তায়েফ ত্যাগের পর কা’ব ইবনে যুহাইরের ইসলাম গ্রহণ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তায়েফ ত্যাগের পর বুজাইর ইবনে যুহাইর তার ভাই স্বনির্বাচিত বিশিষ্ট কবি কা’ব ইবনে যুহাইরকে চিঠি মারফত জানায় যে, “মক্কায় যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিন্দাসূচক কবিতা রচনা করতো তাদের অনেককে তিনি হত্যা করেছেন। কুরাইশ কবিদের মধ্যে ইবনে যাবয়ারী ও হুবাইরা প্রমুখ পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। তুমি যদি বাঁচতে চাও তবে কালবিলম্ব না করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাজির হও। যে ব্যক্তি মুসলমান হয়ে ও তাওবাহ করে তাঁর কাছে আসে তিনি তাঁকে হত্যা করেন না। আর যদি তা না কর তবে দুনিয়ার যেখানে নিরাপদ মনে কর সেখানে গিয়ে আশ্রয় নাও।”
ইতিপূর্বে কা’ব এক কবিতায় বলেছিল,
“বুজাইয়ের কাছে আমার এই বার্তা পৌছিয়ে দাও, আমি যা বলেছি তা গ্রহণ করতে কি তোমার প্রবৃত্তি হয়. আর যদি তা গ্রহণ না কর তাহলে আমাকে আনাও, অন্য কোন্ জিনিসের প্রতি তুমি আগ্রহী? তুমি সেই স্বভাব-চরিত্রের প্রতি আগ্রহী যা আমি তাঁর পিতামাতার মধ্যে দেখিনি (অর্থাৎ মুহাম্মাদের) এবং তুমি তোমার পিতামাতার মধ্যেও দেখনি? আমার কথা যদি ুতমি গ্রহণ না করা তাহলে আমি দুঃখ করবো না এবং তুমি ভুল করে ক্ষতিপ্রস্ত হলেও আর শুধরে দেব না। বিশ্বস্ত মানুষটি তোমকে সেই বিশেষ স্বভাব চরিত্র গড়ার উদ্দেশ্যে নতুন পানীয় পান করিয়েছে।”
কা’ব এই কবিতাটি বুজাইরের নিকট পাঠায় এবং বুজাইর তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে পড়ে শোনায়। তিনি যখন শুনলেন, “বিশ্বস্ত মানুষটি তোমাকে নতুন পানীয় পান করিয়েছে” তখন বলনে, “কা’ব মিথ্যাবাদী হলেও এ কথাটা সত্য বলেছে। আমিই সেই বিশ্বস্ত মানুষ।”
পুনরায় যখন আবৃত্তি করা হলো, “(তুমি কি) সেই স্বভাব-চরিত্রের প্রতি আগ্রহী যা তার মাতাপিতার মধ্যে তুমি দেখনি” তখন রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হাঁ, সে তার পিতামাতার মধ্যে এ চরিত্র দেখেনি।”
ইবনে ইসহাক বলেনঃ বুজাইরের চিঠি পেয়ে কা’ব চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলো। প্রাণের ভয়ে তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল। তার আশেপাশে তার শত্রুভাবাপন্ন যারা ছিল তারা তাকে আরো ভীত এবং সন্ত্রস্ত করার জন্য বলতে লাগলো,!“কা’বের মরণ আসন্ন।” অনন্যোপায় হয়ে সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের প্রশংসা করে একটা কবিতা লিখলো। এই কবিতায় সে তার নিজের ভীতি এবং তার শত্রুদের কর্তৃক তাকে সন্ত্রস্ত করার কথা উল্লেখ করলো। অতঃপর সে মদীনায় চলে গেল। সেখানে তার পূর্ব পরিচিত জুহাইনা গোত্রের এক ব্যক্তির কাছে গিয়ে উঠলো। অতঃপর সে ব্যক্তি কা’বকে নিয়ে ফজরের নামাযের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের নিকট চলে গেল। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাতে নামায পড়লো। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে ইংগিত করে কা’বকে বললো,, “তিনিই রাসূলুল্লাহ। তুমি তাছর কাছে গিয়ে নিরাপত্তা প্রার্থনা কর।” কা’ব তৎক্ষনাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ্অলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে তাঁর সামনে বসে তাঁকে চিনতেন না। কা’ব বললো, “ ইয়া রাসূলুল্লাহ, কা’ব ইবনে যুহাইর তাওবাহ করে মুসলমান হয়ে আপনার কাছে হাজির করি তাহলে কি আপনি তাকে গ্রহণ করবেন?” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হঁ^া।” তখন সে বললে “ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমিই কা’ব ইবনে যুহাইর।” এই সময় জনৈক আনসার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে ছুটে এসে বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমাকে অনুমতি দিন, আল্লাহর এই দুশমনকে হত্যা করি।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাকে ছেড়ে দাও। সে তাওবাহ করে এবং শিরক ত্যাগ করে এসেছে।” ঐ আনসারীর ব্যবহারে কা’ব সমগ্র আনসারদের প্রতি রাগান্বিত হয়। অবশ্য মুহাজিরগণ তাকে কোন অপ্রীতিকর কথা বলেননি। সে একটি কবিতা লেভে। কবিতাটি এরূপ –
“ (আমার স্ত্রী) সুয়াদ আমা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে আমার মন ভেঙ্গে গেছে। আমি আজ অপমানিত এবং শৃংখলিত। তার পদানুসরণ করায় আমার কোন ণাল হয়নি। …. শুনেছি, আল্লাহর রাসূল আমাকে হুমকি দিয়েছেন। তথাপি, আমি আল্লাহর রাসূলের ক্ষমা পাওয়ার প্রত্যাশা করি। একটু সবুর করুন! যে আল্লাহ আপনাকে উপদেশ সমৃদ্ধ কুরআনের ঐশ্বর্য দান করেছেন তিনি যেন আপনাকে ন্যায়পথে পরিচালনা করেন। কুচক্রীদের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে আপনি আমাকে শাস্তি দেবেন না। যদিও আমি বেফাঁস কথা অনেক বলে থাকি, কিন্তু আমি কোন অপরাধ করিনি। আমি আজ এমন (নাজুক) অবস্থানে আছি সেখানে বসে যা যা দেখতে ও শুনতে পাচ্ছি তা শুনলে হাতিও আতংকে অস্থির হয়ে যেত। অবশ্য তাকে আল্লাহর রাসূল যদি আল্লাহর অনুমতিক্রমে নিরাপত্তা দেন তাহলে আলাদা কথা। এ যাবত আমি রাতের আঁধারে ঊষর মরুপ্রান্তর দিয়ে ঘুড়ে বিড়িয়েছি। অবশেষে আমি আমার হাত দিয়েছি সেই ব্যক্তির হাতে যিনি প্রতিশোধ নিতে সক্ষম এবং যার কথা একমাত্র হক কথা। সে হাত আমি আর ফিরিয়ে আনবো না। বস্তুতঃ আমি যখন তাঁর সাথে কথা বলি এবং যখন আমাকে বলা হলো, ‘তুমি অভিযুক্ত ও (বহু অঘটনের জন্য) দায়ী’, তখন তিনি আামার কাছে ‘ইশরে’র নিবিড় অরণ্যের সিংহের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন- যে সিংহ অন্য দুটি সিংহকে মানুষের গোশত খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে, একটি পর্বতের চূড়ায় দিকে যখন সে লাফ দেয় তখন সেই চূড়া জয় না করে সে ছাড়ে না, ‘জাও’ অঞ্চলের বন্য হিং¯্র জন্তুগুলো তার ভয়ে পালায় এবং মানুষেরা দল বেঁধেও তার এলাকায় চলাফেরা করার সাহস পায় না। তার এলাকায় শুধু এমন লোকই যেতে পারে যে নির্ভরযোগ্য এবং সে রক্তাক্ত অস্ত্র ও পুরনো ছেড়া পোশাকে চলতে পারে। নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য পথের দিশারী এক উজ্জ্বল জ্যোতি এবং আল্লাহর এক অপরাজেয় তরবারী। কুরাইশদের একদল লোক যখন মক্কায় তার প্রতি ঈমান আনলো, তখন তাদের কেউ কেউ মু’মিনদের বললো, ‘দূর হয়ে যাও।’ তারা দুল হয়ে গেল বটে। তবে তারা (কুরাইশরা) সেই সমস্ত বীরদের মুকাবিলায় নিরস্ত্র ও অসহায় গয়ে গেল-যারা যুদ্ধের সময় অটুট সুদীর্ঘ সাদা বর্ম পরিধান করে থঅকে- যারা বিজয়ী হলেও উল্লঅসে ফেটে পড়ে না। (কেননা সেটা তাদের অভ্যঅসগত) আর পরাজিত হলেও হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে না। (কেননা তারা জানে জয় পরাজয় আল্লাহর হাতে এবং পরবর্তীতে তাদের জয় অবশ্যম্ভাবী) তারা শ্বেতকায় উটের মত স্থির শান্ত পদক্ষেপে চলে, কালেঅ খাটো লোকগুলো যখন তাদের কাছ থেকে পালিয়ে যায় তখন তারা যুদ্ধ করেই আত্মরক্ষা কলে। আঘাত পড়লে তাদের বুকেই পড়ে। (পিঠে পড়ে না) কেননা তারা মৃত্যুর ভয়ে পালায় না। (বরং সামনে এগিয়ে যায় এবং শত্রুর আঘাতকে বুক পেতে গ্রহণ করে ও প্রতিরোধ করে)।”
আসেম বিন উমার ইবনে কাতাহাদ থেকে বর্ণিত। কা’ব যখন বললো, “কালো খাটো লোকগুলো যখন পালিয়ে যায়” তখন তার ওপর আসসারগণ রেগে যান। কেননা এ কথঅটা সে আমাদের আনসারদের উদ্দেশ্যেই বলেছিল। কারণ আমাদের একজন তার সাথে দুর্ব্যহার করেছিল। পরে আনসারদের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য সে আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য তাদের ত্যাগ তিতিক্ষা ও কুরবানী এবং তাঁর দক্ষিণ হস্তের ভুমিকা পালনের প্রশংসা করে।
সে কবিতাটি এই-
“যে ব্যক্তি জীবনকে ধন্য ও গৌরবান্বিত করতে চায় সে যেন পুণ্যবান আনসারদের সঙ্গ ত্যাগ না করে। মহত্ত্ব ও মহানুভবতা তাদের পূর্বপুরুষদের থেকে প্রাপ্ত উত্তরাধিকার। তাই তারা হলেন শ্রেষ্ঠ মানবদের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা কেবল বর্ম দিয়ে তীর বর্শাকে বলে আনেন। তাদের বর্মগুলো বর্শার মতই- কোন অংশে তা থেকে কম নয়। আগুনের অংগারের মত লাল ও তীক্ষèদৃষ্টি চোখ দিয়ে তারা তাকান। যুদ্ধের সম্মুখীন হলে মৃত্যুর জন্য তারা আপন প্রাণ নবীর হাতে সঁপে দেন। মু’মিনদের ধর্মকে তারা উত্তোলিত তরবারী ও বর্শা দিয়ে রক্ষা করেন। কাফিরদের রক্ত দিয়ে তারা পবিত্রতা লাভ করেন এবং একে তারা পুণ্যব্রত বলে বিবেচনা করেন। খিফয়ার গভীর অরণ্যে ঘাড়মোটা শিকারী সিংহেরা যেমন যুদ্ধের অনুশীলন করে তারাও তেমনি রণদক্ষতা রপ্ত করেন। তারা যখন হামলাকরীর প্রতিরোধ করেন তখন তাকে সম্পূর্নরুপে থামিয়ে দেন। আলী ইবনে মাসউদ মাজেন গাছছানীকে তারা বদরের যুদ্ধে এমন আঘাত করেন যে, সমগ্র বনু নিযার তাতে শায়েস্ত হয় ও বশ্যতা স্বীকার কলে। সকল গোত্র যদি আনসারদের সম্পর্কে আমার যা জানা আছে তা জানতো তাহলে আমার চরম বিরোধী যারা তারাও ব্যাপারটা স্বীকার করতো। তারা এমন একটা মানবগোষ্ঠী যারা চরম দুর্ভিক্ষের সময়ও রাত্রিকালে আগত অীতথিদের প্রতি বদান্যতা প্রদর্শন করে। তারা গাছছানের এমন এক সম্ভ্রান্ত বংশীয় লোক, যাদের আভিজাত্যে কোন ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায় না।”
নিজের স্ত্রী সুরাদ সম্পর্কিত কবিতাটি আবৃত্তি করার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এ কবিতায় তোমার আনসারদের প্রশংসা করা উচিত ছিল। কেননা তারা তার উপযুক্ত বটে।” তখন কা’ব এই শেষোক্ত কবিতাটি আবৃত্তি করেন। ইবনে হিশাম আরো বলেছেন যে, কা’ব তার স্ত্রী সায়াদকে নিয়ে শুরু করা কবিতাটি মসজিদে নববীতে বসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পড়ে শুনিয়েছিল।
তাবুক যুদ্ধ: রযব, নবম হিজরী সন
এরপর যুলহাজ্জ থেকে রযব মাস পযন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় অবস্থান করেন এবং পরে মুসলমানগণকে রোম অভিযানের প্রস্তুত হতে বলেন। যুহরী, ইয়াযীদ ইবনে রোমান, আবদুল্লাহ ইবনে আবু বাক্র, আসেম ইবনে জামর প্রমুখ ঐতিহাসিক তাবুক অভিযানের নিম্নরূপ বর্ণনা দিয়েছেনঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীগণকে রোম অভিযানের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। সে সময় মুসলমানদের জন্য সময় ছিল অত্যন্ত কঠিন। একদিকে ছিল গ্রীষ্মের প্রচন্ড খরতাপ। অন্যদিকে দেশে চলছিল দুর্ভিক্ষ। যাদের কিছু ফল জন্মেছে তা একেবারে পেকে গিয়েছিল। লোকেরা তাদের ফল সংগ্রহ করা এবং ছায়াশীতল জায়গায় অবস্থান করার প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করছিল। ঠিক এমন সময় বাইরে যাওয়া কারো মনঃপূত ছিল না। অধিকাংশ অীভযানে যাওয়ার আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গন্তব্যস্থল সম্পর্কে সামান্য কছিু আভাস ইংগিত দিতেন। জানিয়ে দিতেন যে, যেদিকে রওয়ানা হচ্ছি আসল গন্তব্য তা থেকে আলাদ। কিন্তু তাবুক অভিযানের বেলায় সর্ম্পূর্ণ ভিন্ন রকম ব্যাপার ঘটলো। এক্ষেত্রে গন্তব্যস্থলের কথা সবাইকে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিলেন। কেননা গন্তব্যস্থান ছিল অনেক দূরের, সময়টা ছিল অত্যন্ত নাজুক এবং শত্রুর সংখ্যাধিক্যও ছিল গুরুতর পর্যায়ের। তাই লোকেরা যাতে অভিযানের জন্য যথোপযুক্তভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে সেজন্য আগেভাগে তিনি সবকিছুই জানিয়ে দিলেন। তিনি মুসলমানগণকে প্রস্তুত হতে বললেন এবং জানালেন যে, এবার মুকাবিলা রোম সম্রাটের সাতে। এই প্রস্তুতি চলাকালে একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু সালামা গোত্রের জাদ্দ ইবনে কায়েসকে বললেন, “হে জাদ্দ, এ বছর রোমানদের সাথে লড়তে তুমি কি প্রস্তুত?” সে বললো, “হে রাসূলুল্লাহ, আমাকে (পাপের) ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করার চাইতে আমাকে বাড়ীতে থাকবার অনুমতি দেবেন কি? আল্লাহর কসম, আমার গোত্রের লোকেরা জানে যে, আমি নারীদের প্রতি যতখানি দুর্বল, অতটা খুব কম লোকই আছে। রোমান মেয়েদের দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না বলে আমার আশংকা।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ব্যাপারে আর মাথা ঘামালেন না। তিনি বললেন, “তোমাকে অনুমতি দিলাম।” জাদ্দ ইবনে কায়েস সম্পর্কে এই আয়াত নাযিল হয়-
[আরবী ********]
“তাদের মধ্যে কেই কেউ বলে, ‘আমাকে বাড়ীতে থাকবার অনুমতি দিন, ফিতনার মধ্যে ফেবেন না।’ জেনে রেখো, তারা ফিতানার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েই আছে। জাহান্নাম নাফরমানদের ঘেরাও করেই রেখেছে।” অর্থাৎ সে রোমান নারীদের প্রতি আসক্ত হবার আশংকা বোধ করেছিল। আসলে সে আশংকা তার ছিল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে জিহাদে না গিয়ে এবং নিজের স্বার্থকে অগ্রধিকার দিয়ে সে বরং আরো বড় বিপদের ঝুঁকি নিয়েছে। তার জন্য নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নাম।
মুনাফিকরা একে অপরকে বললো, “এত প্রচন্ড গরমে তোরা সফরে যেও না।” তারা এভাবে জিহাদ থেকে ফিরে থাকতে সচেষ্ট ছিল ও সত্যের পথে দ্বিধা-সংশয়ে লিপ্ত হয়েছিল। আল্লাহ তা’য়ালা তাদের সম্পর্কে নাযিল করলেন-
“তারা বললো, গরমের মধ্যে সফরে যেও না। (হে নবী) তুমি বলে দাও, দোযখের আগুন সর্বাধিক গরম। তারা যদি তা বুঝতো (তাহলে এমন কথা বলতো না) অতএব তারা যেন কম হাসে এবং বেশী কাদে। তাদের অপকর্মের শাস্তি তাদের পেতেই হবে।”
ইবনে ইসহাক বলেনঃ
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরের আয়েঅজন চালাতে লাগলেন এবং মুসলিম জনগণকে দ্রুত গ্রস্তুতি সম্পন্ন করতে বললেন। বিত্তবান মুসলমানগণকে তিনি সওয়ারীর পশু, টাকা-পয়সা ও রসদপত্র ইত্যাদি দিয়ে আল্লাহর পথে সাহায্য করতে উৎসাহিত করতে লাগলেন। ধনী মুসলমানগণ অনেক সাহায্য দিলেন এবং আল্লঅহর সুন্তুষ্টিকেই তারা যথেষ্ট মনে করতে লাগলেন। উসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আন্হু এই সময় সকলের চাইতে বেশী দান করেন। [৮৬. ইবনে হিশাম বলেছেন, তাবুক অভিযাত্রী অভাব পীড়িত মুসলিম জন্য তিনি এক হাজার দিনার দান করেন। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত খুশী হন যে, তিনি দোয়া করেন, “হে আল্লাহ! তুমি উসমানের ওপর সন্তুষ্ট হও। আমি তার ওপর সন্তুষ্ট।”]
আনসার ও অন্যান্যদের মধ্য থেকে সাতজন মুসলমান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে সওয়ারী জানোয়ার চাইলেন। তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে সওয়ারীর বাহন সরবরাহ করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। ফলে তারা জিহাদে যেতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে যান। ইতিহাসে এরা ‘বাকাউন’ অর্থাৎ ক্রন্দনকারী নামে পরিচিত। এরা হলেন: বনু আমর ইবনে আওফ গোত্রের সালেম ইবনে উমাইর, বনু হারেসার উলবা ইবনে যায়িদ, বনু মাজেনের আবু লায়লা আবদুর রহমান, বনু সালমার আমর ইবনে হুমাম ও আবদুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল মুযানী। কেউ কেউ বলেন আবদুল্লাহ ইবনে আমর, বনু ওয়াফেকের হারমী ইবনে আবদুল্লাহ এবং বুন ফাজারার ইরবাদ ইবনে সারিয়া রাদিয়াল্লাহ আনহুম।
বর্ণিত আছে যে, এদের মধ্যে দু’জন আবু লায়লা আবদুর রহমান ও আবদুল্লাহ বিন মুগাফফালকে কাঁদতে দেখে ইবনে ইয়ামীন ইবনে উমাইর জিজ্ঞেস করেন, “ তোমরা কাঁদছ কেন?” তারা বললেন, “আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়েছিলাম তাবুক অভিযানে যাওয়ার জন্য সওয়ারী চাইতে। কিন্তু তিনি দিতে পারেননি। আমাদের কাছেও এমন কিছু নেই যা দ্বারা তাঁর সাথে অভিযানে যেতে পারি।” তখন ইবনে ইয়ামীন তাদেরকে একটা উট এবং কিছু খোরমা দিলেন। তাঁরা ঐ সওয়ারীতে চড়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অভিযানে চলে গেলেন। বেদুইন মুসলমানদের একদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে নানা রকম ওপর পেশ করে এবং অভিযানে না যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে। আল্লাহ তাদেরকে অনুমতি দেননি। কারো কারো মতে তারা ছিল বনু গিফার গোত্রের লোক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে সফর শুরু হলো। কিছুসংখ্যক নিষ্ঠাবান ও খালিছ মুসলমান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে অীভযানে অংশগ্রহণে বিরত থাকেন। তাদের ঈমান সম্পর্কে কারো কোন অভিযোগ ছিল না। কেবল সংকল্পের দৃঢ়তা দেখাতে না পারাই ছিল তাদের পিছিয়ে থাকার কারণ। মদীনার উপকণ্ঠে অবস্থিত পার্বত্য পথ সানিয়াতুল ওয়াদাতে তিনি সেনাবাহিনী চালিত করলেন। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার অধীনস্থ লোকদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করে সানিয়াতুল ওয়াদা’র নীচ দিয়ে যে পথ জুবাব পর্বতের দিকে গিয়েছে সেই পথে চালিত করলো। অনেকের মতে, এই বাহিনেিত বিপুল সংখ্যক লোক ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বাহিনী অনেক দূর এগিয়ে গেলে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার সহযাত্রী মুনাফিক ও সংশয়বাদীদের নিয়ে মদীনায় ফিরে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী ইবনে আবু তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তাঁর পরিবার-পরিজনের তত্ত্বাবধানের জন্য রেখে গেলেন। তাঁকে তিনি পরিবার-পরিজনের সাথে থাকতে বললেন। মুনাফিকরা তাঁকে কেন্দ্র করে নানা রকমের অপবাদ রটনা করলো। তারা বলতে লাগলো যে, আলীকে অলস মনে করে তার থেকে অব্যাহতি লাভের জন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে রেখে গিয়েছেন। মুনাফিকদের এইসব কথা শুনে আলী (রা) অস্ত্রসজ্জিত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলেন। তিনি তখন মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে জুরফ নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন- যেখানে উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) ও মদীনার আরো অনেকের জমিজমা ছিল। আলী (রা) বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, মুনাফিকরা মনে করেছে যে, আপনি আমাকে অলস মনে করে আমার থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য রেখে এসেছেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বললেন, “তারা মিথ্যা বলেছে। আমি তোমাকে আমার ও তোমার পরিবা-পরিজনের দেখাশুনার জন্য রেখে এসেছি। হে আলী! মূসা (আ) হারুন (আ) কে যে পর্যায়ে রেখেছিলেন তোমাকে যদি আমি সেই পর্যায়ে রাখি তাহলে তুমি কি খুশী নও? কেননা আমার পরে আর কেউ নবী হবে না।” একথা শোনার পর আলী (রা) মদীনায় ফিরে গেলেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিযানেব রওনা হয়ে গেলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী তাবুক অভিযানে রওনা হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পর আবু খাইসামা (রা) তাঁর পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে এলেন। দেখলেন, তাঁর দুই স্ত্রী বাগানের ভেতরে নিজ নিজ তাঁবুতে অবস্থান করছে। উভয়ে নিজ নিজ তাঁবুতে পানি ছিটিয়ে ঠান্ডা করে রেখেছে। তিনি এসে তাঁবুর দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে ভেতরে তার দুই স্ত্রীর প্রতি নজর দিলেন এবং তাঁর আরাম-আয়েশের জন্য তারা যে ব্যবস্থা করে রেখেছে তাও দেখলেন। তখন সংগতভাবে বললেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোদ, বাতাস ও গরমে কষ্ট পাচ্ছেন আর আবু খাইসামা কিনা ঠান্ডা ছায়ার সুন্দরী নারীর সাহচর্যে নিজ ভুমি ও সহায়-সম্পদের ভেতরে বসে তৈরী খাদ্য খাবে? এটা কখনো ঠিক হবে না। আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের কারো তাঁবুতে ঢুকবো না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাবো। তোমরা আমাকে জিহাদী সাজে সজ্জিত করে দাও।” তারা তাঁর সাজ-সরঞ্জাম গুছিয়ে দিলেন। অতঃপর তাঁর উট এগিয়ে দেয়া হলো। আবু খাইসামা রওয়ানা হলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্ধানে দ্রুত ছুটলেন। তিনি তাঁবুতে অবস্থান নেওয়ার পর আবু খাইসামা সেখানে উপনীত হলেন। পথিমধ্যে অপর এক সাহাবা উমাইর ইবনে ওয়াহাব জুমাহী আবু খাইসামার সঙ্গী হলেন। তিনিও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভিযানে অংশগ্রহন করতে যাচ্ছিলেন। তাঁরা উভয়ে যখন তাবুকের কাছাকাছি হয়েছেন তখন আবু খাইসামা উমাইরকে বললেন, “আমি একটা গুনাহ করে ফেলেছি। কাজেই তুমি একটু আমার পেছনে পড়লে তোমার কোন ক্ষতি হবে না। আমাকে আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের কাছে পৌছতে দাও।”
তাবুকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছাকাছি পৌছলে সাহাবীগণ তাঁকে দেখে বললেন, “একজন উষ্ট্রচালক এদিকে এগিয়ে আসছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “সম্ভবতঃ আবু খাইসামা।” সাহাবীগণ বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আবু খাইসামাই তো।” কাছে এসে উট থেকে নেমে আবু খাইসামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম জানিয়ে তাঁর কাছে গেলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আবু খাইসামা, তুমি উপযুক্ত কাজই করেছো।” [৮৭. মূল শব্দটি হলো [আরবী ***] (আওলা লাকা) পবিত্র কুরআনে কয়েক জায়গায় এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে তাফসীরকারগণের কেউ কেউ এর এরূপ অর্থও করেছেন, ‘তুমি ধ্বংসের নিকটবর্তী হয়েছিলে।’ তবে এ ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ প্রথম অর্থটাই প্রযোজ্য। অর্থাৎ ‘তুমি তোমার উপযুক্ত কাজই করেছ।’] অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে মোবারকবাদ দিলেন ও তাঁর জন্য দোয়া করলেন।
তাবুক যাওয়ার পথে সমৃদ্ধ জাতির বাসস্থান ‘হিজর’ অতিক্রম করা কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লঅম সেখানে স্বল্প যাত্রাবিরতি করেন। কোন কোন সাহাবী সেখানকার কূয়া থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে গেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাবধান করে দেন যে, এখানকার পানি কেউ পান করো না এবং তা দিয়ে অযু করো না। এখঅনকার পানি দিয়ে কেউ আটা বানিয়ে থাকলে তা ঘোড়াকে খেতে দাও তোমরা খেয়ো না। রাতে এখঅনে কেউ একাকী বের হয়ো না। প্রায় সকল সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ মেনে চললেন। কেবল বনু সায়েদা গোত্রের দুইজন একাকী রাতে বের হয়েছিলেন। একজন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এবং অপরজন তার হারানো উটের সন্ধানে। যিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেন তিনি যে স্থানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গেলেন সেখানেই বেহুঁশ হয়ে গেলেন। আর যিনি উটের সন্ধানে বেরুলেন তিনি প্রবল বাতাসে উড়ে গিয়ে ‘তাই’ পর্বতে নিক্ষিপ্ত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ব্যাপারটা জানানো হলে তিনি বললেন, “আমি কি তোমাদেরকে একাকী বেরুতে নিষেধ করিনি?” অতঃপর যে ব্যক্তি পায়খানা করতে গিয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার জন্য দোয়া করলেন এতে তিনি সুস্থ হয়ে উছলেন। আর যিনি ‘তাই’ পর্বতে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তাকে তাই গোত্রের লোকেরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা ফিরে যাওয়ার পর তাঁর কাছে পৌছিয়ে দেন।
পরদিন সকালে দেখা গেল, কাফিলায় কারো কাছে এক ফোটা পানিও নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা জানানো হলে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। আল্লাহ একখন্ড মেঘ পাঠিয়ে বৃষ্টি বর্ষণ করলেন এবং তাতে সকলের প্রয়েঅজন পূর্ণ হলো। সবাই পরবর্তী সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করেও রাখলেন।
তাবুক যাওয়ার পথে আর একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উট হারিয়ে গেল। সাহাবীগণ উট খুঁজতে বেরুলেন। এই সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উমার ইবনে হাযম নামে আকাবার বাইয়াতে ও বদর যুদ্ধে অংশগ্রহনকারী জনৈক সাবাহী ছিলেন। তিনি ছিলেন বনু আমরের বিশিষ্ট প্রবীণ ব্যক্তি। তাঁর দলে ভেতরে যায়িদ ইবনে লুছাইত নামক বনু কাইনুকা গোত্রের জনৈক মুনাফিক ছিল।
উমারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থিত থাকাবাস্থায় তাঁর দলবলের কাছে বসে উক্ত যায়িদ ইবনে লুছাইত বললো, “আচ্ছা, মুহাম্মাদ তো দাবী করেন যে, তিনি নবী এবং তিনি তোমাদেরকে আকাশের খবর জানা। তিনি এতটুকু জানেন না যে, তাঁর উট কোথায়? ঠিক সেই মুর্হুতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমারার (রা) উপস্থিতিতেই বললেন, “একজন লোক বলছে যে, মুহাম্মাদ নিজেকে নবী বলে দাবী করে থাকেন এবং তোমাদেরকে আসমানের খবরাদি জানা, তিনি কেন তাঁর উট কোথায় তা জানেন না? আল্লাহর কসম, আল্লাহ যেটুকু আমাকে জানিয়েছেন সেইটুকু ছাড়া আমি কিছুই জানি না। আল্লাহ আমাকে উটের সন্ধান দিয়েছেন। এই উপত্যকার ভেতরেই তা অমুক জায়গায় রয়েছে। একটি গাছের সাথে তার লাগাম আটকে গেছে। তোমরা গিয়ে উটটাকে নিয়ে এস।” সাহাবীগণ গিয়ে উট ধরে আনলেন। অতঃপর উমারা (রা) তাঁর দলবলের কাছে ফিরে গেলেন। গিয়ে বললেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এইমাত্র আমাদের কাছে এক বিস্ময়কর খবর জানালেন। আমাদের বাহিনীর মধ্যে কে নাকি এরূপ কথা বলেছে এবং আল্লা তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন।” এই বলে তিনি যায়িদ ইবনে লুছাইতের কথঅ বলেছে ব্যক্ত করলেন। তখন উমারার (রা) দলের একজন যিনি দলের অভ্যন্তরেই ছিলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের নিকট যাননি- বললেন, “আল্লাহর কসম, যায়িদই এ কথা বলেছে।” তখন উমারা (রা) যায়িদের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার ঘাড়ে আঘঅত করে বললেন, “হে আল্লাহর বান্দারা, আমার কাছে এস। আমার কাফিলায় একটা সাপ লুকিয়ে আছে, আমি তা জানতেও পারিনি। হে আল্লাহর দুশমন, বেরিয়ে যা আমার কাফিলা থেকে। আমার সাথে আর থাকিস না।”
বর্ণিত আছে যে, এরপর যায়িদ তাওবাহ করেছিল। আবার কেউ কেউ বলেন, মৃত্যুকাল পর্যন্তই যায়িদ মুনাফেকী অব্যাহত রাখঅর দায়ে অভিযুক্ত ছিল।
যাত্রাপথে মাঝে মাঝে দুই একজন মুসরিম বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ফিরে যাচ্ছিল। মুসলমানগণ এ ধরনের কোন লোকের ফিরে যাওয়ার কথা জানালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, “যেতে দাও। যদি তার মধ্যে সত্যপ্রীতি থেকে থাকে তাহলে আল্লাহ আবার তাকে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে আনবেন। অন্যথায় আল্লাহ তার সাহচর্য থেকে তোমাদেরকে অব্যাহতি দিলেন। ভালই হলো।” এক সময় বলা হলো, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আবু যারও পিছিয়ে গেছে। তাঁর উট তাকে পিছিয়ে দিয়েছে।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “পিছিয়ে যায় তো যাক। যদি তার মধ্যে কল্যাণ থেকে থাকে তাহলে আল্লাহ তাকে তোমাদের মধ্যে ফিরিয়ে আনবেন। আর যদি তা না হয় তাহলে মনে করবে আল্লাহ তোমাদেরকে তার হাত থেকে রেহাই গিয়েছেন।: আবু যার (রা) তাঁর উটকে দ্রুত চালানের অনেক চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাতে কোন ফলোদয় হলো না। অগত্যা তিনি নিজের সাজ-সরঞ্জাম ও রসদপত্র ঘাড়ে করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদানুসরণ করে হাঁটতে শুরু করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক জায়গায় এসে যাত্রাবিরতি করলে তিনি তাঁর সাথে এসে মিলিত হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে একাকী হেঁটে আসতে দেখে বললেন, “আল্লাহ আবু যারের ওপর রহমত বর্ষণ করুন। সে একাই চলে, একাই মরবে এবং পুনরায় একাই আল্লাহর সামনে হাজির হবে।” আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেন, উসমান (রা) তাঁর খিলাফাতকালে যখন আবু যারকে (রা) রাবয়াতে নির্বাসিত করেন তখন সেখানে তাঁর কাছে তাঁর স্ত্রী ও ভৃত্য ছাড়া আর কেউ ছিল না। তিনি তাঁদেরকে এই বলে অছীয়ত করেন যে “আমি মারা গেলে তোমরা আমাকে গোসল ও কাফন দিয়ে রাস্তার ওপর রেখে দিও। অতঃপর সর্বপ্রথম যে কাফিলা তোমাদের কাছ দিয়ে যাবে, তাকে বলবে, এই লোকটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী আবু যার। তাঁকে দাফন করতে তোমরা আমাদের সাহায্য কর।” মৃত্যুর পরে স্ত্রী ও ভৃত্য অছীয়ত মুতাবিক কাজ কররেন এবং তাঁর লাশ রাস্তার ওপর রেখে দিলেন। এই সময় ইরাক থেকে একদল উমরাহ যাত্রীর সাথে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) যাচ্ছিলেন। দলটি রাস্তার ওপর পড়ে থাকা লাশটি দেখে থমকে দাঁড়ালো। অল্পের জন্য তা দলের উটের পাদতলে পিষ্ট হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। ভৃত্যটি তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী আবু যার (রা)। তাঁকে দাফন করতে আমাদেরকে সাহায্য করুন।” আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ কাঁদতে লাগলেন। বললেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যই বলেছেন, তুমি একই চল, একাই মরবে এবং একাই পুররুজ্জীবিত হবে।” অতঃপর তিনি ও তাঁর সহযাত্রীরা নেমে তাঁকে দাফন করলেন। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ তাদেরকে তাবুক যাত্রাপথে আবু যারের (রা) ঘটনা ও তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অসাল্লাম যে কথা বলেছিলেন তা বর্ণনা করলেন। অতঃপর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ তাদেরকে তাবুক যাত্রাপথে আবু যারের (রা) ঘটনা ও তাঁকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কথা বলেছিলেন তা বর্ণনা করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাবুক পৌছলে আয়লার শাসক ইউহান্না ইবনে রোবা তাঁর কাছে হাজির হয়ে জিযিয়া দিয়ে সন্ধি করলো। অনুরুপভাবে জাবরা আজরুহর অধিবাসীরাও এসে জিযিা দিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নিম্নরুপ সন্ধিপত্র লিখে দিলেনঃ
“বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের তারফ থেকে ইউহান্না ইবনে রোবা ও আয়ালাবাসীর জন্য এবং তাদের সকল নৌ ও স্থল যানসমূহের জন্য নিরাপত্তা ঘোষনা করা যাচ্ছে। তাদের জন এবং তাদের সহযোগী সিরিয়া, ইয়ামান ও সাগররবাসীর নিরাপত্তার জন্য আল্লাহর রাসূল পূর্ণ দয়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যদি কেউ এই সন্থির বরখেলাফ কিছু করে তবে সে তার অর্থবিত্ত বলে শাস্তি থেকে অব্যাহতি লাভ করতে পারবে না। যে যার ক্ষতি সাধন করবে, তার কাছ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করা তার জন্য বৈধ হবে। তারা যে কোন জলাশয়ের পানি ব্যবহার করতে পারবে এবং যে কোন নৌ ও স্থল পথে চলাচল করতে পারবে। কেউ তাতে বাধা দিতে পারবে না।”
দুমার শাসনকর্তা উকায়দের – এর নিকট রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক খালিদ ইবনে ওয়ালদীকে প্রেরণ
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদ ইবনে ওয়ালীদকে দুমাতুল জান্দালের শাসক উকায়দের ইবনে আবদুল মালিকের নিকট প্রেণ করলেন। উকায়দের কান্দা গোত্রের একজন খৃষ্টান ছিল এবং সেখানকার বাদশাহ ছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদকে বলে দিলেন, “তুমি গিয়ে দেখবে উকায়দের গরু শিকার করছে।”
গ্রীষ্মের জ্যোৎ¯œা রাতে উকায়দের যখন ছাদের ওপর স্ত্রীসহ বসেছিল, তখন খালিদ তার দুর্গের দৃষ্টি সীমার ভেতরে পৌছে গেলেন। একটি বন্য গরু ঐ সময় উকায়দেরের প্রসাদের দরজায় শিং গিলে গুতোতে লাগলো। তার স্ত্রী বললো, “এমন গরু আর কখনো দেখেছো?” সে বললো, ‘না’। স্ত্রী বললো, “তাহলে এমন শিকার হাতছাড়া করা কি উচিত?” সে বললো, “কখখনো না।” এই বলেই সে নীচে নামালো এবং ঘোড়ায় সওয়ার হলো। সে নিজে এবং তার ভাই হাসানসহ পরিবারের বেশ কয়েকজনকে নিয়ে সে শিকারের পছেনে ছুটলো। বাইরে বেরিয়েই তারা সালূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রেরিত বাহিনীর হাতে ধরা পড়লো। উকায়দেরের ভাই হাসান মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত হলো। তার পরিধানে ছিল স্বর্ণের জরিদার একটি রেশমী জামা। খালিদ (রা) সেটা খুলে নিলেন এবং নিজে মদীনায় যাওয়ার আগেই একজনকে দিয়ে মদীনায় পাঠিয়ে দিলেন।
আনাস ইবনে মালিক (রা) বলেন, উকায়দেরের জামা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌছানো হয়েে আমি তা দেখেিেছ। মুসলমানগণ তা হাত দিয়ে স্পর্শ করে বিস্মিত হচ্ছিল দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “এইটে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছ? আল্লাহর কসম, জান্নাত সা’দ ইবনে মু’য়াযের জন্য যে রুমাল রয়েছে তা এর চেয়েও ভাল।”
ইবনে ইসহাক বলেন, খালিদ উকায়দেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি তাকে প্রাণের নিরাপত্তা দিয়ে জিযিয়ার বিনিময়ে সন্ধি করলেন এবং মুক্ত করে দিলেন। সে তার এলাকায় ফিরে গেল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম তাবুক থেকে সম্মুখে অগ্রসর হলেন না। বরং সেখানেই দশদিন অবস্থান করলেন। তারপর মদীনায় ফিরে এলন। পথিমধ্যেওয়াদিউল মুশাককাক উপত্যকায় একটা ক্ষুদ্র পাহাড়ী ঝর্ণা ছিল। তার পানি দ্বারা বড়জোর দুই বা তিনজন পথিকের পিপাসা নিবৃত্ত হতে পারে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আগে যারা ঐ উপত্যকায় পৌছবে, তারা যেন আমরা না আসা পর্যন্ত পানি পান না করে অপেক্ষ কের।” কিন্তু সবার আগে একদলমুনাফিক সেখানে পৌছে এবং সেখানে যেটুকু পানি ছিল তা পান করে ফেরে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে পৌছে দেখলেন একটু পানিও নেই। তিনি বললেন, “আমাদের আগে কে এখানে এসেছে?” তাকে জানানো হলো যে, অমুক অমুক প্রথমে সেখানে এসেছে। তিনি বললেন, “আমি তো নিষেধ করেছিলাম যে,, আমি এসে পৌছার আগে কেউ পানি পান করবে না।” অতঃপর তিনি ঐ মুনাফিকদের অভিশাপ ও বদদোয়া করেন। তারপর তিনি সওয়ারী থেকে নেমে পাহাড়ের পাদদেশে হাত রাখলেন। তৎক্ষনাৎ আল্লাহর ইচ্ছায় বিপুল পরিমাণ পানি গড়িয়ে পড়তে থাকলো। অতঃপর সেখান থেকে পানি পান কররেন, পাহাড়ের ঐ স্থানটায় হাত বুলালেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকের মত প্রবল গর্জনে পানির ফোয়ারা ছুটলো। লোকেরা তৃপ্ত পানি পান ও অন্যান্য প্রয়েঅজন পূর্ন করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা যদি দীর্ঘ আয়ু পাও তাহলে ভবিষ্যতে এই উপত্যকার খ্যতি শুনতে পাবে এবং এই পানি উপত্যকার আশপাশের এলাকাকে উর্বর করে তুলবে।”
ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেনঃ আবু রুহাম গিফারীর ভ্রাতুষ্পুত্র থেকে ইবনে উকায়মা লায়সী এবং লায়সী থেকে ইবনে শিহাব যুহরী বর্ণনা করেছেন যে,, আবু রুহাম কুলসুম ইবনে হুসাইন যিনি ‘বাইয়াতুল রিদওয়ান’ এ অংশগ্রহণকারী অন্যতম সাহাবী ছিলেন, বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে তাবুক অভিযানে যোগদান করেছিলাম। তাঁর সাথে সফর করছিলাম। একদিন রাতে যখন তাবুকের পার্শ্ববর্মী আখদার অতিক্রম করছিলাম তখন আল্লাহ আমাদের ওপর ঘুম চাপিয়ে দিলেন। যেহেতু আমার সওয়ারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের ওসয়ারীর একেবারে নিকটবর্তী ছিল এবং দুটো কাছাকাছি হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পায়ে আমার সওয়ারীর আঘাত লাগতে পারে এই আশংকায় আমি জেগে থাকতে এবং আমার সওয়ারীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সওয়ারা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম। এই অবস্থায় পথিমধ্যে রাতের একাংশে আমার ঘুম অদম্য হয়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে আমার সওয়ারী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সওয়ারীর সাথে গায়ে গায়ে লেগে গেল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘উহ’ শব্দে আমি জেগে উঠলাম। বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন।” তিনি বললেন, “চলতে থাক।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু গিফারের কে কে অভিযানে আসেনি তা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন আর আমি তার জবাবে যেসব লোক আসেনি তাদের নাম বলতে লাগলাম। তিনি বললেন, “পাতলা দাড়ি ও ভ্রুওয়ালা লম্বা লালচে বর্নের লোকগুলোর খবর কি?” আমি তাঁকে তাদের না আসার কথা বললাম। তিনি বললেন, ‘সবলদেহী খর্বাকার কালো লোকগুলো কি করেছে?” আমি বললাম, “আমাদের মধ্যে এ ধরনের কাউকে আমি দেখছি না।” তিনি বললেন, “হিজাযের গিফার ও আসলামের বসতি এলাকয় যাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে?” আমি তাদের কথা বনু গিফারের প্রসঙ্গেই স্মরণ করতে চেষ্টা করেচিলাম। কিন্তু মনে পড়েনি। অবশেষে আমার মনে পড়লো যে, তারা বনু আসলামের একটা গোষ্ঠী যাদের সাথে আমাদের মৈত্রী বন্ধন ছিল। আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা বনু আসলামের একটি গোষ্ঠী যাদের সাথে আমাদের মৈত্রী বন্ধন ছিল। আমি বললাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা বনু আসলামের একটি গোষ্ঠী যারা আমাদের মিত্র ছিল।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তারা অন্ততঃ নিজেদের একটা উট দিয়ে একজন সক্ষম যোদ্ধাকে আল্লাহর পথে জিহাদে আসতে সাহায্য করতে পারতো। এতে তাদের কোন বাধা ছিল না। আমার সঙ্গীদের ভেতরে আর যে যাই করুক, কুরাইশ মুহাজির, আনসার, বনু গিফার ও বনু আসলামের লোকদের আমার সাথে না আসা আমার কাছে সবচেয়ে বেশী কষ্টদায়ক।
নবম হিজরীর রমযান মাসে বনু সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধিদলের আগমন ও ইসলাম গ্রহণ
ইবনে ইসহাক বলেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে তাবুক থেকে মদীনায় ফিরে আসেন এবং সেই মাসেই তাঁর কাছে বনু সাকীফ গোত্রের প্রতিনিধিদল আসে। এই প্রতিনিধিদল আগমনের পটভূমি এই যে, ইতিপূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তায়েফ থেকে ফিরে আসেন তখন উরওয়া ইবনে মাকউদ সাকাফী তাঁর পিছু পিছু আসেন। মদীনায় পৌছারআগেই তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে মিলিত হন এবং ইসলাম গ্রহন করেন। অতঃপর তিনি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে নিজ গোত্রে ফিরে যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “ওরা তোমাকে হত্যা করবে।” তিনি বনু সাকীফ গোত্রের গোঁয়ার্তুমি ও একগুয়েমীর কথা জানতেন। তিনি এও জানতেন যে, তারা নিজস্ব কোন লোকের দাওয়াত অগ্রাহ্য করতেই অভ্যস্ত। কিন্তু উরওয়া বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি তাদের কাছে নবজাতক শিশুর চেয়েও প্রিয়।”
তিনি প্রকৃতই তাদের কাছে অনুরূপ প্রিয় ও মান্যগণ্য ছিলেন। অনন্তর তিনি নিজ গোত্রের কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানালেন। তাঁর আশা ছিল গোত্রের মধ্যে তাঁর যতখালিন মর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তি রয়েছে তাতে কেউ হয়তো তাঁর বিরোধিতা করবে না। তিনি নিজ গোত্রের ছাদের ওপর থেকে গোত্রের লোকদেরকে যথাযথভাবে দাওয়াত দিয়ে ও নিজের ইসলাম গ্রহণের কথা জানিয়ে যখন তাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন, তখন চারদিক থেকে তাকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করা হয়। একটি তীর তাকে আঘাত করে এবং তাতেই তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
বনু মালিকের মতে তাকে হত্যা করে বনু সালেম ইবনে মালিকের আওস ইবনে আওফ এবং তার মিত্রদের মতে তাকে হত্যা করে বনু আত্তাব ইবনে মালিকের ওয়াহাব ইবনে জাবের। (বনু সালেম ও বনু আত্তাব বনু সাকীফের শাখা বনু মালিকভুক্ত পরিবার)। উরওয়া আহত হওয়ার পর তাকে বলা হয়, “আপনার হত্যা সম্পর্কে আপনার মতামত কি?” তিনি বলেন, “এটা আল্লাহর তরফ থেকে আমার জন্য এক পরম সম্মান ও গৌরব। আল্লাহ নিজেই আমাকে শাহাদাতের এই গৌরবে ভূষিত করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের এই স্থান থেকে ফিরে যাওয়অর আগে তাঁর সাথে আগত যেসব মুজাহিদ শাহাদাত লাভ করেছেন, তাদের থেকে আমার মর্যাদা মোটেই বেশী নয়। কাজেই আমাকে তোমরা তাদের কাছেই দাফন করো।”
কথিত আছে যে, উরওয়াহ ইবনে মাসউদের শাহাদাতের খবর শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মন্তব্য করেন, “সূরা ইয়াসীনে যে মুজাহিদের শাহাদাতের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে উরওয়া তার সাথে তুলনীয়।”
উরওয়াকে হত্যা করার পর এক মাস বনু সাকীফ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর তারা একটি পরামর্শ বৈঠকে মিলিত হলো। তারা স্থির কররো যে,, চারপাশের গোটা আরব জাতি যেখানে ইসলাম গ্রহণ করেছে সেখানে বনু সাকীফ একাকী তাদের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে সক্ষম নয়। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তারা স্থির করলো যে, পূর্বে যেমন তারা উরওয়াকে পাঠিয়েছিল তেমনি এবার আর একজনকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পাঠাবে। এ উদ্দেশ্যে তারা উরওয়অ ইবনে মাসউদের সমবয়সী জনৈক আবদ ইয়ালীল ইবনে আমরের সাথে আলাপ করলো এবং তাকে বনু সাকীফের প্রতিনিধি হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে ফিরে আসবে তখন বনু সাকীফ উরওয়ারর সাথে যে আচরণ করেছে তার সাথেও অনুরূপ আচরণ করবে। সে বললো, “আমার সাথে যদি আরো কয়েকজন লোক পাঠাও তাহলে আমি রাজী আছি, অন্যথায় নয়।” অবশেষে তারা ঠিক করলো যে, আব্দ ইয়ালীদের সাথে মিত্র গোত্রগুলো থেকে দু’জন এবং বনু মালিক থেকে তিনজন- সর্বমোট ছয়জনকে পাঠাবে। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে তারা আব্দ ইয়ালীলের সাথে বনু মুয়াত্তাব পরিবারের হাকাম ইবনে আমর ও শুরাহবীল ইবনে গাইলানকে এবং বনু মালিক গোত্র থেকে বনু ইয়াসার পরিবারের উসমান ইবনে আবুল আসকে, বনু সালেম পরিবার থেকে আওস ইবনে আওফকে এবং বনু হারেস পরিবারের নুমায়ের ইবনে খারাশকে পাঠালো। আবদ ইয়ালীল দলনেতা হিসেবে তাদের নিয়ে রওনা হলো। সে উরওয়া বিন মাসমউদের ভাগ্য বরণের ঝুঁকি মুক্ত হবার অভিপ্রায়েই এই লোকদের সাথে নিল যাতে প্রত্যেকে তায়েফে ফিরে নিজ নিজ গোষ্ঠীকে এতে জড়িত করতে পারে।
প্রতিনিধিদল মদীনার নিকটবর্তী হলে একটি ঝর্ণার পাশে সাহাবাগণের কেউ কেউ উট চরানো সময় মুগীরা ইবনে শু’বাকে (রা) দেখতে পেলো। ঐ উটগুলো পালাক্রমে চরানোর দায়িত্ব সাহাবীদের মধ্যেই ভাগ করা ছিল এবং ঐ সময়কার পালা ছিল মুগীরার। তাদের সাথে সাক্ষাত হওয়ার পর মুগীরা উটগুলোকে বনু সাকীফের প্রতিনিধিদের কাছে রেখেই ছুটে গেলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাদের আগমনের সুসংবাদ শোনানোর জন্য। মুগীরা (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাত করার আগে আবু বাক্র সিদ্দীকের (রা) সাথে দেখা হেরা। তিনি তাকে জানালেন যে, বনু সাকীফের প্রতিনিধিরা ইসলাম গ্রহণ করতে এসেছে। তবে তারা চাফ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন তাদেরকে কিছু সুযোগ সুবিধা দেন এবং তাদের ধন-সম্পদ, জমিজমা ও অধিবাসীদের নিরাপত্তা চিশ্চিত করে একটা অঙ্গীকারপত্র লিখে দেন। আবু বকর (রা) মুগীরাকে (রা) বলরেন, “আমি তোমাকে আল্লাহর নামে অনুরোধ করছি, তুমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে না গিয়ে আমাকে আগে যেতে দাও এবং এ বিষয়ে তাঁর সাথে আমাকে আলোচনা করতে দাও।” মুগীরা (রা) এতে সম্মত হলেন। আবু বাক্র (রা) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গেলেন এবং তাঁকে ঐ প্রতিনিধি দলের কথা জানারৈন। তারপর মুগীরা (রা) স্বগোত্রীয় বন্ধুদের কাছে ফিরে গেলেন। [উল্লেখ্য যে, মুগীরা (রা) বনু সাকীফ বংশোদ্ভুত ছিলেন]। দুপুর বেলা তিনি তাদের সাথে বিশ্রাম করেই কাটিয়ে দিলেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইসলামী অভিবাদন জানানোর রীতি শিখিয়ে দিলেন। কিন্তু সাক্ষাতের সময় তারা জাহিলী রীতি অনুসারেই অভিবাদন জানালো।
প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে হাজির হলে মসজিদে নববীর এক পাশে তাদের অবস্থানের জন্য একটি ঘর ঠিক করে দেয়া হয়। বনু সাকীফের জন্য একটি অঙ্গীকার পত্র লোকানো পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও প্রতিনিধিদলের মধ্যে মত বিনিময় হয় খালিদ ইবনে সাঈদ ইবনে আসের মাধ্যমে এবং এই খারিদই অঙ্গীকার পত্র লিখে দেন। এই সময়ে অঙ্গীকার পত্র লেখানো ও প্রতিনিধিদলের ইসলাম গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে আসা খাদ্যদ্রব্যও প্রথমে খারিদ না খেলে প্রতিনিধিদলের লোকজন খায়েনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তারা যেসব সুযোগ সুবিধা দাবী করে তার মধ্যে একটি ছিল, ‘তগিয়া’ অর্থাৎ লাভের পূজা অব্যাহত রাখতে দিতে হবে এবং তিন বছরের মধ্যে তা ভাঙ্গা চলবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। পরে তারা মেয়াদ কমিয়ে এক বছর করে। তাও প্রত্যাখ্যান করা হলে তারা কমাতে কমাতে এক মাসে নামিয়ে আনে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাও প্রত্যাখ্যান করেন। প্রতিনিধিদল এই দাবীর যে উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে তাছিল এই যে, তারা তাদের গোত্রের অর্বাচীন শ্রেনী, তরুণ বংশধর ও নারীদের রোষানল থেকে রক্ষা পেতে চান এবং গোত্রের লোকেরা ইসলামে দীক্ষা নেওয়ার আগে মূর্তি ধ্বংস করার শাদ্যমে তাদের মধ্যে আতংক সৃষ্টি কার তাদের মনঃপূত ছিল না। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছুতেই এ দাবী মানলেন না। তিনি বরং জোর দিয়ে বললেন যে, তিনি অবিলম্বে ঐ মূর্তি ভাঙ্গার জন্য আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও মুগীরা ইবনে শু’বাকে (রা) পাঠাবেন। তারা এ দাবীও করেছিল যে, তিনি যেন তাদে নামায পড়তে এবং মূর্তিগুলোকে তাদের নিজ হাতে ভাঙ্গতে বাধ্য না করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফ সাফ বলে দিলেন যে,, নামায ছাড়া ইসলাম হতে পারে না তবে তোমাদের হাত দিয়ে মূর্তি ভাঙ্গতে বাধ্য করে হবে না। প্রতিনিধিদল নামাযকে মেনে নেয় ‘অবমাননাকর’ বলে মন্তব্য করেও তা মেনে নিতে সম্মত হলো।
অতঃপর তারা সবাই ইসলাম গ্রহণ করলো এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য অঙ্গীকারনামা লিখে দিলেন। তারপর তাদের আমীর নিযুক্ত করলেন উসমান ইবনে আসকে। তিনি ছিলেন দলের কনিষ্ঠতম সদস্য এবং কুরআন ও ইসলাম শিখতে অপেক্ষাকৃত বেশী আগ্রহী ছিলেন। আবু বাক্র (রা) তার সম্পর্কে এই বলে মন্তব্য করেন যে, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার কাছে উসমানই ইসলাম বুঝতে ও কুরআন শিখতে অধিকতর মনে হয়েছে।”
দায়িত্ব সমাপনান্তে প্রতিনিধিদল যখন তায়েফ অভিমুখে রওনা হলো, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু সুফিয়ান ইবনে হারব ও মুগীরা ইবনে শু’বাকে (রা) মূর্তি ভাঙ্গার দায়িত্ব অর্পণ করে তাদের সাথেই পাঠিয়ে দিলেন। তারা উভয়ে প্রতিনিধিদলের সাথে রওনা হয়ে গেলেন। তায়েফের উপকণ্ঠে পৌছে মুগীরা (রা) আবু সুফিয়ানকে (রা) আগে পাঠাতে চাইলেন। আবু সুফিয়ান তা অস্বীকার করে বললেন, “তুমি তোমার গোত্রের লোকদের সাথে আগে গিয়ে দেখা কর।” আবু সুফিয়ান ‘যুল হুদুম’ নামক জলাশয়ের কাছে থেকে গেলেন আর মুগীরা শহরে প্রবেশ করেই কোদাল নিয়ে লাভ ও অন্যান্য মূর্তি ভাঙ্গার জন্য তাদের ওপর চড়াও হলেন। মুগীরার (রা) গোতও বনু মুয়াত্তাব তাকে সহায়তা করলো এবং তা এই আশংকায় যে, তার পরিণতি যেন উরওয়া ইবনে মাসউদের মত না হয়। ওদিকে বনু সাকীফের মহিলারা মূর্তির জন্য মাতমকরতে করতে রাস্তায় বেরিয়ে এল। তারা বলতে লাগলো,
“রক্ষকের জন্য তোমরা কাঁদ [৮৮.মুশরিকরা লাতকে ‘দাফফা’ অর্থাৎ রক্ষক নামে অভিহি করতো। কেননা তারা বিশ্বাস করতো যে, লাত তাদেরকে শত্রু ও আপদ থেকে রক্ষা করে।] নিমকহারামেরা তাকে ছেড়ে চলে গেছে। [৮৯.অর্থাৎ বনু সাকীফের লোকেরা তাদের রক্ষকের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়ে গেছে এবং তাকে ধ্বংস হওয়ার জন্য মগীরার হাতে সোপর্দ করে চলে গেছে।]
তারা এর জন্য ভালো করে যুদ্ধও করলো না।” [৯০. অর্থাৎ রক্ষককে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ করতে আসা উচিত ছিল। কিন্তু কেউ সেজন্য এগিয়ে এলো না।]
অতঃপর মুগীরা যখন লাতকে কুঠার দিয়ে আঘাত করতে লাগলেন তখন আবু সুফিয়ান “আহা! আহা!” করতে লাগলেন।
লাতকে ধ্বংস করার পর মুগীরা মন্দিরের সমস্ত ধনরত্ন সংগ্রহ করে আবু সুফিয়ানের কাছে পাঠালেন। এই ধনরতেœর মধ্যে ছিল বিপুল পরিমাণ সোনা ও রেশমী দ্রব্যাদি।
উরওয়া ইবনে মাসউদ শহীদ হওয়ার পর তার ছেলে আবু মুলাইহ ও ভ্রাতুষ্পুত্র কারেব ইবনে আসওয়াদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সাক্ষাত করে এবং বনু সাকীফের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদেরকে চিরতরে ত্যাগ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে। এটা হচ্ছে ইয়ালীল প্রতিনিধিদলের আগমনেরও আগের ঘটনা। আবু মুলাইহ ও কারেব ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন, “তোমরা যাকে খুশী অভিভাবক হিসেবে গ্রহণ কর।” তারা বললেন, “আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করলাম।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম বললেন, তোমাদের মামা আবু সুফিয়ানকেও?” তারা বললেন, ‘হা’। পরে তায়েফবাসী ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুগীরা ও আবু সুফিয়ানকে লাভ ধ্বংস করতে পাঠালে আবু মুলাইহ বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, লাতর মন্দির থেকে যে ধনরত্ন উদ্ধার করা হবে তা থেকে আমার পিতার ঋণ শেঅধ করে দিন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মত হলে কারেব বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার পিতা আসওয়াদের ঋণও শোধ করে দিন।”উল্লেখ্য যে, উরওয়া ও আসওয়াদ আপন ভাই ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আসওয়াদ মুশরিক অবস্থায় মারা গেছে।”কারেব বললেন, “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আপনি একজন মুসরিম আত্মীয়কে অর্থাৎ আমাকে সাহায্য করুন। কেননা ঋণ আমার ঘাড়েই চেপে আছে এবং আমিই সাহায্য চাইছি।” তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্মত হলেন এবং আবু সুফিয়ানকে বলে দিলেন, “লাভের ধনরত্ন থেকে উরওয়া ও আসওয়অদের ঋণ শোধ করে দিও।” মুগীরা ধনরত্ন আবু সুফিয়ানের কাছে দেয়ার সময় তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওাসাল্লামের নির্দেশ স্মরণ করিয়ে দিলেন। আবু সুফিয়ান উরওয়া ও আসওয়াদের ঋণ শোধ করে দিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনু সাকীফের জন্য যে অংগীকারনামা লিখে দিলেন তা নিম্নরুপঃ “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে মু’মিনদের প্রতি। ওয়াজ্জের (তায়েফের একটি জায়গা) কষ্টময় বৃক্ষরাজি কাটা নিষিদ্ধ। যে ব্যক্তি এ আদেশ লংঘন করবে তাকে বেত্রাঘাত করা হবে। যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করবে তাকে পাকড়াও করে নবী মুহাম্মাদের কাছে পাঠিয়ে দিতে হবে। এটা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের নির্দেশ। এ ঘোষণাপত্র আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহর নির্দেশে খালিদ ইবনে সাঈদ কর্তৃক লিখিত। কেউ যেন এ ঘোষণাপত্র লংঘন না করে। লংঘন করলে তা নিজের জন্য শাস্তি ডেকে আনারই নামান্তর হবে। কেননা এটা আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের নির্দেশেই লিখিত।”
নবম হিজরী সালকে ‘প্রতিনিধিদল আগমনের বছর’ হিসেবে আখ্যায়িতকরণ। সূরা আন নাছর এই বছরই নাযিল হয়
ইবনে ইসহাক বলেন: মক্কা ও তাবুক বিজয়, বনু সাকীফের ইসলাম গ্রহণ ও আনুগত্যের শপথ প্রহণের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চারদিক থেকে আরবদের প্রতিনিধিদল আসতে শুরু করে।
আরবরা বলতে গেলে একমাত্র কুরাইশদের ইসলাম গ্রহণের অপেক্ষায় ছিল। তারাই ছিল আরবদের নেতা ও দিশারী। তারা ছিল কা’বা শরীফ ও মসজিদুল হারামের রক্ষক ও তত্ত্বাবধায়ক এবং ইসমাঈল ইবনে ইবরাহীমের (আ) অবিসম্বাদিত উত্তরপুরুষ। আরবের কেউ তা অস্বীকার করতো না। অথচ এই কুরাইশরাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরোধিতায় কোমর বেঁধে লেগেছিল। মক্কা বিজয়ের সাথে সাথে কুরাইশরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নত হলো এবং ইসলামের বশ্যত স্বীকার করলো। তখন আরবরা বুঝলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জয়যাত্রা রোধ করে ও তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করে এমন ক্ষমতা তাদের নেই্ তারা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করলো। চারদিক থেকে তাঁর কাছে লোকজন আসতে ও ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো। এ কথাটাই আল্লাহ তা’আলা সূরা নাছরে এভাবে বলেছেন-
[আরবী *******]
“আল্লাহর সাহায্র ও বিজয় যখন এসে গেছে এবং তুমি দেখছো যে, লোক দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে, তখন প্রশংসা সহ তোমার প্রভুর পবিত্রতা বর্ণনা কর এবং তার কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল।”
বনু তামীমের প্রতিনিধিদলের আগমন ও সূরা হুজুরাত নাযিল
আরব গোত্রসমূহ থেকে প্রতিনিধিদল আগমন শুরু হলে সর্বাগ্রে উতারিদ বিন হাকেব তামিমীর নেতৃত্বে বনু তামীম গোত্রের প্রতিনিধিদল আসে। এই দলে বনু তামীমের নেতৃস্থানীয় লোকজনও ছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আকরা ইবনে হারেস, বনু মা’দের যাবারকান ইবনে বদর ও আমর ইবনে আহতাম এবং হাবহাব ইবনে ইয়াযীদ। এছাড়া নুয়াইম ইবনে ইয়াযীদ, কায়েস ইবনে হারেস, কায়েস ইবনে আসেম ও উযাইনা ইবনে হিসনও এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইতিপূর্বে মক্কা বিজয় এবং হুনাইন ও তায়েফের অভিযানে আকরা ইবনে হারেস ও উয়াইরা ইবনে হিসন অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারা দু’জন বনু তামীমের প্রতিনিধিদলেও যোগ দেন। বনু তামীমের এই প্রতিনিধিদল মসজিদে নববীর কাছে এসে বাড়ীর বাইরে থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উচ্চস্বরে এই বলে ডকতে শুরু করে, “হে মুহাম্মাদ! বেরিয়ে আসুন এবং আমাদের সাতে দেখা করুন।” তাদের এই চিৎকার ও হাঁকডাক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কষ্টকর হলো। তারা বললো, “আমরা এসেছি আপনার কাচে আমাদের গৌরবোজ্জল বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরতে। তাই আমাদের প্রধান বক্তা ও কবিকে কথা বলার অনুমতি দিন।” তিনি অনুমতি দিলেন। তখন উতারিদ ইবনে হাজ্জেব বলতে লাগলো, “সেই আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা যিনি আমাদের ওপর অশেষ অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন এবং একমাত্র তিনিই এর ক্ষমতা রাখেন। যিনি আমাদেরকে বাদশাহ বানিয়েছেন এবং আমাদেরকে বিপুল ধন সম্পদে ও ঐশ্বর্য্যে সমৃদ্ধ করেছেন। যার দ্বারা আমরা বদান্যতার পরিচয় দিয়ে থাকি। যিনি আমাদেরকে সমগ্র প্রাচ্যবাসীর মধ্যে সর্বাধিক জনবল ও ধনবলের অধিকারী করেছেন। আমাদের সমকক্ষ আর কেউ আছে কি? আমরাই কি তাদের নেতা এবং সবচেযে অভিজাত নই? আভিজাত্য ও কৌলিন্যে যে আমাদের সমকক্ষতার দাবী করে সে নিজ শেষ্ঠত্বের বর্ণনা দিক। আমরা ইচ্ছা করলে আরো অনেক কিছু বলতে পারি কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত নিয়ে বেশী বাগাড়ম্বর করতে আমরা লজ্জাবোধ কলি। আমাদের এ শ্রেষ্ঠত্বের কথা সুপরিচিত। আপনাদেরকে আমাদের মত আত্মপরিচয়মূলক বক্তব্য পেশ করা এবং আরো ভালো বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দানের জন্যই এসব কথা বললাম।”
এ পর্যন্ত বলেই উতারিদ বসলো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবিত ইবনে সায়েসকে (রা) বললেন, “ওঠো এবং তার ভাষনের জবাব দাও।”
সাবিত উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
“সেই মহান আল্লাহর জন্য সব প্রশংসা, আসমান ও যমীনে তাঁর ইচ্ছা কার্যকর করেছেন, তাঁর জ্ঞানের পরিধি তাঁর কর্তৃত্বের পরিমন্ডল জুড়ে পরিব্যাপ্ত। তাঁর অনুগ্রহ ছাড়া কখনো কোন জিনিষের উদ্ভব ও আবির্ভাব ঘটে না, আমাদের মধ্যে রাজা বাদশাহর আবির্ভাব তাঁরই অনুগ্রহের ফল। আপন অনুগ্রহের বশেই তিনি আপন শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মধ্য থেকে শ্রেষ্ঠতম বংশীয়, আভিজাত্যে ও অতুলনীয় সাত্যবাদিতার গুণে ভূষিত ব্যক্তিকে রাসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন। অতঃপর তাঁর ওপর স্বীয় গ্রন্থ নাযিল করেছেন, তাঁকে সমগ্র মানব জাতির তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করেছেন, একমাত্র তিনিই সমগ্র বিশ্বজগতের মধ্যে আল্লাহ মনোনীত ব্যক্তিরূপে গণ্য হয়েছেন। অতঃপর মানুষকে তিনি তাঁর প্রতি ঈমান আনার আহ্বান জানিয়েছেন, ফলে তাঁর স্বগোত্র ও আপনজনের মধ্র থেকে মুহাজিরগণ তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেছেন- যারা সবার চাইতে কুলীন, সবার চাইতে সম্ভ্রান্ত ও মর্যাাদাশীল, সবার চাইতে সৎকর্মশীল। যারা সর্বপ্রথম রাসূলের দাওয়াত গ্রহণ করেছিল তারা আমরাই। সুতরাং আমরা আল্লাহর একনিষ্ঠ সাহায্যকারী এবং তাঁর রাসূলের ঘনিষ্ঠতম সহযোগী। যারা ঈমান আনে না তাদের সাথে আমরা যুদ্ধ করি; যারা আল্লাহর রাসূলের প্রতি ঈমান আনে তাদের জানমাল আমাদের হাত থেকে নিরাপদ, আর যে কুফরী করে তাদের সাথে একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশের ভিত্তিতেই আমরা সংগ্রামে লিপ্ত হই। সে সংগ্রামের কোন শেষ নেই। তাকে হত্যা করা আমাদের জন্য বৈধ। একথা বলেই আমি নিজের জন্য এবং সকল মুসলমান নারী পুরুষের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাই। আস্সালামু আলাইকুম।”
অতঃপর যাবারকান ইবনে বদর উঠে দাঁড়ালেন। তিনি একটি কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে নিজের বক্তব্য পেশ করলেন। কবিতাটির মর্ম এইঃ
“আমরাই সম্মানিত। কোন গোত্র আমাদের সমকক্ষ নয়। রাজা বাদশাহ আমাদের মধ্যেই বিরাজমান এবং আমাদের উদ্যোগেই তাবত উপাসনালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কত গোত্রকে আমরা বলপূর্বক লুণ্ঠন করেছি তার শেষ নেই। তা সত্ত্বেও আমাদের মান মর্যাদা অপ্রতিহত গতিতে বেড়ে চলেছে। দুর্ভিক্ষের সময়ও আমাদের লোকের ভূনা গোশত আহার করায়। মেঘ যখন মানুষের আকাঙ্খা মুতাবিক বৃষ্টি বর্ষন করে না তখন রাত্রিকালে পথিকেরা সব জায়গা থেকেই আমাদের কাছে ছুটে আসে আর আমরা তাদের খাবারের আয়োজন করি। তখন আমরা বড় বড় উট জবাই করি এবং মেহমানদের পেট ভরে খাওয়অই। এটাই আমাদের মজ্জাগত রীতি। যখনই তুমি দেখবে যে, আমরা কোন গোত্রের কাছে গিয়ে নিজেদের আভিজাত্যের গর্ব প্রকাশ করছি, তখনই দেখতে পারেব যে, তারা আমাদের অনুসারী হয়ে যাচ্ছে আর তাদের মাথা অবনমিত হয়ে আসছে। সুতরাং আজ যে ব্যক্তি আমাদের সামনে তার শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরবে, তার বর্ণনায় আমরা নতুন জ্ঞান লাভ করবো এবং আমাদের প্রতিনিধিদল ফিরে গেলে সে তথ্য প্রচারিত হবে। আমরা কারো শ্রেষ্ঠত্বের মানতে রাজী নই। তবে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব কেউ অস্বীকার করবে না। এভাবেই আমরা গৌরব ও গর্বে অজেয়।”
হাসসান এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বনু তামীমের কবির জবাব দেওয়ার জন্য তলব করলেন। তিনি এসে কবিতা আবৃত্তি করে জবাব দিলেন। সে কবিতায় মর্ম নিম্নরুপঃ
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আমাদের মধ্যে আবির্ভূত হলেন তখন আমাদের মধ্যে তাঁকে পছন্দকারী ও অপছন্দকারী উভয় রকমের লোক থাকা সত্ত্বেও তাঁকে রক্ষা করেছি। আমাদের বসতিতে আবির্ভূত হয়েছেন বলে আমরা তাঁকে তরবারী সজ্জিত হয়ে সকল জালিম ও আগ্রাসীর হাত থেকে রক্ষা করেছি। তিনি এক সম্মাানিত গৃহে আবির্ভূত হয়েছিলেন- যা (সিরিয়ার) জারিয়াতুল জাওলানের সন্নিহিত অপরিচিত লোকদের মধ্যে অবস্থিত। প্রাচীন মহত্ত্ব, আভিজাত্য এবং রাজকীয় সম্মান ও কঠিন মুসিবত সহ্য করার মত গৌরব আর কিছুতে নেই।”
হাসসান বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌছেই আমি প্রতিনিধিদ দলের কবি যে কবিতা আবৃত্তি করেছিল হুবহু তার ছন্দ অনুকরন করে পাল্টা কবিতা আবৃত্তি করলাম। যাবারকান তার কবিতা আবৃত্তি সম্পন্ন করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসসানকে বললেন, “হে হাসসান! যাবারকানের কবিতার জবাব দাও।” হাসসান দাঁড়িয়ে জবাবী কবিতা আবৃত্তি করলেন। কবিতার মর্ম নিম্নরুপ:
“কুরাইশ বংশের নেতৃবৃন্দমানুষের জন্য এক অনুকরণীয় আদর্শ উপস্থাপিত করেছেন। খোদাভীতি যাদের জীবনের গোপন কর্মকান্ডকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং যারা ন্যায় ও সততাকে অনুকরণ করে তারা সকলেই তাদের ওপর খুশী। তারা কুরাইশী নেতৃবৃন্দ। এমন একটা মানবগোষ্ঠী যারা যুদ্ধরত হলে শত্রুকে পর্যুদস্ত করে দেন অথবা (নিদেনপক্ষে) নিজের গোষ্ঠীর (মু’মিনদের)কল্যাণ সাধনের চেষ্ট করেন এবং কল্যাণ সাধন করেন। এটা তাদের কোন নতুন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়, বস্তুতঃ চরিত্রের যা কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য তাই খারাপ। তাদের পরে জনগণের মধ্যে আর যদি কোন বিজয়ীর আগমন ঘটে তা’হলে এ রকম প্রত্যেক বিজয়ী তাদের নগন্যতম বিজয়ীদের চেয়েও নগণ্যতর। তারা যদি কোথাও দুর্বলতা দেখিয়ে থাকে তাহলে সাধারণ মানুষ সেখানে কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম নয়। আর সকল মানুষ যেখানে কৃতিত্ব দেখায় সেখানে তারা কোন দুর্বলতা দেখায় না। তারা যদি সাধারণ মাুনষের সাথে প্রতিযোগিতা করে কিংবা অভিজাত ও মর্যাদাশীলদের সাথে প্রতিদ্বন্দীতা করে তাবে তারাই অগ্রগামী হয়ে থাকে। তারা এমন নিস্কলুষতার উল্লোখ করা হয়। তারা কোনম অপবিত্রতায় জড়িত হয় না এবং কোন লোভ লালসা তাদেরকে হীনতায় পতিত করে না। প্রতিবেশীর প্রতি সৌজন্য প্রদর্শনে তারা কার্পন্য করে না এবং কোন তুচ্ছ জিনিসের প্রতি তারা মোহাবিষ্ট হয় না। আমরা যখন কো গোষ্ঠীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করি তখন তা গোপন রাখি না এবং বুনো গরুর তম গোপনে হিং¯্রতায় মত্ত হই না। যুদ্ধ যখন আমাদের ওপর আগ্রাসী মুষ্ঠি উত্তোলন করে এবং নিরীহ মানুষ যখন তার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয় তখন আমরা তাকে বাগে আনি ও বশীভূত করি। তারা (কুরাইশ নেতৃবৃন্দ) শত্রুকে পর্যুদস্ত করতে পারলে গর্বিত হয় না এবং নিজেরা পরাজিত হলেও হতাশ ও ভীত হয় না। তারা যখন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে লড়াইতে লিপ্ত থাকে তখন তাদের অবস্থা হিলয়ার জঙ্গলের সেই সিংহের মত যার পায়ের কবজিতে শিকল পরানো সম্ভব নয়। তারা স্বোচ্ছায় যা দেয় তাই গ্রহণ কর। আর ক্রোধবশে যা দিতে চায় না তা নিতে চেয়ো না। তাদের সাথে যুদ্ধ করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ ও তিক্ত। অতএব তাদের শত্রুতা পরিত্যাগ কর। যখন অন্যান্য লোকেরা দলে দলে বিক্ষিপ্ত হয় এবং তাদের প্রকৃতি বিভিন্ন রূপ ধারণ করে তখনও আল্লাহর রাসূলকে তাঁর অনুসারীরা গভীর শ্রদ্ধা করে। আমার একাত্মতা বোধকারী মন তাদের প্রতি আমার প্রশংসা উৎসর্গ করেছে, যে কোন মানুষের জিহ্বাই তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কারণ লোকগণ গুরুত্ব সহকারে অথবা ঠাট্রাচ্ছলে যাই বলুক না কেন- তারাই [মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারীরা] সর্বোত্তম মানব গোষ্ঠী।”
কবিতা ও পাল্টা কবিতা পাঠের এই পালা শেষ হওয়ার পর আগন্তুক প্রতিনিধিদল ইসলাম গ্রহণ করলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে শুভেচ্ছামূলক প্রচুর উপঢৌকন দিলেন। প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে আসার সময় আমর ইবনে আহতাম নামক এক অল্পবয়স্ক যুবককে উটের কাফিলায় বসিয়ে রেখে এসেছিল। কায়েস ইবনে আসেম তার প্রতি কিছুটা ক্রুব্ধ ছিল। সে বললো, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের এক ব্যক্তিকে সওয়ারী কাফিলায় বসিয়ে রেখে এসেছি। তবে সে অল্পবস্ক তরুণ।” সে তার ব্যাপারটা একটু হালকা করে দিতে চাচ্ছিল এবং তাকে কিছু দেয়ার প্রয়োজন নেই- এ কথাই বুঝাতে চেয়েছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকেও অন্যান্যদের মত উপঢৌকন দিলেন। কায়েসের এ কথা জানতে পেরে আমর ইবনে আহতাম তাকে তিরস্কার করে কবিতা আবৃত্তি করলো-
“তুই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আমার নিন্দা করেছিস, কিন্তু মিথ্যা বলেছিস আর আমার ক্ষতিও করতে পারিসনি।
আমরা তোদের ওপর সর্বাত্মকভাবে প্রভুত্ব করেছি। অথচ তোদের প্রভুত্ব বিলুপ্ত হওয়ার পথে।”
ইবনে ইসহাক বলেন, এই প্রতিনিধিদল সম্পর্কেই সূরা হুজুরাতের এই আয়াত নাযিল হয়-
[আরবী *******]
“হে রাসূল! যারা আপনাকে বাড়ীর বাইরে পর্দার আড়ালে থেকে হাঁকডাক করে তাদের অধিকাংশই নির্বোধ।” (হুজুরাহ)
বনু আমেরের প্রতিনিধি আমের ইবনে তুফাইল ও আরবাদ ইবনে কায়েসের ঘটনা
বনু আমেরের তিন সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধিদল এল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। তারা হলো আমের ইবনে তুফাইল, আরবাদ ইবনে কায়েস ও জাব্বার ইবনে সালামী। এরা ছিল গোত্রের সবচেয়ে কুচক্রী সরদার। আমের ইবনে তুফা।ীল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধে এক মারাত্মক চক্রান্ত এঁটে এসেছিল। ইতিপূর্বে তাঁর গোত্রের লোকজন- দেশের অধিকাংশ লোকে ইসলাম গ্রহণ করছে- এই যুক্তি দেখিয়ে তাকেও মুসলমান হবার পরামর্শ দেয়। কিন্তু সে বলে, “আমি শপথ নিয়েছি। সমগ্র আরব জাতি আমার নেতৃত্ব মেনে না নেয়া পর্যন্ত আমি থামবো না। আজ কিনা কুরাইশ গোত্রের এই তরুণের নেতৃত্ব আমি মেনে নেব।” আমের আরবাদকে বললো, “আমরা দু’জনে যখন মুহাম্মাদের সাথে দেখা করতে যাবো তখন দু’জনে দু’দিকে বসবো। মুহাম্মাদ যখন আমার সাথে কথা বলতে আমার দিকে মুখ ফেরাবে ঠিক তখনই তুমি তাঁকে তরবারী দিয়ে আঘাত করবে।”
অতঃপর প্রতিনিধিদ্বয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দেখা করলো। আমের বলতে লাগলো, “হে মুহাম্মাদ, আমাকে একটু নির্জনে কথা বরার সুযোগ দাও।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি যতক্ষণ এক আল্লাহর ওপর ঈমান না আনবে ততক্ষণ সে সুযোগ দেব না।” আমের আরবাদকে সুযোগ দেয়ার জন্য বার বার ঐ একই কথা বলতে লাগলো। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কিচুতেই তার সাথে নির্জনে কথা বলতে রাজী হলেন না তখন সে প্রতিনিধিদল নিয়ে সটকান দিল। যাওয়ার সময় হুমকি দিয়ে গেল, “দেখে নিও, আমি বিরাট এক বাহিনী নিয়ে তোমার ওপর হামলা চালাবো।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “হে আল্লাহ, তুমি আমাকে আমের ইবনে তুফাইল থেকে রক্ষা কর।”
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমের আরবাদকে বললো, “হে আরবাদ, ধিক্ তোমাকে, যে নির্দেশ দিয়েছিলাম তার কি করলে? আল্লাহর কসম, প্রথিবীতে আমি তোমাকেই সবচেয়ে বীর পুরুষ মনে করতাম এবং তোমাকেই সবচেয়ে বেশী ভয় করে চলতাম। আজ থেকে আর তোমাকে ভয় করােবা না।” আরবাদ বললো, “তোর সর্বনাশ হোক! তাড়াহুড়া করিসনে। আমাকে যা করতে বলেছিলি তা করতে উদ্যত হয়েই দেখি, আমার সামনে তুই ছাড়া আর কেউ নেই। সে অবস্থায় কোপ দিলে তো ঘাড়েই পড়তো। শেষ পর্যন্ত তোকেই আমি কোপ দেব নাকি?”
অতঃপর তারা নিজ নিজ বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলো। পথিমধ্যে আল্লাহ আমের ইবনে তুফাইলের ঘাড়ে প্লেগ দিলেন। বনু সালুলেল এক মহিলার বাড়ীতে গিয়ে সে ঐ প্লেগেই মারা গেল। মৃত্যুকালে সে বিলাপ করে বলতে লাগলো, “হে বনু আমের। আমাকে কি শেষ পর্যন্ত উটের গলগন্ডতেই ঘরলো আর তাও বনু সালুলের এক মহিলার বাড়িতে?” [৯১. বনু সালুল আরবদের মধ্যে অত্যন্ত কাপুরুষ ও হীনমনা গোত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। কবি সামাওয়াল বলেন, “আমরা এমন এক গোষ্ঠী যারা হত্যাকে বনু আমের ও বনু সালুলেল মত লজ্জাকর মনে করি না।”] আমেরকে সমাধিস্থ করে তার সঙ্গীরা বনু আমেরের বসতিতে দুটো ছাগল নিয়ে হাজির হলো। প্রতিনিধিদের গোত্রের লোকেরা আরবাদকে বললো, “হে আরবাদ! তোমরা কি করে এলে?” সে বললো, “কিছুই না। সে (মুহাম্মাদ) আমাদেরকে এমন এক সত্তার ইবাদাত করার আহ্বান জানিয়েছে যাকে নাগালে পেলে আমি তীর নিক্ষেপ করে হত্যা করতাম।” এ কথা বলার এক বা দুই দিন পর আরবাদ তার উট নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল। সহসা আল্লাহ তার ওপর আকাশ থেকে বজ্র নিক্ষেপ করে উট সহ আরবাদকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিলেন। আরবাদ ছিল কবি লাবীদের ভাই। সে আরবাদের মৃত্যুতে নিম্নরূপ শোকগাথা রচনা করে:
“মৃত্যু কাউকেই ছেড়ে দেয়না, স্নেময় পিতাকেও না।
আরবাদের ওপর একমাত্র মৃত্যুরই আশংকা করতাম- আকাশ থেকে কোন দুর্যোগ
কিংবা সিংহের আক্রমণের আশংকা করতাম না।
অতএব, হে চক্ষু, আরবাদের জন্য অশ্রুবর্ষণ করোনা কেন?
যখন আমরা নারী পুরুষ সকলেই কঠিন দুঃখ কষ্টের ভেতররে কাল কাটাচ্ছিলাম
তখন তারা সবাই যদি চিৎকার করতো আরবাদ তার পরোয়া করতো না।
আর তারা যদি ভারসাম্য রক্ষা করে চলতো তবে
সেক্ষেত্রেও আরবাদ মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতো।
সে একজন মিষ্টভাষী বুদ্ধিমান এবং ন¤্র হৃদয় মানুষ।
সেই সাথে তার মধ্যে তিক্ততাও ছিল।
বৃক্ষরাজি যখন শীতকালে উজাড় হয়ে যায়, এবং পুনরায় তা যখন ফলাদায়ক ও
তরতাজা হয় এবং অবশিষ্ট আশাপ্রদ জিনিসগুলো দেখা দেয়,
(অর্থাৎ দেশে যখন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং পরে আবার দেশে ফসল উৎপন্ন
হওয়ার অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়।) তখন সে (আরবাদ)
জঙ্গলের হিংস্র সিংহের চেয়েও বরিত্ব এবং অভ্যস্ত সূক্ষদর্শিতা পরিচয় দিত)।
তার শোকে আহত মাতমকারিনীরা মাতম করছে, যেন তরুণ হরিণীরা
ঊষর মরুভূমিতে (নিষ্ফল রোদন করছে।) দুর্যোগের দিনটাতে
সেই বীর অশ্বারোহীর বজ্রঘাতে মৃত্যু আমাকে মর্মাহত করেছে।
সে ছিনতাই করতো আবার লুণ্ঠিত ব্যক্তি যদি তার কাছে আসতো তাহলে তাকে
ক্ষতিপূরণ দিত, ইচ্ছা হলে (লুণ্ঠিত জিনিস) ফিরিয়ে দিত।
তার অনেক অভাব থাকা সত্ত্বেও উদ্ভিদ উৎপাদন করে থাকে।
প্রস্তরময় অঞ্চলের অধিবাসীরা মাত্রই ভাগ্যাহত তা
তাদের জনসংখ্যা যতই বেশী হোক না কেন।
কখনো তারা একটু সমৃদ্ধশালী হলেও পরক্ষণেই আবার তাদের কপালে
নেমে আসে দারিদ্র। তারা সংখ্যায় অধিক হলেও ধ্বংস ও
বিনাশের কবলে পড়ার জন্যই হয়।