সপ্তম অধ্যায়
কুরআনী চিত্রের উপাদান
আল-কুরআনের চিত্রায়ণ পদ্ধতে যে শৈল্পিক বিন্যাস দেখা যায়, এবার আমরা তার আরেকটি দিক নিয়ে আলোচনা করবো। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল-কুরআন বিভিন্ন ঘটনাবলীকে দৃশ্যাকারে ও চিত্রাকারে বর্ণনা করে। এজন্য আমরা বলতে চাই, যখন ঐ সমস্ত চিত্রে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ একত্রিত হয়ে যায় তখন তার শৈল্পিক বিন্যাস সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠে।
১. চিত্রে একটি থিম থাকা।
২. স্থান কাল ও পাত্র চিত্রের অনুরূপ হওয়া।
৩.চিত্রের সমস্ত অংশ পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া।
৪. যে কাগজ বা কাপড়ের টুকরোতে চিত্রাংকন করা হবে তার প্রটি অংশ চিত্রের অংশানুপাতে ভাগ করা।
আমরা ‘শৈল্পিক চিত্র’ অধ্যায়ে এ প্রসঙ্গে কিছু ইঙ্গিত করেছি। যেখানে আমরা নাম-যশের জন্য ধন-সম্পদ খরচ করার চিত্রটি উপস্থাপন করেছি। সাথে ঐ পাথরটির ছবিও, যার ওপর মাটির হাল্কা আবরণ পড়েছে। সেই সমস্ত লোকের চিত্রের পাশাাশি তাদের চিত্রও অংকনের চেষ্টা করা হয়েছে যারা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মাল-সম্পদ দান করে। আর ঐ বাগানের ছবিও আমরা দেখিয়েছি, যা একটি চিলার ওপর অবস্থিত। আমরা সেকানে বলেছি, ঐ সমস্ত চিত্রের অংশ এবং তার আনুষঙ্গিক বিষয়াদিতে কী পরিমাণ ভারসাম্য পাওয়া যায়।
আমরা এখন আল-কুরআনের শৈল্পিক বিন্যাসের যে দিকটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই, তা হচ্ছে বিন্যাসের উপায়-উপকরণ। অন্য কথায় বলা যায় এটি হবে সেই তালার চাবি স্বরূপ।
আমাদের দৃষ্টিতে আল-কুরআনের বিন্যাস নিম্নরূপ:
এক: এ বিষয়ে যে কথাটি অত্যন্ত জরুরী তা ‘ওয়াহদাতে নক্শ’ (ছবির একক)। চিত্রকর্ম সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা রাখেন এমন একজন ব্যক্তিও বুঝতে পারেন যে, ‘ওয়াহদাতে নক্শ’ কী? আমরা শুধু একথা বলেই শেষ করতে চাই যে, এটি চিত্রকর্মের মৌলিক ও বুনিয়াদী নিয়মের অন্যতম একটি নিয়ম। যেন এক অংশ আরেক অংশের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়।
দুই: দ্বিতীয প্রয়োজনীয় কথা হচ্ছে, যে কাগজ কিংবা কাপড়ের টুকরোতে ছবি আঁকা হয় সেখানে ছবির প্রয়োজন অনুসারে তার অংশসমূহ ভাগ করে নেয়া। যেন ছবির আঁকায় কোনরূপ সমস্যা সৃষ্টি না হয়।
তিন: তৃতীয় বস্তু হচ্ছে, ঐ রং যা দিয়ে চিত্রকে আকৃতি প্রদান হয় এবং যার মাধ্যমে সৌন্দর্য পুরোমাত্রায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে এবং চিন্তা ও বিষয়বস্তুর সম্মিলন ঘটায়।
রঙের মাধমে যে ছবি আকৃতি প্রাপ্ত হয়, তার মধ্যে মিল বা অনুকূল তা এতো বেশি প্রয়োজন, যেমন সিনেমা ও থিয়েটারে প্রদর্শনীর জন হয়ে থাকে। কুরআনী ছবির ভিত্তিও একই জিনিসের ওপর স্থাপিত। যদিও তা শুধুমাত্র শব্দ বা বর্ণ সমষ্টির মাধ্যমে আঁকা হয়্ ছবির আঁকার অন্য কোন উপাদান সেখানে থাকে না। তবু কুরআনী চিত্রের চমক ও অলৌকিকত্ব ঐসব চিত্রের ঊর্ধ্বে যা রং-তুলির সাহায্যে ক্যানভাসে আঁকা হয়।
১. আল-কুরআনের ছোট সূরাসমূহের মধ্যে যে সূরা সম্পর্কে কিছু লোকের ধারণা এটি যাদুকরদের যাদুটোনা সম্পর্কিত সূরা। সেই সূরা ফালাক সম্পর্কেই আলোচনা করা যাক। প্রশ্ন হতে পারে, এ সূরাটি কখন পাঠ করা হয়? স্বভাবতই দেখা যায় এটি আশ্রয় প্রার্থনার মুহূর্তে তিলাওয়াত করা হয়। এ সময় ভয়, নিন্দুকের নিন্দা, কিংবা অজানা আশংকা জেগে উঠে। শুনুন এবং চিন্তা করে দেখুন:
(আরবী**********)
আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি প্রভাতের পালনকর্তার, তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট থেকে। অন্ধকার রাতের অনিষ্ট থেকে, যখন তা সমাগত হয়। গ্রন্থিতে ফুঁৎকার দিয়ে যাদুকারিণীদের অনিষ্ট থেকে এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে। (সূরা আল-ফালাক: ১-৫)
একটু চিন্তা করুন, ‘ফালাক’ (***) কী? যার জন্য তার প্রতিপালকের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা জরুরী হয়ে পড়ে। অনেকগুলো অর্থের মধ্যে আমরা ‘প্রভাত’ অর্থটি নির্বাচন করেছি। কেননা অন্ধকারকে একমাত্র ‘প্রভাত’ই বিদীর্ণ করে দেয়। তাই প্রভাত অর্থ গ্রহণ করাই এখানে সমীচীন। কারণ, এখানে বিশেষ ধরনের বর্ণনা পাওয়া যায়। যার যৌক্তিকতা আমরা সামনে অগ্রসর হলে বুঝতে পারবো।
এ সূরায় সমস্ত সৃষ্টি থেকে প্রভাতের পালনকর্তার নিকট আশ্রয় চাওয়া হচ্ছে। ‘মা খালাকা’ (****) শব্দে ‘মা’ (**) অক্ষরটি মাওসূলার অর্থ প্রদান করেছে অর্থাৎ সমস্ত সৃষ্টি। মনে হয় সমস্ত সৃষ্টি অন্থকারের গবীরে নিমজ্জিত। (***)-“যখন রাতের আঁধার সবকিছুকে ঢেকে নেয় তখন এক ধরনের বীতিকর অবস্থা দৃষ্টিগোচর হয়।”
(আরবী*******)- ‘যাদুকর মহিলাদের গ্রন্থিকে ফুঁক দেয়ার ঘটনা গোটা পরিবেশকে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলে। কারণ ফুঁকের মাধ্যমে যাদু অধিকাংশ সময় রাতের আঁধারে সংঘটিত হয়ে থাকে। (আরবী*******) হাসাব বা হিংসা এক গোপনীয় কাজের নাম, যা মানুষের মনের অন্ধকার কুঠুরীতে লুকিয়ে থাকে। এ অর্থে হিংসাও এক ধরনের ক্ষতিকর এবং ভয়ংকর কাজ। এখানে অন্ধকার, ভয় ও আতংক ইত্যাদি কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আশ্রয় প্রার্থনাকারী ঐ সকল অন্ধকার থেকে আল্লাহর আশ্রয়ে আসতে চায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহতো সবকিছুর প্রতিপালক তবে নির্দিষ্ট করে ‘রাব্বিল ফালাক’ বা প্রভাতের প্রতিপালক বলার সার্থকতা কি? এর উত্তর হচ্ছে, সৌন্দর্য সৃষ্টি ও স্থান-কালের সাথে অনুকূলতা সৃষ্টির জন্য এরূপ করা হয়েছে। তবে সাধারণ জ্ঞানের দাবি ছিল, অন্ধকার থেকে ‘রাব্বিন নূর’ বা আলোর প্রবুর কাছে আশ্রয় চাওয়া। কিন্তু এ চিন্তা ঠিক নয়, কারণ এখানে জিনিসকে দেখা গেছে তা স্পর্শকাতর ও রহস্যময় এক ছব। যা আলোর পরশে বিলীন হয়ে যায়। আলো সবকিছুকে স্পষ্ট করে দেয়। যদি অন্ধকারের বিপরীতে আলো বা ‘নূর; (***) শব্দ ব্যবহার করা হতো তবে তা গ্রন্থিতে ফুঁক দেয়া ও হিংসা শব্দদ্বয়ের সাথে খাপ খেতো না। তাই তার পরিবর্তে ‘ফালাক’ শব্দটি দিযে সামঞ্জস্য সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হয়েছে। যা প্রকারান্তরে আলোর কথাই বুঝিয়ে থাক্ ‘ফালাক’ –এর সময়টি প্রভাতের উজ্জ্বলতার পূর্বে আসে যখন আলো-আঁধারী ভাব বিরাজমান থাকে। সে সময়টি অস্পষ্ট ও রোমাঞ্জকরও বটে।
প্রশ্ন হতে পারে, এখানে কি কি বস্তুর সমন্বয়ে চিত্র অংকিত হয়েছে?
উত্তর হচ্ছে, যদি ‘ফালাক’ (***) ও ‘আল গাসিক’ (***) শব্দ দুটোকে লক্ষ্য করা যায় তবেদেখা যাবে এ হচ্ছে প্রকৃতিগত দুটো চিত্র এবং যদি (***)
(****) ও (****) নিয়ে চিন্তা করা হয় তবে দেখা যাবে, এ দু’টো দল আল্লাহর সৃষ্ট মানুষ।
আর যদি ‘ফালাক ও ‘গাছিকিন’ শব্দ দুটোকে পৃথক পৃথক করে দেখা হয় তবে সেখানে দুটো চিত্রই প্রতিভাত হয়ে উঠে। সময়ের বিচারে একটি আরেকটির বিপরীত। অর্থাৎ ‘ফালাক’ অর্থ প্রভাত আর ‘গাসিকিন’ অর্থ রাত। তদ্রূপ ‘আন নাফ্ফাসাত’ (***) এবং ‘আল হাসিদ’ (***) শব্দ দুটোও মানুষের মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের দু’টো দল। দেখা যাচ্ছে ছবির সব ক’টি উপাদান ক্যানভাসে পর্যাক্রমে বিন্যাস করা হয়েছে। চিত্রপট বা ক্যানভাসে একে-অপরের মুখোমুখি। সমস্ত অংশের রং-ঢং পর্যন্ত এক ও অভিন্ন। সমস্ত অংশের মধ্যেই ভয়-ভীতি মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। অন্ধকার সবকিচুকে গ্রাস করে নিয়েছে। ছবির মূল থিম বিভিন্ন অংশ এবং রঙ সবকিছু একই কেন্দ্রে কেন্দ্রিভূত।
এ আলোচনায় প্রচলিত কোন রীতি-নীতির সাহায্য নেয়া হয়নি এবং এ চিত্রে যে অনুপম সৌন্দর্য পাওয়া যায়, কালের পরিক্রমণে তা ম্লান হবা মতো নয়। কারণ, এখানে কয়েকটি শব্দ এবং চিন্তার বৈপরিত্যের প্রশ্ন নয়। চিত্রের ক্যানভাস, স্থানের বিস্তৃতি ও পরিধি, তার মিল ও ধারাবাহিকতা এবং ছবির থিম যা ছবি আঁকার জন্য বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যখন শুধু শব্দ ও বর্ণনা ঐ সমস্ত উদ্দেশ্যকে পুরো করে দেয় তখন তা অলৌকিক এক ছবির রূপ নেয়।
২. কুরআন মজীদ অনাবাদী ও শুষ্ক জমিনকে এক জায়গায় ‘হামিদাতুন’ (***) (মৃত-পতিত) এবং অপর জায়গায় ‘খাশিয়াতান’ (***) (ঝুঁকে পড়া) বলেছে। অনেকেই মনে করেন, ভাষাকে মাধুর্য করে তুলার জন্য পৃথক দুটো শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এবার দেখুন, এ দুটো শব্দ কোন্ প্রেক্ষিতে ব্যবহার করা হয়েছে।
‘হামিদাতান’ (***) শব্দটি এসেছে নিম্নোক্ত আয়াতে:
(আরবী*******)
(হে লোক সকল! যদি তোমরা পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করো তবে (ভেবে দেখ) আমি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর বীর্য থেকে, এরপর জমাট রক্ত থেকে, এরপর পূর্ণাকৃতি ও অপূর্ণাকৃতি বিশিষ্ট মাংসপিণ্ড থেকে, তোমাদে কাছে ব্যক্ত করার জন্য। আর আমি নির্দিষ্টকালের জন্য মাতৃগর্ভে যা ইচ্ছে রেখে দেই, তারপর আমি তোমাদেরকে শিশু অবস্থায় (সেখান থেকে ) বের করি। তারপর তোমরা যৌবনে পদার্পণ করো, তোমাদের মধ্যে কেউ মৃত্যুবরণ করে এবং কাউকে নিষ্কর্মা বয়স পর্যন্ত পৌঁছে দেই। তখন সে জানার পরও জ্ঞাত বিষয়ে সজ্ঞান থাকে না। তুমি ভূমিকে মৃত দেখতে পাও, অতপর আমিযখন তাতে বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন তা সতেজ ও স্ফীত হয়ে যায়। এবং সকল প্রকার সুদৃশ্য উদ্ভিদ উৎপন্ন করে। (সূরা আল-হাজ্জ: ৫)
‘খাশিয়াতান’ (***) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতে:
(আরবী*******)
তার নিদর্শণসমূহের মধ্যে আছে দিন, রাত, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, চন্দ্রকে না, আল্লাহর সিজদা করো যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন। যদি তোমরা নিষ্ঠার সাথে তাঁরই ইবাদত করো। অতপর তারা যদি অহংকার করে, তবে যারা তোমার পালনকর্তার নিকট আছে, তারা দিন-রাত তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে কখনো ক্লান্ত হয় না। তাঁর এক নিদর্শন এই যে, তুমি ভূমিকে দেখবে অবনত হয়ে (অনুর্বর) পড়ে আছে। অতপর যখন আমি তার উপর বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন তা সতেজ ও স্ফীত হয়ে উঠে। (সূরা হা-মীম আস-সিজদাহ: ৩৭-৩৯)
উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে ‘হামিদাতান’ (***) এবং ‘খাশিয়াতান’ (***) শব্দ দুটোর পার্থক্য স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে। প্রথম আয়াতে জীবন, জীবনের রূপান্তর ও পুনরুক্থান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তাই সেখানে সেগুলোর সাথে সাস স্য রেখে ‘হামিদাতান’ বা মৃত বলা হয়েছে। আবার মানুষকে যেভাবে পুনরুত্থান ঘটাবেন ঠিক সেইভাবে তিনি জমিনকে পুনরুজ্জীবিত করেন, ফলে সে ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে উঠে।
পক্ষান্তরে দ্বিতীয আয়াতে ইবাদাত, নম্রতার সাথে আনুগত্য ও সিজদার কথা বলা হয়েছে, তাই সেখানে জমিনকে ‘খাশিয়াতান’ বা বিনয়ে মস্তক অবনত বলে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ জমিন পানির মুখাপেক্ষী হয়ে অধমুখে আল্লাহর পানির প্রতীক্ষা করতে থাকে, যখন পানি পায় তখন তা ফুলে-ফেঁপে উঠে। একথা বলার পর পূর্বোক্ত আয়াতের মতো ফল-ফসল উৎপন্নের কথা বলা হয়নি। কেননা এবাদত ও সিজদার সাথে ফল-ফসল উৎপন্নের কথাটি অসুন্দর ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই এ আয়াতে (*****) (সতেজ ও স্ফীত) শব্দ দুটো সেই অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, যে অর্থে পূর্বের আয়াতে ব্যবহৃত হয়েছে। এখানে শুধু এজন্যই শব্দ দুটো ব্যবহার করা হয়েছে, যেন জমিনের নড়াচড়া প্রমাণিত হয়। কেননা ইতোপূর্বে জমিন নতজানু হয়ে পড়েছিল। এখানে সেই অবস্থার ওপর গতি সৃষ্টি করা হয়েছে। কারণ, এ দৃশ্যে ইবাদতের জন্য সবাই নড়াচড়ার মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন করছে, এজন্য এটি সম্ভব ছিল না যে, এখানে জমিন স্থির থাকবে। সে জন্য চলমান এ দৃশ্যে ইবাদাতকারীদের সাথে জমিনেরও গতি সৃষ্টি করা হয়েছে। কারণ, ছবিতে সবকিছু চলমান হলে জমিন স্থির থাকবে কেন? এখানে অতি সূক্ষ্ম এক সৌন্দর্য কিংবা দর্শকের চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন করে দেয়।
‘হুমুদুন’; (***) এবং ‘কুশুয়ুন’ (***) শব্দ দুটো অর্থের দিক দিয়ে অভিন্ন। এ দুটো শব্দের অর্থের মধ্যেই পুনরায় জীবন লাভের ইঙ্গিত রয়েছে। শুধু বর্ণনায় নতুনত্ব আনার জন্য এ দুটো শব্দ প্রয়োগের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু কুরআন যেহেতু বক্তব্যের সাথে সাথে শুধু চিন্তার জগতেই নয় বরং মনের মুকুরেও একটি প্রতিচ্ছবি ফেলতে চায় তাই এ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। যাতে পুরো বক্তব্যের মধ্যে একটি যোগসূত্র পাওয়া যায় এবং সবগুলোর সমন্বয়ে একটি চিত্রও পূর্ণতা লাভ করে।
উল্লেখিত আয়াতসমূহে শব্দের বিভিন্নতা একতার অকাট্য প্রমাণ বহন করে যে, আল-কুরআনের চিত্রায়ণ পদ্ধতিটি বর্ণনা-বিশ্লেষণের অন্যতম মৌলিক ভিত্তি। তাছাড়া কুরআন শুধামাত্র বোধগম্য একটি অর্থ বলে দিয়েই তৃপ্ত নয় বরং অর্থের সাথে সাথে একটি জীবন্ত চিত্রও সে উপস্থাপন করে। এ কারণেই স্থান-কাল ও পাত্র ভেদে কুরআনের শব্দচয়নেও সূক্ষ্ম পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
এবার আমরা দেখচ ঐ দুটো ছবি এবং তার অংসসমূহের মধ্যে কোন ধরনের স্বাতন্ত্র্য বর্তমান। প্রথম চিত্রের ভিন্নতা হচ্ছে তার মধ্যে এমন কতিপয় বস্তুর বর্ণনা করা হয়েছে যা অস্তিত্বহীন ছিল, তাদেরকে আকার-আকৃতি দিয়ে জীবন দান করা হয়েছে। অর্থাৎ তার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন জাগিযে দৃশ্যমান করা হয়েছে। তার অংশের মধ্যে একটি হচ্ছে বীর্য যা বিভিন্ন পর্যায়ে অতিক্রম করে একটি পর্যায়ে উপনীত হয়। আরেকটি হচ্ছে মৃত জমিন, বৃষ্টির সংস্পর্শে এসে জীবন্ত হয়ে উঠে। আস্তে আস্তে তা ফল-ফসলে ভরে যায়। বস্তুত সবকিছু মিলে যে অবস্থা ও পারিপার্শ্বিকতার সৃষ্টি করা হয়েছে, তা জীবনের।
দ্বিতীয চিত্রের প্রাকৃতিক কিছু বর্ণনা করা হয়েছে। এও বলা যায় যে, কতিপয় প্রাকৃতিক চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। এ চিত্রের অংশগুলো হচ্ছে রাত, দিন, চাঁদ, সূর্য এবং জমিন যারা আল্লাহর নিকট আনুগত্যের মস্তক ঝুঁকিয়ে রয়েছে। জমিনের ওপর জীবন্ত দুটো দলকে পাওয়া যায় যাদের প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু দৃশ্যত এক। একদল হচ্ছে মানক সমাজ যারা আল্লাহর ইবাদত থেকে উদাসীন। অপর দল হচ্ছে ফেরেশতাগণ, যারা রাত-দিন সারাক্ষণ আল্লাহর ইবাদতে মশগুল। এ সমস্ত অংশ মিলে যে ছবিটি পরিদৃষ্ট হয় তা ইবাদতের চিত্র। এ চিত্রের বিশাল ক্যানভাসে তার প্রটি অংশকেই যথাযথভাবে সংযোজন করা হয়েছে।
৩. আল-কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ঐসব নিয়ামতের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, যা মানুষকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেক আলোচনারই নিয়াতের এক সার্বিক বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে এক ধরনের বিশেষত্ব পরিলক্ষিত হয়। আমরা ুদাহরণ স্বরূপ দুটো জায়গার উল্লেখ করছি। যেমন:
(৩.ক)
(আরবী*******)
আল্লাহ তোমাদের ঘরকে অবস্থানের জায়গা এবং চতুষ্পদ জন্তুর চামড়া দিয়ে তোমাদের জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তোমরা সেগুলোকে সফরকালে এবং বাড়িতে অবস্থানকারলেও পা। ভেড়ার পশম, উটের বাবরিচুল ও ছাগলের লোম দিযে কতো আসবাবপত্র ও ব্যবহারের সামগ্রী তৈরী করেছেন এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। আল্লাহ তোমাদের জন্য সৃজিত বস্তু দ্বারা ছায়া করে দিয়েছেন এবং পাহাড়সমূহে তোমাদের জন্য আত্মগোপনের জায়গা করেছেন এবং তোমাদের জন্য পোশাক তৈরী করে দিয়েছেন। যা তোমাদেরকে গ্রীস্ম ও বিপদের সময় রক্ষা করে। এমনিভাবে তিনি তোমাদের প্রতি স্বীয় অনুগ্রহের পূর্ণতা দান করেন, যেন তোমরা অনুগত হও। (সূরা আন-নাহল: ৮০-৮১)
(আরবী*******)
তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে চিন্তার খোরাক আছে। আমি তোমাদেরকে পান করাই উদরস্থিত বস্তুসমূহের মধ্য থেকে গোবর ও রক্ত নিঃসৃত দুগ্ধ যা পানকারীদের জন্য উপাদেয় এবং খেজুর বৃক্ষ ও আঙ্গুর ফল থেকে তোমরা উত্তম খাদ্য তৈরী করে থাকো, এতে অবশ্যই বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে। তোমার রব্ব মৌমাছিকে নির্দেশ দিয়েছেন: পাহাড়-পর্বতের গায়ে, বৃক্ষ বা উঁচু ডালে ঘর তৈরী করো। তারপর সর্বপ্রকার ফল থেকে ভক্ষণ করো এবং আপন পালনকর্তার উন্মুক্ত পথসমূহে চলমান হও। তার পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানীয় নির্গত হয়, তাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিষেধক। এতে নিদর্শন আছে যারা চিন্তাশীল তাদের জন্য। (সূরা আন নাহল: ৬৬-৬৯)
ওপরে আমরা ‘ক’ ও ‘খ’-তে দু’প্রকারের আয়তের উদ্ধৃতি দিয়েছি। উভয় প্রকারের আয়অতেই ঐসব নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যা আল্লাহর বান্দার জন্য দিয়েছেন। এবার আমরা দেখব উভয় প্রকার আয়াতের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কিনা, আর যদি থাকে তবে তা কি ধরনের?
প্রথম আয়াত ক’টিতে (৩.ক) এমন বস্তুর বর্ণনা করা হয়েছে, যার মধ্যে মানুষ আশ্রয় লাভ করে থাকে। অথবা যে ছায়া থেকে উপকৃত হয় কিংবা তা পরে লজ্জা আবৃত করে। যেমন- ঘর, ছায়া, কাপড়-চোপড় এবং এ ধরনের অন্যান্য সামগ্রী। উপরোক্ত আয়াতের মূল বক্তব্য তাই। এ চিত্রে চতুষ্পদ জন্তু বর্ণনাও এক বিশেষ বৈশিষ্টমণ্ডিত। যেমন তার চামড়া দিয়ে মানুষ তাঁবু তৈরী করে যা সহজে বহনযোগ্য। পশম দিযে চাদর ও অন্যান্য পোশাক তৈরী করা হয়। বস্তুত এ চিত্রে স্থান, চাদর এবং ছায়ার বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয আয়াত ক’টিতে (৩.খ) পানীয় তৈরীর বর্ণনা দেয়া হয়েচে। যেমন মাদকদ্রব্য (যা ফল থেকে তৈরী করা হয়), দুধ, মধু (যা মৌমিাছি থেকে তৈরী হয়) এবং ঐসব জন্তুর বর্ণনা করা হয়েছে যা থেকে মানুষ পানীয় পেয়ে থাকে।
মূলত ওপরে অতি সূক্ষ্ম এক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যা কোন সাধারণ চিত্র নয়, এক অসাধারণ চিত্র। দেখুন, মাদক দ্রব্য ফল থেকে তৈরী করা হয়, কিন্তু তার ধরন ও প্রকৃতি ঐ ফল থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। আবার মধু ফুল থেকেই সংগৃহীত হয় কিন্তু তার সাথে এর কোন সাদৃশ্যতা নেই। দুধ গোবর ও রক্তের মধ্য ধেকে সৃষ্টি হয় কিন্তু দুধের প্রকৃতি ও গুণাগুণের সাথে গোপর ও রক্তের সামান্যতম সম্পর্কও নেই। এ সমস্ত পানীয় অন্য বস্তু থেকে সৃষ্টি। চিন্তা করলে পুরো দৃশ্যেই প্রাণের স্পন্দন পাওয়া যায।
বর্ণিত আয়অতসমূহে স্বতন্ত্রতার যে সূক্ষ্ম চিত্র প্রতিবাত হয়েছে তার প্রতিটি অংশেই একের সাথে অপরের সাদৃশ্যতা ও সমতা বর্তমান। তার মধ্যে একদিকে যেমন সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে। অপরদিকে তা আশ্চর্যের বিষয়ও বটে। এ ধরনের উপমার সংখ্যা কুরআনে নেহায়েত কম নয়। আমরা নিচের আরেকটি উদাহরণ তুলে ধরছি, যা এ বিষয়ের পূর্ণ প্রতিনিধিত্ব করে।
(আরবী**********)
যারা তোমার কাছে আনুগত্যের শপথ করে, তারা তো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে আনুগত্যের শপথ করে, তারা তো প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে আনুগত্যের শপথ করে। আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপরে রয়েছে। অতএব যে শপথ ভঙ্গ করে অবশ্যই সে নিজের ক্ষতি ডেকে আনে, আর যে আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করে আল্লাহর অচিরেই তাকে মহাপুরষ্কার দানে ধন্য করবেন। (সূরা আল-ফাতাহ: ১০)
এ আয়অতে যে চিত্র আঁকা হয়েছে, তা হচ্ছে হাতে হাত রেখে শপথ গ্রহণের। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: (আরবী**********)-আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপরে রয়েছে’। এখানে এক বিশেষ মুহূর্তে যাচাই ও পরখ করা হচ্ছ। কিন্তু ‘ইয়াদুল্লাহি’ (আল্লাহর হাত) বলে রূপায়ণ পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য প্রাসঙ্গিকতা ও বাক্যের সামঞ্জস্যতা বিধান করা। অলংকার শাস্ত্রের ওলামাদের কাছে এর পারিভাষিক নাম হচ্ছে- ‘মুরাআতুন নযীর’ বা মনোযোগ আকৃষ্টকারী উপমা। কিন্তু অলংকার শাস্ত্রের ওলামাগণ বাহ্যিক অবস্থার ওপরই দৃষ্টি প্রদান করেন। তাই ছবি তাদের দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যায়্ কিন্তু আমরা তাদের সে পরিভাষা ছাড়াও দৃশ্যাংকনে ছন্দ, বিন্যাস এবং থিম এর পুরো সম্মিলন দেখতে পাই। এ সম্মিলন এজন্য সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে চিত্রের অংশাবলী পুরো দৃশ্যটার সাথেই খাপ খেয়ে যায়।
কিন্তু একথা স্মরণ রাখা দরকার, আল-কুরআন এ দৃশ্যাংকনে শুধু পারস্পরিক সূক্ষ্ম সম্পর্কে সাহায্য নেয়নি বরং অনেক সময় দূরের সম্পর্ককেও সে কল্পনার মাধ্যমে খুব কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। আমরা মূলত চিত্রায়ণ ও দৃশ্যাংকনের ভাষায় কথা বলছি। কারণ আমরা আমাদের বক্তব্য উপস্থাপনের পূর্বেই একটি চিত্রের মুখোমুখি হই (যা ওপরের আয়াতে পেশ করা হয়েছে)। দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় আসমান ও জমিনকে একত্র করে উপস্থাপন করা হয়। অনেক জায়গায় প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং জীবিত প্রাণিকে একই পরিসরে একত্রিত করে দেয়া হয়। আর এটি ঐ জায়গায়ই হয়ে থাকে যেখানে চিত্রপটে প্রশস্ততা ও বিস্তৃতির অবকাশ থাকে। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)
তারা কি উটের প্রতি লক্ষ্য করে না, কিভাবে তা সৃষ্টি করা হয়েছে? এবং পাহাড়ের দিকে, তা কিভাবে স্থাপন করা হয়েছে? এবং পৃথিবীর দিকে, দেখ, কিভাবে তা সমতল করা হয়েছে? (গাশিয়া: ১৭-২০)
দেখুন, শিল্পীর তুলি একই ছবির মধ্যে কতো সুন্দরভাবে জমিন, আসমান, উট এবং পাহাড়কে একত্রে সাজিয়ে দিয়েছে। ছোট পরিরে দিগন্ত বিস্তৃত কে ছবি। এখানে যে বস্তুর বর্ণনা করা উদ্দেশ্য তা বিশাল, পুরো ভয়ানক ঐ বস্তুগুলো দেখলেই নিজের অজান্তে মনের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে যায়। যে চিত্র এখানে উপস্থঅপন করা হয়েছে তা আসমান থেকে শুরু করে জমিন পর্যন্ত বিস্তৃত। অপরদিকে বিশাল আকাশচুম্বী পাহাড় এবং উঁচু কুঁজওয়ালা উট, সবকিছুকে ছোট একটি ক্যানভাসে পিুঁণভাবে সাজানো হয়েছে। যা বড় মাপের শিল্পী ছাড়া আর কাউকে দিয়েই সম্ভব নয়। একজন বড় মাপের শিল্পীই পারে এরূপ কারুকাজ ও সূক্ষ্মতা সৃষ্টি করতে।
দ্বিতীয়ত, যাকে শুধুমাত্র শিল্পীর চোখেই দেখে থাকে তা হচ্ছে, পুরো ক্যানভাসের একিদকে আসমান অপরদিকে জমিন, মাঝে বিশালায়তনের পাহাড়, তার মধ্যে জীবন্ত প্রাণী উট- যে দিগন্ত প্রসারী মরুভূমিতে চড়ে বেড়ায়। যাকে পাহাড় চতুর্দিক থেকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে।
৪. সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া নিচের এ আয়াত ক’টিও ওপরের বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্ক রাখে।
(আরবী**********)
নিশ্চয়ই আমি আকাশে দূর্গ সৃষ্টি করেছি এবং তাকে দর্শকদের জন্য সুশোভিত করে দিয়েছি। আমি আকাশকে প্রত্যেক বিতাড়িত শয়তান থেকে নিরাপদ করে রেখেছি। কিন্তু যে চুরি করে শুনে পালায়, তার পশ্চাদ্ধাবন করে উজ্জ্বল উল্কাপিণ্ড। আমি ভূপৃষ্ঠকে বিস্তৃত করেছি এবং তার ওপর পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে প্রত্যেক বস্তু সুপরিকল্পিতভাবে উৎপন্ন করেছি। আমি তোমাদের জন্র সেখানে জীবিকার উপকরণ সৃষ্টি করেছি এবং তাদের জন্যও যাদের রিযিকদাতা তোমরা নও।
এ আয়াতে বলা হয়েছে, আসমানে বড় বড় দুর্গ ও উল্কাপিণ্ড আছে। যে উল্কাপিণ্ড বিদ্রোহী শয়তানকে ওপর নিক্ষেপ করা হয়। বিস্তৃত জমিনের ওপর মজবুত পাহাড় স্থাপন করা হয়েছে, আবার জমিনের ওপর উৎপন্ন করা হয়েছে বিভিন্ন উদ্ভি, তা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এবং যথাযথভাবে। এজন্য ‘মাওযুন’ (***) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘বাহীয’ (****) কিংবা ‘লাতীফ’ (***) শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সৃষ্টিকে ‘মাআয়িশ’ আধিক্যবাচক বহুবচনের শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে। আর বলা হয়েছে জমিনে এমন সব প্রাণীও আছে যাদেরকে মানুষ প্রতিপালন করে না। কিন্তু কথাটি উহ্য রাখা হয়েছে।
গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে বুঝা যায়, এ আয়াতগুলোতে যে দৃশ্য ও চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা বিশাল আয়তনের এবং ভারী। সবকিছুকে ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও তাৎপর্যপূর্ণ করে এমনভাবে গেঁথে দেয়া হয়েছে, যেভাবে বিশাল আয়তনের পুরো এক বইতে একটি ফিতার ওপর সবগুলো ফর্মা সেলাই করে গেঁথে দেয়া হয়।
৫. অনেক সময় ছবির বিস্তৃতি ও প্রশস্ততা সৃষ্টির জন্য ক্যানভাসের প্রস্থের দিককে ওপরে ও নীচে করে দেয়া হয়। তবু তার মধ্যে চিত্রের সবকিছুকে শামিল করা কষ্টকর হয়ে যায়। তাই ক্যানভাসের পুরো কাপড়টিই ব্যবহার করে ছবি আঁকা হয়। এ রকম এক ছবির উাদাহরণ হচ্ছে নিচের আয়াতটি:
(আরবী**********)
নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছেই কিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে তা জানেন। কেউ জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোথায় সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, সকল বিষয়ে অবহিত। (সূরা লুকমান: ৩৪)
দেখুন এ আয়াতে ক্যানভাস বা চিত্রপট সাধ্যাতীত বিস্তৃত। এর মধ্যে স্থান ও কাল, বর্তমান ও ভবিষ্যত, অদৃশ্য জগতের খবরাখবর, কিয়ামত, বৃষ্টি, জরায়ুর মধ্যে লুক্কায়িত ভ্রুণ ইত্যাদি শামিল করা হয়েছে। সেই সাথে ভবিষ্যতে অর্জিত হবে এমন রিযিকের কথাও এসেছে। তা অর্জনের সময় খুব এটা দূরে নয়। চোখের সামনেই। মৃত্যু কখন আসবে এবং কোথায় দাফন কাফন হবে এ দৃশ্যটি সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে নিয়েছে।
এ ছবি সময় ও পরিসীমা উভয় দিকেই বড় বিস্তৃত। তার পরিসীমা এবং চতুর্পাশ অদৃশ্য বিষয়ের আড়ালে হাড়িয়ে গেছে। এ সবকিছু মনে হয় ছোট একটি তাকের সামনে দাঁড়ানো, আর তাকের দরজা বন্ধ। যদি সেখানে সুঁইয়ের ছিদ্রের মতো সূক্ষ্ম কোন ছিদ্র দৃষ্টিগোচর হয় তবে দেখা যাবে- যে বস্তু অনেক দূরে তা অতি নিকটে যে কোন বস্তু কাছে তা পেছনেই দণ্ডায়মান, উভয়ের মাঝে কোন ফাঁক নেই। অর্থাৎ এসব বস্তু দূরত্বের শেষ সীমায় অবস্থান করছে ঠিকই কিন্তু অদৃশ্য বস্তুটিই কোন এক সময়ে চেখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠে। তখন সবকিছুকেই একত্রে একই প্লাটফর্মে উপস্থিত মনে হয়।
শৈল্পিক বিন্যাসের একটি সূক্ষ্ম দিক
কুরআনী দৃশ্যসমূহের মধ্যে শৈল্পিক যে মিল ও বিন্যাস পাওয়া যায়, তার আর একটি দিক নিয়ে আমরা এখন আলোচনা করবো। এ পর্যন্ত শৈল্পিক বিন্যাস ও তার সংগতি নিয়ে যে আলোচনা করা হয়েছে তা ছবি ও দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়েছিল্ তাছাড়া সেটি পরিপূর্ণ শৈল্পিক বিন্যাস ছিল যা ছবির কোন অংশে কিংবা পুরো ছবিতে পাওয়া যেতো। কিন্তু আল-কুরআনের অলৌকিকত্ব ও মাহাত্ম্য এখানে এসেই থেমে যেতে পারে না। অনেক সময় তা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি কিংবা চলমান কোন দৃশ্যাকারে প্রতিভাত হয়। আবার কখনো সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে এক সুরের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে, যা তার চারিদিকের সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তা থেকে যে পরিণতি সৃষ্টি হয় তা নিচের উদাহরণ থেকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। যেমন:
(আরবী**********)
শপথ পূর্বাহ্নের, শপথ রাতের যখন তা গভীর হয়। তোমার প্রভু তোমাকে পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি তিনি বিরূপ নন। পূর্বের চেয়ে পরের অবস্থা উত্তম। তোমার প্রতিপালক শীঘ্রই তো তোমাকে দেভেন যেন তুমি সন্তুষট হয়ে যাও। তিনি কি তোমাকে ইয়াতিম পাননি? অতপর তিনি আশ্রয় দিয়েছেন। তুমি ছিলে পথহারা, তিনিই তোমাকে পথ দেখিয়েছেন। তিনি তোমাকে নিঃস্ব অবস্থায় পেয়ে অভাবমুক্ত করে দিয়েছেন। সুতরাং ইয়াতিমের প্রতি কঠোর হয়ো না, ভিক্ষুককে ধমক দিয়ো না এবং তোমার প্রতিপালকের নিয়ামতের কথা প্রকাশ করো। (সূরা দোহা: ১-১১)
উল্লেখিত আয়াতগুলোতে অনুগ্রহ ও অনুকম্পা, দুশ্চিন্তা ও অসহায়তের্বর এক সম্মিলিত আবহ প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। যেমন: (আরবী**********) আয়াত পর্য়ন্ত রহম ও করম এবং দুঃখ ও হতাশার যে সুর মুর্ছনা সৃষ্টি করা হয়েছে তা যেন হৃদয়বীণার সূক্ষ্ম তন্ত্রীর প্রলয়ংকরী ঝংকর। বক্তব্য উপস্থাপনে উপযুক্ত হাল্কা ও করুণ সুরের সমাবেশ ঘটান হয়েছে। যেখানে দুশ্চিন্তার করুণ রাগিণী বেজে চলছে অবিরত। মধ্যাহ্ন (***) এবং কালো পর্দা বিস্তৃতিকারী রাতকে দিয়ে সেই সুরকে ঘিরে দেয়া হয়েছে। মধ্যাহ্নের এ সময়টি রাত ও দিনের মধ্যে সর্বোত্তম সময়। আর দুঃখ-বেদনার প্রতীক হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে রাতকে। রাত যেমন অন্ধকারের হাল্কা আবরণ দিয়ে সবকিছুকে ঢেকে দেয় তদ্রূপ ইয়াতিমী এবং দারিদ্রতা নামক দুঃখের এক সূক্ষ্ম চাদর রাসূলে আকরাম (সা)-কে ঢেকে দিয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে সে চাদর সরে যাচ্ছে। এবং সুখের প্রভাত উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে মধ্যাহ্নে পৌঁছে যাচ্ছে।
(আরবী**********)
তোমার প্রতিপালক তোমাকে পরিত্যাগ করেননি। তোমার প্রতি তিনি বিরূপও নন। আগের চেয়ে পরের অবস্থা ভাল। অচিরেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে যা দেবেন, তুমি খুশী হয়ে যাবে।
এ সুসংবাদ শুনানো হচ্ছে। এভাবেই ছবিটি পরিবেশ পরিস্থিতি, রং, ঢং এবং উপমা-উৎক্ষেপণ সবকিছু পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।
খ. এখন আরেক ধরনের সুর শুনুন। এর প্রেক্ষাপট ও ছবির দুটোই ভিন্নধর্মী।
(আরবী**********)
শপথ ঊর্ধ্বাশ্বাসে চলমান অশ্বসমূহের। অতপর ক্ষুরাঘাতে অগ্নিবিচ্ছুরক অশ্বসমূহের। অতপর প্রভাতকালে আক্রমণকারী অশ্বসমূহের ও যারা সে সময় ধূলি উৎক্ষিপ্ত করে। অতরপ যারা শত্রুদলের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। নিশ্চয় মানুষ তার পালকর্তার অকৃতজ্ঞ এবং সে অবশ্যই এ বিষয়ে অবহিত এবং সে নিশ্চিত ধন-সম্পদের ভালবাসায় মত্ত। সে কি জানে না, যখন কবরে যা আছে তা উত্থিত হবে এবং অন্তরে যা আছে তা বের করা হবে? সেদিন তাদের কি হবে সে সম্পর্কে তাদের পালনকর্তা সম্যক অবহিত। (সূরা আল-আদিয়াত: ১-১১)
এ সূরার সুর ও ছন্দের ঢং সূরা আন-নাযিয়াতের অনুরূপ। তবে এখানে ‘আন-নাযিয়াতের’ চেয়ে কাঠিন্য ও তীক্ষ্মতা অনেক বেশি। তাছাড়া এখানে কর্কষতা, ভীতি, রাগ ও শোরগোলের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এ সূরাটি স্থঅন, কাল ও পাত্রের সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল। যখন মৃত ব্যক্তি কবর থেকে উঠবে তখন শোরগোল সৃষ্টি হবে এবং তার মনের যাবতীয গোপন জিনিসকে মূর্তমান করে বের করে রাখা হবে। এখানে এক প্রকার কাঠিন্যের সৃষ্ট করা হয়েছে। যা অকৃতজ্ঞা, ঔদ্ধত্য ও সংকীর্ণতার পরিবেশের সাথে পূর্ণ মিল আছে। য্যখন এ পুরো সৌন্দর্যের জন্য একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রেক্ষাটের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে তখনই সেইরূপ কোলাহলপূর্ণ একটি পরিবেশকে গ্রহণ করা হয়েছে এবং দ্রুতগামী ঘোড়ার পদধূলি এবং হ্রেসা দিয়ে তৈরী করা হয়েছে সে প্রেক্সাপট। সেগুলো প্রাতঃকালে দুশমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চিত্রের সাথে প্রেক্ষাপট এবং প্রেক্ষাপটের সাথে চিত্র চমৎকারভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এভাবেই গোটা ছবিটি তার প্রতিটি অংশ নিয়ে সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে।
গ. আমরা ইতোপূর্বে ছবির দুটো প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করলাম। দুটোই স্বতন্ত্র এবং পরস্পর ভিন্নধর্মী। তবে এ দুটো ছবির রং-ঢং একটি অপরটির সাথে সাদৃশ্য রাখে। প্রেক্ষাপট সবসময় একই রঙ-ঢং সীমাবদ্ধ থাকে না বরং বিভিন্ন ধরনের ও রঙের হয়ে’ থঅকে এবং তার মধ্যস্থিত যে ছবি, তাও অনুরূপ হয়। যেমন:
(আরবী**********)
শপথ রাতের যখন সে আচ্ছন্ন করে, শপথ দিনের যখন সে আলোকিত হয় এবং শপথ তাঁর যিনি নর ও নারী সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই তোমাদের কর্ম প্রচেষ্টা ভিন্ন ভিন্ন। অতএব, যে দান করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে ও উত্তম বিষয়কে সত্য মনে করে আমি তার সুখের জন্য সহজ পথ দান করবো। আর যে কৃপণতা করে ও বেপরোয়া হয় এবং উত্তম বিষযকে মিথ্যে মনে করে আমি তার কষ্টের জন্য সহজ পথ দান করবো। যখন সে ধ্বংসে নিপতিত হবে, তখন তার সম্পদ তার কোন কাজেই আসবে না। আমার দায়িত্ব পথ-প্রদর্শন করা। আমিই ইহকাল ও পরকালের মালিক। অতএব, আমি তোমাদেরকে প্রজ্জ্বলিত আগুন সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছি। এতে নিতান্ত হতভাগ্য ব্যক্তিই প্রবেশ করবে, যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ থেকে দূরে রাখা হবে মুত্তাকী ব্যক্তিকে, যে আত্মশুদ্ধির জন্র তার ধন-সম্পদ দান করে এবং তার ওপর কার কোন প্রতিদানযোগ্য অনুগ্রহ থাকে না তার মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্ট অন্বেষণ ছাড়া। সে অচিরেই সন্তুষ্টি লাভ করবে। (সূরা আল-লাইল।: ১-২১)
এ সূরায় যে ছবি আঁকা হয়েছে, তার মধ্যে সাদা ও কালো (অর্থাৎ পাপ ও পুন্য) দুটোই বর্তমান। সেকান (****)- ‘যে দান করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে।’ যেমন বলা হয়েছে, তেমনি পাশাপাশি এও বলা হয়েছে যে, (***) ‘যে কৃপণতা করে ও বেপরোয়া হয়।’ তেমনিভাবে (****) ‘আমি তার সুখের জন্য সহজ পথ দান করবো’ বলা হয়েছে। তদ্রূপ (আরবী**********)-‘হতভাগ্য সে, যে মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়’-এর সাথে সাথে বলা হয়েছে: (আরবী**********)-‘আল্লাহভীরু ব্যক্তি যে আত্মশুদ্ধির জন্য তার ধন-সম্পদ দান করে।’ এভঅবেসাদা এবং কালায় গোটা ছবির প্রেক্ষাপট নির্বাচন করা হয়েছে।
যেমন একদিকে বলা হয়েছে (****)-‘রাতের শপথ যখন তা আচ্ছন্ন করে নেয়।’ ঠিক তেমনিভাবে বলা হয়েছে: (******)-‘দিনের শপথ যখন সে আলোক উদ্ভাসিত হয়ে যায।’ এখানে ‘আল লাইল’ (***) এর সাথে ‘ইয়াগ্শা’ (***) শব্দ বেছে নেয়া হয়েছে কিন্তু সূরা দ্বোহায় নেয়া হয়েছে ‘সাজা’ (***) শব্দটি। সম্ভবত রাত ও দিনের মুখোমুখি অবস্থানকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্যই এরূপ করা হয়েছে। আবার (****)-এর মধ্যে নর ও নারী একই জাতি কিন্তু একে অপরের বিপরীত। এজন্যই বলা যায়, এ প্রেক্ষাপট ছবির সম্পূর্ণ আনুকুল্যে।
সূরা আল-লাইলে যে সুর-ছন্দ পাওয়া যায় তা সূরা দ্বোহার চেয়ে অনেক উন্নত। কিন্তু সেই সুর ব্যঞ্জনায় নির্দয়তা ও মনের গহন বেদনা নেই। কারণ বর্ণনা ও প্রেক্ষাপটের দাবিও তাই। এ ঐক্য ও মিল তর্কতীতভাবেই বড় চমৎকার।
কুরআনী চিত্রের স্থায়ীত্বকাল
আল-কুরআনে যে শৈল্পিক সঙ্গতি পাওয়া যায়, এখন আমরা তার আরেকটি দিক নিয়ে আলোচনা করবো।
আল-কুরআনের দৃশ্য ও ছবি সম্পর্কে শুধু একথা বলেই শেষ করা যায় না যে, ছবি ও দৃশ্যের বিভিন্ন অংশ ও রঙের মধ্যে মিল কেরে দিলে, সুর ও ছন্দের এমন তাল সৃষ্টি করে দিলেই হয়ে যাবে যা প্রেক্ষাট বা মূল থিমের অনুকূলে। বরং দৃশ্যকে আকর্ষণীয় শিল্প মানের পরিপূর্ণতা এবং স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টির প্রয়াসকে সামনে রেখে আরেকটু অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। কারণ, ঐ দৃশ্যকে কল্পনার জগতে প্রতিষ্ঠিত রাখতে সময়কে স্থিরকরণ একান্ত প্রয়োজন। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, কুরআনেকারীম এ প্রয়োজনটাকেও অত্যন্ত সুন্দর ও সঠিকভাবে সম্পন্ন করেছে।
আল-কুরআনের উপস্থিাপিত কিছু দৃশ্য তো চোখের পলকেই হারিয়ে যায়, যা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার অবকাশটুকটুও থাকে না। কিছু ছবি এতো দর্ঘস্থায়ী হয়, পাঠক মনে করে এ দৃশ্য আর কখনো চোখের আড়াৎল হবে না। কিছু ছবি চলমান আবার কিছু স্থির। দৃশ্যের অভন্তরে পাওয়া যায়। তাছাড়া কুরআনের সাধারণ উদ্দেশ্যও সেকানে সমভাবে প্রতিফলিত হয়। কোন দৃশ্যের দীর্ঘতা কিংবা সংক্ষিপ্ততা একটি বিশেষ উপায়ে সংঘটিত হয়। তার মধ্যস্থিত সমস্ত উপায় ও উপকরণ দৃশ্যের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে পূর্ণতা দান করে।
এ নতুন ময়দানে আমাদের প্রদক্ষেপ, এখন আমরা পর্যায়ক্রমে তার দৃষ্টান্ত তুলে ধরবো:
১. কুরআন মানুষেরা সামনে এ দৃশ্য উস্থাপন করতে চায় যে, এ পৃথিবীর সময়কাল কতো কম- যা মানুষকে পরকালের জীবন সম্পর্কে উদাসীন করে দেয়। এ দৃশ্যকে কুরআন উপস্থাপন করেছে:
(আরবী**********)
তাদেরকে পার্থিব জীবনের উপমা শুনিয়ে দাও, তা পানির ন্যায়, যা আমি আকাশ থেকে বর্ষণ করি। অতপর তার সংমিশ্রণে জমিন থেকে লতা ও ঘাস-পাতার অংকুরোদম হয়। তারপর তা শুষ্ক হয়ে ভূসির মতো বাতাসে উড়ে যায়। আল্লাহর সবকিছু করতেই সক্ষম। (সূরা আল-কাহাফ: ৪৫)
এখান তিনটি কথা বলা হয়েছে। ১. পানি আকাশ থেকে বর্ষিত হওয়া। ২. পানি ও মাটির সংমিশ্রণে উর্বরা শক্তির বিকাশ এবং ৩. তারপর তা শুকিয়ে ভূসির মতো বাতাসে উড়ে যাওয়া।
এ তিনটি সংক্ষিপ্ত বাক্যে একথাই বলা হয়েছে যে, তিনটি দৃশ্যেই পার্থিব জীবন শেষ হয়ে গেছে। আহা! জীবন কতো সংক্ষিপ্ত!
সংক্ষিপ্তভাবে উদ্ভিদের যাবতীয় বিবর্তন সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে কোন দিকই বাদ পড়েনি। অবশ্য দ্বিতীয় অবস্থার কথাটা বলা হয়নি। প্রথমে পানির কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা ফসল উৎপাদনক্ষম করে তুলে। তারপর এক পর্যায়ে ফসল পেকে যায় এবং শুকিয়ে খড়কুটোগুলো বাতাসে উড়ে যায়। এখন প্রশ্ন হতে পারে উদ্ভিদের দ্বিতীয অবস্থার কথা ছাড়া আর কী বাদ পড়েছে”?
উল্লেখিত আয়াতের সুস্পষ্ট বর্ণনা, দৃষ্টিকাল এবং সৌন্দর্য সুষমা সব উপকরণই জমা হয়ে’ গেছে। বর্ণনা পদ্ধতি তো এতো সুস্পস্ট ও বলিষ্ঠ যে, তার মাধ্যমে যা কিছু বুঝানোর উদ্দেশ্য ছিল তার সামান্যও আর অবশিষ্ট নেই যাতে দ্বীনি উদ্দেশ্য পুরা হতে পারতো। দর্শন-কাল এ চিত্রকে পূর্ণতায় পৌঁছে দিয়েছে যা সৌন্দর্য সুষমার সীমাতিক্রম করে চিন্তাশক্তিকে শাণিত করে তুলে।
এ দৃশ্যকে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করার জন্য শব্দ বিন্যাস এবং শৈল্পিক উপকরণ দুটোরই সাহায্য নেয়া হয়েছে। যেমন ‘ফাখ্তালাতা’ (****) শব্দের অনুসরণীয় ‘ফা’ যা ঘটনার ধারাবাহিকতা প্রকাশে ব্যবহৃত হয়। এ অক্ষরটি পুরো দৃশ্যটিকে পরিপূর্ণতা এবং দ্রুততার সাথে উপস্থাপন করেছে। এ ‘ফা’ অক্ষরটি হতেই প্রতীয়মান হয় যে, পতিত পানি প্রকৃতপক্ষে জমিনের সাথে না মিলে বরং জমিন থেকে সৃষ্ট লতাগুল্ম ও উদ্ভিদের সাথে মিলে যায়। এমন ঢঙে তা উপস্থাপন করা হয়েছে যা কাংখিত দ্রুততাকে প্রতিস্ঠিত করে দিয়েছে।
২. প্রায় এ রকম আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে নিচের আয়াতটি। অর্থ, উদ্দেশ্য ও দৃষ্টি আকর্ষণের ধরন ও পদ্ধতি একই কিন্তু কিছুটা ভিন্ন স্টাইলে উপস্থাপন করা হয়েছে।
(আরবী**********)
তোমরা জেনে রেখ, পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক, সাজ-সজ্জা, পারস্পরিক অহমিকা ও ধন-জনের প্রাচুর্য ছাড়া আর কিছু নয়। যেমন বৃষ্টি, যার সবুজ ফসল কৃষকদেরকে উৎফুল্ল করে, এরপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তাকে পীতবর্ণ দেখতে পাও, তারপর তা খড়কুটো হয়ে যায়।
এ আয়াতে নশ্বর দুনিয়ার যে ছবি আঁকা হয়েছে তা আগের আয়াতের সাথে মিল আছে। অনেকে মনে করতে পারেন এ ছবিতে চিত্রের কোন গড়মিল নেই। আসলে এ দুটো আয়অতের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান। তা হচ্ছে কাফিররা দুনিয়াকে প্রাধান্য দেয়ার কারণ হচ্ছে এখানে খেলাধূলা ও হাসি-তামাশার পরিবেশের ন্যায় পরিবেশ এবং আনন্দ-ফূর্তির যাবতীয উপায়-উপকরণ হাতের মুঠোয়- যা একটু পরিশ্রমেই লাভ করা যায়। ধন-সম্টদ ও জনবলে পরস্পর প্রতিযোগিতা করা যায়। আল্লাহ বলেন: কাফিররা যেসব বিষয়ে মত্ত আছে এবং জীবনকে অনেক দীর্ঘ উপভোগ্য মনে করছে, মূলত তা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও ধ্বংসশীল। যেমন বৃষ্টি মাটিকে উর্বর করে এবং বিভিন্ন ধরনের ফল-ফল উৎপন্ন করে, কৃষকরা উৎফুল্ল হয়, কিন্তু দেখা যায় সেসব উদ্ভিদ একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর থেকে শুকিয়ে যায় এবং খড়কুটোর মতো বাতাসে উড়ে যায়। দুনিয়ার অবস্থাও ঠিক এমন।
আল-কুরআনে যে সমস্ত আয়াত দেখতে এরকম মনে হয় সে সবের মধ্যে ওপরে আলোচিত পার্থক্যের মতো সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। দেখতে এক রকম এরূপ দুটো আয়অতের মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়। অবশ্য এ পার্থক্যটা সাধারণ হতে পারে আবার গুরুত্বপূর্ণও হতে পারে। ঐ সমস্ত আয়াতের মাধ্যমে যেমন দাওয়াতী কাজ হয়, তেমনিভাবে তা শৈল্পিক সৌন্দর্য ও সৌকর্যের বাহনও বটে। তাছাড়া ঐ সূক্ষ্ম পার্থক্যের কারণে যেমন তার মধ্যে নতুনত্বের সৃষ্টি হয় আবার তা একটি প্রকার হিসেবেও গণ্য হয়।
৩. আগের দুটো উদাহরণে দেখা গেছে দ্বিতীয অবস্থঅকে বিলোপ করে বর্ণনার সংক্ষেপ করা হয়েছে। কিন্তু এখন এমন একটি উদাহরণ পেশ করবো যা আগের উদাহরণের মতোই দুনিয়ার সময়কে সংক্ষিপ্ত করে তুলে ধরা হয়েছে। তবে এ সংক্ষিপ্ততা পূর্বের (উদাহরণের) চেয়েও বেশি। এখানে দুনিয়ার দুটো অবস্থাকে (শুরু ও শেষ) এক মুহূর্তের মধ্যেই একত্র করে দেয়া হয়েছে। সেই সাথে বুঝানো হয়েছে যে, দুনিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময়টি কী পরিমাণ দীর্ঘ। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)
প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে গাফিল করে রাখে। এমনিভাবে তোমরা কবরের সাক্ষাত পেয়ে যাবে। (সূরা আ-তাকাছুর: ১-২)
এ আয়অতে যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা জীবনের পরিসীমার একটি চিত্র। যার শুরু ধন-সম্পদ ও প্রাচুর্যের অনুসন্ধান দিয়ে এবং শেষ কবর। জীবনের শেষ সীমা সম্পর্কে এর চেয়ে সংক্ষিপ্ত ও সীমাবদ্ধ চিত্র, বর্ণনার কিংবা চিন্তার মাধ্যমে আর কিভাবে আঁকা সম্ভব? এ ছবির আরেকটি দিক হচ্ছে জীবনের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত যে সময়টি তাও দুনিয়ার খেল-তামাশায় লিপ্ত হয়ে শেষ হয়ে যায়। ‘হাত্তা’ (***) শব্দটি ব্যবহার করে বুঝানো হয়েছে যে, তার দীর্ঘতার শেষে সীমা কোথায়। এতো স্বল্প সময়েও মানুষ অপ্রয়োজনীয় কাজে লিপ্ত হয়ে যায়, অথচ সে জানে তার জীবন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। সংক্ষিপ্ত দুটো আয়াত দিয়ে পুরো উদ্দেশ্যটিকে সুন্দর ও সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
৪. নিচের আয়াতটিও এ ধরনের বিষয়বস্তু সম্বলিত, কিন্তু এর উদ্দেশ্য ভিন্ন।
(আরবী**********)
কিভাবে তোমরা আল্লাহকে অস্বীকার করতে পার? তোমরা ছলে নিষ্প্রাণ অতপর তিনিই তোমাদের প্রাণ দান করেছেন। আবার মৃত্যু দেবেন, তারপর আবার তোমাদের জীবিত করবেন। অতপর তার দিকেই তোমাদেরকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। (সূরা আল-বাকারা: ২৮)
একই আয়াতের চারটি অংশে সৃষ্টি চার অবস্থার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। প্রথম অবস্থা হচ্ছে সৃষ্টিপূর্ব অব্থা, দ্বিতীয অবস্থা সৃষ্টির পর দুনিয়ার জীবনে বিচরণ সংক্রান্ত, তৃতীয অবস্থা হচ্ছে এ পৃথিবী থেকে অবশ্যই একদিন চলে যেতে হবে এবং চতুর্থ অবস্থা হচ্ছে, দুনিয়ার জীবনের পর আরেকটি জীবন আছে এবং সেখানে সবাইকে উপস্থিত হতে হবে।
দুনিয়ার জীবনের পূর্ব অবস্থাকে বলা হয় আযল। অস্তিত্ব লাভকরার পরের অবস্থা ও অবস্থানকে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, যার নাম হায়াত বা জীবন। তারপর মৃত্যু এবং মৃত্যুর পর শুরু হবে আখিরারেত জীবন। সংক্ষিপ্ততার জন্য চারটি অবস্থাকে মাত চারটি শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। কিন্তু চিন্তাশক্তি একে অনেক দীর্ঘসময় মন করে অথচ কুদরতে আযীমের নিকট এ দীর্ঘ সময়টুকু চোখের একটি পলকের ন্যায়মাত্র। কুদরতে আযমা একটি জিনিসকে শুধু বলেন,‘হয়ে যাও’ আর অমনি তা হয়ে যায়। সেই দ্রততাকেই আরো উজ্জ্বল করে উপস্থাপন করেন। বিশেষ করে সেই দীর্ঘ সময়কে যখন চোখের পলক পরিমাণ সময়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। তাহ
লে কিভাবে আল্লাহকে অস্বীকার করা যায়? আর কিভাবে তার বিরুদ্ধাচরণ করা যায়? তিনিইতো সেই সত্তা যিনি প্রথম থেকেই তোমাদের সবকিছুর মালিক। আবার শেষ পর্যন্ত তিনিই মালিক থাকবেন। আর তোমরা তার নিকটই ফিরে যাবে।
পরের আয়াতে সংক্ষিপট্ততাকে পূর্ণ রূপ দেয়া হয়েছে:
(আরবী**********)
তিনিই সেই সত্তা যিনি পৃথিবীর সবকিছুকে তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেচেন তারপর তিনি মনোযোগ দিয়েছেন আকাশের দিকে, আকাশ সাতটি স্তরে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আল-বাকারা: ২৯)
এভাবে এক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি পৃথিবীর সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি আসমানের দিকে মনোযোগ দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই তা সাত স্তরে বিন্যাস করে সৃষ্টি করেছেন। আল-কুরআনের যেসব জায়গায় এ বিষয়ের বর্ণনা করা হয়েছে সেসব আয়াতে আসমান-জমীনের সৃষ্টির বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
৫. এ পর্যন্ত দৃশ্যাবলীতে সংক্ষিপ্ততার সাহায্য নেয়া হচ্ছিল। এসব দৃশ্যে কোথাও মধ্যবর্তী অবস্থার কথা বাদ দিয়ে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে আবার কোথাও এক অবস্থাকে আরেক অবস্থার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এখন আমরা সংক্ষিপ্ততার এমন একটি উদাহরণ পেশ করবো যেখানে প্রকৃতির শিল্পী তাঁর নিপুণ শিল্পকর্মে সুন্দর এক কলা প্রদর্শন করেছেন, যেখানে অত্যন্ত শক্তিশালী তুলির সাহায্যে নেয়া হয়েছে। সেখানে তুলির বিক্ষিপ্ত স্পর্শে এমন এক অবিস্মরণীয় ছবি ভাস্বর হয়ে উঠেছে, যার দিকে দৃষ্টি দিলে মনে হবে এখানে কিছুই ছিল না। যখন কল্পনাশক্তি সেই ক্যানভাসে দৃষ্টি প্রদান করে তখনই মনে হয় সেখানে কিছুই ছিল না।
(আরবী**********)
যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করলো, সে যেন আকাশ তেকে ছিটকে পড়ল, অতপর মৃতভোজী পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোন দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করলো। (আল-হাজ্জ: ৩১)
কতো দ্রুত এটি সংঘটিত হচ্ছে, জমিন থেকে ছিটকে পড়া, তাৎক্ষনাৎ কোন মাংশাসী পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাওয়া কিংবা বাতাস তাকে দূর-দূরাস্তে উড়িয়ে নিয়ে ফেলে দেয়া। এবার এমন একটা চিত্র চোখের সামনে রয়ে যায় মনে হয় এখানে কোনকালেই কিছু ছিল না।
একটু চিন্তা করুন, ছো মেরে নেয়ার ক্ষিপ্রতার মধ্যে কী রহস্য লুকিয়ে আছে? এর রহস্য হচ্ছে, কেউ যেন মনে না করেন যে, মুশরিকদের কোন ঠিকানা বা স্থায়ীত্ব আছে। তবু পৃথিবীতে তাদেরকে ক্ষণিকের জন্য যায়গা দেয়া হয়েছে। মুশরিকদের বংশ পরিচয় কেমন, তারা কতোটুকু শান-শওকতের অধিকারী, তাদের গোত্রের শাখা-প্রশাখা এবং জনবল কেমন- এসব বিষয় কোন ধর্তবব্যই নয়, তারা অজানা স্থান থেকে এসে আবার চোখের পলকে আরেক অজানায় চলে যায়। দুনিয়ার জীবনে স্থির হয়ে বসা তাদের নসীবেই নেই।
এবার আমরা কিছু দীর্ঘ চিত্র পেশ করব।
দীর্ঘ চিত্র
১. আমরা সেই আয়াতের আলোচনা করেছি, যেখানে বলা হয়েছে বৃষ্টির পানি আকাশ থেকে বর্ষিত হয়। তারপর জমিন থেকে নানা ধরনের উদ্ভিদের অংকুরোদগম হয়। এক পর্যায়ে সেগুলো পেকে শুকিয়ে খড়কুটোয় পরিণত হয় এবং বাতাস তা উড়িয়ে নিয়ে যায়। গোটা দৃশ্যটিকে চোখের পলকে উপস্থান করা হয়েছে। এখন আমরা দেখবো যে, এ ধরনের দৃশ্যকে অনেক জায়গায় কতো ধীরে-সুস্থে বর্ণনা করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে:
(ক)
(আরবী************)
তিনি আল্লাহ যিনি বাতাস প্রেরণ করেন এবং তা মেঘমালাকে সঞ্চারিত করে। অতপর তিনি মেঘমারাকে যেভাবে ইচ্ছে আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তাকে স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি তার মধ্য থেকে বৃষ্টি হতে দেখ। তিনি তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদেরকে ইচ্ছে তা পৌঁছান, তখন তারা আনন্দিত হয়। (সূরা আর-রূম: ৪৮)
এ আয়াতটি প্রথম অবস্থার অন্তর্ভুক্ত যেখানে বৃষ্টির পানি জমিন পর্যন্ত পৌঁছার কথা বলা হয়েছে। যেমন বৃষ্টি মেঘ আকারে আকাশে বাতাসে সাথে ভেসেবেড়ায়। যখন আল্লাহ চান তখন তা ভারী করে দেন এবং বৃষ্টি আকারে জমিনে নেমে আসে। মানুষ প্রথমে নিরাশ হলেও পরে বৃষ্টি দেখে খুশি হয়। আসুন এবার দেখি বৃষ্টির বর্ষণের পরে কি হয়?
(খ)
(আরবী************)
তুমি কি দেখনি যে, আল্লাহ আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং সে পানি দিয়ে বিভিন্ন রঙের ফসল উৎপন্ন করেন, অতপর তা শুকিয়ে যায় ফলে তোমরা সেগুলো পীতবর্ণ দেখতে পাও? তারপর আল্লাহ সেগুলোকে খড়কুটোয় পরিণত করে দেন। নিশ্চয়ই এতে বুদ্ধিমানদের জন্য উপদেশ আছে। (সূরা আয-যুমার: ২১)
দেখুন এখানে সব কাজ ধীরে-সুস্থে পরিচালিত হচ্ছে। পানি আকাশ থেকে বর্ষিত হয় কিন্তু সাথে সাথেই জমিনে অংকুরোদগম হয় না। বরং সে পানি নদী বা ঝর্ণা বয়ে যায়। (আরবী*(*******)-‘অতপর তা থেকে ফসল উৎপন্ন হয়।’ যা বিভিন্ন রঙে পরিবর্তি হয়। রঙের পরিবর্তনই অবকাশের দাবি রাখে। তারপর তা আন্দোলিত হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে পেকে যায় এবং পীতবর্ণ ধারণ করে। এখানে সুস্পষ্ট যে, এ অবস্থা একটি সময় উত্তীর্ণ হওয়পার পর সংঘটিত হয়, ‘ছুম্মা’ (***) শব্দ দিয়ে তাই বুঝা যায়। (***)-অতপর তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হয়’ বাক্য দিয়ে বুঝা যায় চূর্ণ-বিচূর্ণ করার কাজটিও একটু সময় নিয়ে করা হয়। এখানে (***) শব্দটি বর্তমান/ভবিষ্যতকালের শব্দ নেয়া হয়েছে। অন্যত্র (***)-চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে’ এবং (***) –‘চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়’ বলা হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে কারো হস্তক্ষেপ ছাড়া একাকী তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। এখানে বলা হয়েছে, তা চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হয় এবং সে অবস্থায়ই রয়ে যায়। কিন্তু আরেক জায়গায় বলা হয়েছে: (****)-‘বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়।’ তারপর তার আর কোন স্মৃতি চিহ্ন অবশিষ্ট থাকে না।
এ ধীর-স্থিরতা ও দীর্ঘতার মধ্যে রহস্য হচ্ছে, এ আয়াতে আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের কথা আলোচনা করা হয়েছে। এজন্য নিয়ামতের কথা বলতে গিয়ে ধীরে ধীরে বলা হয়েছে যাতে দর্শকগণ ধীরে-সুস্থে এ দৃশ্য অবলোকন করতে পারে এবং তা থেকে উপকৃত হতে পারে, কোন আকাঙ্ক্ষাই যেন আর অবশিষ্ট না থাকে। শুধু এ কারণেই দৃশ্যকে দীর্ঘায়িত করা হয়েছে।
২. আরেকটি দৃশ্য দেখুন, যেখানে নবী করীম সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীদেরকে একটি ক্ষেত ও ফসলের সাথে তুলনা করে বলা হয়েছে:
(আরবী************)
তওরাতে তাদের অবস্থা এরূপ এবং ইঞ্জিলে তাদের অবস্থা বলা হয়েছে যেমন একটি চারাগাছ যা থেকে নির্গত হয় কিশলয়। তারপর তা শক্ত ও মজবুত হয় এবং দৃঢ়ভাবে কাণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে যায়। চাষীকে আনন্দে অভিভূত করে যাতে আল্লাহ তাদের দ্বারা কাফিরদের অন্তর্জালা সৃষ্টি করেন। (সূরা আল-ফাতহ্: ২৯)
এ আয়াতে যে ক্ষেতের কথা বলা হয়েছে সে ক্ষেতের ফসল শুকিয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে বাতাসে উড়ে যায় না। বরং তা অটল ও অনড় থাকে। এ ছবি চিরন্তনী। কখনো মন ও চিন্তা থেকে এটি বিলীন হয়ে যায় না। এটি এমন এক ছবি যা মন ও চিন্তার জগতে সুদীর্ঘ প্রভাব ফেলে।
এখানে একটি কথা চিন্তা করা প্রয়োজন, ছবিটি দীর্ঘ একটি ছবি বটে কিন্তু তার প্রাথমিক অংশগুলো দ্রুত সংঘটিত হয়ে যায়। যেমন একটি ক্ষেতে বীজ ফেলা মাত্র অংকুরোদগম হয়ে খুব তাড়াতাড়ি বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়। এতে বেশি বিলম্ব হয় না। তারপর এক পর্যায়ে গিয়ে তা আপন কাণ্ডের ওপর স্থির হয়ে দাঁড়িযে যায়। এ হচ্ছে মুসলমানদের প্রাথমিক অবস্থা। প্রথমতঃ তারা ইসলাম গ্রহণ করতে বিলম্ব করেননি। দ্বিতীয়তঃ তারা ঐ অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত রইলেন। তাদের অবস্থা পূর্ণতায় পৌঁছার পর আর সেখানে কোন পরিবর্তন সূচিত হলো না।
৩. আমরা এর আগে যে দৃশ্যের উল্লেখ করেছি, সেখানে মানুষের গোটা জিন্দেগীর (অর্থাৎ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত) এমন একটি চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছিল যা চোখের পলকে শেষ হয়ে গিয়েছিল। এবার আমরা দেখবো আরেকটি দৃশ্য, গোটা জিন্দগীর নয়। জীবনের একটি অংশ বিশেষের, কিন্তু দীর্ঘতার দিকে তা অনেক বেশি। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী************)
আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আঁধারে স্থাপন করেছি। অতপর আমি শুক্রবিন্দওকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি। এরপর জমাট রক্তকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করেছি, তারপর সে মাংসপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতপর অস্থিতে মাংস দ্বার আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে এক নতুন রূপে দাঁড় করিয়েছি। নিপুণতম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কতো কল্যাণময়।
দেখুন মানুষের জীবনের শুধু একটি অধ্যায়ের আলোচনা কতো দীর্ঘ। এখানে গর্ভধারণের পর থেকে প্রসবের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের আলোকপাত করা হ য়েছে। এর মাধ্যমে যে উপদেশ যা নসীহত করা হয়েছে তা প্রতিটি বিবেকের ওপর প্রবাব ফেলার জন্য যথেষ্ট। তাই বলা যায় এ দীর্ঘতা এখানে অপসন্দনীয় নয়।
৪. যে সমস্ত দৃশ্য দীর্ঘস্থায়ী করে চিত্রায়ণ করা হয়েছে, তার মধ্যে কিয়ামতের দিনের এবং জাহান্নামের শাস্তির দৃশ্যগুলো অন্যতম। যখন সেই কাজ নির্দিষ্ট হয়ে যায় এবং তার চিত্র তুলে ধরার প্রয়োজন হয়ে পড়ে তবে তা দীর্ঘস্থায়ী চিত্রের সাহায্যে তুলে ধরা হয়। যেন সেই ছবি প্রতিটি মানুষের চিন্তা-চেতনাকে প্রভাবিত করতে পারে এবং তার ভয়াবহ পরিণতি যার ছাপ বিবেকের প্রভাব পড়তে পারে।
কিছু চিত্রকে দীর্ঘায়িত করার জন্য কতিপয় উপায়-উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। নিচে তার কয়েকটি উদাহরণ পেশ করছি। যদি পুস্তকের কলেবর বৃদ্ধি আশংকা না থাকতো তবে এ বিষয়ে স্বতন্ত্র এক অধ্যায় সংযোজন করে দিতাম।
[৪.১] অনেক সময় কোন দৃশ্য দীর্ঘতার সাথে উপস্থাপনের জন্য এমন শব্দে এবং স্টাইলে তা পেশ করা হয়, যা থেকে পুনরাবৃত্তির অনুভূতি সৃষ্টি হয়্ যেমন:
(আরবী************)
যারা আমার আয়াতসমূহকে অস্বীকার করবে তাদেরকে আমি অচিরেই আগুনে দগ্ধ করাবো। আগুন যখন তাদের চামড়াকে ঝলসে দেবে তখন আমরা তার পরিবর্তে নতুন চামড়া তৈরী করে দেব, যেন তারা শাস্তিকে পুরোপুরি অনুভব করতে পারে। (সূরা আন-নিসা: ৫৬)
এ আয়অতে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। কল্পনার চোখ বার বার এ দৃশ্য অবলোকন করে এবং ভয়-ভীতিতে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। যখন পেরেশানী ও দুশ্চিন্তা বেড়ে যায় তখন বার বার তার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। কারণ, যখন নফস সীমাতিক্রম করার প্রয়াস পায় তখন এ ভীতিকর চিত্র তাকে বাধা দান করে এবং আল্লাহর আনুগত্য করতে উৎসাহ প্রদান করে।
[৪.২] অনেক সময় শাব্দিক বিন্যাস ও তারতীবের মাধ্যমে দীর্ঘতা সৃষ্টি করা হয়। যেমন- একটি ঘটনা বর্ণনা করা হয়, তারপর তার অংশ বিশেষের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী************)
আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে এবং আল্লাহর পথে তা ব্যয় করে না তাদের জন্য কঠিন আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও। যেসদিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দিয়ে তাদের ললাট, পার্থ্ব ও পৃষ্ঠদেশে ছ্যাঁকা দেয়া হবে। আর বলা হবে: এগুলো তোমরা জমা করে রেখেছিলে অতএব আজ এ পরিণতির স্বাদ-অস্বাদন করো। (তওবা: ৩৪-৩৫)
প্রথমে (******)-‘তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও’ বলে শাস্তি সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা করা হয়েছে। সামান্য সময়ের জন্য বর্ণনার ধারাবাহিকতা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যেন শ্রোতা আযাবের বিস্তারিত বর্ণনা শোনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারে। তারপর সেই আযাবের ধরন ও প্রকৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। স্বর্ণ ও রৌপ্যের আধিক্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দ্বিবচন-এর পরিবর্তে বহুবচন-এর শব্দ নেয়া হয়েছে। এভাবে তাদের আধিক্য বুঝানো হয়েছে। এমনিভাবে (***) না বলে (****) বলা হয়েছে। দেখুন সোনা ও রূপাকে আগুনে গরম করার পর তা গলে গেল না, তা দিয়ে শুরু করা হলো এক যন্ত্রণাদায়ক আযাব। প্রথমে তা দিয়ে কপালে ছ্যাঁকা দেয়া হচ্ছে। কপারে ছ্যাঁকা দেয়ার কাজ শেষ হলো। এবার দুই বাহুকে সামনে এনে ছ্যাঁকা দেয়াও শেষ হলো। মনে করছেন এখানেই শাস্তি শেষ হয়ে গেল। দাঁড়ান। এখানে এ দৃশ্য শেষ হয়নি। এবার কল্পনার জগতে ভেসে উঠে, একাধিক দলকে পর্যায়ক্রমে আযাবের আওতায় আনা হচ্ছে এবং বার বার তার পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। আর বলা হচ্ছে:
(আরবী************) এগুলো তোমরা জমা করে রেখেছিলে। অতএব আজ এ পরিণতির স্বাদ-অস্বাদন করো। (সূরা আত-তওবা: ২৫)
[৪.৩] অনেক সময় ঘটনার তৎপরতার বিস্তারিত বর্ণনা ও সংখ্যার কারণে দৃশ্য দীর্ঘ হয়ে যায়। সেই সাথে যে সমস্ত শব্দ সেখানে ব্যবহৃত হয় তার মধ্যেও পুনরুক্তির ধারণা সৃষ্টি হয়। যেমন এ আয়াতে কারীমা:
(আরবী************)
এই দুই বাদী-বিবাদী তারা তাদের পালনকর্তা সম্পর্কে বিতর্ক করে। অতএব যারা কাফির তাদের জন্য আগুনের পোশাক তৈরী করা হয়েছে। তাদের মাথার ওপর ফুটন্ত পানি ঢেলে দেয়া হবে। ফলে তাদের পেটে যা আছে তা এবং তাদের চামড়া গলে বের হয়ে যাবে। তাদের জন্য আরো আছে লোহার হাতুড়ী। তারা যখনই যন্ত্রণয় অতিষ্ট হয়ে জাহান্নাম থেকে বের হতে চাবে, তখনই তাদেরকে সেখানে ফিরিয়ে দেয়া হবে। বলা হবে- দহনের স্বাদ অস্বাদন করো। (সূরা আল-হাজ্জ: ১৯-২২)
এ এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য, যা এ আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে। শোরগোল ও পুনঃপৌনিকতায় ভরপুর। একদিকে আগুনের পোশাক, আরেক দিকে টগবগ করে ফোটা গরম পানি যা মাথায় ঢালা হবে। যার কারণে পেটের ভেতরের সবকিছু এবং চামড়া গলে পড়ে যাবে। অতিষ্ঠ হয়ে যদি কেউ পালাতে চেষ্টা করে, তখনই লোহার হাতুড়ী দিয়ে পিটিয়ে তাকে পূর্বাবস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে এবং বলা হবে দহনের স্বাদ আস্বাদন রো। এ চিত্রটি কল্পনার আয়নায় বার বার প্রতিফলিত হয়। বিশেষ করে কাফিররা বের হতে চাচ্ছে এবং তাদেরকে পিটিয়ে ঢুকান হয়েছে। এ দৃশ্যটি মনে হয় শ্রোতা ও পাঠকদের চোখের সামনেই ঘটে চলেছে।
[৪.৪] অনেক সময় কোন দৃশ্য দীর্ঘায়িত করার জন্য তার মধ্যস্থিত সমস্ত তৎপরতাকে থামিয়ে দেয়া হয়। যেমন ধরুন কিয়ামতের ময়দানে এক জালিম দাঁড়ানো। সম্পূর্ণ একা। বার বার লজ্জা ও দুঃখ প্রকাশ করছে। মনে হয় আপনি তাকে দেখে একথা বলবেন যে, আরে ভাই ক্ষান্ত হও, একন লজ্জা ও দুঃখ প্রকাশ করে আর কী হবে? দৃশ্য সংঘটিত হওয়ার সময় খুব কম কিন্তু আপনার মনে হবে তা অনেক দীর্ঘ। যেমন-
(আরবী************)
জালিম সেদিন আপন হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে: হায় আফসোস! আমি যদি রাসূলের সাথে পথ চলতাম, আহা! আমি যদি অমুককে বন্ধু বানিয়ে না নিতাম! আমার কাছে উপদেশ আসার পর সে আমাকে তা থেকে বিভ্রান্ত করেছিল, শয়তান মানুষকে সময় বুঝে ধোঁকা দেয়। (সূরা আল-ফুরকান: ২৭-২৯)
উল্লেখিত আয়াতে অতীতকালের ক্রিয়াকর্মের ওপর একজন কাফিরের অনুতাপ প্রকাশের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সাথে সাথে ব্যথার এমন কুরণ রাগিণী ধ্বনিত হয়েছে, যা থেকে আপনা-আপনিই চিত্রের দীর্ঘতা ফুটে উঠে। তার শব্দ অল্প, বেশি নয়। তবু তা থেমে যখন ঘৃণা, ক্ষোভ ও দুঃখের অবস্থার দীর্ঘতা সৃষ্টি হয়েছে তাই কোন ব্যক্তিই তার প্রভাব বলয়ের বাইরে থাকতে পারে না। বস্তুত এটিই ছিল এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। স্মর্তব্য যে, অপরাধী অপরাধের স্বীকারোক্তির স্থান ও কাল, দুঃখ ও লজ্জার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। চিন্তা করুন, অপরাধীদের এক দলকে জিজ্ঞেস করা হবে:
(আরবী************) তোমরা কেন জাহান্নামে পড়ে গেলে? (সূরা আল-মুদ্দাসরিস: ৪২)
তারা প্রত উত্তরে বলবে: (আরবী************)
তারা বলবে: আমরা নামায পড়তাম না, অভাবগ্রস্তকে আহার্য তিদাম না, আমরা সমালোচকদের সাথে সমালোচনা করতাম এবং আমরা প্রতিফল দিবসকে অস্বীকার করতাম, যতোক্ষণ না এ বিষয়ে বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে (অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত)। (সূরা আল মুদ্দাস্সির: ৪৩-৪৭)
অপরাধীরা শুধু একথা বলে দিলেই পারতো যে, আমরা অবিশ্বাস করতাম এবং মিথ্যে মনে করতাম। কিন্তু তা করে অপরাধের স্বীকারোক্তির সময়কে দীর্ঘায়িত করার মধ্যেও এক ধরনের সৌন্দর্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
[৪.৫] অনেক সময় এমনওদেখা যায় কোন দৃশ্যকে দীর্ঘায়িত করার জন্য পূর্বোল্লেখিত যাবতীয় উপকরণের সাহায্য নেয়া হয়। যেমন শাব্দিক বিন্যাস ও মিলের সহযোগিতা নেয়া কিংবা ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা অথবা কখনো দৃশ্যকে স্থির করে দেয়া। নিচের উদাহরণগুলো লক্ষ্য করুন:
(আরবী************)
যখন সিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে একটি মাত্র ফুঁক। তখন পৃথিবী ও পর্বতমালাকে উত্তোলন করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হবে। সেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে। সেদিন আকাশ বিদীর্ণ ও বিক্ষিপ্ত হবে এবং ফেরেশতাগণ আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে ও আটজন ফেরেশতা তোমার পালনকর্তার আরশকে ঊর্ধ্বে বহন করবে। সেদিন তোমাদেরকে উপস্থিত করা হবে। তোমাদের কোন কিছুই গোপন থাকবে না। (সূরা আল-হাক্কাহ: ১৩-১৮)
(আরবী************)
অতপর যার আমলনামা ডান হাতে দেয়া হবে, সে বলবে: নাও, তোমরা আমলনামা পড়েগ দেখ। আমি জানতাম যে, আমাকে হিসবের সম্মুখীন হতে হবে। অতপর সে সুখী জীবন যাপন করবে সুউচ্চ জান্নাতে। তার ফলসমূহ অবনমিত হবে। (বলা হবে) বিগত দিনে তোমরা যা প্রেরণ করেছিলে তার প্রতিদানে তোমরা খাও এবং পান করো তৃপ্তি সহকারে।
(আরবী************)
যার আমলনামা তার বাম হাতে দেয়া হবে, সে বলবে: হায়! আমার আমলনামা যদি না-ই দেয়া হতো। আমি যদি না জানতাম আমার হিসেব! হায় আমার মৃত্যুই যদি শেষ হতো। আমার ধন-সম্পদ আমার কোন উপকারেই এলো না। আমার ক্ষমতাও বরবাদ হয়ে গেল। ফেরেশতাদের বলা হবে: ধর একে, গলায় বেস্থি পরিয়ে দাও। তারপর জাহান্নামে নিক্ষেপ করো। অতপর তাকে সত্তর গজ শিকল দিয়ে বেঁধে ফেল। নিশ্চয় সে মহান আল্লাহর উপর বিশ্বাসী ছিল না এবং মিসকিনকে খাদ্য প্রদানে উৎসাহিত করতো না। অতএব আজকের দিনে এখানে তার কোন সুহৃদ নেই এবং তার জন্য কোন খাদ্যও নেই, ক্ষত নিঃসৃত পুঁজ ছাড়া। গুনাহগার ছাড়া আর কেউ তা খাবে না। (সূরা আল-হাক্কাহ: ২৫-২৭)
উল্লেখিত দৃশ্য উপস্থাপন করতে কয়েকটি পদ্ধতির সাহায্য নেয়া হয়েছে এখানে, বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দীর্ঘায়িত করা হয়েছে, সুরের রেশও বেশ দীর্ঘ। দৃশ্যের কিছু অংশকে গতিশীল না করে স্থির করা হয়েছে। পুরো দৃশ্যের রঙের মধ্যেও সামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হয়। সত্তর গজ শিকরের বর্ণনা চিন্তাকে বিস্তৃত করে দেয়। বস্তুত এ সবকিছুই দীর্ঘতার দাবি রাখে।
৫. যেখানে বিপরীতধর্মী কোন বিষয় আলোচনা, যেমন পার্থিব ও পারলৌকিক জীবনের সাথে তুলনা করা হয়েছে- সেই দৃশ্যগুলোকে দীর্ঘ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। তার উদাহরণ হচ্ছে নিচের আয়াত কটি:
(আরবী************)
নিশ্চয় সৎলোকের আমলনামা আছে ইল্লিয়্যনে । তুমি কি জান ইল্লিয়্যন কি? এটি লিপিবদ্ধ খাতা। আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতাগণ একে প্রত্যেক্ষ করে। নিশ্চয় সৎলোকগণ থাকবে পরম সুখে, সিংহাসনে বসে দেখতে থাকবে। তুমি তাদের মুখমণ্ডলে স্বাচ্ছন্দ্যের চিহ্ন দেখতে পাবে। তাদেরকে মোহার করা বিশুদ্ধ পানীয় পান করানো হবে। তার মোহর হবে কস্তুরীর। এ বিষয়ে প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত। তার মিশ্রণ হবে তাসনীমের পান। এটি একটি ঝরণা, যার পানি পান করবে নৈকট্যশীলগণ। (সূরা আল-মুতাফ্ফিফীন: ১৮-২৮)
(আরবী************)
যারা অপরাধী তারা বিশ্বাসীদের উপহাস করতো এবং তারা যখন তাদের কাছ দিয়ে যেত তখন পরস্পরে চোখটিপে ইশারা করতো। তারা যখন তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরত তখনও হাসাহাসি করে ফিরত। আর যখন তারা বিশ্বাসীদেরকে দেখত তখন বলতো নিশ্চয় এরা বিভ্রান্ত। অথচ তারা বিশ্বাসীদের তত্ত্বাবধায়করূপে প্রেরিত হয়নি। আজ যারা বিশ্বাসী তারা কাফিরদরেকে উপসাহ করছে।
উল্লেখিত আয়াতসমূহে দীর্ঘ দুটো দৃশ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এক দৃশ্যে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ বিভিন্ন নিয়ামত ভোগে লিপ্ত এবং দ্বিতীয দৃশ্যে দেখানো হয়েছে কাফিররা মুমিনদের সাথে দুনিয়ায় কিরূপ আচরণ করতো। মুমিনদের সাথে হাসি-তামাশা করা কিভাবে তাদের নেশায় পরিণত হয়েছিল। দুটো দৃশ্যই দীর্ঘ। বিশেষ করে দ্বিতীয় দৃশ্যটি। তার শেষ অংশটি তো অনেক মর্মস্পর্শী। আর এ জিনিসটি বুঝানোই এখানে আসল উদ্দেশ্য।
৬. কুরআনে কারীমের যে জায়গায় ঈমানদারগণ এবং তাদের সৎকাজের ছবি আঁকা হয়েছে সে দৃশ্য অনেক দীর্ঘ। সেই দীর্ঘতা বিবেককে সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত করে। এ সমস্ত আয়াতে যারা দৃষ্টি প্রদান করে তাদেরকে আহ্বান জানান হয় যে, তারা যেন ঈমানদারদের সাথে ইকবাদতে শরীক হয়ে যায়, যা দৃশ্যে দেখানো হচ্ছে। এ রকম উদাহরণ আল-কুরআনে অনেক। এখানে আমরা মাত্র একটি উদাহরণ পেশ করলাম।
(আরবী**********)
নিশ্চয় আসমান ও জমিন সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে। (তারা বলে:) পরওয়ারদিগার! এসব আপনি অনর্থক সৃষ্টি করেননি, সকল পবিত্রতা আপনার, আমাদেরকে আপনি জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচান। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি যাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করলেন তাকে অপমানের চূড়ান্ত করে ছাড়লেন। আর জালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই। হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিশ্চিতরূপে শুনেছি একজন আহ্বানকারীকে ঈমানের প্রতি আহ্বান করতে। (এই বলে) ‘তোমাদের পালনকর্তার প্রতি ঈমান আন’ তাই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমারেদ রব্ব! অতএব আমাদের সকল অপরাধ মাফ করে দিন এবং আমাদের সকল দোষ-ত্রুটি দূর করে দিন, আর আমাদের মৃত্যু দিন নেক লোকদের সাথে। হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে দিন, যা আপনি ওয়াদা করছেন আপনার রাসূলগণের মাধ্যমে এবং কিয়ামতের দিন আমাদেরকে অপমানিত করবেন না। নিশ্চয়ই আপনি ভঙ্গ করেন না অঙ্গীকার। (আলে ইমরান: ১৯০-১৯৫)
(আরবী**********)
অতপর তাদের পালনকর্তা তাদের এ দো’আ (এই বলে) কবুল করে নিলেন, আমি তোমাদের কোন পরিশ্রমই বিনষ্ট করি না। তা সে পুরুষ হোক কিংবা মহিলা। তোমরা পরস্পর এক। তারপর যারা হিজরত করেছে, নিজেদের দেশ থেকে যাদেরকে বের করে দেয়া হয়েছে এবং যাদেরকে উৎপীড়ন করা হয়েছে আমার পথে। আর যারা লড়াই করেছে এবং মৃত্যুবরণ করেছে অবশ্যই তাদের ওপর থেকে অকল্যাণকে অপসারি করবো এবং তাদরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো। যার তলদেশে নদী-নালা প্রবাহমান। এ হচ্ছে বিনিময় আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর আল্লাহর নিকট রয়েছে উত্তম বিনিময়। (সূরা আলে ইমরান: ১৯৫)
কোন্ ব্যক্তি এমন আছে, যে খুশুখুজুতে ভরপুর এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী এ দৃশ্য দেখে তার মন বিগলিত হবে না এবং সে ঐ জ্ঞানীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে তাদের মতো দরবারে বারী তা’আলায় হাত উঠিয়ে নিজেকে ঐ রকম বিনয় ও নম্রতার চরম শিখরে আরোহণ করাবে না। বিশেষ করে যখন ঈমানদারদের ত্যাগের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হচ্ছে এবং পরকালের নেয়ামতের জন্য তাদের প্রতীক্ষায় থাকার কথা বলা হচ্ছে। মহান দয়ালু আল্লাহ ঐ ব্যক্তির দো’আকে কবুল না করেই পারেন না। অবশ্যই তাকে যেসব বস্তু প্রদান করবেন যা ঈমানদারদেরকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
যখনই পুরোপুরি মনোযোগ ও আগ্রহ সহকারে কুরআন অধ্যয়ন করা হবে তখনই এ ধরনের অগণিত জীবন্ত দৃশ্যসমূহ লক্ষ্য করা যাবে। আল কুরআনের একজন পাঠক যখন চুলচেরা বিশ্লেষণসহ কুরআন অধ্যয়ন করতে থাকে তখন তার সামনে জ্ঞান ও রহস্যের নতুন নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। শব্দ ও অর্থের সামঞ্জস্যতা, ছন্দ ও বিন্যাসের সৌন্দর্য, মনোহরী বর্ণনা এবং তার সম্মোহনী প্রভাব, বিষয়সমূহের যোগসূত্র ও সন্নিবেশিতা, বক্তব্য উপস্থাপনের সূক্ষ্মতা ও তার স্টাইল, ঘটনাবলীর শৈল্পিক চিত্র, মনমোহনী সুর, এক অংশের সাথে আরেক অংশের সম্পর্ক উপস্থাপনের নতুন নতুন ধরন ও পদ্ধতি ইত্যাদি যেগুলোর সমন্বয়ে আল-কুরআনের অলৌকিকতা ও রহস্যময়তা পরিপূর্ণ রূপ লাভ করেছে।