অষ্টম অধ্যায়
ইসলাম ও কৃষ্টি
ষষ্ঠ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি যে, ইসলামী জীবনাদর্শ প্রথম স্তম্ভের প্রথম অংশ হচ্ছে এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর সমীপে আত্মপমর্পণ। এটাই হচ্ছে, কালেমায়ে ‘লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহু’র অর্থ। এ স্তম্ভের দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে এই যে, আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পিত জীবন যাপনের উপায় –পদ্ধতি হযরত মুহাম্মাদ (সা) থেকে গ্রহণ করতে হবে। কালেমায়ে তাওহীদের দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) — এ অর্থই প্রকাশ করে। আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণ ও তাঁর বন্দেগীর বাস্তব নমুনা হচ্ছে আকীদা-বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বাস্তব কর্মজীবনের এবং আইন-কানুন প্রণয়ন ও আইনের আনুগত্যের ব্যাপারে একমাত্র আল্লাহকেই মাবুদ হিসেবে মেনে নিতে হবে। কোন মুসলমানই আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন শক্তিকে আল্লাহর মর্যাদার অধিকারী অথবা ইবাদাতের যোগ্য বিবেচনা করতে পারে না। মুসলমান কখনো আল্লাহ ছাড়া অন্য সৃষ্ট জীবের পূজা-উপাসনা করা বা তাকে সার্বভৌম শক্তি হিসেবে স্বীকার করে নেয়ার বিষয়ে চিন্তাই করতে পারে না।
পূর্বের অধ্যায়ে আমরা ইবাদাত, ঈমান এ সার্বভৌমত্বের ব্যাখ্যা দান করেছি। এ অধ্যায়ে আমরা সার্বভৌমত্বের তাৎপর্য ও কৃষ্টির সাথে তার সম্পর্ক আলোচনা করব।
শরীয়াতে ইলাহীর সীমারেখা
ইসলামী দৃষ্টিভংগী অনুসারে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব শুধু আইন প্রণয়নের উৎস হিসেবে গ্রহণ অথবা তাঁরই আইন মুতাবিক বিচার ফায়সালা করা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। ইসলামী শরীয়াতের অর্থও নিছক ব্যবস্থা শাস্ত্র নয়। শরীয়াতের ঐ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল রীতিনীতিই এর অন্তর্ভুক্ত। শরীয়াতের ঐ সংকীর্ণ ধারণা ইসলামী শরীয়াতের সঠিক পরিচয় নয়। মানুষের জন্যে আল্লাহ তাআলার দেয়া যাবতীয় নির্দেশাবলীই শরীয়াতে ইসলামের ভিত্তি। আকীদা-বিশ্বাস, শাসন পরিচালনার নীতি, বিচার –পদ্ধতি, নৈতিকতার মান, পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মূলনীতি ইত্যাদি সকল বিষয়ই শরীয়াতের অন্তর্ভুক্ত।
স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কে মানুষের ধ্যান-ধারণা,দৃশ্যমান জগত সম্পর্কে হোক অথবা অদৃশ্য জগত, মানুষের নিজস্ব সত্তা ও সৃষ্টি জগতে তার মর্যাদা ইত্যাদি মানব জীবন সম্পর্কিত সকল বিষয়াদিই ইসলামী শরীয়াতের অন্তরভুক্ত অনুরূপভাবেই রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াদি এবং এ বিষয়গুলোর মূলনীতি ইসলামী শরীয়াতের আওতাভুক্ত। এসব বিষয়ে আল্লাহ তাআলার সমীপে পূর্ণ আত্মসমর্পণই শরীয়াতে ইলাহীর লক্ষ্য। উপরোক্ত বিষয়াদির সাথে সাথে সমাজের আইন-গঠিত বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণও শরীয়াতেরই আওতাধীন কাজ। এ জন্য সাধারণত আমরা শরীয়াত অর্থে শুধু আইন-কানুন অথবা ব্যবস্থা শাস্ত্রকেই বুঝে থাকি। অথচ প্রকৃতপক্ষে শরীয়াতের পরিধি আরও বিস্তৃত। নৈতিক চালচলন এবং সমাজের মূল্যবোধ ও মূল্যমান যাচাই করার মানদণ্ড শরীয়াতেরই অঙ্গ। জ্ঞান চর্চার সকল বিষয় এবং বিজ্ঞান ও কলাশাস্ত্রের মূলনীতি শরীয়াতেরই অংশ বিশেষ। কারণ উল্লেখিত সকল বিষয়েই আইন-কানুন গঠিত বিষয়ের মতই আমরা আল্লাহ তাআলার হেদায়াতের মুখাপেক্ষী।
আইন-কানুন ও সরকার সংক্রান্ত বিষয়ে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়া সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। অনুরূপভাবেই নৈতিকতা, লেন-দেন, মূল্যমান এবং গ্রহণ ও বর্জনের মানদণ্ড বিষয়ে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে কার্যকরী করার প্রয়োজনীয়তাও স্পষ্ট ভাষায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্চে এই যে, মূল্যবোধ, গ্রহণ –বর্জনের মানদণ্ড,নৈতিকতা ও চাল-চলনাদি সামজের প্রতিষ্ঠিত আকীদা-বিশ্বাসেরই পরিণতি এবং যে ঐশী উৎস থেকে আকীদা বিশ্বাসের জন্ম, সে একই উৎস থেকেই উল্লেখিত বিষয়াদিও গৃহীত হয়ে থাকে।
কিন্তু সাহিত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস ও ঐশী জ্ঞান প্রয়োগের আলোচনা শুনে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, ইসলামী সাহিত্যের পাঠক এবং লেখক মণ্ডলীর মধ্য থেকেও অনেকেই আশ্চর্যান্বিত হন।
কলা বিজ্ঞান সম্পর্কে ইতিপূর্বে প্রকাশিক আমার একটি পুস্তকে একথা বলা হয়েছে যে, সকল প্রকারের কলাশিল্পই মানুষের আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন মাত্র। মানব জীবন ও বিশ্ব সম্পর্কে মন-মস্তিষ্কে যে ধারণা বিশ্বাস থাকে তা-ই শিল্পীর তুলিতে রূপ ধারণ করে প্রকাশ পায়। ইসলামী ধ্যান-ধারণা শিল্পকলাকে জন্ম দিয়ে থাকে। কারণ সৃষ্ট জগত সম্পর্কে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস সৃষ্টি ও স্রষ্টার সাথে মানুষের সম্পর্ক নির্ধারণ করে। বিশেষভাবে সৃষ্টি জগতে মানুষের স্থান ও মর্যাদা মানব জীবেনর উদ্দেশ্য ও ভূমিকা এবং মানুষের দায়িত্ব, তার জীবনের সঠিক মূল্য নিরুপণ ইসলামী আকীদারই অন্তর্ভূক্ত। কেননা, ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস শুধু কল্পনা ও চিন্তারাজ্যে সীমাবদ্ধ থাকার বিষয় নয় বরং তা হচ্ছে জীবন্ত, সক্রিয়, প্রভাবশালী ও সদা তৎপর ভাবাদর্শ এবং এ আকীদা-বিশ্বাসই মানুষের ভাবাবেগ ও কর্ম প্রবণতা প্রভান্বিত করে।
সারকথা হচ্ছে এই যে, শিল্পকলা ও সাহিত্য ক্ষেত্রে আল্লাহর বাণীর প্রয়োগ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। আগেই উল্লেখ করেছি যে, এ বিষয়ে আমার বক্তব্য সম্পর্কে শুধু শিক্ষিত ব্যক্তিই নয় বরং আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী অনেক মুসলমানও আশ্চর্যান্বিত হয়ে থাকেন।
ঈমান সম্পর্কে হোক অথবা জীবন সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা, পূজা –উপাসনার প্রকার –পদ্ধতি হোক অথবা নৈতিক ও পারস্পরিক আদান-প্রদান, মূল্যবোধ হোক অথবা গ্রহণ –বর্জনের মানদণ্ড, অর্থনীতি ও রাজনীতির রূপরেখা হোক অথবা ইতিহাসের ব্যাখ্যা, এসব বিষয়ের কোন একটির জন্যেও মুসলামান আল্লাহর অবতীর্ণ বাণী বাদ দিয়ে অন্য কোন উৎস থেকে হেদায়াত গ্রহণ করতে পারে না। তাই উল্লেখিত সকল বিষয়ে জ্ঞান আহরণের জন্যে মুসলমানকে সর্বদা কোন একজন জ্ঞানবান মুসলমানের শরণাপন্ন হতে হবে। কথিত জ্ঞানী ব্যক্তির কথা ও কাজ সর্বদা সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। তবেই তিনি সঠিকভাবে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দিতে পারবেন।
অবশ্য মুসলমানের জন্য অমুসলমানের নিকট থেকে বিশেষ বিদ্যা শিক্ষা করার অনুমতি রয়েছে। উদাহারণ স্বরূপ — রসায়ন মাস্ত্র, পদার্থ বিদ্যা, জ্যোতিশাস্ত্র, চিকিৎসা বিদ্যা, শিল্প, কৃষি, শাসনকার্য (শুধু প্রশাসনিক পদ্ধতি সম্পর্কে), কারিগরী বিদ্যা, সামরিক শিক্ষা এবং জাতীয় শিল্প-বিজ্ঞান ইত্যাদির নামোল্লেখ করা যেতে পারে। অবশ্য একথা সত্য যে, ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করার পর উল্লেখিত সকল বিষয়ে যথেষ্ট সংখ্যক বিশেষজ্ঞ সৃষ্টি করতে হবে। কারণ এসব বিষয়ে জ্ঞানার্জন করা মুসলমানের জন্যে ফরযে কেফায়া অর্থাৎ সমাজের প্রয়োজনানুসারে যথেষ্ট সংখ্যক লোক উপরোক্ত বিষয়গুলোতে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করবেন। অন্যথায় সমগ্র ইসলামী সমাজই গুণাহগার সাব্যস্ত হবে। তবে যতক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথেষ্ট সংখ্যক দক্ষ লোক সৃষ্টি না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলমান বিশেষ বিশেষ বিদ্যা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে ব্যুৎপত্তি লাভ করার জন্যে মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে বিশেষজ্ঞদের দ্বারস্থ হতে পারে কিংবা তাদেরকে বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব অর্পণ করাও যেতে পারে।
এ ধরনের বিষয়াদি সম্পর্কেই আল্লাহর নবী (সা) বলেছিলেন —
——————————————————-
অর্থাৎ পার্থিব বিষয়ে তোমরা অধিকতর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। এসব বিষয় জীবন, সৃষ্ট জগত, মানুষ ও তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য, মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য, সৃষ্ট জগত ও স্রষ্টার সাথে মানুষের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। এসব বিদ্যা সমাজের প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণকারী আইন প্রণয়নের নীতি, নৈতিকতা, চালচলন, প্রথা-পদ্ধতি, রীতিনীতি, অভ্যাস-আচরণ, মূল্যবোধ এবং গ্রহণ-বর্জনের মানদণ্ডের সাথেও সম্পর্কযুক্ত নয়। তাই অমুসলমানদের নিকট থেকে উপরোক্ত বিষয়গুলোতে বিদ্যা শিক্ষার ফলে মুসলমানের ঈমান বিকৃত হয়ে যাবার বা জাহেলিয়াতের দিকে ফিরে যাবার কোন আশংকা নেই।
কিন্তু মানুষের কর্মতৎপরতা অন্তনিহিত ভাবধারা ও তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে হলে (কর্মতৎপরতা ব্যক্তিগত হোক কিংবা সমষ্টিগত) মানুষের ব্যক্তিগত সত্তা ও মানবতার ইতিহাস বিশ্লষণ করতে হবে। অনুরূপভাবেই সৃষ্টির সূচনা এবং মানবজীবনের প্রারম্ভ সম্পর্কিত বিষয়াদি অধিবিদ্যার (Metaphysices) অন্তর্ভূক্ত (অর্থাৎ রসায়ন শাস্ত্র, পদার্থ বিদ্যা, জ্যোতিবিদ্যা ও চিকিৎসা বিদ্যার সাথে সংযুক্ত নয়) বিধায় এগুলো আইন-কানুন ও ব্যবস্থা শাস্ত্রেরই মত মানব জীবনের চালচলন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ বিষয়গুলো পরোক্ষভাবে মানুষের আকীদা-বিশ্বাসের উপর প্রভাব বিস্তার করে।
তাই একজন মুসলমান উল্লেখিত বিষয়গুলোতে জ্ঞান অর্জনের জন্য কোন অমুসলমানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে পারে না। মানুষের জীবন যাত্রা প্রণালীর উপর প্রভাব বিস্তারকারী সকল বিষয়ে শুধুমাত্র দ্বীনদার ও মুত্তাকী মুসলমানের নিকট থেকেই জ্ঞান লাভ করা যেতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষক সম্পর্কে মনে এ বিশ্বাস থাকার দরকার হবে যে,তিনি একমাত্র আল্লাহর দেয়া জ্ঞানের উপরই নির্ভর করেন। সারকথা হচ্ছে এই যে, মুসলমানের মন-মস্তিষ্কে বদ্ধমূল ধারণা থাকা দরকার যে, ঐসব বিষয় আকীদার সাথে জড়িত। তাই উল্লেখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে ঐশী বাণীর আলোকে মতামত ও চলার পথ স্থিরিকরণ বন্দেগীর অপরিহার্য অংশ এবং কালেমায়ে শাহাদাতের অবশ্য পূরণীয় দাবী।
অবশ্য জাহেলিয়াতের সমর্থক লেখকদের রচনা ও গ্রন্থাবলীতে কি কি পরিমাণ বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশিত হয়েছে এবং কি কি উপায়ে মানুষকে ঐসব ভ্রান্ত মতবাদ থেকে রক্ষা করা যায় তা জানার জন্যে তাদের মতামত অধ্যয়ন ও বিচার-বিশ্লষণ করতে কোন বাধা নেই। বরং মানুষকে সঠিকভাবে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের সাথে পরিচিত করানোর জন্যে এরূপ করা প্রয়োজন।
দর্শনশাস্ত্র, মানবেতিহাসের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ, মনস্তত্ব (অভজ্ঞতা ও পরীক্ষা –নিরীক্ষা লব্ধ ফলাফল ব্যতীত— কারণ এগুলো কারো মতামত নয় বরং অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষার বাস্তব ফল) নৈতিকতা, ধর্মতত্ত্ব এ বিভিন্ন ধর্মের তুলনামূলক আলোচনা, সমাজ বিজ্ঞান (পরিসংখ্যান ও অভিজ্ঞতা লব্ধ ফলাফল ব্যতীত) ইত্যাদি বিষয় অতীত এবং বর্তমান যুগের বিভিন্ন সময় নানাবিধ ভ্রান্ত মতবাদের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়েছে এবং হচ্ছে। বরং জাহলী আকীদা-বিশ্বাস ও মতবাদের ভিত্তিতেই উল্লিখিত বিষয়গুলোর পুরো কাঠামো রচিত হয়েছে। এ জন্যেই উপরোল্লিখিত বিজ্ঞানগুলোর বেশীর ভাগই দ্বীনের সাথে সংঘর্ষশীল এবং সাধারণভাবে সকল ধর্মের প্রতি এবং বিশেষভাবে ইসলামের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন।
মানুষের চিন্তা-গবেষণার বিষয়গুলোর মধ্যে উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো রসায়নশাস্ত্র, পদার্থ বিদ্যা, জীববিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান ইত্যাদির মত নয়। এ বিষয়গুলো যদি অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা –নিরীক্ষা লব্ধ ফলাফল পর্যন্ত সীমিত থাকে এবং আন্দায –অনুমানকে ভিত্তি করে কোন মতবাদ রচনার প্রয়াস না পায়— তাহলে তার দ্বারা আকীদা-বিশ্বাস নষ্ট হবার কোন কারণ নেই। কিন্তু যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষার সীমালংঘন করে কল্পনার আশ্রয় নেয়, তাহলে তা হবে অবশ্যই বিভ্রান্তিকর। উদাহারণ স্বরূপ ডারউইনের জীববিদ্যার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। জীববিদ্যা সম্পর্কে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতা করতে গিয়ে তিনি বিনা যুক্তি প্রমাণে ও বিনা প্রয়োজনেই সৃষ্টিতে জীবনের সূত্রপাত ও তার ক্রমবিকাশের আলোচনায় বস্তু জগতের বহির্ভূত কোন শক্তির অস্তিত্বে বিশ্বাস করার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করেছেন।
এসব প্রয়োজনীয় বিষয়ে মুসলমানদের নিকট আল্লাহ প্রদত্ত যে জ্ঞান রয়েছে, তা যথেষ্ট ও পরিপূর্ণ। আল্লাহর প্রতি অটল ঈমান ও তাঁর নিকট পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ সম্পর্কিত জ্ঞান অত্যন্ত উঁচু স্তরের জ্ঞান। মানুষের সকল কাল্পনিক মতবাদ ও যুক্তি-তর্ক আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের তুলনায় হাস্যকর প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।
কারো কারো অভিমত এই যে, কৃষ্টি মানবতার সমষ্টিগত উত্তরাধিকার। কোন বিশেষ দেশ বা জাতি ধর্মের গণ্ডীতে কৃষ্টি সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞান, কারিগরী বিদ্যার কার্যকুশলতা এবং তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পর্যন্ত একথা অনেকাংশে যথার্থ। তবে শর্ত হচ্চে এই যে, পরীক্ষা গবেষণার ফলাফল অতিক্রম করে অধিবিদ্যার দার্শনিক ব্যাখ্যা, মানব জীবেনর উদ্দেশ্য ও তার ঐতিহাসিক ভূমিকার বিচার বিশ্লষণ এবং সাহিত্য ও কলাশিল্প নিয়ে আন্দায-অনুমান ভিত্তিক মতবাদ রচনা থেকে বিরত থাকতে হবে। কিন্তু ‘কৃষ্টি’ ও ‘সৃংস্কৃতি’ কে মানবতার সমষ্টিগত উত্তরাধিকার আখ্যাদানকারীগণ উল্লেখিত শর্ত লংঘন করে চালবাজীর আশ্রয় গ্রহণ করেন। বিশ্বব্যাপি ইয়াহুদী ষড়যন্ত্রের একটি সুক্ষ্ম চাল হিসেবে এ মতের প্রবক্তাগণ কৃষ্টির নামে সকল প্রকার নৈতিক বন্ধন বিশেষত ধর্মীয় আকীদা-বিশ্বাস দুর্বল করে দেয়ার প্রয়াস পেয়ে থাকেন। বিশ্ব-রাজনীতির অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে সমগ্র দুনিয়ায় ইয়াহুদীদের অসদুদ্দেশ্য কার্যকর করার জন্যই তারা মানুষকে নৈতিক ও ধর্মীয় বিধিনিষধ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছেন। ইয়াহুদী ষড়যন্ত্রের প্রথম দফা হচ্ছে সুদী ব্যবসায়। এ ব্যবসার মাধ্যমে তাঁরা মাবনজাতির রক্ত শোষণ করে ইয়াহুদী পরিচালত সুদভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে চলেছেন।
ইসলামের বিবেচনায় নিরেট বৈজ্ঞানিক তথ্য এ তার বাস্তব প্রয়োগ বাদ দিয়ে আমরা দু’ধরনের সংস্কৃতির সন্ধান পাই। একটি হচ্ছে, ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের উপর গড়ে উঠা ইসলামী সংস্কৃতি। অপরটি হচ্ছে জাহেলী সংস্কৃতি। বিভিন্ন ধরনের জীবনযাত্রার ভিতর দিয়ে জাহেলী সংস্কৃতি আত্মপ্রকাশ করে। তবে জাহেলিয়াতের রচিত সকল জীবনযাত্রা প্রণালীই মতবাদগুলোকে আল্লাহ প্রদত্ত মানদণ্ডের ভিত্তিতে যাচাই না করেই গ্রহণ করে নেয়। ইসলামী সংস্কৃতি মানুষের সকল প্রকার চিন্তা ও কর্মপদ্ধতিকেই প্রভাবান্বিত করে এবং সংস্কৃতির কর্মতৎপরতাকে গতিশীল ও বৈশিষ্ট্যময় করে তোলার উপযোগী সূত্র ও কর্মপদ্ধতি দান করে।
ইউরোপের পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান
একথা স্মরণ রাখা দরকার যে, আধুনিক ইউরোপের শিল্প-কৃষ্টির জীবনীশক্তি হচ্ছে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা পদ্ধতি। আর এ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পদ্ধতিটি ইউরোপের আবিস্কার নয়। এ পদ্ধতিটি স্পেন ও প্রাচ্যের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই জন্ম নিয়েছিল। সৃষ্ট জগত, প্রাকৃতিক আইন-কানুন এবং সৃষ্ট-জগতে লুক্কায়িত অসংখ্য শক্তি ও সম্পদ সম্পর্কে ইসলামে স্পষ্ট ভাষায় ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে এবং এ ইঙ্গিতই মুসলমানদেরকে সৃষ্ট জগত সম্পর্কে গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর জন্যে উৎসাহিত করেছে। পরবর্তীকালে ইউরোপ মুসলমানদের প্রদর্শিত পথ ধরেই বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি বিশেষ আন্দোলন শুরু করে দেয় এবং ক্রমে ক্রমে উন্নতির শীর্ষদেশে পৌছে যায়। এদিকে মুসলিম বিশ্ব ইসলাম থেকে দুরে সরে যেতে শুরু এবং এর ফলে তাদের সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা প্রথমত স্থবির এবং পরে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। এ নিষ্ক্রিয়য়তার মূলে অনেকগুলো কারণের একটা ছিল তৎকালীন ইসলামী সমাজের আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং অপরটি ছিল মুসলিম জাহানের উপর পুনঃ পুনঃ খৃস্টান ও ইযাহুদীদের সশস্ত্র আক্রমন। ইউরোপ ইসলামী দুনিয়া থেকে বৈজ্ঞানিক গবেষাণার পদ্ধতি শিক্ষা করে ইসলামের সাথে এ পদ্ধতির সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পরবর্তীকালে তারা গীর্জার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কারণ গীর্জা আল্লাহর শাসন ব্যবস্থার নাম নিয়ে সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতন চালাচ্ছিল। গীজার বিরোধীতা করার সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ইসলামী পদ্ধতিটিও পরিত্যাগ করে। ফলে ইউরোপে চিন্তা-গবেষণার ইসলামী পদ্ধতিটিও পরিত্যাগ করে। ফলে ইউরোপে চিন্তা-গবেষণার ধারা জাহেলিয়াতের পথ ঘরে অগ্রসর হয়ে এবং তা প্রকৃতিগত দিক থেকে ইসলামী ধ্যান-ধারণা থেকে সম্পূর্ণরূপে শুধূ বিচ্ছিন্নই হয়নি উপরন্তু ইসলাম বিরোধী খাতে প্রবাহিত হয়। এ জন্যে একজন মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে ইসলামী ধ্যান-ধারণা ও আকীদা-বিশ্বাসকে নিজের সকল চিন্তা-গবেষণা ও তৎপরতার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা। নিজের জ্ঞান ও যোগ্যতা যথেষ্ট পরিমাণে পাকা-পোক্ত হলে নিজে নিজেই ইসলামী দৃষ্টিভংগীতে চিন্তা-ভাবনা শুরু করবে অথবা কোন আল্লাহভীরু নির্ভরযোগ্য জ্ঞানী ব্যক্তির নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে।
‘যেখানে থেকেই পার, জ্ঞানার্জন কর’— এ নীতি বাক্য ইসলামের দৃষ্টিতে সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ঈমান, জীবনযাত্রা প্রণালী, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ, অভ্যাস ও রীতিনীতি এবং মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ঘটিত বিষয়ে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য যত্রযত্র ছুটাছুটি করলে চলবে না।
অবশ্যই ইসলাম রসায়ন শাস্ত্র, পদার্থ বিজ্ঞান, জ্যোতিষ বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, কারিগরী বিদ্যা, কৃষি বিদ্যা, প্রশাসন পরিচলনা ও অনুরূপ ধরনের যাবতীয় প্রকৌশল বিষয়ক জ্ঞানার্জন করার জন্য আল্লাহভীরু ও নির্ভরযোগ্য মুসলিম শিক্ষক না পেলে অমুসলিম অথবা আল্লাহর নাফরমান মুসলমানের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণের অনুমতি দেয়। মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা দুঃখজনক। তাদের অনেকে নিজের দ্বীন ও জীবন বিধান থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন। তাঁরা ভূলে গেছেন যে, ইসলাম তাঁদেরকে আল্লাহর যমীনে খলিফা নিযুক্ত করেছেন এবং খেলাফতের দায়িত্ব পালনের জন্যে তাদেরকে সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের দক্ষতা অর্জন এবং নিজেদের কর্মক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য তাগিদ করেছেন। তাই বর্তমান অবস্থায় নিছক কারিগরী ও প্রকৌশল বিষয়ে অমুসলিম পণ্ডিতদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জনের অনুমতি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু আকীদা-বিশ্বাসের মূলতত্ত্ব, জীবন সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণার ভিত্তি, কুরআনের তাফসীর, হাদীস, সীরাতুন্নবীর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ, ইতিহাসের দর্শন, মানবীয় কর্মতৎপরতার দার্শনিক পর্যালোচনা, সামাজিক রীতিনীতি, সরকার গঠনের উপায় পন্থা, রাজনীতির মৌলিক সূত্র ইত্যাদি বিষয় কোন অমুসলমান অথবা মুসলমান নামধারী আল্লাহর নাফরমান ব্যক্তির নিকট থেকে জ্ঞান শিক্ষা করার অনুমতি ইসলামে নেই।
আপনাদের নিকট উপরোক্ত বিষয়ে বক্তব্য পেশ করার আগে আমি চল্লিশ বছর কাল পর্যন্ত বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষের চিন্তা-গবেষণার ফলাফল জানতে চেষ্টা করেছি। যেসব বিষয়ের প্রতি আমার বিশেষ আকর্ষণ ছিল সেসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের চিন্তা-গবেষণা করেছি। তারপর আমি আমার ঈমানের উৎস মূলের দিকে মনোযোগী হই এবং আশ্চর্যান্বিত হয়ে লক্ষ্য করি যে, ইতিপূর্বে যা কিছু শিক্ষা লাভ করেছি তা অতি তুচ্ছ। তবে আমার জীবনের চল্লিশটি বছর এসব জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় কাটিয়ে দেয়ার জন্যে আমার কোন দুঃখ নেই। কারণ ঐ সময়ে আমি জাহেলিয়াতের প্রকৃতি, তার বিভ্রান্তি, তার পথচ্যুতি ও তার অজ্ঞতা সম্পর্কে অবগত হবার সুযোগ পেয়েছি এবং সাথে সাথে তার তর্জন-গর্জন ও হাঁক-ডাকের আড়ালে চাপা অন্তসারশূন্যতা পরিস্কারভাবে দেখতে পেয়েছি। আমি ঐ সময়ই ভালভাবে উপলব্ধি করেছি যে, মুসলমান জ্ঞান অর্জনের জন্যে কখনো ঐশী উৎসের পাশাপাশি জাহেলিয়াতের উৎসকে গ্রহণ করতে পারে না।
তবু এটা শুধু আমার ব্যক্তিগত মতামত নয়। কেননা বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এ ধরনের গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যক্তি বিশেষ বা কয়েকজনের ব্যক্তিগত অভিমত সন্বল করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না। বিশেষত যে ক্ষেত্রে স্বয়ং আল্লাহ তাআলারই নির্ধারিত মানদণ্ড রয়েছে, সে ক্ষেত্রে কয়েকজন মুসলমানের মতামতকে প্রাধান্য দান করার প্রশ্নই ওঠে না। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর প্রিয় নবী (সা)আমাদের যে নির্দেশ দিয়েছেন,তদনুসারেই আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সকল বিতর্কমূলক বিষয়ে আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশের প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রতিটি মুসলমানেরই কর্তব্য। সে কর্তব্য স্মরণ করেই আমরা আল্লাহ ও রাসূল এ বিয়য়ে কি বলেন, তা খুঁজে দেখবো। মুসলমানেদর বিরুদ্ধে ইয়াহুদী ও নাসারাদের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন—
——————————————————————————————
“আহলে কিতাবদের বেশী সংখ্যক লোকই তোমাদেরকে ঈমানের পথ থেকে পুরবায় কুফরীর পথে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়। তাদের নিকট সত্য উদঘাটিত হবার পরও তারা শুধু ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে এরূপ করছে। তুমি তাদেরকে ক্ষমা করে দাও যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহ তাআলা তাদের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান।”
——————————————————————————————–
“যতক্ষণ তোমরা ইয়াহুদী ও নাসারাদের মধ্যে শামিল না হয়ে যাবে, ততক্ষণ তারা কখনো তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবে না। বলে দাও যে, আল্লাহ তাআলার হেদায়াতই একমাত্র হেদায়াত। যদি তোমাদের নিকট জ্ঞান এসে যাবার পরও তোমরা তাদেরই কথামত চল, তাহলে আল্লাহর শাস্তি থেকে তোমাদেরকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।”
— আল বাকারা: ১২০
——————————————————————————————-
“হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে কোন উপদলের অনুসরণ কর, তাহলে তারা তোমাদেরকে কুফরী জীবন বিধানের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।” — আলে ইমরান:১১০
হাফিজ আবুল আলী হযরত জাবের (রা), হাম্মাদ ও শাবীর পরিবেশিত রাসূলুল্লাহ (সা) –এর যে উক্তি উদ্ধৃত করেছেন তা নিম্নরূপ —
——————————————————————————————
“কোন বিষয়ে আহলে কিতাবদেরকে কিছু জিজ্ঞেষ করো না। তারা কখনো তোমাকে ভাল পথ দেখাবে না। কারণ, তারা নিজেরাই পথভ্রষ্ট। তাদের প্রভাবে তুমি হয় কোন মিথ্যাকে সত্য বা সত্যকে মিথ্যা হিসেবে মেনে নিবে। আল্লাহর কসম! যদি মূসা (আ) –ও আজ জীবিত থাকতেন তাহলে তাঁর জন্যেও আমার অনুসরণ ছাড়া অন্য পথ জায়েয হতো না।”
আল্লাহ তাআলা স্বয়ং ইয়াহুদী ও নাসারাদের দুরসভিসন্ধি সম্পর্কে মুসলমানদেরকে সতর্ক করে দেয়ার পরও যদি আমরা বিশ্বাস করি যে, তারা ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে আমাদের সঠিক শিক্ষাদান করবে, তাহলে সেটা হবে চরম নির্বুদ্ধিতা। কারণ, আমরা তাহলে ইয়াহুদী ও খৃস্টানদেরকে আমাদের শুভাকাংখী ও কল্যাণকামী অথবা সত্যানুসন্ধিৎসু বিবেচনা করি বলে মনে হবে। অথচ আল্লাহ তাআলা তাদের স্বরূপ প্রকাশ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এরূপ প্রকাশ্য ঘোষণার পরও যদি আমরা তাদের সম্পর্কে এরূপ ধারণা পোষণ করি, তাহলে তা আমাদের বুদ্ধি ও দুরদর্শিতার চরম অভাবেরই প্রমাণ হবে মাত্র।
স্বয়ং আল্লাহ তাআলা বলেছেন— ——————————— (বল, হে নবী! আল্লাহর হেদায়াতই প্রকৃত হেদায়াত)। এ ঘোষণার মাধ্যমে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, মুসলমান তার সকল বিষয়-আশয়ে একমাত্র আল্লাহ তাআলার দেয়া জ্ঞানের উপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। অন্যথায় পথচ্যুতি ছাড়া সঠিক জ্ঞান অন্যত্র কোথাও নেই। তাই অন্য উৎস থেকে সুপথের সন্ধান প্রাপ্তির কোনই আশা নেই। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহর হেদায়াতের বাইরে যা আছে সবকিছুই ভ্রান্ত ও মন্দ সাব্যস্ত হয়ে যায়। এ আয়াতের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট এবং অন্য কোন অর্থ করা যায় না।
কুরআনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, যারা আল্লাহর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং পার্থিব স্বার্থই যাদের লক্ষ্য, তাদের সাথে মুসলমানদের কোনই সম্পর্ক রাখা চলবে না। এ জাতীয় লোকদের স্বরূপ উদঘাটন করে কুরআন বলছে যে, তারা শুধু অনুমান সন্বল করেই চলে। তাদের নিকট কোন জ্ঞান নেই বলেও কুরআন ঘোষণা করেছে —
——————————————————————————————-
“যে ব্যক্তি আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এবং পার্থিব দুনিয়া ছাড়া যার অন্য কোন লক্ষ্য নেই, তাকে কোন গুরুত্ব প্রদান করো না। এ জাতীয় লোকদের জ্ঞানের সীমা ঐ পর্যন্তই। কে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে এবং কে হেদায়াতপ্রাপ্ত তা আল্লাহ তাআলা ভালভাবেই জানেন।”
——————————————————————————————-
“তারা শুধু পার্থিব দুনিয়ার প্রকাশ্য বিষয় সম্পর্কেই অবগত এবং আখেরাত সম্পর্কে তারা অজ্ঞ।” — আর রুম:৭
এসব বাহ্যদর্শী, প্রকাশ্য বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপকারী ও প্রকৃত জ্ঞান থেকে বঞ্চিত ব্যক্তিগণ আল্লাহর যিক্র থেকে উদাসীন এবং পার্থিব জীবনের অস্থায়ী স্বার্থের লিপ্সায় মগ্ন। বর্তমান যুগের সকল বৈজ্ঞানিক ও বিশেষজ্ঞদের অবস্থাই এরূপ। তারা যে জ্ঞান অর্জন করেছে সে জ্ঞানের উপর কোন মুসলমানই নিষ্ঠা সহকারে নির্ভরশীল হতে পারে না এবং বিনা দ্বিধায় তাদের নিকট থেকে শুধু কারিগরী বিদ্যা ছাড়া অন্য বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা যায় না। মানব জীবন সম্পর্কিত আকীদা-বিশ্বাস ও সৃষ্টি রহস্য বিষয়ে তাদের প্রতি আস্থাশীল হওয়অ কোন মুসলামানের জন্য বৈধ নয়। কুরআন পুনঃ পুনঃ যে জ্ঞানের প্রশংসা করছে, সে জ্ঞান এটা নয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন —
—————————————————
“জ্ঞানী ও অজ্ঞান ব্যক্তি কি সমান হতে পারে? — আয যুমার:৯
পূর্বাপর যোগাযোগ বিছিন্ন করে দিয়ে যারা এ আয়াতের ব্যাখ্যা করে তারা ভ্রান্ত!জ্ঞান সম্পর্কে পরিস্কার সীমারেখার সন্ধান পাওয়া যায় নিম্নর আয়াতে—
——————————————————————————————-
“(উপরোল্লিখিত নাফরমানদের চাল-চলন উত্তম অথবা) যে ব্যক্তি অনুগত হয়ে রাত্রিকালে দণ্ডায়মান থাকে, সিজদা করে, আখরাতের ভয়ে ভীত থাকে এবং আল্লাহর রহমতের আশা পোষণ করে? তাদের জিজ্ঞেস কর, যে জানে এবং যে কিছুই জানে না তারা কি কখনো সমান হেত পারে? বুদ্ধিমান ব্যক্তিগণই নসিহত কবুল করে থাকেন।” — আয যুমার: ৯
রাতের অন্ধকারে যারা আল্লাহ তাআলার দরবারে মস্তক নত করে দণ্ডায়মান অবস্থায় অথবা সিজদায় নিজের রবের সমীপে কাকুতি-মিনতি করে এবং আখেরাতের ভয়ে যাদের অন্তর কম্পিত হয়, তারাই হচ্ছে ঐসব ভাগ্যবান ব্যক্তি যারা জ্ঞান-সম্পদে সমৃদ্ধ। কুরআনের আয়াতে এ জ্ঞানকেই সত্যিকার জ্ঞান আখ্যা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যে জ্ঞান মানুষকে আল্লাহর সন্ধান দেয়, যে জ্ঞান মানুষের অন্তরে আল্লাহভীতি ও সরলতা জন্মায়, সে জ্ঞানই প্রকৃত জ্ঞান। আর যে বিদ্যা মানুষের প্রকৃতিকে বিকৃত করে দেয় এবং তাকে নাস্তিকতাও গুমরাহীর বক্র পথে টেনে নিয়ে যায়, সে বিদ্যা কখনো জ্ঞান নামে আখ্যায়িত হতে পারে না।
জ্ঞানের পরিধি শুধুমাত্র আকীদা-বিশ্বাস, দ্বীনি কর্তব্য এবং শরীয়াতের জ্ঞান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়। বরং জ্ঞানের পরিধি আরও অনেক বিস্তৃত। আকীদা-বিশ্বাস, দ্বীনি কর্তব্য ও শরীয়াতের সাথে জ্ঞানের যে পরিমাণ সম্পর্ক ঠিক সে পরিমাণ সম্পর্ক রয়েছে প্রাকৃতিক আইন এবং দুনিয়ার উপর মানুষের খিলাফত প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা সম্পর্কিত সকল বিষয়ে।
যে জ্ঞানের উৎসমূলে ঈমান নেই — কুরআনের সংজ্ঞা অসুসারে সে জ্ঞান কুরআনের প্রশংসিত জ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত নয়। যে জ্ঞানের অধিকারীগণ ঈমানের সম্পদ থেকে বঞ্চিত তারা কুরআনের দৃষ্টিতে মোটেই জ্ঞানীদের শ্রেণীভুক্ত নয়।
যেসব বিজ্ঞান সৃষ্টি জগত ও প্রাকৃতিক আইনের চর্চা করে (যথা জ্যোতিষ বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, পদার্থ বিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র এবং ভুতত্ত্ব) সেগুলোর সাথে অস্তিত্ব সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস সৃষ্টি করে। অবশ্য যাদের চিন্তাধারা বিকৃত হয়ে গেছে, এসব বিদ্যা তাদের আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কিত ধারণা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। ইউরোপেই প্রথম এ জাতীয় দুঃখজনক মনোভাবের জন্ম হয়। সে দেশের ইতিহাসে এক সময় বিজ্ঞানী ও অত্যাচারী ধর্মযাজকদের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ দেখা দেয় এবং এ বিরোধিতার ফল স্বরূপ ইউরোপে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পুরো আন্দোলনটি আল্লাহ বিরোধী মনোভাব নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এ আন্দোলন ইউরোপীয় জীবনযাত্রার সকল দিক ও বিভাগের উপর সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। আর এর পরিণতি স্বরূপ ইউরোপীয় চিন্তাধারার গতি পরিবর্তিত হয়। তাই শত্রুতা ও বিরোধিতা বিজ্ঞান ও ইউরোপীয় গীজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান সামগ্রিকভাবেই সকল ধর্মের প্রতি বিরূপ ভাবাপন্ন হয়ে উঠে এবং ইউরোপ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে চিন্তা ও গবেষণার সাহায্য যত সম্পদ সংগ্রহ করেছে, সবই ধর্মদ্রোহিতার পথে অগ্রসর করেছে। অদিবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র, কারিগরি –বিজ্ঞান ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই একই অবস্থা।
পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ও বিজ্ঞান এভাবেই ধর্মের প্রতি ঘৃণা বিশেষত ইসলামের প্রতি অধিকতর শক্রতামূলক মনোভাবের বিষাক্ত প্রভাব নিয়ে গড়ে ওঠে। এ আলোচনার পর ইসলামের প্রতি পাশ্চাত্য জগতের তীব্র ঘৃণা ও বিরোধের কারণ উপলব্ধি করা কঠিন কাজ নয়। তাদের পক্ষ থেকেই পরিকল্পিত উপায়ে ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য প্রচারণা চালানো হয়। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসকে দুর্বল করে দেয়া পরবর্তী পর্যায়ে ইসলামী সমাজের গোটা কাঠামোটির ধ্বংস সাধনই এরূপ প্রচারণার উদ্দেশ্য।
এসব বিষয় অবগত হবার পরও যদি আমরা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও শিক্ষাদানের ব্যাপারে পাশ্চাত্য চিন্তাধারার উপর নির্ভর করি; তাহলে সেটা হবে আমাদের ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। অবশ্য নিছক কারিগরি বিজ্ঞান শিক্ষা করার জন্য বর্তমান সময়ে আমাদের পাশ্চাত্য জ্ঞানের দ্বারস্থ না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু তবুও এসব বিদ্যা শিক্ষাকালে আমাদের সতর্কতার সহিত কাল্পনিক ও দার্শনিক তথ্যাবলী পরিহার করতে হবে। কারণ, পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের দর্শন ও কল্পনা ইসলামের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতা থেকে জন্ম নিয়েছে। তাই তাদের প্রভাবে ইসলামী জীবনাদর্শের পবিত্র প্রস্রবণটি ঘোলাটে হয়ে যাওয়ার আশাংকা রয়েছে।