মাওলানা আবুল কালাম আযাদ মুসলিম ভারতের জাতীয়তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা
মুসলমানদের মোলিক গলদ হচ্ছে ইসলামকে পরিসমাপ্ত পদ্ধতি হিসেবে ব্যাখ্যা করা। বাইরের সত্য থেকে শুধু নয় বাইরের জনগনের জন্যেও তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভারতের মুসলমানদের এবং ইসলাম সম্পর্কে মৌলিক আশার কথা হচ্ছে এ সম্প্রদায় তা ভাঙ্গতে পারে…. তারা অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে ভ্রাতৃসুলভ মানবীয় আচরণের জন্যে চেষ্টা করতে পারে। (পৃঃ ২৯০)। অতীতে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং সামাজিক সংস্থা ইসলামের এতই মুখ্য বিষয় ছিল সবকিছু হাঁ অথবা না দিয়ে বিবেচনা করা হতো। মুসলমানদের হয় রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল অথবা ছিল না। এর আগে কখনও তারা অন্যের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেনি। ইসলামের দ্বার বন্ধ- এই থে এই বিশ্বাস জন্মেছে যে, মুসলমানদের সামাজিক গ্রুপ বা দল একটি আইনানুগ পরিপূর্ণ সংগঠন। এই বিশ্বাসই পরিশেষে ইসলমাকে ভারতে অনুপযুক্ত প্রমাণ করেছে। (পৃঃ ২০৬-৭) [Islam in modern History, Wilfred cantwell smith Princetion university press. 195]
একজন খ্যাতনামা প্রাচ্যবিদ ভারতের মুসলমান ও হিন্দুদের সম্পর্কের বিষয়টি এভাবে দেখেছেন। মাওলানা আবুল কালাম আযাদ এই ভ্রান্তিপূর্ণ বিশ্লেষণকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করেছেন। তিনিই প্রথম আধুনিক জাতীয়তা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের কথা বলেন।
মাওলানা আবুল কালাম আযাদ সম্পূর্ণ ইসলামী পরিবেশে গড়ে উঠেন। তার বাবা মাওলানা মোহাম্মদ খয়েরুদ্দিন একজন জ্ঞানী পণ্ডিত ছিলেন এবং আরবী ফারসী ভাষায় বহু গ্রন্হ প্রণয়ন করেন। ভারতের সব এলাকায় তার হাজার হাজার শিষ্য ছিল। ১৮৫৭ সালে বৃটিশ বিরোধী বিক্ষোভ দমন করার পর হাজারো মানুষের মত মাওলানার বাবাও জীবনের তাগিদে দিল্লী ছেড়ে পালিয়ে যান। তার বিশ্বস্ত শিষ্যরা ব্যবস্থা করার পর তিনি আরবে চলে যান এবং মক্কায় আশ্রয় নেন। সেখানে তিনি নগরর খুবই ধার্মিক এবং বুজুর্গ ব্যক্তির কন্যার পানি গ্রহণ করেন। মহিলাটি খুবই বুদ্ধিমতি এবং আরবী ভাষার একজন পণ্ডিত ছিলেন। এই মহিলার গর্ভেই ১৮৮৮ সালে আবুল কালাম আযাদ জন্মগ্রহণ করেন। তার মা অন্য কোন ভাষা না জানার কারণে আরবীই তার মাতৃভাষা হয়। প্রাথমিক শিক্ষার জন্যে তাকে কোন বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়নি। বরং তার মা বাবা এবং তার বাবার বন্দু আরবী পণ্ডিতদের কাছে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৯৮ সালে একজন শিষ্যের জরুরী অনুরোধে তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। এখানে গৃহশিক্ষকের কাছে বালক আবুল কালাম আযাদ আরবী, ফার্সী, দর্শন, যুক্তিবিধ্যা, অঙ্ক, ভূগোল এবং ইতিহাস অ্যয়ন করেন। সাধারণভাবে এই বিদ্যা অর্জনে ১৪ বছর সময় লাগে। অসাধারণ মেধাবী আবুল কালাম ৪ বছরেরও কম সময়ে এই বিদ্যা অর্জন করেন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিপদ অনুভব করে তার বাবা পশ্চিমা সভ্যতা এবং তার সকল বাহনের কঠোর বিরোধিতা শুরু করেন। ইংরেজী শিক্ষা এবং স্যার সৈয়দ আহমদ খানের নেয়া ইসলামের আধুনিক ব্যাখ্যাকে ধর্মের প্রতি অভিসম্পাত মনে করেন।
আবুল কালাম আযাদ প্রকৃতপক্ষে অসাদারণ প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি ইমাম আল গাজ্জালীর জীবনী লেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৬ বছর বয়সে তিনি শ্রদ্ধেয় আলেম হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। অবসর সময়ে তিনি শিল্পগুণ সম্পন্ন অর্থহীন উর্দু কবিতা লেখেন। ১৪ বছর বয়সে Lisanus Sidq ‘সত্যের কণ্ঠ’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৪০ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়স তিনি বার্ষিক ভাষণ দানের জন্যে আঞ্জুমানে হেমায়েত-ই-ইসলাম কর্তৃক লাহোরে আমন্ত্রিত হন। তার বক্তব্যের বিষয় ছিল “ধর্মের যৌক্তিক ভিত্তি”। তাঁর শ্রোতাদের মধ্যে উর্দূ গল্পকার নাজির আহমদ, কবি হালি এবং আল্লামা ইকবালের মত ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তার বক্তৃতা এতই আকর্ষণীয় ছিল যে, এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সারা ভারতে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। কবি হালি তাঁকে যুবকের কাঁধে বৃদ্ধের মাথা বলে আখ্যায়িত করেন।
যৌবনের মধ্যভাগ ও শেষ দিকে তিনি তার ভবিষ্যৎকর্মপন্ঞা ঠিক করেন। তার মনে ইসলামই প্রাধান্য পেয়েছে এবং মুসলমান ভাইদের সাহায্যের দিকটিই তিনি বেশী করে ভাবতে থাকেন। এ্ই বাবে ১৯১২ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে সাপ্তাহিক আল হিলাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু করেন। এই উর্দু পত্রিকাটি মুসলিম বিশ্বব্যাপী বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অসৎ উদ্দেশ্যের কঠোর সমালোচনার মাধ্যমে মূলতঃ জালাম উদ্দীন আফগানীর Al Urwah al Wuthqa- এরই দৃঢ় স্বাক্ষর বহন করে। সাংবাদিকতার মাধ্যমে আবু কালাম আযাদ নিজেকে প্রথম শ্রেণরি সাহিত্যিক মেধা হিসেবে প্রমাণ করেন। এই পত্রিকায় খুবই যুক্তিসঙ্গত বক্তব্যের মাধ্যমে স্যর সৈয়দ আহমদ খানের আলীগড় আন্দোলনের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান শুরু করেন। তিনি আধুনিক শিক্ষা এবং যে কোন ধরনের পশ্চিমী ধ্যান ধারণার বিরুদ্ধে যুক্তি দিতে থাকেন। তিনি কি ভারতে রাজনীতির চরমপন্হী অথবা মধ্যপন্হীদের অনুসরণ করছেন কিনা জানতে চাইলে কোন মুসলমান কোন ব্যাপারে অন্য কাউকে অনুসরণ করতে পারে এই ধারণাকে উপহাসের সঙ্গে উড়িয়ে দেন। তারা আল্লাহর বাছাইকৃত ব্যক্তি এবং তাদের জন্যে সুস্পষ্ট পথ রয়েছে। তিনি নিজে কোরআন অনুসরণ করেছেন এবং তার ধর্মাবলম্বীদেরকেও কোরআন অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
দেশব্যাপী ইসলামী পুনর্জাগরণে এটি অভূতপূর্ব উৎসাহের সৃষ্টি করে। এই কারণে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের ক্ষমাপ্রার্থী মনোভাব ও আধুনিক দর্শনের সঙ্গে ইসলামকে খাপ খাওয়ানোর প্রচেষ্ঠার কোর আবেনদ রইল না। বৃটিশ কর্তৃক আল হিলাল নিষিদ্ধ ঘোষণা এবং আবুল কালাম আযাদকে কারাগারে পাঠানোর আগে এর প্রচার সংখ্যা পঁচিশ হাজারে গিয়ে পৌছায়। ১৯২০ সালে মাওলানা আবুল কালাম আযাদের কারামুক্তি তার জীবনে পটপরিবর্তন আনে। এই সময় তিন তার ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা সম্পূর্ণ পরিবর্তন করেন। এজন্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার উদ্বেগ চিল না। ভারতে একটা সত্যিকার ইসলামী সমাজ গঠনে তিনি আর আগ্রহী ছিলেন না। এর পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তার লক্ষ্যে তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রবক্তা হয়ে যান”। ধর্মের মধ্যে পুনর্জাগরণ প্রয়োজন যারা বিশ্বাস করেন আমি তাদেরই একজন, তবে সামাজিক বিষয়ে এটা হচ্ছে প্রগতিকে অস্বীকার করা”।
“১৯২০-২১ সাল পর্যন্ত মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ছিলেন ইসলামী পুনর্জাগরণ ও খেলাফত আন্দোলনের উৎসাহী প্রবক্তা। কিন্তু পরে তিনি কাজে ও চিন্তায় সম্পূর্ণ পাল্টে যান। তাঁর এই পরিবর্তন এতই অস্বাভাবিক ছিল যে, অনেকে চোখ রগড়াতে থাকেন যে, তাদের দেখা ব্যক্তিটি কি সেই আযাদ না রূপান্তরিত কেউ, যার মধ্যে একটি নতুন মানুষ জন্ম নিয়েছে। আবুল কালাম আযাদ এখন পুরোপুরি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী এবং মুসলমান ও অমুসলমানদের নিয়ে একক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সোচ্চার প্রব্ক্তা। তিনি কতিপয় হিন্দু দার্শনিকের ধর্মিয় ঐক্যের তথাকথিত মতবাদ এবং পশ্চিমা জৈবিক বিবর্তনবাদ মেনে নেন। পবিত্র কোরআনের ওপর তার ভাষ্যে এসব মতবাদের সুস্পষ্ট ছাপ দেখা যায়। [১৯৬২ সালের ৩০শে মার্চে লেখা মাওলানা আবুল আলা মওদূদীর ব্যক্তিগত পত্র থেকে উদ্ধৃত।]
জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণ করলে ভারতের মুসলমানদের মুক্তি হবে এই কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ভারতে জাতীয় কংগ্রেস দলে যোগদান করেন এবং মহাত্মা গান্ধীর খুবই ঘনিষ্ঠ সহচরে পরিণত হন।
তিনি ঘোষণা করেন ভারতের মুক্তি এবং বর্তমান বিক্ষোভের জন্যে আমি মহাত্মা গান্ধীর যুক্তির সঙ্গে পূর্ণ একাত্মতা পোষণ করি এবং তার সততায় আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস অস্ত্রের শক্তিতে ভারত সফল হতে পারে না এবং তাকে সেপথে অগ্রসর হওয়ার পরামর্শও দেয়া যায় না। অহিংসা আন্দোলনের মাধ্যমেই কেবল ভারত বিজয়ী হতে পারে এবং ভারতের বিজয় নৈতিক শক্তির বিজয়ের স্মরণীয় উদাহরণ হয়ে থাকবে। [Mohadeb Desia, Moulana Abul Kalan Azad, George Allen & Urwin, London 1941, P. 82]
১৯২২ সালে মহাত্মা গান্ধী খেলাফত আন্দোলন বন্ধের আহবান জানানোর পর এবং হাজার হাজার মুসলমান নিধনকারী সাম্প্রদায়িক গোলযোগ দমনে তার ব্যর্থতার পর কংগ্রেসের মুসলিম সদস্যদের মদ্যে মাওলানা মোহাম্মদ আলী তার ভাই শওকত আলী এবং কায়েদে আজম এক এক করে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করতে থাকেন। মাওলানা আবুল কালাম আযাদ শুধু থেকেই গেলেন না রবং প্রায় দুই দশকের জন্যে এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে কংগ্রেসের একনিষ্ঠ রক্ষকে পরিণত হলেন।
জনাব জিন্নাহ অভিযোগ করেন যে, কংগ্রেসের নির্ধারিত নীতি হচ্চে মুসলিম বিরোধিতা, মুসলমানদের সংস্কতি ধ্বংস করা এবং অব্যাহতভাবে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে হস্তক্ষেপ এবং সব সময় মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থণৈতিক অধিকার খর্ব করা।
“আমি আগেও বলেছি এবং পূর্ণ দায়িত্বের সঙ্গে ঘোষণা করছি যে, কংগ্রেস মন্ত্রী সভার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কংগ্রেসের নীতি মুলমান বিরোধী এবং মুসলমানদের রাজণৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অধিকার খর্ব করছে এ কথা বলা বিরাট মিথ্যঅ কথা। যদি মিঃ জিন্নাহ এবং তার সহযোগিরা মনে করেন যে, মুসলমানদের কল্যাণের জন্যে তারা এসব বলছেন। আমি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে বলব যে তারা তার বিপরীত কাজ করছেন। এটাই আজকের সবচাইত বড় প্রয়োজন”।[Desai op, Cit, pp 152-22.]
১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ভারতে শিক্ষামন্ত্রী হন এবং ১৯৫৮ সালে তার মৃত্যু পর্যন্ত এ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ভারতের মুসলমানদের জন্যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সত্যিকার ইসলাম ভিত্তিক করার চেষ্টার পরিবর্তে তিনি উর্দু এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষার জন্যে ল্যাটিন হরফ চালুর পশ্চিমা ধারণার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তিনি পরিবার পরিকল্পনার জন্যে সরকারী প্রচারাভিযানকেও সমর্থন করেন। তিনি বলেন, “জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে জৈবিক ও সামাজিক সমস্যা” এবং ইসলামী আইনের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের কোন কারণ নেই, যদি বিশেষজ্ঞরা একে জাতির জন্যে অপরিহার্য মনে করেন তবে তারা এর পক্ষে রায় দিতে পারেন”। [Abu Shehab Rafiullah, Islam and family planning, the Pakistan times. Dec. 2. 1966.]
মাওলানা আবুল কালাম আযাদের একনিষ্ঠ অনুসারী করিম চাগলা এই ব্যাপারে অনেক দূরে এগিয়ে যান। ভারতে শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে তিনি মসলিম পারিবারিক আইন বিলোপ, বহুবিবাহ, পর্দা নিষিদ্ধ এবং মুসলমান মেয়ে ও অমুসলমান যুবকের বিয়ে বাধ্যতামূলক করে আইন প্রণয়নের জন্য ভারত সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ দিতে থাকেন। জাতীয় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীর সাফল্যের জন্যে গর্ভপাত বৈধকরণ এবং তিন সন্তানের পিতার জন্য বাধ্যতামূলক বন্ধ্যাত্বকরণের পক্ষে প্রকাশে ওকালতি করেন।
সমসাময়িক মুসলিম পাণ্ডিত্যের ওপর প্রাচ্যবাদের প্রভাবের একটি উদাহরণ
আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের সবচাইতে আশ্চর্যজনক দিক হচ্ছে কতিপয় মুসলমান পণ্ডিত ইসলামী গবেষণার শ্লোগানের আবরণে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস এবং আচরণ সম্পর্কিত প্রাচ্যবাদীদের বক্তব্যকে কোন প্রকার প্রশ্ন ছাড়াই গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়ে পড়েন। অন্যতম বিখ্যাত প্রাচ্যবাদী H.A.R GIBB তার Modern Trends in Islam গ্রন্হে আধুনিক খৃষ্টানরা যেভাবে বাইবেলকে গ্রহণ করছেন ঠিক সেইভাবে কোরআনও হাদিসের ব্যাপক ব্যাখ্যা গ্রহণে আধুনিকতাবাদীদের ব্যর্থতার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এতে কোরআনের অলৌকিক উৎসের চাইতে মানবিক দিকই পরিস্ফুটিত হত- এই ছিল তার ধারণা।
আধুনিক প্রাচ্যবাদীদের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে মুসলিম নামধারী পণ্ডিতদেরকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার নামে পবিত্র কোরআন এবং হাদীসের ব্যাখ্যায় উৎসাহিত করা। যাতে তারা পরবর্তী পর্যায়ে প্রমাণ করতে পারেন কোরান হাদীস নবীল কাছে নাজিল হয়নি, এগুলো তার রচনা অথবা বাইেবলের মত কোরআনও সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তিত হয়েছে। এটা অসম্বব প্রমাণিত হলে (যা হতে বাধ্য) প্রাচ্যবাদীরা মুসলমান নামধারী পণ্ডিতদেরকে কোরআনের ঐতিহাসিক দিকটির মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করবে। যা তাদের মতে নবীল সময়ের আরবের প্রাথমিক অবস্থার জন্যে প্রযোজ্য ছিল এবং বর্তমান যুগের জন্যে তা অপ্রাসঙ্গিক এবং তার কোন চিরন্তন মূল্য নেই। এই ভাবে প্রাচ্যবিদদের প্রভাবে মুসলমান নামধারী পণ্ডিতেরা যদি কোরআনকে অন্যান্য সাধারণ বই এর মত একটি বই মনে করতে শুরু করে তাহলে খোদা না করুন কোরআন পর্যায়ক্রমে তার কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলবে এবং কোরআনের আনুগত্য বা তার প্রতি কেউ সম্মান দেখাবে না।
সৈয়দ আমীল আলীর স্পিরিট অফ ইসলাম (১৯২২) ডঃ তাহা হোসাইনের On Pre Islamic Poetry (১৯৬৬) সুস্পষ্টভাবে একথাই বলেছে। তিনি লিখেছেন: “নবী এবং নবীর ওপর নাজিলকৃত ওহির বক্তব্য স্বাভাবিক এবং কিছুটা উৎসাহ ব্যঞ্জক ছিল। বস্তুতঃ পরে এটাকে প্রায় গোঁড়ামিতে আকীর্ণ করা হয়েছে। এতে জিব্রাইলের বাহ্যত্যের নিশ্চয়তা এবং ওহির লক্ষ্য রক্ষা করতে হতো। আমাদের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে এই পদক্ষেপ অপরিপক্ক মনে হতে পারে তবে যে সময় গোঁড়ামির প্রাধান্য ছিল তখন এই পদক্ষেপ বিশেষ করে যুক্তিবাদের বিরুদ্ধে বিতর্ক ছাড়া কোন উপায় ছিল না। সাধারণভাবে গৃহীত অনেক হাদীসে নবীকে জন সমক্ষে জিব্রাইলের (আ) সঙ্গে কথা বলতে এবং জিব্রাইল সম্পর্কে সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। জিব্রাইলের বাহ্যত্ব এবং ওহি সাধারণ মুসলমানদের মনে এতই বদ্ধমূল হয়েছে যে, প্রকৃত ব্যাপারটি অস্বীকৃত হয়েছে। কোরআনে পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নবী শেষ সীমা পর্যন্ত দেখতে পান। এর ফলে তার অভিজ্ঞতালব্ধ বাণী খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
মহাবনীর মেরাজে যাওয়অর বিষয়টি গোঁড়াদের তৈরী। যীশুর স্বর্গারোহণের ধারণা থেকেই তারা এ বিষয়টি অবতারণা করেছে। যার প্রমাণ হিসেবে তারা হাদীসের উদ্ধৃতি দেন। হাদীস ঐতিহাসিক উপকথা ছাড়া আর কিছুই নয় এবং বিভিন্ন সূত্র থেকেই তার উপাদান এসেছে, (পৃঃ ১৪)। যদিও ওহির বিষয়কে কোরআনে আধ্যাত্মিক ব্যঅপার বলে বর্ণনা করা হয়েছে। হাদীস বা প্রাচীন পন্হায় গোঁড়ামি এমন সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা বা অলঙ্কৃত করা হয়েছে, হাদীস নির্ভর ধর্মতাত্মিক বিজ্ঞানের দ্বারা বলা হয়েছে কর্ণ এবং বাহ্যিকভাবে নবী ওহি পেয়েছেন এবং জিব্রাইল অন্তরের মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছেন বলে বলা হয়েছে”। (পৃঃ ৩১-৩২)
বিজ্ঞ লেখক পবিত্র কোরআনের আরও কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং বিধি নিষেধ আরোপের দুঃসাহস দেখিয়েছেন।
এইব ঘটনা প্রাক ইসলামী যুগের গল্প এবং রূপকাহিনীর সঙ্গে সামণ্ডস্য পূর্ণ হওয়ায় খুবই আনন্দদায়ক তবে সংকটাবিষ্ট। কোরআনের ভবিষ্যৎ বাণীর ভিত্তি সম্পর্কে প্রশ্ন না তুলে বলা যায় প্রকৃত বিষয় নির্ণয়ে এবং নবলি বাণী আমদানীতে এগুলো খুবই অর্থবহ। যে সবক্ষেত্রে এগুলো ব্যবহৃত এবং এর ফল অর্জিত হয়েছে তার আলোকেই এগুলো বিচার্য। অপরদিকে মুসলমানদের উচিৎ নয় এগুলোর ঐতিহাসিক আবেদনে ভীত হওয়া বা প্রত্যাখ্যান করা। কোরআন অবশ্যই বলে য, এসব গুল্প সত্যিই নাজিল হয়েছে। তবে অবশ্যই যা নাজিল হয়েছে, তা হচ্ছে তার বক্তব্য এবং উদ্দেশ্য। (পৃঃ ১৬)
অপর কথায় বিজ্ঞান লেখক পরোক্ষ বোঝাতে চেয়েছেন যে, পবিত্র কোরআনের নবীর সম্পর্কে যে কাহিনী বলা হয়েছে এগুলোকে ওহি হিসেবে গ্রহণ করার কোন প্রয়োজন নেই। সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও লেকক ইসলামের মৌলিক এবাদতের ওপরও হামলা করতে কুণ্ঠা করেননি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের কথা কোরআনে বলা হয়নি। নবীর পরবর্তীকালে কোন বিকল্প ছাড়াই পাঁচ ওয়াক্ত নামায অনমনীয়ভাবে নির্ধারণ করা হয়। মৌলিক তিনি ওয়াক্ত হাদীসের স্রোতে বিলীন হয়ে যায়। এসব হাদীস ও সুন্নার যথার্থতা সম্পর্কে ডঃ ফজলুর রহমানের তীব্র আক্রমণ Joseph Schacht এর the origin of Mohammadan jurisprudence- এর বক্তব্য থেকে এর বক্তব্য থেকে স্বতন্ত্র নয়- মৌলিক বিষয়ের বাইরে নবীর সুন্নাত সম্প্রদায়ের লোকদের নৈতিক জীবনের ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।…. সামাগ্রিক বিষয় থেকে বোঝা যায় যেখানে নবীকে ডাকা হয়েছে সিদ্ধান্ত নেয়া অথবা কর্তৃত্ব ঘোসণার জন্যে বা তিনি যেতে বাধ্য হয়েছেন সবগুলোই ছিল অন্তর্বর্তী বা বিশেষ পরিস্থিতি। সাধারণ পরিস্থিতিতে মুসলমানেরা তাদের দৈনন্দিন ব্যবসা ও সামাজিক লেনদেনের সমস্যা নিজেরাই মীমাংসা করেছে।(পৃঃ ৫১)
অতএব সুন্নত যদিও নবীল আচার আচরণ হিসেবে ধরা হয় তার বিষয়বস্তু কিছু না কিছু পরিবর্তন হতে বাধ্য এবং এর অধিকাংশই সম্প্রদায়ের প্রথমাবস্থার অনুশীলন থেকে এসেছে। তবে চলমান সম্প্রদায়ের প্রকৃত অনুশীল, সংযোজনের দ্বারা পরিবর্তন হতে বাধ্য। প্রাথমিক ইসলামী সমাজের মত একটি দ্রুত সম্প্রসারণশীল সমাজে প্রায়ই নতুন প্রশাসনসহ নতুন নৈতিক ও আইনগত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। নৈতিক বিষয়ের উত্তর দিতে হবে এবং আইনগত পরিস্থিতির সমাধান করতে হবে। যা কিছু নতুন চিন্তা বা উদ্ভাবনা করা হয়েছে তাকে কোরআন এবং হাদীসের আলোকে একটা ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এইসব ব্যাখ্যা প্রথম দিকে ব্যক্তিগত মতামত ছিল কিন্তু দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীতে এগুলো নিয়মিত সিদ্ধান্তের জন্যে অনুরনীয় হয়ে পড়েছে। (পৃঃ ৫৬)
আধুনিক ইসলাম সৃষ্টিশীল প্রেরণায় উন্মুখ এবং নতুন অগ্রগতির জন্যে কতিপয় গ্রুপের আবির্ভাব হযেছে যারা সকল হাদীস বাতিল করতে চায় এবং কোরআনের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে চায় না। তবে এইসব গ্রুপ বিষয়টির প্রকৃত বিপদ সম্পর্কে সজাগ নয়। কারণ সকল হাদীস অস্বীকার করলে এক মুহূর্তেই কোরআনের ঐতিহাসিক ভিত্তি শেষ হয়ে যায়। তবে বর্তমান অস্থিরতা খুবই স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয়। নতুন ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা ঠেকিয়ে রাখা যায় না এবং তা সম্ভবও নয়। এটা খুবই বাঞ্চনীয় যে মুসলমানেরা তাদের হাদীসের অগ্রগতির একটা খোলাখুলি এবং দায়িত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ চালাবে”। (পৃঃ ৬৬-৬৭)
এইভাবে লেখক কোন যৌক্তিকতা ছাড়াই ইসলামের কার্যকারিতা এবং মানব জীবনের ব্যাপক পথ নির্দেশিকা হিসাবে ইসলামের পারদর্শিতার বিরুদ্ধাচারণের চেষ্টা করেন। কারণ হাদীস এবং সুন্নাহ যদি মহানবীর সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য শিক্ষা না হয়ে থাকে তাহলে তার জায়গায় খেয়াল খুশির জগাখিচুড়ি ছাড়া আর কি পেশ করা যাবে? এই বিভ্রান্তিকর বুদ্ধিমত্তার পরিণতি হচ্ছে-“বহুবিবাহ এবং দাস প্রথার উদাহরণ থেকে এটাই সুস্পষ্ট হয় যে, কোরআনের আইন মানবিক মূল্যবোধের প্রগতির দিকে নতুন আইন গ্রহণের ইঙ্গিত দেয়। অপর কথায় কোরআনের কিছু আইন তখনকার সমাজের কিছু আইনকে ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছে। এ থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কোরআনের আইনকে কোরআন নিজেই অবিনশ্বর করেনি।
খুব শীগগীরই মুসলমান আইনবিদ এবং যুক্তিহীন লোকেরা বিষয়টিকে এলামেলো করে ফেলে এবং কোন বাছ-বিছার ছাড়া যে কোন সমাজে কোরআনের বিধান প্রয়োগের কথা চিন্তা করেন। প্রাথমিক যুগের মুসলমানরো কোরআনকে অনেক উদারতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করেছেন। এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু সপ্তম শতকের শেষার্ধের প্রথম দিকে এবং অষ্টম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত আইন শাস্ত্রের উন্নতির পর ঐতিহ্যের সৃষ্টি এবং প্রযুক্তি ও সাদৃশ্যপূর্ণ বিচার শক্তি জাগ্রত হওয়ার ফলে আইনবিদরা পবিত্র গ্রন্হের মূল পাঠকে আঁকড়ে ধরে। আন্তরিকতাবাদের প্রভাবে মুসলিম আইন এবং ধর্মতত্বের সমাধি হওয়া পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল”। (পৃঃ ৩৯-৪০)
একটি হাদীসকে মিথ্যা হতে হলে হাদীসের বর্ণনাকারী সাহাবী অথাব তার থেকে যিনি শুনেছেন তাকে মিথ্যুক হতে হবে। সাহাবীদের বেলায় এটা হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। বিষয়টি মনস্তাত্বিক সমস্যার দিকে দৃষ্টি দিলে এটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। মহানবীর ব্যক্তিত্ব এসব মানুষকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে, এইসব পুরুষ মানব ইতিহাসের সুবিদিত সত্য এবং ইতিহাসে এদের যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। এটা কোন রকমেই বিশ্বাসযোগ্য নয় যারা আল্লাহর নীর কথায় নিজেদের জীবন এবং তাদের সম্পত্তি বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন তারা সেই নবীরই কথা নিয়ে চাতুরী করবেন। নবী করেছেন, “যারা স্বেচ্ছায় আমার সম্পর্কে মিথ্যা বলবে তার দোজখের বাসিন্দা হবে”। সাহাবীরা এটা জানতেন। আল্লাহর দূত হিসেবে তারা যাকে বিশ্বাস করেছিলেন সে নবীর কথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন।
মনস্তাত্বিক দিক থেকে এটা কি সম্ভব যে তারা নিশ্চিত শাস্তিকে অবিশ্বাস করেছেন? আরও একটি যুক্তির ভিত্তিতে হাদীসের যথার্থতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। যে সাহাবী নবীর কথা শুনেছেন অথবা যারা পরে বর্ণনা করেছেন তারা ভুল শুনতে পারেন অথবা স্মরণশক্তির অভাবে ভুল করতে পারেন বা বুঝতে ভুল করতে পারেন। তবে মনস্তাত্বিক সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে এ ধরনের ভুলের কোন অবকাশ অন্ততঃ সাহাবীদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। যারা নবীর সঙ্গে বাস করেছেন, তাদের প্রতিটি কথা এবং কাজ উল্লেখযোগ্য ছিল। এটা শুধু এ কারণে নয় যে, তার প্রতি অগাধ ভক্তি ছিল বরং তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, নবীর মাধ্যমে আল্লাহর প্রতিটি আদেশের আলোকেই তাহাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষণ পরিচালিত করতে হবে। এই কারণে নবীর কোন কথাকে তারা হাল্কাভাবে নেননি বরং ব্যক্তিগত চরম অসুবিধা সত্ত্বেও তা স্মরণ রাখতে চেষ্টিত ছিলেন।
নবীর সঙ্গে যারা ঘনিষ্ঠভাবে ছিলেন তারা প্রত্যেকেই দুইজন করে গ্রুপে থাকতেন এবং একজন পালাক্রমে নবলি কাছে থাকতেন এবং অপরজন তার জীবনোপকরণ সংগ্রহ করতেন। যিনি কাছে থাকতেন নবীর কাছ থেকে শোনা এবং নবীর আচরণ দ্বিতীয় ব্যক্তিকে দেখা মাত্রই অবহিত করতেন। প্রতিটি মুহুর্তে তারা এতই সচেতন ছিলেন যে নবীর কোন কাজই তাদের দৃষ্টির আড়ালে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এই অবস্থায় কি করে বিশ্বাস করা যায় যে, হাদীসের সঠিক শব্দ সম্পর্কে তারা উদাসীন ছিলেন? শত শত সাহাবীর পক্ষে প্রতিটি খুটিনাটি বানানসহ পুরো কোরআন মনে রাখা যেমন সম্ভব ছিল ঠিক তেমনি কোন প্রকার বর্জন, সংযোজন ছাড়া হাদীস মনে রাখাও সম্ভব ছিল। পূর্ব এবং পশ্চিমের আধুনিক সমালোচকরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে সংবেদনশীল সমালোনা করতে পারেননি।
এটা করা কষ্টকর কারণ হাদিসের প্রাথমিক সংকলকরা বিশেষ করে ইমাম বুখারী এবং মুসলিম হাদীসের যথার্থতার জন্যে মানবের সাধ্যানুসারে যা কিছু করণীয় ছিল সবকিছু করেছেন। তারা যে কষ্ট স্বীকার করেছেন কোন ইউরোপীয় ঐতিহাসিক কোন ঐতিহাসিক ঘটনার যথার্থতার জন্যে এত কষ্ট স্বীকার করেন না। এখন পর্যন্ত কোন সমালোচকই যথার্থ হাদীসের কোনটির অযথার্থতা সম্পর্কে কোন প্রমাণ দিতে পারেননি। কোন যথার্থ আচারের পুর্ণাংশ বা অংশ বিশেষ প্রত্যাখ্যান সংবেদনশীলতার পরিচায়ক নয়। কারণ পক্ষপাতশূণ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বারা তা প্রকাশ সম্ভব হয়নি। তবে আমাদের যুগের অনেক মুসলমানের এই বিরোধী মনোভাবের উদ্দেশ্য সহজেই বোঝা যায়। আমাদের নবীর সুন্নায় প্রতিফীলত ইসলামের সত্যিকার মেজাজের সঙ্গে বর্তমানের অধঃপতিত জীবনকে খাপ খাওয়াতে না পারাই এই বিরোধিতার উদ্দেশ্য। নিজের এবং পরিবেশের অসম্পূর্ণতাকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করার জন্যেই হাদীসের ভিত্তিহীন সমালোচকরা সুন্নাত অনুসরণের প্রয়োজনয়িতা এড়াতে চান কারণ এটা করা সম্ভব হলে তাদের খেয়াল খুশিমত কোরআনের ব্যাখ্যঅ করা সম্ভব হবে।
এইভাবে ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন পদ্ধতি হিসেবে ইসলামের ব্যতিক্রমী অবস্থান ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। একই সঙ্গে নবীর সুন্নাহর অনুসরণ ও পশ্চিমা জীবন পদ্ধতির স্বাদ গ্রহণ অসম্ভব। এই পশ্চিমী ধ্যান ধারণার কারণেই আমাদের নবীর আদর্শ সুন্নাহর সমগ্র কাঠামো আজ এত অপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পশ্চিমা সভ্যতার অন্ধ অনুসারীরা সুন্নাহর বিরোধিতা ছাড়া কোন পথ খুঁজে পায় না। তারা বলেন সুন্নাহ অপ্রাসঙ্গিক, সুতরাং তা ইসলামের অপরিহার্য দিক নয়। কারণ তা অনির্ভরযোগ্য ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এরপর কোরআনের শিক্ষাকে পাল্টিয়ে দেয়া সহজ হয়ে পড়ে। তখন তারা পশ্চিমা সভ্যতার সাথে খাপ খাইয়ে কোরআনের ব্যাখ্যঅ করতে পারেন।
শরিয়তের অগ্রগতি সংক্রান্ত ডক্টরের বক্তব্য যোশেফ স্কচ এর ধারণার শব্দান্তরিত রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। স্কচের মতবাদ হচ্ছে প্রাথমিক যুগের মুসলমানরা অনেকটা স্বাধীন চিন্তা এবং স্বাধীন বিচার শক্তির অধিকার ছিলেন। ইমাম শাফেয়ী প্রথম মুসলিম আইনবিদ যিনি ইসলামী শরিয়তের জন্যে কোরআনের পর হাদীসকেই সব চাইতে শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য সূত্র হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আইনকে আরও জোরদার করার জন্যে তিনি সাহাবীদের ‘ইজমা’কে অভ্রান্ত নির্দেশিকা হিসেবে গ্রহন করেছেন।
ইজতেহাদের যোগ্যতা এত নিষ্পাপ ও কঠোর এবং উচ্চে স্থাপন করা হয়েছে যে, মানুষের পক্ষে তা অর্জন অসম্ভব। প্রাথমিক যুগের ধর্মীয় নেতারা সেই হিসেবে নিজেদেরকে খুবই আদর্শবান করে গড়ে তুলেছিলেন। পুরোপুরি ইজতেহাদের ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিলোপ করা হয়েছে। প্রাথমিক ইজতেহাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে-এর অর্থ হচ্ছে একজন তার নিজস্ব চিন্তার গণ্ডির মধ্যে আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারেন অথবা বিভিন্ন চিন্তার বিশ্লেষণ করে আইনের ওপর তুলনামূলক গবেষণা চালিয়ে কিছুটা বিস্তারিত বিবরণ খাড়া করতে পারেন। ইবনে তাইমিয়ার মত অসাধারণ লোকের সংখ্যঅ খুব দুর্লভ, যারা পুরোপুরি ইজতেহাদের দাবী করেছেন। কিন্তু মধ্যযুগে এ ব্যাপারে তাদের স্বীকৃতি খুবই সীমিত ছিল। আমরা পরে দেখব যে, আধুনিক চিনতানায়কদের প্রবল প্রচেষ্টায় এই দিকটি আবার কিভাবে শুরু হয়েছে। কিন্তু সমগ্র মধ্য শতাব্দী ধরে আইনের সংজ্ঞা এবং ব্যা সম্প্রদায়ের ওপর শেলের মত নিক্ষিপ্ত হয়েছে। (পৃঃ ৭৮-৭৯)
এখন আমরা সংক্ষেপে দেখব যে, মহান আইনবিদদের সর্বসম্মত মতের বিরুদ্ধেই ইজতেহাদ করা যায় কিনা? এই বিষয়ের দুইটি দিক আছে তাত্বিক এবং বাস্তব। তাত্বিক দিক থেকে এ ধরনের ইজতেহাদের ব্যাপারে কোন আপত্তি থাকতে পারে না, যেহেতু আমাদের খ্যাতনামা ইমামরা অভ্রান্ত ছিলেন না তাদের সর্বসম্মত মতে ভুলের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে এটা স্মরণ রাখতে হবে যে, তাত্বিক দিক থেকে যা সম্ভভ তাই সত্যি হওয়া অপরিহার্য নয়। উদাহরণস্বরূপ আমাদের সময় আল্লামা ইকবাল দেশের সবচাইতে বড় কবি। এমন কোন কবির আবির্ভাব অসম্ভব নয় যিনি ইকবালের চাইতেও নিজেকে বড় প্রমাণ করবেন। ইকবালের চেয়ে বড় কবির আবির্ভাব সম্ভব এটা ধরে নেয়ার পর ডঃ ফজলূর রহমান নিজেকে সেরূপ দাবী করেন। কবিত্বের দাবির কোন কাজ বা প্রমাণ উপস্থাপন না করলে তার মুখের কথাকে বিশ্বাস করা কি কারও পক্ষে সম্ভব? এখন কথা হচ্ছে, যে বিষয়ে আবু হানিফা, মালিক, শাফী এবং আহমদ ইবনে হাম্বলের মত ইমামগণ সম্পূর্ণভাবে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন সে বিষয়ে কোন মুসলমানের পক্ষে আধুনিকতাবাদদের ফতোয়া বিবেচনা করা কি সম্ভব?
ইসলামের ইতিহাসের বিচার বিশ্লেষণ ডঃ ফজলূর রহমান H.A.R. Gibb’s এর Mohammadism কে অনুসরণ করেছেন। একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে গিবস এর বই এর চাইতে ফজলূর রহমানের বইতে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে। আধুনিক সংস্কার আন্দোলনের পূর্ববর্তী অধ্যঅয়ে তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, মধ্যযুগীয় কর্তৃত্ব এবং ইজতেহাদের ওপর তাদের জেদকে অস্বীকার করে তারা আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। কিন্তু যেহেতু আগের আন্দোলনগুলো কর্তৃত্ব পরিহার করার সময় ইসলামী আইনে সংযোজনযোগ্য কিছু দিতে না পেরে শুধুমাত্র প্রাচীন ইসলামে ফিরে যেতে চেয়েছে ফলে এই শূন্যতা আধুনিকতাবাদীরা পশ্চিমা সভ্যতার বুদ্দিবৃত্তিক উপাদান দিয়ে পূরণ করেছে। (পৃঃ ২১৫)
তিনি নৈতিক প্রত্যক্ষবাদের পরামর্শ দান এবং পার্থিব আত্মিক আন্দোলনের পরিবর্তে সমাজ কল্যাণের ওপর জোর দেয়ার কথা বলেছেন ফলে পরে আধুনিক জীবন ও শিক্ষার ওপর ধর্মনিরপেক্ষবাদ বলবৎ হয়েছে। এইসব আন্দোলন আধুনিকতার অগ্রপথিক এই যুক্তি সম্পূর্ণ ভ্রান্তিকর। পার্থিব সুখ-শান্তির জন্য পরকালকে বিসর্জন দেয়া তাদের লক্ষ্য ছিল না। বরং তা ছিল জীবন পদ্ধতি হিসেবে নিখুঁত ও নির্ভেজাল ইসলামের বাস্তবায়ন। অপরদিকে আধুনিকতাবাদীরা মুসলিম সমাজকে পশ্চিমারুপ দিয়ে কি করতে চান তা আর গোপন নেই।
ডঃ ফজলূর রহমানের ধারণা ঐতিহাসিকভাবে উন্নয়ন প্রাপ্ত আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি মুসলমানদের নিশ্চলতা, দুর্বলতা এবং অধঃপতনের জন্য বিরাট অংশে দায়ী। সকল প্রাক আধুনিক শিক্ষার মত মধ্যযুগের মুসলমানদের শিক্ষার মৌলিক গলদ ছিল শিক্ষার ধারণা সংক্রান্ত। আধুনিক শিক্ষার ধারণা হচ্ছে- তা অবশ্যই অনুসন্ধান এবং আবিস্কারের ফসল হতে হবে। মুসলমানরা এর সম্পুর্ণ বিপরীত ধারণা পোষণ করতেন। তাদের মতে শিক্ষা অর্জন করতে হবে- এই মনোভাব নিষ্ক্রিয় এবং ধারণক্ষম। সৃষ্টিশীল ও ইতিবাচক একদিকে প্রেরিত বা চিরাচরিতের বিরোধিতা অপরদিকে যৌক্তিকতার কারণে মুসলিম বিশ্বে এই বৈপরিত্য এখন আরও তীব্র। এই বিতর্ক, গোঁড়ামি, ঐতিহ্য রক্ষার উদ্বেগ সামগ্রিকভাবে যুক্তির বিরুদ্ধে মাথা চাঁড়া দিয়েছে যাকে সে অন্ধত্বের কড়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিল। (পৃঃ ১৯১)
বিজ্ঞ ডক্টর জানতে আগ্রহী হতে পারেন, কি করে বর্তমান শতকের প্রথম দিকের খ্যাতিম্যান খৃষ্টান মিশনারী Dr. Samuel zwemer একইভাবে মুসলিম শিক্ষার সমালোচনা করেছেন; ঠিক এখানে তাদের শিক্ষা দর্শনের চূড়ান্ত গলদে আমরা হোঁচট খাই। স্মৃতি শক্তিকে খুবই জোরদার করা হয়েছে কিন্তু যুক্তিবাদী ক্ষমতা একেবারে অনুন্নত রয়েছে। একজন মুসলিম প্রতিদিন যা আবৃতি করে, সে জানে না ঐ শব্দ এবং বাক্যে বি বোঝায়। কোরআনের বক্তব্য সম্পর্কে প্রশ্ন করলে গাল খেতে হবে অথবা তার চাইতে বেদনাদায়ক পরিস্থিতির সম্মখীন হতে হবে। এমনকি মোহাম্মদীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র, ইতিহাস এবং ধর্মতত্বও মুখস্ত করানো হয়। যেহেতু গোঁড়ামি অধ্যাপককে ব্যক্তিগত বিচার বিচক্ষনতা প্রয়োগের সুযোগ দেয় না, সেক্ষেত্রে ছাত্ররা কেন নিজেদের জন্যে চিন্তা করবে? আল্লাহ ওহির ১১৪ টি অধ্যায়ে জ্ঞানের আরম্ভ এবং শেষ, অন্য পাঠ্য বইয়ের প্রয়োজন কোথায়? [Chidhood in Moslem world Dr. Samuel M. zwemer Fleming H. Revell co. New York, 1915 pp 137-38]
চিরাচরিত মাদ্রাসা শিক্ষা-যেখানে বুঝার পরিবর্তে শুধু মুখস্ত করার ওপর জোর দেয়া হয় তার বেলায় এই সমালোচনা সত্য। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ডঃ ফজলুর রহমান এবং তার সহানুভূতিশীলরা দেশীয় পদ্ধতির বিকল্প হিসেবে যে আধুনিক শিক্ষা দিতে চান তা কি কোন ভাল কিছু করতে সক্ষম? বস্তুতঃ ডঃ ফজলূর রহমান নিজে এর উত্তর দিয়েছে। তার বই-এর সমাপ্তিতে তিনি লিখেছেন- প্রথম অবস্থা থেকে মাদ্রাসা শিক্ষায় নতুন পদ্ধতি সৃষ্টির চিন্তার কোন সুযোগ নেই। আমাদের আধুনিক পণ্ডিতদের মধ্যেও এই প্রয়োজনীয় প্রেরণা পর্যাপ্তভাবে সঞ্চারিত হয়নি। আমাদের আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষঅ পুরোপুরি ধর্ম নিরপেক্ষ এবং ইসলাম অধ্যয়ন ও গবেষণা কখনো এতে স্থান পায়নি। ফলে আমাদের আধুনিক শিক্ষঅয় শিক্ষিত লোকদের মধ্যে ইসলামের কোন জ্ঞান নেই।
দ্বিতীয়তঃ এই শিক্ষা পদ্ধতির যেসব ছাত্র বৈজ্ঞানিকভাবে ইসলাম অধ্যয়নে যত্নবান হলেন তারা প্রায় সকলেই পশ্চিমী প্রাচ্যবাদের শিষ্য। ফলে তাদের মুসলমান শিষ্যরাও প্রাচ্যবাদী হয়ে পড়েছে। প্রাচীবাদীরা একই সঙ্গে মুসলমানও রয়ে গেলেন। সামগ্রিকভাবে এতে কোন কাজ হয়নি এবং কোন ফলোদয় হয়নি। (পৃঃ ২৫১-৫২)
বিষয়টির সবচেয়ে জটিল অবস্থা হচ্ছে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত আধুনিকতাবাদীরা ইসলামে পণ্ডিত নয় এবং ইসলামের অতীতের সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না। সুতরাং কলহপ্রিয় সংস্কারবাদীদের মোকাবিলায় তারা আত্মরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করেন। ইসলামের রাজণৈতিক মতবাদের ওপর আধুনিকতাবাদদের একটি বইও নেই। (পৃঃ ২৩০)
পশ্চিমী শ্রেণী পর্যাপ্ত সময়ের অভাবে সংস্কৃতির দিক থেকে ঐতিহ্যবাদীদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। পশ্চিমী আধুনিকতাবাদ অপশ্চিমী পরিবেশে উৎকর্ষ সাধন করতে পারে না। এমনকি আধুনিক ক্ষেত্রেও নয় কারণ নতুন পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে এর সময় লাগে। সমসাময়িককালে খুব সীমিত কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ কিছু অগ্রগতি হয়েছে যেমন ইসলামের পুনঃব্যাখ্যা, সৃষ্টিশীল পণ্ডিতদের প্রশিক্ষণ এবং আলআজহারকে পুনর্গঠনের জন্যে পাকিস্তানে ইসলামী রিসার্স ইনষ্টিটিউট স্থাপিত হয়েছে। অবশ্য এর ফল পেতে সময় লাগবে। তবে সময়ের প্রাচুর্যতার অভাবই সব কথা নয়। পশ্চিমীবাদের মোলিক অসুবিধা হচ্ছে এর নৈতিকতার অভাব যা একই এর শক্তি যোগাতে পারতো। কেবলমাত্র আধুনিকতার কয়েকটি কার্যকর দিক প্রয়োজনীয় নৈতিকতা দিয়ে নতুন জায়গায় আসন পেতে পারতো। কার্যকর আধুনিকতা সৃষ্টি হয়নি, মৌলিকত্বের শক্তিই পশ্চিমীবাদের দুর্বলতা। (পৃঃ ২২২-২২৩)
এখানে লেখক খোলাখুলি স্বীকার করছেন যে, আধুনিকতার আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। তুরস্কের মত এত ব্যাপকভাবে কোথাও এই ব্যর্থতা আসেনি। সম্পূর্ণ পশ্চিমী ধ্যান ধারণার অধিকারী শাসকদল ৪০ থেকে ৪৫ বছর সেখানে শাসন করেছেন। কামালবাদীরা শুধুমাত্র একজন বিচক্ষণ নেতার নেতৃত্বই পায়নি বরং এই লক্ষ্য অর্জনের কাজে সকল একনায়কের সমর্থন পেয়েছে। এই বইতে ডঃ ফজলুর রহমান আরও স্বীকার করেছেন যে, সামরিক ও রাজীনতক ক্ষমতার মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষ কর্মসূচী পরিচালিত হয়েছে। এই কারণে সরকারী শিক্ষানীতির দ্বারা তুকী শহরগুলো প্রভাবিত হয়েছে। কামাল আতাতুর্কের শাসন থেকে তুকী বুদ্ধিজীবীরা ধর্মনিরপেক্ষতার কোন উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা দেননি। (পৃঃ ২২৪)
এর অর্থ হচ্ছে মুসলমানদের উপর বর্বর অত্যাচার এবং শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে পশ্চিমীবাদ চাপিয়ে দেয়া যায়। কোন মুসলিম দেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাশ্চাত্যকরণকে স্বাগত জানায়নি।
এসব সত্যকে অস্বীকার করে তিনি ঘোষণা করেন ‘তৃতীয় থেকে নবম শতক পর্যন্ত মুসলমানরা যেসব অবস্থার মোকাবিলা করেছে বর্তমান মুহূর্তে ইসলাম সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা এবং এর পুনর্গঠন অনেক বেশী প্রয়োজন, প্রথম আড়াই শতকে যা করতে হয়েছে এখনও তাই করা প্রয়োজন। অপর কথায় মুসলমানদের নবলি সময়কালের পরবর্তী সময়ের মত এখন চিন্তা করতে হবে এবং একে পুনরায় পুনর্গঠন করতে হবে।(পৃঃ ২৫১)
এই বইয়ের লেখকের মত আধুনিকতাবাদীদের প্রবল শ্লোগান হচ্ছে সৃষ্টিশীল আদি ও স্বাধীন অনুসন্ধানের জন্যে ইজতিহাদ এবং ইসলামী গবেষণা চালাতে হবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে এর ফলে কি পাওয়া গেছে?
এমনকি নিজের পাণ্ডিত্যের মাপকাঠিতে ডঃ ফজলূর রহমান উদ্দেশ্য সমাপ্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার কুরআন সম্পর্কিত অধ্যায়ে তিনি স্যার সৈয়দ আহমদ খানের অতি প্রাকৃতবাদ বিরোধিতা মেনে নিয়েছেন, হাদীস এবং শরীয়তের অগ্রগতি সম্পর্কে Schacht- এর আধুনিকতার যুক্তি সৈয়দ আমীর আলীর Spirit of Islam এবং ইসলামের ব্যাখ্যা Wilfred Centwell smith- এর Islam in modern History-র বক্তব্যকে সমর্থন করেছে। অপর কথায় পাকিস্তানের সরকারী ইসলামিক রিসার্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডঃ ফজলুর রহমানের মত পণ্ডিত ব্যক্তি আদি সৃষ্টিশীল এবং স্বাধীন চিন্তার সামান্য পরিচয়ও দিতে পারেননি। তার কম বুদ্ধিমান অনুসারীদের কাছ থেকে কি আর আশা করা যায়?
জিয়া গোকলপঃ কামাল আতাতুর্কের অগ্রসেনা
মৃত্যুর পাঁচ দশক পরও জিয়া গোকলপ (Ziya Gokalp) তুরস্কের আধুনিক চিন্তানায়কদের মধ্যে খুবই প্রভাবশালী রয়ে গেছেন। ১৮৭৬ সালে জন্মগ্রহণ করে তিনি ইস্তাম্বুলের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন এবং পরবর্তীকালে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েরই সমাজতত্বের অধ্যাপক হন। ১৯১১ সাল থেকে ১৯২৪ সালে মৃত্যু পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত তিনি তার সমস্ত রচনা লিখেন। বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে জিয়া গোকলপই ছিলেন আধুনিক তুর্কী জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছাড়া কামাল আতাতুর্কের আমূল সংস্কার বাস্তবায়ন সম্ভব হতো না।
ঊনিশ শতক পর্যন্ত তুর্কীরা নিজেদেরকে প্রথমতঃ মুসলমান মনে করতো। তাদের আনুগত্য ছিল ইসলামের প্রতি, উসমানিয়া রাজ্যের প্রতি নয়। এমনকি উসমানিয়া শব্দটার অর্থ জাতীয় নয় বরং বংশানুক্রমিক বোঝায়। অতীতের ইসলামী সাম্রাজ্য উমাইয়া, আব্বাসীয়, সেলজুক এবং অন্যান্য বড় সাম্রাজ্যের মত এটাও বংশীয় সাম্রাজ্য। জাতীয় এবং দেশ প্রেমিক হিসেবে উসমানীয় জাতি এবং একটি উসমানীয় স্বদেশের ধারণা ঊনিশ শতকে ইউরোপীয় প্রভাব থেকে আসে। তা হচ্ছে সংক্ষেপে সে যে ভাষায় কথা বলে, যে অঞ্চলে বাস করে যে জাতি থেকে তার জন্ম তা ব্যক্তিগত আবেগ অথবা সামাজিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে পারে তবে রাজণৈতিক সম্পর্ক নয়। সুতরাং ইসলামের সঙ্গে পূর্ণ সংহতির ফলে তুর্কী জাতীয়তা বিলীন হয়ে গেছে। ইসলামের ভিতরে পৃথক বংশোদ্ভূত এবং সংস্কৃতির অধিকারী হিসেবে আরব এবং পারসীদের মত তাদের কোন পৃথক সত্তা ছিলনা। আরব এবং পারসীদের মত তুর্কীরা জাতীয় স্বাতন্ত্রের সামান্য পরিচয়ও প্রকাশ করেনি।
প্রাক ইসলামী তুর্কীরা অসভ্য ছিল না বরং তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র, ধর্ম এবং সাহিত্য ছিল। তবুও খণ্ডিত বিখণ্ডিত না হওয়ার জন্যে ইসলাম সবকিছুই ভুলিয়ে দিয়েছে এবং মুছে ফেলেছে। অমুসলিম আরবদের পৌত্তলিক বীর, ইরানের বিলুপ্ত প্রায় সম্রাটের পারসী ঐতিহ্য অথবা মিশরে ফেরাউনের ভগ্ন কিন্তু বিরাট স্মৃতিস্তম্ভের ঐতিহ্য তুর্কীদের নেই। কিছু লোক কবিতা এবং বংশানুক্রমিক পৌরনিক উপাখ্যান ছাড়া তুকীদের প্রাক ইসলামী সকল ঐতিহ্য ভুলিয়ে দিয়েছে। এমন কি তুর্ক নামটাও যা এক অর্থে ইসলামিক।… এমনকি সহস্র বছরের তুর্কী ভাষঅও ইসলামে জন্মগ্রহণ করেছে এই কারণে আজ তুর্কীদের বংশোদ্ভুত তুরস্কের অমুসলমান নাগরিকদের জন্যে তুর্কী শব্দ কখনো প্রযুক্ত হয় না। উসমানীয়দের কোন গোত্রীয় অহমিকা বা বিশেষত্ব, খাটি তুর্কী বংশোদ্ভূতের ওপর জোরাজুরি নেই। ইসলাম আলবেনিয়া, গ্রীক, শ্লাভ এবং কুর্দ ও আরবদের সত্যিকার শক্তি ও সামাজিক মর্যাদা দিয়েছে”।[The emergence of modern turkey, Bernard lewis, Oxford University press, 1961.]
এই সৌভাগ্যজনক ঐতিহাকি অগ্রগতি তুর্কীদেরকে বিশ্বের মধ্যে সবচাইতে আগ্রহী মুসলমান এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ইসলামের মর্যাাদা রক্ষকে পরিণত করেছে। জাতীয়তাবাদীরা তা সহ্য করতে পারেনি। Halide edib adivar-এর ভাষায় “জিয়া গোকলপ এমন এক নতুন তুর্কী জাতি গঠন করতে চেয়েছিলেন যা উসমানীয় তুর্কী এবং পৌত্তলিক পূর্বপুরুষ তুরানীদের পার্থক্য দূর করবে। তিনি বিশ্বাস করতেন আরবদের প্রতিষ্ঠিত ইসলাম আমাদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে কখনও খাপ খাবে না। বংশীয় সূত্র থেকে তিনি খুব সতর্কতার সঙ্গে প্রাক ইসলামী তুর্কী ইতিহাস থেকে সাংস্কৃতিক ও রাজণৈতিক সংগঠনের তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি চেয়েছিলেন আমাদের জাতীয় ভাবধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ধর্মের সংস্কার করতে”।
জিয়া গোকলপ পশ্চিমী জাতীয়তাবাদের জন্যে মুসলিম বিশ্বের প্রথম সুবিন্যস্ত প্রচেষ্টার দাবী করতে পারেন- “এখন তুর্কীদের কাজ হচ্ছে জনগণের মধ্যে প্রাক ইসলামী যুগের যে তুর্কী ঐতিহ্য রয়েছে তা উন্মুক্ত করা এবং সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা সভ্যতা গ্রহণ করা। ইউরোপীয়দের সঙ্গে সামিরক, বৈজ্ঞানিক ও শিল্পে সমতা অর্জনের জন্যে আমাদের একমাত্র পথ হচ্ছে পশ্চিমী সর্ভতাকে পুরোপুরি গ্রহণ করা”।
জিয়া গোকলপ উম্মা বা ইসলামের সার্বজনীন ভ্রাতৃত্বের ধারণাকে অস্বীকার করেছেন কারণ তা পশ্চিমী জাতীয়তাবাদের বিরোধী।
প্রাক- ইসলামী তুর্কীদের সবচাইতে বেশী দেশপ্রেম ছিল। অতীতের মত ভবিষ্যতেও তুর্কীদের নৈতিকতার ভিত্তি হওয়া উচিৎ দেশপ্রেম, কারণ জাতি এবং আত্মাই শেষ পর্যন্ত স্বকীয় সত্তার বিকাশস্থল। ধর্ম এবং পরিবারের প্রতি আনুগত্যের চাইতে জাতির প্রতি আনুগত্য আগে প্রয়োজন। জাতি এবং স্বদেশকে তুর্কীদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমরা প্রকৃত সভ্যতা- একটি তুর্কী সভ্যতার সৃষ্টি করব যা নতুন জীবনের সঞ্চার করবে। তুর্কীরা আর্যদের চাইতে ফর্সা এবং সুন্দর, মঙ্গোলীয়দের সাথেও তাদের সম্পর্কের কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তুর্কী গোত্র অন্যান্য গোত্রের মত সুরাসার বা লাম্পট্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। সমরক্ষেত্রে ঐতিহ্য নিয়ে তুর্কীরক্ত সতেজ ও পূর্ণ যৌবন নিয়ে সচল রয়েছে। তুর্কী বুদ্ধি লয়প্রাপ্ত হয়নি। তার আবেগ দুর্বল হয়নি। তুর্কি সংকল্পে ভবিষ্যৎ বিজয়ের প্রতিশ্রুতি রয়েছে”। (IBID পৃঃ ৩০২, ২৭১ এবং ৬০)। পশ্চিমী সভ্যতাকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার জন্যে জিয়া গোকলপ যুক্তি দিয়েছেন- পশ্চিমী সভ্যতা প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতার পরবর্তী রূপ। তুর্কীরা ছিল ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা। ইতিহাসে প্রাচীন যুগের আগে তুরানী যুগ ছিল। সেই দিক থেকে পশ্চিম এশিয়ার আদি বাসিন্দারা আমাদের পূর্ব পুরুষ। এইভাবে আমরা পশ্চিমী সভ্যতার অংগ এবং এতে আমাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ রয়েছে। (IBID পৃঃ ২৬৬-৭)।
ইতিহাসের এই বিকৃতির ফলে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা কামাল আতাতুর্কের শাসনকালে দাবী করলেন যে, অতীতের সকল মহান ব্যক্তি তুর্কী ছিলেন অথবা তুর্কীরা তাদের সভ্য করেছে। ফিনিশিয়রা ছিল সেমিটিক, স্কেথিয়ানরা ছিল পারসীদের জাতিভুক্ত। অপরদিকে সুমারিয়ানরা কোন গোত্র পার্থক্য মানতো না। জিয়া গোকলপ মিশরীয়দের কথা উল্লেখ করতেও ভুলে গেছেন। তিনি কি তাদেরকেও তুর্কী মনে করতেন?
জিয়অ গোকলপ দাবী করেছেন যে, রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস করে তুর্কীরা ইউরোপের ইতিহাসে বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। সকল বিপ্লবী তুর্কী জাতীয়তাবাদীর মত তিনিও আধুনিক তুর্কীদের হুন বলে আখ্যায়িত করেছেন। ফলে বহু তুর্কী অভিভাবক তাদের সন্তানদের নাম রেখেছেন “Attila’। ধ্বংসাত্মক তৎপরতা সত্ত্বেও রোমের পতনে হুনদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ছিল না। হুন এবং আধুনিক তুকীদের সম্বন্ধ অস্পষ্ট। অন্ততঃ আমি যদি তুর্কী হতেম তাহলে তাদের বংশধর বলার মধ্যে কোন গৌরব বোধ করতাম না।
জিয়া গোকলপ একটি স্বাধীন সভ্যতার অধিকারী হিসেবে ইসলামকে স্বীকার করে নেননি। যখন একটি জাতি বিবর্তনের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায় তখন তার সভ্যতারও পরিবর্তন প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তুর্কীরা যখন মধ্য এশিয়ার যাযাবর উপজাতি ছিল তখন তারা দূর প্রাচ্যের সভ্যতার অধিকারী ছিল। যখন তারা সুলতানাতের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা অতিক্রম করেছে তখন বাইজেনটাইন সভ্যতায় প্রবেশ করে এবং ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রবেশের মুখে তারা পশ্চিমা সভ্যতা গ্রহণে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ (IBID ২০৭-১)।
পশ্চিমা সভ্যতা চালূর ব্যাপারে জিয়া গোকলপ তার সমসাময়িকদের মত ভাল মন্দ পাথ্যক্য করেননি। বরং সব ব্যাপারে অনুকরণের ওপর জোর দিয়েছেন- তানজিমাত [তানজিমাত আন্দোলন’ উনিশ শতকের প্রথমাধ্যে তুরস্কে পশ্চিমীকরণের প্রাথমিক প্রচেষ্টা।] এর নেতাদের সব চাইতে বড় ভুল হচ্ছে তারা পূর্ব পশ্চিমের মিশ্রণে মানসিক জগাখিচুড়ী সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। তারা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, সম্পূর্ণ বিপরীত নীতির দু’টি সভ্যতার আপোষ সম্ভব নয়। দু’ধরনের রাজনৈতিক সংগঠন, দু’ধরনের বিচার ব্যবস্থা, দু’ধরনের স্কুল, দু’ধরনের কর ব্যবস্থা, দু’টি বাজেট, দু’ধরনের আইন সবই এই ভুলের ফলশ্রুতি। পূর্ব পশ্চিমের আপোষের যে কোন প্রচেষ্টা মধ্য যুগকে আধুনিক যুগে টেনে আনা এবং জিইয়ে রাখার প্রচেষ্টার নামান্তর।
আধুনিক সমর পদ্ধতির সঙ্গে জেনিসারির (Janissary) আপোষ যেমন সম্ভব নয়; আধুনিক ঔষধের সঙ্গে প্রাচীন প্রক্রিয়ার ঔষধকে সারিভুক্ত করা যেমন নিরর্থক, একইভাবে প্রাচীন আইন ও নতুন আইন এবং চিরাচরিত ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে পাশাপাশি ধরে রাখার প্রচেষ্টাও অবান্তর। প্রত্যেক সভ্যতার নিজস্ব যুক্তি, রুচিরোধ এবং বৈষয়িক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই কারণে বিভিন্ন সভ্যতা অবাধে মিশে যেতে পারে না। আবার একই কারণে যখন কোন সমাজ বিশেষ সভ্যতাকে পুর্ণাঙ্গভাবে গ্রহণ করে না সে সমাজ তার অংশ গ্রহণেও ব্যর্থ হয। এমনকি যদি কিছু অংশ নিয়েও থাকে তবে তা হজম করতে ব্যর্থ হয়। আমাদের তানজিমাত সংস্কারকরা এদিকটা বুঝতে ব্যর্থ হয়ে সব সময় প্রত্যেক ব্যাপারে অর্ধ পদক্ষেপ নিয়েছেন। জাতীয় উৎপাদন প্রক্রিয়া আধুনিকীকরণের আগে তারা ভোগ, পরিধান, খাওয়া, নির্মাণ এবং আসবাবের পরিবর্তন করতে চেয়েছেন।
অপরদিকে, এমনকি ইউরোপীয় মনে একটি শিল্পোন্নতির কেন্দ্রও তৈরী হয়নি কারণ তানজিমাতের নীতি নির্ধারকরা অবস্থা পর্যালোচনা না করে এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পরিকল্পনা না নিয়েই সংস্কারের উদ্যেগ নিয়েছেন। (IBID পৃঃ ২৭০-৭৭)। জিয়া গোকলপ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রথম প্রবক্তাদের অন্যতম। পরে মোস্তফা কামাল তা বাস্তবায়ন করেন- আইনে তুর্কীবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হচ্ছে তুরস্কে আধুনিক আইন চালূ করা। আধুনিক জাতিসমূহের পর্যায়ে পৌঁছার জন্যে আমাদের মৌলিক শর্ত হচ্ছে ধর্মতত্ত্ব ও যাজক সম্বন্ধীয় সকল শাখা থেকে আইন কাঠামো মুছে ফেলা।
এই দু’টি চরিত্র বহির্ভূত মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রকে আধুনিক রাষ্ট্র বলা হয়। প্রথমতঃ আধুনিক রাষ্ট্রে আইন প্রণয়ন এবং শাসনের ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে। কোন কার্যালয়, কোন ঐতিহ্য এবং কোন দাবী এই অধিকার খর্ব করতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ আধুনিক জাতির সকল সদস্য ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সকল ক্ষেত্রে সমান বিবেচিত হয়। সংক্ষেপে আমাদের আইনের স্বাধীনতা, সাম্য এবং ন্যায় বিচারের বিরোধী সকল ধারা ধর্মতত্ত্ব ও যাজক বিধানের সকল ধারা নির্মূল করতে হবে। তুর্কীবাদ একটি ধর্ম নিরপেক্ষ আন্দোলন এবং কেবলমাত্র ধর্ম নিরপেক্ষ প্রকৃতির যে কোন আন্দোলনের সঙ্গে আপোষ করতে পারে। (IBID পৃঃ ৩০৪-৫)
ইসলাম ও পশ্চিমীবাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই একথা প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন- কেবলমাত্র সভ্যতার দ্বারা ইউরোপ মুসলিম দেশসমূহকে পরাস্ত করতে এবং বিশ্বের প্রভু হতে পেরেছে। তবে কেন এই সফলতার সাক্ষ্যবহ সভ্যতাকে আমরা গ্রহণ করতে পারব না? আমাদের ঈমান কি সকল প্রকারের বিজ্ঞান ও শিক্ষাকে গ্রহণের দায়িত্ব বর্তায় না? আমাদের মহানবী বলেছেন- “জ্ঞান অর্জনের জন্যে প্রয়োজনে চীনেও যাও” এবং “জ্ঞান ঈমানদারদের হারানো সম্পদ যেখানেই সে পাবে তা গ্রহণ করা উচিৎ”। জাপানকে ইউরোপীয় শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয় কিন্তু সত্যিকার অর্থে ইউরোপীয় সভ্যতা গ্রহণ না করায় তাদেরকে এশীয় জাতি ধরা হয়।
জাতীয়তাবাদ প্রচার করেই জিয়া গোকলপ সন্তুষ্ট হননি তিনি ইসলামেরও পরিবর্তন চেয়েছেন। কোন জাতীয়তাবাদী তার মত জাতীয়তায় এত উন্মত্ত ছিলেন না। তিনি সকল আরবী ফারসী উদ্ভূত শব্দকে তুর্কীকরণের ওপর জোর দেন। এই পরিশুদ্ধির ফলে এক শতকে আগের লিখিত ও পঠিত তুর্কী ভাষা তুর্কীদের কাছে অপরিচিত হয়ে পড়ে। পরবর্তী পর্যায়ে মূল্যবান তুর্কী পাণ্ডুলিপির সকল লাইব্রেরী ইস্তাম্বুল এবং অন্যন্য তুর্কী শহরের যাদুঘরে পঁচতে থাকে। কারণ জাতির বয়োবৃদ্ধরা পর্যন্ত এসব পড়তে বা বুঝতে পারে না। এইভাবে ভাষা সংস্কার চিরস্থায়ীভাবে ইসলামী ঐতিহ্যের ধারক প্রাচীন তুর্কীর সঙ্গে আধুনিক তুরস্কের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। জিয়া গোকলপ এবং তার অনুসারীরা চেয়েছিলেন- প্রার্থনার ভাষা তুর্কী হতে হবে। যাতে প্রার্থনাকারী তাদের ধর্মের মর্মার্থ বুঝতে পারে, কোরআন তুর্কী ভাষায় পড়তে হবে যাতে ছোট বড় প্রতিটি মানুষ খোদার আদেশ বুঝতে পারে- এমন দেশই হবে তুর্কীদের প্রকৃত স্বদেশ।
জিয়া গোকলপ নিজেকে বড় কবি কল্পনা করতেন। তার ‘ধর্ম ও বিজ্ঞান’ কবিতার একটি অংশের ভাবার্থ নিম্নে দেয়া হলো। এতে তিনি আদর্শ নারীত্বের পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে- নারী সে আমার মা ভগিনি বা কন্যা হোক, তার মধ্যে আমার জীবনের গভীর আবেগ নিহিত। চন্দ্র, সূর্য বা তারকার প্রতি আমার ভালবাসা সেও নারীর কারণে। নারীই আমাদের জীবনের ছন্দময় সত্তাকে বুঝতে সাহায্য করে। কিভাবে খোদার পবিত্র আইন এই সুন্দর জীবকে ঘৃণ্য বিবেচনা করতে পারে? নিশ্চয়ই বিজ্ঞরা কোরআনের ব্যাখ্যায় ভুল করেছেন। জাতি এবং রাষ্ট্রের ভিত হচ্ছে পরিবার, যতদিন নারীর প্রকৃত মর্যাদা দেয়অ না হবে ততদিন জাতীয় জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পরিবারের লালন পালনে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অতএব তিনটি বিষয়ে সাম্য প্রয়োজন- তালাক, পৃথক হওয়া এবং উত্তরাধিকারে। যতদিন উত্তরাধিকার এবং বিবাহের ব্যাপারে নারীকে পুরুষের অর্ধেক বিবেচনা করা হবে ততদিন পরিবার বা দেশ উন্নতি করতে পারবে না। অন্যান্য অধিকারের জন্য আমরা জাতীয় বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। কিন্তু পরিবারকে আমরা কাজী এবং ধর্মতাত্মিকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। আমি জানিনা কেন আমরা নারীকে অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছি। সে কি জাতির জন্যে কাজ করে না? অথবা সে কি তার সূঁচকে তীক্ষ্ম বেয়নেটে রূপান্তরিত করে বিপ্লবের মাধ্যমে আমাদের কাছ থেকে অধিকার ছিনিয়ে নেবে? (IBID পৃঃ ১৬১)
ডঃ মোহাম্মদ ইকবাল তার ‘ইসলামী চিন্তার পুনর্গঠন’ গ্রন্হে লিখেছেন- জিয়া গোকলপের ইজতিহাদ প্রায়ই আপত্তিকর। (পৃঃ ১৬০) তুর্কী কবির দাবীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি খুবই আশঙ্কিত যে তিনি ইসলামের পারিবারিক আইন সম্পর্কে খুব বেশী কিছু জানতেন না। (পৃঃ ১৬৯)
জিয়া গোকলপের স্বাদ ছিল ইসলামকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধর্মে সংস্কার করা। ধর্মের আধুনিকীকরণ ও বিজ্ঞানিকরণ দ্বারা তিনি মসজিদকে খৃষ্টীয় গীর্জার মত বানাতে চেয়েছিলেন। তার মৃত্যুর বার বছর পর ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকালটি অফ ডিভাইনটি বা ঐশ্বরিক অনুষদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ পাঠানোর জন্যে একটি কমিটি নিয়োগ করলে তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হয়। ১৯২৮ সালের জুনে প্রকাশিত কমিটির রিপোর্ট অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে প্রার্থনাকে ‘সুন্দর’ ‘উৎসাহব্যঞ্জক’ এবং ‘আধ্যাত্মিক’ করার জন্যে মসজিদে বসার আসন, ক্লোকরুম চালু, জুতা নিয়ে নামাজ আদায়, প্রার্থনার ভাষা হিসেবে তুর্কী ভাষা চালু, আরবী বিলোপ, প্রার্থনায় সেজদার নিয়ম বাতিল, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বাদ্যযন্ত্রী এবং বাদ্য যন্ত্র রাখার সুপারিশ করা হয়। পশ্চিমী আধুনিক যন্ত্র সঙ্গীত মসজিদে চালুর জন্যে বিষয়টি খুবই জরুরী।[The Emergence of Modern Turkey. Bernerd Lewis p-408.]
তুর্কী মুসলমানরা দুনিয়ার অন্যান্য মুসলমানের মত ধর্মনিষ্ঠ হওয়ায় জিয়া গোকলপের হাতে ইসলামের এই অঙ্গহানি মেনে নিতে অস্বীকার করেন। দারুন ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে অতঃপর এই প্রকল্প প্রত্যাহৃত হয়।