দ্বিতীয় অধ্যায়
আল-কুরআনের গবেষণা ও তাফসীর
আল-কুরআন অবতীর্ণের সময়ে আরবে যেসব কাফির ও মুশরিক ছিল, তারা এ শৈল্পিক সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে কখনো এই কুরআনকে কাব্য আবার কখনো একে যাদু বলে আখ্যায়িত করতো। কিন্তু তাদের সম্পর্কে আমরা একথা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি না যে, তাদের নিকট শৈল্পিক সৌন্দর্যের মাপকাঠি কী ছিল। অবশ্য একথা আমরা খুব ভালোভাবেই জানি, কুরআন থেকে তারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কুরআন অবতীর্ণের সময় মুমিন এবং কাফির উভয় গোষ্ঠীর ওপরই এটি যাদুর মতো কাজ করেছে। কেউ এ যাদুর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে মুসলমান হয়েছে। আবার কেউ কেউ এর মায়াজালে আবদ্ধ হয়েও এর থেকে পালিয়ে বেরিয়েছে। তারপর উভয় গোষ্ঠী নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কিন্তু কেউই সুস্পষ্টভাবে বলতে পারেনি, কুরআনের কোন্ অংশটি তাদের মায়াবী প্রভাবে ফেললো। হযরত উমর (রা) থেকে বর্ণিত এক রিওয়ায়েতে আছে;’ “যখন আমি কুরআন শুনলাম তখন আমার মধ্যে ভাবান্তর হলো, যার কারণে আমি কাঁদতে লাগলাম এবং ইসলাম গ্রহণ করে ফেললাম।” হযরত উমর (রা)-এর অন্য বর্ণনায় আছে: “আমি বললাম, এ কথাগুলো কতো গুরুত্বপূর্ণ এবং এর মাহাত্ম্য কতো বেশি।”
ওয়ালীদ বিন মুগিরা কুরআন ও রাসূল (স) উভয়কে অস্বীকার করেছে। শুধু তাই নয়, রাসূল (স)-এর সাথে মারাত্মক শত্রুতাও সে পোষণ করতো। তার মুখ থেকেও বের হয়েছে:
আল্লাহর শপথ! কুরআনের মধ্যে মাধুর্যতা পাওয়া যায়। মনে হয় এটি শাশ্বত এক বাণী। সবকিছুকে জয় করে নেয়। সবচেয়ে উন্নত ও মর্যাদাসম্পন্ন কোন কিছুও এর চেয়ে উত্তম হতে পারে না।
ওয়ালীদ বিন মুগিরা আরো বলেছে:
কুরআনের মধ্যে যাদুকরী প্রভাব আছে, তোমরা দেখ না এটি কিভাবে একজন মানুষকে তার আত্মীয়-স্বজন ও সঙ্গী-সাথীদের থেকে পৃথক করে দেয়?
ঈমানদারগণ এ কালাম তিলাওয়াত করার পর যে প্রতিক্রিয়া তাদের ভেতর সৃষ্টি হয়, সে সম্পর্কে খোদ কুরআনই সাক্ষ্য দিচ্ছে:
(আরবী*************)
এতে (অর্থাৎ কুরআন তিলাওয়াতে) তাদের লোম কাঁটা দিয়ে উঠে চামড়ার ওপর, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, তাদের শরীর ও মন আল্লাহর স্মরণে একাকার হয়ে যায়। (সূরা আয-যুমার: ২৩)
যারা আহলে কিতাব এবং ঈমানদার তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
যারা পূর্ব থেকে ইলম প্রাপ্ত, তাদের নিকট যখন কুরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তারা নতশিরে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এবং বলে: আমাদের পালনকর্তা পবিত্র-মহান। আমাদের প্রতিপালকের ওয়াদা অবশ্যই পূর্ণ হবে। তারা কাঁদতে কাঁদতে নতমস্তকে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয় ভাব আরো বৃদ্ধি পায়। (সূরা বনী-ইসরাঈল : ১০৭-১০৯)
অপরদিকে কুরাইশ কাফিররা কুফরী ও হঠকারিতায় অটল থেকে বলেছিল:
(আরবী**********)
এবং তারা বলে: এতো পুরাকালের কিচ্ছা-কাহিনী যা সকাল-সন্ধ্যা তাকে পড়ে শুনানো হয়। (সূরা আল ফুরকান: ৫)
নাদর বিন হারিস নামে মক্কায় এক কুলাঙ্গার ছিল। রাসুল (স) যখন মসজিদের মধ্যে লোকদেরকে কুরআন শুনাচ্ছিলেন তখন সে পারস্যের রূপকথা ও কিচ্ছা-কাহিনী আরবীতে বলা শুরু করলো। তার উদ্দেশ্য ছিল লোকদেরকে কুরআন শুনতে বাধা দেয়া। কিন্তু তার এ মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়নি। তবু কাফির কুরাইশরা এ কাজ থেকে বিরত থাকেনি; বরং তারা বলেছে:
(আরবী************)
তোমরা এ কুরআন শুনবে না, যখন এটি তিলাওয়াত করা হয় তখন তোমরা হট্টগোল করবে, এতে সম্ভবত তোমরা বিজয়ী হতে পারবে।
কুরআন সম্পর্কে এ ধরনের কথা ও কাজ তারা সর্বদাই বলতো এবং করতো। কিন্তু একটি প্রশ্ন আজও রয়ে গেছে, কুরআন শৈল্পিক সৌন্দর্য কিভাবে প্রকাশিত হয়? কাফিররা যতোটুকু কুরআন শোনার সুযোগ পেয়েছে আরবীঅ ভাষী হওয়ার কারণে সবটুকুই তাদের মন-মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলার জন্য যথেষ্ট হয়েছে। এরপর তারা ‘লাব্বাইক’ বলে ইসলাম কবুল করেছে, না হয় পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পালিয়ে গেছে। উল্লেখ্য যে, শিল্পকলার ব্যাপারে এরূপ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেয়ীদের যুগে তাফসীর
আল-কুরআন অবতীর্ণ হওয়ার পরবর্তী যুগের দিকে যদি আমরা লক্ষ্য করি, তবে দেখতে পাই, সাহাবায়ে কিরাম বিভিন্ন রিওয়ায়াতের মাধ্যমে আল-কুরআনের অনেক জায়গার তাফসীর করেছেন, যা আল-কুরআনের বিষয় ও ভাষ্য সংক্রান্ত সরাসরি রাসুল (স) কর্তৃক বর্ণিত। সাহাবাদের মধ্যে অনেক খুব ভয়ে ভয়ে কিছু আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন। আবার অনেকে কুরআন ব্যাখ্যাকে গুনাহের কাজ মনে করে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ থেকে দূরে থেকেছেন। এমনকি সাইয়েদ ইবনু মাইয়িব (রহ)-এর ব্যাপারে কথিত আছে, তাঁর নিকট কুরআনের কোন অংশের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলতেন: ‘আমি কুরআনের ব্যাখ্যা সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না।’
মুহাম্মদ ইবনু সীরীন (রহ) বলেন: ‘আমি হযরত উবাইদাহ (রা)-কে কুরআন সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, আল্লাহকে ভয় করো এবং সোজা পথে চলো, তারাই নাযাত পাবে, যারা জানতে চেষ্টা করে কুরআন কী উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয়েছে।’
হিশাম বিন উরওয়া বিন যুবাইরন (রা) বলেন: আমি আমার পিতাকে কখনো কুরআনের ব্যাখ্যা করতে শুনিনি। [ফজরুল ইসলাম- ড. আহমদ আমীন।]
ওপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মা হয়, সাহাবা কিরামদের অধিকাংশই কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ব্যাপারে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। এজন্য তাদের সময়ে কুরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কাংখিত মানে পৌঁছুতে পারেনি।
যখন সাহাবাদের যুগের পর তাবিয়ীদের যুগ এলো, তখন আল-কুরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আগের চেয়ে কিছুটা বিস্তৃতি লাভ করলো। তবে তার ধরন ছিল, কোন আয়াতের তাফসীর অনুরূপ কোন বাক্য বা শব্দ দিয়েই তারা সম্পাদন করতেন। যাতে মোটামুটি ভাবটা বুঝা যায়। যেমন: (আরবী**********) –এ আয়াতের তাফসীর এভাবে করতেন (আরবী**********): অর্থাৎ গুনাহ করার ইচ্ছে পোষণকারী হয়ো না। তেমনিভাবে তাঁরা (আরবী**********)-এর তাফসীর করেছেন: জাহিলী যুগে যখন কোন ব্যক্তি সফরে যাবার ইচ্ছে পোষণ করতে তখন দুটো তীর দিয়ে লটারী করতো। তার মধ্যে একটি তীরে লেখা থাকতো (***)-একাজ করো এবং অপরটিতে লেখা থাকতো (***)- একাজ করো না। তাঁরা চোখ বুজে তীর তুলতো এবং তীরের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতো। এ আয়াতে আল্লাহ একাজ করার নিষেধ করেছেন। অবশ্য কেউ কেউ এর শানেনুযুল বা পটভূমিও বর্ণনা করেছেন। এমনকি তাফসীর করতে গিয়ে ইহুদী ও খ্রীস্টানদের কিছু কাহিনী বর্ণনা করাও তাদের রেওয়াজে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষ দিকে তাফসীর শাস্ত্রের বিস্তৃতিত ঘটে। কিন্তু কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য বর্ণনার বিষয়বস্তু করার পরিবর্তে সেখানে ইতিহাস, বষ্ফাকরণ, দর্শন ও তর্কশাস্ত্রের বিষয়বস্তু প্রাধান্য লাভ করে। এভাবে আল-কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য চিহ্নিত করার যে সুযোগ তাদের আসে তারা তা হাতছাড়া করে বসেন।
মুতাআখ্খিরীনদের মধ্যে আল্লামা জামাখশারী আল-কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্যের দিকটি কিছুটা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিল। তাই তিন এ ব্যাপারে কিছুটা অগ্রসর হয়েছেন। তেমন তিনি (আরবী**********)- যখন মূসা (আ)-এর রাগ প্রশমিত হলো। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন: “সম্ভবত মূসা (আ) ঐ সমস্ত কাজের ওপর রেগে গিয়েছিল যা তারা তাঁর অনুপস্থিতিতে করেছিল। তিনি নিজের সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বললেন: একি করছো? একথা বলে লিখিত তওরাতের ফলকগুলো নিক্ষেপ করলেন এবং তাঁর ভাইয়ের দাড়ি ধরে নিজের দিকে টানতে লাগলেন।”
তবু বলা যায় জামাখশারী এ কাজে পরিপূর্ণ সফলতা লাভ করতে পারেননি। কারণ তার বর্ণনা ও উপস্থাপনার গভীরতা কমই পরিলক্ষিত হয়।
এ আয়াতের উত্তম ব্যাখ্যা করতে হলে কল্পনার আশ্রয় নিতে হবে। ধরা যেতে পারে (***) (রাগ) একজন মানুষ। যে কথা বলে আবার চুপ করে থাকে। যে মূসা (আ)-কে উদ্বুদ্ধ করে ঠিকই কিন্তু নিজে নেপথ্যে থাকে। মনে হয় প্রকৃত সৌন্দর্য হয় ((***) (রা)কে মানবরূপে কল্পনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জামাখশারীর অবশ্য সে অনুভূতি ছিল কিন্তু তা তিনি প্রকাশ করতে পারেননি। যা কিছু বলেছেন তা সমসাময়িককালের গণ্ডিতে আবদ্ধ।
জামাখশারী সূরা আল-ফাতিহার তাফসীর করেছেন এভাবে: ‘বান্দা যখন তার স্রষ্টা ও অভিভাবকের প্রশংসা করতে গিয়ে বলে (***) তখন বুঝা যায় সকল প্রশংসা একমাত্র তাঁর। অতপর ঐ সত্তার দিকে প্রত্যাবর্তন করে বলে (******) অর্থাৎ সমস্ত বিশ্বজাহানের প্রতিপালক-মালিক। কোন বস্তুই তার মালিকানা ও প্রতিপালনের আওতার বাইরে নয়। তারপর বলে: (******) ছোট বড় এবং সমস্ত জাতি ও প্রজাতির ওপর অনুগ্রহ প্রদানকারী। এভাবে ঐ ব্যক্তি আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের অনুপ্রেরণা অর্জন করে।
যখন বলে উঠে (আরবী**********)-তিনিই তো বিচার দিনের মালিক। এ পর্যন্ত পৌঁছে সে আবেগাপ্লুত হয়ে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে ঐ সত্তার পর সোপর্দ করে দেয় এবং একমাত্র তাঁই সাহায্য ও সহযোগিতার মুখাপেক্ষী হয়ে বলে উঠে: (আরবী**********)- আমি শুধু তোমার ইবাদাত করি এবং কেবলমাত্র তোমার নিকট সাহায্য চাই।
সূরা ফাতিহা অধ্যয়নে যে অনুভূতি পরিলক্ষিত হয়, তার মধ্যে শৈল্পিক বিন্যাসকে মূর্তমান করে তুলে ধরার এক উত্তম প্রচেষ্টা। কুরআনে কারীমের মধ্যে ছন্দ ও বিষয় বিন্যাসের ধারাবাহিকতা সৃষ্টিতে প্রথম দিকের সূরাগুলোর মধ্যে যে স্টাইল অবলম্বন করা হতো এ সূরাটি তার অন্যতম।
কুরআন শরীফের যে সমস্ত জায়গায় এ ধরনের ছন্দ ও বিন্যাস পাওয়া যায় তা বিশ্লেষণ করতে অনেক তাফসীরকারই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে তারা আদৌ সফলতা লাভ করতে পারেননি। বরং কাজের কাজ এতোটুকু হয়েছে যে, যেখানে একই রকম বিন্যাস ও সাদৃশ্য পাওয়া গেছে তাকে চিহ্নিত করেছেন মাত্র। কিন্তু এ ব্যাপারে তারা কোন নীতিমালা বর্ণনা করতে পারেননি। অবশ্য এতোটুকু করতেই তাদেরকে গলদঘর্ম হতে হয়েছে।
রইলো বালাগাত ও কুরআনের অলৌকিকত্ব নিয়ে বিতর্ককারী ওলামাগণ। আশা করা হয়েছিল হয়তো তারা এদিকে তাফসীরকারদের চেয়ে অগ্রসর হয়ে আল-কুরআনের শৈল্পিক বিন্যাস ও তার সৌন্দর্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদানের সামর্থ রাখেন কিন্তু তারা শুধু নিজেদেরকে অনর্থক তর্ক-বিতর্কেই নিয়োজিত রেখেছেন।
যেমন: বালাকাগত (অলংকারীর বিন্যাস) কি শব্দের মধ্যে না অর্থের মধ্যে পাওয়া যাবে, এ নিয়েবিতর্ক। তাদের মধ্যে কতিপয় আলিম এমনও ছিল অলংকার শাস্ত্রের মূল নিয়ম-নীতি যাদের নখদর্পণে ছিল। তার ওপর ভিত্তি করেই তারা কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্যকে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছেন। কখনো কখনো এর মাত্র ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
এবার আল-কুরআনের সামান্য একটি অংশের সৌন্দর্য সম্পর্কি বর্ণনার প্রতি লক্ষ্য করুন। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী*************)
যদি তুমি দেখতে! অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সামনে নতশির হয়ে দাঁড়ানো। (সূরা আস-সিজদাহ: ১২)
ইসলাম অস্বীকারকারীরা কিয়ামতের দিন অত্যন্ত লাঞ্ছিত ও অপমানিত অবস্থায় উঠবে, এ আয়াতটি তার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। এ আয়াতটি তিলাওয়াত করা মাত্র চোখের সামনে ভেসে উঠে এমন এক অপরাদীর চিত্র, যে অত্যন্ত হীন ও নীচ অবস্থায় মাথা নুয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কার সামনে দাঁড়িযে? স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সামনে। এতো শুধু কল্পনাই নয়, যেন বাস্তব ও চাক্ষুষ। এবার একটু চিন্তা করে দেখুন, এ ধরনের যতো আয়াত আছে সে সম্পর্কে বালাগাতের বক্তব্য শুধু একটি। তা হচ্ছে, ‘এ আয়াতে (***) (তুমি দেখবে) শব্দটি সম্বোধন পদ। সম্বোধন মূলত কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকেই করা হয়ে থাকে। কিন্তু অনেক সময় অনির্দিষ্ট ব্যক্তিকেও সম্বোধন করা হয়ে থাকে। যেমন বলা যায়, অমুক ব্যক্তি খুব খারাপ। যদি তুমি তাকে সম্মান করো তবে সে তোমাকে অপদস্থ করবে। আর যদি তার সাথে ভালো ব্যবহার করো তবে সে তোমার সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করবে।’
এ ধরনের কথোপকথনের জন্য কোন ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করা যায় না। একথা বলার উদ্দেশ্য এই নয় যে, যদি তুমি এরূপ করো তবে সেও এরূপ করবে। বরং উদ্দেশ্য হচ্ছে- তার সাথে এ ধরনের ব্যবহার করা হলে বিনিময়ে এরূপই পাওয়া যাবে। শব্দটি সম্বোধন পদে এজন্য ব্যবহার করা হবে সে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয়। এ ধরনের উদাহারণ আল-কুরআনে ভুরি ভুরি আছে। এ আয়াতেও [(আরবী**********)] সাধারণত্ব প্রকাশ করার জন্যই সম্বোধন আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। স্পষ্টই বুঝা যায়, অপরাধীদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হবে। এতো সুস্পষ্ট কথা যেখানে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। এ জন্য সেই ভীতিকর অবস্থা দর্শনের সাথে কাউকে নির্দিষ্ট করা হয়নি। বরং যার মধ্যে দর্শনের উপযোগিতা পাওয়া যাবে সেই সম্বোধনের মধ্যে শামিল।
নিম্নোক্ত আয়াতসমূহে বিষয়বস্তু যে জীবন্ত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অলংকার শাস্ত্রের (বালাগাতের) সুপণ্ডিতগণ তাকে জটিল করে রেখেছেন। যেরূপ তারা উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। পরিশেষে বালাগাত বিশেষজ্ঞগণ একথা বলে বক্তব্য শেষ করে দেন যে এ আয়াতে অপরাদীদের মর্মান্তিক পরিণতির কথা বলা হয়েছে। যা সর্বোচ্চ প্রকাশভঙ্গিতে প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়া কুরআন মজীদের অন্যান্য আয়াতের ব্যাখ্যার ব্যাপারেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সামনে রাখা যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ- যে সমস্ত আয়াতে কিয়ামত, জান্নাত ও জাহান্নামের চিত্র অংকন করা হয়েছে সে সমস্ত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)
শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে, ফলে আসমান ও জমিনে যারা আছে সবাই বেহুঁশ হয়ে যাবে। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন সে ব্যতীত। অতপর আবার শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। তক্ষণি তারা দাঁড়িযে দেখতে থাকবে।
(আরবী***********)
যেদিন আমি পর্বতসমূহকে চলমান করবো সেদিন তুমি পৃথিবীকে দেখবে এক উন্মুক্ত প্রান্তর। তারপর আমি সকলকে একত্রিত করবো। (আগের কিংবা পরের) কেউ বাদ পড়বে না। (সূরা আল-কাহ্ফ: ৪৭)
(আরবী**************)
জাহান্নামীরা জান্নাতীদেরকে ডেকে বলবে, আমাদেরকে তা থেকে কিছু খাদ্য বা পানীয় দাও, যা আল্লাহ তোমাদেরকে দিয়েছেন। জান্নাতীগণ বলবে:
আল্লাহ এ উভয় বস্তু কাফিরদের জ ন্য হারাম করে দিয়েছেন। (সূরা আল-আরাফ: ৫)
ওপরের আয়াত ক’টিতে পরিপূর্ণ কিছু ছবি ভেসে উঠেছে। যে ছবিগুলো অত্যন্ত পেরেশানীর ও মর্মান্তিক। চোখ তা দেখে, কান তা শোনে এবং মনের গভীরে তার প্রভাব পড়ে। কিন্তু আশর্চর্যের বিষয় হচ্ছে- বালাগাতের পণ্ডিতগণ শুধু এ কথাই বলবে যে, ভবিষ্যতে সংঘটিতব্য বিষয়সমূহকে অতীতকালের শব্দ দিয়ে বুঝানা হয়েছে। যেন বুঝা যায়, এতো ঘটেই আছে।
বালাগাত ও কুরআনের অলৌকিকত্বের প্রবক্তা ওলামাদের মধ্যে একজন আল্লামা জামাখশারীর পূর্বসূরী ছিল। যিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও সফলতা প্রদর্শন করেছেন এ সমস্ত ব্যাপারে। তাকে এ ব্যাপারে মুহাককিক বলা যেতে পারে। তিনি হচ্ছেন আবদুল কাহের জুরযানী। অবশ্য এতে কোন সন্দেহ নেই, তাঁর রচিত ‘দালাইলুল ইজায’ এ বিষয়ের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। কিন্তু দুঃখজনক কথা হলো, গোটা পুস্তকটিই আল-কুরআনের শব্দ ও অর্থ সংক্রান্ত বক্তব্যে পরিপূর্ণ। যা থেকে সাধারণের শিক্ষা গ্রহণ করা অত্যন্ত কষ্টকর। তবু বলা যায়, সেটি ঐ সমস্ত ওলামাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম, যারা এ ব্যাপারে লিখনী চালিয়েছেন। এমনকি বর্তমান সময়েও এ বিষয়ে কেউ তার সমকক্ষতা অর্জন করতে পারেননি।
আবদুল কাহির জুরযানী আল-কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে তিনি যতোটুকু অগ্রসর হয়েছেন আমরা তার উদাহরণ তুলে ধরেছি, যদিও তা থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য পাঠকের অত্যন্ত ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন। কারণ সাহিত্যে যখন মানতিক (Logic) ও কালাম শাস্ত্র নয়ে আলোচনা হতো তখন তার ব্যাখ্যা ও বর্ণনার এ পদ্ধতিই অনুসরণ করা হতো। আবদুল কাহির জুরযানী লিখেছেন:
“উদ্ধৃতাংশের সুন্দর ও অসুন্দরের বর্ণনা তখনই সম্ভব যখন কোন ব্যক্তি বাক্যের বিন্যাস ও ছন্দ সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা রাখে। আপনারা জানেন, যখন লোক এ আয়াত : (আরবী**********)- মাথায় বার্ধক্যের ছাপ লেগেছে (সূরা মারইয়াম: ৪) তিলাওযাত করে, তখন ঐ অংশের রূপ সৌন্দর্য নির্ভর করে শুধুমাত্র উদ্ধৃতির ওপর। এছাড়া আর কোন কিছুর প্রয়োজন নেই। প্রকৃত অবস্থা তা নয়। এ আয়াত শোনামাত্র শ্রবণকারীর ভেতর যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তা শুধুমাত্র উদ্ধৃতির ওপর নির্ভরশীল নয়। এর আসল কারণ হচ্ছে, কোন বাক্যে যদি বিশেষ্যকে কর্তা বানানো হয় তবে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী তাকে পেশ দিতে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটি কর্তা (***) নয়। যদি ঐ বিশেষ্যের পর সম্পর্কযুক্ত আরেকটি বিশেষ্য (****) নেয়া হয় তখন তাই হবে ঐ ক্রিয়ার (***) আসল কর্তা (****)। অর্থাৎ ক্রিয়াকে দ্বিতীয় বিশেষ্যের কারণে প্রথম বিশেষ্যের দিকে সম্পর্ক স্থাপন করা হয় বিধায় দুটো বিশেষ্যের মধ্যে সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। যেমন:
(আরবী*************)
এ রকম আরো অনেক বাক্য আছে যার ক্রিয়াকে প্রকৃত কর্তার সাথে সম্পর্কেত না করে তার কারণের দিকে সম্পর্কিত করা হয়। কেননা আমরা একথা সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত যে, (****) ক্রিয়ার আসল কর্তা হচ্ছে (****) যদিও বাহ্যিকভাবে (****) কে কর্তা মনে হয়। তদ্রুপ অন্য উদাহরণ (****) এর প্রকৃত কর্তা (***) এবং (***) ক্রিয়ার প্রকৃত কর্তা (***) আর (****) এর প্রকৃত কর্তা (****)। এ সমস্ত বাক্যে ক্রিয়াকে এমন বিশেষ্যের সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে যা প্রকৃতপক্ষে ঐ ক্রিয়ার কর্তা নয়। উদ্ধৃতাংশের উদাহরণগুলোতে যে সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটেছে তা ক্রিয়াকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে কর্তা নয় এমন বিশেষ্রের সাথে সম্পর্কিত করার কারণেই সম্ভব হয়েছে। যদি এরূপ না করে প্রকৃত কর্তার সাথে সম্পর্কিত করে বলা হতো: (আরবী**********) তাহলে প্রকৃত সৌন্দর্য বিলোপ হয়ে যেত। যদি প্রশ্ন করা হয়, সৌন্দর্য বিলোপের কারণ কি? তার উত্তর হচ্ছে (আরবী**********) বাক্যের মধ্যে যে সাধারণ সৌন্দর্য বিদ্যমান তা (****) বাক্যে নিহিত নেই। প্রথম বাক্যের তাৎপর্য হচ্ছে পুরো মাথাই সাদা হয়ে গেছে, কোন অংশই সাদা থেকে বাকী নেই। কিন্তু দ্বিতীয় বাক্যে এ অর্থ বুঝা যায় না, তা থেকে বুঝা যায় তার মাথার কিছু অংশ সাদা হয়ে গেছে, পুরো মাথা নয়। তেমনিভাবে যদি বলা হয়: (আরবী**********) তবে বুঝা যায় পুরো ঘরই আগুনে জ্বলেছে। ঘরের কোন অংশ জ্বলে গেছে। পুরো ঘরে আগুন লাগা এবং পুরো ঘর পুড়ে ছারখার হওয়ার কথা এ বাক্যে বুঝা যায় না। কুরআনে কারীমের আরেকটি দৃষ্টা্ত হচ্ছে এ আয়াতে কারীমাটি
(আরবী**********)
আমরা জমিন বিদীর্ণ করে ঝর্ণা প্রবাহিত করেছি।
এ আয়াতে (****) প্রকৃতপক্ষে (***) শব্দের কর্মকারক (****) কিন্তু দৃশ্যত (***) শব্দকে কর্মকারক (***) বানিয়ে দেয়া হয়েছে। এমনিভাবে পূর্বোক্ত আয়াতে (***) কে (***) এর কর্তা হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এর ধরনের পরিবর্তনের কারণে সাধারণভাবে ব্যাপকতা সৃষ্টি করা হয়, তদ্রুপ এ বাক্যেও অনুরূপ ব্যাপকতা তুলে ধরা হয়েছে। বুঝা যাচ্ছে গোটা জমিন বিদীর্ণ করে সকল স্থানে ঝর্ণা সৃষ্টি করা হয়েছে। বাক্যটিকে এভাবে বলা যায় (***) অথবা এভাবেও বলা যায় (আরবী**********) তবে এতে উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয় না। আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে- জমিনের বিভিন্ন জায়গায় ঝর্ণা প্রবাহিত হচ্ছে একথা বুঝানো। (দালাইলুল ই’জায, জুরযানী)
আল্লাহ তা’আলা আবদুল কাহের জুরযানীর ওপর রহম করুন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তিনি প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছিল। কিন্তু সবকিছুকে ভাষায় রূপ দিতে পারেননি। (আরবী**********) এবং (আরবী**********) বাক্যদ্বয়ের মধ্যে যে শৈল্পিক সৌন্দর্য নিহিত তা কালামের শাস্ত্রের দৃষ্টিতে তাই, যা তিনি লিখেছেন। কিন্তু তা ছাড়াও শৈল্পিক সৌন্দর্যের আরেকটি দিক আছে। তা হচ্ছে চিন্তার জগতকে দ্রুত আলোড়িত করা, যাকে (***) শব্দ দিয়ে বুঝানো হয়েছে। দৃশ্যত সাদা চুলের সম্পর্ক মাথার সাথে করা হয়েছে। যা পুরো মাথায় বিস্তৃতি লাভ করবে। তদ্রুপ (***) বা বিদীর্ণ করার ক্ষেত্রে দ্রুততা পাওয়া যায়। যা মানুষের চিন্তা-চেতনাকে গভীরভাবে নাড়া দেয় এবং প্রভাবিত করে ফেলে।
এতো দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, চিন্তার জগতের আলোড়ন সৃষ্টির জন্র (আরবী**********) বাক্যটি অধিক তাৎপর্যপূর্ণ এবং শক্তিশালী। এজন্য যে, সাদা চুলের সম্পর্ক যৌবনের সাথে করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যৌবন তার মধ্যে পওয়া যায় না। সৌন্দর্যের মূল উৎস এখানেই নিহিত। যেমন এর প্রমাণ (***) বাক্যটি। এর মধ্যে যে সৌন্দর্য নিহিত আছে তা কুরআনের পূরোবাক্ত আয়াতটির মতোই। সত্যি কথা বলতে কি, উক্ত আয়াতে দু’ ধরনের সৌন্দর্য পরিলক্ষিত হয়।
প্রথমত, যৌবনকে পাকা চুলের সাথে সম্পর্কিত করলে পাওয়া যায়।
দ্বিতীয়ত, পাকা চুলকে মাথার সাথে সংশ্লিষ্ট করলে পাওয়া যায়।
এ দু’ধরনের সৌন্দর্য একটি আরেকটির পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে কখনো আয়াতের সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলা যাবে না।
আবদুল কাহের জুরযানী (র) এখানে এসেই থেমে গেছেন। আগে বাড়তে পারেননি। দৃশ্যত মনে হয় তার লক্ষ্য এতোটুকুই ছিল। কারণ তার বর্ণনায় এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়া যায় না। প্রত্যেক যুগেই ভাষা ও সাহিত্যের একটি স্টাইল থাকে। আমরা আশা করতে পারি না তিনি তার যুগের সেই স্টাইলকে অতিক্রম করে যাবেন।
সত্যি কথা বলতে কি, এ পর্যন্ত কুরআনের তাফসীর ও অলৌকিকত্ব সম্পর্কে ওলামাগণ যে সমস্ত খেদমত আঞ্জাম দিযেছেন তা নির্দিষ্ট এক সীমায় এসে থেকে গেছে। আগে বাড়তে পারেনি। প্রাচীন আরবী ভাষাও সাহিত্যে পর্যালোচনা ও যাচাইয়ের কিছু দিক ছিল। যে কোন রচনা সেই আলোকে যাচাই করা হতো। তার আগে থেকে আগে বেড়ে এমন হয়নি যে, সার্বিক কাজের পর্যালোচনা করে তার বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করা হবে। কুরআনী বালাগাতের ব্যাপারটিও ছিল তেমন। আজ পর্যালোচনার বিষয় না বানিয়ে সার্বিকভাবেআলোচনার বিষয় বানাবেন। তাই বালাগাতপন্থী ওলামাগণ করার মধ্যে এই করেছেন যে, তারা কুরআনের সমস্ত শব্দ, ছন্দ ও বিন্যাসের পদ্ধতিকে বালাগাতের বিষয়বস্তু বানিয়ে নিয়েছেন। তারপর এ কথা প্রমাণের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন যে, গোটা কুরআনই বালাগাত ও ফাসাহাতে পরিপূর্ণ।
আল-কুরআনের বালাগত নিয়ে যে সমস্ত ওলামায়ে কিরাম আলোচনায় লিপ্ত হতেন তারা কুরআনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহের ধারে কাছেও পৌঁছুতে পারেননি। অবশ্য যদিও বিচ্ছিন্নভাবে কুরআনের শৈল্পিক সৌন্দর্য নির্ণয়ের চেষ্টা তারা করেছেন। কিন্তু তা কোন কাজেই আসেনি। যে সম্পর্কে আমি ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি যে, বালাগাতপন্থী সেসব ওলামাদের চেষ্টা-প্রচেষ্টা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের এবং অপূর্ণাঙ্গ ছিল।
এ বিষয়ে সর্বশেষ কথা হচ্ছে- কোন বক্তব্যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাওয়া পরিতাপের বিষয় হচ্ছে- বালাগাতের আলিমগণ আরবী সাহিত্য কিংবা কুরআনে কারীমের সেই সীমা তারা স্পর্শ করতে পারেননি। কারণ কুরআনে করীমের গুরুত্বপূর্ণ শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত ও বর্ণনা করার বিষয়টি আজও রহস্যাবৃত হয়েই আছে। এ অলৌকিক গ্রন্থটির দরস ও অধ্যয়নের জন্য এক নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করা এবং তার শৈল্পিক সৌন্দর্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করানোর জন্য সাধারণ মূলনীতির ভিত্তিতে আলোচনা করাকে অপরিহার্য মনে করা হয়েছে এবং অলৌকিক বিষয়সমূহের এমন ধরনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে যা কুরআনে করীমের একক সেই বিষয়সমূহ থেকেই নেয়া।
একটি কথা স্মর্তব্য, এ মহাগ্রন্থ যে বৈশিষ্ট্যের ধারক তা কোন নির্দিষ্ট অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং গোটা গ্রন্থেই তা সমভাবে বিস্তৃত। সমস্ত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ধারা বর্ণনা পর্যন্ত এক ও অভিন্ন। যদিও উদ্দেশ্য হচ্ছে- সুসংবাদ দেয়া, আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে ভয় দেখানো, অতীতে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার বর্ণা, ভবিষ্যতে সংঘটিতব্য কোন বিষয়ের বর্ণনা কাউকে আশ্বস্ত করার অভয় বাণী, ঈমান গ্রহণের আহ্বান, দুনিয়াতে জীবন যাপন সম্পর্কে পথ নির্দেশ দান, কিংবা কোন বিষয়কে বোধগম্য করার জন্য তার চিত্রায়ণ, কিংবা কোন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর বর্ণনা অথবা মনোজগতের মূর্তমান দৃষ্টান্ত, কিংবা অতীন্দ্রিয় কোন বস্তুর বর্ণনা, যাই হোক কেন, বর্ণনা ও বাচনভঙ্গির মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই।
কুরআন মজীদের সমস্ত বর্ণনার মধ্যেই একটি সূত্র বিদ্যমান। যা প্রমাণের জন্যই আমরা এ পুস্তকটি লিখেছি। এ সূত্রটিকে আমি ‘শৈল্পিক চিত্র’ নামে অভিহিত করেছি।