সীরাতে ইবনে হিশাম
[সাইয়িদুল মুরসালীনের (সা) প্রচীনতম জীবনীগ্রন্থ]
মূল : ইবনে হিশাম
অনুবাদ : আকরাম ফারুক
ভূমিকা
ইতিহাস ও সীরাত
জাহিলিয়াত যুগে আরবরা ইতিহাস কি জিনিস, তা জানতো না। ইতিহাস বলতে তাদের কাছে ছিল উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জনশ্রুতি। আরব জীবনের স্বভাব +প্রকৃতির বর্ণনাই ছিল সেকালের প্রচলিত ইতিহাসের একমাত্র উপাদান। বাপদাদার বীরত্বগাথা এবং তাদের বদান্যতা, স্বগোত্রের প্রতি আনুগত্য ও প্রতিশ্রুতি পরায়ণতার গৌরবময় কাহিনীতে তা ছিল ভরপুর। বংশ পরম্পরা ও শত্রু মিত্রের পরিচয়মূলক বিবরণে সমৃদ্ধ ছিল সে ইতিহাস। পবিত্র কা’বাঘর ও তার রক্ষকদের, ইতিবৃত্ত, যমযম কূপের উদ্ভব-বৃত্তান্ত, জুরহুম ও কুরাইশ নেতৃবৃন্দের জীবন কথা, মাআরিবের বাঁধভাঙা প্লাবন ও তার পরিণতিতে সেখানকার অধিবাসীদের শতধাবিচ্ছিন্ন হযে দিকবিদিক ছড়িয়ে পড়ার কাহিনী, গণক ও যাজকদের ভবিষ্যদ্বানী ও তাদের ছন্দবদ্ধ গদ্য-কবিতা ইত্যাদি-যার দ্বারা তৎকালীন আরবদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের স্বরূপ জানা যায়- এসবই ছিল আরব জাতির ইতিকথার প্রধান উপজীব্য। যখন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে ইসলামের পুনরাবির্ভাব ঘটলো, তখনো ঐসব জনশ্রুতিমুলক ইতিকাহিনী মানুষের মুখে মুখে বিবৃত হওয়া অব্যাহত থাকলো। অধিকন্তু ইসলামের প্রতি আহ্বান ও তার পূর্বে পরিলক্ষিত নবুওয়াতে পূর্বাভাস, তাঁর ক্রমবিকাশ ও বয়োপ্রাপ্তি, নবুওয়াতোত্তর জীবন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীদের জীবনের ঘটনাবলী এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার আদর্শ জীবনের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন নামধারী মুসলিম, খৃস্টান, ইহুদী ও মুশরিকদের কাহিনী- এসবের মধ্যে আরব কথক ও কহিনীকাররা এক ব্যাপক ও সুদূর প্রসারী উপকরণ পেয়ে গেল। ফলে এসব নতুন কহিনীও একইভাবে মৌখিক বর্ননার মাধ্যমে তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।পবিত্র কুরআন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস ও সাহাবাদের কথাবার্তা ঐ নতুন জীবনের এক সুপরিসর দলীল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো।
পবিত্র কুরআন তো প্রথম থেকেই লিখিত ছিল। কিন্তু মহানবীর (সা) হাদীস দীর্ঘকাল ব্যাপী অলিখিত থাকে তবে লোকেরা এগুলোকে বিশ্বস্ত ও প্রামাণ্য বর্ণনা বলে জানতো। হাদীসকে ব্যাপকভাবে লিখে রাখতে কেউ সাহসই করেনি। হযরত আবু সাঈদ (রা) বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের “কুরআন ছাড়া আমার কোন কথা লিখো না, যদি লিখে থাক হবে তা নিশ্চিহ্ন করে দাও ”- এই উক্তির কারণেই কেউ লিপিবদ্ধ করতে সাহস পায়নি।
এই নিষেধাজ্ঞার তাৎপর্য খুবই স্পষ্ট। কুরআন নাযিল হবার কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি লিখে রাখলে কুরআনের সাথে তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে-এরূপ আশংকা ছিল। শুধুমাত্র এই মিশ্রণ এড়ানোর মহান লক্ষ্য সামনে রেখেই যে এই নিষেধাজ্ঞা উচ্চারিত হয়েছিল এবং তা যে কুরআন নাযিলকালের জন্যই সীমাবদ্ধ ছিল, সে কথা না বললেও চলে।
তথাপি উমার ইবনে আবদুল আযীযের শাসনকালের প্রারম্ভ পর্যন্ত ব্যপকভাবে হাদীস প্রনয়নের কাজে হাত দেয়া হয়নি। ৯৯ হিজরী সন থেকে ১০১ হিজরী সন পর্যন্ত তিনি খিলাফতের আসনে অধিষ্ঠিত থাকেন। কথিত আছে যে, তিনি হাদীস প্রণয়নের কাজে হাত দেবেন কিনা তা নিয়ে চল্লিশ দিন পর্যন্ত ইস্তিখারা করেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর তরফ থেকে হাত দেয়া কর্তব্য বলে আভাস পান। ফলে তিনি আবু বাকর ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে উমার ইবনে হাযামকে হাদীস সংকলনের কাজে নিয়োজিত করেন। আবু বাকর ছিলেন মদীনার গভর্নর ও বিচারক। তিনি ১২০ হি: সন পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। যেসব হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল, তা তিনি একটি পুস্তকের আকারে লিপিবদ্ধ করে পর্যালোচনার জন্য বিভিন্ন শহরে পাঠান। উমার ইবনে আবদুল আযীয মুহাম্মদ ইবনে মুসলিম ইবনে শিহাব আযযুহরীকেও হাদীস সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করেন। তিনি একখানা হাদীস গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
এরপর থেকে মুসলমানগণ হাদীস সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রাখেন। তবে সে কাজ কোন বিশেষ বিন্যাস পদ্ধতির অনুস্ারী ছিল না যিনি যেভাবে পরতেন সংগ্রহ করতেন। কেউ বা শরীয়াতের বিধানের কোন বিশেষ পরিচ্ছেদের অধীন একখানা পুস্তকের আকারে লিপিদ্ধ করতেন। এরপর এই পুস্তক প্রণয়নের ধারা এগিয়ে চলে। এই পর্যায়ে আমরা দেখতে পাই, অনেকে হাদীস গ্রস্থের পরিচ্ছেদ বিন্যাস করেছেন এবং সেইসব গ্রন্থ থেকে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন বৃত্তান্তকে আলাদা করেছেন। এই পর্যায়ে তাঁর জন্মবৃত্তান্ত, ধাত্রীগৃহে তাঁর লালন পালন এবং নবুওয়াতপূর্ব অন্যান্য ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করেছেন। অত:পর কৃরাইশদেরকে আল্লাহর দীনের দিকে আহ্বান জানানো এবং কুরাইশদের পক্ষ থেকে তাঁর ও তাঁর সহচরবৃন্দের ওপর পরিচালিত যুলুম নির্যাতনে ধৈর্য ধারণের ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। সেইসাথে যুদ্ধ বিগ্রহের ঘটনাবলী সংক্রান্ত হাদীসগুলোরও সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন।
ঐতিহাসিকগণ অনুসরণ করেছেন ভিন্নতর পন্থা। তাঁরা ইতিহাস বিষয় নিয়ে ব্যাপক গ্রন্থরাজি রচনা করেছন। এর মাধ্যমে তাঁদের ইসলামী ভাবাবেগই প্রতিফলিত হয়েছে- যার কারণে তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্বে মুসলমানদের জন্য সন্দেহাতীতভাবে অনুকরণীয় আদর্শ ও হিদায়াত প্রাপ্তির উৎসের সন্ধান পেয়েছেন।