সপ্তম অধ্যায়
কানাতির জেলে স্থানান্তর
সেই দিনটি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এর আগে ৩রা ও ৪ঠা জুনে আমাদের কক্ষে দরজা কোন রকমের পূর্বাভাস ছাড়াই যখন মর্জি খোলা হচ্ছিল। ওরা এসে আমাদের “কোন জিনিসের প্রয়োজন আছে কিনা” বার বার জিজ্ঞেস করছিল।
এরপর যুদ্ধ, ফিলিস্তিনি ও আরব সমস্যা ইত্যাদি বিশয়ের উপর আলোচনা শুরু করা হতো। আমার অবশ্য চুপ করেই থাকতাম। আলোচনার অংশ গ্রহণকারীদের মধ্যে একজন ডাক্তার ছিলেন। আমি একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম-
: আমরা কি সত্যিই ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে সক্ষম?
আমার প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন-
: কি,…… কি বলতে চাচ্ছেন আপনি?
আমি ধীর কণ্ঠে বললাম-
: বিভিন্ন পরিণাম থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিৎ। আমাদের কর্তারা ইসরাইলের ব্যাপারে শত্রুতা-মিত্রতা সম্পর্কীয় যত বুলিই আওড়ান না কেন; আর তারা যাই আশা করুক না কেন; যতদিন পর্যন্ত বিশ্ব ইহুদীবাদী আন্দোলন দুই বৃহৎ শক্তিকে তাদের কূটনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের স্ব-ঘোষিত বড় কর্তারা বৃহৎ শক্তিবর্গের তাবেদারি করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবেন না…… বস্তুতঃ ফিলিস্তিন তথা অধিকৃত আরব এলাকা পুনরুদ্ধারের একটি মাত্র উপায় রয়েছে। তা হচ্ছে যথার্থ ইসলামী ঐক্যের মাধ্যম চূড়ান্ত জিহাদ ঘোষণা। আরব ও মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সত্যিকারের ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হলেই ফিলিস্তিন এবং অন্যান্য সব অধিকৃত আরব এলাকা পুনরুদ্ধারের পথ সুগম হতে পারে।
৫ই জুন ভোর হলো। কিন্তু আজ তড়িঘড়ি দরজা খোলার জন্যে কেউ এলো না। কিছুক্ষণ পরে হটাৎ দরজা খুলে এক হাবসী সিপাহী চেঁচিয়ে যা বলে গেল তা তাৎপর্য বোঝা গেল না। যতটুকু বোঝা যায়-হতভাগা নাসের বিজয়ী হয়েছে।
একটু অসমাপ্ত কথা বলে বিড় বিড় করতে করতে অন্যান্যদের কাছে ছুটে গেল। এরপর এসে শত্রুদের বেশ জঙ্গী বিমান ভূপাতিত করার খবর শোনালো। এর সাথে সাথে এক, দুই, তিন, চার করে একের পর এক তাদের তৃতীয় মহান নেতার বীরত্ব ও বিজয়ের কাহিনী বলে যেতে লাগলো।
আমরা কথার আগাগোড়া কিছু অনুমান করতে না পেরে চুপ করে রলাম। আসরের নামাজের পর সাফওয়াত এসে কোন কথাবার্তা ছাড়াই আমাকে তার ভারী বুট দিয়ে লাথি মারতে শুরু করলো।
সে হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে বলছিল- আমরা বিজয়ী হয়েছি।
ভারী বুটের অজস্র লাথি খেয়ে আমি বেহুঁশ হয়ে পড়ি। হামীদা তাকে বার বার আমাকে অতর্কিত আক্রমণ করার কারণ জিজ্ঞেস করছিলো। কিন্তু কেবল লাথি বর্ষণ ছাড়া কোন জবাবই তার মুখ থেকে বেরুচ্ছিল না। আমি আঘাতের চোটে অজ্ঞান হয়ে পড়লে সে তার সাথে আগত সিপাহীদের আমার সব দরকারী জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার আদেশ দিল। জ্ঞান ফিরে এলে সে আমাকে আবার পিটালো। তারপর আমাদের সে’ল থেকে বের করে হাঁটতে বলে সেও গালি দিতে দিতে এগিয়ে চলল। সে বার বার এটাই বলছিল “আমরা বিজয়ী হয়েছি! আমরা সাফল্য অর্জন করেছি”। ৫ই জুনের বিকেল বেলায় আমাকে এবং হামীদাকে সামরিক অফিসার ও জোয়ানদের একটি গাড়ীতে বসিয়ে সামরিক কারাগারের প্রধান গেট অতিক্রম করে। কারাগারের কর্তারা ড্রাইভারের পাশের সীটে বসেছিল। আমি আল্লাহ্র নামে তসবীহ্ পাঠ করতে শুরু করলাম। আমার মনে হচ্ছিল, আসমান জমীন তথা পূরো সৃষ্টি-জগতের প্রতিটি প্রাণী ও প্রতিটি বস্তু আমার সাথে আল্লাহ্র নাম জিকির করছে। আমি যখন উচ্চস্বরে তসবীহ্ পাঠ করছিলাম তখন হামীদা আমাকে আওয়াজ বন্ধ করতে বলল। এরপর আমি তসবীহ্র শাব্দিক অর্থ ও তাৎপর্যের দিকে মনোনিবেশ করি। এবার মনে হচ্ছিল গোটা পৃথিবী আমার সাথে কথা বলছে।
সামরিক কারাগারের কক্ষে আমার উপর অতর্কিত হামলার সময় সাফওয়াতের কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল আমাকে ফাঁসীতে ঝোলাবার জন্যেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এজন্য আমি আল্লাহ্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াত তেলাওয়াতে মগ্ন হয়ে পড়ি। “নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ জান্নাতের বিনিময়ে মুমিনদের জান মাল কিনে নিয়েছেন”।
একটি কবিতার কিছু অংশ আমার মনে পড়ছিল তখন। কবি বলেছেন-
……… আসে যদি মৃত্যু ঈমানের সাথে
প্রশ্ন নেই কোন কিভাবে এলো, মৃত্যু আমার?
অন্যত্র কবি বলেছেন-
“ পাখি উড়ে গেল অজানা পথে নিরুত্তর পৃথিবী
আমি জানি কিন্তু তার মনজিল মধুর”।
কবি আরো বলেন-
“ যদি বাঁচতে চাও মেয়েদের বেশী
অসম্ভব জেনে এখানে বেশী কম দাবীর
নেই অনুমতি”।
…… ব্যাস মেনে নাও মৃত্যু ধৈর্যের সোপান,
এ সোপান হয় শেষ অন্তরের দ্বারে”।
গাড়ী ব্রেক করে দাঁড়ালে হামীদা আমাকে ডাক দেয়। আমি চোখ খুলে দেখি সামনে কানাতি জেল। মহিলাদের জন্যে নির্দিষ্ট
মানসিক পীড়ার রাত
কানাতির কারাগারের প্রধান গেট অতিক্রম করে আমাদের জেল দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে আমাদের মালপত্রের নিখুঁত তল্লাশী করা হয়। তখন রাত্রিকাল। এরপর কমিশনারের পাশের দফতরের মহিলা জেলার আবার আমাদের তল্লাশী নেন এবং বন্দীদের জন্যে নির্ধারিত ইউনিফর্ম পরিয়ে দিয়ে নির্দিষ্ট কক্ষে পৌঁছিয়ে দেয়া হয়। কক্ষ কি বলা যায়, লোহারতাবু লোহার কয়েকটি খুঁটি ছাড়া এর দরজা বলতে কিছুই ছিল না। তারই মাঝে একটি পাশ ভাঙ্গা চৌকি এবং অপর চৌকির উপর রাখা একটি ছাড়া কোথাও আর কোন জিনিসের অস্তিত ছিল না। আমাদের কক্ষ পেরিয়েই শুরু হয় বিরাট এক হলঘর।এর সাথেই ছিল মহিলা কয়েদীদের তিনটি ওয়ার্ড। এসব মহিলাদের চুরি, মাদক দ্রব্যের ব্যবসা; হত্যা এবং অবৈধ যৌন-অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।
রাতের অন্ধকার গাঢ় হতেই দূর মসজিদের মিনার থেকে ভেসে আসে আজানের সুমধর ধ্বনি। তায়াম্মুম করে এশার নামাজ আদায় করি। নামাজের পর শুয়ে পড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করি। কিন্তু কোথায় ঘুম। ঘুম কোথায় কোন অজানা রাজ্যে পালিয়েছে, কে জানে! রাতের অন্ধকারে আরো ঘন ও বিভীষিকাময় হতে লাগলো আর ওয়ার্ডের দরজা সে রাতের মতো বন্ধ হতেই নৈতিক চারিত্রিক অধঃপতনের বীভৎস রূপ প্রকট হতে লাগলো। মানুষ তার মানবিকতার আবরণ খুলে ফেলে নির্লজ্জ নোংরামীর চরম সীমায় পৌঁছাতে শুরু করলো। মানুষ স্বেচ্ছায় অমানুষে পরিণত হলে যে পরিণতি হতে পারে; তারই চরম নিদর্শন দেখে মানসিক যন্ত্রণা আর আহত উপলব্ধির যাতনায় কাটলো সেই অভিশপ্ত রাত্রি।আমরা দীর্ঘ সময় ধরে আল্লাহ্র জিকিরে মশগুল থাকতাম। কারণ আল্লাহ্র স্মরণের মাধ্যমেই হৃদয়ে প্রশান্তি অর্জন করা সম্ভব। সুব্হে উমিদের আলোক রেখা প্রকাশ পেলে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে আল্লাহ্কে কৃতজ্ঞতা জানালাম। আমরা আল্লাহ্র দরবারে মনের উদারতা এবং সার্বিক মুক্তির জন্যে মোনাজাত করলাম।
আমি সেই বীভৎস নারকীয় রাতটিকে কোনদিন ভুলতে পারবো না। অথচ সেদিন সে রাতে কোন জল্লাদ আমার উপর হান্টার বা চাবুক চালায়নি……কেউ গালি-গালাজও করেনি। তবুও সেটাই ছিল আমার কারা জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অসহ্য-নারকীয় রাত। সেই নারকীয় রাতের বিষাক্ত বিদঘুটে পরিবেশ দেখে হামীদা কাঁদতে কাঁদতে বেহুশ হয়ে পড়ছিল। আমি তাঁর জ্ঞান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে বলি-
: আমরা যে আদর্শ ও পথের অনুসারী…… সে পথে চলতে গিয়ে যে কোন অবস্থা ও পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্যে ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রয়োজন। আল্লাহ্ আমাদের সাহায্য করবেন। সামরিক কারাগারে আমাদের উপর নৃশংস অত্যাচার চালানো হয়েছিল, অপমান করা হয়েছিল,মেরে মেরে শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছিল, ক্ষুধা-পিপাসায় অবর্ণনীয় কষ্ট দেয়া হয়েছিল; কিন্তু তা সত্ত্বেও এই রাতে আমরা যা দেখতে পেয়েছি যা শুনতে পেয়েছি তা আমাদের কাছে সামরিক কারাগারের অমানুষিক জুলুম-নীপিড়ন থেকেও অনেক বেশী কষ্টকর মনে হয়েছে। এ রাতে আমাদের সামনে অজ্ঞতা ও পাশবিকতার পঙ্কিলতায় আবর্তনশীল মানুষদের একটি দল জঘন্যতম পাপাচারে লিপ্ত ছিল। এরা সবাই ছিল নারী। এরা মানবিকতার সব বন্ধন থেকে নিজেদের মুক্ত করে চরম যৌন বিকৃতি ও শয়তানী প্রবৃত্তির বাঁদীতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এরা প্রত্যেকেই অপরাধ প্রবণতাকে তাদের পেশা-নেশায় পরিণত করে। মানবতা, ভদ্রতা, পবিত্রতা, মান-মর্যাদা, শালীনতা ইত্যাদি শব্দ বা গুণাবলীর সাথে এদের আদৌ কোন সম্পর্কই ছিল না। বস্তুতঃ এরা এমন এক হীনতর জীবে পরিণত হয় যাদের কাছে অশ্লীলতা আর যৌন পাপাচারই হচ্ছে জীবনের মোদ্দা কথা।
এদের এমন জীবের সাথে তুলনা করা যায়, যার গলার রশি ধরে রয়েছে আর এক অন্ধ। সেই অন্ধের নির্দেশমতেই এসব অন্ধ-জীব ভুল-ভ্রান্তি ও বিপদের পথে জীবন বরবাদ করে চলছে। এরা কোনদিন সরল-সুন্দর পথ দেখার, জানার, বোঝার সুযোগ হয়নি। ফলে অন্ধ তারা অন্ধ প্রবৃত্তির অনুসরণে জাহান্নামের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। মাটির বুকে যেসব মানুষ অন্যসব মানুষকে গোলামীর শৃংখলে আবদ্ধ করে প্রয়াসী তারা এসব অন্ধ পথহারা লোকদের বিপথে চলতে আরো বেশী সাহায্য করেছে। খোদাদ্রোহী শাসকরা তাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়নের হীন স্বার্থে এ ধরণের অপরাধীদের সহযোগিতা গ্রহণকে জরুরী মনে করে থাকে। যাহোক, শেষ পর্যন্ত ফজরের নামাজের আযানের সাথে সাথে সেই পাপাচারে পূর্ণ আঁধার রাতের অবসান ঘটে। ভোরের স্বর্গীয় আলোকে দূর হয়ে যায় নারকীয় রাতের অবাঞ্ছিত অন্ধকার। আমরা দয়ালু ও করুণাময় আল্লাহ্র দরবারে সিজদাবনত হই এবং তাঁর সন্তুষ্টি প্রার্থনা করি।
নতুন পর্যায়ে সংঘাত
আমি এবং হামীদা জেল-কমিশনারের অফিসে গেলে জানানো হয় যে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তোমাদের জন্যে ক্যান্টিনে যাওয়া এবং কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ করা নিষিদ্ধ। কমিশনার বললেন-
: তোমাদের দু’জনের জন্যে বন্দীদের দেয়া অধিকারও নেই। পরবর্তী নির্দেশ পর্যন্ত তোমাদেরকে এ অবস্থাতেই থাকতে হবে।
আমি তাকে বললাম-
আমরা আপনার কাছে সেজন্যে আসিনি, বরং এই অনুরোধ নিয়ে এসেছি যে, কমিশনার আমার কথা শেষ না হতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
তোমরা আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিল?
আমি বললাম-
হ্যাঁ। আমরা আমাদের কক্ষ পরিবর্তন করতে চাই।
হামীদা বলল- আমরা এমন কক্ষ চাই, যাতে অন্ততঃ দরজা থাকবে। জীব-জন্তুর খোঁয়াড় নয়……
কমিশনার বললেন- এটা আবার কেমন কথা হল? ঠিক আছে, আমরা তোমাদেরকে আবার সামরিক কারাগারে পাঠিয়ে দেব। সেখানে যা ভোগ করে এসেছো, তা আবার ভোগ করতে পারবে।
আমি বললাম- আমরা এমন স্থানে থাকতে পারিনে, যা জীব-জন্তুর জন্যেও অযোগ্য। তিনি বললেন- আমি কমিশনার; এটা জেল এবং তোমরা বন্দিনী। এছাড়া আমি আর কিছুই জানিনা।
এরপর তিনি দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন-
: কে আছ; এসে এদের বের করে দাও।
আমি আবার বললাম-
: আমরা জেলের প্রাঙ্গণে পড়ে থাকবো, কিন্তু কোন অবস্থাতেই সেই কক্ষে যাবো না, যা তা পরে দেখা যাবে।
কমিশনার বললেন- কারাগার কারাগারই। তোমরা যদি আদেশ মানতে অস্বীকার কর তাহলে গুলী করে মারা হবে।
আমি বললাম তা বরং অনেক সহজ ……… তাছাড়া তোমাদের হাতে খুন হবার অর্থই তো শাহাদাত……
কমিশনার আমাদেরকে অফিস থেকে বের করে জেল- ওয়ার্ডে ছেড়ে দিলেন। একটু পরে কমিশনার মহিলা জেলারকে ডেকে আমাদের তল্লাশী নেবার হুকুম দিলেন।
তল্লাশীর জন্যে আমাদেরকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিয়ে যাওয়া হয়। এটা একটা প্রশস্ত ওয়ার্ড। এতে বিশখানা চৌকি ছিল। ঘণ্টা খানেক পরে সেই মহিলা জেলার এসে বলল-
: এস, তোমাদের আয় কত? আমরা তার প্রশ্নের মানে বুঝতে অক্ষম ছিলাম। সুতরাং আমাদের ‘নোংরা’ নামে বিশেষিত মেয়ে লোকদের কাতারে দাঁড় করানো হয়। এরা এমন সব মেয়েলোক, যাদের চরিত্র বা মান-মর্যাদা জ্ঞানের কোন অর্থই ছিল না। এরা তাদের হীন দুশ্চরিত্রতার অপরাধে জেলে এসেছে।
কক্ষের পাশে গিয়ে জেলার চেঁচিয়ে বলল-
: আজকের আমদানী মোট পঁয়তাল্লিশ। পঁচিশজন বেলাল্লাপনার দায়ে, পনের জন যৌন অপরাধ ও নৈতিকতার-বিরোধী অপরাধে, তিনজন চুরির অপরাধে এবং দুজন রাজবন্দিনী।
রাজবন্দিনী অর্থাৎ আমি আর হামীদা। জেলারের চেঁচানো শেষ হলে আমি আগের লাইন ছেড়ে সরে আসি। হামীদাও আমার অনুসরণ করে। তা দেখে জেলার বলল-
: আরে তোমরা যাচ্ছ কোথায়……? অপেক্ষা কর।
আমি বললাম, আমরা পৃথক ভাবে দাঁড়াবো। কারণ এসব বাজে লোকদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্কও নেই। সে বলল- তোমাদের এত নাক ছিটকানো হচ্ছে কেন?
আমি বললাম- ওদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।তাই আমরা আলাদা ভাবেই দাঁড়াবো। সে জিজ্ঞেস করলো- ওরা কি তোমাদের চেয়ে নিকৃষ্ট?
আমি এর কোন জবাব না দিয়ে চুপ করে রলাম। জেলার ওসব পথভ্রষ্ট চরিত্রহীনদের একটি কক্ষে বন্ধ করে আমাদের কাছে এসে বলল-
: সিষ্টার! ডাক্তার সাহেবা তোমাদের বসতে বলেছেন। তাঁর অবসর হলে তাঁর কাছে যাবে।
মহিলা ডাক্তার অবসর পেয়ে আমাদের ডেকে নাম-বয়স এবং ব্যাথা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন। দরজা বন্ধ করার একটু পরেই বিকট চিৎকারের সাথে কান্নাকাটির শব্দ শোনা যেতে লাগলো। সারা পরিবেশ কেমন যেন বিষণ্ণ রূপ ধারণ করলো। আমরা কৌতুহলী হয়ে বাইরে কান লাগিয়ে বুঝতে পারলাম, বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটেছে।। আমি আত্মসমীক্ষায় মগ্ন হয়ে পড়লাম-
: কত সংকট আর দুর্ঘটনাই ঘটে চলেছে হায়! আমার হতভাগ্য জাতি! দুর্যোগ-দুর্ঘটনা আর হাহাকারই বুঝি তোর নিয়তি? কে আছে তোর আপন?
একের পর এক কঠিন দুর্যোগ আর দুর্ঘটনায় সয়লাবে বারবার নিমজ্জিত হচ্ছে জাতির ভাঙ্গা তরী। কখনো চারিত্রিক দুর্যোগ, কখনো আদর্শিক দুর্যোগ, কখনো অর্থনৈতিক ও সামাজিক অরাজকতার দুর্যোগ। সব শেষে ৫ই জুনের গ্লানি, অপমান জনক পরাজয়ের শোকাবহ ঘটনা। ৫ই জুনের প্রলয়ঙ্কারী দুর্ঘটনা জাতীয় জীবনকে আরো ঘোলাটে আরো পতনশীল করে দিয়েছে। আমাদের শাসক গোষ্ঠী বাঁদরের মতো অনুকরণ প্রিয় এবং শুকরের মতো স্বার্থপর ও নির্লজ্জ। এরা দেশের অভিশপ্ত লোকদের সংস্পর্শে এসে সাক্ষাৎ শয়তানে পরিণত হয় এবং শত্রুর হাতে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে, এরা জাতির উপর আরো কঠোর অত্যাচার চালাতে শুরু করে। এদের নিষ্ঠুরতা, নির্লজ্জতা ও হীনতা দেখে অভিশপ্ত ইহুদীরা পর্যন্ত অনুকম্পাবোধ করে। আমি ভাবছিলাম-
: কোন ধরণের জীবন-যাপন করছি আমরা? আমাদের চোখের সামনেই ইসলাম, ভ্রাতৃত্ব, মর্যাদাবোধ, ভদ্রতা-শিষ্টাচার ইত্যাদি সব সৎগুণাবলী ধ্বংস করা হচ্ছে। মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। সাধারণ মানবিক অধিকার থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। সামান্যতম অধিকার অর্জনের অনুমতিও তাদের দেয়া হচ্ছে না। এরা ইসলাম এবং মুসলমান উভয়কেই ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে। মুসলমানদের জনশক্তি, মুসলমানদের সামাজিক মর্যাদা, সহায়-সম্পদ, জমি, পুঁজি সব কিছুই কেড়ে নিয়ে তাদের অস্তিত্বকে বিলুপ্ত করে দিতে চাচ্ছে। অথচ ইসলামের সত্যিকার অনুসারী মুসলমানরা হচ্ছে মানবতার অতন্দ্র প্রহরী। তারা মানুষের কল্যাণের জন্যে বাতিলের বিরুদ্ধে জিহাদ ক’রে জুলুম শোষণের অবসান ঘটায়। তারা দুঃখী সর্বহারাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সর্বস্ব ত্যাগ করে দেয় এবং তাদের নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলী মানব সমাজকে করে নিষ্কলুষ শুভ্র-সুন্দর। এদের ব্যক্তিত্বের সৌরভ সমাজ পরিবেশকে করে সুরভিত। মুসলমান আল্লাহ্র পথে চলে, আল্লাহ্রই সন্তুষ্টির জন্যে মিথ্যের বিরুদ্ধে এবং সত্যের পক্ষে সংগ্রাম করে। আল্লাহ্র আদেশের সামনে মাথা নত করে। ভয়-ভীতি ও দুঃখ মুসিবতের তোয়াক্কা না ক’রে দুর্জয় সাহসে এগিয়ে চলে মানবতার মুক্তির পথে।
আমার পাশে কারা যেন ফিস ফাস করছে। সত্যের পথে সহযাত্রী ভায়েরা আমার! চাপা শব্দে কথা বলোনা, মাথা নীচু করে ধীরে ধীরে বলোনা; বরং স্পষ্ট কথাবার্তা বল, সম্পূর্ণ শক্তি ও সাহসিকতার সাথে সামনে-আরো সামনে এগিয়ে চল। কোন ইতস্ততা, কোন জড়তা, কোন সন্দেহ আর শঙ্কা নয়। দূর্বার নির্ভীক অব্যাহত গতিতে লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে চল।
তোমরা যদি আল্লাহ্র সন্তুষ্টির পথ ত্যাগ কর তাহলে ভয়-ভীতি আর অপমান তোমাদের পায়ের জিঞ্জির হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহ্র শপথ করে বলছি, আমরা যদি আল্লাহ্র নির্দেশিত পথে অবিচল থাকি, তাহলে আল্লাহ্ অবশ্যই আমাদের সাহায্য করবেন। আমাদের মনপ্রাণ আর বিবেকের গভীরতা দিয়ে ইসলামকে গ্রহণ করার মতো গ্রহণ করতে হবে। আমরা চির অনির্বাণ শাশ্বত সুন্দর অকৃত্রিম ইসলামকে পূর্ণাঙ্গরুপে বাস্তবায়ন করেই পেতে পারি তার সোনালী ফসল। আমাদেরকে সংশয়বাদিতা ত্যাগ করতে হবে, বিভেদ মতভেদ-বিতর্কের পথ পরিহার করা ফরজ, অবশ্য কর্তব্য প্রথম ও প্রধান লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এগিয়ে যেতে হবে। আমরা যদি এভাবে চলতে থাকি তাহলে আল্লাহ্র রহমতে আল্লাহ্র মেহেরবানীতে আমরা দুনিয়ার বুকে আমাদের স্বপ্ন ও সাধনার নগদ ফসল তুলতে পারবো। আমরা অস্থায়ী ভেল্কিবাজ শক্তিবর্গকে পরাস্ত করে সাফল্য অর্জন করতে পারবো, প্রতিষ্ঠা করতে পারবো আল্লাহ্র কালাম ও রাসূলের সুন্নাতের আলোকে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র। আমরা আবার ফিরে পাবো আমাদের হৃত গৌরব মান-মর্যাদা। বস্তুতঃ আল্লাহ্র আনুগত্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমাদের মান-মর্যাদা, গৌরব, সৌভাগ্য, শক্তি ও সমৃদ্ধি। ইসলামের অনুসরণে কেবল ইহকালের এ জীবনে নয়, মৃত্যুর পরবর্তী মহাজীবনেও আমরা হবো জান্নাতুল ফেরদৌসের ভাগ্যবান। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা মহান উমর (রাঃ) বলছেন-
: আল্লাহ্র দুশমনদের মোকাবেলার বিনিময়েই অর্জিত হয় মুসলমানদের সত্যিকারের সাফল্য। আর এ পথেই আমরা পাই আল্লাহ্র সাহায্য। তা না হলে আমরা কোনদিন তাদের উপর বিজয়ী হতে পারতাম না। কারণ সংখ্যা ও সাজ-সরঞ্জাম অস্ত্র-শস্ত্রের দিক থেকে কাফেরদের তুলনায় আমাদের প্রস্তুতি নিতান্তই তুচ্ছ। কিন্তু ইসলামী বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে আমরা কাফেরদের বরাবর ও যদি হয়ে পড়ি তাহলেও তারাই হবে আমাদের উপর বিজয়ী।
আজ যে আমরা-মুসলমানরা অপমান ও পরাজয়ের গ্লানী বহন করছি, কুরআন ও সুন্নাহ্র পথ থেকে আমাদের দূরত্বই এর একমাত্র কারণ। এভাবে অবস্থা চলতে থাকলে আমাদেরকে আরো বিপদ এবং অপমানজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। কারণ, অপমান, পরাজয়, দুর্বলতা অধঃপতন, অভাব-অনটন ইত্যাদি আসে খোদা বিরোধিতার পরিনামেই। খোদা-দ্রোহিতার পরিণাম ইহ-পরকালে অব্যাহত আজাব ও জাহান্নামে ছাড়া আর কিছুই নয়।
আল্লাহ্ বলেছেন-
“ যারা আমার আদেশ মেনে চলেছে তারা দুর্ভাগ্য-পীড়িত এবং অপমানিত হবে না; আর যে ব্যক্তি আমার স্মরণ বর্জন করেছে তার জীবন হবে সংকীর্ণ। রোজ হাশরের দিন আমি তাকে দৃষ্টিহীন অবস্থায় উঠাবো। সে বলবে, ‘হে আমার প্রভু! তুমি আমাকে অন্ধ করে কেন উঠালে’ অথচ আমি দৃষ্টি-শক্তিসম্পন্ন ছিলাম’। তখন আল্লাহ্ বলবেন, তোমার কাছে আমার নিদর্শনাবলী পৌঁছেছিল, কিন্তু তুমি তা ভুলে গেছ, তাই তোমাকেও ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে, আমি অত্যাচারী এবং প্রভুর নিদর্শনাবলীর উপর অবিশ্বাসকারীদের এভাবেই বদলা দিই। পরকালের আজাব হবে চিরস্থায়ী এবং অত্যন্ত কঠিন”।
আমি ভাবনার অথৈ পাথারে ডুবন্ত ছিলাম। অনেক অর্থ আর তাৎপর্য আমার মস্তিস্কে ঘুরপাক খাচ্ছিল। দুঃখজনক পরিস্থিতি, তিক্ত ঘটনাবলী আমার গভীর অন্তঃপুরে শোক-দুঃখের সাথে সাথে অজানা আশংকায় ছায়াও রেখায়িত হয়ে উঠছিল।
হামীদার ডাকে আমি চমকে উঠি। আমি পাশের বন্ধ কক্ষেই বসেছিলাম। এর দরজা কখনো কখনো খোলা হতো। আশে পাশের কোথায় কি আছে না আছে বা কি হচ্ছে না হচ্ছে তা জানার কোন উপায় ছিল না। একদিন মহিলা প্রহরীর চোখে ধুলো দিয়ে আমরা এক প্যাকেট সিগারেট আনতে সক্ষম হই। কঠোর-প্রাণা মহিলা-প্রহরীর জন্যে এই সিগারেটের প্যাকেট ছিল দুর্লভ বস্তু। তাকে নরম-কোমল করার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট ছিল যথেষ্ট। এতে করে আমাদের আশ-পাশের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হতে শুরু করি। আমাদের পার্শ্ববর্তী কক্ষে ছিল একটি নারী ও তার শিশু সন্তান। শিশু সন্তানটির পিতা সম্পর্কে কেউ কিছু জানতো না। সামনের কক্ষে একটি মেয়ে তার কুকর্মের ফল ভোগ করছে টি-বি রুগিনী হিসেবে। ওর সামনের ওয়ার্ডে মারাত্তক রোগে আক্রান্ত মেয়ে বন্দীনীরা সাজা ভোগ করছিল। বিল্ডিং-এর শেষ প্রান্তে ছিল শৌচাগার। আমাদেরকেও প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম সারার জন্যে ওখানে যেতে বলা হয়। এই আদেশের উদ্দেশ্য ছিল আমাদেরকেও কোন না কোন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত করা।
বিল্ডিং- এর দ্বিতীয় ভাগে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এবং সাজানো গোছানো কক্ষ দেখা যাচ্ছিল এবং তাতে অবস্থানরত মহিলারা কোন দেশের নাগরিক তা প্রথমে আমরা জানতে পারিনি। সে অংশের গোসলখানা এবং শৌচাগারও ছিল বেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন।
একদিন সেই পরিচ্ছন্ন ওয়ার্ডের এক মহিলা আমাদেরকে উত্তম খাদ্য পরিবেশন করেন। আমরা খুবই ক্ষুধার্ত ছিলাম বলে তা পরম তৃপ্তি সহকারে খাই। এভাবে তাদের প্রতি আমাদের কৌতুহল আরো বৃদ্ধি পেলো। মহিলার ভদ্রতার পরিচয় পেয়ে মনে হলো জীব-জন্তুর এই দুর্ভেদ্য অরণ্যে হটাৎ যেন কোন মানুষ এসে পৌঁছেছে।
আমি মহিলা গার্ডকে বললাম-
: আমাদেরকে ওপাশের পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বাথরুম ব্যবহারের অনুমতি দাও।
সে বলল-
: তাতো শুধু মহিলা…… ডাক্তার এবং ইহুদীর জন্যে নির্দিষ্ট।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
ইহুদী বলছো তুমি কাদের?
সে বলল- হ্যাঁ, ছয় জন ইহুদী মহিলা। মাদাম মুরসেল, মাদাম লোস প্রমুখ।
ওরা বেশ ঘোরাফেরা করে। যা চায় তা পায়। তাদের অবাধ স্বাধীনতা ছিল সর্বত্র গতি-বিধির। ওদের থাকার স্থান ছিল উত্তম। ওদের দেয়া হতো উৎকৃষ্ট পুষ্টিকর খাদ্য-দ্রব্য। অথচ ওরা সবাই ছিল ইসরাইলের গুপ্তচর। গুপ্তচর বৃত্তির অপরাধেই তাদের গ্রেফতার ও আটক করা হয়। মহিলা প্রহরী অবশ্য বলল-
: আপনারা বরং মহিলা ডাক্তারের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলুন। তিনি আপনাদেরকে তাঁর বাথরুম ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারেন।
এ ব্যপারে আমরা মহিলা ডাক্তারের সাথে কথা না বলে জেলারের সাথে আলোচনা করি। জেলার কোন মতেই রাজী হননি। কারণ সেই বাথরুম কেবল ইহুদীনি গুপ্তচরদের জন্যেই নির্দিষ্ট ছিল।
শত্রু হলেও মানুষ বটে
শেষ পর্যন্ত আমি সব ব্যাপারে আল্লাহ্র মর্জির উপর ছেড়ে দিয়ে তাঁরই ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়ি। হামীদাও আমার পাশে বসে ইবাদাত করছিল। এমন সময় দীর্ঘ গৌর বর্ণ এক মহিলা আমাদের কক্ষে এসে আমাদের সালাম জানালেন। আমরা সালামের জবাব দিলে তিনি প্রশ্ন করলেন-
: আপনিই জয়নব আল-গাজালী?
আমি ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি বললেন-
আমি মুরসেল-রাজ বন্দিনী এবং স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ও আপনাদের মধ্যে আদর্শগত মতভেদ রয়েছে। কারণ আমি ইহুদী এবং আপনারা মুসলমান; কিন্তু এই বিপদ-মুসিবতে আমরা সবাই মানুষ এটাই বড় কথা। এজন্যে কারাগারে আমাদের পারস্পরিক ব্যাপারে কোন বাধা-বিপত্তি অবশ্যই কাম্য নয়। এসময় আমরা সবাই বিপদগ্রস্থ। আমি প্রহরীদের দৃষ্টি এড়িয়ে আপনাদের কাছে এসেছি। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে পারস্পরিক সাহায্যের ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়ানো। আমরা তাঁর প্রস্তাবকে স্বাগত জানাই। এরপর তিনি বললেন-
: আমাদের কাছে কম হলেও যথেষ্ট খাদ্য-দ্রব্য রয়েছে। আমরা আপনাদের সাথে খাদ্য-দ্রব্য বণ্টন করবো। অবশ্য কোন রকমের অবৈধ হারাম খাদ্য আপনাদের দেয়া হবে না। বলা বাহুল্য, আমরা ইহুদীরাও মুসলমানদের মতো শুকরকে অবৈধ বা হারাম গণ্য করি।
এরপর থেকে সে ইহুদী মহিলা মুরসেল আমাদের জন্যে নিয়মিত খাদ্য-দ্রব্য নিয়ে আসতেন। তার চেয়েও বড় কথা তিনি আমাদেরকে তাদের জন্য নির্দিষ্ট বাথরুম ব্যবহার করার ব্যবস্থা করে দেন।
হামীদা কিন্তু এসব ব্যপারে কেমন যেন ইতস্ততঃ বোধ করছিল। আমি তাকে বললাম-
দেখ, আল্লাহ্ তার বান্দাদের সাহায্য করার জন্যে যেকোনো উপায় গ্রহণ করতে পারেন। যেকোনো ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি কল্যাণ পৌঁছাতে পারেন। আল্লাহ্ কোন সময় তাঁর বান্দাদের উপর জুলুম করেন না এবং স্থায়ী অভাব অনটনেও ফেলে রাখেন না। আমিতো একবার এক বিশাল অরণ্যে এবং আরেকবার মরুভূমিতে ভীষণ বেকাদায় পড়ে গিয়েছিলাম। সেই বিপদের মুহূর্তে এক খ্রিষ্টান মহিলা-ডাক্তারের মাধ্যমে আল্লাহ্ আমাকে উদ্ধার করেন। সেই খ্রিষ্টান মহিলা-ডাক্তার আমাকে এভাবে সেবা করতেন যে দেখে আমি বিস্মিত হতাম। বস্তুতঃ এসব হচ্ছে আল্লাহ্রই রহমত। তিনি শত্রুকে দিয়ে মিত্রের কাজ করিয়ে থাকেন। এই কারাগারে এই অধঃপতিত চরিত্রহীন বিকৃত স্বভাবের মূর্খ লোকদের সাথে আমাদের সময় কাটানো ছিল মুশকিল। এখানে তো টাকা ছাড়া কোন কথাই নেই। টাকা দিলে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত খোলা রাখা যায়। যা চায় সব পাওয়া যায়। এখানে কয়েদী আর জেলার সবাই সমান। এখানে মানুষের কাছে টাকা আর ভালোবাসা দাবী করা হয়। তা এটাকি এতো সহজ কথা?
মৃত্যু এবং বিদ্রোহী
ক্ষমতার দণ্ডে মদমত্ত অত্যাচারী শাসক গোষ্ঠী একবারে ভুলে বসেছে যে, একদিন তাদেরকেও মৃত্যুবরণ করতে হবে। তারা আল্লাহ্র পক্ষে থেকে নির্ধারিত মৃত্যুকে ভুলে গিয়ে আল্লাহ্র বান্দাদের উপর জুলুম ত্রাসের শাসন চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ, সময় ও যুগের গতি আল্লাহ্রই নিয়ন্ত্রানাধীনে রয়েছে। রাতের পর দিন, বংশের পর বংশ, আসা-যাওয়া , জীবনের শুরু ও শেষ, শরীরের ক্রমবৃদ্ধি ও ক্ষয়, প্রাণের সঞ্চয় সমাপ্তি ইত্যাদি সব কিছুই আল্লাহ্রই হুকুমের অধীনে হচ্ছে। হ
“ মৃত্যু পথযাত্রীর প্রাণ যখন কুণ্ঠাগত আর তোমরা যখন দেখছো যে সে মরছে তখন সেই বহির্গামী প্রাণকে তোমরা ফিরিয়ে আন না কেন? সে সময় তোমাদের চেয়ে আমিই তার অধিক নিকটবর্তী থাকি, কিন্তু তোমরা দেখতে পাওনা”। (কুরআন)
এই ত্রস্তব্যস্ত সর্বস্ব জীবনের প্রেক্ষাপটে মানবিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি অপমান ও অধঃপতনের অথৈ গভীরে নিমজ্জমান দেখা যায়। কানাতির জেলের লোকেরা নাসেরের মৃত্যুতে বাহ্যিক শোক দুঃখ প্রকাশ করে। কিন্তু আল্লাহ্ সাক্ষী; তার মৃত্যুতে আমাদের মনে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়নি। কারণ আমরা জানি মৃত্যু একদিন নির্ধারিত রয়েছে। একদিন আসবেই। এর কবল থেকে পালিয়ে বাঁচার কোন উপায় নেই। মৃত্যুকে এড়িয়ে যাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। নিঃসন্দেহে মৃত্যু হচ্ছে অত্যন্ত ভয়ানক এবং বিনয়ের বাস্তব ঘোষণা। মৃত্যুই আমাদের ডেকে বলে যে, তোমরা সাবধান হয়ে যাও, অত্যাচার ও ঔদ্ধত্য থেকে ফিরে এস। কারণ তাতে তোমার কোন মঙ্গল নেই। তোমার এসব দণ্ড-অহংকার এসব ধন-দৌলত, শক্তি-অস্ত্র সৈন্যবাহিনী সন্তান-সম্পত্তি কিছুই তোমার কাছে আসবে না। সব কিছুই পড়ে থাকবে আর আল্লাহ্র দরবারে তুমি ঠিক সেভাবেই নিঃস্ব-উলঙ্গ অবস্থায় পৌঁছুবে যেমন তুমি মায়ের পেট থেকে ভুমিষ্ট হয়েছিলে।
“ হায়, তোমরা যদি অত্যাচারীদেরকে সেই অবস্থায় দেখতে, যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় ওরা ছটফট করে এবং ফেরেশতারা হাত বাড়িয়ে বলে-দাও বের কর নিজের প্রাণ।আজ তোমাদের সেসব কথার অবাধে অপমানজনক শাস্তি দেয়া হবে, যা তুমি আল্লাহ্র উপর অভিযোগ এনে অবৈধ বকাবকি করতে এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মোকাবেলায় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে”।
আল্লাহ্ বলবেন-
“তুমি এখন ঠিক সেভাবেই নিঃসঙ্গ একাকী আমার সামনে উপস্থিত যে ভাবে আমি তোমাকে প্রথম বার একাকী সৃষ্টি করেছিলাম। আমি তোমাকে যা দেবার তা দিয়েছিলাম। সেসব তুমি ছেড়ে এসেছ। এখন আমি তোমার ওসব সুপারিশকে বিবেচনা করবো না, যার ব্যাপারে তোমার ধারণা ছিল যে, তোমার কাজে আসার ক্ষেত্রে ওসবেরও কিছু অংশ রয়েছে। তোমার পারস্পরিক সব সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে। আর যা তোমার বড্ড দম্ভ ছিল, তা সব তোমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে”।
আল্লাহ্ আরো বলেন-
“ আমরা তাদের উপর জুলুম করিনি, তারা নিজেরাই নিজেদের উপর জুলুম করেছে এবং যখন আল্লাহ্র হুকুম এসে পড়লো তখন তাদের উপর প্রভু কোন কাজে আসেনি-আল্লাহ্কে ছেড়ে তারা যাদের ডেকে থাকতো। ওরা তাদের ধ্বংস ও ক্ষতি ছাড়া কোন উপকার করেনি”।
“এবং তোমার পালন কর্তা, রব যখন কোন জুলুমের বসতিকে পাকড়াও করেন তখন তাঁর ধরন এমনই হয়ে থাকে। বস্তুতঃ তাঁর পাকড়াও হয় অত্যন্ত কঠিন এবং যন্ত্রণাদায়ক। বস্তুতঃ এতে ইঙ্গিত রয়েছে, ওসব লোকদের জন্যে যারা আখেরাতের আযাবের ভয় করে। সে একদিন নির্ধারিত আছে, যখন সব মানুষ একত্রিত হবে এবং সেদিন যা কিছুই ঘটবে প্রত্যেকের চোখের সামনে ঘটবে। সেদিন আমার জন্যে আমি খুব বেশী দেরি করছিনে। মোট কথা তার জন্য সময় নির্ধারিত রয়েছে। যখন সেদিন এসে পড়বে- কারো কথা বলার সাহস হবে না। অবশ্য আল্লাহ্র অনুমতিতে কিছু বলতে পারা যাবে।
“ সেদিন কেউ দুর্ভাগা হবে এবং কেউ হবে সৌভাগ্যের অধিকারী। যারা দুর্ভাগা হবে তারা জাহান্নামে যাবে। সেখানে গরম ও পিপাসার প্রচণ্ডতায় ছটফট করবে এবং এ অবস্থাতেই তারা ততদিন থাকবে-যতদিন আকাশ ও মাটি বর্তমান থাকবে। অবশ্য তোমার প্রভু যদি অন্যকিছু চান, নিঃসন্দেহে তোমার প্রভু পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী তিনি যা চান তাই করেন। আর যারা সৌভাগ্যের অধিকারী হবে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং সেখানেই চিরজীবন অবস্থান করবে। যতদিন আকাশ ও মাটি বর্তমান থাকবে। অবশ্য তোমার প্রভু যদি অন্য কিছু চান তারা এমন পুরস্কার পাবে যার ধারা কোনদিন শেষ হবে না”।
সুতরাং কোন ব্যক্তি বিশেষের মৃত্যুতে, তা সে যে কেউ হোক না কেন- আল্লাহ্র পথের মুজাহীদের মনে কোন প্রভাব পড়ে না। কেননা মৃত্যু একান্ত সত্য। এজন্যে মৃত্যু সম্পর্কে কোন দুশ্চিন্তা নেই। তাদের কাছে বিবেচনার যোগ্য বিষয় হচ্ছে আল্লাহ্র আনুগত্য করে তাঁরই সন্তুষ্টির ছায়াতলে জীবন যাপন করা এবং তাওহীদের শ্রেষ্ঠ পয়গাম তুলে ধরার সংগ্রামে মন-প্রাণ ঢেলে কাজ করে যাওয়া। যখন তাদের কাছে এবং অন্যান্যদের মৃত্যুর ডাক এসে পড়ে তখন তারা জবাবদিহির জন্যে ইহলোক ত্যাগ করে চলে যায়। সেখানে প্রত্যেকের কর্মফল অনুযায়ী শাস্তি অথবা পুরস্কার দেয়া হবে।
ইসলামের সংগ্রামে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের বিরুদ্ধে নয় বরং ইসলামের সংগ্রাম হচ্ছে মিথ্যে বাতিলের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম, অবিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিশ্বাসের সংগ্রাম এবং আল্লাহ্র সাথে শিরককারী নাস্তিক, মূর্তি পূজারী শক্তির সাথে তাওহীদবাদীদের সংগ্রাম।
যার মৃত্যু অবধারিত সে মরবেই, আর যার ভাগ্যে শাহাদাত লেখা আছে তাকে শহীদ করে দেয়া হবে, মু’মিন অবশ্যই জান্নাতের প্রশস্ত মনোরম বাগানে ঠাঁই পাবে। আল্লাহ্র অত্যন্ত ঘনিষ্টতায় জান্নাতুল ফেরদৌস পাবে তারা। তাতে থাকবে মৃদু প্রবাহমান সুদৃশ্য ঝর্ণাধারা আর দিগন্ত-বিস্তৃত সুশোভিত উদ্যান। আর শহীদদের ব্যাপার তো বলা হয়েছে- তারা চিরঞ্জীব। তাদের মৃত্যু নেই।
“ হে আমার বান্দারা আজ তোমাদের কোন ভয় নেই, কোন দুঃখ তোমাদের স্পর্শ করবেনা। তোমরা এবং তোমাদের স্ত্রীগণ জান্নাতে প্রবেশ কর। তোমাদেরকে সুখী-সন্তুষ্ট করা হবে। ওদের সামনে সোনার তশতরী এবং পানপাত্র রাখা হবে এবং তাতে লোভনীয় ও আকর্ষণীয় দ্রব্যাদি মওজুদ থাকবে। দুনিয়াতে তোমরা যেসব সৎকর্ম করেছ তারই ফলশ্রুতিতে তোমরা এই জান্নাতে ওয়ারিশ হতে পেরেছ। তোমাদের খাবার জন্যে রয়েছে এখানে অফুরন্ত ফলমূল”।
কুফর, বাতিল ও নাস্তিক্যবাদদের উপর যারা নিহত বা মৃত্যুবরণ করেছে তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী। জাহান্নাম সম্পর্কে তোমরা কিইবা জান? তা তোমাদেরকে ধ্বংস করবে এবং তাত্থেকে কোন ক্রমেই নিষ্কৃতি পাবেনা। তোমাদের এই চেহারা আর শরীর তাতে জ্বলে-পুড়ে যাবে। এক চামড়া পুড়ে গেলে দ্বিতীয় চামড়া তার স্থান দখল করবে- এই জন্যেই যে তা কষ্ট পেতে পারে। ওদের উপরে নীচে আগুন আর আগুন হবে এবং আগুনের লেলিহান শিখা তাদের ঘিরে রাখবে। তারা যদি পানি চায় তাহলে তাদেরকে এমন উত্তপ্ত পানি দেয়া হবে , যার বাস্পে তাদের চেহারা ঝলসে পড়বে। আর তা হবে অত্যন্ত ময়লা এবং বিস্বাদ ও দূষিত পানি। তাতে ক্ষুৎ-পিপাসার তীব্রতা বিন্দুমাত্র কমবে না।
“ ওদের জন্যে রয়েছে জাহান্নামের আগুন, সেখানে তারা মরবেও না এবং তাদের জন্যে জাহান্নামের শাস্তিও কমানো হবে না। এভাবেই আমরা প্রতিফল দিয়ে থাকি”।
“ আল্লাহ্কে অস্বীকারকারী প্রতিটি কাফের সেখানে চিৎকার করে বলবে- হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে এখান থেকে বের করে দাও। আমরা সৎ কর্ম করবো, যা আমরা আগে করেছি, এখন হবে তাত্থেকে ভিন্নতর”।
তাদের জবাবে বলা হবে-
“ আমি কি তোমাদেরকে এতটা বয়স দিয়নি, যাতে তোমরা কোন শিক্ষা গ্রহণ করতে চাইলে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারতে? এখন মজা দেখ। অত্যাচারীদের জন্যে এখানে কোন সাহায্যকারী নেই”। আল্লাহ্ যেভাবে চান সেভাবেই জীবন কাটাতে থাকবে। বয়সের পর বয়স জীবনের পর জীবন শেষ হতে থাকবে কিন্তু কোন ব্যাক্তি আল্লাহ্র ইচ্ছের রদবদল করতে পারবে না।কোন কোন লোক আব্দুন নাসেরের মৃত্যুতে চেঁচিয়ে কান্না কাটি করে অবস্থাকে শোকার্ত করে তুলছিল। দিন-রাত তার শোক গাঁথা গাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সব কিছুই হচ্ছিল লোক দেখানোর জন্যেই। এসব কান্নাকাটি আর শোক প্রকাশে তাদের লেশমাত্র ও আন্তরিকতা ছিল স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে, সব কিছু হচ্ছিল কৃত্রিমতায় ভরা অভিনয়ের মতো। মাত্র কয়েক বছর আগেও আমার ঘরে বসে এক ব্যক্তি বলেছিল- যারা আব্দুন নাসেরকে ইসলামের খাদেম মনে করে তারা কাফের। আজ সেই ব্যক্তির মুখেও নাসেরের শোক গাঁথা শুনছি। এ ধরণের ব্যক্তি তাদের বিবেককে এভাবেই বিক্রি করে। এরাই দুনিয়া ও আখেরাতের ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকে। এ অবস্থায় যখন নাসেরের মৃত্যুতে কৃত্রিম শোক-দুঃখের প্লাবন বইছিল, আমরা আল্লাহ্র পক্ষে থেকে তার যাত্রাকে স্বাগত জানাই। নাম মাত্র ঈমানদারদের পক্ষেও যেভাবে স্বাগত জানানো সম্ভব আমরা ঠিক সেভাবেই তা জানিয়েছি।
“ এবং অত্যাচারী শীগগির জেনে নেবে যে, তার পরিণাম কি”।
কানাতির জেলে এ খবর বেশ সরগম হয়ে উঠলো যে, আমরা নাসেরের মৃত্যুতে কোন রকম শোক বা দুঃখ প্রকাশ করিনি এবং তথাকথিত মহানায়কের মৃত্যুতে আমরা বিন্দুমাত্র শোকগ্রস্থ হয়নি। তাই তার অনুসারী ব্যাক্তিরা আমাদের উপর খুব ক্ষেপে উঠে। ওরা তাদের লোভ-লালসা ও হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে সব সময় তাদের মনিবের খেদমতে অনুগত থাকার শপথ করে রেখেছিল। সুতরাং আমাদের উপর তাদের ক্রোধ প্রকাশের জন্যে শীঘ্রই প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে। তাদের মতে; এটা কিভাবে সম্ভব যে, আমরা নাসেরের মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করবো না।
বুদ-বুদ উড়ে যায়
বুদ-বুদ উড়ে যায়, কিন্তু যা মানুষের জন্যে উপকারী তা মাটিতে অবস্থান করে। বলাবাহুল্য, মুনাফেক এবং কৃত্রিম শোক প্রকাশকারী পোষা চাটুকাররা তৎপর হয়ে উঠলো। এরা তাদের মনিবদের মনতুষ্টির উদ্দেশ্যে অতি ক্ষুদ্র ব্যাপারেও আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করে দিল। নাসেরের মৃত্যুর দ্বিতীয় দিন সকালে মহিলা-জেলার আমাদের কক্ষের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে হটাৎ লোহার এক ভারী রড প্রচণ্ডবেগে আমার মাথায় ছুঁড়ে মারে। কিন্তু আল্লাহ্র রহমতে আমি সেই মারাত্মক আঘাত থেকে বিস্ময়করভাবে বেঁচে যাই। নয়তো আমার মাথা ফেটে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতো। এতবড় অপরাধের জন্যেও জেল কর্তৃপক্ষ তাকে কোন শাস্তি দেয়নি, জবাবদিহি পর্যন্ত নেয়নি। সেই অপরাধী জেলার দিব্যি নিশ্চিন্তে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছিল, যেন সে কোন অপরাধই করেনি। ঠিক সে সময়ই আমার আত্মীয়-স্বজন আমাকে দেখতে এলে আমি তাদেরকে এ ব্যাপারে অবহিত করি। তাঁরা ছোটবড় সব দায়িত্বশীল অফিসারের সাথে দেখা করে এবং ঘটনার উল্লেখ করে সরকারী দপ্তরে টেলিগ্রাম পাঠান। শেষ পর্যন্ত আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় দুর্ঘটনার তদন্ত করতে বাধ্য হয়। তদন্তে জেলারকে ঘটনার জন্যে দায়ী করে বলা হয় যে, সে মানসিক রোগিনী।
আমি আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়কে জানাই যে, তাদের তদন্ত অসম্পূর্ণ রয়েছে। তাই ঘটনার পিছনে জেলারের মস্তিস্কে নয়, বরং ইসলাম বিরোধী চক্রেরই সুচিন্তিত পরিকল্পনা কার্যকরী রয়েছে। এজন্যে জেলার বেচারীকে শাস্তি দেয়ার কোন অর্থই হয় না। সে নিজের কোন পদক্ষেপের জন্যে দায়ী নয়; সে তো উপর ওয়ালাদের ইঙ্গিতে তা করেছে। তারা ইসলামের সেবকদের সন্ত্রস্ত করতে চেয়েছে। কিন্তু আল্লাহ্র ইচ্ছাই বিজয়ী থাকবে।
এ ধরণের নতুন পরোক্ষ শাস্তির কথা আমি ভাবতেও পারিনি। অভাবনীয় অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নাসেরের পোষ্যরা এ ধরনের পরোক্ষ আঘাত হানার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। বস্তুতঃ আল্লাহ্ যাদের বিভ্রান্ত করে দেন তাদেরকে কেউ সৎ পথে আনতে পারে না।
নতুন পরীক্ষা
ঊনিশ শো একাত্তরের ৯ই আগস্ট সকালে আমার সামনে আরেক নতুন পরীক্ষা এসে উপস্থিত। মহিলা জেলার ছুটে এসে আমাকে বলল।
: কমিশনার আপনাকে তাঁর অফিসে ডাকছেন।
এই অস্বাভাবিক আহ্বান আমার মনে নানা রকমের উৎকণ্ঠার উদ্রেক করে কি জানি কি হবে? কি জানি জালিমরা কোন্ নতুন ফন্দি এঁটেছে? আমরা কারাগারে বসেও ইসলাম প্রচার করছি এবার বুঝি এই অভিযোগ তোলা হবে? অথবা হতে পারে বাড়ী থেকে কোন খবর এসে থাকবে। এ ধরনের অনেক কথাই ভাবছিলাম। কিন্তু সত্যি সত্যি যা হতে যাচ্ছিল সে ব্যাপারে আমার আদৌ কোন অনুমানও ছিলনা।
আমি কমিশনারের অফিসে পৌঁছলে আমাকে মুক্তির আদেশ শোনানো হয়। কি আজব ব্যাপার। আমাকে ওরা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েও স্বস্তি পাচ্ছিল না! তা’যাই হোক, আমি তা মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে যাবো কিন্তু হামীদা কি এই পুঁতিগন্ধময় দুঃসহ পরিবেশে পড়ে থাকবে? শঙ্কায় আমার বুক কেঁপে উঠলো। আমি অজান্তেই চিৎকার করে উঠে বললাম-
: না,…… না এটা কক্ষণো হতে পারে না। আমি আমার হামীদাকে ছেড়ে কখনো বের হবো না। তোমরা সব জালিয়াতী আর বিধ্বংসী পরিকল্পনাকারী। ক্রোধে ফেটে পড়ছিলাম আমি। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে সারা অস্তিত্ব আমার কাঁপছিলো।
কমিশনার আমার অবস্থা দেখে আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন-
: আমরা এই আদেশের বিন্দুমাত্র বিরোধিতাও করতে পারিনি। তোমাকে এখানে আনা হয়েছে উপর ওয়ালাদের হুকুমে এবং বের করাও হচ্ছে উপওয়ালাদের হুকুমে। এ ব্যাপারে আমরা তোমাদের মতোই অসহায়।
কয়েক মুহূর্ত পরে দেখলাম হামীদাও কমিশনারের অফিসে এসে পৌঁছেছে। আমাকে বুঝিয়ে শান্ত করার জন্যেই কমিশনার তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। আমার জন্যে এটা ছিল ভীষণ রকমের পরীক্ষা। অত্যন্ত মর্মপীড়া অনুভব করছিলাম আমি। আমি আমার হামীদাকে কিভাবে একা এই কারাগারে ছেড়ে যেতে পারি। তার মতো মহীয়সী মেয়েকে এই জঘন্য নোংরা জেলের পরিবেশে একা ছেড়ে যাবার কথা ভাবতে আমার সারা শরীর ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। আমি অনুভূতির তাগিদে আবার অজান্তে চিৎকার করে বলি-
: না,না, কক্ষনো নয়। আমি ওকে কোন অবস্থাতেই একা ছেড়ে যাবো না……
আমার অবস্থা দেখে হামীদা শান্ত নম্রভাবে বলল-
: এটা আমাদের উপর আল্লাহ্র মেহেরবানী এবং রহমত বৈ-কি! সব কিছুই তাঁরই নির্দেশে হয়ে থাকে। আর আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের ভুলেন না। তিনি আমাদের নেগাহ্বান আপনি নিশ্চিন্ত হোন। এভাবে কথোপকথনে অনেক সময় কাটে। কমিশনার হামীদাকে অনুরোধ করে বললেন-
: আপনি তাঁকে সালাম জানিয়ে নিজের কক্ষে ফিরে চলুন।
সে মুহূর্তটি ছিল অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। সে সময়ের অনুভূতি উপলব্দিকে কোনক্রমেই ভাষায় রুপান্তরিত করা সম্ভব নয়। আমরা পরস্পর গলা জড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ি। হৃদয়ে জাগছিল মহাসাগরের উত্তাল বিক্ষুব্ধ ঊর্মিমালা,শ্বাস-প্রশ্বাসে ছিল প্রচণ্ড ঝড়ের বেগ আর দু’চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল উত্তপ্ত ফল্গু ধারার মতো।
অন্তরের সেই অভূতপূর্ব উদ্বেলতা আর অনুভূতির করুণ সন্ধিক্ষণে আমি নিজেকে কমিশনারের কক্ষে একাকী অনুভব করলাম। কমিশনার আমার মুক্তির কাগজ-পত্রে আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর করেন এবং আমি অস্থির-চিত্ত, বিচলিতপ্রাণ আর প্রবাহমান অশ্রু সম্বল করে মুক্ত দুনিয়ার দিকে প্রথম কদম তুললাম।
শেষ পাঁয়তারা
আমার বাড়ীর দিকে দ্রুতগামী গাড়ীটি হটাৎ পথ পরিবর্তন করে সরকারী তদন্ত দপ্তরে গিয়ে দাঁড়ায়। আমাকে একটি কক্ষে পৌঁছানোর পরপরই দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। এখানে বেলা দু’টো থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত এভাবেই পড়ে থাকি। এরপর আমাকে একটি অফিসে কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে দু’জন অফিসার বসেছিল। তারা উভয়েই আমাকে ইসলামী জীবনাদর্শ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন করলো। তারা এও জিজ্ঞেস করলো যে-
: এরপর কি আপনি ইখওয়ানের সাথে যোগাযোগ রাখবেন?
আমি তাদের জিজ্ঞাসা এড়িয়ে গিয়ে বললাম-
: আমাকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড থেকে মুক্তি দেয়া হলো কিন্তু হামীদাকে আটক রাখা হলো কেন? তোমরা আসলে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাচ্ছ। কিন্তু জেনে রেখ, আল্লাহ্ কক্ষনো তোমাদের দুরভিসন্ধি পূর্ণ হতে দেবেন না।
এদের একজন বলল-
মুহতারেমা জয়নব! আপনি শান্ত হোন।
আমি বললাম-
: তোমরা আমাদেরকে ধোঁকা এবং প্রতারণার জালে আটকাতে চাও। অথচ তোমাদের উপর আল্লাহ্ রয়েছেন। তাঁর সিদ্ধান্তই কার্যকরী হবে। যদিও অধিক সংখ্যক লোক তা জানেনা।
সে বলল-
: দেখুন জয়নব! এটা উপর ওয়ালাদের হুকুম। আমরা এর বেশী কিছুই করতে পারিনে।
এরপর আমাকে আহমদ রুশদীর অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।
: এই সেই ব্যক্তি যার নেপথ্য ইঙ্গিতে সামরিক কারাগারের জল্লাদেরা আমার উপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিল। এর মতো ধোঁকাবাজ ও চালবাজ খুব কম লোকই পাওয়া যাবে। “বিভেদ সৃষ্টি করে শাসন চালাও” এই নীতিতেই সে বিশ্বাসী। আমি তার অফিস কক্ষে প্রবেশ করলে সে আমাকে তার সামনের সোফায় বসার অনুরোধ করে এবং মুক্তির জন্যে অভিনন্দন জানায়। এরপর তার ও আমার মধ্যে যে আলোচনা হয় তার সারমর্ম হলো এই যে, তার কথামতো-
আমি আমার ইসলামী তৎপরতা বন্ধ করবো।
আমি আমার ইসলামী ভাই এবং বন্ধুর সাথে দেখা করবো না।
তাঁদের সাথে কোন পারস্পরিক সহযোগিতা করবো না এবং স্নেহ মমতার কোন সম্পর্কও রাখবো না। এবং সময়ে আমি তার অফিসে এসে হাজিরা দেবো। আর এসব শর্ত সাপেক্ষ কথা শেষ হলে আমি স্পষ্ট করে বলে দিলাম যে-
: যে সব কথা তুমি এখন আমাকে বললে- তা সর্বসামগ্রিকভাবে আমি প্রত্যাখ্যান করছি। বরং তোমরা আমাকে মুক্তি দেয়ার যে আদেশ দিয়েছো- তাকেও প্রত্যাখ্যান এবং অস্বীকৃতি জানাচ্ছি। তুমি আমার এই প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকৃতি কথা তোমার বড় কর্তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দাও। আর আমি এক্ষুণিই আমাকে আবার কানাতীর জেলে ফেরত পাঠাবার দাবী করছি।
আহমদ রুশদী তার কথা বাদ দিয়ে হাসতে হাসতে বললো-
: অনেক ইখওয়ানী আমাদের শর্তে সমঝোতা করছেন।
আমি তার কথা কেড়ে নিয়ে বললাম-
: খোদার শপথ। ইখওয়ানদের ব্যপারে আমার উত্তম ধারণাই বর্তমান আছে। কোন কোন ইখওয়ান সম্পর্কে তুমি যে কথার দাবী করছ সে সম্পর্কে আমি কিছুই বলতে চাই না। অবশ্য ওঁদের ব্যাপারে তোমার কথাকে আমি সত্য বলে মনে করিনে। নিঃসন্দেহে ইখওয়ানীরা সত্যবাদী এবং সত্যের পথে আপোষহীন। এই সত্যের জন্যেই তাঁরা রাতদিন কর্মব্যস্ত রয়েছেন এবং আল্লাহ্র সাহায্য বা শাহাদাত না পাওয়া পর্যন্ত তাঁরা সত্যের সংগ্রামে অটল অবিচল থাকবেন।
এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠলো। আহমদ রুশদী রিসিভার তুলে হ্যালো বলার পরক্ষনেই আনন্দ প্রকাশ করল বললো-
: আহ্লান ও সাহলান। (স্বাগত স্বাগত) হে অধ্যাপক আব্দুল মোনায়েম। আসুন! আসুন! আপনারই অপেক্ষায় আছি।
এরপর রিসিভার রেখে দিয়ে বললো-
: আব্দুল মোনায়েম গাজালী আসছেন।
একটু পরেই আমার ছোট ভাই অধ্যাপক আব্দুল মোনয়েম এসে আমাকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সালাম জানালো। আহমদ রুশদী আমার ভাইকে বলল আপনি ও আপনার বোন জয়নবের মধ্যে মধ্যস্থতা করে দিন। আমাদের মদ্ধেও এখনো মত বিরোধ রয়ে গেছে।
আমার ভাই বলল-
: তিনি আমার বড় এবং আমি তাঁর ছোট ভাই। তাঁকে বোঝানোর সাহস আমার নেই। আর আপনি অনুমতি পেলে এতটুকু কথা বলতে চাই যে যুক্তিতর্ক এবং বাগ্মিতার দিক দিয়ে তাঁর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে।
আহমদ রুশদী এবার বলল-
: ঠিক আছে জয়নব! আপনাকে মুবারকবাদ। ব্যাস্ ইখওয়ান সংগঠন থেকে একটু দূরে সরে থাকবেন আর তার সাথে মিলে কাজ করার জন্যে কাউকেও অনুপ্রাণিত করবেন না।
আমি তাকে বললাম-
: গোপন সমস্ত সংগঠনের কাহিনীটা আগাগোড়া তোমাদের উর্বর মস্তিষ্কের ফসল। দেখ, ইসলামী শাসক ও সরকার কায়েমের প্রচেষ্টা চালানো প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ অর্থাৎ সামষ্ঠিক দায়িত্ব। এর প্রস্তুতির জন্যে আল্লাহ্র পথে মানুষকে আহবান জানাতে হবে, যেভাবে প্রিয়নবী এবং তাঁর সাহাবারাও মানুষকে ডেকেছিলেন। এটা প্রত্যেক মুসলমানের সাধারণ দায়িত্ব। এতে ইখওয়ানী বা অ-ইখওয়ানীর কোন প্রশ্ন ওঠে না।
এরপর আমি আমার ভাইয়ের সাথে যখন বাড়ী পৌঁছাই তখন রাত তিনটে আর তারিখ ছিল ১০ই আগস্ট ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ।
— সমাপ্ত —