চতুর্থ অধ্যায়
কল্পনা ও রূপায়ণ
আমরা বলছি দৃশ্যায়ণ ও চিত্রায়ণের মাধ্যমে নিজস্ব স্টাইলে আল-কুরআন তার বক্তব্য পেশ করেছে। যা আল-কুরআনের বর্ণনা রীতির মূল বা ভীত্তি স্বরূপ। তাই বলে একথার অর্থ এই নয় যে, দীর্ঘ বিষয়বস্তুর গুরুত্ব শেষ হয়ে গেছে, আর আমরা তার পুরোপুরি হক আদায় করে ফেলেছি। বরং বিষয়বস্তুর গুরুত্ব স্বাতন্ত্রভাবে আজও পুরোপুরি বিদ্যমান। সে কথা সামনে রেখেও পৃথক অধ্যায় রচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।
প্রশ্ন হতে পারে, এ চিত্রগুলো কোন্ ভিত্তির ওপর স্থাপিত? বিগত অধ্যায়ের শুরুতে আমরা এ প্রসেঙ্গ আভাস দিয়েছি। আমরা সেখানে বলেছি, কোন কোন সময় চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তব জগতের দিকে দৃষ্টি ফেরানোর জন্য এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। অর্থাৎ কল্পিত বিষয়কে ইন্দ্রিয়ানুভূতির বিষয়ে পরিণত করা। তেমনিবাবে মানুষের স্বরূপ এবং প্রকৃতিকেও বোধগম্য চিত্রে উপস্থাপন করা হয়। অনেক সময় অনুভবের বিষয়কে কল্পিত চিত্রে প্রকাশ করা হয। তারপর সেই চিত্রকে গতিশীল করার জন্য তার মধ্যে জৈবিক তৎপরতা সৃষ্টি করা হয়। ফলে তা চিন্তার জগৎকে আলোড়িত করে তোলে। তখন ইন্দ্রিয়াতীত বস্তু এক জীবন্ত চলমান ছবি হয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠে। চাই তা কোন দুর্ঘটনার ছবি হোক, কিংবা কোন সাদারণ বা ঘটনামূলক ছবিই হোক। জীবন ও গতির সাথে সাথে যদি তাকে বাকশক্তি দেয়া হয়, তবে সেখানে কল্পনার সমস্ত উপাদানই জমা হয়ে যায়, কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। বিগত আলোচনায় আমি যে সমস্ত উদাহরণ ও উপমা পেশ করেছি সেগুলো আমার এ বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করে। যদিও সেই অধ্যায়ে ঐগুলো আলোচনা করার উদ্দেশ্য ছিল, বক্তব্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে আল-কুরআন কিভাবে চিত্রায়ণ পদ্ধতি অবলম্বন করেছে সেই ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা। কিন্তু এ অধ্যায় শুধুমাত্র বিগত উপমার উদ্ধৃতিকে আমরা যথেষ্ট মনে করবো না। তার কারণ আল-কুরআন আমাদের কাছে বিদ্যমান। যা নতুন নতুন উদাহরণ ও উপমায় পরিপূর্ণ। আমরা সেখান থেকে এমন কিছু উপমা নির্বাচন করবো যা নির্দিষ্ট বিষয়কে পরিপূর্ণভাবে নির্দেশ করবে এবং তা হবে কল্পনা ও অনুভবের রূপায়ণের নিয়ম-নীতি সংক্রান্ত।
তাখঈল বা কল্পনা
কুরআনী চিত্রের মধ্যে এমন চিত্র কমই আছে যা নিরব ও নির্বাক অবস্থায় আমাদের সামনে আসে। অধিকাংশ ছবিতেই প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য উদ্দীপনা পাওয়া যায়। এ উদ্দীপনাই জীবনের স্পন্দন জাগায় এবং তা হয়ে উঠে চলমান। মনে রাখতে হবে, চিন্তাকে আলোড়িত করার ব্যাপারটি শুধুমাত্র কিছু দুর্ঘটনা বা কিয়ামতের দৃশ্য অথবা শান্তি ও শাস্তির দৃশ্যাবলীর মধ্যেই নয় বরং তা এমন জায়গায়ও আছে যেখানে তার আশাও করা যায় না।
আমরা বলতে চাই, এই আলোড়নের ধরন ও প্রকৃতি কী। উল্লেখ্য যে, এ ধরনের জীবন স্পন্দনের কাজরণেই প্রকাশ্য বস্তুসমূহকে জীবন্ত মনে হয়। মানুষের কাছে যে জীবন অদৃশ্য তাও এ উদ্দীপনার বাইরে নয়। এ উদ্দীপনাকে আমরা ‘তাখঈল হাস্সী’ বা কল্পিত অনুভূতি বলে অভিহিত করবো। আল-কুরআনের প্রতিটি চিত্রের মধ্যেই এ উদ্দীপনা বিদ্যমান। জীবনের এ স্পন্দন প্রতিটি চিত্রের মধ্যেই এমনভাবে উপস্থিত, যেভাবে জীবনের বিভিন্ন ধারা ও প্রকৃতি পরিলক্ষিত হয়।
তাজসীম বা রূপায়ণ
আল-কুরআনে চিত্রায়ণের সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি বিষয় পাওয়া যায়, যা রূপায়ণ তা তাজসীম-এর ভিত্তি বলে গণ্য করা যায়। এ বিষয়ে কুরআন অগ্রসর হয়ে অনেক দূর পর্যন্ত গেছে। এমনকি যেসব বিষয তার মুল ধারা থেকে পৃথক রাখা প্রয়োজন ইসলাম তাকে উন্মুক্ত করে তুলে ধরার ওপর গুরুত্ব প্রদান করে। অনেক সময় সেগুলোকেও দৈহিক আকারে উপস্থাপন করা হয। যেমন আল্লাহ্ তা’আলার যাত ও সিফাত (সত্তা ও গুণাবলী)। এ থেকে অকাট্যভাবেযে কথাটি আমাদের সামনে চলে আসে তা হচ্ছে- রূপায়ণের স্টাইলকে আল-কুরআন অন্যান্য পদ্ধতির ওপর প্রাধান্য দিয়েছে। কিন্তু সেই সাথে হুশিয়ার করেও দেয়া হয়েছে যে, রূপায়ণের পদ্ধতি অনেক সময় বিপজ্জনক পরিণতি ডেকে আনে। এখন আমি উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটিকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করব।
ব্যক্তিরূপে প্রকাশ: ১. কল্পনার একটি প্রকার এমন যাকে আমরা তাশখীস বা ব্যক্তিরূপে প্রকাশ বলতে পারি। তাশখীস বলতে বুঝায়, যে বস্তু জীবন থেকে মুক্ত তাকে জীবন দেয়া। মেযন প্রাকৃতিক দৃশ্য কিংবা অন্য কোন জড়বস্তুকে জীবন্ত বোধগম্য আকৃতিতে উপস্থাপন করা হয়। অনেক সময় সেই জীবনকে উন্নত করে মানুষের মতো বানিয়ে দেয়া হয়। তার মধ্যে বাহ্যিক উপকরণ ও অনুভূতি পর্যন্ত শামিল থাকে। প্রাণহীন বস্তুকে মানবিক আগ্রহ, উদ্দীপনা ও চাঞ্চল্য পদ্রান করা হয। যার বদৌলতে তা মানুষের কাছে আসে এবং তাদের সাথে লেনদেনও করে। তাদের সামনে আবির্ভূত হয় বিভিন্ন রঙ ও পোশাকে। ফলে মানুষ তাকে জীবিত মনে করতে বাধ্য হয়। মনে হয় যেন সেনিজের চোখে তা দেখে এবং ইন্দ্রিয় দিয়ে তা অনুভব করছে। তার সূক্ষ্মানুভূতি ও তৎপরতা দেখে মানুষ ভীত বিহ্বলও হয়ে পড়ে। যেমন- একটি আয়াতে সকাল বেলাকে জীবন্ত মনে করে শ্বাস গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। (আরবী****) –সকাল বেলার শপথ যখন তা শ্বাস গ্রহন করে। (আত-তাকভীর: ১৮)
এ আয়অত পাঠ করলে এ ধারণার সৃষ্টি হয় যে, সকার বেলা’ এর সময়টা জীবন্ত কোন বস্তু, কারণ সে শ্বাস গ্রহণ করে। এমনকি শ্বাস গ্রহণের সময় তার দাঁতগুলোও যেন দৃষ্টিগোচর হয়। এ জীবন শুধু ‘সকালের’ নয় বরং সকল বিশ্ব ও প্রকৃতির বলে মনে হয়। যেমন বলা হয়েছে, রাত দিনকে ধরার জন্য খুব জোরে তার পেছনে দৌড়াচ্ছে কিন্তু তাকে ধরতে পারছে না। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী*********)
তিনি পরিয়ে দেন রাতের ওপর দিনকে। এমতাবস্থায় দিন দৌড়ে দৌড়ে রাতের পেছনে আসে। (সূরা আল-আ’রাফ: ৫৪)
রাত ও দিনের পরস্পর দৌঁড়ানোর যেমন শেষ নেই তেমনিভাবে মানুষের চিন্তাশক্তিও এদের পেছনে সমানভাবে দৌড়াচ্ছে। আবার দেখুন, রাতের চলাচলের কথা বলা হয়েছে।
(আরবী*******)
এবং শপথ রাতের যখন তা যেতে থাকে। (সূরা আল-ফজর: ৪)
আয়াতটি পাঠ করা মাত্র পাঠকের চোখে ভেসে উঠে পৃথিবীর সীমাহীন পথে রাত নামক বস্তুটি শুধুমাত্র ভ্রমণ করেই যাচ্ছে। অতি পরিচিত এক চিত্র। আবার দেখুন, জমিন ও আসমানকে বুদ্ধিমান মনে কাতের তাদেরকে সম্বোধন করা হচ্ছে এবং সাথে সাথে তারা জবাবও দিচ্ছে:
(আরবী*********)
তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন, যা ছিল ধুম্রকুঞ্জ; অতপর তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন: তোমরা উভয়ে এসো ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। তারা বললো: আমরা স্বেচ্ছায় এলাম।
পাঠক কল্পনার চোখে দেখুন, আসমান ও পৃথিবীকে ডাকা হচ্ছে। তারা সে ডাকে সাড়াও দিচ্ছে। দেখুন চন্দ্র, সূর্য, রাত ও দিন নিজস্ব পথে ও নিজস্ব গতিতে চলমান। কিন্তু-
(আরবী*************)
সূর্য নাগাল পায় না চাঁদের এবং রাতের আগে চলে না দিনের। (সূরা ইয়াসীন: ৪০)
রাত এবং দিনের এ পরিভ্রমণ মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যেন কখনো কেবল রাত আবার কখনো কেবল দিন একটানা হতে না পারে। জমিনের দিকে দেখুন। মৃত জমিন। সেখানে বৃষ্টির পানি পড়ে। আর অমনি তা নবজীবন লাভ করে জেগে ওঠে।
(আরবী***********)
তুমি জমিনকে পতিত ও বিরাণ দেখতে পাও, তারপর আমি যখন সেখানে বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন তা সতেজ৮ ও স্ফীত হয়ে উঠে এবং সকল প্রকার সুদৃশ্য উদ্ভিদ উৎপন্ন করে। (সূরা আল-হাজ্জ: ৫)
অন্যত্র বলা হয়েছে:
(আরবী*******)
তাঁর আরেক নিদর্শন এই যে, তুমি জমিনকে দেখবে বিরাণ- অনুর্বর পড়ে আছে। যখন আমি তার ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করি তখন সে ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে উঠে। (সূরা হা-মীম আস-সাজদা: ৩৯)
এভাবে মৃত-বিরাণ জমিন দেখতে না দেখতেই নবজীন লাভ করে।
জাহান্নামের দৃশ্য: এ হচ্ছে জাহান্নাম। কেমন জাহান্নাম? ধ্বংসাত্মক ও মহাযন্ত্রণাদায়ক বস্তু, যা থেকে কেউ বেচে বের হতে পারে না। যেখানে কোন নড়াচড়া পর্যন্ত করা যাবে না, যাদেরকে পৃথিবীতে হেদায়েতের দিকে আহ্বান করা হতো কিন্তু তারা তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিত। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এখন তাদেরকে জাহান্নামের দিকে ডাকামাত্র এসে হাজির হবে। এটি ঐ জাহান্নাম যে অপরাধীদেরকে দেখে রাগে ফেরে পড়বে এবং ভীষণভাবে তর্জন-গর্জন করতে থাকবে। নিচের আয়াত ক’টি থেকেক সে চিত্রে কিছুটা প্রকাশ ঘটেছে:
(আরবী***********)
সেদিন আমি জাহান্নামকে জিজ্ঞেস করবো, তুমি কি পরিপূর্ণ হয়েছো? সে উত্তর দেবে আরো আছে কি (সূরা ক্বাফ: ৩০)
(আরবী**********)
জাহান্নাম যখন দূর থেকে তাদেরকে দেখবে, তখন তারা তার জর্গন ও হুংকার শুনতে পাবে। (সূরা আল-ফুরকান: ১২)
(আরবী************)
যখন তারা সেখানে নিক্ষিপ্ত হবে, তখন তার ক্ষিপ্ত গর্জন শুনতে পাবে। ক্রোধে জাহান্নম ফেটে পড়বে। (সূরা আল মুল্ক: ৭-৮)
(আরবী************)
কখনো নয়। নিশ্চয়ই এটি লেলিহান আগুন। যা চামড়া ঝলসে দেয়। তা সেই ব্যক্তিকে ডাকবে যে সত্যের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছিল ও বিমুখ ছিল। ধন-সম্পদ জমা করে তা আগলে রেখেছিল।
অপরাধীরা যে ছায়ায় আশ্রয়ের জন্য আসবে তার অবস্থা হচ্ছে:
(আরবী*******)
ধূয়ার কুণ্ডুলীর ছায়া, যা শীতলও নয় এবং আরামদায়কও নয়। (সূরা ওয়াকিয়াহ: ৪৩-৪৪)
সেই ছায়ায় জাহান্নামীদের দম বন্ধ হয়ে আসবে এবং তারা দিশেহারা হয়ে যাবে।সে ছায়া তাদের জন্য শীত কিংবা আরামদায়ক হবে না। এমনকি তা দেখতেও সুন্দর দেখাবে না।
আর দেখুন, বৃষ্টির পানি ভর্তি বায়ুর চলাচল:
(আরবী**********)
আমি পানি ভরা বাসাত পরিচালনা করি এবং আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করি। (সূরা আল-হিজর: ২২)
বাতাসকে (***) (বৃষ্টি দ্বারা গর্ভবতী) বলে তার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন সৃষ্টি করা হয়েছে। মনে হয় পানির দ্বারা বাতাস গর্ভবতী হয় এবং বৃষ্টি বর্ষণ করে তা গর্ভমুক্ত হয়।
আবার বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
যখন মূসার রাগ পড়ে গেল, তখন তিনি তখতীগুলো তুলে নিলেন।
(আরবী**********)
অতপর যখন ইবরাহীমের আতংক দূর হলো এবং সুসংবাদ এসে গেল, তখন সে আমার সাথে তর্ক শুরু করলো কওমের লূত সম্পর্কে।
দেখুন, উপরোক্ত আয়াত দুটোতে (***) (রাগ)-কে তীব্র আকার ধারণ ও কমে যাওয়া এবং (***) (ভয়)-এর বিদূরিত হওয়া, আর (***) (সুসংবাদ) এর যাওয়অ আসা করার কথা বলা হয়েছে। মনে হয় এগুলো জীবিত কোন বস্তু। যার মধ্যে প্রাণের সাড়া পাওয়া যায়।
২. তাখঈল বা কল্পনার আরেকটির ধরন হচ্ছে, চলমান ছবি হয়ে সামনে উপস্থিত হওয়া। যার মাধ্যমে কোন অবস্থা বা কোন একটি অর্থকে বুঝানো হয়। যেমন- ঐ ব্যক্তির চিত্র, যে প্রান্তিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর ইবাদত করে। অবস্থা ভাল দেখলে সে পরিতৃপ্ত হয় আর যদি কোন পরীক্ষায় নিমজ্জিত হয় তবে ইসলাম থেকে দূরে সরে যায়। অথবা ইসলাম গ্রহণের পূর্বে মুসলমানদের চিত্র, যারা আগুনের এক গর্তের কিনারে অবস্থান করছিল। অথবা ঐ ব্যক্তির উদাহরণ- যে তার ঘরের ভিত্তি এমন গর্তের কিনারে স্থাপন করে যা অট্টালিকাসহ তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবে। এগুলো এমন সব চিত্র যা প্রাণ চঞ্চলতায় ভরপুর। শেষ চিত্রটিতো পূর্ণতার শীর্ষে পৌঁছে গেছে। যে সম্পর্কে আমি ‘শৈল্পিক চিত্র’ অধ্যায়ে আলোচনা করেছি।
হৃষ্টপুষ্ট এক উট সূচের ছিদ্র পথে প্রবেশের চেষ্টারত চিত্রটি তাখঈলের আরেকটি উদাহরণ। যা কাফিরদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, তারা কোন অবস্থাতেই ক্ষমা পাবে না এবং জান্নাতেও যেতে পারবে না। এমন আজাব চলমান উদাহরণে চিন্তাশক্তি হতবাক হয়ে যায়। কারণ, চিন্তা যতোক্ষণ তার অনুগত থাকবে ততোক্ষণ এর গিত পূর্ণ হতে পারে না এবং তা শরীরী অবস্থায় আসার পরও বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। ইরশাদ হচ্ছে:”
(আরবী**********)
বলো, আমার পালনকর্তার কথা লিখার জন্য যদি সমুদ্রের পানি কালি হয়, তবে আমার পালনকর্তার কথা লিখা শেষ হওয়ার আগেই তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। যদি তার সাথে আরেকটি সমুদ্রের পানি যোগ করা হয়- তাও। (সূরা আল-কাহ্ফ : ১০৯)
এ আয়াত পাঠে সদা চলমান যে ছবিটি চিন্তার জগতকে আচ্ছন্ন করে রাখে তা হচ্ছে- সমুদ্রের পানি দিয়ে আল্লাহর প্রশংসা লিখা হচ্ছে কিন্তু তা শেষ হচ্ছে না। শেষ করা যাবে না। এ এক গতিশীল বিরামহীন চিত্র। সমুদ্রের পানি শেষ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আল্লাহর প্রশংসা লিখে শেষ করা যাচ্ছে না। এভাবেই এ গতিশীলতা পূর্ণতায় পৌঁছে যায়।
নিচের আয়াতগুলো থেকে মানসপটে যে ছবিটি ফুটে উঠে তাও উপরোক্ত চিত্রের সাথে মিলে যায়।
(আরবী**********)
তারপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সে কৃতকার্য। (সূরা আলে-ইমরান: ১৮৫)
(আরবী**********)
এরূপ আয়ুপ্রাপ্তি তাদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারবে না। (সূরা বাকারাহ: ৯৬)
এ আয়অতে (***) শব্দ থেকেই গতিশীলতা অনুভূত হয় যা কল্পনায় চলমান ছবি হিসেবে প্রতিভাত হয়ে উঠে। এ এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আমরা আরেকটু সামনে অগ্রসর হয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারবো।
এ গতিশীলতা থেকে কল্পনার চোখে ভেসে উঠে, কোন ব্যক্তি আগুনের গর্তের কিনারে দাঁড়ানো। আর তার লেলিহান শিখা সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে।
৩. তাখঈল বা কল্পনার আরেকটি ধরন হচ্ছে- যা কল্পনায় গতির সৃষ্টি হয়। কতিপয় শব্দের মাধ্যমে তা মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করা হয়। যেমন-
(আরবী**********)
আমি তাদের কৃতকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করবো, অতপর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধুলোকণায় পরিণত করে দেব। (সূরা আল-ফুরকান: ২৩)
আমরা ইতোপূর্বে ‘শৈল্পিক চিত্র’ অধ্যায়ে আলোচনা করেছি, আমলকে ধুলোকণায় পরিণত করার অর্থ তাদের কৃতকর্মকে নষ্ট করে দেয়া। এটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য একটি চিত্র। এখন আমরা কাদিমনা (***) শব্দটির তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করবো। এ শব্দটি বুঝানো হয়েছে, তাদের সৎকর্মসমূহ ধ্বংস করে দেয়ার পূর্বে সামনে উপস্থিত করা হবে। যদি বাক্য থকে কাদিমনা শব্দটি বিলুপ্তি করা হয় তবে চিন্তার সূত্রটি ছিন্ন হয়ে যায়। সাথে সাথে সমস্ত সৌন্দর্য (যা ঐ শব্দটির সাথে জড়িত) তাও আর অবশিষ্ট থাকে না যদিও ধুলোকণার নড়াচড়া তখনো অব্যাহত থাকে। নিচের আয়াতটিও একটি সুন্দর উদাহরণ।
(আরবী**********)
বল, আমি কি আল্লাহ ছাড়া এমন কোন কিছুকে আহ্বান করবো, যা আমাদের কোন কল্যাণ করতে পারে না এবং ক্ষতিও করতে পারে না। আমরা কি পেছন দিকে ফিরে যাব? (সূরা আল-আনআম: ৭১)
এ আয়াতে (******) বাক্যাংশ দিয়ে দ্বীন থেকে ফিরে যাওয়া ইন্দ্রিয়াতীত বস্তু তাকে ইন্দ্রিয়ানুভূত অবস্থায় বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবেই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হয়ে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়। পরবর্তী আয়াতটিও এ রকম একটি উদাহরণ:
(আরবী**********)
আর শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না, নিঃসন্দেহে সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা আল-বাকারা: ১৬৮)
উদ্দেশ্য ছিল- ‘তোমরা শয়তানের অনুসরণ করো না’ একথা বলা। কিন্তু (***) অনুসরণ করো না) এবং (***) (পদাংক) শব্দ দুটো দিয়ে শয়তানের চলাচরের ছবি আঁকা হয়েছে। মনে হচ্ছে শয়তান আগে আগে চলছে এবং মানুষ (যারা তার অনুসারী) তার পিছে পিছে পায়ের দাগ অনুসরণ করে চলছে। অদ্ভুদ একটি ছবি। শয়তান এমন এক অশুভ শক্তি যে মানব পিতা আদম (আ)-কে জান্নাত থেকে বের করার ব্যবস্থা করেছিল। তবু মানুষ এখনও তার অনুসরণ করে।
এ রকম আরেকটি আয়াত:
(আরবী**********)
তুমি তাদেরকে শুনিয়ে দাও, সেই লোকের অবস্থা, যাকে আমি নিজের নিদর্শনসমূহ দান করেছিলাম, অথচ সে তা পরিচার করে বেরিয়ে গেছে। তার পেছনে লেগেছে শয়তান, ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। (সূরা আরাফ: ১৭৫)
এ আয়াত এবং তার আগের আয়াতের মধ্যে সামান্য পার্থক্য আছে। এ আয়াতে শয়তানকে গুমরাহ ব্যক্তির পেছনে নেয়া হয়েছে। আগের আয়াতে শয়তানের পেছনে চরা নিষেধ করা হয়েছে, আর এখানে খোদ শয়তানই পিছে লেগেছে।
নিচের আয়াতটিও এ বিষয়ের সাথে সম্পর্ক রাখে:
(আরবী**********)
(হে বান্দা) যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তার পেছনে লেগে যেও না। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৩৬)
এখানে জ্ঞঅনকে দেহ বিশিষ্ট বস্তু কল্পনা করা হয়েছে।
৪. কল্পনার আরেটি ধরন হচ্ছে, তা দ্রুত এবং একের পর এক দৃশ্যমানে হয়। আমরা ইতোপূর্বে এ ধরনের উদাহরণ পেশ করেছি। অর্থাৎ মুশরিকদের তৎপরতা, যাদের সম্পর্কে নিচের আয়াতে বলা হয়েছে।
(আরবী**********)
যে আল্লাহর সাথে শরীক করলো, সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল। অতপর মৃতভোজী পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোন দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করলো। (সূরা হজ্জ: ৩১)
নিচের আয়াতটিতেও একটি সাদৃশ্যতা আছে:
(আরবী**********)
যে ধারণা করে, দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ কখনো তাঁর রাসুলকে সাহায্য করবেন না, সে যেন একটি রশি আকাশ পর্যন্ত ঝুলিয়ে নেয়, তারপর তা কেটে দেয় এবং দেখে তার এ কৌশল তার আক্রোশকে দূর করতে পারে কিনা? (সূরা আল-হাজ্জ: ১৫)
এ আয়াতে আশ্চর্য এক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যে ব্যক্তি এরূপ কুধারণা পোষণ করে যে, আল্লাহ তাঁর নবীকে সাহায্য করবেন না। সে শুধু শুধু মনকে ব্যাথা ভারাক্রান্ত করে তুলে। যে ব্যক্তি এ অবস্থায় ধৈর্যধারণ করতে পারে না অথবা আল্লাহর ওয়াদা পূর্ণ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করার মানসিকতা রাখে না, তার উচিত অবস্থাকে পরিবর্তন করে কাংখিত মানে নিয়ে যাওয়া। আসলে আসমানে রশি রাগিয়ে তাতে আরোহণ করা যেমন অসম্ভব। অবস্থার পরিবর্তন করাও তার জন্য তেমন অসম্ভব। যদি আসমানেরশি লাগিযে তাতে আরোহণের চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হয়ে রশিকে ছিঁড়ে এবং জমিন পড়ার পর হয়তো তা নিয়ে কিছুটা চিন্তা করার সুযোগ থাকে।
পরবর্তী আয়াতটিতেও এ ধরনের বক্তব্য পেশ করা হয়েছে:
(আরবী**********)
আর যদি তাদের অবজ্ঞা তোমার নিকট কষ্টদায়ক হয়, তবে জমিনে কোন সুরঙগ খুঁজে বের করো কিংবা আকাশে কোন সিঁড়ি লাগিয়ে নাও এবং তাদেরকে কোন নিদর্শন এনে দিতে পার তবে তা নিয়ে এসো। (সূরা আল-আন’আম: ৩৫)
রাসূলে আকরাম (সা)-এর আহ্বানে প্রতি কাফিরদের অবজ্ঞা প্রদর্শন তাঁর কাছেবড় অস্বস্তিকর মনে হচ্ছিল। তিনি চাইতেন যদি যুৎসই কোন মু’জিযা এনে তাদেরকে দেখাতে পারতেন তবে হয়তো তারা ঈমান এনে সোজা পথে চলতো। এ আয়াত স্বয়ং নবী করীম (স)-কে সম্বোধন করে অবতীর্ণ হয়েছে। এজন্য তাঁর মান-মর্যাদার প্রতি লক্ষ্য রেখে অত্যন্ত শালীন ও মার্জিত ভাষায় এবং সূক্ষ্ম রসিকতার সাথে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এটি কল্পিত চিত্রের উৎকৃষ্ট এক নমুনা, যেখানে শৈল্পিক সৌন্দর্য পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান।
৫. কল্পনার আরেকটি স্টাইল হচ্ছে- জড় বস্তুকে গতিশীল হিসেবে পেশ করা। (আরবী**********)
বার্ধক্যে মাথা সাদা হয়ে গিয়েছে। (সূরা মারইয়াম: ৪)
এ আয়াতে সাদা চুলকে জ্বলন্ত আগুনের সাথে তুলনা করা হয়েছে। সাদা চুলকে কল্পনায় এমন পর্যায়ে পৌঁছান হয়েছে, যেভাবে শুষ্ক খড়কুটা আগুনের হাল্কায় জ্বলে উঠে। এ কারণেই আয়াতটিতে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়েছে। যা আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি।
রূপায়ণ: আগের অধ্যায়ে আমরা রূপায়ণের বেশ কিছু উদাহরণ বর্ণনা করেছি। উপমেয় বাক্য এজন্যই ব্যবহৃত হয় যাতে তার অন্তর্নিহিত অবস্থাকে একটি নির্দিষ্ট অবয়বে পরিবর্তন করা যায়। এটি তাজসমি বা রূপায়ণের সাথেও সংশ্লিষ্ট। নিচে আমরা কয়েকটি উদাহরণ পেশ করলাম।
(আরবী**********)
যারা তাদের পালনকর্তার সত্তায় বিশ্বাস করে না তাদের কর্মসমূহ যেন ছাইভস্ম, যার ওপর দিয়ে প্রবল বাতাস বয়ে যায় ধুলোঝড়ের দিন। (সরা ইবরাহীম: ১৮)
(আরবী**********)
হে ঈমানদারগণ! তোমরা অনুগ্রহের কথা প্রকাশ করে এবং কষ্ট দিয়েনিজেদের দান-খয়রাত বরবাদ করো না সেই ব্যক্তির মতো, যে নিজের ধন-সম্পদ লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। তার দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ পাথরের মতো, যার ওপর কিছু মাটি পড়েছিল।
(আরবী**********)
যারা আল্লাহর রাস্তায় তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এবং নিজের মনকে দৃঢ় করার জন্য স্বীয় সম্পদ দান করে তাদের উদাহরণ টিলায় অবস্থিত বাগানের মতো। (সূরা আল-বাকারা: ২৬৫)
(আরবী**********)
তুমি কি লক্ষ্য করো না, আল্লাহ তা’আলা কেমন উপমা বর্ণনা করেছেন: পবিত্র কথা হচ্ছে বৃক্ষের মতো। তার শেকড় মজবুত এবং শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত। সে পালনকর্তার নির্দেশে অহরহ ফল প্রদান করে। আল্লাহ মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করতে পারে এবং নোংরা কথার উদাহরণ হচ্ছে নোংরা বৃক্ষ। একে মাটির ওপর থেকে উপড়ে ফেলা হয়েছে। এর কোন স্থিতি নেই। (সূরা ইবরাহীম: ২৪-১৬)
মনে রাখতে হবে, আমাদের মতে শুধু বোধগম্য কোন বস্তুর সাথে তুলনা করার নামই রূপায়ণ নয়। কেননা এতো সাধারণ কথা, ইন্দ্রিয়াতীত কোন বিষয়কে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন বিষয়ের সাথেতই তুলনা দেয়া হয়। আমাদের কাছে রূপায়ণের অর্থ হচ্ছে- ইন্দ্রিয়াতীত কোন বিষয়কে শুধু তুলনা ও উপমার সাহায্যে মূর্তমান না করে বরং ঘটনার মাধ্যমেই দেহাবয়ব গঠন ও মূর্তমান করে তোলা। যেমন:
(আরবী**********)
যেদনি প্রত্যেকেই চোখের সামনে দেখতে পাবে সে যা ভাল করেছে তা এবং যা মন্দ করেছে তাও। তখন তারা কামনা করবে, যদি তার এবং এসব কর্মের বিস্তর ব্যবধান থাকতো। (সূরা আলে-ইমরান: ৩০)
(আরবী**********)
তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। তোমার রব্ব কারো প্রাতি জুলুম ক রবেন না। (সূরা আল-কাহফ: ৪৯)
(আরবী**********)
তোমরা নিজের জন্য পূর্বে যে ভাল কর্ম পাঠাবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। (সূরা আল-বাকারা: ১১০)
ওপরের উদাহরণগুলো থেকে বুঝা যায়- আমল একটি অদৃশ্য ও আকার-আকৃতিহীন বস্তু। কিন্তু একে সেদিন বোধগম্য আকার-আকৃতিতে পেশ করা হবে। এর-ই নাম রূপায়ণ বা তাজসীম। মনে হয় আমল কোন মানুষের অবয়ব সেদিন তার কাছে এসে হাজির হবে। সেই সাথে একথাও বুঝা যায় পৃথিবীতে আমল করলে তা আল্লাহর নিকট আমানত থাকে এবং কিয়ামতের দিন যা অবয়ব দান করে বান্দাদের ফেরত দেযা হবে।
গুনাহকে সেদিন এক বিরাট আকৃতির বোঝাতে রূপান্তর করা হবে। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********) সেদিন তারা নিজেদের গুনাহর বোঝা নিজেদের পিঠে বহন করবে। (সূরা আন’আম: ৩১)
(আরবী**********) সেদিন কেউ কারো বোঝা বহন করবে না। (সূরা আন’আম: ১৬৪)
ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়কে মূর্তমান করে প্রকাশ করা হয়েছে নিচের আয়াতগুলোতেও। যেমন :
(আরবী**********) আর তোমরা পাথেয় সাথে নিও। নিঃসন্দেহে সর্বোত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া। (সূরা আল-বাকারা: ১৯৭)
এ আয়অতে তাকওয়াকে পাথেয় বলে সম্বোধন করা হয়েছে।
(আরবী**********) আমরা আল্লাহর রঙ ধারণ করেছি। আল্লাহর রঙ্গের চেয়ে উত্তম রঙ আর কারো হতে পারে? (সূরা আল-বাকারা: ১৩৮)
এ আয়অতে আল্লাহর দ্বীনকে রঙ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
(আরবী**********)
হে ঈমানদারগণ! ইসলামের মধ্যে পুরোপুরি প্রবেশ করো।
এ আয়অতে প্রবেশ করা যায় এমন আকৃতিতে ইসলামকে পেশ করা হয়েছে।
(আরবী**********)
তোমরা প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন গুনাহসমূহ পরিত্যাগ করো। (আন আ’ম: ১২০)
এ আয়াতে গুনাহকে প্রকাশ্য ও প্রচ্চন্নতার সাথে সম্পর্কিত করা হয়েছে।
রূপক অর্তে ব্যবহৃত সংকীর্ণতা, দুঃখ-দুর্দশা, চিন্তা-বিমর্ষতা ইত্যাদি বিমূল্ত ও অতীন্দ্রিয় বস্তু, কিন্তু পরবর্তী আয়াতগুলোকে একে মূর্তমান করে তুলে ধরা হয়েছে:
(আরবী**********)
আর অপর তিনজন যাদেরকে পেছনে রাখা হয়েছিল, যখন পৃথিবী বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্য সংকুচিত হয়ে গেল এবং তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল, আর তারা বুঝতে পারল, আল্লাহ ছাড়া আর কোন আশ্রয়স্থল নেই। (সূরা আত্ তাওবা: ১১৮)
বলা হয়েছে- পৃথিবী তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে এসেছিল। এ সংকীর্ণতাকে জমিনের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। সংকীর্ণতা ও বিমর্ষতা এক বিমূর্ত ও অতীন্দ্রিয় বস্তু কিন্তু এ আয়াতে তাকে মূর্তমান করে দেখানো হয়েছে। যেসব সাহাবা নবী করীম (স)-এর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি তাদের অবস্থাকে মূর্তমান করে তুলে ধরা হয়েছে। তাঁরা পেছনে থেকে যাওয়ায় এতো লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং এতো বিপর্যস্ত ছিলেন যে, তাদের কোন আশ্রয়স্থল ছিল না। সামান্য সময়ের জন্যও তারা একটু স্বস্থিবোধ করেননি, যতোক্ষণ তাদের তওবা আল্লাহর দরবারে গৃহীত না হয়েছে।
এমনি ধরনের আরেকটি আয়াত:
(আরবী**********)
তুমি তাদেরকে আসন্ন দ্বীন সম্পর্কে সতর্ক করো, যখন প্রাণ কণ্ঠাগত, দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। পাপীদের জন্য কোন বন্ধু এবং সুপারিশকারী নেই, যার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে। (সূরা মু’মিন: ১৮)
এ আয়াত থেকে মনে হয় কাঠিন্যের কারণে প্রাণ আসল জায়গা থেকে স্থানান্তর হয়ে কণ্ঠের কাছে চলে আসবে।
(আরবী**********)
অতপর যদি কারো প্রাণ কণ্ঠাগত হয় এবং তোমরা তাকিয়ে থাক। (সূরা ওয়াকিয়াহ: ৮৩-৮৪)
এ আয়াত থেকে বুঝা যায় রূহ একটি শরীরি বস্তু, যা নড়াচড়া করে গলা পর্যন্ত পৌঁছে যায়।
(আরবী**********)
কিন্তু যারা এমন সম্প্রদায়ের সাথে মিলিত হয়, তোমাদের মধ্যে ও তাদের মধ্যে চুক্তি আছে অথবা তোমাদের কাছে এভাবে আসে, তাদের অন্তর তোমাদের সাথে এবং স্বজাতির সাথে যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক। (সূরা আন-নিসা: ৯০)
অর্থাৎ এই পেরেশানী ও অনিশ্চয়তার কারণে তারা সংকটে পড়ে যায় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তারা তোমার সাথে মিলে স্বজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, না স্বজাতির সাথে মিলেমিশে তোমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।
৩. কুরআন কাফিরদের বুদ্ধিবৃত্তিক ও ইন্দ্রিয়াতীত অবস্থানসমূহের বর্ণনা তুলে ধরতে চায়। কাফিররা কুরআন তো অবশ্যই শোনে কিন্তু এ থেকে তারা কোন কল্যাণ লাভ করতে পারে না। মনে হয় তারা শুনেইনি। কুরআন সেই ইন্দ্রিয়াতীত ব্যাপারটিকে এমনভাবে তুলে ধরেছে মনে হয় কাফির ও কুরআনের মাঝে এমন এক প্রতিবন্ধকতকা রয়েছে যা তাদেরকে কুরআনের পথে আসতে দেয় না। নিচে কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো:
(আরবী**********)
তাদেরকে তো শ্রবণের জায়গা থেকে দূরে রাখা হয়েছে। (সূরা আল-শু’আরা: ২২)
(আরবী**********)
আমি তাদের অন্তরেরর ওপর আবরণ ফেলে দিয়েছি যেন তারা একে না বুঝে এবং তাদের কানে বোঝা ভরে দিয়েছি। (সূরা আন’আম: ২৫)
(আরবী**********)
তারা কি কুরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না, তাদের অন্তর কি তালাবদ্ধ? (সূরা মুহাম্মদ : ২৪)
(আরবী**********)
আমি তাদের ঘারে চিবুক পর্যন্ত বেড়ী পরিয়ে দিয়েছি। ফলে তাদের মস্তক উর্ধ্বমুখী হয়ে গেছে। আমি তাদের সামনে ও পেছনে প্রাচীর স্থাপন করেছি, অতপর তাদেরকে আবৃত করে দিয়েছি, তাই তারা দেখে না। (সূরা ইয়াসীন: ৮-৯)
(আরবী**********)
আল্লাত তাদের অন্তর ও কানগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন, আর তাদের চোখগুলো পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন। (সূরা আল-বাকারা: ৭)
(আরবী**********)
আমার স্মরণ থেকে যাদের চোখে আবরণ পড়ে গেছে, তারা শুনতে সক্ষম নয়। (সূরা আল-কাহ্ফ: ১০১)
কাফিররা যে ইন্দ্রিয়াতীত বাধার কারণে আল-কুরআনের পথে আসতে পারেনি তা মূর্তমান হয়ে আমাদের সামনে এসেছে। মনে হয় তা এক সদৃশ্য দেয়াল। এভাবেই প্রচণ্ড প্রভাব সৃষ্টিকারী বর্ণনার স্টাইল অবলম্বন করা হয়েছে।
৪. অনেক সময় কোন জিনিসের বর্ণনা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ঢংয়ে করা হয়েছে কিন্তু তার বর্ণনা পদ্ধতি এমন যে, প্রথম সম্বোধনেই তার মধ্যে বলিষ্ঠতা ও পরিপুষ্টতার ছাপ পরিলক্ষিত হয়। যেমন: (আরবী**********)
যেদিন আযাব তাদেরকে ঘেরাও করে নেবে মাথার ওপর এবং পায়ের নিচ থেকে। (সূরা আল-আনকাবুত: ৫৫)
অর্থাৎ আযাব তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলবে। চতুর্দিক না বরে ‘ওপর-নিচ’ বলার কারণ হচ্ছে- এটি ‘চতুর্দিক’ শব্দের চেয়ে প্রভাব সৃষ্টিতে অধিক কার্যকর।
(আরবী**********)
যখন তারা তোমাদের নিকটবর্তী হয়েছিল, উচ্চভূমি এবং নিম্নভূমি থেকে। (সূরা আল-আহযাব: ১০)
(আরবী**********)
যদি তারা তওরাত, ইঞ্জিল এবং যা প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে, পুরোপুরি পালন করতো তবে তারা ওপর থেকে এবং পায়ের নিচ থেকে খেতে পারতো। (সূরা আল-মায়েদা: ৬৬)
(আরবী**********)
তাদের মুখমণ্ডল যেন ঢেকে দেয়া হয়েছে আঁদার রাতের টুকরো দিয়ে। (সূরা ইউনিস: ২৭)
মনে হয় কাফিরদের মুখমণ্ডল যে কালো রঙ ধারণ করবে তা কোন রঙের প্রবেপ নয়; বরং কালো আঁদার রাতের টুকরো, যা দিয়ে তাদের চেহারাকে ঢেকে দেয়া হয়েছে।
৫. তাজসীম বা রূপায়ণের আর একটি পদ্ধতি হচ্ছে- অতীন্দ্রিয় বস্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর সাথে সম্পর্কিত করে বর্ণা করা। যেমন এ আয়াতে আযাব বা শাস্তিকে (***) (শক্ত)-এর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে এবং পরবর্তী আয়াতে দিনকে (***) (ভারী) বলে অভিহিত করা হয়েছে।
(আরবী**********) তাদের পশ্চাতেও রয়েছে কঠিন আযাব। (সূরা ইবরাহীম: ১৭)
(আরবী**********) এরা ভারী দিনকে পেছনে ফেলে রাখে। (সূরা আদ-দাহর: ২৭)
প্রথম আয়াতে আযাবকে এমন এক বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে, যা লম্বা, চওড়া ও মোটা বলে অভিহিত করা যায়। অন্য কথায় কঠিন শব্দটি বস্তুর সাথেই প্রয়োগ করা হয়।
দ্বিতীয় আয়াতে দিনকে সময় বলে না বুঝিয়ে ঘনো মোটা ওজনদার বস্তু বলে বুঝানো হয়েছে।
৬. অতীন্দ্রিয় বস্তুকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর সাথে সংশ্লিষ্ট করে বর্ণনা করা হয়েছে এমন কিছু উদাহরণ:
(আরবী**********) আল্লাহ কোন মানুষের পেটে দুটো অন্তর রাখেননি। (সূরা আহযাব: ৪)
(আরবী**********) তোমরা ঐ মহিলার মতো হয়ো না, যে পরিশ্রম করে সূতো কেটে তারপর টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে। (সূরা আন-নাহল: ৯২)
(আরবী**********)
কেউ যেন কারো গীবত না করে। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? (সূরা আল-হুজরাত: ১২)
প্রথম আয়াতে বুঝানো হয়েছে, পরস্পর বিরপরীতধর্মী কোন বস্তুকে একই অন্তরে জায়গা দেয়া সম্ভব নয়। দ্বিতীয় আয়াতে বুঝানো হয়েছে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করা ঐ রকম নিষ্ফল কাজ যেমন এক বুড়ি নিজে সূতো কেটে তারপর তা নষ্ট করে ফেল। তৃতীয আয়াতে গীবতের ওপর ঘৃণা সৃষ্টি করার প্রয়াস পেয়েছে। বলা হয়েছে গীবতকারী তার মৃত ভাইয়ের গোশত ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়্ কারণ যে উপস্থিত নেই তাকে মৃতের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কাজেই যার অনুপস্থিতিতে তার দোষ আলোচনা করা হলো- এ যেন দোষ আলোচনা নয় বরং খুবলে খুবলে তার গোশ্ত খাওয়া।
৭. রূপায়ণ পদ্ধতি একটি সাধারণ মূলনীতির মর্যাদা রাখে। যেমন শেষ বিচারের দিন আমলকে একটি অবয়ব দান করে ওজন করার কথা বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********) আমি কিয়ামতের দিন ন্যায় বিচারের মানদণ্ড স্থান করবো। (সূরা আল-আম্বিয়া: ৪৭)
(আরবী**********)
অতএব যার পাল্লাহ ভারী হবে সে সুখী জীবন যাপন করবে এবং যার পাল্লা হাল্কা হবে, তার ঠিকানা হবে হাবিয়া। (সূরা ক্বারিয়া: ৬-৯)
(আরবী**********)
যদি কোন আমল সরিষা-দানা পরিমাণ হয়, আমি তাও উপস্থিত করবো এবং হিসেবে গ্রহণের জন্য আমিই যথেষ্ট। (সূরা আম্বিয়া:ধ ৪৭)
(আরবী**********) তাদের ওপর সুতা পরিমাণ জুলুমও করা হবে না। (সূরা আন-নিসা: ৪৯)
(আরবী**********) তাদের ওপর তিল পরিমাণ জুলুমও করা হবে না। (সূরা নিসা: ১২৪)
ওপরের আয়অতগুলোতে আমল এবং মিযানকে শরীরী বস্তু বলে অভিহিত করা হয়েছে।
কল্পনা ও রূপায়ণের যৌথ সমাবেশ
অনেক সময় আল-কুরআনের একই আয়অতে কল্পনা ও রূপায়ণের যৌথ সমাবেশ ঘটে থাকে। অতীন্দ্রিয় বস্তুটি তখন মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শরীরী ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু হিসেবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে সেই শরীরী বস্তুটিত কাল্পনিক গতি সঞ্চারও করে দেয়া হয। আমরা আগে যেসব উদাহরণ পেশ করেছি, সেখানে এর নমুনা আছে। কিন্তু আমরা এ নিয়মের আর কিছু নতুন উদাহরণ দিতে চাই। যেন প্রতিটি নিয়মের একাধিক উদাহরণ আমাদের নিকট থাকে। ইরশাদ হচ্ছে
(আরবী**********)
বরং আমি সত্যকে মিথ্যার ওপর নিক্ষেপ করি, অতপর সত্য-মিথ্যার মস্তক চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। (সূরা আল-আম্বিয়া: ১৮)
(আরবী**********)তিনি তাদের অন্তরে ভীতি নিক্ষেপ করলেন (সূরা আল-আহযাব: ২৬)
(আরবী**********) আমি তাদের পরস্পরের মধ্যে কিয়ামত পর্যন্ত বিদ্বেষ ঢেলে দিলাম। (সূরা মায়িদা: ৬৪)
(আরবী**********) তারপর আল্লাহ অবতীর্ণ করলেন নিজের পক্ষ থেকে প্রশান্তি তাঁর রাসূল ও মু’মিনদের প্রতি। (সূরা আত তওবা : ২৬)
(আরবী**********) বিনয় ও নম্রতার সাথে তাদের সামনে ঝুঁকে থাকো। (সূরা বনী ইসরাঈল: ২৪)
উল্লেখিত আয়াতগুলো বার বার পড়ুন এবং চিন্তা করুন। প্রথম আয়াতে মনে হয় সত্য বুঝি এক ধরনের বাতাসের গুলী যা বাতিলের ওপর পড়েতাকে তছনছ করে দেয়। দ্বিতীয় আয়াতে ভীতি এমন এক কঠিন বস্তুরূপে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা দূর থেকে নিক্ষেপ করে অন্তরে প্রবেশ করানো যায়। তৃতীয় আয়াত থেমে মনে হয় বিদ্বেষ-শত্রুতা এমন একটি নিরেট বস্তু যা দু’দলের মধ্যে ছুড়ে দেয়া যায়। চতুর্থ আয়াত থেকে বুঝা যায় সান্ত্বনা এক ধরনের বস্তু যা রাসুলে করীম (স) ও ঈমানদারদের ওপর দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিল এবং পঞ্চম আয়াত থেকে মনে হয় বিনয় ও নম্রতার জন্য বাহু প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, যা সর্বদা তাদের সামনে ঝুঁকে থাকে।
ওপরের সবগুলো উদাহরণ কল্পনা এবং রূপায়ণের একত্রে সমাবেশ ঘটেছে। কারণ এসব উদাহরণ অশরীরী জিনিসকে শরীরীরূপে তুলে ধরা হয়েছে এবং তার মধ্যে কল্পিত গতি সৃষ্টি করা হয়েছে। আরো কয়েকটি উদাহরণের প্রতি লক্ষ্য করুন।
(আরবী**********)
হ্যাঁ, যে ব্যক্তি পাপ অর্জন করেছে এবং সে পাপ তাকে পরিবেষ্টন করে নিয়েছে। (সূরা আল-বাকারা: ৮১)
(আরবী**********)
শুনে রাখো, তারাতো (পূর্ব থেকেই) ফিতনায় পড়ে গেছে এবং নিঃসন্দেহে জাহান্নাম এসব কাফিরদরে পরিবেষ্টন করে রয়েছে। (সূরা তওবা: ৪৯)
প্রথম আয়াতে গুনাহকে এক নিরেট বস্তু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং পুনরায় পরিবেষ্টন করে রাখা রকথা বলে তার গতিশীলতার কথা বুঝানো হয়েছে। দ্বিতীয় আয়াত দ্বারা মনে হয় ফিতনা একটি গর্ত। আর কাফিররা সে গর্তে পড়ে গেছে।
(আরবী**********) তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিলিয়ে দিয়ো না। (সূরা বাকারা: ৪২)
অতএব আল্লাহর যে নির্দেশ তুমি পেয়েছ তা তাদেরকে শুনিয়ে দাও। (সূরা হিজর: ৯৪)
প্রথম আয়াত থেকে বুঝা যায় সত্য ও মিথ্যা দুটো নিরেট পদার্থ। যা একটি আরেকটিকে ঢেকে রাখে। দ্বিতীয আয়াতে (***) (চিরে ফেলা) শব্দটি ব্যবহার করায় মনে হয় আল্লাহর নির্দেশ এমন এক বস্তু, যাকে চিরে ফেলা যায় এবং যা অন্য বস্তুতে মিলান যায়।
(আরবী**********)
যারা ঈমান এনেছে আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আনেন। আর যারা কুফরী করে তাদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। (সূরা আল-বাকারা: ২৫৭)
(আরবী**********)
আর যে তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর বিশ্বাস করলো, সে এমন একটি হাতল ধরলো যা কখনো ছিন্ন হবার নয়। (সূরা বাকারা: ২৫৬)
প্রথম আয়াতে হেদায়েতকে আলো এবং গুনাহকে অন্ধকারের সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং বের করা কথাটি বলে চিন্তাকে গতিশীল করার প্রয়াস পেয়েছে। দ্বিতীয় আয়াতে ঈমানকে কঠিন বস্তুর সাথে তুলনা করা হয়েছে যা ভাঙ্গার কিংবা ছিন্ন হবার ভয় নেই।
বর্ণিত উদাহরণগুলোতে দেয়া যায়, যখন অতীন্দ্রিয় বস্তুকে মূল থেকে পৃথক করে শরীরী ও গতিশীল অবস্থায় পেশ করা হয় তখন সেই অর্থ মূর্তমান হয়ে আমাদের মস্তিষ্ককে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলে।
কুরআনে হাকীমের ঐ সমস্ত জায়গা, যেখানে আল্লাহ তা’আলার যাত ও সিফাতের বর্ণনা করা হয়েছে এবং যেখানে উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে প্রকাশ করা হয়েছে সেখানেও একই স্টাইলে শরীরী চিত্র অংকিত হয়েছে। যেমন:
(আরবী**********) আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপরে। (সূরা আল-ফাতহ: ১০)
(আরবী**********) তার আরশ (তখন) পানির ওপর ছিল। (সূরা হুদ: ৭)
(আরবী**********) তার আসন (ক্ষমতা) আসমান ও জমিনব্যাপী বিস্তৃত। (সূরা বাকারা: ২২৫)
(আরবী**********) অতপর আরশের ওপর গিয়ে দাঁড়ালেন। (সূরা আল-আরফ: ৫৪)
(আরবী**********) তারপর তিনি আসমানের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন এবং তা ছিল ধুম্রকুঞ্জ। (সূরা হামীম সাজদাহ: ১১)
(আরবী**********)
কিয়ামতের দিন গোটা পৃথিবী থাকবে তাঁর হাতেট মুঠোয় এবং আসমানসমূহ ভাজ করা অবস্থায় থাকবে তাঁর ডান হাতে। (সূরা আয-যুমার: ৬৭)
(আরবী**********)
হে নবী! যখন তুমি কংকর নিক্ষেপ করছিলে তখন তুমি নিক্ষেপ করনি আল্লাহই তা নিক্ষেপ করেছেন। (সূরা আল-আনফাল: ১৭)
(আরবী**********) আল্লাহ সংকীর্ণ করেন এবং বিস্তৃত করেন। (সূরা বাকাহরা: ২৪৫)
(আরবী**********) এবং তোমার পালনকর্তা ও ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে এসে উপস্থিত হবেন। (সূরা আল-ফজর: ২২)
(আরবী**********)
ইহুদীরা বলে: আল্লাহর হাত বন্ধ হয়ে গেছে। তাদেরই হাত বন্ধ হোক। একথা বলার জন্য তাদের প্রতি লা’নত। বরং তাঁর উভয় হস্তকে উন্মুক্ত। (সূরা আল-মায়েদা: ৬৪)
(আরবী**********)
যখন আল্লাহ বলেন: হে ঈসা! আমি তোমাকে দুনিয়ায় থাকার সময়কাল পূর্ণ করবো এবং আমার নিকট উঠিয়ে আনবো। (সূরা আলে-ইমরন: ৫৫)
আসল কথাতো তাই ছিল, ওপরে আমরা যা বর্ণনা করেছি। কিন্তু ভাষা ও বাক্যের প্রয়োগ এবং তার তাৎপর্য নিয়ে বা-বিতণ্ডা করা এক ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে তাই উপরোক্ত শব্দসমূহ নিয়েও মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। অথচ এখানে সেরূপ বাক-বিতণ্ডার কোন অবকাশই ছিল না। কারণ এ সমস্ত বাক্যে বক্তব্য পেশ করার এমন স্টাইল অবলম্বন করা হয়েছে যা কুরআনের সাধারণ স্টাইলণ। অর্থাৎ মূল অর্থকে তাজসীম ও তাখয়ীলের পদ্ধতিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর এটি এমন এক স্টাইল যেখানে না আছে কোন পশ্চাৎপদতা আর না আছে কোন বক্রতা।