চতুর্থ অধ্যায়
শামস বাদরানের অত্যাচার
সাফওয়াত আমাকে নিয়ে অনেক্ষণ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে অফিসার হা’নীর দফতরে পৌঁছায়। এরপর হা’নী আমাকে শামস বাদরানের অফিসে নিয়ে যায়।
জানেন, কে এই শামস বাদরান? নির্দয়-নিষ্ঠুর পশুর চেয়েও অধম এক দুশ্চরিত্র ব্যক্তি। হায়নার চেয়ে হিংস্র এবং অসভ্য এই লোকটি মানুষের উপর জুলুমের ভয়ঙ্কর রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। মুমিন মুসলমানদের পেলে তো সে আরো ভয়ঙ্কর রুপ ধারণ করে। এ বিশেষ পদ্ধতিতে বর্বরতার পন্থায়, এমন কঠোর এবং প্রচণ্ডতার সাথে সে মুসলমানদের উপর অত্যাচার চালায় যে, এর সঠিক বর্ণনা পেশ করা অসম্ভব। সে তার সর্বশক্তি দিয়ে মুসলমানদের আকীদা বিশ্বাস নষ্ট করার এবং মারের চোটে মুসলিমকে অমুসলিম বানানোর চেষ্টা করে। অবশ্য তার সব পাশবিক প্রায়সই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।
আমি পৌঁছলে সে অত্যন্ত দম্ভ এবং তাচ্ছিল্যের সাথে জিজ্ঞেস করল-
: জয়নব আল-গাজালী! তুই এখনো বেঁচে আছিস?
: হ্যাঁ ! ধীর শান্ত কণ্ঠে একই শব্দে জবাব দিলাম আমি।
শামস বাদরানের অফিসের পাশেই ছিল হামজা বিসিউনির অফিস। আমার পিছনে সাফওয়াত আরো দু’জন জল্লাদকে নিয়ে চাবুক হাতে প্রস্তুত ছিল। আগুনের হল্কার মত লকলকে দেখাচ্ছিলা চাবুকে চকচকে কালো ডগা।
শামস বাদরান দাম্ভিকতার সাথে বলল-
: এই মেয়ে…জয়নব……! এখনও সময় আছে, তোমার মন দুরস্ত করে নাও……নিজের মঙ্গল দেখ। আমারও তোমার ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে অন্যদের দিকে দৃষ্টি দিতে চাই। ……আবদুন নাসেরের মর্যাদার শপথ! হান্টারের আঘাতে আঘাতে তোমাকে কেটে-চিরে টুকরো টুকরো করে ছাড়বো।
আমি তেমনি ধীর-শান্ত কণ্ঠে বললাম-
: আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেন তাই হয়, তিনিই সর্বশক্তিমান।
সে বলল-
: এ-ই মেয়ে! কেমন আজব ঔদ্ধতা দেখাচ্ছিস তুই? আমি চুপ করে রইলাম।
এবার সে প্রশ্ন করল-
: সাইয়েদ কুতুব এবং হুজায়বীর সাথে তোর কি সম্পর্ক? আমি স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললাম-
: ইসলামী ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক।
সে আহাম্মকে মত জিজ্ঞেস করল-
: কিসের ভ্রাতৃত্ব?
আমি আবার বললাম-
: ইসলামী ভ্রাতৃত্ব।
: সাইয়েদ কুতুবের পেশা কি? সে প্রশ্নে করল।
আমি বললাম-
: অধ্যাপক ইমাম সাইয়েদ কুতুব আল্লাহর পথের বীর মুজাহিদ, পবিত্র কুরআনের মোফাসসির, মানে ব্যাখ্যাকার, মুজাদ্দিদ এবং মুজতাহিদ।
সে মূর্খের মতো জিজ্ঞেস করল-
: এসবের অর্থ কি?
আমি এবার প্রতিটি শব্দের উপর বিশেস জোর দিয়ে স্পষ্ট উচ্চারণ করে ধীরে ধীরে বললাম-
: অধ্যাপক সাইয়েদ……কুতুব……নেতা……এবং শিক্ষক……ইসলামী চিন্তা নায়ক ……লেখক…… বিখ্যাত সাহিত্যিক এবং রাসূলে খোদার সার্থক অনুসারী……।
সে জল্লাদের দিকে নীরব ইঙ্গিত করলে এবার জল্লাদরা তাদের চাবুক ও হান্টার নিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অনেকক্ষণ পর্যন্ত মার-পিট চলার পর সে আবার প্রশ্ন করল-
: এ-ই মেয়ে! হুজায়বীর পেশা কি?
আমি জবাব দিলাম-
: অধ্যাপক ইমাম হাসান হুজায়বী মুসলমানদের নেতা-ইমাম। তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সাথে সম্পর্ক রাখেন। ইসলামী শরীয়াতের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আল্লাহ্র পথের মুজাহিদ। তাঁর উদ্দেশ্য, গোটা মুসলিম মিল্লাত কুরআন ও সুন্নাহর পথে ফিরে আসুক……।
আমার কথা শেষ হবার আগেই আবার চাবুক আর হান্টার আমার পিঠে আগুন জ্বালাতে শুরু করল।
শামস বাদরান রাগে জ্বলে পুড়ে বলল –
: সব বাজে কথা, অর্থহীন প্রলাপ বকছিস মেয়ে……!
হাসান খলীল ও সেখানে উপস্থিত ছিল। সে বলল-
: পাশা তুমি তাকে বলতে দাও। একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিস্কার হতে যাচ্ছে। এরপর সে আমার সামনে এসে আমার হাত ধরে জিজ্ঞেস করল-
: তুমি সাইয়েদ কুতুবের গ্রন্থ ‘ময়ালিমু ফিততারীক’- মাইলস্টোন-পড়েছ কি? আমি জবাব দিলাম-
: হ্যাঁ পড়েছি বৈ-কি।
সেখানে অনেক পদস্থ অফিসার উপস্থিত ছিল। ওরা এসেছিল আমার উপর পৈশাচিক নির্যাতন উপভোগ করতে। তাদের একজন বলল-
: তুমি কি এই গ্রন্থের সারাংশ বলে শোনাবে? আমি বললাম হ্যাঁ, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু ‘আলা রাসূলিহিল আমীন- শুরু করছি সেই আল্লাহ্র নামে, যিনি পরম দয়ালূ ও অতি করুণাময়। পরম বিশ্বাসী রাসূলের প্রতি অশেষ দরুদ ও সালাম……
কিন্তু শামস বাদরান আমাকে আর এগুতে দিল না। সে অদ্ভুত কায়দায় হাত ঠুকে আমাকে জিজ্ঞেস করল-
: এটা কি মসজিদের মিম্বার পেয়েছিস? মনে রাখবি, আমরা মসজিদে নয়…… গীর্জায় অবস্থান করছি। এর সাথে সাথে শোনাল কদর্য্য গালিগালাজ।
হাসান খলীল বলল-
: মাফ করবেন পাশা! ……আচ্ছা জয়নব, ‘ময়ালিমু ফিত-তারীক” থেকে তুমি কি শিক্ষা পেয়েছ?
এবার আমি গাম্ভীর্যের সাথে বললাম-
: ‘ময়ালিমু ফিত-তারীক’ মুফাসসির ও সাহিত্যিক-মুজতাহিদ সাইয়েদ কুতুবের বিখ্যাত গ্রন্থ। এতে তিনি মুসলিম মিল্লাতকে ইসলামের ছায়াতলে ফিরে আসার আহবান জানিয়েছেন। তিনি মুসলমানদেরকে তাওহীদ বিশ্বাসের ভিত্তিতে পুনরায় জেগে উঠার ডাক দিয়েছেন……। বিভ্রান্ত এবং পথভ্রষ্ট লোকদের তিনি কুরআন ও সুন্নাহর আলো দেখিয়েছেন…… তিনি ভুল-ভ্রান্তির জন্যে তাওবা করে দ্বীনের পথে এগিয়ে আসতে বলেছেন, মুসলিম মিল্লাতকে মূর্খতার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে ইসলামী আদর্শের আলোকবর্তিকা তুলে ধরতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, মুক্তি ও অগ্রগতির একমাত্র পথ ইসলাম। শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনের একমাত্র পথ ইসলাম। মুসলমানরা যতক্ষণ না ইসলামের পথ অবলম্বন করছে, ততক্ষণ তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। এজন্যে কুরআন পড়তে হবে, বুঝতে হবে। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে চলতে হবে। তিনি বলেছেন, জ্ঞানবুদ্ধি ও বিবেকের ডাকে মুসলমানদের সাড়া দিতে হবে। তাওহীদ ও রিসালাতের অনুসরণ করতে হবে। কারণ, তাওহীদ এবং রিসালাতের আদর্শই মুসলিম মিল্লাতকে উজ্জ্বলতর জীবনের নিশ্চয়তা দান করতে পারে।
আমার কথা শুনে কয়েক মুহূর্ত সবাই নীরব-নিশ্চুপ বসে রইলো। এরপর নীরবতা ভঙ্গ করে হাসান খলীল আহম্মদ সুলভ মন্তব্য করল-
: এ দেখছি ভাল বাগ্মী, চমৎকার বক্তৃতা করতে পারে। অপর একজন বলল-
: তা ছাড়া সাহিত্যিক এবং সাংবাদিকও। এরপর সে আমার গ্রেফতারীর সময় আটককৃত আমার সম্পদনায় প্রকাশিত পত্রিকার সম্পাদকীয় থেকে একটি অংশ পড়ে শোনাল।
কিন্তু শামস বাদরানের কাছে এসব ভাল লাগছিল না। সে কথা কেড়ে নিয়ে আমার দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে চেয়ে বোকার মত বলল- এ মেয়েটির কোন কথাই মাথায় ঢোকে না।
: তার এই কথার সাথে সাথেই জল্লাদরা তাদের চাবুক নিয়ে আমার উপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারা আমাকে মারতে মারতে বলল-
: পাশাকে সব কথা ঠিক ঠিক বলে দে।
হাসান খলীলের কথাবার্তার ধরণ-ধারণে বোঝা যাচ্ছিল যে, সে যেন আমাকে শিকার করার ফাঁদ পাতছে। সে ওদেরকে বলল-
: কিছু আসে যায় না। এতো তাড়াহুড়ো কেন?
এরপর আমাকে লক্ষ্য করে বলল –
: তোমরা যে লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ- কে তোমাদের সবচেয়ে প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ শ্লোগান হিসেবে গ্রহণ করেছে, আমি তার তাৎপর্য জানতে চাই। আমি বললাম-
: বেশ তো, প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মাদ (সঃ) গোটা বিশ্বমানবতাকে আহবান করে বলেছেন, মূর্তি-মানুষ বা অন্য যে কোন বস্তু বা শক্তির উপাসনা করা মানুষের শোভা পায় না। মানুষ এক আল্লাহ্র প্রতিনিধি। সৃষ্টি জগতের সব জীব বস্তু থেকে মানুষের মর্যাদা ও গুরুত্ব বেশী। সুতরাং মানুষ এক আল্লাহ্র ইবাদত-উপাসনা ছাড়া আর কারো উপাসনা করবে না। শুধু এক আল্লাহ্র সামনেই তার মাথা নত হবে। এছাড়া আর কোথাও কারো কাছে নয়। মোটামুটি এ হচ্ছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ। আর মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র অর্থ হচ্ছে মোহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহ্র মনোনীত শেষ রাসূল। তাঁরই মাধ্যমে আল্লাহ্ মানুষের জন্যে শাশ্বত চিরস্থায়ী জীবন বিধান ইসলামকে পাঠিয়েছেন দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠার জন্যে। কুরআন ও সুন্নাহ হচ্ছে ইসলামের মূল কথা। আল্লাহ্ তাঁর রাসূল মোহাম্মাদ তথা কুরআন ও সুন্নাহর উপর পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাস স্থাপন এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে এর বাস্তব উদাহরণ পেশ করাই হচ্ছে অবশ্য কর্তব্য। সংক্ষেপে এটাই হলো আমাদের কালেমায়ে তাইয়্যেবার তাৎপর্য।
শামস বাদরান এসব কথায় জ্বলে উঠলো যেন। সে চেঁচিয়ে বলল-
: বন্ধ কর এসব বাজে কথা।
: এর সাথে সাথেই তার পোষ্য পশুরা আমার উপর হান্টার আর চাবুক বর্ষাতে শুরু করলো। হাসান খলীল, শিকার তাঁর ফাঁদের কাছাকাছি বলে মনে করেই যেন শামসকে বলল-
: পাশা! আমার খাতিরেই আর একটু অবকাশ দাও।
এরপর আমার দিকে চেয়ে বলল-
: আমাদের ব্যাপারে তোমার কি মন্তব্য। আমরা মুসলিম না কাফের?
আমি বললাম –
: নিজেকে কুরআন-সুন্নাহর কষ্টি পাথরে রেখে পরখ করে দেখ। তুমি কি, এবং ইসলামের সাথে তোমার সম্পর্ক শত্রুতার না বন্ধুত্বের, তা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
আমার একথা শুনে শামস বাদরান রাগে ফেটে পড়ল। সে যা মুখে আসছে, তাই বলে যাচ্ছিল। অত্যন্ত নোংরা অশ্লীল গালাগালি শুরু করে। আমি চুপ থাকলাম। তাছাড়া করার মত আর উপায়ই বা কি ছিল? এতেও শান্ত না হয়ে সে হিংস্র পশুর মত হাঁফাতে-লাফাতে লাগল। সে বকতে লাগল-
জামাল নাসেরের বন্যতন্ত্র সম্পর্কে তুমি কিছুই জাননা। এতে অন্ধ বর্বরতার রাজত্ব চলছে এবং তা প্রচণ্ড ঝঞ্ঝার সামনের সব কিছুকে খড়কুটোর মত উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তার লোকেরা ক্ষুধার্ত বাঘের মত পথের পথিকদের সাবাড় করতেই অভ্যস্ত……।
শামস বাদরান সাফওয়াতের দিকে চেয়ে বলল-
মারধোরেও এ কাবু হবে না দেখছি; একে উল্টো করে লটকিয়ে দাও। সাফওয়াত বাইরে গিয়ে লোহার এক মোটা রড এবং কাঠের দু’খানা স্ট্যান্ড নিয়ে হাজির হলো। তার পেছনে চাবুক হাতে আরও তিন জন জল্লাদ।
আমাকে লটকিয়ে রাখার ব্যবস্থাদী পূর্ণ হলে আমি তাদের কাছে পরার জন্যে একটি ফুলপ্যান্ট চাইলাম।
হাসান খলীল বাদরানকে বলল-
: তা কিছু আসে যায় না। এরপর শামস বাদরান আমার জন্যে ফুল প্যান্ট আনতে বলল। একজন সিপাহী তাড়াতাড়ি তা এনে হাজির করল। শামস বাদরান বলল-
: যা ঐ ঘরে গিয়ে প্যান্ট পরে এস।
প্যান্ট পরার জন্যে এসে দেখলাম; কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিরাট ঘর। উন্নতমানের আসবাবপত্র; দামী কার্পেটে মোড়া মেঝে এবং বিলাসিতার সব সাজসরঞ্জাম ভর্তি সুসজ্জিত এই হল ঘর। যাই হোক, ফুল প্যান্ট পরে আমি ফিরে এলে শামস বাদরান এর নির্দেশে আমাকে শূন্যে লটকিয়ে দেয়া হয়। তারা কিভাবে যে আমার হাত পা জুড়ে বেঁধে লটকিয়েছে, তা আমার ঠিক মনে নেই। তবে মনে পড়ে শামস বাদরান আমাকে লটকানোর কাজে লোকদের উপর এমনভাবে হুকুম চালাচ্ছিল যেন সে রনাঙ্গনে সৈন্য পরিচালনা করছে।
আমাকে বেঁধে লটকানো হয়ে গেলে সে হেঁকে বলল-
: সাফওয়াত, একে পাঁচশো বার বেত্রাঘাত কর। এর সাথে সাথেই শুরু হোল সেই নৃশংস অত্যাচারের তাণ্ডব লীলা। তারা কে কার চেয়ে বেশী পেটাতে পারে, তারই যেন প্রতিযোগিতা চলছিল এমন সম্মিলিত প্রহারে আমার ব্যাথা-যন্ত্রণা যে কি পরিমাণ বেড়েছিল, তা অনুমেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এসব পশুদের সামনে নিজের দুর্বলতা প্রদর্শন করিনি। তাদের বেত ও চাবুকের ত্রস্ত ঘা সহ্য করে যাচ্ছিলাম আর আল্লাহ্র নাম স্মরণ করে অন্তরের প্রশান্তি খুঁজছিলাম। কিন্তু ব্যাথা-বেদনা যখন সহ্যের সীমা অতিক্রম করল, তখন আর নীরবে সয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না, তখন সেই সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তিমানের দ্বারে ফরিয়াদ ধ্বনি তুললাম, যাঁর কাছে প্রকাশ্য এবং গোপনীয় সবকিছুই সমানভাবে স্পষ্ট। আমি ‘ ইয়া আল্লাহ্- ইয়া আল্লাহ্’ ধ্বনি তুলছিলাম এবং চাবুকের ঘা আমার ব্যাথা আরো তীব্রতর করছিল। এরপর অচেতন হওয়া পর্যন্ত শুধু আল্লাহ্কেই ডাকতে থাকি। বেহুশ হয়ে আমি প্রাণহীন দেহের মত মাটিতে পড়ে যাই। ওরা আমাকে দাঁড় করিয়ে আবার লটকানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু পারল না। দাঁড়ানোর জন্যে বিন্দুমাত্র শক্তিও আমার অবশিষ্ট ছিলনা। দাঁড়াবার চেষ্টা করলেই আবার পড়ে যেতাম। আমার ব্যথা সহ্যের সীমা অতিক্রম করছিল। আমার দু’পায়ে রক্তের ধারা প্রবাহিত হচ্ছিল আর শামস বাদরান সাফওয়াতকে হুকুল দিচ্ছিল, আমাকে দাঁড় করিয়ে আবার লটকিয়ে দিতে। আমি যন্ত্রণায় আতিশয্যে দেয়ালের সাথে হেলান দেয়ার চেষ্টা করলে সাফওয়াত চাবুক মেরে আমাকে দেয়াল থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।আমি এবার অনন্যোপায় হয়ে বললাম-
: আমাকে একটু মাটিতে বসতে দাও।
এর জবাবে শামস বাদরান বলল-
: মোটেই বসতে দেয়া হবে না। কোথায় তোর আল্লাহ্! ডাকতো দেখি তাকে আমাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য! কিন্তু এর পরিবর্তে আবদুন নাসেরকে ডেকে দেখ কি লাভ হয়। আমি এমন ইতর-মূর্খের কথা কানে না নিয়ে চুপ করে থাকি। সে আস্ফালন করে বললো-
: আমাকে বল দেখি, এখন তোর আল্লাহ্ কোথায়?
আমাকে চুপ থাকতে দেখে সে আবার চেঁচিয়ে বলল –
কোথায় তোর আল্লাহ্? জবাব দে!
এবার আমি অশ্রু ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললাম-
: আল্লাহ্পাক সর্বশক্তিমান এবং উত্তম ব্যবস্থাপক।
এরপর আমাকে শামস বাদরানের অফিস থেকে সোজা হাসপাতালে পাঠানো হয়।
পানির সে’লে
শামস বাদরানের অফিস থেকে বের হবার সময় আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। আমি মুহূর্ত কয়েক বসে শ্বাস-নিশ্বাস স্বাভাবিক পর্যায়ে আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলাম। মনে হচ্ছিল সমস্ত অঙ্গ-প্রতঙ্গ আমার খসে পড়েছে যেন। কিন্তু উপায় নেই জল্লাদরা মানুষের ব্যথা বুঝতে অক্ষম।সাফওয়াত আমাকে টেনে হিঁচড়ে যখন হাসপাতালের শেষ গ্যালারীতে পৌঁছায়, তখন হঠাৎ হাসান খলীল পিছন থেকে বলে-
: সাফওয়াত, ফিরে এস। পাশা জয়নবকে ডাকছে। ফলে আবার শামস এর আদেশে ফিরতে হল। অফিসে ঢুকেই আমি সামনে বোন হামিদা কুতুবকে দেখতে পাই। আমিতো তাকে দেখা মাত্রই চিনেছি কিন্তু আমার শারীরিক কাঠামো বিগড়ে গেছে বলে তিনি দেখা মাত্রই আমাকে চিনতে পারেননি। ক্ষিধেয়, পিপাসায়, তার উপর প্রতি মুহূর্তের এই অকথ্য নির্যাতনে আমার শরীর, চেহারা এবং গায়ের রং-বর্ণ সব বিগড়ে গিয়েছিল। শামস বাদরান মুহতারেমা হামীদা কুতুবকে জিজ্ঞেস করল-
: এ কি জয়নব আল-গাজালী?
প্রশ্ন শুনে হামীদা আমাকে গভীরভাবে দেখে ম্লান স্বরে বলল-
: হ্যাঁ।
আমার তখন অচেতন অর্ধচেতন অবস্থা। এজন্যে বোন হামীদা কুতুবের সাথে জিজ্ঞাসাবাদ এবং কথোপকথন বিস্তারিত মনে রাখতে পারিনি। তবে কোন কথা শুনে মনে হচ্ছিল শামস বাদরান বোন হামীদা কুতুবের কাছে বোন ঈসা ফাতেমা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছিল। তিনি আমার সেলের পাশের সেলেই ছিলেন।
হামীদা কুতুব যখন শামস বাদরানের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন, তখন সে আমাকে বেরুবার আদেশ দেয়।
তার অফিস থেকে বেরুবার সাথে সাথেই আমি পরিপূর্ণ অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে যাই। সাফওয়াত সিপাহী আবদুল মাবুদের মাধ্যমে একজন নার্সকে ডেকে পাঠায়। নার্স একটি শিশির ঢাকনা খুলে আমাকে তা শুকালে পরে আমার চেতন ফিরে আসে। এরপর জল্লাদ সাফওয়াত আমাকে দাঁড় করিয়ে তার হাতের চাবুক ঘুরাতে ঘুরাতে বলে-
: দ্রুত পায়ে চল- আরো দ্রুত।
চলতে গিয়ে আবার বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে যাই। হুঁশ হতে সে আবার আমকে দাঁড় করিয়ে দ্রুত চলার হুকুম দেয়। সাথে সাথে সে আমার উপর তার হান্টার ব্যবহার করছিল। আহত শরীরের উপর হান্টারের মার পড়ছিল জ্বলন্ত আগুনের মত। এভাবে উঠতে-পড়তে মার খেতে খেতে আমার লবেজান দশা। জল্লাদের পাগলা চাবুক বড্ড নির্দয়। হে আল্লাহ্! এরাও কি তোমার সৃষ্টি মানুষ! বড্ড আজব সৃষ্টি বটে, তারা দু’পা এবং এক চাবুকের উপর ভর করে চলে। এমন সময় কেউ যেন হুকুম করল-
: একে পাঁচ নম্বর সেলে ছেড়ে দাও। অন্য এক হুকুম এল-
: একে পানির সেলে নিয়ে যাও।
সাফওয়াত আমাকে এক কক্ষে ঢুকিয়ে বসতে বলে নার্স ডেকে এনে আমার ক্ষতস্থান ব্যান্ডেস বাঁধালো।
সেলের দরজা খুললে আমি দরজার পেছনে একটি লৌহ প্রাচীর দেখতে পাই। এর উচ্চতা ছিল বড় গাছের বরাবর। সেই প্রাচীরে তুলে সে আমাকে লাফিয়ে নীচে পড়তে আদেশ দেয়। তার কথা শুনে ভয়ে আমার সারা অস্তিত্বই যেন জমে গেল। এমনকি এক ইঞ্চি নড়ার শক্তিও পাচ্ছিলাম না আমি। প্রাচীরের ওপারে পানির কূপ দেখতে পেলাম। আমি আমার সমস্ত শক্তি একত্রিত করে সাফওয়াতকে বললাম-
: আমি কোন অবস্থাতেই কাপড় ছাড়বো না। সে ক্রুর হাসি হেসে বলল-
: তুমি শুধু এক কাপড়েই পানিতে নামবে। আমি বললাম-
: আমি কেবল একখানা চাদর জড়িয়ে আছি। সে তাচ্ছিল্যের সাথে বলল-
: ঘণ্টা খানেকের মধ্যে তো এমনিতেই মরতে হবে। ফুল প্যান্টও খুলে দে।
আমি বললাম-
: কক্ষে গিয়ে আমি তা তোমাকে ফেরৎ দেবো। সে পাল্টা প্রশ্ন করল-
: কোথাকার কক্ষ? আমিতো তোকে এক্ষণি এই কূপে ছুঁড়ে ফেলে দেবো।
আমি বললাম-
: তাহলে তুমি উল্টো দিকে ঘুরে যাও। সে উল্টো মুখো ঘুরে দাঁড়ায় এবং আমি ফুলপ্যান্ট খুলে ফেরত দেই। এভাবে শামস বাদরানের অফিসে আমাকে পাঠানোর সময় যে ফুলপ্যান্ট পরতে দেয়া হয়েছিল, তা ফেরত দিয়ে দেয়া হয়।
এখন আমি শতচ্ছিন্ন পুরানো কাপড় পরে ভাবছিলাম যে, কি করব! সাফওয়াত আমাকে পানিতে ঝাঁপ দিতে বললে আমি রুখে দাঁড়াই এবং বলি-
: না, আমি আত্মহত্যা করবোনা। যদি তোমারা আমাকে হত্যা করতে চাও তো তোমাদেরই তার পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে।
আমি ভাবছিলাম, তারা সত্যি সত্তিই আমাকে হত্যা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ অবস্থা দেখে তাই মনে হচ্ছিল। কারণ, অস্বাভাবিক নির্যাতন, অকথ্য গালিগালাজ, শাসানো এবং পানির কূপে ঝাঁপ দেয়ার নির্দেশের পিছনে আর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে? পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল যে, আমার হত্যাই তাদের কাম্য। তারা চাইলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে কূপে ফেলে মারতে পারে। এভাবে আল্লাহ্র পথে শহীদ হওয়া ছিল আমার বাসনা। আমি বলছিলাম-
: হে আল্লাহ্, পাক পরওয়ারদিগার। তোমার দ্বীনের পথে শহীদি মৃত্যুকে আমি স্বাগত… খোশ আমদেদ জানাই।
জল্লাদ এসে চাবুক মেরে আমাকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে বাধ্য করছিল। কিন্তু আমি নিজ থেকে ঝাঁপ দিতে অস্বীকার করি। আর যায় কোথা, অনবরত চাবুক শ্রাবনের বৃষ্টির মতো আমার পিঠকে রক্তে প্লাবিত করতে শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত সইতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। তা দেখে সাফওয়াত, সা’দ এবং সাম্বকে নিয়ে ধরাধরি করে আমাকে পানির কূপে নিক্ষেপ করে।
আমি নীচে পড়ে দেখি, পায়ের নীচে কঠিন মাটি। তখন আমার ভুল ভাঙলো যে, এটা পানির কূপ নয় বরং পানির সেল। শাস্তির আর এক জঘন্য পদ্ধতি। আমি আল্লাহ্র দরবারে হাত তুলে বললাম-
: ইয়া রাব্বুল আলামীন! আমি আমার সব ব্যাপার তোমার উপর ছেড়ে দিয়েছি। আমি কেবল তোমারই সন্তুষ্টি চাই। যতক্ষণ প্রাণ আছে তোমার সন্তুষ্টির পথে অবিচল থাকব। হে আল্লাহ্, আমি তোমার সন্তুষ্টি ও ভালবাসা চাই। তুমি আমাকে ধৈর্য ও সাহস দাও, যেন তোমার পথে চলতে গিয়ে যে কোন বিপদের মোকাবেলা করতে পারি।
এরই মধ্যে সাফওয়াত আমার উপর নির্দয়ভাবে চাবুক মারতে থাকল।
সে চাবুক মারতে মারতে বলল-
: বস।
: এতো পানিতে আমি বসবো কেমন করে? এতো অসম্ভব!
অত্যাচারী সাফওয়াত তার মুখ এবং চাবুককে একই সাথে ব্যবহার করে বলল-
: যেভাবে নামাজ পড়তে বসা হয়, ওভাবে বস। আর তা তোর ভাল করে জানা থাকারই কথা। বস…… বসে দেখা জলদি। … জামাল নাসেরই শুধু ইখওয়ানদের শায়েস্তা করতে জানে……। বস বলছি…… এ-ই মেয়ে শুনছিস কথা?
আমি যখন কোনমতে বসলাম তখন চিবুক পর্যন্ত আমার পানিতে ডুবে গেছে। সাফওয়াত বলল-
সাবধান! চুল বরাবরও এদিক সেদিক নড়াচড়া চলবে না। হাত পা বা শরীরের কোন অংশ নাড়াতে পারবি নে! জামাল নাসের তোকে দৈনিক এক হাজার হান্টার মারার আদেশ দিয়েছে……। তা আমরা তোকে প্রতি নড়ার জন্যে দশবার করে হান্টার মারব।
এই অকল্পনীয় ভয়ানক পরিবেশে এসে আমি এতই ব্যাকুল হয়ে পড়ি যে, দুঃখ-যন্ত্রণার অনুভূতি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলি। অবশ্য পানির পরশ পেয়ে ক্ষতস্থান গুলোর ব্যথা আরো অনেক গুন তীব্র হয়ে উঠে। এ অবস্থায় আল্লাহ্র বিশেষ মেহেরবানী না পেলে আমি এত দুঃখ-যন্ত্রণা সহ্য করতে অক্ষম ছিলাম। যন্ত্রণার তীব্রতায় আমি জল্লাদ সাফওয়াত, সা’দ এবং সাম্বর কথাও ভুলে গিয়েছিলাম। এর উপর সাফওয়াত আবার চাবুক মারতে শুরু করে পরিবেশের তিক্ততাকে আরো প্রবল করে দেয়। সাফওয়াত তার চাবুক চালাতে চালাতে বলল-
: শোন হতভাগী! তুই যদি ঘুমোবার চেষ্টা করিস তাহলে এই চাবুক তোকে জাগিয়ে দেবে; ঠিক এইভাবে অবিচলভাবে বসে থাকবে। ……ঐ যে দরজার ছিদ্র পথ দেখতে পাচ্ছিস তা দিয়ে তোর অবস্থা দেখা হবে। তুই যদি একটু দাঁড়াতে, হাত পা ছড়াতে বা এদিক ওদিক দেখতে চেষ্টা করিস, তাহলে চাবুক তোকে সোজা করার জন্যে তৈরী থাকবে……। আমরা তোকে সেলের ঠিক মাঝামাঝিতে রেখেছি। খবরদার দেয়ালের কাছাকাছি হবার চেষ্টা করবিনা যেন! যদি দেয়ালের কাছে যেতে চাসতো দশ চাবুক। পা ছড়ালে দশ চাবুক, হাত ছড়ালে…… দশ চাবুক…মাথা নাড়লে দশ চাবুক…। মনে রাখিস, এভাবে দৈনিক হাজার চাবুক পূরন করা হবে। দেখি তোকে হুজায়বী বা সাইয়েদ কুতুব বাঁচাতে পারে কিনা…… মনে রাখিস, এটা নাসেরের জাহান্নাম। তুই আল্লাহ্র নাম নিয়ে সারা জীবন চেঁচালেও কেউ তোকে বাঁচাতে আসবে না। আর যদি সৌভাগ্য বশতঃ আবদুন নাসেরের নাম ডাকিস তাহলে তোর জন্যে মুহূর্তেই বেহেশতের দরজা খুলে দেয়া হবে। বুঝেছিস, আবদুন নাসেরের বেহেশত……। যদি না বুঝিস, তাহলে আরো অনেক কঠিন শাস্তি তোর অপেক্কায় রয়েছে। তুই যদি আমার কথা মানিস তাহলে আমি তোর মুক্তির জন্যে পাশার কাছে সুপারিশ করতে প্রস্তুত আছি। তুই তার কাছে গিয়ে তিনি যেভাবে বলেন, সেভাবে কাজ করবি। তারপর আর কোন দুঃখ নেই, দুশ্চিন্তা নেই। বলতো, তুই কি পাগল। আহম্মক। কার জন্যে, কিসের জন্যে নিজের জীবন নষ্ট করছিস? ইখওয়ানের জন্যে? ওরাতো সব বলে দিয়েছে। এখন ফাঁসির রজ্জু তোর মাথার উপর ঝুলছে।
আমি নির্বিকার বসে বকবক শুনছিলাম। সে আহম্মক, নির্বোধ, মূর্খ এবং গোঁয়ার-দাম্ভিক আমার চেহারার ভাষা বুঝতে অক্ষম ছিল। তাই সে বলে চলল-
আমার আদেশ পালন কর, আমার কথাগুলো ভেবে-চিন্তে নিজের মুক্তির ব্যবস্থা কর…… নয়তো আগামীকাল ভোরে তোর মৃত্যু নিশ্চিত, জয়নব।
এরপরও যখন আমি কোন কথা বললাম না। তখন সে ক্ষেপে উঠে বলল।
জবাব দিচ্ছিস না যে, এ্যাঁ!
তবুও আমি চুপ করে থাকলাম আর সে তার বক্তৃতা জারী রাখল-
: দেখ, খুব সহজ পথ দেখাচ্ছি। আমি তোকে পাশার কাছে নিয়ে যাবো। তুই তাঁকে শুধু এটাই বলবি যে, সাইয়েদ কুতুব ও হাজায়বী নাসেরকে হত্যা করার পরিকল্পনা কিভাবে নিয়েছিল।
এর এসব বাজে কথা আর সহ্য করতে না পেরে আমি সমস্ত শক্তিতে জোর গলায় বললাম-
: সব ইখওয়ানই নির্দোষ নিরপরাধ। আল্লাহ্ শিগগিরই তোদের জোর-জুলুমের প্রতিবিধান করবেন। পার্থিব স্বার্থ আমাদের কাম্য নয়, আল্লাহ্র সন্তুষ্টিই আমাদের পরম কাম্য…… ব্যাস, এরপর যা হবার তাই হবে।
আমার কথা শুনে সাফওয়াত ওখানে দাঁড়িয়ে আধ ঘণ্টা পর্যন্ত আমাকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করতে থাকলো। এরপর যেতে যেতে বলল-
: যাক, আমি তো তোমার দৈনিক শাস্তির আদেশ তোমাকে জানিয়ে দিয়েছি।
সে চলে গেলে আমি ভাবলাম যে, নড়াচড়া করবই বা কেমন করে? পা ছড়াতে গেলে পানিতে নাক-মুখ ডুবে যায়। সুতরাং দাঁড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কি আর করবো, দশ চাবুক না হয় সইতেই হবে। আমি আল্লাহ্র উপর ভরসা করে পানিতে উঠে দাঁড়ালাম।
ভেবেছিলাম প্রহরী সিপাহী ঘুমুচ্ছে। ফজরের আযান শুনে আমি দেয়ালে হাত মেরে তায়াম্মুম করে ইঙ্গিতে প্রথমে দু’রাকাত সুন্নাত ও পড়ে দু’রাকাত ফরজ নামাজ আদায় করছি এমন সময় দরজা খুলে প্রহরী এসে চাবুক বর্ষাতে লাগলো। আমি তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করে আবার চিবুক ডুবা পানিতে বসে পড়ি। এই পানি এতই ময়লা এবং দুর্গন্ধযুক্ত ছিল যে তা দিয়ে ওজু করা যায় না।
আমি বসে পড়লে দরজা আবার বন্ধ করে দেয়া হয়। আমি ‘হাসবুনাল্লাহু ওয়া নেয়ামাল ওয়াকীল’ বারবার পড়ছিলাম। ক্রমে আমি ঝিমুতে শুরু করি। কিন্তু পানিতে চিবুক ডুবার সাথে সাথে ঝিমুনি বন্ধ হয়ে যায়।
এভাবে প্রতি প্রহরী সাম্ব আমাকে চাবুক পেটা করার জন্যে পাঁচ-পাঁচ বার সেলে ঢুকতো। আমার নড়াচড়া যেমন স্বাভাবিক ছিল তেমনি চাবুক মারাও ছিল একান্ত জরুরী।
অপরাধ
চাশতের সময় অর্থাৎ বেলা ন’টার দিকে সাফওয়াত এসে আমাকে পানির সে’ল থেকে বের কর পাশাপাশি অন্য একটি সে’লে বন্ধ করে দেয়। আমি সে’লের একটি দেয়ালে ঠেশ দিয়ে বসে পড়ি। আমার কাছে পাথরের এই কঠিন দেয়ালকেও তখন তুলোর নরম বালিশের মতো কোমল মনে হচ্ছিল। ব্যথা-বেদনা এবং ক্ষিধেয় আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়, ক্ষিধেয় আমার পেট জ্বলছিল, আঘাতের ব্যথা আমাকে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছিল যেন, শরীরের ক্ষত আর হৃদয়ের ক্ষত মিলে এমন এক অচিন্তনীয় অবর্ণনীয় মর্মান্তিক আজাব সৃষ্টি করেছিল, যার-তুলনা করা সম্ভব নয়।
এই দুঃসহ অবস্থায় সাফওয়াত এক কৃষ্ণকায় শয়তানকে নিয়ে চাবুক ঘোরাতে ঘোরাতে উপস্থিত হয়। সাফওয়াত দাড়িয়ে কৃষ্ণকায় শয়তানকে আদেশ দিল-
: এর সাথে সবচেয়ে জঘন্য কাজে লিপ্ত হও। যদি কোন প্রতিবাদ বা বিরোধিতা করে সে, তাহলে তাকে বাগে আনার জন্যে থাকলো এই চাবুক।
এই জঘন্য পৈশাচিক আদেশ শুনে আমি আল্লাহ্র কাছে ফরিয়াদ করে বললাম-
: জান ও ইজ্জত-আবরু রক্ষাকারী হে আল্লাহ্! আমি তোমারই দাসী এবং তোমার সন্তুষ্টির পথে অবিচল থাকার প্রতিজ্ঞায় অটল রয়েছি…… আমি আমার দুর্বলতার কারণে তোমার কাছে কমপক্ষে এতটুকু সাহায্যে ভিক্ষে চাইছি যে, শয়তানের চক্রান্ত এবং পাপিষ্ঠদের হাত থেকে আমার ইজ্জত আবরু রক্ষা কর এবং জালিমের মোকাবেলায় আমাকে সাহায্য কর।
সত্যিই আল্লাহ্র কি অপার মহিমা যে, যে ব্যক্তি নিয়োগ করা হয়েছে আমার ওপর অমানুষিক অত্যাচারের জন্যে, যাকে দেখে এবং যার কণ্ঠস্বর শুনে আমার চেতনা প্রায় লুপ্ত হচ্ছিল, সেই ব্যক্তি আমাকে ‘খালা আম্মা’ বলে ডাকল। আমি বিস্মিত হয়ে তার দিকে দৃষ্টি ফেরাই। তার চেহারার সেই বীভৎসতা আর নেই এখন। অদ্ভুত এক আলোর আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তার চোখমুখ। সে পরিস্কার কণ্ঠে বলল-
: খালা আম্মা, আপনি নির্ভয় থাকুন। ওরা যদি আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে, তাও আমি আপনাকে বিন্দু পরিমাণ দুঃখ দেবনা। আমি আনন্দাবেগ আপ্লুত বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললাম-
: আমার ছেলে……বাপ আমার! আল্লাহ্ তোমাকে হেদায়াত দান করুন।…… আল্লাহ্ তোমাকে উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করুন। হঠাৎ এক ঝটকায় সেলের দরজা খুলে গেল। সাফওয়াত সেই লোকটির উপর চাবুক মেরে বলে চলল-
: অভিশপ্ত কুত্তার বাচ্চা! তুই আমার হুকুম পালন না করে নিজকে বিপদে ফেলেছিস। আমি এক্ষুণি তোকে ‘কোর্ট মার্শালে’ পাঠাচ্ছি…… কুত্তার বাচ্চা! তুই জামাল নাসেরের হুকুম অমান্য করেছিস…… যদি প্রাণ বাঁচাতে চাসতো তোকে শামস পাশার কাছে নিয়ে যাওয়ার আগে আমার হুকুম পালন করে। আমি তোকে এক ঘণ্টা সময় দিচ্ছি, দেখি তুই কাজ করছিস কিনা, যদি জীবনে বেঁচে থাকার সাধ থাকে তাহলে এক্ষণি শুরু কর।
সাফওয়াত দরজার ছিদ্রপথে এসব হুকুম নিয়ে চলে যায়।
সিপাহী সে’লের ভিতর থেকেই সাফওয়াতকে স্যালুট করে বলল-
: হুজুরের হুকুম শিরোধার্য।
আমি ভয়ে ভয়ে আরো বেশী করে আল্লাহ্র নাম স্মরণ করে এই আশু বিপদ থেকে রক্ষার জন্যে তাঁর সাহায্য চাইলাম। ভেবেছিলাম নতুন হুকুম পেয়ে এবং নিজের জানের স্বার্থে এবার সেই সিপাহী আমার উপর অত্যাচার করতে বাধ্য হবে। এবার হয়তো সে ক্ষুধার্ত জানোয়ারের মতো আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু না! সে সত্যিই বীরত্তের পরিচয় দিল। সে নিস্পাপ শিশুর মত হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করল-
: মা, ওরা তোমার সাথে এ নিষ্ঠুর ব্যবহার করছে কেন?
আমি তাকে বুঝালাম-
: বাবা, আমরা মানুষকে আল্লাহ্র নির্দেশিত সত্য ও শান্তির পথে আহবান করি এবং দেশের জনগণের কল্যাণের জন্যে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের দাবী জানাই। আমরা নিজেদের জন্যে কোন ক্ষমতা বা সম্পদ চাইনা। অত্যাচারীদের দৃষ্টিতে এটাই আমাদের অপরাধ।
জোহরের আজান শুনে আমি দেয়ালে হাত মেরে তায়াম্মুম করে নামাজ আদায় করি আমি দোয়ার জন্যে হাত উঠালে সে তার জন্যে ও দোয়া করার অনুরোধ জানায়। আমি তার সার্বিক মঙ্গলের জন্য দোয়া করি এরপর সুন্নাত নামাজের জন্যে দাঁড়ালে সে আবার বলল-
: খালাজান, আল্লাহ্র কাছে দোয়া কর, যেন আমিও নামাজী হতে পারি…… খালাজান, মনে হয় তোমরা যেন মানুষ নও, তার চেয়ে বড় কোন কিছু তোমাদের এরা নাহক দুঃখ দিচ্ছে…… হে নাসেরের অনুসারীরা আল্লাহ্ তোমাদের সমূলে ধ্বংস করুন।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম-
: তুমি কি অজু করতে জান?
সে বলল-
: জ্বী হ্যাঁ, জানি। আমি আগে নিয়মিত নামাজ আদায় করতাম। কিন্তু এরা আমাকে নামাজ আদায় করতে দেখলে গ্রেফতার করে জেলে আটক করে।
আমি তাকে বললাম-
: বাপ আমার! তোমাকে তারা জেলে আটক করুক বা অন্য কোন দুঃখ দিক, তুমি নিয়মিত নামাজ আদায় করতে থেকো। আল্লাহ্ সব সময় তোমার সহায় হবেন।
আমার কথা শুনে তার চোখে মুখে স্বর্গীয় আলোর দিপ্তি ভেসে উঠল। সে উৎসাহের সাথে বলল-
: হ্যাঁ মা, আমি নামাজ পড়ব।
ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজার ছিদ্রপথে উঁকি মেরে দরজায় লাথি মারতে মারতে এক সিপাহী তাকে সম্বোধন করে বলল-
: এ-ই কুত্তার বাচ্চা, তুই কি করছিস?
সে জবাবে বলল-
: তিনি যে এখনও নামাজ সেরে উঠেননি…… তখন সিপাহীটি হাতে তালি মারে বলল-
: সাফওয়াত আসছে…… সেই আমাকে পাঠিয়েছে তোকে পরীক্ষা করার জন্যে।
একটু পরে সাফওয়াত পাগলা কুকুরের মত ভিতরে ঢুকে সেই সৈনিক ছেলেটির উপর চাবুকের প্রহার শুরু করলো। সে চাবুকের ভীষণ প্রহারে অতিষ্ঠ হয়ে বেহুঁশ হয়ে পড়ে। অন্য এক জল্লাদ এসে তাকে উঠিয়ে নিয়ে চলে যায় এবং সেলের দরজা আবার বন্ধ হয়। কেবল আমার জন্যেই, আমাকে একটু শান্তি ও আরামের সুযোগ দেয়ার জন্যেই ছেলেটির উপর এমন উৎপীড়ন চলল বলে আমি যারপরনাই দুঃখিত হলাম। সে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির পথে সন্ধান লাভ করে, সত্যদৃষ্টি লাভ করে এবং জালিমের নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জানায়। যে জালিমদের অত্যাচারে আমি ধুঁকেধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলাম, সে তাঁদের নিন্দা ও সমালোচনা করে। আর তাই তাকে বরণ করতে হলো মর্মান্তিক শাস্তি। এই দুঃসহ দুঃখ বোধের মধ্য দিয়েই আদায় করলাম সেদিনের আসরের নামাজ।
আবার পানির সে’লে
সূর্যাস্তের সাথে সাথেই সামরিক কারাগারের জল্লাদরা কর্মতৎপর হয়ে উঠে। তাদের ক্রুর নিষ্ঠুর অট্টহাসিতে কেঁপে উঠে কারাগারের কঠিন চার-দেয়াল। সর্বনাশা আঁধারের মেঘ হয়ে ওঠে আরো ঘনীভূত আরও শংকাময়।
ওরা আমাকে রাতের অন্ধকারে আবার পানির সে’লের দিকে নিয়ে যায়। ক্ষিদেয় আমার পেট জ্বলছিল, পিপাসায় ছাতি ফাটার উপক্রম আর চাবুকের ঘা আমার সমস্ত অস্তিত্বকে বিষময় করে রেখেছিল। ক্লান্তিভরা এ অবস্থাতেই আমার ঘুম এসে যায়। ঘুমের ঘোরে সপ্ন দেখি যে, কুচকুচে কালো রেশমের উপর মনিমুক্তা খচিত পোশাক পরিহিত বেশ কিছুলোক অতি মূল্যবান সোনা-রুপার পাত্রে উৎকৃষ্ট ফল খেতে এবং উত্তম পানীয় পানে ব্যস্ত। অঢেল খাদ্য সম্ভারে সমৃদ্ধ তাদের দস্তরখানা। স্বপ্ন দেখার সাথে সাথে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং ক্ষুৎপিপাসার কথা একেবারে ভুলে যাই। বিন্দুমাত্র ক্ষিধে বা পিপাসা অনুভব হচ্ছিল না আর। মনে হচ্ছে যেন এক্ষণি খেয়ে উঠেছি। এই অভাবিতপূর্ব অনুভূতির জন্যে আল্লাহ্কে অশেষ শুকরিয়া জানাই। আমি পুরো তিনটি দিন এভাবে একাকী কিছু না খেয়ে পানির সে’লে আকণ্ঠ ডুবন্ত অবস্থায় আটক থাকি। এরপর সাফওয়াত এসে পানিতে নেমে আমাকে জোরে ধাক্কা দিতে দিতে বলল-
: নিজের ঔদ্ধত্যের উপর আর কতদিন অটল থাকবি? আমি বলেছি, সব কথা আমাকে বলে দিয়ে এ থেকে মুক্তি অর্জন কর। কিভাবে সাইয়েদ কুতুব এবং হুজায়বী নাসেরকে হত্যার পরিকল্পনা নেয় তার পুরো ঘটনা বলে দে। আর তুই আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলকে নাসেরের হত্যার হুকুম দেয়ার কথা বলেছিলি…… ইত্যাদি সব বলে দিচ্ছিসনে কেন?
আমি তাকে বললাম-
: এসব কথা একেবারে অবাস্তব। যে ঘটনা আদৌ ঘটেনি, আমি সে ব্যপারে কি বলব?
আমার জবাব শুনে সে গালি দিতে দিতে ফিরে যায়। এর ঘণ্টা খানেক পর সাফওয়াত ফিরে এসে আমাকে পানির সে’ল থেকে বের করে পাশের অন্য একটি সে’লে আটক করে চলে যায়। এ সে-ই সে’ল, যেখানে সাফওয়াত আমার উপর জঘন্যতম আচরণ করার জন্যে এক সিপাহীকে আদেশ দিয়েছিল। ওকথা ভেবে আমি শঙ্কায় কেঁপে উঠি এবং আল্লাহ্র কাছে ইজ্জত-আবরু রক্ষার জন্যে সাহায্যে প্রার্থনা করি।
একটু পরে সাফওয়াত ইব্রাহীম এক সামরিক অফিসারের সাথে আবার এলো, সে বলল-
: অফিসার তোমার সাথে কথা বলবেন।
অফিসার সাফওয়াতকে যেতে বলে আমার উদ্দেশ্যে বলল-
: তুমি নিজের কল্যাণ এবং স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হও; এটা কি তোমার জন্যে উত্তম নয়? জান, যারা জালিম-অত্যাচারী তারা কোন আল্লাহ্ খোদা মানে না। আল্লাহ্কে তারা ভয় করে না। তা তুমি জান, সেই সৈনিকের কি পরিণাম ঘটেছে? হ্যাঁ সেদিন সে তোমাকে শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে হুকুম অমান্য করেছে বলে তাকে গুলি করে মারা হয়েছে। এখন এরা তোমার জন্যে অত্যন্ত অসভ্য এবং অপরাধ প্রবণতায় অভ্যস্ত লোকদের একটি গ্রুপ তৈরি করছে। আমার অনুরোধ, তুমি এদের কথা মেনে নিয়ে এসব অসভ্য বর্বরদের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা কর। হাসান হুজায়বী…… সাইয়েদ কুতুব……এবং আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল সবাই নিজ নিজ ভুলের জন্যে দায়িত্বশীল।
আমি এই অফিসারের সংবেদনশীল কথা শুনেও চুপ করে থাকি। আমি এর কথাকেও উদ্দেশ্যমূলক প্রতারণা এবং আমাকে ব্ল্যাকমেল করার আর এক চক্রান্ত বলে মনে করছিলাম। সত্যিসত্যিই যে এক ভয়ানক এবং লোমহর্ষক নির্যাতন আমার জন্যে অপেক্ষা করছে, এ সম্পর্কে আমি উদাসীন ছিলাম।
সামরিক অফিসারটি……সম্ভবতঃ মনক্ষুন্ন হয়ে বলল-
: তোমার যা মর্জি কর সাফওয়াত …… এ সত্যিই অনড় দেখছি……।
সাফওয়াত ভিতরে ঢুকে অভ্যাস বশতঃ প্রথমে আমাকে খুব গালি দিল; এরপর বলল-
: আবদুন নাসের শয়তানদের একটি দল পাঠিয়েছে। ওরা তোকে কেটে চিরে খতম করে ছাড়বে। তুই ওদের হাত থেকে কতক্ষণ নিজেকে বাঁচাবি? সময় কেটে যাচ্ছে, প্রতি মুহূর্তে তুই মৃত্যু গহ্বরের নিকটতর হচ্ছিস। এরপর সে সে’লের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেয়।
আসরের নামাজের পর ওরা আমাকে আবার পানির সে’লে পাঠিয়ে দেয়। তিন দিন সেই ভয়ঙ্কর সে’লে কাটানোর পর চতুর্থ দিন সাফওয়াত এসে আমাকে পানি থেকে বের করে অন্য সে’লে বন্দি করে। সেদিন বিকেলেই আসরের পরে আবার পানির সে’লে পাঠানো হয় এবং পঞ্চম দিন বেলা ন’টা পর্যন্তই ওখানেই পানিতে পড়ে থাকি। এভাবে প্রতিদিন এক সে’ল থেকে অন্য সে’লে পাঠিয়ে আমাকে মানসিক এবং দৈহিক যন্ত্রণা দেয়া হচ্ছিল।
আমার সে’লে পশুত্বের লাশ
আমার শরীর এবং মন কোন দিক থেকেই অক্ষত ছিল না। অত্যাচার উৎপীড়নের এই অব্যাহত ধারাবাহিকতা রক্ত-মাংসের মানুষের পক্ষে কতটুকু সহ্য করা সম্ভব? এই নির্যাতনের কোন নজীর নেই। শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিক থেকে প্রচণ্ড অত্যাচার। চাবুক, হান্টার-গালিগালাজ-প্রবঞ্চনা-শাসানী এ সবই নিত্য দিন রুটিনের; মতো আমার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর যারা আমাকে এই অমানুষিক দুঃখ কষ্টে জর্জরিত করছিল তারাও আমার-ই মতো মানুষ। রক্তমাংস-হৃদয় সবই তাদের আছে। কিন্তু পরিবেশ ও প্রশিক্ষণ তাদেরকে এমন করে দিয়েছে যে, আসলে আজ তাদেরকে মানুষ বলেই মনে হয় না। দেখতে-শুনতে তারা হাত-পা বিশিষ্ট মানুষের মত। কিন্তু আসলে তারা মানুষের রুপে এক আলাদা ভয়ঙ্কর জীব। মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এক জঘন্য ভয়ঙ্কর জীব। মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এক জঘন্য সৃষ্টি। তাদেরকে বানানোর উদ্দেশ্যটাও কি আলাদা?
আমাকে পানির সে’ল থেকে উঠিয়ে আবার পাশের সে’লে পৌঁছানো হয় এবং সেখানে সদ্য তেল মাখানো সাফওয়াতের চাবুক আমাকে অভ্যর্থনা জানায়। সে চাবুকের তালে তালে বলল-
: আজ তোমার সাথে যে আচরণ করা হবে তা কেউ কুকুরের সাথেও করে না।
এই বলে সে দরজা বন্ধ করে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর হামজা বিসিউবি সাফওয়াত এবং দু’জন সিপাহী সে’লে প্রবেশ করে।
হামজা অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিতে দিতে বলল- হুজায়ীব, সাইয়েদ কুতুব, আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভুল স্বীকার করেছে এবং তাদের স্বীকৃতিও দিয়েছে। হুজায়বীর কাছ থেকে এটাও জেনেছি যে, সে আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলের মাধ্যমে বলে পাঠিয়েছে যে, নাসেরকে খুন বৈধ-কারণ সে কাফের।
একথা শুনে তার রক্ত চোখে যেন আগুন ঠিকরে পড়ছিল। অগ্নিশর্মা হয়ে বলল-
তোর জানা উচিৎ যে, আমি তোর কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নিয়েই ছাড়ব। বল……বলবি কি-না?
এরপর সাফওয়াত নির্দেশ দিলেন-
: সাফওয়াত, এদের কাজ বুঝিয়ে দাও। আর সিপাহীদের দিকে ইঙ্গিত করলেন-
: কোনও কুত্তার বাচ্চা যদি নির্দেশিত কাজে ফাঁকি দেয় বা হুকুম অমান্য করে তাহলে তাকে আমার অফিসে পাঠিয়ে দেবে।
এরপর সাফওয়াত সিপাহীদেরকে অত্যন্ত কদর্য ও কুৎসিত ভঙ্গিতে কুকর্মের আদেশ দিতে শুরু করে। তার কথা লজ্জা-শরমের শেষ সীমাকেও ডিঙ্গিয়ে যাচ্ছিল।
এক সিপাহীকে সে আদেশ দিল-
: দরজা বন্ধ করে নিজের কাজ করে যাবি। বুঝলি কুত্তার বাচ্চা। …… আর যখন তোর কাজ শেষ হবে তখন তোর সাথীকে পাঠাবি একই কাজ করার জন্যে…… বুঝলিতো।
এই আদেশের পর সে ফিরে যায়।
সিপাহীটি যখন ক্রমে আমার দিকে অগ্রসর হচ্চিল তখন আমি পূর্ণ শক্তিতে চিৎকার করি-
:খবরদার! এক পাও এগুবিনা আর। যদি তুই সামনের দিকে আসার চেষ্টা করিস তো আমি তোকে মেরে ফেলব… মেরে ফেলব… বুঝেছিস। কিন্তা তা সত্ত্বেও সে ক্ষুধার্ত জন্তুর মতো এগিয়ে আসছিল। এরপর আমার এতটুকু মনে আছে যে, আমি লাফিয়ে পড়ে দু’হাতে তার কণ্ঠ চেপে ধরি, আবার পুরো শক্তিতে ‘বিসমিল্লাহ্-আল্লাহ্ আকবর’ বলে তার কণ্ঠে জোরে দাঁত বসিয়ে দিই। হঠাৎ সে আমার হাত থেকে ছিটকে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার মুখ থেকে সাবানের ফেনার মতো ফেনা বেরুচ্ছিল। সে আমার পায়ের কাছে নিঃসাড় হয়ে পড়ে রইল।
আমি ক্ষুধায় পিপাসায় কাতর। প্রতিদিন মার খেয়ে ক্ষতবিক্ষত অসহায় নারী হওয়া সত্ত্বেও বীরের মতো দাঁড়িয়েছিলাম। শুধু ঈমানের বলে বলীয়ান হয়েই, আমি এতো বড় শক্তিমান এক হিংস্র পশুকে যমের মুখে ঠেলে দিতে পেরেছি। সে সময় আল্লাহ্ আমার দুর্বলতা ক্লিষ্ট শরীরে কোত্থেকে যে এত শক্তির সঞ্চার করে দেন তা ভেবে আজও বিস্মিত হই।
সত্য-মিথ্যের এই যুদ্ধেও মিথ্যের পরাজয় হলো। এটা সত্য ও ঈমানের জয় ছিল। সত্যিকার মুসলমানের জন্যে আল্লাহ্র সাহায্যে এভাবেই আসে। মিথ্যের অনুসারীরা যত শক্তিশালী হোক না কেন সত্য পথের নিরস্ত্র এক মুসলমানের সামনে তা টিকতে পারে না। চাই শুধু অটুট মনোবল ও দৃঢ় আত্মবিশ্বাস।
হে খোদা, কতো দয়াময় মেহেরবান তুমি। তোমার অশেষ শোকর।
আল্লাহ্র দ্বীনের বিরুদ্ধে ওরা সব সময় যুদ্ধ করতে এসেছে কিন্তু সাফল্য অর্জন করেছে কেবল ঈমানদাররাই। সত্যিকার ঈমানদার ব্যক্তি কোন দিন ব্যর্থ হবে না।
কিছুক্ষণ পরে সে’ল খুলে জল্লাদের সর্দার হামজা বিসিউবি সাফওয়াত ও অন্যান্য সিপাহীরা ভিতরে আসতেই তাদের দৃষ্টি ভূলুণ্ঠিত সেই জন্তুর উপর পড়ে। ওর মুখ তখনো ফেনায় ডুবন্ত ছিল।
এ অবস্থা দেখে আল্লাহ্র শত্রুরা থ’ হয়ে গেল। তারা বোবার মতো বাকশূন্য; পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলো। এরপর সবাই ভেজা বেড়ালের মতো লেজ গুটিয়ে সরে পড়লো। যেতে যেতে আমাকে আবার পানির সে’লে বন্ধ করে গেল।
ইঁদুরের পাশ থেকে পানির দিকে
একধারে পাঁচ দিন পর্যন্ত আমি পানির সে’লে আবদ্ধ থাকি। ষষ্ঠ দিন আমাকে পানির সেল থেকে বের করে পাশের সে’লে পৌঁছানো হয়।
অনাগত ঘটনাবলীর অপেক্ষায় আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গার উপক্রম হচ্ছিল। এই সে’লেও আমার উপর নানারকম জুলুম অত্যাচারের পাহাড় ভাঙ্গছিল। আমি সব জুলুম থেকে উদাসীন হয়ে আল্লাহ্র ধ্যানে মগ্ন থাকি। সে’লের দেয়ালে ঠেস দিয়ে আমি সারাক্ষণ বসে থাকি।
হঠাৎ আমি অনুভব করলাম, মাথার উপর কিসের যেন খস্ খস্ শব্দ হচ্ছে। উপরে চোখ তুলে দেখি, ভেন্টিলেটরের পথ দিয়ে থলের মুখ খুলে শত-সহস্র ইঁদুর আমার সে’লে পাঠানো হচ্ছে। কি এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। আমার রক্ত যেন হিম হয়ে আসছিল। আমি এই দোয়া পড়তে শুরু করলাম,
আউজু বিল্লাহি মিনাল খুব্ছে অল খাবায়েছে, আল্লাহুম্মা আসরিফ আন্নী আস্সূ বিমা শি-ইতা ও কাইফি শি-ইতা-
“আমি প্রতারণাকারী নারী ও পুরুষের প্রতারণা থেকে আল্লাহ্র আশ্রয় প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ্, আমার নিকট থেকে সকল বিপদ- সে বিপদ কোথায় এবং কেমন তা তুমিই জান-দূর করে দাও”।
এই দোয়া পড়তে পড়তে জোহরের নামাজের আযান হল। তায়াম্মুম করে নামায আদায় করে আবার আল্লাহ্র জিকিরে মশগুল হয়ে পড়ি। এভাবে আসরের আযান হয় এবং আসরের নামাজও আদায় করি।
এ সময় সাফওয়াত এল। সে সে’লে প্রবেশ করার আগেই সব ইঁদুর ভেন্টিলেটরের পথে পালিয়ে গেছে। সে অবাক হয়ে কক্ষময় দৃষ্টি বুলাতে লাগল। সে বুঝেই উঠতে পারছিলনা যে, এতো সব ইঁদুর গেল কোথায়? সে কিছু ভেবে কুলকিনারা না পেয়ে আমাকে অস্পষ্টভাবে গালি দিতে দিতে পানির সে’লে বন্ধ করে চলে যায়। কিছুক্ষণ পড়ে রিয়াজকে নিয়ে সে আবার ফিরে আসে। রিয়াজ পদস্থ অফিসার। সে সে’লের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আমাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করছিল। সে বলল-
: ইখওয়ানের সংগঠন নাসেরের হত্যা, ক্ষমতা দখল এবং সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করছিল।
আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে প্রতিবাদ করলাম-
: সবই বাজে কথা, মিথ্যে। কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক যুবকদের গড়ে তোলার জন্যে আমরা সংঘবদ্ধ হয়েছিলাম। ইসলামকে বুঝে শুঝে তারপর আমরা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের চেষ্টা চালাতাম।
: এখনো তুমি সে কথাই বার বার বলছ……? এবার তাহলে বুঝবে যে…… শাস্তি কাকে বলে। যা এতদিন ভুগেছো তাতো শুধু প্রাথমিক পর্যায়ের শাস্তি ছিল। এরপর সে চলে গেল আমি পানিতেই পড়ে রইলাম। এভাবে আট দিন পড়ে রলাম সেই বন্ধ পানির সে’লে। কি দুঃখ দুর্দশা আর অস্থিরতার মধ্যে কাটছিল সেসব দিন, তা বুঝিয়ে বলা অসম্ভব। তখন আমাকে দেখে যে কেউ শোকগাথা রচনা করতে পারতো।
নবম দিনে রিয়াজ, সাফওয়াত এবং উর্দি পরিহিত একজন অফিসার এসে আমাকে সেই ময়লা দুর্গন্ধময় পানি থেকে বের করে। রিয়াজ আমাকে ধমক দিয়ে বলল-
: এটা তোমার মুক্তির শেষ সুযোগ। হয় সব স্বীকার কর না হয় মৃত্যু বরণ কর।
তোমার আল্লাহ্র কাছে জাহান্নাম আছে তা ঠিক…… কিন্তু এখানে আবদুন নাসেরের কাছেও জাহান্নাম আছে এবং জান্নাতও আছে। জামাল নাসেরের জান্নাত ও জাহান্নাম তোমার আল্লাহ্র জান্নাত-জাহান্নামের মত কল্পিত বিষয় নয় বরং এটা সাক্ষাৎ বাস্তব।
ওরা আমাকে পানির সে’ল থেকে বের করে পার্শ্ববর্তী অন্য একটি সে’লে বন্ধ করে চলে যায়। আমি আল্লাহ্র আছে এসব লোকের অনিষ্ঠ থেকে মুক্তি কামনা করি।
আমি মোনাজাতে ব্যস্ত থাকা কালেই সাফওয়াত ও হামজা বিসিউবি দশজন সিপাহী এবং একজন অফিসারসহ সে’লে প্রবেশ করে। সাফওয়াত হামজাকে জিজ্ঞেস করলো-
: পাশা! এই মেয়ের ব্যাপারে আপনার হুকুম কি? জবাবে হামজা সিপাহীদের শুনাল-তোমরা কি খাবে?
: সিপাহীগণ জানাল, চা খাবো।
হামজা রেগে বলল-
: আরে ধ্যাৎ! চা খাবি; কুত্তার বাচ্চারা; চা নয়, হে সাফওয়াত, এদেরকে মদ, চরস, হাসীস এনে দাও-এছাড়া যা চায়, এনে দাও এবং ওকে এদের হাতে ছেড়ে দাও। এরা ওর সাথে যা চায় তা করুক, আমি আমার পক্ষে থেকে পুরোপুরি সমর্থন জানালাম।
এরপর তারা সে’ল বন্ধ করে চলে যায়। আমি সে’লে আসরের নামাজ আদায় করছিলাম। সিজদাতে থাকতেই হটাৎ সাফওয়াত এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে বের করে পানির সে’লে নিয়ে বন্ধ করে দেয়।
রিয়াজ ফিরে এসে বলল-
: তুমি পাক-পবিত্র থাকতে চাইছো? তোমাকে শায়েস্তা করার জন্যে ওসব সিপাহীকে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। ওরা সব হোস্টেলে গেছে। আগামী কালই আসবে এবং তারা তোমার গোশত্ ছিঁড়ে খাবে। হাসপাতালে ওদেরকে বিশেষ ইঞ্জেকশন দেয়া হয়েছে। ওরা এখন উন্মাদ কুকুরের মতো হয়ে আছে। এ সবকিছু প্রেসিডেন্ট নাসেরের আদেশে করা হয়েছে। নাসের তোমাকে জিন্দা ছাড়বেনা। আমরা সবাই তোমাকে বুঝাবার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। কতো কষ্ট করে তোমাকে বুঝাতে চেয়েছি, কিন্তু তুমি নিজের জিদ ছাড়নি। এখন তুমি পাক-পবিত্র থাকবে কেমন করে বলতো? বল, জবাব দাও! তোমার হান্টার কোথায় সাফওয়াত? সাফওয়াত আমাকে মারতে শুরু করে এবং রিয়াজ তাকে আরো মারার জন্য উস্কানি দিতে থাকে।
: সত্যাগ্রহী মেয়ে! তুমি বুঝি মনে কর, তোমার মৃত্যুর পর ৩০ বছর পরে তোমার স্মৃতিতে লোকেরা মসজিদ-মাজার তৈরী করে কারাগারে তোমার মহৎ কীর্তির স্বীকৃতি দেবে এবং বলবে যে, এ-ই সেই জয়নব আল-গাজালীর স্মৃতি সৌধ, যিনি কারা নির্যাতনের শেষ সীমায় পৌঁছেও নিজের ঈমানী নীতিতে অটল ছিলেন……? কিন্তু তোমার জেনে রাখা উচিৎ আমরা তোমার সাথে কি আচরণ করছি এবং আরো করবো তা মানুষ তো দূরের কথা শয়তানও টের পাবে না।
ব্যথা-যন্ত্রণার কাতর সত্ত্বেও ওর কথা শুনে আমার মুখে অবজ্ঞার হাসি ফুটে উঠল। আমি তার মিথ্যে দর্প ও গর্বকে চূর্ণ চূর্ণ করার জন্যে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম-
: তুমি যা বলছ তা সত্য হতো তাহলে আল্লাহ্পাক আমাদেরকে তোমাদের অনিষ্ঠ থেকে বাঁচিয়ে রাখতেন না; তোমাদের কথামত আবদুন নাসেরের তথাকথিত জাহান্নামে বসেও হাসতে পারতাম না, আল্লাহ্ আমাকে এত দুঃখ কষ্ট সহ্য করার শক্তি দিতেন না……। বস্তুতঃ আমরা সত্যসন্ধানী। আমরা কেবল আল্লাহ্র সন্তুষ্টি কামনা করি। ইনশাআল্লাহ্ আমরা সাফল্যমণ্ডিত হবো এবং যাদেরকে তোমরা আমার গায়ের গোশত কামড়ে খাওয়ার জন্যে তৈরী করেছো তাদের বিষ দাঁত ভেঙ্গে পড়বে।
আমার স্পষ্ট কথা শুনে রিয়াজ শঙ্কিত চোখে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। সাফওয়াত তখন একটু দূরে কোথাও ছিল। সে সাহায্যের জন্যে তাকে ডাকতে লাগল-
: জলদি এস সাফওয়াত…… এই মেয়ে তো বক্তৃতা শুরু করে দিয়েছে। ……আর চাই কি, সাফওয়াত বিজলির মতো তেড়ে এসে আমার ক্ষত-বিক্ষত শরীরের উপর শপাং শপাং চাবুক চালাতে চালতে রিয়াজকে বলল-
: জনাব একে আমার জন্যেই ছেড়ে দিন। কালই দেখে নেবেন যে এর কি অবস্থা হয়েছে।
এরপর তাঁরা প্রতিদিনকার মতো আবার পানির সে’লে বন্ধ করে চলে গেল। দুঃখ যন্ত্রণায় আমার শরীর ও মনের তখন কি শোচনীয় অবস্থা তা কেবল আল্লাহ্ই জানেন। এমন অবস্থায় কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। কিন্তু কেবল ঈমানের জোরেই আমি বেঁচে রয়েছি।
দেশের দুরাবস্থার জন্যে ভীষণ দুঃখ হলো আমার। অত্যাচারী শাসকের অধীনে দেশের সঠিক পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অসন্তুষ্ট অশান্ত জনগণ, ক্ষমতা-মদ-মত্ত নিষ্ঠুর শাসকদের সামনে অসহায়; আইন- কানুন বলতে কিছু নেই। ক্ষমতাসীন দল যা মর্জি তা করে বেড়াচ্ছে। দারুন অরাজকতা চলছে দেশময়।
দেশ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে গিয়ে দেশের দুরাবস্থা দেখে তার তুলনায় নিজের দুঃখ যন্ত্রণাকে বড্ড তুচ্ছ মনে হলো, কিন্তু মানসিকভাবে আমার দুঃখ আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেলো যেন। সমগ্র দেশটাকেই মনে হচ্ছিল বন্দী শিবিরের মতো আর হামজা সাফওয়াত ও রিয়াজরা সারা দেশের নিরীহ জনতার উপর অত্যাচারের ষ্ট্রীমরোলার চালাচ্ছিল। ভয় আতঙ্ক আর সন্ত্রাসের এক অদ্ভুত রাজত্ব চলছে। এসব লোক একই গোষ্ঠীর পৃথক পৃথক নাম মাত্র। জাতে-স্বভাবে এরা প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে জল্লাদ পর্যন্ত একই প্রকৃতির। এরাই দেশকে, দেশের জনগণকে লুণ্ঠন করছে; শোষণ করছে এবং বিদেশী শক্তিবর্গের সাথে জাতির বৃহতর স্বার্থের বিকিনি করছে।
হায় দেশ! আমার হতভাগ্য দেশ……না-না বলছি, হতভাগ্য হবি কেন তুই! কারণ তোর সন্তাদের কাছে রয়েছে কুরআন ও সুন্নাহর অমূল্য সম্পদ। তাওহীদ রিসালাতের নীতিকে সামনে রেখে তারা পুনর্জাগরণে বদ্ধপরিকর। আমার মতো বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা শেষ হয়ে গেলেও……এগিয়ে আসছে নবীন তরুণদের দল। তাদের বিজয় পতাকা তোর বুকে আল্লাহ্র দ্বীন কায়েমের প্রতিশ্রুতিতে সমুন্নত। আজ না হয় শয়তানের রাজত্ব চলছে, কিন্তু অদুর ভবিষ্যতে তোর বুকে কায়েম হবে আল্লাহ্র শাসন, আজকের অন্ধকার কেটে গিয়ে কাল উদয় হবে নতুন যুগের সোনালি সূর্য…… মানুষ আবার তার প্রকৃত প্রভুর দরবারে হবে সিজদাবনত।
পানি থেকে এটর্নির দিকে
বারবার একই ধরনের ঘটনাবলী উল্লেখ করছি বলে আমি দুঃখিত। কিন্তু যা যেভাবে ঘটেছে তা যথাযথ তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করা যায় না। এজন্যে সব ঘটনা অনেকটা একই ধরণের হলেও তুলে ধরছি।
আমরা যখন কারাগারে এসব অত্যাচার সহ্য করছি তখন আমার দেশ মিশরের কি অবস্থা? বলতে পারেন, দারুন দুরাবস্থা। জনগন সদা সন্ত্রস্ত্র; কারো জীবনে কোন নিরাপত্তা নেই। সর্বত্র জোর-জুলুম আর অত্যাচারের জয় জয়কার। যারা সে’লের বাইরে ছিল, তারা আরো বেশি শংকিত। লুট-তরাজ, হত্যা, রাহাজানী, ছিনতাই চলছিল সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়। ভাড়াটে গুন্ডা এবং অসৎ দুষ্কৃতিকারীদেরকে সর্বত্র মোতায়েন করা হয়েছিল জনগণকে শায়েস্তা করার জন্যে। তাদের লাগামহীন উপদ্রবে জনসাধারণের জান-মাল ইজ্জত-আবরু হয়ে পড়েছিল মূল্যহীন। সততা-সভ্যতার কোন অর্থ তারা বুঝতোনা। মান-মর্যাদা বা শিক্ষা-দীক্ষায় কোন দাম ছিল না তাদের কাছে। চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিকসহ, সাংবাদিক, কবি, আলেম, শিক্ষক, জননেতা, এমনকি সৎপ্রকৃতির সামরিক অফিসাররা পর্যন্ত ওসব দুর্বিত্তদের হাতে লাঞ্ছিত অপদস্ত হচ্ছিল। কিন্তু কারো মুখে টু-শব্দ বের করার উপায় ছিল না। কারণ প্রেসিডেন্ট নাসের নিজেই এসব দুর্বৃত্ত ও সমাজবিরোধী চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছিল।
কিশোর, নবীন, বুড়ো, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেশের শান্তিকামী প্রতিটি নাগরিকই এভাবে নাজেহাল হচ্ছিল। সম্ভ্রান্ত লোকদের পিছনেও এরা লেলিয়ে দিত। আর কোন ব্যক্তি যদি এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতো তাকে কোন না কোন অভিযোগে গ্রেফতার করে চাবুক-হান্টার মারা হত, কুকুরের ভিড়ে ছেড়ে দেয়া হতো এবং শেষ পর্যন্ত ফাঁসীর কুঠুরী পর্যন্ত বেড়িয়ে আসতে হতো। এই ছিল নাসেরের শাসনামলে মিশরের সাধারণ অবস্থা। যাই হোক নবম দিন খুব ভোরে সাফওয়াত এসে আমাকে পানির সে’ল থেকে বের করে বলল-
: তোমাকে এ্যাডভোকেট আন্নায়াবাতার কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তোমার সাজা হয়ে গেছে। অবশ্য এখনো চাইলে নিজেকে বাঁচাতে পার। এরপর এই বলে ধমক দিল-
: নিশ্চয়ই তুমি আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত রয়েছ। এখন আমরা দেখবো যে, এ্যাডভোকেটের সামনে তুমি কি বলছ। এসব বলতে বলতে সে আমাকে পশুর মতো টানতে লাগল। আমি তাকে বললাম-
: দেখ আমার পরণের কাপড় একেবারে ছিঁড়ে গেছে। এসব আর পরণের উপযুক্ত নেই। …… আমার অন্য কাপড় এনে দাও আমাকে।
সে আমার কথার বিশেষ কোন গুরুত্ব না দিয়ে বলল-
: তা দেখা যাবে, তবে তুমি যদি হাসান হুজায়বী এবং সাইয়েদ কুতুবের ব্যাপারে বল যে, তারা আবদুন নাসেরকে হত্যা করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছে…… তাহলে তোমাকে একখানা চাদর এনে দেব।
আমি বললাম-
: না-না, ওসব মিথ্যে কথা।
তখন সে বলল-
: তাহলে উলঙ্গই থাক। দেখি তোমার ইসলাম তোমার লাজ ঢাকতে পারে কিনা! আর ইখওয়ানরাও তোমাকে এ-ই অবস্থাতেই দেখুক।
আমি অসভ্য বর্বরের মুখে এসব কথা শুনে বললাম-
: নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ অসহায়ের সহায় এবং অত্যন্ত দয়ালু সর্বজ্ঞ এবং সুবিচারক।
আমাকে সামরিক কারাগার থেকে বের করে আলাদা এক বিল্ডিংয়ের প্রশস্ত কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। কক্ষের মাঝামাঝিতে এক ভদ্রলোক বসেছিলেন। পরে জেনেছি তিনি ছিলেন জালাল আদীব। তিনি আমার দিকে এক নজর দেখে বললেন-
: বসুন।
আমি টেবিলের বিপরীতে চেয়ারে গিয়ে বসি। তিনি আলোচনা শুরু করতে গিয়ে বললেন –
: আপনি ইসলামী আন্দোলনের প্রখ্যাত নেত্রী জয়নব আল-গাজালী। আপনি নিজে এমন অভিমত গ্রহণ করলেন কেন? যে অবস্থায় আপনি আছেন তাতে কি আপনি সুখী? দেখুন, আমি মুসলমান এবং আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী, আপনাকে এই অবস্থা থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যেই আমি এসেছি। আমার নাম ফকরুদ্দিন আন্নায়াবাতা। আমি ভাবতেও পারছিনে যে, জয়নব আল-গাজালীর মতো প্রখ্যাত নেত্রী আমার সামনে এমন অবস্থায় বসে আছেন। আমি যথার্থই আশা করব যে, নিজেকে এ থেকে মুক্ত করানোর প্রচেষ্টায় আপনি আমার সহযোগিতা করবেন।
আমি তার জবাবে বললাম-
: দেখুন, যা সত্য এবং যাতে আল্লাহ্ সন্তুষ্ট, তা আমি অবশ্যই বলব। আল্লাহ্র শপথ করেই আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি।
আমার কথা শুনে তাঁর কপালের রেখা কুঞ্চিত হয়ে উঠলো। তিনি কিছুটা বিরক্তির সাথেই জিজ্ঞেস করলেন-
: বর্তমানে আপনার বয়স কত?
: ১৯৭১ সালের ২রা জানুয়ারি আমি জন্মগ্রহণ করি।
আমার বয়স জেনে তিনি স্তম্ভিত হয়ে বললেন-
: আমি তো আপনাকে দেখে মনে করছি আপনার বয়স নব্বই বছরের কম নয়। উহ্, বলুনতো কেন এই দুরাবস্থায় পড়তে এলেন? এর উত্তরে আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম-
: আল্লাহ্ আমাদের কিসমতে যা রেখেছেন তাতো হবারই কথা। আল্লাহ্ই আমাদের পরম বন্ধু এবং তিনিই প্রত্যেক মু’মিন মুসলমানের শেষ ভরসা।
তিনি সমবেদনার সাথে বললেন-
: আমার মনে হচ্ছে কথা বলতেও আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে।
আমি চুপ করে থাকলাম। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন-
: আপনি এবং আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল কোন বিষয়ে একমত হয়েছিলেন?
: আমরা যুবকদের ইসলামী প্রশিক্ষণ দান এবং কুরআন ও সুন্নাহ শিক্ষা দানের ব্যাপারে একমত হয়েছিলাম। বর্তমান সামাজিক সমস্যাবলীর সমাধানের জন্যে তা অপরিহার্য ছিল।
তিনি আমার কথা কেড়ে নিয়ে বললেন-
: দেখুন আমি বক্তৃতা শুনতে আসিনি বরং শুধু বাস্তব ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা চাচ্ছি। জনাব হুজায়বী আপনাকে আবদুল ফাত্তাহর কাছে একটি পয়গাম পৌঁছাতে বলেন এবং অন্য একটি পয়গাম সৈয়দ কুতুবের কাছে পৌঁছাতে বলেন; ওসব পয়গাম কি ছিল? আমি মনে করি আমার প্রশ্ন খুবই স্পষ্ট। কি বলেন?
আমি এবার বললাম-
: আমি মুর্শিদে আ’ম হুজায়বীর কাছে যুবকদের সামষ্টিক পাঠ সমাবেশ বিষয়বস্তু হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে কুরআন, হাদীস ও ফিকাহ্র ভিত্তিতে কয়েকটি গ্রন্থ, যেমন ইবনে হামজা এর মুহাল্লা ইবনে আবদুল ওহাব ও ইবনে তাইমিয়ার কিতাবুত তাওহীদ এবং সাইয়েদ কুতুবের রচনাবলী পাঠ্যসূচিতে শামিল করার অনুমতি চাই। যুবকদের মধ্যে ভাই আবদুল ফাত্তাহ ও শামিল ছিলেন।
এ্যাডভোকেট সাহেব ম্লান হেসে বললেন-
: না জয়নব, এসব কথা নয়, আসল কথা বলুন। নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করুন। প্রকৃত ঘটনা আমার কাছে খুলে বলুন।
আমি বললাম-
আসল কথা এবং প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে নবী বংশধর তথা মুসলিম মিল্লাতের পূর্নগঠন ও পুনর্জাগরণ। তিনি এবার জোর দিয়ে বললেন-
: ওরা সবাই ভুল স্বীকার করে আপনাকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন। আমি স্বাভাবিক গম্ভীর কণ্ঠে বললাম-
: আল্লাহ্ আমাকে এবং তাঁদেরকে নিরাপদ রাখবেন। আমরা মিথ্যের দিকে ফিরে যাবো না।
এর জবাবে তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন।
: আমার মনে হচ্ছে আপনি কেবল আপনার বাগ্মিতার শক্তি প্রদর্শনই করে যেতে চাচ্ছেন। আপনি আত্ম প্রবঞ্চনায় ভুগছেন, এমনকি উচ্চতর আদালতও আপনার সাথে কোন মতৈক্যে পৌঁছুতে পারছে না। আমার তখন সত্যি কথা বলার শক্তি ছিল না। বড্ড কষ্ট হচ্ছিল; কিন্তু তাঁর উচ্চতর আদালতের বয়ান শুনে আমি বলতে বাধ্য হলাম।
: উচ্চতর আদালত যদি তার দায়িত্ত ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন ও সজাগ থাকতো তাহলে……
তিনি আমাকে বাধা দিয়ে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন-
: আপনি থামুন! এখন দেখছি মিশরের উচ্চতর আদালত সম্পর্কেও আপনি যা তা বলতে যাচ্ছেন……
এরপর তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা সাফওয়াতকে ডেকে বললেন-
: কোন লাভ নেই সাফওয়াত! তিনি তো আদালতকেও অপমান করলেন।
সাফওয়াত যেন অপেক্ষায় ছিল। সে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে এটর্নির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-
: কোথায় হুজুর?
এটর্নি বলল পানির দিকে। তারপর আবার পানি এবং সাফওয়াত বিরামহীন অব্যাহত চাবুকের শিকারক্ষেত্রে ফিরে গেলাম। সে এবার নতুনভাবে আরো নিষ্ঠুর নির্দয়ভাবে এবং নির্লজ্জভাবে আমার উপর জুলূম শুরু করল। কিন্ত তার বর্বরতা যত তীব্রতর হচ্ছিল, আল্লাহ্র সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল তার চেয়ে বেশী।
আল্লাহ্ এমন হীন-নিষ্ঠুর-মূর্খ জালিমদের হাত থেকে মুসলমানদের রক্ষা করুন।
খাদ্য এবং চাবুক
দশম দিন আসরের পর সে’লের দরজা খুলে আমাকে পানি থেকে বের করে অন্য দু’জন জল্লাদের কাছে হস্তান্তর করে বলা হল-
: তিন নম্বর সে’লে রেখে এস।
তিন নম্বর সে’লে গিয়ে আমি নিষ্প্রাণ লাশের মত মাটিতে পড়ে রলাম। আঘাতে আঘাতে ফুলে-ফেঁপে আমার শরীর ফুটবলের মত গোল হয়ে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল, যেন প্রাণ এই বুঝি দেহের সম্পর্ক ছেড়ে যাচ্ছে। আহ্ উহ্ করার মত শক্তিও তখন আমার নেই। আমি পরম করুণাময় আল্লাহ্র কাছে আমার জান-প্রাণ সমর্পণ করলাম। যাঁর হাতে সমগ্র বিশ্বের নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি, সেই মহান আল্লাহ্র উপরই ভরসা করে পড়ে রলাম।
এই অচেতন অর্ধচেতন অবস্থায় কতক্ষণ পড়েছিলাম, জানি না। হটাৎ সে’লের বাইরে ভীষণ হৈ-হুল্লা শুনে কোন রকমে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে ছিদ্রপথে বাইরে তাকিয়ে দেখি, ইখওয়ান ভাইদের এক বিরাট জমায়েত লাইন বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে পেয়ালা। লাইনের মাথায় এক সিপাহী এক জাতের তরল খাদ্য ওদের পেয়ালায় তুলে দিচ্ছে। ওরা যখন খাদ্য-দ্রব্য নিতে সামনে আসে তখন অন্য এক জল্লাদ প্রত্যেকের পিঠে চাবুক মারে। খাদ্য ও চাবুক একই সাথে প্রদানের এই হৃদয় বিদারক দৃশ্য এর আগে কেউ কোন দিন হয়তো কল্পনাও করেনি। হায়রে জুলুম।
শুধু তাই নয়। ইখওয়ানদের লাইনের উভয় পাশে সিপাহীদের দু’টি কাতারও চাবুক হতে দাঁড়িয়েছিল। ইখওয়ানরা পেয়ালার খাদ্য নিয়ে ফেরার পথে এসব সিপাহীর চাবুকের তীব্র আঘাতও হজম করছিল। এভাবে এক মুঠো অন্নের বিনিময়ে তাদেরকে খেসারত হিসেবে অজস্র চাবুকের আঘাতও সইতে বাধ্য করা হচ্ছিল। আমি যে লুকিয়ে এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখেছিলাম , তা এক জল্লাদ টের পায়। আর তৎক্ষণাৎ সে উন্মত জানোয়ারের মতো তেড়ে এসে আমাকে এমন প্রচণ্ড ঘুঁষি এবং লাথি মারতে থাকে যে, আমি আবার অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি।
দুরাচার সাফওয়াত এবং তার এক সহকারী অনেক চেষ্টা করে আমার হুঁশ ফিরিয়ে আনে। তার হাতে একটি পাত্রে কালো বর্ণের একটুখানি ডাল দেখা গেল। তা থেকে ভীষণ রকমের দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল। সাফওয়াত আমাকে বলল-
: এসব খেয়ে নাও। না খেলে দশ চাবুক-
আমি বললাম-
রেখে দাও। আমি খেয়ে নেব।
সাফওয়াত তার সহকারীকে বলল-
: দশ মিনিটের মধ্যে যদি সে এসব না খায় তাহলে তাকে দশ চাবুক লাগিয়ে আমাকে খবর দিও। অত্যন্ত দুঃখ-যন্ত্রণা এবং অস্থিরতার মধ্যে সেই রাতটিও কাটিয়ে দিই।
হাসপাতালে
একাদশ দিনে সাফওয়াত সে’লের দরজা খুলে ভিতর থেকে কাউকে ডেকে বলল-
: ডাক্তার মাজেদ, ভিতরে আসুন।
ডাক্তার মাজেদ সামরিক উর্দিতে তার কম্পাউন্ডার সিপাহী আবদুল মাবুদের সাথে ভিতরে এলেন। তখন আমার পা থেকে রক্ত এবং পুঁজ বেরুচ্ছিল। এছাড়াও সারা শরীরের অবস্থাও ছিল তথৈবচঃ ঘা-ক্ষত আর তার আনুসঙ্গিক অসহ্য যন্ত্রণা।
ডাক্তার মাজেদ তার সহকারীকে বললেন, এঁর উভয় পা’কে খুব ভাল করে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে এবং পায়ের ভিতর থেকে সব দুষিত রক্ত ও পুঁজ বের করে শিগগির হাসপাতালে পৌঁছাও। এরপর দু’জন জল্লাদ আমাকে হাসপাতালে রেখে আসে।
আবার শামসের কবলে
মাত্র একদিন আমাকে হাসপাতালে থাকতে দেয়া হয়। আমাকে দৈহিক ও মানসিক আঘাত না দিয়ে তাদের স্বস্তি ছিল না। সুতরাং আবার শাস্তির তীব্রতা শুরু করা হয়। অবশ্য এবার আমাকে জায়গা বদলে হাসপাতালেরই কারাগারে রাখা হয়। অবশ্য অত্যাচার অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালের কারাগারে আমি অপেক্ষাকৃত শান্তি অনুভব করছিলাম। এজন্যে আমি আল্লাহ্র শোকর আদায় করি। হাসপাতালের কারাগারে থাকার সময় দীর্ঘ হোক, আমি মনে মনে তা কামনা করছিলাম। এতে আমার ক্ষত শুকাবে এবং হাড়ের ব্যথা কমতে পারে বলে ভাবছিলাম। কিন্তু হায়! জল্লাদরা আমার সেই সামান্য অংশটুকু পূরণ হতে দিল না। তারা আমাকে আবার সেই তিক্ত-বিষাক্ত জাহান্নামে পৌঁছিয়ে দিল।
জল্লাদ আমাকে শামস বাদরানের অফিসে নিয়ে চলল। আমি অতি কষ্টে পথ চলছিলাম। নিজের ওজন বইবার ক্ষমতাও আমার ছিল না। কিন্তু ওরা এই অবস্থাতেই আমাকে বেত্রাঘাত করতে দ্বিধাবোধ করেনি। পথ চলায় সামান্যতম শিথিলতা দেখলেই তাদের চাবুক আর হান্টার আমার খবর নিতো। আমি হাসপাতাল থেকে শামস্ বাদরানের অফিস পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যেতে পারিনি। দুর্বলতার কারণে মাটিতে ঢলে পড়ি। কিন্তু জল্লাদরা আমাকে পড়ে থাকতে দেয়নি। তারা মাটিতে টেনে টেনে আমাকে শামস্ বাদরানের অফিসে পৌঁছায়।
খুনি জালিম শামস বাদরানের দৃষ্টি আমার উপর পড়া মাত্রই সে সাফওয়াতকে ডেকে রাগের বশে অদ্ভুত সব নর্তনকুর্দন শুরু করে। মনে হচ্ছিল যে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করছে। রাগে তার চেহারা বিকৃত হয়ে গিয়েছিল তার চোখ দুটো দেখাচ্ছিল জ্বলন্ত কয়লার মত লাল। সে সাফওয়াতকে ডেকে বিপরীত দিক থেকে আঙ্গুলের ইশারায় বলল-
একে এক্ষুণি উল্টো করে লটকিয়ে দাও এবং পাঁচশো চাবুক লাগাও। বর্বরতার উপর চরম বর্বরতা। এমন হিংস্রতা আর নৃশংসতার নজীর কেবল শামস বাদরানরাই দেখাতে পারে। সাফওয়াত তার প্রভূর নির্দেশ মতো লটকিয়ে এক দুই করে পাঁচশো চাবুকের মার পূরণ করতে শুরু করে। আমি অসহ্য যন্ত্রণায় আল্লাহ্ আল্লাহ্ ডাকছিলাম। শামস বাদরান ভেংচি কেটে বলছিল কোথায় তোর আল্লাহ্ যাকে তুই ডাকছিস? আল্লাহ্ যদি বাস্তবিকই থাকতো, তাহলে অবশ্যই তোকে সাহায্য করতো। দেখ তুই আবদুন নাসেরকে ডাক, এক্ষুণিই সে তোকে সাহায্য করবে। এবার সে আল্লাহ্ সম্পর্কে এমন সব ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তি করে যে, কোন মুসলমানই তা সহ্য করতে পারবে না। পাঁচশো চাবুক পুরো হলে আমাকে নামিয়ে দাঁড় করানো হয়। আমার আহত পা বেয়ে তখন দরদর করে রক্ত গড়াচ্ছে। তা দেখে শামস বাদরান বলল- একে আরও কঠিন শাস্তি দাও এবং তাই হবে এর পায়ের চিকিৎসা। একটু পরে আমি দেয়ালে ঠেস দিই এবং অসহ্য শান্তি ক্লান্তিতে বসে পড়ি। এ দেখে সাফওয়াত পূর্ণ শক্তিতে আমাকে টেনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সম্ভব হয়নি।
ঠিক তক্ষুণি সামরিক কারাগারের জঘন্যতম পশু হামজা এসে বলল-
: এসব অভিনয় করা হচ্ছে।
এরপর আর কি হয়েছে, জানিনা। কারণ আমি অচেতন হয়ে পড়ি। আবার যখন জ্ঞান ফিরে পাই তখন আমি ডাক্তারের পাশে। ডাক্তার আমার বাহুতে ইনজেকশন দিচ্ছিলেন। ইনজেকশন দেয়া হলে ডাক্তার আমাকে এক পেয়ালা কমলার রস খাওয়ানোর জন্যে ওদের নির্দেশ দেন। কিন্তু কে শোনে ডাক্তারের হুকুম। শামস বাদরান আমাকে বলে-
: এভাবে জেদ ধরে থেকে কোন লাভ হবে না। আমরা যা চাই, তা কর; নয়তো একবার, দু’বার, তিনবার নয়, বরং শত-শতবার তোমাকে উল্টো লটকিয়ে পিটানো হবে। এটা মনে করো না যে, আমরা তোমার কাছে থেকে কথা বের করতে অক্ষম। আসলে আমরা তোমাকে সুযোগ দিচ্ছি মাত্র বুঝছো? তোমাকে যদি আমরা জীবিত অবস্থাতেই মাটিতে পুঁতে দিই তাহলেও কেউ জিজ্ঞাসা করতে আসবে না যে, এমন করলে কেন? কে আমাদের বাধা দেবে?
আমি বললাম-
: আল্লাহ্ যা চান তাই হয়। আল্লাহ্র সন্তুষ্টি জন্যে আমরা তাঁরই শোকর আদায় করি।
একথা শুনে সে জ্বলে উঠে বলে –
: এ ধরনের কথা আমার সামনে বলবে না।
হাসান খলীলও আমাকে উপদেশ দিয়ে বলল-
: জ্ঞান-বুদ্ধি খরচ কর মেয়ে। তোকে এখানে বাঁচানোর জন্যে কোন ইখওয়ান কাজে আসবে না। ওরা নিজেরা নিজেদের বিপদে বেসামাল। ওরা তো কোন রকমে মুক্তি পেতে চায়। এরপর সে কাগজ-কলম বের করে পরামর্শের সুরে বলল-
: সাফওয়াত! একে হাসপাতালে নিয়ে যাও এবং সেখানে স্বাধীনভাবে ইখওয়ান সম্পর্কে লিখতে দাও, কেমন করে কিভাবে সে ইখওয়ানদের সংস্পর্শে আসে, তা সে বিস্তারিত লিখবে। আর আবদুন নাসেরকে হত্যার ব্যাপারে কিভাবে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়, তা এবং ইখওয়ানের মধ্যে যাদের নাম জান, সব লেখ।
হাসপাতালে যাওয়ার পথে সাফওয়াত আমাকে জোরে পা চালাতে হুকুম করে। কিন্তু আমার অবস্থা ছিল সদ্য হাটি হাটি পা-পা করছে এমন শিশুর মতো। এজন্যে সাফওয়া আমাকে চলার পথেই থেমে থেমে চাবুক লাগাতে লাগাতে বলে-
: এ হচ্ছে তোর পায়ের চিকিৎসা।
হাসপাতালের কক্ষ পর্যন্ত আমি কিভাবে যে পৌঁছেছি, তা কেবল আল্লাহ্ই জানেন। সাফওয়াত আমাকে কাগজ কলম ধরিয়ে দিতে গিয়ে বলে-
: ওরে ক্ষুধে ইখওয়ানী! স্বাভাবিক ভাবেই তুই আমাদের উদ্দেশ্য জানিস। তাই বলছি, কোন দার্শনিকতার দরকার নেই। যা জানিস, তা ঠিক ঠিক লিখে দে। কিভাবে জামাল নাসেরকে খুন করতে চেয়েছিলি এসব লেখ…… বলতে বলতে সে দরজা বন্ধ করে চলে যায়।
আমার উভয় হাতে ফোস্কা পড়েছিল বলে আমার পক্ষে কলম ধরা মুশকিল ছিল। প্রথম দিন এভাবেই কেটে গেল। আমি একটি অক্ষরও লিখিনি। সাফওয়াত লিখিত বক্তব্য নিতে এসে সাদা কাগজ পড়ে থাকতে দেখে বলল-
: তোমার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে আমি আবার কাগজ রেখে যাচ্ছি। সে যেমন এসেছিল, তেমনই চলে গেল।
আমি শেষ পর্যন্ত ব্যথাগ্রস্ত হাত নিয়েই লিখতে শুরু করি। তৃতীয় দিন হামজা বিসিউবি এসে সব কাগজ একত্রিত করে নিয়ে যায়। আমি সারাটি দিন অত্যন্ত অস্থিরতার মধ্যে কাটাই। পায়ের ব্যাথার জন্যে বসে থাকা, দাঁড়ানো বা ঘুমানো কোনটাই সম্ভব হচ্ছিল না। প্রতিটি হাড়ে ব্যথা করছিল। একেবারে অসহ্য অবস্থা। সাফওয়াত আগের পথেই আমাকে শামস বাদরানের অফিসে নেয়ার জন্যে আরো দু’জন সিপাহীকে নিয়ে এলো। আমি শামস বাদরানের কক্ষে ঢোকা মাত্রই সে আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিকটভাবে চেঁচাতে লাগলো এবং আমার লিখিত কাগজগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ডাস্টবিন এ ফেলে দিয়ে বলল-
: হায়রে মেয়ে, তোর জন্যে এতোসব শাস্তিও কি যথেষ্ট হলোনা? ……এসব কি লিখেছিস তুই? সব বাজে কথা………। তারপর হামজাকে ডেকে বললো –
: একে চাবুক লাগাও।
হামজা ও খলীল সমস্বরে বলল :
: না পাশা; তার চেয়ে একে কুকুরের সে’লে হিংস্র কুত্তাদের মধ্যে পাঠানো উচিৎ। শামস বাদরান উত্তেজিত কণ্ঠে বলল-
: কুকুর গুলো এখানে নিয়ে এসো তাহলে-
সাফওয়াত ও তার সহযোগী সামরিক কারাগারে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া সবচেয়ে হিংস্র দুটি কুকুর এনে উপস্থিত করল। শামস বাদরান কুকুর দু’টিকে আমার উপর ছাড়তে হুকুম করলো। উভয় কুকুর তাদের বিষদাঁত এবং থাবা দিয়ে আমাকে আক্রমণ করলো। দাঁত এবং নখ সম্পূর্ণ আমার শরীরে বসে যায়। আমি অনন্যোপায় হয়ে আল্লাহ্র সাহায্য চেয়ে প্রার্থনা করলাম-হাসবুনাল্লাহু ওয়া-নেয়মাল ওয়াকীল- হে আল্লাহ্ আমাকে সব বিপদ থেকে রক্ষা কর।
একদিকে কুকুরের দংশন ও নখের আঘাত; অন্যদিকে শামস বাদরানের মুখের অশ্লীল গালি-গালাজ সমানভাবে আমার দেহ প্রাণকে ক্ষত-বিক্ষত করতে লাগলো। এর মধ্যে আবার হুকুম চলছিল-
: তুই যে জামাল নাসেরকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলি, তা লিখে দে,…… তোরা তাকে কিভাবে খুন করতে চেয়েছিলি?
এবার আরো একটি কুকুর ছাড়া হলো। ৩টি ভয়ঙ্কর কুকুরের হামলা বিষাক্ত কামড় আর থাবার আঘাত। আর আমি খুৎপিপাসায় কাতর চাবুকের পীড়ন-যন্ত্রণায় অস্থির এক অসহায় নারী। কিন্তু আল্লাহ্র রহমতে সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা পাই।
শামস বাদরান এবং তার সাথীরা দেখল যে, কুকুর দিয়েও তাদের কাজ উদ্ধার হবে না, তখন শামস বাদরান বিকট চিৎকার করে সাফওয়াতকে বলল-
: ওকে নিয়ে গিয়ে চাবুক লাগাতে থাক।
রাগে তার শরীর কাঁপছিল। একটু পরে ডাক্তার এলো। পরীক্ষা করে ডাক্তার অন্ততঃ সেদিনের জন্য আর চাবুক লাগাতে নিষেধ করে বলল-
: আর আঘাত সইবার ক্ষমতা এর নেই।
শামস বাদরান হামজাকে বলল-
: একে চব্বিশ নম্বর সে’লে রেখে এস। এরপর আমি তার লাশ দেখতে চাই। আমাকে চব্বিশ নম্বর সে’লে পাঠানো হলো। এখানে এর আগে আসিনি আমি। আমি সে’লে ঢুকে আঁৎকে উঠি। সে’লের ঠিক মাঝামাঝিতে একটি গোলকে আগুন জ্বলছিল। তার চারপাশে চাবুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে জল্লাদের দল। আমি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দেখছিলাম এই নারকীয় দৃশ্য।
হটাৎ এক জল্লাদ আমার উপর চাবুকের আঘাত করে মাঝখানে গোলকে প্রবেশ করতে বলে। আমি আগুনের কাছাকাছি গেলে অন্য এক জল্লাদ চাবুক মেরে আমাকে দূরে সরিয়ে দেয়। এভাবে সবাই মিলে আমাকে একবার আগুনের কাছে এবং একবার দেয়ালের দিকে ছুটোছুটি করতে বাধ্য করে। আমার উপর তখন চাবুকের বর্ষণ হচ্ছিল যেন। চাবুকের ঘা আর আগুনের তাপে সে এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণাময় অবস্থার সৃষ্টি হলো, পুরো দু’ঘণ্টা ধরে আমি আগুনের এই সেলে জ্বলতে পুড়তে এবং চাবুক খেতে থাকি।
এরপর হামজা বিসিউবি এসে আমার দিকে রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে বলল-
: তোরা আবদুন নাসেরকে খুন করতে চেয়েছিলি বলে লেখ্। ……নয়তো তোকে এই আগুনে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারা হবে।
আমি কোন কথার জবাব না দিয়ে নিঃশব্দে চিৎকার করে বিনা অশ্রুতে কেঁদে আপন নীতিতে অটল থাকি। শেষ পর্যন্ত আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ি। হাসপাতালে গিয়ে আবার জ্ঞান ফিরে পাই।
অত্যাচারের নাটকীয় দৃশ্য
একদিন সকালবেলা আমাকে হসাপাতালের কক্ষ থেকে বের করলে সামনেই কয়েকজন ফটোগ্রাফারকে ক্যামেরা নিয়ে তৈরি দেখে আমি অবাক হই। আমাকে একখানা চেয়ারে বসিয়ে পায়ের উপর পা রেখে মুখে সিগারেট নিতে হুকুম করা হয়। এই ভাবে নাকি আমার ছবি নেয়া খুব জরুরী হয়ে পড়েছে।
আমি বললাম-
: অসম্ভব, মুখে নেয়া তো দূরের কথা, আমি সিগারেট স্পর্শ ও করবো না।
এর জবাবে ওরা আমার মাথা এবং পিঠে পিস্তল রেখে বলল-
: সিগারেট মুখে না নিলে শেষ করে দেয়া হবে। আমি ওদের পিস্তলের পরওয়া না করে পুনরায় সিগারেট নিতে অস্বীকার করি এবং কালেমায়ে শাহাদাত পড়তে থাকি। আমি বললাম-
: তোমাদের যা মর্জি তা কর, আমি কোন অবস্থাতেই সিগারেট স্পর্শ করবো না। এবার তারা আমার উপর খুব করে চাবুক বর্ষালো। তারপর আবার ঠিক কণ্ঠনালীর উপর পিস্তল ঠেকিয়ে বলল-
: তোমাকে সিগারেট মুখে নিতেই হবে।
কিন্তু আমি বারংবার অস্বীকার করতে থাকি।
শেষ পর্যন্ত তারা যখন বুঝলো যে, আমাকে সিগারেট স্পর্শ করানো সম্ভব নয় তখন তারা এমনিতেই ছবি নিয়ে চলে গেল।
পরদিন তারা এসে বলল-
: আমরা তোমাকে যা শিখিয়ে দেবো, তা টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বলতে হবে তোমাকে। এই বলে তারা ইখওয়ান সম্পর্কে যতসব মিথ্যে অভিযোগ আমাকে মুখস্ত করতে বলল।আমি তাদেরকে বললাম-
: আমাকে যদি টেলিভিশনের মাধ্যমে কিছু বলতে হয়ে তাহলে আমি যা বলব তা হচ্ছে-
“ জামাল নাসের অবিশ্বাসী কাফের এবং সে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এ জন্যে আমরা তার বিরোধিতা করছি। কারণ, সে কুরআনের আলোকে শাসন পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং ইসলামকে প্রতিক্রিয়াশীলতা বলেছে। সে অনগ্রসরতা এবং দারিদ্রের জন্যে ধর্মকে দায়ী করেছে। সে তার আইন প্রণয়ন এবং প্রশাসন চালানোর জন্যে সব বিধি-বিধান গ্রহন করেছে কম্যুনিজম ও নাস্তিক্যবাদ থেকে। তার মতে খোদাদ্রোহিতা এবং বস্তুবাদী বিলাসীতার নামই জীবন। এজন্যেই আমরা তার সাথে ন্যায় ও সত্যের স্বার্থে প্রতিরক্ষামূলক লড়াই করছি। আমার কথা শুনে তারা বলল-
: তোমার কাঁধে ও পিঠে পিস্তলের নল লেগে রয়েছে, তা দেখেও এমন নির্ভীক উক্তি করার সাহস হয় কেমন করে তোমার? তা যাই বলনা কেন আমরা যা বলছি, তা তোমাকে টেলিভিশনের সামনে বলতেই হবে।
আমি বললাম-
: গতকাল তোমরা সাংবাদিক এবং প্রেস ফটোগ্রাফারদের সামনে শত চেষ্টা করেও তোমাদের সিগারেট স্পর্শ করাতে পারোনি। তবে আজ যে আমি তোমাদের পিস্তলের ভয়ে অবাস্তব মিথ্যে কথা বলব, তা কিভাবে ধারণা করলে? না, খোদার শপথ করে বলছি, মিথ্যের সামনে আমরা নত হব না। আমরা এক আদর্শের অনুসারী। আমরা মুসলিম উম্মতের খাদেম এবং কুরআন ওয়ারিস। উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যর্থ হয়ে তারা আমাকে চাবুক লাগাতে লাগল। অনেকক্ষণ পর্যন্ত চাবুক চালিয়ে আবার কক্ষে রেখে দিয়ে এল।
বত্রিশ নম্বর সে’লে
আমি একটি কথা অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে ভাবি যে, এরা যদি সত্যি সত্যিই আমাকে কোন বিশেষ অপরাধে আটক করে থাকে, তাহলে আমার কাছ থেকে এতসব স্বীকারোক্তি গ্রহণের চেষ্টা করা হচ্ছে কেন? আমি নাসেরকে খুন করার ব্যাপারে একমত হয়েছি বা পরিকল্পনাও আমি করেছি বলে তারা আমার কাছে স্বীকারোক্তি দাবী করছে কেন? যদি আমার অপরাধের দলীল-প্রমাণ তাদের কাছে থাকবে, তাহলে অনর্থক এতো হয়রানী আর জোর জুলুম কেন? ওরা আমার কাছে এমন সব অবাস্তব স্বীকারোক্তি চাচ্ছে, যার অস্তিত্ব তাদের কল্পনায় ছাড়া আর কোথাও নেই। আসলে এসব গ্রেফতারী এবং অমানুষিক জুলূম উৎপীড়নের উদ্দেশ্য শুধু এটাই নয় কি যে, এভাবে ইসলামের আন্দোলন এবং তার প্রভাবকে বিপর্যস্ত করা হবে? আমাকে দেখা মাত্রই কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করে বলল-
: আরে, তুই এখনো বেঁচে রয়েছিস? হামজা,আমি তোমাকে বলেছিলাম না যে, আমি এর লাশ দেখতে চাই।
হামজা অনুরোধের স্বরে বলল-
: মাফ করবেন পাশা! এবার আপনি একে যে হুকুম দেবেন,তা মানার জন্যে তৈরি।
শামস বাদরান আমাকে লক্ষ্য করে বলল-
: লেখ তাহলে……
আমি বললাম-
: বাস্তব ঘটনা ছাড়া আমি আর কিছুই লিখব না। তা তোমরা আমাকে খুনই করে দাও কেন! সম্ভবতঃ তা খোদার মর্জিতে আমার শহিদী মৃত্যু হবে।
হাসান খলীল বলল-
: আমরা তোমাকে কখনো শহীদ হতে দেবো না।
আমি বললাম-
: শাহাদাত তো খোদার পক্ষে থেকে উপহার হয়ে আসে। তিনি যার জন্যে নির্ধারিত করেন, তাকে তা’ অবশ্যই দান করেন।
শামস্ বাদরান বিরক্ত হয়ে বলল-
: সাফওয়াত, একে লটকিয়ে দিয়ে পাঁচশো চাবুক লাগাও…… দেখা যাক, তার আল্লাহ্ কে?
আদেশ পাওয়া মাত্রই জল্লাদরা আমাকে উল্টো লটকিয়ে পাঁচশত চাবুক লাগানোর আজ্ঞা পালন করলো। তাদের এতটুকু ভেবে দেখার অবকাশও নেই যে, মামুলি আঘাত সহ্য করার যোগ্যতাও এই বেচারীর নেই। চাবুক লাগান শেষ হলে আমাকে কক্ষে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সে আমাকে একটি চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করে বলল-
: তুই আমাদেরকে খুব নিষ্ঠুর এবং নিষ্প্রাণ মনে করিস। অথচ, আমরা তোর অবস্থা দেখে খুবই মর্মাহত। জানিস, আমার পিতা আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক……
আমি কোন কথা না বলে নীরবে অত্যন্ত ঘৃণার দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকলাম।
সে তৎক্ষণাৎ তার আসল প্রকৃতিতে ফিরে এসে ধমক দিয়ে বলল।
: হামজা, একে বত্রিশ নম্বর সে’লে রেখে এস।
আমি নতুন সে’লে প্রবেশ করে দেখলাম, কাঠের দু’টো উঁচু থামের উপর সমান্তরালে কাঠের ফ্রেম বসিয়ে তাতে লোহার দুটি বড় রিং লাগানো হয়েছে। জল্লাদরা আমাকে চেয়ারের উপর দাঁড় করিয়ে সেই রিং দু’টো দু’হাতে ধরতে বলল। হান্টারের ঘা খেয়ে আমি রিং দু’টো ধরা মাত্রই তারা পায়ের নীচ থেকে চেয়ার হটিয়ে নেয়। আমি রিং ধরে শূন্যে লটকে থাকি। মাটিতে পড়া মাত্র জল্লাদরা হান্টার নিয়ে তেড়ে আসে আবার ওভাবে লটকিয়ে দেয়। আমি আবার পড়ে যাই এভাবে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত এই নিষ্ঠুর মহড়া চলতে থাকে।
ঈমানের মান ও মিথ্যের অপমান
আমাকে আবার শামস্ বাদরানের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। শামস্ অভিনেতা সুলভ ইঙ্গিত করে আমাকে পাশের চেয়ারে বসতে বলে। বসার পর জালাল এবং হাসান খলীল আমাকে পাশা’র মর্জি মোতাবেক লিখিত বিবৃতি দেয়ার জন্যে সম্মত করার চেষ্টা শুরু করে। কারণ এতে নাকি আমার উপকার হবে।
আমি উভয়কেই বললাম-
: আমি যা জানিনা সে সম্পর্কে কোন কথাই লিখতে পারবো না। তারা বলল-
: আমরা সব কিছু জানি। ইখওয়ানরা সব বলে দিয়েছে।
এরপর জালালকে ফাইল খুলে মজিদ শাদলী এবং ইখওয়ানদের কথিত বিবৃতি পড়ে শোনাতে বলল। জালাল তাদের কথা মত প্রথমে আলী উসমাবীর বিবৃতি পড়ে শোনালো। শুনে তো আমি হতভম্ব! সব বিবৃতি পড়ে শোনানো হলে শামস্ মাথা দুলিয়ে জিজ্ঞেস করলঃ
এসব বিবৃতি সম্পর্কে তোমার মন্তব্য কি?
আমি সাথে সাথেই বললাম-
: সব মিথ্যে বানোয়াট অপবাদ ছাড়া আর কিছু নয়।
শামস্ বাদরান বলল-
: তুমি ইখওয়ানকে পুনর্গঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলে- তাকি অস্বীকার করতে চাও? অথচ তোমাদের লোকের কথায় স্পষ্টভাবে এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, তুমিই এই সংগঠনের পুনঃপ্রতিষ্ঠার বুনিয়াদ রেখেছ………। জালাল, তাহলে হুজায়বীর বিবৃতিটা পড়ে শোনাওতো! ……কিন্তু সাথে সাথেই বলল-
: আচ্ছা থামো থামো, ওটা থাক। আপাততঃ আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাইলের বিবৃতিই শুনিয়ে দাও।
পড়া হলে শামস্ আমাকে জিজ্ঞেস করল, এবার তোমার মত কি……?
এরপর জালাল একের পর এক ফাইল খুলে এক একটি স্বীকারোক্তি পড়ে শোনাতে লাগলো। সব পড়া হলে শামস্ আমাকে বলল-
: যা কিছু শুনলে সে ব্যাপারে তোমার মতামত কি……? এখন বল আমরা যা চাই তাই লিখবে কিনা?
আমি দৃঢ়তার সাথে বললাম-
সব কিছুই বানোয়াট একেবারে বাজে কথা।
সে বিজ্ঞের হাসি হেসে জিজ্ঞেস করল-
: তাহলে সত্যটা কি?
আমি বললাম-
: আলী উসামাবীর যে স্বীকারোক্তি রেকর্ডে রাখা হয়েছে, তা আমার মতে ভুল। অবশিষ্ট ইখওয়ানদের ব্যাপারে আমি বলব, তারা সত্যপন্থী এবং সত্যবাদী। আর তাদের নাম রচিত এসব বিবৃতি ও স্বীকারোক্তি তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যে অপবাদেরই নামান্তর।
শামস্ হামজাকে ডেকে বলল-
: একে এবার উল্টো লটকিয়ে দাও এবং আলী উসমাবীকে নিয়ে এস। উজ্জ্বল ধোব দুরস্ত পোশাক পরে আলী উসমাবী এলো। সুন্দরভাবে আঁচড়ানো তার চুল; শাস্তি বা দুঃখ ভোগের কোন চিহ্নই তার শরীর বা চেহারায় নেই। আমি তাকে আমার এবং অন্যান্য বন্দীদের তুলনায় বিবেচনা করে দেখে এটা বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় রলো না যে, এ ব্যক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং ইখওয়ানদের বিরুদ্ধে মিথ্যে সাক্ষ্য নিয়ে ওসব মিথ্যুক অসভ্যদের চক্রান্তে পড়ে গেছে। ওরা নীতি বা ধর্ম কিছুই মানে না। আর এও শামস্ বাদরানের শিকারে পরিণত হয়ে নাসেরের দলে গিয়ে শামিল হয়েছে।
শামস্ বাদরান তাকে জিজ্ঞেস করলো-
: আচ্ছা আলী! শেষ দিন যখন তুমি জয়নব আল-গাজালীর কাছে গিয়েছিলে, তখন তার নিকট থেকে তুমি কি নিয়েছিলে এবং সে তোমাকে কি বলেছিল?
উসমাবী বলল-
: তিনি আমাকে এক হাজার জিনিহ (মিশরীয় পাউন্ড) দিয়ে বলেছিলেন, এ টাকা হুজায়বী অথবা সাইয়েদ কুতুবের ঘরে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্যে গা’দা আম্মারের কাছে নিয়ে যাবে……। আমি যদি গ্রেফতার হয়ে পড়ি তাহলে টাকার দরকার হলে গা’দা আম্মার অথবা হামীদার সাথে যোগাযোগ করবে। টাকা কোথায় আছে তা তাঁরা জানেন।
শামস্ বাদরান আমাকে জিজ্ঞেস করল-
: কত টাকা ছিল জয়নব? আর তা নিয়ে তুমি এতো সন্ত্রস্ত ছিলে কেন?
আমি বললাম-
: সুদান এবং সউদী আরবে অবস্থানরত ইখওয়ানের সাথীরা বন্দী ভাইদের পরিবারবর্গের সাহায্যার্থে ৪হাজার জিনিহ চাঁদা পাঠান। এছাড়া স্কুল কলেজে অধ্যয়নরত দরিদ্র ছাত্রদের সাহায্য এবং ঘর ভাড়া ইত্যাদি বাবদ এক হাজার জিনিহ্ ব্যয় হয়…… তোমার সামনে দাঁড়িয়ে যে ব্যক্তি সাক্ষ্য দিচ্ছে, তার হাতেই এক হাজার জিনিহ্ পাঠানো হয়। ভাই আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাইলের পরিবারের ব্যয় নির্বাহের জন্যে……
এবার শামস্ তাকে জিজ্ঞেস করলো-
: আলী! তুমি শেষবার জয়নব আল-গাজালীর ওখানে কি খেয়েছিলে? আলী উসমাবী বলল-
: তিনি কলিজি দিয়ে রান্না করে প্লেট ভর্তি ভাত দিয়ে বলেছিলেন, খাও আলী! আল্লাহ্ তোমায় সাহায্য করবেন।
শামস্ বললো-
আচ্ছা যথেষ্ট! তুমি এবার যাও আলী। আলী শামস্ বাদরানের সন্তোষভাজন হয়ে বেরিয়ে গেল
শামস্ এবার হামজাকে বলল-
: আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলকে আন।
মুহূর্ত খানেক পরেই হামজা আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলকে নিয়ে উপস্থিত হল। আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলের চোখে ছিল গম্ভীর ব্যক্তিত্তের আকর্ষণীয় দীপ্তি। তিনি কারাগারে শতচ্ছিন্ন কাপড় পরেছিলেন। তাঁর উপর যে অমানুষিক উৎপীড়ন চালানো হয়েছে তার স্বাক্ষর সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছিল। তিনি এসে আমাকে দেখে স্বাভাবিক নম্রতার সাথে সালাম জানালেন। আমিও তাঁর সালামের জবাব দিই।
শামস্ তাকে জিজ্ঞেস করলঃ
“ আবদুল ফাত্তাহ! তুমি জয়নব আল-গাজালীর ওখানে কি ক’রতে এবং তুমি তার কাছে কেন যেতে? আবদুল ফাত্তাহ বীরদৃপ্ত কণ্ঠে বললেন”।
তিনি আল্লাহ্র সন্তুষ্টির পথে আমার ইসলামী বোন। আমরা মুসলিম যুবকদের কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা প্রচারের কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করি। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের লক্ষ্য ছিল সরকার পরিবর্তন করে বাতিলপন্থী সরকারের জায়গায় ইসলামী সরকার কায়েম করা।
তাঁর কথা শুনে শামস্ বাদরান ক্ষেপে গিয়ে বলল :
তুমি বক্তৃতা শুরু করলে বুঝি? জান তুমি মিম্বরে দাঁড়িয়ে নও… বেরিয়ে যাও……বেরিয়ে যাও।
আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল যেভাবে এসেছিলেন ওভাবেই বেরিয়ে গেলেন। যেতে যেতে তিনি আমাকে সালাম জানাতে আমি জবাবে বললামঃ
“ ওয়া আলাই কুমুস্সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু”।
শামস্ বাদরান পাগলের মত বিশ্রী গালি দিতে থাকল……। অবশ্য আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলের স্পষ্ট মহত্ত্বপূর্ণ এবং মহান ব্যক্তিত্ব সুলভ কথা শুনে আমি আন্তরিকভাবে স্বস্তি ও শান্তি অনুভব করি। বীর মুজাহিদই বটে! শত বিপদেও সত্যের নীতিতে অটল অবিচল রয়েছেন তিনি। আল্লাহ্র অশেষ শুকরিয়া যে আজকের এই আধুনিক অজ্ঞতার যুগেও এমন সত্যনিষ্ঠ লোক বর্তমান রয়েছেন। আমি আল্লাহ্র দরবারে তাঁর জন্যে দোয়া করলাম। আলী উসমাবী মত লোক বিশ্বাসঘাতকতা করলে কি হবে, হাজার হাজার সত্য- সেনা আল্লাহ্র পথের জিহাদী কাফেলায় এখনো ধৈর্য্য ও সাহসিকতার সাথে এগিয়ে চলছে।
শামস্ বাদরানের চিৎকার শুনে আমি সচকিত হলাম। সে চেঁচিয়ে বলছে-
: এই মেয়েকে নিয়ে যাও। লিখিত কাগজসহ সকালে আবার আমার কাছে আনবে।
হাসান খলীল সাফওয়াতকে কাগজ কলম দিল এবং আমাকে হাসপাতালে কক্ষে পাঠানো হল। কাগজ কলম হাতে নিয়ে আমি ভাবছিলাম যে কি লিখব? ওরা কি চায়? ওরা কি এটাই চায় যে, আমার আল্লাহ্ এবং তাঁর দ্বীনের বিরুদ্ধে লিখি? না, খোদার শপথ, তা কোন দিনই হবে না। আমি লিখলাম-
: আমরা আল্লাহ্র নির্দেশিত পথেই চলছি আল-কুরানের পতাকাতলে একতাবদ্ধ, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহ্র শেষ রাসূল। আমরা কোন সময় কোন অবস্থাতেই আল্লাহ্র সাথে কাউকে শরীক করব না। শুধু তাঁরই ইবাদাত, তাঁরই উপাসনা করব। হে আমাদের আল্লাহ্! আমাদেরকে সাহস ও ধৈর্য্য দান কর এবং ঈমান ও ইসলামের উপর মৃত্যু দান কর।
আর তোমার যুগের ফেরাউনরা!- পার্থিব জীবনের এই সংক্ষিপ্ত সময় পুরো করে নাও। মৃত্যু অবশ্যই একদিন নির্ধারিত রয়েছে। অতি শীঘ্রই তোমরা তোমাদের পরিণামের সম্মুখীন হবে।
পরদিন হামজা বিসিউবি, রিয়াজ, সাফওয়াত এসে লিখিত কাগজ নিয়ে চলে গেল। আবার ঘণ্টা খানেক পরে এসে আমাকে গাড়ীতে উঠিয়ে শামস্ বাদরানের অফিসে নিয়ে যায়। আমার পক্ষে তখন পায়ে হাঁটার উপায় ছিল না। শামস্ আমাকে দেখিয়ে কিছু কাগজ ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বলল-
: এসব তোমার লিখিত কাগজ…… আমি তোমার শরীর থেকে এক পেয়ালা রক্ত বের করে না নেয়া পর্যন্ত তুমি আমার মর্জিমতো লিখবে না দেখছি।
এরপর গালি-গালাজ এবং চাবুকের আঘাতের সাথে আমাকে আবার হাসপাতালে রেখে আসা হয়।
আমার ফাঁসির হুকুম
আমি প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি ছিলাম বলে আমাকে কিছুদিনের জন্যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাখা হয়। একদিন সূর্যাস্তের একটু আগে আমাকে শামস্ বাদরানের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু আমাকে অফিসে না ঢুকিয়ে একটি প্রকাণ্ড মেশিনের সামনে দাঁড় করানো হয়। এই বৈদ্যুতিক মেশিন থেকে বিকট শব্দ এবং অত্যন্ত গরম বাতাস বেরুচ্ছিল। আমাকে পুরো রাত সেই বিভীষিকাময় মেশিনের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। সকালে আবার হাসপাতালে পাঠানো হয়। ডাক্তার মাজেদ আমার চেহারার অবস্থা দেখে আবদুল মাবুদকে জিজ্ঞেস করলেন-
: এর মুখমণ্ডল তো একেবারে হলদে হয়ে গেছে। ……তাঁকে রাতে আবার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নাকি?
আবদুল মাবুদ বললঃ জ্বী হ্যাঁ!
আধঘণ্টা পরে আবদুল মাবুদ আমাকে পাউরুটি এবং কিছু মোরব্বা দিয়ে বলল, ডাক্তার সাহেব পাঠিয়েছেন এবং এসব খেতে বলেছেন। সূর্যাস্তের সময় আমাকে আবার শামস্ বাদরানের অফিসের কাছে একটি সে’লে নিয়ে রাখা হয়। একটু পরে হামজা সাফওয়াত রিয়াজ এসে পৌঁছালো। ওরা চাপাস্বরে পরস্পর কি সব কথা বার্তা বলল। প্রথম দু’জন চলে যায় এবং তৃতীয় জন সেখানেই থাকে। হটাৎ সে নিজেই নিজের মুখে চড়-ঘুষি মেরে, নিজের চুল ছিড়ে মত্ত পাগলের মত এক আজব কাণ্ড শুরু করে দেয়। সে আমাকে লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে বলতে লাগল-
: পাগলি কোথাকার! আজ যদি তুই শামসে্র কথা না মানিস তো আজই তোর জীবনের শেষ দিন। জানিস রিফায়াত, ইসমাইল এবং আলকিউমীরা কোথায়?
সে বলল-
: এখানে এই কারাগারে নাসেরের হুকুমে প্রতি দিন দশ জন ইখওয়ান কুত্তাকে দাফন করা হয়।
আমি যখন তাকে বললাম যে, ওরাতো আল্লাহ্র পথে শহীদ হয়ে জান্নাতবাসী হয়েছেন। একথা শুনে আরো জোরে জোরে নিজের মুখে নিজে চড় মারতে শুরু করলো এবং বলল-
: এ পর্যন্ত কুকুর, পানি, আগুন, চাবুক, হান্টার কোন কিছুতেই তোকে টলাতে পারেনি। আজ পাশা তোকে জবাই করে ছাড়বে। সে নাসেরের অনুমতি নিয়ে নিয়েছে। কি করবি তুই?
আমি শান্তভাবে বললাম-
: যা করার আল্লাহ্ই করেন।
সে এবার বলতে শুরু করল-
: তুই চাস্, আমরাও তোর মতো কাজ করে ব্যর্থ হই? সে সোভিয়েত ইউনিয়ন আধা পৃথিবীর উপর শাসন করছে তুই চাস আমরা তোকে ছেড়ে দেই? আর আমরা হুজায়বী, সাইয়েদ কুতুব এবং হাসানুল বান্নার মতো লোকদের কথা মেনে চলি?
-তোরা পাগল……… আমরা তোদের মতো পাগল নয় বুঝলি……?
আমি জবাবে কুরআনের আয়াত পড়ে বললাম-
: এসব লোকদের যখন বলা হয় যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তখন তারা অহংকার করে বলে- “ আমরা কি এক পাগল কবির কথায় আমাদের এতসব উপাস্য ছেড়ে দেব?” আর এসব উপাস্য হচ্ছে মূর্তি প্রতিবাদী। আর শাসকরা এসব মূর্তির হেফাজতে নিযুক্ত রয়েছে। এরাই সেসব লোক, যারা মানবতার নবী হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ)-কে পাগল বলতে ইতস্ততঃ করেনি। আজ আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আজ তোমরাও আল্লাহ্র পথের মুজাহিদদের পাগল বলছ, আর মিথ্যে বাতিলের অনুসারী শাসকবর্গ তোমাদের প্রভু হয়ে বসেছে, সব হীন কাজে তোমাদের ব্যবহার করছে। আর তোমরা কয়টি মাত্র টাকার বিনিময়ে নিজেদের মানবতাবোধ কে বিসর্জন দিয়ে অসৎ জীবন যাপন করছ। বল তোমরা কি জালিম-অত্যাচারীকে সন্তুষ্ট করার জন্যে আল্লাহ্র গজবের সম্মুখীন হতে চাচ্ছ?
এবার প্রশ্ন করলো-
: তোমরা কি আমাদেরকে সেই স্থবির অনগ্রসরতার দিকে ফিরিয়ে নিতে চাও?
এমন সময় দরজা খুলে জল্লাদরা বেপরোয়াভাবে আমার উপর চাবুক ও হান্টার চালাতে লাগলো। আর তা দেখে রিয়াজ হেসে হেসে বলছে-
: খোদার শপথ জয়নব; আমি তোমাকে স্নেহ করি এবং তোমার ব্যাপারে শঙ্কাও পোষণ করি।
আমি চাবুক খাওয়ার মাঝেই তাকে ব্যঙ্গ করে প্রশ্ন করলাম-
: স্নেহ এবং শঙ্কা? সে আবার কেমন কথা হল? তুমি কি ভীরু কাপুরুষ? ব্যাপারতো খুবই স্পষ্ট। তোমরা শুধু আমার স্বীকারোক্তি নেয়ার জন্যে এতো উৎসাহী কেন? তোমাদের সব মিথ্যে জালিয়াতি, অপবাদ, বিনাদোষে শাস্তি, বিশেষ উদ্দেশ্য মামলার প্রহসন এবং নিরপরাধ লোকদের উপর ভিত্তিহীন অভিযোগে আরোপের মূল উদ্দেশ্য তো খুব স্পষ্ট হয়ে গেছে।
রিয়াজ তার ছাতি ছাপিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে , চুল ছিঁড়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল-
: আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি শক্তি সব তোর কাছে ব্যর্থ-বেকার প্রমাণিত হয়ে গেছে? আমরা খেয়ে পরে সুস্থ থেকেও অসুস্থ হয়ে পড়েছি…… আর তুই? তুই এখনো বেঁচে আছিস কিসের জোরে? …… ডাক্তার বলেছেন তোকে এখন খাবার না দিলে তুই মরে যাবি।
হামজা ও সাফওয়াত এসে রিয়াজকে জিজ্ঞেস করলো-
: কি করেছিস ভাই; আশা করি ওর বুদ্ধি ফিরে এসেছে।
আমি স্মিত হেসে হামজার দিকে তাকিয়ে বললাম-
: তোমাদের মধ্যে পাগল কে তা বুঝতে পারছিনা।
হামজা কোন কথা না বলে নীরব দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে সাফওয়াতকে বলল-
:একে পাশের অফিসে নিয়ে চল।
পাশার দফতরে
শামস্ আমাকে পাশের চেয়ারে বসতে দিয়ে বলল-
: দেখ, আমার মতে, অব্যাহত শত্রুতা পোষণ করে কোন লাভ নেই।
তুমি আমার ইচ্ছেমত সব লিখে দাও।
আমি স্বাভাবিক শান্ত কণ্ঠে বললাম-
: তুমি কি এটাই লিখাতে চাও যে, আমরা নাসেরকে খুন করতে চেয়েছি? ……এটা অসম্ভব। খোদার শপথ আমরা শুধু কুরআন ও হাদীসের শিক্ষার জন্য একত্রিত হয়েছিলাম। আমরা লোকদের জানাতে চেয়েছিলাম যে, অত্যাচারী মানুষের অনুসরণ না করে আল্লাহ্র দ্বীনের অনুসরণ করা উচিৎ এবং কিভাবে তারা আল্লাহ্র ইবাদাত করবে এবং কেমন করে এই পৃথিবীতে আল্লাহ্র দ্বীন প্রতিষ্ঠা করবে আমরা লোকদের সেসব বিষয়ে অবহিত করি। আমরা কুরআন সুন্নাহ্ মোতাবেক কাজ করি, আল্লাহ্র কোন হুকুম অমান্য করিনা। যদি ভুল-ভ্রান্তিতে আল্লাহ্র হুকুম অমান্য হয়ে যায়, তাহলে তার জন্যে অনুশোচনা করে তাওবা করি। আমাদের মতে বর্তমান সরকার অযোগ্য এবং এজন্যে এর অবসান দরকার। কিন্তু তা জোর-জবরদস্তিভাবে নয়। আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে জনসাধারণকে বুঝিয়ে সুজিয়ে ইসলাম সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল করে পরিবর্তন করতে চাই……… আমরা চাই সত্যিকারের ইসলামী শাসন ব্যবস্থা……।
হঠাৎ আমার উপর হান্টার চালানো শুরু হলে আমি চিৎকার করে বলি-
: না,না, আমি মিথ্যে লিখবো না; আমাকে মেরে ফেললেও লিখবো না, আমার কাছে পৃথিবীর কোন মূল্য নেই……।
শামস্ বাদরান আমাকে লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করলো-
: যেসব কাগজ আমি ছিঁড়ে ফেলেছি, তাতে তুমি আবদুল আজীজ আলীর নাম লেখনি কেন?
আমি জানতে চাইলামঃ
কোন আবদুল আজীজ আলী?
: সেই আবদুল আজীজ পাশা। যাকে নাসের তার মন্ত্রীসভার সদস্য নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু সে নাসেরের সাথে নিমকহারামী করে,যে হাত তাকে সাহায্য করেছিল সে হাতকেই কেটে দেয় এবং নাসেরের বিরোধিতা শুরু করে।
এবার আমি চিনতে পারলাম এবং বললাম-
: আবদুল আজীজ আলী বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণগুপ্ত আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি জাতীয় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা। আবদুন নাসের এবং তার সঙ্গীরা এঁরই কাছে জাতীয়তাবাদের দীক্ষা গ্রহণ করে। আমার মতে তিনি এক মহান ব্যক্তিত্ব। তিনি আমার স্বামীর বন্ধু। আর এখন তিনি আল্লাহ্র পথে আমার ইসলামী ভাই। তাঁর পত্নী আমাদের সংস্থার কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্যা, আমার বান্ধবী এবং ইসলামী বোন……।
শামস্ কর্কশ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
: তাহলে তুমি তাকে ইখওয়ানের শামিল করনি কেন?
আমি বললাম-
: তা আমার বিবেচনায় ছিল… কিন্তু যেমন প্রবাদ আছে যে, কারো মাথা মগজের পরিবর্তে আগুনে ভর্তি থাকে……।
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে শামস্ বিকট চিৎকার করে বলে-
: এসব বাজে কথা, বন্ধ কর। এরপর চাবুক লাগানোর আদেশ দিল। কিছুক্ষণ পর্যন্ত তারা পরস্পর ফিস্ফাস করলো, তারপর হাসান খলিল আমাকে জিজ্ঞেস করলো।
: তুমি আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলের সাথে আবদুল আজীজকে কেন পরিচয় করিয়েছিলে এবং কোথায় এই পরিচয় করানো হয়?
আমি জবাবে বললাম-
: তোমাদের গোয়েন্দা বাহিনীর আক্রমণের ফলে যখন আমার পা ভেঙ্গে যায় তখন তিনি এবং তাঁর পত্নী হাসপাতালে এসে আমার সাথে দেখা করতেন। এভাবে আমি হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ী ফিরে গেলেও তাঁরা মাঝে মধ্যে আসতেন। একদিন আবদুল আজীজের উপস্থিতিতেই ভাই আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলও এসে পৌঁছান। এভাবেই তাঁরা পরস্পরের সাথে পরিচিত হন। এ ব্যাপারে আমি শুধু এইটুকুই জানি।
হাসান খলীল বলল-
: তা স্বীকার করলাম যে, আবদুল আজীজ ও আবদুল ফাত্তাহর সাক্ষাৎ আকস্মিক হয়েছিল। কিন্তু আবদুল আজীজ তোমার বাড়ীতে তোমার মাধ্যমে ফরিদ আবদুল খালেকের সাথে কিভাবে পরিচয় লাভ করে।
আমি জবাবে বললাম-
: আমার বাড়ীতে নার্স আমার পায়ের ভাঙ্গা হাড়ের উপর ব্যান্ডেজ বাঁধতে এলে ভাই আবদুল আজীজ ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসেন। এ সময় ভাই ফরিদ আবদুল খালেকও ওখানে এসে বসেন। তাঁরা তখনো পরস্পরের অপরিচিত ছিলেন। আমার পায়ে ব্যান্ডেজের কাজ শেষ হলে নার্স চলে গেলে ভাই ফরিদ, আবদুল খালেক আমাকে দেখার জন্যে ভেতরে আসেন। এ সময় ভাই আবদুল আজীজ ও বিদায় নেবার জন্যে ভিতরে যান। এই উপলক্ষে আমি এদের উভয়কে পরস্পরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।
আমার কথা শুনে শামস্ অগ্নিশর্মা হয়ে সাফওয়াতকে ডাকলো। হাসপাতালে আমার জ্ঞান ফিরে এলে আমার উভয় পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা হয়েছে। দু’পায়ে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম আমি। আর এই যন্ত্রণা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহে। মনে হচ্ছিল, আস্ত শরীর যেন গরম তেলে ভাজা হচ্ছে।
সংশয়ের আবর্তে
হাসপাতালে কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর আমাকে আবার শামস্ বাদরানের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সে তার পুরানো কথা ও সন্দেহের পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। আমার মনে হয় একটি সন্দেহকে বারবার উচ্চারণ করে একের পর এক পুনরাবৃত্তি করার ফলে তার সংশয়টি তার মনে বাস্তবতার রুপ ধারণ করে নিয়েছে। সে এখন তার নিছক সন্দেহকে বাস্তব ঘটনার মতো বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।তার সেই একই কথা ইখওয়ানুল মুসলিমুন আবদুন নাসেরকে খুন করার ষড়যন্ত্র এঁটেছিল। শামস্ বাদরান আমার দিকে লক্ষ্য করে বিস্ময় প্রকাশ করে বলল-
: তুমি এখনো জীবিত রয়েছ? অথচ সব রকমের শাস্তিই তোমাকে দেয়া হয়েছে।
আমি জবাবে আসহাবুল উখদুদের ঘটনা বললাম-
: আল্লাহ্ বলছেন- ‘আসহাবুল উখদুদকে’ হত্যা করা হয়; যারা এদেরকে হত্যা করে, তারা তাদের মিথ্যেবাদিতা এবং অপবাদ আরোপের কারণে বদ্ধপাগলে পরিণত হয়। আর নিজেদেরই জাতির লোকদের হতে শহীদ হওয়া এসব লোকেরা ছিলেন সকলের বিশ্বাসভাজন ও সম্ভ্রান্ত। তাঁরা লোকদেরকে খোদার পয়গাম পৌঁছানো এবং ঈমানদারীর সাথে দায়িত্ব পালনের শিক্ষাদানে সক্রীয় ছিলেন।
শামস্ বাদরান বলল-
: আমরা ওসব নীতি কথা বুঝিনা। তা তুমি কি এখনো আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাস কর? অথচ ১৯৪৮ সাল থেকে আজ পর্যন্ত তোমরা বরাবর ব্যর্থ হয়ে আসছ। তোমরা বাদশাহ ফারুকের মোকাবেলায় ১৯৫৪ সালের বিপ্লব বিরোধিতায় এবং ১৯৬৫ সালে বিপ্লবের পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখতে গিয়ে দারুণভাবে পর্যুদস্ত হয়েছো……। বলি, তোমাদের সে তথাকথিত খোদা আছেন কোথায়? আমি তাকে বললাম-
: ১৯৪৮ সালে আমরা সফল হয়েছি, ১৯৫৪ সালেও আমরাই বিজয়ী থাকি এবং ১৯৬৫ সালেও আমরা ময়দান জয় করি।
সে বলল-
: আমরা তোমাকে মুরগীর মতো উল্টো লটকিয়ে রেখেছি, পানিতে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রেখেছি, আগুনের হল্কার মধ্যে ছুটাছুটি করতে বাধ্য করেছি, হিংস্র কুকুর দিয়ে দংশন করিয়েছি…… যদি সত্যিই তোমাদের কোন খোদা বা পালনকর্তা থেকে থাকতো সেকি তোমাকে রক্ষা করার জন্যে এগিয়ে আসতো না? বল রে হতভাগী মেয়ে……।
আমি দৃঢ়কণ্ঠে বললাম-
: আমাদের উপর চাবুক বর্ষিয়ে এবং বিভিন্ন রকমের নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে তোমরা বুঝি এই আত্মতৃপ্তিতে আছ যে, তোমরা বিজয়ী হয়েছ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তোমরা সব সময় আমাদের ভয়েই সন্ত্রস্ত রয়েছ।
সে ক্রোধের সাথে হুঙ্কার করলো-
:চুপ কর মেয়ে! তোরা সব অপরাধী।
: কক্ষনো না। আমি তেমনি দৃঢ়তার সাথে বললাম।
আমি আরো বললাম- আমরা অপরাধী হবো কেন? …… আমরা তো সত্যের পথে, সত্য ও শান্তি প্রচারের দায়িত্বে নিয়োজিত আছি। আমরা সত্যের কাণ্ডারি এবং অনির্বাণ আলোর দিশারী। সে জিজ্ঞেস করলো –
: তোমরা আমাদের উপর বিজয়ী কেমন করে হলে?
আমি বললাম-
: কারণ, আল্লাহ্র পক্ষ থেকেই আমরা, সমৃদ্ধ ও শক্তিমান। তাঁর উপরই আমাদের অটল ভক্তি ও অবিচল বিশ্বাস; তাঁরই পথে আমরা জিহাদ ও আন্দোলন করি। যখন আমরা ইসলামের মর্যাদা ও তাওহীদের পতাকাকে সমুন্নত রাখার দায়িত্ব পালনে গড়িমশি করবো, কেবল তখনই আমাদের পরাজয় প্রমাণিত হবে। বস্তুতঃ ইসলাম হচ্ছে একটি সর্বকালীন ও সার্বজনীন জীবনাদর্শ। ধর্ম, সরকার, আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা তথা ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনের সব দিক বিভাগের পন্থা নির্দেশক জীবনাদর্শ হচ্ছে এ-ই ইসলাম। শান্তি-সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ব সহনশীলতা এবং ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ইসলামের উদ্দেশ্য। এটা সর্বমানবতা শাশ্বত স্বাভাবিক জীবনাদর্শ।
ইসলাম মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে এক আল্লাহ্র ইবাদাতে উদ্বুদ্ধ করে। খোদাদ্রোহীতার জন্যে কোন মানুষের অনুসরণ করতে নেই। যারা সত্য ও সরল মনে এবং পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে ইসলাম গ্রহণ করেছেন তারা সত্যিকারের সাফল্য সোনালী মঞ্জিলে পৌঁছবেই। তারা আল্লাহ্র সিপাহীতে পরিণত হয়ে যায় এবং আল্লাহ্র পথের সিপাহী তারা অন্য কোন ব্যক্তি বা শক্তিকে ভয় করবে কেন? যারা সত্য ও ন্যায়ের স্বার্থে ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হয়, দুনিয়ার স্বার্থ তাদের কাছে একান্ত সংকীর্ণ ও তুচ্ছ বলে মনে হয়। জীবন ও পৃথিবীর বাস্তবতা তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে পড়ে। তাই তারা, এই নশ্বর সংক্ষিপ্ত পার্থিব জীবনের ক্ষুদ্র স্বার্থের পরিবর্তে পরকালের অশেষ সমৃদ্ধ ও শান্তিময় বেহেশতী জীবনের প্রত্যাশায় আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে এগিয়ে চলে।
আর তোমরা বিভ্রান্ত কাপুরুষরা! তোমরা কি করতে পার? আমাদের উপর অত্যাচার চালাতে পার; মারতে কাটতে পার, খুন করতে পার, শত রকমের পৈশাচিক নির্যাতন চালাতে পার, পানিতে বা কুকুরের ভিড়ে ঠেলে দিয়ে তামাশা দেখতে পার, চাবুক মেরে আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পার। কারণ তোমাদের হাতে চাবুক আর হান্টার আছে, আছে অনেক রকমের অস্ত্র। কিন্তু আমাদের কাছে তোমাদের এসব জুলুম-নির্যাতন একেবারে অর্থহীন। তোমাদের কোন অত্যাচারই আমাদেরকে সত্যের পথ থেকে টলাতে পারবে না। তোমরা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
তোমরা ভীত হয়ে আমাদেরকে আলাদা আলাদা ভাবে বন্দী করে রেখেছ কেন? কেন এত ভয়? তা এই জন্যেই যে, আমরা আল্লাহ্র পথের মুজাহিদ আর তোমরা হচ্ছ শয়তানের চেলা। যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে তাদের পরাজয় এবং অপমান অবশ্যম্ভাবী। বস্তুতঃ এরাই হীন, ইতর লোক। আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের দ্বীন বিজয়ী থাকবে। নিঃসন্দেহে সমস্ত শক্তির উৎস একমাত্র আল্লাহ্। আমার এসব কথা সহ্য করা শামস্ বাদরানের পক্ষে অসম্ভব ছিল। সে মাথায় হাত চেপে আতঙ্কগ্রস্ত ব্যক্তির মতো বলল-
: সাফওয়াত-সাফওয়াত! একে উল্টো লটকিয়ে পাঁচশো চাবুক লাগাও। চাবুক লাগানো হলে আমাকে নামিয়ে সেই সব বাসি প্রশ্নের জবাব দিতে বলল। আমিও আমার জবাব দিতে থাকি। এতে বিরক্ত হয়ে শামস্ বাদরান আমাকে আবার লটকিয়ে আড়াইশো চাবুক লাগার হুকুম দিল। তার হুকুম যখন পালন হয় তখন আমি অজ্ঞান। হাসপাতালে আমার জ্ঞান ফিরে এলে দেখি, আমার চারপাশে ডাক্তারদের ভিড় এবং আমার শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যান্ডেজ এবং ঔষধ লাগানো হচ্ছে। হাসপাতালে কয়েক দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর আমাকে ষ্টেচারে করে আবার শামস্ বাদরানের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।
জীবনের শেষ লগ্নে মৃত্যুপথ যাত্রীর মতো দুর্বল ক্ষীণ কণ্ঠে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম। এটর্নি!…… তুমি কে?
সে বললঃ আমরা তোমাকে আদালতে পেশ করার জন্যে তৈরি করেছি। আমি প্রশ্ন করলাম-
: তোমরা আমার কাছ থেকে আর কি চাও?
এটর্নি ধমক দিয়ে বলল-
: সাবধানে কথা বল। তোমার গায়ে এখন মার খাওয়ার মতো শক্তি নেই……। আমরা … পুরোপুরি তৈরি……।
: আমি বললাম- আল্লাহ্ই সাফল্যদাতা এবং সাহায্যকারী।
এটর্নি জিজ্ঞেস করলো –
: মোহাম্মাদ কুতুব এবং ইখওয়ানের যুবকরা তোমার বাড়ীতে একত্রিত হতো কেন?
আমি বললাম-
: অধ্যাপক মোহাম্মাদ কুতুব এবং তাঁর উভয় বোন প্রায়ই আমার সাথে দেখা করতে আসতেন। শামস্ রেগে গিয়ে গালি উচ্চারণ করে পুনরায় প্রশ্ন করলো-
মোহাম্মাদ কুতুব এবং ইখওয়ানের যুবকরা তোমার বাড়ীতে একত্রিত হত কেন? তাই বল।
আমি তার গালি-গালাজের তীব্র প্রতিবাদ করে বলি-
: ছাত্র এবং ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা আমার কাছে সাক্ষাতের জন্যে আসতো এবং ঘটনাক্রমে অধ্যাপক মোহাম্মাদ কুতুবের সাথেও তাদের দেখা হয়ে যেতো।
: সে গর্জন করে বলল- আমি বলছি, যুবকেরা মোহাম্মাদ কুতুবের সাথে সাক্ষাৎ করানোর জন্যে তোমার কাছে দাবী তুললে তুমি ওসব যুবক এবং মোহাম্মাদ কুতুবকে দুপুরের ভোজে আমন্ত্রন কর। খাবার পর তারা বৈঠকে মিলিত হয়,……কেন?
আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম-
: যখন অধ্যাপক মোহাম্ম দ কুতুবের দু’টি গ্রন্থ ‘আত্-তাতাউউরু ওয়াস সোবাত ফিল ছায়াতিল বাশারিয্যাহ’ মানব জীবনে স্থিতি ও বিকাশ এবং জাহেলিয়্যাতিল কুরনিল এশরীন’ বিংশ শতাব্দীর মূর্খতা প্রকাশিত হল তখন আমার এবং ইসলামী আন্দোলনের কোন কর্মী এই গ্রন্থ দু’টির বিভিন্ন বিষয়াবলী সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্যে অধ্যাপক মোহাম্মাদ কুতুবের সাথে সাক্ষাতের ইচ্ছে প্রকাশ করে। এ উদ্দেশ্যে অধ্যাপক কুতুব বেশ কয়েকবার আমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসেন।
এবার সে জিজ্ঞেস করলো-
: আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল এসব সমাবেশে উপস্থিত থাকতো কেন? আমি বললাম-
: যেহেতু তিনিও ইখওয়ানুল মুসলিমুনের চরিত্রবান যুবকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন……।
সে চরিত্রবান শব্দটির প্রতি বিদ্রুপ করে বলল-
: আল্লাহ্ এসব চরিত্রবানদের মুখাপেক্ষী নন। তা এসব সমাবেশের মধ্যে কোন্ সমাবেশে মোহাম্মাদ কুতুব নাসেরকে খুন করার ব্যাপারে একমত হয়?
আমি বললাম- আবদুন নাসেরের খুনের কল্পিত কাহিনী তোমাদের রচিত কৃত্রিম গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়।
শামস্ প্রশ্ন করলো- তুমি আইনজীবী হওনি কেন?
: আমি বললাম আল্লাহ্র শুকরিয়া যে, তিনি আমাকে উত্তম অবস্থাতেই রেখেছেন। আমি আল্লাহ্র পথে নিবেদিত প্রাণ, কেবল আল্লাহ্র সন্তুষ্টির পথের দায়িত্বই পালন করতে থাকব। হটাৎ শামস্ বাদরান উঠে আমাকে বেদম লাথি মারতে শুরু করে। সে হাঁফাতে হাঁফাতে বলতে থাকে, আজ তোর রক্ষা নেই। আমার হাতে তোকে মরতে হবে। সে অবস্থাতেই সে জিজ্ঞেস করলো-
: তুই মোহাম্মাদ কুতুবের সাথে মিলে যে সংগঠন কায়েম করেছিলি, তার নাম কি? …… আবদুন নাসেরকে খুন করার জন্যে কাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল, আবদুল ফাত্তাহ নাকি আল ফাইউমিকে? আমি বললাম –
: আল-ফাইউমিকে তো তোমার খুন করেছ…… তার আবার নাম নেওয়ার অর্থ কি?
সে উচ্চস্বরে বীভৎস হাসি হেসে বলল-
: তুমি তাকে জান? সেকি খুবই সুদর্শন ছিল? সাফওয়াত…… সাফওয়াত,ফাইউমিকে এ ভালোবাসতো।
সাফওয়াত এসে হান্টার নিয়ে আবার বন্য হায়েনার মতো আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি আঘাত সইতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে পড়ি। তারা আমাকে কিছুটা সুস্থ করে আরো অত্যাচার-উৎপীড়নের জন্যে তৈরি করার উদ্দেশ্য আবার হাসপাতালে পাঠায়।
শামস্ তার বিভ্রান্তিতে অটল
আমাকে আবার শামস্ বাদরানের অফিসে পাঠানো হয়। যেহেতু আমার জ্ঞান ফিরে এসেছে তাই নির্যাতন সইবার জন্যে ওখানে যাওয়া দরকার। অবশ্য ষ্টেচারে করেই আমাকে তার অফিসে পৌঁছানো হয়। শামস্ তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের সাথে বসেছিল। আমাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল-
: তোমার গায়ে নির্যাতন সইবার ক্ষমতা আর বিন্দুমাত্র নেই। এখন নিজের উপর নিজে দয়া কর। নয়তো আবদুন নাসেরের শপথ করে বলছি, তোমাকেও ফতোহীর সাথে দাফন করে দেব। ওর এক পাণ্ডাও তার সাথে যোগ করে বলল-
: শুন জয়নব, পাশাকে সঠিক জবাব দাও এবং নিজের আখের গুছাও। আমরা তোমার সাথে কোন একটা মীমাংসায় পৌঁছুতে চাই।
শামস্ বাদরান আরেকটু ঝাঁঝিয়ে বলল- স্মরণ কর, তোমার কাছে ফুয়াদ সিরাজ উদ্দিনের পক্ষ থেকে এক ব্যক্তি এসে নাসেরের সরকার উৎখাতের জন্যে ইখওয়ানের সাথে সহযোগিতা দানের অনুরোধ করে। সেই ব্যক্তি তোমাকে আরো বলেছিল যে, উপদেষ্টা আমেরের অফিসে এমন লোক আছে, যারা তোমার সাথে এবং ‘ওয়াফাদ পাঁটির’ সাথে সহযোগিতা করবে।
আমি এই শয়তানের মিথ্যে বচন এবং সত্য বিকৃত করার পটুতা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে এক একটি শব্দের উপর জোর দিয়ে বলি-
: এটা নিছক মিথ্যে কথা। ফুয়াদ সিরাজুদ্দিন এ ব্যাপারে সে ব্যাপারে কোন ব্যাপারে কোন সমস্যা নিয়ে কোন ব্যাক্তিকেই আমার কাছে পাঠাননি। বস্তুতঃ গত ১২ বছর ধরে তাঁর সাথে আমার দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। ঘঠনাক্রমে একবার এক গণপ্রদর্শনীতে ফুয়াদ পাশার সাথে আমার স্বামী মোহাম্মদ সালেম সালেহে্র দেখা হয়। তিনি আমার স্বামীর কাছে আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন এবং আমার জন্যে সালাম-দোয়া পাঠান।
একথা বলার সাথে সাথে আমার উপর আবার হান্টারের বর্ষণ শুরু হয়। আমার ক্ষত-বিক্ষত দেহের উপর হান্টারের ঘা পড়ছিল আগুনের হল্কার মত। অথচ আমার পায়ে তখন ব্যান্ডেজ বাঁধা। আগের ক্ষত শুকোতে না শুকোতে আবার অজস্র আঘাত আমার দেহ বিদীর্ণ করছিল। জল্লাদ আমার হাতে ও পায়ে হান্টারের আঘাত করতে করতে জিজ্ঞেস করল-
: বল, ফুয়াদ সিরাজুদ্দিন তোকে কোন পয়গাম পাঠিয়েছিল কিনা। আমি বললাম-না।
তখন শামস্ বাদরান আমাকে আরো কঠিন শাস্তি দেয়ার আদেশ দেয়। এরপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু হতেই আমি অচেতন হয়ে পড়ি। অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে ষ্ট্রেচারে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু একটু পরে আবার তার অফিসে ফিরিয়ে আনা হয়।
শামস্ বাদরান অত্যন্ত ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল-
: শুনে রাখ, আমাদেরকে বাধা দেয়ার কেউই নেই। তোমার মত কুড়িজন কুকুরকে আমি রোজ দাফন করি। আর এই সামরিক কারাগারের মাঠ এমন হাজার হাজার কুকুরকে গিলে খাওয়ার জন্যে হা করে আছে। আবদুন নাসেরের শপথ! আমার মর্জি মোতাবেক কাজ না করলে তোকেও অন্যান্যদের মত এখানে পুঁতে রাখবো।
আমি এই আহম্মকের প্রলাপের জবাব দেয়ার কোন প্রয়োজন বোধ না করে চুপ করলাম।
সে বেসামাল হয়ে বলল, জবাব দাও। নয়তো উল্টো লটকিয়ে হান্টার দিয়ে পিটাতে পিটাতে শেষ করে দেব।
আমি বললাম, আল্লাহ্ই উত্তম কর্ম সম্পাদনকারী। তিনিই আমার জন্যে যথেষ্ট। তিনি উত্তম সাহায্যকারী। “হে খোদা, তুমি আমাদেরকে সাহস ও ধৈর্যশক্তি দান কর এবং ইসলামের উপর মৃত্যু দান কর”।
এসব ভাল কথা শামসের অসহ্য। সে ক্ষিপ্ত হয়ে সাফওয়াতকে বললো-
সাফওয়াত, কুকুর নিয়ে এস।
:সাফওয়াত, মুহূর্তেই হিংস্র কুকুর নিয়ে উপস্থিত হলো এবং আমার উপর কুকুরগুলো ক্ষুধার্ত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো।
কুকুরের কামড়ের অসহ্য যন্ত্রণায় আমি মুক্তির জন্যে আল্লাহ্র কাছে দোয়া করলাম- “ হে আল্লাহ্, আমি তোমার সন্তুষ্টিতে তোমার আজাব থেকে রেহাই চাই। হে আল্লাহ্, তুমি আমাকে এই বিপদ-মুসীবত থেকে উদ্ধার কর”। হামজা চেঁচিয়ে বলল, পাশা এর চেহারা ফিকে হয়ে গেছে। ওর মৃত্যু নিকটবর্তী। শামস্ এসে আমার অবস্থা দেখে বলল-
: কুকুরদের বের কর আর একে মরার জন্যে হাসপাতালে রেখে এস।
সুতরাং আমাকে ষ্ট্রেচারে করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু সেদিন মধ্যরাতে আমাকে চতুর্থবারের মতো আবার শামসেরের এর অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের এ এক ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত। তাদের হিংসা বিদ্বেষ ও শত্রুতা ইসলামের সাথে। আর যেহেতু আমি ইসলামের সেবিকা, তাই আমার উপর অত্যাচার চালিয়ে তারা ইসলামের প্রতি তাদের বৈরীতার প্রমাণ পেশ করেছে। তারা মনে করেছে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে খুন করে এবং মেরে-পিটে হয়রানি করে ইসলামের পুণর্জাগরণ ও জয়জাত্রাকে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে। তারা ইসলামকে স্তব্ধ করে দিয়ে বাতিল নাস্তিক্যবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখছে। যাই হোক, আমাকে ষ্ট্রেচার থেকে নামিয়ে আর অফিসের চেয়ারে বসানো মাত্রই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। তারা আমাকে লেবুর শরবত এবং ইঞ্জেকশন দিয়ে আবার সচেতন করে। এবার শামস্ নাটকীয়ে ভঙ্গিতে বললো-
: দেখ, ভাল করে শোন। তুমি আমাদেরকে বিরাট বিপদে ফেলে রেখেছ। আমরা বন্য বস্তু নই-যেমনটা তুমি আমাদেরকে মনে করছ……আর প্রেসিডেন্ট নাসেরের মন অনেক বড়… তুমি সব কথা বলে দিলে তোমাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে……। এখন তুমি কমপক্ষে নিজের স্বার্থে আসল কথা বলে দাও।
আমি বললাম-
: সত্যি সত্যিই আসল কথা বলবো? …… শোন তাহলে সত্য কথা এবং আসল কথা হচ্ছে, তোমরা আবদুন নাসেরকে গিয়ে বলে এসো যে, তুমি অত্যাচারী এবং জবরদখলকারী-তুমি খোদাদ্রোহী- তুমি অনুতপ্ত হয়ে তাওবা কর-মিথ্যে বাতিলের পথ ত্যাগ করে সত্য ও সুবিচারের পথে এসো-অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এস……।
“যারা মিথ্যের পথে তোমাদের সমর্থন করে এবং যাদেরকে তোমরা তোমাদের জোর-জুলুমের কাজে ব্যবহার কর, তাদের বিবেক মরে গেছে এবং তোমরা সবাই নৈতিক ও মানসিক রোগী”।
ওরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
: তোমার একথা কি আমরা নাসেরের কাছে পৌঁছাবো?
আমি বললাম-
: হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওকে বলার জন্যেই তো তোমাদেরকে এসব বলেছি। ওরা বললো-
: ভীষণ দুঃসাহস করছো তুমি। এরপর তারা সমস্বরে আমাকে পাগল, পাগল বলে চেঁচিয়ে বললো।
: একে বৈদ্যুতিক শক্ লাগানো দরকার। এমন সময় শামস্ বাদরান হুঙ্কার ছেড়ে বললো-
: গতকাল থেকে যেসব কুকুরকে অভূক্ত রাখা হয়েছে, ওসব কোথায় হামজা? মাঝখানে হাসান অভিনয় করে বলল-
: জয়নব, এখনো প্রাণ বাঁচা! মৃত্যু একদম সম্মুখে। সব ইখওয়ান নিজেদের স্বার্থ চিন্তা করে বেঁচে যাচ্ছে। আমি আশা করি পাশা, আলী উসমাবীকে উপস্থিত করার অনুমতি দেবেন। হতে পারে যে ফুয়াদ সিরাজ্জুদ্দিনের পাঠানো লোক সম্পর্কে জয়নবকে স্মরণ করাতে পারবে।
শামস্ বাদরান বললো-
: এ মেয়ে তুই স্মরণ কর। নয়তো আলী উসমাবীকে ডেকে তোর মোকাবেলায় দাঁড় করাবো।
আমি বললাম, আলী উসমাবী তো সংকীর্ণ-স্বার্থের বিনিময়ে তোমাদের মতো অসভ্য জালিমদের কাছে নিজের বিবেক বিক্রি করে দিয়েছে এবং তা করে দুনিয়া ও আখিরাতের ক্ষতি বরণ করে নিয়েছে……। আর সিরাজুদ্দিনের গল্পও তোমাদের মনগড়া। মহৎ ও ব্যক্তিত্ববান লোকদের অপমান করাই হচ্ছে এসব বানোয়াট কাহিনীর উদ্দেশ্য।
জিজ্ঞাসাবাদের এই কক্ষে সাঈদ আবদুল করিম নামক পদস্থ কর্মকর্তা এসে আলোচনায় শামিল হয়ে বললো-
: জয়নব! সিরাজুদ্দিন সম্পর্কিত ব্যাপারে তোমাকে কয়েকটা সহায়ক তথ্য দিচ্ছি। এতে করে তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। তুমিতো ইখওয়ানুল মুসলিমুনের হুসায়নী আবদুল গাফফারকে জেনে থাকবে। পরে সে সাইয়েদেনা মুহাম্মদের সাথে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। তুমি তার সাথে বেশ কয়েকবার মত বিনিময় করেছ। তাকে ইখওয়ানের কাতারে ফিরিয়ে আনাই তোমার উদ্দেশ্য। তুমি তাকে ইখওয়ানের আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সক্রীয় তৎপরতা চালানোর জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিলে।
আমি বললাম-
: হাসবুনাল্লাহু ওয়া নেয়’মাল ওয়াকীল। হুসায়নী আব্দুল গাফফার আমার দ্বীনি ভাই!…… আমি তাঁর সাথে পুণরায় ইখওয়ানে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহনের ব্যাপারে আলোচনা করি কিন্তু তিনি অক্ষমতা প্রকাশ করেন। তাঁর সাথে সিরাজুদ্দিন বা ওয়াফাদ পার্টির সাথে কোন সম্পর্ক ছিল না। সে সময় তিনি যেহেতু আহ্বার যুবদলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন এজন্য ওয়াফাদ সংস্পর্শ থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন এবং ওয়াফাদকে তিনি সমর্থন করতেন না।
হাসান খলীল বললো-
ঠিক আছে। কিন্তু কোন ব্যাপারে যখন আহ্বার, ওয়াফাদ এবং ইখওয়ানের মধ্যে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা যে কোন সমস্যার সমাধান করতে পারে। আমি বললাম-
: মোটেই নয়। ইখওয়ান এবং ওদের মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে। যারা যথার্থভাবে ইসলামী জীবনাদর্শ সম্পর্কে পড়াশোনা করেনি…… শামস্- এর ইঙ্গিতে এ সময় আমার উপর চাবুক চালানো শুরু হয়। আব্দুল করীম শামস্ কে বললো-
: আরেকটু সময় দিন। সে তার বক্তব্য শেষ করুক।
হ্যাঁ জয়নব, যা বলতে চাচ্ছিলে বল-
আমি বললাম-
: ইখওয়ানুল মুসলিমুন তাদের আদর্শের উৎস, নীতি, উদ্দেশ্য এবং কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে দূরদর্শিতার সাথে বিস্তারিত চিন্তা-ভাবনা করে যে নিয়ম ও গঠনতন্ত্র তৈরি করেছে, তা সম্পূর্ণরূপে কুরআন ও সুন্নাহ্র উপর ভিত্তিশীল। তারা জীবনের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি মুহূর্ত কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক সম্পন্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইখওয়ানের কাছে কেবল সে দেশ বা মাটিই প্রিয়, যেখানে ইসলাম কায়েম থাকবে এবং ইসলামের স্বার্থে তারা শাহাদাত কবুল করে। ইখওয়ান সব মানুষকে স্বাধীন এবং মানুষের এই পৃথিবীকেও স্বাধীন দেখতে চায়। আর তা সম্ভব কেবল আল্লাহ্র দ্বীন কায়েমের মাধ্যমে।
ইখওয়ান মানুষ ও মাটি উভয়কেই আল্লাহ্র নিকটতর করতে চায়। কারণ এতেই নিহিত রয়েছে প্রকৃত মুক্তি, শান্তি ও সমৃদ্ধি। এভাবে ইসলামী জীবনাদর্শ বাস্তবায়িত হলে কোন শোষণ, কোন অত্যাচার এবং কোন অবিচারের অস্তিত্ব থাকবে না আর। তখন মাটির এই পৃথিবী হয়ে উঠবে বেহেস্তের মতো সুন্দর-শান্তিময়।
প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) আংশিকভাবে নয় বরং পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি প্রথমে কোন স্বাধীন দেশ গঠন করে ইসলামের প্রচার করেননি। সামাজিক সংস্কারের দোহাই দিয়ে ইসলাম প্রচার করেননি, গনতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বা সম্পদের সমবন্টনের কথা বলেই শুধু ইসলাম প্রচার করেননি- তিনি পরের কাজ আগে বা আগের কাজ করে করেননি। বরং স্বাভাবিকভাবে একের পর এক করে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গভাবে কায়েম করেছেন। প্রিয়নবী সর্বপ্রথম তাওহীদের শিক্ষায় মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করেন এবং সব বাতিলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এক আল্লাহ্র দাসত্বে সংঘবদ্ধ করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই এবং রাসূল (সঃ) হচ্ছেন আল্লাহ্র পক্ষ থেকে শাসনকর্তা এবং সর্বময় ক্ষমতার মালিক ও সকল মানুষের নেতা।
আল্লাহ্ই স্রষ্টা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা এবং লাভ-ক্ষতির চাবিকাঠিও তাঁরই হাতে। তিনি জীবন-মৃত্যুর নিয়ন্ত্রন করেন। তিনি আইন ও বিধানদাতা এবং তিনিই পথ নির্দেশক। প্রিয়নবী আল্লাহ্র নির্দেশ মোতাবেক মদীনায় প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করেন এবং সময়ে অবতীর্ণ কুরআনের পয়গাম মোতাবেক ব্যক্তি সমাজ-রাষ্ট্র তথা দুনিয়ার মানুষের স্বার্থে সত্য, সুবিচার ও সমান অধিকার ভিত্তিক ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করেন।
শামস্ বাদরান বললো-
এসব বুঝি তোমার সিরাজুদ্দিনের ঘটনা বলা হল?
আমি বললাম-
: সিরাজুদ্দিনের ঘটনাতো তোমাদের মনগড়া কাহিনী। যারা এই কাহিনী রচনা করেছে, তারা পয়সার বিনিময়ে মিথ্যে কাহিনী রচনা করেছে। ……… আমি সিরাজ সম্পর্কে শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে, তিনি একজন দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতা। আমার মনে হয় আজকাল তিনি সব রকমের তৎপরতা ছেড়ে দিয়ে অবসর নিয়েছেন।
শামস্ বলল-
:সাফওয়াত কুকুর নিয়ে এস।
সাথে সাথে কুকুর এবং মানুষ আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কুকুরের কামড় এবং মানুষের হাতে চাবুকের আঘাত আমার সারা শরীরকে রক্তাক্ত করে দেয়। পাশেই কোথায় ডাক্তার দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি তেড়ে এসে কুকুর জল্লাদের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করেন। ঠিক তক্ষুণি দূর মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসছিল ফজরের আজানধ্বনি। আজান শুনে আমি এতো দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্যেও এক অপূর্ব অস্বাভাবিক প্রশান্তি লাভ করি। আমার মনে পড়লো নমরুদের আগুন থেকে হযরত ইব্রাহীমকে রক্ষার জন্য আগুনের প্রতি আল্লাহ্র সেই নির্দেশ-
“ হে আগুন! ইব্রাহীমের উপর শীতল ও শান্ত হয়ে যাও”। আমি মুনাজাত করে বললাম, “ হে পরওয়ারদেগার, আমিও তোমার হাবীব মুহাম্মদ (সাঃ) এবং নবী হযরত ইব্রাহীমের অনুসারী। আমাকে শয়তানী চক্রের মোকাবেলা করার জন্যে সাহস ও শক্তি দাও। তুমি ছাড়া আর কোন খোদা নেই। অবিশ্বাসী পথভ্রষ্ট লোকেরা যাদের উপাসনা করে, আমি তাদের উপাসনা করিনা। তোমার সন্তুষ্টি চাই খোদা! আমিন”। কখন যে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি, তা মনে নেই। পুনরায় যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন আমি হাসপাতালে। এভাবে কতবার যে হাসপাতালে গেছি আর বেরিয়েছি এবং অজ্ঞান-অচেতন হয়ে পুনরায় জ্ঞান-চেতনা ফিরে পেয়ছি, তার সঠিক হিসাব তুলে ধরা কঠিন।
প্রবৃত্তির শাসন ও নীচ লোকদের প্রভুত্ব
অদূরদর্শী উগ্র লোকদের হাতে শাসন ক্ষমতা; এবং প্রশাসন যখন অযোগ্য লোকদের আয়ত্তে চলে যায় তখন স্বৈরাচারের সবচেয়ে জঘন্য রূপ সামনে এসে পড়ে। এ ধরনের স্বৈরাচারী শাসন জনজীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে এবং দেশের অগ্রগতির চাকা উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করে। স্বৈরাচারী গোষ্ঠী নিজেদেরকে সম্পদ ও ক্ষমতার সর্বময় মালিক মনে করে বসে, যা তাদের মর্জি তাই করে চলে। এভাবে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ তাদের ব্যক্তি স্বার্থের সামনে খর্ব হয়ে যায়। তাদের স্বেচ্ছাচারিতার ফলে ব্যাপক হারে দূর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে এবং গোটা দেশ ও জাতিকে তারা তাদের মর্জি মতো ব্যবহারের প্রয়াস পায়।
স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের ভিত্তিতে মজবুত করার উদ্দেশ্যে দেশের সচেতন ও দেশপ্রেমিক লোকদের লোভ-লালসা বা ভয়ভীতি দেখিয়ে, হয় নিস্ক্রিয় করে রাখে অথবা লৌহ-কারাগারের অন্তরালে পাঠিয়ে দেয়। এরপর তারা তাদের মর্জি মোতাবেক আইন তৈরি করে নিরীহ জনগণকে কঠোর শাসনের অক্টোপাসে আবদ্ধ করে রাখে।
শাসন ক্ষমতায় অসীন হয়ে লোক, নৈতিক ও চারিত্রিক মূল্যবোধের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করে মানুষের মান-মর্যাদা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে শুরু করে এবং জ্ঞান ও বিবেকের কণ্ঠরোধ করার অপচেষ্টা চালায়। সেই আমলে মিশরের স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীও এসব ঘৃণ্যতম উপায় অবলম্বন করে দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রাখে। ফলে দেশের সামগ্রিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। আদালতের স্বাধীনতা খর্ব করা হয় বলে সুবিচারের সব পথ বন্ধ। সরকারী চাটুকারদের উৎখাত উপদ্রবে মানবতা অপমানিত এবং দেশের উপর থেকে আল্লাহ্ও যেন তাঁর দয়া ও রহমতের ছায়া তুলে নেন।
যাই হোক, আমাকে আবার সেই বিভীষিকাময় অফিসে নিয়ে গেলে শামস্ এবং তার সহকারীরা জিজ্ঞেস করলো-আবদুল গাফফার ফুয়াদ সিরাজুদ্দিনের পক্ষ থেকে যে পয়গাম পৌঁছিয়েছিল- তা কি? উপদেষ্টা আমেরের অফিসে ফুয়াদ সিরাজুদ্দিনকে সহযোগিতা দানকারী লোক কারা ছিল? আর অভ্যুথানের জন্যে ইখওয়ানের কাছে কি কি দাবী করা হয়েছিল?
আমি জবাব দিলাম-
: হুসাইন আবদুল গাফফার আমার দ্বীনি ভাই। আর তাঁর সম্পর্কে তোমাদের মুখে যে সব মিথ্যে ও ভিত্তিহীন অভিযোগ শুনছি-সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা।
সায়াদ ও হাসান খলীল জানতে চাইলো –
: শোন জয়নব, হুসায়নি কি তোমার বাড়িতে আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলের সাথে সাক্ষাৎ করেনি? আর তুমি ইখওয়ানুল মুসলিমুনে শামিল হবার ব্যাপারে হুসায়নির সাথে আলোচনা করনি?
আমি জানলাম-
: আমি আন্দোলনে ফিরে আসার ব্যাপারে হুসায়নির সাথে আলোচনা করেছি, এবং এটা কোন অপরাধ নয়। হুসায়নি আমাদের আন্দোলনে আস্থাশীল। অবশ্য, হুসাইনি ইখওয়ানে শামিল না হলেও, তিনি ইখওয়ানের সাফল্য কামনা করেন এবং জনগণকে কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি ইখওয়ানের অভিমতকে সমর্থন করেন। হুসায়নি এবং আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল আমার বাড়ীতে ইসলাম ও মুসলমানদের বর্তমান উদ্বেগজনক অবস্থা, মুসলমানদের দারিদ্র, অশিক্ষা ইত্যাদি সমস্যাবলী নিয়ে আলোচনা করেন, এরপর হুসায়নী সেদিন চলে যান।
: এরপর আর একদিন আকস্মিকভাবেই ওঁরা উভয়ে আমার বাড়ীতে এলে তাঁদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। পরে আবদুল ফাত্তাহ হুসায়নী সম্পর্কে আমাকে বলেন যে-
: হুসায়নী অত্যন্ত ভদ্র, চরিত্রবান, বিজ্ঞ এবং সরলপ্রাণ আলেম। আধ্যাত্মিকতাবাদী সুফীদের সাথে তাঁর গভীর যোগাযোগ রয়েছে-
আমার এতটুকু বলা হলে ওদের মধ্যে একজন বলল-
: হুসায়নী গোটা ব্যাপারটাই আমাদের জানিয়েছে…… তুমি অনর্থক ইখওয়ানদের জানের বিনিময়ে নিজেকে বলি দিতে চাচ্ছো! এখন দেখছি হুসায়নী এবং ফুয়াদ সিরাজুদ্দিনের জন্যে নিজেকে উৎসর্গ করতে চাচ্ছো……। আমরা কিন্তু তোমাকে শেষ সুযোগ দিচ্ছি। তুমি নিজের ব্যাপারে, বিশেস করে ওয়াফাদ পার্টির ওসব লোক সম্পর্কে, যারা উপদেষ্টা আমেরের অফিসে কাজ করছে এবং হুসায়নী ও ফুয়াদ সিরাজুদ্দিন সম্পর্কে তোমার অভিমতসহ সবকথা স্পষ্ট ভাবে বলে দাও। …… তোমার দু’চোখ বের করে তোমাকে অন্ধে পরিণত করে পরে তোমার সামনে হুসায়নি এবং ফুয়াদ সিরাজুদ্দিনকেও আনা হবে।
আমি বললাম-
: আল্লাহ্কে অশেষ ধন্যবাদ যে, আমরা অন্তরের দৃষ্টিতে দেখতে সক্ষম , এবং অন্তরের দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার ক্ষমতা কারো নেই। সুতরাং দু’চোখ উপড়ে ফেললেও আমরা অন্ধে পরিণত হবো না। আমার স্পষ্ট কথাবার্তা শুনে শামস্ বাদরান এমনভাবে চিৎকার করে উঠলো যেন তাকে যেন সাপে কেটেছে। সে হুঙ্কার দিয়ে বলল-
: সাফওয়াত, কুকুর নিয়ে এস।
ওর এক চাটুকার তাকে বাধা দিয়ে বলল- না পাশা। এই মেয়ে নিজের জীবন সম্পর্কে উদাসীন। সে এখনো তার মৃত্যু সম্পর্কে সংশয়ে ভুগছে। আমি তার জবাবে বললাম-
: মৃত্যুটা কি আল্লাহ্র হাতে না তোমাদের হাতে?…… জীবন-মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক তো একমাত্র আল্লাহ্। তিনিই সব করেন এবং তিনিই সর্বশক্তিমান। শামস্ বাদরানের চারপাশে বসা অফিসারদের মধ্যে একজন বলল –
: পাশা! হুসায়নীকে উপস্থিত করার হুকুম দিন। এরপর সবাই সমস্বরে হুসায়নীকে আনার জন্যে সাফওয়াতকে বলল। কিন্তু শামস্ অত্যন্ত দাম্ভিকতার সাথে তাদের কথা অগ্রাহ্য করে বলল-
: এই মেয়েকে আপাততঃ হাসপাতালে রেখে এস। উল্লুক নাকি রাত না হলে কিছু দেখতে বা করতে পারে না। এদের স্বভাবও অনেকটা উল্লুকের মতো দিনের আলোর চেয়ে রাতের অন্ধকারই এদের কাছে অধিক আকর্ষণীয়। বলাবাহুল্য, আমাকে রাতের অন্ধকারে আবার শামসের অফিসে পৌঁছিয়ে এক জায়গায় বসিয়ে দেয়া হয়। কয়েক-মুহূর্ত পরে হুসায়নীকে উপস্থিত করা হয়। হুসায়নীর এক হাত ভাঙ্গা এবং ব্যান্ডেজ বাঁধা। ভাঙ্গা হাতটি এখনো তার বুকের উপর ঝুলে রয়েছে। ওর পায়েও আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট। সমগ্র শরীরে অত্যাচারের ইঙ্গিত। অনেক ক্ষত তখনও দগ্দগ্ করছে। হুসায়নী কক্ষে ঢুকেই আমাকে দেখে সালাম জানালো আমিও তার সালামের জবাব দিই। শামস্ আমাদের সালাম- কালাম দেখে কৃত্রিম রসিকতার সুরে প্রশ্ন করল-
: হ্যাঁ, হুসায়নী সা’ব! জয়নবের সাথে তোমার কি সম্পর্ক ছিল?
জবাবে হুসায়নী বললেন-
: কাগজে সব কিছুই লেখা রয়েছে।
শামস্ কাগজগুলো হুসায়নীর হাতে দিয়ে তা পড়ে শোনাতে বলল-
হুসায়নীকে গিয়ে কাগজে কি লিখানো হয়েছে, তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা ছিল না। আমি বরং ভাবছিলাম যে, এমন কোন কথা বলব যাতে করে হুসায়নী এ বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারেন। আমার এতে কোন সন্দেহ নেই যে হুসায়নীকে অমানুষিক দুঃখ-কষ্ট দিয়ে এরা এদের মর্জি মতো কথা লিখিয়ে নিয়েছে।
হুসায়নী শামস্ বাদরানের দেয়া কাগজ পড়তে শুরু করলো। তাতে এমন কিছু লিখিত ছিল, যা হুসায়নী লিখতে পারে বা এসব কথা ভাবতে পারে বলেও আমার মনে হয়নি। বস্তুতঃ যা তিনি পড়লেন, বাস্তবতার সাথে তার আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। একদম মিথ্যে মনগড়া। হুসায়নী পড়া শেষ হলে শামস্ আমাকে বিজ্ঞের মতো প্রশ্ন করলো-
: যা শুনলে সে সম্পর্কে তোমার মতামত কি?
আমি বললাম-
: ইখওয়ানদের উপর তোমাদের জোর-জুলুম অত্যাচার আর অমানুষিক নির্যাতনের ফলেই তিনি তোমাদের কথা মতো এসব ভিত্তিহীন কথা লিখতে বাধ্য হয়েছেন।
শামস্ জিজ্ঞেস করলো-
: যা তুমি শুনলে, তা কি সত্য নয়?
আমি বললাম- হুসায়নী মিথ্যে বলার মতো ব্যক্তি নন। তবে আমার স্থির বিশ্বাস যে, নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে তাকে এসব লিখতে বাধ্য করা হয়েছে।
শামস্ রাগে চিৎকার করে বলল-
: হুসায়নী যা লিখেছে……… তুমি তাকে এসব বলোনি?
হাসান খলিল বলল –
: আমরা তোমার কাছ থেকে এটা জানতে চাই যে, হুসায়নী যা শুনিয়েছে, তা ঘটেছিল কিনা? আরেক জন বলল –
: হুসায়নীকে বাঁচানোর জন্যে তুমি কি নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবে? যেমন তুমি অন্যান্য ইখওয়ানদের বাঁচানোর জন্য ও করেছ?
আমি বললাম, না; আমি আমাকে ধ্বংস করছি না বরং সত্যের পক্ষ অবলম্বন করছি মাত্র।
শামস্ হুসায়নীকে জিজ্ঞেস করল-
: হুসায়নী, তুমি কি জয়নবকে ফুয়াদ সিরাজুদ্দিনের চিঠি পৌঁছিয়েছিলে? আমিও হুসায়নীকে জিজ্ঞেস করলাম-
হুসায়নী, আপনি আমাকে ফুয়াদ পাশা সিরাজুদ্দিনের চিঠি পৌঁছিয়েছিলেন না?
হুসায়নী পাল্টা প্রশ্ন করলেন-
ফুয়াদ সিরাজুদ্দিনের সগীর, নাকি মালী পাশা?
আমি বললাম-
: আমি তো কেবল ফুয়াদ পাশা সিরজুদ্দিনকেই জানি। ফুয়াদ সগীরকে, হুসায়নি?
হুসায়নী বললেন, ফুয়াদ পাশার চাচাতো ভাই।
তখন আমি হুসায়নীকে প্রশ্ন করলাম, তা সেই সমস্যাটা কি ছিল হুসায়নী?
তিনি বললেন-
: যেমন আমি আগেই বলেছি, ওটা খুবই মামুলি একটা প্রসঙ্গ ছিল। …… আলী সোলাইমান তা আমাকে শুনিয়েছিল……… আর আমি তা জয়নবের কাছে উল্লেখ করেছি। শামস্ এবার ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, হুসায়নী, বেরিয়ে যাও। এরপর শামস্কে বললাম-
: বেশ তো, তুমি এই সামান্য একটা কথাকে ষড়যন্ত্র বানিয়ে নিয়েছ? আক্ষেপ, ফুয়াদ পাশার মতো ব্যক্তিত্ব ও তোমাদের জুলুমের হাত থেকে রক্ষা পাননি।
শামস্ সাফওয়াত ডাক দিল। আর আমার উপর চাবুকের আঘাত পড়তে লাগল শ্রাবণের বৃষ্টির মতো। চাবুক লাগানো শেষ হলে শামস্ হামজাকে বললো- হামজা, একে হাসপাতালে রেখে এস।
হাসপাতালেও জোর-জুলুম
দ্বিতীয় দিন হামজা একজন সামরিক অফিসার নিয়ে হাসপাতালের ওয়ার্ডে উপস্থিত হয়। হামজা আবদুল মাবুদকে একখানা চেয়ার ও ছোট টেবিল আনতে বলল। চেয়ার, টেবিল এলে হামজা আব্দুল মাবুদকে বলল-
: এই নাও কাগজ। আমার পাশে বস এবং এই মেয়ে যা যা বলবে লিখে যেতে থাক। সাফওয়াত একটি মোটা ফাইল নিয়ে কক্ষে ঢোকে। হামজা সেই ফাইল থেকে একটি লিখিত কাগজ বের করে আমাকে বলল, এতে যা লেখা আছে সব কথা তুমি তোমার বিবৃতি হিসেবে লিপিবদ্ধ করবে। এতে হুজায়বী, সাইয়েদ কুতুব, আবদুল ফাত্তাহ, হাওয়াশ, আবদুল মজিদ প্রমুখের নাম উল্লেখ রয়েছে।
আমি তাকে বললাম-
: আমি যা কিছু জানি, শুধু তাই লিখবো। অন্য কোন কথার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। …আমি এসবকে ইখওয়ানের বক্তব্য বলে স্বীকার করিনে এবং এসব ইখওয়ানদের পক্ষ থেকে লেখা বা বলা হয়েছে বলেও আমি মনে করিনা। যদিও তোমারা তা দাবী করছ।
হামজা বলল- তুমি যা চাও তাই লেখ। আমরা তোমাকে শামস্ এর অফিসে পাঠিয়ে দেব। সেখানে নানা রকমের শাস্তি ভোগ করতে তোমার খুব ভাল লাগবে। সে কথায় আল্লাহ্ সন্তুস্ত হন এবং আমাদের সাহায্য করবেন, আমি আবদুল মাবুদকে সে সব কথা লিখতে বলি। এর পরের দিন সকালে আমাকে শামস্ বাদরানের অফিসে নিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়। শামস্ কয়েকটি কাগজ নিয়ে তা ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে অত্যন্ত নোংরা-অশ্লীল ভাষায় গালি দিতে দিতে বলল-
: এ-ই মেয়ে! তুমি কি সব বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে চাও? ইখওয়ানদের সব কথাকেও তুমি ভুল বলতে চাও? অথচ ইখওয়ানরা যা বলেছ, তা যেমন প্রামাণ্য ও যুক্তিসংগত তেমনি বিশ্বাস করারও যোগ্য। এর আগে তুমিও ইখওয়ানদের সত্যবাদিতা সম্পর্কে নিজেই অনেক কথা বলেছ…… তোমাকে ইখওয়ানদের কথা মানতেই হবে।
আমি বললাম-
আমি যা সত্য মনে করি, এর উপর অটল রয়েছি। আমি আমার বিশ্বাস মোতাবেক যা বলার দরকার মনে করি, শুধু তাই বলবো। অবশ্য ইখওয়ানদের কথাবার্তা এবং জবাবের সত্যতা যাঁচাইয়ের অবকাশ আমার নেই। …… তোমরা চাবুকের মুখে তাদেরকে যে সব কথা বলতে ও লিখতে বাধ্য করেছ, তা আমি সব শুনেছি। এখানে সত্য কথা বলার স্বাধীনতা ও অধিকার নেই। আমার কথা শুনে শামস্ ক্রুদ্ধসরে বলল-
: হামজা , একে নিয়ে যাও। আমি এর লাশ চাই। …… এর দাফনের কাগজে আমি নিজেই সাক্ষর করবো।
এরপর ওরা আমাকে নিয়ে একটি কক্ষে বন্ধ করে রাখে। এক ঘণ্টা পরে আমাকে বের করে হান্টার চালাতে চালাতে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের পাশে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে বলল। আমি ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার মনে হচ্ছিল, যেন তপ্ত লৌহ-শলাকার উপর দাঁড়িয়ে আছি। ব্যথা-বেদনা দুঃখ-যন্ত্রণার কতইবা আর বলবো……
মধ্যরাতে আমাকে আবার শামস্-এর অফিসে নিয়ে যাওয়া হলে সে বলল-
: জয়নব, চল আমাদের সাথে চল। প্রেসিডেন্ট নাসের তোমাকে ক্ষমা করে দেবেন। …… অধিকাংশ ইখওয়ানই তাদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে। তুমি যদি আমাদের কথা মেনে নাও তাহলে কাল সকালেই প্রেসিডেন্টের সাথে তোমার দেখা হবে এবং এরপর সোজা বাড়ী চলে যেতে পারবে। তাছাড়া ইসলামী মহিলা সংস্থার সদরদপ্তর, সংস্থার বাজেয়াপ্তকৃত পুঁজি ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং নয়ামিশরস্থ সংস্থার জমিনের উপর ইমারত তোমার জন্যে প্রথম পর্যায়ে ৫০ হাজার জিনিহ্ সাহায্য দেয়া হবে। আর তোমার পত্রিকার পুণঃপ্রকাশনার জন্যে দেয়া হবে দশ হাজার জিনিহ্। অফিসে অপেক্ষমান অন্য এক ব্যাক্তি জিজ্ঞেস করলো-
: নয়ামিশরে কি ইসলামী মহিলা সংস্থার জমিন আছে?
আমি বললাম- হ্যাঁ আছে…… ৬হাজার বর্গমিটার।
পরে জানতে পেরেছি এ ব্যাক্তির নাম- ‘সালেহ নসর’।
সে অবাক হয়ে জানতে চাইলো, এতবড় জমিনের উপর সংস্থা কি করবে? আমি বললাম- সংস্থা, মুসলিম মহিলাদের জন্যে একটি প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, মহিলাদের জন্যে একটি মিলনায়তন, একটি অতিথিশালা, একটি কেন্দ্রীয় দফতর, একটি মস্জিদ, একটি হেফজ খানা, একটি কুরআন শিক্ষাগার, একটি করে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং একটি বক্তৃতা প্রশিক্ষণাগার ও একাডেমী কায়েমের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি।
সে জিজ্ঞেস করলো-
: কোথায় পাবে তোমরা এত টাকা?
আমি বললাম, সার্বজনীন চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে। …… তাছাড়া ক্রমপর্যায়ে কাজ হাতে নেয়া হবে। সে এবার উৎসাহিত হয়ে বলল-
তবেতো এটাই সুবর্ণ সুযোগ; প্রেসিডেন্ট নাসের তোমাকে এই সুযোগ করে দিয়েছেন। তুমি মুক্তি পেয়ে নিজের বাড়ী যেতে পারবে। তোমার সংস্থা পুণঃপ্রতিষ্ঠিত হবে এবং প্রেসিডেন্টের আস্থাবশতঃ আরো অনেক উদ্দেশ্যই সাধিত হবে।
আমি বললাম-
: আমরা কেবল মহান আল্লাহ্র সাহায্যের উপরই আস্থা পোষণ করি। আল্লাহ্র প্রতি ঈমান ও ভালবাসা আমাদের কাছে জান-মাল, টাকা-কড়ি এবং শাসন-ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশী মূল্যবান। আর তোমরাতো মানুষের অধিকার এবং মান-মর্যাদা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছো। তোমাদের কাছে আমরা কিছুই চাই না। আবদুন নাসেরের সাথে দেখা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার নেই। ইসমাঈল ফউহী, বাফায়াত বকর এবং আবদুল কাদের আওদার মতো শহীদের রক্তে যার হাত রঞ্জিত… আমি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে মোটেই প্রস্তুত নই। নিঃসন্দেহে, ওসব শহীদানের রক্ত অনাগত দিন পর্যন্ত তার তাওহীদ বাদীদেরকে সত্য পথের দিশা দিতে থাকবে। ভবিষ্যৎ বংশধরেরা অতীতের এসব মহান শহীদের আত্মত্যাগের জন্য গর্ব করবে এবং দায়িত্ব পালনে সদা সক্রীয় থাকবে……। আমার কথা শেষ হতে না হতেই শক্ত বুটের লাথি আর কঠিন মুষ্ঠাঘাত আমার পিঠে পড়তে লাগলো। শেষ পর্যন্ত সইতে না পেরে আমি অর্ধচেতন হয়ে মাটিতে পড়ি! এরপর শামস্ বাদরান হুকুম করলো-
: হামজা, একে চৌত্রিশ নম্বর সে’লে রেখে এস। চৌত্রিশ নম্বর সে’ল সে’লই বটে। বলতে পারেন একটি কবর। ঠিক কবরের মতোই সংকীর্ণ এবং অন্ধকার। ভীষণ ভয়ানক। এতে আবার দুটো কুকুরও ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আমি সে’লে ঢোকা মাত্রই তায়াম্মুম করে নামাজ শুরু করে দিলাম। এক নামাজ শেষ হতে অন্য নামাজ। জালিমদের এসব জুলুম ভুলে থাকার জন্যে এবং অন্তরের প্রশান্তির জন্যে নামাজের চেয়ে উত্তম উপায় বা বিকল্প আর কিছুই নেই। জালিমদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্যে আমি আল্লাহ্র সাহায্যে প্রার্থনা করি। … পা, পিঠে এবং সারা শরীরের হাড়ে হাড়ে অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও নামাজ আদায় করে আমি শান্তি পাচ্ছিলাম। এক ঘণ্টা পরে দরজা খুলে সে’ল থেকে কুকুর দু’টিকে বের করে নেয়া হয় এবং আমাকে হাসপাতালে পৌঁছানো হয় কিন্তু রাতে এশার নামাজের পরে আমাকে আবার শামসের অফিসে হাজির করা হয়। সে অফিসে ঢুকাতেই বলল- জয়নব, তোমার বাড়ীতে একদিন এক সমাবেশ হয়। তাতে মিশরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত ইখওয়ানের পঞ্চাশ জন শামিল হয়।
তিন বছর আগে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশ কেন হয়েছিল?
আমি বললাম-
: আমরা মাগরীব, এশা এবং তারাবীর নামাজ জামায়াতে পড়েছি।
: আমি জানতে চাচ্ছি সমাবেশের উদ্দেশ্য কি ছিল?
আমি বললাম, তা আমার মনে পড়ছে না।
: ওরা তোমার ওখানে নাস্তা করেছিল?
: হ্যাঁ, ওদের মধ্যে কিছু লোক নাস্তা করেছিল।
: সমাবেশ কেন হয়েছিল?
আমি বললাম-
: বাতিল শক্তিবর্গ আমাদের দেশ ও সমাজে নাস্তিক্যবাদী ধ্যান-ধারণা প্রচারের জন্যে যেভাবে আদা-জল খেয়ে উঠে পড়ে লেগেছিল, তার মুকাবেলা করার উদ্দেশ্যে আমরা ইসলামী আদর্শ সম্পর্কে লেখা-পড়া এবং মত বিনিময় করি।
সে জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু তা তোমার বাড়ীতেই কেন?
: যেহেতু আল্লাহ্র ফজলে আমিও মুসলমান, তাই।
সে জানতে চাইলো, বাতিল কি? ইসলাম কি? এবং নাস্তিক্যবাদ কি?
আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম-
: তুমি যাতায়াতের পথে অবশ্যই দেখে থাকবে যে দোকানে দোকানে এমনকি ফুটপাতেও নাম মাত্র মূল্যে অশ্লীল পত্র-পত্রিকা এবং কম্যুনিজমের প্রচার সম্পর্কীয় বই-পুস্তক এবং সাময়িকী বিক্রি ও বণ্টন করা হচ্ছে। আর……
সে আমাকে আর বলতে না দিয়ে বলল-
: ব্যাস, ব্যাস, যতসব বাজে কথা। এখন তোমার কাছে সমবেত লোকদের নাম বল। আমি বললাম, প্রত্যেকের নামতো আমার স্মরণ নেই।
সে জিজ্ঞেস করলো-
: সমাবেশ থেকে এক ব্যক্তি উঠে হুজায়বীর সাথে সাক্ষাৎ করে এবং পরে আবার হুজায়বীর বাড়ীতে টেলিফোনে যোগাযোগ করে। এরপর সে চলে যায়। কে সে ব্যক্তি?
আমি বললাম-
: আমার মনে নেই। তবে যতটুকু আমার মনে পড়ে, সে ব্যক্তি হুজায়বী সাহেবের সাক্ষাতের জন্যে আমার অনুমতি চেয়েছিল। তা, তাতে কি হয়েছে, সে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো-
: তোমরা একত্রিত হতে কেন? …… আর হ্যাঁ, আমি তোমার জবাব সহজ করে দিচ্ছি। …… ঐ সেই ব্যক্তি, যে হুজায়বীর কাছে গিয়েছিল, তার কি আবদুল ফাত্তাহ শরীফ নয়? …… তুমি যদি ঠিক জবাব না দাও তাহলে তোমাকে লটকিয়ে দেয়া হবে। …… তোমরা সরকার পরিবর্তনের এবং নাসেরকে খুন করার ব্যাপারে একমত হয়েছিলে। আমি বললাম-
: আমরা মূর্খতা, নাস্তিক্যবাদ, অশ্লীলতা, কম্যুনিজমের বিরুদ্ধে এবং কুরআনের শিক্ষা প্রচার করে মুসলমানদের কুরআন ও সুন্নাহ্র অনুসরণে জীবন যাপনে প্রস্তুত করার ব্যাপারে একমত হয়েছিলাম। সে মুখ ভেংচিয়ে বলল-
: তাহলে আল-আজহারের কি কাজ? বলতো আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব কি? তারপর সে সাফওয়াতকে ডেকে বলল-
: সাফওয়াত, একে উল্টো লটকিয়ে চাবুক লাগাও।
চাবুকের প্রহার শুরু হয়ে গেল আর আমি আল্লাহ্-আল্লাহ্ বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া পর্যন্ত চাবুকের তীব্র-তীক্ষ্ণ আঘাত সইতে থাকলাম।