তৃতীয় কারণ: মুসলমানদের ইতিহাসে একটি তৃতীয় কারণেরও সন্ধান পাওয়া যায়, এটাও আমাদের জানা উচিত। রাসূলুল্লাহ (সা) –এর যুগে যে ব্যক্তি ঈমান আনতেন তিনি জাহেলিয়াতের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতেন। ইসলামের প্রশান্তির ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণের পর তিনি এক নতুন জীবন শুরু করতেন। আল্লাহর বিধান সম্পর্কে অজ্ঞাতায় নিমজ্জিত আগেকার জীবন যাত্রা থেকে নওমুসলিমগণ সম্পূর্ণরূপে পৃথক হয়ে নতুন সমাজে যোগদান করতেন। অজ্ঞতার যুগে তিনি যে ভ্রান্ত উপায়ে জীবন যাপন করেছেন সে জন্যে অনুতপ্ত হয়ে সর্বদা ভয়ে ভয়ে জীবন যাপন করতেন এবং ইসলামে প্রবেশের পর পুরাতন পদ্ধতির সাথে কোন সম্পর্ক রক্ষা করাই যে অনুচিত তা পূর্ণরূপে বিশ্বাস করতেন। যদি কোন সময় মানবীয় দুর্বলতার জন্যে পুরাতন জীবনযাত্রা প্রণালী তাঁর উপর প্রভাবশীল হতে বা পুরাতন অভ্যাস তাঁকে আকর্ষণ করার দরুন তিনি ইসলামের নির্দেশ পালনে কোন ত্রুটি –বিচ্যুতির শিকারে পরিণত হতেন; তাহলে অনুতাপ ও অনুশোচনায় তিনি চঞ্চল হয়ে উঠতেন এবং তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংশোধন করার জন্যে কুরআনের দিকে ধাবিত হতেন।
এভাবে ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানদের জীবন আগেকার জাহেলিয়াতের জীবন-যাত্রা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে বয়ে চলতো। যেহেতু ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তি পূর্বাহ্ণে ভালভাবে চিন্তা-ভাবনা করেই পদক্ষেপ নিতেন, সে জন্যেই তিনি ইসলামের বিধি-নিষেধগুলো পুরোপুরি মেনে নিয়ে জাহেলিয়াতের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতেন। অবশ্য মুশরিকদের সাথে বৈষয়িক লেন-দেন অব্যাহত রেখেই তাঁরা জাহেলিয়াতকে বর্জন করতেন। কারণ, বৈষয়িক লেন-দেন ও আদর্শের সমঝোতা দু’টো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।
জাহেলিয়াতের পরিবেশ, রীতিনীতি, চাল-চলন ও চিন্তা-ভাবনা বর্জন করার মূলে ছিল আল্লাহ ও জগত সম্পর্কে শিরকবাদী ভ্রান্তধারণার পরিবর্তে তাওহীদভিত্তিক জীবন দর্শন গ্রহণ করে— মুসলমানদের দলে যোগদান এবং এ নতুন সমাজের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে পরিপূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন।
ইসলাম গ্রহণের অর্থই ছিল নতুন পথে জীবন যাপন। জাহেলিয়াতের সকল মূল্যবোধ ও ধ্যান-ধারণার প্রভাব মুক্ত এক নব জীবন। বিরোধী পক্ষের নির্যাতন ছাড়া মুসলমানেরা অন্য কোন অসুবিধার সম্মুখীন হননি। কিন্তু ইসলামের পথে পা বাড়ানোর আগেই তাঁরা তাঁদের অন্তরের অন্তস্থলে সকল অমানুষিক অত্যাচারের মুখে দৃঢ় থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তাই অত্যাচারীদের নিষ্ঠুর নির্যাতন মুসলমানদের অটল ধৈর্যে কোন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারেনি।
আমাদের করণীয়
বর্তমানে আমরাও সে যুগের মতই জাহেলিয়াতের বেষ্টনীতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি এবং বর্তমানের জাহেলিয়াত সে যুগের চাইতেই অধিক মারাত্মাক। আমাদের সমগ্র পরিবেশ, জনগণের বিশ্বাস ও আকীদা, স্বভাব-চরিত্র ও রীতিনীতি সবই জাহেলিয়াত। এমন কি আমরা যেসব বিষয়কে ইসলামী সংস্কৃতি, ইসলামী উৎস, ইসলামী দর্শন ও ইসলামী চিন্তাধারা বলে জানি, সেগুলোও জাহেলিয়াতেরই সৃষ্টি।
এ জন্যেই আমাদের অন্তরে সত্যিকার ইসলামী মূল্যবোধ স্থান লাভ করে না। এ জন্যই আমাদের হৃদয় কখনো ইসলামী ধারণা বিশ্বাসের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে না। এবং এ জন্যেই ইসলামের স্বর্ণযুগে যেসব পথিকৃৎ জন্মেছিলেন, তাঁদের সমগুণ সম্পন্ন লোক আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় না।
তাই ইসলামী আন্দোলনের সূচনায় এবং আমাদের প্রশিক্ষণের প্রাথমিক স্তরে জাহেলিয়াতের প্রভাবাধীন বর্তমান পরিবেশ থেকে আমাদের নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করে নিতে হবে। আমাদের সে নির্ভেজাল উৎস থেকেই জ্ঞান আহরণ করতে হবে, যেখান থেকে সাহাবায়ে কিরাম (রা) পথের সন্ধান লাভ করেছিলেন। আর ঐ উৎসটিকে যত্নসহকারে সর্বপ্রকার ভেজাল ও সংমিশ্রণ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। এখান থেকেই সৃষ্টিজগতের গতিধারা, মানব প্রকৃতির এ সর্বোচ্চ ও সুমহান সত্তা প্রকৃত আল্লাহ তাআলার সাথে সৃষ্টজগত ও মানব প্রকৃতির সম্পর্ক বিষয়ে জ্ঞান হাসিল করতে হবে। একই উৎসসমূহ থেকে আমাদের সরকার পরিচালনা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও জীবনের অন্যান্য বিভাগ সম্পর্কে মৌল ধারণা ঠিক করে নিতে হবে।
আমরা নিছক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা এবং আনন্দ উপভোগ করার জন্যে ইসলামের মৌল উৎসের দিকে ফিরে আসবো না। বরং আল্লাহর আনুগত্য করা ও ইসলামী বিধান মেনে চলার উদ্দেশেই এ পথ অবলন্বন করবো। ইসলাম আমাদেরকে যে দরনের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে বলে, ঠিক সে ধরনেই আমরা নিজেদেরকে গড়বো। সাথে সাথে আমরা কুরআনের সহিত্যক মান, অপরূপ বর্ণনাভংগী, কিয়ামতের চিত্রাংকন, যুক্তিবিদ্যা এবং এ জাতীয় অন্যান্য সম্পদ সম্পর্কে গবেষণা চালিয়ে যাব। এসব বিষয় থেকে আমরা অবশ্যই উপকৃত হবো, কিন্তু এগুলো কুরআন অধ্যয়নের মূর উদ্দেশ্য নয়। আমরা কুরআন থেকে জানতে চাই, কুরআন আমাদের জন্যে কোন ধরনের জীবন পদ্ধিত পেশ করে। সৃষ্টিজগত সম্পর্কে কুরআন আমাদের কোন দৃষ্টিভংগী শিক্ষা দেয়, আল্লাহ তা আলাকে কিভাবে উপস্থাপিত করে, কোন ধরনের নৈতিক মান ও আচার –ব্যবহার শিক্ষা দেয় এবং বিশ্বের মানব সমাজের জন্যে কোন ধরনের আইন ও শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেয়।
সাথে সাথে আমাদেরকে জাহেলিয়াতের সমাজ বিজ্ঞান, ধ্যান-ধারণা, আচার-ব্যবহার ও জাহেলী নেতৃত্বের কবল থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হতে হবে। আমরা জাহেলিয়াতের সমাজ ব্যবস্থার সাথে আপোষ করতে পারি না। ঐ ব্যবস্থা মেনে নিয়ে তার অধীনে জীবন যাপন করা আমাদের জন্য সম্ভব নয়। ঐ সমাজের সাথে সৌহার্দ স্থাপন এ জন্যে সম্ভব নয়, ঐ ব্যবস্থা ভ্রান্ত। তাই প্রথমে আমাদের নিজেদের জীবন পরিবর্তন করে নিয়ে ঐ সমাজের পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
আমাদের প্রধান লক্ষ্য হবে জাহেলী সমাজের সকল রীতিনীতির পরিবর্তন সাধন। এ পরিবর্তন আসবে সমাজের গোড়া থেকেই। কারণ, জাহেলী সমাজের ভিত্তিই স্থাপিত রয়েছে ভ্রান্ত মতবাদের উপর, এ জন্যে তা ইসলামের বিপরীত এবং এ ব্যবস্থা শুধুমাত্র পাশবিক শক্তি ও অত্যাচারের মধ্য দিয়ে আমাদেরকে আল্লাহর মনোনীত জীবন ব্যবস্থারসকল সূফল প্রাপ্তি থেক দূরে সারয়ে রাখে।
প্রথমত আমাদের নিজেদরকে জাহেলী মূল্যবোধ ও ধ্যান-ধারণার উপর রচিত জীবন বিধানের নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত ভ্রান্ত সমাজের সাথে আপোষ করার উদ্দেশ্যে আমরা আমাদের মূল্যবোধ মোটই পরিবর্তন করবো না। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ও প্রচলিত বাতিল সমাজ ব্যবস্থায় যাত্রা-পথ সস্পূর্ণ ভিন্ন। আমরা যদি জাহেলিয়াতের পথ ধরে চলি, তাহলে গন্তব্যস্থলে কখনো পৌছাতে পারবো না।
আমরা অবগত আছি যে, এ পথে পা বাড়ানোর সাথে সাথেই অনেক অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তি আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়াবে এবং আমাদের অনেক ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করতে হবে। তবু স্বর্ণযুগের যেসব মযলুমদের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাঁর দ্বীনকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত ও জাহেলিয়াতকে পদদলিত করেছিলেন, সে মহান ব্যক্তিদের পদাংক অনুসরণ করতে হলে আমাদের এসব বাধা-বিপত্তির দরুন পিছিয়ে গেলে চলবে না।
ভবিষ্যত চলার পথ সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ঠ জ্ঞান থাকা দরকার। কোন পথ ধরে আমরা রওয়ানা হবো, চলার পথে আমাদের কোন কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে এবং অজ্ঞতার ঘোর অন্ধকার থেকে ইসলামের আলোকোজ্জল রাজপথে পৌছার আগে কোন কোন গলিপথ অতিক্রম করতে হবে এবং মহানবী (সা)-এর মহান সাহাবীগণ কিভাবে সফলতা অর্জন করেছিলেন, এসব বিষয়ে ভালো করে জেনে নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু করতে হবে।