মোস্তফা কামাল আতাতুর্কঃ জীবন ও কাজের মূল্যায়ন
মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ১৮৮১ সালে সালোনিকার এক জীর্ণ কুটিরে জন্মগ্রহণ করেন। সরকারী অফিসের ছাপোষা কেরানীর পদে ইস্তফা দেয়ার পর তার বাবা আলী রেজা ব্যবসায়ে দু’বার ব্যর্থ হন। পরে দুঃখকষ্ট ভুলে থাকার জন্যে মাদকদ্রব্যে ডুবে থাকেন এবং আতাতুর্কের ৭ বছর বয়সের সময় যক্ষারোগে মারা যান। তার মা জুবাইদা খুবই পর্দানশীল এবং অশিক্ষিত ছিলেন। পরিবারের কর্তৃত্ব তার হাতেই ছিল। তার স্বামীর বৈপরিত্যে তিনি ছিলেন খুবই ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান। সে যুগের অন্যান্য তুর্কী মহিলার মত তার সমগ্র জীবন বড় ছেলেকে ঘিরেই কেন্দ্রীভূত ছিল। গভীর ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে জুবাইদা চেয়েছিলেন তার সন্তান ধার্মিক পণ্ডিত হবে।
কিন্তু সন্তানের ভিন্ন ধ্যান ছিল, তিনি সকল প্রকার কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন এবং প্রকাশ্যে তার শিক্ষকদের অপমান এবং গালাগালি করতেন। তার সহপাঠিদের প্রতিও তার ব্যবহার ছিল অমার্জিত এবং তাদের খেলা ধুলায় অংশগ্রহণ না করে সকলের অপ্রিয় হয়ে উঠেন। তার কাজে হস্তক্ষেপ করলে তিনি বিরক্ত হয়ে একলা খেলাধুলা করতেন। এ ধরনের উদ্ধত আচরণে একদা এক শিক্ষক ক্রোধান্ধ হয়ে তাকে বেদম প্রহার করেন। মোস্তফা স্কুল থেকে পালিয়ে যান এবং পুনরায় স্কুলে যেতে অস্বীকার করেন। তার ধর্মনিষ্ঠা মা বুঝাতে চেষ্টা করলে তিনি তাঁকে উল্টো আঘাত করেন। জুবাইদা হতাশ হয়ে কি করবেন ভেবে উঠতে পারলেন না, পরে তার এক চাচা তাকে সালোনিকার সামরিক স্কুলে পাঠিয়ে সৈনিক করার পরামর্শ দেন।
সরকারের অনুদানে পরিচালিত হওয়ায় স্কুলে তার কোন খরচ পড়বে না, যোগ্যতার পরিচয় দিলে সে অফিসার হবে যদি তা না হয় অন্ততঃ সাধারণ সৈনিক হবে। যে কোনভাবে তার ভবিষ্যৎ জীবন যাত্রার নিশ্চয়তা আছে। যদিও জুবাইদা রাজী হননি কিন্তু তার বাধ সাধার আগেই মোস্তফার বাবার জনৈক বন্ধু তাকে কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে যেতে সম্মত হন। সে পরীক্ষা দেয় এবং ক্যাডেটে উত্তীর্ণ হয়। এখানেই সে নিজের জীবন শুরু করল। শিক্ষাগত দিক থেকে সে এতই সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে যে, তার একজন শিক্ষক তাকে মোস্তফা নাম দেন। এই আরবী শব্দের অর্থ পরিপূর্ণ। অঙ্ক এবং সামরিক বিষয়ে মেধার কারণে তাকে শিক্ষকতায় নিযুক্ত করা হয়।
শেষ পরীক্ষায় সর্বোচ্চ পদমর্যাদাসহ ১৯০৫ সালের জানুয়ারীতে তিনি ক্যাপ্টেন পদমর্যাদায় স্নাতক সম্মান পাশ করেন। এই সময় তিনি VATNM স্বদেশ নামে পরিচিত জাতীয়তাবাদী ছাত্র সমিতিতে যোগ দেন। VATAN এর সদস্যরা বিপ্লবী হওয়ার জন্যে গর্বিত ছিলেন। তারা সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদের শাসনের প্রতি বিরুপ ছিলেন এবং ইসলামের কর্তৃত্ব অবমাননাকারী তথাকথিত উদার নীতির প্রতি কঠোরতার জন্যে তার নিন্দে করেন।
তারা তুরস্কের অনগ্রসরতার জন্যে ইসলামকে দায়ী করতে কুণ্ঠিত ছিলেন না এবং শরিয়তকে সেকেলে বলে আখ্যায়িত করেন। ‘ভাতানে’র সদস্যরা সুলতানকে অপসারনের শপথ নেন এবং তার পরিবর্তে পশ্চিমী চালের সরকার, সংবিধান, পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন, তারা উলেমা বা ধর্মীয় পণ্ডিতদর কর্তৃত্ব অস্বীকার, পর্দা বিলোপ এবং নারী পুরুষের নিরঙ্কুশ সাম্যের প্রচেষ্টা শুরু করেন। শগগীরই মোস্তফা কামাল এর প্রধান হয়ে যান।
১৯০৮ সালে সুলতান আবদুল হামিদকে অপসারণের আগে তরুন তুর্কীদের ক্ষমতাসীন সংগঠন The committee of union and progress মোস্তফা কামালকে দলে যোগদানের আহ্বান জানালে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ এসে যায়। অবশ্য দলের নতুন সদস্য হিসেবে তাকে আদেশ মানতে হত, এ সময় তার প্রকৃতি ছিল হয় তাকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নতুবা কোন অংশ্রহণ করতে হবে না, তিনি ক্রমেই চরম এবং অসহিষ্ণু হয়ে পড়েন। দলের অন্যান্য সদস্যকে তিনি কোন গুরুত্বই দিতেন না। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী যুবরাজ সৈয়দ হালিম পাশা এবং সমরমন্ত্রী আনোয়ার পাশাকে ঘৃণা করতেন। তিনি তাদের সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া করতেন।
পরবর্তী দশ বছর সামরিক পেশায় নিজেকে জন্মগতভাবে সৈনিক এবং নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠায় চেষ্টিত হন। ক্রমান্বয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা তিনি আরও রাজনৈতিক প্রভাবের অধিকারী হন। সন্ধায় তালাবদ্ধ ঘরে তিনি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনায় গোপনে বৈঠক করতেন। প্রথম বিশ্বযুদ্দে তুরস্কের আঞ্চলিক অখণ্ডত্ব রক্ষায় নেতৃত্ব দেয়ায় তার সুযোগ সৃষ্টি হয়। দেশ রক্ষার জন্যে উৎসর্গকৃতপ্রাণ সৈনিকদের প্রিয় নেতা মোস্তফা কামাল পাশা জাতীয় বীরে পরিণত হন। গ্রীকের পরাজয় এবং তুরস্কের বিজয় সুনিশ্চিত হওয়ায় তুর্কী জনগণ আনন্দে উন্মত্ত হয়ে যান। তারা তাকে রক্ষক হিসেবে অভিনন্দিত করেন এবং গাজী উপাধিতে ভূষিত করেন।
কূটনীতিক আবেগের আতিশয্যে প্রাচ্যের দেশগুলো তাকে পাশ্চাতের বিরুদ্ধে প্রাচ্যের নেতা হওয়ার আহ্বান জানান। রাষ্ট্রীয় পরিষদে আরব রাষ্ট্রনায়কদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেনঃ আমি সকল ইসলামী রাষ্ট্রের ফেডারেশন বা সোভিয়েতের অধীনে সকল তুর্কী জনগণের লীগ কোনটাতেই বিশ্বাসী নই, আমার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে তুরস্কের প্রাকৃতিক সীমান্তে তার স্বাধীনতা রক্ষা করা, উসমানীয় বা অন্য কোন সাম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবনের জন্যে নয়, স্বপ্নের মোহ দিয়ে অতীতে তারা আমাদের অনেক ক্ষতি করেছে।
তার সমর্থন আদায়ের জন্যে আগত কম্যুনিষ্ট প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে আরও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেনঃ এখানে কোন শোষক বা শোষিত নেই। এখানে কেবল তারা আছে যারা নিজেদের শোষণ করার অনুমতি দেয়। তুর্কীরা এদের মধ্যে নেই, তারা কেবল নিজেদের ব্যাপারে সচেতন। অন্যরাও তাই করুক, আমাদের একটা মাত্র নীতি- তুর্কীর চোখে সকল সমস্যাকে দেখা এবং তুর্কীর জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা।
স্বাভাবিক সীমান্তের মধ্যে ক্ষুদ্র এবং সংহত জাতি, সবকিছুর উর্ধ্বে একটি সমৃদ্ধশালী আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ককে গড়ে তোলার ব্যাপারে মোস্তফা কামাল পাশার ঘোষিত নীতি বিশ্বের সকল জাতি কর্তৃক সম্মানিত হয়েছে। তিনি এতই দৃঢ় আস্থাবান ছিলেন যে, এই কাজ সমাধার জন্যে তিনি যোগ্যতম ব্যক্তি। তিনি দাবী করেন আমি তুরস্ক, আমাকে ধ্বংস করার মানে তুরস্ককে ধ্বংস করা।
ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই তিনি ঘোষণা করেন যে তিনি তুর্কী জাতির জীবন থেকে ইসলামের সকল চিহ্ন মুছে ফেলবেন। কেবলমাত্র ইসলামের কর্তৃত্ব নির্মূল করার পরই তুর্কীরা অগ্রগতি করতে পারে এবং আধুনিক ও সম্মানিত জাতিতে পরিণত হতে পারে। তিনি ইসলাম এবং ইসলামের সকল দিকের বিরুদ্ধে জনসমক্ষে একের পর এক বক্তৃতা দিতে থাকেন।
প্রায় পাঁচশ বছর ধরে একজন আরব শেখের মতবাদ ও আইন এবং অলস ও অকর্মন্য মোল্লাদের ব্যাখ্যা তুরস্কের দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত করে আসছে। তারা সংবিধানের ধরন, প্রতিটি তুর্কীর জীবনযাত্রা, তার খাদ্য, তার নিদ্রা এবং শয্যা ত্যাগের সময়, তার কাপড়ের আকৃতি, তার সন্তান ধারক ধাত্রীর রুটিন, তার স্কুলের পঠিতব্য বিষয়, তার আচার প্রথা, চিন্তা এমনকি তার ঘনিষ্ঠ অভ্যঅস নির্ধারণ করে আসছে। ইসলাম একজন ধর্মতাত্মিক নীতিহীন আরবের প্রচলিত একটি মৃত বস্তু। সম্ভবতঃ এটি মরুর উপজাতিদের জন্য উপযুক্ত ছিল। বর্তমান আধুনিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রের জন্যে এর কোন মূল্য নেই। খোদার ওহি? কোন খোদাই নেই! এগুলো হচ্ছে শৃংখল, যার দ্বারা মোল্লা এবং খারাপ শাসকরা জনগণতে নত থাকতে বাধ্য করে, যে শাসক ধর্ম চায় সে দুর্বল প্রাণী, কোন দুর্বল প্রাণীর শাসন করা উচিত নয়। (IBID পৃঃ ১৯৯-২০০)
আবদুল মজিদ খলিফা নির্বাচিত হলে মোস্তফা কামাল পাশা চিরাচরিত ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার অনুমতি দেননি। বিষয়টি আলোচনার জন্যে পরিষদের বৈঠক বসার পর মোস্তফা কামাল বিতর্ক বন্ধ করে দিয়ে বলেনঃ নামমাত্র রাষ্ট্র প্রধান ছাড়া খলিফার কোন ক্ষমতা বা মর্যাদা নেই। আবুদল মজিদ তার ভাতা বৃদ্ধির দাবী জানিয়ে দরখাস্ত করলে মোস্তফা কামাল উত্তর দেন- আপনার খেলাফতের অফিস ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই নয়। এর অস্তিত্বের কোন যৌক্তিকতা নেই। আামর কোন সচিবের কাছে লিখা আপনার ধৃষ্টতার সামিল।
১৯২৪ সালের ৩রা মার্চ খেলাফতকে চিরদিনের জন্যে সম্পূর্ণ বিতাড়িত এবং সম্পূর্ণ ধর্ম নিরপেক্ষ তুর্কী জাতি প্রতিষ্ঠার জন্যে পরিষদে বিল উত্তাপন করেন। বিল পেশ করার আগে এবং বিল সম্পর্কে কেউ কিছু জানার আগে দূরদর্শিতার সঙ্গে তার কোন কাজের বিরোধিতাকে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করেন-
“সবকিছুর বিনিময়ে প্রজাতন্ত্র বজায় রাখতে হবে। উসমানীয় সাম্রাজ্য ভেঙ্গে যাওয়ার পরও ধর্মীয় আইনের ওপর ভিত্তিকৃত নড়বড়ে কাঠামো ছিল। খলিফা এবং উসমানীয় পরিষদের অবশেষকে বিদায় করতে হবে। প্রাচীন ধর্মীয় আদালত এবং আইনের যায়গায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক দেওয়ানী আইন চালূ করতে হবে। মোল্লাদের মক্তবে ধর্মনিরপেক্ষ সরকালের স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে পৃথক করতে হবে। তুর্কী প্রজাতন্ত্রকে সত্যিকার ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে”।
পরবর্তী পর্যায়ে কোন বিবর্ত ছাড়াই বিলটি গৃহীত হয় এবং সাবেক খলিফা ও তাঁর পরিবারকে সুইজারল্যাণ্ডে নির্বাসনে পাঠানো হয়। নতুন প্রশাসন তখন এই আইন জারী করেন। নতুন তুর্কী সংবিধানের মুখবন্ধ আতাতুর্কেল সংস্কারের প্রতি নিষ্ঠা প্রকাশ করছে এবং ১৫৩ অনুচ্ছেদে সংস্কার থেকে পশ্চাতে ফিরে যাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে। এই সংবিধানের কোন ধারাকে ভাষান্তর বা সংবিধান বিরোধী বলে ব্যাখ্যা করা যাবে না, কারণ নিম্ন বর্ণিত সংস্কার আইনগুলোর লক্ষ্য হচ্ছে তুর্কী সমাজকে সমসাময়িক সভ্যতার পর্যায়ে পৌঁছানো এবং প্রজাতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য রক্সা করা যা গণভোটে গৃহীত হওয়ার দিন থেকে কার্যকর হয়েছে-
১। ১৯২৪ সালের ৩রা মার্চের শিক্ষা ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে একত্রীকরণের আইন।
২। ১৯২৫ সালের পঁচিশে নভেম্বরে টুপি আইন।
৩। দরবেশ আশ্রম, সমাধি স্তম্ভসমূহ বন্ধ এবং সমাধি রক্ষকের কার্যালয় বিলুপ্তি এবং ১৯২৫ সালের ৩০শে নভেম্বরের কিতপয় খেতাব নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত আইন।
৪। ১৯২৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারীর সাধারণ বিয়ের নিয়ম কানুন।
৫। ১৯২৮ সালের ২০শে মে’র আন্তর্জাতিক সংখ্যা প্রবর্তন সংক্রান্ত আইন।
৬। ১৯২৮ সালের ১লা নভেম্বরের তুর্কী হরফের যায়গায় ল্যাটিন হরফ চালু ও প্রয়োগ এবং আরবী পাণ্ডুলিপি নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত আইন।
৭। ১৯৩৪ সালের ২৬শে নভেম্বরের পাশা, BEY ও EFFENDI ধরনের খেতাব ও পরিচিতি বাতিল সংক্রান্ত আইন।
আতাতুর্কবাদকে পুরোপুরি অস্বীকার করা অসম্ভব এবং অচিন্তনীয় হয়ে পড়লো। এটা অসম্ভব কারণ সংবিধান তা নিষিদ্ধ করেছে, অচিন্তনীয় কারণ বৃদ্ধ এবং যুবকরা সংস্কারের ফলাফল গ্রহণ করেছে এবং সমৃদ্ধ জীবনের জন্যে পশ্চিমীকরণ একটা জনপ্রিয় ম্যাজিক হয়ে উঠেছে। [Turkey to-day and to-morrow; An experiment in westernization, Nuri Eren Praeger, New York, 1963 p-100-102.]
যে সময় এসব সংস্কার কার্যকর করা হচ্ছিল মোস্তফা কামাল পাশা লতিফা নাম্নী ইউরোপীয় শিক্ষিতা একজন সুন্দরী মহিলাকে বিয়ে করেন। তুরস্কের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মোস্তফা কামাল পাশা এই মহিলাকে পুরুষদের পোষাক পরিধান এবং মহিলাদের নিরস্কুশ সাম্যের দাবী করতে উৎসাহিত করেন। কিন্তু আত্মসম্মান বোধ সম্পন্না হয়ে যখন তিনি সম্মানিত স্ত্রীর মত ব্যবহারের দাবী করেন, রাগান্বিত হয়ে মোস্তফা তাকে তালাক দেন। লতিফাকে তালাক দেয়ার পর তাঁর লজ্জাহীনতার সীমা ছিল না। এত বেশী মদ পান শুরু করেন যে, িতন মদ্যপ বনে যান। সুন্দর যুবক ছেলেরাই তাঁর কামপ্রবৃত্তির লক্ষ্য হয়ে পড়ে এবং তাঁর রাজণৈতিক সমর্থকদের স্ত্রী কন্যাদের প্রতি তার ব্যবহার এতই উদ্ধত হয়ে পড়ে যে, তারা তাদের মহিলঅদেরকে তাঁর কাছ থেকে যতদূরে সম্ভব পাঠাতে শুরু করলেন। যৌনরোগে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে।
তাঁর চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে The grey wolf এর লেখক H.G. Armstrong- লিখেন- মোস্তফা কামাল পাশা সব সময় একা, নিঃসঙ্গ ও একক হাতে খেলছিলেন। তিনি কাউকে বিশ্বাস করেননি। কেউ তাঁর সঙ্গে মতদ্বৈততা দেখালে তিনি তাকে অপমান করতেন। তিনি সব কাজ আত্ম স্বার্থের মাপকাঠিতে বিবেচনা করতেন। তিনি বিবেচনাহীন প্রতিহিংসাপরায়ণ ছিলেন। একজন চাতুর বা সক্ষম মানুষ তার কাছ থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন ছিল। অন্য যে কোন লোকের পারদর্শিতা সম্পর্কে তিনি খুবই খুঁতখুঁতে ছিলেন। তিনি তাঁর সমর্থকদের চরিত্র হনন এবং তাদের প্রতি অবজ্ঞা দেখিয়ে পাশবিক আনন্দ পেতেন। অবজ্ঞা ছাড়া তিনি কখনো দয়া বা উদারতা দেখাননি। তিনি কারো ওপর আস্থা স্থাপন করেননি। তার কোন ঘনিষ্ঠ লোকও ছিল না। তার বন্ধুরা শয়তান গোছের, যারা তার সঙ্গে মদ্যপান করতো, তার ইন্দ্রিয় সুখে সহায়তা করতো। যুদ্ধের কালো দিনগুলোতে যেসব ভাল লোক তার পাশে ছিলেন পরবর্তী কালে সকলেই তার বিরুদ্ধে ছিলেন। (পৃ৬ ২১৩-১৪)
কোন স্বৈরাচারী প্রতিদ্বন্দ্বী বরদাশত করতে পারে না। কামাল পাশাও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দীদের নিশ্চিহ্ন করতে কোন সুযোগই ছাড়েননি- গোপন পুলিশ তাদের কাজ করেছে। গ্রেফতারকৃত রাজনৈতিক নেতাদেরকে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়ার জন্যে পুলিশ খেয়াল খুশী মত অত্যাাচর করেছে। তাদের বিচারের জন্যে একটি স্বেচ্ছাচারী ট্রাইবুনাল মনোনয়ন করা হয়েছে। কোন বিচার পদ্ধীত বা সাক্ষ্য ছাড়াই আদালত তাদের ফাঁসীর আদেশ দিয়েছেন।
মৃত্যু পরোয়ানায় মোস্তফা কামালের স্বাক্ষরের জন্যে তার খানকায়ার প্রাসাদে পাঠানো হয়। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের একজনের নাম ছিল আরিফ। মোস্তফা কামালের সঙ্গে ঝগড়া করে তিনি বিরোধী দলে যোগ দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের বিভৎস দিনগুলোতে আরিফ তার পাশাপাশি ছিলেন। আরিফ তার এতই ঘনিষ্ঠ ছিলেন যে তার কাছে পাশা হৃদয়ের সমস্ত কথা খুলে বলতেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন বলেছেন মৃত্যু পরোয়ানা প্রাপ্তির পর গাজলি মুখে সামান্য পরিবর্তনও হয়নি, তিনি কোন মন্তব্য করেননি এবং স্বাক্ষরদানে কুণ্ঠা করেননি। তিনি ধুমপান করছিলেন। এ্যাশটেতে সিগারেটের অবশিষ্টাংশ রেখে তিনি নির্বিকার চিত্তে আরিফের মৃত্যু পরোয়ানার স্বাক্ষর করে পরবর্তী কাজে মনোনিবেশ করলেন।
তিনি সব কাজ যথাযথভাবে করেন। সে রাতেও তিনি ‘খানকায়ায়’ পার্টির আয়োজন করলেন। বিচারক, মন্ত্রী, রাষ্টৃদূত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সকল খ্যাতনামা ব্যক্তি এবং সকল সুন্দরী মহিলঅকে আসতে হবে। আঙ্কারায় উৎসব চলতেই হবে।
খুব শান্তভাবে নাচ শুরু হয়। লণ্ডন থেকে তেরী নিষ্কলঙ্ক পোষাক পরে গাজী এক কোণায় কূটনীতিকদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। অতিথিরা খুব সতকৃতার সঙ্গে তাঁকে লক্ষ্য করছিলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি খোশ মেজাজ দেখাবেন ততক্ষণ সবাইকে সতর্কতার সঙ্গে নীচ স্বরে কথাবার্তা বলতে হয়। তার ক্রোদের সময় কারও আনন্দ প্রকাশ খুবই বিজদজনক। কিন্তু গাজী খুবই খোশ মেজাজে ছিলেন। এটা কোন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ছিল না। কেবলমাত্র স্ফূর্তি করে রাত কাটানোর অনুষ্ঠান। তিনি বললেন- “আমাদেরকে উৎফুল্ল হতে হবে। আমাদেরকে বাঁচতে হবে। সজাগ হোন”! একথা বলেই তিনি এক অপরিচিতা মহিলার হাত ধরে নাচ গান শুরু করলেন। অতিথিদের একে একে সবাই তার অনুসরণ করলেন। তারা নাচলেন। যদি না নেচে থাকেন গাজী তাদের নাচালেন। গাজী উত্তেজিত হয়ে তার সঙ্গীর পাশাপাশি ঘুরতে লাগলেন এবং সবাইকে নাচের ফাঁকে ফাঁকে পানীয় দিতে লাগলেন।
আঙ্কারা থেকে চার মাইল দূরে। ডজন খানেক বৈদ্যুতিক বাতিতে সমুজ্জল একটি বিরাট মোড়। এর চারিদিকে এবং রাস্তায় বিরাট জনতা সমবেত। বৈদ্যুতিক বাতির নীচে কারাগারের পাথরের দেয়াল ঘেঁষে বিরাটকায় ৮টি কাঠের ত্রিভুজ। প্রতিটির নীচে একজন মানুষ। তার হাত পেছনে টেনে বাঁধা এবং গলার ফাঁস জড়ানো। মোস্তফা কামাল পাশার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা মৃত্যুর মুখোমুখি।
বিরাট নীরবতার মধ্যে প্রত্যেকেই পর পর জনতার উদ্দেশ্যে কিছু বললেন। একজন একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন, আরেকজন প্রার্থনা করলেন, তখনও একজন চীৎকার করে বললেন- তিনি তুরস্কের অনুগত সন্তান।
‘খানকায়া’র প্রায় সকল অতিথিই চলে গেছেন। কক্ষগুলো সিগারেটের গোড়া মদমিশ্রিত থুথু, মাদকীয় গন্ধে ভুর ভুর করছিলো। মেঝে, টেবিল সব জায়গায়ই তাস আর টাকা গড়াগড়ি দিচ্ছিল।
মোস্তফা কামাল কক্ষের ভেতর দিয়ে হেটে গিয়ে একটি জানালার পাশে দাঁড়ালেন। তার মুখমণ্ডল স্থির এবং ধূসর; ফ্যাকাশে দৃষ্টি অভিব্যক্তিহীন, তার দেহে ক্লান্তির কোন ছাপ নেই, তার বৈকালিক পোশাক আগের মতই নিষ্কলঙ্ক। পুলিশের কমিশনার জানালেন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। সমস্ত লাশ ফেলে দেয়া হয়েছে। অতঃপর তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তার শক্ররা হয় নিশ্চিহ্ন, নতুবা মৃত অথবা ছিন্নবিচ্ছিন্ন। (পৃঃ ২২৯-২৩৬)
এদিকে তুর্কী জনগণের ধুমায়িত বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠতে লাগল। ১৯২৬ সালে পার্বত্যাঞ্চলের কুর্দী উপজাতিরা কামাল প্রশাসনের বিরুদ্দে প্রকাশ্য বিদ্রোহ করলে ধুমায়িত বিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। মোস্তফা কামাল ব্যবস্থা গ্রহণে কালবিলম্ব করেননি। তুর্কী কুর্দীস্থানে বর্বর অত্যাচার শুরু করলেন, গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিলেন, পশু ও শষ্য ধ্বংস করলেন, মহিলা ও শিশুদের ধর্ষণ এবং হত্যা করলেন। ৪৬ জন কুর্দী নেতাকে জনসমক্ষে ফাঁসী দিলেন। সবশেষে মরলেন কুর্দী নেতা শেখ সাঈদ। তিনি হত্যাকারীর উদ্দেশ্যে বললেন- “তোমার প্রতি আমার কোন ঘৃণা নেই। তুমি এবং তেমার মনিব কামাল আল্লাহর নিকট ঘৃণিত। শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর কাছে আমাদের ফয়সালা হবে”।
মোস্তফা কামাল এখন নিরঙ্কুশ একনায়ক। তুর্কী জনগণ টুপি এবং পাগড়ী নিষিদ্ধকরণ, পশ্চিমা পোষাক বাধ্যতামূলক পরিধান, ল্যাটিন হরফ, খ্রীষ্টীয় বর্ষপঞ্জিকা, রবিবার সরকারী ছুটির দিন প্রভৃতি ইসলাম বিরোধী সংস্কারকে অস্ত্রের মুখে মেনে নিলেন। হাজার হাজার উলামা এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীলরা সত্যের জন্যে প্রাণ দিলেন, তুর্কী জনগণ এসব চেয়েছে এটা বলা সত্যের অপলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। আরও বিলম্বের আগেই তুরস্কের বাইরের এবং ভেতরের মুসলমানদেরকে নিম্ন বর্ণিত পদক্ষেপগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়ন করতে হবে-
১. তুর্কী মুজাদ্দিদ বদিউজ্জামান সৈয়দ নূরসীল আন্দোলনকে পুরো বস্তুগত ও নৈতিক সমর্থন দিতে হবে। যদিও এটি সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে পরিহার করছে তবুও তুরস্কের বুকে এটাই একমাত্র সংগঠন যা নির্ভেজাল ইসলাম প্রচার করছে এবং পশ্চিমীবাদের অনিষ্টকে প্রতিরোধে সক্ষম।
২. যে সব শহর ও গ্রামের জনগণ এখনো ঈমানের প্রতি নিষ্ঠাবান এবং সংবিধান থেকে ইসলাম বিরোধী ধারা বাতিল করে শরিয়তের প্রাধান্যের জন্যে সরকারের কাছে দাবী জানাচ্ছেন সে সব এলাকায় এই আন্দোলনের সমর্থকদেরকে ইসলাম প্রচারে উৎসাহ দিতে হবে এবং সংঘবদ্ধ করতে হবে।
৩. তুরস্কে শিক্ষার সকল পর্যায়ে আরবী ভাষায় কোরআন ও হাদীস অধ্যয়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রীদেরকে ফার্সী এবং উর্দু অধ্যয়নে উৎসাহিত করতে হবে এবং এ জন্যে উপযুক্ত পাঠ্যক্রম চালু করতে হবে। এই ব্যবস্থা তুরস্কের ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে তাদের অন্যান্য জায়গায় মুসলমান ভাইদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করে তুলবে।
৪. উসমানীয় আমলের তুরস্কের আরবী পাণ্ডুলিপি শিক্ষার সকল স্তরে পড়াতে হবে। এতে তুরস্কের ইসলামী ঐতিহ্যের উজ্জ্বল নিদর্শন রয়েছে। এতে আমাদের ঐতিহ্যেরও পুনরুদ্ধার হবে যা শুধু তুর্কী নয় অন্য জায়গার মুসলমানদেরও কাজে আসবে।
৫. অসুন্দর অর্ধনগ্ন পোষাক পরিধান করে পশ্চিমা ফ্যাশনে এবং প্রথায় মহিলাদের জনসমক্ষে আসা আইন দ্বারা নিষিদ্ধ করে দিতে হবে। মহিলা বা পুরুষ সকলের জন্যে পশ্চিমা ফ্যাশনের অনুকরণকে নিরুৎসাহিত করতে হবে, ভবিষ্যৎ বংশধরদেরকে ইসলামী নম্রতা ও শিষ্ঠতা শেখাতে হবে এবং সে ধরনের পোষাক পরিধানে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৬. তুর্কী জনগণকে বোঝাতে হবে যে, পশ্চিমাদের সঙ্গে গোত্রভুক্ত করা তাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্হী। তাদের জানা উচিৎ তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকা এবং বৃটেন গ্রীকের আর্কবিশপ ম্যাকরিয়সকে সমর্থন করছে এবং তুর্কী সাইপ্রিয়টদের বাঁচাবার জন্যে কিছুই করছে না। এটাই হচ্ছে তুর্কীদের প্রতি পশ্চিমাদের প্রীতির নমুনা।
শেখ মোহাম্মদ আবদুহ
শেখ মোহাম্মদ আবদুহ উনিশ শতকের মিশরে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টা তাঁর জীবদ্দশায় ব্যর্থ হলেও তাঁকে খাট করে দেখা যায় না। তাঁর মৃত্যুর পরবর্তী দশকেই তাঁর প্রভাব অনুভূত হয়। মিশরের অধিকাংশ বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক, শিক্ষক, সাহিত্যিক প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে তার শিষ্য এবং সহযোগী ছিলেন।
শেখ মোহাম্মদ আবদুহ ১৮৪৯ সালে এক ক্ষুদ্র গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর অভিভাবকরা অশিক্ষিত হলেও ধর্মনিষ্ঠ এবং চরিত্রবান ছিলেন। স্থানীয় মক্তবে তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। লিখতে এবং পড়তে শেকার পর তাঁর অভিভাবক তাঁকে কোরআন পড়ার জন্যে স্থানীয় একজন হাফেজের কাছে পাঠান। ১২ বছর বয়সে তিনি পরিপূর্ণ কোরআন শরীফ মুখস্ত করেন। পরবর্তী বছর তাঁর অভিভাবক তাঁকে তান্তার মক্তবে পাঠান কিন্তু তিনি সেখানকার শিক্ষা পদ্ধতিতে বিরক্ত হয়ে উঠেন। স্কুল থেকে উপকৃত হবে না এ কথা বুঝতে পেরে তিন নিজ গ্রামে ফিরে যান এবং আর কোন পুস্তক না খোলার অঙ্গীকার করেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন, এ সময় পিতার মত মাটি কাটা ছাড়া তাঁর আর কোন উচ্চাকাঙ্খা ছিল না।
অবশ্য ভাগ্যের বিধান ছিল অন্যরূপ। তাঁর এক চাচা তার প্রতি দৃষ্টি দেন এবং তাঁকে সুফীবাদের সঙ্গে পরিচিত করান। এ সময় সুফীবাদে তিনি এতই মগ্ন হয়ে যান যে, এটাই তাঁর জীবনের প্রধান দিক হয়ে পড়ে। নতুন আশায় উদ্বেলিত হয়ে তিনি তান্তায় ফিরে যান এবং লেখাপড়া শুরু করেন। তিনি এতই অসাধারণ প্রতিভাধর ছিলেন যে, খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে আল-আজহারে পড়ার জন্যে একটি বৃত্তি লাভ করেন।
শেখ মোহাম্মদ আবদুহ তান্তার মত আল-আজহারের শিক্ষায় হতাশ হয়ে পড়েন। তিনি এর শিক্ষা পদ্ধতিকে বিরক্তিকর, প্রাণহীন এবং গোঁড়ামিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেন। হতাশ হয়ে তিনি সুফীবাদ ও তপস্যায় আত্মনিয়োগ করেন। পার্থিব জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ আকর্ষণহীন জীবনের এই অংশে তিনি জামাল উদ্দীন আফগানীর সাক্ষাৎ পান। তাঁর গতিশীল ব্যক্তিত্ব এবং উৎসাহ তাঁকে ইসলামের সাবেক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে অনুপ্রাণিত করে। তবে জামাল উদ্দীন আফগানীর মত রাজনৈতিক বিপ্লবকে উদ্দেশ্যে পৌঁছার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ না করে তিনি মনে করেন শিক্ষার মাধ্যমেই তা সম্ভব।
১৮৭৭ সালে শেখ মোহাম্মদ আবদুহ আল-আজহার থেকে আলেম খেতাব নিয়ে স্নাতক পাশ করেন। কিন্তু পুনারায় শিক্ষক হিসেবে সেখানে প্রত্যাবর্তন করেন এবং মুসলিম শিক্ষা পুনরায় চালূকেই তাঁর প্রধান কর্তব্যে পরিণত করেন। পশ্চিমা শিক্ষা এবং বিজ্ঞানকে ইউরোপরে সম্পদ ও শক্তির মাপকাঠি মনে করে তিনি মিশর ও পার্শ্ববর্তী মুসলিশ দেশে তা সম্প্রসারণকে নিজের দায়িত্ব মনে করেন। আল-আজহার মুসলিম বিশ্বের বুদ্দি ও শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় তিনি ভাবলেন আল-আজহারের সংস্কার করা হলে ইসলামের সংস্কার হয়ে যাবে। তিনি চিরাচরিত শিক্ষাকে আধুনিক যুগের উনুপযোগী আখ্যায়িত করেন এবং শেখ ও উলামারা আধুনিক যুগের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারায় তাদের নিন্দা করেন।
শেখ মোহাম্মদ আবদুহ ইউরোপ এবং তার সভ্যতার উৎসাহী গুণগ্রাহী ছিলেন। ইংল্যাণ্ড এবং ফ্রান্স সফর করে তিনি এতই অভিভূত হয়ে যান যে, তিনি বারবার তাঁর আত্মার নবায়নের জন্যে সেখানে ফিরে যান। তিনি বলেন “আমার জনগণের পরিবর্তন সাধনের স্বপ্ন সফল না হওয়া পর্যন্ত আমি কখনো তা নবায়নের জন্যে ইউরোপ যাইনি”। যখনি তিনি মিশরে প্রতিবন্ধকতার কারণে হতাশ হয়েছিলেন তখনি তিনি ইউরোপ গেছেন এবং দুই-তিন মাসের মধ্যে তিনি দেখতে পেয়েছেন আগে যা তার কাছে কঠিন মনে হয়েছে এখন তা খুবই সহজ।
যদিও শেখ মোহাম্মদ আবদুহ ইবনে আরাবীর নেতৃত্বাধনি জাতীয়তাবাদীদের বিপ্লবী গোলযোগের বিরোধী ছিলেন, তিনি কখনো বৃটিশ সহযোগী KHEDIVE- এর বিরুদ্ধে তাদের পক্ষ নেননি। পরবর্তীকালে আরাবী বিদ্রোহীরা ধ্বংস হয়ে গেলে এবং বৃটেন মিশর দখল করার পর শেখ মোহাম্মদ আবদুহকে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তক্ষুণি তিনি প্যারিস যান এবং জামাল উদ্দীন আফগানীকে AL URWAH AL WUTHQA লেখা ও প্রকাশে সাহায্য করেন।
অবশেষে ১৮৮৩ সালে খেদাইব তৌফিক পাশা তাঁকে ক্ষমা করে শুদু নির্বাসন শেষ করেননি উপরন্তু তাঁকে স্থানীয় আদালতের কাজী পদে নিয়োগ করেন। তিনি অবশ্য কখনো আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়কে আধুনিকীকরণের প্রদান দায়িত্বের কথা ভুলেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর নিযুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সম্মান ও প্রভাব বাড়তেই থাকে। শিক্ষকদের সমর্থন লাভের জন্যে তিনি তাঁদের বেতন বাড়িয়ে দেন, আবাসিক সুবিধা বৃদ্ধি করেন। ছাত্রদের আবাসিক সুবিধাও উন্নত করা হয়, তাদের বিনা খরচায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এবং পাঠাগারের সংস্কার সাধন করেন। বস্তুগত সংস্কার ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক আধুনিককীকরণের সূচনামাত্র। তিনি আল-আজহারের পাঠ্যক্রমে আধুনিক ও ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় সংযোজন করেন তাকে ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মানে উন্নীত করতে মনোযোগী হন। তিনি এ ব্যপারে নিশ্চিন্ত হন যে, আল আজহারে ইসলাম সংস্কার করা হলে মুসলিম বিশ্বসহ সর্বত্র এর প্রভাব পড়বে। তিনি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিলেন যে, আল আজহার বর্তমান অবস্থায় চলতে পারে না। হয় এর সংস্কার করতে হবে নতুবা এটা ধ্বংস হয়ে যাবে। অবশ্য শেখ এবং উলামারা বিপরীত ধারণা পোষণ করায় বিরোধিতা অপ্রতিরোধ্য ছিল। এইভাবে তাঁর প্রচেষ্ঠা ব্যর্থতার পর্যবসিত হলেও তাঁর মৃত্যু পরবর্তী সংস্কারের জন্যে তা ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
হতাশ হয়ে শেখ মোহাম্মদ আল আজহারের প্রশাসনিক কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি সম্পূর্ণ পশ্চিমা ধারায় একটি নুতন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যেই তাঁর স্বপ্নের সফলতা দেখতে পান। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর পর ১৯০৮ সালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়। ১৮৯৯ সালে বৃটিশের সমর্থনে শেখ মোহাম্মদ আবদুহ মিশরের মুফতী নিযুক্ত হন। শরীয়তের সরকারী ব্যাখ্যাদাতা হিসেবে যে কোন বিষয়ে তাঁর ফতোয়াই চূড়ান্ত বলে গ্রহণ করা হতো। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন।
তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল ইসলামকে পশ্চিমী সভ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রমাণ করা। তার দু’টি বিখ্যাত ফতোয়ায় মুসলমানদের জন্যে ছবি এবং মূত্যি আইনসিদ্ধ এবং সুদের ব্যবসায় নিয়োজিত ব্যাংকে মুসলমানদের টাকা জমা রাখার অনুমতি দেয়া হয়। তিনি মুসলমানদের জন্যে পশ্চিমা পোষাককেও গ্রহণযোগ্য বলে ফতোয়া দেন।
শেখ মোহাম্মদ আবদুহ মানব মনীষার প্রাধান্যে বিশ্বাসী ছিলেন। ধর্ম কেবলমাত্র মানব মনীষার সহায়তা করে। যুক্তিই ধর্মের যথার্থ বিচারক। সবকিছুর উপরে ইসলাম যুক্তিভিত্তিক ধর্ম, তার সব আদেশ যুক্তি দিয়ে প্রামান্য। শেখ মোহাম্মদ আবদুহ আধুনিক বিজ্ঞানে বিমোহিত ছিলেন। তিনি কোরআনের মধ্যেও তা পেতে চেয়েচিলেন। তাঁর একটি যুক্তির উদাহরণ- “উলামারা বলেন জ্বীন হচ্ছে অদৃশ্য জীবন্ত সত্তা। তবে অতি সম্প্রতি দূরবীনের সাহায্যে যেসব প্রাণীর অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে সেগুলোকেও জীন বলা যেতে পারে। সাম্প্রতিক আবিষ্কারের আলোকে মুসলমানদেরকে চিরাচরিত ব্যাখ্যা পরিবর্তন করতে হবে। কোরআন আধুনিক বিজ্ঞানের বিরোধিতা করার মত অনুদার নয়”।
শেখ মোহাম্মদ আবদুহ শুধুমাত্র পদার্থবিদ্যা বিষয়ক বিজ্ঞানের প্রাধান্যে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি নেতৃস্থানীয় পম্চিমা দার্শনিকদের ব্যাখ্যানুযায়ী সামাজিক বিজ্ঞানের প্রাধান্যেও বিশ্বাস করতেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, ডারউইনের বিবর্তনের মতবাদ কোরআনেও দেখা যায়।
১৮৮৩ থেকে ১৯০৭ পর্যন্ত মিশরের সত্যিকার শাসক এবং মুসলিম বিশ্বে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম স্থপতি লর্ড ক্রোমার বলেছেন- শেখ মোহাম্মদ আবদুহ খুবই উন্নত প্রকৃতির আলেম ছিলেন। খুবই ভাল প্রকৃতির খেদাইব তৌফিক বৃটিশ চাপের মুখে তাঁকে ক্ষমা করেন এবং বিচারক নিযুক্ত করেন। ১৮৯৯ সালে মোহাম্মদ আবদুহ গ্র্যাণ্ড মুফতি নিযুক্ত হন। তিনি সততার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। শেখ মোহাম্মদ আবদুহ প্রমস্ত ও সজাগ মনের অধিকারী ছিলেন। তিনি প্রাচ্যের সরকারগুলোর অধীনে গজিয়ে উঠা কুপ্রথাকে স্বীকার করেন। তিনি সংস্কার কাজে ইউরোপীয়দের সহায়তার প্রয়োজনীয়তাও স্বীকার করেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শেখ মোহাম্মদ আবদুহ’র অবহান উল্লেখ করে বলতে হয় ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মত তিনি মিশরে একটা চিন্তার জগত সৃষ্টি করেন এবং এর মাধ্যমে গোঁড়ামি মুক্ত একটি মুসলিম জাতির পত্তন করেন, তাদের কাজ খুবই কষ্টসাধ্য। সুতরাং তাঁরা সর্বপ্রকার উৎসাহ সমর্থন পাওয়ার যোগ্য। তাঁরা ইউরোপীয় সংস্কারকদের আত্মিক মিত্র। (আধুনিক মিশর পৃঃ ১৭৯-৮০)
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের লক্ষ্যের সঙ্গে সহযোগিতা এবং আধুনিক জীবনের সঙ্গে ইসলামের আপোষ সংক্রান্ত শেখ মোহাম্মদ আবদহর আকাঙ্ক্ষার ফলাফল অমঙ্গলজনক প্রমাণিত হয়েছে। তিনি তাঁর পরবর্তী পাশ্চাত্য পন্হীদের জন্যে পথ প্রশস্ত করে দিয়ে যান। কাসিম আমীন, আলী আবদ আর রাজিক, মোহাম্মদ কুরদ আলী এবং তাহা হোসাইন তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনকারী উদার ধারাকে যৌক্তিক সমাপ্তিতে টেনে নিয়ে যান। আশ্চর্যের ব্যাপার তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং শিষ্য রশিদ রিজা (১৮৬৫-১৯৩৫) তাঁর যুক্তিবাদে প্রতারিত হননি। রশিদ রিজা আবদুহর লেখা ও চিন্তার সম্পাদনা ও ব্যাখ্যা করেই তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু বছর যেতে না যেতে তিনি তাঁর গুরুর যুক্তির ভ্রান্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেন। শেখ আবদুহ’র মত পশ্চিমা সভ্যতার সত্যিকার প্রকৃতি সম্পর্কে রশিদ রিজার বিভ্রম ছিল না। জীবন সায়াহ্নে তিনি সঠিক ধারণা লাভ করেন এবং তাঁর গুরুর সবকিছুরই বিরোধিতা করেন।
কাসিম আমিন ও মুসলিম নারী মুক্তি
বিশ্বস্ত সহধমিনী হিসেবে গরে নারীর স্থান। পারিবারিক, ব্যবস্থাপনায় ও সন্তান লালন-পালনে তার দায়িত্ব। পরিবার প্রধান ও পরিবারের ভরণ-পোষণে স্বামীর কর্তৃত্ব। স্ত্রীকে তালাক দেয়া এবং একাধিক বিবাহের বেলায় তার অধিকার, ১৩ শতক ধরে কোন প্রকার প্রশ্ন ছাড়াই আমাদের প্রিয় নবী, তাঁর সাহাবা, ইমাম, ঐতিহ্যবাদী, বিচারক, ধর্মতত্ত্ববিদ এবং সকল চিন্তার আলেমগণ সর্বসম্মতভাবে মেনে আসছেন। মুসলিম বিশ্বের ওপর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত সার্বজনীনভাবে গৃহীত এসব বিধানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সামান্য প্রবণতাও কারও মধ্যে দেখা যায়নি। কোরআন এবং সুন্নায় নারীর যে মর্যাদা দেয়া হয়েছে তাকেই নারী পুরুষ সকলেই সর্বোত্তম বলে মেনে নিয়েছেন।
কাসিম আমিনই প্রথম মুসলমান যিনি পর্দার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছেন। কুর্দী বংশের এই লোকটি পেশাগত দিক থেকে বিচারক এবং শেখ মোহাম্মদ আবদুহ-এর শিষ্য ছিলেন। জীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি কায়রোতে কাটান। ফরাসী শিক্ষার সময় খ্রীষ্টান মিশনারীর তার্কিক ব্যক্তিরা তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, পর্দা, বহুবিবাহ এবং তালাক প্রথা মুসলমানদের দুর্বলতা ও অধঃপতনের কারণ। যতই তিনি আধুনিক পশ্চিমী সংস্কৃতি অধ্যয়ন করেন ততই তাঁকে হীনমন্যতায় পেয়ে বসে। তিনি লিখলেন; “পরিপুর্ণ সভ্যতা বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার আগেই ইসলামী সভ্যতা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। সুতরাং একে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যায় না”। তিনি যুক্তি দিলেন “অতীতের সকল সভ্যতার মত ইসলামী সভ্যতারও ক্রটি রয়েছে। পরিপূর্ণতার পথ হচ্ছে বিজ্ঞানে। ইউরোপ বিজ্ঞানে সবচাইতে অগ্রসর। সুতরাং ইউরোপ সামাজিক পরিপূর্ণতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সব দিক থেকে ইউরোপ আমাদের অগ্রভাগে।
ইউরোপ বস্তুগত দিক থেকে আমাদের চাইত শ্রেষ্ঠ, কিন্তু নৈতিকতার দিক থেকে আমরা শ্রেষ্ঠ- এই ধারণা ঠিক নয়। ইউরোপীয়রা নৈতিকতার দিক থেকেও আমাদের চাইতে অগ্রসর এবং তাদের সকল শ্রেণীই সামাজিক গুণে গুণান্বিত। ইউরোপে নারীর স্বাধীনতা আবেগ অনুভূতির ওপর নয় বরং যৌক্তিক ও বিজ্ঞান ভিত্তিক। ইউরোপের নৈতিকতা ছাড়া বিজ্ঞান গ্রহণ করার আশা বৃথা। দু’টি দিক অবিভাজ্য। অতএব আমাদরেকে জীবনের সার্বিক পরিবর্তনের জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে”।[Arabic thought in the Liberal age, Albert Hourani, oxford University Press, London, 1962 p-168-169]
এসব চিন্তা কাসিম আমিনকে পর্দার বিরুদ্ধে বই লিখতে অনুপ্রেরণা যোগায়। ১৯০১ সালে The New Women গ্রন্হে তিনি লিখেন “পুরুষ নিরঙ্কুম মনিব এবং নারী দাসী, সে পুরুষের ভোগ বিলাসের লক্ষ্য, এমন একটা কেলনা যা দিয়ে সে যখন যেভাবে খুশি খেলতে পারে। জ্ঞান পুরুষের জন্যে, অজ্ঞতা নারীর। উন্মুক্ত আকাশ আর আলো পুরুষের জন্যে, অন্ধকার এবং বদ্ধ কারাগার নারীর জন্যে। পুরুস আদেশ দেবে নারী অন্ধভাবে তা মেনে চলবে। পুরুষেরই সবকিছু নারী সবকিছুরই অনুল্লেখ্য অংশ”। [Childhood in Modern world, Smual Zwemer p-158.]
কাসিম আমিনই প্রথম মুসলমান যিনি পশ্চিমী ধারায় মুসলমান পরিবারে সংস্কারের ব্ক্তব্য রেখেছেন। তাঁর মতে মুসলিম বিশ্বের সামাজিক সমস্যার সমাধানের এটাই মহৌষধ। “প্রাচ্যের দেশগুলোর দিকে তাকাও দেকবে নারীরা পুরুসের দাসী আর পুরুষরা শাসকদের দাস, পুরুষ তার বাড়ীতে অত্যাচারী, শাসকদের কাছে অত্যাচারিত। ইউরোপের দিকে তাকাও! সরকার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, ব্যক্তিগত অধিকারের মর্যাদা দেয় এবং নারীর মর্যাদা চিন্তায় ও কাজে সর্বোচ্চ আসনে আসীন”।
কাসিম আমিনের মতে মুসলমানদের পতনের প্রকৃত কারণ হচ্ছে অজ্ঞতা বশতঃ সামাজিক গুণাবলী নিমূল করা। পরিবার থেকেই অজ্ঞতার শুরু। নারীর মর্যাদা বাড়াবার জন্যে কাসিম আমিন মহিলাদের জন্য আধুনিক পশ্চিমা শিক্ষার ওকালতি করেন। তাঁর মতে এই জ্ঞান তাদেরকে শুধু ঘরকন্না করতে সাহায্য করবে না উপরন্তু জীবন ধারণের জন্যে আয়েরও সুযোগ দেবে। নারী আত্মনির্ভর না হলে তাকে সব সময় পুরুসের করুণার ওপর নির্ভর করতে হবে। আধুনিক শিক্ষা এই অত্যাচারের পরসমাপিত ঘটাবে এবং তার নিঃসঙ্গার অবসান করবে। নারীকে ঘরের মধ্যে নিঃসঙ্গ রাখা ক্ষতিকর, কারণ এটা অবিশ্বাসের শামিল। পুরুষ নারীকে সম্মান করে না। তারা নারীকে দরজা বদ্ধ করে ঘরে রাখে কারণ তারা নারীকে সম্পুর্ণ মানুষ মনে করে না। পুরুষ নারীকে তার দেহ ভোগের কাজেই ব্যবহার করে। বহুবিবাহেও একই কারণ নিহিত। কোন মহিলাই স্বেচ্ছায় তার স্বামীকে অপর মহিলার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে রাজী হবে না, যদি কোন পুরুষ দ্বিতীয় বিবাহ করে তবে তা প্রথম স্ত্রীর অজ্ঞাতেই করে থাকে। তালাক ঘৃণ্য, যদি তা মানতে হয় তাহলে নারীর তালাক দেয়ার অধিকার স্বীকার করে নিতে হবে। নারীরা কেন সমান রাজনৈতিক অধিকার পাবে না? তবে তাদের জনজীবনে অংশ গ্রহণের জন্যে পর্যাপ্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
The New Women খ্রীষ্টান ও মানবিক আদর্শের কাছে একজন নতজানু চিত্ত আধুনিক মুসলমানের অভিব্যক্তি। এটা পড়ে কারো পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন যে এর লেখক একজন মুসলমান, খ্রীষ্টান মিশনারী নয়!
The New Women- এ মুসলমান সমাজের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি দেয়া হয়েছে এগুলো ভিত্তিহীন। কাসিম আমিন মুসলমান নারীর অবস্থা খোলা মনে বিচার করার পরিবর্তে খ্রীষ্টানদের যুক্তিকেই অন্ধভাবে মেনে নিয়েছেন। সত্যিকার অবস্থা এই যে, এই ক্রমাবনতিশীল যুগে প্রায় প্রতিটি মুসলমান পরিবারে প্রেম-প্রীতি ও সমমর্মিতা বিরাজমান। মুসলমান সমাজের পারিবারিক বন্ধন যে কোন সমাজের চাইতে শক্তিশালী। পারিবারিক ঐতিহ্যানুসারে নারীরা স্ত্রী এবং মা হিসেবে মর্যাদা, সম্মান এবং শ্রদ্ধা পেয়ে থাকেন। নারী স্বামীর অত্যাচারে নয় বরং নিজের স্বার্থেই পর্দা মেনে চলেন।
পশ্চিমা সভ্যতার অন্ধ পূজারী হিসেবে কাসিম আমিন ১৯০১ সালে ভাবতে পারেননি যে, পাশ্চাত্যের স্ত্রী পুরুষের সমানাধিকার আন্দোলন, এক বংশ পর কিভাবে অপরাধ, বিশৃংখলা এবং সার্বজনীন অবৈধ যৌন সম্পর্কের মহামারীর পথ প্রশস্ত করেছে। বাড়ী ও পরিবারের সম্পূর্ণ অনৈক্যের ফলে পশ্মিী সভ্যতা নারীত্বের জন্যে বড় নিষ্ঠূর প্রমাণিত হয়েছে। একদিকে তারা চায় প্রকৃতির ভার নারী একলা বহন করুক এবং অপরদিকে সে চায় বাইরেও সে পুরুষের সঙ্গে বহুমুখী দায়িত্ব পালন করুক। এইভাবে তাকে দুটি শান পাথরের মাঝে আড়াআড়িভাবে বসানো হয়েছে। এছাড়া পুরুষদের কাছে লোভনীয় ও আকর্ষণীয় করে তোলার নামে তাদের স্বল্প পোষাক এমনকি নগ্নতার দিকে ঠেলে দেয়া হয়। তারা পুরুষদের হাতের খেলনায় পরিণত হয়েছে।
ইসলামই নারীর সব চাইত বড় রক্ষা কবচ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ তা প্রতিটি নারীকে একজন পুরুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে এবং সকল পুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। প্রকৃতি প্রদত্ত দায়িত্ব পালনের জন্যে ইসলাম তাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। অপরদিকে পশ্চিমা সভ্যতা তাকে অগণিত পুরুষের দাসীতে পরিণত করেছে এবং নারীত্বের মর্যাদা বৃদ্ধিকারী সকল কাজের প্রতি তার বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করেছে। বাড়ী ও পরিবার সম্পর্কিত ইসলামের শিক্ষা সত্যিকার নারী প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।[মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীর ব্যক্তিগত পত্র থেকে, ১লা এপ্রিল, ১৯৬১।]
শতাব্দীর প্রারম্ভে কাসিম আমিন খ্রীষ্টান মিশনারী ও পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের সমর্থন নিয়ে পর্দার বিরুদ্ধে বই-এর মাধ্যমে যে অভিযান শুরু করেছেন তার প্রচুর সাফল্য এসেছে। তাঁর চেষ্টার ফলে প্রতটি মুসলিম দেশে মহিলারা আগাছার মত লাফাতে শুরু করলো এবং মুসলিম নারীর সত্যিকার ভূমিকা ধ্বংস করতে এবং পশ্চিম দেশের বোনের মত নিজের জীবনকে গঠন করতে কৃতসংকল্প হলো।