দশম অধ্যায়
কাহিনীর শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য
এখন আমি এমন সাধারণ শৈল্পিক বৈশিস্ট্য বর্ণনা করতে চাই, যা পাওয়া গেলে কোন ঘটনার দ্বীনি উদ্দেশ্য, শৈল্পিক সৌন্দর্য সুষমার পথ ধরে পুরো হয়ে যায় এবং শৈল্পিক সৌন্দর্য-সুষমা সেই কাহিনীকে মন-মস্তিষ্ক এবং চিন্তা-চেতনার ওপর বেশি প্রভাব বিস্তারকারী বানিয়ে দেয়। যার ফলে মানুষের মন অতি সহজেই তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। এ ধরনের বর্ণনার জন্য চারটি শৈল্পিক মূলনীতি গ্রহণ করা হয়েছে। যথা :
১. বর্ণনা বিভিন্নতা: শৈল্পিক বিশেষত্বের মধ্যে প্রথম প্রকার হচ্ছে কাহিনী বর্ণনার পদ্ধতিগত পার্থক্য। কুরআনে বর্ণিত ঘটনাবলী আমরা বর্ণনা করতে গিয়ে তার চারটি ধরন সম্পর্কে অবহিত হই। নিচে পর্যায়ক্রমে তা আলোচনা করা হলো।
[১.১] যেমন আসহাবে কাহফের ঘটনা আল-কুরআনে শুরু করা হয়েছে এভাবে:
(আরবী************)
তুমি কি মনে করো, গুহা ও গুহার অধিবাসীরা আমার নিদর্শনাবলীর মধ্যে বিস্ময়কর ছিল? যখন যুবকগণ পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে তথন দো’আ করেছিল: হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে আপনার নিকট থেকে রহমত দান করুন এবং আমাদের কাজকে আমাদের জন্য সহস করে দিন। তখন আমি কয়েক বছরের জন্য গুহায় তাদের কানের ওপর (নিদ্রা) পর্দা ফেলে দিলাম। তারপর আমি তাদেরকে পুনরুত্থিত করি একথা জানার জন্য, দুই দলের মধ্যে কে তাদের অবস্থান সম্পর্কে অধিক নির্ণয় করতে পারে। (সূরা আল-কাহফ: ৯-১২)
এ হচ্ছে ঘটনার সার-সংক্ষেপ। এরপর ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা শুরু হয়েছে। যেমন- গুহায় প্রবেশ করার পূর্বে পরস্পর পরামর্শ, গুহায় প্রবেশের অবস্থা, তাদের গুম ও জাগ্রত হওয়া, তাদের একজনকে খাদ্য ক্রয়ের জন্য পাঠানো, শহরে তাকে নিয়ে আলোচনা ও কানা-ঘুষা, তার প্রত্যাবর্তন, আসহাবে কাহ্ফের মৃত্যু। তাদের কবরে ওপর সৌধ নির্মাণ, এ সম্পর্কে লোকদের মতান্তর ইত্যাদির বর্ণনা। ঘটনার শুরুতে এমনভঅবে সার-সংক্ষেপ বর্ণনা করা হয়েছে পাঠক তা পড়ামাত্র পরের ঘটনা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে।ৎ
[১.২] অনেক সময় কোন ঘটনার উপসংহার বা পরিণতি বর্ননা করা হয়, তারপর পুরো ঘটনা বিস্তারিতভাবে বলা হয়। তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনা, যা সূরা কাসাসে বর্ণিত হয়েছে। তার শুরু হয়েছে এভাবে:
(আরবী************)
আমি তোমার কাছে মূসা ও ফিরাউনের ঘটনা সত্য সহকারে বর্ননা করছি ঈমানদার সম্প্রদায়ের জন্য। ফিরাউন তার দেশে উদ্ধৃত হয়েছিল এবং সে দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের একটি দলকে দুর্বল করে দিয়েছিল্ সে তাদের পুত্র সন্তানকে হত্যা করতো এবং নারীদেরকে জীবিত রাখতো। নিশ্চয়ই সে ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। দেশে যাদেরকে দুর্বল করা হয়েছিল, আমার ইচ্ছে হলো তাদের প্রতি অনুগ্রহ করার, তাদেরকে নেতা, দেশের উত্তরাধিকারী এবং তাদেরকে দেশের ক্ষমতায় অসীন করার। যেন ফিরাউন, হামান ও তাদের সেনাবাহিনীকে দেখিয়ে দেয়, যা তারা দুর্বল দলের পক্ষ থেকে আশংকা করতো। (সূরা কাসাসা: ২-৬)
এরপর হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন- জন্ম, প্রতিপালন, দুধপান করানো, যৌবনে পদার্পণ, এক কিতবীকে হত্যা করে দেশামন্তর হওয়া ইত্যাদি। তারপর শুরু হয়েছে পরবর্তী ঘটনাবলী যা শুরুতেই বর্ণনা করা হয়েছে। ঘটনার শুরু এমনভাবে করা হয়েছে যে, পাঠকের ব্যাকুলতা বেড়ে যায়। আগ্রহের অতিশয্যে তাদের মনে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়- এমতাব্থায় মূসা (আ) কী করলেন?
হযরত ইউসুফ (আ)-এর ঘটনাও একই রূপ। ঘটনার শুরু হয়েছে স্বপ্নদর্শন থেকে। স্বপ্ন দেখে তিনি তার পিতার নিকট বর্ণনা করছেন। পিতা বুঝতে পারছেন এ স্বপ্ন পৃথিবীতে তার প্রতিষ্ঠিত ও সুনাম অর্জনের ইঙ্গিত। ঘটনার শুরু এভাবে:
(আরবী************)
যখন ইউসুফ পিতাকে বললো: আব্বাজান! আমি স্বপ্নে দেখলাম এগারটি নক্ষত্র, চন্দ্র এবং সূর্য আমাকে সিজদা করছে । পিতা বললো: বেটা! তুমি তোমার ভাইদের সামনে এ স্বপ্নের কথা বলো না। তারা তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে। কেননা শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন। এমনিভাবে তোমার পালনকর্তা তোমাকে মনোনীত করবেন এবং তাঁর বাণীসমূহের নিগুঢ় তত্ত্ব শিক্ষা দেবেন এবং তোমার প্রতি ইয়াকুব পরিবারের প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করবেন। যেমন ইতোপূর্বে তোমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম ও ইসহাকের প্রতি পূর্ণ করেছেন। নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক জ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা ইউসুফ: ৪-৬)
তারপরই ঘটনার শুরু হয়ে গেছে। ঘটনার আর কিছু নয়, তাঁর স্বপ্নের প্রতিফলন মাত্র। যে সম্পর্কে পিতা ইয়াকুব (আ) আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ঘটনা শেষ হয়ে গেছে স্বপ্নের পূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে। সুন্দর পরিসমাপ্তির পর আল-কুরআন নীরব। ঐসব বক্তব্য সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি যা তওরাতে বর্ণিত।
[১.৩] অনেক সময় ঘটনাসমূহ বিনা ভূমিকায় কিংবা সার-সংক্ষেপ বর্ণনা ছাড়াই সরাসরি শুরু করা হয়েছে। আবার হঠাৎ করেই তা শেষ করা হয়েছে। যেমন- হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে মারইয়াম (আ)-এর ঘটনা বিনা ভূমিকায় বর্ণিত হয়েছে। তেমনিভাবে হযরত সুলাইমান (আ) ও সম্রাজ্ঞী বিলকিসের ঘটনার মধ্যে হঠাৎ করে হুদহুদ ও পিপিলিকার বর্ণনা চলে এসেছে।
[১.৪] আবার এমনও দেখা যায়, ঘটনা বর্ণনায় কল্পনার রঙ দেয়া হয়েছে। ঘটনা শুরু হলো, ঘটনা বিবরণ চলছে এমনি সময় নায়কের মুখ দিয়ে কতিপয় আবেনদ করানো হলো। যেমন- আমরা ‘শৈল্পিক চিত্র’ অধ্যায়ে হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত ইসমাঈল (আ)-এর ঘটনার দৃশ্যাবলী তুলে ধরেছি। যেখানে বলা হয়েছে:
(আরবী************)
স্মরণ করো যখন ইবরাহীম ও ইসমাঈল কা’বা ঘরের ভিত্তি স্থাপন করছিল, (তখন বললো:) পরওয়ারদিগার! আমাদের থেকে কবুল করো। নিশ্য়ই তুমি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ। (সূরা আল-বাকারা: ১২৭)
এটি অনেক বড় দৃশ্য। আল-কুরআনে বর্ণিত ঘটনাবলীতে এ ধরনের অনেক উপমা-উদাহরণ পাওয়া যায়।
২. হঠাৎ রহস্রের জট খোলা: দ্বিতীয প্রকার হচ্ছে, হঠাৎ কোন ঘটনার রহস্যের জট খুলে যাওয়া।
[২.১] অনেক সময় ঘটনার রহস্য পাঠক কিংবা নায়ক উভয়ের কাছেই অজানা থাকে। কিন্তু ঘটনার কোন এক জায়গায় গিয়ে হঠাৎ তা পাঠকের সামনে প্রতিভাত হয়ে উঠে। এর উদাহরণ হচ্ছে হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনা, যখন তিনি একজন সৎ ও জ্ঞানী ব্যক্তির নিকট গিয়েছিলেন। যা সূরা আল-কাহ্ফে বর্ণিত হয়েছে:
(আরবী************)
যখন মূসা তার যুবক (সঙ্গী)-কে বললো: দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে না পৌঁছা পর্য়ন্ত আমি থামবো না, যুগ যুগ ধরে বলতে থাকবো। অতপর যখন দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলে পৌঁছল, তখন তারা নিজেদের মাছের কথা ভুলে গেল। মাছটি সমুদ্রে সুড়ঙ্গপথ সৃষ্টি করে নেমে গেল। সে স্থঅনটি অতিক্রম করে গিয়ে মূসা সঙ্গীকে বললো: আমাদের নাস্তা আনো। আমরা এ সফরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সে বললো: আপনি কি লক্ষ্র করেছেন, আমরা যখন প্রস্তর খণ্ডে বিশ্রাম নিয়েছিলাম তখন আমি মাছের কথা ভুলে গিযেছিলাম। শয়তানেই আমকে একথা স্মরণ রাখা থেকে ভুলিয়ে দিয়েছিল। মাছটি আশ্চর্যজনকভাবে সমুদ্রে নিজের পথ করে নিয়েছে। মূসা বললো: আমরা তো সেই স্থানটিই খুঁজেছিলাম। অতপর তারা নিজেদের চিহ্ন ধরে ফিরে বললো। তারপর তারা আমাদের বান্দাদের মধ্রে এমন একজনের সাক্ষাৎ পেল, যাকে আমি আমার পক্ষ থেকে রহমত দান করেছিলাম ও আমার পক্ষ থেকে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান। মূসা তাকে বললো: আমি কি এ শর্তে আপনার অনুসরণ করতে পারি, সত্য পথের যে জ্ঞান আমাকে শেখানো হয়েছে, তা থেকে আমাকে কিছু শিক্ষা দেবেন? সে বললো: আপনি কিছুতেই আমার সাথে ধৈর্যধারণ করে থঅকতে পারবেন না। যে বিষয় (বুঝা) আপনার আয়ত্বাধীন নয়, তা দেখে আপনি ধৈর্য ধরবেন কেমন করে? মূসা বললো: আল্লাহ চাহেতো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আমি আপনার কোন আদেশ অমান্য করবো না। সে বললো: যদি আপনি আমার অনুসরণ করেনই তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত আমি নিজেই সে সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলি। অতপর তারা চলতে লাগল। অবশেষে যখন তারা নৌকায় আরোহণ করলো তখন সে তাতে ছিদ্র করে দিলো। মূসা বললো: আপনি কি এর আরোহীদের ডুবিয়ে মারার জন্য এতে ছিদ্র করে দিলেন? নিশ্চয়ই আপনি গুরুতর অপরাধ করলেন। সে বললো: আমি কি বলিনি যে, আপনি কিছুতেই আমার সাথে ধৈর্যধারণ করে থাকতে পারবেন না? মূসা বললো: আমাকে ভুলের জন্য অপরাধী করবেন না। তারপর তারা আবার চ লতে লাগল। অবশেষে একটি বালকের সাক্ষাৎ পেল, সে তাকে হত্যা করে ফেললো। মূসা বললো: আপনি কি একটি নিষ্পাপ জীবন শেষ করে দিলেন প্রাণের বিনিময় ছাড়াই? নিশ্চয়ই আপনি তো এক গুরুতর অন্যায় কাজ করলেন। সে বললো: আমি কি বলিনি আপনি আমার সাথে ধৈর্যধারণ করে থাকতে পারবেন না? মূসা বললো: এরপর যদি আমি আপনাকে কোন বিষয়ে প্রশ্ন করি, আপনি আমাকে সাথে রাখবেন না। আপনি আমার পক্ষ থেকে অভিযোগমুক্ত হয়ে গেছেন। অতপর তারা চলতে লাগলো। অবশেষে যখন একটি জনপদের অধিবাসীদের কাছে পৌঁছে খাবার চাইল, তারা আথিয়েতা করতে অস্বীকার করলো। অতপর তারা সেখানে খাবার চাইল, তারা আতিথেয়তা করতে অস্বীকার করলো। অতপর তারা সেখানে একটি পতন্মুখ প্রাচীর দেখতে পেল, সেটি সে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলো। মূসা বললো: আপনি ইচ্ছে করলে তাদের কাছ থেকে এর পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে পারতেন। সে বললো এখানেই আমার ও আপনার বিচ্ছেদ ঘটল। এখন যে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করতে পারেননি, আমি তার তাৎর্য বলে দিচ্ছি। (সূরা কাহ্ফ: ৬০-৭৮)
উল্লেীখত আয়াতে ধারণকৃত উপাদান যা আমাদের জন্য রহস্যের সৃষ্টি করেছে, তার কোন কুলকিনারা আমরা পাই না। সেই রহস্যের সামনে আমরা তেমনি লা-জবাব যেন ঘটনার নায়ক হযরত মূসা (আ)। আমরা এটিও জানি না অত্যাশ্চার্যজনক ঘটনা যিনি ঘটালেন তিনিই বা কে। এমনতি আল-কুরআন বা তার নাম প্রকাশেরও প্রয়োজনবোধ করেনি। তার নাম প্রকাশের প্রয়োজনই বা কি? ঐ ব্যক্তিতো আল্লাহর কুদরতে এরই তাঁরই নির্দেশে সমস্ত কাজ আনজাম দিয়েছেন। আর আল্লাহ সেই মামলার পরিণতি সেই রকম করবেন না। যা আমাদের সামনে ঘটে গেল, আমরা দেখলাম। কারণ, তাঁর দৃষ্টিতো সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য পানে নিবদ্ধ। যেখানে আমাদের দৃষ্টি পৌঁছে না। তদ্রূপ তার নাম উল্লেখ না করার ব্যাপারটিও ঘটনার রহস্যময়তার সাথে পুরো সামঞ্জস্যশীল।
এতে কোন সন্দেহ নেই, ঘটনার শুরু থেকেই অজানার এক অদৃশ্য পর্দা ছিল। মূসা (আ) সৎ বান্দাকে দেখার উৎসুক্য, তাঁর সন্ধানে পথ চলা, মূসা (আ)-এর যুবক সাথী কর্তৃক পাথরের নিকট মাছ চলে যাওয়ার ব্যাপারটি ভুলে যাওয়া, ভুলের মাসুল আদায়ের জন্য পুনরায় পাথরের নিকট চলে আসা, সৎ ব্যক্তির সাক্ষাৎ লাভ। যদি ফিরে না আসতেন তহবে আর কখনো তাঁর সাক্ষাৎ তিনি পেতেন না। যে ঘটনা সংঘটিত হলো তাও রহস্যাচ্ছন্ন। যিনি এ ঘটনা ঘটালেন তার নাম পর্যন্ত জানা গেল না।
সবেমাত্র সহস্যের জট খুলছে। এখন মূসা (আ) জানতে পারবেন কেন এ ঘটনাগুলোর অবতারণা করা হলো। সাথে সাথে আমাদেরও কাছেও তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)
নৌকাটির ব্যাপার- সেটি ছিল কয়েকজন দরিদ্র ব্যক্তির। তারা সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করতো, আমি সেটিকে ত্রুটিযুক্ত করতে ইচ্ছে করলাম, কারণ তাদের অপরদিকে ছিল এক বাদশাহ, সে বল প্রয়োগে প্রত্যেকটি নৌকা ছিনিয়ে নিত। বালকটির ব্যাপার- তার পিতা-মাতা ছিল ঈমানদার। আমি আশংকা করলাম, সে অবাধ্যতা ও কুফুরী দিয়ে তাদেরকে প্রভাবিত করবে। অতপর আমি ইচ্ছে করলাম, তাদের পালনকর্তা তাদেরকে মহত্তর, তার চেয়ে পবিত্রতায় ও ভালবাসায় ঘনিষ্ঠতর একটি শ্রেষ্ঠ সন্তান দান করুক। প্রাচীরের ব্যাপার- সেটি ছিল নগরের দু’জন পিতৃহীন বালকের। এর নিচে ছিল তাদের গুপ্ত ধন এবং তাদের পিতা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। সুতরাং আপনার পালনকর্তা দয়াপরবশ ইচ্ছে করলেন যে, তারা যৌবনে পদার্পণ করুক এবং নিজেদের গুপ্তধন উদ্ধার করুক। আমি নিজ মতে এটি করিনি। আপনি যে বিষয়ে ধৈর্যধারণে অক্ষম ছিলেন, এই হলো তার ব্যাখ্যা। (সূরা আল-কাহাফ: ৭৯-৮২)
উল্লেীখত ঘটনায় যে রহস্যের সৃষ্টি করা হয়েছে তা সৎ ব্যক্তি কাশ্ফ কিরামতের রহস্য উন্মোচন হওয়পার পর পাঠক কিছুটা সম্বিত ফিরে পান। জিজ্ঞেস করেন- তিনি কে? উত্তর পাওয়া যায় না। রহস্য রহস্যই থেকে যায়। তিনি প্রথমও যেমন রহস্যাচ্ছন্ন ছিলেন এখনও তাই। এ ঘটনায় অত্যন্ত শক্তিশালী হিকমতের প্রকাশ ঘটেছে। যার সামান্য এক ঝিলিক আমাদের দৃষ্টিগোচর হলো, অতপর তা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল আমাদের দৃষ্টির আড়ালে।
[২.২] অনেক সময় এমনও দেখা যায়, ঘটনার রহস্য দর্শকদের নিকট পরিষ্কার কিন্তু তখনও তা নায়কের কাছে অজানা। তবু সে তার কাজহ করেই যায়। অবশ্য দর্শক জেনে যান তা কিভাবে ঘটেছে, কেন ঘটছে। এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে তখন, যখন কাউকে উপসাহ বা হাসিঠাট্টার ছলে কিছু বলা হয়। দর্শকগণ শুরু থেকেই তাদের তৎপরতা দেখেন, তা নিয়ে হাসাহাসিও করেন। ইতোপূর্বে আমরা বাগান মালিকদের ঘটনা বলেছি। সে ঘটনা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)
যখন তারা শপথ করেছিল, সকালে বাগানের ফল সংগ্রহ করবে। কিন্তু তারা ‘ইনশা আল্লাহ’ বললো না। অতপর তোমার পালনকর্তার পক্ষ থেকে বাগানে এক বিপদ এসে পতিত হলো, তখন তারা নিদ্রিত ছিল। ফলে সকাল পর্যন্ত তা হয়ে গেল ছিন্নভিন্ন তৃণসম।
আমরা তো ঘটনা জানলাম কিন্তু এখনো বাগান মালিকগণ বেখবর। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)
সকালে তারা একে-অপরকে ডেকে বললো: তোমরা যদি ফল আহরণ করতে চাও, তবে সকাল সকাল ক্ষেতে চল। অতপর তারা চললো ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে: আজ যেন কোন মিসকিন তোমাদের কাছে বাগানে প্রবেশ করতে না পারে। তারা সকালে লাফিয়ে লাফিয়ে সজোরে রওয়ানা হলো। (সূরা আল-কলম: ২১-২৫)
আমরা দর্শকগণ যখন মুচকি মুচকি হাসি, যখন তারা ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে বাগানের দিকে রওয়ানা দেয়। ওদিকে বাগানকে তছনছ করে দেয়া হয়েছে। যখন আমরা হাসিতে লুটিপুটি খাই, তখন কেবল তাদের কাছে রহস্যের জট খুলতে শুরু করে।
(আরবী**********)
অতপর যখন তারা বাগান দেখল, তখন বললো: আমরা পথ ভুল করেছি, না হয় আমরা বঞ্চিত হলাম। (সূরা আল-কলম: ২৬-১৭)
অবশ্যই যারা মিসকিনদেরকে বঞ্চিত রাখতে চায় তাদের জন্য এটি যথার্থ শাস্তি।
[২.৩] অনেক সময় এমনও হয়, দর্শকদেরকে ঘটনার আংশিক অবগত করানো হয়কিন্তু ঘটনার মূর অবস্থা তখনও দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায় এবং এ ঘটনার একটি অঙশ এমন থাকে, যা দর্শক এবং নায়ক কেউই ওয়াকিফহাল নয়। তার উদাহরণ সম্রাজ্ঞী বিলকিসের সিংহাসন। যা চোখের পলকে হাজির করা হয়েছিল। আমরা এও জানি, তা হযরত সুলাইমান (আ)-এর সামনেই সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু সে সম্পর্কে রানী বিলকিস মোটেও অবহিত ছিনে না। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো: এটি কি আপনার সিংহাসন? তিনি উত্তর দিলেন এটি যেন সেইটি-ই। এটি এমন এক রহস্য যা আমরা প্রথম থেকেই অবগত আছি। কিন্তু কাঁচের প্রাসাদের ব্যাপারটি বিলকিসের মতো আমরাও অন্ধকারে ছিলাম। বিলকিসের সাথে সাথে আমরওাও ঠিক তখনই ব্যাপারটি বুঝতে পারলাম যখন বিলকিস পানির হাউস অতিক্রম করার জন্য পায়ের গোছার ওপর কাপড় তুলে ধরেছেন। হযরতহ সুলাইমান (আ) তা দেখে বললেন: এটি পানির হাউজ নয়। এটি প্রসাদ, যার নিচে কাঁচের দ্বারা এরূপ করা হয়েছে। [পরবর্তীতে আমরা তা সবিস্তারে বর্ণনা করবো।]
[২.৪] অনেক সময় দেখা যায়, রহস্যের কোন ঘটনা নয়, সাদাসিদা ঘটনা, প্রথমে তা সুস্পষ্ট থাকে না কিন্তু হঠাৎ করে তা পাঠক ও নায়ককে হতচকিত করে দিয়ে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠে। যেমন হযরতহ মারইয়াম (আ)-এর ঘটনা। হযরত মারইয়াম (আ) পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী যাচ্ছিলেন। এমন সময় জিবরাঈল (আ) মানবরূপে আবির্ভূত হন। হযরত মারইয়াম (আ) বলেন: যদি আপনি সৎলোক হয়ে থাকেন তবে আমি আপনার কাছ থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি। আমরা ঘটনা শুনেই বুঝতে পারি, তিনি জিবরাঈল (আ)। কিন্তু অল্পক্ষণ পরই তিনি নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বললেন: আমি তোমার প্রবুর পক্ষ থেকে প্রেরিত দূত। তোমার জন্য একজন সৎ পুত্রের সুসংবাদ নিয়ে এসেছি। তারপর হঠাৎ এ ঘটনা আমাদের সামনে চলে আসে, প্রসব বেদনায় কাহির হয়ে মারইয়াম (আ) একটি খেজুর গাছের নিচে আশ্রয় নেন এবং বলেন: হায়! যদি আমি এর পূর্বেই মরে যেতাম। আমাকে সবাই ভুলে যেত। তখন নিচ থেকে ফেরেশতা আওয়াজ দিয়ে বললেন: ‘দুশ্চিন্তা করো না। তোমার পালনকরাতা তোমার নিচ দিকে কএকটি ঝর্ণনা প্রবাহিত করে দিয়েছেন।’ আয়াতের শেষ পর্যন্ত।
৩. দৃশ্যান্তরে বিরতি: কাহিনীর তৃতীয় শৈল্পিক বৈশিস্ট্য হচ্ছে- বর্ণিত ঘটনার মাঝে মাঝে সূক্ষ্ম বিরতি। যেমন আজকাল থিয়েটারে ও সিনেমায় বিরতির সময় পর্দা ফেলে দেয়া হয়, এভাবেই এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যের পার্থক্য করা হয়। আল-কুরআনে যতো ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, সকল ঘটনার মধ্যেই এ ধরনে বিরতি বিদ্যমান। ইতোপূর্বে আমরা যেসব ঘটনার উল্লেখ করেছি সেখানে সহজভাবেই তা অনুসন্ধান করা যেতে পারে। এখন আমরা উদাহরণ স্বরূপ হযরত ইউসুফ (আ)-এর ঘটনা নিয়ে আলোচনা করবো। সর্বমোট ২৮টি দৃশ্যে এ ঘটনা শেষ করা হয়েছে। তবে আমরা সবগুলো দৃশ্য নিয়ে আলোচনা না করে বিশেষ কয়েকটি দৃশ্য নিয়ে আলোচনা করবো।
হযরত ইউসুফ (আ)-এর ভাইয়েরা রেশন সংগ্রহের জন্য দুর্ভিক্ষের সময় তাঁর কাছে যান। তিনি তখন খাদ্য মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি ভাইদের পুনরায় এলে তার আপন ভাইকে সাথে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ দেন। হযরত ইয়অকুব (আ)-এর সম্মাতি না থাকা সত্ত্বেও তারা বিন ইয়ামিনকে নিয়ে মিসরে যায় রেশনের জন্য। হযরত ইউসুফ (আ) শস্য পরিমাপের সময় একটি পেয়ালা তার ভাইয়ের পোত্রে লুকিয়ে রাখেন। তারপর তাকে চোর সাব্যস্ত করে কৌশলে নিজের নিকটে রেখে দেন। তখন ভাইয়েরা পরামর্শ করে অন্য কাউকে আটকে রাখার আবেনদ করে কিন্তু তিনি তা বলিষ্ঠভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)
অতপর যখন তারা তাঁর কাছ থেকে নিরাশ হয়ে গেল তখন পরামর্শের জন্য এক জায়গায় বসলো। তাদের ভড় ভাই বললো: তোমরা কি জান না পিতা তোমার কাছ থেকে আল্লাহর নামে শপথ নিয়েছেন এবং পূর্বে ইউসুফের ব্যাপারেও তোমরা অন্যায় করছো? অতএব, আমি তো কিছুতেই এদেশ ত্যাগ করবো না, যে পর্যন্ত পিতা আমাকে আদেশ দেন কিংবা আল্লাহ আমার পক্ষে কোন ব্যবস্থা করে দেন। তিনিই সর্বোত্তম ব্যবস্থাপক। তোমরা তোমাদের পিতার কাছে ফিরে যাও এবং বলো: আব্বাজন, আপনার ছেলে চুরি করেছে। আমরা তাই বলে দিলাম যা আমাদের জানা ছিল এবং অদৃশ্য বিষয়ের প্রতি আমাদের লক্ষ্য ছিল না। জিজ্ঞেস করুন ঐ জনপদের লোকদেরকে যেখানে আমরা ছিলাম এবং ঐ কাফেলাকে, যাদের সাথে আমরা এসেছি। অবশ্যই আমরা সত্য কথা বলছি। (সূরা ইউসুফ: ৮০-৮২)
পর্দা পড়ে গেল। এখন আমরা হযরত ইউসুফ (আ)-এর ভাইদের সাথে অন্য এক দৃশ্যে মিলবো। তবে তা মিসরের কোন শহরে নয়। আমরা মিলবো, যখন তারা পিতার সামনে দাঁড়িয়ে কৈফিয়ত দানে ব্যস্ত। পর্দা উঠে গেল। আমরা সেখানে তাদের পিতা হযরত ইয়অকুব (আ)-কে নিম্নোক্ত মন্তব্য করতে দেখি।
(আরবী**********)
ইয়াকুব বললো: এসব কিছুই নয়। তোমরা শুধু মনগড়া একটি কথা নিয়ে এসেছ। এখন ধৈর্যধারণই উত্তম। সম্ভবত আল্লাহ তাদের সবাইকে একই সাথে আমার কাছে নিয়ে আসবেন। তিনি সুবিজ্ঞ প্রজ্ঞাময়। (সূরা ইউসুফ: ৮৩)
পর্দা পড়ে গেল। এখন আমরা হযরত ইউসুফ (আ) ও তাঁর ছেলেদেরকে অন্য একটি দৃশ্যে দেখবো। সেখানে দেখা যাবে ইয়াকুব (আ) গভীরভাবে চিন্তামগ্ন। ছেলেরা পিতার অবস্থা দেখে পেরেশান। পর্দা উঠে গেল।
(আরবী**********)সে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল এবং বললো: হায় আফসোস ইউসুফের জন্য! দুঃখে তার চোখ ঘোলাটে হয়ে গেল। অসহনীয় মনস্তাপে সে ছিল ক্লিষ্ট। তারা বলতে লাগল: আল্লাহর কসম! আপনি তো ইউসুফেল স্মরণ থেকে নিবৃত হবেন না। যে পর্যন্ত মরণাপন্ন হয়ে যান কিংবা না মৃত্যুবরণ করেন। সে বললো: আমিতো আমার দুঃখ ও অস্থিরতা আল্লাহর সমীপেই নিবেদন করছি এবং আল্লাহর পক্ষথেকে আমি যা জানি তা তোমরা জান না। বেটারা! যাও ইউসুফ ও তাঁর ভাইকে তালাশ করো এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। একমাত্র অবিশ্বাসী ছাড়া আর কেউ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয় না। (সূরা ইউসুফ: ৮৪-৮৭)
এখন আবার পর্দা পড়ে যাবে। ইউসুফ (আ)-এর ভাইয়েরা রওয়ানা দিলো। এরপর আর কিছু আমাদের জানা নেই। যখন পুনরায় পর্দা উঠলো তখন আমরা মিসরে হযরত ইউসুফ (আ)-এর নিকট তাদেরকে উপস্থিত হয়ে বলতে শুনি:
(আরবী**********)
অতপর যখন তারা ইউসুফের নিকট পৌঁছল তখন বললো: হে আমীর! আমরা ও আমাদের পরিবারবর্গ কষ্টের সম্মুখীন হয়ে পড়েছি এবং আমরা অপর্যাপ্ত পুঁজি নিয়ে এসেছি। অতএব আপনি আমাদের পুরোপুরি বরাদ্দ দিন এবং আমাদেরকে দান করুন। আল্লাহ দাতাদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকেন। (সূরা ইউসুফ: ৮৮)
আসহাবে কাহ্ফ, হযরত মারইয়অম (আ)-এর ঘটনা হযরত সুলাইমান (আ)-এর ঘটনাবলীও একই স্টাইলে বর্ণিত। আমরা সামনে আরও আলোচনা করবো, ইনশাআল্লাহ্।
৪. ঘটনার মাধ্যমে দৃশ্যাংকন: আমরা ইতোপূর্বে কাহিনীর তিনটি শৈল্পিক বৈশিস্ট নিয়ে আলোচনা করেছি। এখন আমরা আলোচনা করবো কিভাবে ঘটনার মাধ্যমে দৃশ্যাংকন করা হয়েছে। এ প্রকারটি আলোচ্য পুস্তকের ‘শৈল্পিক চিত্র’ অধ্যায়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। সেখানে আমরা বলেছি, আল-কুরআনে যে সমস্ত ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যদিও তা অতীতকালের কিন্তু পাঠকগণ যখন তা পাঠ করেন কিংবা শ্রোতাগণ তা শ্রবণ করেন তখন তাদের নিকট সমস্ত চিত্রটি মুর্তমান হয়ে উপস্থিত হয়। মনে হয় ঘটনাটি বর্তমানে তার চোখের সামনেই সংঘটিত হচ্ছে।
এখন আমরা যা বলতে চাই তা হচ্ছে, ঘটনাবলীর মাধ্যমে যে দৃশ্য বা ছবি আঁকা হয়। তা বিভিন্ন স্টাইলের হয়ে থাকে। যেমন ঘটনার মাধ্যমে কোন ছবি জীবন্ত হয়ে প্রতিভাত হওয়া। কিংবা সেই ছবিতে আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ হওয়া, অথবা ব্যক্তিত্বের ছাপ পরিলক্ষিত হওয়া। কোন কোন সময় ঘটনা বা কাহিনীতে দু’ ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকলেও একটি অন্যটির চেয়ে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠে। ফলে ঐ ঘটনাটিকে সেই নামেই আখ্যায়িত করা হয়। সমস্ত কাহিনীর দৃশ্যেই এসব শৈল্পিক সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়। আমরা এগুলোর শুধুমাত্র শব্দের মাধ্যমে আলোচনা না করে উদাহরণ দিয়ে বুঝাতে চাই।
আমরা এর আগে বাগান মালিকদের ঘটনা বর্ণনা করেছি। এমনকি আমরা সে ঘটনার চিত্রায়ণও দেখেছি। হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত ইসমাঈল (আ)-কে কা’বা ঘরের সামনে দাঁড়ান দেখেছি। হযরত নূহ (আ) ও তাঁর পুত্রকে দেখেছি প্লাবনের মুহূর্তে। এ চিত্রগুলো সর্বদা জীবন্ত, চিরন্তনী। এসব ঘটনার পাঠক কিংবা শ্রোতা মনে করেন ঘটনাটি তার চোখের সামনই সংঘটিত হচ্ছে। এখন আমরা আরও কিছু উদাহরণ বর্ণনা করছি।
যখন আসহাবে কাহ্ফ (হুগার অধিবাসীগণ) মুশরিকদের দল থেকে বেরিয়ে তওহীদের পথে এলেন, তখন তার পরস্পর একটি পরামর্শ করেছিলেন। যা কুরআন আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। যখনই আমরা তা পাঠ করি কিংবা শুনি মনে হয়, তারা যেন আমাদের চোখের সামনেই পরামর্শ করছে এমনকি তাদের কথাবার্তা পর্যন্ত আমরা শুনছি।
(আরবী**********)
আমি তোমার কাছে তাদের বৃত্তান্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। তারা ছিল কয়েকজন যুবক। তারা তাদের সৎপথে বলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। তাদের মনকে দৃঢ় করেছিলাম, যখন তারা উঠে দাঁড়িযেছিল। তারা বলবে: আমাদের প্রতিপালক আসমান ও জমিনের পালনকর্তা, আমরা কখনো তাঁর পরিবর্তে অন্য কোন উপাস্যকে আহ্বান করবো না। যদি করি তা হবে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এরা আমাদেরই স্বজাতি, এরা তাঁর পরিবর্তে অনেক উপাস্য গ্রহণ করেছে। তারা এদের সম্পর্কে প্রকাশ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে না কেন? যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যে উদ্ভাবন করে, তার চেযে বড় জালিম আর কে? তোমরা যখন তাদের থেকে পৃথক হলে এবং আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ইবাদত করে তাদের থেকে, তখন গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করো। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের ওপর রহম করবেন এবং তোমরা কাজকর্মকে ফলপ্রসু করার ব্যবস্থা করবেন। (সূরা আল-কাহ্ফ: ১৩-১৬)
এখানে এ দৃশ্য শেষ, পর্দা পড়ে যায়। বিশং শতাব্দীর সিনেমা-থিয়েটারের মতোই এখানে দৃশ্যান্তরে বিরতি। যখন পর্দা সরে যাবে তখন আমরা দেখতে পাব, পরামর্শ শেষে তারা পরস্পর গুহায় ঢুকে পড়েছে। আমরা নিজের চোখে তাদেরকে গুহায় প্রবেশ করতে দেখছি। এতে কোন সন্দেহ নেই। এমন দৃঢ় বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। আল-কুরআনের বর্ণনা ও ব্যাখ্যার দাবিও তাই।
(আরবী**********)
তুমি সূর্যকে দেখবে, যখন উদিত হয়, তাদরে গুহা থেকে পাশ কেটে ডানে চলে যায় এবং যখন অস্ত যায় তাদের থেকে পাশ কেটে বামে চলে যায়, অথচ তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত।
একেই বলে কোন কিছুকে চোখের সামনে হাজির করে দেয়া। বর্তমানে থিয়েটারে যেভাবে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে দৃশ্যকে স্পষ্ট করা হয় এখানেও সূর্যের আলোর মাধ্যমে তাই করা হয়েছে। সূর্যের চলমানতা এ দৃশ্যকে সচল করে তুলেছে। কিন্তু যখন সূর্য উঠে কিংবা যখন তা ডুবে, কোন সময়ই তার আলো গুহার ভেতর প্রবেশ করে না। দিনের সারাক্ষণ সেখানে চলে আলো-আঁধারীর খেলা। ‘তাযাওয়ারু’ (****) শব্দ দিয়ে সে কথাই বুঝানো হয়েছে। কতো সহজভাবে চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে, এ দৃশ্যটি সিনেমার পর্দায় দেখাতে কতো কষ্টই না করা হতো।
আসুন, আসহাবে কাহ্ফকে দেখুন। বলা হয়েছে:” (আরবী**********)- ‘তারা গুহার প্রশস্ত জায়গার মধ্যে অবস্থিত’ একথাটি একটি অনুপম সংযোজন। যা মুজিযা’র চেয়ে কোন অংশে কম নয়। একথা কয়টি আমাদের সামনে গোটা চিত্রটিকে জীবন্ত ও সচল করে তুলেছে। মনে হয় তারা আমাদের চোখের সামনেই নড়াচড়া করছে।
(আরবী**********)
তুমি মনে করবে তারা জাগ্রত, অথচ তারা নিদ্রিত। আমি তাদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাই ডানদিকে ও বামদিকে। তাদের কুকুর ছিল সামনের পা দুটো গুহামুখে প্রসারিত করে। যদি তুমি উঁকি দিয়ে তাদেরকে দেখতে, তবে পেছনে ফিরে পালাতে এবং তাদের ভয়ে আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়তে। (সূরা আল-কাহ্ফ: ১৮)
এ কয়টি শব্দের মাধ্যমে আঁকা ছবিটি একেবারেই জীবন্ত, চলমান।
হঠাৎ আসহাবে কাহ্ফের মধ্যে প্রাণের স্পন্দন ঘটলো। আসুন দেখা যাক এবার কি ঘটে:
(আরবী**********)
আমি এমনিভাবে তাদেরকে জাগ্রত করলাম, যাতে তারা পরস্পর জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের একজন বললো: তোমরা কতোদিন অবস্থান করেছ? তাদের কেউ বললো: একদিন কিংবা তারচে’ কিচু কম। কেউ কেউ বললো: তোমাদের প্রতিপালকই ভাল জানেন, তোমরা কতোকাল অবস্থান করেছে। এখন তোমাদের একজনকে এ মুদ্রাসহ শহরে পাঠাও, সে যেন দেখে কোন খাদ্য পবিত্র, তারপর তা থেকে কিছু খাদ্য নিয়ে আসে তোমাদের জন্য। সে যেন নম্রতার সাথে যায় আর কিছুতেই তোমাদের খবর কাউকে না জানায়। তারা যদি তোমাদে খবর জানতে পারে, তবে পাথর মেনে তোমাদেরকে হত্যা করবে অথবা তোমাদেরকে তাদরে ধর্মে ফিয়ে নেবে। তাহলে আর তোমরা সফলতা লাভ রতে পারবে না। (সূরা আল-কাহফ: ১৯-২০)
এ হলো তৃতীয় দৃশ্য অথবা দ্বিতীয় দৃশ্যের শেষাংশ। এখন তারা সবাই জাগ্রত। সর্বপ্রথম তাদের জিজ্ঞাসা, কতোদিন তারা ঘুমিয়েছিলেন? উত্তর পাওয়া গেল, একদিন কিংবা তার চেয়ে কম। অথচ আমরা জানি তাঁরা দীর্ঘ সময় গুহায় অবস্থান করেছেন। ঘটনার সার-সংক্ষেপ থেকে আমরা জানতে পেরেছি। তারা ক্ষাধার্ত ছিলেন, তাই তারা ব্যাপারটি নিয়ে এতো মাথা ঘামাননি। এখন ঐ মুমিন ব্যক্তি যিনি বলেছিলেন: (আরবী**********)-“তোমাদের প্রতিপালক জানেন, তোমরা কতোদিন ঘুমিয়েচিলে”। তিনি কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক করে একজনকে খাদ্য কেনার নির্দেশ দিলেন। তিনি সতর্ক করে বললেন: অত্যন্ত নম্রতার সাথে শহরে যেতে হবে, কাউকে এ জায়গার কথা ফাঁস করে দেয়া যাবে না, খাদ্য ভাল ও পবিত্র দেখে কিনতে হবে। যদি কেউ খবর জেনে ফেলে তাবে তারা হয়তো তাদেরকে মেরে ফেলবে কিংবা পিতৃপুরুষের ধর্মে জোর করে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। এ কথাগুলো তো গুহাবাসী (আসহাবে কাহ্ফ) বললেন। আমরা জানি কয়েকশ’ বছর অতিবাহিত হয়েছে। এমন কেউ আর এখন অবশিষ্ট নেই যে, তাদেরকে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড দেবে কিংবা পৈতৃক ধর্মে ফিরিয়ে নেবে। কারণ, তারা সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছে। আসুন পরের দৃশ্যে আমরা তাদের প্রতিনিধির কার্যাবলী দেখি।
এর পরের দৃশ্য কোথায়? এখানে অবশ্যই চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন আছে। আমরা জানি, তাদের কথা লোকেরা জেনে ফেলেছিল। কিন্তু তাঁরা যে কাফিরদের ভয় করেছিলেন প্রকৃতপক্ষে তখন সেসব কাফির-মুশরিক ছিল না। ঐ সময় সবাই ঈমানদার হয়ে গিয়েছিল।
(আরবী**********)
এমনিভাবে আমি তাদের খবর প্রকাশ করে দিলাম, যাতে তারা জানতে পারে, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং কিয়ামত হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। (সূরা আল-কাহ্ফ: ২১)
এখানে পৌঁছে ঘটনা দ্বীনি উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়েছে। সাথে সাথে শৈল্পিক দিকটিও পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়েছে। এখন আমাদের চিন্তার জগতে যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খায তা হচ্ছে- যাকে শহরে পাঠান হলো তাঁর অবস্থা কি হলো? যখন লোকজন তার রহস্য জেনে ফেললেন, তখনই বা তিনি কি করলেন?
এখানেও এক সূক্ষ্ম বিরতি। তারপর বুঝা যায়, তখন তাদেরকে মৃত্যু গ্রাস করে নিল। তখন লোকজন গুহার বাইরে দাঁড়িযে বিতর্ক শুরু করে দিলো যে, তারা কেন্ দ্বীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
(আরবী**********)
যখন তারা নিজেদের কর্তব্য বিষয়ে পরস্পর বিতর্ক করেছিল, তখন তারা বললো: তাদের ওপর সৌদ নির্মাণ করো। তাদের পালকন্তা তাদের বিষয়ে ভাল জানেন। তাদের কর্তব্য বিষয়ে যাদের মত প্রবল হলো, তারা বললো: আমরা অবশ্যই তাদের স্থানে মসজিদ নির্মাণ করবো। (সূরা আল-কাহ্ফ: ২১)
আবার বিরতি। এখন যদি কেউ চায় তবে সে কল্পনায় তাদের মাযারের ওপর মসজিদ নির্মাণ করতে পারে। এদিকে লোকদের অবস্থা ছিল- তারা বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক শুরু করলো। কারো বিতর্ক তারা সংখ্যায় কতোজন ছিল, আবার কারো বিতর্কের বিষয হচ্ছে- তারা কতোদিন ঘুমিয়েছিল?
(আরবী**********)
অজ্ঞাত বিষয়ে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে এখন তারা বলবে: তারা ছিল তিনজন চতুর্থটি ছিল তাদের কুকুর। আবার কেউ বলবে: তারা ছিল পাঁচজন, তাদের কুকুর ছিল ষষ্ঠ। আবার এমন বলবে: তারা ছিল সাতজন, অষ্টম ছিল তাদের কুকুরটি। (সূরা আল-কাহ্ফ: ২২)
যখন আসহাবে কাহ্ফকে জীবিত করার পর দ্বীনি উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেল তখন পুনরায় তাদেরকে রহস্যের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হলো:
(আরবী**********)
বলো: আমার পালনকর্তা তাদের সংখ্যা ভাল জানেন। তাদের খবর অল্প লোকই জানে। আলোচনা ছাড়া তুমি তাদের সম্পর্কে বিতর্ক করবে না এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে কাউকে জিজ্ঞেসও করবে না।
ঘটনা পূর্ণতা প্রাপ্তির পর কুরআন তার দ্বীনি উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছে। আসহাবে কাহ্ফকে পুনর্জীবন দান করার পর আল্লাহর যে কুদরতের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার দিকে ইঙ্গিত করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হচ্ছে:
(আরবী**********)
তুমি কোন কাজের বিষয়ে বলবে না যে, টি আমি ‘আগামীকাল করবা’। ইনশাআল্লাহ (আল্লাহর ইচ্ছা করলে) একথা বলা ছাড়া। যখন ভুলে যাও, তখন তোমার পালনকর্তাকে স্মরণ করো এবং বলো: আশা করি আমার পালনকর্তা আমাকে এর চেয়েও নিকটতম সত্যের পথ-নির্দেশ করবেন। (সূরা আল-কাহফ: ২৩-২৪)
এখানে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে একটি বিশেষ কথা বলা হয়েছে। আমাদের সে আলোচনায় গিয়ে কাজ নেই। এতোটুকুনতো বুঝ কুরআন যেভাবে ঘটনা বর্ণনার সাথে সাথে দ্বীনি উদ্দেশ্যকে সুস্পষ্ট করে দেয়, এখানেও তেমন দিয়েছে। শিক্ষামূলক উপদেশের জন্য এর চেয়ে উত্তম সুযোগ আর কী ছিল?
সর্বশেষ তারে গুহায় অবস্থান কালের সঠিক তথ্য দেয়া হয়েছে, যা এ ঘটনায় আমাদেরও বক্তব্য। অবশিষ্ট থাকে তাদের সংখ্যা। তা আজও- স্বয়ং আসহাবে কাহ্ফের মতো- এক রহস্য।
(আরবী**********) গুহায় তাদের উপর তিনশ’ বছর, অতিরিক্ত আরও নয় বছর অতিবাহিত হয়েছে। (সূরা আল-কাহ্ফ: ২৫)
এ ঘটনার অন্তরালে যে দ্বীনি শিক্ষা নিহিত তা নিম্নের শব্দমালায় প্রকাশ ঘটেছে:
(আরবী**********)
বলো: তারা কতোকাল অবস্থান করেছে, তা আল্লাহই ভাল জানেন। আকাশ ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই কাছে রয়েছে। তিনি কতো চমৎকার দেখন ও শুনেন। তিনি ছাড়া তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। তিনি কাউকে নিজ কর্তৃত্বে শরীক করেন না। তোমার প্রতি তোমার প্রবু যে কিতাব ওহী করা হয়েছে তা পাঠ করো। তার বাক্য পরিবর্তন করার কেউ নেই। তাঁকে ছাড়া তোমার কোন আশ্রয়স্থলও নেঈ। (সূরা আল-কাহ্ফ: ২৬-২৭)
আমি কাহিনীর সমস্ত বৈশিষ্ট্যগুলো অনুসন্দানের চেষ্টা করেছি, তারপর তা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করলাম। একটি কথায় কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে, আল-কুরআনে ঘটনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা পাঠ করা মাত্র পাঠকের চোখের সামনে ছবির মতো সবকিছু ভেসে উঠে। এটিই সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। আর কেন বৈশিষ্ট্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
আবেগ অনুভূতির চিত্র
এখন আমরা কাহিনীর দৃশ্যায়নের আরেকটি দিকে দৃষ্টি দেবো।তা হচ্ছে- আবেগ ও মনের ঝোঁক প্রবণতার ছবির বহিঃপ্রকাশ।
আগে আমরা দু’ বাগান মালিক এবং তার সাথীর কথোপকথনের ঘটনা বর্ণনা করেছি। তেমনিভাবে হযরত মূসা (আ) ও একজন সৎলোকের ঘটনাও আমরা বর্ণনা করেছি। এ দুটো ঘটনায় আবেগ ও অনুভূতির ছবিতো আছেই সেই সাথে ব্যক্তিত্বের ছবিও উপস্থাপন করে সেই সকল দৃশ্যাবলকেমূর্তমান করে চোখের সামনে তুলে ধরে। এখন আমি এ রকম আরেকটি ঘটনা আপনার সামনে পেশ করছি। হযরতমারইয়াম (আ) যখন হযরত ঈসা (আ)-কে প্রসব করেন তখনকার ঘটনা। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)
এ কিতাবে মারইয়ামের কথা বর্ণনা করো, যখন সে তার পরিবারের সদস্যদের থেকে পৃথকহয়ে পূর্বদিকে একস্থানে আশ্রয় নিল। তখনতাদের থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য সে পর্দা করলো। (সূরামারইয়াম: ১৬-১৭)
হযরতমারইয়অম একাকী নির্জনবাসে সন্তুষ্ট ছিলেন। কারণ একদিন তিনি মগ্নচিত্তে গোসলকানার দিকে যাচ্ছিলেন এমতাবস্থায় সেখানে এক যুবককে দেখলেন।ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন, কল্পনারজগৎ নিমিষে বদলে গেল।
(আরবী**********)
অতপর আমিতার কাছে আমার রূহ প্রেরণ করলাম। সে তার নিকট পূর্ণ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করলো। মারইয়াম বললো: আমিম তোমার থেকে দয়াময়ের আশ্রয়প্রার্থনা করছি,, যদি তুমি আল্লাহভীরু হও। (সূরা মারইয়াম: ১৭-১৮)
এ কথাগুলো হচ্ছে ঐ রকম, যেমন কোন কুমারী নিরালয় একাকী বসে আছে, অকস্মাৎসেখানে এক ব্যক্তি এসে ধমকে উঠলো, তখন সে কোন উপায়ান্তর না দেখে তার মধ্যে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করার চেষ্টা করলো।
যদিও আমরা বুঝতে পারি, সে আগন্তুক যুবক নয় স্বয়ং ফেরেশতা জিবরাঈল আমীন। কিন্তুমারইয়াম (আ) মনে করেছিলেন, সে একজন অপরিচিত যুবক। চিন্তা কের দেখুন, এক অপরিচিত যুবক এমন এক পবিত্রা কুমারী মেয়ের কাছে কেন আসবে, যে অত্যন্ত উঁচু পরিবারের ময়ে। যার সমস্ত আচার-আচরণদ্বীনের গণ্ডিতেসীমাবদ্ধ। যার অভিভাবক স্বয়ং হযরত জাকারিয়া (আ)। তার মা তাকে দ্বীনেরজন্যে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। এটি প্রথম অংশ।
(আরবী**********)
সে বললো: আমিম তোমার প্রতিপালকের দূত। তোমাকে এক পবিত্র পুত্র দান করে যাব। (সূরা মারইয়াম: ১৯)
লজ্জাবনত কোন কুমারীকে তার একাকীত্বের সুযোগে কেউ এসে ভড়কে দিলে তার মানসিক অবস্থা ও অনুভূতিত কেমনহয়,তা চিন্তাশক্তি সহজেইঅনুমান করতেত পারে। যদিওসে নিজেকে আল্লাহর দূত (অর্থাৎ ফেরেশতা) হওয়ার কথা বলে।তবু তিনি পুরোপুরি বিশ্বাসকরতে পারলেন না। শুধু একটি কথাইবারবার তার চিন্তার জগতে ঘুরপাক খেতে থাকে যে, তার সরলতার সুযোগ নিয়ে হয়তো সে তারকুমারীত্বকে নষ্ট করতে চায়। নইলে সে তাকে একটি সন্তানের সংবাদ দিচ্ছে এমন এক পদ্ধতিতে আজ পর্যন্ত যার কোন দৃষ্টান্ত নেই। এটি দ্বিতীয় অংশ।
এবার মারইয়াম (আ) এমন এক সাহসী মেয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণহলেন, যে বিপদে না ঘাবড়ে সাহসিকতারসাথে তারমুকাবিলা করে।
(আরবী**********)
তিনি বলে উঠলেন: কিভাবে আমার পুত্র হবে অথচ কোন পুরুষ আমাকে স্পর্শকরিনি? আর আমি কখনো ব্যভিচারিণীও ছিলাম না? (সূরামারইয়াম: ২০)
মারইয়াম (আ) বড়ব্যথা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কথা কয়টি বললেন। এখনো মারইয়ামম (আ) এবং উল্লেখিত যুবক একাকী দাঁড়িযে। অবশ্য ইতোমধ্যে মারইয়মা (আ) আগন্তুকের আগমনের উদ্দেশ্য হৃদয়ঙ্গমকরতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝতেত পারছেন না, কিভাবে তাসম্ভবপর হতে পারে? তারসান্ত্বনার কথা একটিই,তাহচ্ছে ভদ্রলোকের বক্তব্য- আমি তোমার প্রতিপালকের দূত। তবু মনে হয় এতে কোন ধোঁকাবাজের ধোঁকাওহতে পারে। যে প্রসঙ্গে আমরা প্রথমে আলাপ করেছি। এটি কোন লজ্জা-শরমেরকাজ নয়। কথা আরো সুস্পষ্ট হওয়া দরকার। তাই জিবরাঈল (আ) বললেন:
(আরবী**********)
সে বললো: এমনি করেই হবে। তোমার প্রতিপালক বলেছেন: এটি আমার জন্য অত্যন্ত সহজ কাজ এবং আমি তাকেমানুষেরজন্য একটি নিদর্শন ও আমর পক্ষ থেকে একে রহমত স্বরূপকরতেচাই। এটি একটি স্থিরকৃত ব্যাপার। (সূরামারিইয়াম: ২১)
তার কি হলো? এখানে দীর্ঘ এক শৈল্পিক বিরতি। কিন্তু এ বিরতির মুহূর্তে পাঠকদের চিন্তার জগতে একটিকা বারবার প্রতিধ্বনিতহয়, মারইয়াম (আ)-এর কি হলো? আবার কাহিনীর পট পরিবর্তন। এবারও আমরা মারইয়াম (আ)-কে আরেক ব্যাপারে উদ্বিগ্ন দেখতে পাই। যা আগের চেয়েও বেশি।
(আরবী**********)
অতপর তিনিগর্ভে সন্তান ধারণ করলেন। তারপর তিনি দূরবর্তী এক জায়গায় চলে গেলেন। প্রসব বেদনা তাঁকে এক খেজুর গাছের পাদদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করলো। তিনি বললেন: হায়! আমি যদি এর পূর্বে মরে যেতাম এবং মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতাম। (সূরা মারইয়াম:২৩)
এটি তৃতীয অংশ।
প্রথমাবস্থায় হযরত মারইয়াম (আ)-এর সামনে শুধু নিজ স্বত্ত্বা ছিল। পাক-পবিত্র পরিবেশে লালিত-পালিতহয়েছিলেন। কিন্তু অবশেষে তিনি সম্পূর্ণ নতুন এক অবস্থারমুখোমুখি হলেন।বর্তমান আচরণও ভিন্নতর। তিনি এখন জাতিরত কাছে লাঞ্ছিত-অপমানিত, শুধু মানসিক দিকেই নয় শারীরিক দিকেও তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। কেননা প্রসব বেদনার দরুন তিনি একটি খেজুর গাছের নিচে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এখঅনে তিনি একা। দ্বিতীয় কোন লোক তার কাছে নেই। তাছাড়া প্রথম সন্তান সম্ভবা নারীর যে সমস্ত অসুবিধা হয়ে থাকে হযরতমারইয়াম (আ)-এরও সেসব অসুবিধা হচ্ছে, এমন অবস্থায় কি করতে হবে সেই ধারণাটুকুও নেই। সামান্য একটুসহযোগিতা করবে এমন একজন লোকও নেই। তাই তিনি আক্ষেপ করে বললেন: “হায় এ অবস্থার পূর্বে আমি কেন মনে গেলাম না এবংমানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেলাম না।” একথা থেকে তার শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণাএবংতাঁর দুঃখ-দুর্দশা সম্পর্কে আমরা অবহিত হতে পারি। আমরা দেখতে পাচ্ছি তিনি কতো বড় বিপদে নিমজ্জিত। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)অতপর ফেরেশতা তাকে নিম্মদিক থেকে আওয়াজ দিলো, তুমি দুঃখ করো না। তোমার রব্ব তোমার পায়ের তলায় একটি নহর প্রবাহিত করেছেন। আর তুমি নিজের দিকে খেজুর গাছের কাণ্ড নাড়া দাও, তোমার ওপর পাকা খেজুর পতিত হবে। তা থেকে খাও, পান করো এবং চোখ জুড়িয়ে নাও। যদি মানুষের মধ্যেকাউকে তুমি দেখ, তবে বলে দিও: আমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে রোযা মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনমানুষের সাথে কথা বলবো না। (সূরামারইয়াম: ২৪-২৬)
এটি চতুর্থ অংশ।
এ ঘটনা এমন আশ্চর্যও পেরেশানীর যে, ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা [মারইয়াম (আ) নয়] দৌড়ে পালাতে প্রস্তুত। হঠাৎ সন্তান ভূমিষ্ঠহওয়া, নিচ থেকে ফেরেশতার আওয়াজ, এমন সন্তান যামারইয়াম (আ)-এর জন্য যন্ত্রণা ও তিরষ্কারের উৎস। তৎক্ষণাৎ খাদ্য ও পানীয়ের সুবন্দোবস্ত, নিঃসন্দেহে এটি একটি আজব ঘটনা।
আমাদের ধারণা, হযরত মারইয়াম (আ)-ও আশ্চার্যান্তিব হয়েছেন। দুর্বল শরীরে খেজুরের ডাল নাড়ানো, সেখান থেকে তরতাজা পাক খেজুর সংগ্রহ করে খাওয়া।তারপর একটু শক্তি সঞ্চয় করে বাড়ির দিকে যাত্রা। কিন্তু চিন্তার আরেকটি সেতু এখানে অতিক্রম করতে বাকী।
(আরবী**********) অতপর সে তার সন্তানকে নিয়ে নিজসম্প্রদায়ের নিকট ফিরে এলো। (সূরা মারইয়াম: ২৭)
এবার মারইয়াম (আ)মানসিক তৃপ্তি লাভ করার পর তার দুশ্চিন্তা ও দুঃখ-বেদনাঅন্যদের কাছে হস্তান্তর করা উচিত।
(আরবী**********)
তারাবললো: হে মারইয়াম! তুম একটি অঘটন ঘটিয়ে বসেছ। সে হারূনের বোন! তোমার পিতা অসৎ এবং মাতাব্যভিচারিণী ছিলেন না। (সূরামারইয়াম: ২৭-২৮)
গোত্রের লোকজন তাকে ভর্ৎসনাকরতে লাগলো।উপহা কতের তাকে ‘হারূনের বোন’ হিসেবে সম্বোধন করছে এবংবলছে- তুমি এমন সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ে, যে বংশে ইতোপূর্বে এ রকম কোন ঘটনা ঘটেনি। তাছাড়া তোমার পিতা-মাতাও এমন ছিলেন না। তুমি কি করে বংশেরমুখে কালিমাম লেপন করলে?
মারইয়াম (আ) ভারাক্রান্ত হৃদয়েনিরুত্তর থেকে,সন্তানের দিকে ইঙ্গিতকরেবলতেন:আমকে জিজ্ঞেসনা করে একে জিজ্ঞেস করো জবাব পাবে। মনেহয় মামরইয়াম (আ)-এরএ বিশ্বাস ছিল তার সন্তানের দ্বারা কোন মুজিযা সংঘটিতহবে।এজন্যই তিনি সন্তানের দিকে ইঙ্গিতকরেছিলেন। লোকজন শুনেআশ্চর্যহয়ে আরো বেশি তিরষ্কার করতে লাগলো। কেননালোকজনতা হতবাক।কুমারী মেয়ে সন্তান ধারণকরেছে এবং সে এ সন্তাতনেরপ্রতি খুশী। তারপর গভীর আত্মবিশ্বাসেরসাথে লোকদেরকে তাচ্ছিল্যভাবে সন্তানকে দেখিয়ে দেয়া ইত্যাদি লোকদেরকেআশ্চর্যের শেষ প্রান্তে উপনীত করলো।
(আরবী**********) তারা বললো: কোলের শিশু তার সাথে আমরা কিভাবেকথা বলবো?
তখন অলৌকিকভাবে হযরত ইসা (আ) বলে উঠলেন:
(আরবী**********)
শিশু বলে উঠলো: আমি আল্লাহর দাস। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং নবী করেছেন। আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতোদিন জীবিতথাকি ততোদিন নামায ও যাকাত আদায় করতে এবং মায়ের আনুগত্যকরতে।আমাকে তিনউদ্ধত ও হতভাগ্য করেননি। আমার প্রতি সালাম, যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিনমৃত্যুবরণ করবো এবং যেদিন পুনরুজ্জীবত হয়ে উত্থিতহবো। (সূরা মারইয়াম:; ৩০-৩৩)
আমরাকিছুক্ষণ আগে এ ঘটনা যদি না শুনতাম, তাহলে এ ঘটনা শুনে ঘাবড়ে ভেগে যেতাম। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুমুতে পারতাম না। আমাদেরমুখমণ্ডলে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ে যতো। কিন্তু আমরা ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। তাই দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে’ যেমন চোখের পানিটপ টপ করেঝরে পড়ে, আবার আনন্দের আতিশয্যেহাততালি দিতেও ইচ্ছে করে। এমন সময় পর্দা পড়ে গেল। অবস্থা এমন হয়ে গেল ঘটনার মর্মান্তিকতায় চোখ থেকে টপ টপ করে পানিঝরছে আবার আনন্দে হাততালি দেয়া হচ্ছে। হৃদয়ের তন্ময়তায় নাড়া দিয়ে এক আওয়াজ শোনা গেল। ঘোষক ঘোষণা করছে:
(আরবী**********)
এই মারইয়ামের পুত্র ঈসা! সত্যকথা, যে সম্পর্কে লোকেরা সতর্ককরে। আল্লাহ এমন নন যে, সন্তানগ্রহণ করবেন। তিনি পবিত্র ওমহিমাময় সত্তা। যখন তিনি কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তখন বলেন: ‘হও’ আর অমনিতা হয়ে যায়। (সে শিশু আরো বললো:) নিশ্চয় আল্লাহ আমার পালনকর্তা এবং তোমাদেরও। অতএব, তোমরা তাঁর ইবাদত করো, এটিই সরল-সোজা পথ। (সূরা মারইয়াম: ৩৪-৩৬)
এখানেপৌঁছে দ্বীনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং সেই সাথে ঘটনার দৃশ্য ও ছবি দুটোই পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে এবং নিঃসন্দেহে যে কথাটি বলা যায়, তা হচ্ছে এটি আবেগ-অনুভূতির সর্বোত্তম একটি চিত্র।সমস্ত ঘটনায় এ রঙ ছেয়ে আছে। যারকারণে অন্য বৈশিষ্ট্যসমূহ ম্লান হয়ে গেছে।
কাহিনীতে ব্যক্তিত্বের ছাপ
এবার আমরা আল-কুরআনের দৃশ্যায়নের তৃতীয প্রকার নিয়ে আলোচনা করছি। একটি চিত্রায়ণের অন্যান্য প্রকারেরমধ্যে একটি, তবু এটিকে পৃথক করবর্ণনাকরার প্রয়াসস পাচ্ছি। এটিব্যক্তিত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট।
ইতোপূর্বে বর্ণিত দুই বাগানমালিক ও তার সাথী হযরতমূসা (আ) ও একজন সৎলোকের কাহিনী দুটোতেও ব্যক্তিত্বেরছাপ পুরোপুরি পরিলক্ষিত হয়। ঘটনাব্যক্তিত্বের সাথে জড়িত। তাই ঘটনা বর্ণনায় ব্যক্তিত্বের প্রকাশ অত্যন্ত উঁচুমানের শিল্প। পুরোকাহিনীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যক্তিত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট।চাই সেস ঘটনা- কুরআনের সাথে সংশ্লিষ্ট হোক কিংবা শিল্পকলার সাথে।
যদিও কুরআনে শুধুমাত্র দ্বীনের দাওয়াতের প্রয়োজনেই বিভিন্ন ঘটনা ও কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। তাই যে কোন ঘটনাবা কাহিনীর প্রধান লক্ষ্যহচ্ছে দাওয়াতে দ্বীন। তবুব্যক্তিত্ব চিত্রণকে তা থেকে পৃথক করে দেখা যায়না। এ বৈশিষ্ট্যটি কুরআনের সমস্তকাহিনীতেই বিদ্যমান। ব্যক্তিকে মানবিক উপমা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কুরআনে এমন কিছুব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে যারা ব্যক্তিত্বের সীমা ছড়িয়ে ‘উপমার মানুষ’ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। আমরা এ প্রসঙ্গে নিচেকয়েকটি ঘটনারপর্যালোচনা করবো।
১.চঞ্চল প্রকৃতির নেতা
উদাহরণ স্বরূপ আমরা মূসা (আ)-এরকথা বলতে পারি। তিনি ছিলেন একজন চঞ্চলপ্রকৃতির নেতা।
হযরত মূসা (আ) ফিরাউনেরপ্রাসাদে লালিত-পালিত হয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছিলেন। তিনিছিলেন সুঠাম ও সবল দেহের অধিকারী।
(আরবী**********)
একদিন সে শহরে প্রবেশ করলো, তখন তার অধিবাসীরা ছিল বেখবর। সেখানে দুই ব্যক্তিকে লড়াই করতে দেখল। এদের একজন ছিল তার নিজ দলের এবং অন্যজন তার শত্রুদলের। অতপর যে তার নিজদলের সে তার শত্রুদলের লোকটির বিরুদ্ধেতারকাছেসাহায্য প্রার্থনা করলো।তখন মূসা তাকে ঘুষি মারল, তাতেই লোকটি অক্কা পেল। (সূরা আল-কাসাস: ১৫)
এ ঘটনায় দুটো কথা স্পষ্টহয়ে উঠেছে। এক: হযরত মূসা (আ) –এর জাতিপ্রীতি। দুই :চঞ্চল প্রকৃতিরস্বভাব।কারণ তার জাতির একজন লোক তাঁর সাহায্য চাইল আর অমনি তিনিতাঁর পক্ষ নিয়ে ঘুষি মেরেতারজীবনলীলা সাঙ্গকরে দিলেন। তারপর তিনি লজ্জিত হয়েবললেন:
(আরবী**********)
মূসাবললো: এটি শয়তানের কাজ। নিশ্চয়ই সে প্রকাশ্য শত্রু, বিভ্রান্তকারী। সে আরো বললো: হে আমার প্রতিপালক! আমিতো নিজের ওপরজুলুম করে ফেলেছি। অতএব, আমাকে ক্ষমাকরে দাও।আল্লাহ তাঁকেক্ষমা করলেন। নিশ্চয়ই তিনিক্ষমাশীল, দয়ালু।সেবললো: হে আমার পরওয়ারদিগার! আপনি আমার প্রতি যে অনুগ্রহকরেছেন,এরপর আমিকখনওঅপরাধীদের সাহায্যকারীহবো না। (সূরাকাসাস:১৫-১৮)
তারপরবলা হয়েছে:
(আরবী**********) অতপর সে প্রভাতে সেই শহরে ভীত-সন্ত্রস্তঅবস্থায় উঠলো। (সূরা কাসাস:১৮)
এ আয়াতে অতি পরিচিত এক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যখনমানুষ ঘাবড়ে যায় তখন সে এদিক-ওদিক তাকায় এবং পথ চলে। কারণ সে আর পুনরায় এ অবস্থার মুখোমুখি হতেচায় না।চঞ্চল প্রকৃতির মানুষের অবস্থা এমনইহয়ে থাকে।
হযরতমূসা (আ) ওয়াদাকরেছিলেনআর কাউকে তিনি বিপদে সাহায্য করবেন না। আসুন আমরা দেখি, তিনকতোটুকু স্তির চিলেন তাঁরএ সিদ্ধান্তে। হঠাৎ তিনি দেখলেন:
(আরবী**********)
হঠাৎ সে দেখলো, গতকাল যে ব্যক্তি তার সাহায্য চেয়েছিল, সে চিৎকারকরে তার সাহায্য প্রার্থনা করছে। মূসা তাকে ব ললো: তুমি তো একজন প্রকাশ্র পথভ্রষ্ট ব্যক্তি। (সূরা আলকাসাস:ড় ১৮)
কিন্তু তিনি ভুলে গেলেন তার প্রতিশ্রুতি। তিনি তার দিকে এগিয়ে গেলেন। আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতেচাইলেন।কারণ তিনি ছিলেনচঞ্চল প্রকৃতির মানুষ। এজন্য তিনি ভুলে গেলেন যে, এ ধরনের কাজ থেকে তিনি লজ্জিত হয়ে দরবারে ইলাহীতে মাফ চেয়েছেন। যখন তাঁকে অতীতের অপরাধের কথা স্মরণকরিয়ে দেয়াহলো, তখন তিনি ভয় পেয়ে গেলেন।
(আরবী**********)
অতপর মূসা যখন উভয়েরশত্রুকে শায়েস্তাকরতে চাইল, তখন সে বললো: গতকাল তুমিম যেমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলে তেমন আমাকও কি তুমিহত্যা করতেচাও? তুমিতো পৃথিবীতে স্বৈরাচারী হতে চলছো, তুমি সংশোধনকারী হতে চাও না। (সূরা কাসাস:১৯)
এমন সময এক ব্যক্তি এসে তাকে শহর থেকে পালিয়ে যাবার জন্য পরামর্শ দিলো। আমরা জানি তিনি এ পরামর্শ অনুযায়ী দেশান্তরহলেন। আপাতত তাকে ছেড়ে দিন। আসুন, দশ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর আমরা তাঁর সাথে মিলিত হেই। এ দীর্ঘ সময়ে কি তাঁর স্বভাবে কোন স্থিতিশীলতা এসেছিল? তিনি কি শান্ত ও স্থিরচিত্তের অধিকার হতে পেরেছিলেন?
নিশ্চয়িই নয়। তাঁর স্বভাব-প্রকৃতিতেমৌলিক কোন পরিবর্তন হয়নি। যখন তুর পাহাড়ের ডান প্রান্ত থেকে আওয়াজ হলো: তোমার লাঠি নিক্ষেপ করো। তিনি তা নিক্ষেপ করলেন কিন্তু যখন লাঠি চলমান সাপে রূপান্তর হয়ে গেলে, তা দেখে তিনি ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে লাগলেন। একারও তিনি পেছন ফিরে দেখলেন না। পরিণত বয়সেও তিনি পূর্বের অভ্যাস ত্যাগ করতে পারলেন না।– অবশ্য ঐ অবস্তায় সবাই দৌড়াবে- কিন্তু তিনি সবার আগে দৌড়ালেন। এক মুহূর্তের জন্য থেমে তিনি দেখার চেষ্টা করলেন না, সেখানে কি ঘটছে।
যাদুকরদের ওপর বিজয়ী হলেন, বনী ইসরাঈলকে ফিরাউনের নির্যাতনের কবল থেকে উদ্ধার করলেন। তাদেরকে সমুদ্র পার করে দিলেন, তারপর নির্দিষ্ট সময়ে তুর পাহাড়ে পৌঁছলেননবুওয়াতের কল্যাণ লাভের জন্য। কিন্তু তবু তিনিতুর পাহাড়ে গিয়ে আল্লাহর নিকট এক আযব বায়না ধরলেন:
(আরবী**********)
মূসা বললো: প্রভু আমার!আমাকে দেখা দাও। আমি তোমাকে দেখবো। আল্লাহ বললেন:তুমি আমাকে কখনো দেখতে পাবে না। তুমি পাহাড়ের দিকে চেয়ে থাক, যতি তা স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে তবে তুমিও আমাকে দেখতে পাবে। (সূরা আল-আরাফ: ১৪৩)
তারপর যা ঘটলো তা শুধু মূসা (আ) কেন, পৃথিবীর কোন মানুষই হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম নয়।
(আরবী**********)
অতপর যখন তার রব্ব পাহাড়ের ওপর আপন জ্যোতির বিকিরণ ঘটালেন সাতে সাথে বিধ্বস্ত হ য়ে গেল এবং মূসা অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল। যখন জ্ঞান ফিরে পেল তখন বললো: হে পরোয়ারদিগার! তোমার সত্তা পবিত্র, আমি তোমার কাছে তওবা করছি এবং আমিই সবার আগে বিশ্বাস করলাম। (সূরা আল-আ’রাফ: ১৪৩)
মূসা (আ) তাই করলেন, যা একজনচঞ্চল প্রকৃতির লোক করে থাকে।
এখানেই শেষ নয়। যখন তিনি সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করে দেখলেন, তাঁর কওম একটি বাছুর পূজা করছে, হাতে তওরাতের তখতী ছিল, যা প্রভু তাঁকে দিয়েছিলেন, তিনি কোন চিন্তা-ভাবনা না করেই তা সজোরেমাটিতে নিক্ষেপ করে ভাইয়ের দাড়ি ধরে তাকে টানা-হেঁচড়াকরতে লাগলেন। তাঁর কথা পর্যন্ত শুনতে রাজী হলেন না। তাই বলতে লাগলেন:
(আরবী**********)
হে আমর জননী তনয়! আমার দাড়ি ও মাথার চুল ধরে টানাটানি করো না, আমি ভয় করেছিলম, তুমি বলবে: তুমি বনী ইসরাঈলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছো এবং আমার কথা স্মরণ রাখনি। (সূরা ত্ব-হা: ৯৪)
যখন তিনিজানতে পারণে, বাছুর পূজার ব্যবস্থা করেছে সামেরী নামক এক ব্যক্তি, তখন তাঁর সমস্ত আক্রোশ তার দিকে পতিত হলো। তিনি সামেরীকে লক্ষ্য করে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন:
(আরবী**********)
মূসা বললো: দূর হ, তোর জন্য সারা জীবন এ শাস্তি রইলো, তুই বলবি আমাকে স্পর্শ করো না। তোরজন্য একটি নির্দিষ্ট ওয়াদা আছে, যার ব্যতিক্রম হবে না। তুই তোর সেই ইলাহ্র প্রতি লক্ষ্য কর যাকে তুই আগলে থাকতি। আমরা তাকে জ্বালিয়ে দেবো এবং বিক্ষিপ্ত করে সাগরে ছুড়িয়ে দেবো। (সূরা ত্ব-হা: ৯৭)
হযরত মূসা (আ) এসব কিছুই করেছিলেন রাগের বশবর্তী হয়ে। আসুন আমরা তাঁকে আরও ক’বছরের অবকাশ দেই।
মূসা (আ)-এর জাতি তীহ প্রান্তরে অবস্থান করছে। আমাদের ধারণা যখন তিনি তাঁর জাতি থেকে পৃথক হন তখন তিনি পৌঢ়ত্বে পা দিয়েছিলেন। এক সৎব্যক্তির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। তিনি তাঁর সাহচর্যে থেকে উপকৃত হবার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। আমরা জানি সেখানেও তিনি ধৈর্যধারণ করে থাকতে পারেননি। যা হোক অবশেষে সৎব্যক্তি কর্তৃক সংঘটিত আচরণের ব্যাখ্যা প্রদান করতঃ তাঁকে পৃথক করে দেন।
এ ছিল হযরত মূসা (আ)-এর ব্যক্তিত্ব। যা কাহিনীর পরতে পরতে উপমার মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
২. কোমল হৃদয়- সহনশীল ব্যক্তিত্ব
হযরতমূসা (আ)-এর চরিত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র হযরত ইবরাহীম (আ)-এর। হযরত ইবরাহীম (আ) ছিলেন কোমল হৃদয় ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********) নিঃসন্দেহে ইবরাহীম ছিলেন বড় কোমল হৃদয় সহনশীল ব্যক্তি। (সূরা তওবা: ১১৪)
তিনি শৈশবেই আল্লাহর সন্ধান লাভের প্রচেষ্টা করতে গিয়ে গভীরভাবেচিন্তা-ভাবনা করেছিলেন এভাবে। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)
যখন রাতের আঁধার তাকে আচ্ছন্ন করে নিল, তখন সে একটি তারকা দেখতে পেল। বললো: এ আমার প্রতিপালক। অতপর যখন তা অস্তমিত হলো, তখন বললো: আমি অস্তগামীদেরকে ভালবাসি না। তারপর যখন ঝলমলে চাঁদ দেখল, তখন বললো: এটিই আমার প্রতিপালক। অনন্তর যখন তা অদৃশ্য হয়ে গেল, তখন বললো: যদি আমার প্রতিপালক আমাকে পথপ্রদর্শন না করেন তবে আমি অবশ্যই বিভ্রান্ত সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। তারপর যখন আরও উজ্জ্বল সূর্যকে দেখল, বললো: এ-ই আমার প্রতিপালক, এ সবচেয়ে বড়। যখন তা-ও অস্তমিত হয়ে গেল, তখন বললো: হে আমার জাতি, তোমরা যেসব বিষয়কে শরীক করো আমি সেসব থেকে মুক্ত। আমি একমুখী হয়ে স্বীয় আনন ঐ সত্ত্বারদিকে ফিরলাম যিনি নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিক নই। তাঁর সাথে তাঁর জাতির লোকেরা বিতর্কে লিপ্ত হলো। সে বললো: তোমরা আমার সাথে আল্লাহরএকত্ববাদ নিয়ে বিতর্ক করছো? অথচ তিনি আমাকে পথ প্রদর্শন করেছেন। তোমরা যাদেরকে শরীক করো আমি তাদেরকে ভয় করি না তবে যদি আমার পালনকর্তা কোনকষ্ট দিতে চান তা ভিন্ন কথা। আমার পালনকর্তা প্রত্যেক বস্তুকেই স্বীয় জ্ঞান দ্বারা বেষ্টন করে আছেন। তোমরা কি চিন্তা-ভাবনা করো না? (সূরা আল-আনআম: ৭৬-৮১)
যখন হযরত ইবরাহীম (আ) আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলেন, তখন অত্যন্ত নরম সুরে ও মহব্বতের সাথে তিনি সর্বপ্রথম পিতাকে তওহীদের দিকে আহ্বান জানালন:
(আরবী**********)
যখন সে তাঁর পিতাকে বললো: হে আমার পিতা! যে শুনে না, দেখে না এবং তোমার কোন উপকারে আসে না তার ইবাদত করো কেন? হে আমার পিতা! আমার কাছে এমনজ্ঞান এসেছে, যা তোমার কাছে আসেনি। সুতরাং আমার অনুসরণ করো, আমি তোমাকে সরল পথ দেখাব। পিতা! শয়তানের অনুসরণ করো না, শয়তান তো দয়াময়ের অবাধ্য। হে আমার পিতা! দয়াময়ের একটি আযাব তোমাকে স্পর্শ করবে, অতপর তুমি শয়তানের সঙ্গী হয়ে যাবে। (সূরা মারইয়াম: ৪২-৩৫)
কিন্তু ইবরাহীম (আ)-এর পিতা তাঁর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করলো এবং ধমকের সুরে বললো:
(আরবী**********)
বললো: হে ইবরাহীম! তুমি আমার ইলাহদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যতি তুমি বিরত না হও, আমি অবশ্যই প্রস্তরাঘাতে তোমাকে হত্যা করবো। তুমি চিরতরে আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও।
কিন্তু পিতার এ শক্ত আচরণেও তাঁকে ধৈর্য ও সহনশীলতারসীমা পরিহার করতে দেখা যায়নি এবং তাঁকে উদ্ধ্যত প্রকাশ করতেও দেখা যায়নি। বরং ভদ্র ও নম্রভাবে উত্তর দিলেন:
(আরবী**********)
ইবরাহীম বললো: তোমার ওপর শান্তিবর্ষিত হোক। আমি আমার রব্বের কাছে তোকারজন্য ক্ষমা প্রার্থন করবো। নিশ্চয়ই তিনি আমার প্রতি মেহেরবান। আমি পরিত্যাগ করছি তোমাদেরকে এবং তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত করো তাদেরকে, আমি আমার পালনকর্তার ইবাদত করবো। আশা করি আমি আমার পালনকর্তার ইবাদত করে বঞ্চিতহবো না। (সূরা মারইয়াম: ৪৭-৪৮)
তারপর হযরত ইবরাহীম (আ) মূর্তিগুলো ধ্বংস করে দিলেন। সম্ভবত এটিই একমাত্রকাজ যা তিনি কঠোর মনোভাব নিয়ে সম্পাদন করেছিলেন। আল্লাহর অপার মহিমার বদৌলতেই তিনি মূর্তিগুলোকে ধ্বংস করতে পেরেছিলেন। আর এ ধারণা করেছিলেন, যখন তাঁর জাতি মূর্তিগুলো বিধ্বস্ত-বিক্ষিপ্ত দেখবে তখন তারা একথা মনে করতে বাধ্যহবে, মূর্তি তো কখনো নিজেদের দুঃখ-কষ্টের কারণে নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারে না। অতএব অবশ্যই কেউ তাদেরকে ধ্বংসকরেছে। তিনি মনে করেছিলেন এভাবে তাঁরজাতি ঈমান আনবে। অবশ্যই তারা মনে মনে বললো:
(আরবী**********) অতপর তারা মনে চিন্তা করলো এবং বললো: লোক সকল! তোমরাই জালিম। (সূরা আল-আম্বিয়া: ৬৪)
যখন তাঁর জাতিতাঁকে আগুনে পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নিলতখন আল্লাহ বললেন:
(আরবী**********)আমি বললাম: হে আগুন! তুমি ইবরাহীমের ওপর ঠাণ্ডা নিরাপদহয়ে যাও। (সূরা আল-আম্বিয়া: ৬৯)
অতপর হযরত ইবরাহীম (আ) ঈমানদারদেরকে নিয়ে হিজরত করলেন। ঈমানদারদের মধ্যে তাঁর ভাতিজা হযরত লূত (আ)-ও চিলেন।তারপর বার্ধক্যেআল্লাহ হযরত ইসমাঈল নামক এক পুত্র সন্তান দান করেন। কিন্তু ঘটনা অন্যদকে মোড় নেয়, তিনি স্ত্রী ও ছেলেকে অন্যত্ররেখে আসতে বাধ্য হন। আল-কুরআন তার কারণ সম্পর্কে নিরব। শুধুমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করে তাদেরকে একনির্জন ভূমিতে রেখে আসেন। তখন অত্যন্ত অনুনয়-বিনয় ও কাতরকণ্ঠে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করেন।
(আরবী**********)
হে আমার প্রতিপালক! আমি নিজের এক সন্তানকে তোমার পবিত্র ঘরের কাছে চাষাবাদহীন উপত্যকায় আবাদ করেছি। হে আমার পালনকর্তা! যাতে তারা নামায কায়েম রাখে। আপনি কিছু লেকের অন্তরকে তাদের প্রতি আকৃষ্ট করে দিন এবং তাদেরকে ফলমূল রিযিক প্রদান করুন। সম্ভবত তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। (সূরা ইবরাহীম: ৩৭)
হযরত ইসমাঈল (আ) তখনও যৌবনে পদার্পণ করেননি, সবেমাত্র কিশোর। এমতাবস্থায় হযরত ইবরাহীম (আ) স্বপ্নে দেখেন, তিনি ইসমাঈল (আ)-কে যবেহকরচেন। স্বপ্ন ভঙ্গের পর তিনি ঈমানের পরীক্ষা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন। তখন আল্লাহ তাঁর ওপর দয়াপরবশ ইসমাঈল (আ)-এর পরিবর্তে ‘যবহে আযীম’ বাবড়কুরবানী প্রদান করেন।
বস্তুতহযঙরত ইবরাহীম (আ) সম্পর্কে যতো ঘটনাবা উপাখ্যান পাওয়া যায়, তা থেকে একটি কথাই প্রতীয়মান হয়, তিনি অত্যন্ত কোমল স্বভাবের এবং সহনশীল প্রকৃতির লোক ছিলেন। এসম্পর্কে স্বয়ং কুরআন সার্টিফিকেট দিচ্ছে:
(আরবী**********) নিঃসন্দেহে ইবরাহীম ছিল- বড়ই ধৈর্যশলী, কোমল হৃদয় ও আল্লাহপন্থী (সূরা হূদ : ৭৫)
৩. হযরত ইউসুফ (আ)]
হযরত ইউসুফ (আ) একজন জ্ঞানী ও বিজ্ঞ ব্যক্তিত্বের প্রতিভূত ছিলেন।
দেখুন আজীজের স্ত্রী তাকেকুকর্ম করার জন্য ফুসলাচ্ছিল এবং তার কথা না শোনারজন্য তাকে ভয়ও দেখাচ্ছিল। কিন্তু তিনি দৃঢ়তার সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি আজীজের বাড়ীতে থাকতেন তাই তিনি সবাইকে সম্মান ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেন। তাই এমন কোন কথা যেন না হয় যাতে তার মান-সম্মান ভূলুণ্ঠিত হতে পারে সর্বদা তিনি সেই প্রচেষ্টা করতেন।
ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)
নিশ্চয় মহিলা তার বিষয়ে চিন্তা করেছিল এবং সে-ও মহিলার বিষয়ে চিন্তা করতা, যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার নিদর্শন দেখত এভঅবে, আমি তার থেকেমন্দ নির্লজ্জ বিষয়সমূহ সরিয়ে দেই। নিশ্চয়ই সে আমার মনোনীত বান্দাদের একজন। (সূরা ইউসুফ: ২৪)
একটু আগে বেড়ে দেখুন মহিলার আসল চেহারা:
(আরবী**********)
তারা উভয়ে ছুটে দরজার দিকে গেল এবং মহিলা ইউসুফের জামা পেছন থেকে ছিঁড়ে ফেললো। (সূরা ই্উসুফ: ২৫)
হঠাৎ ঐ আওয়াজ পেল, যে আওয়াজে স্ত্রী ভয় পেত।
(আরবী**********) এবং তারা উভয়ে মহিলার স্বামীকে দরজার কাছে পেল।
একানে মহিলা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। তিনি ইউসুফ (আ)-এর ওপর অপবাদ দিলেন:
(আরবী**********) মহিলা বললো: যে তোমার পরিজনের সাথে কুকর্ম করার ইচ্ছে পোষণ করে।
যেহেতু মহিলা হযরত ইউসুফ (আ)-এর জন্য প্রেম উন্মাদিনী ছিলেন তাই তিনি চাইতেন না, এজন্য ইউসুফ (আ)-এর কঠিন কোন শাস্তি হয়ে যাক। এজন্য নিজেই একটু হাল্কা শাস্তির আভাস দিয়ে বললেন:
(আরবী**********) তাকে কারাগারে পাঠান কিংবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি চাড়া (আর কি শাস্তি দেয়া যায়)। (সূরা ইউসুফ: ২৫)
ভদ্রভাবে সত্য কথাটি বলে দিলেন।
(আরবী**********) সে বললো: সে-ই আমাকে আত্মসংবরণ না করতে ফুসলিয়েছে। (সূরা ইউসুফ: ২৬)
প্রমাণ করলেন। মজার ব্যাপার হলো স্বয়ং ঐ মহিলার নিকটতম এক লোক সাক্ষী হয়েদাঁড়ালেন।
(আরবী**********)
মহিলা পরবারের জনৈক ব্যক্তি সাক্ষ্য দিলো: যদি তার জামা সামনের দিকে ছেঁড়া হয় তবে মহিলা সত্যবাদী এবং সে মিথ্যাবাদী। আর যদি জামা পেছন দিকেছেঁড়া হয় তবে মহিলা মিথ্যেবাদী এবং সে সত্যবাদী। (সূরা ইউসুফ: ২৬-২৭)
এতে হযরত ইউসুফ (আ)-এর সত্যবাদিতা প্রমাণিত হলো।
গোটা শহরের সমস্ত মহিলার মধ্যে এ ঘটনা ছ ড়িযে গেল। আজীজের স্ত্রীর লজ্জায় মাথা কেটে যেতে লাগলো। তিনি একদিন শহরের সমস্ত মহিলাকে দাওয়াতহ দিলেন। মহিলাগণ যকন খানা খাওয়ার জন্য ছুরি হাতে নিলেন। (উল্লেখ্য যে, তখন মিসরে ছুরি দিয়ে কেটে কেটে মেহমান খাবে, এ রেওয়াজ ছিল) তখন ইউসুফ (আ)-কে তাদের সামনেহাজির করা হলো। মহিলাগণ তন্ময় হয়ে তাকে দেখতে লাগলেন। এমনকি তার দিকে ছুরি দিয়ে খাবার কাটতে গিয়ে প্রত্যেকে নিজের হাত জখম করে ফেললো।
(আরবী**********)
যখন তারা তাঁকে দেখর, হতভম্ব হয়ে গেল এবং আপন হাত কেটে ফেললো। তারা বললো: কখনও এ মানুষ হতে পারে না! এতো মহান কোন ফেরেশতা। (সূরা ইউসুফ: ৩১)
তারা সবাই ছিলেন মহিলা। তার মধ্যে আজজের স্ত্রীও একজন। তিনি ভালই জানতেন, মহিলাগণ কেমন জব্দ হয়েছে।
(আরবী**********) অতপর এসব নিদর্শন দেখার পর তারা তাঁকে কিছুদিন কারাগারে রাকা সমীচীন মনে করলো। (সূরা ইউসুফ: ৩৫)
এরপর আমরা দেখি, হযরত ই্উসুফ (আ) জেলখানায় বাদশাহর দু’জন অনুচরের স্বপ্নের বৃত্তান্ত বলে দেয়,তাদের মধ্যে একজন যার ব্যাপারে তিনি মনে করলেন সে মুক্তি পেয়ে পুনরায় বাদশাহর সাথী হিসেবে নিয়োজিত হবে, তখন তিনি তাকে বললেন: বাদশাহর কাছে গিয়ে আমার কথা বলবে। কিন্তু সে বাইরে বেরিয়ে ভুলে গেল।ফলে হযরত ইউসুফ (আ) আরও ক’বছর জেলের কষ্ট ভোগ করলেন। যখন বাদশাহ এক স্বপ্ন দেখে তার ব্যাখ্যা জানতে পেরেশান হয়ে গেলেন। কেউ তার সঠিক তা’বীর (তাৎপর্য) বলতে পারলেন না। তখন সেই লোকটিরহযরত ইউসুফ (আ) এর কথা মনে পড়ে গেল। সে বাদশাহর কাছে সব ঘটনা খুলে বললো। পরে বাদশাহ তাঁকে স্বপ্নেরব্যাখ্যা বলে দেয়ার জন্য জেল থেকে ডেকে পাঠালেন।
এখানে হযরত ইউসুফ (আ)-এর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় প্রকাশ হচ্ছে। তাঁকে বিনা দোষে জেলের নির্যাতনভোদ করতে হয়েছে। আজ মুক্তির আহ্বান শোনেও তাঁর ভয় হচ্ছে যদি পুনরায় সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তাঁকে জেলে পাঠান হয়। এজন্য তিনি সুযোগের সন্ধান করছিলেন, কথাটি বলিয়ে নেবার জন্য।তাই দূতকে তিনি বলে পাঠালেন।
(আরবী**********)
সে বললৈা: ফিরে যাও তোমার প্রভুর কাছে এবং জিজ্ঞেস করো: ঐ মহিলাদের অবস্থা কি যারা হাত কেটে ফেলেছিল? আমার পালনকর্তা তো তাদের ছলনা সবই জানেন। (সূরা ইউসুফ: ৫০)
বাদশাহ ঐ সমস্ত মহিলার কাছে সমস্ত ঘটনা জিজ্ঞেস করেন। তারা সব বলেন। স্বয়ং আজীজ পত্নীই তাঁর সচ্চরিত্রার কথা স্বীকার করলেন। স্বভাবতই বুঝা যায়, তখন ঐ মহিলা বৃদ্দা হয়ে গিয়েছিলেন। আমাদের দারণা এ ঘটনা যখন সংঘটিত হয়েছিল তখন ঐ মহিলার বয়স ৪০ কিংবা তার চেয়ে কিছু বেশি ছিল। তিনি তখন পৌঢ়ত্বে পা দিয়েছিলেন, কাজেই তখনতার দ্বারা আর কোন অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার সম্ভব ছিল না। তাই সে অকপটে স্বীকা করলো:
(আরবী**********)
আজীজ পত্নী বললো: এখন সত্য প্রকাশ হয়ে গেছে। আমিই তাঁকে ফুসলিয়েছিলাম। সে সত্যবাদী। (সূরা ইউসুফ: ৫১)
ওপরের আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, হযরত ইউসুফ (আ) অত্যন্ত বিজ্ঞ ও যুক্তিবান ছিলেন। প্রতিটি পদক্ষেপ সতর্কতার সাথে ফেলাই ছিল তার অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এজন্য বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
এটি এজন্য যে, আজীজ যেন জানতে পারেন, গোপনে আমি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকাত করিনি। তাছাড়া আল্লাহ বিশ্বাসঘাতকদের প্রতারণাকে এগুতে দেন না। আমি নিজেকে নির্দোষ বলি না। নিশ্চয়ই মানুষের মন খারাপ কাজের দিকে প্রবল। (সূরা ইউসুফ: ৫২-৫৩)
হযরত ইউসুফ (আ) যখন দেখলেন, বাদশাহ তার কথায় প্রভাবিত হয়েছেন এবং স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে পেরে খুশী হয়েছেন। এমনকি তিনি বলেই ফেললেন।
(আরবী**********) নিশ্চয়ই তুমি আজ থেকে আমার কাছে বিশ্বস্ত হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছো। (সূরা ইউসুফ: ৫৪)
এ সুযোগে তিনি হাতচাড়া না করে বাদশাহকে বললেন:
(আরবী**********)
আমাকে দেশের ধন-ভাণ্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত করুন। আমি বিশ্বস্ত রক্ষক ও অভিজ্ঞ। (সূরা ইউসুফ: ৫৫)
এভাবে তিনি সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন। সচ্ছল ও দুর্ভিক্ষ উভয় অবস্থায় তিনি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে তার যোগ্যতার পরিচয় দিলেন। চৌদ্দ বছর তিনি দায়িত্ব পালন করলেন। এ সময় তিনি শুধু মিসরের খাদ্য মন্ত্রীই নন বরং নিজেকে আশেপাশের রাষ্ট্র ও এলাকার জিম্মাদারও মনে করতেন। কেননা সেগুলোও দুর্ভিক্ষের করার গ্রাস পতিত হয়েছিল। তাই তারা সাত বছর পর্যন্ত মিসর থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে বাধ্য হয়েছিল।
তাঁর ভাইয়েরা যখন রেশন নেয়ার জন্য মিসর এলেন তখন তিনি তাদেরকে চিনে ফেললেন কিন্তু তাঁরা তাঁকে চিনতে পারেননি। তিনি তাদেরকে শর্তারোপ করেন, পরের বার যদি তাদের ভাইকে না নিয়ে আসেতাহলে রেশন দেয়া হবে না। পরের কিস্তিতে যখন ভাই বিন ইয়ামিনকে নিয়ে এলেন কথন তাকে পৃথক করার জন্য তার মালামালের মধ্যে একটি রাজকীয় পেয়ালা ঢুকিয়ে দিলেন এবং ঘোষণা দিলেন, রাজ প্রাসাদ থেকে একটি পেয়ালা চুরি হয়ে গেছে। হে কাফেলার লোকজন! তোমরা চুরি করেছ। তারা চুরির কথাঅস্বীকার করলেন এবং মাল-সামানা তল্লাশী করার জন্য চ্যালেঞ্জ করলেন। তারা একথাওবললেন, যার কাছে হারান পেয়ালা পাওয়া যাবে তাকে আপনার গ্রেফতার করে রাখুন। এখানে হযরত ইউসুফ (আ) এর-এর বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়।
(আরবী**********)
অতপর ইউসুফ আপন ভাইয়ের থলের পরিবর্তে তাদের থলে তল্লাশী শুরু করলেন। অবশেষে সেই পাত্র আপন ভাইয়ে থলে থেকে বের করলেন। (সূরা ইউসুফ: ৭৬)
ইউসুফ (আ)-এর ভাইয়েরা বিন ইয়ামিনকে রেখেই দেশে চলে গেলেন এবং পুনরায় ফিরে এলেন,তখন হযরত ইউসুফ (আ)নিজের পরিচয় দিলেন। তার আগে তাদেরকে বিভ্রান্তিতে ফেলে একটু শিক্ষা দিলেন।
এখানে হযরত ইউসুফ (আ)-এর ব্যক্তিত্বকে অত্যন্ত উজ্জ্বলভাব উপস্থাপন করা হয়েছে। জ্ঞা ও প্রজ্ঞা, ঠাণ্ডা মেজাজে চিন্তা-ভাবনা, যুক্তিবাদিতা ইত্যাদি ছিল তার ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য।
৪. হযরত আদম (আ)
আমরা হযরত আদম ও ইবলিসের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা না করে সংক্ষিপ্তাকারে একত্রে বর্ণনা করছি।কারণ আমি অন্যত্র এ ঘটনা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার আশা রাখি।
সত্যি কথা বলতে কি, হযরত আদম (আ)-কে কুরআনে এমন একজন মানুষের নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যার মধ্যে মানবিক সমস্ত গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান। মানবিক বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে এমন একটি বৈশিষ্ট্য হযরত আদম (আ)-এর জীবনের প্রথম দিকে পাওয়া যায়, যা আজও মানুষের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। তা হচ্ছে মানবিক দুর্বলতার সুযোগই ইবলিস গ্রহণ করেছিল। এজন্য আদম এবং হাওয়া উভয়েই ইবলিসের কথায় বিশ্বাসস্থাপন করেছিলেন।
(আরবী**********)
ইবলিস বললো: হে আদম! আমিতোমাকে বলে দেব না অনন্তকাল জীবিত থাকার বৃক্ষ ও অনিশ্বর রাজত্বের কথা? (সূরা ত্ব-হা: ১২০)
এজন্য মানুষ চিরদিনই এমন একটি জীবনের প্রত্যাশী যে জীবনের শেষ নেই। যখন শয়তানের পরামর্শ মুতাবেক তা অর্জনের চেষ্টা করা হয় তখন বৈধ-অবৈধ কথাটি তার কাছে গৌণ হয়ে যায়। মানুষ কখনো নিজের উত্তরসূরীর মাধ্যমে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে চায়, আবার ককনো নিজের আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার মানসপুত্র সৃষ্টি করে তাদর মাঝে বেঁচে থাকতে চায়। কিন্তু বেঁচে থাকার সত্যিকার পথটি দেখিয়েছে ইসলাম। এজন্য মানুষকে মৃত্যুর পর আরেকটি জীবনের কথা বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম একটি অনন্ত জীবনের জিম্মাদার। রইলো ইবলিসের ব্যক্তিত্ব। তার ব্যক্তিত্ব হচ্ছে শয়তানের ব্যক্তিত্ব। ব্যস! ইবলিসের জন্য একথাই যথেষ্ট।
৫. হযরত সুলাইমান (আ)
এখন আমি এমন একটি ঘটনার কথা বলবো, যে ঘটনায় পুরো মাত্রায় ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটেছে। সেই বিকাশ আমাদের ধারণারও অতীত। সেই সাথে শৈল্পিক সৌন্দর্য এবং দ্বীনি উদ্দেশ্যও পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। তা হচ্ছে হযরত সুলাইমান (আ) ও বিলকিসের ঘটনা।
এ ঘটনায় উভয়ের ব্যক্তিত্ব-ই উজ্জ্বল। একজন পুরুষের ব্যক্তিত্ব এবং পাশাপাশি একজন স্ত্রীলোকের ব্যক্তিত্ব সেই সাথে একজন বাদশাহর এবং একজন সম্রাজ্ঞীর ব্যক্তিত্বও আমরা দেখতে পাই। আসুন এবার দেখা যাক তাদরে কারব্যক্তিত্ব কিভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
(আরবী***********)
সুলা্মান পাখীদের খোঁজ-খবর নিল, অতপর বললো: কি ব্যাপার হুদহুদকে তো দেখছি না? নাকি সে অনুপস্থিত? আমি অবশ্যই তাকে কঠিন শাস্তি দেবো কিংবা মৃত্যুদণ্ড, না হয় সে উপযুক্ত কারণ দর্শাবে। (সূরা আন-নামল: ২০-২১)
এটি প্রথম দৃশ্য। এখানে একজন বিজ্ঞ শাসক, তদুপরি নবী সেই সাথে একজন বিচক্ষণ ব্যক্তিত্বও প্রকাশ পাচ্ছে। বাদশাহ তাঁর প্রজাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, একজন প্রজাকে বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত দেখতে পেয়ে রেগে যাচ্ছেন। কিন্তু তবু তিনি অত্যাচারী বাদশাহ নন। অনেক সময় অনুপস্থিতির যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে কোন সঙ্গত কারণ যদি এরূপ হয়ে থাকে তাহলে কথা নেই। অন্যথায় এটি অপরাধ। এজন্য তাকে আমি শাস্তি দেবো বা মৃত্যুদণ্ড।
(আরবী***********)
কিছুক্ষণ পর হুদহুদ এসে বললো: আপনি যা অবগত নন এমনএকটি বিষয় আমি অবগত হয়েছি। আমি আপনার কাছে সাবা থেকে নিশ্চিত সংবাদ নিয়ে এসেছি। আমি এক নারীকে সাবা জাতির ওপর রাজত্ব করতে দেখেছি। তাকে সবকিছুই দেয়া হয়েছে এবংয় তার একটি বিরাট সিংহাসন আছে। আমি তাকে এবং তার জাতিকে দেখলাম আল্লাহর পরিবর্তে সুর্যকে সিজদা করছে। শয়তান তাদের নিকট এ কাজকে আকর্ষণীয় করে দিয়েছে এবং তাদরকে সৎপথ থেকে বিরত রেখেছে, তাই তারা সৎপথ পাচ্ছে না। তারা আল্লাহকে সিজদা করে না কেন, যিনি মভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলে গোপন বস্তু প্রকাশ করেন এবঙ তিনি জানেন যা তোমরা গোপন করো ও যা প্রকাশ করো। আল্লাহ ব্যতী আর কোন ইলাহ নেই, তিনি বিশাল আরশের মালিক। (আন-নামল: ২২-২৬)
হুদহুদ অনুপস্থিত ছিল এখন তার আগমনে দ্বিতীয় দৃশ্যের অবতারণা হলো। সে জানত বাদশাহ অত্যন্ত ক্ষমতাবান এবং তাঁর শাস্তিও অত্যন্ত কঠোর। তাই সে বক্তব্র এমন ভাষায় শুরু করেছে যে, তাঁর বিশ্বাস এভাবে বক্তব্য শুরু করলে বাদশাহর দৃষ্টি আকৃষ্ট হবে এবং তাকে অনুপস্থিতির দণ্ড গ্রহণ করতে হবে না। বক্তব্র শুরু করা হয়েছে এই বলে:
(আরবী************)
আমি এমন একটি খবরনিয়ে এসেছি যে সম্পর্কে আপনি অবহিত নন। সে খবরটি হচ্ছে ‘সাবা’র সম্পর্কে নিশ্চিত খবর।
যদি কোন এক সাধারণ প্রজা বাদশাহর কাছে বলে, ‘আমি এমন একটি খবর জানি যা আপনি অবগত নন।’ তাহলে এমন কোন বাদশাহ আছে, যে তহার কথা না শুনে পারে? হুদহুদ দেখল, বাদশাহ তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে তখন সে ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করছে। তারপর সে বিলকিসের জাতির আচরণে আশ্চর্য হয়ে বলছে:
(আরবী***********)
(আমি বুঝতে পারি না) যে আল্লাহ আসমান এবং জমিনের সমস্ত গোপনীয় জিনিসের খবর রাখেন তাঁকে কেন তারা সিজদা করছে না? (সূরা নামল: ২৫)
এখানে হুদহুদ অপরাধী। বাদশাহ তার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দেননি। তাই হুদহুদ সুকৌশলে বাদশাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করলো যে, আরশে আযীমের মালিক একমাত্র আল্লাহ। সুলাইমান (আ) বললেন:
(আরবী************)
এখন আমি দেখবো তুমি সত্য বলছ না মিথ্যে। তুমি আমার এ প্রত্র নিয়ে যাও এবং এটি তাদের নিকট নিক্ষেপ করবে। তারপর তুমি দূরে সরে থাকবে এবং দেখতে তারা কি জবাব দেয়। (সূরা নামল: ২৭-২৮)
এ হচ্ছে দ্বিতীয় দৃশ্যের শেষ পর্ব। এ পর্বে বিজ্ঞ ও ন্যায়বিচারক একজন বাদশাহ উপস্থিত। যিনি এতো বড় সংবাদ প্রদানের পরেও সেনাবাহিনী থেকে অনুপস্থিত থাকার অপরাধ মার্জনা করেননি। তাই তিনি ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করেছেন। একজন পয়গাম্বর ও একজন ন্যায়বিচারক বাদশাহর উপযুক্ত সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছেন। আমরা এ দৃশ্যেরসাধারণদর্শক মাত্র। আমরা এখনো বুঝতে পারিনি তিনি চিঠির মধ্যে কি লিখেছেন। সম্রাজ্ঞীর হাতে চিঠি পৌঁছার পূর্ব পর্যন্তআমাদের জানার উপায় নেই। যখন সম্রাজ্ঞী চিটি পেলেন তখন তা প্রকাশ করছেন। এখান তেকে তৃতীয় দৃশ্যের অবতারণা।
(আরবী***********)
সম্রাজ্ঞী বললো: হে পরিষদবর্গ, আমাকে একটি সম্মানিত পত্র দেয়া হয়েছে। সে পত্র সুলাইমানের পক্ষ থেকে এবং তা এই : অসীম দাতা পরম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু। আমার মুকাবিলায় শক্তি প্রদর্শন করো না এবং বশ্যতা স্বীকার করে আমার কাছে উপস্থিত হও। (সূরা নমল: ২৯-৩১)
সম্রাজ্ঞী চিঠিটি নিয়ে পরামর্শ করার জন্য সভাষদবর্গের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন:
(আরবী************)
সম্রাজ্ঞী বললো: হে সভাষদবর্গ ! আমাকে আমার কাজে পরামর্শ দিন। আপনাদের উপস্থিতি ছাড়া আমি তো আর কোন কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না। (সূরা আন-নামল: ৩২)
সবসময় এবং সব জায়গায় সেনাবাহিনীর লোকদের একটি অভ্যাস হচ্ছে তারা সর্বদা নিজেদের শৌর্যবীর্য প্রদর্শন করে থাকে। কেননা তাদের শৌর্যবীর্য প্রদর্শন ছাড়া তাদের রুটি-রুজির কোন ব্যবস্থা নেই। সেই সাথে তারা এ কথাও বলে যে, সমস্ত ক্ষমতা-ইখতিয়ার বাদশাহর কাছে। যা আদেশহয় আমরা মানতে প্রস্তুত। তারা তাদের সেই চিরাচরিত অভ্যাস মতো বলে উঠলেন:
(আরবী***********)
তারা বললো: আমরা শক্তিশালী এবং বীর যোদ্ধা। এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আপনারই। ভেবে দেখুন, আমাদেরকে কি নির্দেশ দেবেন। (সূরা আন-নমল: ৩৩)
এখানে পৌঁছে বিলকিসের নারীত্বের প্রকাশ পেল। নারীরা সাদারণত হৈ-হাঙ্গামা ও দাঙ্গা-ফাসা এড়িযে চলতে চায়, পছন্দ করে না। মেয়েদের স্বভাব হচ্ছে, শক্তিপ্রয়োগ না করে কৌশলে কাজ আদায়ের চেষ্টা করা। আবার এটিও তাদের বৈশিষ্ট্য, বিনা ঝগড়া-বিবাদেও তারা পুরুষকে প্রতিপক্ষ ভেবে বসে থাকে।
(আরবী**********)
সে বললো: রাজা-বাদশাহগণ যে জনপদে প্রবেশ করে, তাকে তছনছ করে দেয় এবং সেখানকার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গকে অবদস্ত করে। তারা এরূপই করবে। আমি তার কাছে কিছু উপঢৌকন পাঠাচ্ছি। দেখি প্রেরিত লোকেরা কি জবাব আনে। (সূরা আন-নামল: ৩৪-৩৫)
এথানেদৃশ্যের যবনিকা। দূত সুলাইমান (আ)-এর কাছে প্রবেশের পর পুনরায় পর্দা উঠল।
(আরবী**********)
অতপর যখন সুলাইমানের কাছে আগমন করলো, তখন সুলাইমন বললো: তোমরা কি ধন-সম্পদ দিয়ে আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লহ আমাকে যা দিয়েছেন তা তোমাদের প্রদত্ত বস্তু থেকে উত্তম। বরং তোমরাই তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে সুখে থাক। ফিরে যাও তাদেরকাছে, আমি একনই তাদের বিরুদ্ধে এক সৈন্য বাহিনী নিয়ে আসবো, যার মুকাবিলা করার ক্ষমতা তাদর নেই। আমি অবশ্যই তাদেরকে অপদস্ত করে সেখান থেকে বের করে দেবো, তারা লাঞ্ছিতহবে। (সূরা নমল: ৩৬৫-৩৭)
যে উপহার উপঢৌকন নিয়ে তাঁর কাছে দূত এসেছিল সেগুলোসহ তিনি তাকে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। আসুন, আমরা তাকে ফেরত যেতে দেই।
সুলাইমান (আ) শুধু একজন নবী কিংবা বাদশাহই নন, একজন বীর পুরুষও বটে। বাদশাহী অভিজ্ঞতার দ্বরা তিনি বুঝতে পেরেচিলেন, যে দাপটের সাথে সম্রাজ্ঞীর উপহার ফেরত দেয়া হলো তাতে সম্রাজ্ঞীর সাথে চূড়ান্ত বুঝাপড়া হয়ে যাবে।
সম্রাজ্ঞীর উপহার পাঠানো থেকে বুঝা যায় তিনি শত্রুতাকে পরিহারকরে চলতে সচেষ্ট। এজন্য উপহার পাঠিয়েছিলেন যাতে সন্ধি হতে পারে। এদিকে বাদশাহর (সুলাইমানের) বিশ্বাস তিনি দাওয়াত কবুল করবেন। এখানে হযরত সুলাইমান (আ)-এর ভেতর সেই পৌরুষ জেগে উঠল, যা স্বীয় শক্তি ও কৌশলে নারীর ওপর প্রাধান্য বিস্তারকরতে চায়।
হযরত সুলাইমান (আ) চেয়েছিলেন সম্রাজ্ঞীর আগমনের পূর্বেই তার সিংহাসনটি নিয়ে আসবেন এবং তাঁর কাঁচের একটি প্রাসাদ বানাতে চাইলেন কিন্তু ঘটনায় তার সুস্পষ্ট বর্ণন আসেনি। আমাদেরমতো দর্শকদের জন্যতা রহস্য হয়ে রইলো। যখন সম্রাজ্ঞীহযরত সুলাইমান (আ)-এর কাছে পৌঁছলেন আমরা মহলের দ্বিতীয় দৃশ্য সম্পর্কে জানতে পারি:
(আরবী**********)
সুলাইমান বললো: হে পারিষদবর্গ! তারা আত্মসমর্পণ করে আমার কাছে পৌঁছার পূর্বে কেতার সিংহাসনটিকে আমার কাছে এনে দেবে? জণৈক দৈত্য জ্বিন বললো: আপনি আমার স্থান থেকে উঠার পূর্বেই আমি তা এনে দেব এবং আমি একাজে সামর্থ, বিশ্বস্ত। (সূরা নমল: ৩৮-৩৯)
কিন্তুদ্বীনি উদ্দেশ্য জ্বিনদেরক্ষমতার সামঞ্জস্যশীল নয়। সুলাইমান (আ)-কে চুপ করতে দেখে মুমিন ব্যক্তি, যিনি আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন। বললেন: আমি আপনার খেদমতে হাজির। অবশ্য তাঁর ক্ষমতা ঐ জ্বিনের চেয়ে বেশি ছিল।
(আরবী*********)
কিতাবের জ্ঞান যার ছিল, সে বললো: আপনার চোখের পলক পড়ার পূর্বেবই তা এনে আপনাকে দিচ্ছি। (সূরা আন-নমল: ৪০)
এখানে সামান্য বিরতি। শুধু একবার চোখ বন্ধ করে আবার খোলা যায় এতোটুকু পরিমাণ। তারপর আবার দৃশ্যের শুরু।
(আরবী*********)
অতপর সুলাইমান যখন তা সামনে রক্ষিত দেখলেন, তখন বললেন: এটি আমর পালনকর্তার অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করতে পারেন, আমিকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, না-অকৃতজ্ঞ হয়ে যাই। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সে নিজের উপকারের জন্যই তা করে আর যে অকৃতজ্ঞ হয় সে জেনে রাখুক, আমার রব্ব অভাবমুক্ত কৃপনানিধান। (আন-নামল: ৪০)
হযরত সুলাইমানের (আ) অভ্যন্তরে যে একজন নবী ছিল তা এবার আল্লাহর মেহেরবানীতে জেগে উঠলো। এ মেহেরবানীর বিচ্ছুরণ ঘটান হলো তারই একবান্দার মাধ্যমে মাত্র এক পলকে রাণীর সিংহাসন উপস্থিত করে। তাই হযরত সুলাইমানের (আ) প্রশান্ত চিত্তেবার বার আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করছেন। যাতে তাঁর দ্বীনি উদ্দেশ্য পুরা হয়ে যায়।
একটু পেই আবার সুলাইমান (আ)-এর পৌরুষ জেগে উঠলো।
(আরবী*********)
সে বললো: তার সিংহাসনের আকৃতির পরিবর্তন করে দাও। দেখি সে বুঝতে পারে কিনা, নাকি সে তাদের অনর্ভুক্ত, যাদের বুদ্ধিশুদ্ধি কিছুই নেই। (সূরা আন-নামল: ৪১)
এবার সম্রাজ্ঞীকে অভ্যর্থনা জানানোর দৃশ্য। দর্শকগণ রুদ্ধশ্বাসে সম্রাজ্ঞীর আগমনের প্রতীক্ষা করছেন।
(আরবী*********)
যখন সম্রাজ্ঞী এসে পৌছল, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো: আপনার সিংহাসন কি এরূপ? সে বললো : মনে হয় এটি সেইটিই।
এরপর কি হলো? মনে হয় এখনো সম্রাজ্ঞী ইসলাম গ্রহণ করেননি।
(আরবী*********)
আল্লাহর পরিবর্তে সে যার ইবাদত করতো, [সুলামিান (আ)] তাকে তা থেকে বিরত থাকতে বললো। (ইতোপূর্বে সে) নিশ্চয়ই সে কাফির সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। (সূরা আন-নামল: ৪৩)
এখানে এসে সম্রাজ্ঞী এবং দর্শকদের (যার মধ্যে আমিও একজন) দ্বিতীয দৃশ্য শেষ হলো।
(আরবী*********)
তাকে বলা হলো: এ প্রাসাদে প্রবেশ করুন। যখন সে সেদিকে দৃষ্টিপাত করলো, ধারণা করলো এটি স্বচ্ছ জলাশয়। সে তার পায়ের দিকের কাপড় উঁচু করে ধরলো। সুলাইমান বললো: এটিতো স্বচ্ছ স্ফটিত নির্মিত প্রাসাদ। বিলকিস বললো: হে আমার প্রতিপালক! আামিতো নিজের ওপর জুলুম করেছি। আমি সুলাইমানের সাথে বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। (সূরা নামল: ৪৪)
এ ঘটনার আলোকে প্রতীয়মান হয়, বিলকিস একজন পূর্ণ নারী সত্ত্বার নাম। যেহিতু তিনি একজন নারী তাই দাঙ্গা-ফাসাদ পরিহার করে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা করেছিলেন। একথাও ভেবে দেখার মতো যে, তিনি প্রথমেই আকৃষ্ট হননি, পর্যবেক্ষণ করেছেন। কিন্তু তিনি যা ছিলেনতাই রইলেন। দ্বিতীয় দৃশ্যে তিনি চিন্তা করলেন, যে অবস্থা তার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তার যে বিষয়টি ভেবে দেখা প্রয়োজন তা হচ্ছে তিনি [হযরত সুলাইমান (আ)] তাঁকে সম্মান দিচ্ছেন, তাঁর সম্মানে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা দিয়েছেন। কাজেই তিনি নিজেকে তাঁর কাছে সোপর্দ করে দিলেন। তাঁর শান-শওকত ও শৌর্যবীর্যের কাছে তিনি তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নিলেন। যদিও তিনি জেনেছিলেন, সমস্ত আয়োজন তাঁর জন্য করা হয়েছে, তবু তিনি নারীসুলভ সতর্কতা অবলম্বন করলেন, যে নারীসুলভ আচরণ হাওয়া (আ)-কে প্রদান করা হয়েছিল। পর্দা পড়ে যাচ্ছে।
এসব ঘটনার দ্বিীনি ও শৈল্পিক- কোন দিকেই ঘাটতি নেই। কোন একটি দিকও সংযোজন করার মতো নেই। নিরেট একটি গল্প কিংবা উপন্যাস, শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে কোন সম্পর্ক নেই, ব্যাপারটি এমনও নয়। এটি এমন এক কাহিনীর যাদ্বীনি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
এর মধ্যে (মানুষের) আবেগ-অনুভূতি ও প্রভাব সম্পর্কিত যেসব আলোচনা এসেছে ‘মানুষের স্বরূপ’ শিরোনামে তা সুন্দর এক স্টাইলে সাজান হয়েছে, যা নেহায়েত আনন্দদায়ক।
আমি কুরআনী কিস্সা-কাহিনীর ওপর যে আলোচনা করলাম তা এখানেই শেষ করছি। এরপর যদি কেউ আরও অগ্রসর হতেচান তবে এ আলোচনা তাকে পথপ্রদর্শন করবে।