ইসলাম কি বিশ শতকীয় ধারণার সঙ্গে আপোষ করতে পারে?
‘আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে’। প্রতিটি মুসলিশ দেশের আধুনিক শিক্ষিত মুসলমানদের মুখে বারবার একথা শোনা যাচ্ছে। তারা সব সময় আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, আমরা অতিক্রান্ত যুগের ধ্যান ধারণা নিয়ে বাঁচতে পারি না। আমাদেরকে শেখানো হচ্ছে যে, ঘড়ির কাঁটা পেছনের দিকে ঘোরানো অবস্তাব, কারণ ইতিহাসের গতি কেউই পরিবর্তন করতে পারে না। অতএব ক্রম পরিবর্তনশীল ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের সঙ্গে ঈমানকে খাপ খাওয়ানো ছাড়া আমাদের আর গত্যন্তর নেই। শক্তিশালী হওয়ার জন্যে আমাদেরকে কোরআনের চিরাচরিত ব্যাখ্যা বর্জন করতেহবে এবং আধুনিক জীবনের আলোকে যুক্তিসঙ্গতভাবে তা অধ্যয়ন করতে হবে। মুসলিম দেশের সরকারসমূহ নিজেদের লক্ষ্য অনুযায়ী ইসলামের সংস্কারের সুপারিশ করেছেন। আমরা এখন সবচাইতে গুরুত্বপুর্ণ সুপারিশসমূহ এবং ইসলামী সম্প্রদায়ে তার ফলাফল খতিয়ে দেখব।
সুবিধাবাদের দ্বারা প্রভাবিত দুনিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্র ধর্মযাজকমণ্ডলীর অভিসম্পাতগ্রস্ত বস্তু। আধুনিক শিক্ষিত নেতারা আমাদেরকে খেলাফতের ধারণা সম্পূর্ণ বিলোপ করে ভবিষ্যতে এর পুনরুজ্জীবনের সকল দ্বার রুদ্ধ করে দেয়ার পরামর্শ দেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং সরকারকে ‘মধ্যযুগীয়’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। অতএব আধুনিক বিশ্বে স্থান পাওয়ার জন্যে মুসলমানদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের সঙ্গে আপোষ করতে হবে। এই যুক্তির সারবত্তা প্রমাণের জন্যে আমাদের সকল অনিষ্টের মূলে খেলাফতকে দায়ী করে মুসলিম পুস্তক [Islam and Principles of govt (Al- Islam wa usul Alhukm) Ali Abd Al Raziq, Cairo, 1925 from here we start (min Huna Nabda) Khalid Mohmad Khalid, Cairo, 1950.] লেখা হয়েছে। দাবী করা হয়েছে যে, খেলাফত ইসলামদের অংশ নয় কারণ মহানবীর মিশন ছিল কেবলমাত্র প্রচারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ। তিনি কখনো শাসনের ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। কেবলমাত্র অপরিহার্য তাকে বাধ্য করেছিল। বুদ্ধিবৃত্তিক অসাধুতা পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছি। ইসলামী সমাজ ছাড়া ইসলাম বাঁচতে পারে না এবং ইসলামী সমাজ সুসংগঠিত নেতৃত্ব ছাড়া সম্ভব নয়।
আমাদের আধুনিক শিক্ষিতরা শরিয়তকে যুগের অনুপযোগী এবং এর বিচার পদ্ধতিকে পশ্চিমা বিচার পদ্ধতির চাইতে নিম্নমানের মনে করেন। তাদের মতে কেবলমাত্র ধর্মনিরপক্ষ আইনই সমাজের কল্যাণ সাধন করতে পারে। [A Modern Interpretetion of islam, Asat Ali Fyazee, Asia Publishing House, Bombay, 1963.] অবৈধ যৌন সম্পর্ক, মদ্যপান, জুয়া এবং সুদে টাকা ধার দেয়ার জন্যে কোরআন ও সুন্নাহের আরোপিত শাস্তিকে নিষ্ঠুর এবং অমানুষিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আইনের শিথিলতা থেকেই কি তার গুণাগুণ বিচার্য? অপরাধীরা কি সমাজের চাইতেও বেশী সহানুভূতি পাওয়ার অধিকারী? আইনের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া নৈতিক মূল্যবোধ কি শীগগীরই ফাঁকা উক্তিতে পরিণত হয় না?
বর্ণ, ভাষা এবং ভৌগলিক পার্থক্যের উর্ধে ইসলামের বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রাধান্যেল সঙ্গে সামাঞ্জস্যহীন। এই কারণে একে বিশ শতকের ধ্যান ধারণার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্যে আমাদের আধুনিক শিক্ষিত নেতারা উম্মতের স্থলে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ [Turkish nationalism and Western civilization. Ziya gokalp, Columbia university Press, New York, 1859.] কে গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এর ফলে বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন এবং নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বে। অভিন্ন ইসলামী ঐতিহ্যের পরিবর্তে আমাদের নেতারা পৌরণিক ঐতিহ্যের ওপর জোর দেন, ভাবখানা এমন যে তা ছিল স্বর্ণযুগ, ইসলাম আমাদেরকে তা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। এই কারণে তুর্কী জাতীয়তাবাদীরা ওসমানীয় যুগকে বিদেশী সংস্কৃতি ও ভাষার আধিপত্য বলে ঘৃলা করেন এবং একই ধ্যান ধারণার বশবর্তী হয়ে রেজা শাহ পাহলভী আর্যসম্প্রদায়ের কথিত আবাসভূমি হিসেবে ‘পারস্যকে’ ইরানে রূপান্তরিত করেন।
আরবী মূল পাঠ ছাড়া কোরআনের আনুষ্ঠানিক অনুবাদের জন্যে অব্যাহত চীৎকারের পিছনেও জাতীয়তাবাদী চিন্তাদারা কাজ করেছে। তুরস্ক, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায় ল্যাটিন হরফ চালু এবং অনারব মুসলিম দেশে আরবীকে অবজ্ঞা করে ইংরেজী ভাষার প্রাধান্য, চলিত ভাষার পরিবর্তে সর্বোকৃষ্ট ভাষা প্রচলনের জন্যে আরব জাতীয়তাবদীদের দাবীকে জোরদার করেছে। এই প্রচেষ্টা ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে কোরআনের ভাষাকে ক্রমেই অস্পষ্ট করে তুলছে। আরবী মূল পাঠ ছাড়া কোরআনের অনুবাদ শুধুমাত্র উম্মাৎকেই ধ্বংস করবে না উপরন্তু (খোদা না করুন) মূল পাঠকেও বিকৃত করবে।
প্রতিটি মুসলিম দেশেই যারা কর্তৃত্ব ও প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে থাকেন তারা দুনিয়ার সঙ্গে সকল প্রতিযোগিতার জন্যে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রয়োগের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তারা ভাল মন্দ বিচার না করে আধুনিক সভ্যতার সকল অবদানকে গ্রহণের জন্যে জোর দেন। অন্য কথায় তারা বোঝাতে চান যে, আমাদের সমাজকে শক্তিশালী করতে হলে কোন প্রকার বাছবিচার ছাড়াই জনগণের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নের জন্যে বিদেশী কারিগরি ‘সাহায্য’ কর্মসূচী, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিল্পায়ণ করে দারিদ্র, রোগ ও নিরক্ষরতা দূর করতে হবে। যারা মনে করেন যে, আমরা কেবলমাত্র আধুনিক সভ্যতার ভাল দিক গ্রহণ করব এবং খারাপ দিক বর্জন করব তাদের মনে রাখা উচিৎ যে প্রত্যেক সভ্যতারই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। কোন সংস্কৃতির একটি বিশেষ দিককে পৃথক করা যায় না বরং তার একটি অপরটির ওপর নির্ভরশীল।
এই কারণে কোন সভ্যতার বাস্তব সাফল্য তার মৌলিক চরিত্রের প্রভাবমুক্ত হতে পারে না। আধুনিকতাবাদের শিষ্যরা এতই অর্থনৈতিক বাতিকগ্রস্ত যে, অর্থনীতিই তাদের বিচারের একমাত্র মাপকাঠি। পরকালকে অস্বীকার করার ফলে মার্কিন এবং ইউরোপীয়রা তাদের সকল প্রচেষ্টা স্বাস্থ্য ও দৈহিক আরাম আয়েসের জন্যে ব্যয় করে। পার্থিক সমৃদ্ধির জন্যে পর্যায়ক্রমে তারা এক্ষে্রে সকল মানুষকে পশ্চাতে ফেলে যায়। ইসলাম সহ অন্যান্য সভ্যতা কখনও এই সাফল্য অর্জন করতে পারে না। এর কারণ নীতিগতভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অস্বীকার নয় বরং জীবনের অন্যান্য দিককে তারা আরও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সেদিকে দৃষ্টি দেয় বলে।
মুসলিম নারী মুক্তিকে সামাজিক অগ্রগতির জন্যে অপরিহার্য [The new woman, Qassim Amin bey, cairo 1901.] মনে করা হয়। নারীত্ববাদীরা নারী মুক্তি বলতে অত্যাধুনিক ফ্যাশন অবলম্বন, ঘরের বাইরে চাকুরী নেয়া, পরিবার ও বাড়ীর সঙ্গে অনিবার্য সম্পর্কচ্ছেদের মাধ্যমে জনজীবনে পূর্ণ অংশ গ্রহণকে বুঝিয়ে থাকেন। মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি সরকার পাশ্চাত্যের পোশাক পরিচ্ছদ গ্রহণকে উৎসাহিত করেন। তুরস্ক আইনের মাধ্যমে পশ্চিমা পোশাক গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে এই ক্ষেত্রে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। পশ্চিমা পোশাককে প্রগতি ও অগ্রগতির প্রতীক এবং চিরাচরিক পোশাককে পশ্চাৎপদতার চিহ্ন আখ্যায়িত করা হয়। এই পোষাক ক্রমেই গ্রামের গরীব জনগণের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মূসলমানিত্বের দৃষ্টিগোচর চিহ্নকে বর্জন এবং ইসলাম বিরোধী সভ্যতার পোশাক, কারুকার্য এবং জীবন পদ্ধতি গ্রহণ স্বধর্ম ত্যাগের নামান্তর। [Islam at the Cross Roads, Mohammad assad, Lahore 1904. Nationalism and India, Maulana Maudoodi, Pathankot 1939] আমাদের মহানবী বেঈমানদের অনুকরণকারীদের নিন্দা করার সময় এ বিষয়ের ওপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করতেন।
এইভাবে আমরা দেখেছি যে, কেন বিশ শতকীয় প্রেরণার সঙ্গে ইসলামকে খাপ খাওয়ানো সম্ভব নয়। আমরা মুসলমানরা আধুনিক জীবনের সঙ্গে ইসলামকে খাপ খাওয়ানোর যতই চেষ্টা করব ততই দুর্বল হয়ে পড়ব। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নয় বরং সময়ের প্রতিকূলে লড়াই করেই আমরা শক্তিশালী ও জোরদার হবো।
আধুনিকতার গলদ
মুসলমান জনসমাজে আধুনিকতাবাদী বলতে এমন লোককে বোঝায়, সে হযরত মোহাম্মদ (সা) থেকে আগত এবং সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত ইসলামের প্রতি বিরাগভাজন এবং ইসলাম ও পশ্চিমা সভ্যতার কোন দ্বন্দ্ব নেই বলে প্রমাণে সচেষ্ট হন। নামে মুসলমান হলেও আধুনিকতাবাদী ইউরোপীয় ধ্যান ধারণার আলোকে ইসলামকে বিচার করেন। ইউরোপীয় ধ্যান-ধারণা জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তার মনের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে। ইসলামের যা কিছুই ইউরোপীয় আদশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন তাই বাতিল করার পক্ষে তিনি ওকালীত করেন।
“আমরা জানি আন্তর্জাতিক জগৎ, বিশেষ করে পশ্চিমা খৃষ্টীয় জগত আমাদের দেশে কি ঘটতে যাচ্ছে তা দেখার জন্য উৎকষ্টা নিয়ে প্রতীক্ষা করছে। আমরা এখন রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি। তাদের বিরাট ভয়; বেঈমানদের বিরুদ্ধে জেহাদ পুনঃপ্রচলন ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সম্ভাবনাসহ ইসলামী দেশসমূহে আল্লাহতন্ত্র চালূ হবে। যদি আমরা একদিকে পশ্চিমাদেরকে আশ্বাস দেই যে আমরা তাদের বিপদের কারণ হবো না অপর দিকে আমরা দেশে কি করব সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখতে হবে। [Philososphy and Ideology, Hazi Agus Salim, Former Foreign Minister of Indonesia, The light organ of the Ahmedia movement, Lahore, September 8, 1967.] আমাদেরকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্যে দেশে পশ্চিমা সভ্যতাকে প্রচলন করতে হবে।
শেখ মোহাম্মদ আবদুহুর শিষ্য এবং কায়রোর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেকটর (১৯২৭-২৯/১৯৩৫-৪৫) মোস্তফা আল-মারাগী কতিপয় আমেরিকান মুসলমানদের জন্যে দেয়া এক বার্তায় আধুনিকতাবাদীদের আদশ্য মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন,
“এইসব লোক ইসলাম সম্পর্কে পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করেছেন। আমি আশা করি তারা কখনো ইসলামী দেশ সফর করবেন না এবং আমরা যে কার্পণ্য, অজ্ঞতা, একগুয়ে এবং অনগ্রসরতা প্রদর্শন করি তা দেখতে পাবেন না”। [Quoted from “The Re-Evaluation of Islam in Turkey” Fareed S. Jafri, The pakistan times, Lahore, 1967.]
কানাডীয় একজন মুসলমান একই পুস্তকের সমালোচনা করতে গিয়ে আমার কাছে যে চিঠি লিখেছেন তাতেও একই মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন, “আল্লাহ আমাকে একজন ককেশীয়, একজন কানাডীয়, বিশ শতকের একজন মানুষ হিসাবে তৈরী করেছেন এবং তিনি আমাকে মুসলমানও করেছেন। যদি আমি কালো, অপরিচ্ছন্ন, অশিক্ষিত বেদুঈন হতাম, যারা তাদের পূর্ব পুরুষের ন্যায় বসবাস করে তাহলে মরে যেতাম। যদি ইসলাম পরিপূর্ণভাবে অমুসলিম দেশে টিকে থাকার অযোগ্য হতো, যদি একজন মুসলমান পশ্চিমা হতে না পারতো, আধুনিক অথবা পশ্চিমা আধুনিকতা গ্রহণ করতে না পারতো খৃষ্টীয় পরিবেশে উন্নতি করতে না পারতো তাহলে এই ধর্ম মরুভূমির বাসিন্দাদের জন্যেই উপযুক্ত হতো- যেখান থেকে তার আবির্ভাব ঘটেছে”।
আধুনিকতাবাদীরা শুধু জোরের সঙ্গে নিজেদের মুসলমানিত্ব প্রচার করেই ক্ষ্যান্ত হয় না উপরন্তু নিজেদেরকেই সর্বোত্তম এবং সত্যিকার মুসলমান বলে দাবী করে। তাদের বিরোধিতাকারীদের প্রতিক্রিয়াশীল একগুয়ে অথবা অসংস্কৃত বলে আখ্যায়িত করে। তাদের মধ্যকার আদর্শবাদী এবং উচ্চমনারা বিভ্রান্তি প্রচার করে বেড়ান যে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও আধুনিকতার আলোকে ইসলামের ব্যাখ্যা করে কেবলমাত্র তারাই একে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। জীবন সম্পর্কে দুটি বিরোধী দর্শনের দুঃখজনক সংঘর্ষের সমাধান করতে গিয়ে তারা অসামঞ্জস্যকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ধরে আত্মপ্রবঞ্চনায় অস্বাভাবিক মাত্রায় মেতে উঠেন। পাঠকদের আধুনিকতাবাদীদের সম্পর্কে কিছু ধারণা দেয়ার জন্য ইসলামের ইতিহাসের বহুল অপব্যাখ্যার কিছু নজির তুলে ধরা হলো।
১। আধুনিকতাবাদীদের মতে আমাদের মহানবী ও খেলাফতের সময় ইসলাম ছিল খুবই উদার, প্রগতিশীল এবং যুক্তিনির্ভর ধর্ম। কিন্তু আমাদের ইমাম, কাজী, ঐতিহ্যবাদী ও ধর্মতত্ববিদদের হাতে ইসলাম সেকেল অযৌক্তিক, সংকীর্ণ, অচল ও প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়েছে, যা আমাদের বর্তমান দুর্বলতা এবং অবমাননার জন্যে দায়ী। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আধুনিকতাবাদীরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, মুসলিম বিশ্বের সকল অনিষ্টের মূলে রয়েছে উলেমা এবং ধর্মীয় পন্ডিতেরা। তাদের একজন লিখেছেন, “সৌদী আরব থেকে মৌরিতানিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত প্রতিটি মুসলিম দেশের জনগণ আজ শুধু মাত্র বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে। মোল্লারা এই অবনতির জন্যে পশ্চিমা প্রভাবকে দায়ী করবেন। তারা ভুলে যান যে, যে সব যায়গায় এখনও পশ্চিমা প্রভাব পড়েনি সেখানেও ইসলামের করুণ অবস্থা দৃষ্টি গোচর হয়। তারা কি এই সত্য অস্বীকার করতে পারবেন যে, পশ্চিমা প্রভাব যেখানে যায়নি সেগুলোই হচ্ছে সব চাইতে খারাপ এবং পশ্চাৎপদ এলাকা।
অপরদিকে সেখানে শতাব্দী ধরে মোল্লারা ধর্মীয় কর্তৃত্বের অপব্যবহার করে আসছে। এটা তাদের জন্যেই হয়েছে যারা সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে ইসলামকে অবাধে মিশে যেতে না দিয়ে নিশ্চল করে রেখেছে। মুসলিম বিশ্বের সকল দুযোর্গ থেকে মুক্তির জন্যে আমাদেরকে যুক্তি মানেন না এমন লোকদের দেয়া কোরআনিক ব্যাখ্যা ভুলে যেতে হবে। যখন আমরা নিজেরা কোরআন বুঝতে চেষ্টা করব, তখন আমরা ইসলামকে রক্ষা করতে পারব, আমাদের নারীদেরকে ১৪শ’ বছরের অবমাননা থেকে রক্ষঅ করতে পারব এবং আমরা তাদেরকে স্বাধীনতা ও সাম্যের রাজপথে দাঁড় করাতে পারব। প্রেমের দ্বারা ধর্মের অনুশীলন চলবে, জোর করে নয়। জীবন একঘেয়েমী মুক্ত হবে, প্রার্থনার সঙ্গে খেলাধূলাও চলবে এবং আমরা স্বচ্ছ হীরার ন্যায় ইসলামের মর্মাথ উপলব্ধি করব। [The need for Re-Evalution of Islam in pakistan, Fareed S. Jafri. Pakistan times, Lahore, August 11, 1967.]
অপর কথায় আমাদের প্রিয় নবীর জীবদ্দশা থেকে এখন পর্যন্ত মুসলমানরা ইসলামের সম্পুর্ণ ভুল ব্যাখ্যঅ করছেন। কেবলমাত্র তখনকার পশ্চিমা সভ্যতায় প্রভাবিক আধুনিকরা সত্যিকার অর্থে ইসলামের সঠিক জ্ঞান লাভ করেছেন। বোখারী, মুসলিম, আবু হানিফা, শাফেয়ী, মালিক, আহামদ ইবনে হাম্বল, আল-গাজ্জালী এবং ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মত যুক্তিহীন পন্ডিতেরা সবাই ভুল করেছেন এবং যতদিন মুসলমানেরা এদেরকে শ্রদ্ধা করার পরিবর্তে মেস্তফা কামাল আতাতুর্কের মত লোককে শ্রদ্ধা করতে না শিকে ততদিন আমাদের মুক্তি নেই।
২। আধুনিক জীবনের সঙ্গে সংঘাতময় ইসলামের এমন সব চিরন্তন নীতি ও আইন কানুন পৃথক করে নিতে হবে। এগুলো নবীর যুগের প্রাথমিক অবস্থার জন্যে ছিলো যা আমাদের মত অগ্রসর সমাজের জন্যে অবান্তর এবং অযোগ্য, সুতরাং এগুলো বাদ দিতে হবে। এমন কি নামাজ, রমজানের মাসে রোজা, যাকাত এবং হজ্বের মত প্রশ্নাতীত অপরিহার্য এবাদও এমন শিথিল ও নমনীয়ভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে যাতে এগুলো পালনের বাধ্যবাধকতা না থাকে।
৩। মধ্যযুগের ইউরোপের সাংস্কৃতিক জীবনে মুসলমানদের এতই উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে যে তাদের ছাড়া আজকের আধুনিক সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হতো না। অপর কথায় ইসলাম ছিল পশ্চিমা সভ্যতার জনক। পশ্চিমা সভ্যতা তারই নীতি ও মূল্যবোধের আরও উন্নত সংস্করণ। যদিও মুসলমান নামধারী নয় পম্চিমা সভ্যতার অনুসারীরা মুসলমানদের চাইতেও সত্যিকার ইসলামী প্রেরণায় উজ্জীবিত। এই কারণে মুসলমানেরা আধুনিক সংস্কৃতি গ্রহণ করে প্রকৃত উত্তরাধিকার ফিরে পেতে পারে।
আমাদের মহানবী এবং তার সাহাবীদের উদারতা প্রগতিশীল মনোভাবের উচ্ছাসিত প্রশংসা করে এরা এমন ভাব দেখায় যে, তারা ইসলামের কোন একক দিক নয় বরং তাদের কাংখিত উপায়ে পূর্ণাঙ্গ ইসলামই তারা পেতে চায়। সীমাহীন খোদা ভীতির মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিতকারী আমাদের ইমামদের সম্পর্কে তাদের আত্মপ্রাসাদপুর্ণ অনুমান আমাদের লোভের কারণ। তারা ইসলামেরে যে ব্যাখ্যঅ করেছেন নাস্তিক ও বস্তুবাদী লোকদের ব্যাখ্যাকে তার চাইতে উন্নত জ্ঞান করে আধুনিকতাবাদীরা ইসলাম ভক্তির কি হাস্যকর পরাকাষ্ঠই না দেখান।
ইসলামের চিরন্তন পবিত্র নীতির প্রতি তাদের কপট ভক্তি শ্রদ্ধা অবিশ্বাস ও সরাসরি অস্বীকারকে গোপন করারই হীন প্রচেষ্টা মাত্র। সুযোগ পেলে তারা কোন কিছুই বাদ দিতেন না। আধুনিকতাবাদীদের মতানুযায়ী স্বতন্ত্র ও স্বাধীন জীবন বিধান হিসেবে ইসলামের যদি স্বাভাবিক অস্তিত্ব না থাকে এবং জোর করে ভিন্ন মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান ছাড়া যদি নিজস্ব কোন গুণাগুণ না থাকে তাহলে ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণ বা আদো মুসলমান থাকার কোন প্রয়োজন আছে কি?
ইসলাম ও সমসাময়িক বিরুদ্ধ মতাদর্শ
‘বিরুদ্ধ মত’ শব্দটা আজ এতই অপ্রিয় যে, যে কেউ কোন ব্যক্তি বা ধারণার বিরুদ্ধে তাকে আনতে চাইলে আমাদের ‘আলোকপ্রাপ্ত উদার নীতিকরা’ তাকে গোঁড়া এবং ধর্মোম্মাদ বলে আখ্যায়িত করেন। প্রাচীন ধর্মমতের আমন্ত্রণকে যতই গালাগাল দেয়া হেকা না কেন যেখানে তার আমন্ত্রণ অপরিহার্য এবং যুক্তিসংগত সেখানে তার আগমন ঠেকিয়ে রাখা যায় না। খৃস্টান মিশন এবং পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা আমাদের জন্যে জোড়াতালি দেয়া নতুন ধরনের ইসলাম চালুর প্রচেষ্টায় আমাদের দেশয়ি আধুনিকতাবাদীদের পূর্ণ সমর্থন করেন।
ডঃ কেনেথ ক্র্যাগ তার ‘কল অফ দি মিনারেট’ এ বলেছেন, “ইসলামের আবির্ভাবকালে অনৈসলামী ভাবধারা প্রতিরোধে রক্ষণশীলরা তত্বগত দিক থেকে সঠিক ছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। ওহি থেকে সৃষ্ট মুসলিম আইনের ভিত্তি প্রয়োগের উপযোগী, পরিণামদর্শী এবং সাংসারিক বিষয়ে অভিজ্ঞ ছিল, সহস্রাধিক বছর পরে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সবকিচু সংশোধন, প্রতিযোজন এবং পরিবর্ধন অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আধুনিক মন যখন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ইসলামের প্রকৃতির খৃষ্টীয় পরিবর্তন বা জীবনে তার প্রযুক্ততা অস্বীকার করার ব্যাপারে সর্কতা প্রকাশ করে তখন তারা সঠিক পথে চলে।
অতএব আমাদেরকে (খৃষ্টান মিশনারী) সহানুভূতির সঙ্গে ইসলামকে সত্যিকার গণতন্ত্র, সঠিক সমাজতন্ত্র, নির্দোষ পুঁজিবাদ এবং স্থাযী শান্তির সমপর্যায়ে দেখতে প্রস্তুত থাকতে হবে। লর্ড ক্রমারের বিখ্যাত এবং বেকুবী ধারণা ‘সংস্কার হলে ইসলাম থাকে না’ এই মন্তব্যের ওপর নির্ভর করা ঠিক হবে না। আমরা চাইনা এবং তা ঠিকও নয় যে এক কালে ইসলাম যেভাবে ছিল এখনও সেইভাবে অবিকৃত থাকবে”।
এর অর্থ হচ্ছে আমাদের দেশীয় আধুনিকতাবাদীরা ধর্মনিরপেক্ষতা ও বস্তুবাদের সঙ্গে ইসলামকে জোর করে সামঞ্জস্য বিধানের জন্যে যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তাতে খৃষ্টান মিশন এবং বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতা করছেন। বস্তুতঃ তারা ওদেরই দায়িত্ব সম্পাদনের ঠিকাদারী নিয়েছেন।
ইসলাম প্রিয় প্রতিটি পণ্ডিতের দায়িত্ব হচ্ ইসলামের নিরঙ্কুশ আবহমানতা, সার্বজনীনতা, চূড়ান্ত আত্মনির্ভর ও মানব রচিত আদর্শ থেকে তাকে স্বাধীন রাখার জন্যে সর্বসম্মত প্রচেষ্টা চালানো। কোরআন এবং সুন্নাহর বর্ণিত বৈশিষ্ট্রের যথার্থ হেয় করার যে কোন প্রচেষ্টা প্রচলিত ধর্মমতের বিরোধী হিসেবে সরাসরি প্রত্যাখ্যঅন করা উচিৎ। উম্মাতের মতবিরোধ পরিহার করার জন্যে বিরুদ্ধ মতবাদকে ব্যক্তিগত বা দলের পর্যায়ে বিবেচনা করা উচিৎ নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি নিজেকে উম্মাতের অংশ জ্ঞান করেন এবং আল্লাহর একত্ব ও রাসূলের (সা) শেষ নবুয়তকে প্রকাশ্যে অস্বীকার না করন তাকে আমরা উম্মতের বহির্ভূত করতে পারি না। কোন ব্যক্তির চূড়ান্ত বিচারের ভার আল্লাহর হাতে। অবশ্য একটি আধুনিক ইসলাম বিরুদ্ধ আন্দোলনকে শীগগীর নিন্দে করা হলে সত্যিকার ইসলাম সম্পর্কে আমাদের বংশধরদের মধ্যে কোন সন্দেহ দানা বেঁধে উঠতে পারবে না। এই ধরনের সিদ্ধান্তে বিলম্ব ইসলামের কোন নির্ধারিত শিক্ষা নেই এবং তা মুসলমান নামধারী শাসকের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল- এই ধারণাকেই জোরদার করবে।
আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের সবচাইতে অশুভ প্রচেষ্টা হচ্ছে আধুনিক চিন্তার আলোকে ইসলামের পুনঃব্যাখ্যা। তাদের মনোমোহিনী সঙ্গীত হচ্ছে ‘সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে ইসলামকেও পরিবর্তন করতে হবে’। ‘প্রগ্রতি’তে এরা এতই আচ্ছন্ন যে, যে কোন মামুলি পরিবর্তনকেই তারা বিরাটগুণ মনে করেন। তারা কখনো ভাবেন না যে এই পরিবর্তন আমাদের কল্যাণ কি অকল্যাণ আনছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে ইসলামের পরিবর্তন করতে হবে তাতে যে ক্ষতিই হোক না কেন। তাদের দৃষ্টিতে একমাত্র গুণ হচ্ছে বাতাসের অনুকূলে ভেসে যাওয়অ। কোন দিকে যাচ্ছে সেটা বড় কথা নয়।
পশ্চিমারা যদি গান, নাচ, ছবি এবং মূর্তি ভালবাসে তাই সত্যিকার (?) ইসলামী এবং মুসলমানদেরকেও তা করতে হবে। পুঁজির সুদ যদি আধুনিক অর্থনীতির ভিত্তি হয় অনগ্রসরতা ও অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠে প্রগতিশীল ও আধুনিক হওয়ার জন্যে মুসলিম দেশেও তা চালূ করতে হবে। সর্বাধুনিক ফ্যাশন যদি আধুনিক জীবনের প্রবণতা হয় তাহলে তাকে ইসলামী পোষাক ঘোষণা করে আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে। খৃষ্টান মিশনারীরা যদি পর্দাকে তথাকথিত নারী অবনতি ও হীনমন্যতার প্রতীক আখ্যায়িত করে নিন্দে করে, ইউরোপ ও আমেরিকার মত নারী মুক্তির সহায়তা করার জন্যে আমাদেরকে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে।
আধুনিকতাবাদীরা যদি বহুবিবাহ এবং তালাকের সাহায্যে বিবাহ বিচ্ছেদকে অসহনীয় অন্যায় বলে, তাহলে আলোকপ্রাপ্ত এবং প্রগতিশীল হওয়ার জন্যে মুসলিম বিশ্বকেও সেই ভাবে মুসলিম পারিবারিক আইনের পরিবর্তন করতে হবে। ডঃ কেনেথ ক্রাগ লিখেছেনঃ “সাদারণভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যে, সমান আচরণের শর্তে চার স্ত্রী গ্রহণের কোরআনিক অনুমতি প্রকৃতপক্ষে একাধিক স্ত্রী গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা। বাইবেলের সমালোচনায় যে ব্যাখ্যাই দেয়া হোক না কেন, ফলাফল খুবই কাঙ্খিত।
ডঃ কেনেথ ক্র্যাগ এবং আগ্রহীদের জন্যে এটি কাঙ্খিত। এই ধরনের ভ্রান্তিপূর্ণ যুক্তিতে কতখানি বুদ্ধিবৃত্তিক অসাধুতা এবং কপটতা আছে তাতে কিছু এসে যায় না। লক্ষ্যই কার্য পদ্ধতির যথার্থ নির্ণায়ক।
স্যার সৈয়দ আহমদ খানঃ মুসলিম বিশ্বের আধুনিকতার অগ্রদূত
স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮১৭ সালের ১৭ই অক্টোবর দিল্লীতে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ধর্মীয় পরিবেশে গড়ে উঠেন। তিনি প্রাচীন ও চিরচরিত ব্যবস্থায় শিক্ষা লাভ করেন। তবে আরবী এবং ফার্সীর ব্যাপারে এতই অসহিষ্ণু ছিলেন যে, যখনই পেরেছেন তা পরিহার করেছেন। যৌবনকালে তিনি অবাধ জীবন যাপন রেছেন এবং নাচ গানের উৎসবে খুবই ঘনঘন যাতায়াত করতেন। ১৮৩৮ সালে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীতে চাকুরী নেন। যথা নিয়মে বিভিন্ন শহরে তিনি সাবজজ নিযুক্ত হন।
উনত্রিশ বছর বয়সে তিনি যৌবনের বেখেয়ালী অবস্থায় অর্জিত সামান্য ইসলামী জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং তার সময়ের খ্যাতনামা পণ্ডিতদের কাছে অধ্যয়ন শুরু করেন। অবসর সময়ে নবীর জীবনীসহ কয়েকটি ধর্মীয় পুস্তিকা রচনা করেন। এগুলোতে ধর্মীয় গোঁড়ামী থাকলেও বিষয়বস্তু এবং সাহিত্যিক মানে ছিল খুবই সাধারণ।
১৮৪৭ সালে ‘দিল্লীর বিখ্যাত জনগণ ও স্মৃতিস্তম্ভে’র ইতিহাস Athar al sanadid প্রকাশ করে স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রথম খ্যাতি অর্জন করেন। এ ঐতিহাসিক কাজে পাণ্ডিত্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মীয় লেখায় তার পাণ্ডিত্যের দৈন্য খুবই সুস্পষ্ট হয়েছিল। এটি ১৮৫৪ সালে পুনঃমুদ্রিত হয় এবং বহুবছর পরে ফরাসী ভাষায় অনূদিত হয়। ১৮৬৩ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান লণ্ডনের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির অবৈতনিক সদস্যপদ লাভ করেন। এই বইয়ের সমালোচনা করতে গিয়ে উর্দু কবি গালিব মন্তব্য করেছেন যে, সৈয়দ আহমদ খানের উচিৎ ভারতে ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগের স্বপ্ন দেখে সময় নষ্ট করার পরিবর্তে ইংরেজী সংস্কৃতি অধ্যয়নে আত্ননিয়োগ করা। আমরা এখন দেখতে পাব কত আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি এই উপদেশ গ্রহণ করেছিলেন।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ এবং পরবর্তীকালে ভারতে বৃটিশ রাজত্ব থেকে স্যার সৈয়দ আহমদ খান সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, ভারতের মুসলমানদের মুক্তির পথ হচ্ছে বৃটিশের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা এবং তাদের সংস্কৃতি গ্রহণ করা। তিনি নিজেকে স্বঘোষিত মধ্যস্থতাকারী করার সিদ্ধান্ত নিলেন। বললেন, ধর্মীয় কারণে মুসলমান এবং খৃস্টানদের শক্রতা ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। কারণ বিশ্বের সকল ধর্মের চাইতে খৃস্টান ধর্ম এবং তার প্রবর্তকের প্রতি মুসলমানদের সর্বাধিক শ্রদ্ধা রয়েছে। তিনি ইংরেজেদের আশ্বাস দিলেন যে, ইসলাম আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, “আল্লাহর ইচ্ছায় যদি আমরা কোন জাতির অধীনস্থ হই এবং তারা যদি ভারতে বৃটিশের ন্যায় আমাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়, ন্যায়ের সঙ্গে শাসন করে, দেশে শান্তি বজায় রাকে এবং আমাদের ব্যক্তিসত্ত্বা ও সম্পত্তির প্রতি শ্রদ্ধা দেখায়, আমরা তাদের আনুগত্য করতে বাধ্য”।
ইসলামকে রাজণৈতিক গোলামীতে রাখার ব্যাপারে আপোষ করতে গিয়ে তিনি ঈসা (আ)-এর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেন, মিশরের ফেরাউন অমুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার আনুগত্য করেছেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষার উৎসাহে তিনি বৃটিশ সরকারের অধীনস্ত মুসলিম কর্মচারীদের জন্যে সরকারী বিশেষ নির্দেশ প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। “আমি এতে সমদর্শী ও নিরপেক্ষ বৃটিশ সরকারের পুরস্কার ও অনুগ্রহের কথা উল্লেখ করব, যাতে ভারতের সকল মুসলমান এটা পড়ে আমাদের দয়ালু সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করতে পারে”। [Reforms and religious ideas of Sir Sayyid Ahmed Khan J. M. S. Beljon, Nd. Ashraf. Lahore. P-2.]
মুসলমানদের ইংরেজী সংস্কৃতি প্রীতি বাড়ানোর জন্যে স্যার সৈয়দ আহমদ খান সামাজিক ব্যবধান দূর করার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন। এই সময় তিনি খৃস্টানদের সঙ্গে একই টেবিলে মুসলমানদের খাওয়া আইনসঙ্গত ঘোষণা করে তার বিখ্যাত ফতোয়া জারী করেন। এই ধারনার প্রতি মুসলমানদের আকৃষ্ট করার জন্যে তিনি কোরআনের ঐ সব আয়াত উদ্ধৃত করেন যেখানে বলা হয়েছে আহলে কিতাবদের খাদ্য মুসলমানদের জন্যে জায়েয। কিন্তু ধর্মীয় আচার অনুসারে হারাম গোস্তের প্রশ্ন দেখা দিলে তিনি দারুণ অসুবিধায় পড়েন। তিনি সন্দিগ্ধ হাদীসের ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, জবাই না করা জন্তুর গোস্তও মুসলমানেরা খেতে পারে।
১৮৬৯ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ ইংল্যান্ড সফররের সিদ্ধান্ত নেন। তার উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ শক্তির উৎসের সন্ধান লাভ করে তার দেশবাসীকে একই পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করা। তিনি ভারতের মুসলমানদের চাইতে ইংরেজদের শুধু শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে নয় বরং সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রাধান্য লক্ষ্য করে অভিভূত হয়ে পড়েন। ১৮৬৯ সালের ১৫ই আক্টোবর লণ্ডন থেকে বাড়ীতে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেন, ইংরেজদের চাটুকারীতা না করেও আমি বলতে পারি ভারতের বাসিন্দা উচ্চ কিংবা নীচ, ব্যবসায়ী কিংবা ছোট দোকানদার, শিক্ষিত বা অশিক্ষিত ইংরেজদের সঙ্গে শিক্ষা আচার ব্যবহার এবং সততার দিক থেকে তুলনায় সক্ষম সুন্দর মানুষের কাছে ক্লেদাক্ত জন্তুর মত। ভারতের অধিবাসীদের পুরুষত্বহীন নিবোর্ধ ভাবার ইংরেজদের যুক্তি আছে। আমি যা দেখেছি এবং প্রতিদিন যা দেখি কোন কোন ভারতীয়ের পক্ষে তা কল্পনা করাও অসম্ভব। ‘মোহাম্মদী’ সম্প্রদায়ের চতুর্দিকে আত্মপ্রসন্না স্বজাত্যের মারাত্মক আবরণ রয়েছে। তারা তাদের পূর্বপুরুষদের পুরনো কাহিনী স্মরণ করে এবং ভাবে যে, তাদের মত কেউই নেই। মিশর এবং তুরস্কের ‘মোহাম্মদী’রা দিন দিন সভ্য হচ্ছে। এখানকার মত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষত করা না গেলে ভারতীয়দের পক্ষে সভ্য এবং সম্মানিত হওয়া অসম্ভব।
স্যার সৈয়দ আহমদ প্রমাণ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলেন যে, আধুনিকতার পরিপন্হি প্রাচীন আচার-আচরণ পরিহার করা হলে মানবতা, সভ্যতা ও অগ্রগতির বাহনরূপী সত্যিকার ধর্মে ইসলামকে রূপান্তরিত করা সম্ভব।
মুসলমানদের মধ্যকার আধুনিকতাবাদীদের উন্নতির জন্যে স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮৭৮ সালে আলিগড়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, আরবী ফার্সী, উর্দু অথবা যে কোন ভারতীয় ভাষার সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে অসন্দিগ্ধ হয়ে তিনি ইংরেজীকেই শিক্ষার একক মাধ্যম করার ওপর জোর দেন। ১৯২০ সালে আলিগড় স্কুল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নীত হয়।
স্যার সৈয়দ আহমদ খান আধুনিক আত্মপক্ষ সমর্থনকারীদের অগ্রদূত। আত্মপক্ষ সমর্থনকারী কিছু বক্তব্য নিম্নরূপঃ
১। বহু বিবাহ ইসলামের প্রকৃতি বিরুদ্ধ, বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া এর অনুমতি দেয়া উচিৎ নয়।
২। ইসলাম দাসপ্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে এমন শরিয়তের অনুমোদন প্রাপ্ত যুদ্ধবন্দীদেরকে দাসত্ব করানো যাবে না।
৩। আধুনিক ব্যাংকিং, বাণিজ্যিক লেন দেন, কর্জ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রাভৃতিতে যে সুদের ব্যবস্থা আছে তা ঠিক রিবার (সুদের) ব্যাখ্যার আওতায় পড়ে না, অতএব তা কোরআনী আইনের বিরুদ্ধে নয়।
৪। কোরআন এবং সুন্নাহ চুরির জন্যে হাতকাটা, ভেজাল দেয়ার জন্যে পাথর নিক্ষেপ করে মেরে ফেলা এবং অবিবাহিত যুবক-যুবতীর যৌন সংসর্গের জন্যে যে একশ বেত্রাগাতের শাস্তি বিধান করেছে তা বর্ববতার পরিচায়ক এবং প্রাথমিক যুগে যখন জেল ছিল না কেবলমাত্র তখনকার জন্যে তা প্রযোজ্য ছিল।
৫। আত্মরক্ষার অন্তিম প্রয়োজন ছাড়া জেহাদ নিষিদ্ধ।
স্যার সৈয়দ আমহ খান ইসলামের একমাত্র সত্য জিনিস বিবেচনা করেছেন উনিশ সতকের বৈজ্ঞানিক প্রকৃতিবাদের সঙ্গে ইসলামের সামঞ্জস্য বিধান। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, ধর্ম যদি মানব প্রকৃতি বা সাধারণ প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপুর্ণ হয় তবেই তা সত্য হতে পারে। ইসলাম বিজ্ঞান এবং যুক্তিভিত্তিক ধর্ম প্রমাণ করার জন্যে তিনি ভাগ্য, ফেরেশতা, জ্বিন, কুমারীর গর্ভে হযরত ঈসার (আ) জন্মকে অস্বীকার করেছেন, নবীর (সা) মিরাজে গমনকে একটা সাধারণ স্বপ্ন হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং শেষ বিচারের দিনে স্বশরীরে উপস্থিতি, বেহেশত দোজখ প্রভৃতিকেও অস্বীকার করে বলেছেন এগুলো শাব্দি অর্তে গ্রহণ না করে প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করা উচিৎ। তিনি ওহি নাজিলের মত ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বিষয়কেও মানসিক অসুস্থতাজনিত মতিভ্রমের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
স্যার সৈয়দ আহমদ খান অষ্টাদশ শতকের ফ্রান্সের ওহি বিহীন ঈশ্বরের ধারণা নিয়ে খোদাকে বিশ্বাস করেছেন। তার মতে খোদা নির্জন এবং সম্পূর্ণ বস্তুনিরপেক্ষ। প্রকৃতির বিদান অপরিবর্তনীয়। এমনকি খোদাও তা পরিবর্তন করতে পারেন না। সুতরাং তার কাছে প্রার্থনার কোন মানে নেই। এ ধরনের নিষ্প্রাণ ও নৈর্ব্যক্তিক দেবতার প্রতি আমাদের কোন আগ্রহই থাকতে পারে না।
স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মতে কোরআন এবং সুন্নাহর কর্তৃত্ব সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় বিষয়ে সীমাবদ্ধ। কোরআন এবং হাদীসের যেসব আয়াতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কথা-বার্তা বলা হয়েছে সেগুলো নবীল যুগের প্রাথমিক অবস্থার জন্যে প্রযোজ্য ছিল। আমাদের মত আলোকপ্রাপ্ত আধুনিক সভ্যতার জন্যে তা সম্পূর্ণ অনুপযোগী। অতএব মুসলমানরা যদি ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ জীবন পদ্ধতি হিসেবে অনুসরণ না করে তাহলে পশ্চিমা সংস্কৃতি গ্রহণে কোন বাধা নেই।
এটা সুস্পষ্ট যে, স্যার সৈয়দ আহমদ খানের ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনে কোন আগ্রহ ছিল না। তার সম্পর্কে এতটুকু বলা যায় যে, তিনি ভারতের মুসলমানদের সামাজিক এবং আর্থিখ কল্যাণ চেয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল পার্থিব অগ্রগতির মাধ্যমেই তারা উন্নতি করতে পারবে। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি এ বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন যে, ইতিহাসে কোন জাতিই এমনকি বস্তুগত দিক থেকেও বিদেশী শাসনাধীনে উন্নতি লঅভ করতে পারেনি। মীর্জা গোলাম আহমদ (১৮৩৯-১৯০৮) বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার মনিবের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন, বৃটিশ শাসনের জন্যে এক ফোটারক্তদানকে খুবই অপরিহার্য ঘোষণা করে। অপরদিকে জেহাদকে একটি অপরাধ হিসেবে নিন্দা করে তিনি বস্তুত স্যার সৈয়দ আহমদের ধারণাই সমর্থন করেছেন।
ভারতে নির্বাসনকালে জামালুদ্দিন আফগানী (১৮৩৮-৯৭) স্যার সৈয়দ আহমদের সঙ্গে পরিচিত হন। তিনি তার Al- Urwah Al- Wuthqz গ্রন্হে লিখেছেন, “ইংরেজ কর্তৃপক্ষ মুসলমানদেরকে চরিত্রহীন করার জন্যে স্যার সৈয়দ আহমদ খানকে উপযুক্ত পাত্র হিসেবে দেখতে পেয়েছিলেন, এ জন্যে তারা তাকে প্রশংসা ও সম্মান করতে শুরু করলেন এবং আলীগড় কলেজ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করলেন এবং এটাকে মুসলমানদের কলেজ আখ্যায়িত করলেন, যাতে ঈমানদারদের সন্তানদের আকৃষ্ট করে তাদের মধ্যে নাস্তিকতা প্রচার করা যায়। বস্তুবাদী স্যার সৈয়দ আমহদ খান ইউরোপের বস্তুবাদীদের চাইতেও জঘন্য, কারণ পশ্চিমা দেশে যারা ধর্ম ত্যাগ করে তারা দেশপ্রেম ত্যাগ করে না এবং পিতৃভূমিকে সমর্থন করার উৎসাহ হারায় না। অপরদিকে স্যার সৈয়দ আহমদ খান এবং তার বন্ধুরা বিদেশী স্বেচ্ছাচারী শাসনকর্তাকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন”। [The refroms and religious Ideas of Sir Sayyid Ahmed Khan, op. cit, pp 117-119.]
স্যার সৈয়দ আহমদ খানের পরবর্তী পশ্চিমানুসারীদের ওপর তার প্রভাব অস্বাভাবিক নয়। তার আত্মপক্ষ সমর্থনকারী বক্তব্য আজও বিশ্বস্ততার সঙ্গে অনুসৃত হয়। আমীর আলী, চিরাগ আলী, খুদা বকশ, গোলাম আহমদ পারভেজ, খলিফা আবদুল হাকিম এবং কাদিয়ানী আন্দোলনের মাওলানা মোহাম্মদ আলী লাহোরী তার বক্তব্যই পুনরাবৃত্তি করেছেন। এখন পর্যন্ত তাদের নতুন কোন বক্তব্যই নেই।
অবিশ্বাসের প্রবণতা আমীর আলীর স্পিরিট অফ ইসলামের পর্যালোচনা
সৈয়দ আমীর আলীর Spirit of Islam একই বিষয়ে ইংরেজী ভাষীদের কাছে খুবই পরিচিত। ব্সতু তা ইংরেজী ভাষার উৎকৃষ্ট শ্রেণীর গ্রন্হের মর্যাদা লাভ করেছে। একইভাবে ইউরোপ এবং আমেরিকার ধর্মান্তরিত মুসলমানরা এই বই থেকে ইসলামের একটা বিকৃত ধারণা লাভ করেন। একজন ইংরেজ মুসলমান এই বই সম্পর্কে বৈচিত্রপূর্ণ মন্তব্য করেছেনঃ “ইসলাম সম্পর্কিত অধ্যয়নে যে বইটি আমাকে সব চাইতে প্রভাবিত করেছে সেটি হচ্ছে সৈয়দ আমীর আলীর Spirit of Islam, যদিও বইটি মুসলিম বিশ্বে সমালোচনার উর্ধে নয়। এতে বহ আচার প্রথার সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। এতে অবশ্য মুসলমানদের সামনে ঈমানের অনুপ্রেরণামূলক বিশালতা তুলে ধরা হয়েছে যা জীবনে বাস্তবায়ন করা প্রতিটি মুসলমান ছাত্রের পড়ার চেষ্টা করা উচিৎ”।
মুসলিম বিশ্বে এর আশাতীত সমালোচনা হয়েছে। বস্তুতঃ শুধুমাত্র সমালোচনাই যথেষ্ট নয়। উলেমারা যদি ঘুমিয়ে না থেকে দায়িত্ব সচেতন হতেন তা হলে এই বই এর বিষয়বস্তু ধর্মের বিরোধী বলে প্রত্যাখ্যান করা উচিৎ ছিল।
১৮৪৯ সালে শিয়া ধর্মানুসারী পরিবারে জন্মগ্রহণ করে আমীর আলী আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেন এবং স্যার সৈয়দ আহমদের একনিষ্ঠ শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি ইংরেজী সংস্কৃতির প্রতি সীমাহীন উৎসাহী ছিরেন। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি স্বীকার করেছেন যে, ১২ বছর বয়সের … মুগ্ধ হয়ে ছিলেন এবং বিশ বছর বয়সে তিনি শেক্সপিয়র, মিলটন, কীটস, বায়রন, রংফেলো সহ অন্যান্য কবির অধিকাংশ বই এবং Thackery ও স্কট প্রমুখের উপন্যাস শেষ করেছেন। শলীকে অন্তর দিয়ে জানতেন। পরে তিনি ওকালতি শুরু করেন এবং যৌবনের অধিকাংশ সময় ও ১৯২৮ সালের মৃত্যু পর্যন্ত তার ইংরেজ স্ত্রীর সঙ্গে লন্ডনে কাটান।
তার বিখ্যাত Spirit of Islam এর প্রথম সংস্করণ ১৮৯১ সালে লন্ডনে প্রকাশিত হয়। ১৯২২ সালের বর্তমান রূপ গ্রহণ করার আগে আমীর আলী বইটি বহুবার সংশোধন এবং পরিবর্ধন করেছেন। তখন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইংল্যাণ্ডে বইটি বার বার ছাপা হচ্ছে। এই বই এর অংশ বিশেষ আরবী এবং তুর্কী ভাষায় অনুদিত হয় এবং সে সব এলাকার আধুনিক শিক্ষিতদের প্রশংসা লাভ করে। Spirit of Islam গ্রন্হের লক্ষ্য ছিল ইসলামকে উদার এবং যৌক্তিক ধর্ম হিসেবে প্রমাণ করা। এই কারণে বহু বিবাহ, পর্দা এবং জেহাদকে ইসলামের সত্যিকার মেজাজের বিরাধী বলে নিন্দে করা হয়েছে। এইভাবে তিনি আশা করেছিলেন যে, ইউরোপীয় নবু মুসলমানরা পশ্চিমা আদর্শের সঙ্গে ইসলামকে সমপর্যায়ে দেখবেন।
Spirit of Islam এর প্রথম অর্ধাংশ জুড়ে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবন তুলে ধরা হয়েছে। এখানে তিনি পশ্চিমী জগতকে দেখাতে চেয়েছেন তাঁর চরিত্র ছিল মিষ্ট, কোমলতা, ভদ্রতা, ক্ষমা, দয়া এবং ভালবাসার সমষ্টি। এই ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনকারী সকল সাহিত্যিক হীনমন্যতাবোধ থেকে মহানবীর জেহাদকে এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেনঃ
“শক্রদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্যে মুহাম্মদ (স) আল্লাহর নির্দেশ পাওয়ার আগেই কোরাইশ সৈন্য মাঠে এসে গেছে। জীবনে কোনদিন অস্ত্র হাতে ধরেননি। মানুষের দুঃখ কষ্ঠে যিনি বেদনাভারাক্রান্ত হতেন, যিনি ছিলেন আরব চরিত্রের বিপরীত, আপন সন্তান বা শিষ্যের মৃত্যুতে কেঁদে বুক ভাসাতেন, যার হৃদয় এতই কোমল এবং করুণ হওয়ার কারণে শক্ররাও তাকে নারীসুলভ কোমল হৃদয়ের অধিকারী বলতেন, তাঁকেই পরিস্থিতির প্রয়োজনে ইচ্ছার বিরুদ্ধে আক্রমণ শক্তির দ্বার প্রতিহত করতে হলো”। (পৃঃ ২১৪-২১৮)
বই এর লেখক পশ্চিমা সমালোচনার মুখে নিজেকে এতই দুর্বল মনে করতেন যে, জেহাদের ধারণাকে তিনি কুলক্ষণে মনে করতেন এবং এই কারণে দেখাতে চেয়েছেন যে, আমাদের মহানবী প্রকৃতপক্ষে শক্রর সঙ্গে লড়াই করতে চাননি। কেবল মাত্র পরিস্থিতি তাকে তা করতে বাধ্য করেছ্ রাসূলুল্লাহর নির্ভরযোগ্য জীবনী গ্রন্হ- যেমন, ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশামের ‘সিরাতে রাসূলুল্লাহ’ আল ওয়াকিদীর ‘কিতাব আল মাঘাজী’তে এ ধরনের আচরনের সাক্ষ্য দেয় না। কোরআনের অষ্টম এবং নবম সূরার কেন্দ্রীয় আলোচ্য হচ্ছে জেহাদ। এ থেকেই আমীর আলীর আত্মপক্ষ সমর্থনকারী বক্তব্যের অসারতা প্রমাণিত হয়। আধুনিক মন মানসিকতা নিয়ে তিনি বর্তমানকে অতীতে দেখতে চেয়েছেন। “এই খ্যাতনামা শিক্ষকের মন বুদ্ধিবৃত্তি ও প্রগতির দিক থেকে ছিল আধুনিক, তার কাছে মানবতার সেবই ছিল সর্বোচ্চ এবাদত” (পৃ-১২১)।
লেখক পরোক্ষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, কোরআন অভ্রান্ত নয় এবং সম্পূর্ণ মানবিক ধ্যানের ফলাফল।
“এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ধর্মীয় সচেতনতায় মহান শিক্ষকের মন পূর্ণত্ব লাভ করার আগে মধ্যবর্তী পর্যায়ের সূরাগুলোতে জোরেয়াষ্টার, সাবিয়ান এবং ইহুদী পুরানের ভাসা ভাসা বিবরণ থেকে স্বর্গ ও নরকের বাস্তব ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। মরুভূমির সাধারণ মানুষের জন্যে ভাষার এই চাতুর্যের প্রয়োজনও ছিল। যাতে তারা এসব দেখে ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিনয় ও ভালবাসার দ্বারা প্রার্থনা করে এবং খোদার সত্যিকার অস্তিত্ব অনুধাবন করতে পারে। জোরাষ্টরদের কাছ থেকেই স্বর্গ এবং হুরের ধারণা এসেছে আপরদিকে ইহুদী পুরানে কঠোর শাস্তির জন্যে নরকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সম্ভবতঃ ধর্মীয় চেতনার প্রথম দিকে মুহাম্মদ নিজে তার চারিদিকের চিরাচরিত জিনিসে বিশ্বাস করতেন, তবে আত্মার ব্যাপক জাগৃতির ফলে বিশ্বের স্রষ্টার সঙ্গে গভীর যোগাযোগ সৃষ্টি হয় এবং যে সব চিন্তা বস্তুগত দিক থেকে অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল তা প্রথমে আধ্যাত্মিকতায় রূপ নেয়। মহান শিক্ষকের মন শুধুমাত্র সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে পরিবর্তিত হয়নি বরং আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভের ব্যাপারে তার সাহাবীদের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গেও পরিবর্তিত হয়েছে, উন্নত মনের দ্বারাই গুণাগুণ অনুধাবন করা যায়। সাধারণ বুদ্ধির লোক, অশিক্ষিত লোকদের ব্যাপক বা সংক্ষিপ্ত যে ধরনেরই হোক না কেন বিধি-নিষেদের প্রয়োজন রয়েছে”। (পৃঃ ১৯৭-১৯৮)।
আমীর আলী পরকালের সত্যিকার অস্তিত্বের বিশ্বাস করতে পারেননি। তবে সাধারণ মানুষের উন্নতির অপরিহার্য হাতিয়ার হিসাবে তা স্বীকার করে নিয়েছেন। এই জন্যে জীবন সম্পর্কে প্রাচীন জোরাষ্ট্রানদের ধারণার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে দেখিয়েছেন এগুলো কিভাবে মুহাম্মদের বিশ্বাসে প্রভাব ফেলেছে। শিয়াদের ধর্মমতানুসারে খলিফাদের ইতিহাস রচনা করা হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে অন্যায়ভাবে তিনি তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান (রা)-এর সমালোচনা করেছেন।
“হযরত আবু বকরের তীক্ষ্মতা, হযরত ওমরের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণোৎসাহ এবং ণৈতিক সুক্ষ্মতা হযরত ওসমানের ছিল না। Dozy সুস্পষ্টভাবে প্রতারিত ধর্ম যাজকের (?) চরিত্র অঙ্কন করেছেন। ওসমানের ব্যক্তিত্ব খলিফা হিসেবে তার নির্বাচনের যৌক্তিকতা প্রমাণ করে না। এটা সত্য যে, তিনি ধনী এবং দরদী ছিলেন, মুহাম্মদ (স) এবং ইসলামকে আর্থিক সাহায্য করেছেন এবং প্রায়ই প্রার্থনা করতেন, রোজা রাখতেন এবং তিনি অমায়িক ও দয়ার্দ হৃদয় ছিলেন। তিনি অবশ্য প্রেরণাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন এবং বার্ধক্যজনিত দুর্বল ছিলেন। দুঃখের বিষয় এই বৃদ্ধ মানুষ তার আত্মীয়দের প্রতি অসাধারণ দুর্বল ছিলেন। তারা মক্কার ঐসব অভিজাত যারা ২০ বছর ধরে মুহাম্মদ (স)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তাঁকে শাস্তি দিয়েছে, অপমান করেছে, খলিফা এসব লোকদের আনুকূল্য করেছেন। সমগ্র সাম্রাজ্য থেকে মদীনায় অভিযোগ আসতে শুরু করে। কিন্তু প্রায় অভিযোগই গালি আর কর্কশ ভাষায় বাতিল করা হয়েছে। খলিফা আবু বকরেরর ছেলে মোহাম্মদের নেতৃত্বে ১২ হাজার লোকের একটি প্রতিনিধিদল ওসমানের কাছে অভাব অভিযোগ জানাতে এবং তার প্রতিকার দাবী করতে এসেছে। ফেরার পথে খলিফার সীলমোহর সহ তার সেক্রেটারী একটি চিঠি দিয়েছেন। যাতে নীতিজ্ঞানশূন্য মুয়াবিয়াকে বলা হয়েছে তাদেরকে সদলবলে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। তার ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’ বিক্ষুব্ধ হয়ে তারা মদীনায় ফিরে যায় এবং বৃদ্দ খলিফার ঘরে প্রবেশ করে তাঁকে হত্যা করে। ওসমানের মৃত্যুর পর উমায়াদের দীর্ঘ প্রতিক্ষিত ইসলাম বিরোধী, ইসলামের গণতন্ত্র সাম্য এবং নেতিকতার কঠোর নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের সুযোগ সৃষ্টি হয়”।
আমাদের প্রিয় নবীর বিশ্বস্ততম সাহাবীর বিরুদ্ধে ইতিহাসের এই নিন্দাকারী ভাষা। ওসমান বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। উল্লেখিত চিঠিগুলি ছিল জাল যাতে ওসমানের কিছুই করণীয় ছিল না। লেখক যেভাবে চিত্রিত করেছেন, খোদা না করুক ওসমান যদি সত্যিই সেরূপ হতেন তাহলে আমাদের মহানবী কখনো তাকে তার বিশ্বস্ত সহচরদের অন্তর্ভুক্ত এবং সরাসরি বেহেশতে গমনকারী দশজনের একজন বলে ঘোষণা করতেন না। আমাদের মহানবী ঘোষণা করেছেন ওসমান বেহেশতে তার নিত্য সহচর থাকবেন। অনেক নির্ভরযোগ্য হাদীসেই ওসমানের গুণাবলীর স্বীকৃতি রয়েছে। ওসমানের সঙ্গে বিশ বছরেরও অধিক সময় কাছাকাছি থেকে আমাদের প্রিয় নবী ওসমানের চরিত্র সম্পর্কে আধুনিকতাবাদী এবং এবং শিয়া প্রভাবিতদের চাইতে অনেক বেশী প্রাজ্ঞ ছিলেন।
একই ভাবে এই লেখক মুসলিম বিশ্বের পরবর্তি অধঃপতনের জন্যে ইমাম এবং মুজাদ্দিদদের দোষারোপ করেছেন। ইমাম আহমদ বিন হাম্বলকে তিনি কিভাবে চিহ্নিত করেছেন তার নমুনা- চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ ‘সুন্নী গীর্জা সম্প্রদায়ের’ সৃষ্টি হয় ইবনে হাম্বলের হাতে। তিনি মামুন এবং তার উত্তরাধিকারী মুতাসীম বিল্লাহর সময় উন্নতি লাভ করেন। এই দুইজন খলিফা ছিলেন ‘মতাজিলা পন্হী’ ইবনে হাম্বলের চরম গোঁড়ামী এবং জেদ, যার দ্বারা তিনি ধর্মান্ধতা দিয়ে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে জনগণকে উত্তেজিত করতে চেয়েছিলেন, তা শাসকদের সঙ্গে তার মনোমালিন্যের সৃষ্টি করে। ইবনে হাম্বল এবং তার হিতৈষীরা মুতাজিলা প্রচারে মানুষের অসৎ সাফল্যের জন্যে এবং ঘন ঘন মুসলিম হত্যা অভিযানের জন্যে দায়। এই হত্যাভিযান মুসলিম ইতিহাসে কলঙ্ক লেপন করেছে”। (পৃঃ ৩৫২)
“অতি শুদ্ধাচারী ব্যক্তি ইবনে হাম্বল তার মতবিরোধীদের চির অবলুপ্তি কামনা করতেন। তিনি হানাফীবাদের উদারতায় মনক্ষুন্ন, মালেকীবাদের নিরঙ্কুশ সংকীর্ণতায় হাতশ এবং শাফেয়ীবাদের সাধারণ চরিত্রে সুখী হতে না পেরে চিরাচরিত প্রথার ভিত্তিতে সমগ্র সাম্রাজ্যের জন্যে একটি নতুন পদ্ধতি চালূ করেন। আবু হানিফা চিরাচরিত প্রথার অধিকাংশ প্রত্যাখ্যান করেছেন, (ইহা ঠিক নয়)। ইবনে হাম্বলের পদ্ধতি অসঙ্গত, অযৌক্তিক এবং হতবুদ্ধিকারী গল্পের সমষ্টি যার অধিকাংশই পরষ্পরের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং মনগড়া। তিনি বিদ্যা অর্জন ও বিজ্ঞানের নিন্দে করেছেন এবং যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
জনসাধারণের মধ্যে তার বাগ্মীতা অথবা প্রচন্ডতা ধর্ম প্রচারের মঞ্চ থেকে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদীদের বিরুদ্ধে আগুন ছড়াতে শুরু করলো। বাগদাদের রাস্তায় ঘন ঘন দাঙ্গা এবং রক্তপাত শুরু হল। গোলযোগের প্রধান উদগাতাকে জেলে পাঠানো হয় এবং সেখানেই তিনি প্রাণ ত্যাগ করেন (খৃঃ ৪৩৮-৪৩৯)। ইবনে হাম্বলের প্রধান অনুসারী ধর্মতত্বের ছাত্ররা দুবর্ল আব্বাসীয় খলিফাদের জন্যে বাগদাদে বিরাট সমস্যার কারণ হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের নিয়ে দায়িত্বহীন ছিদ্রান্বেষী সমালোচকদল গড়ে তুলল। তারা জোর করে মানুষের বাড়ীতে ঢুকে বাদ্যযন্ত্র ভেঙ্গে দিত এবং এ ধরনের বর্বরতা চালাতো (পৃঃ ৪৮৭)।
এইভাবে লেখক শরিয়তের বিধানকে সেকেলে এবং প্রগতির বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন। মুসলমানদের বর্তমান জড়ত্বের কারণ হচ্ছে মুসলমানদের সাধারণ বিশ্বাস। এই বিশ্বাস চিন্তার স্বাধীনতা ও বিচার বিচক্ষণ ক্ষমতা হরণ করে কিছু জিনিস মনের মধ্যে বদ্ধমূল করে দিয়েছে। নবী যুক্তিকেই মানব মনীসার সর্বোচ্চ এবং আদর্শ অবদান বলে আখ্যায়িত করেছেন। আমাদের মধ্যযুগের পণ্ডিত এবং তাদের অনুসারীরা এর প্রয়োগকে সবচাইতে পাপ এবং অপরাধ বলে গণ্য করেছেন। আজকের মুসলমানেরা সেই মেজাজ হারিয়ে ফেলেছেন। শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা এবং প্রশংসা প্রকাশ করতে গিয়ে তার প্রাথমিক যুগের অনুসারীরা তখনকার জন্যে প্রযোজ্য আদেশ এবং নিয়মকানুনকে সর্বকালের করে দিয়েছেন। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারকের প্রচলিত এবং একটি আধা সভ্য জাতির জন্যে প্রযোজ্য বিধানকে এখন পর্যন্ত চালূ করা নবীল প্রতিই অবিচারের সামিল। সমাজ ও নৈতিকতার ক্রম পরিবর্তনশীল ধারণা নিয়ে কারও পক্ষেই চিরকালের বিধান দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মানবতার প্রগতিশীল দাবীর সঙ্গে সামঞ্চস্যপূর্ণ কোন ধর্মই এত বিরাট প্রতিশ্রুতি দেয়নি (পৃঃ ১৮২-৮৩)। গীর্জার জনক যা দিয়েছেন তা অপরিবর্তনীয় এবং আলোচনার আওতা বহির্ভূত। (পৃঃ ৩৫৩)।
আমীর আলীর মতে মুতাজিলাদের পথই ইসলামের সত্যিকার পথ। তার অনুসারী আলকিন্দী, আল ফারাবী, ইবনে সিনা এবং রুশদ ইসলামের ভেতর গ্রীক দর্শনের অনুপ্রবেশ ঘটাতে চেষ্টিত হয়েছিলেন। আমীর আলী মুতাজিলাদেরকে অগ্রপথিক হিসেবে আখ্যায়িত করেন। জীবনের মূল সূত্রে না হলেও আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতার দিক থেকে। যে সব মুজাদ্দিস বাইরের ধ্যান ধারণাকে বাতিল করে সত্যিকার ইসলাম রক্ষা করেছিলেন তিনি তাদেরকে মুসলিম বিশ্বের ক্ষতির জন্যে দায়ী করেন। এটা সুস্পষ্ট যে, লেখক যার পক্ষে ওকালতি করেছেন তা ইসলাম ছিল না বরং তা চিল মুসলিম নামের ছদ্মাবরণে পশ্চিমা ধ্যান ধারণা।