম। খদীজার কাছে উপনীত হয়ে তার কাছে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলাম। সে বললো, “হে আবুল কাসিম, আপনি কোথায় ছিলেন? আমি আপনার খোঁজে লোক পাঠিয়েছিলাম। তারা মক্কার উচ্চভূমিতে আপনাকে খুজে ফিরে এসছে।” আমি যা কিছু দেখেছিলাম সবকিছু খাদীজাকে খুলে বললাম। খাদীজা বললো, “এ ঘটনাকে আপনি পরম শুভ লক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করুন এবং অবিচল থাকুন। যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলেছি, আপনি এ যুগের মানবজাতির জন্য নবী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”
অতঃপর খাদীজা কাপড়-চোপড়ে আবৃত হয়ে ওয়ারাকা ইবনে নওফেলের কাছে গেলেন। ওয়ারাকা ছিলেন খাদীজার চাচাতো ভাই। তিনি খ্রস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং আসমানী কিতাবের জ্ঞানে সুপ-িত ছিলেন। বিশেষতঃ তাওরাত ও ইনজীল বিশ্বাসীদের নিকট থেকে অনেক জ্ঞান লাভ করেছিলেন। খদীজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখা ও শোনা সমস্ত য়টনা তাঁর কাছে আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলেন। সব শুনে ওয়ারাকা বলে উছলেন, “কুদ্দূসুন কদ্দূসুন! মহা পবিত্র ফেরেশতা! মহা পবিত্র ফেরেশতা!! আল্লাহর শপথ করে বলছি, হে খাদীজা, তুমি বিশ্বাস কর, মুহাম্মাদের নিকট সেই মহান দূতই এসেছেন যিনি মূসার নিকট আসতেন। বস্তুতঃ মুহাম্মাদ বর্তমান মানব জাতির জন্য নবী মনোনীত হয়েছেন। [২১.সুহাইলী বলেনঃ ঈসা (আ) সময়ের ব্যবধানের দিক দিয়ে নিকটতর নবী হওয়া সত্ত্বেও ওয়ারাকা তার পরিবর্তে মূসার নামোল্লেখ করলেন এই যে, ওয়ারাকা তখন খৃস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। আর খৃস্টানদের মতে হযরত ঈসা (আ) নবী নন। বরং তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী হয়রত ঈসা (আ) আল্লাহ তায়ালার তিনটি সত্তার একটি যা ঈসার সত্তায় একাকার হয়ে গিয়েছে। খৃস্টানদের মধ্যে অবশ্য এ ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।]তাঁকে বলো, তিনি যেন অবিচল থাকেন।”
খাদীজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ফিরে গিলেন এবং ওয়ারাকা যা বলেছেন তা তাঁকে জানালেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হেরা গুহায় মাসব্যাপী ইবাদাত শেষ হলে তিনি মক্কায় ফিরে যথারীতি কা’বার তাওয়াফ করতে শুরু করলেন। এই সময় ওয়ারাকা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাতিজা, তুমি যা দেখেছো ও শুনেছো- বলতো।”রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সমস্ত ঘটনা কললেন। সব শুনে ওয়ারাকা বললেন, “নিশ্চিত জেনো, তুমি এ যুগের মানব জাতির নবী। সেই মহাদূতই তোমার কাছে এসেছিলেন যিনি মূসার কাছেও আসতেন। তুমি এটাও নিশ্চিত জেনে রেখো যে, তোমার বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হবে, নির্যাতন করা হবে। তোমাকে দেশান্তরিত করা হবে এবং তোমার বিরুদ্ধে লড়াই করা হবে। আমি যদি তখন জীবিত থাকি তাহলে অবশ্যই আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠায় প্রকাশ্যভাবে সাহায্য করবো।” অতঃপর ওয়ারাকা তাঁর কাছে মাথা এগিয়ে নিয়ে এলেন এবং তাঁর কপালে চুমু খেলেন। তাওয়াফ সমাপ্ত করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ী ফিরে গেলেন।
কুরআন নাযিলের সূচনা
পবিত্র রমযান মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ওহী নাযিল শুরু হয়। মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন,
“রমযান মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানব জাতির জন্য পথনির্দেশক রূপে, হিদায়াতের সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ সহকারে, হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী হিসেবে।”
মহান আল্লাহ আরো বলেন.
“আমি এই কুরআন লাইলাতুল কদরে নাযিল করেছি। লাইলাতুল কদর কী তা কি তুমি জানো? লাইলাতুল কদর সহস্র মাসের চেয়ে উত্তম। এ রাতে ফিরিশতাগণ ও জিবরীল অবতীর্ণ হয় তাদের প্রতিপালকের ইচ্ছায় ওবং প্রভাত হওয়া পর্যন্ত এ রাত শান্তিময় হয়ে থাকে।”(সূরা কদর)
আল্লাহ তা’য়ালা আরো বলেন,
“হা-মীম! সুস্পষ্ট গ্রন্থের শপথ! নিশ্চয়ই এই কিতাবকে আমি একটি কল্যাণময় রজনীতে নাযিল করেছি। নিশ্চিতভাবে নিশ্চিভাবেই আমি সাবধান করতে চেয়েছি। এ ছিল এমন এক রাত, যে রাতে আমার হুকুমে সকল বিষয়ের যুক্তিপূর্ণ ও বিজ্ঞানভিত্তিক ফায়সালা করা হয়। আর আমি একজন রাসূল পাঠাতে চাচ্ছিলাম।”(সুরা দুখান)
আল্লাহ তা’য়ালা আরো বলেন,
“তোমরা যদি আল্লাহর ওপর এবং আমার বান্দার ওপর পৃথকীকরণ ও দুই দলের মুখোমুখী হওয়ার দিনে আমি যা নাযিল করেছি তার ওপর ঈমান এন থাক….” এখানে মুখোমুখী হওয়ার দিন অর্থ বদরের ময়দানে মুশরিকদের ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখোমুখী হওয়ার দিন।
খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদের ইসরাম গ্রহণ
খাদীজা বিনতে খুয়াইলিদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ঈমান আনলেন। আল্লাহর কাছ থেকে যে প্রত্যাদেশ তিনি পেলেন তা সত্য বলে মেনে নিলেন। নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের কাজে তাঁকে সমযোগিতা করলেন। বস্তুতঃ তিনিই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলেন প্রতি ঈমান আনয়নকারী ও তাঁকে সত্যরূপে গ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি।
এভাবে আল্লাহ তাঁর নবীর দুঃখ-কষ্টকে লাঘব করেন। যখনই অবাঞ্ছিত অবস্থার সৃষ্টি হতো, কেউ তাঁর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করতো ও মিথ্যা প্রতিপন্ন করতো, তখন তিনি মর্মাহত হতেন। কিন্তু খাদীজার কাছে গেলেই আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর মনোকষ্ট দূর হয়ে যেতো। খাদীজা তাঁকে সান্ত¦না দিতেন, তাঁর মনের দুঃখ-বেদনা হালকা করে দিতেন, তাঁর দাওয়াতকে সম্পূর্ণ সত্য বলে স্বীকৃতি দিতেন এবং মানুষের আচরণকে যাতে তিনি হালকাভাবে গ্রহণ করেন, সেজন্য অন্রপ্রণিত করতেন। আল্লাহ তাঁর (খাদীজার) ওপর রহমত নাযিল করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “এ কারণে আমি খাদীজাকে জান্নাতে এমন একটি গৃহের সুসংবাদ দিতে আদিষ্ট হয়েছি, যে গৃহ অনুপম কারুকার্যখচিত মুক্তার তৈরী এবং যেখানে কোন হৈ চৈ, দুঃখ-কষ্ট ও অসুস্থতা থাকবে না।”
ওহীর বিরতি
এরপর কিছুদিনের জন্য ওহী বন্ধ থাকে বিষয়টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য খুবই কষ্টকর হয়ে উঠলো। এরপর জিবরীল (আ) তাঁর কাছে সূরা ‘আদ্ দুহা’ নিয়ে আবির্ভূত হলেন। যে মহান প্রতিপালক তাঁকে নবুওয়াত দ্বারা সম্মানিত করেছেন তিনি ঐ সূরাতে শপথ করে বলেছেন যে, তিনি তাঁকে ত্যাগ করেননি এবং তাঁর প্রতি বৈরীও হননি। মহান আল্লাহ বলেন, “মধ্যাহ্নের শপথ এবং তিমিরাচ্ছন্ন রজনীর শপথ!
তোমার প্রভু তোমাকে ত্যাগ করেননি এবং পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি বৈরিও হননি।” অর্থাৎ তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তোমাকে পরিত্যাগ করেননি, আর তোমার প্রতি শত্রুতা পোষণ করার পর পুনরায় ভালোবেসেছেন এমনও হয়নি। “বস্তুতঃ তোমার জন্য পূর্বের অবস্থার চেয়ে পরবর্তী অবস্থাই ভালো।” অর্থাৎ আমার নিকট তোমার প্রত্যাবর্তনের পর তোমার জন্য যা প্রস্তুত করে রেখেছি তা দুনিয়াতে তোমাকে যা দিয়েছি তার চেয়ে উত্তম। অবশ্যই তিনি তোমাকে অচিরেই এতো পরিমাণে প্রদান করবেন যাতে তুমি খুশী হয়ে যাবে। অর্থাৎ দুনিয়ায় সাফল্য ও বিজয় এবং আখিরাতে প্রতিদান। “তিনি কি তোমাকে ইয়াতীম অবস্থায় পেয়ে আশ্রয় দেননি? আর তিনিই তোমাকে দিশেহারা দেখে পথের সন্ধান দিয়েছেন এবং তোমাকে দরিদ্র অবস্থায় পেয়ে সম্পদশালী করেছেন।” এ আয়াত ক’টিতে আল্লাহ তা’য়ালা তাঁর প্রথম জীবনে প্রাপ্ত সম্মান এবং তাঁর মাতৃ-পিতৃহীন, সহায়-সম্বলহীন ও দিশেহারা অবস্থায় আল্লাহ তাঁর প্রতি যে করুণা-অনুকম্পা দেখিয়েছেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাঁকে যে শোচনীয় দুরবস্থা থেকে উদ্ধার করেছেন, তার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। “অতএব তুমি ইয়াতীমের প্রতি ক্রোধ প্রদর্শন করো না এবং সাহায্য প্রার্থনাকারীকে ধমক দিও না।” অর্থাৎ আল্লাহর দুর্বল বান্দাদের ওপর ঐদ্ধত্য ও অহংকার প্রদর্শন করো না এবং নিষ্ঠুর ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ করোনা। “আর তোমার প্রতিপালকের দেয়া নিয়ামতের কথা প্রচার কর।” অর্থাৎ আল্লাহর তরফ থেকে নবুওয়াত প্রপ্তির মাধ্যমে যে অতুলনীয় সম্পদ ও অনুপম মর্যাদা তুমি লাভ করেছ, তার কথা মানুষকে জানাও ও তাদেরকে সেদিকে দাওয়াত দাও।
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতি সংগোপনে তাঁর নিকটতম লোকদের মধ্য হতে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের কাছে দীন প্রচারে আত্ননিয়োগ করলেন। আল্লাহ তাঁকে নবুওয়াত দান করে স্বয়ং তাঁর ওপর ও সমগ্র মানব জাতির ওপর যে মহা অনুগ্রহ করেছেন তার কথা ব্যক্ত করতে লাগলেন।
প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী
পুরুষদের মধ্য হতে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান আনেন, তাঁর সাথে নামায আদায় করেন, এবং তাঁর প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হওয়া ওহী মনে-প্রাণে গ্রহণ করেন, তিনি ছিলেন তাঁরই চাচা আবু তালিবের পুত্র আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু। তখন তাঁর বয়স মাত্র দশ বছর।
হযরত আলীর (রা) ওপর আল্লাহর একটা বিশেষ অনুগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। আল্লাহ যে তাঁর কল্যাণ চেয়েছিলেন এবং সে জন্য তাঁর উপযোগী ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন, সেটা তাঁর ইসলাম গ্রহণের পূর্ববর্তী ঘটনাবলী থেকে বুঝা যায়। কুরাইশদের তখন ঘোর দুর্দিন। বহু সন্তানের পিতা হওয়ায় আবু তালিব নিদারুণ আর্থিক সংকটে ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরেক চাচা ছিলেন আব্বাস। তিনি ছিলেন বনু হাশিম গোত্রের মধ্যে সচ্ছলতম ব্যক্তি। তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আব্বাস, আপনার ভাই আবু তালিব অধিক সন্তানের ভারে জর্জরিত। দেখতেই পাচ্ছেন মানুষ কি ভীষণ দুর্দশায় ভুগছে। আসুন, আমরা তাঁর সন্তান ভার লাঘব করি। তাঁর পুত্রদের মধ্য হ’তে একজনের দায়-দয়িত্ব আমি গ্রহণ করি আর অপর একজনের দায়িত্ব আপনি গ্রহণ করুন। এভাবে দু’টি সন্তানের দায়-দায়িত্ব থেকে তাঁকে রেহাই দেয়া যাবে।”
আব্বাস বললেন, “ঠিক আছে, চলো যাই।”
অতঃপর তাঁরা উভয়ে গিয়ে আবু তালিবকে বললেন, “যতদিন দেশবাসী বর্তমান আর্থিক সংকট থেকে মুক্ত হচ্ছে না ততদিনের জন্য আমর আপনার সন্তানদের ভার লাঘব করতে চাই।” আবু তালীব বললেন, “তোমরা আকীলকে আমার কাছে রেখে যাও। তারপর যাকে খুশী নিয়ে যাও।”
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে আলীকে নিলেন এবং তাঁকে নিজ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করলেন। আর আব্বস নিলেন জাফরকে এবং তাঁকে তিনি স্বীয় পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করলেন। এরপর আলী (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির সময় পর্যন্ত তাঁর কাছেই ছিলেন। তাই নবুওয়াত প্রাপ্তির পরে আলী তাঁর ওপর ঈমান আনলেন ও তাঁকে নবী হিসেবে মনে-প্রাণে মেনে নিয়ে তাঁর অনুসরন করতে লাগলেন।
কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে, নামাযের সময় উপস্থিত হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার দুর্গম গিরি গুহায় চলে যেতেন, আর তাঁর সাথে আলীও যেতেন। কিন্তু এ কাজটি তাঁর পিতা, চাচা ও গোত্রের সকলের অগোচরে সঙ্গোপনে করতে থাকলেন।সেখানে তাঁরা দু’জনে গিয়ে নিভৃতে নামায পড়তেন এবং সন্ধ্যা হলে বাড়ী ফিরতেন। এভাবেই তাঁরা আল্লাহর ইচ্ছায় বেশ কিছুদিন কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। একদিন আবু তালিন তাঁদের দুজনকে নামাযরত অবস্থায় দেখতে পেয়ে নামায শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভাতিজা, এটা আবার কোন দীন (ধর্ম) যার অনুসরণ তুমি করছো?” তিনি বললেন, “চাচা, এটা আল্লাহর দীন, তাঁর ফেরেশতাদের দীন, তাঁর নবী-রাসূলদের দীন। আর বিশেষতঃ আমাদের পিতা ইবরাহীমের দীন। আল্লাহ আমাকে রাসূল বনিয়েছেন এবং এই দীনসহ মানব জাতির কাছে পাঠিয়েছেন। হে চাচা, আমি যত লোককে এই দীনের শিক্ষা দিয়েছি এবং যত লোককে এই জীবন বিধান গ্রহনের আহ্বান জনিয়েছি তাদের সবলের চাইতে আপনি এই দাওয়াত পাওয়ার অধিক হকদার। আর যত লোক আমার এই দাওয়াত গ্রহণ করেছে এবং আমাকে কাজে সহযোগিতা করেছে তাদের তুলনায় আপনারই বেশী কর্তব্য এ আহ্বানে সাড়া দেয়া ও সহযোগিতা করা।”
আবু তলিব বললেন, “ভাতিজা, আমি আমার পূর্বপুরুযদের ধর্ম ও রীতিনীতি বর্জন করতে পারি না। তবে আল্লাহর কসম, আমি যতদিন বেঁচে আছি তোমার এ তৎপরতার দরুন তোমাকে কোন অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে না।”
এরপর ইসলাম গ্রহণ করেন যালিদ ইবনে হারিস্ ইবনে শুরাহবীল ইবনে কা’ব ইবনে আবদুল উযযা। ইতিপূর্বে খাদীজার ভ্রাতুষ্পুত্র হাকীম ইবনে হিযাম ইবনে খুয়াইলিদ সিরিয়া থেকে যায়িদ ইবনে হারিসাসহ বেশ কযেকজন ক্রীতদাষ নিয়ে আসেন। একদিন তার ফুফু খাদীজা তার কাছে এলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে খাদীজার বিয়ে হয়ে গেছে। হাকীম বললেনম, “ফুফু, আপনি এই দাসগুলোর মধ্য থেকে যে কোন একজনকে পছন্দ করুন। যে ছেলেটিকেই আপনি পছন্দ করবেন তাকেই আমি আপনাকে দিয়ে দেব।” তিনি যায়িদকে পছন্দ করে নিয়ে নিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদীজার কাছে যায়িদকে দেখে তাকে পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করতেই খাদীজা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লা কে উপহার হিসেবে তাকে দিয়ে দিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্ত করে পালক পুত্র হিসেবে গ্রহন করলেন। এটা ছিল নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বের ঘটনা।
এরপর ইসলাম গ্রহণ করেন আবু বাক্র ইবনে আবু কুহাফা। তাঁর আসল নাম আতীক। আর আবু কুহাফার প্রকৃত নাম ছিল উসমান। আবু বাক্র রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণ করার পর তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। তিনি ছিলেন তাঁর গোত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয়, বন্ধুবৎসল ও অমায়িক ব্যক্তি। কুরাইশদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ও তাদের বংশপরিচয় সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত। কুরাইশদের ও তাদের ভালো-মন্দ ও কল্যাণ-অকল্যাণ সম্পর্কে তাঁর মত বিচক্ষণ জ্ঞানী আর কেউ ছিল না। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী, দানশীল ও চরিত্রবান লোক। গোত্রের লোকেরা তাঁর কাছে ভীড় জমাতো। তাঁর অমায়িক মেলামেশা, পা-িত্য ও ব্যবসায়িক দক্ষতার কারণে অনেকেই তাঁর সাথে বন্ধুত্ব ও সখ্যতা স্থাপন করতো। এ জন্য গোত্রের মধ্য থেকে যারা তাঁর সান্নিধ্যে আসতো ও তাঁর নিকট অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিল, তিনি তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন। তাঁর দাওয়াতে একে একে ইসলাম গ্রহণ করলেন উসমান এবনে আফফান, যুবাইর ইবনুল আওয়াম, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস ও তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ। এই পাঁচজন এবং আবু বাক্র, আলূ ও যায়িদ-মোট আটজনই ছিলেন প্রথম মুসলিম। তাঁরাই প্রথম নামায কায়েম করেন ও ইসলামকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করেন।
এরপর আবু উবইদা ইবনুল জাররাহ, আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদ, আরকাম ইবনে আবুল আরকাম, [২২.আরকামের বাড়ী ছিল সাফা পাহাড়ের ওপর। এই বাড়ীতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরাইশদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। হযরত উমারের (রা) ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে মুসলমানদের সংখ্যা চল্লিশে পৌঁছার পূর্বে পর্যন্ত এভাবে গোপনে অবস্থান ও দাওয়াতের কাজ চলতে থাকে। চল্লিশজন পূর্ণ হবার পর তারা জনসমক্ষে আত্ন প্রকাশ করেন।]
উসমান ইবনে মাযউন এবং তাঁর দুই ভাই কুদামা ও আবুদল্লাহ, উবাইদা ইবনে হারেস, সাঈদ ইবনে যায়িদ ইবনে আমর ও তাঁর স্ত্রী উমার উবনুল খাত্তাবের বোন ফাতিমা, আসমা বিনতে আবু বাক্র ও আয়িশা বিনতে আবু বাকর (আয়িশা তখন অল্পবয়স্কা বালিকা), খাব্বাব ইবনে আরাত, উমাইর ইবনে আবু ওয়াক্কাস, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, মাসউদ ইবনে কারী, সালীত ইবনে আমর, আইয়াশ ইবনে আবু রাবীয়া ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে সুলামা, খুনাইস ইবনে হুযাফা, আমের ইবনে রাবীয়া, আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ ও তাঁর ভ্রাতা আবু আহমদ, জাফর ইবনে আবু তালিব ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস, হাতেব ইবনে হারেস ও তাঁর স্ত্রী ফাতিমা বিনতে মুজাল্লাল, তাঁর ভ্রাতা হুতাব ও তাঁর স্ত্রী ফুকাইহা বিনতে ইয়াসার, মা’মার ইবনে হারেস, সায়েব ইবনে উসমান ইবনে মাযউন, মুত্তালিব ইবনে আযহার ও তাঁর স্ত্রী রামলা বিনতে আবু আউফ, নাহহাম তথা নাঈম ইবনে আবদুল্লাহ, আমের ইবনে ফুহাইরা, খালিদ ইবনে সাঈদ ইবনুল আস ও তাঁর স্ত্রী আমীনা বিনতে খালাফ, হাতেব ইবনে আমর, আবু হুযাইফা ইবনে উতবা ইবনে রাবীয়া, ওয়াকিদ ইবনে আবদুল্লাহ, বুকাইর ইবনে আবদে ইয়ালীলের পুত্র খালিদ, আমের, আকেল ও ইয়াস, আম্মার ইবনে ইয়াসার ও সুহাইব ইবনে সিনান রুমী [২৩.সুহাইব জন্মগতভাবে আরব। তিনি শৈশবে রোমকদের হাতে বন্দী হন এবং তাদের মাঝেই দাস হিসেবে বড় হন। পরে কালব গোত্রের এক ব্যক্তি তাঁকে ক্রয় করে এন মক্কায় বিক্রয় করে। আদুল্লাহ ইবনে জুদআন তাঁকে খরিদ করে মুক্ত করেছেন। হাদেিস সাহাইব উসলাম গ্রহণকারী প্রথম রুমবাসী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।] ইসলাম গ্রহণ করেন।
প্রকাশ্য দাওয়াত
এরপর লোকেরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। ফলে মক্কার সর্বত্র ইসলামের কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হতে থাকে। অতঃপর মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে তাঁর বাণী উচ্চকণ্ঠে প্রচার করার নির্দেশ দেন এবং আল্লাহর দীনের দাওয়াত নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রকাশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে বলেন। নবুওয়াত লাভের পর ইসলামের প্রকাশ্য প্রচার শুরু হবার আগে গোপন প্রবার কাজ তিন বছর ধরে চলে। তখন আল্লাহ এই নির্দেশ দেন,“হে নবী,এখন আপনি উচ্চকণ্ঠে প্রচার শুরু করুন এবং মুশরিকদের কথার প্রতি ভ্রƒক্ষেপ করবে না।” তিনি আরো বলেন, “হে নবী, আপনি আপনার নিকট-আত্মীয়দেরকে সতর্ক করুন আর আপনার অনুসারী মু’মিনদের প্রতি অনুকম্পাশীল ও সদয় থাকুন। আর বলুন : আমি প্রকাশ্য সতর্ককারী।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাগণ নামায পড়ার সময় দুর্গম গিরিগুহায় চলে যেতেন এবং লোকজনের চোখের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে নামায পড়তেন। একদিন সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস সহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবাদের এবটি ক্ষুদ্র দল মক্কার কোন এক পর্বত গুহায় নামায পড়ছেন, এমন সময় মক্কার মুশরিকদের একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়। তারা মুমিনদেরকে কঠোরভাবে নিন্দা ও গালিগালাজ করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে তারা তাদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাসক এই সময় একটা মরা উটের চোয়ালের হাড় দিয়ে প্রচ- জোরে আঘাত হেনে মুশরিকদের একজনের মাথা ফাটিয়ে দেন। ইসলামের জন্য এটাই ছিল রক্তপাতের প্রথম ঘটনা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নির্দেশ মুতাবিক প্রকাশ্য দাওয়াত দিলেও যতক্ষণ তাদের দেব-দেবীর সমালোচনা করেননি ততক্ষণ তারা তাঁর থেকে দূরে যায়নি কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখরও হননি। কিন্তু যখন তিনি তাদের দেব-দেবীর সমালোচনা করলেন তখনই তারা তাঁর আন্দোলনকে একটা ভয়ংকর ও মারাত্মক জিনিস বলে মনে করলো। তাঁর বিরুদ্ধে প্রচ-ভাবে ক্ষেপে উঠলো এবং তাঁর বিরুদ্ধতা ও শত্রুতায় কোমর বেঁধে নামলো। তবে স্বল্পসংখ্যক লোক যারা তখনো আত্মপ্রকাশ করেননি- ইসলামের খাতিরে এই শত্রুতা থেকে তাদেরকে রক্ষা করলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তাঁর চাচা আবু তালিব পুর্ণ সহানুভূতি ও অনুকম্পা দেখাতে থাকেন। তিনি কুরাইশদের আক্রমণের মুখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করতে থাকলেন এবং তার পাশে এসে দাঁড়ালেন। ফলে তিনি আল্লাহর দ্বীন প্রচারের কাজ অপ্রতিহত গতিতে চালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। কিন্তু কুরাইশরা যখন দেখলো, সম্পর্কচ্ছেদ ও দেব-দেবীর সমলোচনার বিরুদ্ধে তাঁদের প্রবল আপত্তিকেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিন্দুমাত্র পরোয়া করছেন না, অধিকন্তু তাঁর চাচা তাঁকে আশ্রয় দিয়ে চলছেন, কোন মতেই তাঁকে কুরাইশদের হাতে সমর্পণ করছে না; তখন একদিন কুরাইশদের গণ্যমান্য নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সদলবলে আবু তালিবের কাছে গিয়ে বললো, “হে আবু তালিব আপনার ভাতিজা আমাদের দেব-দেবীকে গালি-গালাজ করেছে, আমাদের ধর্মের নিন্দা করেছে, আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে বোকামী ঠাউরিয়েছে এবং আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে পথভ্রষ্ঠ বলে আখ্যায়িত করেছে। এমতাবস্থায় হয় আপনি তকে এসব থেকে বিরত রাখুন নতুবা তাকে শায়েস্তা করার জন্য আমাদেরকে সুযোগ দিন।” আবু তালিব তাদেরকে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় জবাব দিলেন এবং বুঝিয়ে-সুজিয়ে বিদায় করলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কাজ যথারীতি চালিয়ে যেতে লাগলেন। তিনি আল্লাহর দীনের দিকে মানুষকে দাওয়াত দিতে থাকলেন ও তাঁর প্রচার-প্রসারের কাজ অব্যাহত রাখলেন। ফলে কুরাইশদের বিদ্বেষ ও আক্রোশ দিন দিন বেড়ে যেতে লাগলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনায় মেতে উঠলো এবং পরস্পরকে তাঁর বিরুদ্ধে উস্কানী দিতে আরম্ভ করলো।
তাই পুনরায় তারা আবু তালিবের কাছে উপস্থি হয়ে বললো, হে আবু তালিব, আপনি আমাদের মধ্যে প্রবীণ ও মুরুব্বী। আমারা আপনাকে গণ্যমান্য ও শ্রদ্ধেয় মনে করি।
আমরা বলেছিলাম, আপনার ভাতিজাকে নিষেধ করুন কিন্তু আপনি তা করলেন না। আল্লাহর কসম, এভাবে আর চলতে দিতে পারি না। সে আমাদের সমলোচনা দেব-দেবীর নিন্দা ও আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে বোকামী ঠাওরানোর যে ধৃষ্টতা দেখিয়ে যাচ্ছে তা আমরা আর সহ্য করতে পারি না। এখন হয় আপনি তাকে নিবৃত করবেন নচেৎ আমরা আপনাকে সহ তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবো এবং একপক্ষ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে আর থামবো না।”
আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাঁকে বললেন, “ভাতিজা তোমার সম্প্রদায়ের লোকজন আমার কাছে এসে এইসব কথা বলেছে।” এই বলে তিনি কুরাইশ নেতৃবৃন্দ যা বলেছিলো তা তাঁকে বললেন। তারপর বললেন, “অবস্থা যখন এই পর্যায়ে উপনীত হয়েছে তখন তুমি নিজেকে ও আমাকে সামলে চলো। আমার ওপর আমার সাধ্যের বেশী কোন কিছু চাপিয়ে দিও না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মনে করলেন, চাচা মত পাল্টে ফেলেছেন, কুরাইশদের মুকাবিলায় তাঁকে একাকী ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন এবং তাঁর সহায়তা করতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন “চাচা, আল্লাহর কসম করে বলছি, তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চাঁদ এন দেয় এবং তার বিনেময়ে আমাকে এই কাজ ত্যাগ করতে বলে, তবুও আমি এটা ত্যাগ করবো না। আমি ততদিন পর্যন্ত এ কাজ করতে থাকবো, যতদিন না আল্লাহ তাঁর দীনকে বিজয়ী করেন কিংবা এই কাজ করতে করতে আমি ধ্বংস হয়ে যাই।” এই কথা বলার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো অতঃপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং চলে যেতে উদ্যত হলেন। কিছুদূর অগ্রসর হলে আবু তালিব তাঁকে ডেকে বললেন, “হে ভাতিজা, কাছে এসো।” তিনি কাছে গেলেন। আবু তালিব বললেন, “ভাতিজা, ঠিক আছে। তুমি যা বলতে চাও বলতে থাক। আমি কখনো কোন কারণে তোমাকে ওদের কাছে সর্পণ করবো না।”
কুরাইশরা যখন জানতে পারলো যে, আবু তালিব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অবমাননাকর অবস্থার মুখে একা ছেড়ে দিতে রাজি নন এবং তাদের সম্পর্কচ্ছেদ ও শত্রুতা সত্ত্বেও তাঁকে তাহাদের হাতে তুলে না দিতেও অবিচল, তখন তারা উমারাহ ইবনে ওয়ালদি ইবনে মুগীরা নামক এক যুবককে আবু তালিবের কাছে নিয়ে গেয়ে বললো, “হে আবু তালিব, এই যুবককে দেখুন, এর নাম উমারাহ ইবনে ওয়ালীদ কুরাইশ গোত্রে এর মত সাহসী, শক্তিমান ও সুদর্শন যুবক আর নেই। একে আপনি পুত্র হিসেকে গ্রহণ করুন। এর বুদ্ধিমত্তা ও সাহায্য-সহোযোগিতা দ্বারা আপনি উপকৃত হতে পারবেন। আর আপনার ঐ ভাতিজাকে আমাদের হাতে তুলে দিন, যে আপনার পূর্বপুরুষের ধর্মের বিরোধিতা করছে, আপনার সম্প্রায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে এবং তাদের বুদ্ধিমত্তাকে বোকামি ঠাওরাচ্ছে। তাকে আমাদের হাতে তুলে দিন, আমরা তাকে হত্যা করি। একজন মানুষের বিনিময়ে একজন মানুষ আপনি পেয়ে যাচ্ছেন।”
আবু তালিব বললেন, “আল্লাহর কসম, তোমরা অত্যন্ত জঘন্য ব্যাপার আমার ওপর চপিয়ে দিচ্ছ। আমি কি এমন প্রস্তাব মেনে নিতে পারি যে, তোমরা তোমাদের সন্তান আমাকে দেবে, আমি তাকে খাইয়ে-দাইয়ে মানুষ করবো আর আমার সন্তান তোমাদের হেিত তুলে দেবো, তোমরা তাকে হত্যা করবে? খোদার কসম, জেনে রেখো, এটা কখনো হবে না।”
মুতয়িম ইবনে আদী বললো, “হে আবু তালিব, আপনার সম্প্রদায় আপনার কাছে ন্যয়সঙ্গত প্রস্তাবই দিয়েছে। আপনি নিজেও যা পছন্দ করেন না তা থেকে তারা আপনাকে অব্যাহতি দিতে চাচ্ছে। অথচ মনে হচ্ছে, আপনি তাদের কোন প্রস্তাবই গ্রহণ করতে প্রস্তুত নন।” আবু তালিব মুতয়িমকে বললেন, “আল্লাহর কসম, তারা আমার প্রতি সুবিচার করেনি। আসলে তুমি আমাকে অপমানিত করতে বদ্ধপরিকর। এজন্য গোটা সম্প্রদায়কে আমার বিরুদ্ধে লিলিয়ে দিতে চাচ্ছ। এখন তোমার যা ইচ্ছা করতে পার।”
এবার ব্যাপারটা সবার আয়ত্তের বাইরে চলে গেল এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিল। কুরাইশরা পরস্পরকে যুদ্ধের জন্য ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলো। প্রত্যেক গোত্র তার মধ্যে অবস্থানকারী মুষ্টিমেয় মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, ভয়ংকর নির্যাতন শুরু করে দিল এবং ইসলাম ত্যাগ করার জন্য কঠোর চাপ দিতে লাগলো একমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নির্যাতন থেকে নিরাপদ রইলেন। চাচা আবু তালিবের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁকে রক্ষা করলেন।
আবু তালিব যখন দেখলেন কুরাইশরা চরম হিংসাত্মক পথ বেছে নিয়েছে, তখন বনু হাশিম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের লোকদের সাথে তিনি যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রক্ষা করা ও তাঁর প্রতি যে কোন অশোভন আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যে নীতি তিনি গ্রহণ করেছিলেন তার প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য সকলকে আহ্বান জানালেন। এই দুই গোত্রের সকলেই তাঁর আহ্বানে সাড়া দিলো ও তাঁকে সমর্থনের আশ্বাস দিলেন। একমাত্র আল্লাহর দুশমন অভিশপ্ত আবু লাহাব সমর্থন দিল না।
কুরআন সম্পর্কে ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার মন্তুব্য
প্রবীণ কুরাইশ নেতা ওয়ালীদ ইবনে মুগীরার কাছে কুরাইশদের একটি দল সমবেত হলো। তখন হজ্জের মওসুম সমাগত। ওয়ালীদ বললো, “হে কুরাইশগণ, হজ্জের মওসুম সমাগত। আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তোমাদের এখানে লোক আসবে। আর মুহাম্মাদের কথা তারা ইতিমধ্যেই শুনেছে। সুতরাং তোমরা তার সম্পর্কে একটি সর্বসম্মত মত স্থির কর। এ ব্যাপারে তোমাদের মধ্যে যেন কোন রকম মতানৈক্য না থাকে। একজন একটা বলবে, আরেকজন তার কথা খ-ন করবে এমন যেন না হয়। তাহনে একজনের কথা আরেকজনের কথা দ্বারা মিথ্যা প্রমাণিত হবে।”
সবাই বললো, “তাহলে আপনিই একটা মত ঠিক করে দিন। আমরা সবাই সেই মতেরই প্রতিধ্বনি করবো।”ওয়ালীদ বললো, “বলো তোমারাই বলো, আমি শুনি।” সমবেত সবাই বললো, “আমরা বলবো, মাহাম্মাদ একজন গণক।” ওয়ালীদ বললো, “না, সে গণক নয়। আমরা অনেক গণককে দেখেছি। মাহাম্মাদের কথাবার্তা গণকের ছন্দবদ্ধ অস্পষ্ট কথার মত নয়।”
সবাই বললো, “তাহলে আমরা বলবো, মুহাম্মাদ পাগল।”
ওয়ালীদ বললো, “না, সে পাগলও নয়। আমরা অনেক পাগল দেখেছি, আর পাগলামী কাকে বলে তাও জানি। পাগলের কথাবার্তায় জড়তা ও অস্পষ্টতা থাকে, প্রবল ভাবাবেগের মূর্ছনা এবং সন্দেহ-সংশয়ে তা ভারাক্রান্ত থাকে। কিন্তু মুহাম্মাদের কথায় তা নেই।”
সবাই বললো, “তাহলে আমরা বলবো, সে একজন কবি।”
ওয়ালীদ বললো, “না সে কবিও নয়। আমরা সব ধরনের কবিতা সম্পর্কে অবহিত। কিন্তু মুহাম্মাদের কথা কোন ধরনের কবিতার আওতায় পড়ে না।”
সবাই এবার বললো, “তাহলে আমরা বলবো, সে যাদুকর।” ওয়ালীদ বললো, “সে যাদুকরও নয়। আমরা যাদুকর ও যাদু অনেক দেখেছি। কিন্তু তাদের মত গিরা দেয়া ও গিরায় ফুঁক দেয়ার অভ্যাস মুহাম্মাদের নেই।” সবাই বললো, “তাহলে আপনি কি বলতে চান?”
ওয়ালীদ বললো, “এতে কোন সন্দেহ নেই যে, মাহাম্মাদের কথা শুনতে বেশ মিষ্টি লাগে। তার গোড়া অত্যন্ত শক্ত এবং শাখা-প্রশাখা ফলপ্রসূ। তোমরা যে কথাই বলবে তা মথ্যিা বলে প্রতিপন্ন হবে। তবে সবচেয়ে উপযুক্ত কথা হবে তাকে যাদুকর বলা। কেনা সে এমনভাবে কথা বলে যা ভাইয়ে ভাইয়ে, স্বামী-স্ত্রীতে ও আত্মীয়-স্বজনের পরস্পরের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে যাদুর মতই কার্যকর। তাই তাকে যথার্থ যাদুই বলা চলে এর প্রভাবে জাতি বাস্তুবিকই বিভেদের শিকার হয়েছে।
এরপর হজ্জের মওসুমে লোকজনের আগমন শুরু হলে কুরাইশরা লোকজনের যাতায়াতের পথে জটলা করে বসে থাকতে লাগলো। আর যখনই কেউ তাদের পাশ দিয়ে যেতো তখনই তাকে বলতো মুহাম্মাদের সংস্পর্শ থেকে যেন সে সাবধান থাকে। আর তাকে তারা মুহাম্মাদের তৎপড়তা সম্পর্কেও অবহিত করতো। এই উপলক্ষে আল্লাহ ওয়ালীদ ইবনে মুগীরা সম্পর্কে নাযিল করলেন,
“যাকে আমি একা সৃষ্টি করেছি তার সাথে বুঝাপড়ার দায়িত্ব আমার জন্য রেখে দাও। তাকে সৃষ্টি করার পর আমি অনেক সম্পদ দিয়ে সর্বক্ষণ পাশে থাকার মত অনেক পুত্র সন্তান দিয়েছি এবং তার নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করেছি। এরপরও যাতে তাকে আরো অধিক দান করি সেজন্য সে লালায়িত। তা কক্ষণো হবে না। সে আমার আয়াতসমূহের প্রতি অত্যন্ত বৈরীভাবাপন্ন।”
এরপর যার সাথেই দেখা হয়, তার কাছেই তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ঐসব কথা বলতে লাগলো। হজ্জের মওসুম শেষে আরবরা যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো তখন তাদের মুখে কেবল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রসঙ্গই আলোচিত হতে লাগলো। এভাবে আরবের প্রতিটি জনপদে তাঁর কথা ছড়িয়ে পড়লো।
রাসূলুল্লাহর (সা) ওপর উৎপীড়নের বিবরণ
ক্রমেই কুরাইশরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে লাগলো। রাসূলুল্লাহ ও তাঁর সহচরদের শত্রুতায় তারা বেসামাল হয়ে উঠলো। তারা মূর্খ ও বখাটে ধরনের লোকদের উস্কিয়ে দিতে লাগলো। এইসব অর্বাচীন তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে গালাগালি এবং নানাভাবে কষ্ট দিতে লাগলো। তাঁকে কনি, যাদুকর, জ্যোতিষী ও পাগল বলে অপবাদ দিলো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দীন প্রচার ও প্রসার করার কাজে অবিচল থাকরেন। ক্রমেই তিনি অধিকতর প্রকাশ্যভাবে দাওয়াত দিতে লাগলেন। আরবদের বাতিল রসম রেওয়াজের সমালোচনা, তাদের মূর্তিপূজা প্রত্যাখ্যান ও তাদের কুফরী মতবাদের সাথে তাঁর সম্পর্কচ্ছেদের কথা তাদের কাছে ঘোর আপত্তিকর হওয়া সত্ত্বেও তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তা করতে লাগলেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস বলেন-
“একদিন যখন কুরাইশ সরদারগণ হাজরে আসওয়াদের নিকট সমবেত হয়েছে, তখন আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বললো, “এই লোকটার ব্যাপারে আমরা যতটা সহিষ্ণুতা দেখিয়েছি তা নজিরবিহীন। সে আমাদেরকে বোকা বানিয়েছে এবং আমাদের দেবদেবীকে গালাগালি করেছে। অত্যন্ত নাজুক ও মারাত্মক ব্যাপারে আমরা তাকে সহ্য করেছি।” এভাবে তাদের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকাকালে সহসা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে আবির্ভূত হলেন। শান্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে তিনি হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করলেন। তাদের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ কেউ বিরূপ মন্তব্য করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখম-লে আমি সে মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম। দ্বিতীয়বার যখন তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন তখন তারা আবার শ্লেষপূর্ণ মন্তব্য করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারায় আমি তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম। তৃতীয় বারে তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় আবার তারা অনুরূপ মন্তব্য করলে তিনি সেখানে থেমে বললেন, “হে কুরাইশগণ, শোন, যার হাতে আমার প্রাণ সেই সত্তার শপথ করে বলছি, আমি তোমাদের সর্বনাশ বয়ে এনেছি (যদি তোমরা ঈমান না আন)।”
তাঁর উক্তিতে জনতা বজ্রাহতের ন্যায় স্তব্ধ ও হতবাক হয়ে গেল। তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ক্ষণকাল আগেও তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশী আক্রোশ ও উস্কানিমূলক কথা বলেছে, সেও যথাসম্ভব মিষ্ট কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শান্ত করতে উদ্যত হলো। এমনকি সি বলতে বাধ্য হলো, “আবুল কাসিম, তুমি যাও। তুমি তো আর নির্বোধ নও।”
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখান থেকে চলে গেলেন। পরদিন সবাই একই স্থানে সমবেত হলো। আমিও সেখানে ছিলাম। তখন তারা বলাবলি করতে রাগলো, “দেখলে তো! মহাম্মাদের কতদূর বাড় বেড়েছে এবং সে কতদূর ধৃষ্টতা দেখালো। তোমরা যে কথা একবারেই পছন্দ কর না তা সে তোমাদের মুখের ওপর স্পষ্ট বলে দিল। আর তোমরা তাকে ছেড়ে দিলে।”
ঠিক সেই মুহূর্তেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে আবির্ভূত হলেন। আর যায় কোথায়! সকলে একযোগে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সবাই তাঁকে ঘেরাও করে বলতে থাকলো, “তুমিই তো আমাদের ধর্ম ও দেব-দেবীর বিরুদ্ধে আপত্তিকর কথা বলে থাকো।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যাঁ আমিই ঐসব কথ বলে থাকি।” আমি দেখলাম তাদের মধ্যে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহকে তাঁর গলার ওপরের চদরের দু’পাশ ধরে ফাঁস লাগিয়ে হত্যা কতে উদ্যত হয়েছে। সেই মুহূর্তে হযরত আবু বাক্র এগিয়ে গিয়ে বাধা দিলেন। তিনি কেঁদে ফিললেন এবং বললেন, “একটি লোক আল্লাহকে নিজের রব কলে ঘোষনা করেছ, এই কারণে কি তোমরা তাঁকে হত্যা করে ফেলবে।”
এরপর জনতা সেখান থেকে চলে গেল। সেদিন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর কুরাইশদের যেরূপ মারাত্মক আক্রমণ দেখেছি, তেমন আর কখনও দেখিনি।”
হামযার ইসলাম গ্রহণ
আসলাম গোত্রের একজন তুখোড় স্মৃতিধর ব্যক্তি আমাকে বললেন,
“একদিন সাফা পর্বতের পাশে আবু জাহল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাক্ষাত পায়। ঐ সময় সে তাঁর সাথে দুর্ব্যবহার করে তাঁকে গালি দেয়। সে তাঁকে অত্যন্ত অপ্রীতিকর কথা বলে। ইসলামের বিরুদ্ধে কটূক্তি এবং তাঁর দাওয়াত ও আন্দোলনের প্রতি শ্লেষাত্মক বাক্যবাণ নিক্ষেপ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে কোন একটি কথা বললেন না। আবদুল্লাহ ইবনে জুদআনের এক দাসী নিজের ঘরে বসে এসব কটূক্তি শুনতে পায়। অতঃপর আবু জাহল সে স্থান ত্যাগ করে কা’বার পাশে কুরাইশদের এক দরবারে গিয়ে বসে।
এর অল্পক্ষণ পওেরই আবদুল মুত্তালিবের পুত্র হামযা তীর-ধনুক সজ্জিত অবস্থায় শিকার থেকে ফিরছিলেন। তিনি একজন ভাল শিকারী ছিলেন। শিকারের প্রতি তীর নিক্ষেপে ও শিকারের সন্ধান করায় তিনি বেশ পটু ছিলেন। এরকম শিকার করে যখনই তিনি ফিরতেন তখন পথে কুরাইশদের কোন দরবার বা জটলা দেখলে সেখানে থামতেন, সালাম দিতেন এবং তাদের সাথে কথাবার্তা বলতেন। তিনি ছিলেন কুরাইশদের সম্ভ্রান্ত ও তাগড়া জোয়ান। তিনি যখন আবদুল্লাহ ইবনে জুদআনের দাসীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। দাসি হামযাক দেখেই বললো, একটু আগে হিশামের পুত্র আবুল হাকাম [২৪. আবুল হাকাম আবু জাহলের উপনাম বা উপাধি। তার নাম আমর ইবনে হিশাম ইবনে মুগীরা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমার ইবনে মাখযুম।] তোমার ভাতিজা মুহাম্মাদের সাথে কি আচরণ করেছে তা যদি দেখতে। এখানে মুহাম্মাদ বসা ছিল। তাকে দেখেই সে তার সাথে দুর্ব্যবহার ও গালাগালি করেছে। তার সাথে অত্যন্ত আপত্তিকর আচরণ করেছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটা কথাও না বলে চলে গেল।”
হামযা এ কথা শুনে ক্রোধে অধীর হয়ে পড়লেন। কেননা আল্লাহ তাঁকে ইসলামের গৌরব মুকুট পরাতে চাচ্ছিলেন। তাই তিনি আবু জাহলেন সন্ধানে দ্রুত ছুটে গেলেন। পথে কারো কাছে দাঁড়ালেন না। তাঁর ইচ্ছা ছিল আবু জাহলকে পেলেই তাকে শিক্ষা দেবেন। মসজিদে হারামে ঢুকেই দেখলেন, সে দরবার জমিয়ে বসে আছে। তিনি তার গিকে এগিয়ে গেলেন। কাছে গিয়েই ধনুক দিয়ে তাকে প্রচ- আঘাত করে গুরুতরভাবে জখম করে দিলেন। অতঃপর বললেন, “তুই মুহাম্মাদকে গালাগালি করিস? অথচ আমি তার ধর্ম গ্রহণ করেছি। সে যা কিছুই বলে আমি তা সমর্থনকারী। পারিস তো আমাকে পাল্টা আঘাত কর দেখি।”
তৎক্ষণাৎ বনী মাখযুম গোত্রের কিছু লোক ছুটে এল হামযার বিরুদ্ধে আবু জাহলকে সাহায্য করতে। কিন্তু আবু জাহল বললো, “তোমরা হামযাকে কিছু বলো না। কেনানা আমি সত্যিই তার ভতিজাকে অত্যন্ত জঘন্য ভাষায় গালাগালি করেছি।”
হামযা ইসলামের ওপর দৃঢ় ও অবিচল রইলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কার্যক্রমে সাহায্য ও সহায়তা অব্যাহত রাখলেন। হামযার (রা) ইসলাম গ্রহণের পর কুরাইশরা উপলব্ধি করলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এখন আর নিপীড়ন ও হেয় করা সহজ হবে না। কিছু করতে গেলেই হামযা এসে রুখে দাঁড়াবে। তাই আপাততঃ তারা উৎপীড়নের মাত্রা কিছুটা কমিয়ে দিল।