২৭. বিপ্লবের প্রক্রিয়া
কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ইসলামী বিপ্লবের সূচনা হবে এ বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে আলোচিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। মুসলিম দেশগুলোতে বিভিন্ন ধরণের সরকার চালু রয়েছে। ক্ষমতার হাত বদলই যেহেতু ইসলামী বিপ্লবের মূলকথা নয় সেহেতু উল্লেখিত শর্তসমূহ পূরণের পাশাপাশি সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তন আনয়নের উদ্দেশ্যে এক পর্যায়ে ইসলামী আন্দোলনকে ক্ষমতায় উত্তরণ করতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় দায়দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। এ পুস্তিকায় বিভিন্ন অধ্যায়ের আলোচনায় এটা সুস্পষ্ট হয়েছে যে, নিছক ক্ষমতা দখল ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্য নয়। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনকে এক পর্যায়ে অবশ্যই ক্ষমতা নিতে হবে। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে ক্ষমতার উত্তরণ সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা না থাকলে বিভ্রান্তি অনিবার্য। আর চিন্তার এ বিভ্রান্তি আন্দোলনের সংহতিকেই শুধুমাত্র বিনষ্ট করে না বরং আন্দোলনে ভাংগন সৃষ্টি, বড় ধরণের মতপার্থক্য এবং পরিণতিতে লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার আশংকা বিদ্যমান। তাছাড়াও এ নিয়ে অপরিপক্ক বিতর্কে পরিবেশ নষ্ট এবং সময় ক্ষেপন হতে বাধ্য। আন্দোলনের কর্মকৌশলেও স্থিতিশীলতার অভাব দেখা দিতে পারে এবং ঝোঁক প্রবণ যে কোন সিদ্ধান্তও ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে।
বর্তমান যুগে আন্দোলনের জন্য একটি বড় সুবিধাজনক দিক এটা যে, বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত মহানবী সা-এর জীবনী ও কর্মপন্থা, খুলাফায়ে রাশেদীনের দৃষ্টান্ত, উমর বিন আবদুল আজিজ র. থেকে শুরু করে বিগত প্রায় দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের ইতিহাস, ইমাম মুজতাহিদগণের সংগ্রামী সাধনার অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে রয়েছে। তাছাড়াও ফরাসী বিপ্লব ও রুশ বিপ্লবসহ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঘটনাবলীর শিক্ষা ও দৃষ্টান্ত আমাদের পর্যালোচনা করে দেখার সুযোগ রয়েছে। গণতন্ত্রের সাফল্য ও ব্যর্থতার ইতিহাসও আমাদের সামনে মওজুদ আছে। এমতাবস্থায় মানবতার সত্যিকার কল্যাণ সাধনের জন্য নিবেদিত একটি বিপ্লবী অর্থাৎ ইসলামী বিপ্লবের বাস্তব প্রক্রিয়া কি হতে পারে বা কি প্রক্রিয়া ইসলামী আন্দোলনে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারে এ প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাবের জন্য আমরা নিম্নোক্ত প্রক্রিয়াসমূহ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে পারিঃ
১. সশস্ত্র সংগ্রাম
২. সামরিক অভ্যুত্থান
৩. ক্ষমতাসীন সরকারে যোগদান
৪. নির্বাচন
৫. গণআন্দোলন
সশস্ত্র সংগ্রাম
সশস্ত্র সংগ্রামের ধারণাটা মূলত সমাজতন্ত্রীদের বা কম্যুনিষ্টদের। অস্ত্রবলে ক্ষমতা দখল, রাজ্য দখল আগের যামানায় রাজা বাদশাহ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর প্র্যাকটিস ছিল। কিন্তু সশস্ত্র সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত সরকার উৎখাত করে কোন নতুন আদর্শ প্রতিষ্ঠার চিন্তাধারাটা সমাজতন্ত্রের অবদান। সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে সরকারের পতন ঘটানো হয়তোবা অসম্ভব কোন ব্যাপার নয়। কিন্তু এর মাধ্যমে যে মানবতার কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে এমন দাবী বোধ হয় যুক্তিসংগত হবে না। এ ধরণের প্রক্রিয়ায় অস্ত্রধারী একটি মহল ক্ষমতায় আসতে হয়তোবা সক্ষমও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু জনগণের মাথার উপর তরবারী ঝুলিয়ে রেখে কোন বিপ্লব সাধন করে জনগণের কোন কল্যাণ করার কথা চিন্তা করা অর্থহীন। স্বাধীনতা সংগ্রাম কিংবা মুক্তি আন্দোলনের জন্য সর্বাত্মক সশস্ত্র সংগ্রাম বা গণযুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। কিন্তু তাতেই যে অর্থবহ কোন সমাজ পরিবর্তন বা আদর্শের বিপ্লব ঘটে যাবে এমন গ্যারান্টি দেয়া যায় না।
সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটিয়ে ইসলামী সরকার কায়েমের চিন্তা কারো মধ্যে দেখা দেয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে যে, তরবারী, কামান, বন্দুকের জোরে কোন জনপদে ইসলাম কায়েম করে দেয়া যায় না। ইসলামী বিপ্লবের জন্য মানসিক বিপ্লব সাধন এক অনিবার্য প্রাথমিক অধ্যায়। কিছু লোক কামান বন্দুক ও গোলা বারুদ হাতে নিয়ে বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবেন এটিই যদি ইসলামী বিপ্লবের কর্মপন্থা হতো তাহলে ইসলামের মহান আল্লাহর রাসূল সা. তাই করতেন। বিপ্লবকে সুসংহত করার জন্য কিংবা প্রতিবিপ্লবী শক্তির দূর্গ চূর্ণ করে দেয়ার জন্য নবীজী সা. ও সাহাবায়ে কেরামকে এক পর্যায়ে অস্ত্র হাতে নিতে হয়েছে। কিন্তু তা বিপ্লবের সূচনাকালে কিংবা বিপ্লবকালে নয় বরং বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ন্যায়সংগতভাবেই তা করতে হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের হেফাজত ও নিরাপত্তার জন্য তা ছিল অনিবার্য। সশস্র সংগ্রাম করে ইসলাম কায়েমের চিন্তা মূলতঃ একটি হঠকারী চিন্তা। কেননা ইসলামী আদর্শ তা অনুমোদন করে না। সরকার গঠন, কর্তৃত্ব বা কমাণ্ড প্রতিষ্ঠার পূর্বে অস্ত্রের ব্যবহার ইসলামী শরীয়ত অনুমোদন করে না। পরিস্থিতির চাপে অস্ত্র হাতে নেয়ার ফলাফল কি দাঁড়িয়েছে তার কিছু দৃষ্টান্ত মধ্যপ্রাচ্যের কোন কোন দেশে লক্ষ্য করা গিয়েছে। অস্ত্রের এ চর্চার কারণে সেখানকার ইসলামী আন্দোলনে ব্যাপক মতভেদ ও গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। ইখওয়ানূল মুসলেমীনের মত সংগঠন- যে সংগঠন মিশর, সিরিয়া, সুদান, জর্দানসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে এক দারুণ আশাবাদের সঞ্চার করেছিল সেই সংগঠনেও অস্ত্র ব্যবহারের প্রশ্নে সংকট সৃষ্টি হয়। অবশ্য সেখানকার বিশেষ করে সিরিয়ার পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। আর মিশরের অস্ত্রের ব্যবহারটা প্রশিক্ষণ এবং একটি বিশেষ গ্রুপ পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল। তথাপি ঠুনকো অযুহাতে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় ক্ষমতাসীন সরকার ইখওয়ানের উপর চড়াও হয় এবং এ শতাব্দীর সাড়া জাগানো অন্যতম এ আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে সক্ষম হয়। সাম্রাজ্যবাদ অবশ্য অস্ত্র ব্যবহার না করলেও অন্য যেকোন অজুহাত সৃষ্টি করে ইসলামী আন্দোলনকে খতম করতে পারে। কিন্তু সশস্ত্র এবং সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত করে বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হবে না সে অবস্থায়। ইখওয়ানের অস্ত্রের প্রশ্নে সামান্য সংশ্লিষ্টতাকে অবলম্বন করে ইখওয়ানের উপর যেভাবে আঘাত হানা সম্ভব হয়েছিল তা অন্যদিক থেকেও ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। এ ঘটনার ফলে আন্দোলনের অভ্যন্তরেও সুস্পষ্ট মতপার্থক্য এবং চিন্তা অনৈক্য সৃষ্টি হয়। এ খেসারত মধ্যপ্রাচ্যের জনগণকে এখনও দিতে হচ্ছে। ইখওয়ানের পরিচালিত ইসলামী আন্দোলন আযাদী লাভ থেকে শুরু করে প্রায় ৭০ বছর যাবত সংগ্রাম চালিয়েও মিশরে ইসলামী বিপ্লব ঘটাতে নানা বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে একটি জেনারেশনের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। যদিও ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যের জন্য নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা নেই। তবে কোন সময়সীমা যে নেই এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্বই আমাদের দায়িত্ব একথা কম লোকেই বুঝে থাকে। অন্যথায় সকলেই আন্দোলনের একটি সাফল্য বা পূর্ণতা দেখতে চায়। মিশরে এত শক্তি অর্জন করার পরও বিপ্লব সংঘটনে সাফল্য লাভ করেনি। ফলে দুনিয়াবী সাফল্য সম্পর্কে প্রশ্ন সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। যদিও বা আদর্শিক বিপ্লবের জন্য ষাট সত্তর বছর সময় কোন সময় নয়। অনেকে মনে করেন যে, সশস্ত্র একটি গ্রুপ গঠনে উৎসাহ যুগিয়ে ইখওয়ান ভুল করেছিল। এ গোপন গ্রুপের তৎপরতার কারণে বাহ্যিক অসুবিধার সাথে সাথে আন্দোলন আভ্যন্তরীণভাবেও সংকটের সম্মুখীন হয়। এ কারণেই আন্দোলনে সাফল্যও পিছিয়ে যায়। ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। অবশ্য এ সম্পর্কে মন্তব্য করা কঠিন যে, ইখওয়ানের জন্য কোনটা সঠিক ছিল আর কোনটা সঠিক ছিল না। এ আন্দোলনকে আমরা যতটা জানতে পেরেছি তাতে এই একটি মাত্র দিক ছাড়া বড় ধরণের অন্য কোন ত্রুটি আমাদের নজরে পড়ে না। কর্মী বাহিনী ত্যাগ-তিতিক্ষা, নিষ্ঠা-আদর্শবাদিতা, যোগ্যতা, দক্ষতা সোনালী অক্ষরে লিখিত থাকবে। নেতৃত্বের সাহসিকতা, বলিষ্ঠতা এবং কোরবানী আধুনিক বিশ্বের মানুষদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তথাপি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চক্রান্ত ইখওয়ানের আন্দোলনের পথে বড় বাধা হলেও ক্ষমতা উত্তরণের প্রক্রিয়া সম্পর্কিত আলোচিত চিন্তাধারাও যে এ আন্দোলনের সাফল্যের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে একথা অনেকটা জোর দিয়ে বলা যেতে পারে।
সাম্প্রতিক বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় উজ্জীবিতদের সশস্ত্র সংগ্রামের ইতিহাস কমবেশী আমাদের সামনেই আছে। সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান, শ্রেণী শত্রু খতম করার শ্লোগান এবং অস্ত্রের সাহায্যে শত্রু খতম করে সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ কায়েমের মন্ত্রে বিশ্বের দিকে দিকে যুব সমাজ এক সময় আলোড়িত হয়েছে। আমাদের উপমহাদেশে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাকে সাড়া দিয়ে কত অসংখ্য নেতা, সংগঠক এবং প্রতিভাবান যুবকদের এক বিশাল অংশ যেভাবে ঝুঁকে পড়েছিল এবং পরবর্তীকালে যে মর্মান্তিক ও দুঃখজনক পরিণতির সম্মুখীন হয়েছে তাতে সশস্ত্র সংগ্রাম সম্পর্কে এটা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ক্ষমতা পরিবর্তন, বিপ্লব সাধন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল ও জনগণের কল্যাণের জন্য এ পথ কোন সুস্থ পথ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে না। রাশিয়া থেকে অস্ত্রপাতি, সোনাদানা, টাকা-পয়সা ভারতে এনে এখানে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটানোর আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে সন্ত্রাসবাদী সূর্যসেনদের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের হঠকারী রাজনীতি আমাদের সামনেই আছে। কম্যুনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলা, গোপন সংগঠনের মাধ্যমে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে কর্মীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দান ও গলাকাটা রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ সকল প্রচেষ্টার যোগফল হয়েছে অবশেষে শূণ্য। কম্যুনিষ্ট আন্দোলন এ উপমহাদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন তো দূরের শত্রু নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে নানা বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে কম্যুনিষ্ট আন্দোলনে শুধু এ উপমহাদেশেই নয় বিশ্বব্যাপী বিভ্রান্তির ফলে অসংখ্য উপদল ও গ্রুপে কম্যুনিষ্ট আন্দোলন বিভক্ত হয়ে পড়ে। সন্ত্রাসবাদী কায়দায় আন্দোলনে সাফল্য আনায় যারা বিশ্বাসী তারাও নানা উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়। সশস্ত্র সংগ্রাম ও সন্তাসবাদীদের এ বিপর্যয় থেকে এটা আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, অস্ত্রের বলে কিংবা সশস্ত্র পন্থায় মানব কল্যাণের জন্য কোন বিপ্লব উপহার দেয়া তো দূরের কথা সশস্ত্র সংগ্রাম ও সন্ত্রাসবাদের চক্কর থেকে কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের উদ্ধার পাওয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও কম্যুনিষ্টদের কোন কোন গ্রুপ বা দল সশস্ত্র লাইন পরিহার করার কথা ঘোষণা করেছে তথাপি জনগণের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের শ্লোগান দিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবী গণবাহিনী গঠন করে চমক সৃষ্টির মাধ্যমে বিপ্লবের পদক্ষেপ নিয়েও তারা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। সশস্ত্র সগ্রাম প্রয়াসীদেরকে কম্যুনিষ্টদের একটি বিরাট অংশও আজ অতিবিপ্লবী হঠকারিতা বলে প্রত্যাখ্যান করেছে। নিকট অতীতে বাংলাদেশেও সশস্ত্র সংগ্রাম ও শ্রেণী সংঘাতের মাধ্যমে যারা রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রয়াস চালিয়েছে তারাও এখন সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে ইস্তফা দিয়েছে। কোন কোন সশস্ত্র পার্টি আজ কেবল মাত্র সশস্ত্র ডাকাত দলে পরিণত হয়েছে। গুপ্ত হত্যা, সন্ত্রাস, ডাকাতি এবং লুটপাটই এখন তাদের কার্যক্রম। পশ্চিম বংগে নক্সাল পন্থী বলে কথিত সশস্ত্র সংগ্রামীরা আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন। একথা আজ বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিপ্লবে রঙ্গীন স্বপ্নের মোহ তারা বাস্তবতার নিরিখেই ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। গলাকাটা, সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির পথ পরিহার করে তথাকথিত বিপ্লবী এসব বিভ্রান্ত নেতারা নিজেরাই অতীতের ভুল সংশোধন করে স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরে আসছেন। বাংলাদেশে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সেনাবাহিনীর একটি অংশের সাথে যোগসাজশ করে শ্রেণী সংগ্রাম তথা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন করে যে হঠকারী কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল তার পরিণতি এ দেশের রাজনীতি সচেতন মানুষ অবহিত আছেন। সশস্ত্র বিপ্লবে যে রঙ্গীন স্বপ্ন তারা দেখেছিল তা শুধু ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়নি দলটি ভেঙ্গে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায়। দলের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিগণ এখন নানা ভাগে বিভক্ত ও কর্মীদের বিশাল অংশ হতাশ। দলের অন্যতম প্রাণ পুরুষ শেষ জীবনে ইসলামী রাজনীতি দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান দেশপ্রেমিককে হারিয়েছে। প্রতিভাবান ও সম্ভাবনাময় যুব রাজনৈতিক কর্মীদের সমাবেশ ঘটেছিল জাসদে কিন্তু হঠকারী ও অপরিপক্ক পদক্ষেপ এবং রাতারাতি বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলার নীল স্বপ্ন জাসদের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটিয়েছে এবং হতাশার সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত করেছে অনেক মেধাবী এবং সাহসী তরুণদের।
সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর পরই তদানীন্তন মুজিব সরকারের জন্য একটি হুমকির সৃষ্টি করেছিল। ছাত্র-যুবকদের মাঝে একটি নেটওয়ার্ক নানা ধরণের সশস্ত্র কর্মকাণ্ড পরিচালনা, থানা লুট ও ছিনতাই ইত্যাদির মাধ্যমে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। হক-তোয়াহার নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সিস্ট-লেলিনিস্ট) ও সাম্যবাদী দলের বিভিন্ন গ্রুপও হঠকারী কর্মকাণ্ড চালিয়ে গণবিচ্ছিন্ন খুনী ও ডাকাত দলে রূপান্তরিত হয়েছে। অবশ্য মোহাম্মদ তোয়াহা সহ বেশ কিছু নেতা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে গণতান্ত্রিক রাজনীতির লাইন গ্রহণ করেছিলেন। তাদের এই ভুল সংশোধন প্রমাণ করে সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতি স্বাভাবিক বা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু বেলা অনেক গড়িয়ে গিয়েছে। তারা যতক্ষণে তাদের ভুল অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছেন ততক্ষণে বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট অনেক বদলে গিয়েছে। কম্যুনিষ্টদের আন্তর্জাতিক মুরুব্বী রাশিয়া নিজেই ঝুঁকে পড়েছে সেই ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদী দুনিয়ার দিকে। সুতরাং একথা আজ দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যেতে পারে যে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে আদর্শ বা বিপ্লবের কোন ভবিষ্যত আর অবশিষ্ট নেই।
আমাদের এ স্বল্প পরিসর আলোচনায় সশস্ত্র সংগ্রামের ব্যর্থতার গোটা চিত্র তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে একথা সত্য যে, সশস্ত্র সংগ্রামে মানব কল্যাণে কোন পথ হতে যে পারে না তা আজ সুপ্রমাণিত। তাছাড়াও অস্ত্রের একটা নিজস্ব ধর্ম আছে। কোন গ্রুপ বা গোষ্ঠী হাতে যখন অস্ত্র দেয়া হবে তাদের চরিত্র আচরণে তার প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। ফেতনা ও বিপর্যয় সৃষ্টির জন্য অস্ত্রই যথেষ্ট। ইসলামী আন্দোলনে পরিসরেও তাই অস্ত্রের চিন্তা করা অজ্ঞতা এবং হঠকারিতারই ফসল । সুতরাং ইসলামী আন্দোলনে জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের চিন্তা করার কোন অবকাশই নেই।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট কোন দল ও প্রতিপক্ষের ছাত্র ও যুবক কর্মীদের মাঝে অস্ত্র ব্যবহারের একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ফলে তার মোকাবিলায় কেউ কেউ অস্ত্র ব্যবহারের প্রশ্নটি উত্থাপন করেন। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, অস্ত্রের জবাব বিক্ষিপ্তভাবে অস্ত্র দিয়ে দিতে গেলে বিপর্যয় সৃষ্টি হতে বাধ্য। বিশেষ করে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সাম্রাজ্যবাদী ও বিদেশী শক্তি এবং ক্ষমতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী শক্তিসমূহ এ রকম পরিস্থিতিতে বিশেষ গ্রুপ লালনের প্রক্রিয়া হিসাবে অস্ত্রের ব্যবহার করে থাকে। এর মোকাবিলা জনগণকে সংগঠিত করার মাধ্যমেই করতে হবে, অস্ত্রের মাধ্যমে নয়। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করেই এর জবাব দেয়া সম্ভব। রাজনৈতিকভাবে হতাশ এবং জনগণকে ভয় পায় এমন সব গ্রুপ অস্ত্র প্রয়োগে সাময়িক রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়। ধৈর্য ও হিকমতের সাথে ঐ অস্ত্রবাজদের মুখোশ উন্মোচিত করতে হবে। কেননা সন্ত্রাসবাদী শক্তি চায় অস্ত্রের খেলায় তারা যদি ইসলামী সংগঠনকে মাঠে নামাতে পারে তাহলে তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভূদের মাধমে সহজেই ইসলামী আন্দোলনকে ঘায়েল করা সম্ভব হবে। ঐসব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজ দেশে সশস্ত্র সংগ্রামের বিরোধিতা করলেও ছোট ছোট দেশগুলোতে নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে বা ইসলামী আন্দোলনের তৎপরতা স্তব্ধ করে দেয়ার স্বার্থে এমন ধরণের কূট কৌশল গ্রহণ করে থাকে। যেমন আমাদের দেশেও কোন কোন পাশ্চাত্যপন্থী, ভারতপন্থী বা কম্যুনিষ্টপন্থী অনেক সংগঠন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার করছে। অস্ত্রবাজ ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করেই এর জবাব দিতে হবে।
সামরিক অভ্যুত্থান
তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ নিবন্ধ রচনাকালেও কম করে হলেও ৬০টির মত দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামরিক শাসন কিংবা সেনাবাহিনী রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতা, বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ, ক্ষমতার কোন্দল ইত্যাদি নানা কারণে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে থাকে। শুধুমাত্র ক্ষমতা দখল কিংবা রাজনীতিকদের ব্যর্থতার কারণেও সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে থাকে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ অনাকাঙ্ক্ষিত বিবেচনা করা হলেও কিংবা এটাকে পেছন দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখল বলে গণ্য করা সত্ত্বেও সামরিক শাসন বা সামরিক অভ্যুত্থান ক্ষমতা দখলের একটা প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে।
সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে দেশেই ক্ষমতা দখল করা হোক না কেন এ শাসনের বৈধতা বা লেজিটিমেসির সমস্যাটি থেকেই যায়। এটা হচ্ছে জনগণের উপর এক ধরণের চেপে বসা শাসন। কোন কোন ক্ষেত্রে সামরিক শাসন জনগণ কর্তৃক প্রাথমিকভাবে অভিনন্দিত হওয়ার ঘটনাও বিচিত্র নয়। কিন্তু সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণ যেহেতু রাষ্ট্র পরিচালনার চাইতে দেশ রক্ষা বা জাতীয় প্রতিরক্ষার সাথেই বেশী সংশ্লিষ্ট তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা নির্দেশ জানার পদ্ধতিটাই ভিন্ন ধাচের। তাই এক পর্যায়ে গিয়ে আশা ভংগের কারণ সৃষ্টি হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামরিক অভ্যুত্থান উত্তর শাসন একনায়কত্ব বা ডিক্টেটরশিপের দিকে মোড় নিয়ে থাকে।
সামরিক শাসন থেকে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বা জনগণের রায় নিয়ে সরকার বদলের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ খুবই কঠিন হয়ে থাকে। অনেক সময় স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিকাশ এবং স্থিতিশীলতা আনয়ন অর্থাৎ রাজনৈতিক শৃংখলা ফিরিয়ে আনা দুঃসাধ্য ব্যাপারে পরিণত হয়।
একবার কোন দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটলে চক্রাকারে এর পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। সামরিক শাসনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ বলয় থেকে বের হয়ে এসে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির কাঠামো বিকশিত হতে বাধাগ্রস্থ হয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুধাবনে অনেক সময়ই ভুল করা হয়ে থাকে। নতুন শ্লোগান এবং সরকারের যে বক্তব্য ক্ষমতা দখলের স্বার্থে জনগণের সামনে উত্থাপন করা হয় তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। উপরন্তু সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যারা ক্ষমতা দখল করে থাকেন তারা এক পর্যায়ে রাজনীতিকদের সহযোগিতা গ্রহণে বাধ্য হন। আর এ সুযোগে দুর্নীতিপরায়ণ এবং ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিকদের একটি অংশ এগিয়ে আসে। তাছাড়াও বেসামরিক আমলারা যারা দীর্ঘ প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা রাখেন তাদের সহযোগিতা সামরিক বাহিনীকে নিতে হয়। সামরিক শাসনের স্থায়িত্বের জন্য বেসামরিক আমলাদের সহযোগিতা জরুরী। ফলে সামরিক অভ্যুত্থানকালে উচ্চাভিলাষী সামরিক জান্তা, বেসামরিক আমলাচক্র এবং ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিক এই তিন শক্তির অশুভ আঁতাতের শাসন চলে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হয় এবং দেশে এক নতুন ধরণের লুণ্ঠন চলতে থাকে এবং দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম হয়।
সামরিক সরকার জনগণের কাছে কোন ব্যাপারে জবাবদিহির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে না। সরকার পরিচালনা থেকে জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অন্যকথায় সরকার গণবিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে যায়। কালক্রমে এক ব্যক্তির হাতে সকল ক্ষমতা পুঞ্জিভূত হয় এবং ক্ষমতাসীনরা সরকার পরিচালনা নয় বরং তারা এক ধরণের রাজত্ব পরিচালনা করেন। এ রাজত্বে অন্যরা সব হুকুমের পুতুল। যাদের মন্ত্রী হিসাবে নিয়োজিত করা হয় তাদের কোন স্থায়িত্ব থাকে না। ঘন ঘন মন্ত্রিসভার রদবদল করে সহযোগীদের তটস্থ রাখা হয়ে থাকে। এটা এক ধরণের কৌশল। সামরিক অভ্যুত্থানে যারা ক্ষমতায় আসেন আরেকটি পাল্টা অভ্যুত্থানে তাদের পতনের আশংকা বিদ্যমান থাকে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় এবং এ নিয়ে বড় বেশী ব্যস্ত থাকতে হয়। সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার এসব কারণেই স্থিতিহীনতায় ভোগে। মোদ্দাকথা সামরিক সরকার দেশকে কোন স্থিতিশীল রাজনীতি উপহার দিতে পারে না। ফলে এ ধরণের সরকারের পক্ষে কোন আদর্শিক কর্মসূচী বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে।
পাকিস্তানের সামরিক সরকারের শরীয়তী শাসন কায়েমের এটি পরীক্ষা সাম্প্রতিককালে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। বিশেষ করে পাকিস্তানের সামরিক নেতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক নিজে ইসলামী বিধি বিধান কায়েমের ব্যাপারে বড় বেশী সোচ্চার ছিলেন। যে কোন মূল্যে ক্ষমতা দখল করে ইসলাম কায়েমের তত্ত্ব যেহেতু ইসলাম সম্মত নয় সেহেতু জনগণের নিকট সামরিক সরকারের ইসলামী কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণযোগ্য হয় না। বন্দুকের জোরে কোন সেনানায়ক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা করায়ত্ব করে ফরমান জারী করলেন আর ইসলামী বিপ্লব হয়ে গেল এ ধারণা ভুল। বিভিন্ন দেশের সামরিক শাসন বা সামরিক অভ্যুত্থান পরবর্তীকালের সরকারের কর্মকাণ্ড থেকে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, আইনগত বৈধতা না থাকার কারণে সামরিক সরকার জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়। জনগণের আন্তরিক আস্থা অর্জন ছাড়া ইসলামী বিপ্লব প্রত্যাশা করা যায় না। যারা অবৈধভাবে জনগনের মাথার উপর চেপে বসলেন তারা ইসলাম কায়েমের মত একটি মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিবেন জনগণ এটা বিশ্বাস করতে পারে না। জনগণের আন্তরিক অংশগ্রহণ ছাড়া কোন রাজনৈতিক প্রক্রিয়াই সফল হতে পারে না। অধিকন্তু ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকেও জোরপূর্বক বা অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল করাটা সম্পূর্ণ অবৈধ। যাদের নিজেদেরই ক্ষমতায় থাকার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন আছে তারা কি করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার মত মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারেন? সামরিক অভ্যুত্থান ইসলামী বিপ্লবের সাতে সংগতিবিহীন এবং ইসলামী বিপ্লবের প্রকৃতি বিরোধী। সুতরাং ইসলামী আন্দোলন বিপ্লবে এ প্রক্রিয়াকে যুক্তিসংগত কারণেই গ্রহণ করতে পারে না।
ক্ষমতাসীন সরকারে যোগদান
ক্ষমতাসীন সরকার যখন নিজের রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত করতে চায় তখন নতুন মিত্রের সন্ধান করে। এ সুযোগে কোন কোন দল বা ব্যক্তি ক্ষমতাসীন সরকারে যোগদান করে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারে। নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় কারো সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত হতে পারে এবং এ ব্যাপারে দ্বিমতেরও অবকাশ থাকতে পারে। কিন্তু একটি সরকার যথারীতি ক্ষমতায় আছে বা ক্ষমতা দখল করেছে। এমতাবস্থায় সে সরকারে যোগদান সরকারটিকে সাহায্য কারা মাধ্যমে কিংবা সরকারের সমর্থন নিয়ে ইসলামী বিপ্লবের চিন্তাও কেউ কেউ করতে পারেন।
সুদান ও পাকিস্তানে এই প্রক্রিয়ার একটি পরীক্ষা হয়ে গেছে। পাকিস্তানের পরীক্ষাটি সম্পূর্ণ ব্যর্থই হয়নি বরং বুমেরাং হয়েছে বলা চলে। আন্দোলনের সুনাম ও সংহতি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সুদানের পর্যায়টিও শেষ হয়নি। মালয়েশিয়ায় সরকারী দলে যোগদান করে ক্ষমতার সামান্য ভাগ নিয়েছে একটি ইসলামী গ্রুপ। এর পরিণতি হয়েছে অত্যন্ত ভয়ংকর ও বেদনাদায়ক। অবশ্য সেখানকার প্রধান ইসলামী সংগঠন তা করেনি। ক্ষমতাসীন সরকারে যোগদান করে ইসলামী আন্দোলনের যে সেবা করা যায় তার চাইতে বেশী সেবা সংশ্লিষ্ট সরকারকেই করা হয়ে থাকে। ক্ষমতায় ভাগ বসানোর আপোষকামী নীতি মহান রাসূল সা. এর কর্মধারার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আল্লাহর নবী সা. এ পন্থা গ্রহণ করেননি। আধুনিক যুগে যে ধরণের শাসনতান্ত্রিক, প্রশাসনিক ও বিচার কাঠামো গড়ে উঠেছে এবং আমলাতান্ত্রিক প্রভাব অব্যাহত রয়েছে তাতে এ প্রক্রিয়ায় হয়তোবা ক্ষমতার রাজনীতিতে উত্তরণ সহজ হতে পারে। কিন্তু ইসলামী বিপ্লব সফল হবে না। একটি আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্যতা যদি একবার নষ্ট হয় তাহলে তা পুনরুদ্ধার করতে খুবই কষ্ট হয়। ক্ষমতাসীনদের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতায় ভাগ বসিয়ে আর যাই কিছু করা সম্ভব হোক না কেন প্রকৃত কোন ইসলামী বিপ্লব আশা করা যায় না।
নির্বাচন
বুলেট নয় ব্যালটের বিপ্লব সাধন। ব্যাপকভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে জনমত সংগঠিত করতে পারলে নির্বাচনের স্বাভাবিক পথে বিপ্লব আসতে পারে। জনগণের ব্যাপক সমর্থনকে পুঁজি করে নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে দেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা অসম্ভব নয়। আন্দোলন গড়ে তোলার সামর্থ থাকলে নির্বাচনে জয়লাভের সামর্থও সৃষ্টি হবে। নির্বাচন এবং আন্দোলন একে অপরের প্রতিবন্ধক নয় বরং সহায়ক।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্রমান্বয়ে নির্বাচনে ভালো করে এক পর্যায়ে গিয়ে বিপ্লব সম্পন্ন হয়ে গেছে এমন দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা রীতিমত কঠিন। নির্বাচনের প্রচলিত যে ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা চালু রয়েছে সেই ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইসলামী আন্দোলনের জন্য খুব সুবিধা লাভও কঠিন। দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা পীড়িত দেশে নির্বাচনে সঠিক গণরায় প্রতিফলিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থায় সঠিক রায় প্রদানের জন্য যতটুকু শিক্ষা থাকা জরুরী তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তা নেই। নির্বাচনে অঢেল অর্থের ছড়াছড়ি যা উন্নত দেশগুলোতেও হয়ে থাকে তা চালু থাকা পর্যন্ত সৎ ও ভালো লোক নির্বাচিত হবার কোন সুযোগ সীমিত। অর্থ ব্যয় করার পর স্বাভাবিকভাবে সেই অর্থ পুনরুদ্ধার করার চিন্তা প্রার্থীর মধ্যে থাকে। তবে এর ব্যতিক্রমও থাকা বিচিত্র নয়।
অস্ত্র ও শক্তি বলে নির্বাচন কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ করা ইদানিং কালের আরেক নতুন প্র্যাকটিস। নির্বাচন অস্ত্রধারীদের হাতে জিম্মি হয়ে গিয়েছে। নির্বাচন কেন্দ্র দখল করে প্রতিপক্ষকে বাধা দান, তাছাড়াও ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সেকালে ভোট যে কারচুপি হতো তা জ্বাল ভোট দেয়া, মৃত ব্যক্তির ভোট দেয়া, একজনে একাধিক ভোট দেয়া ইত্যাদির মধ্যে সীমিত থাকতো। আর আজ সম্পূর্ণ অভিনব ধরণের কর্মকাণ্ড নির্বাচনে চালু হয়েছে। যাকে প্রকাশ্য ডাকাতি ছাড়া অন্য কিছু বলার উপায় নেই। টাকা ব্যয় করে ভোট কিনে ফেলাটাও নির্বাচনে এক ধরণের কারচুপি। কালো টাকার মালিকরা এ প্র্যাকটিস করে থাকেন। নির্বাচনের উল্লেখিত দিকগুলো একটি ইসলামী আন্দোলন কিভাবে মুকাবিলা করতে পারে তা একটি বড় ধরণের প্রশ্ন। নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যা কিছু করতে পারে ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে কি তা করা সম্ভব হতে পারে?
ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকার পুরো সুযোগটা ব্যবহার করে থাকে। প্রশাসন, সরকারী অর্থ, মিডিয়া, যানবাহন ও অন্যান্য উপকরণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকে। এটা মুকাবিলা কিভাবে করা সম্ভব? ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে তৃতীয় বিশ্বের কেউ ক্ষমতা হারান এমন দৃষ্টান্ত বিরল।
অনেকে মনে করেন কিছু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সাপেক্ষে জনগণের মধ্যে ভোটের আমানতদারী সম্পর্কে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব হলে এবং প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচনকে বিপ্লবের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য সন্ত্রাস, অস্ত্র, কালো টাকার ব্যবহার, পক্ষপাতদুষ্ট প্রশাসন, মিডিয়া, এনজিও গোষ্ঠীর অনাকাঙ্ক্ষিত ভূমিকা কিভাবে মুকাবিলা করে জনগণের নির্বিঘ্নে ভোট দানকে নিশ্চিত করা যায় তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের আলেম সমাজের মধ্যে ‘ইজমা’ বা ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। কেননা এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে সৎ ও ভদ্রলোকদের নির্বাচনে জয়লাভ করে রাষ্ট্রশক্তিতে ভূমিকা পালন সম্ভব হবে না। ভোট ডাকাতি ও সন্ত্রাসের মুকাবিলায় কোন কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে নির্বাচনের অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে কি সাফল্য লাভ করা যাবে। সুতরাং বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার সময় এসেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলামী দলসমূহ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ইসলামী দলসমূহের ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। এ ব্যাপারে ইসলামী দলসমূহের মধ্যে পারস্পরিক মতবিনিময় ও অভিজ্ঞতার আদান প্রদান হতে পারে। সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তনের জন্য সরকার গঠনের অপরিহার্যতা যেতেতু সর্বজনস্বীকৃত তাই ইসলামী সরকার গঠনের কৌশলকে কার্যকর করার স্বার্থেই বিষয়টি বিবেচিত হওয়া উচিত। ইসলামী বিপ্লব অর্জন করতে হলে জনগণকে আদর্শিক লড়াইয়ের জন্য তৈরী করতে হবে। তাই নির্বাচনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন এখন সময়ের দাবী।
নির্বাচনঃ বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট
রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্বাচন পদ্ধতির উদ্ভব প্রায় দুইশত বছর আগে। আমাদের দেশের জনগণের নির্বাচনের সাথে জড়িত ও পরিচিত হওয়ার ইতিহাস প্রায় একশ বছরের বা তার কম। বৃটিশ শাসন আমল থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে এ দেশে দু’ দু’টি বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে জনগণ।
এদেশে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে এবং বিশেষভাবে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের মাধ্যমেই বৃটিশ রাজের পতন , দেশ বিভাগ ও স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। আরেকবার ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং ৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। ৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে সামরিক জান্তার গড়িমসি ইয়াহিয়া-ভুট্টো ষড়যন্ত্রের কারণেই অবশেষে তদানিন্তন পূর্বপাকিস্তানের জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য হয়। সুতরাং নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশর অভ্যুদয়ে ১৯৭০-এর নির্বাচন এক বিরাট অবদান রেখেছিল। তা ছাড়াও বৃটিশ শাসনকাল থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, জিলা পরিষদের নির্বাচনে দীর্ঘদিন যাবত জনগণ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে অংশগ্রহণ করে আসছে। বর্তমানে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন শ্রমিক ইউনিয়ন, ছাত্র সংসদ, বণিক সমিতি, ক্লাব, মসজিদ কমিটি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা বোর্ড থেকে বাজার কমিটি পর্যন্ত প্রায় সর্বত্র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মহা সমারোহে। নির্বাচনে আমাদের জনগণ অভ্যস্থ হয়ে উঠেছেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তারা বিপুলভাবে। জনগণের নিকট নির্বাচন এখন প্রায় একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে।
বিগত ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের রাজনীতির প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠেছেন। তিনটি মোটামুটিভাবে দেশে বিদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি মজবুত হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে এসব নির্বাচন বিরাট ভূমিকা পালন করবে। আধুনিক গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে পরিচিত বৃটেনে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বর্তমান পর্যায়ে আসতে প্রায় ২০০ বছর সময় লেগেছে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অনেক বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে অগ্রসর হচ্ছে। মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিক থেকে অগ্রগামী রয়েছে। এখানে রাজনৈতিক দল ও সংবাদপত্র পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। বিরোধী রাজনৈতিক দল নিরাপত্তার সাথে কর্মসূচী পালন করছে। এমনকি হরতালের মত কর্মসূচী যা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশ পরিত্যাগ করেছে এবং বাংলাদেশেও বিকল্প কর্মসূচী প্রণয়নের ব্যাপারে ব্যাপক জনমত তৈরী হয়েছে- বিরোধী দল কারণে অকারণে সেই হরতাল কর্মসূচীও পালন করছে। বাংলাদেশ বর্তমান গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে দেশটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে দ্রুত এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশে জনসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ, উর্বর জমি, বিশাল বাজার সঠিকভাবে কাজে লাগানোর জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর ও উন্নত হোক এটা যারা চায় না তারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হোক সেটা চাইতে পারে না। এমনকি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এগিয়ে যায় সে ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্ব অর্থনৈতিকভবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে এবং সংঘাত ও হানাহানির পরিবর্তে আদর্শ কর্মসূচী ও উন্নয়নের রাজনৈতিক ধারা শক্তিশালী হোক সেটাও ঐ মহল পছন্দ করে না।
বিভিন্ন রাজনৈতিক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ কতিপয় বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন বা সজাগ হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়।
এক. জনগণ তাদের রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে আগের তুলনায় সজাগ।
দুই. রাজনীতি সচেতন জনগোষ্ঠী এ ব্যাপারে একমত পোষণ করে যে, আমাদের দেশের রাজনীতি বহুদলীয় ধাচের হবে। জনগণ একদলীয় ব্যবস্থা ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে।
তিন. দেশ চালানো দায়িত্ব জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণই পালন করবেন। অর্থাৎ নির্বাচনই হবে ক্ষমতা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া।
মোটামুটিভাবে আমাদের দেশের জনগণ একটি সংগ্রাম ও সংঘাতের রাজনীতির মধ্য দিয়েই অগ্রসর হয়ে এসেছে।
সুতরাং নির্বাচন আমাদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচাররের সাথে মিশে আছে। নির্বাচনের এ রাজনৈতিক কালচার বিভিন্নভাবে আমাদের রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। নির্বাচন শুধু আমাদের দেশেই নয় পৃথিবীর বহু দেশেই রাজনীতির সাথে অংগাংগিভাবে জড়িয়ে আছে। অনেক দেশেই নির্বাচনকে বাদ দিয়ে রাজনীতির কথা কল্পনা করা যায় না। আবার যেখানে নির্বাচন নেই সেখানে রাজনীতির অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন আছে। সত্যিকার অর্থে রাজনীতি সেখানে নেই, জনগণের রাজনীতি নেই এবং রাজনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ সেখানে নেই।
এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত। বৃটিশ যে রাজনীতি রেখে গিয়েছিল মূলতঃ আমরা সেই রাজনীতির উত্তরাধিকারী হয়েছিলাম। তাই বৃটিশের রেখে যাওয়া নির্বাচন পদ্ধতিও আমরা নির্বিচারে অনুসরণ করে আসছি। প্রার্থীদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট যিনি পাবেন তিনিই নির্বাচিত হবেন তার প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা যাই হোক না কেন? এই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পদ্ধতি আমাদের উপমহাদেশের দেশগুলোতে এবং সাবেক বৃটিশ কলোনিগুলোতে অনুসৃত হয়ে থাকে। বৃটেন বাদে বাকী ইউরোপীয় দেশগুলোতে এবং কিছু আমেরিকান দেশ, জাপান, সুইজারল্যাণ্ডে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভোট পদ্ধতি চালু আছে।
পৃথিবীর সংখ্যার দিক থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে আনুপাতিক হারে নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে বেশীর ভাগ দেশ। অবশ্য দুটো পদ্ধতিরই কমবেশী সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ পদ্ধতির নির্বাচন অনুসরণ করেও অনেক দেশ মোটামুটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যেতে পারে যে ভারত ও পাকিস্তান একই সাথে স্বাধীনতা লাভ করা সত্ত্বেও ভারত গণতান্ত্রিক একটি ঐতিহ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের জনগণ নিয়মিতভাবে নির্বাচনে ভোটের অধিকার প্রয়োগ করার সময় পায়নি বলে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামো গড়ে উঠেনি। একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে কোন ব্যবস্থার পিছনেই নেতৃত্বের ভূমিকা, দূরদর্শিতা ও আন্তরিকতা একটি বড় কার্যকর উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে।
অতীতে নগর রাষ্ট্রগুলোর পরিচালনায় প্রত্যক্ষ ভোট পদ্ধতিতে জনতার রায়ে রাষ্ট্রনায়ক নির্বাচিত হতেন কিংবা ইসলামে খেলাফতে রাশেদার সময় জনগণের প্রত্যক্ষ রায়ে রাষ্ট্রনায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। জনগণ খলিফা বা রাষ্ট্র প্রধানের নিকট বাইয়াত গ্রহণ করতেন। বর্তমানের কোন ভোট দান পদ্ধতি সেটা ছিল না। তবে এর মাধ্যমে খলিফাদের প্রতি জনগণের সমর্থনই জ্ঞাপন করা হতো। অর্থাৎ তারা জনগণ কর্তৃক সমর্থিত ছিলেন বা তাদের রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনার পিছনে জনগণের মঞ্জুরী বা অনুমোদন ছিলো। সুতরাং তারা জনসমর্থন সাপেক্ষেই রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনা করতেন অর্থাৎ ইসলামী ব্যবস্থায় জনগণের রায় বা মতামতকে এখন ভোট বলে আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞানে আখ্যায়িত করে তার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য়ভাবে স্বীকার করা হয়েছে। ইসলামের খলিফাগণ জনগণের মতামত ব্যতীত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বের মত বড় দায়িত্ব গ্রহণ করেননি বা নিজেরা স্বঘোষিত রাষ্ট্রনায়ক সেজে বসেননি। আর একথা তো ইতিহাস স্বীকৃত যে হযরত মুয়াবিয়া রা.-এর সময় যখন ইসলামের এ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পদ্ধতির পরিবর্তে বংশানুক্রমিক রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তিত হতে যাচ্ছিলো তখন হযরত হোসাইন রা.-সেই স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কারবালার প্রান্তরে জেহাদে অবতীর্ণ হন। এজিদ ইসলামের খেলাফতি রাজনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস করেছিল বলেই হোসাইন রা. স্বপরিবারে এ মর্মান্তিক জেহাদের শাহাদাত বরণ করেন। অতএব জনগণের মতামত উপেক্ষা করে কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ইসলাম উৎসাহিত করে না। পক্ষান্তরে জনগণের অংশগ্রহণকে ইসলাম বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে।
বৃটিশের উত্তরাধিকার হিসেবে বাংলাদেশে যে নির্বাচন ব্যবস্থা আমরা পেয়েছি সেই নির্বাচন ব্যবস্থা হুবহু চালু রেখে তা থেকে ফায়দা হাসিল করা কঠিন। যেহেতু নির্বাচন একটি স্বীকৃত সর্বোত্তম ক্ষমতা হস্তান্তর ও পরিবর্তনের ব্যবস্থা সেহেতু কিছু সংস্কার ও পুনর্গঠনের মাধ্যমে এ ব্যবস্থাকে একটি কার্যকর ব্যবস্থায় রূপান্তর করা যেতে পারে। ইসলাম যে ধরণের সমাজ ব্যবস্থা চায় সেই সমাজ ব্যবস্থার পক্ষে ব্যাপক জনমত সংগঠিত করে নির্বাচনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লব এখানে সম্পন্ন হতে পারে একথা অনেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। একটি ব্যবস্থার পক্ষে যদি জনমত থাকে, জন সমর্থন থাকে তাহলে স্বাধীনভাবে জনগণকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ দিলে জনগণ দ্বিধাহীন চিত্তে সে ব্যবস্থার প্রতিই তাদের রায় ঘোষণা করবে।
অনেকে মনে করেন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই মূখ্য বিষয়। নির্বাচন ব্যবস্থাকে যদি নিশ্চিতভাবে পক্ষপাতহীন করা যায় তাহলেই লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব।
অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের শর্ত
এক. যারা ক্ষমতায় থাকবেন তারা যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তাহলে নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করা কঠিন। নির্বাচনের তিন মাস বা ছয় মাস একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ পরিচালনা করতে পারে। ক্ষমতাসীনরা কমপক্ষে তিন মাস আগে পদত্যাগ করবেন।
দুই. নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত শক্তিশালী হতে হবে এবং কমিশনের বর্তমান সুযোগ সুবিধা ও পরিধি বৃদ্ধি করে আইন প্রণয়ন, যে কোন মামলার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য কমিশনকে দায়িত্ব অর্পন করতে হবে।
তিন. সঠিক ভোটার তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। ভোটারদের বয়স, নাম, ঠিকানা ও সনাক্তকরণ চিহ্নসহ সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ভোটার তালিকায় থাকতে পারে। ভোটারদের পরিচয় পত্রের ব্যবস্থা করতে হবে। পরিচয় পত্রের ব্যবস্থা ইতিমধ্যে অনেক দেশেই চালু করা হয়েছে।
চার. ভোট দানের সময় অনপনেয় কালি ব্যবহার করতে হবে যাতে একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার ভোটদানে আসতে না পারে। জাল ভোট দাতার শাস্তি কঠোর করতে হবে যাতে শাস্তির ভয়ে কেউ জাল ভোট দিতে না আসে।
পাঁচ. ভোট গণনার সময় প্রত্যেক প্রার্থীর প্রতিনিধি হাজির থাকার ব্যবস্থা করতে হবে এবং গণনা শেষে প্রিসাইডিং অফিসারের পাশাপাশি তাদেরও স্বাক্ষর থাকতে হবে। প্রতি কেন্দ্রেই ভোট শেষ হওয়ার পর ভোট গণনা করে মাইক যোগে ফলাফল জানিয়ে দিতে হবে।
যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ভোটের বাক্স, ফলাফল শিট রিটার্নি অফিসারের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। টেলিফোনে ফলাফল জানানো হলে তা সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের প্রতিনিধিবৃন্দের উপস্থিতিতেই জানাতে হবে। প্রত্যেক প্রার্থীর নিকট ফলাফলের শিটের কপি ফলাফল ঘোষণার সময়ই পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কোন প্রিসাইডিং বা সংশ্লিষ্ট কোন অফিসারের দুর্নীতি বা অনিয়ম প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে।
ছয়. প্রার্থী ফরম পূরণের সময়ই দুর্নীতি, বলপ্রয়োগ বা কোন ধরণের অনিয়মের আশ্রয় গ্রহণ করবে না মর্মে লিখিত অংগীকার নিতে হবে। এ অংগীকার ভংগ করা হলে শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে।
সাত. প্রার্থীর পক্ষ থেকে কোন ধরণের সভা সমাবেশ আয়োজন বা দান-অনুদান প্রদান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। নির্বাচন উপলক্ষে প্রার্থী কোন ধরণের অর্থ ব্যয় করতে পারবে না। একই মঞ্চে পরিচিতি সভার আয়োজন নির্বাচন কমিশন বা সরকার ব্যবস্থা নিবে। একই পোষ্টার বা প্রচার পত্রে সকল প্রার্থীর নাম প্রচারিত হবে। নির্বাচনের ৩ মাস কোন প্রার্থী নিজের জন্য ভোট চাইতে পারবে না। অর্থাৎ ব্যক্তিগত অভিযান হতে পারবে না। ভোটের নামে যে প্রচুর অর্থ ব্যয়ের বিলাসিতা করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। নির্বাচন বা ভোটদান যে প্রার্থীর স্বার্থে নয় একথাটা ভালভাবে জনগণকে বুঝাতে হবে। নির্বাচনের সময় প্রার্থী অঢেল অর্থ ব্যয় করছে। যার ফলে নির্বাচিত হবার পর সেই অর্থ উদ্ধারের জন্য রাষ্ট্র ও জনগণের অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা তাকে করতে হচ্ছে।
আট. প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে বি.ডি.আর , পুলিশ ও আনসারের সহযোগিতায় শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা এবং মাস্তান দমনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সহযোগিতাও নেয়া যেতে পারে। তাছাড়াও দেশকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে পরপর কয়েকদিন নির্বাচন সম্পন্ন করার কথাও চিন্তা করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ফলাফল এক সাথে ঘোষণার ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থাৎ ভোট গ্রহণের শেষ দিন ফলাফল ঘোষণা করা যেতে পারে।
নয়. গরিষ্ঠ ভোট পদ্ধতির পরিবর্তে আনুপাতিক ভোট পদ্ধতি গ্রহণ করা হলে নির্বাচনর আরও সুষ্ঠু এবং অবাধ হবে। আনুপাতি ভোট পদ্ধতিই অধিকতর গণতন্ত্র সম্মত এবং ভারসাম্যপূর্ণ। গরিষ্ঠ পদ্ধতিতে কম ভোট পেয়ে এমনকি কোন ক্ষেত্রে জামানত বাজেয়াপ্ত একজন প্রার্থীও নির্বাচিত ঘোষিত হতে পারে। অধিকাংশ ভোটারের সমর্থন যাদের পিছনে নেই তারাই জন প্রতিনিধি হয়ে যেতে পারেন গরিষ্ঠ ভোট পদ্ধতিতে। কিন্তু আনুপাতিক পদ্ধতিতে এ সুযোগ নেই। নিম্নতম ভোট সংখ্যা নির্ধারিত করে দিলে দলের সংখ্যাও কমে আসবে এবং স্বতন্ত্র নির্বাচনের নামে পরবর্তী সময়ে সুযোগ বুঝে ক্ষমতাসীন কিংবা কোন বড় দলে যোগদানের সুযোগও থাকবে না। অনেক প্রার্থী স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত হয়ে পরে সরকারী সুযোগ সুবিধা গ্রহণের জন্য অনৈতিকভাবে সরকারী দলে যোগদান করে থাকে। জাতীয় নির্বাচন যেহেতু সরকার গঠনের জন্য নির্বাচন সেহেতু স্বতন্ত্র প্রার্থীর এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা অর্থহীন।
দশ. বেসরকারীভাবে একটি শক্তিশালী পর্যবেক্ষক দল অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়ক হতে পারে। অবাধ ও পক্ষপাত মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেসব শর্তের আলোচনা করা হয়েছে তা নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাপেক্ষ। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান বিষয়বস্তু হওয়া উচিত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা। নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত হলে যাদের প্রতি জনগনের আস্থা প্রকাশ পাবে অর্থাৎ যারা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ম্যাণ্ডেট পাবেন তাদেরকেই এ দায়িত্ব দিতে হবে। ক্ষমতা পরিবর্তনের এ প্রক্রিয়া মেনে নিয়ে নিষ্ঠার সাথে তা অনুশীলন করলে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া গড়ে উঠতে পারে। দেশের রাজনীতিতে একটি পদ্ধতি অনুসরণের প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে এবং রাজনীতিতে সুস্থতা ফিরে আসাও সহজ হতে পারে। এমন একটি রাজনৈতিক পদ্ধতির সুযোগ পেলে ইসলামী আদর্শকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলে মানুষের সমর্থন ও সহযোগিতার মাধ্যমেই ইসলামের রাষ্ট্র বিপ্লব সাধন সম্ভব হতে পারে। ভোটের প্রক্রিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব নয় বলে যারা বিশ্বাস করেন তারা মুদ্রার একটি পিঠই দেখতে অভ্যস্ত, ভিন্ন পিঠ দেখতে নারাজ। গণতন্ত্রের মত ব্যবস্থা নির্বাচনের জোড়াতালি দিয়ে টিকে আছে আর ইসলামের মত নির্ভুল ব্যবস্থা কেন নির্বাচন প্রক্রিয়ার মত একটি উত্তম ব্যবস্থাকে কাজে লাগাতে পারবে না তার কোন যুক্তি নেই। ইসলাম যে ধরণের নির্বাচন পদ্ধতিকে উৎসাহিত করবে তা মূলতঃ মানুষের মনন ও দৃষ্টিভংগিকেই পাল্টে দিবে। এক ধরণের হতাশায় আক্রান্ত হয়ে আজ অনেকে নির্বাচনের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়াতে ঝুঁকি দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের প্রস্তাবিত শর্তাদি পূরণ সাপেক্ষে নির্বাচন ব্যবস্থায় ত্রুটি বিচ্যুতি হ্রাস করে তাদের সে হতাশা দূর করা সম্ভব হতে পারে। শক্ত হাতে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় যারা বিশ্বাসী তারা কেন শক্ত হাতে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার সাধনে আস্থা রাখতে পারেন না এর কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ও শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণের সুযোগ আর কোন পন্থায় নিশ্চিত করা যেতে পারে? জনগণের সমর্থন ও অনুমোদন ছাড়া কি কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থা স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে কিংবা স্থিতিশীলতা ও জনকল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে?
গণআন্দোলন
জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, ত্যাগ ও কোরবানীর বিনিময়েই ইসলামী আন্দোলনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম। এজন্য ব্যাপক গণআন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। ইসলাম কায়েমের স্বার্থে গণজাগরণ দরকার। জনগণের মধ্যে আত্মত্যাগ, কোরবানী ও আদর্শের জন্য প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দেয়ার মত ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠা না থাকলে কোন আন্দোলনেই গতিবেগ সঞ্চারিত হতে পারে না। অনৈসলামী সমাজ ব্যবস্থা উৎখাত করে শোষণ জুলুমের অবসান করা, দুনিয়ার মানুষের কল্যাণ ও আখেরাতের মুক্তির লক্ষ্যে আল্লাহর আইন ও সৎলোকের শাসন কায়েমের জন্য প্রচণ্ড আন্দোলন গড়ে তোলা যেতে পারে। ক্ষমতায় উত্তরণের অন্যান্য প্রক্রিয়ায় যে সমস্যা আছে গণআন্দোলনে তা নেই। গণআন্দোলনের একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও ব্যবস্থা হতে পারে। সুতরাং গণআন্দোলনের ও নির্বাচনের সমন্বয়েই কাঙ্ক্ষিত একটি পরিবর্তন আসতে পারে। গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে উঠলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিতে পারে। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য স্বল্প সময়ের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করে সঠিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে। চূড়ান্তভাবে যেমন নির্বাচনকেই একমাত্র পন্থা বলে ধরে নেয়া ঠিক হবে না তেমনি কেবলমাত্র গণআন্দোলনকেই বিপ্লবে একমাত্র পন্থা বলে গ্রহণ করা সমীচীন হবে না। ইসলামী বিপ্লবের জন্য এ দুটো প্রক্রিয়াই উন্মুক্ত থাকতে পারে। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী উভয় প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে অথবা যে কোন একটি প্রয়োগ করে সামনে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে।
সফল গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থান-এর মাধ্যমে ইসলামী বিপ্লব বা রাষ্ট্র বিপ্লব সাধন করা যে সম্ভব ইতিহাসে তার একাধিক দৃষ্টান্ত রয়েছে। গণআন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কালে ইরানের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করার মত। রাজতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ইরানী জনগণ যে বিপ্লব সাধন করেছে আধুনিক ইতিহাসে তা এক যুগান্তকারী ঘটনা বলেই চিহ্নিত হতে পারে। তাদের সাথে কারও মতপার্থক্য থাকা বিচিত্র নয়। কিন্তু স্বৈরাচারী ব্যবস্থার পতন ঘটিয়ে ইরানী জনগণ সম্পূর্ণভাবে এক নতুন কাঠামোর শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সুন্নী জগতের সাথে বিস্তর মতপার্থক্য সত্ত্বেও এ বাস্তবতা কারো পক্ষেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তারা দীর্ঘকালের ঐতিহ্যবাহী এক নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করতে সক্ষম হয়েছে। জনগণের ব্যাপক সমর্থন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং রক্তদানের মধ্য দিয়েই ইরানে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ঘটনার বিচারে এবং তাৎপর্যের দিক থেকে ইরানী বিপ্লব সম্ভবতঃ বিগত অর্ধশতাব্দীর এক স্মরণীয় ঘটনা। একটি দেশের অসহায় নিরস্ত্র জনগণের শক্তির সামনে শেষ পর্যন্ত পরাক্রমশালী শাসক গোষ্ঠীর কামান বন্দুক ও গোলা বারুদ টিকতে পারেনি। জনতার বিক্ষুব্ধ স্রোতের সাথে এক পর্যায়ে সশস্ত্র বাহিনীও একাত্মতা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। বহির্বিশ্ব বিপ্লব সংঘটিত হবার কিছু আগেও কল্পনা করতে পারেনি যে, ইরানে এতবড় এক গণঅভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে। এমনকি অঘটন ঘটন পটিয়সি শক্তিধর সি আই এ কিংবা কে জি বি-র পক্ষেও অনুমান করা কঠিন ছিল যে, ইরানে কি হতে যাচ্ছে। বিদ্রোহী জনতাকে শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সহায়তায় শেষ পর্যন্ত ইরানের শাহ দমন করতে সক্ষম হবে বলে সি আই এ-এর পক্ষ থেকে আশাবাদ পোষণ করা হয়েছিল। আমাদের উপমহাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই স্বাধীনতা সংগ্রামসমূহ গণআন্দোলন তথা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে। গণ-আন্দোলনগুলোর পরিণতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত না হলে পাকিস্তান এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। পাকিস্তান বা বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে যেমন জড়িয়ে আছে গণআন্দোলন তেমনি অনেক দেশের রাজনৈতিক উত্থান পতনের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আছে গণআন্দোলন। সরকার পরিবর্তনের ক্ষেত্রেই শুধু নয় বরং সমাজ ব্যবস্থার ব্যাপক কিংবা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ইতিহাসের বিশিষ্ট দিক হচ্ছে গণআন্দোলন। তাই আজও এই প্রক্রিয়া কার্যকর রয়েছে। গণআন্দোলন ক্ষেত্র বিশেষে সশস্ত্র সংগ্রামের রূপ পরিগ্রহ করার কারণে গণআন্দোলনের সাথে তারা সশস্ত্র সংগ্রামের একটা যোগসূত্র আশংকা করেন। সুশৃঙ্খল কর্মীবাহিনী, বলিষ্ঠ এবং বিচক্ষণ নেতৃত্ব এবং যথাযথ পরিস্থিতি এ তিনের সংযোগ ঘটলে দুনিয়াতে বড় ধরণের গণঅভ্যুত্থান ঘটা সম্ভব এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিপ্লব সাধনও সম্ভব বলে দৃঢ় অভিমত ব্যক্ত করা যেতে পারে। ভৌগলিকভাবে একটি স্বাধীন দেশের কাঠামোর মধ্যে থেকে গণআন্দোলন সৃষ্টি করে বিপ্লবে লক্ষ্য হাসিল করা অসম্ভব নয়। শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলন চালিয়ে জনতার আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, গণআন্দোলন ও নির্বাচন সম্পূরক হতে পারে অর্থাৎ একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি নয়। ইসলাম যেহেতু শক্তির জোরে কিংবা বন্দুকের জোরে কোন জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেয়ার কোন প্রক্রিয়া সমর্থন করে না সেহেতু ইসলামী বিপ্লবের জন্য গণআন্দোলন অপরিহার্য।
গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবেঃ
এক. ইসলাম মানুষের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কি পরিবর্তন আনতে চায় তা অতি সহজ ও পরিচ্ছন্ন ভাষায় জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।
দুই. ইসলাম সম্পর্কে সৃষ্ট ভুল ধারণা ও বিভ্রান্তির অবসান কল্পে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তিন. ইসলামের মানবতাবাদী বিপ্লবী দাওয়াত মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছানোর জন্য যোগাযোগের যাবতীয় বৈজ্ঞানিক মাধ্যম ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে।
চার. চরিত্র ও কর্মে জীবন্ত ইসলামের নমুনা হিসেবে এক ত্যাগী, দক্ষ ও যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। সত্যের সাক্ষ্যদাতা হিসেবে যারা সমাজে স্থান করে নিতে সক্ষম।
পাঁচ. ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণ এবং জনমত সংগঠনের জন্য ব্যাপকভিত্তিক সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে।
ছয়. দাওয়াত-সংগঠন-সংগ্রাম প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংগ্রাম যুগে আদর্শের প্রতীক লোক গঠন করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, যেকোন আন্দোলনের সাচ্চা সৈনিক সংগ্রাম যুগেই তৈরী হয়। বিভিন্ন চড়াই উৎরাই ও কঠিন পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই খাঁটি লোক তৈরী হবেন যারা সত্যিকারভাবে বিপ্লব গঠন ও বিপ্লবের সাফল্য ধরে রাখবেন।
সাত. বিভিন্ন ইস্যু ভিত্তিক ও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে জনতাকে জড়িত করার জন্য প্রচণ্ড গণজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে।
আট. প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণবিক্ষেভ সৃষ্টি এবং ক্ষমতাসীন প্রতিক্রিয়াশীলদেরকে গণবিচ্ছিন্ন করার জন্য সঠিক রণকৌশল গ্রহণ করতে হবে। গণজাগরণের পাশাপাশি বিকল্প নেতৃত্ব উপস্থাপন করতে হবে জনগণ যাদের উপর আস্থাবান হবেন।
নয়. ক্ষমতা দখল ও সরকার বা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে এবং প্রচলিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বৃহত্তর জনতাকে সম্পৃক্ত করার কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
দশ. জনমত সংগঠনের জন্য একটি আধুনিক রাজনৈতিক দল যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে সেসবের সাথে সাথে আন্দোলন জনগণের মধ্যে কতটা সাড়া উৎপন্ন করছে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে জনমত জরীপ করে অবস্থান নির্ধারণ করতে হবে।
এগার. বাস্তব জীবনের সমস্যাদির সমাধানের পাশাপাশি মানব জাতিকে আখেরাতের ভয়াবহ পরিণতি এবং চিরন্তন পুরস্কারের দিকে ধাবিত করতে হবে। আল্লাহর দাসত্ব, নবী সা.-এর আনুগত্যের মধ্যেই যেন মানব জাতি শান্তি, স্বস্তি, প্রশান্তি ও সমৃদ্ধির সন্ধান পায়।
——-