প্রথম অধ্যায়
আমার প্রতি জামাল নাসেরের ব্যক্তিগত আক্রোশ
উনিশ-শো চৌষট্রি সালের ফেব্রুয়ারী মাসের এক মনোরম বিকেলে নিজের গাড়িতে করে বাড়ি ফিরছিলাম। হটাৎ বিপরীত দিক থেকে অন্য একটি গাড়ী এসে প্রচণ্ড বেগে আমার গাড়ীটিকে ধাক্কা মারে এবং সাথে সাথেই আমার গাড়ীটি উল্টে পড়ে যায়। এই অভাবিত-পূর্ব দুর্ঘটনায় আমি গুরুতরভাবে আহত হয়ে পড়ি এবং যন্ত্রণায় তীব্রতায় প্রায় সম্বিৎ হারিয়ে ফেলি। তখন ঘটনাস্থল এবং তার আশেপাশে কারা কোন তৎপরতায় লিপ্ত ছিল, সে সম্পর্কে কিছু অনুমান করার মতো অবস্থাও আমার ছিল না। অবশ্য মনে হচ্ছিল, কে যেন বার বার আমাকে ডাকছে।
সম্বিৎ ফিরে দেখিতে পাই, আমি পুলিশ হাসপাতালের শয্যায় শায়িত। আমার এক পাশে প্রিয়তম স্বামী ও ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজন এবং অন্যপাশে ইসলামী আন্দোলনের কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মী দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের প্রত্যেকের চেহারায় ছিল ভয় এবং উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। আমি বেঁচে গেছি বলে আল্লাহ্র শোকর আদায় করি এবং দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানার জন্যে ওদের কিছু জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে আবার সম্বিৎ হারিয়ে ফেলি।
পুনরায় জ্ঞান ফিরে এলে দেখি, একজন মহিলা ডাক্তার তার সহযোগীদের নিয়ে আমাকে এক্সরে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসছেন। তখন একে একে পূর্বাপর সব ঘটনা আমার মনে পড়ছিল। আমি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছি বলে আমার স্বামী তখনো ভক্তিতে গদগদ কণ্ঠে আল্লাহ্কে শুকরিয়া জানাচ্ছিলেন। আমি আমার গাড়ীর ড্রাইভার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান –“ ড্রাইভার সুস্থই আছে। সামান্য আঘাত পেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে”। পরে জেনেছি যে, ওর মাথা এবং মস্তিস্কে চোট লেগেছে। এদিকে এক্সরে রিপোর্ট মোতাবেক আমার উরুর হাড় ভেঙ্গে গেছে। সুতরাং অস্ত্রোপচারের জন্য “আমাকে মাযহার আশুর” হাসপাতালে পাঠানো হয়। এখানে প্রখ্যাত সার্জন মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ আমার অজ্ঞান অবস্থায় সাড়ে তিন ঘণ্টা স্থায়ী অপারেশন কার্য চালিয়ে আমাকে বিপদমুক্ত করেন।
বিপদসংকুল কয়েকটি দিন কেটে যাওয়ার পর আমি বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারি যে, প্রেসিডেন্ট জামাল নাসেরের গোয়েন্দা বাহিনীই আমাকে হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরের ঘটনাবলী দ্বারা এর সত্যতা আরও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। সরকারী সন্ত্রাসের সেই দুর্যোগপূর্ণ দিনগুলোতেও ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবী কর্মীরা আমার অবস্থা জানার জন্য নিয়মিত হাসপাতালে আসতো। হাসপাতালের বাইরে সরকারী গুপ্তচর বাহিনীর লোক মোতায়েন ছিল। দেশের প্রতিকূল পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত অবগতির পর জনগণ এবং আন্দোলনের বৃহত্তর স্বার্থে আমি কর্মীদের তাদের প্রিয় নেতা ভাই আব্দুল ফাত্তাহ আবদুহ ইসমাইল শহীদের মাধ্যমে আমাকে দেখার জন্য হাসপাতালে আসতে বারণ করি। কিন্তু দেখে বিস্মিত হয়েছি যে, কর্মীরা কোন প্রতিকূল অবস্থার চাপ মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। কয়েকদিন পর সরকারী প্রশাসনের সেক্রেটারী আমার অনুমোদনে এর স্বাক্ষর লাভের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিয়ে হাসপাতালে উপস্থিত হয়। বলা বাহুল্য, আমি সংস্থার সভানেত্রী বলে আমার কাছে তার আসা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আমার স্বামী সেক্রেটারিকে দেখা মাত্রই উঠে তার হাত থেকে ফাইল কেড়ে নিয়ে ওকে নিয়ে কক্ষের বাইরে চলে যান। তাদের কথাবার্তায় প্রকাশ পেলো যে, এর আগেও একবার সেক্রেটারীকে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেয়া হয়নি। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগেনি। আমি আমার স্বামীকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি সংক্ষেপে কেবল এতটুকুই বলেন- “আমি ডাক্তারের হুকুম পালন করছি মাত্র”।
পরে ডাক্তার এসে আমার ক্ষতস্থান পরীক্ষা করেন এবং আমাকে সব রকমের কাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরো জানান যে, ফাইলে বিভিন্ন কাগজপত্র এবং তথ্যাদি ছিল। কিন্তু ওসব আপনার কাছে পৌঁছানো নিষেধ আছে। আমি সাথে সাথেই তাঁর একথার প্রতিবাদ করে বলি যে,এসব কাগজপত্র এমন কোন ভয়ঙ্কর কিছুতো নয় যে, তা আমার কাছে পৌঁছাতে দেয়া হচ্ছে না। বস্তুতঃ ওসব দলিলপত্র সাক্ষরের জন্য আমার কাছে পৌঁছানোই উচিৎ। কিন্তু তিনি আমাকে ফাইল দিতে অস্বীকার করেন। এর কয়েকদিন পর আমি শয্যায় বসে সংস্থার কিছু কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করি। কিন্তু তাও প্রত্যাখ্যান করা হয়। এসব দেখে-শুনে আমার সন্দেহ বিশ্বাসে রুপান্তরিত হলো যে, নিশ্চয়ই এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটেছে, যা এঁরা ইচ্ছাকৃত ভাবেই আমার কাছ থেকে লুকোবার চেষ্টা করেছেন। আমার স্বামী, প্রাইভেট সেক্রেটারি, এমনকি সংসদের কার্য্যনির্বাহী পরিষদের সাধারণ সম্পাদিকার কোন কোন আলোচনা থেকেও এটা বোঝা যাচ্ছিল যে, এরা সবাই আমার কাছে ঘটনা বিশেষ গোপন রাখার চেষ্টা করেছেন।
যা আশংকা করছিলাম, শেষ পর্যন্ত তাই হলো। পরদিন বিকালে সরকারী সচিবালয়ের মহিলা সেক্রেটারি আমার স্বামীর উপস্থিতিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করেই আমার কাছে এগিয়ে এলেন। প্রকৃত ঘটনা খুলে বলার আগে তিনি আমাকে ধৈর্য্য ও সাহসিকতার সাথে যেকোনো কথা শুনার জন্য মানসিক প্রস্তুতি অর্জনের পরামর্শ দেন। এরপর বিন্দুমাত্র ইতস্ততঃ না করে আমার সামনে ফাইল খুলে ধরেন। দেখি যে, ফাইলে সেই অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজটি, যা আমার কাছ থেকে লুকানো চেষ্টা চলছিল তা আর কিছু নয়,-আমাদের মহিলা সংস্থাকে নিষিদ্ধ ঘোষণার সরকারী ফরমান মাত্র।
সরকারের মহিলা সেক্রেটারী আমাকে সাময়িক সান্তনা দেয়ার জন্য বলছিলেন-স্বভাবতই, এতে আপনার ভীষণ দুঃখ পাওয়ার কথা। “আল্লাহ্কে অশেষ ধন্যবাদ, কিন্তু মহিলা সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা আরপের কোন যুক্তি বা সাংবিধানিক ক্ষমতা সরকার কোথায় পেলো?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকারের সামনে এ প্রশ্ন তুলে ধরার মতো কোন একজন লোক ও এখন মুক্ত নয়। আমার আমাদের পর্যায়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু জামাল নাসের ইসলামী মহিলা সংস্থাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে দৃঢ়সংকল্প। সে ব্যক্তিগত ভাবে আপনার উপর দারুণ নাখোশ; এমন কি, কারো মুখে আপনার নাম পর্যন্ত তার অসহ্য। কেউ অজান্তে আপনার নাম উচ্চারণ করলে তিনি এমনই বিরুপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেন, যা বলার মতো নয়। আপনার ব্যক্তিত্ব এবং আন্দোলন তার স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে যেন’। সরকারী সেক্রেটারীর কথা শুনে আমি বললাম –“ আল্লাহ্র শোকর যে, নাসের শুধু এই জন্যেই আমাকে এবং দলকে ভয় করে যে, আমরা মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্যে ইসলামী সমাজ কায়েমের আন্দোলন চালাচ্ছি। আর নাসেরের প্রতি আমার অসন্তুষ্টির মূল কারণ হচ্ছে, সে জনগণের ইসলামী দাবী উপেক্ষা করে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী চক্রের পদলেহন করছে। যাই হোক, সে অনতবিলম্বেই টের পাবে যে, সরকারী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আমাদের হত্যা করে বা জেলে পুরে রেখে ইসলামী আন্দোলনকে স্তব্ধ করা সম্ভব নয়। ইসলামী আন্দোলন তার স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যাবেই। দুনিয়ার কোন শক্তিই এই আন্দোলনের সামনে বেশী দিন টিকে থাকতে পারবে না। আল্লাহ্র দ্বীনের মুজাহিদদের দূর্বার অভিযানের সামনে এসব তথাকথিত শক্তি খড়কুটোর মতো উড়ে যেতে বাধ্য। আল্লাহ্ আমাদেরকে গঠনমূলক এবং সৃজনশীল কাজ করতে বলেছেন এবং ধ্বংস ও বিকৃতির কাজে রুখে দাঁড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন”।
আমার কথা শুনে সচিবালয়ের সেক্রেটারী অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন- “সম্মানিত সভানেত্রী! আমি যথার্থভাবেই আশা করি যে, আপনার দলের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে”। এরপর এদিক ওদিক দেখে ঈষৎ চাপা স্বরে বললেন “এখানে কোন গোপন মাইক্রোফোন লুকিয়ে রাখা হয়েছে কিনা, ভয় হচ্ছে। জানেন তো, দেয়ালেরও কান আছে”। এবার সরকারী সচিবালয়ের সেক্রেটারী গুপ্ত পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে আশেপাশে দৃষ্টি রেখে বললেনঃ “মহামান্য সভানেত্রী ! আপনার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ , অনুগ্রহ করে এই কাগজটিতে স্বাক্ষর করুন। এতে স্বাক্ষর করার সাথে সাথেই আপনার দলের উপর সরকারী নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নাকচ হয়ে যাবে”।
পড়ার জন্যে কাগজখানা হাতে নিয়ে আমার ক্ষোভ আর বিস্ময়ের সীমা রইলো না যে , এটি হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারী সমাজতান্ত্রিক দলে যোগদানের আবেদন পত্র।
আমি কয়েক মুহূর্ত যেন পাথর হয়ে রইলাম। এরপর সব তিক্ততা হজম করে জামাল নাসেরের সেক্রেটারীকে বললাম-
সেক্রেটারী, কোন সৎকাজ পেলে গিয়ে করোগে। মনে রেখো এবং নাসের কে জানিয়ে দিও, তার মতো অতাচারি শাসকের পক্ষ সমর্থনে স্বাক্ষর করার আগে আমার হাত যদি জ্বলে পুড়ে গলে যায়,তাও ভালো। জামাল নাসের আল্লাহ্ এবং ইসলামের বিরুদ্ধে অন্যায় তৎপরতায় লিপ্ত। সে জনগণের দুশমন; জননেতা আব্দুল কাদের আওদাহ এবং অসংখ্য বিপ্লবী মুসলমানের না হোক রক্তে রঞ্জিত তার কলঙ্কিত হাত। তার মতো নিষ্ঠুর জালিমের পক্ষ অবলম্বনের চেয়ে আমার দলের অবলুপ্তি মেনে নেয়াই আমার কাছে অগ্রগণ্য।
এরপর সরকারী সচিবালয়ের সেক্রেটারী আমার হস্ত চুম্বন করে বললো-
:মা, আপনি কি আমাকে মেয়ে বলে মেনে নিতে পারেন?
:কেন নয়? আমি বললাম।
:তাহলে, ও প্রসঙ্গ ছাড়ুন, তার চেয়ে ………
:না, কোন বৃহত্তর কোরবানির বিনিময়েও জামাল নাসেরের অত্যাচারী শাসনের সমর্থনে স্বাক্ষর করা সম্বভ নয়। মিথ্যের সাথে সত্যের মিত্রতা অচিন্তনীয়। তুমি আসতে পার,সেক্রেটারী!
ক্রমশঃ সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালের দিনগুলো ফুরিয়ে আসে। আমি গৃহে ফিরে যাই।
আমি এবং সমাজতন্ত্রী ইউনিয়ন
এরপর বলতে গেলে প্রায় রোজই সচিবালয়ে সেই মহিলা সেক্রেটারী আমার কাছে আসতে থাকেন। একদিন এসে তিনি বললেন-
: সুসংবাদ মাদাম! আপনার সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হয়েছে।
শুনে বিস্মিত হলাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম-
:তা কেন?
:আমি সঠিক কিছু জানিনে। তবে মনে হচ্ছে, এরকম হতে পারে যে আপনার সাথে সরকারীভাবে যোগাযোগ এবং আলোচনার জন্যে পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে। এভাবে সরকারী প্রশাসনের সেক্রেটারী আমার কাছে বিভিন্ন তথ্যাদি নিয়ে আসতে থাকেন এবং আমিও নিজ বাসস্থান থেকে দলীয় কাজকর্ম এবং তৎপরতা পরিচালনা করতে থাকি। কিছুদিন পর প্লাস্টার খোলার জন্যে হাসপাতালে গিয়ে জননেতা জনাব সাইয়েদ কুতুবের মুক্তির সংবাদ পাই। তিনি কারাগারে থেকেই আমার সড়ক দুর্ঘটনার খবর পান এবং মুক্তিলাভের পরপরই আমাকে দেখার জন্যে হাসপাতালে ছুটে আসেন।
এর কয়েকদিন পর সরকারের ডাকে একখানা রেজিস্ট্রী কার্ড পাই। কার্ডের বিবরণ ছিল ঠিক এরকম-
আরব সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়ন-
স্বাধীনতা-সমাজতন্ত্র-সংহতি-
নাম-জীনত আল-গাজালী আল-জুবাইলী।
ওরফে-জীনত আল গাজালী।
পদ/পেশা-ইসলামী মহিলা সংস্থার সভানেত্রী।
ইউনিট-আলবাসায়ীন-আলমাজা।
বিভাগ-নয়া মিশর।
জেলা-কায়রো।
এই কার্ডের সাথে একই ডাকে আরো একটি বিস্তারিত দস্তাবেজ আসে। এই দস্তাবেজ হচ্ছে ১৯৬৪ সালের মিশর-সোভিয়েত সম্পর্কের একটি প্রমানপত্র।
এরপর ধারাবাহিকভাবে সরকারী দলের পক্ষ থেকে চিঠি এবং আমন্ত্রন পত্রাদি আসতে থাকে। তাদের বিভিন্ন সভা-সম্মেলনে অংশ গ্রহণের জন্যেও আমন্ত্রন জানানো হয়।কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম, এ ধরণের কোন চিঠি-পত্রের জবাবই দেবোনা। ইতিমধ্যে পরিপূর্ণভাবে আরোগ্য লাভের পরিপ্রেক্ষিতে ডাক্তার আমাকে দলীয় কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করার অনুমতি দেন।
একদিন ইসলামী মহিলা সংস্থার সদর দপ্তরে আমার ব্যক্তিগত সেক্রেটারী জানায় যে, সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। আমি রিসিভার তুলে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বললাম। অপর প্রান্ত থেকে জবাব এলোঃ
:ওয়া আলাইকুমুস সালাম।
:আপনি কে বলছেন?কাকে চাই এবং কেন? একই সাথে তিন তিনটি প্রশ্ন করে জবাব তলব করলাম আমি।
আপনি যদি মুহাতারেমা জীনত গাজালী হয়ে থাকেন তাহলে সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আপনাকে অনুরোধ করার প্রয়োজন মনে করছি যে, মেহেরবানী করে প্রেসিডেন্ট জামাল নাসেরকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্যে আপনার নেতৃত্বে ইসলামী মহিলা সংস্থার বোনেরা বিমান বন্দরে এলে আমরা খুব খুশী হব।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে ও প্রান্ত থেকে আবার বললো-
:আপনার আদেশ পেলে মোটর গাড়ি পাঠিয়ে দেবো এবং তা সব সময় আপনার ব্যবহারের জন্যই থাকবে।
:না, ধন্যবাদ বলে আমি রিসিভার রেখে দেই। দু’তিন দিন পর সমাজতান্ত্রিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আবার টেলিফোন আসে। এবার এক ভদ্রমহিলা জানতে চাইলেন-
আপনারা প্রেসিডেন্টকে স্বাগতম জানাবার জন্যে বিমানবন্দরে উপস্থিত হননি কেন?
আমি বললাম –“আমাদের সংস্থার কর্মীরাও কোথাও যাওয়া না যাওয়ার ব্যপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন। তাছাড়া আমরা ইসলামী শিক্ষার অনুসারী। এমন কোথাও যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, যেখানে মান-সম্ভ্রম এবং শালীনতার প্রশ্ন জড়িত………
মনে হচ্ছে আপনারা আমাদের সমর্থন করতে প্রস্তুত নন। তা আপনি না হয় আসেননি, কিন্তু অন্যান্য মহিলাদের কি বিমান বন্দরে পৌঁছানোর আদেশ দেননি?
:না, যে ব্যাপারকে আমি নিজের জন্যে অনুচিত মনে করি, সে ব্যাপারে অন্য কাউকে আদেশ দেয়ার তো প্রশ্নই ওঠেনা।
:এর অর্থ হচ্ছে আপনারা কোনক্রমেই আমাদের সাথে সহযোগিতা করবেন না।
:হ্যাঁ করবো, কেবল ইসলামের পথে। আপনারা যদি আল্লাহ্র নির্দেশিত পথের অনুসরণ করেন তাহলে প্রতি কদমে আমাদের সহযোগিতা পাবেন, অন্যথায় সত্য-মিথ্যার সংঘাত অব্যাহত থাকবে।
:আপনি কি আলোচনার জন্যে আমাদের দফতর পর্যন্ত আসতে পারেন?
: না , আমি এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ নই। তবে আপনার পক্ষে সম্ভব হলে আমার গরীবালয়ে আসতে পারেন-এই রিসিভার রেখে দিই। এই টেলিফোন আলোচনার সপ্তাহ খানেক পর ১৫/৯/১৯৬৪ তারিখের একটি রেজিষ্ট্রী চিঠি আমার নামে পাঠানো হয়। এতে ৬/২/১৯৬৪ তারিখের একটি মন্ত্রীপর্যায়ের সিদ্ধান্ত ছিল। এর নম্বর ছিল ১৩২। এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক ইসলামী মহিলা সংস্থাকে দ্বিতীয় বারের মতো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় আর সে সংবাদই পাঠানো হয়েছে রেজিষ্ট্রী ডাকে।
খোদাদ্রোহীদের জন্য নয়
ঊনিশশো চৌষট্রির পনেরই সেপ্টেম্বর, সরকারের পক্ষ থেকে ইসলামী মহিলা সংস্থাকে নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় সংস্থার এক জরুরী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে সরকারী সিদ্ধান্ত মেনে নিতে এবং দলীয় তহবীল সরকার বা কোন দল বিশেষকে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। বৈঠকে পরবর্তী বিশেষ জরুরী বৈঠক ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অনুষ্ঠানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং বৈঠকে সরকারের সিদ্ধান্ত অমান্য করার এবং সরকারের সেই অবৈধ সিদ্ধান্তকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করার ফয়সালা গ্রহণ করা হয়।
আমরা সংস্থার পক্ষে মামলায় প্রতিনিধিত্ব করার উদ্দেশ্যে প্রখ্যাত আইনজীবী জবাব আব্দুল্লাহ, রিশওয়ানকে কৌশলী নিযুক্ত করি এবং সাথে সাথেই এ ব্যাপারে বিস্তারিত বিবরণাদি প্রেসিডেন্ট, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পত্র-পত্রিকায় পাঠাই। আমরা এসব পত্রে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেই যে, ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী মহিলা সংস্থার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী আদর্শের প্রচার ও প্রসার এবং দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে মুসলিম মহিলাদের ইসলামী পতাকাতলে সংঘবদ্ধ করা। সরকার বা স্বরাষ্ট্র দফতর আমাদের সংস্থার পৃষ্ঠপোষক নয় যে, তাদের অবৈধ কোন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যে সংস্থাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে। আমরা সরকারের এহেন যে কোন সিদ্ধান্ত বা ঘোষণা মেনে নিতে বাধ্য নই বরং সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান পুনরাবৃত্তি করছি যে, আল্লাহ্র দুনিয়াতে আল্লাহ্র দেয়া জীবন-বিধান বাস্তবায়নের মহান লক্ষ্যে সরকার আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। এক্ষেত্রে আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
কিন্তু জামাল নাসেরের ক্ষমতার নেশা এবং ইসলাম বিরোধিতার এমন উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল যে, সে কোন ন্যায় বা সত্যকে বিবেচনাযোগ্য মনে করতেই রাজী ছিলনা। আমার প্রতি তার শত্রুতাপূর্ণ মনোভাবের কারণেই সে তড়িঘড়ি যেমন ইসলামী সংস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করে তেমনি আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকাটিকেও অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বন্ধ করে দেয়। এসব অবৈধ কর্মে সে সামরিক শক্তির সাহায্য নিতেও ইতস্ততঃকরেনি। তারা হটাৎ সংস্থার সদর দফতরে অনাধিকার প্রবেশ করে দফতর এবং তার সব আসবাব-পত্রের উপর জবর দখল কায়েম করে। এমনকি, সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সংলগ্ন এতিমখানার মাসুম গরীব শিশুদের ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। জবর দখলের জন্য তারা এমন সময় বেছে নেয়, যখন সদর দফতরে আমাদের কোন কর্মকত্রীই উপস্থিত ছিলেন না। কেবল সহকারী দফতর সম্পাদিকা তখন কাজ করছিলেন। সরকারী জবরদখলকারীরা তাঁর কাছ থেকেই নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা কেড়ে নেয় বলে দাবী করে। পরদিন আমি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের জন্যে নিম্নলিখিত বিবৃতি দেই।
“১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী মহিলা সংস্থা একটি নিয়মতান্ত্রিক ইসলামী সংগঠন। মানুষের যাবতীয় সমস্যার সুষ্ঠু ও স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে আল্লাহ্র দেয়া জীবন ব্যবস্থা আল-ইসলামকে পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করাই হচ্ছে সংস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য। বস্তুতঃ সর্বময় ক্ষমতার মালিক আল্লাহ্, এবং আল্লাহই আমাদের প্রভু এবং জনসাধারণের উপর ব্যক্তি শাসন প্রতিষ্ঠার প্রবণতাকে নিন্দনীয় মনে করি।
আমরা, ইসলামী মহিলা সংস্থার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সরকারী ফয়সালা দ্ব্যর্থহীনভাবে নিন্দা করি এবং তা মেনে নিতে অস্বীকার করছি। আমরা এও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই যে, উড়ে এসে জুড়ে বসা জামাল নাসেরের মুসলিম জনগণের উপর শাসন চালানোর কোন নৈতিক অধিকার নেই। তার পদ এবং মন্ত্রী পরিষদ উভয়ই অবৈধ।
আমরা আরও স্পষ্ট করে দিতে চাই যে, জোর-জুলুম চালিয়ে এবং অত্যাচার ও চক্রান্তেরর মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করা যাবে না। কোন রকমের দফতর, তহবিল বা আসবাবপত্র ছাড়াও ইসলামী আন্দোলন অব্যাহত থাকবেই। দুনিয়ার কোন শক্তি আমাদের বিশ্বাস, বলিষ্ঠ প্রেরণার উৎস কেড়ে নিতে পারবে না। আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর অবিচল আস্থা এবং বিশ্বজনীন ইসলামী ভ্রাতৃত্ব আমাদের অগ্রগতিকে অপ্রতিরোধ্য রাখবে। সত্যের পথে অবিরাম জিহাদই হচ্ছে আমাদের কর্মপন্থা। ইসলামী বিপ্লবের মহান লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলতে থাকবে”।
আমরা কি করবো?
ইসলামী মহিলা সংস্থার সদর দফতরে সরকারী জবরদখল কায়েমের পর বিভিন্ন মহিলা প্রতিনিধিদল আমার কাছে এসে পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে পরামর্শ করে এবং পথনির্দেশ চায়।
ঊনিশশো চৌষট্রি সালকে এক হিসেবে নাসের শাহীর উত্থানের চরম বছর বলা যেতে পারে। এ সময় এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, তার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে টু-শব্দ করাকে দস্তুর মতো দুঃশাসন মনে করা হতো। ইতিমধ্যে প্রখ্যাত ইসলামী আন্দোলন Muslim Brotherhood বা ইখওয়ানুল মুসলিমুনের ছোট-বড় প্রায় সব নেতাকেই বিভিন্ন মিথ্যা বা বানোয়াট অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। ফলে সরকারের গনবিরোধী কার্যকলাপের সমালোচনা করার মতো কেউ অবশিষ্ট ছিল না। অন্যদিকে সুবিধাবাদী এবং স্বার্থসন্ধানী রাজনীতিকরা নাসেরের পদলেহন করে স্বার্থসিদ্ধির মোক্ষম সুযোগের সদ্ব্যবহার করছিল। এমনকি কোন কোন ধর্মীয় নেতা এবং কতিপয় ধর্মীয় পত্রিকাও তখন নাসের শাহীর স্তুতিকেই অপেক্ষাকৃত মঙ্গলজনক মনে করছিলেন। বিখ্যাত আরবী পত্রিকা আল-আজহারে-ও এমন সব প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রকাশ পাচ্ছিল, যা অত্যাচারী শাসক গোষ্ঠীর ন্যাক্কারজনক ভূমিকা যুক্তিভিত্তিক মানদণ্ডে প্রতিষ্ঠার অপপ্রয়াস বলেই গণ্য হওয়ার যোগ্য।আর যারা ইসলামী আন্দোলনের নিবেদিত প্রাণ, মুখোসধারী পত্র-পত্রিকা তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের বান ছুঁড়তে ব্যস্তই ছিল। জুলুম-ত্রাসের এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও ইসলামী আন্দোলনের নির্ভীক মুজাহিদরা সত্যের পতাকা বুলন্দ রাখেন। শত নির্যাতন-নিষ্পেষণ সত্ত্বেও তাদের মনোবল টুটে যায়নি; তাদের তৎপরতায় আসেনি এতটুকু শৈথিল্য, ম্লান হয়নি তাদের মুখের মিষ্টি হাসি।
মুসলিম মহিলারাও এক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা পার্থিব স্বার্থ অর্জনের চেয়ে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের পথে দুঃখ হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন। ভয়-ভীতি এবং বাধাবিপত্তির বিদ্ধাচল অতিক্রম করে তাঁরা নিয়মিত আমার কাছে আসতেন নতুন উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে। এমন দুর্দিনেও তারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় ঘরোয়া বৈঠক এবং সাধারণ সমাবেশের আয়োজন করেন। এ সময় আমরা মহিলা বক্তাদের প্রশিক্ষন দেয়ার কার্যক্রম হাতে নেই। এভাবে প্রশিক্ষন-প্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে আন্দোলনের প্রচার কার্য চালানো এবং মহিলাদের সংঘবদ্ধ করার জন্যে দেশের সর্বত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু অনতিবিলম্বেই সরকারের কঠোর দমন নীতির ফলে আমাদের এই পরিকল্পনা তখনকার মতো স্থগিত রাখতে হয়। এরপর আন্দোলন ব্যক্তিগত পর্যায়ের তৎপরতা পর্যন্ত সীমিত হয়ে পড়ে।
টালবাহানা ও প্রতারণা
এর কিছুদিন পরে জামাল নাসেরের গুপ্তচর বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা আমার সাথে সাক্ষাৎ করে ইসলামী মহিলা সংস্থাকে পুনর্জীবিত করার ব্যাপারে বিভিন্ন প্রস্তাব ও শর্ত আরোপ করে। তারা আমাকে আমার পত্রিকাও ফিরিয়ে দেয়ার শর্ত সাপেক্ষে প্রস্তাব করে। এছাড়া আমাকে মাসিক তিনশো মিশরীয় পাউন্ড ভাতা দেয়ারও প্রস্তাব করে। কিন্তু এসব কিছুর বিনিময়ে তারা চায় আমি যেন ইসলামী আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখি।
আমি তাদেরকে বললাম-
:আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের বিনিময়ে দুনিয়ার সব সম্পদ এবং সব শক্তিকেও আমি অতি তুচ্ছ মনে করি। আমি আপনাদের এসব প্রলোভন এবং শর্ত সাপেক্ষ প্রস্তাবাবলী প্রত্যাখ্যান করছি।
আমার স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও গুপ্তচর বাহিনীর কর্মকর্তারা পুণরায় আমাকে বলে-
“দেখুন, আপনার সংস্থা যদি সরকারী দলের সহায়ক দল হিসেবে ময়দানে আসতে চায় তাহলে অতি শিগগীরই তা পুনর্জীবিত করা হবে এবং বার্ষিক কুড়ি হাজার পাউন্ডের বিশেষ ভাতাসহ আপনাকে আপনার সদর দফতরও ফিরিয়ে দেয়া হবে”।
এর জবাবে আমি তাদের বললাম-
“আপনারা বারবার একটি ভ্রান্তির পুনরাবৃত্তি করে চলেছেন। আপনাদের জানা উচিৎ যে, ইসলামের পথ থেকে কোন লোভ বা ভয়ভীতি আমাদের বিচ্যুত করতে পারেনা। ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত নই। আমরা নিজেরা যেমন বিভ্রান্ত নই, তেমনি অন্য কাউকেও বিভ্রান্ত করার কথা চিন্তা করতে পারিনা। কোন রকমের গোঁজামিল বা অস্পষ্টতায় আমরা বিশ্বাস রাখিনা। আপনারা আসতে পারেন”। এরপরও তারা বিভিন্ন উদ্দেশ্যমূলক প্রস্তাবাবলী পেশ করতে থাকে এবং কোন না কোনভাবে আমাকে আপোষে আনার চেষ্টা চালায়। তাদের এই হাস্যকর প্রয়াসে আমি বিস্মিত হই এবং এটাকে কোন নতুন সরকারী নাটকের অনুশীলন বলেই অনুমান করি। বস্তুত আমার সেই অনুমান যে সত্য ছিল, শিঘ্রই তা প্রমাণিত হয়। তাদের সব প্রয়াসই ছিল পরবর্তী ষড়যন্ত্রের পটভূমি মাত্র।
রাতের উল্লুক
একদিন বিকেলে তিন ব্যক্তি আমার বাড়ি পৌঁছে আমার সাথে সাক্ষাতের আবেদন জানায়। আমি অতিথিদের সাক্ষাতের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে গিয়ে দেখি, তিনজনই আরবী পোষাক পরিহিত। সালাম বিনিময়ের পর আমি তাদের এখানে আমার কাছে আসার উদ্দেশ্য জানতে চাইলে তাদের একজন বললো-
“আমরা সিরীয় নাগরিক। বর্তমানে সৌদী আরব থেকে সংক্ষিপ্ত ছুটি কাটানোর জন্য কায়রো এসেছি। আমরা সউদী আরবের ইখওয়ান নেতা সাঈদ রমজান, শেখ মোস্তফা আলম, কামেল শরীফ, মুহাম্মাদ উসমাভী এবং ফতহী খোলির সাথে সাক্ষাৎ করে এসেছি। (উল্লেখযোগ্য যে এসব নেতা, জামাল নাসেরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সউদী আরবে নির্বাসন নিতে বাধ্য হয়।) তাঁরা মিশরীয় জনগণের কাছে সালাম ও শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন এবং আন্দোলনের প্রতি জনসাধারণের অবিচল আস্থা কামনা করেন”।
এরপর তিন ভদ্রলোক ইখওয়ান এবং জামাল নাসের সম্পর্কে নিজেরাই আলোচনা করতে থাকে। নাসের ইখওয়ানের উপর যেসব জুলুম নির্যাতন চালিয়েছে, ১৯৫৪ সালে ঘটনাবলী এবং আবদুল কাদের আওদাহ ও তাঁর সহকর্মীদের শাহাদাতের ব্যাপারে নিয়ে অনেক আলোচনার পর আমাকে বলে যে, দেশে বিদ্রোহ সৃষ্টি এবং নাসেরকে হত্যার জন্য তারা প্রস্তুত আছে এবং নির্বাসিত ইখওয়ান নেতৃবর্গ এ ব্যাপারে তাদের সাথে একমত। এরপর তারা জিজ্ঞাসুনেত্রে আমরা দিকে তাকায়। আমি এতক্ষন চুপচাপ- কেবল তাদের কথা শুনছিলাম। এবার আমি বললাম- “আপনারা যে উদ্দেশ্য বর্ণনা করলেন, তা আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন বিষয় এবং পরিভাষা বলে মনে হচ্ছে। আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানিনে এবং জানতেও চাইনে”।
আমার কথা শুনে তারা বললো- “তাহলে আমরা মুর্শিদে আম এবং দলের মতামত জানার জন্যে পরে আবার আপনার কাছে আসবো”।
আমি বললাম –“আমি ইখওয়ানের কোন গুপ্ত দল সম্পর্কে কিছুই জানিনে।তাছাড়া রাজনৈতিক দল হিসেবে সরকার ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আমি এ ব্যাপারে মুর্শিদে সাথে কোন রকমের আলাপ-আলোচনা করতে অক্ষম। কারণ ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও পারিবারিক মিত্রতার উপরও আমাদের সম্পর্ক স্থাপিত। আমার মতে জামাল নাসেরকে হত্যা করার মতো কোন কথা কোন মুসলমানই চিন্তা করছে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাদের নিজ দেশে ফিরে গিয়ে আত্মশুদ্ধি অর্জনের পরামর্শ দেয়া ছাড়া আর কোন সেবা করতে সক্ষম নই”।
আমার কথা শেষ হবার পর ওদের একজন বললো-
“আপনি সম্ভবতঃআমাদের উপর অসন্তুষ্ট। কিন্তু বলুনতো, নাসের কি দেশকে ধ্বংস করে ছাড়েনি?”
“কিন্তু নাসেরকে হত্যা করা ইখওয়ানের উদ্দেশ্য নয়”।
আমি এই বলে তাদের নাম জানতে চাইলাম। নাম বলতে গিয়ে তারা তিন জনেই থতমত খেলো যেন। কিছুটা ইতস্ততঃকরে একজন বলল তার নাম আবদুশশাফী আবদুল হক, অপরজনের নাম আবদুল জলীল ঈষা এবং তৃতীয় জনের নাম আবদুর রাহমান খলিল। তাদের নাম বলার ঢং এবং প্রত্যেকের নামের আগে আবদু শুনে আমি আর হাসি লুকাতে পারলাম না, যা বোঝার দরকার তা বুঝে আমি তাদেরকে বললাম-
“ভায়েরা আমার, নাসেরের গুপ্তচর বাহিনীর হাতে ধরা পরে হেস্তনেস্ত হবার আগে শিগগীর স্বদেশে ফিরে যাওয়াই আপনাদের জন্যে উত্তম”।
এর জবাবে একজন বলল- “আপা জীনত! আমাদের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করার অধিকার আপনার অবশ্যই রয়েছে। তবে, এটা আপনি শিগগীরই জানতে পারবেন যে, আমরা কারা!” এরপর তারা চলে যায়।
পরে আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল আমার কাছে সাক্ষাতের জন্যে এলে আমি তাঁকে এসব কৃত্রিম নিরীহ নাগরিকদের কাহিনী বর্ণনা করি।
সবাই আহমদ রাসেখ
এরপর দু’সপ্তাহ ও কাটেনি, একদিন আহমদ রাসেখ নামে এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ভদ্রলোক তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে জানান যে, তিনি গোয়েন্দা বাহিনীর লোক। কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থাকার পর, সপ্তাহ দু’য়েক আগে সেই তিন জন সিরীয় নাগরিকের সাথে আমার কি আলোচনা হয়েছিল তা জানতে চাইলেন।
আমি নির্লিপ্ত ভাবে বললাম-
“আমার যতটুকু বিশ্বাস, সেই তিন ভদ্রলোক মোটেই সিরীয় নাগরিক নন। আসলে ওরা আমাকে বোকা মনে করেই এসেছিলেন’ আরো বোকা বানানোর উদ্দেশ্যে। আমার পত্রিকা এবং সদর দফতর ছিনিয়ে নেয়ার পরও প্রশাসন এসব নাটকীয় পাঁয়তারা খেলছেন কেন তা বুঝতে সত্যিই অক্ষম আমি। আসলে সরকারের উদ্দেশ্য কি?” এরপর গোয়েন্দা বাহিনীর ভদ্রলোক প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে প্রশ্ন করেন-
:জামালূফ এবং জামালূফা সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?
:এরা সবাই বিভ্রান্ত নাস্তিক। অন্যায় ও অবৈধ তৎপরতায় এরা সিদ্ধহস্ত। ভদ্রলোক আমার কথায় প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বললেন-
:দেখুন আপা, আমরাও তো মুসলমান।
:শুধু নাম মুসলমানের মতো হলেই কেউ মুসলমান হয়না, বরং মুসলমান কি অমুসলমান, তা প্রমাণিত হয় কাজের মাধ্যমে- আমি বললাম।
“আপনারা ইসলামের দিকে যে আহ্বান জানাচ্ছেন, তাতে সাড়া দিতে আমাদের মন প্রস্তুত নয়। আর আপনাদের আহ্বান বিবেচনা করতেও আমরা অক্ষম। তা’ আপনারা আপনাদের কাজ করুন এবং আমাদেরকে আমাদের কাজে মগ্ন থাকতে দিন”। বলতে বলতে ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ান। আমি তাঁকে বললাম-
:আল্লাহ্ সবাইকে হেদায়াত করুন এবং আমাদের সবাইকে ন্যায় ও সত্য পথে পরিচালিত করুন”।
এই সাক্ষাতের দু’দিন পরে একটি সরকারী মোটর গাড়ী আমার বাড়ির আঙ্গিনায় এসে দাঁড়ায়। ছাই রং-এর স্যুট পরিহিত এক যুবক গাড়ী থেকে নেমে এসে আমাকে সালাম জানিয়ে বলে-
“আমি আহমদ রাসেখ, গোয়েন্দা বাহিনীর অফিসার”। আমি যুবককে আগাগোড়া নিরীক্ষণ করে স্বরাষ্ট্র দফতরের সেই আহমদ রাসেখের সাথে মিল খুঁজছিলাম, যে আমাকে এর আগে স্বরাষ্ট্র দপ্তরে ডেকে পাঠিয়েছিল। ওর অফিসের বাইরের নেমপ্লেটেও একই নাম ‘আহমদ রাসেখ’ লেখা ছিল। আমাকে মৌন থাকতে দেখে যুবক অফিসার বললো-
“দু’দিন আগেও জনৈক আহমদ রাসেখ আপনার সাথে সাক্ষাৎ করে গেছেন। আর এখন আমি তৃতীয় আহমদ রাসেখ আপনার সামনে উপস্থিত”।
ওর কথা শুনে আমি আরো গভীর দৃষ্টিতে তাকে নিরীক্ষণ করতে চাইলাম। একই বিভাগে একই নামের তিনজন পদস্থ অফিসার কেমন যেন হে’য়ালীর মতো মনে হচ্ছিল আমার কাছে। আমাকে চুপচাপ নিরীক্ষণ করতে দেখে যুবক অফিসার জড়সড় হয়ে বললো-
:একান্ত বিস্ময়ের সাথে আপনি চুপচাপ আমাকে কি দেখছেন? অসময়ে এসেছি বলে বিরক্ত হয়েছেন বুঝি?
আমি স্মৃত হেসে তার কথা এড়িয়ে গিয়ে বললাম-
:মেহমানদের স্বাগত জানাবার জন্যে তো এ ঘরের দ্বার সব সময়ই উন্মুক্ত রয়েছে। যাই হোক, তোমাকে একটি মজার ঘটনা শোনাবার প্রয়োজন মনে করছি, শোন। ঘটনাটি সম্ভবতঃ আল-আহরাম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ঘটনাটি ছিল এরকম- “কয়েক বছর আগের কথা। হল্যান্ডের রাণী এবং তাঁর স্বামী ইংল্যান্ডের রাজার আমন্ত্রণে লন্ডনে বেড়াতে গেছেন। একদিন আলোচনাকালে হটাৎ দেখা গেল, হল্যান্ডের রাণী চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে রিসেপশনের কক্ষে মোতায়েন বিশেষভাবে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত একটি কুকুরের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ গভীরভাবে কুকুরটিকে দেখলেন। তারপর পাগলপ্রায় হয়ে কুকুরটিকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খেতে লাগলেন। এরপর কুকুরটিকে তাঁর স্বামীর কাছে হস্তান্তর করে কানে কানে কি যেন বললেন। তারপর দেখা গেল তাঁর স্বামীও পাগলপ্রায় হয়ে কুকুরটিকে চুমু খেতে লাগলেন। ইংল্যান্ডের রাজা ও রাণী বড্ড অবাক হয়ে এসব কাণ্ড দেখতে থাকেন। তাঁদের বিস্ময়ের আর সীমা রইলো না, যখন দেখলেন যে, স্বামীর কাছ থেকে কুকুরটিকে ফিরিয়ে নিতে গিয়ে হল্যান্ডের রাণীর চোখে অশ্রু টলমল করছিল। কুকুরটিকে তিনি ঠিক আপন সন্তানদের মতো বুকে চেপে ধরেছিলেন। এর কিছুক্ষণ পরে, রাজকীয় ভোজের সময়ও দেখা গেল, তিনি কুকুরটিকে বরাবর কোলে চেপে রেখেছেন”।
এবার ইংল্যান্ডের রাণী সম্মানীতা অতিথিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন-
“যে কুকুরটিকে আপনি এতো আদর করছেন, তার মালিক হচ্ছে রাজকুমারী; সেও কুকুরটিকে খুব ভালোবাসে। নয়তো কুকুরটি আপনাকে উপহার দিতে পারলে আমরা বেশ আনন্দিত হতাম”।
হল্যান্ডের রাণী, আত্মার ভিন্ন অস্তিত্ব রূপধারণের মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বললেন-
“কয়েকবছর আগে আমার একমাত্র পুত্র সন্তানের বিয়োগ ঘটে। আমার বিশ্বাস, আমার ছেলের আত্মা এই কুকুরের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছে। দেখুন না, কুকুরের চোখ দুটি হুবহু আমার ছেলের চোখের মতো”।
একথা শুনে ইংল্যান্ডের রাণী কুকুরটিকে হল্যান্ডের রাজদম্পতিকে উপহার হিসেবে প্রদান করতে সম্মত করান রাজকুমারীকে। বলাবাহুল্য, রাজকুমারী কুকুরটিকে হল্যান্ডের রাজা ও রাণীকে উপহার দেন। ঘটনাটি বর্ণনা করে আমি যুবককে বললাম-
: তা জনাব রাসেখ সাহেব, যারা আত্মার রুপান্তরে বিশ্বাস করে, তারা কোন না কোন পশুর মধ্যে তাদের মৃত আপন জনের ছাপ দেখতে পায় কিন্তু আমি ভেবে বিস্মিত হচ্ছি যে, মিশরীয় গোয়েন্দা বাহিনীর যে তিন ব্যাক্তির সাথে আমার দেখা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের নাম আহমদ রাসেখই বটে! কিন্তু তাদের শরীর , চেহারা এবং বর্ণে বিন্দুমাত্র মিলও নেই, এমনকি ভাব-ভঙ্গিতেও কোন সামঞ্জস্য নেই। তা তোমাদের প্রেসিডেন্ট সাহেব কি আত্মার রুপান্তর সম্পর্কিত কোন নতুন মতবাদ আবিষ্কার করেছেন? সম্ভবতঃ তোমাদের সেই নতুন মতবাদের অনুসরণ করতেই বলা হচ্ছে; কি বল, ব্যাপারটা কি সে রকম কিছু? আমার কথা শুনে ওর চেহারার রং বদলাচ্ছিল যেন, সে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার চেষ্টা করে বললো-
:দেখুন মাদাম! আমরা কোন আজে বাজে লোক নই। আমরাও সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। আপনাকে ব্যথিত করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরাতো কেবল আপনার সাথে একটা সমঝোতায় আসার চেষ্টা করছি। আসলে প্রকৃত আহমদ রাসেখ আমিই।
:কিন্তু তুমিই আসল, অন্যরা নকল-তা বিশ্বাস করবো কোন যুক্তিতে! তাছাড়া ওসবে আমার দরকারই বা কি! তোমরা আমার কাছে কি চাও, তা কি স্পষ্ট করে বলতে পারবে?
:ব্যপার হচ্ছে, সরকার আপনার সাথে সমঝোতা করতে আগ্রহী। আমরা মনে করি, ইখওনুল মুসলেমুন আপনাকে বিভ্রান্ত করছে। ওরা অরাজকতায় বিশ্বাসী লোক। এজন্যে আমরা আপনাকে যে কষ্টটুকু দিতে চাই, তা হচ্ছে-আপনি শুধু ইখওয়ানের কাছে সক্রিয় লোকদের নাম জানিয়ে দিন। এর বিনিময়ে খোদ প্রেসিডেন্ট আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবেন এবং আপনার সব প্রয়োজন মেটানো হবে। আমরা আশা করবো, আপনি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ইখওয়ানী সন্ত্রাসবাদীদের নামের তালিকা আমাদেরকে দেবেন। আমরা ভেবে অবাক হয়েছি যে, আপনার মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয়া এবং বুদ্ধিমতী নেত্রী কিভাবে ইখওয়ানিদের চক্রান্তের শিকার হলেন!
সে আরো বলে চললো-
“ইমাম হুজায়বী এবং সাইয়েদ কুতুবের মতো বড়বড় ইখওয়ান নেতৃবৃন্দ এখন প্রেসিডেন্টের সাথে সমঝোতায় আসার চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট তাঁদের উপর সন্তুষ্ট নন বলে তাঁদের আগ্রহে সাড়া দিচ্ছেন না। বস্তুতঃ ইখওয়ানুল মুসলেমুন আপনার সম্পর্কে যেসব প্রচারণা চালাচ্ছে, আপনি যদি সে সম্পর্কে অবহিত হতেন তাহলে এক্ষুণি আমাদের সাথে সমঝোতায় আসতেন এবং এক্ষুণি ইখওয়ানের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতেন”।
এতক্ষণ পর্যন্ত এই যুবক গোয়েন্দা কর্মকর্তার মিথ্যে বচন এবং অমূলক কথাবার্তা শুনে বিরক্তি প্রকাশের পরিবর্তে আমি হেসেই দিলাম এবং বললাম-
:বৎস, তুমি গোয়েন্দা বিভাগের কে বা কি, এবং তোমার কথাবার্তা, নাম বা চেহারা, বর্ণ যাচাই করার কোন প্রয়োজনীয়তা আমি অনুভব করছিনা। আমার এতটুকু বক্তব্যেই আশা করি তোমার জন্য যথেষ্ট। তবে, ছেলে মনে করে আরো একটা কথা তোমাকে বলা দরকার। তা হচ্ছে, ইসলামী আদর্শকে যথার্থভাবে জেনে বুঝে তার অনুসরণের চেষ্টা কর। পাশ্চাত্য বা প্রাচ্যের ধার করা কোন ইজম বা মতবাদের পেছনে অন্ধের মতো ছুটে যেওনা। কেন, সত্য ও মিথ্যের প্রভেদ বোঝা কি তোমার পক্ষে অসম্ভব? কেন, তবে তোমরা মুসলমান হয়ে সমাজতন্ত্রের শ্লোগান দিচ্ছ। আর কেনইবা বিদেশী শক্তির ইঙ্গিতে নাচতে গিয়ে নিজের জীবনকে বরবাদ করে দিচ্ছ। সংশয়-সংকটের আবর্ত থেকে মুক্তি পেয়ে তোমাদের মতো যুবকরা যে কবে ইসলামী পতাকার ছায়াতলে একতাবদ্ধ হবে আমি সেদিনরেই অপেক্ষা করছি”।
সে যে একজন ভালো মুসলমান, তা প্রমাণ করার জন্যে আমাকে বললো-
:মাদাম, আল্লাহর শপথ, আমি নিয়মিত জুময়ার নামাজ আদায় করি। এছাড়া অন্যান্য নামাজ এবং ফরজ ওয়াজেব ইত্যাদি……… আমার আব্বু আমাকে ছোটবেলা থেকেই জুময়ার নামাজ পড়তে নিয়ে যেতেন বলে আমি তাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।
:তুমি কি তোমার আব্বুকে কখনো জিজ্ঞেস করেছ যে, তিনি কেবল জুময়ার নামাজই আদায় করেন কেন?
:দেখুন, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বলাটি কি মুসলমান হবার জন্যে যথেষ্ট নয়?
:কিন্তু এই কালেমার ঘোষণা মোতাবেক যদি জীবন যাপন না কর তাহলে যে হিতে বিপরীত হবে। কলেমা পড়ার পরে তোমার ইসলামী দায়িত্ব কি আরো বেড়ে যায় না?
:শাসকদের অনুসরণ ও আনুগত্য করা উচিৎ।
:ঠিক আছে তাহলে, রোজ কেয়ামতের দিন সেসব-বেচারা শাসকদের সাথেই সারিবদ্ধ হবার জন্যে তৈরী থেকো।
:দেখুন , আমি সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলাম।
:তবে জেনে রেখো যে, নবী-রাসূলদের সত্য শিক্ষার সাথে শয়তানী মিথ্যার সমঝোতা কোনদিন হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবেনা। আমরা ইসলামের পথে অবিচল থাকতে সংকল্পবদ্ধ বাতিলের সাথে আপোষের কোন প্রশ্নই উঠতে পারেনা। যতক্ষণ না তোমরা এবং তোমাদের সরকার সত্যদ্বীনের অনুসারী হবে, ততক্ষন আমাদের ও তোমাদের মধ্যেকার বিরোধ অব্যাহত থাকবে।
একথা শুনে যুবক গোয়েন্দা অফিসার খুব রাগান্বিত হয়ে বললো-
:আমি, আর কোনদিন আপনার কাছে আসবোনা। যদি যোগাযোগ করতে চান তাহলে এই রলো আমার টেলিফোন নাম্বার………। আমি হেসে বললাম-
:ধন্যবাদ, এর দরকার আমার কোনদিনই হবে না।
১৯৬৫ সালের জুলাই মাসের শেষ দিকে ব্যাপক হারে ইখওয়ান নেত্রীবৃন্দের গ্রেফতারীর খবর আমাকে অত্যন্ত বিচলিত করে তোলে। কেননা, ইখওয়ানের মহান আন্দোলনের সাথে আমার অত্যন্ত গভীর এবং পুরনো সম্পর্ক রয়েছে।