জারুদের নেতৃত্বে বনু আবদুল কায়েসের প্রতিনিধিদলের আগমন
বনু আবদুল কায়েস গোত্রের প্রতিনিধিদল খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী জারুদ ইবনে আমরের নেতৃত্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসে। হাসান বর্ণনা করেন করেন: জারুদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে আলাপ আলোচনা শুরু করলো, তিনি তার নিকট ইসলাম পেশ করলেন এবং তাকে ইসলাম প্রহণের দাওয়াত ও উপদেশ দিলেন। জারুদ বললো, “ইয়া রাসূলুল্লা। আমার একটা ধর্ম আছে। এখন আপনার ধর্ম গ্রহণের উদ্দেশ্যে আমি নিজ ধর্ম ত্যাগ করতে রাজী আছি। তবে নিজ ধর্ম ত্যাগ করায় আমার কোন ক্ষতি হবে না- আমাকে এ নিশ্চয়তা আপনি দিতে পারেন কি?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হ্যা, আমি তোমাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি ইসলাম গ্রহণের অর্থ দাঁড়াবে এই যে, আল্লাহ তোমার ধর্মের চেয়েও ভাল ধর্ম গ্রহণ করার সুযোগ দিলেন।”
এ কথা শুনে জারুদ ও তার সঙ্গীরা ইসলাম গ্রহণ করলো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দেশে ফিরে যাওয়অর জন্য সওয়ারী [বাহন] প্রার্থনা করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সওয়ারী প্রদানে অক্ষমতা প্রকাশ করলেন। তখন জারুদ বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের স্বদেশ গমনের পথে অনেক লাওয়ারিশ পথভ্রষ্ট উট পাওয়া যায়। সেগুলোতে চড়ে আমরা যেতে পারি কি?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “না,খবরদার। এগুলোতে আরোহণ করো না। ওগুলো দোযখে যাওয়ার বাহন হবে।”
অতঃপর জারুদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে বেরিয়ে স্বদেশ মুখে রওনা হলেন। তিনি মৃত্যুকাল পর্যন্ত ইসলামের ওপর অবিচল ছিলেন এবং খুবই ভালো মুসলমান ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের পর যখন কিছু লোক ইসলাম ত্যাগ করে, সে সময়ও তিনি বেঁচে ছিলেন।
তার গোত্রের কয়েকজন মুসলমান তাদের পূর্ব ধর্মে ফিরে গেলে জারুদ তাদের সামনে ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম- এ কথা ব্যাখ্যা করলেন এবং তাদেরকে ইসলামের দিকে ফিরে আসার দাওয়াত দিলেন। তিনি বললেন, “হে লোকজন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। আমি এ কথাও ঘোষণা করছি যে, যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দেয় না সে কাফির।”
মুসাইলিমা কাযযাব সহ বনু হানীফা প্রতিনিধিদলের আগমন
মুসাইলিমা কাযযাব সহ বনু হানীফা প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসে তারা আনসারদের এক মহিলা বিনতে হারিসের বাড়ীতে ওঠে যিনি পরবর্তী সময় বনু নাজ্জারের গ্রহিনী হন। মদীনাবাসী জনৈক ঐতিহাসিক জানিয়েছেন যে, বনু হানীফার প্রতিনিধিদল মুসাইলিমাকে কাপড়ে ঢেকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবাদের সাথে বসে ছিলেন। তাঁর হাতে ছিল একটা পাতা-ছাঁটা খেজুরের ডাল। ডালের মাথার দিকে কয়েকটি পাতা ছিল। কাপড়ে আচ্ছাদিত মুসাইলিমা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌছে তাঁর সাথে কথা বললো এবং কিছু দান প্রার্থনা করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি যদি এই খেজুরের ডালটি আমার কাছে চাও তবে তাও আমি দেব না।”
ইবনে ইসহাক বলেন: ইয়ামামার অধিবাসী বনু হানীফার জনৈক বৃদ্ধ আমাকে মুসাইলিমার ঘটনাঅন্য রকম জানিয়েছেন। তিনি বলেন,
বনু হানীফার প্রতিনিধদল যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করতে আসে তখন মুসাইলিমাকে উটের কাফিলায় রেখে আসে। প্রতিনিধিদল ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানায় যে, মুসাইলিমাও তাদের সাথে উপস্থিত হয়েছে। তারা বলে, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমরা আমাদের এক সঙ্গীকে উটের কাফিলার রক্ষক হিসেবে রেখে এসেছি।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দলের অন্যান্য সদস্যকে যেরূপ উপঢৌকন দেন সেরূপ তাকেও দেন। তিনি এ কথাও বললেন “তোমাদের ঐ সঙ্গিটি তোমাদের চাইতে কম মর্যাদার লোক নয় যে, তাকে এখানে না এনে তোমাদের জিনিসপত্র পাহারা দিতে রেখে এসেছ।” অতঃপর প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে চলে গেল এবং তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা দিয়েছিলেন তা তার হাতে পৌছিয়ে দিল। অতঃপর তারা ইয়ামামার পৌছা মাত্রই মুসাইলিমা ইসলাম ত্যাগ করলো এবং মিথ্যা নবুওয়অতের দাবী কের বসলো। সে বললো, “তোমারা যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আমার কথঅ উল্লেখ করেছিলে তখন তিনি কি বলেননি যে,, ‘সে তোমাদের চাইতে কম মর্যাদাশীল নয়।’এ কথা তিনি এ জন্যই বলেছেন যে, আমি যে তার সহকর্মী নবী তা তিনি জানেন।” এরপর সে তাদের কাছে নানা রকমের ছন্দবদ্ধ কথা বলে কুরআনের সাথে সাদৃশ্য প্রমাণ করার চেষ্টা করে। তার এ ধরনের একটি ছন্দবদ্ধ উক্তি হলো,
[আরবী *******]
“আল্লাহ গর্ভবতী মহিলাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন নেকনা তিনি তাদের পেট থেকে চলাচল করতে সক্ষম মানুষ বের করেছেন-নাড়ীভুঁড়ি ও তরল পদার্থের মধ্য থেকে।”
মুসাইলিমা তার গোত্রের জন্য মদ ও ব্যভিচার হালাল এবং নামায মাফ করে দেয়। এতদসত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াত সে স্বীকার করতে থাকে। বনু হানীফা গোত্র তার এ মনগড়া দাবী মেনে নেয়।
উপরোক্ত দুই রকমের বর্ণনার মধ্যে কোনটি সঠিক তা আল্লাহই ভাল জানেন।
হাতিম তাঈ-এর পুত্র আদীর ঘটনা
আদী ইবনে হাতিম বলতেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনে আমি তাঁর প্রতি যতটা ঘৃণ্য পোষন করতাম অতটা আরবের আর কেউ করাতা না। আমি নিজে সম্ভ্রান্ত খৃষ্টান ছিলাম। আমি গোত্রপতি হিসেবে রাজা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনে আমার মনে তাঁর প্রতি প্রবল বিদ্বেষ জন্ম নিল। আমার এক আরব গোলাম ছিল। সে আমার উট চরাতো। তাকে বললাম, “আমার জন্য ভাল পোষমানা মোটাসেটা দেখে কয়েকটা উট প্রস্তুত রাখো এবঙ এগুলো আমার কাছে বেঁধে রাখো। তারপর যখন শুনবে, মুহাম্মাদের সেনাবাহিনী এদিকে আসছে তখন আমাকে জানাবে।” সে উট এনে আমার কাছে বেঁধে রাখলো।
একদিন সকালে সে আমার কাছে এসে বললো, “হে আদী, মুহাম্মাদের সেনাবাহিনী তোমার ওপর চড়াও হলে কি করতে চেয়েছিল এক্ষুণি তা কর।” আমি কতকগুলো পতাকা উড়তে দেখে লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, “এগুলো, কিসের পতাকা?” তারা বললো, “এগুলো মুহাম্মাদের সেনাবাহিনীর পতাকা।” আমি একথা শুনে গোলামকে বললাম, “তাহলে আমার উটগুলো কাছে নিয়ে এসো।” একটি উটের পিঠে আমি চড়ে বসলাম। অপরগুলিতে নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের বসালাম। তারপর সিরিয়ার খৃষ্টনাদের কাচে যাওয়ার জন্য উচের কাফিলা হাঁকালাম। কাফিলা জোশিয়া পার্বত্য পথ ধরে রওনা হলো। পেছনে হাতিমের এক কন্যাকে গোত্রে রেখে গেলাম। আমি সিরিয়ায় গিয়ে অবস্থান করতে লাগলাম। এদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একদল অশ্বারোহী আমার সন্ধানে এসে হাতিমের কন্যাকে ধরে নিয়ে গেল। তাকে নিয়ে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যুদ্ধবন্দিনী হিসেবে হাজির করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার সিরিয়া পালানোর খবর জেনে ফেলেছিলেন। তিনি হাতিমের কন্যাকে মসজিদে নববীর এক পার্শ্বে অবস্থান করতে দিলেন। সেখানে অণ্যান্য যুদ্ধবন্দিনী মহিলা ও আটক ছিল। হাতিমের কন্যা ছিল সুবক্তা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন সে বললো,“ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা মারা গেছেন এবং তত্ত্বাবধায়ক নিখোঁজ হয়েছেন। এমতাবস্থায় আমার ওপর অনুগ্রহ করুন, আল্লাহ আপনার ওপর অনুগ্রহ করবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “কে তোমার তত্ত্বাবধায়ক?” সে বলে, “আদী ইবনে হাতীম।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “যে আদী আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল থেকে পালিয়েছে সে?” এ কথা বলেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চলে গেলেন। হাতিম তনয়া বলেন পরদিন আবার তিনি আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি আবার আগের দিনের মত বললাম। তিনিও আগের দিনের জবাবের পুনরাবৃত্তি করলেন। তার পরের দিন আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার পাশ দিয়ে যেতে লাগলেন। আমি হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণকারী এক ব্যক্তি আমাকে বললো, “উঠে দাঁড়াও এবং রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কথা বল।” আমি দাঁড়ালাম এবং পুনরায় বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি পিতৃহীনা এবং আমার অভিভাবকও নিখোঁজ। অতএব আমার ওপর অনুকম্পা প্রদর্শন করুন। আল্লাহ আপনাকে অনুকম্পা প্রদর্শন করবেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমার আবেদন আমি গ্রহণ করছি। তুমি এখান থেকে বেরুবার জন্য তাড়াহুড়া করো না। তোমার গোত্রের এমন কোন বিশ্বস্ত লোক পেলে আমাকে জানবে যে তোমাকে তোমার দেশে পৌছেয়ে দিতে পারে।” আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, যে ব্যক্তি আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কথা বলতে বলেছিল তিনি আবু তালিবের পুত্র আলী (রা)। আমি সেখানে থাকতে লাগলাম। অবশেষে বালী অথবা কুজায়া গোত্রের একদল উষ্ট্রারোহী এল। আমার ইচ্ছা ছিল সিরিয়াতে ভাইয়ের কাছে যাবো। তাই ঐ কাফিলাকে উপযুক্ত সঙ্গী মনে করে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম এবং বললাম, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমার গোত্রের একদল লোক এসেছে। তাদের ওপর আমার আস্থা আছে এবং আমার গন্তব্যে পৌছার জন্য ওরা উপযোগী।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে সওয়ারী দিলেন, পাথেয় দিলেন এবং পোশক-পরিচ্ছদ দিলেন। আমি দলটির সাথে রওনা হয়ে সিরিয়া পৌছে গেলাম।
আদী বলেনঃ আমি স্বীয় পরিবার-পরিজন নিয়ে বসে ছিলাম। সহসা এক উষ্ট্রারোহী মহিলাকে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। মনে মনে ভাবলাম, সম্ভবত সে হাতিমের কন্যাই হবে। দেখলাম, সত্যিই তাই। সে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আমাকে যা ইচ্ছে তাই বলে ভর্ৎসনা করতে লাগলো। বললো, “আত্মীয়তা ছিন্নকারী যলিম। তোমার পিতার পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যকে অরক্ষিত রেখে নিজের সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে পলিয়ে এসেছো?” আমি বললাম, “হে বোন! আমাকে তিরষ্কার করো না। আমার বাস্তবিকই কোন ওজর নেই। তুমি যা বলছো আমি সত্যিই তাই করেছি।”
সে উটের পিঠ থেকে নামল এবং আমার কাছেই থাকতে লাগলো। সে একজন প্রখর ধীশক্তি সম্পন্না মহিলা ছিল। আমি বললাম, “মুহাম্মাদ সম্পর্কে তোমার ধারণা কি?” সে বললো, “আমার ধারণা, তোমার অবিলম্বে তাঁর আন্দোলনে যোগদান করা উচিত। যদি তিনি নবী হয়ে থাকেন তাহলে যে তাঁর কাছে আগে যাবে তার প্রতি তাঁর বেশী অনুগ্রহ হবে। আর যদি তিনি রাজা-বাদশাহ হয়ে থাকেন তাহলে ইয়ামনের সম্ভ্রান্ত লোকদের সামনে তোমার গৌরব মোটেই হ্রাস পাবে না। তুমি যেমন আছ তেমনই থাকবে।” আমি বললাম, “তুমি যা বলছো সেটাই সঠিক।” এরপর আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করার জন্য মদীনা অভিমুখে রওনা হলাম। সেখানে পৌছে মসজিদে প্রবেশ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে দাঁড়ালেন এবং আমাকে নিয়ে আপন গৃহ অভিমুখে রওনা হলেন। পথিমধ্যে এক বৃদ্ধা মহিলার সাথে দেখা হলো। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একটু দাঁড়াতে বললো। তিনি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে তার নানান অভাব অভিযোগের কথা শুনলেন। তা দেখে আমি মনে মনে বললাম, “আল্লাহর কসম, এ লোক কোন রাজা-বাদশাহ হতে পারেন না।”
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে নিয়ে তাঁর গৃহে প্রবেশ করলেন। তিনি আমাকে খেজুর ছলের তৈরী একটি গদীতে বসতে দিলেন। আমি বললাম, “আপনি বসুন।” তিনি বললেন, “না তুমি বস।” আমি তাতে বসলাম। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসলেন মাটিতে।
আমি মনে মনে বললাম, এটা নিশ্চয়ই কোন রাজার চরিত্র হতে পারে না। অতঃপর বললেন, “হে আদী ইবনে হাতীম। তুমি কি রাকুসী নও?” [৯২. রাকুসী তৎকালীন একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে বলা হতো এই গোত্র খৃষ্টান ও সাবী ধর্মমতের মধ্যবর্তী একটা ধর্মমত পোষন করতো।] আমি বললা, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “তুমি কি তোমার গোত্রের যুদ্ধলব্ধ সম্পদের এক চতুর্থাংশ ভোগ করা না?” আমি বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “এটা কিন্তু তোমার ধর্মে অবৈধ।” আমি বললা, “সত্যিই তাই।” আমি এই সময় নিশ্চিত হলাম যে তিনি সত্যই আল্লাহর নবী যিনি মানুষকে বিস্মৃত কথা স্মরণ করিয়ে এবং অজানা জিনিস শিখিয়ে দিয়ে থাকেন। অতঃপর বললেন, “হে আদী। সম্ভবতঃ মুসলমানদের দারিদ্র দেখে তুমি ইসলামে প্রবেশ করছো না। আল্লাহর কসম, সে দিন বেশী দূরে নয় যখন মুসলমানরা এত বিত্ত-বৈভবের অধিকারী হবে যে, টাকা পয়সা নেয়ার লোকই পাওয়া যাবে না। তোমার ইসলাম গ্রহণ না করার কারণ এও হতে পারে যে, মুসলমানদের সংখ্যা কম ও তাদের শত্রুসংখ্যা বেশী। আল্লাহর কসম, সেদিন নিকটবর্তী যখন তুমি শুনবে যে কাদেসিয়া থেকে এক মহিলা একাকিনী নির্ভয়ে ও নিরাপদে উষ্ট্রে আরোহণ করে পবিত্র ঘর যিয়ারত করতে এসেছে। তুমি যত রাজা-বাদশাহ দেখছো তাও অমুসলিমদের মধ্যে দেখছো বলেও হয়তো ইসলাম গ্রহণ করছো না। কিন্তু আল্লাহর কসম, সেদিন অত্যাসন্ন যখন ব্যবিলনের শ্বেত প্রাসাদগুলো মুসলমানদের দখলে চলে আসবে।”
আদী বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুটো ভবিষ্যদ্বানী আমি পূর্ন হতে দেখেছি। এসটা শুদু বাকী রয়েছে এবং আল্লাহর কসম, সেটিও পূর্ণ হবেই। ব্যাবিলনের শ্বেত প্রসাদসমূহ আমি দখলে আসতে দেখেছি। কাদেসিয়া থেকে নিরাপদে একাকিনী মহিলার হজ্জ সমপনেও দেখেছি। আর সম্পদের প্রাচুর্য এত হবে যে, টাকা পয়সা নেয়ার লোক পাওয়া যাবে না- সেটিও একদিন বাস্তব হয়ে দেখা যাবে।
ফারওয়া ইবনে মুসাইক মুরাদীর আগমন
ইবনে ইসহাক বলেন: কান্দার রাজাদের প্রভুত্ব অস্বীকার করে ফারওয়া ইবনে মুসাইক মুরাদী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এল। ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্বে মুরাদ ও হামদানের মধে সংঘটিত যুদ্ধে হামদান মুরাদের বিপুল ক্ষতি সাধন করে এবং ব্যাপক গণহত্যা চালায়। ইতিহাসে সে দিনটি ‘ইয়াওমুর রদম’ অর্থাৎ ‘গন কবর রচনার দিন’ নামে খ্যাত। সেদিন হামদানী বাহিনীর মুরাদ আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিল আজদা ইবনে মালিক।”
ফারওয়া কান্দায় রাজাদের ত্যাগ করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাওয়ার সময় নিম্নলিখিত কবিতা আবৃত্তি করে:
“আমি যখন দেখলাম কান্দার রাজারা বিশ্বাসঘাতকের মত রাজ্যের
নারীদের ইজ্জত আবরুকে অবজ্ঞা করেছে, তখন
নিজের সওয়ারীতে আরোহণ করে উত্তম অনুগ্রহ ও উত্তম আশ্রয়ের আশায়
মুহাম্মাদের নিকট রওয়ানা হলাম।”
ফারওয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থাপিত হলে তিনি বললেন, “হে ফারওয়া! ইয়াওমুর রাদমে তোমার জাতি যে ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে তাতেই কি তুমি মর্মাহত হয়েছো।” সে বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! অমন ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে কে না মর্মাহত হয়?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “শোনো, ইসলাম গ্রহণ করলে তোমার জাতির এই ক্ষতি সত্ত্বে উত্তরোত্তর কল্যাণ সাধিত হবে।”
এরপর তিনি ফাওয়াকে মুরাদ, যুবাইদ ও মাজহিদ গোত্রের শাসনকর্তা নিয়োগ করলেন এবং তার সাথে যাকাত আদায়কারী হিসেবে খালিদ ইবনে সাঈদকে পাঠিয়ে দিলেন। খালিদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তিকালের সময় পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
আমর ইবনে মা’দী ইয়াকরাবের নেতৃত্বে যুন যুবাইদের একটি প্রতিনিধিদলের আগমন
আমর ইবনে মা’দী ইয়াকরাবের নেতৃত্বে যুন যুবাইদের একটি প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে ইসলাম গ্রহণ করলো। ইতিপূর্বে আমর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খবর শুনে কায়েস ইবনে মাকশুহ মুরাদীকে বলেছিল, “হে কায়েস! তুমিতো তোমার গোত্রের সরদার। আমরা শুনতে পেলাম, মুহাম্মাদ নামক কুরাইশ বংশীয় এক ব্যক্তি হিজাযে নিজেকে নবী পরিচয় দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। আমাদেরকে নিয়ে তার কাছে চল, দেখা যাক সে যে দাবী করে, তা সত্য কিনা। যদি সত্যিই সে নবী হয় তাহলে তুমি অবশ্যই বুঝতে পারবে। আর আমাদের কাছে যদি প্রতিভাত হয় যে, সে সত্যিই নবী, তাহলে অনুসরণ করবো। আর যদি তা না হয় তাহলে তার জ্ঞানের দৌড় কতদূর, তা আমাদের জানা হয়ে যাবে।” কিন্তু কায়েস এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং তা নির্বুদ্ধিতা প্রসূত মত বলে আখ্যায়িত করে। এপর আমর ইবনে মা’দী ইয়াকরাব নিজেই সদলবলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। এ খবর পেয়ে কায়েস ইবনে মকশুহ বললো, “আমর আমার বিরোধিতা করলো এবং আমার মত অগ্রাহ্য করলো। আচ্ছা মজা দেখাবো।” সে আমরকে ভীষণভাবে হুমকী দিল ও শাসালো।
[ইবনে হিশামের মতে উক্ত অভিযানে হামদানের নেতৃত্ব দিয়েছিল মালিক ইবনে হারিস হামদানী।]
তার জবাবে আমর নিম্নলিখিত কবিতা আবৃত্তি করেছিল:
“সা’নার ঘটনার দিন তোমাকে একটা সঠিক উপদেশ দিয়েছিলাম,
তোমাকে উপদেশ দিয়েছিলাম আল্লাহকে ভয় করতে ও ন্যায়ের সাতে একমত হতে।
তুমি মৃত্যু হতে রক্ষা পেয়েছো সেই গাধার মত-যে তার খুঁটির ওপর গর্বিত।
সে আমাকে একটি ঘোড়ার ওপর পেয়েছে,
যার ওপর বসে আমি তার গতিরোধ করতে সক্ষম।
আমি এমন বর্ম পরিহিত যা পাথুরে জমিতে অবস্থিত
একটা স্বচ্ছ পানির পুকুরের মত প্রশান্ত।
সে বর্মে আঘাত খেয়ে বর্শা ঘুরে যায় এবং তার ভাল অংশ দূরে ছিটকে পড়ে।
যদি তুমি আমার মুকাবিলায় আস তাহলে দেখবে
এক কেশর বিশিষ্ট সিংহের মুকাবিলায় এসছো।
তখন আমাদের দুর্দম যোদ্ধাকে বজ্রমুষ্ঠি ও উন্নত গ্রীবা
(অর্থাৎ যুদ্ধের জন্য অধীরভাবে প্রস্তত) দেখতে পাবে।
যদি তার প্রতিদ্বন্দ্বী কোন সমবয়স্ক যোদ্ধা তাকে কাবু করতে চায় তাহলে সে-ই
তাকে পরাজিত করে, তাকে পাকড়াও করে উর্ধে উৎক্ষেপ করে,
অতঃপর ভুতলে নিক্ষেপ করে হত্যা করে,
তার মগজ বের করে তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়,
অতঃপর তাকে গিলে কেয়ে ফেলে।
শিরকের অত্যাচারে তার দাঁত ও নখর কলুষিত।”
পরে ফারওয়া ইবনে মুসাইকের শাসনাধীন বনু যুবাইর গোত্রে আমর ইবনে মা’দী ইয়াকরাব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনতিকালের সময় পর্যন্ত অবস্থান করে। এরপর ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়। সত্য ভ্রষ্ট হওয়ার সময় সে নিম্নরূপ কবিতা আবৃত্তি করেঃ
“ফারওয়ার শাসন আমাদের কাছে নিকৃষ্টতম শাসন বলে মনে হয়েছে।
তাকে আমরা সেই গাধার মত পেয়েছি যে জরায়ুর ভেতরে নাক ঢুকিয়ে গ্রাণ নেয।
তুমি যদি এ শাসন দেখতে হে আবু আমর, তাহলে
দেখতে পিশাচ ও বিশ্বাসঘাতক দিয়েই তার দল পরিপূর্ণ।”
আশয়াস ইবনে কায়েসের নেতৃত্বে কিন্দার প্রতিনিধিদলের আগমন
ইবনে ইসহাক বলেন: কিন্দার প্রতিনিদিদল নিয়ে আশয়াস ইবনে কায়েস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে আগমন করেন। যুহরী ইবনে শিহাব আমাকে জানিয়েছেন যে, আশয়াস কিন্দার আশিজন উষ্ট্রারোহী নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মসজিদে নববীতে মিলিত হন। তার দল সুন্দরভাবে চুল আঁচড়ানো, চোখে সুরমা লাগানো এবং নকশী করা রেশম সংযুক্ত ইয়ামনী জুব্বা পরা অবস্থায় এসেছিল। তারা দেখা করতে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা কি মুসলমান হওনি?” তারা বললেন, ‘হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “তাহলে তোমাদের গায়ে এত রেশমের ছড়াছড়ি কেন?” একথা বরার সঙ্গে সঙ্গে তারা তাদের পোশাকের রেশমী অংশ ছিড়ে ফেলে দিলেন। তারপর আশয়াস ইবনে কায়েস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন,
“ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমরা যেমন ‘আকিলুল মুরাব’ এর বংশধর আপনিও তেমনি ‘আকিলুল মুরার’ [৯৩. এটি বনু কিন্দার এক পূর্বপুরুষের উপাধি। যেহেতু কুরাইশদের অন্যতম পূর্বপুরুষ কিলাব ইবনে মুরার এর মাতা বনু কিন্দার মেয়ে ছিলেন, আশয়াস তাঁকে মাতামহের দিক থেকে আকিলুল মুরাবের বংশধর বলে রসিকতা করেন।] এর বংশধর।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হেসে বললেন, “তোমরা এই বংশ পরিচয় আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব ও রাবীয়া ইবনে হারেসের ক্ষেত্রে প্রয়োগ কর।” ঐ দুই ব্যক্তি ব্যবসায়ী ছিলেন এবং ব্যবসা উপলক্ষে দূরবর্তী কোন আরব জনপদে গেলে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলে তারা বলতেন, “আমরা ‘আকিলুল মুরার’- এর বংশধর।” এ কথা বলে তারা নিজেদের সম্মান বৃদ্ধির চেষ্ট করতেন। কারণ কিন্দা গোত্রে বহু রাজন্যবর্গ ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় বললেন, “না, আমরা বরং নাদার ইবনে কিনানার বংশধর। আমরা মায়ের বংশধররূপে পরিচিত হই না এবং পিতৃপরিচয় কখনো বর্জন করি না।” অতঃপর আশয়াস ইবনে কায়েস তাঁর সহচরদের নিজ গোত্রের কাছে ফিরে যাওয়অর তাড়া দিয়ে বললেন, “তোমাদের কাজ শেষ হয়েছে কি? আল্লাহর কসম, এমন কথা যে বলে (পিতৃ বংশ পরিচয়ের পরিবর্তে যে মায়ের বংশ পরিচয় প্রচার করে) তাকে আশি যা বেত না মেরে ছাড়ি না।”
সুরাদ ইবনে আবদুল্লাহ আযদীর আগমন
আযদ গোত্রের একদল লোক সাথে নিয়ে সুরাদ ইবনে আবদুল্লাহ আযদী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন এবং খুব নিবেদিতপ্রাণ মুসলমান হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে গোত্রের মুসলিম সদস্যদের আমীর নিযুক্ত করলেন এবং তাদের নিয়ে আশপাশের মুশরিক ইয়ামানী গোত্রগুলোর বিরুদ্ধে জিহাদ পরিচালনার নির্দেশ দিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে জিহাদ করার লক্ষ্যে প্রথমে জুরাশ অীভযানে বের হলেন। ইয়ামানী গোত্র অধ্যূষিত এই শহরটি সে সময় ছিল প্রাচীর ঘেরা ও সুরক্ষিত। মুসলিম বাহিনী তাদেরকে আক্রমণ করতে ছুটে আসছে একথা শুনে খাশয়াম গোত্র ইয়ামনীদের সাথে যোগ দেয়। সুরাদের বাহিনী ইয়ামনী খাশয়ামীদেরকে প্রায় একমাস অবরোধ করে রাখে এবং তারাও জুরাশের ভেতরে থেকে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে অক্ষত থাকে। অতঃপর সুরাদ তার বাহিনী নিয়ে ফিরে যান। তিনি যখন শাকার পর্বতের কাছে পৌছেন তখন জুরাশবাসী তাঁকে পরাজিত মনে করে তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করে। যেই মাত্র তারা সুরাদের বাহিনীর ওপর আক্রমণ করলো অমনি তিনি তাদের ওপর আক্রমণ চালালেন এবং তাদের বিপুল সংখ্যক লোককে হত্যা করলেন। ইতিপূর্বে জুরাশবাসী দু’জন লোককে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য মদীনার পাঠিয়েছিল। একদিন আছরের পর তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে বসলে তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “শাকার কোথায় অবস্থিত।” জুরাশবাসী লোক দুটি বললো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের অঞ্চলে একটা পাহাড় আছে। আমরা জুরাশবাসী তাকে ‘কাশার’ বলে থাকি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ওই পাহাড়টার নাম কাশার নয় শাকার।” তারা বললো, “শাকারের কি হয়েছে ইয়া রাসূলুল্লাহ?” তিনি বললেন, “সেখানে এই মুহুর্তে প্রচুর লোক নিহত হচ্ছে।”
লোক দুটি আবু বাক্র কিংবা উসমান রাদিয়াল্লাহ আনহুর নিকট হিয়ে বসলে তারা বললেন,, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমদের গোত্রের মৃত্যুর সংবাদ দিয়েছেন। তোমরা তাঁকে তোমাদের গোত্রের বিপদমুক্তির জন্য দোয়া করতে অনুরোধ কর।” তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে অনুরোধ করলে তিনি এইরূপ দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ, জুরাশবাসীর ওপর থেকে এ বিপদ দূর করে দাও।” অতঃপর তারা দুজন জুরাশ অভিমুখে যাত্রা করলো। সেখানে পৌছে তারা জানতে পারলো যে, সুরাদ ইবনে আবদুল্লাহ জুরাশবাসীকে ঠিক সেইদিন সেই মহুর্তে হত্যা করেছিলেন যেদিন এবং যে সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের কাছে ঐ ঘটনার কথঅ উল্লেখ করেছিলেন।”
জুরাশের প্রতিনিধিদল রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে ইসলাম গওহণ করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের শহরের চারপাশে পশু চারণের জন্য কয়েকটি সুরক্ষিত এলাকা নির্ধারণ করে দিলেন। ঘোড়া, উট ও চাষের বলদের জন্য আলাদা আলাদাভাবে এলাকা চিিহ্নত করা হলো এবং ঘোষণা করা হলো যে, ঐসব এলাকায় যে কোন লোকের পশু চরে বেড়াবে তা ধরে নেয়া বা খাওয়া কারো জন্য বৈধ হবে না।
হিমইয়ার বংশীয় রাজাদের দূতের আগমন
হিমইয়ার রাজন্যবর্গ তাদের ইসলাম গ্রহণের খবর জানিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পত্রসহ দূত পাঠান। এই রাজন্যবর্গের মধ্যে ছিলেন হারেস ইবনে আব্দ কুলাল, নুআঈম, মা’আফির ও হামদানের উপশাসক নুমান কায়ল। [৯৪. কায়ল শব্দটি সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ কেবল বলেন এর অর্থ রাজা। অন্যান্যরা বলেন এর অর্থ রাজার নিছর কোন পদস্থ কর্মকর্ত। শেষোক্ত মতটিই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক অভিযান থেকে ফিরে আসার সময় এসব দূত আগমন করে। ইয়ামানের অধিপতি যুররা পাঠান মালিক ইবনে মাররা বাহাওয়ীকে। তারা সকলেই নিজেদের ইসলাম গ্রহণ, শিরক বর্জন এবং মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘোষণা করে দূত ও চিঠি পাঠান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাবে তাঁদেরকে নিম্নরূপ চিঠি লেখেন, “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর রাসূল ও নবী মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে রুআইন, মায়াফির হামদানের অধিপতি ইবনে আব্দ কুলাল, নুআঈম ইবনে আব্দ কুলাল ও উপশাসক নুমানের প্রতি। আমি মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি যিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই। আমরা রোমক ভূমি থেকে ফেরার পর তোমাদের দূত মদীনাতে আমাদের সাথে দেখা করে তোমাদের বার্তা আমাদের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছে। তারা তোমাদের ইসলাম গ্রহণ ও মুশরিকদের হত্যা করার খবর আমাদেরকে জানিয়েছে। তোমরা যদি সততার পথে চল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, নামায কায়েম কর, যাকাত দাও, গনীমত থেকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে এক পঞ্চমাংশ, নবীর অংশ ও তার বন্টনপূর্ব বাছাই করা অংশ এবং মুমিনদের ওপর ধার্যকৃত অবশ্য দেয় সাদকা প্রদান কর, তাহলে আল্লাহর হিদায়াত লাভ করবে। ধার্যকৃত অবশ্য দেয় সাদকা হলো, যেসব কৃষিভূমি বৃষ্টি ও খঅলের পানি দ্বারা সিঞ্চিত তার ফসলের এক দশমাংশ এবং কৃত্রিমভঅবে সিঞ্চিত কৃষিভূমির ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ।
আর চল্লিশটা উটে একটা দুই বছরের বেশী বয়সের উষ্ট্রী শিশু এবং ত্রিশটায় একটা দুই বছরের বেশী বয়সের উট। প্রতি পাঁচটা উটে একটা ছাগল, দশটা উটে দুইটা ছাগল, চল্লিশটা গরুতে একটা গাভী, ত্রিশটাতে এক বছর অথবা দুই বছর বয়স্ক বাছুর এবং প্রতি চল্লিশটা গরুতে একটা গাভী, ত্রিশটাতে এক বছর অথবা দুই বছর বয়স্ক বাছুর এবং প্রতি চল্লিশটা চারণশীল ছাগল বা ভেড়ায় একটা করে ছাগল। এগুলো মুমিনদেরওপর আল্লাহর ধার্য করা অপরিহার্য সাদকা। এর বেশী দিলে আরো ভালো কিন্তু যে ব্যক্তি শুধু এইটুকু প্রদান করবে, তারা ইসলামের আনুগত্যের প্রমাণ দেবে এবং মু’মিনদেরকে মুশরিকদের ওপর বিজয়ী হতে সাহায্য করবে, সে-ই মু’মিন। সকল মু’মিনদের যতটা অধিকার ও দায়দায়িত্ব তারও ততটা অধিকার ও দায়দায়িত্ব। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল তাঁর সার্বিক নিরপত্তার জিম্মাদার। কোন ইহুদী ও খৃষ্টান ইসলাম গওহণ করলে সে মু’মিনদের অন্তর্ভুক্ত হবে। তার অধিকার ও দায়দায়িত্ব অন্যান্য মু’মিনদের সমান। আর যদি কেউ নিজের ইহুদি ও খৃষ্টান ধর্মে বহাল থঅকতে চায় তবে তাকে জোরপূর্বক ইসলামে দীক্ষিত করা হবে না। তবে এ ধরনের প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষ গোলাম কিংবা স্বাধীন যাই হোক না কেন, তাকে জিযিয়া দিতে হবে। জিযিয়ার পরিমাণ মায়াফের (ইয়ামানী কাপড় বিশেষ) এর ক্রয়মূল অনুসারে এক দীনার অথবা তদপরিমাণ কাপড়। যে ব্যক্তি এই জিয়িয়া আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রদান করবে, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল তার নিরাপত্তার জিম্মাদরা। আর যে ব্যক্তি তা পদান করতে অস্বীকার করবে সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দুশমন।
ইয়মানের অধিপতি যুরযাকে আল্লাহর নবী ও রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিচ্ছেন যে, আমার দূত মুয়ায ইবনে জাবাল, আবদুল্লাহ ইবনে যায়িদ, মালিক ইবনে উবাদাহ ও উকবা ইবনে নামির ও তাদের সঙ্গীরা (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) যখন তোমাদের কাছে যাবে তখন তাদের সঙ্গে সদাচরণ করবে, আর তারা যদি তোমাদের প্রজাদের কাছে প্রাপ্য যাকাত ও জিযিয়া উসুল করে আমী মুয়ায ইবনে জাবালের অধীনস্থ দুতদের কাছে পৌছিয়ে দেয় তাহলে যুরা যেন তাতে সম্মতি দেয়।
মুহাম্মাদ পুনরায় ঘোষণা করছেন যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই এবং তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।
আরো উল্লেখ থাকে যে, মালিক ইবনে মাররা বাহাত্তরী আমাকে জানিয়েছে যে, তুমি (যুররা) হিমইয়ার নরপতিদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছো এবং মুশরিকদের হত্যা করেছো। এজন্য তুমি সুসংবাদ ও মুবারকবাদ নাও এবং হিমইয়ারের প্রতি বাল আচরণ কর। বিশ্বাসঘাতকতা করো না এবং কাউকে নির্যাতন করো না। মনে রেখ, আল্লাহর রাসূল তোমাদের ধনী-গরীব সকলেরই অভিভাবক। যাকাত সাদকা মুহাম্মাদ ও তাঁর পরিবার পরিজনের জন্য বৈধ নয়। যাকাত হলো ধন সম্পদের পবিত্রতা সাধনের উপায় এবং তা শুধু মুসলিম দরিদ্র ও পথিকের জন্য বৈধ। মালিক সুষ্ঠুভাবে ও বিশ্বস্ততার সাথে তোমার বার্তা পৌছিয়ে দিয়েছে। কাজেই তাঁর সাথে ভাল আচরণ করার জন্য তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি। আমার অনুসারীদের মধ্যে থেকে অত্যন্ত সৎ, সুযোগ্য, জ্ঞানী ও পরহেজগার লোকদেরকে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছি। তাদের সাথে সদাচরণ করার জন্য তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছি। কারণ তাদের রিপোর্টই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন বিবেচিত হবে। ওয়সসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।”
মুয়ায ইবনে জাবালকে ইয়ামানে পাঠানোর সময় রাসূলুল্লাহর উপদেশ
ইবনে ইসহাক বলেন: আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র আমাকে জানিয়েছেন যে, তাঁর কাছে এ মর্মে বর্ণনা করা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুয়াযকে (রা) দূত হিসেবে পাঠান, তখন কতিপয় উপদেশ দেন ও তাঁর অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। তিনি বলেন, “সহজভাবে ইসরামের দাওয়াত পেশ করবে, কঠিনভাবে নয়। তাদের মনে আশার আলো জাগাবে, বীতশ্রদ্ধ করে দেবে না। তাহলে কিতাবের একি গোষ্ঠির সাক্ষাত পাবে। ওরা জিজ্ঞেস করবে যে, জান্নাতের চাবিকাঠি কি? তাদের বলবে, আল্লাহ এক ও তাঁর কোন শরীক নেই-এই সাক্ষ্য প্রদানই জান্নাতের চাবি।”
অভিযান পরিচালনাকালে খালিদ ইবনে ওয়ালীদের (রা) হাতে বনু হারিস গোত্রের ইসলাম গ্রহণ
ইবনে ইসহাক বলেন: দশম হিজরীর রবিউস সানী অথবা জামাদিউল আউয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে নাজরানের বনু হারিস ইবনে কা’ব গোত্রের কাছে এই নির্দেশদিয়ে পাঠালেন যে, “যুদ্ধে লিপ্ত হওয়অর আগে তাদেরকে ইসলামের দিকে তিন দিন পর্যন্ত দাওয়াত দেবে। তারা যদি দাওয়াত গ্রহণ করে তাহলে তা মেনে নেবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাবে।”
খালিদ রওনা হলেন। বনু হারিসের বসতিতে পৌছে খালিদ তাঁর সঙ্গীদের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ইসলামের দাওয়াত দিতে নির্দেশ দিলেন। তারা বরতে লাগলেন, “হে জনগণ, তোমরা ইসলাম গ্রহণ কর। তাহলে তোমরা নিরপদে থাকবে।” লোকরা ইসরাম গ্রহণ করতে লাগলো, খালিদ তাদের কাছে থেকে গেলেন। তাদেরকে ইসলামের শিক্ষা দিতে লাগলেন এবং কুরআন ও রাসূলের সুন্নাহ সম্পর্কে অবহিত করতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে এ নির্দেশও দিয়েছিলেন যে, নাজরানবাসী যদি যুদ্ধ করার বদলে ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে তিনি যে তাদের কাছে থেকে যান এবং তাদেরকে ইসলামের বিস্তারিত শিক্ষা দিতে থাকেন। খালিদ ইবনে ওয়ালীদ (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট নিম্নরূপ চিঠি লিখলেন,
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। খালিদ ইবনে ওয়ালীদের তরফ থেকে আল্লাহর প্রেরিত নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট। ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার ওপর শাস্তি, আল্লাহর রহমত ও বরকত নাযিল হোক। আপনার কাছে আমি আল্লাহর প্রশংসা ব্যক্ত করছি, তিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই। ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহর করুণা ও শাস্তি বর্ষিত হোক আপনার ওপর। আপনি আমাকে বনু হারিসের কাছে এই নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়েছেন যে, আমি যেন তিন দিন পর্যন্ত যুদ্ধ না করে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেই। তারা যদি ইসলাম গ্রহণ করে তাহলে যেন তা মেনে নেই। তাদের সাথে অবস্থান করি এবং ইসলামের বিস্তৃত বিধান, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ শিক্ষা দিই। আর যদি তার ইসলাম গ্রহণ না করে তাহলে আমি যেন তাদের সাথে যুদ্ধ করি। ইমি তাদের কাছে এসেই তিন দিন ধরে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিয়েছি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ অনুসারে। আমি এখানকার জনগণের কাছে আমার সঙ্গীদেরকে পাঠিয়েছি। তারা এই বলে দাওয়াত দিয়েছে, ‘হে বনু হারিস! ইসরাম গ্রহণ কর্ াতাহলে তোমরা নিরপদে থাকবে।’
ফলে বনু হারিস যুদ্ধ করেনি এবং ইসলাম গ্রহণ করেছে। আমি তাদের মধ্যেই অবস্থান করছি এবং আল্লাহ যে আদেশ করেছেন সেই মুতাবিক তাদেরকে আদেশ দিচ্ছি। আর আল্লাহ যা নিষেধ করেছেন তা থেকে তাদেরকে বিরত রাখছি। আর তাদেরকে ইসলামের বিস্তৃত বিধান ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিধান শিক্ষা দিচ্ছি এবং এ কাজ এই চিঠি লেখার সময় পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। ইয়া রাসূলুল্লাহ, আসসালামু আলাইকা ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।”
প্রত্যুত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদের কাছে নিম্নরূপ চিঠি লিখলেন: “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর প্রেরিত নবী মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে খালিদ ইবনে ওয়ালীদের নিকট। তোমার ওপর শান্তি বির্ষত হোক। আমি তোমার কাছে সেই আল্লাহর প্রশংসা ব্যক্ত করছি, যিনি ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই। দূত মারফত তোমার চিঠি পেয়ে জানতে পারলাম যে, যুদ্ধ না করেই বনু হারিস ইসলাম গ্রহণ করেছে এবং তোমাদের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। তুমি জানিয়েছ যে, আল্লাহ তাদেরকে তাঁর হিদায়াতের বাণী দ্বারা হিদায়াত করেছেন। অতএব তুমি তাদেরকে সুসংবাদ দাও এবং সেই সাথে সাবধানও করে দাও। এবার তুমি চলে এস এবং বনু হারিসের একটি প্রতিনিধিদলকে আমার কাছে আসতে বলে দাও। ওয়াসাল্লামু আলাইকম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চিঠি পেয়ে খালিদ মদীনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের কাছে ফিরে এলেন। তাঁর সাথে বনু হারিসের একটি প্রতিনিধিদলও এল। এ প্রতিনিধিদলের উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন: কায়েস ইবনুল হুসাইন, ইয়াযীদ ইবনে আবদুল মাদান, ইয়াযীদ ইবনে মুহাজ্জাল, আবদুল্লাহ ইবনে কুরাদ যিয়াদী, শাদ্দাদ ইবনে আবদুল্লাহ কানানী ও আমরইবনে আবদুল্লাহ দিবাবী। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওযাসাল্লামের নিকট এলে তাদের দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ভারতীয়দের মত দেখতে এরা কারা?” সাহাবীগণ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, এরা বনু হারিসের লোক।” তাঁরা রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এসে তাঁকে সালাম দিলেন। তারা বললেন, “আমরা সাক্ষ দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আমি ও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল।” তিনি আবার বললেন, “আচ্ছা তোমরাই সেই জাতি না যাদেরকে পেছনে হটিয়ে দিলে আরো এগিয়ে আসে?” তিনি চারবার কথাটার পুনরাবৃত্তি করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “খালিদ যদি একথা না জানাতো যে, তোমরা বিনা যুদ্ধে ইসলাম গ্রহণ করেছ তাহলে আমি তোমাদের মস্তক ছেদন করে তোমাদের পায়ের তলায় লুটিয়ে দিতাম।” ইয়াযীদ ইবনে আবদুল মাদান বললেন, “জেনে রাখুন, আমরা আপনার কিংবা খালিদের প্রশংসা করিনি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তা হলে কার প্রশংসা করেছো?” তাঁরা বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা সেই মহা প্রতাপন্বিত ও মহাপরাক্রান্ত আল্লাহর প্রশংসা করেছি যিনি আপনার মাধ্যমে আমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন।” তিনি বললেন, “তোমরা সত্যই বলছো।” তিনি আরো বললেন, “তোমরা জাহিলী যুগে কিসের জোরে যুদ্ধ বিগ্রহে প্রতিপক্ষের ওপর জয় লাভ করতো?” তারা বললেন, “কই, আমরা তো কারো ওপর জয়লাভ করতাম না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হাঁ। যারা তোমারেদ সাথে যদ্ধে লিপ্ত হতো তাদের ওপরতোমরা জয়লাভ করতে।” প্রতিনিধিগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, প্রতিপক্ষের ওপর আমাদের জয় লাভের কারণ ছিল এই যে, আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতাম, কলহ বিবাদে লিপ্ত হতাম না। আর কখনো কারো ওপর প্রথমে বা অন্যায়ভাবে আক্রমণ চালাতাম না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তোমরা সত্য বলছো।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কায়েস ইবনে হুসাইনকে বনু হারিসের আমীর নিয়োগ করেন।
অতঃপর বনু হারিসের প্রতিনিধিদল শাওয়ালের শেষভাগে অথবা যুলকান্দার প্রথম ভাগে নিজ এলাকায় ফিরে গেল। তাদের যাওয়ার চার মাস পরেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল করেন।
প্রতিনিধিদল চলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু হারিসকে ইসলামের বিস্তৃত বিধান ও তাঁর সুন্নাহ শিক্ষা দেয়া এবং তাদের সাদকা আদায় করার জন্য আমর ইবনে হাযম (রা) কে প্রেরণ করেন। তিনি নিজের নির্দেশাবলী সম্বলিত একটি পত্রও তাঁকে দেন। পত্রটি ছিল নিম্নরূপঃ
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে এটি একটি ঘোষণাপত্র। হে মুমিনগণ, তোমরা চুক্তি পালন কর। আল্লাহর প্রেরিত নবী মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে ইয়ামানে প্রেরিত তাঁর দূত আমর ইবনে হাযমের জন্য এটি একটি নির্দেশনামা। আমরকে তিনি সর্বত্র ও সর্বাস্থায় আল্লাহকে ভয় করে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন যারা তাঁকে ভয় করে চলে এবং যারা ভাল কাজ করে। তাকে নির্দেশ দেয়া গেল যে, সে যেন সবসময় ন্যায় ও সত্যের পথে অনুসরণ করে, যেভাবে আল্লাহ তাকে আদেশ করেছেন। সে যেন মানুষকে কল্যাণের পথ চলার প্রেরণা দান করে ও আদেশ জারী করে। তাদের মধ্যে কুরাআনের শিক্ষা বিস্তার করে ও কুরাআন সম্পর্কে মানুষকে সূক্ষজ্ঞান বিতরণ করে এবং কেউ যাতে নাপাক অবস্থায় কুরআন স্পর্শ না করে সে ব্যাপারে যেন সাবধান করে দেয়। কিসে মানুষের ভাল হবে এবং কিসে মন্দ হবে, তা যেন জানিয়ে দেয়, হক ও ন্যায়ের ওপর যারা চলে তাদের সাথে নমনীয় আচরণ করে আর যারা যুলুম করে তাদের বিরুদ্ধে যেন কঠোর হয়। কেননা আল্লাহ যুলুমকে র্ঘণা করেন এবং তা থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: ‘সাবধান! যালিমদের আল্লাহর লানত!’সে যেন মানুষকে জান্নাতের এবং তার উপযোগী কাজ করার জন্য উৎসাহিত করে আর জাহান্নাম ও তার উপযোগী কাজ থেকে হুঁশিয়ারী করে দেয়। মানুষকে ইসলামের সূক্ষ্ম ও বিস্তৃত জ্ঞঅন দানের জন্য সে যেন তাদের প্রিয় হবার চেষ্টা করে, তাদেরকে বড় হজ্জ ও ছোট হজ্জ তথা উমরার নিয়মকানুন, সুন্নাত, ফরয ও আল্লাহর নির্দেশবলী শিক্ষা দেয়। সে যেন মানুষকে মাত্র একখঅনা ছোট কাপড় পরে নামায পড়তে নিষেধ করে, অবশ্য সেই কাপড়খানা যদি এতটা বড় হয় যে, তার এক প্রান্ত পরে অপর প্রান্ত ঘাড়ের ওপর ঘুরিয়ে দেয়া যায় তাহলে সেটা আলাদা কথা। একটি মাত্র কাপড় পরে ঠ্যাং উচিয়ে এমনভাবে বসতে সে যেন মানুষকে নিষেধ করে যাতে তার লজ্জাস্থান নগ্ন হয়ে যায়। সে যেন পুরুষদের চুল বেণী করে পিঠের ওপর ঝুলিয়ে দিতে নিষেধ করে। উত্তেজনার সময় জনসাধারণকে গোত্র ও আত্মীয়-গোষ্ঠীর দোহাই দিয়ে ডাকতে যেন নিষেধ করে এবং শুধু এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তায়ালার নামে ডাকতে আদেশ দেয়। যারা আল্লাহর দিকে না ডেকে গোত্র-গোষ্ঠী বিশেষের দিকে ডাকে তাদেরকে যেন তরবারী দিয়ে উৎখাত করা হয় এবং এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কায়েস ইবনে হুসাইনকে বনু হারিসের আমীর নিয়োগ করেন।
অতঃপর বনু হারিসের প্রতিনিধিদল শাওয়ালের শেষভাগে অথবা যুলকাদার প্রথম ভাগে নিজ এলাকায় ফিরে গেল। তাদের যাওয়ার চার মাস পরেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইনতিকাল করেন।
প্রতিনিধিদল চলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু হারিসকে ইসলামের বিস্তৃত বিধান ও তাঁর সুন্নাহ শিক্ষা দেয় এবং তাদের সাদকা আদায় করার জন্য আমর ইবনে হাযম (রা) কে প্রেরণ করেন। তিনি নিজের নির্দেশাবলী সম্বলিত একটি পত্রও তাঁকে দেন। পত্রটি ছিল নিম্নরূপঃ
“বিমমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে এটি একটি ঘোষণাপত্র। হে মুমিনগণ, তোমরা চুক্তি পালন কর। আল্লাহর প্রেরিত নবী মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে ইয়ামানে প্রেরিত তাঁর দূত আমর ইবনে হাযমের জন্য এটি একটি নির্দেশনামা। আমরকে তিনি সর্বত্র ও সর্বাস্থায় আল্লাহকে ভয় করে চলার নির্দেশ দিয়েছেন। মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন যারা তাঁকে ভয় করে চলে এবং যারা ভাল কাজ করে। তাকে নির্দেশ দেয়া গেল যে, সে যেন সবসময় ন্যায় ও সত্যের পথে অনুসরণ করে, যেভাবে আল্লাহ তাকে আদেশ করেছেন। সেযেন মানুষকে কল্যাণের পথ চলার প্রেরণা দান করে ও আদেশ জারী করে। তাদের মধ্যে কুরআনের শিক্ষা বিস্তার করে ও কুরআন সম্পর্কে মানুষকে সূক্ষ্মজ্ঞান বিতরণ করে এবং কেউ যাতে নাপাক অবস্থায় কুরআন স্পর্শ না করে সে ব্যাপারে যেন সাবধান করে দেয়। কিসে মানুষের ভাল হবে এবং কিসে মন্দ হবে, তা যেন জানিযে দেয়, হক ও ন্যায়ের ওপর যারা চলে তাদের সাথে নমনীয় আচরণ করে আর যারা যুলুম করে তাদের বিরুদ্ধে যেন কঠোর হয়। কেননা আল্লাহ যুলুমকে ঘৃণা করেন এবং তা থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: ‘সাবধান। যালিমদের ওপর আল্লাহর লানত।’ সে যেন মানুষকে জান্নাতের এবং তার উপযোগী কাজ করার জন্য উৎসাহিত করে আর জাহান্নাম ও তার উপযোগী কাজ থেকে হুঁশিয়ারী করে দেয়। মানুষকে ইসলামের সূক্ষ্ম ও বিস্তৃত জ্ঞান দানের জন্য সে যেন তাদের প্রিয় হবার চেষ্টা করে, তাদেরকে বড় হজ্জ ও ছোট হজ্জ তথা উমরার নিয়মকানুন, সুন্নাত, ফরয ও আল্লাহর নির্দেশাবলী শিক্ষা দেয়। সে যেন মানুষকে মাত্র একখানা ছোট কাপড় পরে নামায পড়তে নিষেধ করে, অবশ্য সেই কাপড়খানা যদি এতটা বড় হয় যে, তার এক প্রন্ত পরে অপর প্রান্ত ঘাড়ের ওপর ঘুরিয়ে দেয়া যায় তাহলে সেটা আলাদা কথা। একটি মাত্র কাপড় পরে ঠ্যাং উচিয়ে এমনভাবে বসতে সে যেন মানুষকে নিষেধ করে যাতে তার লজ্জাস্থান নগ্ন হয়ে যায়। সে যেন পুরুষদের চুল বেণী করে পিঠের ওপর ঝুলয়ে দিতে নিষেধ করে। উত্তেজনার সময় জনসাধারণকে গোতও ও আত্মীয়-গোষ্ঠীর দোহাই দিয়ে ডাকতে যেন নিষেধ করে এবং শুধু এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ তায়ালার নামেডাকতে আদেশ দেয়। যারা আল্লাহর দিকে না ডেকে গোত্র-গোষ্ঠী বিশেষের দিকে ডাকে তাদেরকে যেন তরবারী দিয়ে উৎখাত করা হয় এবং এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর একজন বিশ্বস্ত লোক আবু হুরাইরার (রা) উদ্ধৃতি দিয়ে আমাকে জানিয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামতের আগে ত্রিশজন দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে এবং তাদের প্রত্যেকেই নবুওয়াতের দাবীদার হবে।”