১২. ইসলামী বিপ্লব প্রসংগে মাওলানা মওদূদী
ক. ইসলামের স্বাভাবিক পন্থায় একটি রাষ্ট্র বিপ্লব
ইসলামী বিপ্লব একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দেয়। যাকে ইসলামী রাষ্ট্র বলে আখ্যায়িত করা যায়। ইসলামী রাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে একটি আদর্শ রাষ্ট্র। ইসলামের স্বাভাবিক পন্থা অনুসরণের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র বিপ্লব সংঘটিত হওয়াকেই বর্তমান শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তানায়ক সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী র. ইসলামী বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ প্রসংগে তিনি ১৯৪০ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত এক ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বলেন, ‘‘একটি রাষ্ট্রের বাস্তবায়নের জন্য কিছুটা প্রাথমিক আয়োজন প্রস্তুতি, সামাজিক উদ্যম-উদ্দীপনা এবং কিছুটা প্রাথমিক ঝোঁক প্রবণতা এমনভাবে বর্তমান থাকা চাই যার নিবিড় সমন্বয়ে ও ঘটনা প্রবাহের অনিবার্য চাপে স্বাভাবিক পন্থায় একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। ন্যায়শাস্ত্রের সূত্রগুলো পর্যায়ক্রমে সজ্জিত করলেই তার সিদ্ধান্ত যেমন স্বতঃই আত্মপ্রকাশ করে, রাসায়ন শাস্ত্রে- যেমন রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উপাদানসমূহ বিশেষ প্রক্রিয়ায় পদার্থ প্রস্তুত হয় সমাজ বিজ্ঞানেও সেইরূপ একটি বিশেষ সমাজ পূর্ব হতে বর্তমান অবস্থা পারম্পর্যের স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবেই জন্মলাভ করে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের জন্ম ও গঠনের গোড়ায় যেসব অবস্থা বর্তমান থাকে, তার প্রকৃতি অনুসারেই নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রের প্রকৃতি ও স্বরূপ। ন্যায়শাস্ত্রের সূত্রগুলো পর্যায়ক্রমে সাজালে যেমন তার সিদ্ধান্ত ভিন্নরূপ হতে পারে না, বিশেষ গুণ সম্বলিত রাসায়নিক উপাদানের সংমিশ্রণে যেমন সম্পুর্ণ ভিন্নধর্মী মিশ্র পদার্থ সৃষ্টি হতে পারে না, লেবুর বীজ হতে উদ্ভূত বৃক্ষ যেমন আম ফলাতে পারে না, অনুরূপভাবে বিশেষ ধরণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করার অনুকূল শর্তসমূহ বর্তমান থাকলে এবং তার পারস্পরিক মিলিত কার্যক্রম ধরণের রাষ্ট্র গঠনের অনুকূল হলে তা ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী রাষ্ট্র জন্ম দিতে পারে না। রাষ্ট্রের স্বরূপ নির্ধারণে ব্যক্তি এবং সমাজের ইচ্ছা ও কর্মশক্তির গুরুত্ব অত্যধিক। যে ধরণের রাষ্ট্রব্যবস্থা করতে হবে প্রথম থেকেই তার স্বভাব ও প্রকৃতির অনুরূপ উপাদান ও কার্যকারণ সংগ্রহ করা এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়ার মত কর্মপন্থা অবলম্বন করা অপরিহার্য, সে জন্য যে ধরণের আন্দোলন, যে রকম ব্যক্তিগত ও সামাজিক চরিত্র এবং যে ধরণের নেতৃত্ব ও সামাজিক কার্যকলাপ অপরিহার্য আগে থেকে সেগুলো ঠিক তদনুযায়ী হওয়া অবশ্য প্রয়োজন। এই সমস্ত কার্যকারণ ও উপাদানগুলো সংগৃহীত ও পরস্পর মিলিত হয়ে দীর্ঘকাল পর্যন্ত অবিশ্রান্তভাবে চেষ্টা-সাধনা করার পর তার শক্তি যখন অত্যন্ত মজবুত হয় এবং বিপরীতধর্মী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিরোধ করার মত শক্তি অর্জিত হয় তারপরই অত্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে সেই ঈপ্সিত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। একটি বীজ থেকে যেমন বৃক্ষ জন্মে এবং আভ্যন্তরীণ সক্রিয় শক্তিতে তা ক্রমবর্ধনের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে একটি বিশেষ সীমানায় পৌঁছে ঠিক সে ধরণেরই ফল দিতে শুরু করে, যে ধরণের ফল ধারণ করার জন্য তার আভ্যন্তরীণ শক্তি দীর্ঘদিন ধরে নিরন্তর প্রস্তুতির পথে অগ্রসর হয়েছে। এ নিগূঢ়তত্ত্ব সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে একথা স্বীকার করতে কারও বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ হবে না যে, যেখানে আন্দোলন সংগঠন, নেতৃত্বে ব্যক্তিগত স্বভাব ও সমষ্টিগত চরিত্র এবং কর্মকুশলতা সবকিছুই এর বিপরীত ধরণের কোন কিছু প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশা নিতান্ত অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা এবং খোশখেয়াল ছাড়া আর কিছুই নয়।’’ [ইসলামী বিপ্লবের পথ, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী]
মাওলানা মওদূদীর উপরোক্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের প্রত্যক্ষ প্রমাণ ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান।’ জনগণ যে প্রত্যাশা নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে শরীক হয়েছিল একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উপায়-উপাদান কার্যকারণ এবং সংগঠন, আন্দোলন ও নেতৃত্বের সমন্বয় না ঘটায় পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও ইসলামের নামে অর্জিত ঐ রাষ্ট্রটি ইসলামী বিপ্লবের সিঁড়ি অতিক্রম করে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিগণিত হতে পারেনি।
মাওলানা মওদূদীর মতে ইসলামী রাষ্ট্র হবে সম্পূর্ণরূপে আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্র। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ এবং এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব হতে এ রাষ্ট্র হবে সম্পূর্ণ মুক্ত। ফরাসী বিপ্লব এবং রুশ বিপ্লব পর্যালোচনা করে তিনি মন্তব্য করেন, ‘‘মানব ইতিহাসের এ দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব ও জাতীয়তাবাদের গভীর অন্ধকারে মিলিয়ে যায় এবং জাতীয়তাবাদের বিষাক্ত ভাবধারার অনুপ্রবেশে আদর্শচ্যুত হয়। আদিকাল হতে আজ পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে ইসলামই একমাত্র পন্থা যা জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণতার ঊর্ধে উঠে খাঁটি আদর্শবাদের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। তাই ইসলাম এর নিজস্ব আদর্শ অনুসারে সমগ্র বিশ্বামানবকে একটি উদার অজাতীয়তাবাদ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানায়।’’ [ইসলামী বিপ্লবের পথ, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী]
খ. মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত হলেই ইসলামী রাষ্ট্র হয় না
মুসলমানদের কর্তৃত্বে একটি রাষ্ট্র পরিচালিত হলেই যে তা ইসলামী রাষ্ট্র হবে এর কোন গ্যারাণ্টি নেই। আজকের মুসলিম বিশ্বই এর প্রমাণ। মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোও শেষ পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে ন্যাশনষ্টেটেই পরিণত হয়েছে।
‘‘ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি বিভাগের প্রত্যেক কাজেই এমন লোকের প্রয়োজন যাদের মনে সর্বোপরি খোদার ভয় আছে, যাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ তীক্ষ্ণ, যারা দুনিয়া অপেক্ষা পরকালকেই শ্রেয় মনে করে, যাদের দৃষ্টিতে নৈতিক লাভ-ক্ষতির মূল্য ও গুরুত্ব পার্থিব লাভ-লোকসান অপেক্ষা বহুগুণে অধিক, যারা দৃঢ়তার সাথে ইসলামের আইন-কানুন ও কর্মপদ্ধতি অনুসারে কাজ করবে, যাদের জীবনের সকল চেষ্টা-সাধনা ও দুঃখ-কষ্ট ভোগের একমাত্র লক্ষ্য খোদার সন্তোষ বিধান। ইসলামী রাষ্ট্রের জন্যে এমন নিঃস্বার্থ কর্মী আবশ্যক যারা ব্যক্তিগত স্বার্থের দাসত্ব করবে না, যাদের দৃষ্টি সংকীর্ণতার ঊর্ধে, যাদের মনে হিংসা-বিদ্বেষের স্থান নেই, যারা ধন-দৌলত ও হুকুমাত প্রভূত্বের নেশায় মত্ত হবে না, যাদের মধ্যে ঐশ্বর্যের লালসা, প্রভূত্বের লিপ্সা থাকবে না। ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য এমন কর্মচারী গড়ে তুলতে হবে যাদের নৈতিক শক্তি এত বলিষ্ঠ হবে যে, পৃথিবীর বিপুল ধন-ভাণ্ডার তাদের হস্তগত হলেও তারা আমানতদার প্রমাণিত হবে। রাজশক্তি করায়ত্ত হলে তারা রাতের সুখনিদ্রা ভুলে জনস্বার্থে রক্ষণাবেক্ষণে সতর্ক দৃষ্টি ও তীক্ষ্ণ প্রহরায় আত্মনিয়োগ করবে, যাতে দেশের জনগণের জানমাল ও মানসম্ভ্রম সম্পর্কে কোন আশংকা না থাকে। যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে যখন তারা পররাজ্যে প্রবেশ করবে, তখন সে দেশের অধিবাসীগণ পাইকারী হত্যা, জুলুম, পীড়ন, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে এবং গুণ্ডামী, ব্যভিচার ও বলাৎকারের ভয়ে সন্ত্রস্ত হবে না। বরং বিজয়ী বাহিনীর প্রত্যেকটি সৈনিককেই বিজিত দেশের জনগণ তাদের জানমাল ও আবরুর রক্ষকরূপে দেখতে পারেব। বস্তুতঃ একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এরূপ লোকেরাই আবশ্যক। [ইসলামী বিপ্লবের পথ, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী]
গ. ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি অপরিহার্য
‘‘ইসলামী রাষ্ট্র কোন অলৌকিক ঘটনায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সে জন্য গোড়া থেকেই ইসলামের বিশিষ্ট জীবন দর্শন ও জীবন পদ্ধতি এবং ইসলামী চরিত্র ও স্বভাব প্রকৃতির বিশেষ মাপকাঠি অনুযায়ী গঠিত একটি বিরাট ও ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি অপরিহার্য। সে আন্দোলনের নেতা, পুরোধা ও কর্মী হবেন এমন লোক যারা মানবতার এই বিশিষ্ট আদর্শে আত্মগঠন করতে প্রস্তুত থাকবেন। অতঃপর তারা সমস্ত সমাজ মনে অনুরূপ মনোভাব ও নৈতিক অনুপ্রেরণা জাগ্রত করতে সর্বশক্তি প্রয়োগে সচেতন থাকবেন। এতদ্ব্যতীত ইসলামের উল্লেখিত ভিত্তিতে এক অভিনব শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করাও আবশ্যক যা সঠিক ইসলামী আদর্শে নাগরিকদের জীবন গঠন করবে এবং মুসলিম বৈজ্ঞানিক, মুসলিম ঐতিহাসিক, মুসলিম অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ, মুসলিম আইনজ্ঞ, মুসলিম রাষ্ট্রনায়ক- এক কথায় জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রত্যেক শাখায় খাঁটি ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা ও কাজ করতে লোক গড়ে তুলবে।’’
ঘ. আত্মত্যাগী নেতৃত্ব
তাদের মধ্যে খালেছ ইসলামের আদর্শে চিন্তা ও মতবাদের পূর্ণ ব্যবস্থা এবং কর্মজীবনের একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনা রচনার সামর্থ্য বর্তমান থাকা চাই, যে শক্তি দ্বারা তারা দুনিয়ার খোদাদ্রোহী চিন্তা-নায়কদের বিরুদ্ধে নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তা শক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন। বুদ্ধি ও মনন শক্তি এই বিপ্লবী পটভূমির ভিত্তিতে এহেন ইসলামী আন্দোলন চারিদিকের যাবতীয় অবাঞ্ছিত জীবনধারার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য সংগ্রাম করবে। সেই সংগ্রামে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ দুঃখ-লাঞ্ছনা ভোগ করে, নির্যাতন ও নিষ্পেষণ অকাতরে সহ্য করে আত্মদান করে, এমনকি প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েও তাদের অন্তরের ঐকান্তিক নিষ্ঠা, আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা ও আদর্শের দৃঢ়তা প্রমাণ করবে। পরীক্ষার অগ্নিদহন সহ্য করে তারা এমন নিখাত স্বর্ণে পরিণত হবেন যে, যে কোন পরীক্ষায় কষ্টিপাথরে যাচাই করেও তাদের থেকে এতটুকু খাদ বের করা সম্ভব হবে না। যুদ্ধ বিগ্রহের সময় নিজেদের প্রত্যেকটি কথা ও কাজ দ্বারাই তারা নিজেদের সেই আদর্শবাদিতার বাস্তব প্রমাণ পেশ করতে সমর্থ হবে। তাদের প্রত্যেকটি কথাই দুনিয়ার মানুষ বুঝতে পারবে যে, এসব নিঃস্বার্থ, নিষ্কলুষ, সত্যবাদী, ন্যায়নিষ্ঠ, ত্যাগী, আদর্শবাদী, চরিত্রবান ও খোদাভীরু লোক মানবতার কল্যাণের জন্য যে আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানাচ্ছে, তাতে নিঃসন্দেহে নিখিল মানুষের প্রকৃত কল্যাণ, সুবিচার ও নিরবচ্ছিন্ন শান্তি নিহিত রয়েছে। এরূপ ধারাবাহিক অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে গেলে সমাজের যেসব লোকের ন্যায় ও সত্যের উপাদান অন্তর্নিহিত রয়েছে সকলেই ধীরে ধীরে এ আন্দোলনে যোগদান করবে। পক্ষান্তরে হীন প্রকৃতির দুর্বলতা ও নীচুমনা লোকদের প্রভাব সমাজ থেকে ক্রমশঃ নিশ্চিহ্ন হবে। এর ফলে জনগণের মনোজগতে এক প্রচণ্ড বিপ্লবের সৃষ্টি হবে। সমাজমনে সেই বিশেষ ধরণের আদর্শবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবী যেমন জেগে উঠবে, এর প্রয়োজনবোধ ও চাহিদাও অনুরূপভাবে বেড়ে যাবে। সামগ্রিকভাবে গোটা সমাজের অবস্থা আমূল পরিবর্তিত হয়ে যাবে এবং একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা ব্যতীত অন্যবিধ ব্যবস্থা দানা বাঁধার অবকাশ পাবে না। সর্বশেষ স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী রূপে সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থাই কায়েম হবে, যার জন্য এতদিন যাবত অক্লান্ত চেষ্টায় অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। আর সেই রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংগে সংগেই সেই বিশেষ শিক্ষা পদ্ধতির প্রভাবে তা পরিচালনার জন্য নিম্নশ্রেণীর কর্মচারী থেকে শুরু করে উজির ও শাসনকর্তা পর্যন্ত প্রত্যেক শ্রেণীর কর্মকর্তা প্রস্তুত হবে। কোন দিকে রাষ্ট্রের কোন বিভাগেই কর্মকর্তার অভাব হেতু কাজ বন্ধ হওয়ার আশংকা থাকবে না।’’ [ইসলামী বিপ্লবের পথ, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী]
ঙ. সেই ধরণের আন্দোলন চাই
বস্তুতঃ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এটাই হচ্ছে একমাত্র স্বাভাবিক পন্থা। একেই বলা হয় ইসলামী ইনকিলাব। পৃথিবীর বিপ্লবের ইতিহাস সর্বজনজ্ঞাত। কোন বিশেষ ধরণের বিপ্লব সৃষ্টি জন্য গোড়াতেই সেই বিশেষ ধরণের সামাজিক ও সামগ্রিক চেতনা এবং নৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টির অপরিহার্য প্রয়োজন অনস্বীকার্য। যেশো, ভলটেয়ার এবং মনটেস্কিত প্রমুখ নেতৃবৃন্দ দীর্ঘকাল ধরে ফ্রান্সে যে বিশেষ আদর্শের নৈতিক ও মানসিক ক্ষেত্র তৈরী করেছিলেন, তার ফলেই সেখানে তাদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী বিপ্লব সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল। রুশ বিপ্লব কেবল মার্ক্সের চিন্তাধারা, লেলিন ও স্ট্যালিন নেতৃত্ব আর কমিউনিজমের মতাদর্শে সুশিক্ষিত হাজার হাজার কমিউনিস্ট কর্মীর বিপ্লবী কার্যকলাপের দ্বারাই সৃষ্টি হতে পেরেছিল, অন্য কোন উপায়ে নয়। তদ্রুপ ইসলামী বিপ্লবও তখনই সৃষ্টি হবে এবং ইসলামী রাষ্ট্র তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন কোরআনের আদর্শ ও মতবাদ এবং নবী মোহাম্মদ মোস্তফা সা.-এর চরিত্র ও কার্যকলাপের বুনিয়াদে কোন গণ-আন্দোলন জেগে উঠবে আর সমাজ জীবনের সমগ্র মানসিক, নৈতিক, মনস্তাত্বিক এবং সাংস্কৃতিক বুনিয়াদকে একটি প্রবলতর সংগ্রামের সাহায্যে একেবারে আমূল পরিবর্তন করে ফেলা সম্ভব হবে।’’ [ইসলামী বিপ্লবের পথ, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী]
চ. ইসলাম প্রতিষ্ঠাকামীদের বৈশিষ্ট্য
‘‘আল্লাহ তায়ালার কালেমার প্রচার এবং তার দ্বীন ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা বলতে যা বুঝায় সেজন্য চাই এমনসব একনিষ্ঠ কর্মী যারা খাঁটিভাবে আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করে কোন প্রকার লাভ ক্ষতির বিন্দুমাত্র পরোয়া না করেই খোদার আইন ও বিধানের উপর মজবুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এমন কর্মী আমাদের বংশানুক্রমিক মুসলিম সমাজের মধ্য থেকেই আসুক কিংবা অন্য কোন জাতির মধ্য থেকে এসে এই দলে নতুনভাবে শামিল হোক তাতে কোন পার্থক্য হবে না। কিন্তু একথা অবধারিত সত্য যে, এই ধরণের বিপ্লবী কর্মী ব্যতীত এই বিরাট কাজ কখনই সম্পন্ন হতে পারে না।’’ [ইসলামী বিপ্লবের পথ, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী]
বর্তমান মুসলিম সমাজের মর্মান্তিক অধঃগতির বর্ণনা করে মাওলানা মওদূদী বলেন, ‘‘চরিত্রের দিক দিয়ে যত প্রকারের মানুষ দুনিয়ার অমুসলিম জাতিগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়, ঠিক তত প্রকারের মানুষ এই মুসলিম নামধারী জাতির মধ্যেও বর্তমান। আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার ব্যাপারে অমুসলমান যতখানি সক্ষম ও নির্ভীক মুসলমানগণ সে অপেক্ষা কোন অংশেই কম নয়। ঘুষ, সুদ, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার, মিথ্যাচার ধোঁকা ও প্রতারণা এবং অন্যান্য সকল প্রকার অপরাধ অমুসলিমগণ যে হারে করে মুসলমানগণ সে অপেক্ষা কিছুমাত্র কম করে না। বিশেষ স্বার্থলাভ এবং অর্থোপার্জনের জন্য কাফেরগণ যে অপকৌশল অবলম্বন করে মুসলমানগণও তা করতে কুণ্ঠিত হয় না। মুসলিম আইন ব্যবসায়ী জেনে বুঝে প্রকৃত সত্যের বিরুদ্ধে ওকালতি করে সেই মুহূর্তে একজন অমুসলিম ব্যক্তি আল্লাহকে যতখানি ভুলে যায়, একজন মুসলিম আইন ব্যবসায়ীও ঠিক ততখানিই ভুলে যায়। একজন মুসলিম ধনশালী ব্যক্তি ঐশ্বর্য লাভ করে কিংবা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব দখল করে সেইসব কার্যকলাপ করে থাকে যা করে একজন অমুসলিম ব্যক্তি। যে জাতির নৈতিক অবস্থা এত হীন ও এত অধঃপতিত তারা সেই নানা মতের ও নানা প্রকৃতির বিরাট জনতার ভীড় জমিয়ে একটি বাহিনী গঠন করে দিলে কিংবা রাজনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষার সাহায্যে তাদেরকে শৃগালের ন্যায় চতুর করে অথবা যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী করে তাদের মধ্যে ব্যাঘ্রের হিংস্রতা জাগিয়ে তুললে অরণ্য জগতে প্রভুত্ব লাভ করা হয়তবা সহজ হতে পারে, কিন্তু তার সাহায্যে মহান আল্লাহ তায়ালার দ্বীন ইসলামের কোন প্রচার বা ইসলামী হুকুমাত কায়েম হওয়া মোটেই সম্ভব নয়। কারণ এমতাবস্থায় দুনিয়ার কেউই তাদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করবে না, কারো দৃষ্টি তাদের সম্মুখে শ্রদ্ধায় অবনমিত হবে না, তাদের দেখে কারো মনে ইসলামের আপোষহীন ভাবধারা ও অনুপ্রেরণা জাগ্রত হবে না।’’ আমাদের বর্তমান জাতীয় চরিত্রে এই যে চিত্র তা সামনে রেখে অনায়াসেই বলা যায় যে, এ ধরণের লক্ষ লক্ষ লোকের বিরাট ভীড় অপেক্ষা ১০ জন মাত্র বিপ্লবী কর্মী ইসলামের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অধিকতর কৃতিত্ব ও সাফল্যের সাথে পরিচালিত করতে পারে।
‘‘এতদ্ব্যতীত দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের জন্য এমন এক দুরন্ত ও অনমনীয় নেতৃত্বের আবশ্যক যা এই বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মপথে ইসলামের মূলনীতি থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণ বিচ্যুতিও কখনোই বরদাশত করবে না।’’ তিনি অত্যন্ত চমৎকার যুক্তিসহ প্রমাণ করেছেন যে, ‘‘সুবিধাবাদী এবং স্বার্থ শিকারী নেতৃত্ব দ্বারা ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টি করা ও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা একেবারেই অসম্ভব।’’
‘‘রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল শিকড় সমাজ জীবনের গভীর তলদেশে মযবুতভাবে গেঁথে থাকে। কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজ জীবনের অভ্যন্তরে এর মর্মমূলে কোন পরিবর্তন সূচিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত কোন কৃত্রিম উপায়ে শাসনতন্ত্রে বা শাসনযন্ত্রে কোনরূপ পরিবর্তন সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।’’ [ইসলামী বিপ্লবের পথ, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী]
ছ. সামষ্টিক প্রস্তুতি প্রয়োজন
কোন ব্যক্তি বিশেষের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পূর্ণাংগ ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজ কায়েম সম্ভব নাও হতে পারে যদি সমাজ মানসে সমষ্টিগতভাবে সংশোধন ও পরিবর্তন গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি না থাকে। ব্যক্তিগত তাকওয়া পরহেজগারীর অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও মুহাম্মদ তোগলক, আলমগীর এবং মামুনুর রশিদের মত ইতিহাসের পরাক্রমশালী শাসকগণ সামাজিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হননি। অবশ্য ব্যক্তিগত সততা এবং নিষ্ঠার কারণে অনেকেই অনেক ভাল কাজ করে যেতে সক্ষম হয়েছেন। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা এবং ব্যক্তি বিশেষের শক্তি আধিপত্য ইতিহাসে অনেক অসাধ্য সাধন করেছে এবং রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। এমনকি রাষ্ট্রীয় সংস্কার সাধনের জন্য একটি শক্তিশালী টিম থাকা সত্ত্বেও সমষ্টিগত সামাজিক প্রয়াস না থাকার কারণে পূর্ণাংগ বিপ্লবের আশা করা যায় না। ইসলামের ইতিহাসে পঞ্চম খলিফা নামে খ্যাত হযরত ওমর বিন আবদুল আজীজের কথা এ প্রসংগে উল্লেখ করা যেতে পারে। বিরাট এক আলোড়ন সৃষ্টিকারী পরিবর্তন প্রচেষ্টার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হলেও পূর্ণাংগ একটি ইসলামী সমাজ বিপ্লব সাধন সম্ভব হয়ে উঠেনি। সুতরাং সমাজের গভীর তলদেশ থেকে উল্লেখিত আকাঙ্ক্ষা এবং সর্বস্তরের গণমানুষের বিপ্লবাকাঙ্ক্ষা ছাড়া কেবলমাত্র নেতার আকাঙ্ক্ষা এবং প্রয়াসের ফলেই ইসলামী বিপ্লব সফল হতে পারে না। অনুরূপভাবে পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত একটি জাতি রাষ্ট্রের গায়ে ইসলামী হুকুমাত বা ইসলামী রিপাবলিক লেবেল বা সাইন বোর্ড লাগিয়ে দিলেই ইসলামী বিপ্লব আসবে না। বরং অভিজ্ঞতা বলে, সত্যিকার ইসলামী বিপ্লবের পথ রুদ্ধ করার জন্য এ ধরণের লেবেল বা সাইনবোর্ড বেশি কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে। এ প্রসংগে মাওলানা মওদূদী মুসলিম জাতীয় রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোকপাত করে বলেছেন, ‘‘এমনকি একটি অমুসলিম রাষ্ট্র যেসব অপরাধের জন্য কারাদণ্ড দিবে মুসলিম জাতীয় রাষ্ট্র সেইসব ক্ষেত্রেই প্রাণদণ্ড বা নির্বাসন দণ্ড দান করবে। আর এ সত্ত্বেও মুসলিম জাতীয় রাষ্ট্রের কর্ণধারগণ তাদের জীবদ্দশায় ‘গাজী’ ও ‘বীর মুজাহিদ’ এবং মৃত্যুর পর মহিমান্বিত বলে অভিহিত হবে। অতএব মুসলিম জাতীয় রাষ্ট্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্যকারী হতে পারে বলে মনে করা একেবারেই ভুল। [ইসলামী বিপ্লবের পথ, সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী] মাওলানা উদ্বৃতি থেকে এটাও পরিষ্কার হলো যে, ইসলামী রাষ্ট্র বিপ্লবের জন্য নেতৃবৃন্দের উপর নির্ভরশীল হয়ে বসে থাকার ধারণাও সঠিক নয়। নেতৃত্ব এবং জনগণ উভয়কে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। সক্রিয় নেতৃত্ব যেমন জনগণকে সক্রিয় করতে পারে আবার সক্রিয় জনগণ নেতৃত্বকে সক্রিয় করতে পারে।