পঞ্চম অধ্যায়
নাসেরের উপস্থিতিতে নির্যাতন
জ্ঞান ফিরে এলে দেখতে পেলাম, অনেকগুলো লোক আমাকে ঘিরে রয়েছে। আমি হিম-শীতল অবস্থায় মেঝেতে লুটিয়ে আছি। আমাকে ওষুধপত্র খাওয়ানোর পর কোন রকমে উপস্থিত লোকদের দিকে তাকিয়ে দেখি, এক পাশে প্রেসিডেন্ট নাসের, আবদুল হাকিম আমেরের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে তার হাতে ছিল কালো গগলস্। প্রেসিডেন্ট নাসের এবং আব্দুল হাকিমকে দেখে আমার ব্যথা-বেদনার কথা ভুলে গিয়ে দেহ এবং মনে এক নতুন সচেতনতার প্রবাহ অনুভব করি। আমি মনে মনে পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্যে তৈরী হই। আমাকে এক পেয়ালা রস দেওয়া হয়, আমি তা পান করি। এরপর কয়েকজন আমাকে মাটি থেকে তুলে একখানা চেয়ারে বসিয়ে দেয়। তারা আমাকে কফি ভরা একটি ফ্লাস্কও দেয়। কিন্তু সেদিকে আমার তেমন কোন আগ্রহ ছিল না।
পরিবেশ দেখে স্বাভাবিক ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা হল। শামস্ বাদরান কথার শুরুতেই বলল-
: দেখ জয়নব; আমি আমার প্রত্যেক প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব চাই। নইলে……। জয়নব, মনে কর ইখওয়ানুল মুসলিমুনে দেশে সরকার পরিচালনা করছে আর আমরা তোমাদের সামনে মামলার আসামী হিসেবে উপস্থিত, তখন তোমরা আমাদের সাথে কি ব্যবহার করবে?
আমি সম্পূর্ণ শক্তি ও সাহসিকতার সাথে বললাম-
: যারা নিজেরা নিজেদের উপর জুলুম করে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত নই। আমরা আমাদের হাতকে কোন মন্দ কাজে ব্যবহার করতে রাজী নই, যেমন অত্যাচারীরা তাদের হাতকে মন্দকাজে তৎপর রেখেছে। আমরা আমাদের হাতকে রক্তরঞ্জিত করতে চাইনা। অত্যাচারীদের আসনে বসার কোন আকাঙ্ক্ষাও আমরা পোষণ করি না।
সে ধমক দিয়ে বলল –
: থামো, আমি, জিজ্ঞেস করছি, তুমি যদি আমার স্থলে এই চেয়ারের মালিক হও তাহলে আমার সাথে কি ব্যবহার করবে?
আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম-
: আমরা সত্যাকাঙ্ক্ষী লোক এবং সত্যের পথই অনুসন্ধান ও অনুসরণ করছি। সরকারী ক্ষমতা অর্জন আমাদের উদ্দেশ্য নয় বরং আমরা হচ্ছি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর’ পতাকাবাহী এবং এই কালেমা ও পতাকার মর্যাদা রক্ষার জন্য নিবেদিত প্রাণ। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ জান্নাতের বিনিময়ে মু’মিন ব্যক্তিদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন। শামস্ বাদরান দাঁতে দাঁতে কষে বলল-
: চুপ, এই মেয়ে! আমি আবার প্রশ্ন করছি; যদি তোমাদের হাতে ক্ষমতা আসে তাহলে তোমরা আমাদের সাথে কি ব্যবহার করবে?
আমি ধীর শান্ত কণ্ঠে বললাম-
: আমরা ক্ষমতার অভিলাষী নই। উচ্চতর দায়িত্বও আমাদের কাম্য নয় বরং শরীরে বিশেষ রক্তবিন্দু অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত মহান ইসলামী আদর্শের শিক্ষা ও পয়গাকে প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছানোর কর্তব্য সক্রিয় থাকবো।
…… আমরা আল্লাহ্র ইবাদাত করতে এবং আল্লাহ্র দ্বীনকে তাঁর দুনিয়াতে বাস্তবায়নের কাজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমরা ইসলামী জাগরণ সৃষ্টির জন্যে এবং ইসলামের আলো সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার মহান ব্রতে দৃঢ় সংকল্প। শামস্ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল-
: চুপ…চুপ…… থামো! আমি একটি প্রশ্নের জবাব চাই, মনে কর, যে চেয়ারে আমি বসে আছি তুমি তাতে বসে আছ এবং তোমার সামনে আমি আসামী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছি; তখন তুমি আমার সাথে কি ব্যবহার করবে?
আমি তেমনি স্বাভাবিক কণ্ঠেই বললাম-
: কোন কোন সময় ইসলামী শাসন কায়েমের কাজে যুগ যুগ কেটে যেতে পারে। আমরা তড়িঘড়ি কোন পদক্ষেপ নিতে চাই না। ……যেদিন ইসলামী শাসক প্রতিষ্ঠিত হবে-মুসলিম মহিলারা তাদের স্বাভাবিক স্থান থেকে জাতি গঠনের বৃহত্তর দায়িত্ব পালন করবে।
শামস্ মরুপ্রান্তরে দিকহারা মুসাফিরের মতো চেঁচিয়ে বলল –
: এ-ই মেয়ে…… মনে কর, তুমি যদি আমার স্থানে এসে বস তাহলে আমার সাথে কি ব্যবহার করবে? আমি বললাম-
: ইসলাম-সুবিচার, ন্যায়-নীতি, দয়া, মহানুভবতা ও সার্বজনীন সাম্যের আদর্শ। এখানে চাবুক আর হান্টার, কারানির্যাতন, দেশত্যাগ, জীবন্ত দাফন, জোর-জুলুম, ইয়াতীম ও বিধবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা ইত্যাদি জঘন্য শাস্তির কোন অবকাশ নেই। ইসলামের বিচার-ব্যবস্থা সত্য ও যুক্তির উপর ভিত্তিশীল। এখানে অবিচার বা জোর-জুলুমের কোন স্থান নেই। সত্যভিত্তিক যুক্তি-প্রমাণই ইসলামী বিচার ব্যবস্থার মোদ্দা কথা। শামস্ এবার ভূলুণ্ঠিত কুস্তিগীরের মতো বলল-
: থামো থামো! সাফওয়াত; একে লটকিয়ে দাও এবং চাবুক লাগাও। সাফওয়াত আমাকে লটকিয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ মোড়া সারা শরীরের উপর চাবুক চালাতে লাগল। রক্ত গড়িয়ে পড়ছিল। আর আমি অচেতন হয়ে পড়ছিলাম। ডাক্তার আমাকে ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দিয়ে বললেন-
: এ তো সাংঘাতিক অবস্থা! এতে করে তিনি মরেই যাবেন।
শামস্ চেচাঁলো-
: মন্দবুদ্ধি; ধোঁকাবাজি……। অন্য একজন অফিসার বলল-
: আদালতে দাঁড় করানোর জন্যে আমরা ওকে জিন্দা রাখতে চাই।
শামস্ বলল –
: হ্যাঁ, হ্যাঁ আমরাও চাই সে জীবিত থেকে আদালতে উপস্থিত হোক এবং জাতি এর নিকট থেকে শিক্ষা অর্জন করুক।
ডাক্তার বললেন-
: কয়েকটি ওষুধের খুবই প্রয়োজন, ওসব আমাদের কাছে নেই।
শামস্ বলল-
: উপদেষ্টা আমেরের মেডিক্যাল ষ্টোর থেকে আনিয়ে নাও।
এরপর আমাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। সে রাতের অন্যান্য ঘটনাবলী আমার স্মরণ নেই। তবে প্রেসিডেন্ট নাসের ও আবদুল হাকীমের উপস্থিতিতে, শামস্ বাদরানের সাথে প্রশ্নোত্তর জবাবকালে আমার যা বলার প্রয়োজন ছিল, তা বলে দিয়েছি।
আসল চক্রান্তঃ গুজব
তাদের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যে আমাকে আরো কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখা দরকার তাই আমার চিকিৎসা করানো হচ্ছিলো।আমি এমন লোকদের সামনে আসামী হিসেবে উপস্থিত ছিলাম – যাদের পেশা এবং নেশা হচ্ছে মিথ্যে মামলা তৈরি করে নির্দোষীকে দোষী এবং দোষী কে নির্দোষ ঘোষণা করে বীরত্বের আসনে প্রতিষ্ঠা করা। এরা তাদের জীবন স্বার্থ হাসিলের জন্য যে কোন পন্থা অবলম্বন করতে পারে। অভিনয়, জোর-জুলুম-লালসা-প্রবঞ্চনা এবং বিশ্বাসঘাতকতায় এরা বিশেষভাবে অভ্যস্ত। আদালতে উপস্থিত হতে সক্ষম করে তোলার জন্যে আমাকে যে ওষুধ-পত্র দেয়া হচ্ছে- এটা কোন তাজ্জবের ব্যাপার নয়।
তিন দিন পর্যন্ত অজ্ঞান অবস্থায় থাকার পর চতুর্থ দিন বিকেলে জ্ঞান ফিরে এলে পার্শ্ববর্তী ভাই আহমদের সে’ল থেকে মুরাদ ও সাফওয়াত এর কণ্ঠস্বর শুনলাম। তারা ওর কাছে সাইফুল ইসলাম আল-বান্নার ঠিকানা জিজ্ঞেস করছিল। তিনি তাদেরকে ঠিকানা জানাতে বাধ্য হলেন। এরপর প্রায় তিনি ঘণ্টা ওরা আবার ভাই আহমদ কামালের কাছে ফিরে এসে সাইফুল ইসলাম আল বান্নার অফিসের ঠিকানা চাইলো। সাইফুল ইসলাম বান্না হচ্ছেন শহীদ ইমাম হাসানুল বান্নার ছেলে। …… আমি তাঁদের পরিবারের প্রত্যেকের নিরাপত্তার জন্যে আল্লাহ্র কাছে মোনাজাত করলাম। কারণ তাঁর মা ছিলেন হৃদরোগে আক্রান্ত এবং সাইফুল ইসলাম একাই সারা পরিবারের দেখাশোনা করছিলেন। এই সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্যবর্গের বিরুদ্ধে এসব জালিমদের সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ হয় যেন, আল্লাহ্র কাছে এই দোয়া করলাম।
পরে আমাকে ষ্ট্রেচারে করে শামস্ বাদরানের অফিসে নেয়া হলে তার এক প্রশ্ন শুনে বিশ্বাস না করে আর উপায় রলো না যে তারা সাইফুল ইসলামকেও গ্রেফতার করে এই সামরিক কারাগারেই বন্দী করে রেখেছে। এতে করে ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়লাম আমি।
এ সময় শামস্ হামজাকে ডেকে বলল-
: আমি তোমাকে বলেছিলাম এই মেয়েকে যেন জীবিতাবস্থায় আমার অফিসে না আনা হয়। … এই দেখ এখনো ওর শ্বাস চলাচল করছে।
এরপর আমার দিকে চেয়ে বলল-
: তুমি এখনো বেঁচে আছ? কিন্তু কেন? ……
আমি তাকে বললাম-
: জীবন মৃত্যু তোমার বা আমার ইচ্ছাধীন নয়। বরং আল্লাহ্ই জীবন মৃত্যুর ফয়সালা করেন। সে গর্জে উঠে বলল- ব্যাস-ব্যাস, চুপ কর। আমি শুধু আমার প্রশ্নের জবাব চাই। …… বল, সামরিক বাহিনীর কোন কোন ব্যক্তি আলেকজান্দ্রিয়ার পথে নাসেরকে খুন করতে চেয়েছিল? হাসান খলীল শামস্কে বলল-
: আমাকে কথাটা বুঝিয়ে বলার অনুমতি দিন পাশা। শামস্ মাথা নেড়ে অনুমতি দিলে হাসান বলল-
: এক ব্যাক্তি তোমাকে এসে বলেছিল যে, মোটরযোগে আলেকজান্দ্রিয়া যাওয়ার পথে নাসেরকে হত্যা করার জন্যে সৈন্যদের একটি দল মরুভূমিতে ওৎ পেতে বসেছিল। এই ঘটনা তোমাকে কে শুনিয়েছিল এবং নাসেরকে হত্যা করার উদ্দেশ্য কারা কারা জীপে বসেছিল?
শামস্ বাদরান বললো- এবার জলদি জবাব দাও।
আমি বললাম-
: কতো তুচ্ছ এবং ক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়ে নিছক সন্দেহের বসে তোমরা লোকদের উপর অত্যাচারের পাহাড় ভাঙ্গাচ্ছো। আল্লাহ্ তোমাদের নিপাত করুন! …… তোমরা ধ্বংস হও এবং গোটা জাতির পক্ষ থেকে তোমাদের উপর অভিশাপ……।
এসব কথার জবাব সেই একই; হান্টার চাবুকের ভীষণ মার। আমাকে এমন বেদম প্রহার করা হলো যে ব্যান্ডেজ ফেটে রক্ত গড়াতে লাগলো।
হাড়-গোড় ভেঙ্গে চুরচুর অবস্থা।
শামস্ বলল-
: আমরা তোমাকে লটকিয়ে দিলে তুমি মরেই যাবে… অবশ্য তুমি ঘটনাটা খুলে বললে আমরা তোমাকে ক্ষমা করবো। …… বল, শুরু থেকে ঘটনা খুলে বল। সাইফ তোমাকে যা বলেছিল, তা বলে দাও।
আমি বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম – ওহ, সাইফের বর্ণিত সেই গুজব?
শামস্ তেড়ে এসে লাথি মেরে দাঁত খিঁচিয়ে বলল- হ্যাঁ, সেই গুজব।
আমি বললাম-
: আমি যখন শহীদ হাসানুল বান্নার বাড়ীতে ছিলাম তখন সাইফ এসে বলল যে লোকেরা একটি গুজব নিয়ে বলাবলি করছে…… তাহলো নাসের মোটরযোগে আলেকজান্দ্রিয়া যাওয়ার পথে তাকে হত্যা করার জন্যে সামরিক বাহিনীর কয়েকজন লোক জীপ নিয়ে লুকিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নাসেরের যাত্রাপথ পরিবর্তন করা হয় এবং নাসের ট্রেনযোগে যাত্রা করে। মজার কথা হলো জীপটি পালিয়ে যায় এবং ওসব লোককে সনাক্ত করা যায়নি।
আমি সাইফকে বললাম –
: আসলে এটা গুজব; কোন জীপ এভাবে ওৎ পেতে ছিল বলে আমি মনে করিনা। বরং ঘটনাটা গোয়েন্দা বিভাগেরই তৈরী গল্প। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই তারা নাসেরের হত্যা-ষড়যন্ত্রের গুজব ছড়িয়ে থাকে। এবং কৃত্রিম গুজবের ভিত্তিতে হাজার হাজার সামরিক ও বেসামরিক লোককে গ্রেফতার করার খবর নিত্য শুনে আসছি।
সাইফ বলল-
হ্যাঁ হ্যাঁ, এটা শ্রেফ গুজব বৈকি কিছুই নয় এবং জনসাধারণও এটাকে গুজব বলেই ধরে নিয়েছে। আমি বললাম-
: কেউ তাকে হত্যা করার চিন্তা করে না। কারণ জালিম-অত্যাচারীকে হত্যা করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। আসল সমস্যা নাসেরকে খুন করার চেয়েও গুরুতর। আর তা হচ্ছে দেশকে মূর্খ, খোদাদ্রোহী এবং অত্যাচার শাসকদের নাগপাশ থেকে মুক্ত করা।
সাইফ বললেন, ব্যক্তিত্বের পরিশুদ্ধি এবং ব্যক্তিগত প্রশিক্ষণের দিকেই লোকদের দৃষ্টি নিবন্ধ করা উচিৎ। আমি বললাম-
: যাই হোক, গুজব ছাড়া এই দেশকে কে ধ্বংস করেছে? জনসাধারন আজ গুজবকেও একটা অবলম্বনের বিষয় মনে করে নিয়েছে। …… কারণ এসব গুজবের ভিত্তিতেই অনেক বীর-পুরুষ এবং দায়িত্বশীল ব্যাক্তিকে খুন করা হয়েছে। এরপর সাইফুল ইসলামের সাথে আমার আলোচনা শেষ হয়ে যায়। শামস্ বাদরান বলল-
: এই ঘটনা সম্পর্কে তোমার বাড়ীতে আবদুল ফাত্তাহ ও আলী উস্মাবীর মধ্যে আলোচনা হয় এবং তোমার সেই চক্রান্তের পরিকল্পনা এবং তার ভুল ত্রুটি পর্যালোচনা করেছিলেন, কিন্তু কেন?
আমি জবাব দিলাম-
: তা তো হয়নি। আমি শুধু সাইফুল ইসলামের কাছ থেকে শোনা কথা ভাই আবদুল ফাত্তাহ্কে বলেছিলাম যে এই গুজব……
এইটুকু বলতেই লাথি আর ঘুঁষির বর্ষণ শুরু হল। শামস্ জিজ্ঞেস করলো-
: তুমি এই ঘটনা হুজায়বীকে শুনিয়েছিলে কেন? কারা কি বলছে না বলছে, তা নিয়েই তুমি বলাবলি কর কেন?
আমি বললাম-
: তা ঠিক, কিন্তু এ ব্যাপারে কারো মাথা ব্যথা হবে কেন?
ব্যাস্, আবার হান্টারের আঘাত।
শামস্ এবার বলল-
যাকগে, আমরা এবার সাইফের বিষয় ছেড়ে অন্য বিষয় নিয়ে আলাপ করবো……।
: তা বলতো, সাইয়েদ কুতুবের কারাগার থেকে মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত আবদুল আজীজ আলী ইখওয়ানের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করছিল……। আমাকে বল এটা কেমন করে হয়েছে?
আমি বললাম- তা ঠিক নয়।
সে জিজ্ঞেস করলো-
: কেন ঠিক নয়? আবদুল আজীজ, আলী উসমাবী, আবদুল ফাত্তাহ, জিয়া, ইয়াহিয়া, সাজলী এবং মজিদের সাথে বৈঠক করতো ও সাইয়েদ কুতুবের মুক্তির পর বেশ কয়েকবার তার সাথে সাক্ষাৎ করে।
আমি জবাবে বললাম-
: এসব বৈঠক সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা।
শামস্ বলল –
: তুমি ছাড়া আর কে জানবে? এসব বৈঠক সম্পর্কে অবশ্যই অবহিত ছিলে।
আমি বললাম- এটা মিথ্যে অপবাদ।
শামস্ ধমক দিয়ে বলল-
: আমি এক্ষুণি মজা দেখাচ্ছি… তুমি নিজের ভালমন্দ দেখতে পাচ্ছ না এবং নিজের জ্ঞান-বুদ্ধিও ব্যবহার করছো না। …
উপস্থিত লোকদের মধ্য থেকে তার এক চাটুকার বলল-
: একজন গরম হলে অন্যজনকে নরম হতে হয়……।
পাশা; এক মিনিত সবুর করুন। আমি চেষ্টা করে দেখছি।
এরপর আমার দিকে চেয়ে বলল –
: জয়নব; হুজায়বী এবং আবদুল আজীজ উভয়েই সব স্বীকার করে নিয়েছে। এখন অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। নাসেরকে হত্যা করার জন্যে আবদুল আজীজের তৈরি বিষ ব্যবহারের কথা ছিল ইসমাইলের। বিষ প্রয়োগের ঘটনাটা কি ছিল এবং এ ব্যাপারে কি করে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়?
আমি উচ্চস্বরে বললাম-
: তোমরা সব নাসেরের হত্যার নামে পাগল হয়ে রয়েছে। সত্যি সত্যিই যদি তোমরা তাকে খতম করতে চাও তো খতম করে আমাদেরকে মুক্তি দাও। আমাকে আবদুল আজীজ এবং ইমাম হুজায়বীর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দাও।
তারা বলল- না, আমরা প্রথমে তোমাকে আলী উসমাবীর সাথে সাক্ষাৎ করাবো।
আমি বললাম- আলী উসমাবী এক নম্বর মিথ্যুক ব্যক্তি। সে তোমাদের ভাড়াটে লোক আমি তার সাথে কথা বলবো না।
শামস্ বাদরান জিজ্ঞেস করলো- আলী উসমাবী কি তোমাদের একজন নয়?
আমি ওর প্রশ্ন উপেক্ষা করে বললাম-
: আমাকে শ্রদ্ধেয় আবদুল আজীজ এবং জনাব ইমাম হুজায়বীর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দাও। হাসান খলীল বলল-
: তা ঠিক আছে, আমরা তোমাকে তাঁদের সাথে দেখা করাবো।
শামস্ বাদরান বলল-
: তুমি আবদুল আজীজকে ইখওয়ানদের নেতৃত্বদানের ব্যাপারে তার উপস্থিতিতে কখন হাসান হুজায়বীর সাথে পরামর্শ করছিলে?
আমি বললাম- এমন কোন কথা হয়নি।
শামস্ আলী উসমাবীকে ডেকে আনার জন্যে সাফওয়াতকে পাঠালো।
আলী উসমাবী বেশ কেতাদুরস্ত হয়ে এলো। আর পরণে যেমন উত্তম রেশমী পরিচ্ছেদ তেমনি সুন্দর করে আঁচড়ান চুল এবং তার সাথে ওদের মিষ্টি ব্যবহার আমাদের সাথে তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণই পেশ করছিল।
শামস্ তাকে স্নেহের স্বরে বলল-
:আলী, জয়নবের যখন পা ভেঙ্গে যায়, তখন সে গাড়ী থেকে না নেমে এ ব্যাপারে হুজায়বীর মতামত জানার জন্যে তোমাকে তার মেয়ের কাছে পাঠানো হয়। কেন অমন করা হয়েছিল?
আলী উসমাবী বলল-
: জী হ্যাঁ, আমি হুজায়বী সাহেবের মেয়েকে গিয়ে বলি তিনি যেন আবদুল আজীজের উপর আস্থা সম্পর্কে তার আব্বার মতামত জিজ্ঞেস করেন। …… তিনি ভারপ্রাপ্ত নেতৃত্বের জন্যে আবদুল আজীজের নির্বাচনের পক্ষে জনাব হুজায়বীর মতামত ও সমর্থন নিয়ে আসেন।
শামস্ আমাকে জিজ্ঞেস করল-
: এবার তোমার মত জয়নব?
আলী উসমাবীকে লক্ষ্য করে বললাম-
: ভীষণ মিথ্যেবাদী তুমি……। আসলে তুমি আমাকে বলেছিলে যে, একজন ইখওয়ানী আবদুল আজীজের নাতনীর বিয়ের পয়গাম দিতে ইচ্ছুক, এ ব্যাপারে সে জনাব হুজায়বীর মতামত নিতে চায়। ঘটনাচক্রে আমি গাড়ীতে করে বেরুচ্ছিলাম, তখন তুমিও আমার গাড়ীতে উঠে বস। আমি তোমাকে বলেছিলাম যে…… আহত পা নিয়ে আমি জনাব হুজায়বীর বাড়ী পর্যন্ত যেতে সক্ষম নই……। জনাব হুজায়বীর বিয়ের প্রস্তাব শুনে বলেছিলেন যে, আবদুল আজীজের পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসার কিছুই নেই…… সত্যিকারের মুসলিম পরিবারই বলতে হয়……। এই বিয়েতে আল্লাহ্ বরকত দিবেন।
শামস্ জিজ্ঞেস করলো- আলী এর কথা কি সত্য?
আলী উসমাবী বলল পাশা- এসব তার পারিভাষিক কথা। জয়নব এ ধরনের পারিভাষিক বলতে খুব পাকা।
আমি তার কথা শুনে তাকে প্রত্যক্ষভাবে বললাম-
: আলী, তুমি এক নম্বরের মিথ্যুক এবং বেঈমান। তুমি তোমার কৃত অপকর্মের জন্যে একদিন অবশ্যই অপমানি হবে। …… ইখওয়ানদেরকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হচ্ছে; তাদের উপর হান্টার আর চাবুকের অবিরাম বর্ষণ চলছে, তাদের উপর কুকুর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে- আরো কতো রকমের নিষ্ঠুর জুলুম চলছে। আর তুমি এদের ভাড়াটে দালালের ভূমিকা পালন করছো। এজন্যেই এরা তোমার কথাকে বিশ্বাস করে।
শামস্ আলীকে যেতে নির্দেশ করে বলল-
: জয়নব, আমরা তোমাকে সর্বশেষ সুযোগ দিচ্ছি। সংগঠনের সাথে আবদুল আজীজের সম্পর্কের ব্যাপারে আমাকে বিস্তারিত জানাও। তোমার মাধ্যমে হুজায়বী এবং আবদুল আজীজের মধ্যে যে চিঠি পত্রের আদান-প্রদান চলে, সেসব খুলে বল।
আমি এসব কথা এড়িয়ে গিয়ে বললাম-
: আমি, জনাব আবদুল আজীজ ও জনাব হুজায়বীর সাথে দেখা করার ব্যাপারে বিশেষ অনুরোধ জানাচ্ছি।
শামস্ বাদরান সাফওয়াতকে ডেকে বলল-
: আবদুল আজীজ এবং হুজায়বীকে না আনা পর্যন্ত একে এখান থেকে নিয়ে যাও।
সাফওয়াত আমাকে একটি দেয়ালের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে আবার শামস্ এর অফিসে নিয়ে গেল। কিন্ত আবদুল আজীজ এবং হুজায়বী কেউ সেখান উপস্থিত ছিলেন না। আমি জানতে চাইলাম……
: আবদুল আজীজ এবং হুজায়বীকে সাহেবরা কোথায়?
শামস্ ঝাঁঝিয়ে বলল- আমরা কি তোমার কথামত কাজ করবো? আমরা যখন যাকে সে সময় প্রয়োজন মনে করবো ডেকে আনবো। …… তোমাকে দেখছি আগের শাস্তিই আবার দিতে হবে।
আমি তার অভিশপ্ত চেহারার দিকে চেয়ে বললাম-
: তুমি যখন আল্লাহ্কেই ভয় করনা, তো মানুষকেই কতটুকু শরম করবে?
হাসান খলীল এসে বলল- দেখ মেয়ে, আমার সাহায্য নাও। পাশা তোমাকে আদালতে সোপর্দ করতে চাচ্ছেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম- আদালত? কিসের আদালত? তোমরা কারা?
শামস্ বলল-
: আমরা তোমাকে আদালতে পেশ করার জন্যে তৈরী করবো।
আমি বিদ্রুপ করে বললাম-
: আদালতে পেশ করার প্রস্তুতিই বটে! চাবুক, হান্টার, কুকুর, আগুন আর পানির সে’ল, জবাইকৃত পশুর মতো উল্টো লটকিয়ে মারপিট করা, অশ্লীল নোংরা ভাষায় গালি-গালাজ করা, ক্ষুধায়-পিপাসায় কাতর করে রাখা, দীর্ঘদিন পর্যন্ত মল-মুত্র ত্যাগ করার সুযোগ না দেয়া, তদন্তের নাম রাত দিন অফিসে অফিসে ঘুরিয়ে হয়রানী করা, পাশবিক নির্যাতন চালানো, যান্ত্রিকভাবে কঠিন শাস্তি দেয়া-ইত্যাদি নির্মম ব্যবহার করে বুঝি আমাকে মিশরের আদালতে পেশ করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
মোহাম্মদ কুতুব
শামস্ এর অফিসে হাসান খলীল বলল, আমরা আদালতের কাজকর্ম শুরু করার আগে ডঃ মাসুদের সমস্যা বিবেচনার জন্যে মুহাম্মদ কুতুবের সংগঠন সংক্রান্ত বিষয়াবলীর আলোচনা শেষ করতে চাই।
শামস্ হটাৎ যেন কোন হারানো বস্তু ফিরে পেল বা ভুলে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে পড়লো – তেমনি ভান করে অভিনয় সুলভ ভঙ্গিতে বলল- ওহ্ হো, সেই কুতুবের সংগঠন……?
আমি বললাম-
: আমি আগেই বলেছি যে, মোহাম্মাদ কুতুব কোন সংগঠনের বুনিয়াদ স্থাপন করেননি। তিনি একজন সাহিত্যিক-চিন্তাবিদ। মানুষকে সত্য সরল সহজ পথের দিক-নির্দেশ দেয়াই তাঁর কাজ। মুসলমানদের সমস্যাবলী ও তার সমাধান এবং তারা কোন পর্যায় অতিক্রম করছে ইত্যাদি বিষয়ে জাতিকে সজাগ ও সচেতন করার জন্যেই তিনি তাঁর সাহিত্য প্রতিভাকে নিয়োজিত রেখেছেন। …… তা যেন কোন ব্যক্তির চিন্তা-ধারা এবং মতামত প্রকাশ করার মৌলিক অধিকার রয়েছে।
শামস্ বাদরান অস্থিরতা প্রকাশ করে বলল-
হামজা, একে নিয়ে যাও। আমার মনে হচ্ছে আবার ঐ পানি, আগুন, কুকুর এবং চাবুকের দিকে ফিরে যেতে চাচ্ছে।
হামজা আমাকে শামস্ – এর অফিস থেকে কিছু দূরে নিয়ে একটি কক্ষে আটক রেখে চলে যায়। আধঘণ্টা পরে হাসান খলীল এসে বলল-
: শোন জয়নব! আমি তোমাকে সুপরামর্শ দিতে এসেছি। তুমি যেভাবে নিজেকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছ, তাতে আমি উদ্বিগ্ন। …… সব ইখওয়ানরাই বাঁচার পথ খুঁজে নিয়েছে। … আমরা এক লাখ লোককে গ্রেফতার করেছিলাম। কিন্তু এখন আমাদের কাছে মাত্র বিশ হাজার লোক রয়ে গেছে। আর এই মধ্যেই সবাই তাদের নিজ নিজ অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে। যারা যারা ক্ষমা চাচ্ছে, তাদের মুক্তি দেয়া হচ্ছে। এমনকি মুর্শিদে আ’ম হাসান হুজায়বী, আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইল আর সাইয়েদ কুতুবের মতো লোকেরাও দোষ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। আর তুমি কিনা মুর্শিদে আম’কে বাঁচানোর চেষ্টায় আছ; অথচ তিনি তোমার ব্যাপারে অনেক অভিযোগ তুলেছেন। তুমি এমন লোকদের জন্যে নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছ, যারা তোমার বিরোধিতা করছে। তোমার অভিমত পরিবর্তন করা উচিৎ। কারণ, ওরা সব ঘটনার জন্যে তোমাকেই দোষী সাব্যস্ত করেছে। হুজায়বী, সাইয়েদ কুতুব, আবদুল ফাত্তাহ, মোহাম্মাদ কুতুব এবং অন্যান্য সব ইখওয়ানরাই তোমার নিন্দা করছে। …… পাশা, হামজা, সাফওয়াত ইত্যাদির গালিগালাজ এবং দুর্ব্যবহার সত্ত্বেও তোমার অভিমত আমাদের কাছে প্রশংসনীয় মনে হয়েছে। ইখওয়ানরা যখন তোমাকে গালি দিয়েছে তখন তাদেরকে আমারা হীন মনে করেছি এবং তোমার প্রতি আমাদের মর্যাদার ভাব আরো আরো বৃদ্ধি পেয়েছে……। দেখ, পাশা তোমাকে নতুন করে কঠোর শাস্তি দেয়ার কথা ভাবছে। কিন্তু আমি তোমার সাথে সমঝোতা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছি……। সুতরাং আমি পাশার কাছে তোমার এমন মতামত নিয়ে যেতে চাই যাতে তুমি এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পার। সে এবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলল-
: তুমি সপ্তাহে দু’বার বা কমপক্ষে একবার দুপুরের খাবার কি হুজায়বীর সাথে খেতে? এটা হুজায়বীও স্বীকার করেছেন; এবং তুমি তার নির্দেশ ও পরামর্শ আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলের কাছে পৌঁছাতে। আমি আশা করি তুমি সেসব পরামর্শের নমুনা আমাদেরকে সরবরাহ করবে। আবদুল ফাত্তাহ এবং হুজায়বীর উভয়েই একথা স্বীকার করেছেন, সাইয়েদ কুতুব যখন জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন তখন থেকে তুমি তাঁর ও হুজায়বীর মধ্যেকার যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিলে। দেখ জয়নব, আমরা ভিত্তিহীন কথা বলছি না।
ওর হাতে একখানা লিখিত কাগজ ছিল। তা দেখে দেখে সে কথা বলছিল। এরপর সে আরো বলল-
: যেমন, সংগঠনের টাকা তোমার কাছেই গচ্ছিত ছিল এবং এ টাকা তুমি হুজায়বীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছ। ওসব টাকা আবার তোমার কাছে আসে; কিন্তু তুমি আবার ওসব টাকা হুজায়বীর বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দাও। পরে সে টাকা আবার তোমার কাছে আসে, হুজায়বীও এ কথার উল্লেখ করেছেন। এসব কথা অস্বীকার করার কোন উপায় আছে কি? সব গোপন কথা ফাঁস হয়ে গেছে জয়নব! ব্যাস, এখন শুধু তোমার লিখিত স্বীকৃতির প্রয়োজন রয়ে গেছে। নিশ্চয়ই তুমি এ সব কথা এবং অন্যান্য বিষয় লিখে দেবে। এরপর আমরা তোমাকে আদালতে নিয়ে যাবো। ওখানে এসবের তদন্ত হবে। এর দু’দিন পরেই তোমাকে মুক্তি দেয়া হবে এবং তোমাকে সমাজ কল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রীপদে বরণ করা হবে। …… হেকমত আবুজায়েদকে এখন আর পছন্দ করা হচ্ছে না…… তোমার কি মত? এসব বলে সে ঘণ্টা বাজাতেই একজন সিপাহী এসে উপস্থিত হলো। সে তাকে লেবুর রস আনতে বলে আমার সাথে অন্যান্য প্রসঙ্গের আলোচনা জুড়ে দিল। …… সিপাহীটি দু’পেয়ালা লেবুর রস এনে উপস্থিত করলে সে আমাকে তা পান করার অনুরোধ করলো। এরপর সে সিপাহীকে দু’পেয়ালা কফি আনতে হুকুম দিয়ে তার কথা অব্যাহত রাখলো। আমি আগাগোড়া চুপ থেকে তার কথা শুনে গেলাম। বুঝলাম, সে বেশ আশ্বস্ত হয়েছে। যাবার সময় সে সিপাহীকে বলে গেল, তুমি জয়নবের অধীনে থাকবে। আমার দিকে চেয়ে বলল-
এক ঘণ্টা পরে তোমাকে পাশার অফিসে ডাকা হবে। ততক্ষণে তুমি তোমার ভাল-মন্দ সম্পর্কে খুব ভাল করে ভেবে নাও। আমি লিখতে বসলাম এবং আমার কলম ছুটে চললো।
বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম
মহান আল্লাহ্র যথার্থ প্রশংসা এবং তাঁর অশেষ মেহেরবানীর শোকর আদায় করতে আমার ভাষা সত্যিই অক্ষম। আমার শত অযোগ্যতা সত্ত্বেও তিনি আমাকে তাঁর দ্বীনের খেদমতের জন্যে মনোনীত করেছেন; যে পথ তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্যে নির্বাচিত করেছেন, আমাকেও সেই পথে চলার শক্তি ও সুযোগ দান করেছেন।
বস্তুতঃ কুরআন এবং সুন্নাহর পথ এবং আদর্শই হচ্ছে প্রকৃত সত্য, শান্তি ও সুন্দরের পথ। আল্লাহ্ও বিশ্বমানবতাকে এই পথেই আহ্বান জানিয়ে বলেছেন “ হে মানব জাতি, তোমাদের কাছে তোমাদের পালন-কর্তার পক্ষ থেকে সেই বস্তু এসেছে, যা তোমাদের জন্যে সর্বোত্তম পথ এবং শ্রেষ্ঠ উপদেশ”। আল্লাহ্ আরো বলেছেন, “ হে মানবজাতি, আপন প্রতিপালকের উপাসনা কর, তিনিই তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বসূরী মানুষদের সৃষ্টি করেছেন।
কৃতজ্ঞতা জানাই সেই মহান আল্লাহ্কে, যিনি আমাকে তাঁর সেই ফরমান মোতাবেক গড়ে ওঠার সৌভাগ্য দিয়েছেন যে, “ হে আমাদের প্রভু আমরা এক আহ্বানকারীকে ঈমানের পথে ডাকতে শুনেছি। তিনি বলেছেন “ হে দুনিয়ার মানুষ। তোমাদের পালনকর্তার উপর বিশ্বাস স্থাপন কর। আমরা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ঈমান এনেছি”। সেই পরম করুণাময় আল্লাহ্র প্রশংশা ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করছি, যার কালামের ছায়া-তলে আমি আশ্রয় পেয়েছি “ নিঃসন্দেহে, আল্লাহ্ জান্নাতের বিনিময়ে মু’মিনদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন”। সেই আল্লাহ্র প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা নিবেদন করি, যিনি আমাকে মু’মিন পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে শামিল করেছেন এবং আমাকে তাঁদের সাথে নির্বাচিত করেছেন।
“ শোকর সেই দয়াময় আল্লাহ্র যিনি আমাকে তাঁর দ্বীন ও আদর্শের প্রচার, দ্বীনের পথে মানুষকে ডাকার ও দ্বীনের পথে জিহাদ করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন এবং আল্লাহ্র কালামের সত্যতা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়ার যোগ্যতা দিয়েছেন”। আল্লাহ্ বলেছেন, ‘মুমিনরা’ তাদের জান-মালের বিনিময়ে জান্নাত ক্রয় করে নিয়েছেন। তারা আল্লাহ্র পথে জিহাদ করে, মারে এবং শাহাদাত বরণ করে”। আল্লাহ্ আরো বলেছেন, “দুনিয়াতে তোমারই শ্রেষ্ঠ জাতি। তোমাদেরকে এই জন্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে যে, তোমরা সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করবে এবং মিথ্যে ও বাতিলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে”।
“ আমি দ্ব্যার্থহীন কণ্ঠে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছি যে, আল্লাহ্ এক এবং অদ্বিতীয়। আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, তাঁর কোন অংশীদার নেই এবং মোহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহ্র বান্দা এবং তাঁর রাসূল”। আমরা কালেমায়ে শাহাদাতের এই ঘোষণার উভয়দিক ও তাৎপর্যের ধারক ও বাহক। আমরা আল্লাহ্র কুরআন, তাঁর নির্দেশাবলী ও বিধি-বিধানের সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত”। যেমন আল্লাহ্ বলেছেন, “ আমরা তোমার উপর কুরআন অবতীর্ণ করেছি যাতে করে মানুষের সমাজে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা লাভ করে”। প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর উম্মতের প্রতি যে পথ নির্দেশ দিয়ে গেছেন, আমরা তাঁর অনুসারী। প্রিয় নবী বলেছেন “ আল্লাহ্ যা তোমাদেরকে দান করেছেন তার আলোকে মানব সমাজে সত্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা কর”। আমরা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের আদেশ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে দৃঢ় সংকল্প।
হে আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী থাক যে, আমরা তোমার পথে অটল-অবিচল রয়েছি। আমাদের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি। অতএব হে খোদা, যারা শিরক করে, যারা তোমার কুরআনকে দূরে সরিয়ে দেয়, যারা তোমার দ্বীনের সাথে শত্রুতা করে, যারা তোমার দ্বীনের পথের যাত্রী, তোমার কুরআনের পতাকাবাহী এবং তোমার রাসূলের নীতির অনুসারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, সে সব জালিম-অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত জিহাদে আমাদের সাহায্য কর।
হে রাসূল আল-আমীন! আমি এভাবেই জীবন যাপন করবো এবং এভাবে তোমার দরবারে উপস্থিত হবো। হে আল্লাহ্, তুমি আমাকে তাওহীদবাদীদের মধ্যে সত্যিকারের মুসলমান এবং তোমার ভয়ে ভীত ও তোমার কাছে লজ্জিত ব্যক্তিদের মধ্যে শামিল কর।
হে খোদা, তুমি আমাকে শক্তি দাও। আমি যেন কেবল তোমার জন্যেই ভালবাসি, তোমারই কারণে ঘৃণা করি এবং তোমারই সন্তুষ্টির পথে জিহাদ করি। হে মানুষ! এ-ই হল আমাদের জীবন-চলার পথ। এরপর তোমরা যা চাও কর। …… কথা ভাবছে। কিন্তু আমি তোমার সাথে সমঝোতা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছি…। সুতরাং আমি পাশার কাছে তোমার এমন মতামত নিয়ে যেতে চাই যাতে তুমি এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পার। আমি পুরো আত্মদৃষ্টি এবং সম্পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে তোমাদের আল্লাহ্র পথে ডাকছি। অতএব তোমরা আমাকে তোমাদের দূর্বলতার অংশীদার করতে কুফর ও বিভ্রান্তির অন্ধকারে হোঁচট খেতে এবং ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত করানোর ব্যর্থ চেষ্টা করো না। আমি তোমাদের সব অপকর্ম থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রয়েছি এবং তোমাদের মিথ্যে আর বাতিলের মোকাবেলার জন্যে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রস্তুত থাকবো।
স্বাক্ষর-
জয়নব আল-গাজালী
হামজা কক্ষে প্রবেশ করেই বলল-
: বাহ্ জয়নব! আল্লাহ্ চাহেতো আমাদের মনিব তোমার সহযোগিতা করবেন। একমাত্র শর্ত হলো তুমি নিজ স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। …… তোমার স্বামী সালেম অত্যন্ত ভালো লোক। …… তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। …… কি জানি, তুমি কিভাবে ইখওয়ানদের শিকারে পরিণত হলে!…… আচ্ছা হ্যাঁ, তোমার লেখা শেষ হয়েছে কি?
সে কাগজগুলো হাতে নিয়ে বলল, এস,আমার সাথে পাশার অফিসে চল। আমরা শামস্ এর অফিসের দিকে চললাম। শামস্ বাদরান আমাকে দেখে কৃত্রিম আনন্দ প্রকাশ করে বলল- এস জয়নব, বস।
সে আমার জন্যে শরবত এবং কফি আনার আদেশ দিয়ে আমার লিখিত কাগজ পাঠে মন দিল। তার চেহারার উত্থান-পতন তার ভাব ও অনুভূতির আবাস দিচ্ছিল। অবস্থা দেখে আমার বুঝতে বাকী রলো না যে, এক্ষুণ ফেটে পড়বে। সত্যি সত্যি তার দু’চোখ আগুনের ভাটার রঙ ধারণ করল এবং দাঁতে দাঁতে পিষে বিশ্রী চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো-
এ-স-ব-কী……? …… সাফওয়াত, এক হাজার চাবুক। এই মেয়ে আমাদের প্রত্যেককে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছে। তোমরা সবাই কোথায় ছিলে?
ততক্ষণে হান্টারের বিষবর্ষণ শুরু হয়ে গেছে। শামস্ কাগজগুলোকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল-
: এই মেয়ে আমাদের প্রত্যেকের জ্ঞান-বুদ্ধির সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ দেখছি অতিমাত্রায় লেখিকা এবং বাগ্মী। আমার উভয় আহত পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল, আমার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ সহ্যসীমার অতিরিক্ত চাবুক আর হান্টারের আঘাতে বরদাস্ত করেছে কিন্তু এরপরও তারা আমাকে জবাইকৃত পশুর মতো আবার উল্টো লটকিয়ে দেয়। রাগে উন্মাত্ত শামস্ পাশার আদেশে আমার দূর্বল ক্ষত-বিক্ষত শরীরের উপর চালাল অসহ্য চাবুকের অজস্র আঘাত।
সারা শরীর, এমনকি ব্যান্ডেজ কেটেও ঝরঝর করে রক্ত বেরুতে দেখে ডাক্তার আমাকে তক্ষুণি নামিয়ে দেয়ার হুকুম দেন। আমাকে শামস্ এর অফিসের বাইরে এক ঘণ্টা পর্যন্ত ফেলে রাখা হয়। এরপর ষ্ট্রেচারে করে হাসপাতালে পৌঁছানো হয়।
মুরাদ এবং হামজা বলল-
: ডাক্তারদের মতে তুমি মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আছ। কিন্তু আমাদের মতে তোমাকে আদালতে পেশ করা দরকার। কারণ এতে করে তুমি নিজেই ফাঁসীর হুকুম শুনে মরতে পারবে। আমরা আগামীকাল সকালে তোমাকে আইন বিচার বিভাগীয় মন্ত্রণালয়ে সোপর্দ করবো। খুব মনে রেখো, তুমি যদি আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত আদেশ মোতাবেক জবাব না দাও তাহলে তোমাকে আবার এখানে আসতে হবে। এরপর হামজা সাফওয়াতকে ডেকে বলল-
: একে সকাল ন’টায় আদালত ভবনে নিয়ে যাবে।
এই বলে ওরা সবাই চলে যায়।
তদন্ত
আমি অত্যাচারের প্রতিটি পর্যায় অতিক্রম করেছি। অনলবর্ষী হান্টার দিয়ে আমাকে পিটানো হয়েছে, কুকুর লেলিয়ে দিয়ে কামড়ানো হয়েছে, পানির সে’লে ডুবানো হয়েছে, আগুনের সে’লে জ্বালানো-পোড়ানো হয়েছে, জবাইকৃত পশুর মতো উল্টিয়ে লটকানো হয়েছে। এ ধরনের লাগাতার জুলুম নির্যাতনে আমার দেহ-মন উভয়কেই জর্জরিত করা হয়েছে। এতসব জোর-জুলুমের পর এখন সরকারের আইন দপ্তর বিচারের নামে প্রহসন চালিয়ে আমার মতো অসহায় নিরীহ মজলুমদের উপর আরো অন্যায় শাস্তি চাপানোর পাঁয়তারা করছে।
আমাকে আদালতের তদন্ত বিভাগের শিবিরে পাঠানো হয়। এরাও ওদের মতো সেই একই পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করছে। তদন্ত শিবিরে তথ্য সংগ্রাহকরা ধমক এবং ভয় দেখিয়ে অভিযুক্তদের মধ্যে ভিত্তিহীন দোষ-স্বীকার সম্বলিত কাগজ-পত্রে স্বাক্ষর করার জন্যে বাধ্য করছিল।
আর এসব মিথ্যে অভিযোগ সম্বলিত দলিল-দস্তাবেজ তৈরি করা হয়েছে, তথাকথিত আইন-উপদেষ্টা এবং বিচারপতিদের নাকের ডগায় বসে।
সত্য ও সুবিচারের ক্ষেত্রে মুসলিম বিচারপতিদের নির্ভীক ও নিরপেক্ষ রায়ের যে ঐতিহ্য ও সুনাম ইতিহাসের পাতাকে উজ্জ্বল করে রেখেছে, আজ তাদেরই উত্তরসূরীরা মিথ্যে শক্তির সামনে মাথা নত করে আদালত ও বিচার ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করছে। জাতির জন্যে এটা চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়। এভাবে চলতে থাকলে মুসলিম জাতির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। অথচ মুসলমান কাজী ও বিচারপতিদের সত্যনিষ্ঠা ও ন্যায়-প্রীতি সর্বকালে সর্বমানবতার অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করে আসছে।
আইন বিভাগের এসব লোকদের কয়েক জনকে আমি সামরিক কারাগারে প্রকাশ্য মিথ্যে বলতে শুনেছি। এরা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক ভাবে মনগড়া কথা লিখে তার উপর স্বাক্ষর করার জন্যে নির্দোষ লোকদের বাধ্য করে। এরা কিভাবে যে ভয়-ভীতি দেখিয়ে কয়েদীদের সন্ত্রস্ত করে স্বাক্ষর আদায় করছিল, তা আমি নিজের চোখে দেখেছি।
আমি যখন দ্বিতীয় বারের মতো জেলের তদন্ত দপ্তরে উপস্থিত হই, এটর্নি আমাকে নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলেন। আমার সারা শরীর ব্যান্ডেজ বাঁধা; আমি এতো দুর্বল ছিলাম যে, বার বার অজ্ঞান হয়ে পড়ছিলাম, আমার কথার শব্দ যথার্থভাবে উচ্চারণের ক্ষমতাও ছিল না।
একগাদা ফাইলের স্তুপের পিছনে এটর্নি সাহেব বসেছিলেন। তার সামনে ছিল একখানা লিখিত কাগজ। তার পাশে একটি ছোট টেবিলের সামনে বসেছিল এটর্নির সেক্রেটারি। তার সামনে এক গাদা সাদা কাগজ। তিনি কলম হাতে নিয়ে এটর্নির নির্দেশ পালনে তৈরি ছিলেন। এটর্নি সাহেব প্রথমে আমার নাম, বয়স, জাতীয়তা এবং বাড়ীর ঠিকানা লিখলেন।
এরপর এটর্নি নির্বিকার-নিস্প্রভ দৃষ্টি মেলে আমাকে বললেন-
: জয়নব, এসব ফাইল সব ইখওয়ানের বিবৃতি রয়েছে। এর মধ্যে তোমার বিবৃতিই সবচেয়ে স্পষ্ট। আমি তোমার বিবৃতি ফাইলেই রেখে দেবো। …… আমি তোমার মুখে আসল ব্যাপার শুনতে চাই। …… ফাইলের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বললেন-
: এসব হুজায়বী, সাইয়েদ কুতুব এবং আবদুল ফাত্তাহ ইসমাইলের বিবৃতিতে পূর্ণ। …… জয়নব, আমি চাই তুমি তোমার জিদ ছেড়ে দিয়ে সঠিক পথে এস। অনর্থক ফালতু কাজে আমাদের সময় নষ্ট করো না। নয়তো তোমাকে আবার সামরিক কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
এরপর তিনি আমাকে প্রশ্ন করতে থাকেন এবং আমি জবাব দিতে থাকি। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে আমি স্তম্ভিত হলাম যে, আমি যেখানে মাত্র কয়েকটি বাক্যে জবাব শেষ করি, সেখানে তা লিখার জন্যে পুরো এক পৃষ্ঠার দরকার পড়ছিল তাদের।এটা দেখে অত্যন্ত রাগ হলো আমার। আমি এটর্নির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম-
: জনাব কোনাবী! আমিতো কেবল কয়েক বাক্যে জবাব দিয়েছিলাম……! কিন্তু……
এটর্নি বললেন- আমি তোমাকে সাহায্য করবো। কারণ তোমার এসব কথা অক্ষরে অক্ষরে প্রেসিডেন্টের কাছে পেশ করা হবে। তিনি দৈনিক তোমার বক্তব্য জানতে চান। আমি বললাম-
:আমি আমার বক্তব্যের কোন পরিবর্তন পরিবর্ধন বা কমবেশী করার অধিকার দিচ্ছেনা, অর্থাৎ আমার কথা হলো আমার নাম কেবল আমি যা বলেছি তাই লেখা হবে।
এটর্নি বললেন-পরে তোমাকে সব পড়ে শোনানো হবে।
আমি শান্তভাবে বললাম-
: আপনারা যদি আপনাদের পক্ষ থেকেই আমার কথা লিখতে থাকেন, তাহলে আমার পক্ষে কথা বলা অনাবশ্যক। আপনার কেরানীকে দিয়ে আপনার ইচ্ছেমত সব কিছু লেখাতে পারেন। যদি এসবের উপর ভিত্তি করে মামলা চালানো হয় তাহলে আমি শুধু আমার কথাই স্বীকার করবো।
এটর্নি আবার জিজ্ঞেস করলেন-
: তুমি কি প্রেসিডেন্ট নাসের, তাঁর সরকার এবং বর্তমান সমাজকে কাফের বলতে চাও?
আমি বললাম-
: আমি কেবলা কাবার অনুসারীদের কাফের মনে করিনা।
এটর্নি জানতে চাইলো, কেবলা-কাবার অনুসারী কারা?
আমি বললাম-
: যারা কালেমা তাইয়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লায় বিশ্বাস করে এবং যারা জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাসূলের মাধ্যমে পাঠানো আল্লাহ্র বিধান মেনে চলে। এটর্নি পরীক্ষার মতো প্রশ্ন করলেন-
কেবলা-কাবা অনুসারীদের গুণাবলী বিশ্লেষণ কর।
আমি বিশ্লেষণ করে বললাম-
: যারা নামাজ আদায় করেন, যাকাত আদায় করেন, রমজানে রোজা রাখেন, সক্ষম হলে হজ্বব্রত পালন করেন, কুরআন ও সুন্নাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলেন এবং নিজের পক্ষ থেকে আইন প্রণয়ন করেন না আর আল্লাহ্র নির্দেশিত আইন ছাড়া অন্য কোন আইন মোতাবেক সরকার পরিচালনা করেন না।
এটর্নি জিজ্ঞেস করলেন-
তুমি কি নাসেরকে, তার সরকারকে এবং বর্তমান সমাজকে কেবলা কাবার অনুসারী মনে কর?
আমি পরিস্কার করে বললাম-
: নাসেরের ব্যাপারে আমি তা মনে করিনা। কারণ সে চাইলে কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক শাসন পরিচালনা করতে পারে কিন্তু তা সত্ত্বেও সে কুরআন সুন্নাহ্র আইনকে স্থগিত করে রেখেছে। সে নিজের পক্ষ থেকে জনগণের উপর আইন চাপিয়ে দেয়…… নাসের এটা প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করেছে যে, সে কোন ইসলামী শাসন কায়েম করবে না।
: এটর্নি জিজ্ঞেস করলো, তুমি আমাকে স্পষ্ট করে বলে দাও যে, আবদুন নাসের এবং তার সরকার উভয়ই কাফের।
আমি বললাম-
: আমার জবাব দেয়া হয়েছে। যারা নিজেদের বাস্তবতা যাচাই করতে চায়, আল্লাহ্র কুরআনের কষ্টি পাথরে নিজেদের পরখ করে দেখা তাদের কর্তব্য।
ব্যাস, এই কথাটাই লেখার জন্যে এটর্নি সাহেব ফুলস্কেপ কাগজের পাঁচটি পৃষ্ঠা কালা করলেন।
লেখা শেষ করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন- তোমারা উম্মে কুলসুম এবং আবদুল হালীম হাফেজকে খুন করতে চেয়েছিলে?
আমি বললাম-
: মুসলিম জাতির কর্ণধার এবং ইসলামী আন্দোলনের ব্যক্তির কাছে এসব তুচ্ছ কথা ভাবার অবকাশ নেই। যেদিন মুসলমানরা আবার জেগে উঠবে সেদিন এমনিতেই সব অনাচারের বিলুপ্তি ঘটবে এবং জাতি সত্যিকারের মর্যাদা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে। আজ বিভিন্নভাবে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে শয়তানী কর্মে তৎপর রাখা হয়েছে, তা একদিন বুদবুদের মতোই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
এটর্নি মোহাম্মাদ আল কোনাবী আমার কাছ থেকে শুনতেন এক রকম এবং লিখতেন অন্য রকম। তিনি আমার সামনে বসেই আমার কথাকে বিকৃত করেছিলেন, পরিবর্তন-পরিবর্ধন করছিলেন। কোন কোন কথা আবার অন্য ফাইল থেকে নকল করছিলেন!
এভাবে দশদিন পর্যন্ত আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের এই আজব তদন্ত নাটক চলতে থাকে। উপদেষ্টা আবদুল সালাম দৈনিক এসে জনাব কোনাবীর কাছে অবস্থা জিজ্ঞেস করতেন এবং চেষ্টা অব্যাহত রাখার জন্য আদেশ দিয়ে ফিরে যেতেন।
শিবিরের তাবুতে একদিন আমি এটর্নি জনাব কোনাবীকে বললাম-
: আমি আজ আজব ব্যাপার প্রত্যক্ষ করছি। …… আমি দেখতে পাচ্ছি আইন বিভাগ ও আদালতের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গ বন্যজন্তুর রূপ ধারণ করেছেন, তারা দেহ থেকে বিচারের পোশাক এবং মাথা থেকে আইনের তাজ ফেলে দিচ্ছেন।
এটর্নি বললেন-
: আমরা তোমাকে ইখওয়ানের কবল থেকে বাঁচাতে চাচ্ছি। হুজায়বী, সাইয়েদ কুতুব ও আবদুল ফাত্তাহর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তোমার জন্যে ফাঁসীর দণ্ড অনিবার্য হয়ে পড়েছে। হুজায়বী, সাইয়েদ কুতুব এবং আবদুল ফাত্তাহর বক্তব্য সম্পর্কে তোমার অভিমত কি?
আমি তার চোখে চোখ রেখে বললাম-
: আপনি ওদের নামে মিথ্যে কথা বলছেন। তাঁরা সব ইসলামী আন্দোলনের নেতা। তাঁরা কোন সময় কারো বিরুদ্ধে মিথ্যে কথা বলবেন না।
এটর্নি প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বললেন- তুমিই মিথ্যে বলছ।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
: আমি কার বিরুদ্ধে মিথ্যে কথা বলছি?
এটর্নি জবাব দিলেন-
: সরকার এবং আমাদের বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে।
আমি তখন এটর্নিকে চ্যালেঞ্জ করে জিজ্ঞেস করলাম-
: আপনি যে আদালতের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি, তার প্রমাণ পেশ করতে পারেন কি? এটর্নি এবার বললেন-
: আমি তদন্তের কাজ বন্ধ করছি এবং তোমাকে আবার শাস্তির জন্যে সামরিক কারাগারে পাঠাচ্ছি। পরে তোমাকে আবার এখানে আসতে হবে।
এরপর তিনি কফি পান করতে লাগলেন। কফি পান শেষ করে তিনি বললেন-
: জয়নব, তুমি কি আবার সেই শাস্তির কারাগারে ফিরে যেতে চাও? আবদুন নাসের শিগগীরই তোমার কাগজ-পত্র দেখতে চান।
এরপর এটর্নি যা কিছু লিখেছিলেন, আমাকে তাতে স্বাক্ষর করতে নির্দেশ দিলে আমি তা করতে অস্বীকার করি। …… বলাবাহুল্য, আমাকে আবার সামরিক কারাগারের অফিসে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং সেখানে চাবুক আর হান্টার আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়। এভাবে বিচার বিভাগীয় তদন্তের আপাততঃ এখানেই ইতি হয়।
আবার আদালত
দু’দিন পর আবার আমাকে আদালত ভবনে তলব করা হয়। এবার এখানে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় অনেক আহত যুবকদের দেখতে পেলাম। এটর্নি কোনাবী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-
: তুমি কখনো এদের সাথে দেখা করেছ? কখন এদের সাথে পরিচিত হয়েছ এবং এদের নাম কি?
আমি যুবকদের দিকে দৃষ্টিপাত করে জিজ্ঞেস করলাম-
: আমি তোমাদের কবে দেখেছি? আসলে তোমরা আমার সাথে কখনো দেখা করেছ? এর আগে কি তোমরা কখনো আমাকে দেখেছিলে। তোমাদের নাম কি?
এটর্নি চেঁচিয়ে আপত্তি তুলে বললেন-
: আমিই তাদের কাছে প্রশ্ন করবো।
আমি জবাবে বললাম-
: তাহলে আপনি তাদের জিজ্ঞেস করুন, তারা কবে আমার সাথে দেখা করেছে?
আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না যে, আমি কবে তাদের সাথে দেখা করেছি?
এরপর এটর্নি একের পর এক ওদের সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। ওরা প্রত্যেকেই যখন বলল যে, তারা আমার সাথে দেখা করেননি, তখন এটর্নি তাদের প্রশ্ন করলেন-
: কিন্তু তদন্তের সময় তোমরা প্রত্যেকেই জয়নবের সাথে দেখা করার কথা বলেছিলে কেন?
ওরা জবাবে বলল-
: হান্টারের মারই আমাদেরকে মিথ্যে বলতে বাধ্য করেছিল।
এরপর আমাদের সবাইকে সামরিক কারাগারে পাঠানো হয়। এসব বীর যুবকরা অসংখ্যবার আমার সামনে দিয়ে আদালত ভবন এবং সামরিক কারাগারের মধ্যে যাতায়াত করতে বাধ্য হয়।
আবার সেই অত্যাচার
শামস্ বাদরানের সাথে তার কারাগারের অফিসে জিজ্ঞাসাবাদ এবং আমার উপর জোর-জুলুম চলতে থাকে। আমাকে প্রায় প্রতি রাতেই শামস্ অথবা তার কোন সাথীরা অফিসে নিয়ে গিয়ে প্রথমে ভীষণ শাস্তির ভয় দেখানো হতো, তারপর পরিচিত কিশোর-যুবক-মহিলা-পুরুষ বন্দীদের সামনে এনে জিজ্ঞেস করতো-
: তুমি এদের সাথে কবে দেখা করেছিলে?
আমি জবাবে বললাম-
: তাদেরকেই জিজ্ঞেস করে দেখ যে, ওরা কবে আমার সাথে দেখা করেছে এবং তারা আদৌ আমাকে চেনে কিনা?
এর উত্তরে দেয়া হতো নিত্য নতুন শাস্তি। যেমন, কোন অন্ধকার স্থানে দাঁড় করিয়ে রাখা, অথবা আমাকে দৌড়াতে বাধ্য করে পিছন থেকে হান্টারের আঘাত করা ইত্যাদি। আহত এবং দুর্বলতার কারণে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি যখন হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে যেতাম তখন কষে কষে পনের বিশ ঘা লাগিয়ে আবার দৌড়াতে আদেশ দিত। অবশেষে বেহুঁশ হয়ে পড়লে হাসপাতালে কক্ষে রেখে আসতো। আইন ও বিচার বিভাগীয় তদন্তের পর আমাকে যেসব নির্যাতনমূলক শাস্তি দেয়া হয়- তা আগেকার শাস্তি চেয়েও ভয়ানক এবং মর্মান্তিক। এ ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করবো। এতে করেই আপনারা অনুমান করতে পারবেন যে, নাসের এবং তার পোষা চাটুকাররা কতো নিষ্ঠুরভাবে অমানবিক নির্যাতন চালাতে পারে।
শাস্তি
মধ্যরাতে অন্ধকারে আমাকে শামস্ বাদরানের অফিসের কাছে অন্য একটি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে জালালুদ্দিন নামক এক ব্যক্তি বসেছিল। সে আমাকে দেখা মাত্রই প্রশ্ন করলো-
: জয়নব, খালেদা হুজায়বী এবং তাঁর স্বামী আহমদ সাবেতের সাথে তোমার সম্পর্ক এবং সংগঠনে ওদের উভয়ের কি ভূমিকা ছিল? বল।
আমি বললাম- আমার সাথে খালেদা হুজায়বীর কাজ, আটক ব্যক্তিদের পরিবারবর্গের সাহায্য পর্যন্ত সীমিত ছিল।
জালাল জিজ্ঞেস করলো কি ধরনের সাহায্য?
আমি বললাম- আর্থিক এবং বস্তুগত সাহায্য। যেমন-খাদ্যদ্রব্য এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
এরপর সে আমাকে খালেদা হুজায়বীর স্বামী আহমদ সাবেত সম্পর্কে জানতে চাইলে আমি জানালাম যে, তিনি মহিলা সংস্থার দফতর থেকে বিভিন্ন পরিবারের জন্যে দেয়া দ্রব্য সামগ্রী খালেদা হুজায়বীর কাছে পৌঁছাতেন। তিনি এসব দ্রব্যাদি নিতে আসতেন সত্য কিন্তু গাড়ীতেই বসে থাকতেন। অফিসে যেতেন না। এছাড়া তাঁর উপর আর কোন দায়িত্ব ছিল না।
জালাল আমার কথার সত্যতা মানতে অস্বীকার করে এবং আমাকে সাফওয়াতের হাতে সোপর্দ করে। সাফওয়াত আমাকে দেয়ালের দিক মুখ করে দাঁড় করিয়ে সেই সকল প্রশ্ন আবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো। আমি আগের জবাবেরই পুনরাবৃত্তি করলাম। এভাবে জিজ্ঞাসা ও জবাবের ধারা এক ঘণ্টা পর্যন্ত চলতে থাকে; কিন্তু আমার বর্ণনায় কোন পরিবর্তন না দেখে সে আমাকে হান্টার আর কুকুরের ভয় দেখাতে লাগলো। কিন্তু আমি আপন বক্তব্যে অনড়। এর মধ্যে হামজা এবং জালাল এসে উপস্থিত হয়। জালাল আমার উপর কুকুর লেলিয়ে দেয়ার আদেশ করে। এরপর আমাকে দু’ঘন্টা পর্যন্ত একটি কুকুরের সাথে আটক করে রেখে পরে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।
দ্বিতীয় রাতও হুজায়বী এবং তাঁর স্বামী সম্পর্কে সেই একই প্রশ্ন করা হলো এবং আমিও আমার সাবেক জবাব দিতে থাকি। আমাকে বারবার একই অভিমত প্রকাশ করতে দেখে জালাল সাফওয়াতকে ডাকলো। সাফওয়াত তার সর্বশক্তি দিয়ে আমাকে মারতে শুরু করলো।
অর্থ
আমাকে আবার শামস্ বাদরানের অফিসে তলব করা হয়। শামস্ বাদরান আমাকে বলল-
: আমরা গাজা থেকে জেইনিকে আনিয়েছি। মুর্শিদে আ’ম এবং মামুন হুজায়বী তাকে চেনে। তুমি যদি তাকে চিনতে অস্বীকার কর তাহলে আমরা তোমাকে আবার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পুনঃতদন্তের জন্যে পাঠিয়ে দেবো। জেইনি? স্বীকারোক্তি…… খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে এমন কিম্ভুত কিমাকার ব্যাক্তিকে দেখানো হলো, যাকে চেনার বা জানার কোন প্রশ্নই উঠে না। সুতরাং আমাকে আবার শামস্ এর কাছেই ফিরিয়ে আনা হল।
শামস্ জিজ্ঞেস করলো- কে এই ব্যক্তি?
জবাব দিলাম- আমিতো চিনলাম না।
শামস্ বলল-
: এ যে সাদেক জেইনি তাকে প্রত্যেকেই জানে। কথার মাঝখানে জালাল শামস্কে বাধা দিয়ে টাকা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে বলল। শামস্ এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে আমি বললাম-
যে সব লোকের উপার্জনকারী লোকদের কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে, তাদের পরিবার-পরিজনের খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, চিকিৎসা, ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার খাতে ব্যয়ের জন্যে এসব টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিল। শামস্ উত্তেজিত কণ্ঠে হামজাকে ডেকে বলল-
একে নিয়ে গিয়ে এবার কুকুরের কাছে নয় বরং বিষাক্ত সাপের সে’লে বন্ধ করে দাও।
হামজা ও সাফওয়াত আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। হামজা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, তুমি যদি টাকা সংগ্রহের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সত্য কথা বলে দাও, তাহলে আমরা তোমাকে সাপের সে’লে বন্ধ করবো না।
আমি বললামঃ তোমরা ইতিমধ্যেই সব ব্যাপার তদন্ত করে দেখেছ। এসময় জালালুদ্দিন সেখানে পৌঁছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো-
: ও কি ঠিক পথে এসেছে?
হামজা বলল- ওকে আমার হাতে ছেড়ে দিন। মনে হচ্ছে সে কুকুরের সংস্পর্শই পছন্দ করে।
কুকুর! হ্যাঁ আমার দৃষ্টিতে বিবেচনা এবং বিবেকের ক্ষেত্রে কুকুর এদের তুলনায় অনেক উন্নত। যখনই কুকুরের সে’লে বসে আমি এসব লোকদের চরিত্র ও মানসিকতার সম্পর্কে ভেবেছি, তখন আমার কাছে কুকুরের তুলনায় ওদের বেশী ঘৃণ্য জীব মনে হচ্ছে। শামস্, হামজা, জালাল, সাফওয়াত ইত্যাদির তুলনায় কুকুরের পরিবেশ অনেক সহনীয় ছিল নিঃসন্দেহে।
একদিন রাতে আমাকে শামস্ এর অফিসে নিয়ে গিয়ে কথা-বার্তা ছাড়াই হটাৎ এমনভাবে মারতে শুরু করে যে, কয়েক মুহূর্তেই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। আমাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তিন দিন পরে আমাকে আবার শামস্ এর অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।
সে জামাল নাসেরের শপথ করে বলল-
: তুমি যদি আমার প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব না দাও, তাহলে তোমাকে এক নম্বর থেকে চৌত্রিশ নম্বর সে’ল পর্যন্ত আবার নতুন করে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
আমি ইতিমধ্যে এসব সে’লের লোমহর্ষক নির্যাতন সয়ে এসেছি। শামস্ কথা শুরু করতে দিয়ে বলল-
: জয়নব, আমি তোমাকে দু’টি ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। এর একটিতে মোহাম্মাদ কুতুব, জনাব হুজায়বীর স্ত্রী এবং মোহাম্মদ কুতুবের বোনেরা শামিল রয়েছে, আর দ্বিতীয় ঘটনার সাথে জড়িত রয়েছে আলী উসমাবী এবং মামুন হুজায়বী।
আমি যদি বলি যে, এসব কথা হাসান হুজায়বী তাঁর স্ত্রী এবং মোহাম্মাদ কুতুব স্বীকার করেছেন তাহলে তুমি বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তাহলে বল যে, আমরা এসব কেমন করে জানতে পারলাম? মানলাম; যে ঘটনার সাথে আলী জড়িত ছিল তাকে তুমি মিথ্যে বলতে পার কিন্তু অন্যটিতে তো আলী নেই।
যেদিন মোহাম্মদ কুতুব হালওয়ান থেকে রাতের বেলা আমার বাড়ীতে যায় এবং আলাপ আলোচনার পর তুমি তাঁকে স্বর্ণালংকারসহ পাঁচশো জিনিহ্ দিয়ে বলেছিলে, পাঁচশো জিনিহ্ মা’কে অর্থাৎ হুজায়বী সাহেবের স্ত্রীকে দেবেন আর এসব স্বর্ণালঙ্কার বন্দী ইখওয়ানদের পরিবার পরিজনের ব্যয় নির্বাহের জন্যে চাঁদা হিসেবে গ্রহণ করুন এবং যথা সময়ে মা’য়ের কাছে হস্তান্তর করবেন।
আমি বললাম-
: হ্যাঁ, এই ঘটনা ঠিকই। কিন্তু তাতে এমন দুশ্চিন্তার কি থাকতে পারে? আমি আমার অলঙ্কার যাকে মর্জি দিতে পারি। আমি তা এক মানব সেবামূলক কাজে দান করেছি, তাতো সুখের বিষয়। অবশ্য টাকাগুলো ছিল ইখওয়ানের। এ টাকা দায়িত্বশীল ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়া আমার কর্তব্য ছিল। শামস্ জিজ্ঞেস করলো-
: পাঁচশো জিনিহ্ সংগঠনের জন্যে ছিল, নাকি ওসব পরিবারবর্গের জন্যে।
আমি বললাম- শুধু পরিবারবর্গের ব্যয়ের জন্যে।
শামস্ বলল-
: আলী উসমাবীর কথা মতো ওসব টাকা সংগঠনের জন্যে ছিল।
আমি বললাম- আলী উসমাবী মিথ্যুক।
শামস্ বলল- মোহাম্মদ কুতুব বলেছেন পাঁচশো জিনিহ্ কি উদ্দেশ্যে দেয়া হয়েছিল তা তিনি জানেন না। অবশ্য তুমি তা অলঙ্কারের সাথে দিয়ে হুজায়বী সাহেবের স্ত্রীকে পৌঁছাতে বলেছে।
আমি বললাম-
: মোহাম্মদ কুতুবকে আমার সামনে আন। …… আমি তাঁকে বলেছিলাম যে, পাঁচশো জিনিহ্ পরিবারবর্গের সাহায্যার্থে দেয়া হয়েছে।
শামস্ বলল-
: আচ্ছা ঠিক আছে? কিন্তু তা কোত্থেকে এসেছে?
আমি বললাম-
: আলী উসমাবী একদিন আমার কাছে এক সউদী-ভাইয়ের জন্য মুর্শেদ অথবা মামুনের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সুপারিশপত্র নিতে আসে। আমি তাকে বললাম যে, ভাই মামুনের সাথে দেখা করার জন্যে কোন সুপারিশপত্র বা মাধ্যমের দরকার নেই। আর মুর্শেদ আলেকজান্দ্রিয়ায় রয়েছেন। অবশ্য মামুন এখানেই আছেন এবং তার সাথে দেখা করা যেতে পারে। পরে আলী উসমাবী আমাকে জানায় যে, সউদী ভাই মামুনের সাথে সাক্ষাৎ করে চাঁদা হিসাবে কিছু টাকা দেন। মামুন তাঁকে চাঁদার সেই টাকা জয়নব আল-গাজালীকে দেয়ার অনুরোধ করেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সউদী ভাই আলী উসমাবীর কথা মোতাবেক আমার কাছে সেই চাঁদার টাকা পৌঁছানোর জন্যে তাকে দায়িত্ব দেন। তিনি এটাও বলে দেন যে, এ টাকা বন্দী ইখওয়ানদের পরিবারবর্গের সাহায্য বাবদ ব্যয় করা হবে।
শামস্ বলল-
: মোহাম্মদ কুতুবের কথা মোতাবেক সে টাকা পরিবারবর্গের জন্য ছিলনা।
অধ্যাপক মোহাম্মদ কুতুবকে আমার সামনে হাজির করা হলে তখন আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললাম-
: মায়ের কাছে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে আপনার কাছে অলঙ্কার ও টাকা হস্তান্তর করার সময় আমি আপনাকে বলেছিলাম যে, এ টাকা পরিবারবর্গের জন্যে আমার কাছে গচ্ছিত ছিল……। সম্ভবত আপনি সেকথা ভুলে গেছেন।
আমার কথার পর জনাব মোহাম্মাদ কুতুব বললেন-
: জয়নব, আমাকে সেকথা বলেছেন বলে যদি নিশ্চিত থাকেন-
তাহলে জয়নবের কথাই সত্য।
এরপর ওরা আমাকে দেয়ালের দিকে মুখ করে ভোর পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করে। এরপর আমাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।
দু’দিন পরে আবার শামস্ এর অফিসে নিয়ে গিয়ে কোন ভূমিকা ছাড়াই বলা হয়-
: জয়নব, মোহাম্মদ কুতুব যে সংগঠন কায়েম করেছেন, সে কথা স্বীকার কর।
আমি বললাম-
: এ ব্যাপারে আগেও প্রশ্ন করা হয়েছে এবং আমি জানিয়েছিলাম যে, মোহাম্মাদ কুতুব কোন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেননি।
একথা শুনে শামস্ আমাকে লটকিয়ে চাবুক মারার জন্যে সাফওয়াতকে আদেশ দেয়। এরপর কাছাকাছি আরেক অফিসে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে এক অপরিচিত ব্যক্তি আমাকে বলল-
: জয়নব, তুমি একটা আস্ত বোকা। তুমি নিজের প্রাণ বাঁচাতে জাননা। ইখওয়ানরা তোমার বিরুদ্ধে অনেক মিথ্যে অপবাদ দিয়েছে……। তাহলে তুমি মোহাম্মাদ কুতুব সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করবে না কেন? জান, তোমার একটু সহযোগিতায় সমঝোতার পথ কত সহজ হয়ে যাবে।
আমি বিদ্রূপাত্মক প্রশ্ন করলাম-
: সমঝোতা করবো তোমাদের সাথে? আমিতো তোমাদের চাল-চলন ব্যবহার এবং শঠতাকে মনে প্রাণে ঘৃণা করি। তোমরা সবাই শয়তানের সহচর। কিন্তু তোমরা কোন দিন আমাদের চলার পথে টিকতে পারবে না। আমরা আল্লাহ্র গোলাম ও মুজাহিদ। তোমরা যতই অপচেষ্টা করো না কেন, আমাদের কোন ভাইকে বিভ্রান্ত করে অথবা অত্যাচার করে মিথ্যে বলাতে পারবে না। এটা তোমাদের জানা থাকা চাই।
সে কর্কশ কণ্ঠে বলল-
: আমরা আবার তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি দেবো এবং তোমাদের ব্যাপারে আবার বিচার-বিভাগীয় তদন্ত করাবো।
আমি বললাম-
: আইন মন্ত্রনালয় বিচার-বিভাগ এবং তোমরা সবাই একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তোমরা আল্লাহ্র পথ থেকে দূরে সরে গিয়েছ। তোমরা প্রত্যেকেই বিভ্রান্তির আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছ, তোমরা আল্লাহ্র গজবের শিকারে পরিণত হবে।
এ সময় হামজা এসে একটি লিখিত কাগজ সামনে রেখে চলে যায়। এবার এ ব্যক্তি আমাকে মোহাম্মদ কুতুব সম্পর্কে বলতে শুরু করলো। একটু পরে সেও কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।
এরপর সাফওয়াত এসে আমাকে বেদম প্রহার করে চলে যায়। তারপর আর এক ব্যক্তি এসে আমাকে এক বিশেষ সংগঠন সম্পর্কে তথ্য সরবরাহের বিনিময়ে অনেক পুরস্কার লোভ দেখাতে থাকে। কিন্তু কোনক্রমেই যখন আমার মতের রদবদল করা গেল না তখন আমাকে কুকুরের সে’লে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়। এবার কিন্তু কুকুরের সাথে অন্য একটি লোকও ছিল। হামজা সেই লোকটিকে বলে গেল যে, কুকুর যদি তাকে না কামড়ায় তাহলে তুমিই তাকে কামড়াবে। দু’ঘন্টা পর্যন্ত সে’ল বন্ধ করে রাখা হলো। এ সময় আমি শুধু আল্লাহ্র স্মরণে ব্যস্ত থাকলাম। দু’ঘন্টা পরে দরজা খোলা পর্যন্ত কুকুর এবং সেই ব্যক্তি শান্ত সুবোধ শিশুর মতো চুপ করে বসে রইল।
এরপর আমাকে হাসপাতালে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। পরের দিন রিয়াজের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সে আমাকে করওয়াসাহ্র কোন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করেছি কিনা জানতে চাইলো। আমি তাকে বললাম-
: করওয়াসাহ্ সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা।
রিয়াজ জিজ্ঞেস করলো-
: তোমার সাথে ওখানকার কোন ব্যক্তি কি কোন সময় দেখা করেনি? জয়নব, তোমার কি স্মরণ নেই যে আবদুল হামীদ করওয়াসাহরই লোক। এরপর সে এক ধমক দিয়ে বলে গেল-
: তোমাকে শায়েস্তা করার জন্যে আমি পাশার কাছে থেকে লোক পাঠাচ্ছি। এর পরমুহূর্তেই এক সিপাহী এসে আমাকে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে চাবুক লাগাতে লাগলো। দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত অত্যাচার চালিয়ে আমাকে আবার হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বিচার-বিভাগীয় তদন্তের পরই এসব অত্যাচার করা হচ্ছে।
কয়েকদিন পরে আমাকে আবার রিয়াজের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। এবার সেখানে আরো কয়েকজন মহিলাও উপস্থিত ছিলেন। এদেরকে আমি আগে কোনদিনই দেখিনি।
আমাকে জিজ্ঞেস করল- এদের মধ্যে সিসীর স্ত্রী কে?
জবাবে বললাম- আমি তো জানি না।
এসময় সিপাহী, একজন তরুণকে নিয়ে উপস্থিত হলো। তরুণ ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করা হল, এদের মধ্যে জয়নব আল-গাজালী কে?
ছেলেটি চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে বলল- আমি জানি না।
এরপর তাকে আব্বাস সিসী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে এতেও অজ্ঞতা প্রকাশ করে। এরপর তাকে জিজ্ঞেস করা হয়-
: এখানে উপস্থিত মহিলাদের মধ্যে তুমি কার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলে? ছেলেটি এবারও নেতিবাচক জবাব দিলে তাকে চাবুক লাগিয়ে বের করে দেয়া হয়।
এসময় হটাৎ বোন হামীদা কুতুবকে আসতে দেখা গেল। তাঁর পিছনে সাফওয়াত আসছিল। বোন হামীদা কুতুবকে সিসীর স্ত্রী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনিও বলেন, আমি তাঁকে জানিনা।
এরপর বোন হামীদা কুতুবসহ সব মহিলাকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু আমাকে রিয়াজের সামনে বসিয়ে রাখা হয়। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো-
: এক ইখওয়ানি নাকি চার বিয়ে করেছে। সে সম্পর্কে তুমি কিছু জানকি?
আমি বললাম- না।
সে গর্জে উঠে বলল-
তাহলে আমি কি মিথ্যে বলছি? সে ব্যক্তি কে, তা যদি তুমি না বল তাহলে পিটানো হবে।
আমি ঘৃণা প্রকাশ করে বললাম- যা মর্জি তাই কর।
সে আমাকে দেয়ালের দিকে ফিরিয়ে বেশ কয়েক ঘা চাবুক লাগিয়ে চলে গেল। দু’ঘন্টা পরে সে সাফওয়াতের সাথে ফিরে এসে আমাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।
গোশতের কীমার প্যাকেট
আমার দ্রুত অবনতশীল স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ্য করে ডাক্তাররা বলেন যে বাড়ী থেকে আমার জন্যে উত্তম খাবার সরবরাহের অনুমতি না দিলে আমার জীবননাশের আশংকা রয়েছে। সুতরাং ডাক্তারী পরামর্শ মোতাবেক আমার জন্যে বাড়ী থেকে খাবার আনানোর অনুমতি দেয়া হয়। অবশ্য এ অনুমতি দুধ এবং ফল পর্যন্তই সীমিত রাখা হয়। একদিন আমার বোন আমার কাছে গোশত পৌঁছানোর চমৎকার বুদ্ধি করে। সে দুধের খালি প্যাকেট এমনভাবে গোশতের কীমা ভরে দেয় যে, বাইরে থেকে বোঝা মুশকিল। একেবারে দুধের প্যাকেটের মতোই তা ছিল মোলায়েম। কেবল আমার কাছেই তা ধরা পড়ে। এর সাথে কিছু মাখন এবং কমলালেবু ও পাঠানো হয়। আমি আমার অংশ রেখে অবশিষ্ট খাবার আবদুল মাবুদের মাধ্যমে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অন্যান্য ইখওয়ান ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দেই। আমাদের সাথে তখন স্থানীয় প্রশাসন বিষয়ক সাবেক মন্ত্রী অধ্যাপক আবদুল আজীজও ছিলেন। আমরা প্রত্যেকে একটি করে কমলালেবু এবং প্রতি দু’জনে মিলে এক প্যাকেট মাখন পরস্পরের মধ্যে বণ্টন করে নেই।
খাবার বণ্টন শেষ হলে আমি আবদুল মাবুদকে ডেকে দুধের থলে দিয়ে তা সব ইখওয়ানদের মধ্যে বণ্টন করতে বলি। সে বাইরে গিয়ে আবার ফিরে এসে বলল।
: আরে, এতে তো দেখছি গোশতের কীমা রয়েছে। এটা আপনার জন্যে খুবই উপকারী হবে। নিজের কাছে রেখে দিন।
কিন্তু আমি তাকে তা বণ্টন করে দিতে বলি। সবাইকে বণ্টন করার পরও প্যাকেটে কিছুটা কীমা থেকে যায়। আমি এসব কীমা এবং কিছু মাখন অধ্যাপক আবদুল আজীজের কাছে পাঠিয়ে দেই।
আবদুল মাবুদ জিজ্ঞেস করলো- আপনার জন্যে রাখলেন না যে?
আমি বললাম-
: আল্লাহ্র অশেষ শোকর। তিনিই তাঁর বান্দাদের রিজিক দান করেন।
সে বলল- সব প্রশংসা আল্লাহ্রই। তিনিই পালনকর্তা, তিনিই রিজিক দাতা।
ওয়ার্ড এ্যাসিস্টেন্ট এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো-
:ভেতরে খাবার এলো কেমন করে?
আমি বললাম- ডাক্তারের অনুমতিতে।
ইখওয়ানের ভাইয়েরা অল্প-সল্প উত্তম খাদ্যদ্রব্য একত্রিত করে অপেক্ষাকৃত অসুস্থ ভাইদের জন্যে রেখে দিতেন। এই জন্যে জেলের বাইরে থেকে কিছু এলে আমরা খুব আনন্দিত হতাম। তা’ সে জিনিষ যতই কম হোক না কেন! জালিম অত্যাচারীদের অধীনে থেকেও আমরা পরস্পর পরস্পরের কল্যাণের দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতাম।
হাসপাতালে অভুক্ত
কারাগারে প্রথম এক বছর আমাকে বাড়ী বা বাইরের খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। একেবারে শেষ দিকে অনন্যোপায় হয়ে আমাকে বাড়ী থেকে খাবার আনানোর অনুমতি দেয়। তাও এজন্যে যে, তাদের মিথ্যে ভিত্তিহীন অভিযোগের আলোকে আদালতে আমাকে যেন সম্ভাব্য ফাঁসির দণ্ড দিতে পারে। এ উদ্দেশ্যে অন্তত ফাঁসির আদেশ পর্যন্ত আমাকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে বাড়ী থেকে উত্তম খাদ্যদ্রব্য আনিয়ে খাবার অনুমতি দেয়।
আদালতে মামলা শুরু হবার কয়েকদিন আগে আমার মা এবং বোন আমার সাথে কারাগারে দেখা করতে এসে কথা প্রসঙ্গে জানান যে, সাফওয়াত আমার নাম ভাঙ্গিয়ে তাদের কাছ থেকে ঔষুধপত্র, ফলমূল, কাপড় ইত্যাদি কেনার বাহানায় মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ ছাড়া আরো নানাভাবে আমার পরিবার ও আত্মীয়দের উপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে স্বার্থ পূর্ণ করা হয়।
ওরা কোন কোন কয়েদীকে শুরু থেকেই বাইর থেকে খাবার আনার অনুমতি দিয়ে রাখে কিন্তু ইখওয়ানদের বেলায় এ ধরনের কোন অনুমতি দেয়া হয়নি। বরং কোন না কোনভাবে ইখওয়ানদের কষ্ট দেয়া বা মেরে ফেলাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এজন্যে তারা এমনকি হাসপাতালেও ইখওয়ানদেরকে তাদের ন্যায্য খাবার থেকে বঞ্চিত রাখতো। বস্তুত এ সব কিছুই ছিল তাদের ইসলাম বিদ্বেষী, হীন-মানসিকতারই বাহ্যরুপ।
একদিন এক যুবক ইখওয়ানকে ভীষণভাবে আহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। ওর চিকিৎসার জন্যেই সুগারের প্রয়োজন দেখা দেয়। ডাক্তার সুগার বা ঐ জাতীয় কোন দ্রব্য খুঁজে আনার জন্যে লোক পাঠান। কিন্তু কোথাও তা পাওয়া গেল না। আমি ব্যাপারটা জানতে পেরে ওয়ার্ডের দরজায় করাঘাত করি। দরজা খোলা হলে আমার জন্যে বাড়ী থেকে পাঠানো মধুর বোতলটি ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দেই। এতে করে শিগগীরই ইখওয়ান ভাইটির চিকিৎসা হয়। হাসপাতালে মোতায়েন সরকারী চররা এসব লক্ষ্য করে। আইন মোতাবেক আমি নাকি নিষিদ্ধ কাজ করেছি।
এর জন্যে কয়েকদিন পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কয়েদীদের জন্যে পানি বন্ধ করে দেয়া হয়। অমানবিক আচরণের এটা একটা ঘৃণ্য উদাহরণ। প্রচণ্ড গরমের মৌসুমে প্রত্যেক রাত এক ফোঁটা পানি থেকে আমাদের বঞ্চিত করে রাখা হয়। সারাদিন কোনোভাবে এক পেয়ালা পানি যোগাড় করা ছিল বাঘের দুধ সংগ্রহ করার মতো দুঃসাধ্য ব্যাপার।
আমি এমনিতেই ভীষণ অসুস্থ ছিলাম। স্বাস্থ্য দিন দিন অবনতির শেষ সীমার দিকে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত শুধু আমার জন্যে পানি বরাদ্দ করা হয়। আমি আমার পানি ভাগ করে পাশের কক্ষের ভাই আবদুল করীমের কাছে পাঠাতাম। কিন্তু পাশের কক্ষে পানি পৌঁছানো ছিল ভীষণ কষ্টকর। প্রহরীদের ফাঁকি দেওয়ার কোন উপায় ছিল না। অগত্যা দেয়ালের একটি অতি শীর্ণ ছিদ্র পথে আমি এপার থেকে গড়িয়ে দিতাম আর ওপারে দেয়ালের ছিদ্র পথে মুখ লাগিয়ে ভাইটি তাঁর পিপাসা নিবারনের চেষ্টা করতেন। হান্টারের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত শরীর আর মন টিকিয়ে রাখার জন্য সেই কয়েক বিন্দু পানি তাঁর জন্যে নবজীবনের সমতুল্য ছিল। সরকারের পোষা জল্লাদরা এসব নিরপরাধ লোকদের উপর সব রকমের জঘণ্য শাস্তিরই অনুশীলন করতো। মানবতাবোধের মতো কোন অনুভূতির সাথে তারা আদৌ পরিচিত ছিলনা। এমনকি তাদের নিষ্ঠুরতা পশুত্বের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল বললে ভুল হবে না।
অত্যাচারীর অনুতাপ ও সত্য পথে প্রত্যাবর্তন
আমি হাসপাতালে থাকতেই একটি ঘটনা ঘটে। এতে আমার কাছে মানুষের সুপ্ত সৎ গুণাবলী প্রকাশিত হয়ে পড়ে। আমার এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সত্যিকার অর্থে যদি আন্তরিকতার সাথে কোন ব্যক্তিকে সৎ কথা বোঝানো হয় তাহলে, সে যতই মন্দলোক হোক না কেন- একদিন না একদিন সৎশিক্ষা গ্রহণ করবেই। প্রয়োজনে শুধু আন্তরিক প্রচেষ্টার। চেষ্টা করলে জাতি আবার তার আসল মঞ্জিলের পথে পূর্ণ শক্তির সাথে এগিয়ে চলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে।
আমাদের তত্ত্বাবধানে জন্যে সামরিক হাসপাতালে সালাহ্ নামক এক সামরিক সহকারী ছিল। সে রোগীদের ইঞ্জেকশন দেয়া এবং কয়েদীদের গতিবিধির প্রতি লক্ষ্য রাখার দায়িত্বও পালন করতো। একদিন আমি স্নানাগারে যাবার পথে দেখলাম সাইয়েদ কুতুবের কক্ষের দরজা হিসাবে ব্যবহৃত পর্দা বেশ উঁচু হয়ে বাতাসে উড়ছে। ঠিক সেই সময়েই আমি ওখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। ব্যাস, তা দেখে হৈ-চৈ করে এক এলাহী কাণ্ড জুড়ে দিল। সে বলল-
: জয়নব আল-গাজালী পর্দা হটিয়ে ভিতরে বসা সাইয়েদ কুতুবকে দেখার দুঃসাহস কিভাবে করলো? সালাহ্ অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ শুরু করে দিল। লম্ফ ঝম্ফ করে সে এক অবস্থা আর কি! ঠিক সেই মুহূর্তে ওখানে সাফওয়াত পৌঁছায় সালাহ্র হাঁকডাক এবং গালাগালি আরও বেড়ে গেল। সে এসব করে তার উপরওয়ালাদের কাছে এটাই প্রমাণ করতে চাচ্ছে যে সে কতো যোগ্যতা এবং সতর্কতার সাথে তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। সে যে হাসপাতালে আহত-অসুস্থ বন্দীদের নিজের প্রশাসনিক শক্তির গুণে একেবারে কাবু করে রেখেছে, তার প্রামাণ্য তথ্য সে একে একে বলে যেতে লাগলো।
আসলে সালাহ্ ছিল জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক, ধর্ম শিক্ষা ইত্যাদি সব সদ্গুণ থেকে বঞ্চিত বন্যজন্তুর মতো পাশবিক স্বভাবের লোক। তার কদর্য কথাবার্তা এবং হৈ-চৈ শুনে অধ্যাপক সাইয়েদ কুতুব তাকে কাছে ডেকে খুব স্নেহের সাথে বুঝালেন-
: ভাইটি আমার! পর্দাতো বাতাসেই উড়ছিল। এতে ওর অপরাধ হবে কেন? তারতো কোন দোষ নেই। এভাবে তিনি তাকে আরো অনেক কথা বুঝালেন। আশ্চার্য! এই বন্যপশুর মতো জঘণ্য লোকটি সাইয়েদ কুতুবের কথায় মোহিত হয়ে একেবারে গলে গেল যেন। সে চুপচাপ লজ্জাবনত দৃষ্টিতে মাটির দিকে চেয়ে রইল।
কয়েকদিন পর সে আমার কাছে এসে তার পূর্ব ভুলের জন্যে লজ্জা প্রকাশ করে বলল-
: আমি আবার নতুন করে মুসলমান হতে চাই। আমি ইসলামকে জানতে চাই বলুন, আমি কিভাবে একজন সত্যিকার মুসলমানে পরিণত হতে পারি।
আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
: ইখওয়ানদের সাথে যে জোর-জুলুম অত্যাচার ও দুর্ব্যবহারের দৃশ্য দেখতে পাচ্ছ, তা-কি তুমি সহ্য করতে পারবে?
সে বলল-
: আমিও যদি তাদের মতো যথার্থ মুসলমান হতে পারি তাহলে আল্লাহ্ আমাকেও ধৈর্য ও শক্তি দান করবেন।
আমি আবেগ জড়িত কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম-
: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)।
সে বেশ কয়েকবার অত্যন্ত ধীর অথচ বলিষ্ঠ উচ্চারণে কালেমা তাইয়্যেবা পড়লো।
এরপর আমি বললাম-
: ঠিক আছে, আল্লাহ্ যা করতে হুকুম করেছেন, তা করতে থাকো। আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন বাতিল শক্তির সামনে মাথা নত করো না।
সে বলল-
: আমি সেই সত্যিকারের ইসলামী শিক্ষা শিখতে চাই, যা আপনাদের চরিত্রকে এত উন্নত এবং আপনাকে ঈমানকে এত মজবুত করেছে যে, নিষ্ঠুরতম অত্যাচারের সামনেও আপনাদের নীতির এতটুকু পরিবর্তন হয়নি এবং হাসিমুখে সব জুলুম-নির্যাতন সয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ কোন মানুষের পক্ষে এ ধরনের অত্যাচারের শতকরা একভাগ সহ্য করাও সম্ভব নয়। বলুন, কিভাবে আমি সত্যিকারের ইসলামী শিক্ষা অর্জন করতে পারি।
আমি তাকে বললাম-
: তুমি যখন ইঞ্জেকশন এবং ঔষধ দেয়ার জন্যে সাইয়েদ কুতুবের কাছে যাও তখন এ প্রশ্ন করো। তিনি তোমাকে উত্তমভাবে ইসলামী শিক্ষার সন্ধান দেবেন।
আমি তার মাধ্যমে সাইয়েদ কুতুবের কাছে সালাম পাঠাই।
ফয়সালা নিকটবর্তী
বেশ কয়েকদিন পরে আদালতে মামলা শুরু হবার আগে আনুষ্ঠানিক ভাবে আমার কাছে অভিযোগ পত্র আসে।
এ এক আজব মামলা। বিচার বিভাগের এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ভূমিকার নজীর ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া মুশকিল……। এটাকে বিরাট ট্রাজেডী বলা যেতে পারে। আমরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছি যে, আদালতের চূড়ান্ত রায় শামস্ বাদরানে টেবিলের দেরাজে পড়ে রয়েছে। আর ওদিক মামলার প্রহসন মঞ্চস্থ করার আয়োজন চলছে। সরকারী ফরমান মোতাবেক আমাদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার এবং কৌশুলীদের সাথে সাক্ষাৎ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। আমি প্রসিদ্ধ আইনজীবী জনাব আহমদ খাজাকে Mondater নিযুক্ত করতে চাইলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, তিনি এই মামলায় অংশ নিতে পারবেন না। এরপর আমি বললাম, আমার কোন কৌশুলীর দরকার নেই। আমি নিজেই নিজের মামলা পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করি।
জনসাধারণ আমার অজান্তেই আমার পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্যে একজন খ্রিষ্টান অ্যাডভোকেট নিযুক্ত করে। মামলা শুরু হবার পূর্বক্ষণে আমার সাথে সাক্ষাতের জন্যে আমার নিকটাত্মীয়দের অনুমতি দেয়া হয়। আমার মা এবং বোন আমাকে দেখতে আসেন। আমার দুরবস্থা এবং শারীরিক দুর্বলতা দেখা তাঁরা প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আমি তাঁদের সাথে বসে শান্তনা ও উৎসাহ দিলাম। আমাদের সাক্ষাতের সময় সাফওয়াত ও হামজা পাশেই দাঁড়িয়ে তাদের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করছিল। আমি আমার মা ও বোনের মাধ্যমে প্রত্যেকের কাছে অনুরোধ করে পাঠাই যে, কেউ যেন আমার জন্যে কৌশুলী নিযুক্ত না করেন। কিন্তু তারা আমাকে জানান যে,এক হাজার জিনিহ্র বিনিময়ে হুসাঈন আবু জায়দকে ইতিমধ্যেই আমার পক্ষের কৌশুলী নিযুক্ত করা হয়েছে এবং তাঁকে মামলা শুরু হবার আগেই অর্ধেক টাকা অগ্রীম দিয়ে দেয়া হয়েছে। তা আসলে আমি তাদেরকে এ ব্যাপারে ওখানে শেষ করতে বললাম। কিন্তু মামলা শুরুর প্রথম দিনই দেখলাম যে হুসাঈন আবু জায়েদকে আমার পক্ষে মামলায় লড়তে এসেছেন।
ওদিকে মামলা শুরু হবার আগের দিন আমাকে শামস্ বাদরানের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। শামস্ আমাকে ডেকে বললেন-
: আশা করি তুমি তদন্তকালীন লিখিত বিবৃতির ব্যাখ্যা সম্পর্কে কোন আপত্তি করবে না এবং লিখিত সব কথারই সত্যতা স্বীকার করবে। তুমি যদি আদালতে একথা প্রকাশ কর যে, ইখওয়ান তোমাকে বিভ্রান্ত করেছিল এবং সেজন্যে তুমি লজ্জিত, তাহলে অতি সহজেই মামলার নিস্পত্তি হয়ে যাবে এবং আমরাও তোমার যথাযোগ্য সেবা ও সম্মান করবো।
আমি বললাম-
: আল্লাহ্ যা পছন্দ করেন তাই করেন। কোন ব্যক্তি তার আপন সমস্যা সমাধানে সক্ষম নয়।
শামস্ বলল-
: বাপু! তুমি সহজ আরবী ভাষায় কথা বল। আমি তোমার ওসব কথা বুঝি না। তবে মনে হচ্ছে তোমার উদ্দেশ্য আমাদের পক্ষে নয়। অথচ আমরা তোমার সেবা ও সম্মান দিতে চাচ্ছি।
আমি বললাম-
: অজানা অদৃশ্য রহস্যের চাবিকাঠি সব আল্লাহ্র হাতে। এই বিশাল আকাশ-মাটি, জলে-স্থলে, কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে; তিনি ছাড়া আর কেউই জানেনা। তিনিই সবকিছু জানেন, শুনেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন। এই যে পাতাটি ঝরে পড়লো তার খবরও তিনি রাখেন আর মাটির নীচে গভীর অন্ধকারে যে বীজটি অঙ্কুরিত হয়ে যাচ্ছে, তাও তিনিই শুধু দেখেন-জানেন। বস্তুতঃ অণু থেকে আসমান পর্যন্ত সব কিছুই তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন পরিচালিত হচ্ছে।
শামস্ হা করে তাকিয়ে সব শুনে হামজাকে ডেকে বলল-
: একে নিয়ে যাও হামজা। ও নিজের স্বার্থ সম্পর্কে চিন্তা করা না করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীন।
হামজা বলল-
: ওকে আমার কাছে ছেড়ে দিন জনাব, আমি তার সাথে আলাপ করে দেখছি।
আমাকে শামস্ বাদরানের অফিস থেকে বের করে অন্য এক কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। হামজা আমাকে আদালতে ইখওয়ান-বিরোধী ভূমিকা পালনের জন্যে বোঝাতে লাগলো। এ পর্যন্ত ওদের মুখ থেকে যেসব কথা শুনতে শুনতে আমার বিরক্তি ও বিতৃষ্ণা এসে গেছে, সে সব বস্তাপচা কথাই আউড়িয়ে যেতে থাকলো। সে বলল-
: প্রথমতঃ তোমার কাছ থেকে বাজেয়াপ্তকৃত সব টাকা তোমাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। আর আদালতে ইখওয়ানকে যদি ধোকা দেয়া হয় তাহলে তা প্রেসিডেন্ট নাসেরের প্রতি তোমার বিরাট উপহার বলে গণ্য হবে।
সে আমাকে শামস্- এর কাছে নিয়ে গিয়ে হুকুম ও ইচ্ছে মোতাবেক কাজ করার উপদেশ দিতে লাগলো। আমি তার সব কথা নির্লিপ্তভাবে শুনলাম, হ্যাঁ-না কোন শব্দই উচ্চারণ করলাম না। অবশেষে সে যখন আমাকে ফাঁসীর দণ্ড থেকে বাঁচাবে বলে কথাটা একাধিকবার বলল-
তখন আমি তার দিকে অনুকম্পার দৃষ্টিতে চেয়ে বললাম-
: আহম্মক কোথাকার! তোমার যদি মলত্যাগ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়, তা বের করার সামান্য শক্তিও তোমার নেই, আর তুমি এসেছ কিনা আমাকে ফাঁসী থেকে বাঁচাতে।
সে আমাকে কক্ষে পৌঁছিয়ে দিয়ে আদালতে মিথ্যে মামলা দায়েরের ব্যবস্থা পাকাপাকি করতে চলে গেল।
আশ্চার্য! সরকার আর আদালত সবই ছিল তাদের হাতের মুঠোয়। এরপরও তারা আমাকে এতো ভয় করছিলো কেন? তারা চাচ্ছিল আমি যেন আদালতে কথা না বলি, তাদের পেশ কৃত বক্তব্য অস্বীকার না করি এবং তাদের দুঃশাসনে অক্টোপাশে আবদ্ধ জাতির সামনে সত্য তুলে না ধরি!
তারা আদালতে যে মামলা পেশ করে তা এক হাস্যকর অথচ ট্রাজেডিপূর্ণ নাটকীয়তার পরিচয় বহন করছিল। তারা এটা বোঝাবার প্রয়াস পাচ্ছিল যে, দেখ ওরা যে নাসেরকে খুন করতে চেয়েছিল, সেকথা তারা নিজ থেকে স্বীকার করেছে এবং প্রত্যেক স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের বিরুদ্ধে নিজের সাক্ষ্য দিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্র রহমতে তাদের সব চক্রান্ত এবং দুরভিসন্ধি ব্যর্থ হয়ে যায়। আদালতে রায় তাদের চক্রান্তকে ধূলিসাৎ করে দেয়। অথচ আদালতকে প্রভাবিত করার জন্যে তারা সব আয়োজনই পূর্ণ করেছিল। এমনকি কর্ণেল ওজুমীর মতো লোকেরা এসে আদালতের ডায়াসে বসে থাকতো। কিন্তু সত্যের জয় যে অবশ্যম্ভাবী তা প্রমাণিত হয়ে গেল।
সুখবর
: এমন অবস্থায় একদিন আমি স্বপ্নে দেখি যে, দিগন্ত বিস্তৃত, এক মাঠে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে মনে হচ্ছিল এটাই আদালত এবং এখানেই আমাদের বিচার হবে। সারা আকাশ যেন মাটির উপর সামিয়ানা হয়ে ছায়া দিচ্ছিল। আর আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত মনোরম এক আলোক রেখা ছড়িয়ে আছে। আমি দেখলাম, প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) কেবলামুখী হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এবং আমি তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে তাঁর কথা শুনছিলাম। তিনি বলছিলেনঃ “ সত্যের আওয়াজ মনোযোগ দিয়ে শোন!” আমি এমন এক অপূর্ব আওয়াজ শুনলাম, যা মনে হচ্ছিল আসমান-যমীনের সবদিক থেকে একই ভাবে ভেসে আসছিল।ভেসে আসা এই কথাগুলি ছিলঃ “ এখানে মিথ্যে আদালত কায়েম হবে এবং তা বাতিলের পক্ষে সিদ্ধান্ত দেবে। কিন্তু তোমরা বিশ্বাসী এবং সত্য পথের দিশারী……। তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং ধৈর্যের শিক্ষা দাও, পরস্পর যোগাযোগ রাখ এবং আল্লাহ্কে ভয় কর। তোমাদের কল্যাণ হবে”। এসব কথা অতি সুন্দরভাবে আকাশ-মাটি ছেদ করে যেন বেরিয়ে আসছিল। এর প্রভাবে এক গভীর উপলব্ধি এবং হৃদয়-মনে এক অবর্ণনীয় আনন্দে আপ্লূত হয়ে পড়েছিলাম বলে সব কথা আমার স্মরণ নেই। এই অস্বাভাবিক আওয়াজ শেষ হলে প্রিয়নবী আমার দিকে লক্ষ্য করে ডানদিকে দেখতে ইঙ্গিত করলেন। দেখলাম, আকাশ-ছোঁয়া এক পর্বত চুড়া। তার সজীব-সুন্দর শ্যামলিমা ছিল অত্যন্ত মনোলোভা তাতে সবুজ গালিচা পেতে দেয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছিল।
প্রিয়নবী আমাকে বললেন-
: “ জয়নব, তুমি এই পর্বত চূড়ায় উঠে পড়। চূড়ায় হাসান হুজায়বীকে দেখতে পাবে। তার কাছে এসব কথা পৌঁছিয়ে দাও”। এরপর প্রিয়নবী গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি আমার সকল অস্তিত্বে অপূর্ব এক শক্তি অনুভব করলাম। যদিও প্রিয়নবী কোন শব্দ উচ্চারণ করেননি, কিন্তু আমার মনে হলো আমি তাঁর সব কথা বুঝে নিয়েছি এবং এর উদ্দেশ্যও বুঝতে পেরেছি। প্রিয়নবী পর্বত চূড়ার দিকে হাত উঠালে- আমি নিজেকে পর্বত আরোহণ করছি বলে অনুভব করলাম। পর্বতারোহণ কালে খালেদা ও আলীয়া হুজায়বীর সাথে দেখা হলো। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম-
: আপনারাও কি আমার সহযাত্রী?
তাঁরা ইতিবাচক জবাব দিলেন। আমি তাদের ছেড়ে সামনে এগিয়ে চললাম। কিছুদূরে গিয়ে উমাইয়াহ্ ও হামীদা কুতুব এবং নাজমা ঈসার সাথে দেখা হলো। আমি তাদের জিজ্ঞেস করলাম-
: আপনারাও কি আমার সাথে চলছেন?
তাঁরা জবাব দিলেন- হ্যাঁ।
আমি আরো এগিয়ে চললাম। অবশেষে চূড়ায় গিয়ে পৌঁছলাম। চূড়ায় গিয়ে দেখি, গালিচা মোড়া ছোট সমতল মালভূমি।একপাশে চমৎকার করে আসন পাতা রয়েছে ওখানে জনাব হুজায়বী বসে আছেন। আমাকে দেখে তিনি দাঁড়িয়ে সালাম জানালেন। আমার উপস্থিতিতে তিনি অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করলেন। আমি তাঁর কুশলাদী জেনে বললাম-
: আমি প্রিয়নবীর কাছে থেকে কয়েকটি কথা আপনার কাছে পৌঁছিয়ে দেয়ার দায়িত্ব নিয়ে এসেছি।
তিনি বললেন-
: তা ইতিমধ্যেই আমার কাছে পৌঁছে গেছে।
আমরা আল্লাহ্কে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বসে পড়লাম। প্রিয়নবীর কথা শব্দে নয় বরং আধ্যাত্মিকভাবে পৌঁছে গেছে। আমাদের জ্ঞান ও অনুভূতির তাঁর স্পষ্ট ছবি অংকিত হয়ে গেছে।
আমি জনাব হুজায়বীর কাছে বসা অবস্থায় পর্বতের নীচে তাকিয়ে একটি চলন্ত রেলগাড়ীতে দু’জন বিবস্ত্র মহিলা দেখতে পেলাম। আমি জনাব হুজায়বীর দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করলে তিনিও তা দেখেন। আমি দৃশ্য দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হলাম। আমার মর্ম যাতনা আঁচ করে জনাব হুজায়বী বললেন-
: এতে কি তোমার কোন আপত্তি আছে?
আমি বললাম- অবশ্যই আছে।
তিনি বললেন-
: তুমি কি মনে কর যে, আমরা আমাদের হাত পায়ের শক্তিতে এখানে পৌঁছেছি। বরং আমাদের উপর আল্লাহ্র মেহেরবানী হয়েছে। …… তুমি ঐ দু’জন মহিলা সম্পর্কে দুশ্চিন্তা করো না।
আমি বললাম, এদেরকে সৎপথে আনার জন্য আমাদেরকে সংগ্রাম করে যেতে হবে।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন- তা কি তুমি ব্যক্তিগতভাবে করতে পার?
আমি বললাম- আল্লাহ্র সাহায্যে পারবো।
হুজায়বী সাহেব তখন বললেন-
: আল্লাহ্র রহমতের জন্যে আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিৎ। শোকর আদায়ের জন্যে তিনি দু’হাত তুলে মোনাজাত করলেন। আমিও তাঁর সাথে যোগ দিলাম। মোনাজাত কালে আমরা বার বার আলহামদু লিল্লাহ্ শব্দ উচ্চারণ করতে থাকি।
এমন সময় হটাৎ আমার চোখ খুলে যায়। জেগে উঠে অপূর্ব এক অনুভূতিতে সারা মনপ্রাণ ছেয়ে যায়। এরপর আমার মনে আর কোন ভয়ভীতি থাকলো না। অদ্ভুত এক প্রশান্তি আর শক্তি অনুভব করলাম। এই স্বপ্ন আমার শারীরিক ব্যথা-বেদনা এবং মানসিক দুঃখ-দুশ্চিন্তাও দূর করে দিল।
আল্লাহ্ বলেছেন- “ যারা হিযরত করেছে, যাদেরকে তাদের আপন বাসস্থান থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, যারা আমার পথে চলতে গিয়ে দুঃখ দুর্দশা সহ্য করেছে, যারা জিহাদ করেছে এবং শহীদ হয়েছে- আমি তাদের সব পাপ ক্ষমা করে দেবো। আর তাদেরকে এমন বাগানে স্থান দেব, যার নীচ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হচ্ছে। আল্লাহ্র পক্ষ থেকে প্রতিদান হিসেবে উত্তম পুরস্কার দেয়া হবে। তোমরা ওসব লোকের অনুসরণ করো না, যারা আল্লাহ্কে অবিশ্বাস করেছে। হে মুমিনগণ! ধৈর্যধারণ কর, ধৈর্যের শিক্কা দাও, পরস্পর পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রাখ, আল্লাহ্কে ভয় কর। তোমরা কল্যাণ পাবে”।
প্রতিশ্রুত দিবস
মামলার রায় ঘোষণার দিন আমাদের আদালতে পৌঁছানোর জন্যে গাড়ীর অপেক্ষায় অফিসে পাঠানো হয়। আটটার দিকে পুলিশ সামরিক বাহিনীর অফিসার এবং সৈনিক কারাগারের মাঠ ভরে যায়। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল যেন যুদ্ধ করার জন্যে রণাঙ্গনে যাচ্ছে। একটি গাড়ী এলে আমরা তাতে উঠে বসি। অফিসার এবং সিপাহীরা আমাদের গাড়ী ঘিরে দাঁড়ায়। আদালতে পৌঁছতেই আমাদেরকে কাঠগড়ায় পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। আমরা সংখ্যায় ছিলাম ৪৩ জন। ক্রমিক পর্যায়ে তাঁদের নাম হচ্ছে-
১। সাইয়েদ কুতুব
২। মোহাম্মদ ইউসুফ হাওয়াশ
৩। মোহাম্মদ ফাত্তাহ ইসমাইল
৪। আহমদ আবদুল মজিদ আবদুস্ সমী
৫। আহমদ ওরফে ইব্রাহীম আলকাওমী
৬। মাজদী আবদুল আজীজ মুতাওয়াল্লী
৭। আবদুল মজীদ ইউসুফ আবদুল মজীদ আল সাজলী
৮। আব্বাস সাঈদ আস্ সিসী
৯। মোবারক আবদুল আজীম মাহমুদ আয়াদ
১০। ফারুক আহমদ আলী আল মানসাবী
১১। ফায়েজ মোহাম্মদ ইসমাইল ইউসুফ
১২। মামদুহ্ দরবেশ মুস্তাফা আদ দিউবী
১৩। মোহাম্মদ আহমদ আবদুর রহমান
১৪। জালালুদ্দিন বিকরী দিসাবী
১৫। মোহাম্মদ আবদুল মোয়াত্তা ইব্রাহীম আল জাজ্জার
১৬। মোহাম্মদ আল মামুন ইয়াহিয়া জাকারীয়া
১৭। আহমদ আবদুল হালীম আস সীরোজী
১৮। সালাহ্ মোহাম্মদ খলিফা
১৯। সাইয়েদ সাদুদ্দিন আস-সায়েদ শরীফ
২০। মোহাম্মদ আবদুল মোয়াত্তা আবদুর রহীম
২১। ইমাম আবদুল আব্দুল ফাত্তাহ গাইস
২২। কামাল আব্দুল আজীজ আল ইরফী
২৩। ফুয়াদ হাসান আলী মুতাওয়াল্লী
২৪। মোহাম্মদ আহমদ আল বুহাইরী
২৫। মুহাম্মদী হাসান সালেহ্
২৬। মোস্তফা আব্দুল আজীজ আল-খুজায়বী
২৭। আস-সাইয়েদ নজিলি মোহাম্মদ আউলিয়াহ্
২৮। মুরসী মোস্তফা মুরসী
২৯। মোহাম্মদ বদি আব্দুল মজীদ মোহাম্মদ সানী
৩০। মোহাম্মদ আব্দুল মোনয়েম্ শাহীন
৩১। মাহমুদ আহমদ ফখরী
৩২। মোহাম্মদ ইজ্জত ইব্রাহীম
৩৩। সালাহ্ মোহাম্মদ আব্দুল হোক
৩৪। হেলমী মোহাম্মদ সাদেক হাতহুত
৩৫। আলহিসাম ইয়াহিয়া আব্দুল মজীদ বদবী
৩৬। আব্দুল মোনয়েম আব্দুর রউফ ইউসুফ আরাফাত
৩৭। মোহাম্মদ আব্দুল ফাত্তাহ রিজ্ক শরীফ
৩৮। জয়নব আল-গাজালী আল জুবাইলী
৩৯। হামীদা কুতুব ইব্রাহীম
৪০। মহীউদ্দীন হেলাল
৪১। ইসাবী সুলাইমান
৪২। মোস্তফা আল-আলম
৪৩ নম্বর ছিল আলী উসমাবী। কিন্তু সে সংকীর্ণ স্বার্থের মায়ায় পড়ে নিজের ধর্ম ও বিবেক বিক্রি করে রাজসাক্ষী হয়ে যায়। এভাবে সে লজ্জিত ও অপমানিত হয়।
আমরা কাঠগড়ায় পৌঁছলে সুবিচারের শত্রু বিচারপতির গাউন পড়ে এজলাসে এসে বসলেন। তিনি একে একে আমাদের প্রত্যেকের নাম ডেকে তাঁর বিচারের প্রতি আমাদের প্রতি কোন আপত্তি আছে কিনা জানতে চাইলেন। জবাবে তাঁকে জানানো হলো-
: কোন ব্যক্তি বিশেষের প্রতি আমাদের কোন আপত্তি নেই; তবে যে আইনের মাধ্যমে আমাদের বিচার করা হচ্ছে, সে সম্পর্কে আমাদের আপত্তি অবশ্যই আছে। যেসব আইনের অধীনে আমাদের বিচার করা হচ্ছে, তা বাতিল আইন। এর উপর আমাদের কোন আস্থা নেই। আমরা কেবল আল্লাহ্র দেয়া আইনের বিশ্বাসী এবং সেই আল্লাহ্র আইন মোতাবেকই বিচার চাই।
যাহোক, আদালতের আনুষ্ঠানিক জিজ্ঞাসাবাদের পর জানানো হয় যে, আদালত, জয়নব আল-গাজালী এবং হামিদা কুতুব সম্পর্কিত মামালার রায় আলাদাভাবে ঘোষণা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরপর আমাদের কাঠগড়া থেকে বের করে দেয়া হয়। আমরা আদালত কক্ষে আগত আত্মীয়-স্বজনকে দুর থেকে ইঙ্গিতে সালাম জানাই।
আদালতের শুনানী মুলতবী না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে একটি কক্ষে বন্ধ করে রাখা হয়। এরপর গাড়ীতে করে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ হচ্ছে ১৯৬৬ সালের ১০ই এপ্রিলের কথা। সে বছর ১৭ই মে পর্যন্ত আমরা বিচারের নামে প্রহসন শুরু হওয়ার অপেক্ষায় কারাগারের কালো কক্ষে অবস্থান করি।