নবম অধ্যায়
আল-কুরআনের ঘটনাবলী দ্বীনি উদ্দেশ্যের অনুগামী হওয়ার প্রমাণ
১. আমরা ইতোপূর্বে বলেছি, যে সমস্ত ঘটনাবলী আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে তা দ্বীনি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের পরিপূরক। ঘটনাগুলো যে দ্বীনের অনুগামী তার প্রমাণ কাহিনীগুলোতেও বিদ্যমান। আমি নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রমাণ সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই। সেসব ঘটনাবলী দ্বীনি উদ্দেশ্যের পরিপূরক হওয়ার প্রথম প্রমাণ হচ্ছে- একই ঘটনা বিস্তারিত কিংবা সংক্ষিপ্ত আকারে কয়েক জায়গায় তার পুনরাবৃত্তি।
কিন্তু ভাবনার বিষয় হচ্ছে, সেখানে পুরো ঘটনা বর্ণিত হয়নি, বর্ণিত হয়েছে ঘটনার বিশেষ বিশেষ অংশ।– খাস করে ঐ অংশগুলো বর্ণিত হয়েছে যেখানে উপদেশ ও শিক্ষা বর্তমান- সম্পূর্ণ ঘটনা একই সাথে বর্ণিত হয়েছে কদাচিত উপদেশ ও শিক্ষা বর্তমান- সম্পূর্ণ ঘটনা একই সাথে বর্ণিত হয়েছে কদাচিত এমন ঘটেছে। তা-ও করা হয়েছে বিশেষ কারণ, পরম্পরা ও উপযোগিতাকে সামনে রেখে। অবশ্যই ঘটনার বর্ণনার সময় আমি এ ব্যাপারে আভাস দিয়েছি।
যখন পাঠক ঘটনার পুনরাবৃত্তির অংশগুলো পাঠ করেন এবং তার পূর্বাপরের দিকে দৃষ্টি নিক্সেপ করেন তখন পুরো ঘটনাটিকেই সংগতিপূর্ণ বলে দখেতে পান। পাঠক মনে কনে যেখানে যে অংশ নেয়া হয়েছে এবং যে পদ্ধতিতে বর্ণনা করা হয়েছে তা যথার্থ। তিনি বিস্মৃতি হন না যে, আল-কুরআন মূলত একটি দাওয়াতী কিতাব। এজন্য ঘটনার যে অংশ যেখানে বর্ণিত হয়েছে তা দাওয়াতী বিষয়ের সাথে পুরোপুরি মিল রেখেই বর্ণিত হয়েছে। আর ঘটনার মিলটাও আল-কুরআনের অন্যতম লক্ষ্য। সবসময়ই এমন হয়। কিন্তু ঘটনার শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ তা থেকে প্রভাবিত হতে দেখেন না।
একই ঘটনার বিভিন্ন অংশ বার বার উপস্থাপনের জন্য গোছাপন একটি নীতিমালাও আছে। যে ক্রমানুসারেন আল-কুরআনের সূরা অবতীর্ণ হয়েছে সেই ক্রমানুসারে সূরাগুলো এবং ঘটনার অংশগুলো মিলিয়ে পড়লেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। অধিকাংশ সূত্রপাত হয়েছে সামান্য ইঙ্গিত দিয়ে। পরে পর্যাক্রমে তা পূর্ণত্বের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যেখানে বর্ণনা শেষ করা হয়েছে সেখানে পাঠক পৌঁছলেই পুরো চিত্রটি তার সামনে ভেসে উঠে।
উদাহরণ স্বরূপ আমরা হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনা বলতে পারি। কেননা আল-কুরআনে যে সমস্ত ঘটনা বার বার বলা হয়েছে তার মধ্যে এ ঘটনাটি অত্যাধিকবার বর্ণিত হয়েছে। তার সংখ্যা প্রায় ত্রিশের মতো হবে। আমরা তার মধ্যে উল্লেকযোগ্য কয়েকটি স্থান নিয়ে আলোচনা করবো এবং সে স্থানগুলোও চিহ্নিত করবো যেখানে শুধুমাত্র মূসা (আ)-এর ঘটনার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে কিন্তু বিস্তারিত কিছু বর্ণনা করা হয়নি। আমরা সূরাসমূহ অবতীর্ণের ক্রমানুসারে তার আলোচনা করবো।
[১.১] সূরা আল-আ’লা যার অবস্থান অবীর্ণের ক্রমানুসারে ৮ম। সেখানে মূসা (আ)-এর ঘটনার সামান্য ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে: (আরবী***********)]
এটি লিীখত আছে পূর্ববর্তী কিতাবসূহে, ইবরাহীম ও মূসার কিতাবে।
এরূপ সম্মিলিত ইঙ্গিত সূরা আন-নাজমেও দেয়া হয়েছে এবং তা অবতীর্ণর দিক দিয়ে ২৩তম সূরা।
[১.২] সূরা আল-ফজর, অবতীর্ণের ক্রমানুসারে ১০ম সূরা। এখানে ফিরাউনের কথা বর্ণিত হয়েছে কিন্তু মূসা (আ)-এর কথা নয়। অবশ্যই আ’দ ও সামুদ জাতির কথাও বলা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী***********)
এবং বহু কীলকের অধিপতি ফিরাউনের সাথে। যারা দেশে সীমালংঘন করেছিল, ফলে সেখানে সাংঘাতিক অশান্তি সৃষ্টি হয়েছিল্ অতপর তোমার রব্ব তাদেরকে শাস্তির কষাঘাত করলেন।
এ ধরনের ইঙ্গিতসূচক বর্ণনা সূরা আল-বুরুজেও করা হয়েছে। যার অবতীর্ণের ক্রমধারা সাতাইশ।
[১.৩] সূরা আল-আ’রাফ, অবতীর্ণের ক্রমধারা ঊনচল্লিশ। এ সূরায় বেশ কিছু নবী-রাসূলদের আলোচনা এসেছে, তার মধ্যে মূসা (আ)-এর ঘটনাটিও মোটামুটি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেসব নবীদের কথা বর্ণিত হয়েছে, যারা তাদের জাতির কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং সবাই নিজেদের নবীকে মিথ্যেবাদী বলেছে এবং পরিণতিতে তারা আল্লাহর আযাবে ধ্বংস হয়ে গেছে।
সূরা আল-আ’রাফে ঘটনার শুরু হয়েছে হযরত মূসা ও হারুন (আ)-কে নবী করে ফিরাউনের কাছে পাঠানোর প্রসঙ্গ নিয়ে। তারপর লাঠি ও হাত উজ্জ্বল হওয়ার মুজিযা সম্পর্কে বলা হয়েছে। তাপর যাদুকরদের জমায়েত ও মূসা (আ)-এর বিরুদ্ধে যাদু প্রদর্শন। মূসা (আ) তাদের মুকাবিলায় বিজয় লাভ করা, যাদুকরদের ঈমান গ্রহণ, তারপর ফিরাউন কর্তৃক বনী ইসরাঈলকে নির্যাতনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, ফিরাউন ও তার সম্প্রদায়কে কি কি মুসিবত দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে। তার মধ্যে টিড্ডি, উকুন, ব্যাঙ, রক্ত ইত্যাদি দিয়ে পরীক্ষা ছিল অন্যতম। প্রতিবারই হযরত মূসা (আ)-কে দিয়ে দো’আ করিয়ে পরিত্রাণ লাভ। পুনরায় আবার বনী ইসরাঈলের প্রতি নির্যাতন, তারপর মূসা (আ)- এর নেতৃত্বে বনী ইসরাঈলের মিসর ত্যাগ। তারপর তারা মূসা (আ)-কে বললো: মিসরীয়দের যেমন অনেক মাবুদ তদ্রূপ আমাদেরও থাকা উচিত। অতপর মূসা (আ)-এর তুর পাহাড়ে গমন ত্রিশরাত পর আল্লাহ তা’আলার সাক্ষাত লাভ এবং মেয়াদ বাড়িয়ে চল্লিশ রাত করা এবং চল্লিশ রাত অতিহাহিত হওয়া, আল্লাহর দর্শনের জন্য হযরত মূসা (আ)-এর আবেদন, পাহাড় খণ্ড-বিখণ্ড হওয়া, মূসা (আ)-এর বেহুশ হওয়া, তারপর জ্ঞান ফিরে পাওয়া। নিজের সম্প্রদায়ের কাছে এসে দেখেন তারা গো-শাবক বানিয়ে তার পূজা করছে, ভাইকে ভর্ৎসনা, পুনরায় আল্লাহর দর্শনের জন্য ৭০ জনের পরীক্ষা, যখন তারা তূর প্রান্তরে আল্লাহর দীদারের জন্য পীড়াপীড়ি করলো তখন তূর পাহাড়কে তাদের ওপর তুলে ধরা। তারপর তাদেরকে আল্লাহর রহমত দানে ধন্য করা হলো এবং বলে দেয়া হলো, আল্লাহর রহমত তারাই পাবে যারা নবীর আনুগত্য করে।
[১.৪] তারপর অবতীর্ণের ক্রমানুসারে ৪২তম সূরা, সূরা আল-ফুরকান ও ৪৪তম সূরা, সূরা মারইয়ামে সম্মিলিত কিছু ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। সে ঘটনাবলীতে নবীদের রিসালাত ও তাদেরকে যারা মিথ্যেবাদী বলেছৈ তাদের পরিণতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
[১.৫] অবতীর্ণের ক্রমধারায় ৪৫তম সূরা, সূরা ত্বা-হা’র মধ্যেও মোটামুটি বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে। সূরা আ’রাফে হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনা শুরু হয়েছিল নবুওয়াত ও রিসালাতের কথা বলে। অর্থাৎ সে ঘটনাটি ছিল নবুওয়াতের পরের আর সূরা ত্বা-হা’য় নবুওয়াতের পূর্বের ঘটনা দিয়ে শুরু করা হয়েছে। তূর পাহাড়ের প্রান্তহ থেকে আলো প্রদর্শনের কথা দিয়ে। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী***********)
তোমার কাছে মূসার বৃত্তান্ত পৌঁছে কি? সে যখন আগুন দেখলো, তখন পরিবারবর্গকে বললো: তোমরা এখানে অবস্থান করো, আমি আগুন দেখেছি, সম্ভবত আমি তা থেকে তোমাদের কাঝে কিছু আগুন জ্বালিয়ে আনতে পারবো অথবা আগুনে পৌঁছে পথের সন্ধান পাব। অতপর যখন সে আগুনের কাছে পৌঁছল তখন আওয়াজ এলো, হে মূসা! আমিই তোমার পালনকর্তা, অতএব তুমি জুতো খুলে ফেল, তুমি পবিত্র উপত্যকা তুয়ায় অবস্থাণ করছ। আমি তোমাকে মনোনীত করেছি, কাজেই যে প্রত্যাদেশ হয় শুনতে থাক। (সূরা ত্বা-হা: ৯-১৩)
হযরত মূসা (আ) ফিরাউনকে দাওয়াত দেয়ার জন্য আদিষ্ট হলেন তখন তিনি আল্লার নিকট ফরিয়াদ করলেন- আমার ভাই হারুনকে আমার সহযোগী করে দিন যেন সে আমার জন্য সাহস ও শক্তির কারণ হয়। আল্লাহর হযরত মূসা (আ)-কে যে নিয়ামত দিয়েছেন এবং তাঁর ওপর যে দয়া করেছেন তার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। শৈশবের ঘটনা এবং তা৭র মা’কে তার কাছে প্রত্যাবর্তন করানোর ঘটনা। পরবর্তী ঘটনা বর্ণিত হয়েছে সূরা আল-আ’রাফের মতো। তবে টিড্ডি, উকুন, ব্যাঙ এবং রক্তের শাস্তির কথা বাদ দেয়া হয়েছে। তেমনিভাবে ফিরাউন কর্তৃক বনী ইসরাঈলকে দেয়া প্রিতিশ্রুতি এবং তা ভঙ্গের ঘটনাও বিবৃত করা হয়নি। তকেবসূরা ত্বা-হা’য় অন্য একটি ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে। তা হচ্ছে- সামেরী নামে এক ব্যক্তি যে বাছুর তৈরী করেছিল, তার বিস্তারিত বর্ণনা।
[১.৬] সূরা শু’আরা অবতীর্ণক্রম অনুযায়ী ৪৬তম সূরা। এ সূরায়ও হযরত মূসা (আ)-এর রিসালাতের কথা বর্ণিত হয়েছে। তারপর বনী ইসরাঈলের মিসর ত্যাগের ঘটনা বলা হয়েছে। তবে এ সূরায় দুটো কথা নতুন বলা হয়েছে।
এক: মূসা (আ) এক কিবতীকে হত্যা করেছিলেন। তারপর তিনি ধরা পড়ার ভয়ে মিসর ত্যাগ করেন। যখন পুনরায় ফিরাউনের কাছে তাকে পাঠানো হয় তখন ফিরাউন মূসা (আ)কে শৈশবে প্রতিপালনের কথা এবং কিবতীকে হত্যা করার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
দুই : সমুদ্র দু’ভাগে ভাগ হয়ে তলদেশে রাস্তা হয়ে যাওয়া এবং মূসা (আ) ও ফিরাউনের বিতর্কের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। মূসা (আ) কর্তৃক আল্লাহর গুণাবলী বর্ণনা এবং যাদুকরদের সাথে যে কথোপকথন হয়েছিল তা নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপনা।
[১.৭] অবতীর্ণক্রমে ৪৮তম সূরা, সূরা আন-নামল। এ সূরায় নবী রাসূলদেকে মিথ্যাবদী বলা এবং যারা বলেছৈ তাদের পরিণতি সম্পর্কে কিছু ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
[১.৮] সূরা আল-কাসাস, অবতীর্ণের ক্রমানুসারে ৪৯তম সূরা। এখানে হযরত মূসা (আ)-এর জন্ম বৃত্তান্ত থেকে শুরু করা হয়েছে। ফিরাউনের দোর্দণ্ড প্রতাপের সময় মূসা (আ)-এর জন্ম, সিন্দুকে ভরে নদীতে নবজাতককে ভাসিয়ে দেয়া, ফিরাউনের ঘনিষ্ঠজন কর্তৃক সেই সিন্দুক উত্তোলন, মূসা (আ)-এর বোনের সংবাদ সংগ্রহ, তারপর ফিরাউনেকে ধাত্রী মায়ের সন্ধান দেয়া, যার বদৌলতে মূসা (আ) মায়ের কাছে প্রতিপালিত হবার সুযোগ লাভ করেন।
হযরত মূসা (আ) যৌবনে পদার্পণ করে একদিন এক মিসরীকে হত্যা করেন। আরেকজনকে হত্যা করতে চাইলে আগের হত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে হুমকি দেয়া, এক ব্যক্তি দৌড়ে এসে তাকে সংবাদ দেয়া যে, শহরে আপনার হত্যাকাণ্ডের কথা ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি মিসর থেকে মাদইয়ানের দিকে পাড়ি জমান। সেখানে শু’আইব(আ)-এর মেয়ের সাথে পরিচয় এবং তাঁর ছাগলকে পানি পান করানো, তাদের বাড়িতে ফিরে পিতাকে ঘটনা খুলে বলা, মূসা (আ) নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত শু’আইব (আ)-এর কাছে চাকুরী করা। তার শর্ত সাপেক্ষে তার কন্যার সাথে মূসা (আ)-এর বিয়ে এবং নিজের পরিবার নিয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন, পথিমধ্যে আগুনের সন্ধানে গিযে (এ সম্পর্কে সূরা ত্বা-হা’য় বলা হয়েছে) নবুওয়াত লাভ।
অবশ্যই সূরা আল-কাসাসে নতুন একটি দিকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তা হচ্ছে ফিরাউনকে দাওয়াত দেয়ার পর তার হাসি-তামাশামূলক প্রতিক্রিয়া:
(আরবী***********)
ফিরাউন বললো: হে হামান! তুমি ইট পোড়াও, তারপর আমার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ করো যেন আমি মূসার প্রতিপালককে উঁকি মেরে দেখতে পারি। (সূরা আল-কাসাস: ৩৮)
[১.৯] সূরা আসরা (বনী ইসরাঈল) অবতীর্ণক্রম পঞ্চাশ। এখানে ফিরাউনের সলিল সমাধি এবং বনী ইসরাঈলের সমুদ্র পার হওয়া সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত করা হয়েছে।
[১.১০] সূরা ইউনুস, অবতীর্ণক্রম একান্ন। এখানে নবী-রাসূলদেরকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করার পরিণাম করা হয়েছে। তার মধ্যে হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনাটিও সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে যাদুকরদের কথা, বনী ইসরাঈলের সমুদ্র পারাপার এবং ফিরাউনেসর নিমজ্জিত হওয়ারও সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। তারপর নিম্নোক্ত কথাটি অতিরিক্ত সংযোগ করা হয়েছে। যা আর কোথাও উল্লেখ করা হয়নি।
(আরবী***********)
যখন তারা ডুবতে আরম্ভ করলো তখন বললো: এবার বিশ্বাস করে নিচ্ছি কোন ইলাহ নেই তাকে ছাড়া যার ওপর বনী ইসরাঈল ঈমান এনেছে। বস্তুত আমিও তাঁর অনুগতদের অন্তর্ভুক্ত। এখন একথা বলছ! অথচ তুমি ইতোপূর্বে নাফরমানি করছিলে! এবং পথভ্রষ্টদেরই অন্তর্ভুক্ত চিলে। অতএব আজকে আমি তোমার দেহকে সংরক্ষণ করবো যা তোমার পশ্চাদযাত্রীদের জন্য নিদর্শন হতে পারে। (সূরা ইউনুস: ৯০-৯২)
[১.১১] সূরা হুদ, অবতীর্ণক্রম বায়ান্ন। এ সূরায় মিথ্যেবাদীদের ধ্বংসের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে মূসা (আ)-এ ঘটনাও বর্ণনা করা হয়েছে।
[১.১২] সূরা আল-মু’মিন, অবতীর্ণক্রম ষাট। এ সূরায়ও হযরত মূসা (আ) এবং ফিরাউনের মধ্যকার কথোপকথনের উল্লেখ আছে। তবে নিচের কথাটি অতিরিক্ত বলা হয়েছে। যা আর কোথাও বলা হয়নি।
(আরবী***********)
(বিতর্কের এক পর্যায়ে) ফিরাউন বললো: আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মূসাকে হত্যা করবো, সে তার প্রতিপালককে ডাকুক। (সূরা মুমিন: ২৬)
তারপর ফিরাউনের এমন এক সভাসদদের কথা বলা হয়েছে যে ঈমান এনেছিল ঠিকই কিন্তু সে তা গোপন করে রেখেছিল্ সে লোকদেরকে বললো: মূসা (আ)-কে হত্যা করো না, হতে পারে তার রাস্তাই সঠিক। এ কথাটিও শুধুমাত্র এ সূরায়ই বর্ণিত হয়েছে।
[১.১৩] সূরা ফুস্সিলাতে (সূরা হা-মীম আস-সিজদা) অবতীর্ণক্রম একষট্টি হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনার সামান্য ইঙ্গিত করা হয়েছে। তদ্রূপ সূরা যুখরুফেও (অবতীর্ণক্রম তেষট্টি) এ ঘটনার সংক্ষিপ্ত আলোচনা এসেছে। তবে সেখানে নিম্নোক্ত কথা কয়টি অতিরিক্ত বলা হয়েছে যা আর কোথাও বলা হয়নি একমাত্র সূরা যুখরুফ ছাড়া। ফিরাউন বললো:
(আরবী*********)
আমি মিসরের অধিপতি নই? এ নদীগুলো আমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয় তোমরা কি দেখ না? আমি শ্রেষ্ঠ এ ব্যক্তি থেকে, যে নিচ এবং ভাল করে কথা বলতেও সক্ষম নয়। (সূরা আয-যুখরুফ: ৫১-৫২)
[১.১৪] সূরা আয-যারিয়াতে (অবতীর্ণক্রম সাতষট্টি) হযরত মূসা (আ)-কে ফিরাউনের কাছে রাসুল হিসেবে প্রেরণ, ফিরাউন কর্তৃক তাঁকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করা এবং ফিরাউনের ধ্বংস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে।
[১.১৫] সূরা আল-কাহাফে (অবতীর্ণক্রমে ঊনসত্তর) বর্ণিত হয়েছে, হযরত মুসা (আ) এমন এক ব্যক্তির সাক্ষাত এবং সাহচর্য পেয়েছিলেন, যাকে আল্লাহ বিশেষ ইলম দান করেছিলেন। মূসা (আ) তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁকে যেন তাঁর সাহচর্যে রেখে একটু উপকৃত হবার সুযোগ দেন। তিনি উত্তর দিলেন, আপনি ধৈর্যের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হবেন। মূসা (আ) ধৈর্য ও স্থৈর্যের ওয়াদা করে তাঁর সঙ্গ নিলেন কিন্তু বেশিদিন ধৈর্যধরে তার সঙ্গে থাকতে পারলেন না। কারণ তিনি এমন কিছু ঘটনা সংঘটিত হতে দেখলেন যার সঠিক তাৎপর্য তিনি অনুধাবন করতে পারলেন না। ফলে দু’জনের মধ্যে বিচ্ছেদ অবধারিত হয়ে গেল। আল-কুরআনে এ ঘটনাটি শুধুমাত্র এক জায়গায়ই বর্ণিত হয়েছে।
[১.১৬] সূরা ইবরাহী (অবতীর্ণ বাহাত্তর) ও সূরা আল-আম্বিয়া (অবতীর্ণ তিয়াত্তর) নামক সূরা দুটোতে মাদ্র দু’ জায়গায় এ ঘটনার ইঙ্গিত করা হয়েছে। দ্বিতীয সূরায় ইঙ্গিতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে সেখানে তাওরাতকে ‘ফুরকান’ (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী) বলা হয়েছে।
[১.১৭] সূরা আল-বাকারা (অবতীর্ণক্রম সাতাশি) বনী ইসরাঈলের ওপর প্রদত্ত আল্লাহর নিয়মতসমূহ এবং তাঁর অবজ্ঞা প্রদর্শন সংক্রান্ত আলোচনা পেশ করা হয়েছে। সেখানে মোটামুটি বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়ে। এ সূরায় মূসা (আ)-এর ঘটনা একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছ। একপর্যায়ে তাদেরকে যে ‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’ প্রদান করা হয়েছিল এবং বনী ইসরাঈল তার বিনিময়ে অন্য খাদ্য সামগ্রী চেয়েছিল তার কথাও এসেছে। আবার অন্য জায়গায় গাভী যবেহ করার ঘটনা বিবৃত হয়েছে। সোজা নির্দেশ ছিল একটি গাভী যবেহ করার কিন্তু তারা তাকে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে জটিল করে ছাড়ল। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:
(আরবী**********) অতপর তারা সেটি যবেহ করলো অথচ যবেহ করবে বলে মনে হচ্ছিল না। (সূরা আল-বাকারা: ৭১)
গাভী যবেহ করার ঘটনাটি এ সূরায় সম্পূর্ণ নতুন, যা ইতোপূর্বে কোন সূরায় বর্ণিত হয়নি।
[১.১৮] সূরা আন-নিসা (অবতীর্ণক্রম বিরানব্বই) বলা হয়েছে, বনী ইসরাঈল বিনা অন্তরালে আল্লাহকে দেখার জন্য গো ধরেছিল।
[১.১৯] সূরা আল-মায়িদা (অবতীর্ণক্রম একশ’ বার) বনী ইসরাঈলের ঘটনা বর্ণনা করদে গিয়ে বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
তারা বললো: হে মূসা! সেখানে একটি প্রবল পরাক্রান্ত জাতির রয়েছে। আমরা কখনো সেখানে যাব না, যে পর্যন্ত না তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়। তারা যদি সেখান থেকে বের হয়ে যায় তবে অবশ্যই আমরা সেখানে প্রবেশ করবো। (সূরা আল-মায়িদা: ২২)
একটু অগ্রসর হয়ে বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
তারা বললো: হে মূসা! আমরা জীবনে কখনো সেখানে যাব না, যতোক্ষণ তারা সেখানে থাকবে। অতএব, তুমি ও তোমার প্রতিপালক সেখানে যাও এবং যুদ্ধ করো। আমরা এখানেই বসলাম। মূসা বললো: হে আমার পালনকর্তা! আমি শুধু নিজের ওপর ও ভাইয়ের ওপর ক্ষমতা রাখি। কাজেই আল্লাহ বললেন: এ দেশ তাদের জন্য চল্লিশ বছর পর্যন্ত হারাম করে দেয়া হলো। তারা ভূপৃষ্ঠে উদ্ভ্রান্তের মতো ফিরবে। অতএব, তুমি অবাধ্য সম্প্রদায়ের জন্য দুঃখ করো না।
তারপর তাদেরকে এক মরুপ্রান্তরে ছেড়ে দেয়া হয় এবং সেখানেই তাদের বসতি গড়ে উঠে। এরপর মূসা (আ) ও বনী ইসরাঈল সম্পর্কে আর কিছু বলা হয়নি। অবশ্য বনী ইসরাঈল ঈসা (আ)-এর সাথে শত্রুতা পোষণ করতো সে কথা বলা হয়েছে।
একমাত্র হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনাটিই আল-কুরআনে সর্বাধিক বর্ণিত হয়েছে। ওপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, পুনরাবৃত্তির ধরনটি কেমন। ছয় জায়গায় ছাড়া আর সবগুলো জায়গায় খুব সংক্ষেপে কিংবা শুধুমাত্র ইঙ্গিতে ঘটনা বিবৃত করা হয়েছে। তবে সে সমস্ত জায়গায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে সেখানে কোন না কোন নতুন বক্তব্য অবশ্যই বলা হয়েছে। এখন যদি কোন পাঠক কুরআন পাঠ করার সময় ঘটনার নতুনত্ব খুঁজে না পান তবে তাতে আল-কুরআনের দোষ কী?
২. আল-কুরআনের ঘটনাগুলো দ্বীনি উদ্দেশ্যের অনুগামী হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে- যেখানে যতোটুকু ঘটনা (পুনরাবৃত্তি ছাড়া) বর্ণিত হয়েছে সেখানে ঠিক ততোটুকু উদ্দেশ্য পূরণে যথেষ্ট। শুধু সেই অংশেরই বর্ণনা করা হয়েছে বিষয়বস্তুর সাথে যা সঙ্গতিপূর্ণ। যেমন কখনো ঘটনার প্রথম অংশ আলোচনা করা হয়েছে আবার কোথাও ঘটনার শেষাংশ আলোচনা করা হয়েছে আবার কখনো শুধু ততোটুকু আলোচনা করা হয়েছে যতোটুকু শিক্ষা ও উপদেশের সাথে সংশ্লিষ্ট। কারণ ইতিহাস বর্ণনা করা কুরআনের উদ্দেশ্য নয় উদ্দেশ্য হচ্ছে ইতিহাসের আলোকে শিক্ষা প্রদান করা। কতিপয় উদাহরণ উল্লেখ করা হলো-
[২.১] অনেক সময় কোন ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে দেখা গেছে ঘটনার নায়কের জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করা হচ্ছে। কারণ সে জন্ম বৃত্তান্তের মধ্যে শিক্ষনীয় অনেক ঘটনা বিদ্যমান থাকে। যেমন- হযরত আদম (আ)-এর জন্ম বৃত্তান্ত। হযরত আদম (আ)-এর জন্মের ঘটনাটিতে আল্লাহর কুদরত এবং দয়া-অনুগ্রহের পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। সাথে সাথে ইবলিসের যে ঘটনা বলা হয়েছে তার পেছনেও দ্বীনি উদ্দেশ্য নিহিত আছে।
তেমনিভাবে হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম বৃত্তান্তের কথা উল্লেখ করা যায়। এ ঘটনাটি কুরআনে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ ঈসা (আ)-এর জন্ম বৃত্তান্ত ব্যতিক্রমী একটি ঘটনা, যা এক বিরাট মুজিযা। তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত এমন ছিল, যা সমস্ত যুক্তি-তর্কের বিপরীত। ইসলাম প্রকাশ হওয়ার আগে এবং পরে ঈসা (আ) সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক সমস্ত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। আবার হযরত মারইয়াম (আ)-এর ঘটনাটিও উল্লেখযোগ্য। তাকে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করা হয়েছিল। হযরত মারইয়াম (আ) হযরত জাকারিয়া (আ)-এর তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হচ্ছিলেন, শৈশবেই তিনি আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম রিযিক পেতেন। একবার তিনি দেখতে পেলেন মারইয়াম (আ)-এর নিকট অনেক ফল-মূল। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)
যখনই জাকারিয়া মিহরাবে প্রবেশ করতেন তখনই তার কাছে খাদ্য সামগ্রী দেখতে পেতেন। একদিন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হে মারইয়াম! তুমি এগুলো কোথায় পেলে? সে উত্তর দিলো: এগুলো আল্লাহ দিয়েছেন। (সূরা আলে ইমরান: ৩৭)
এ ঘটনার সবটুকু তুলে ধরা হয়েছে। এমনকি হযরত ঈসা (আ)-এর জন্ম বৃত্তান্তের কথাও এসেছে। হযরত ঈসা (আ)-এর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশের বর্ণনা এখানে করা হয়েছে। এমনিভাবে হযরত মূসা (আ)-এর জন্ম বৃত্তান্তও আল-কুরআনে বলা হয়েছে। তার কয়েকটি দিক ও কারণ আছে-
ক. হযরত মূসা (আ)-এ জন্ম ঐ সময়ে হয়েছিল, যখন ফিরাউন বনী ইসরাঈলের ওপর নির্যাতনের স্টীম রোলার চালাচ্ছিল।
খ. ফিরাউন বনী ইসরাঈলের কোন পুত্র সন্তানকে জীবিত রাখত না।
গ. আল্লাহ তা’আলা অলৌকিকভাবে মূসা (আ)-কে বাঁচিয়ে দিলেন এবং ফিরাউনের ঘরে প্রতিপালনের ব্যবস্থা করলেন।
উপরোক্ত তথ্যের ভিত্তিতে বুঝা যায় মূসা (আ)-এর জন্ম বৃত্তান্ত অত্যন্ত গুরুত্বের দাবি রাখে। আল্লাহ দেখিয়ে দিলেন, যাকে নবুওয়াতের জন্য সৃষ্টি করা হলো তাকে সে লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়া হলো। কেউ কোন ক্ষতি করতে পারলো না। জন্ম বৃত্তান্ত ছাড়াও জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। আবার হযরত ইসমাঈল (আ) ও হযরত ইসহাক (আ)-এর জন্ম বৃত্তান্তও কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ তাদের জন্মের সাথেও নসীহত ও শিক্ষা জড়িয়ে আছে। হযরত ইসমাঈল (আ)-এর জন্ম ঐ সময় হয়েছিল যখন হযরত ইবরাহীম (আ) বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর সহায়তায় তিনি কা’বা ঘর নির্মাণ করেছেন। বার্ধক্য যখন পূর্ণ মাত্রায় প্রতিফলিত তখন হযরত ইসহাক (আ)-এর জন্ম। তেমনিভাবে হযরত ইয়াহ্ইয়া (আ)-এর জন্মও হয়েছিল হযরত জাকারিয়া (আ)-এর বৃদ্ধ বয়সে। তখন তার চুলগুলো সাদা হয়ে গিয়েছিল।
[২.২] আমরা কুরআনে এমন কিছু ঘটনাও পাই যেখানে জন্মের পরের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে। জন্ম বৃত্তান্ত বলা হয়নি। যেমন হযরত ইউসুফ (আ)-এর ঘটনা। যার শুরু হয়েছে শৈশবের ঘটনা দিয়ে। তিনি শৈশবে এমন এক স্বপ্ন দেখলেন যা অবশিষ্ট জীবনের প্রতিচ্ছবি। তিনি স্বপ্নে দেখলেন, এগারোটি তারা, চাঁদ ও সুরুজ। বিজ্ঞ পিতা এ স্বপ্নের মর্মার্থ বুঝে ফেললেন এবং তাকে আগের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখাশুনা করতে লাগলেন। তার ভাইয়েরা হিংসার আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরতে লাগলো। তারপর ঘটনা আপন গতিতে চললো।
হযরত ইবরাহীম (আ)-এর ঘটনাও শৈশব থেকে শুরু হয়েছে।
শৈশবে একদিন তিনি আকাশের দিকে চেয়ে এক তারকা দেখে মনে করলেন হয়তো এটিই তাঁর প্রতিপালক। যখন তা ডুবে গেল তখন বললেন- যা ডুবে যায় তা আমি পসন্দ করি না। চন্দ্র উদিত হলো তখন মনে করলেন এটি অনেক বড় কাজেই এটিই আমার প্রতিপিালক। রাত্রি শেষে যখন চাঁদ অস্তমিত হয়ে গেল এবং গোটা পৃথিবী আলোকি করে সূর্য উদিত হলো, তখন তিনি বললেন: এটি যখন সবচেয়ে বড় এবং উজ্জ্বল কাজেই এটি ইলাহ না হয়ে যায় না। কিন্তু দিবাবসানে যখন সূর্য অস্তমিত হয়ে গেল তখন তিনি প্রকৃত আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করলেন। যাকে দেখা যায় না শুধু অনুভব করা যায়। তারপর তিনি নিজের কাওম ও পিতাকে সেই ইলাহর দিকে আহ্বান জানালেন কিন্তু তারা সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করলো।
হযরত ইবরহীম (আ) একদিন তাদের অসতর্কতার সুযোগে তাদের পূজা মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে দিলেন। লোকজন বললো: এ কাজ ইবরাহীম নামক যুবক ছাড়া আর কেউ করেনি। তখন তারা তাঁকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু আল্লাহ তাঁকে বাঁচিয়ে দিলেন। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)
আমি নির্দেশ দিলা, হে আগুন তুমি ঠাণ্ডা হয়ে যাও, যে রূপ ঠাণ্ডা ইবরহীমের জন্য উপযোগী হয়। (সূরা আল-আম্বিয়া: ৬৯)
হযরত দাঊদ (আ)-এর ঘটনাও তাঁর শৈশব থেকে শুরু করা হয়েছে। তিনি প্রসিদ্ধ হয়েছিল জালুত নামক এক অত্যাচারী বাদশাহকে হত্যা করে। যা ছিল সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কুদরত। ব্যস! এভাবেই হযরত দাঊদ (আ)-এর ঘটনা শুরু করা হয়েছে। হযরত সুলাইমান (আ)-এর ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে তার যৌবনকাল থেকে। যখন তাঁর পিতা দাঊদ (আ)-এর এক ফয়সালার মুকাবিলায় তিনি নতুন ফয়সালা দিয়েছিলেন। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)
যখন তাতে কিছু মেঘ ঢুকে পড়েছিল, তাদের বিচার আমার সামনে ছিল। (সূরা আল-আম্বিয়া: ৭৮)
[২.৩] কুরআনে কারীমে এমন কিছু ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। যেখানে শুধুমাত্র শেষ কিস্তি বর্ণিত হয়েছে। যেমন- হযরত নূহ (আ), হযরত হূদ (আ), হযরত সালেহ (আ), হযরত লূত (আ), হযরত শু’আইব (আ) প্রমুখ আম্বিয়ায়ে কিরাম। এদের ব্যাপারে উল্লেখিত অংশের বাইরে অতিরিক্ত আর কোন আলোচনা করা হয়নি। কারণ তাদের ঘটনার সেই অংশটুকুই গুরুত্বপূর্ণ এবং তার মধ্যেই শিক্ষা ও উপদেশ নিহিত।
কাহিনীর সংক্ষেপ ও বিস্তৃতি
এতোক্ষণ আমরা যা আলোচনা করলাম, সে কাহিনী কোথা থেকে শুরু করা হয়েছে সে সম্পর্কে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন আমরা আলোচনা করবো, আল-কুরআনের অনেক ঘটনা দীর্ঘ ও বিস্তারিত এবঙ অনেক ঘটনা সংক্ষিপ্ত, কিন্তু তার শিক্ষণীয় দিকটি কী পরিমাণ বিস্তৃত। নিচে আমরা তার কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।
১. হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এজন্য আল-কুরআনে তা আদ্রপ্রান্ত বর্ণনা করা হয়েছে। কাহিনীর শুরু মূসা (আ)-এর জন্ম বৃত্তান্ত দিয়ে এবং শেষ পবিত্র ভূমির কাছে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসাসের মাধ্যমে। সেখানে তাঁর জাতি চল্লিশ বৎসর অস্থান করার নির্দেশপ্রাপ্ত হয়। যা ছিল বনী ইসরাঈলের বাড়াবাড়ির প্রতিফল। এ ঘটনা বিস্তারিতভাবে এজন্য বলা হয়েছে যে, তার প্রতিটি অংশেই দ্বীনি শিক্ষা ও উপদেশের প্রকাশ ঘটেছে। উপরন্তু তা কুরআনী দাওয়াত এবং উদ্দেশ্য-লক্ষ্যের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।
ঈসা (আ)-এর ঘটনাটিও বিস্তারিত, তবে মাঝের কিছু অংশ সংক্ষেপ করা হয়েছে। তাঁর জন্ম বৃত্তান্ত ও মুজিযাসমূহ বিস্তারিত বলা হয়েছে, হাওয়ারীগণ কর্তৃক সহযোগিতা এবং ইহুদী কর্কৃত তাঁকে মিথ্যেবাদী আখ্যায়িত করে শূলে চড়ানোর প্রচেষ্টা, তারপর আল্লাহর নির্দেশে তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নেয়া। তাঁকে উঠিয়ে নেয়ার পর বনী ইসরাঈলের দলাদলি ও বিচ্ছিন্নতার ঘটনাও কুরআন বর্ণনা করেছে। কুরআনে একথাও বলা হয়েছে যে, কিয়ামতের দিন ঈসা (আ)-কে জিজ্ঞেস করা হবে কেন তাঁকে ও মারইয়ামকে আল্লাহর সমকক্ষ বানান হয়েছে? হযরত ঈসা (আ) উত্তর দেবেন:
আমিতো তাদেরকে নির্ভেজার তওহীদের দাওয়াত দিয়েছিলাম। তারপর গোটা জাতিকে আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে বলবেন: আপনি ইচ্ছে করলে তাদের মাফ করে দিন কিংবা শাস্তি দিন।
হযরত ইউসুফ (আ)-এর ঘটনা একই সাথে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে। ভাইদের ষড়যন্ত্র, মিসরে তাঁকে দাস হিসেবে বিক্রি, মিসরের গভর্ণর আজীজের হস্তগত হওয়া, তার স্ত্রী কর্তৃক ফুসলানো, কারাগারের অসহনীয় যন্ত্রণা, দু’ কয়েদীর স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদান, বাদশাহর স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদান এবং কারাগার থেকে মুক্তি লাভ, মিসরের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন, ভাইদের মিসরে আগমন, বিন ইয়ামিনের সাথে হযরত ইউসুফ (আ)-এর সাক্ষাত, বিন ইয়ামিনকে আটক করে পিতা-মাতাকে মিসরে হাজির করা এবং মিসরে সপরিবারে বসবাসের সিদ্ধান্ত গ্রহণের করার পর কাহিনীর যবনিকা। এ ঘটনা বর্ণনার পেছনে দু’টো উদ্দেশ্য আছে- এক: ওহী ও রিসালাতের স্বীকৃতি। দুই: গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনি শিক্ষা।
হযরত ইবরাহীম (আ)-এর ঘটনা শুরু করা হয়েছে শৈশবে তাঁর ঈমান গ্রহণের ঘটনা দিয়ে। তারপর পিতা ও জাতির সাথে বিতর্ক, মূর্তি ভাঙ্গা, দেশান্তর, ইসমাঈল ও ইসহাকের জন্ম, স্বপ্নে পুত্র কুরবানীর নির্দেশ প্রাপ্তি, কা’বা ঘর নির্মাণ এবং হজ্জ অনুষ্ঠানের ঘোষণা প্রদান, অন্তরের প্রশান্তির জন্য আল্লাহর কাছে মৃত ও জীবন দানের ঘটনা প্রত্যক্ষের আবেদন, আল্লাহর নির্দেশে চারটি পাখী যবেহ করে তাদের গোশতগুলো মিলিয়ে রাখার পর সেসব পাখীদের জীবিত হওয়া।
হযরত সুলাইমান (আ)-এর ঘটনাও বিস্তারিতভাবে কুরআনে বলা হয়েছে। ক্ষেত সংক্রান্ত ফয়সালা, সাম্রাজ্য পরিচালনা, উত্তম ঘোড়ার মাধ্যমে পরীক্ষা, জ্বিন ও বাতাসে তাঁর অধীনস্ত করে দেয়া, হুদহুদ, পিপিলিতা ও রাণী বিলকিসের সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনাসমূহ, সর্বশেষ মৃত্যুর পর লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এবং এ ব্যাপারে জ্বিনদের বেখবর থাকার ঘটনা বর্ননা করে কাহিনীর ইতি টানা হয়েছে। গোটা কাহিনী গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও উপদেশে ভরপুর।
২. আল-কুরআনের কিছু ঘটনা এমন, যা জীবনের একটি অংশের তৎপরতার সাথে সংশ্লিষ্ট। যেমন- হযরত নূহ (আ)-এর ঘটনা। শুধুমাত্র নবুওয়াত ও রিসালাতের বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। দ্বীনের দাওয়াত প্রদান, জাতির কর্তৃক প্রত্যাখ্যান, নৌকা তৈরী, প্লাবন, নূহ (আ) এর ছেলের সলিল সমাধি (আমলে সালেহ ছাড়া নবী তনয়ও আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পায়নি)। এমনিভাবে হযরত আদম (আ)-এর সৃষ্টি, জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠান, তওবা কবুল ইত্যাদি ঘটনা বিবৃত হয়েছে। আবার মারইয়াম (আ) ও ঈসা (আ)-এর জন্ম বৃত্তান্তও বলা হয়েছে। তবে এ ঘটনাগুলো পূর্বে বর্ণিত ঘটনাগুলো পূর্বে বর্ণিত ঘটনাগুলোর মতো বিস্তারিত নয়। তবু একে বিস্তারিত ঘটনা বলা চলে। হযরত দাঊদ (আ)-এর ঘটনাও মোটামুটি উল্লেখযোগ্য। তবে তা হযরত সুলাইমান (আ)-এর ঘটনার মতো এতো বিস্তারিত নয়। তবু হযরত দাঊদ (আ)-এর ঘটনাটি বেশ কয়েকটি অংশে বর্ণিত হয়েছে।
৩. আল-কুরআনের কিছু ঘটনাকে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, যেমন- হযরদ হুদ (আ), হযরত সালেহ (আ), হযরত লুত (আ), হযরত শু’আেইব (আ) প্রমুখ নবীদের ঘটনা। শুধামাত্র রিসালাত ও নবুওয়াত সংক্রান্ত ঘটনাবলী সংক্ষেপে বর্ণনা করা হয়েছে। হযরত ইসমাঈল (আ)-এর জন্ম, কুরবানী এবং পিতা-পুত্র মিলে কা’বা ঘর তৈরীর কথা সংক্ষিপ্তভাবে এসেছে। হযরত ইয়াকুব (আ)-এর কিচু বর্ণনা এসেছে হযরত ইউসুফ (আ)-এর ঘটনায়। তাছাড়া অন্যত্র ইয়াকুব (আ)-এর অন্তিম মুহূর্তের ওসীয়তের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এ অংশটি এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, এর মধ্যে তওহীদর কথা বিবৃত হয়েছে, যে কথা তিনি অন্তিম মুহুর্তে ওসীয়ত হিসেবে বলে গেছেন।
৪. কোন কোন ঘটনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে বলা হয়েছে। যেমন- হযরত জাকারিয়া (আ)-এর কাহিনী, ইয়াহইয়অ (আ)-এর জন্ম ও মারইয়অম (আ)-এর অভিভাকত্বের ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। হযরত আইউব (আ)-এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে রোগগ্রস্ত হওয়া, আল্লাহর দরবারে ধর্ণনা এবং পরিত্রাণ লাভ সংক্রান্ত অধ্যায়টুকু। হযরত ইউনুস (আ)-এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে জাতিকে দাওয়াত দেয়োর পর জাতি কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হতে দেশান্তর হওয়ার প্রচেষ্টা, আছে গিলে ফেলা, বিজন ভূমিতে মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ এবং তার জাতি কর্তৃক ইসলাম গ্রহণ পর্যন্ত অধ্যায়ে সীমাবদ্ধ।
৫. কিছু কিছু ঘটনা বিস্তারিত না বলে শুধুমাত্র ইঙ্গিত দেয়াকে যথেস্ট মনে করা হয়েছে। যেমন- হযরত ইদ্রিস (আ), হযরত আল-ইসাআ’, যুলকিফল প্রমুখ। এরা নবীদের অন্তর্ভুক্ত শুধু এ কথার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এর বেশি কিছু নয়।
৬. এমন কিচু কাহিনী বলা হয়েছে, যা পৃথক অন্য কোন ঘটনার সাথে সংশ্লিস্ট। যেমন- আসহাবে উখদুদ, আসহাবে কাহ্ফ, আদম (আ)-এর দু’ ছেলের ঘটনা, দুই বাগান মালিকের ঘটনা, বাগান মালিকদের ঘটনা ইত্যাদি। এর মধ্যে কিছু ঘটনার আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে এবং সামনেও কিছু ঘটনার আলোচনা করা হবে। এখন আমরা এখানেই প্রসঙ্গ শেষ করতে চাই। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু একথা বলা- আল কুরআন কোন ঘটনার শুধু ঐ অংশটুকুই আলোচনা করেছে যা দ্বীনি উদ্দেশ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট। আমাদের সেই উদ্দেশ্র পূর্ণ হয়ে গেছে।
উপসংহার ও পরিণতি বর্ণনা
আল-কুরআন বর্ণিত কাহিনীগুলো দ্বীনি উদ্দেশ্যের অনুগামী হওয়ার আরেকটি প্রমাণ হচ্ছে- ঘটনা বর্ণনার সাথেই কিছু দ্বীনি হেদায়েত এবং সেই কাহিনীর পরিণতিও বর্ণনা করা হয়েছে। তা কখনো কাহিনীর প্রথমে, কখনো শেষে বা কখনো মূল কাহিনীর সাথেই বর্ণিত হয়েছে।
শুরুতে শিক্ষণীয় ঘটনা বলে পরে কাহিনী শুরু করা হয়েছে। এমন দুটো উদাহরণ নিয়ে আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। অবশ্য তার দুটো দিক রয়েছে:
১. ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে ওহী ও রিসালাতের প্রমাণ উপস্থাপন করা। অর্থাৎ বলে দেয়া হয়েছে, এ ঘটনা ওহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত। যেমন: হযরত ইউসুফ (আ) ও হযরত আদম (আ)-এর ঘটনাবলী। যেখানেই তা বলা হয়েছে সেখানে প্রথমে ওহীর স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
২. প্রথমে ঘটনার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, তারপর ঘটনার বর্ণনা করে তার সত্যতা প্রমাণ করা হয়েছে। যেমন:
(আরবী**********)
আমার বান্দরেদ জানিয়ে দাও, আমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দায়ালূ। আবার আার শাস্তি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। (সূরা আল-হিজর: ৪৯-৫০)
এ আয়াতে রহম ও আযাবের কথা বলে তারপর রহম ও আযাবের প্রমাণ স্বরূপ পুরো ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।
আবার ঘটনা বর্ণনা শেষে তার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করা হয়েছে এমন দুটো ঘটনাও আমরা উল্লেখ করেছি। তারও দুটো কারণ আছে:
১. সমস্ত ঘটনা ওহীর মাধ্যমে জানান হয়েছে একথার প্রমাণ করা এবং ঘটনাটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, স্বয়ং ঘটনাই সে কথার প্রমাণ দেয়। যেমন- সূরা আল-কাসাসে মূসা (আ)-এর ঘটনা বর্ণনা করার পর মূল বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। তেমনিভাবে সূরা হূদে হযরত নূহ (আ)-এর ঘটনা বর্ণনার পর আসল বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে।
২. আল্লাহ (নাউযুবিল্লাহ) জালিম নন এবং কোন সম্প্রদায়ের কাছে নবী রাসূল না পাঠিয়ে তাদেরকে শাস্তি দেননি এ কথার প্রমাণ করা। যেমন- সূরা আল-আনকাবুতে নবী-রাসূলদের কথা বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
আমি প্রত্যেককেই তার অপরাধের কারণে পাকড়াও করেছি। তাদের কারো প্রতি প্রেরণ করেছি প্রস্তরসহ প্রচণ্ড বাতাস, কাউকে পেয়েছে বজ্রপাত, কাউকে আমি বিলীন করেছি ভূগর্ভে এবং কাউকে করেছি নিমজ্জিত। আল্লাহ তাদের ওপর জুলুমকারী ছিলেন না, কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছিল। (সূরা আল-আনকাবুত: ৪০)
সত্যি কথা বলতে কি, যে বক্তি কুরআনের এ কাহিনীগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে সেই এর রহস্য অনুধাবন করতে পারবে এবং বুঝতে সক্ষম হবে যে, কুরআন প্রত্যেকটি ঘটনার সাথেই তার পরিণতি ও শিক্ষা বর্ণনা করেছে।
এবার আমরা এমন কয়েকটি উদাহরণ বা ঘটনা আলোচনা করবো, যেখানে ঘটনা বলার সাথে সাথে শিক্ষণীয় দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
১. আল-কুরআনে বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
(তুমি কি সে লোককে দেখনি?) যে এমন এক জনপদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিল, যার বাড়ি-ঘরগুলো ভেঙ্গে ভিত্তির ওপর পড়েছিল। সে বললো: কেমন করে আল্লাহ মরণের পর একে জীবিত করবেন? তখন আল্লাহ তাকে একশ’ বছর মৃত অবস্থায় রাখলেন, তারপর তাকে উঠালেন। বললেন: তুমি কতোদিন এভাবে ছিলে? সে উত্তর দিলো: একদিন কিংবা তার চেয়ে কম সময়। আল্লাহ বললেন: ত নায়, তুমি একশ’ বছর মৃত ছিলে। এবার তোমার খাদ্র ও পানীয়ের দিকে চেয়ে দেখ, তা অবিকৃত আছে। গাধার দিকে চেয়ে দেখ- আমি তোমাকে মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বানাতে চেয়েছি- তার হাড়গুলো আমি কেমন করে জুড়ে দেই এবং সেগুলোর ওপর মাংসের আবরণ পরিয়ে দেই। যখন তা ঘটে গেল তখন সে বললো: আমি জানি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বশক্তিমান। (সূরা বাকারা: ২৫৯)
দেখুন আল্লাহ তা’আলা ঘটনার মধ্রেই (*****)- “আমি তোমাকে মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বানাতে চাই” আয়াতটি দিয়ে উদ্দেশ্র ব্যক্ত করেছেন এবং ঘটনার শেষে (আরবী**********)-‘আমি জানি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সকল বিষয়েই সর্বশক্তিমান” বলে প্রকৃত শিক্ষা তুলে ধরা হয়েছে।
২. হযরত সুলাইমান (আ) এবং রানী বিলকিসের ঘটনায় হুদহুদের কণ্ঠে বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
আমি এক নারীকে সাবা জাতির ওপর রাজত্ব করতে দেখেছি। তাকে সবকিছুই দেয়া হয়েছে এবং তার একটি বিরাট সিংহাসন আছে। আমি তাকে ও তার জাতিকে দেখলাম, তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান তাদের কাছে তাদের কাজকর্মকে আকর্ষণীয় করে দিয়েছে এবং তাদের সৎপথ থেকে নিবৃত্ত রেখেছে। কাজেই তারা সৎপথে নেই। তারা আল্লাহকে সিজদা করে না কেন, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর গোপন বিষয়ের খবর রাখেন এবঙ তোমরা যা প্রকাশ করো এবঙ গোপন রাখ তাও তিনি জানেন। আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি বিশাল আরশের মালিক। (সূরা আন-নমল: ২৩-২৬)
ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে এ সমস্ত কথা হুদহুদের মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ হুদহুদের কথা শুনে প্রভাবিত হয়ে যাবে।
৩. হযরত ইউসুফ (আ)-এর ঘটনায় হযরত ইউসুফ (আ) বাদশাহর দু’ অনুচরের স্বপ্নের ব্যাখ্যা পদান করেন, তখন তিনি বলেন:
(আরবী**********)
এ জ্ঞান আমার পালনকর্তা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন। আমি ঐসব লোকের ধর্ম পরিত্যাগ করেছি যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না এবং পরকালের প্রতিও কোন বিশ্বাস রাখে না। (সূরা ইউসুফ: ৩৭)
(আরবী**********)
আমি আপন পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুবের ধর্মের অনুসরণ করছি। আমাদের জন্য শোভা পায় না কোন বস্তুকে আল্লাহর অংশীদার করি। এটি আমাদের প্রতি এবং অন্য সব লোকের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ। কিন্তু অধিকাংশ লোক সে অনুগ্রহ স্বীকার করে না। (সূরা ইউসুফ: ৩৮)
মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, কাহিনী বর্ণনার সাথে সাথে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষামূলক উপদেশ বর্ণনা করা। তবে তা এমনভাবে কাহিনীর সাথে একাকার করে দেয়া হয়েছে, মনে হয় এ কথাগুলোও মূল কাহিনীর অংশ। কাহিনীর পাঠকগণ ঘটনার মধ্যে সর্বত্রই এ ধরনের বর্ণনা পেয়ে থাকেন।
দ্বিতীয কথা হচ্ছে, তার স্টাইল এ রকমই হোক কিংবা কিছুটা ব্যতিক্রম তাতে কিছু যায় আসে না কিন্তু একটি কথা দৃঢ়তার সাথে বলা যায়, এ বিষয়টি কাহিনী বর্ণনা মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে কাজ করে। সত্যি কথা বলতে কি দ্বীনি কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছাড়া আল-কুরআনে কাহিনী বর্ণনার কোন প্রশ্নই আসতে পারে না।
কাহিনী বর্ণনায় দ্বীনি ও শৈল্পিক সংমিশ্রণ
আমরা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি, কাহিনী দ্বীনি উদ্দেশ্যের অনুগামী হওয়ার অর্থ এই নয় যে, তা শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যসমূহের অন্তরায়। আমরা এখন বলতে চাই, দ্বীনি উদ্দেশ্যের অনুগামী হওয়ার ফলে, ঐ বৈশিষ্ট্যকে শৈল্পিক জগতে গল্পের মূল ভিত্তি গণ্য করা হয়। এ অধ্যায়ের শুরুতে আমরা যে কথা বলেছিলাম, সেখানেও একথার সমর্থন পাওয়া যায়। তা হচ্ছে:
আল-কুরআন বিবেকের ওপর প্রভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে শৈল্পিক সৌন্দর্যকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ আল-কুরআন দ্বীনি চেতনা প্রভাবিত করার জন্য শৈল্পিক সৌন্দর্যের উপকরণ ব্যবহার করেছে। নিচে আমরা ঘটনাবলীর শৈল্পিক বিশেষত্ব নিয়ে আলোচনা করবো, ‘কাহিনীর শৈল্পিক রূপ’ শিরোনামে।
কাহিনীর শৈল্পিক রূপ
১. কুরআনে হাকীমের বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনার অন্যতম উদ্দেশ্য- দ্বীন, নবী-রাসূল এবং তাঁদের অভিন্নতা এবং প্রতিটি নবী-রাসূলের সাথে কাফির-মুশরিকদের এক ও অভিন্ন আচরণ ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করা। অবশ্য এ সম্পর্কে পূর্বের অধ্যায়েও আলোচনা করা হয়েছে।
আল-কুরআনের ঘটনাবলীতে যে বক্তব্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠে, তা হচ্ছে- প্রত্যেক নবী ও রাসূলের দ্বীন ছিল এক এবং তাঁরা প্রত্যেকে একই দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। আবার প্রত্যেক নবীর জাতি যারা একমাত্র দ্বীনকে মিথ্যে প্রতিপন্ন করেছে মনে হয় তা একই সূতোয় গাঁথা। নবীগণ যখনই এসেছেন তখনই সেই গোষ্ঠীর মুকাবিলা করতে হয়েছে। আল-কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় সেসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু সেই পুনরাবৃত্তির মধ্যেও এক ধরনের শৈল্পিক সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে মনে হয় এরা ভিন্ন ভিন্ন বী নয় বরং একজন নবী এবং ভিন্ন ভিন্ন জাতি নয় বরং একই জাতি। তদ্রূপ মিথ্যে প্রতিপন্নকারীরাও দীর্গ সময় ও অবস্থার ব্যবধানেও মনে হয় সকলে একই মানসিকতার অধিকারী। প্রত্যেক নবী এসেছেন এবং কালিমার দাওয়াত দিয়ে পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। আর গুমরাহ মানুষগুলো সবসময়ই তাদেরকে মিথ্যেবাদী বলেছে এবং তাঁর সাথে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছে। নিচের আয়াতগুলো লক্ষ্য করুন:
(আরবী**********)
আমি নূহকে তার জাতির নিকট পাঠিয়েছি। সে বললো: হে আম র জাতির লোকেরা! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ্ নেই। আমি তোমাদের জন্য এক মহাদিবসের শাস্তির ভয় করি। তার জাতির সর্দাররা বললো: আমরা তোমাকে সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। সে বললো: হে আমার জাতি! আমি কখনো গোমরাহ্ নই, আমি তো রাব্বুল আলামীনের সদুপদেশ দেই। আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে সেসব জিনিস জান, যা তোমরা জান না। তোমরা কি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছ এ কারণে যে, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে তোমাদেরই এক ব্যক্তি উপদেশ নিয়ে এসেছে- যাতে সে তোমাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করে, যেন তোমরা সংযত হও এবং অনুগৃহীত হও। অতপর তারা তাকে মিথ্রে প্রতিপন্ন করলো। আমি তাকে জাহাজের আরোহীদেরকে রক্ষা করলাম, আর যারা মিথ্যে প্রতিপন্ন করছিল তাদেরকে ডুবিয়ে দিলাম। নিশ্চয়ই তারা ছিল অন্ধ। (সূরা আরাফ: ৫৯-৬৪)
(আরবী**********)
আদ জাতির কাছে তাদের ভাই হূদকে পাঠিয়েছি। সে বললো: হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তার জাতির নেতৃবৃন্দ বললো: আমরা দেখছি, তুমি একজন নির্বোধ, আর আমরা তোমাকে মিথ্যেবাদী মনে করি। সে বললো: হে আমার সম্প্রদায়! আমি মোটেই নির্বোধ নই বরং আমি রাব্বুল আলামীনের পয়গাম্বর। তোমাদেরকে প্রতিপালকের পয়গাম পৌঁছে দেই এবং আমি তোমাদের হিতাকাংখী-বিশ্বস্ত। তোমরা কি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছ এ কারণে যে, তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এবং তোমাদেরই এক ব্যক্তি উপদেশ নিয়ে এসেছে যেন সে তোমাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করে। তোমরা স্মরণ করো, যখন আল্লাহ তোমাদেরকে নূহের জাতির পর নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং দেহাকৃতিও বৃদ্ধি করে দিয়েছেন। তোমরা আল্লাহর নিয়ামত স্মরণ করো যাতে তোমাদের মঙ্গল হয়।
তারা বললো: তুমি কি আমাদের কাছে এজন্য এসেছ, আমরা এক আল্লাহর ইবাগদ করি এবং আমাদের বাপ-দাদা যাদের পূজা করতো আমরা তাদেরকে ছেড়ে দেই? তাহলে তুমি যার ভয় আমাদেরকে দেখাচ্ছ তা নিয়ে এসো। যদি তুমি সত্যবাদী হও। সে বললা: অবধারিত হয়ে গেছে তোমারেদ ওপর তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে শাস্তি ও ক্রোধ। আমার সাথে ঐসব নাম সম্পর্কে কেন তর্ক করছো যেগুলো তোমার ও তোমাদের বাপ-দাদারা রেখেছ। আল্লাহ এদের কোন মন্দ অবতীর্ণ করেননি। অতএব তোমরা অপেক্ষা করো আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষায় রইলাম। অতপর আমি তাকে ও তার সঙ্গীদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে রক্ষা করলাম এবং যারা আমার আয়াতসমূহে মিথ্যারোপ করতো তাদের মূল কেটে দিলাম। কারণ তারা বিশ্বাসী ছিল না। (সূরা আল-আরাফ: ৬৫-৭২)
(আরবী**********)
সামুদ সম্প্রদায়ের নিকট তাদের ভাই সালেহকে পাঠিয়েছি। সে বললো: হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে একটি প্রমাণ এসে গেছে। এটি আল্লাহর উটনী। অতএব একে ছেড়ে দাও, আল্লাহর জমিনে চরে বেড়াবে। অসৎ উদ্দেশ্যে একে স্পর্শও করবে না। নইলে তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি পাকড়াও করেবে। স্মরণ করো, তোমাদেরকে আ’দ জাতির পরে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। তোমাদেরকে পৃথিবীতে ঠিকানা দিয়েছেন। তোমরা নরম মাটিতে অট্টালিকা নির্মাণ করো এবং পর্বত-গা খোদাই করে প্রকোষ্ট নির্মাণ করো। অতএব তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্বীকার করো এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক নেতৃবৃন্দ দরিদ্র ঈমানদারকে জিজ্ঞেস করলো: তোমরা কি বিশ্বাস করো, সালেহকে তার পালনকর্তা প্রেরণ করেছেন? তারা বললো: আমরা তো তার আনিত বিষয়ের প্রতি বিশ্বাসী। অহংকারীরা বললো: তোমরা যে বিষয়ে বিশ্বাস করছো আমরা তা বিশ্বাস করি না। তারপর তারা উটনীকে হত্যা করে ফেললো এবং স্বীং প্রতিপালকের নির্দেশ অমান্য করলো। তারা আরও বললো: হে সালেহ! নিয়ে এসো তোমার সেই শাস্তি যর ভয় আমাদেরকে দেখাচ্ছ যদি তুমি রাসূল হয়ে থাক। অতপর তাদেরকে পাকড়াও করলো ভূমিকম্প। ফলে সকালবেলায় নিজ নিজ গৃহে তারা মুখ থুবড়ে পড়ে রইলো। (সূরা আল-আরাফ: ৭৩-৭৮)
আল-কুরআনের যেখানেই এ ধরনের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে সেখানেই সকল নবী-রাসূলের সাথে মিলে যায়। এ অবস্থা প্রত্যেক নবীর সময়ই চলেছে। চলতে চলতে অবশেষে মুহাম্মদ (স) পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে। কল্পনার চোখে আমাদরে সামনে ভেসে উঠে সেই দৃশ্য- কাফিরদের সামনে তিনি কালিমার দাওয়াত পেশ করেছন ঠিক সেইভাবে, যেভাবে অতীতের নবী-রাসূলগণ পেশ করেছেন। এদিকে কাফিররা তাঁর সাথে ঠিক সেই আচরণই করছে যে আচরণ পূর্ব থেকে চলে আসছিল্ নবী-রাসূলদের এ সমস্ত ঘটনাবলীর ধারাবাহিকতা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করলে এর মধ্যে অবারিত সৌন্দর্য ও সুষমা দৃষ্টিগোচর হয়।
২. কাহিনী দ্বীনি উদ্দেশ্যের অনুগামী হওয়ার আরেকটি পরিণতি এটিই ছিল যে, ঘটনার ঠিক ততোটুকুই উপস্থাপন করা হয যতোটুকু উদ্দেশ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ। এ ব্যাপারে আল-কুরআন এক বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করেছে যা একটি বিশেষ নিয়ম হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে। যেমন সূরা অবতীর্ণের ক্রমানুসারে ঘটনাবলী বর্ণনা করার পর যে সূরায় গিয়ে শেষ কিস্তি বর্ণিত হয়েছে সেখানে দ্বীনি উদ্দেশ্যের সাথে সাথে শৈল্পিক দিকটিও পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। আবার এমনও দৃষ্টিগোচর হয়, শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কাহিনী শেষ করা হয়েছে কিন্তু সেখানে দ্বীনি উদ্দেশ্যের বর্ণনা নেই।
আমরা হযরত মূসা (আ)-এর ঘটনায় দেখেছি, সূরা আল-মায়িদায় যার শেষ কিস্তি বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বনী ইসরাঈলের ওপর বিভিন্ন অনুগ্রহের কথা বলা হয়েছে, যেসব অনুগ্রহ আল্লাহ বিভিন্ন সময়ে তাদেরকে করেছিলেন। কিন্তু এতো অনুগ্রহ প্রাপ্তির পরও তাদের সামান্য কৃতজ্ঞতাবোধও ছিল না। তাদেরকে আল্লাহর নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও তারা পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ করতে রাজী হয়নি। তাই তাদেরকে তীহ্ প্রান্তরে নির্বাসন দিযে এমন শাস্তির সম্মুখীন করা হয়েছিল, একমাত্র মৃত্যুই ছিল সেখান থেকে পরিত্রাণের উপায়।
এখানে একটি দ্বীনি উদ্দেশ্য ছিল। তীহ্ প্রান্তরের দৃশ্যে ঘটনার যবনিকাপাতের মাধ্যমে শৈল্পিক সৌন্দর্যের উচ্চতর বিকাশ ঘটান হয়েছে। তীহ্ প্রান্তরের দৃশ্য ছাড়া অন্য কোথাও এ কাহিনী শেষ করলে তা এতো চমকপ্রদ হতো না।
আসু আমরা আরও কতিপয় ঘটনাবলীতে উপরিউক্ত সূত্রটি সন্ধান করি।
[২.১] হযরত ইবরাহীম (আ)-এর ঘটনাবলী আল-কুরআনে প্রায় বিশ জায়গায় বর্ণিত হয়েছে। সর্বশেষ কিস্তি বর্ণনা করা হয়েছে সূরা আল-হাজ্জে। এ ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছে এভাবে:
(আরবী**********)
যখন আমি ইবরাহীমকে বাইতুল্লাহর স্থান ঠিক করে দিয়ে বলেছিলাম: আমার সাথে আর কাউকে শরীক করো না এবং আমার ঘরকে পবিত্র রাখ তাওয়াফকারী, নামাযে দণ্ডয়মান এবং রুকু-সিজদাকারীদের জন্য। আর মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা করে দাও। তারা তোমার কাছে পায়ে হেঁটে এবং কৃশকায় উটের পিঠে চড়ে আসবে দূর-দূরান্ত থেকে। (সূরা হজ্জ: ২৬-২৭)
দ্বীনি দৃষ্টিকোণ থেক দেখলে দেখা যায়, হযরত ইবরাহীম (আ)-এর দ্বীনে হাজ্জের রুকন (শর্তাবলী) তাই ছিল যা নবী করীম (স)-এর শরীয়তে ফরয করা হয়েছে। তারই উল্লেখ করা এখানে উদ্দেশ্য। তদ্রূপ সূরা আল-হাজ্জের শেষ দিকে (অবতীর্ণক্রম একশত তিন) হযরত ইবরাহীম (আ) সম্পর্কে বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
তোমাদের পিতা ইবরাহীমের দ্বীনে কায়েম থাক। তিনিই তোমাদের নাম মুসলিম রেখেছেন পূর্বে (এবং এ কুরআনেও)। (সূরা হাজ্জ: ৭৮)
যদি নির্ভেজাল শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় তবে দেখা যাবে- যে জায়গায় এবং যেভাবে হযরত ইবরাহীম (আ)-এর ঘটনা শেষ করা হয়েছে, এর চেয়ে ভাল কোন দৃশ্য আর ছিল না। যেখানে এ ঘটনা শেষ করা হয়েছে, এর চেয়ে ভাল কোন দৃশ্য আর ছিল না। যেখানে এ ঘটনা শেষ করা হয়েছে, এর চেয়ে ভাল কোন দৃশ্য আর ছিল না। যেখানে এ ঘটনা শেষ করা যেত এবং দ্বীনি উদ্দেশ্যও পূর্ণমাত্রায় সফল হতো। অবশ্য সেখানেও এ ঘটনা শেষ করা যেত যেখানে কা’কবা নির্মাণের পর হাজ্জের জন্য লোকদেরকে আহ্বান কিংবা কা’বা নির্মাণের আগে কলিজার টুকরো শিশু ইসমাঈল (আ)-কে এক নির্জন উপত্যকায় রেখে আসা হচ্ছিল। কিন্তু তাতে দ্বীনি উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হতো না।
[২.২] হযরত ঈসা (আ)-এর ঘটনা দেখুন যা আল-কুরআনে আট জায়গায় বর্ণিত হয়েছে। সর্বশেষ কিস্তি বর্ণিত হয়েছে সূরা আল-মায়িদায়। (অবতীর্ণের ক্রমধারা-১১২)। সেখানে বলা হয়েছে:
(আরবী**********)
যখন আল্লাহ বলবেন: হে ঈসা ইবনে মারইয়াম! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলে, আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে এবং আমার মাকে উপাস্য বানিয়ে নাও? ঈসা বলবে: আপনি পবিত্র, আমার শোভা পায় না যে, আমি একথা বলি আর তা বলার অধিকারও আমার নেই। যদি আমি বলে থাকি তবে আপনি অবশ্যই তা অবহিত। আপনি তো আমার মনের কথাও জানেন এবঙ আমি জানি না যা আপনার মনে আছে। নিশ্চয়ই আপনি অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞাত। আমিতো তাদেরকে কিছুই বলিনি, শুধু তাই বলেছি যা আপনি বলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তোমরা আল্লাহর দাসত্ব করো, যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা। আমি তাদের সম্পর্কে অবগত ছিলাম যতোদিন তাদের সাথে ছিলাম। যখন আপনি আমাকে লোকান্তরিত করলেন, তখন থেকেই আপনিই তাদের সম্পর্কে অবগত আছেন। আপনি সর্ববিষয়ে পরিজ্ঞাত। যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন তবে তারা আপনা বান্দা, আর যদি তাদেরকে মাফ করে দেন তবে আপনিই প্রবল পরাক্রান্ত মহাবিজ্ঞ। (সূরা আল-মায়িদা: ১১৬-১১৮)
দেখুন, হযরত ঈসা (আ)-এর ঘটনার উপসংহারও টাসনা হয়েছে দ্বীনি ও শৈল্পিক উভয়টির সমন্বয়ে।
একদিকে দ্বীনি উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে, অন্যদিকে শৈল্পিক সৌন্দর্যও পূর্ণতা লাভ করেছে। ঈসা (আ)-এর জন্মের ব্যাপারটিই ব্যতিক্রম- অলৌকিক। সেই জটিলতার। শেষ মুহূর্তে তিনি সৃষ্টিকর্তার সামনে দাঁড়িযে নিজের দাসত্বের স্বকিারোক্তি এবং জাতিকে যে কথা বলা হয়েছে তার সাক্ষ্য প্রদান এবং সর্বশেষ এ ব্যাপারটি পরাক্রমশালী ও মহাবিজ্ঞানী আল্লাহর নিকট সোপর্দ করা।
যেখানে এ কাহিনী শেষ করা হয়েছে শৈল্পিক দাবিও ছিল কাহিনীটি সেখানেই শেষ হোক। এ কাহিনী শেষ কার জন্য এর চেয়ে ভাল কোন জায়গা আর ছিল না।
[২.৩] হযরত আদম (আ)-এর ঘটনা কুরআনের সব ক’টি জায়গায়ই তাঁকে পৃথিবীতে পাঠানোর বর্ণনার মাধ্যমে শেষ করা হয়েছে। তার সাথে শুধু এতোটুকুন বর্ধিত করা হয়েছে, তিনি অপরাধের মা’ফ চেয়েছেন এবঙ আল্লাহ তাকে মা’ফ করে দিয়েছেন। তারপর আল-কুরআন নীরব- (যদিও তওরাতে আরেকটি বিস্তারিত বর্ণনা এসেছে) তার কারণ- হযরত আদম (আ) তাঁর পুরনো দুশমন শয়তানের পরামর্শ গ্রহণ এবং আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার পরিণতিতে পৃথিবীতে প্রেরণ। এখানেই দ্বীনি উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যায়।
শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যাবে, প্রতিটি সমাপ্তি বিন্দুতে সেই জিনিস বর্তমান, যার অনুসন্ধান একজন শিল্পী করে থাকে। একজহন শিল্পীর জন্য শুধু এ কথাই যথেষ্ট, হযরত আদম (আ) নিজের অপরাধের কারণে জান্নাত থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। তারপর মানুষের চিন্তা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তিনি চিন্তা করতে পারেন- হযরত আদম ও হাওয়া আনাড়ীভাবে কোথায় কোথায় ঘুরেছেন? তাদের জীবনযাত্রা এবং অর্থনৈতিক লেনদেন কেমন ছিল? এরূপ নানা প্রকার খেয়ালী প্রশ্ন। এ ঘটনার সাথে এসব বিষয় আলেঅচনায় এলে শৈল্পিক সৌন্দর্য ভাটা পড়তো। তাই যেখানে শেষ করা হয়েছে সেখানে শৈল্পিক সৌন্দর্য কোন ভাটা পড়েনি।
[২.৪] হযরত সুলাইমান (আ)-এর ঘটনা আল-কুরআনে মোট তিন জায়গায় বর্ণিত হয়েছে। সর্বশেষ যে সূরায় এ ঘটনার বিবৃত হয়েছে তা সূরা আল-আম্বিয়া (অবতীর্ণক্রম তিয়াত্তর)। এ সূরায় ঘটনার শেষ কিস্তি বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে:
(আরবী**********)
এবং স্মরণ করো, দাউদ ও সুলাইমানকে, যখন তারা শস্যক্ষেত সম্পর্কে বিচার করছিল। তাতে রাতে কিছু মেষ ঢুকে পড়েছিল। তাদের বিচার আমার সামনে ছিল। অতপর আমি সুলাইমানকে সে ফয়সালা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম এবং আমি উভয়কে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছিলাম। আমি পর্বত ও পাখীকূরকে দাউদের অনুগত বানিয়ে দিয়েছিলাম, তারা আমার পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করতো। এগুলো আমিই করেছিলাম। আমি তাকে তোমাদের জন্য বর্ম নির্মান শিক্ষা দিয়েছিলাম যাতে তা যুদ্ধে তোমাদেরকে রক্ষা করে। অতএব তোমরা কি কৃতজ্ঞ হবে? আর বায়ুকে সুলাইমানের অধীন করে দিয়েছিলাম, তা তার নির্দেশে প্রবাহিত হতো ঐ দেশের দিকে, যেখানে আমি কল্যাণ দান করেছি। আমি সব বিষয়েই সম্যক অবগত রয়েছি। আর শয়তানের কতককে তার অধীন করে দিয়েছিলাম, তারা তার জন্য ডুবুরীর কাজ করতো এবঙ এছাড়া অন্য আরও অনেক কাজ করতো। আমি তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতাম। (সূরা আম্বিয়া: ৭৮-৮২)
হযরত সুলাইমান (আ)-এর ঘটনায় বেশি বিষয়বস্তু ও উদ্দেশ্য পাওয়া যায়। সেখানে দ্বীনি হিকমত এবং প্রজ্ঞাও বিদ্যমান। কিন্তু বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় ঘটনার সমাপ্তিতে দ্বীনি উদ্দেশ্য ও শৈল্পিক বিষয়ের মধ্যে কোন সংগতি নেই। শৈল্পিক দাবি ছিল হযরত সুলাইমান (আ)-এর ঘটনা ঐ দৃশ্যে সমাপ্তি টানা যেখানে তাঁর মৃত্যুর বর্ণনা দেয়া হয়েছে এবং তিনি মৃত্যুর পরও লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
নিঃসন্দেহে এ দৃশ্য কাহিনী শেষ করার জন্য যথার্থ ছিল। হযরত সুলাইমান (আ)-এর জীবনে শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশাসন ও প্রজ্ঞা উভয়ই পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছিল। হযরত সুলাইমন (আ) যেমন একজন বিচারক ঠিক তেমনি একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। কুরআনে বর্ণিত দৃষ্টান্তে যেমন আল্লাহ প্রদত্ত বিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার প্রকাশ ঘটেছে। অপরদিকে বিশাল সাম্রাজের প্রাশাসনের দিকটিও এসেছে। বস্তুত কাহিনীর পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছে এমন এক উপসংহারের মাধ্যমে যেখানে গোটা জিন্দেগীর ওার সার-সংক্ষেপ আলোচনা করা হয়েছে। আলোচ্য আয়াতে শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের তৎপরতার বর্ণনা এসেছে এবং সবকিছুকে এক কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়েই ঘটনার সমাপ্তি ঘটানো হয়েছে।
[২.৫] আল-কুরআনের অনেক জায়গায় বিভিন্ন নবী-রাসূলের ঘটনাবলী সংক্ষিপ্তকারে বর্ণনা করা হয়েছে, তার সমাপ্তিও হয়েছে শৈল্পিক দাবি অনুযায়ী এবং সেখানে দ্বীনি উদ্দেশ্যও প্রকাশিত। ইরশাদ হচ্ছে:
(আরবী**********)
তারা যদি তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে বলুক, তাদের পূর্বেও মিথ্যেবাদী বলেছে নূহ, আদ, সামুদ, ইবরাহীম ও লূতের সম্প্রদায় এবং মাদইয়ানের অধিবাসীরা এবং মূসার সম্প্রাদায়ও তাদেরকে মিথ্যেবাদী বলেছৈ। তারপরও আমি কাফিরদেরকে সুযোগ দিয়েছিলাম। পরে আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি। দেখ, কী ভীষণ ছিল আমাকে অস্বীকৃতির পরিণাম। (সূরা হজ্জ: ৪২-৪৩)
এতে কোন সন্দেহ নেই, এ সমাপ্তিতে দ্বীনি উদ্দেশ্য ও শৈল্পিক সৌন্দর্যের পূর্ণমাত্রায় বিকাশ ঘটেছে এবং তা সঠিক জায়গায় সমাপ্ত হয়েছে।
[২.৬] হযরত ইউসুফ (আ)-এর ঘটনাটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্টি করেছে। যার শুরু হয়েছে ইউসুফ (আ)-এর স্বপ্নের মাধ্যমে এবং শেষ হয়েছে স্বপ্নকে পূর্ণতা দিয়ে। হযরত ইউসুফ (আ)-এর ভাইদের লজ্জাবনত মস্তকে উপস্থিতি এবং পিতা-মাতার প্রত্যাবর্তন ও মিলনের মাধ্যমে ঘটনার সমাপ্তি টানা হয়েছে। এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা হয়নি। কারণ ঘটনা বর্ণনার যে দ্বীনি উদ্দেশ্য ছিল তা পুরা হয়ে যাওয়ায় অন্যত্র এ কাহিনীর পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়নি।
৩. কাহিনী বর্ণনার দ্বীনি উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে আরেকটি দাবি ছিল, তা স্থান কাল ও পাত্রের সাথে সংগতিপূর্ণ হবে, যেখানই তা বর্ণনা করা হোক না কেন। এদিক থেকে এটি একই রঙ ও শিল্পের পূর্ণ প্রতিনিধিত্ব করে, যে প্রসঙ্গে ইতোপূর্বে আমরা আলা এক অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। সেই অধ্যায়ে আমরা কুরআনী চিত্রের বিভিন্ন রঙ ও অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেছি।
ঘটনায় বর্ণিত বিষয়ের মধ্যে যে পরিমাণ মিল ও সামঞ্জস্য পাওয়া যেতে পারে আমরা তা কুরআনী কাহিনী দ্বীনি উদ্দেশ্যের অনুগামী হওয়ার দির্শন’ শিরোনামে আলোচনা করেছি এবং সেখানে নিম্নোক্ত আয়াতটি দিয়ে উদাহরণও দিযেছি:
(আরবী************)
তুমি আমার বান্দাদেরকে জানিয়ে দাও, আমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল দয়ালু এবং আমার শাস্তিও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। (সূরা হিজর: ৪৯-৫০)
তারপর এমন একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে সেখানে উপরোক্ত বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হয়। এখন আমরা আরও কিছু উদাহরণ বর্ণনা করবো যেখানে দ্বীনি উদ্দেশ্য এবং শৈল্পিক বিন্যাস একটি আরেকটি পরিপূরক।
[৩.১] সূরা আল-আ’রাফে হযরত আদম (আ)-এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে:
(আরবী************)
আর আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, এরপর আকার-অবয়ব তৈরী করেছি। পরে আমি ফেরেশতাদেরকে বলেছি আদমকে সিজদা করো, তখন সবাই সিজদা করেছে কিন্তু ইবলিস সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। আল্লাহ্ বললেন: আমি যখন নির্দেশ দিযেছি, তখন কিসে তোকে সিজদা থেকে বিরত রাখল? সে বললো: আমি তা চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দিয়ে। আল্লাহ বললে: তুই এখান থেকে যা। এখানে অহংকার করার কোন অধিকার তোর নেই, বেরিয়ে যা। তুই নীচ ও হীনদের অন্তর্ভুক্ত। সে বললো: আমাকে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত অবকাশ দিন। আল্লাহ বললেন: তোকে সময় দেয়া হলো। সে বললো: আপনি আমাকে যে উদভ্রান্ত করেছেন আমিও অবশ্য তাদের জন্য আপনার সরল পথের ওপর বসেথাকব। এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনে থেকে, পেছন থেকে, ডানে থেকে এবং বাম থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না। আল্লাহ বললেন: বেরিয়ে যাও এখান থেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে। তাদের যে-কেউ তোর পথে চলবৈ, অবশ্যই আমি তাদের দিয়ে জাহান্নাম পূর্ণ করবো। হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করো। অতপর সেখান থেকে যা ইচ্ছে খা। তবে ঐ বৃক্ষের কাছেও যেও না। তাহলে তোমরা জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। অতপর শয়তান তাদের উভয়কে প্ররোচিত করলো, যাতে তাদের অঙ্গ- যা গোপন ছিল- তাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়। সে বললো: তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করেননি, তবে তা এ কারণে যে, তোমরা না আবার ফেরেশতা হয়ে যাও। কিংবা হয়ে যাও চি রকাল বসবাসকারী। সে তাদের কাছে কসম খেবেয় বললো: আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাংখী। অতপর প্রতারণার দ্বারা তাদেরকে সম্মত করে ফেললৈা। অনন্তর যখন তারা বৃক্ষ আস্বাদন করলো, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের সামনে খুলে গেল এবং তারা নিজের ওপর জান্নাতের পাতা জড়াতে লাগল। তাদের প্রতিপালক তাদেরকে ডেকে বললেন: আমি তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? তারা উভয়ে বললো: হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে মাফ না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন তবে আমরা অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব। আল্লাহ বললেন: তোমরা নেমে যাও, তোমরা একে অপরের শত্রু। তোমাদের জন্য পৃথিবীতে বাসস্থান আছে এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত সেখানে থাকতে হবে। আরও বললেন: তোমরা সেখানেই জীবন ধারণ করবে, মৃত্যুবরণ করবে এবং সেখানেই পুনরুত্থিত হবে। (সূরা আল-আ’রাফ: ১১-২৫)
এরপর ধারাবাহিকভাবে প্রসঙ্গ অব্যাহত রাখা হয়েছে। আদম সন্তানকে শয়তানের প্রতারণা থেকে বাঁচার নসিহত করে বলা হয়েছে: ‘হে আদম! তোমরা শয়তানের ধোঁকায় পড়ো না, যেভাবে তোমাদের পিতা-মাতা (আদম ও হাওয়া) পড়েছিল। ফলে তারা জান্নাত থেকে বহিস্কৃত হয়েছে।’
মানুষকে বলা হয়েছে যে, মুবাহ জিনিস থকেও সতর্ক থাক এবং আল্লাহ যা হালাল করেছেন তা হারাম করে নিও না। যেসব নবী-রাসূলদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠান হয়েছিল তাঁদের আনুগত্য করো। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে: ‘আমরা শয়তানকে তাদের বন্ধু বানিয়ে দিয়েছি যারা ঈমান গ্রহণ করে না।’ তারপর কিয়ামতের চিত্র পেশ করা হয়েছে। যারা আল্লাহর পাঠানো হেদায়েত অনুযায়ী চলেছিল তারা আল্লাহর দরবারে উপস্থিত। এমনিভাবে যারা শয়তানের অনুসরণ করেছিল তারাও জবাবদিহির জন্য আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান। এর শেষ হয়েছে এভাবে, একদল জান্নাতে প্রবেশ করলো এবং আরেক দল জাহান্নামে। আরও সামনে অগ্রসর হয়ে বলা হ য়েছে আরাফবাসীগণ অন্যদেরকে ডেকে বলবে: ‘ভয়-ভীতি ছাড়া সরাসরি জান্নাতেগ প্রবেশ করে যাও।’ অন্যদিক থেকে ফেরেশতাগণ ডেকে বলবে: ‘এটি ঐ জান্নাত যা তোমাদের নেক আমলের বিনিময়ে তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে।’ যে সম্পর্কে আমরা ‘শৈল্পিক চিত্র’ অধ্যায়ে আলোচনা করেছি।
আসল কথা হচ্ছে, শয়তানের অনুসরণ করার কারণেই তাকে জান্নাত থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে আবার শয়তানের অনুসরণ না করার কারণেই জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। তাদের প্রত্যাবর্তন ঐ ব্যক্তির প্রত্যাবরতনের মতো যে নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে গেল এবং কিছুদিন পর পুনরায় নিজের বাড়ি চলে এলো। এখানে ‘বের হওয়া এবং প্রবেশ করার’ মধ্যেই শৈল্পিক সৌন্দর্য নিহিত। এ প্রসঙ্গে আলোচনার আসল জায়গা সেইটি যেখানে আমরা ‘শৈল্পিক বিন্যাস’ সম্পর্কে আলোচনা করেছি।
আমরা এ আলোচনা এখানে শেষ করলাম এ আশায়, পাঠকগণ এরই আলোকে অন্যান্য ঘটনাবলী যাচাই করতে পারবেন।