১৬. সংগঠন
এমন এক সময় ছিল যখন আধুনিক পদ্ধতির বা কাঠামোর সংগঠন ছিল না। কিন্তু বর্তমান দুনিয়ায় সর্বত্র সংঘবদ্ধ হয়ে কিংবা কোন একটি সংগঠনের শৃংখলার কাঠামোর মধ্যে কাজ করার বা আন্দোলন করার প্রবণতা শুধু বাড়েইনি বরং ছোট বড় সব ধরণের লক্ষ্য বাস্তবায়নেই সংগঠন হাতিয়ার হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। সুতরাং ইসলামী বিপ্লবের মত অতবড় একটি কর্ম সম্পাদনের জন্য সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার্য। আল্লাহর নবীর সা. সংগঠনের কোন নাম ছিলনা বটে কিন্তু সেটি যে একটি সংগঠনের রূপ পরিগ্রহ করেছিল তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
বর্তমান বিশ্বে কমবেশী সর্বত্র ইসলামী তৎপরতা চালাতে গিয়ে সকলেই সাংগঠনিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে দ্বিধা করেননি। সর্বত্র সংগঠন গড়ে তুলেই কাজ হচ্ছে। অবশ্য সংগঠন বা দল গঠন করাকে কেউ কেউ পাশ্চাত্য পদ্ধতির অনুসরণ বলে সমালোচনা করতে প্রয়াস পেয়েছেন। রাজনৈতিক দল গঠনের আধুনিক প্রক্রিয়াকে যারা পাশ্চাত্যের অনুকরণ বলে সমালোচনা করেছেন সম্প্রতি তারা এর কোন বিকল্প উপস্থাপন করেননি বা করতে সক্ষম হননি। অন্যদের পাশ্চাত্য দলের অনুসরণের সমালোচনা করে তারা নিজেরাই প্রকারান্তরে তার অনুসরণ করছেন। নিজেরাও একটি শৃংখলা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতি অনুসরণ করেন। তার নাম কোন দল বা পার্টি বলা হোক বা না হোক কার্যতঃ একটি সংগঠন হিসেবে তা কাজ করে। দল গঠনকে যারা পাশ্চাত্যের অনুসরণ বলে একটি তাৎক্ষণিক আকর্ষণীয় বক্তব্য উপস্থাপন করতে প্রয়াস পাচ্ছেন তাদের সে সমালোচনা অন্তঃসারশূণ্য। উপরন্তু তাদের মধ্যে এক ধরণের মারাত্মক ব্যক্তি পূজার প্রবণতা রয়েছে যা দ্বীনি দৃষ্টিভংগীর সম্পূর্ণ খেলাফ। মজার ব্যাপার যে কোন দল ও গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত থেকেই কিন্তু তারা আধুনিক রাজনৈতিক দল গঠন করে মাওলানা মওদূদী র. সঠিক কাজ করেননি বলে তরুণ ও যুব মানসে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন। সুতরাং এ ধরণের অর্থহীন ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত সমালোচকদের কথার গুরুত্ব দেবার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
তবে ইসলামী বিপ্লবাকাঙ্ক্ষী সংগঠনের অবশ্যই কতগুলো বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হতে হবেঃ
এক. সংগঠনটির সার্বিক কর্মকাণ্ড ইসলামী বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্য নিবেদিত হতে হবে। এ সংগঠন দাওয়াত সম্প্রসারণ করবে ব্যক্তিগত বা সামষ্টিকভাবে বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে। দাওয়াতে সাড়া দিয়ে যারা সংঘবদ্ধভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে প্রস্তুতি গ্রহণে আগ্রহী হবেন তাদের সমন্বয়ে গড়ে উঠবে সাংগঠনিক নেটওয়ার্ক। যে সংগঠন বা একটি প্রাথমিক ইউনিট গড়ে উঠবে তা বিপ্লবের জন্য সংগ্রাম করবে এবং সংগ্রামী তৎপরতাকে প্রাধান্য দিবে। সংগ্রামের মাধ্যমেই বিপ্লব আসবে অন্য কোন সহজ প্রক্রিয়ায় নয়। সুতরাং সংক্ষেপে আমরা বলতে পারি দাওয়াতের মাধ্যমে গড়ে উঠবে সংগঠন, আর এই সংগঠন আঞ্জাম দিবে সংগ্রাম এবং সংগ্রামের কণ্টকাকীর্ণ পথেই অর্জিত হবে বিপ্লব। দাওয়াত-সংগঠন-সংগ্রাম-বিপ্লব এই ফর্মূলায় চলবে একটি বিপ্লব প্রত্যাশী ইসলামী সংগঠন।
দুই. ইসলামী বিপ্লব প্রত্যাশী সংগঠনের নেতৃত্বকে অবশ্যই প্রশ্নাতীতভাবে বিপ্লবী হতে হবে। শুধু মূল নেতা গতিশীল হলেই চলবে না বরং তার গোটা টীমটাই হবেন বিপ্লবী এবং গতিশীল।
তিন. সংগঠনের জনশক্তি তাদের চরিত্র ও কর্মচাঞ্চল্যের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের জনসমষ্টিকে গণসংগ্রামে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি সর্বাবস্থায় অগ্রাধিকার দিবে। সংগঠনের অধিকাংশ শক্তি, সম্পদ প্রত্যক্ষভাবে বিপ্লব প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হবে। যেকোন মূল্যে একটি টিপটপ বা সৃশৃংখল সংগঠন গড়ে তোলা কঠিন নয়, কিন্তু সে সংগঠন কতুটুকু বিপ্লবী সংগঠন হতে পেরেছে সেটাই বিচার্য।
চার. সংগঠনে তাকওয়া, আমানতদারী, আনুগত্য, সংশোধন, সমালোচনা পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধের এক উন্নত দ্বীনি পরিবেশ থাকতে হবে। সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করা, আলাপ-আলোচনা পরামর্শ ও মতবিনিময় করার উন্মুক্ত পরিবেশের পাশাপাশি বিভিন্ন মতের সমন্বয় সাধনের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থাও থাকতে হবে। অন্য সংগঠনের ন্যায় ইসলামী সংগঠনে নেতৃত্ব লাভের কোন প্রতিযোগিতা যদি বিন্দুমাত্রও থাকে তা হবে আত্মঘাতী এবং বিপর্যয়ের কারণ।
১৭. ক্যাডার সিসটেম
জামায়াতে ইসলামী এবং ইখওয়ানুল মুসলিমিনসহ বিশ্বময় পরিচিত আন্দোলনসমূহ ক্যাডার সিসটেম গ্রহণ করেছে। অতি সম্প্রতি কেউ কেউ জোর গলায় জামায়াত ও ইখওয়ানকে ট্র্যাডিশনাল ইসলামী আন্দোলন আখ্যায়িত করেছেন এবং এসব সংগঠন বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনা করছেন না মর্মে প্রচারণা চালাচ্ছেন। আবার অনেকে ক্যাডার সিসটেম সম্পর্কেও সমালোচনা মুখর। এদের ধারণা জামায়াত বা ইখওয়ান কম্যুনিষ্ট আন্দোলন থেকে বিষয়টি ধার করেছেন। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট যে, সমালোচনাকারীদের এসব ধারণা ঠিক নয়। হুজুর সা.-এর সংগী সাথীদেরকে বলা হয় সাহাবায়ে কেরাম। সাহাবাদের মধ্যে আরেক দল ছিলেন আসহাবে সুফফা। আবার বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবাদেরকে দেয়া হয়েছিল বিশেষ মর্যাদা। মহানবীর সা. জিন্দেগীতে দেখা গেছে তিনি বিশেষ একদল সাহাবীর বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে ডাকতেন এবং তাদের সাথে পরামর্শ করতেন। আবার অনেক সময় সাধারণভাবে সমাবেশ আয়োজন করে আলোচনা করতেন। অনুরূপভাবে ছিলো আনসার ও মুহাজিরগণ। অন্যদিকে মহানবী সা.-এর মক্কায় তেরো বছর অবস্থান কালে যারা ইসলামের পতাকা তলে সমবেত হন তারাই ছিলেন হিজরতের আগ পর্যন্ত নবীজীর বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথমিক জনশক্তি। এসব আজকালকার পরিভাষায় ক্যাডার বলা না হলেও মূলতঃ তারা ক্যাডারের ভূমিকা পালন করেছেন। সুতরাং নবীজীর আন্দোলনে ক্যাডার ছিলো না এমন কথা বলা যায় না। তাছাড়া ক্যাডার পদ্ধতি লোক রিক্রুটম্যান্ট এবং প্রশিক্ষণ দানের উত্তম একটি ব্যবস্থা। এটা বৈজ্ঞানিকও বটে। মানুষের মধ্যে শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টির জন্য নয় বরং লোক তৈরী ও মানোন্নয়নের জন্য ক্যাডার ব্যবস্থা দরকার। তবে ক্যাডার কোনক্রমেই একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীতে পরিণত হওয়া উচিত নয়। কম্যুনিষ্ট দেশগুলোতে যা হয় তাহলো মূলতঃ কমরেড বা কম্যুনিষ্ট পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ের ক্যাডারগণ একটি প্রিভিলেজড ক্লাস হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকে। এতদসত্ত্বেও ক্যাডার সিসটেমের উপকারিতা এবং প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। স্মরণযোগ্য যে, ক্যাডার যেন জনগণের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত একটি সদাকর্মচঞ্চল আদর্শ জনশক্তি হিসেবে ভূমিকা পালনে সক্ষম হয় সেদিকে সংগঠনকে সতর্ক থাকতে হবে। অবশ্যই প্রথম শ্রেণীর ক্যাডার বলে যারা গণ্য হবেন তাদের ইসলামী গুণাবলীতে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হতে হবে। যারা হবেন সার্বিক বিবেচনায় সমাজে অগ্রগণ্য এবং সমাজকে নেতৃত্ব দানের যোগ্যতাসম্পন্ন।
কোন একটি সংগঠনের ক্যাডার সার্টিফিকেট হিসেবে বা সংশ্লিষ্ট ক্যাডারে উন্নীত হলেই সমাজ তাকে আলাদা মর্যাদা দান করবে এমনটি আশার করার পরিবর্তে ক্যাডার উন্নীত ব্যক্তিকেই নিজ গুণাবলী ও যোগ্যতা বলে সমাজে তার মর্যাদা বা স্থান করে নিতে হবে। সমাজের আর দশজন লোকের চাইতে নৈতিক আধ্যাত্মিক সকল দিক দিয়ে তিনি স্বাভাবিকভাবেই অগ্রসর হবেন। তার বিপ্লবী চরিত্র, ত্যাগ ও কোরবানী সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করবে। তার কার্যক্রম, স্বভাব চরিত্র, লেনদেন, আচার-ব্যবহার তার নিষ্ঠা আন্তরিকতা, দেশপ্রেম, রাজনৈতিক সচেতনতা সমাজে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। সংগঠনের নাম ভাংগিয়ে ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় তো দূরে থাক বরং ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার বিনিময়ে সংগঠনের তথা সংগঠনের আদর্শের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে ভূমিকা পালন করবে।
প্রথম শ্রেণীর ক্যাডার যদি সার্বিক বিবেচনায় উন্নত মান সংরক্ষণে ব্যর্থ হয় তাহলে ক্যাডারভিত্তিক আন্দোলন পিছিয়ে যেতে বা গতিহীন হতে বাধ্য। সংখ্যা যত বড়ই হোক না কেন কাঙ্ক্ষিত মানের ক্যাডার ছাড়া একটি বিপ্লবী আন্দোলন অগ্রসর হতে পারে না। স্থবিরতার জঞ্জাল যদি ক্যাডার সংগঠনের কাঁধে চেপে বসে তাহলে সেই সংগঠনের ব্যাপারে জনগণের হতাশা বেড়েই চলবে। জনগণ যদি একবার হতাশ হয় তাহলে হতাশার হাত থেকে সংগঠনটিকে বাঁচানো কঠিন হতে বাধ্য। সংগঠনের জনশক্তি যদি হতাশার শিকার হয় তাহলে ঐ সংগঠনকে সামনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়াও কঠিনতর। ইসলামী বিপ্লবের জন্য ক্যাডার সংগঠন বিশেষভাবে পয়োজন। কিন্তু ক্যাডারের মান অবশ্যই এতটা উন্নত হতে হবে যে, ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত জনশক্তি তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে জনগণের কাছে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হবেন।
ঈমানের ঘোষণা দানকারীকে মুমিন বলা হয়। আল্লাহ, রাসূল সা., অবতীর্ণ গ্রন্থ, ফেরেশতা, আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণকারী ব্যক্তি মুমিন হিসেবে পরিগণিত হবার পর পরিপূর্ণভাবে ইসলামে দাখেল হওয়ার জন্য কোরআন মজিদ মুমিন ব্যক্তির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً
‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা পরিপূর্ণরূপেই ইসলামের মধ্যে দাখিল হও।’’ –(সূরা আল বাকারাঃ ২০৮)
এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে যারা আল্লাহর নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাদেরই ‘মুসলিম’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মুসলিমগণের মধ্যে যারা তাকওয়া অবলম্বন করে চলেন তাদের বলা হয়েছে মুত্তাকী। আবার মুত্তাকীদের মধ্যে যারা এহসানের নীতি অবলম্বন করে মহান আল্লাহর আরও নৈকট্য লাভ করেন তাদের ‘মুহসিন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ চারটি স্তর গুণগত অবস্থান নির্দেশ করে। সুতরাং দেখা যায় আল্লাহর প্রতি ঈমানদার বান্দাদেরকে চারটি স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে কেবলমাত্র তাদের মানের উপর ভিত্তি করে। সুতরাং যারা এ ধরণের ধারণা পোষণ করেন যে, জনশক্তি বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়- ক্যাডার সিস্টেমের মাধ্যমে তাদের ধারণাও সঠিক নয়। একটি সংগঠন সংহত শক্তি অর্জনের জন্য তার অন্তর্ভুক্ত জনশক্তিকে মানের ভিত্তিতে স্তরবিন্যাস করা বা বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে মানোন্নয়নের প্রচেষ্টা চালানো কোনক্রমেই ইসলামের দৃষ্ঠিভংগির সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে না।
১৮. নেতৃত্ব
একটি কাঙ্ক্ষিত বিপ্লবের জন্য নেতৃত্বের ভূমিকা এবং অবদান অনস্বীকার্য। প্রচলিত ক্ষমতা দখলের রাজনীতির নেতৃত্ব থেকে বিপ্লবী নেতৃত্বের পার্থক্য অনেক। প্রচলিত রাজনীতিতে মোটামুটিভাবে কিছু কলাকৌশল অবলম্বন বা ঝোপ বুঝে কোপ দিতে পারলে সাফল্য লাভ সহজ হয়ে যায়। কিন্তু বিপ্লব এর চাইতেও অনেক বড় ব্যাপার এবং অনেক কঠিন ব্যাপার। বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন হয় ক্ষেত প্রস্তুতের এবং প্রয়োজনীয় যাবতীয় উপায়-উপকরণ সংগ্রহের। প্রচলিত সমাজ কাঠামো ভেংগে যারা নতুন সমাজ গড়ার আকাঙ্ক্ষা এবং সাহসিকতা পোষণ করেন কেবলমাত্র তারাই বিপ্লবী নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
একটি নির্দিষ্ট জনপদে বা ভূখণ্ডে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পদাংক অনুসরণ করে একটি বিপ্লব সৃষ্টির জন্য যেসব উপাদান প্রয়োজন নেতৃত্ব হচ্ছে তার মধ্যে পয়লা নম্বরের উপাদান। নেতৃত্বের উদ্যোগ এবং অগ্রগামী ভূমিকা ব্যতীত কোন বিপ্লব প্রত্যাশা অর্থহীন। ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামীদের মধ্য থেকেই কেউ না কেউ সহজাতভাবেই এ দায়িত্বে এগিয়ে আসবেন। নেতৃত্ব নিঃসন্দেহে আল্লাহর দান। সব মানুষকে আল্লাহ তায়ালা এক ধরণের যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেন না। নেতৃত্বের গুণাবলী নিয়ে অনেকে আসেন। বিকাশ লাভের পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর নেতৃত্ব গড়ে উঠা নির্ভর করে। পরিস্থিতিগত কারণে নেতৃত্বের বিকাশ বা আবির্ভাব ঘটে থাকে। ঘটনা পরস্পর নেতৃত্বের ভূমিকায় যিনি দায়িত্ব পালন করেন অনেক সময় তিনি বুঝেও উঠতে পারেন না, তিনি কত বড় দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন।
ইসলামী বিপ্লবের যিনি বা যারা নেতৃত্ব দেবেন তাদের অবশ্যই সার্বিক ইসলামী গুণে গুণান্বিত হতে হবে। ইসলামের তাত্ত্বিক বা একাডেমিক দিকের পড়াশুনা, জ্ঞান (ইলম) অবশ্যই এতটুকু হতে হবে যে, কোরআন হাদীস থেকে ইসলামকে সরাসরি বুঝতে পারেন। কোরআন হাদীসের সরাসরি জ্ঞান ছাড়া এতবড় দায়িত্ব পালনের কথা চিন্তা করা যায় না। মুসলিম জাহানে পাশ্চাত্য প্রভাবিত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু থাকা সত্ত্বেও ইসলামী আন্দোলনের প্রচেষ্টায় এমন অনেক লোক তৈরী হচ্ছেন যারা সরাসরি কোরআন হাদীস থেকে ইসলামের জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাচ্ছেন। তাছাড়া সমসাময়িক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি ক্ষেত্রের উন্নতি এবং সমাজ বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস সম্পর্কেও নেতৃত্বকে ভালোভাবে অবহিত হতে হবে।
আমানতদারী, খোদাভীতি, দৃঢ়তা, সাহসিকতা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ছাড়াও নেতৃত্বের জন্য তীক্ষ্ণ ইতিহাস-জ্ঞান ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি অপরিহার্য। সংগ্রাম সংঘাত এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই জনগণের মধ্য থেকে এ নেতৃত্ব বিকশিত হবে। একথা মনে করার কারণ নেই যে, গণবিচ্ছিন্নভাবে কোন নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটবে।
অনেকে জননন্দিত শক্তিধর ব্যক্তিত্বকে বিপ্লবের একমাত্র উপাদান মনে করেন। পৃথিবীতে অনেক প্রতিভাধর ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটে থাকে। কিন্তু তারা সবাই বিপ্লব সৃষ্টি করতে পারেন না। এ ধরনের ব্যক্তিত্ব হঠাৎ করে জ্বলে উঠে নিভে যেতে পারে, একটি সময়ের জন্য ক্যরিজমা বা চমক সৃষ্টিও করতে পারে। স্বাভাবিক গতিতে গড়ে উঠা একটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যদি কোন নেতৃত্ব গড়ে উঠে কেবলমাত্র সেই নেতৃত্বের পক্ষেই গোটা পরিস্থিতি মুকাবিলা করা সহজ। কোন সহজ বা কৃত্রিমভাবে নেতৃত্ব বিকাশ লাভ করতে পারে না। আন্দোলনকে যেমন অনেক চড়াই উৎরাই অতিক্রম করতে হয় তেমনি নেতৃত্বকে অনেক বন্ধুর পথ পেরিয়ে আসতে হয়। ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বকে মানুষ হিসেবে একজন অত্যন্ত উঁচুদরের মানুষ হতে হয়। মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা, অকৃত্রিম সহানুভুতি না থাকলে কেউই ইসলামী আন্দোলনের বড় নেতা হতে পারে না। সাময়িকভাবে কেউ হয়তো বা খ্যাতির শীর্ষেও আরোহণ করতে পারেন এমনকি সাফল্যও লাভ করতে পারেন। কিন্তু তাই বলে মানুষের হৃদয় জয় করতে একটি আদর্শিক বিপ্লব সাধন করার মত মহৎ কাজ তাঁর দ্বারা সম্পাদিত নাও হতে পারে। একজন মানুষ হিসেবেই তিনি মানুষের আস্থা লাভ করবেন এবং তিনি যে জনপদের অধিবাস সেখানকার জনগণের আস্থা অর্জন করবেন। আদর্শিক দুশমন ও তার চরিত্র সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বলবেন। আল্লাহর নবী সা.-কে মক্কার কাফের মুশরিকরা আদর্শের কারণে বরদাশত করতে পারেনি কিন্তু সেই সমাজই তাকে আল আমিন, আস-সাদিক খেতাব দিয়েছিল। তার উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সকলেই উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তাদের দৃষ্টিতে মুহাম্মদ সা.- এর প্রধান ত্রুটিই ছিল বাপ-দাদার ধর্ম ও রসম-রেওয়াজ বাদ দিয়ে এক অভিনব নতুন ধর্মের কথা বলছিলেন। তারা ভালো করেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, নবী মুহাম্মদ সা.-এর বক্তব্য মেনে নিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্ব খতম হয়ে যাবে। এ কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তিই সর্বশক্তি দিয়ে নবীজির সা. নেতৃত্বের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু নবীজীর উন্নত নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে সকলেই অবহিত ছিলেন। নবীদের নিষ্পাপ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও কোন সাধারণ মানুষের অর্জন করার প্রশ্নই উঠে না। তবে একথা ঠিক যে, সমাজ ভালো মানুষকে ভালো মানুষ হিসেবে যে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্বকে তা লাভ করতে হবে; ততটুকু গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে।
ইসলামী নেতৃত্ব বিভিন্ন ধরণের মানুষ, জনশক্তি ও বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্ব কাঠামোর মধ্যে সমন্বয় রক্ষার অবশ্যই সাফল্যের পরিচয় দিবেন। এ পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরণের যোগ্যতা, গুণাবলী সম্পন্ন মানুষের সমাবেশ। নানা ধরণের লোককে বিভিন্নভাবে কাজে লাগানোই নেতৃত্বের দক্ষতা। নেতৃত্ব অবশ্যই পক্ষপাতদুষ্ট হবেন না, একাদর্শি হবেন না। নিকটবর্তী স্তাবকদের দ্বারা প্রভাবিত হবে না। প্রশংসায় বিগলিত হবেন না, যত্রতত্র বা ত্বরিত মন্তব্য করবেন না, উত্তেজিত এবং অসংযত হবে না।
সংগী সাথীদের ব্যাপারে খুবই যত্নবান হবেন। যে নেতৃত্ব তার সংগী সাথীদের মধ্য থেকে আরও অধিকতর যোগ্যতা ও প্রতিভাসম্পন্ন নেতৃত্ব বিকাশে ব্যর্থ হন তারা আসলেই ব্যর্থ। যে নেতৃত্ব বড় বট গাছের মত তার ছায়ায় আর কিছুই বাড়তে দেন না সে নেতৃত্ব ব্যর্থ। যে নেতৃত্ব যোগ্যতা সম্পন্ন উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারেন না ইতিহাস তাদেরকেও ব্যর্থ বলে চিহ্নিত করবে।
আধুনিক সমাজে ইসলামী নেতৃত্বকে শুধুমাত্র সমমনা ইসলামী জনশক্তির আস্থা অর্জন করলেই চলবে না বরং বিভিন্ন সামাজিক শক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে এবং সফল সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঐক্যের যোগসূত্র রচনা করতে হবে।
পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতৃত্বকে অগ্রগামী এবং পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিস্থিতির উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা ছাড়া এবং বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি ছাড়াও যা বেশি প্রয়োজন তাহলো গভীর অন্তর্দৃষ্টি, আদর্শিক এবং নৈতিক দৃঢ়তা। বিপ্লবী আন্দোলনের প্রধান নেতাকে দার্শনিক পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতে হবে। জ্ঞান চর্চা ও সাধনায় তাকে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য সময় দিতে হবে। তাকে খুবই সক্রিয়, সচল এবং উদ্যোক্তা হতে হবে। উদ্ভূত যে কোন কঠিন পরিস্থিতিতে আবেগমুক্ত এবং শান্তভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা নেতার মধ্যে থাকতে হবে। অসাধারণ সাহসিকতা ছাড়া অসাধারণ নেতৃত্ব হয় না এবং অসাধারণ নেতৃত্ব ছাড়া বিপ্লব আসতে পারে না। আর বিপ্লব তো নিজেই অসাধারণ।
দেশময় একটি নেতৃত্বের নেটওয়ার্ক বা কাঠামো নির্বাচন ছাড়া বিপ্লবের চিন্তা করা যায় না-নেতৃত্বের সবচাইতে বড় কাজ সম্ভবতঃ এটাই। নেতার একটি বহুমুখী যোগ্যতাসম্পন্ন টিম থাকাই যথেষ্ট নয়। বিপ্লব ধরে রাখার মত প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বেশি কিছু লোকের সমাবেশ আন্দোলনের হাই কমান্ডে সমবেত হলেই রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপ্লব সফল করে বিপ্লব পূর্ণতার দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে বলে মনে করার কোন যুক্তিপূর্ণ কারণ নেই। জনগণ এবং নেতৃত্বের মাঝে যোগসূত্র রচনাকারী নেতৃত্বের প্রয়োজন অনেক বেশী। নেতৃত্ব তখনই শক্তি অর্জন করতে পারে যখন জনগণের সাথে যোগসূত্র রক্ষাকারী উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লিংকম্যান তৈরী হয়। আন্দোলনের বাণী গ্রামে গঞ্জে মানুষের কাছে বহন করে নিয়ে যায় এ লিংকম্যান লিডারশীপ। ইসলামী আন্দোলনের এ লিংকম্যানরা যতবেশী দক্ষতা ও যোগ্যতাসম্পন্ন হবেন ইসলামী আন্দোলনের নেতৃত্ব তত মজবুত হবে।
মানুষের সাথে ব্যবহার, আচার-আচরণ, চাল-চলন, লেন-দেন, উঠা-বসা, সৌজন্যতা-ভদ্রতা, আতিথেয়তা, দয়া-দানশীলতা, দরদ-ভালোবাসা, নিয়মানুবর্তিতা, অল্পে তুষ্টি, পরিশ্রমপ্রিয়তা সহনশীলতা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই নেতৃত্বকে অবশ্যই উন্নততর হওয়া উচিত।
কোন্ কাজটির তিনি অগ্রাধিকার দিবেন, কোন্ কাজে কতটা সময় ও শক্তি ব্যয় করবেন এ বিষয়ে নেতা নিজে সতর্ক হবেন তবে নিকটবর্তী লোকদেরও এ ব্যাপারে দায়দায়িত্ব আছে। মনে রাখতে হবে যে, কৃত্রিমভাবে কাউকে নেতৃত্বে সমাসীন করা যাবে না। বক্তৃতা-ভাষণ অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। জনতাকে আকৃষ্ট করার জন্য এটা ভালো। জনতাকে আকৃষ্ট করার মত ব্যক্তিত্ব হলেই যে কেউ নেতা হয়ে যেতে পারবেন এমন আশা সুদূরপরাহত। উপরের আলোচিত বৈশিষ্ট্যসমূহের যদি সমন্বয় ঘটে তা হলে ভালো ধরণের একটি নেতৃত্ব বের হয়ে আসতে পারে।
নেতৃত্বের নৈতিক এবং আধ্যাত্মিক শক্তি আন্দোলনের সাফল্যের জন্য এক বড় ধরণের উপাদান। জনগণের মধ্যে ইসলামী নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতার বড় কারণ নেতৃত্বের আধ্যাত্মিক শক্তি। আধ্যাত্মিক শক্তি বলতে এখানে প্রাকৃতিক কোন কিছুকে বুঝানো হয়নি। ইসলাম যে তাকওয়া, পরহেজগারী এবং চরিত্র দাবী করেছে, তাই, প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূর সা.-এর পছন্দ অপছন্দের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি, আদল, ইনসাফ, এহসানের অধিকারী হওয়াই বড় আধ্যাত্মিকতা। জীবনাচার এবং বাস্তব কর্মকান্ডের মধ্য দিয়েই তা প্রকাশিত হবে। যেকোনে ধরণের স্বার্থচিন্তা এবং দুনিয়াদারীর ঊর্ধে হবেন এ নেতৃত্ব। আল্লাহর স্মরণ বা যিকির এবং আখেরাতের চিন্তায় অবশ্যই অগ্রসর কাতারের অন্তর্ভুক্ত হবেন। মানবীয় গুণাবলীর উন্নততর বিকাশ তার মধ্যে যেমনি ঘটবে তেমনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দোষত্রুটি থেকেও তিনি মুক্ত থাকতে প্রয়াসী হবেন।
মুসলিম দেশগুলোতে যে রাষ্ট্রীয় এবং সমাজ কাঠামো গড়ে উঠেছে তাতে সত্যিকার ইসলামী আদর্শের অনুসারীরা অনেক পেছনে পড়ে গিয়েছে। সর্বত্র যে স্বার্থপর নেতৃত্বের বিকাশ ঘটেছে সে নেতৃত্ব কায়েমী স্বার্থের প্রতীক। ‘‘ইসলামকে পুনরায় মানব জাতির নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মুসলিম উম্মাহকে তার আসল রূপ পুনরুদ্ধার করতে হবে। মুসলিম উম্মাহ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানব রচিত রীতিনীতির আবর্জনায় চাপা পড়ে রয়েছে। ইসলামী শিক্ষার সাথে সেসব ভ্রান্ত আইন কানুন আচার আচরণের দূরতম সম্পর্কও নেই, যেগুলোর গুরুভারে আজ মুসলিম উম্মাহ নিষ্পিষ্ট।— এবং মানব গোষ্ঠীর নেতৃত্ব অনেক আগেই অন্যান্য আদর্শ, অনৈসলামিক ধ্যান-ধারণা, ভিন্ন ধরণের জীবন বিধান ও অমুসলিম জাতিগুলোর করায়ত্ব হয়ে রয়েছে।’’ [Mile Stone, সাইয়েদ কুতুব শহীদ]
মুসলিম দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ নেতৃত্বের অবস্থাও ঠিক অনুরূপ। ইসলামী আদর্শের বিজয় এবং পুনরুজ্জীবনের সাথে জাতীয় নেতৃত্ব এবং বিশ্ব নেতৃত্ব গ্রহণের প্রশ্নটিও জড়িত। ইসলামী ইনকিলাবের জন্য এটি অনিবার্য।
একথা ঠিক যে, আজকে বিশ্ব নয়া নেতৃত্বের প্রত্যাশীঃ
‘‘It is essential for mankind to have a new leadership!
The leadership of mankind by Western man is now on the decline, not because Western culture has become poor materially or because its economic and military power has become weak. The period of the Western system has come to an end primarily because it is deprived of those life-giving value which enbled it to be the leader of mankind.
It is necessary for rhe new leadership to preserve and develop the material fruits of the creative genius of Europe, and also to provide mankind with such high ideals and values as have so far remined undiscovered by mankind, and which will also acquaint humanity with a way of life which is harmonious with human nature, which is positive and contructive, and which is practicable.
Islam is the only system which possesses those values and this way of life.’’ [Mile Stone, সাইয়েদ কুতুব শহীদ]
অনুবাদঃ ‘‘মানব জাতির জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে একটি নতুন নেতৃত্বের। পাশ্চাত্য এখন মানব জাতির নেতৃত্ব দিতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। এটা এজন্য নয় যে, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আসলে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে বা তাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে পাশ্চাত্য ব্যবস্থা নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে এজন্য যে, যে মূল্যবোধ ও জীবনীশক্তি সঞ্চারকারী গুণাবলী তাদের মানবতার নেতৃত্বের আসনে বসিয়ে দিল সেসব গুণাবলী আজ আর তাদের মধ্যে নেই।
অনাগত দিনের নতুন নেতৃত্বকে ইউরোপের সৃজনশীল প্রতিভার অবদানগুলোকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানব জাতির সামনে এমন মহান আদর্শ ও মূল্যবোধ পেশ করতে হবে যা আজ পর্যন্ত অনাবিষ্কৃতই রয়ে গিয়েছে। ভবিষ্যত নেতৃত্বকে মানব জাতির সামনে একটি ইতিবাচক গঠনমূলক ও বাস্তব জীবন বিধান পেশ করতে হবে যা মানব স্বভাবের সঙ্গে সুসামঞ্জস্যশীল।
একমাত্র ইসলামী ব্যবস্থাই উল্লেখিত মূল্যবোধ ও জীবন বিধান দান করতে সক্ষম।’’
বিশ্ব আজ যে নয়া নেতৃত্বের প্রত্যাশী সে নেতৃত্বকে জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে কাজ করতে হবে। এবং আল্লাহ প্রদত্ত বিশ্ব নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনের জন্য কাঙ্ক্ষিত গুণাবলী অর্জন করতে হবে। আজকে বিশ্ব নেতৃত্বে যারা অধিষ্ঠিত তাদের বিজ্ঞান, কারিগরি ও বস্তুতান্ত্রিক অগ্রগতিকে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা চ্যালেঞ্জ করতে পারবো না। তাই আমাদের এমন সব গুণাবলী অর্জন করতে হবে যা আধুনিক সভ্যতায় বিরল।
‘‘To attain the leadership of mankind, we must have something to offer beside material progress, and this other quality can only be a faith and a way of life which on the one hand conserves the benefits of modern science and technology, and on the other, fulfils the basic human needs on the same level of excellence as technology has fullfilled them in the sphere of material comfort.’’ [Mile Stone, সাইয়েদ কুতুব শহীদ]
অনুবাদঃ মানব জাতির নেতৃত্বদানের জন্য আমাদের বৈষয়িক উন্নতি ছাড়াও অতিরিক্ত কিছু পেশ করতে হবে। আর তা হচ্ছে মানব জীবনকে মৌলিক বিশ্বাস (ঈমান) এবং ঐ বিশ্বাসের ভিত্তিতে রচিত একটি জীবন বিধান। এ বিধান বিস্ময়কর বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও কারিগরী বিদ্যায় সকল অবদান সংরক্ষণ করবে। সাথে সাথে মানব জাতির মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্য আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান মানুষের কল্যাণের যেসব চমকপ্রদ উদ্যোগ আয়োজন করেছে, তার মান বজায় রাখতে সক্ষম হবে। আর এ বিশ্বাস (ঈমান) ও জীবন বিধান মানব সমাজে তথা মুসলিম সমাজে বাস্তব রূপ ধারণ করে আত্মপ্রকাশ করবে।
১৯. গণতন্ত্রের শ্লোগান ও ইসলামী বিপ্লব
গণতন্ত্র শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের এক অনন্য সাধারণ ব্যবস্থা। জনগণের আস্থা যাদের উপর আছে তারাই নেতৃত্ব দেবেন এবং রাষ্ট্রকার্য পরিচালনা করবেন এবং জনগণের আস্থা হারালে নেতৃত্বের মর্যাদাসম্পন্ন আসনটি ছেড়ে দিয়ে জনগণের কাতারে ফিরে আসবেন। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের বা কাউকে নেতৃত্বের আসন থেকে অব্যাহতি দানের এ ব্যবস্থাকে বলা যায় গণতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রাষ্ট্র পরিচালনা ও নেতৃত্ব নির্বাচনের এ ধরনের একটি চুক্তি বা বিধান জনসমষ্টির সম্মতির ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করলে শক্তি প্রয়োগ ও নৈরাজ্য সৃষ্টি ছাড়াই যে প্রক্রিয়া সমাজের চালিকা শক্তির ভূমিকা পালন করতে পারে তাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বা বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ইসলামের আবেদন বা দৃষ্টিভংগী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে এখানেই সাদৃশ্যপূর্ণ। গণতন্ত্র বলতে পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক দর্শনের যে ব্যাখ্যা তার সাথে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির অনেক অমিল সত্ত্বেও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং জনগণের রায় নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার প্রশ্নে একটি সাধারণ ঐক্যমত্য রয়েছে। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত রায় বা মতামতের ভিত্তিতে গঠিত রাজনৈতিক অবকাঠামোর সাথে এ কারণেই ইসলামী আদর্শের একটি সুসামঞ্জস্য রয়েছে। ইসলামের ইতিহাসে খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়কার নেতৃত্ব নির্বাচন একথার উজ্জ্বল প্রমাণ বহন করে যে, ইসলাম নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখে থাকে। আরোপিত বা স্বঘোষিত নেতৃত্ব ইসলাম অনুমোদন করে না। যে জনসমষ্টির জন্য নেতৃত্ব সেই জনসমষ্টির পছন্দ অপছন্দকে ইসলাম খাটো করে দেখেনি। সমাজের মধ্যে থেকেই নেতৃত্ব বিকাশের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে। জনগণের স্বাধীন অংশগ্রহণ ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
পাশ্চাত্যে গণতন্ত্র বা জনগণের শাসনের সাথে ইসলামের তত্ত্বগত পার্থক্য আছে। পাশ্চাত্য গণতন্ত্র সংখ্যাধিক্যের জোরে হ্যাঁ কে না এবং না কে হ্যাঁ করার যে ক্ষমতা রাখে ইসলাম তা অনুমোদন করে না। কোরআন হাদীসের নির্দেশিত মূলনীতির বাইরে কিংবা কোরআন সুন্নাহর খেলাফ কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার পার্লামেন্টকে ইসলাম দেয়নি। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্যের পার্লামেন্ট সংখ্যা শক্তির জোরে যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার রাখে। ইসলামে সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ কোন জিনিসকে সমাজে চালু করার পক্ষে কোন আইন পার্লামেন্ট পাশ করতে পারবে না কিংবা এমন কোন বিলও আনতে পারবে না। পক্ষান্তরে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের পার্লামেন্টে হালালকে হারাম বা হারামকে হালাল করতে পারবে যদিও বা পাশ্চাত্যের পার্লামেন্ট মানব রচিত সংবিধানের সীমার মধ্যেই পরিচালিত হয়ে থাকে। এমনকি ইসলামী পার্লামেন্টের সদস্যদের স্বাধীনভাবে বক্তব্য রাখার বা মতামত দেবার সুযোগ থাকবে। পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের পার্লামেন্টে একজন সদস্যের জন্য এ সুযোগ প্রথাসিদ্ধ সরকারী এবং বিরোধী দলীয় রাজনীতির কারণে খুবই সীমিত। সীমারেখার বাইরে তারা কথা বলতে পারেন না।
পাশ্চাত্য গণতন্ত্র পার্লামেন্টকে সার্বভৌম আখ্যায়িত করে থাকে। পক্ষান্তরে ইসলাম আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ছাড়া অন্য কারো সার্বভৌমত্ব মানে না। পার্লামেন্ট সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইসলামী বিধানের আওতায় ফয়সালা গ্রহণের এখতিয়ার রাখে। ইসলামের রাজনৈতিক পদ্ধতি এবং পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের মধ্যকার উল্লেখিত পার্থক্য সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তর, নেতৃত্ব নির্বাচন পদ্ধতি, প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে রাষ্ট্রকার্যে জনগণের অংশগ্রহণ ইত্যাদি ব্যাপারে গণতন্ত্রের দৃষ্টিভংগীকে অবহেলা করার উপায় নেই। ইসলামের সাথে এসব ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যটাকে অস্বীকার কারাও যৌক্তিকতা নেই। গণতন্ত্র ইসলামের বিকল্প নয়। তাই বলে গণতন্ত্রকে ইসলামের বিপরীত প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবী সংগঠনসমূহ নির্বাচনকে সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণ করার কিংবা নির্বাচনে অংশ নেয়ার অথবা পাশ্চাত্য গণতন্ত্র মতেই জনগণের ভোটাধিকার বহাল বা স্বৈরশাসনের অবসান কল্পে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবীতে আন্দোলনে শরীক হওয়ার কারণে প্রশ্ন এবং সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। বলা হচ্ছে ইসলাম বাদ দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করা হচ্ছে, অমুক দল তো ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েমের পরিবর্তে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছে, গণতন্ত্র ইসলাম সম্মত নয়, এটাকে পরিহার করতে হবে ইত্যাদি। এ প্রচারণা মুসলিম যুব মানসে প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টিতে তেমন সফল না হলেও চিন্তার বিভ্রান্তি যে ঘটাচ্ছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব সরকার ব্যবস্থা চালু আছে তার পরিবর্তন ঘটিয়ে ইসলামী শাসন ও সমাজ কিভাবে কায়েম হবে কিংবা জনগণের অধিকার বহালের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন কোন আন্দোলন থেকে ইসলামী কোন দল কিভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে তার কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রশ্নকর্তারা উত্থাপন করতে পারেননি। নির্বাচন ছাড়া কিভাবে জনগণের রায় প্রতিফলিত হবে তারও কোন বিকল্প তাদের সামনে আছে বলে মনে হয় না। ন্যূনতম গণতন্ত্র যে অধিকারটুকু দিয়েছে তা পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন করার মধ্যে কি বিচ্যুতিটা তারা দেখতে পেলেন তাও পরিষ্কার নয়। ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম জোরদার করার জন্য কেন গণতন্ত্র প্রদত্ত সুযোগ সুবিধাটুকু কাজে লাগানো হবে না এ প্রশ্নের জবাবও জানা নেই। অস্ত্র বলে সমাজ পরিবর্তনের নীতি যেহেতু স্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয় বা ইসলাম এটাকে অনুমোদনও করে না সেহেতু গণতন্ত্র মতামত প্রকাশের এবং জনমত সংগঠিত করার যে সুযোগ দিয়েছে তা গ্রহণ করতে অসুবিধা কোথায়? সংগঠন গড়ে তোলা ও জনমত সংগঠিত করার জন্য একজন নিরস্ত্র মানুষ কি করতে পারে? এজন্য গণতন্ত্রের সংগ্রামকে সহায়ক হিসেবে গ্রহণের মধ্যে ভুলটা কোথায়? গণতন্ত্রের সৌন্দর্য যাদের আকৃষ্ট করে তারা যদি গণতন্ত্রের সুবাদে ইসলামের ঐসব মূল্যবোধ সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন আমার বিশ্বাস তারাও ইসলামকেই স্বাগত জানাবেন। এমনকি সমাজতন্ত্রকে মানব মুক্তির পথ হিসেবে গ্রহণ করে যারা বিভ্রান্তির সাগরে ভাসছেন তাদেরও বোধোদয় হতে পারে।
গণতন্ত্র সাধারণভাবে গৃহীত এমন একটি পরিভাষা যা বললে শৃংখলমুক্ত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই বুঝানো হয় বা গণতন্ত্র বলতে জনগণের অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগ, নেতৃত্ব নির্বাচনে অংশগ্রহণ, প্রতিনিধিত্বশীল শাসন, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি মূল্যবোধকে ব্যাপকভাবে বুঝিয়ে থাকে। অবশ্য গণতন্ত্র শব্দটির বিভ্রান্তিকর ব্যবহারও ব্যাপক হারে চালু করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও বলা যায় যে, গণতন্ত্রকে নির্বাসন দিতে হবে বা বর্জন করতে হবে এমন প্রান্তিক চিন্তার আদৌ কোন যৌক্তিকতা নেই।
তবে গণতন্ত্র বলতে যেহেতু এক ধরণের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বুঝায় সেহেতু ইসলামী আন্দোলনকে এ সম্পর্কে সতর্ক থাকার প্রয়েঅজন রয়েছে। শ্লোগানের অন্তরালে গণতন্ত্রের চাইতে বেশী উৎকৃষ্ট গণতান্ত্রিক ইসলামের খেলাফতি শাসন ব্যবস্থা যেন বিভ্রান্তির শিকার না হয় সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। নিছক পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত একটি দলের সাথে ইসলামের সর্বোৎকৃষ্ট গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত ইসলামী আন্দোলনের সুস্পষ্ট পার্থক্যটা জনগণ যেন বুঝতে পারেন এ নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। একটি ইসলামী দল বা আন্দোলনকে জনগণ বুঝার সাথে সাথে ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাও যেন তারা বুঝতে সক্ষম হন এটা নিশ্চয়তা বিধান না করা গেলে ইসলামী আন্দোলনকেও জনগণ একটি নিছক ক্ষমতাকামী রাজনৈতিক দল ভেবে নিতে পারে। একটি ইসলামী আন্দোলন যদি নিছক ক্ষমতারোহণকারী রাজনৈতিক দলে পরিগণিত হয় তাহলে আন্দোলনের সঠিক মেজাজ, পরিবেশ এবং আবেগ উচ্ছ্বাস এবং উপলব্ধির ক্ষেত্রে শূণ্যতা সৃষ্টির আশংকা থেকে যেতে পারে। সাধারণ গণমানুষের শুভেচ্ছা, ভালোবাসা যেহেতু বিপ্লব সৃষ্টির জন্য একটি বিরাট উপাদান তাই একটি ইসলামী আন্দোলনের বক্তব্য বুঝা এবং গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সাথে যাতে করে কোন ক্রমেই বিচ্ছিন্নতা বা কমিউনিকেশন গ্যাপ সৃষ্টি না হয় এ ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং সাময়িক লক্ষ্য হাসিলের ব্যাপারটা যাতে চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে বিবেচিত না হয়ে যায় সেদিকটাও গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া মাধ্যম হতে পারে কিন্তু লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য ইসলামের ইনসাফভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণ।