২০. রাজনৈতিক স্ট্যাটেজি
ইসলামী বিপ্লব সাধনে রাজনৈতিক কলা কৌশল বা স্ট্যাটেজি কি হবে এ নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। একটি সাধারণ রাজনৈতিক দল যেভাবে কর্মসূচী প্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে ইসলামী বিপ্লবাকাঙ্ক্ষী কোন দলের জন্য যে তা মোটেই সমীচীন নয় ইতিমধ্যেই আমাদের আলোচনা থেকে তা স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু অনেক দেশে ইসলামী সংগঠনগুলো সাধারণ রাজনৈতিক দলের প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হওয়ার প্রবণতা থেকেই এ প্রশ্নের সৃষ্টি। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে এ ধরণের বিপ্লবী আন্দোলন কতটা অগ্রসর হতে পারবে এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়ে গেছে। কেননা গণতন্ত্র নামক যে রাজনৈতিক পদ্ধতিটি আজ বহুলভাবে অনুসরণ করা হয়ে থাকে তা আসলেই কতটুকু গণতান্ত্রিক তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। উপরন্তু যে নির্বাচন ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন মহলের প্রভাব বিস্তার করার বিস্তর সুবিধা রয়েছে এবং তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে যেভাবে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে এর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। উন্নত বিশ্বেও নির্বাচন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিয়ে ইদানিং প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। সেসব দেশেও নির্বাচনকে নানাভাবে প্রভাবিত করা হয়ে থাকে। অস্ত্র ও পেশী শক্তি এবং নতুন ধরণের কারচুপি, দুর্নীতি সঠিক অর্থে জনমতের প্রতিফলন ঘটানোর ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেশে দেশে বিরাজমান। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজিত হওয়ার দৃষ্টান্ত তৃতীয় বিশ্বে খুব একটা ঘটে না। ফলে গণতন্ত্র কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। কম্যুনিষ্ট বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এক মহা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার সাথে সাথে বহুদলীয় এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকলেও ইসলামী বিপ্লবাকাঙ্ক্ষীদের জন্য এর উপযোগিতা কতটুকু তা নিয়ে বিতর্ক বা মতভেদ অনস্বীকার্য। নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য যেসব উপাদান আছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ঐসব উপাদান প্রয়োগে মোটেই ভুল করবে না। ইসলামী আন্দোলন যদি ব্যাপক গণভিত্তি এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে তাহলে বর্তমান ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থার মধ্যেও ভালো করতে বা লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হতে পারে বলে অনেকে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে থাকেন। এর বিপরীত মত কম যুক্তিপূর্ণ নয়। সুতরাং বিষয়টি সম্পর্কে চূড়ান্ত মন্তব্য করা কঠিন।
তবে ইসলামী বিপ্লবাকাঙ্ক্ষী দল বা সংগঠনকে এ বিষয়ে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে যে, এর আবেদন নিছক রাজনৈতিক দলের মত হবে না। সাধারণ মানুষ যেহেতু রাজনীতিকে ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার বলে গণ্য করে থাকে সেহেতু ইসলামী আন্দোলনের রণকৌশল নির্ধারণে এ বিষয়টি গভীরভাবেই বিবেচনা করতে হবে। রাজনৈতিক দলের মত সাময়িক ইস্যুতে একাত্ম হয়ে যাওয়ার মত ঘটনা ঘটলে পরবর্তীতে অসুবিধা সৃষ্টির আশংকা আছে। ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন কতটুকু করা যাবে এবং কতটুকু করা উচিত এ হিসাব নিকাশ বড় কঠিন। কোন একটি ইস্যু বা বক্তব্য অতি বেশী প্রাধান্য পেয়ে যায় তখন আন্দোলনের সামগ্রিক ইসলামী চরিত্র ক্ষুন্ন হওয়ার আশংকা থাকে। এজন্য কোন বিশেষ সাময়িক আন্দোলনে ইসলামী আন্দোলন সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়ার মধ্যে সমস্যা আছে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রভাব যেহেতু গোটা বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত প্রকট এবং ক্ষেত্রবিশেষে নগ্ন সেহেতু ইসলামী বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মকৌশলও হতে হবে খুবই সূক্ষ্ণ। রাজনৈতিকভাবে এবং প্রচার প্রপাগাণ্ডার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ ইসলামী আন্দোলনকে পর্যুদস্ত করবে। সুতরাং এমন কোন সুযোগ তাদের দেয়া যাবে না। সর্বাবস্থায় ইসলামী আন্দোলনকে জনগণের আস্থা এবং আল্লাহর নৈকট্য এবং সাহায্য পাওয়ার ব্যাপারেই যত্নবান হতে হবে বেশী।
মিশরে ইখওয়ানুল মুসলেমীনের আন্দোলন দমন করার জন্য ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ইংগীতে এবং সহযোগিতায় যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে। নির্যাতন-নিপীড়ন, জেল-জুলুম, মামলা-মোকদ্দমা থেকে শুরু করে আন্দোলনের নেতাকে হত্যা, মিথ্যা প্রচারণা চালানো, বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও চক্রান্ত করে আন্দোলন নিষিদ্ধ ঘোষণা, সম্পত্তি বাজেয়াপ্তসহ যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা হয়। নেতৃবৃন্দকে বিচারের প্রহসন করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়। মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া, দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। সংবাদপত্র ও প্রকাশনা বন্ধ করা হয়। ক্ষমতাসীন মহল ইখওয়ানের সাথে বিশ্বাস ভংগ পর্যন্ত করেছে।
অনুরূপভাবে সিরিয়া, আলজিরিয়া, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশের ইসলামী সংগঠনের সাথে ক্ষমতাসীন সরকারের আচরণ থেকেও স্পষ্ট যে, ক্ষমতার রাজনীতিতে বিশ্বাসীগণ একটা পর্যায় পর্যন্ত অথবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার জন্য যতটুকু ইসলাম দরকার তার বেশী অগ্রসর হতে প্রস্তুত নয়। সিরিয়া এবং সুদানের অভিজ্ঞতাও আমাদের সামনেই রয়েছে। ক্ষমতাসীন মহল সিরিয়ায় যে গণহত্যা চালালো, তা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয়নি। কোথাও সামান্য কিছু ঘটলে পাশ্চাত্য সংবাদ মাধ্যম হৈ চৈ পড়ে যায় কিন্তু সিরিয়ার হামা শহরে ইসলাম পন্থীদেরকে হাজারে হাজারে হত্যা করার নির্মম ঘটনা বিশ্ববাসীকে ঐভাবে জানানো হয়নি। সুদানেও ইখওয়ানকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়। নেতাদের জেলে পাঠানো হয়। অবশ্য সুদানী ইখওয়ানের রাজনৈতিক কৌশলের কারণে পরবর্তী সময়ে তারা প্রতিবন্ধকতা উত্তরণে সক্ষম হন। যদিও ষ্ট্র্যাটেজি প্রশ্নে তাদের মধ্যে জাফর আল নিমেরীর শাসনকালেই মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়। আন্দোলনের রাজনৈতিক কৌশল প্রশ্নে মিশরেও ইখওয়ান মতপার্থক্যের শিকার হয়। ইখওয়ানের আন্দোলন চিন্তাধারার পার্থক্য রচনায় শাসকমহলের ভূমিকাও কম নয়। কৌশলগত প্রশ্নে মালয়েশিয়ায় পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনে মতপার্থক্য দেখা দেয়। তুরস্কে সংগ্রামরতদের মাঝেও মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বিগত দুই দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৌশলগত প্রশ্নে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামীদের মধ্যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। কমবেশী পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতেও রাজনৈতিক ষ্ট্র্যাটেজি প্রশ্নে মতপার্থক্য এবং বিতর্ক বিদ্যমান। কোথাও এ বিতর্ক কিছুটা প্রকাশিত আবার কোথাও এ বিতর্ক আন্দোলনের অভ্যন্তরে। তবে একটি শুভ লক্ষণ যে মতভেদ এবং কৌশলগত প্রশ্নে চিন্তা-ভাবনার পার্থক্য সত্ত্বেও একটি সহনশীলতার পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে।
মৌলিক পার্থক্য যেহেতু নেই তাই কৌশলগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একটি সমন্বয় সাধনের চিন্তা হতে পারে। পৃথিবীর দেশে দেশে ইসলামী আন্দোলনরত সংগঠনগুলো আজ যেসব সংকটের মুখোমুখি আমাদের মতে রাজনৈতিক ভূমিকা বা ষ্ট্র্যাটেজির সংকট হচ্ছে বড় সংকট। রাজনৈতিকভাবে আন্দোলন কতটা অগ্রসর ভূমিকা কখন রাখবে তা নির্ধারণ করা সেখানকার নেতৃবৃন্দেরই দায়িত্ব। পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার সময় বোধ হয় আর নেই। ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ইসলামকে বিজয়ী করার প্রচেষ্টায় যেসব বাধা বিপত্তি এসেছে তা থেকে আগামী দিনের কৌশল গ্রহণের ব্যাপারটা অনেকখানি সহজ হয়েছে বলে মনে করা যায়। সমসাময়িক বিশ্বের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটি যুক্তিপূর্ণ ভিত্তির উপর কৌশল নির্ধারিত হওয়া উচিত।
এক. আন্দোলনের বক্তব্য ও ভূমিকা অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন হতে হবে।
দুই. জনগনের হৃদয়ের কাছাকাছি যেতে হবে। জনগণের আস্থা, সমর্থন, ভালোবাসা অর্জন করতে হবে।
তিন. গণভিত্তি অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক শক্তি ও সমন্বয় ঘটাতে হবে।
চার. স্বৈরাচার, যালেম শাসকদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে।
পাঁচ. বৈষম্য, বেইনসাফী, নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করতে হবে।
ছয়. সংগঠন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে উঠার সাথে সাথে গণ জাগরণের ও বিপ্লব সৃষ্টির লক্ষ্যকে সর্বাবস্থায় অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সাত. আধ্যাত্মিক এবং দ্বীনি বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে হবে। প্রচলিত ধাঁচের রাজনৈতিক দলের কর্মপন্থা যেন প্রাধান্য পেয়ে না যায় সেদিকটার উপর বিশেষ নজর দিতে হবে।
আট. বিভিন্ন স্তরে জনগণের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং পরিচিত এমন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতৃত্ব বিকাশের বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
নয়. কর্মতৎপরতা এবং প্রচারণার মধ্যে যুক্তিপূর্ণ ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
দশ. আন্তর্জাতিক ইস্যুতে অত্যন্ত সূক্ষ্ণতর এবং দূরদৃষ্টির পরিচয় দিতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত এবং নেটওয়ার্ক সম্পর্কে সদাসতর্ক থাকতে হবে।
এগার. গতিশীলতাই আন্দোলনের প্রাণশক্তি, স্থবিরতার সকল পথ রুদ্ধ করে দিতে হবে।
বার. বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্ব এবং জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হতে হবে। নেতৃত্ব যাতে কোন অবস্থায় গণবিচ্ছিন্নতার শিকার না হন সে বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ থাকতে হবে।
তের. শোষিত, বঞ্চিত, অসহায়, দারিদ্র্য পীড়িত মানুষ ইসলামী বিপ্লবের প্রধান শক্তি। এরা আন্দোলনে যতবেশী সংখ্যায় শরীক হবে আন্দোলনে ততবেশী গতি সঞ্চারিত হবে।
চৌদ্দ. সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত সহজ ও দ্রুত হতে হবে।
পনের. মাথাভারী ব্যবস্থা যাতে সংগঠনে প্রশ্রয় না পায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ষোল. পৃথিবীর সকল বিপ্লবসমূহের পিছনের সবচাইতে কার্যকর শক্তি মানুষ। সুতরাং যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষ বা দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার দিকেই সমধিক মনোনিবেশ করতে হবে।
বিকল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার চাইতে মানুষ গড়া অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া যেসব প্রতিষ্ঠান কার্যকর হতে পারে না বিপ্লবপূর্বকালে সে ধরণের প্রতিষ্ঠানাদি গড়ে তোলার প্রবণতা সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে এবং ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে পুরো একটি বিকল্প ব্যবস্থা তৈরী করে নিয়ে অতঃপর বিপ্লব সাধন করতে হবে। এ ধরণের ধারণা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।
সতের. শত্রুতাকে আদর্শ দিয়ে জয় করতে হবে। চরম শত্রুর নিকটও দাওয়াত পৌঁছাতে হবে, দেখা সাক্ষাৎ ও সংলাপ অব্যাহত রাখতে হবে। দাওয়াত ও সংলাপে নতুন রিক্রুটমেন্ট বাড়বে, পরিচিতি ও প্রভাব বলয় সৃষ্টি শত্রুতা কমাবে। বিপ্লবী আন্দোলনে মানুষের কাছে সরাসরি দাওয়াত পৌঁছানোর মত আর দ্বিতীয় কোন শক্তিশালী কার্যক্রম নেই। আন্দোলনে যিনি যত বড় দায়িত্বশীল তিনি দাওয়াত পৌঁছাবেন অনুরূপ দায়িত্বশীল পর্যায়ের লোকের নিকট এটা ইসলামী বিপ্লবী আন্দোলনের এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্যে যে সংগঠন যত বেশী অর্জন করতে পারবে তার ভূমিকা বিপ্লবের জন্য তত বেশী গুরুত্বপূর্ণ হবে।
আঠার. ইসলাম সম্পর্কে এবং ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে এক ধরণের ভীতিকর প্রচারণা রয়েছে। ইসলামের সার্বজনীন আবেদন ও সর্ব শ্রেণীর মানুষের মর্যাদা, জান-মাল ও ইজ্জতের গ্যারান্টি সম্পর্কিত ব্যবস্থা সম্পর্কে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে অবহিত করতে হবে। অমুসলিমদের মর্যাদা ও অধিকার তাদের ধর্ম পালন ও চর্চার স্বাধীনতা এবং বহুমাত্রিক ও বহু ধর্ম ও বর্ণের প্রতি ইসলামের উদার ও সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি, ইসলামী রাষ্ট্রে নাগরিকদের মধ্যে যে কোনরূপ বৈষম্য থাকবে না এ সম্পর্কে ইসলামের সঠিক দাওয়াত ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক প্রচার করতে হবে। ইসলাম যে একটি মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা বিশ্ব মানবতাকে উপহার দিয়েছে অনেক সময় সংকীর্ণভাবে ইসলামকে উপস্থাপনের জন্য বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। ইসলাম শুধু মুসলমানদের জন্য নয় বা তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ নয় বরং ইসলাম সকল মানুষের জন্য। মানুষের মহান স্রষ্টা সকল মানুষের কল্যাণ ও মুক্তির নিশ্চয়তা দিয়েছেন- এ বক্তব্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
২১. ইসলামী আন্দোলনের প্রতিবন্ধকতা
এক. গোটা মুসলিম বিশ্বেই সাধারণভাবে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো ইসলামী আন্দোলনের বিরোধী। মুসলিম জাহানের দেশগুলো নামে স্বাধীন হলেও এসব দেশে স্বাধীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ব্যবস্থা তথা স্বাধীন সরকার গড়ে উঠতে পারেনি। অনেক মুসলিম দেশেই সরকার মুখে ইসলামের কথা বলে থাকে। ফলে ইসলামের নামে উত্থিত কোন রাজনৈতিক শক্তির বিকাশকে সেসব সরকার তাদের নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ মনে করে। কেবলমাত্র সাধারণ মুসলিম জনগণের সমর্থন পাবার উদ্দেশ্যেই যেহেতু ঐসব সরকার ইসলামকে ব্যবহার করে থাকে তাই সত্যিকারভাবে ইসলামের জাগরণকে তারা ভয় পায়। কেননা তারা এটা ভালোভাবেই জানে ইসলাম সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কায়েম হলে তাদের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। তাছাড়া এসব সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে এমন সব অপকর্ম গণবিরোধী ভূমিকা পালন করে থাকে যার ফলে আত্মরক্ষার জন্যই তাদের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা জরুরী হয়ে পড়ে।
মুসলিম জাহানে লক্ষ্য করা যায় সাধারণতঃ ইসলামী আন্দোলন যতটুকু শক্তি লাভ করলে সরকারের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবার আশংকা থাকে না খুব বেশি হলে ততটুকু পর্যন্ত ক্ষমতাসীন সরকার ইসলামী আন্দোলন বরদাশত করে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে এ ধরণের সরকারগুলো ইসলামী তৎপরতা বিন্দুমাত্রও সহ্য কতে রাজী নয়। চালাক সরকারগুলো ইসলামী শক্তির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে কোন না কোন গ্রুপের প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে থাকে। অনেক মুসলিম রাষ্ট্রের সরকার আছে যারা সাম্রাজ্যবাদের এতটা তল্পীবাহী যে, নগ্নভাবে ইসলামী আন্দোলন ও তৎপরতার বিরোধীতা করে থাকে। সাধারণতাবে সরকার ইসলামী আন্দোলনের সাথে সহানুভূতিশীল আচরণ করার দৃষ্টান্ত খুবই কম। কোথাও কোথাও দু’একটা সহানুভূতিশীল আচরণ দেখা গেছে। কিন্তু সেটাও চূড়ান্ত বিশ্লেষণে ক্ষমতাসীনদের গদি রক্ষার তাগিদেই, কোন ইসলামী বিপ্লব সংগঠনের জন্য নয়।
ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকারগুলোর অভিযোগের ধরন হলো যে এরা অর্থোডক্স, কনজারভেটিভ, ফ্যানাটিক, চরমপন্থী, মৌলবাদী, সন্ত্রাস ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী। মজার ব্যাপার ইসলামের কথা বলে যেসব সরকার জনসমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে থাকে তারাই অভিযোগ করে থাকে যে, ধর্ম পবিত্র জিনিস অথচ ইসলামী দলগুলো ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করে ধর্মের পবিত্রতা নষ্ট করছে। এরা মসজিদে রাজনীতি করছে অথবা ধর্ম ও রাজনীতি আলাদা জিনিস ধর্মের সাথে রাজনীতি করা চলবে না ইত্যাদি। অনেক মুসলিম দেশেই সরকার ইসলামী আন্দোলনকে প্রকাশ্যে প্রতিহত করছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিই যেহেতু এসব দেশের সরকারগুলোকে মদদ জুড়িয়ে থাকে সেহেতু সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ইংগিতেই মুসলিম দেশের সরকারগুলো ইসলামের উত্থানের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। মূলতঃ এসব সরকার মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। জনতার সেবা নয়, ক্ষমতার সেবাই এসব সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ আলোচনাকে যে কোন একটি মুসলিম দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটের সাথে মিলিয়ে দেখলেই ব্যাপারটি আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
দুই. যুগে যুগেই সমাজে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। অব্যাহত পুঁজিবাদী শোষণ এবং একনায়কত্ব বা স্বৈরশাসনের ফলশ্রুতি হিসেবে অনেক মুসলিম দেশেই একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছে। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তির আশীর্বাদপুষ্ট এ অশুভ শক্তিটি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা, লাইসেন্স, পারমিট ইত্যাদির মাধ্যমে বেড়ে উঠে। ব্যবসায় বাণিজ্যে ও অর্থনীতির এরা নিয়ন্ত্রণকারী শক্তিতে পরিগণিত হয়। এরা প্রায় সর্বাবস্থায় ইসলামী আন্দোলনের বিরোধীতা করে থাকে। তবে এদের মধ্যে শুভবুদ্ধি জাগ্রত হওয়া বিচ্রিত নয়। বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হলে এদের অনেকেই রাতারাতি অবস্থান পরিবর্তন করতে দ্বিধাবোধ করবে না। ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ সম্প্রসারণে সুবিধাভোগী শ্রেণীর ভূমিকা খুবই কার্যকর। কোন নীতি-নৈতিকতার এরা ধার ধারে না। যেহেতু এরা প্রতিষ্ঠিত সরকারের পক্ষপুটে বেড়ে উঠে সেহেতু ইসলামী আন্দোলনের জন্য এরা বড় ধরণের বাধার সৃষ্টি করে থাকে। ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এ তিন কায়েমী স্বার্থবাদী বা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিই সুবিধাভোগী শ্রেণীর অন্তর্গত। এ তিনটি কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীই ইসলামী আন্দোলনের চরম দুশমন।
তিন. অনেক মুসলিম দেশেই রাজনৈতিক ও আদর্শিক প্রতিবন্ধকতা খুবই জোরদার। তবে এর প্রকৃতি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। ইসলাম বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি যেখানে বেশী শক্তিশালী সেখfনে রাজনৈতিক বাধা বেশী প্রকট। আবার ইসলামের সঠিক চর্চা ও অনুশীলনের অভাবে ভিন্ন মতাদর্শের প্রভাব মুসলিম সমাজে প্রকট হয়ে দেখা দিতে পারে। তবে রাজনৈতিক ও আদর্শিক বিষয়গুলো পরস্পর সম্পূরক এবং সীমারেখা টানা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক মুসলিম দেশে পাশ্চাত্য জীবনধারা আজ এতটা প্রভাব বিস্তার করেছে যাকে আদর্শিক বিপর্যয়ও বলা যেতে পারে কিংবা রাজনৈতিক বিপর্যয়ও বলা যায়। আদর্শিক বিপর্যয়ের মাধ্যমেই রাজনৈতিক বিপর্যয়ও আসে। মুসলিম দেশগুলো আজ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, স্বৈরাচার বা একনায়কত্ববাদ, রাজতন্ত্র, পাশ্চাত্য গণতন্ত্র বা সামন্তবাদী ব্যবস্থার শিকার। মুসলিম জাহানের সরকারগুলো এর কোনটা না কোনটা আঁকড়ে ধরে আছে রাজনৈতিক ও আদর্শিকভাবে। এর কোনটাই ইসলামী আদর্শের পক্ষে নয়।
চার. বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরী অগ্রগতির এ যুগে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা যেমন সহজতর হয়ে উঠেছে তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে হস্তক্ষেপের সুযোগও বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃথিবীর কোন একটি দেশও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নেটওয়ার্কের বাইরে নয়। বিশ্বময় মোড়লীপনা ও আধিপত্য বিস্তারের মনোভাব থেকেই এ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। সবসময়ই বিশেষ নির্দিষ্ট আন্তর্জাতিক শক্তির বিকাশ ঘটেছে এবং প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। আমাদের আজকের বিশ্বটাও তাই। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে যেহেতু অদ্যাবধি কোন কার্যকর ইসলামী ঐক্যের অস্তিত্ব নেই সেহেতু কোন না কোন বিশ্ব শক্তি বা আঞ্চলিক শক্তি মুসলিম দেশগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। মুসলিম রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে পরাশক্তির হস্তক্ষেপ অতি সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কোন মুসলিম দেশে কারা ক্ষমতায় থাকবে, কারা ক্ষমতায় আসবে এসব কিছুও পরাশক্তির ইচ্ছায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এসব দেশের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণে পরাশক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ পরোক্ষ হস্তক্ষেপ আজ সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। অসহায়ভাবে এসব দেশের জনগণ আজ তা প্রত্যক্ষ করছে। ফলে কোথায়ও জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটছে না। ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তের মাধ্যমে মুসলিম জনগণের কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই শুধু বিলম্বিত করা হচ্ছে না বরং ষড়যন্ত্রের রাজনীতি মুসলিম দেশগুলোর স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে।
পরাশক্তিগুলোর অন্তঃসারশূণ্যতা আজ আর অস্পষ্ট নয়। হাতিয়ার আর বন্দুকের শক্তি ছাড়া অন্য কোন শক্তিই তাদের নেই। একটি নেতবিাচক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পরাশক্তিগুলোর অবস্থান ঠিক রেখেছে। ইতিবাচক শক্তির বিকাশ ঘটলে কিংবা বিশ্বময় নেতৃত্ব দিতে পারে এমন কোন শক্তির আবির্ভাব ঘটলে তা বর্তমান পরাশক্তিগুলোর জন্য অনিবার্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। বিশ্ব নেতৃত্ব দেবার যাবতীয় গুণ ও শক্তি ইসলামের আছে বিধায় ইসলামী আন্দোলনকে পরাশক্তিসমূহ বিপজ্জনক মনে করে। এসব কারণেই পরাশক্তি বা আঞ্চলিক কোন রাজনৈতিক শক্তি ইসলামী আন্দোলনের জন্য বাধার সৃষ্টি করছে।
পাঁচ. পরাশক্তি যেহেতু বর্তমান দুনিয়ায় নেতৃত্বের আসনে সমাসীন ফলে বিশ্বময় তাদের সৃষ্ট সমস্যার কারণে মানবতা যেমন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন তেমনি বিশেষ করে মুসলিম জাহানে তাদের সৃষ্ট সমস্যা ইসলামের অগ্রগতির পথে বাধা। পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ উভয়ই মানুষকে ভোগবাদীর দিকেই আহ্বান জানিয়েছে। মানুষের জীবন ও যৌবনকে উপভোগ করা ছাড়া মানব জীবনের অন্য কোন মহত উদ্দেশ্য নেই। এ ভোগবাদী দৃষ্টিভংগী সৃষ্টি করেছে সাম্রাজ্যবাদ। খুব সহজেই এ বস্তুবাদী দর্শন মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে। পরকালের জীবন দুনিয়ার জীবনের হিসাব-নিকাশ, ভাল-মন্দ পায়ে ঠেলে দিয়ে মানুষকে নফসের গোলামে পরিণত করার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য সভ্যতার অবদান অস্বীকার্য। সুতরাং শয়তানের সাক্ষাত প্রতিভূ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে সাম্রাজ্রবাদ। তাই বলা যায়, ভোগবাদী সভ্যতা ইসলামের জন্য এক বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ।
ছয়. সাম্রাজ্যবাদ গোয়েন্দা তৎপরতার জাল বিস্তার করে রেখেছে সর্বত্র। মুসলিম দেশগুলোতে এ তৎপরতা অনেক বেশী জোরদার। অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার মাধ্যমে বিভিন্ন কৌশলে সাম্রাজ্যবাদ ইসলামী আন্দোলনের উপর আঘাত হানছে।
সাত. মুসলিম দেশগুলোতে স্থিতিশীল কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে না পারে সে ব্যাপারে সাম্রাজ্যবাদ অত্যন্ত সজাগ। নিজ দেশের জন্য তারা যা ভালো বলে মনে করে অন্য দেশে তা করতেও তারা রাজী নয়। অস্থিতিশীলতার মধ্যেও তাদের অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ নিহিত। জনগণের রায় বা ভোট সরকার পরিবর্তনের কোন রাজনৈতিক পদ্ধতি যাতে মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে গড়ে না উঠে সে ব্যাপারেই পরাশক্তিগুলো যত্নবান।
আট. সামরিক শাসন, একনায়কত্ব, স্বৈরশাসন, পারিবারিক বা রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই সাম্রাজ্যবাদ টিকে থাকতে সহায়তা করে। দুই পরাশক্তির মধ্যে এ ক্ষেত্রে বস্তুতঃ কোন পার্থক্য ছিল না। পার্থক্য ছিল শুধুমাত্র বাহ্যিক শ্লোগানে। আর সেই শ্লোগানের অন্তরালে একই ধরণের নিপীড়নমূলক শাসনকে তারা বিশেষভাবে মুসলিম জাহানে উৎসাহিত করে থাকে। আঞ্চলিক ও ভৌগলিক আধিপত্য এবং বাজার সৃষ্টির স্বার্থে এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের লক্ষ্যে কোন অভিন্নতা নেই।
নয়. মুসলিম সমাজকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে দ্বীন ইসলাম তথা স্বকীয়তা,স্বাতন্ত্র্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং তাদের কৃষ্টি-কালচার থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য সর্ববিধ কৌশল সাম্রাজ্রবাদ অবলম্বন করেছে। মুসলিম জাহানে অনৈক্য সৃষ্টি পারস্পরিক বিরোধ জাগিয়ে তোলা এবং ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে লিপ্ত করার কূটকৌশল করে সাম্রাজ্যবাদ মুসলিম সমাজকে প্রতিনিয়ত দূর্বল করে দিচ্ছে।
দশ. ভয়াবহ অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দুর্নীতি বিস্তারের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগণকে অসহায় করে তোলা সাম্রাজ্রবাদী শক্তির আরেকটি কৌশল। অর্থনৈতিক বৈষম্য যাতে মানুষের আদর্শবোধকে পিছনে ঠেলে ফেলে দেয়, রুটি রুজির সন্ধান এবং জীবিকার্জনই যেন জনগণের প্রধান চিন্তার বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়; দারিদ্র্যপীড়িত মুসলিম দেশগুলোতে এ ধরণের সীমাবদ্ধতা সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামের অগ্রগতিকে ব্যাহত করা হচ্ছে।
এগার. কোন দেশে যদি ইসলামী আন্দোলনের একটি সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যায় তাহলে সেই দেশের ইসলামী নেতৃত্বকে গণ বিচ্ছন্ন করা, নেতৃত্ব সম্পর্কে প্রশ্নের সৃষ্টি করা বা নেতৃত্বকে জনগণের কাছে বিতর্কিত করে দেয়াও ইসলামের দুশমনদের বড় ধরণের কৌশল। এজন্য মিথ্যাচার, অপপ্রচার চালানোর যাবতীয় পদক্ষেপ নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার জন্য যা করা দরকার তার সবই করা হয়। এমন কি খুবই সুকৌশলে ইসলামী নেতৃত্বকে দেশের দুশমন, জনগণের দুশমন এবং স্বাধীনতা বিরোধী বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। যেহেতু দেশে দেশে জনগণ একটি নেতৃত্বকে সামনে রেখেই সংঘবদ্ধ বা সংগঠিত হয়ে থাকে তাই একবার যদি নেতৃত্বকে অকার্যকর বা অথর্ব প্রমাণ করে দেয়া সম্ভব হয় তাহলে ইসলামী আন্দোলনকে অনেক পিছিয়ে দেয়া সম্ভব। একই কারণে ইসলামী নেতৃত্ব যাতে গড়ে উঠতে না পারে সে ব্যাপারেও ইসলাম বিরোধী শক্তি তৎপর।
বারেো. শিক্ষা-দীক্ষায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অনগ্রসরতা ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথে আরেকটি বড় ধরণের সমস্যা। নিরক্ষরতা, কুসংস্কার এবং ধর্ম সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাও সমস্যার সৃষ্টি করে। কারণ এর ফলে জনগণ অনেক সময় শত্রুমিত্র চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয় বা জনগণের পক্ষ থেকে যে সাড়া ও সহযোগিতা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন তা সৃষ্টি করা কঠিন হয়ে উঠে।
তেরো. ভয়াবহ সাংস্কৃতিক আক্রমণের মাধ্যমে মুসলিম জাহানে পশ্চিমা সভ্যতা প্রভাব বিস্তারের অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিশেষ করে যৌনতাভিত্তিক পশ্চিমা সংস্কৃতি মুসলিম দেশগুলোতেও বিকৃত সাহিত্য, শিল্পকলা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দিয়ে ধর্মপ্রাণ ঐতিহ্যবাহী জনসমষ্টিকে ভাসিয়ে নিতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ভোগবাদী ও নাস্তিক্যবাদী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপক বিস্তারের মাধ্যমে নৈতিকতা ধ্বংস করা হচ্ছে। যে কোন মতবাদের চাইতে মুসলিম যুব সমাজের শাসনে তথাকথিত পাশ্চাত্য জীবনধারার আকর্ষণই আজ সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। শয়তান যেভাবে নানা পথে ঈমানদার বান্দাকে বিচ্যুত করে থাকে শয়তানের অনুসারী ও বস্তুবাদের ধারক ও বাহকরাও তেমনি মানব জাতিকে শয়তানের প্রলোভনের পথে পরিচালিত করে বিপথগামী করতে সচেষ্ট।
চৌদ্দ. ইসলাম সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করে, মুসলমানরা সন্ত্রাসী।
পনের. এগারোর টুইন টাওযার ধ্বংসের পর বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে একটি ভয়ংকর মিডিয়া ক্যাম্পেইন হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ ও ইসলামকে একাকার করে ফেলা হয়েছে। জেহাদ ও সন্ত্রাসকে সমার্থক করার অপপ্রয়াস চলছে। কুরআন ও মহানবী সা. স্বয়ং সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করেছেন এমন একটি মারাত্মক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ইসলামের বদনাম করার জন্য অত্যন্ত সুকৌশলে কাজ হচ্ছে। ইসলামের নাম ব্যবহার করে চরমপন্থী ও বিপথগামীদের মাঠে নামানো হয়েছে। পাশ্চাত্যের আক্রমণাত্মক প্রচারণা ইসলামকে কোণঠাসা করার জন্য যা কিছু করা দরকার তাই করছে। মিথ্যা প্রচারণা যুৎসইভাবে মুকাবিলায় ব্যর্থ মুসলিম উম্মাহ এখন শুধু চিৎকার করে বলছে যে, ‘আমরা সন্ত্রাসী নই, ইসলাম শান্তির ধর্ম।’ অথচ বিশ্ব ইতিহাসে ঘৃণ্যতম সন্ত্রাস ও মানবাধিকার লংঘনের জন্য যারা দায়ী, কোটি কোটি মানুষের রক্তে যাদের হাত রক্তাক্ত তারা আজ মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন সেজেছে।
২২. সমস্যার মোকাবিলায় করণীয়
আলোচিত সমস্যাগুলোর মুকাবিলা করে ইসলামী বিপ্লবের পথ রচনা করাটাই আজকের প্রেক্ষাপটে সবচাইতে বড় কাজ। একথা নিঃসন্দেহে ঠিক যে বাধা, প্রতিবন্ধকতা এবং সমস্যাদি মুকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হলে ইসলামী নেতৃত্বকে নিম্নোক্ত বিষয়ে আশু দৃষ্টি প্রদান করতে হবেঃ
১. আন্দোলনের কর্মী বাহিনীকে তাকওয়া ও নৈতিকতার মানদণ্ডে গড়ে তুলতে হবে। আন্দোলনের কর্মী বাহিনীর অস্তিত্বই তার আদর্শের পতাকাকে ঊর্ধে তুলে ধরবে।
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
‘‘আল্লাহর নিকট তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক সম্মানার্হ সে, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে নীতিপরায়ণ।’’- (সূরা আল হুজুরাতঃ ১৩)
কোরআনে বিঘোষিত এ নীতিমালাই হবে সম্মান ও মর্যাদার মাপকাঠি।
২. একটি বিপুল সাংগঠনিক শক্তি অর্জন করতে হবে। সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক এমন হতে হবে যাতে আন্দোলনের কেন্দ্র থেকে গৃহীত কর্মসূচী সর্বত্র বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
৩. বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে আন্দোলনের গণভিত্তিকে মজবুত করতে হবে।
৪. জনগণকে আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে। জনসমর্থন লাভ আন্দোলনের বিজয়ের অন্যতম শর্ত। আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক যে কোন ষড়যন্ত্র মুকাবিলা কেবলমাত্র জনসমর্থন দ্বারাই করা সম্ভবন।
৫. স্বৈর সরকার পতনের পর কি ধরণের সরকার কায়েম হবে সে সম্পর্কে যথাসম্ভব জনমনে সচেতনতা জাগ্রত করতে হবে। কোন ধরণের আপোষকামী নীতি অবলম্বন থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। বর্তমান ব্যবস্থার প্রতীক সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় জনমত গড়ে তুলতে হবে।
৬. আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্রবাদের বিপদ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৭. সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আক্রমণ প্রতিরোধ করার পকিল্পনা থাকতে হবে।
এখানে বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য যে, আধুনিক বিশ্বে ইসলামী বিপ্লবের সাফল্য লাভের পথে নানাবিধ জটিল বাধাবিপত্তি ও সমস্যাদি রয়েছে। এসব বাধার পাহাড় এবং সমস্যার জটিলতা অতিক্রম করে আল্লাহর আইন এবং সৎলোকের শাসন তথা খেলাফতি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে হলে ব্যাপক গণসমর্থক অর্জন অপরিহার্য। এ কারণেই ইসলামী আন্দোলনের মূল ইস্যু বা কেন্দ্রীয় বক্তব্য থেকে কোন পার্শ্ব ইস্যু বা প্রাসংগিক ইস্যু এতটা প্রাধান্য পেতে পারে না যাতে আন্দোলনের মূল টার্গেট সম্পর্কেই জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ মূল ইস্যু এবং পার্শ্ব ইস্যুর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরী। সাময়িক বা ছোটখাট ইস্যুতে আন্দোলনকে জড়িয়ে ফেলার বিপদ সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
সক্ষম নেতৃত্ব এবং শক্তিশালী সংগঠনের মাধ্যমে গণজাগরণ বা গণ-অভ্যুত্থান সৃষ্টি করতে পারলে নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সাফল্য লাভ করা যেতে পারে। নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় গণচেতনা সৃষ্টি করা বা ইসলামী হুকুমত কায়েমের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে সাড়া জাগানোর কঠিন কাজটি আঞ্জাম দিতে হবে। সাম্রাজ্যবাদ নিজে সন্ত্রাসের হোতা বা সন্ত্রাসী শক্তির সহায়তাকারী হওয়া সত্ত্বেও অনিয়মতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ এনে নিবর্ত্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে মাঝপথেই কিংবা যাত্রাপথেই আন্দোলনের অগ্রগতি রোধ করতে পারে। তাই ইসলামী বিপ্লবের দুশমনদের অজুহাত সৃষ্টির কোন সুযোগ দেয়া যাবে না।
আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েমের মহান শ্লোগানকে দলীয় গণ্ডি বা সীমারেখার ঊর্ধে তুলে জন আকাঙ্ক্ষা বা জনগণের দাবীতে পরিণত করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, জনগণের কল্যাণ ও মুক্তির জন্য এ সংগ্রাম সেই জনগণ যদি তা না চায় তবে আল্লাহ তায়ালা সেই জনপদে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করে দেবেন এ ধারণা মারাত্মক ভুল। আল্লাহর দ্বীন কায়েমের ব্যাপারে আগ্রহ এবং আকাঙ্ক্ষা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে না থাকলে কোন্ যুক্তিতে বা কেন তিনি ইসলামের ফযিলতে সে জনপদকে সিক্ত করবেন?
আন্দালনের সাফল্যের জন্য আকাঙ্ক্ষা বা আগ্রহের প্রকাশই যথেষ্ট নয়। জনমনে আন্দোলনের প্রতি সহানুভুতি বা সহমর্মিতাই যথেষ্ট নয়। বরং এ আন্দোলনের প্রতি জনগণের ভালোবাসা সৃষ্টি হতে হবে। আদর্শ ও নেতৃত্বের প্রতি কৌতূহল এবং উদ্দীপনার সাথে সাথে আন্দোলনের কল্যাণ কামনায় সক্রিয় জনমত অর্থাৎ জনপ্রিয়তা অনিবার্য। বিরোধীরা হতাশ হয়ে পড়বে অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে এবং আন্দোলনের প্রতি দুর্বলতা প্রদর্শন শুরু করবে। এভাবে ইসলাম বিরোধী শক্তি গণবিচ্ছিন্নতার শিকার হবে। পক্ষান্তরে ইসলামী নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়তে থাকবে।
আন্দোলনকে অবশ্যই দলীয় ভাবমূর্তির ঊর্ধে উঠে সম্মিলিত সংগ্রাম রচনার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দলীয় সংকীর্ণতার অপকারিতা থেকে বেঁচে থাকার মধ্যে আন্দোলনের প্রভাব বলয় বৃদ্ধি ও ব্যপ্তি লাভ অনেকাংশে নির্ভরশীল। একটি ব্যাপক ভিত্তিক ঐক্য, যে ঐক্য হবে এক কথায় জনগণের ঐক্য তা অর্জনে দলীয় স্বার্থ বিসর্জন দেবার প্রজ্ঞাসম্পন্ন হতে হবে ইসলামী নেতৃত্বকে। মতপার্থক্য বা ভিন্নতা নিয়েও ঐক্য এবং সমঝোতা সৃষ্টি করতে হবে। কেননা বিভ্রান্তি বা প্রশ্ন সৃষ্টির জন্য বেশি লোকের দরকার হয় না। অনুল্লেখযোগ্য শক্তিও বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে সফল হয়ে যেতে পারে। সূচনাকালের প্রেক্ষাপট এবং বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিকাশমান একটি আন্দোলনের লক্ষ্য বিচ্যুতি হওয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। অনুপ্রবেশ অন্তর্ঘাত, আপোষকামিতা, হঠকারিতা বা চরমপন্থা, ফ্যাসাদ বা সন্ত্রাস এ সবের ব্যাপারেই সতর্কতা অবলম্বন অতি জরুরী। আন্দোলন যত বেশী গণভিত্তি ও জনসমর্থন লাভ করতে থাকে উল্লেখিত ব্যাপারগুলো তখনই সংঘটিত হতে দেখা যায়। এ লক্ষণগুলো যদিও বা উদ্বেগ ও আশংকার সৃষ্টি করতে পারে তথাপি গতিশীল একটি আন্দোলনে এক পর্যায়ে এ ধরণের লক্ষণ দেখা দেয়া বিচিত্র নয়। আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে এ ব্যাপারে জাগ্রত ভূমিকা পালন করা ছাড়া বিকল্প নেই।
শয়তান যেহেতু ইসলামের চরম দুশমন সেহেতু চতুর্দিক থেকে ইসলামী আন্দেলনের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিই তার প্রধান কাজ। শয়তান এ ক্ষেত্রে ছোটখাট মতপার্থক্য কাজে লাগানো থেকে শুরু করে আন্দোলনে ভাংগন ও বিভেদ সৃষ্টির মত ভয়ংকর ঘটনা সংঘটিত করার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। নানারূপে ও বিভিন্ন পথে ইসলামী শক্তির সংহতি বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। ষড়যন্ত্রের এ প্রকৃতি বুঝা না বুঝার উপরই কেবলমাত্র তা প্রতিহত করার বিষয়টি নির্ভর করে। ইসলামপন্থীদের বিভেদ আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য একটি বড় ধরণের সমস্যা। কেননা সরলপ্রাণ জনগণের মধ্যে এতে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। নতুন নতুন ইসলামী সংগঠন গঠন করেও অনেক সময় ইসলামী আন্দোলনের বিরোধীতা করা হয় এবং জনমনে আন্দোলনের পবিত্রতা সম্পর্কে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি করা হয়। গণআন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এসব বাস্তব সমস্যা সতর্কতার সাথে মুকাবিলা করতে হবে। এর কোন একটির ব্যাপারে অসতর্কতা আন্দোলনের গতি পিছিয়ে দিতে পারে। অনেক মুসলিম দেশেই ইসলামী আন্দোলনে এ ধরণের বাস্তব সমস্যার মুকাবিলায় কঠিন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। বর্তমান যুগের ইসলামী আন্দোলনের জন্য সমস্যা যেমন বেশী তেমনি বিভিন্ন দেশে আন্দোলনের অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে সতর্কতা অবলম্বন করার সুযোগও বেশী।
২৩. গণআন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি
এক. রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব সৃষ্টিঃ মূল নেতৃত্ব আন্দোলনের যে মহাপরিকল্পনা রচনা করবেন তাতে সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়ার যোগ্য বিষয় নেতৃত্ব। তৃতীয় বিশ্বের বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি যেহেতু অনাগ্রহ বা অনাস্থা রয়েছে সেহেতু সমান্তরালভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নিতে হবে। সামাজিক নেতৃত্ব অনেক বেশি কার্যকর এবং শক্তিশালী। জনগণের নিকট অধিকতর গ্রহণযোগ্য এবং জনমত সৃষ্টিকারী শক্তিসমূহের নিকট গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব সামনে আনতে না পারলে নিছক আদর্শের সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন। বিভিন্ন শ্রেণীর এলিট পর্যায়ভুক্ত জনমণ্ডলী নেতৃত্বকে মেনে নিতে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। জাতির নেতৃত্ব তারা গ্রহণ করতে পারেন এ আস্থা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনের সাফল্যা আশা করা অসম্ভব।
দুই. গণ সংগঠনঃ সাংগঠনিক আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা দূরীকরণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা একটি মজবুত সংগঠনই পারে আন্দোলনের বাহন হিসেবে ভূমিকা পালন করতে। সংগঠনের সদ্য পর্যায়ভুক্ত না হয়েও যখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক সংগঠনটিকে সামগ্রিকভাবে নিজের মনে করবেন এবং দেশের সর্বত্র গণ সংগঠন ও নেটওয়ার্ক সক্রিয়ভাবে সংগঠনের বাণী সর্বত্র পৌঁছে দিতে পারবে কেবলমাত্র তখনই আন্দোলন জোরদার করার পদক্ষেপ নিবে।
তিন. দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কঃ দ্বীন ইসলাম যেহেতু ইসলাম আন্দোলনের প্রণশক্তি তাই দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাসমূহের সাথে আন্দোলনের গভীরতা বৃদ্ধি করার আগে গণআন্দোলন সৃষ্টির চেষ্টা অবাস্তব। দেশের মানুষ যেসব প্রতিষ্ঠানকে দ্বীনি প্রতিষ্ঠান মনে করে যেসব প্রতিষ্ঠানকে সত্যিকার-ভাবেই অর্থাৎ নামে ও কাজেও দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হতে হবে। ইসলামের বিপ্লবী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোও যাতে কাংখিত ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে পারে সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
চার. নারী সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবেঃ মহিলা ও নারী সমাজ সামাজিক পরিবর্তনে বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম। অন্য কথায় তাদের সহযোগিতা ছাড়া কোন সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন সফল হতে পারে না। আজকের দুনিয়ায় শিক্ষিত মহিলারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তেমনি পালন করছে যেমনটি আগেও ছিল। আদিকাল থেকেই রাজনীতি ও সমাজ নিয়ন্ত্রণে মহিলাদের একটি শক্তিশালী ভূমিকা রয়েছে। কোন আন্দোলনের জন্য সে আন্দোলনকে গণআন্দোলনের রূপ দেয়া অতি জরুরী। আর গণআন্দোলনের রূপ দিতে চাইলে মহিলাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ অনিবার্য। অনেক মনে করতে পারেন যে, এটা বাস্তব নয়। কিন্তু আসলেই বাস্তব। মহিলাদেরকে তাদের অবস্থান থেকেই এ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাই নারী সমাজ ও ছাত্রীদেরকে ইসলামী আন্দোলনের পথে উদ্বুদ্ধ করতে হবে ব্যাপকভাবে। ইসলামের সঠিক শিক্ষার অভাবে মহিলা ও ছাত্রীরা বিভ্রান্ত হয়েছে বা হচ্ছে। বিভ্রান্তির জাল ছিন্ন করে ইসলামের মহত্ব ও সৌন্দর্যের মানে তাদেরকে পরিচিত করতে হবে। জাতীয় জীবনে তাদের অবদান রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা যা ইসলাম অনুমোদন করে তা নিশ্চিত করতে হবে।
পাঁচ. মেহনতি মানুষের ভূমিকাঃ শিল্পকারখানায় খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের সমাবেশ ঘটে থাকে। সভ্যতার কারিগর হিসেবে ইসলামী আন্দোলনেও শ্রমিক সমাজ অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে। তাছাড়া ইসলাম ও মানবতার দুশমনরা দুনিয়া ব্যাপী যে শ্রেণীটিকে সবচাইতে বেশী ধোঁকা দিচ্ছে তারা হলো শ্রমিকশ্রেণী। মুসলিম দেশগুলোতেও শ্রমিকদেরকে বিদেশী তন্ত্রমন্ত্রের নামে চরম বিভ্রান্তির শিকারে পরিণত করা হয়েছে। ইসলামে শ্রমিকদের মর্যাদা এবং অধিকার যা নির্ধারিত রয়েছে অন্য কোন রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তা নেই। দুঃখজনক হলো সরল প্রাণ শ্রমিকদের উল্টো ইসলামের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করছে ইসলামের দুশমনরা। গণআন্দোলনের সূচনালগ্নেই শিল্প-কারখানা ও শ্রম অংগনে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।
ছয়. ছাত্র সমাজকে গঠনমূলক কাজে লাগাতে হবেঃ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই সবচাইতে পবিত্র ও নিঃস্বার্থ মানুষের আঙিনা। ছাত্র ও তরুণদের দেশের প্রতি ভালোবাসা, আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা ও আবেগ এক অতুলনীয় শক্তি। সবচাইতে নিঃস্বার্থভাবে যারা কোন আন্দোলন বা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে তারা হলো ছাত্র সমাজ। আমাদের দেশেরই শুধু নয়, বরং পৃথিবীর দেশে দেশে ছাত্রদের সংগ্রামী ভূমিকা সংশ্লিষ্ট দেশের ইতিহাসের গতি বদলে দিয়েছে। মানচিত্র পরিবর্তন করেছে এবং আদর্শের উত্থান ও পতনেও শিক্ষাঙ্গনের অসাধারণ শক্তিশালী ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ছাত্র সমাজের সম্মিলিত শক্তির সামনে সামরিক বাহিনীর কামানবন্দুক পর্যন্ত অকেজো হয়ে পড়েছে। গণআন্দোলন সৃষ্টি নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি হচ্ছে ছাত্র সমাজ। এখান থেকে অংকুরিত হয়েই বিভিন্ন সময়ে বড় বড় আন্দোলন দানা বেধে উঠেছে। তবে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়েই কেবলমাত্র ছাত্রদের অংশগ্রহণ যুক্তিযুক্ত। এক্ষেত্রে অনেক দেশেই তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। কোন কোন দেশে তো এমনও অনেক হতে দেখা গেছে যে, ছাত্রদের কেবলমাত্র আন্দোলনের উপকরণ হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে। কোন অবস্থাতেই ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে শিক্ষাঙ্গনের আন্দোলনকে ব্যবহার করা যায় না। ছাত্রদেরকে রাজনৈতিক আন্দোলনে খুব সহজলভ্য মনে করে এবং দ্রুত ফলাফল লাভের আশায় যারা ছাত্রদের ব্যবহার করার কৌশল অবলম্বন করেছে তারা জাতিকে তেমন কিছুই দিতে পারেনি। ছাত্র সমাজকে গঠনমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
সাত. আলেম সমাজের অগ্রণী ভূমিকাঃ দেশের আলেমগণ মুসলিম সমাজে এক বিরাট প্রভাব রাখেন। দেশের জনগণের আস্থা তাদের প্রতি এখনও অটুট। কিন্তু যে সময় থেকে আলেম সমাজ নেতৃত্ব থেকে সটকে পড়েছেন তখন থেকেই মুসলিম সমাজের বড় ধরণের বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দেশ চালানো বা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে বর্তমান আলেম সমাজ আমাদের কতটুকু নেতৃত্ব দিতে সক্ষম এ প্রশ্নটি ছোট কোন প্রশ্ন নয়। আলেম সমাজের মধ্যে যারা বিপ্লবী এবং যাদের জ্ঞান, চরিত্র, আয়ের উৎস এবং তাকওয়া পরহেজগারী সম্পর্কে জনগণের আস্থা রয়েছে; তারা অবশ্যই একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনে সক্ষম হবেন। ইসলামী বিপ্লবের কাজে আলেম সমাজকে অগ্রণী ভূমিকায় সম্পৃক্ত করতে না পারলে ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপক গণসমর্থন অর্জন করা কঠিন। আলেম সমাজকে উচ্চতর ইসলামী গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে।
আট. ব্যাপক দাওয়াতী কার্যক্রমঃ মূল দাওয়াত মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হবে। অনেক দফা ও অনেক কথার ভীড়ে মূল কথা অনেক সময় হারিয়ে যায়। ইসলামী আন্দোলন যে মূল দাওয়াতের দিকে দেশবাসীকে আহ্বান জানাতে চায় তা জনগণকে অবহিত করার জন্য এবং জনগণের দায়িত্ব সম্পর্কে তাদের সচেতন করার জন্য নিম্নরূপ কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। মানুষের ঘরে ঘরে দাওয়াত পৌঁছানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাপক দাওয়াতী তৎপরতা গণভিত্তি রচনার প্রধান কাজ।
১. ইসলামের তৌহিদের বিপ্লবী বাণী মৌখিকভাবে ব্যাপক প্রচার। ইসলাম চর্চা, প্রচার ও অনুশীলনের এক ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি।
ক. যার যার সামর্থ অনুযায়ী ব্যক্তিগতভাবে আলাপ আলোচনা এবং প্রয়োজনে ঘরে ঘরে গিয়ে পৌঁছান।
খ. সব ধরণের সভা, সমাবেশ, সেমিনার, ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য পেশ। মানুষের মধ্যে খিলাফত ও বন্দেগীর অনুভূতি সৃষ্টি।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশের মত নিরক্ষরতার হার যেসব দেশে বেশী সেসব দেশে মুখে মুখে ইসলাম প্রচার অর্থাৎ মৌখিক প্রচার পদ্ধতি নিঃসন্দেহে সবচাইতে শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে। মৌখিকভাবে আন্দোলনের দাওয়াত পৌঁছানোর একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া আছে যা সংগঠন ব্যবস্থায় করে থাকে। আবার স্বল্পকালীন অভিযান পরিচালনা করা যেতে পারে। সপ্তাহ বা পক্ষ পালন করে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় প্রতিটি ঘরে দাওয়াত পৌঁছানে যেতে পারে। বড় বড় মাহফিল বা সমাবেশ আয়োজন করে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে বক্তব্য দেয়া যেতে পারে। নিরক্ষর বা অল্প শিক্ষিত লোকদের মধ্যে দাওয়াতী তৎপরতা কার্যকরী করার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাপক পদক্ষেপ নিতে হবে। মসজিদগুলোকে দ্বীনি দাওয়াতের প্রাণ কেন্দ্রে পরিণত করতে হবে।
২. প্রচারপত্রঃ প্রচারপত্র সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের বুঝার উপযোগী করে দুঃশাসন এবং অনৈসলামী সমাজ ব্যবস্থার হাত থেকে জনগণের মুক্তি ও আখেরাতের নাজাতের পথ নির্দেশ করে আন্দোলনের মূল কথা মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছানের ব্যবস্থা। নানা রকম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রচারপত্র ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩. পোষ্টারিং ও দেয়াল লিখনঃ আন্দোলনের নেতৃত্বের পক্ষ থেকে প্রচারপত্রের পাশাপাশি পোষ্টারিং ও দেয়াল লিখনের মাধ্যমে আন্দোলনের মূল বক্তব্যের সাথে জনগণকে পরিচিত করা এবং জনপ্রিয় করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ খুবই কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে। নির্দিষ্ট ও আকর্ষণী কতিপয় শ্লোগানের ভাষাকে জনপ্রিয় করে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪. বই পুস্তক প্রকাশ ও প্রচারঃ মানুষের হৃদয়ে আন্দোলন সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি এবং মানসিক প্রস্তুতির জন্য তথা ইসলামী বিপ্লবের বুদ্ধিবৃত্তিক পটভূমি গড়ে তোলার জন্য পুস্তক খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। জনগণের মধ্যে ব্যাপক বই পুস্তক পড়ানো ও পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তোলার দিকেও নজর দিতে হবে।
৫. কোরআনের তাফসীর ও হাদীসের বাণীঃ সংশ্লিষ্ট ভাষায় ব্যাপকভাবে পবিত্র কোরআনের তাফসীর ও হাদীসের ব্যাপক চর্চা ও প্রচারের অব্যাহত অভিযান পরিচালনা। মনে রাখতে হবে কোরআন-হাদীসের শিক্ষার ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমেই কেবল মাত্র ইসলামী জাগরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যেতে পারে। আরবী ভাষায় যেহেতু অন্যান্য ভাষাভাষীর জনগোষ্ঠীর পক্ষে সরাসরি বুঝা ও হৃদয়ঙ্গম করা কঠিন তাই সহীভাষায় তাফসীর এবং হাদীসের ব্যাপক চর্চা সমাজে ছড়িয়ে দেয়া। এভাবেই নীরবে ইসলামী বিপ্লবের বুদ্ধিবৃত্তিক পটভূমি সৃষ্টি করা সহজ হতে পারে।
৬. ক্যাসেট ও ভিডিওঃ আন্দোলনের নেতৃত্বের বাণী ও বক্তব্য আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া ও উদ্দীপনা সৃষ্টিতে ক্যাসেট ও ভিডিও সিডি শক্তিশালী ভূমিকা পালনে সক্ষম। কোন কোন পর্যায়ে এ মাধ্যম ব্যবহার অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। নেতৃবৃন্দের বক্তৃতার সিডি ভিডিও ক্যাসেট ব্যাপকভাবে ছড়াতে হবে।
৭. সংবাদপত্র ও সাময়িকীঃ আধুনিক বিশ্বে সংবাদপত্রের অসাধারণ ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না। জনগণের দাবী দাওয়া আদায়ের আন্দোলন থেকে শুরু করে পার্শ্ব ইস্যু কিংবা সমাজ কাঠামোর বা মানচিত্রের পরিবর্তন আনয়নে সংবাদপত্রের ভূমিকা খুবই কার্যকর ও শক্তিশালী। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে বিপ্লবের পটভূমি সৃষ্টি পর্যন্ত সংবাদপত্রের ভূমিকা অনবদ্য।
জনমত গঠন ছাড়া সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন কল্পনা করা যায় না। আর জনমত গঠনের জন্য সংবাদপত্র সবচাইতে শক্তিশালী আধুনিক হাতিয়ার। এমনকি ইলেট্রনিক মিডিয়া রেডিও টেলিভিশনের ব্যাপক প্রভাব সত্ত্বেও সংবাদপত্রের গুরুত্ব কমেনি মোটেই। দৈনিক পত্রিকার পাশাপাশি এবং অনেক ক্ষেত্রে তার চাইতেও বেশী গুরুত্বের দাবীদার সাপ্তাহিক পত্রিকার। সাপ্তাহিক পত্রিকা, সংবাদ নিবন্ধ, সংবাদ পর্যালোচনা, সংবাদ বিশ্লেষণ, সংবাদ-পটভূমিকা এবং খবরের পিছনের খবর নিয়ে আলোচনা করে জনতাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতে পারে। পত্রিকার শক্তি এতটা বেশী যে ছাপার অক্ষরে পত্রিকাগুলো দেশ জয় করতে পারে। তাছাড়া মানুষের কাছে এখনও ছাপার অক্ষরের গুরুত্ব অনেক বেশী।
প্রচার কৌশলের উপর সমাজতন্ত্রীরা অনেক বেশী গুরুত্ব দিয়েছিল। ফলে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তারা একটি উল্লেখযোগ্য অবস্থান করে নিয়েছে। যে কারণে সমাজতন্ত্রের মত অবাস্তব একটি মতবাদ পৌনে এক শতাব্দীকাল মানুষকে প্রতারিত করতে সক্ষম হয়েছে। সংবাদ মাধ্যম ও শক্তিশালী প্রচারণাই মূলতঃ এ অন্তঃসারশূণ্য ব্যবস্থাকে দীর্ঘদিন টিকে থাকতে সাহায্য করেছে। ইহুদীরাও পাশ্চাত্যের সংবাদপত্রের পিছনে জোঁকের মত লেগে আছে। অর্থনীতিকে হাত করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি বরং সংবাদপত্রে তাদের হাত শক্তিশালী রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত যন্তশীল।
মুসলমানরা সাধারণভাবে শক্তিশালী এ হাতিয়ারটির ব্যাপারে অসচেতন। ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামীগণও এ ব্যাপারে খুব একটা সাফল্যের পরিচয় দিতে পারেননি। হয় তারা এ গুরুত্বকে হালকা করে দেখেছেন অথবা এক্ষেত্রে অযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। মক্তব-মাদ্রাসা-ইয়াতিমখানা প্রতিষ্ঠার যতটুকু গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সংবাদপত্র গড়ে তোলার জন্য সে প্রচেষ্টাটুকুও চালানো হয়নি।
সফল গণআন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পত্রপত্রিকা যেমন শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে তেমনি আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে আন্দোলনকে অনেক পিছিয়ে দিতে পারে অথবা আন্দোলনের অগ্রগতিতে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। প্রচার মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে অনেক দেশেই বহু ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে প্রচার মাধ্যমের ইসলামী আন্দোলন বিরোধী ভূমিকা অনেকেই প্রত্যক্ষ করছেন। ভিত্তিহীন মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে ইসলামী আন্দোলন ও নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে জনমনে বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষ সৃষ্টির হেন প্রচেষ্টা নেই যা প্রচার মাধ্যম করেনি।
প্রচার মাধ্যমের ক্রমাগত অসহযোগিতা ও বিরোধিতার কারণে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে আদর্শ, দেশ ও জনগণের সেবায় সর্বস্ব ত্যাগ করার পরও যতটা সুফল পাওয়া উচিত ও জনসমর্থন পাওয়া দরকার তা পায় না। এমনকি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে জীবন দেবার পরও শাহাদাত লাভের পরও সংবাদপত্রের বিভ্রান্তিকর ভূমিকার জন্য দেশবাসীর সমবেদনা লাভ করতে সক্ষম হয় না। বৈরী সংবাদপত্র শুধু যে, কোন ঘটনা ঘটলে বিরূপ ও মিথ্যা খবর পরিবেশন করেই ক্ষান্ত হয় তা নয়। ইতিবাচক যেসব সংবাদ প্রচারিত হওয়া অতি প্রয়োজনীয় তার পরিবর্তে শুধুমাত্র নেতিবাচক খবর প্রচার করে মানুষের মনে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সঞ্চার করে। মিথ্যা ঘটনা, বিকৃত উক্তি প্রচার করে আন্দোলনের বিরুদ্ধে সংবাদপত্র মানুষকে ক্ষেপিয়েও তুলতে পারে।
শক্তিশীল সংগঠন পর্যন্ত বৈরী সংবাদপত্রের সামনে অসহায় হয়ে পড়ে। শক্তিশালী সংবাদপত্র গড়ে তোলা ছাড়া গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে যে বাধা আছে তা দূর করা সম্ভব নয়। সারা দুনিয়ায় অন্যান্য ক্ষেত্রের মত সংবাদপত্রের নেতৃত্বও দিচ্ছে হয় ইসলাম বিরোধীরা না হয় ইসলামকে পছন্দ করে না এমন শক্তিগুলো। প্রতিটি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিলে ভারসাম্য সৃষ্টি করা সম্ভব হতে পারে। বর্তমান অবস্থাটা একতরফা। ইসলামী আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক, উগ্রবাদী ও ফ্যাসিষ্ট শক্তি হিসাবে চিত্রিত করা হচ্ছে। ইসলামী আন্দোলনের জনসমর্থন লাভের ক্ষেত্রে যে সমস্ত বাধা আছে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম তার মধ্যে অন্যতম। বিষয়টি সঠিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে সফল ও শক্তিশালী সংবাদ মাধ্যম সৃষ্টির কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৈরী সংবাদ মাধ্যমের এভাবেই মুকাবিলা সম্ভব।
৮. গণসংযোগ অভিযান ও সফর ইসলামী বিপ্লবের সাফল্যের জন্য নেতৃত্বের সাথে জনগণের একটি সফল সেতৃবন্ধ রচনা করা দরকার। জনগণের সাথে নেতৃত্বের যোগসূত্র যদিওবা সংগঠন কিংবা সাংগঠনিক প্রচারপত্র, বই পুস্তক তথাপি নেতৃত্বকে জনগণের খুব নিকটে পৌঁছতে হবে। মহানবী সা. যেমন মানুষের ঘরে গিয়ে হাজির হতেন ঠিক তেমনি গণসংযোগ অভিযান ইসলামী আন্দোলনের বর্তমান নেতৃত্বকেও পরিচালনা করতে হবে। সফর এমন হবে যাতে এলাকাবাসী বুঝতে পারেন যে অমুক ব্যক্তি আজ এখানে এসেছেন এবং তার বক্তব্য এই। কে কোথায় গেলেন, কি বললেন মানুষ জানতে পারলো না এমন সফর অর্থহীন। সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য হবে মানুষের কাছে যুগ সমস্যা ও যুগের দাবী সামনে রেখে মানুষের সামনে দাওয়াত তুলে ধরা। দাওয়াত জনগণের মধ্যে পৌঁছাতে সাফল্য লাভ করার উপরই নির্ভর করছে আন্দোলনের সাফল্য। মনে রাখতে হবে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের মনে দ্বীনের আলো জ্বালিয়ে দিতে হবে, ঈমানী চেতনা জাগ্রত করতে হবে।
৯. বাস্তব কাজের মাধ্যমে সামাজিক শক্তি অর্জনঃ শুধু বক্তৃতা ভাষণ নয়, বরং কাজের মাধ্যমে সমাজে স্থান করে নিতে হবে ইসলামী নেতৃত্বকে। মানুষ তার পরিচয় পাবে কাজের মাধ্যমে এবং বাস্তব তৎপরতার মাধ্যমে জনগণের কল্যাণের জন্য এবং মানুষের বিপদে আপদে তাদের পাশে দাঁড়াতে না পারলে বা জনগণের উৎপাত সহ্য করার মত ধৈর্য ও সহনশীলতা না থাকলে সেই নেতৃত্ব ইসলামী আন্দোলনে তেমন কোন অবদান রাখতে পারবেন না। মানুষ হৃদয় দিয়ে ভালোবাসলেই কেবলমাত্র তাদের হৃদয়ে স্থান করে নেয়া সম্ভব।